আড়ংধোলাই
এখান থেকে যখন ফিরে যাব তখন ঈশ্বর আমাকে নিশ্চয় জিগ্যেস করবেন, বাপু হে, অভিজ্ঞতাটা কেমন হল? তখন আমাকে বলতেই হবে, ‘পিতা, সে এক জবরদস্ত ব্যাপার।’ আড়ংধোলাই জিনিসটা কী তা তাঁতের কাপড়ই জানে; তবে আমারও কিছু জানা হল। পাটপাট কাপড়। সেই কাপড়ে মাড় দিয়ে কাঠের মুগুর দিয়ে পেটানো। যত পেটায় তত জেল্লা খোলে সুতোর। পরতে পরতে মাড় ঢুকে যায়। শুকোবার পর টাইট এক পিস কার্ডবোর্ড। এইবার সেই কাপড় যিনি পরবেন, তিনি বুঝবেন কী জিনিস! এক এক পরত খুলতে জীবন বেরিয়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করলেই ছিঁড়ে ফর্দাফাই। সেই কাপড় পরার পর পেখম মেলা ময়ূরের মতো দেখাবে। আগে চলে কোঁচা পিছে চলে নর। কোঁচার খোঁচায় চোখ চলে যেতে পারে। সংসারে আমার এই অভিজ্ঞতা হল। জীবন নামক বসনে দু:খসুখের মাড় তারপর নানা হাতের পেটাই। তারপর আড়ষ্ঠ একখণ্ড কাঠ। হাত পা ছেতরে গেল। চোখে একটা ভ্যালভ্যালে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। দেহের জেল্লা বাড়ল না বটে, মনের জেল্লা নিশ্চয়ই বাড়ল। কারণ মরার সময় মনেই হল না যে, চিরবিদায়!
পড়ে রইল আমার আম কাঠের জাম্বোজি খাট। সেই খাটে পেতে ছিলাম বোনাসের টাকায় তৈরি ছোবড়ার গদি। এ বস্তু একমাত্র ভারতেই ভাবা যায়। ভেতরে আড়াই মণ ছোবাড়ার পাউডার। কত বড় দর্শন, নীরবে পড়ে থাকে আমাদের দেহের তলায়। একদিন তুমি যা হবে, এ বস্তু হল তাই। সংসার তোমার শাঁস আর জলটি খেয়ে নেবে, তারপর সবাই মিলে তোমার আঁশ ছাড়াবে, তারপর তুমি শুকনো মালাটি হয়ে স্বর্গারোহণ করবে। পড়ে থাকবে তোমার ওই লীলাভূমি। টিকিনের খোল। বেরিয়ে আছে ছোবড়ার হুল জায়গায় জায়গায়। তার ওপর একটি তোষক। তুলো আর ফুলো নেই, দেহের চাপে চাটুর মতো হয়ে গেছে। তপ্ত কটাহ একেই বলে। জীবন রঙ্গমঞ্চও বলা চলে। ফুলশয্যা থেকে মৃত্যুশয্যা।
এই ছোবড়ার গদি তৈরি এক শীতের দুপুরে। তখনই বোঝা গিয়েছিল নতুন একটা সংসারের পত্তন হচ্ছে। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। যদিদং হৃদয়ং হয়ে গেছে। ওঁ প্রজপতয়ে নম: দিয়ে শুরু হয়েছে। মাঝে-মাঝে এক একটা হিন্দিগান এত অর্থবহ হয়ে ওঠে। দৃশ্যও। ফাঁকা মাঠ। এপাশে একটা বাঁশ, ওপাশে একটা বাঁশ। টানটান দড়ি দিয়ে বাঁধা। দড়ির ওপর হেমা মালিনী ব্যালেনস করে আছেন, নীচে ধর্মেন্দ্র নেচে নেচে গাইছেন—আহা, আহা খেল, শুরু হো গিয়া, আহা আহা, খেল শুরু হো গিয়া।
কী, কী, অবিচ্ছেদ্য। হাঁড়ি ও সরা। জুতো ও শুকতলা। গোলাপ ও কাঁটা। গাড়ি ও চাকা। চাল আর কাঁকর। নেতা ও বক্তৃতা। শিল্প ও ধর্মঘট। বাংলা ও বাংলাবন্ধ। হনুমান ও লেজ। কুকুর ও ঘেউ। ম্যাও আর মিউ। স্ত্রী ও তিরস্কার। গাড়ি ও হর্ন। বিদ্যুৎ ও অন্ধকার। মন্দির ও পাণ্ডা। পুজো আর চাঁদা। উৎসব ও মাইক। মাংস আর পেঁয়াজ। মাথা আর মাথাধরা। আকাশ ও তারা। আঙুল আর নখ। স্বামী আর স্ত্রী। খাট আর ছোবড়ার গদি।
একটা জবরদস্ত কম্বিনেশান। একেবারে মাপে মাপে খাটে চাপিয়ে দেওয়া হল তিন মনী এক কৈলাস। ধুনুরি লাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে বলে গেল, ‘এ বাবু শুতে শুতে সমান হয়ে যাবে। মোটা কেউ নেই? এক জোড়া শুইয়ে রাখবেন এক মাস। একেবারে প্লেন, ফাসক্লাস।’ মোটা আর পাই কোথায়। নিজেই চেষ্টা করলুম মোটা হওয়ার। হাজারপাঁচেক গলে গেল অকারণে। এক আউন্স ফ্যাট লাগল না শরীরে। নিউট্রিশান স্পেসালিস্ট বললেন, ‘আপনার আড়াটাই ওই রকম। বংশগতির ধারা। আপনার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সকলেই মনে হয় খেতে পেতেন না। এ হল গিয়ে না-খাওয়ার, মানে না-খেতে পাওয়ার ট্রাডিশান।’ জবরদস্ত চেহারা আসে জবরদস্ত অতীত থেকে। একজন বললেন, ডন বৈঠক মারো আর আলো চালের ফ্যান খাও, এক চিমটে বিট নুন আর লেবু দিয়ে। তাড়াতাড়ি মোটা হওয়ার জন্যে কোঁত পেড়ে পেড়ে পঁচিশটা ডন, পঞ্চাশটা বৈঠক। এক জামবাটি আলোচালের ফ্যান। তিন দিনেই স্কেলিট্যান। পেট ছেড়ে পটল তোলার জোগাড়। শুনলুম বিয়ার খেলে মোটা হয়। হয়ে গেল জন্ডিস। জবরদস্ত ছোবড়ার ড্যালা পাকানো গদিতে কেটে গেল জীবন। ট্রাম, বাস, আর ট্রেন থেকে ছারপোকার বাচ্চা এনে ছেড়ে ছিলুম। বেশ ভালোই চাষ হয়েছিল। মানুষের কথায় হুল আর ছারপোকার হুল। একটা মনে আর একটা দেহে। এমন ‘ডাবল আকুপাংচার’ চিনারাও দিতে পারবে না।
হোল ফ্যামিলির হাতে জবরদস্ত পেটাই হয়ে মনে প্রানে মোক্ষলাভ করে, এখন চলেছি মহাপ্রস্থানে। পৃথিবীটা যে ঈশ্বরের ডাইং-ক্লিনিং তা জানা হয়ে গেল। ওপরে মনে হয় এইভাবেই বলাবলি চলে, ‘ওরে ডেট হয়ে গেছে। ডেলিভারি নিয়ে আয়। আড়ং ধোলাই হয়ে গেছে।’