আঠারো শতকের সাহেব বিবি গোলাম
১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দ থেকেই ইংরেজরা পাকাপোক্তভাবে কলকাতায় বাস করতে থাকে। দশ বছরের মধ্যেই তাদের সংখ্যা, হাজারের ওপরে গিয়ে পৌঁছায়। একজন সমসাময়িক বণিক আলেকজাণ্ডার হ্যামিলটন লিখে গেছেন যে ১৭১০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় ১২০০ ইংরেজ বাসিন্দা ছিল। লঙ সাহেব বলেছেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে কলকাতায় ইংরেজ বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল ৪০০০। কিন্তু তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০ জন। সুতরাং যে সমাজে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কম থাকে, সে সমাজে যা ঘটে, ইংরেজদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। অধিকাংশ ইংরেজই তাদের যৌনক্ষুধা মেটাতো এদেশী মেয়েদের মাধ্যমে। এ সম্বন্ধে পর্তুগীজ ফিরিঙ্গি মেয়েরাও সহায়ক ছিল। এরকম পর্তুগীজ মেয়েদের আড়ত ছিল ব্যাণ্ডেলে। তবে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে সাহেবরা এদেশী মেয়েদেরই বেশি পছন্দ করত। এরূপ মেয়েদের সাহেবরা ‘বিবিজান’ বলত। কলকাতায় বিলাতী মেয়েদের দুষ্প্রাপ্যতা হেতু বিলাত থেকে ক’জন অবিবাহিতা মেয়ে জাহাজে করে কলকাতায় এল, তার খবর অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের সংবাদ পত্র সমূহে নিয়মিত প্রকাশিত হত। তবে যারা আসত তারা সাধারণত উচ্চপরিবারের মেয়ে নয়, নিম্নবিত্ত পরিবারের ভাগ্যান্বেষী মেয়ের দল। বিলাতে বসে তারা শুনত এদেশে যে সব ইংরেজ আছে, তারা এক এক জন ‘নবাব’ বিশেষ। সেই আকর্ষণেই তারা বিলাত থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি মারত—যদিও তখন বিলাত থেকে কলকাতায় আসবার জাহাজভাড়া ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এখানে এসে তথাকথিত কোন ‘মাসীমার’ বাড়ি উঠত এবং পরবর্তী রবিবার সকালে গির্জাঘরে প্রার্থনার সময় কোন অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ের কাজটা সমাধা করত।
ক্লাইভের আমলে সাধারণ ‘রাইটারদের মাহিনা পাঁচ পাউণ্ড, আর সিনিয়র মার্চেন্ট’দের ৪০ পাউণ্ড। কিন্তু জ্বরে কি করে, পিলেয় মেরে দিত। গোপন ব্যবসায়, উৎকোচ ও উপঢৌকন এবং নানারূপ অবৈধ উপায়ে তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। সে জন্য তারা এদেশের নবাবদের মতো বিলাসময় জীবন যাপন করতে পারত। সাহেবরা এভাবেই কলকাতাকে ভোগবিলাসের লীলাকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। এসব সাহেব- নবাবের ঘরণী হবার আকাळাতেই বিলাতের নিম্নবিত্ত সমাজের মেয়েরা কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি মারত। মেয়েছেলে নিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহেবদের মধ্যে প্রায়ই লড়াই হত। একে ‘ডুয়েল’ বলা হত। বর্তমান ঘোড়দৌড়ের মাঠের কাছে দুটো গাছ ছিল। ওই গাছ দু’টোর তলাতেই ‘ডুয়েল’ লড়া হত। সে জন্য ওই গাছ দুটোকে “Trees of destruction’ বলা হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহেবদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার একটা মনোরম বিবরণ পাই ১৭৭৯ খ্রীষ্টাব্দে, কলকাতা থেকে এক মহিলা বিলাতে তার বান্ধবীকে যে চিঠি লিখেছিল তাতে। ওই পত্রে ওই মহিলা লিখেছিল— সকাল সাতটার সময় সাহেবের দারওয়ান ফটক খুলে দিলে সরকার, পিয়ন, হরকরা, ছাবদার, হুঁকাদার খানসামা, কেরাণী প্রভৃতি সাহেবের কর্মচারীরা ভিতরে ঢুকে সামনের বারান্দায় জড় হয়। আটটার সময় জমাদার সাহেবের শোবার ঘরে যায়। সাহেবের পাশে যে এদেশী মহিলাটি শুয়ে থাকে, সে তখন ভিতরের এক দরজা দিয়ে নিচে নেমে যায় নিজের ঘরে। সাহেব শয্যা ত্যাগ করলেই তার ভৃত্যবৃন্দ ঘরে ঢুকে তাঁকে তিনবার সেলাম দিয়ে অভিবাদন জানায়। আধঘণ্টা লাগে সাহেবের পোষাক পরিচ্ছদ পরিবর্তন করিয়ে দিতে। তারপর নাপিত এসে সাহেবকে কামিয়ে দেয়, তার নখ কেটে দেয় ও কান পরিষ্কার করে দেয়। তারপর জল দিয়ে সাহেবের হাত পা ধুইয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের খানসামা প্রাতরাশ নিয়ে এসে হাজির করে। প্রাতরাশ শেষ হলে, পিছন থেকে সাহেবের হেয়ার-ড্রেসার সাহেবের মাথা আঁচড়ে দেয় ও সামনে হুঁকাবরদার হুঁকার নলটা এগিয়ে দেয়। তারপর সাহেবের বেনিয়ান এসে হাজির হয়। তাদের সঙ্গে কাজ সেরে, সাহেব পালকিতে গিয়ে আরোহণ করে। সাহেবের পালকির সামনে দশ বারো জন ছাবদার, হরকরা, পিয়ন প্রভৃতি ছুটতে ছুটতে যায়। বাইরের সমস্ত কাজকর্ম সেরে সাহেব মধ্যাহ্ন ভোজনের আগেই বাড়িতে ফেরে। দু’টার সময় মধ্যাহ্ন ভোজন হয়। বেলা চারটে নাগাদ সাহেব নিদ্রা যায় ও সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত নিদ্রায় মগ্ন থাকে। ঘুম থেকে উঠে সাহেব চা খায় ও তামাক পান করে। তারপর উৎকৃষ্ট পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে সাহেব পরিচিত মহলে মেয়েদের আনুষ্ঠানিক দর্শন দিতে যায়, রাত্রি দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে সান্ধ্য ভোজ করে। এই করতে করতেই রাত্রি বারোটা বেজে যায়। তারপর সাহেব শয়নকক্ষে প্রবেশ করে।
.
সস্তাগণ্ডার দিন ছিল বলে সাহেবরা গাণ্ডেপিণ্ডে খেত। সাহেবরা দিনে তিনবার খেত। সকালবেলা প্রাতরাশ। যার যা খুশি তাই খেত এবং পরিমাণের হিসাব থাকত না।
তারপর দু’টার সময় মধ্যাহ্ন ভোজন। মধ্যাহ্ণ ভোজনে যত পারত খেত ঝলসানো ও কষা মাংসের পদ। তাছাড়া ছিল মুরগী ও হাঁসের মাংস, নানারকম শাক-সব্জি, আলু ইত্যাদি। এছাড়া ছিল মদ্যপানের ধুম। ‘হার্টলে হাউস’-এ বলা হয়েছে—‘মদই ছিল পরিবারের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জিনিস। প্রতি মেয়েছেলে দিনে এক বোতল ও পুরুষরা চার বোতল মদ খেত। সে-যুগে বিলাতী মদের দাম পাঁচ টাকা বোতল ছিল। সান্ধ্যভোজনেও রীতিমত চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় সবই থাকত। সাহেবরা যেমন অত্যধিক মদ খেত, তেমনই তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল অত্যধিক পরিমাণে ব্যভিচার ও রক্ষিতা রাখার ব্যাপার। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের এক সংবাদপত্রে বলা হয়েছে ‘যদি গরমের হাত থেকে বাঁচতে চাও, তা হলে কাছে রক্ষিতা রেখে দেবে।’ তবে সে-যুগের সাহেবী সমাজে ইওরোপীয় রক্ষিতা রাখা দূষনীয় ছিল। কিন্তু এদেশীয় রক্ষিতা রাখা দুষণীয় ছিল না। নিজেদের ব্যভিচার প্রকৃতি চরিতার্থ করবার অসুবিধা দেখলে সে-যুগের সাহেবরা সাধারণতঃ ডাক্তারকে ঘুষ দিয়ে স্ত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে ডাক্তারকে দিয়ে স্বাস্থ্যের কারণে স্ত্রীকে বিলাতে পাঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ সংগ্রহ করত।
কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর ইংরেজরা দুটো জিনিস রপ্ত করে নিয়েছিল। একটা পালকি চাপা ও আর একটা হুঁকোয় তামাক খাওয়া। হুঁকোয় তামাক খাবার নেশায় সাহেবরা মশগুল হয়ে উঠেছিল। শুধু যে সাহেবরাই তামাক খেত, তা নয়। মেমসাহেবরাও এর বেশ অনুরক্ত ছিল। আর পালকিতে চড়া সম্বন্ধে সাহেব ও মেমদের মধ্যে দুই ভিন্ন পদ্ধতি ছিল। সাহেবদের ক্ষেত্রে পালকি-বাহকরা পালকিটাকে খানিকটা নিচু করে ধরত, আর সাহেব পালকির দরজার দিকে পিছন হয়ে পাছাটা পালকির ভিতর ঢুকিয়ে দিত। তারপর পালকির ভিতর ঠিক হয়ে বসে নিত। মেয়েরা এ-প্রণালী অবলম্বন করত না। এতে শ্লীলতাহানির সম্ভাবনা থাকায়, তারা পালকির প্রবেশ পথের দিকে মুখ করে দাঁড়াত। পালকিবাহকরা পালকিটাকে একেবারে মাটির কাছাকাছি নিচু করে ধরত। এবং মেমসাহেব পরনের গাউনটা গুটিয়ে নিয়ে পালকির ভিতর ঢুকে পড়ত।