আট. বেদাঙ্গসূত্র প্রসঙ্গে

আট. বেদাঙ্গসূত্র প্রসঙ্গে

উপনিষদগুলি যেমন নিছক আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে বিচ্ছেদের যুগ সূচনা করে সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সঙ্গে নিশ্চিত পার্থক্য এবং পরবর্তী নূতন দার্শনিক সন্ধানের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তেমনই উপনিষদের উত্তরসূরী বেদাঙ্গগুলিও পূর্ববর্তী যুগের সমগ্র ধর্মীয় সাহিত্যের সঙ্গে অপর একটি বিপুল বিচ্ছেদ সূচনা করেছিল। উপনিষদগুলির মতো এই ছেদ সার্বিক নয়, কেননা অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। তবে বেদাঙ্গ— বা বিশিষ্ট আঙ্গিকের জন্য ‘সূত্র’রূপে অভিহিত— সাহিত্যধারার ক্ষেত্রে এই ছেদ অনেক বেশি মৌলিক, কারণ সূত্র-সাহিত্য অপৌরুষের নয়, মানুষের রচিত সাহিত্য-রূপেই এগুলি স্পষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছে। বেদাধ্যয়নে সহায়ক রচনারূপে বেদাঙ্গের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ষড়বিংশ ব্রাহ্মণে।

প্রধান বেদাঙ্গগুলি মোট ছয় ধরনের: ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত, শিক্ষা, জ্যোতিষ ও কল্প। কল্পসূত্রগুলি আবার চার ভাগে বিন্যস্ত: শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শুল্ক। বেদাঙ্গকে অবশ্য কার্যকর ভাবে আমরা দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করতে পারি: ১. ধর্মসংক্রান্ত— এর মধ্যে শ্রৌত, গৃহ্য ও ধর্মসূত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় এবং ২. পার্থিব— যার মধ্যে রয়েছে শুল্বসূত্র, শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ ও নিরুক্ত। এ ছাড়াও আমরা কয়েকটি সহায়ক রচনাধারার উল্লেখ করতে পারি— প্রায়শ্চিত্ত, পরিশিষ্ট, শ্রাদ্ধকল্প, ইত্যাদি।

রচনাকাল

সূত্রগুলির আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এই সাহিত্যের অধিকাংশ রচনাকে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত বলে নির্দেশ করে থাকেন। সূত্র রচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ গোষ্ঠীর নামের সঙ্গে ‘অয়ন’ এই অন্ত্য পদটি যুক্ত রয়েছে— যেমন আশ্বলায়ন, বৌধায়ন, ইত্যাদি। খ্রিস্টপূর্ব যুগের শেষ দুটি শতাব্দী এবং খ্রিস্টীয় প্রথম দুটি শতাব্দীকে বিদেশি প্রভাব আত্মীকরণের এবং এদের সঙ্গে আদিম জনগোষ্ঠীর ধর্মমতের সমন্বয় ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে নূতন ধর্মীয় আন্দোলন সৃষ্টি করার পক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়রূপে চিহ্নিত করা যায়।

তাই সূত্র-রচনার যুগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যে বুদ্ধপরবর্তী যুগে সূত্রধারার সাহিত্য রচিত হয়েছিল, সেই কালে যজ্ঞনিষ্ঠ ধর্ম কঠোর প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। রূঢ় আঘাতের ফলে বৈদিক ধর্মের প্রাচীন রূপ আর কখনও প্রাক্তন গৌরবে অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। এই যুগটি ছিল বহু বৈদেশিক আক্রমণেরও কাল; খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর থেকে উত্তর ভারত একাদিক্রমে শক, কুষাণ, হূন ও অন্যান্য গোষ্ঠী দ্বারা বহুবার আক্রান্ত হয়েছিল। এই যুগে উত্তর ভারতে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য মৌর্য বংশের অভ্যুত্থান ঘটে। প্রকৃতপক্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ সময়েই আমরা প্রাগৈতিহাসিক স্তর অতিক্রম করে ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রবেশ করেছি। এটা ঘটেছিল প্রধান উপনিষদগুলি রচিত হওয়ার শেষ পর্যায়ে। বেদাঙ্গযুগের প্রাচীনতর পর্যায়েরও তখনই সূত্রপাত; এই যুগে ভারতবর্ষ গ্রিস, রোম, মধ্যপ্রাচ্য, চিন ও দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে সমৃদ্ধিপূর্ণ বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছিল এবং ফলে দূরবর্তী দেশগুলি থেকে বাণিজ্যিক সামগ্রীর সঙ্গে সঙ্গে নূতন ও অপরিচিত ভাবাদর্শ, আচার ব্যবহার, অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস এ দেশে আসছিল। পাটলিপুত্র ও কৌশাম্বির মতো সমৃদ্ধিশালী নগরীর উত্থান আর্থিক প্রাচুর্যের প্রমাণ বহন করে। অন্ততপক্ষে বণিকশ্রেণি এবং শাসকগোষ্ঠী অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও পুরোহিতদের সমৃদ্ধি যে বিশেষ মাত্রা অর্জন করেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে যে যুগে দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত এবং বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের ফলে লাভের প্রভাবে মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির উদ্ভব হয়েছিল; প্রাচীন বৌদ্ধ রচনাসমূহে এই অভ্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এবং অন্যান্য প্রতিবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের ফলে যজ্ঞনিষ্ঠ ধর্মের ভিত্তিমূল চূড়ান্ত ভাবে শিথিল হওয়ার পূর্বে পুরোহিতশ্রেণি যজ্ঞপরায়ণ গোষ্ঠীর মধ্যে জাগতিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন।

শিল্পকলা সে সময় এমন ভাবে বিকাশলাভ করে যা পূর্বে দেখা যায়নি। ভাস্কর্যে গান্ধার ও মথুরা রীতি (লক্ষণীয় যে, এই দুটি অঞ্চল তৎকালীন বাণিজ্যপথের দুই প্রান্তে অবস্থিত) এবং স্থাপত্যে সাঁচি ও ভারহুত রীতির উত্থান এ যুগেই ঘটেছিল। শিলালিপি ও মুদ্রার প্রচলন হওয়াতে শিল্প-প্রচেষ্টার বহু নিদর্শন আমরা পেয়েছি। এ যুগের সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যকর্মের সাক্ষ্য থেকে এই তথ্য পরিস্ফুট হয়েছে যে গণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাবিদ্যা সে সময় গভীর ভাবে অনুশীলিত হত। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই যুগে যেমন বহু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমত বিধিবদ্ধ হয়েছিল, তেমনই ভারতবর্ষে দুই মহাকাব্য মহাভারত এবং রামায়ণ এ-যুগেই রচিত হয়। তা ছাড়া ভাসের নাটকগুলি এবং অশ্বঘোষের রচনাবলিও সাহিত্যের রচনাশৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে প্রধান দিকপরিবর্তনেরও সূচনা করে— এদের মধ্যে আমরা পরিণত ধ্রুপদী শৈলীর সাহিত্যসৃষ্টির নিদর্শন দেখতে পাই। ললিতবিস্তর এবং কিছু পরবর্তিকালের বুদ্ধচরিত, গ্রন্থ দুটি একটি নূতন সাহিত্যধারার সূত্রপাত করে— লোকত্রাতা দেবতার জীবনকাহিনি পরবর্তী যুগে আমাদের নিকট একটি নূতন ধর্মীয় সাহিত্যের শ্রেণিপরিচয় পরিস্ফুট করে তোলে। এই শ্রেণির বিশেষ অভিব্যক্তি দেখা যায় পুরাণ সাহিত্যে, যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও নির্দিষ্ট ধর্মচর্যা বা সম্প্রদায়ের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও অবতার বা দেবতার জীবন ও কীর্তি কাহিনি চিত্রিত হয়েছে।

এই যুগের ব্রাহ্মণ্যধর্মে আমরা লোকায়ত ধর্মের সমঝোতার একটি প্রক্রিয়া লক্ষ করি। দীর্ঘকাল থেকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের উপর চাপ অব্যাহত ছিল। এমনকী আর্যরা যখন তাদের অপরিশীলিত ও প্রাথমিক যজ্ঞগুলি এ দেশে এনেছিল, তখন বিবিধ প্রচলিত উপাসনা-পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হয়েছিল। তাই ঋগ্বেদেও আমরা ইন্দ্র কর্তৃক শালাবৃকদের কাছে যতিদের সমর্পণ করার বৃত্তান্ত, মুনিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং মৃত বৈখানসদের পুনরুজ্জীবনের কাহিনি পাই। এই সব গোষ্ঠী পরবর্তী যুগে বিভিন্ন তপস্বী সম্প্রদায়রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং ফলে দেশীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীধর্মের দ্বারা আর্য উপাসনা পদ্ধতি সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে, কেননা সে সময় এ ধরনের বহু ধর্মগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের বিপুলসংখ্যক অনুগামী ছিল। এরা যজ্ঞধর্মের মৌলিক আদর্শগুলিকে এমন ভাবে প্রতিস্পর্ধা জানিয়েছিল যে, ব্রাহ্মণ্যধর্ম সার্বিক বিলুপ্তির আশঙ্কার মুখোমুখি হল। পূর্ববর্তী একটি অধ্যায়ে আমরা দেখেছি কীভাবে আরণ্যকগুলি আধ্যাত্মিক ও অধ্যাত্মবাদী প্রতীকায়নের সাহায্যে যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির পুনর্বিশ্লেষণ করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আয়ুষ্কালকে দীর্ঘতর করতে চেয়েছিল। এতে যে নূতন পথ উন্মুক্ত হল, সে দিকে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম আরও কিছুকাল বেঁচে থাকল বটে, কিন্তু এরই মধ্যে যজ্ঞের মৃত্যুনির্দেশ ও প্রাচীনতর পুরাণসাহিত্যের উদ্ভবের মধ্যবর্তী সময়টা ছিল অচলাবস্থা, অবক্ষয় ও ক্রমাবলুপ্তির যুগ। অবশ্য যজ্ঞ তখনও অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, কেননা, রাজা ও রাজন্যরা তখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো সমৃদ্ধিশালী ছিলেন।

এ শতাব্দীগুলিতে যজ্ঞ আরও কৃত্রিম, যান্ত্রিক হয়ে উঠেছিল এবং উত্তর ভারতের সর্বত্র উদ্ভুত অসংখ্য নগররাষ্ট্রের রাজসভাগুলিতে বিত্তশালী পৃষ্ঠপোষকের সামাজিক মর্যাদার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ দূর থেকে যজ্ঞের জাঁকজমক দেখে কৌতূহল বোধ করত, কিন্তু সংশয়, অবিশ্বাস এবং ব্যয়বহুল যজ্ঞ-সম্পাদনে নিজেদের অক্ষমতা-হেতু ক্রমশ এই ধর্মপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিরাসক্ত দর্শক ও সমালোচকে পরিণত হয়েছিল। এই জনসাধারণ যেমন সক্রিয় ভাবে যজ্ঞানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত তেমনই সে যুগে প্রচলিত বিমূর্ত আধ্যাত্মবাদী আলোচনা সম্পর্কেও কোনও প্রকৃত আগ্রহ বা অনুশীলনের ক্ষমতাও তাদের ছিল না। ফলে তারা লঘু ঐতিহ্যের অন্তর্গত লোকায়ত ধর্মের সেই উপাদানগুলির প্রতিই ক্রমশ অধিকতর আকৃষ্ট হচ্ছিল যা তাদেরকে কিছু কিছু আত্মিক আশ্রয়ের সন্ধান দিয়ে পার্থিব সমৃদ্ধির প্রত্যাশা এবং মৃত্যুর পর স্বর্গের আশ্বাস দিতে পারত। দেহান্তরবাদ সাধারণ ভাবে গৃহীত হওয়ার পর মূল তত্ত্বগুলি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষের অন্তগূঢ় জীবনমুখী প্রত্যয় বারংবার জীবনলাভের প্রত্যাশায় ঔৎসুক্য বোধ করবেই; এ জীবনে যে-সমস্ত আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হয়নি, পরবর্তী সুযোগে তা আরও পরিপূর্ণ ভাবে ভোগ করার জন্য মানুষ পুনর্জীবনলাভের আশাই আঁকড়ে ধরেছিল— লোকায়ত ধর্ম সাধারণ মানুষের কাছে তারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাই সমাজে তখন যে সংশ্লেষণী প্রক্রিয়ার সূত্রপাত হল, ক্রমশ পরবর্তী কয়েকটি শতাব্দীতে পরিপূর্ণতা লাভ করে তা পৌরাণিক হিন্দুধর্মে পর্যবসিত হল। অবশ্য এই পর্যায়ে তা নিতান্ত অস্পষ্ট ছিল। যজ্ঞধর্মের পুরনো কাঠামো রক্ষিত হয়েছিল, কেননা কালাত্তীর্ণ ও পরিচিত কাঠামো হিসাবে সমাজ তাকে উত্তরাধিকাররূপে পেয়েছে, যদিও এর মধ্যে নূতন ভাববস্তু সর্বদাই সংযোজিত হচ্ছিল।

মহাকাব্যগুলিতে এই সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে যে, রাজারা তাদের রাজনৈতিক জীবনের সমস্যা-সঙ্কুল সন্ধিক্ষণে কিছু কিছু যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে চলেছেন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী পাওয়ার আশায় পুত্রেষ্টি, স্বজনহত্যার পাপমোচনের জন্য অশ্বমেধ বা যুদ্ধজয়ের জন্য নূতন ধরনের যজ্ঞ (নিকুন্তিলা ) অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু তখনকার সমাজে এর মধ্যেই পূজার প্রচলন হয়ে গেছে। তা ছাড়া তীর্থযাত্রা, বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার, দেবতাদের লীলা, ব্রতপালন, প্রতিমা-প্রতিষ্ঠা, মন্দির-নির্মাণ, ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। পরিত্রাতা দেবতা এবং তাঁদের পূজা প্রায়ই বিবৃত হয়েছে। স্পষ্টত সমাজ ইতোমধ্যে বিশেষ এক মিশ্র ধর্মচিন্তার পথে অগ্রসর হয়ে গেছে; বৈদিক মন্ত্ৰ অবৈদিক অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যাতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে এক ধরনের আপাত-ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তবে ধর্মের বিষয়বস্তু ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে যজ্ঞের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।

এই যুগেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম তার শেষ সংকটের সম্মুখীন হয়; যজ্ঞানুষ্ঠানের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির আশঙ্কার মুখোমুখি এসে এবং অন্য দিকে নব্য হিন্দুধর্মের আসন্ন উত্থানের পূর্বাভাস সূচনা করে তা অতীত ঐতিহ্যের বিনাশ সম্ভাবনার সম্মুখীন হল। ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে ব্রাহ্ম্যণ্যধর্মের প্রতি প্রথম পর্যায়ের প্রত্যাহ্বানের উত্তর যেমন উপনিষদ সাহিত্যে পাওয়া গিয়েছিল, তেমনই তার শেষ পর্যায়ের সংকটের সমাধান পাওয়া গেল বেদাঙ্গগুলিতে। এমন এক সময় এরা বৈদিক সাহিত্যকে সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল যখন তা দ্রুত প্রকৃত অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল।

সূত্রসাহিত্যের আঙ্গিক ও ভাষা

সংহিতা-সাহিত্যের অধিকাংশই পদ্যে ও ব্রাহ্মণ গদ্যে রচিত; আবার আরণ্যক ও উপনিষদ সাহিত্যে গদ্য ও পদ্য উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সমগ্র সূত্র-সাহিত্য একটি বিচিত্র ধরনের জটিল, সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ ভাষায় রচিত হয়েছিল। সূত্রের গদ্য সম্পূর্ণত স্বরন্যাস থেকে মুক্ত হলেও এর ব্যাকরণগত কাঠামো ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের অনুরূপ; অবশ্য প্রাচীনতর সূত্রগুলিতে বাসংযমের প্রবণতা অনেক বেশি। এতে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ছয় বা সাতশো বছরের মধ্যে মৌখিক গদ্যে কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। সাধারণ ভাবে এ ভাষা উপনিষদ ও তৎপরবর্তী যুগের বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত বহন করে। শব্দভাণ্ডারে মহাকাব্যিক যুগের লক্ষণ পরিস্ফুট হলেও এর বিপুল অংশ ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষায় তখনই অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাকরণ প্রাক্‌পাণিনীয়। সূত্রসাহিত্য মহাভারত সম্পর্কে অবহিত ছিল। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ভারত’ ও ‘মহাভারত’-এর উল্লেখ করায় মনে হয়, মহাকাব্য রচনার তিনটি মুখ্য স্তরের দুটির সঙ্গেই তা পরিচিত ছিল।

শব্দসংক্ষেপের জন্য লেখকের অতিরিক্ত উদ্বেগ ছিল বলে ক্রিয়া, সর্বনাম, সম্পূরক শব্দ এবং সমস্ত ধরনের বর্জনীয় ক্রিয়াবিশেষণ ও বিশেষণ পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে যে কর্কশ, সংক্ষিপ্ত ও সাংকেতিক ভাষার সৃষ্টি হল, অনেক সময়েই উপযুক্ত ভাষ্য ব্যতীত তার অর্থবোধ প্রায় অসম্ভব। প্রাথমিক ভাবে শিক্ষকরা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া সম্পর্কিত নির্দেশ মৌখিক ভাবে দিতেন। বস্তুত, সূত্রসাহিত্যের অধিকাংশ রচনা এমন একটি যুগে উদ্ভূত হয়েছিল যখন লেখন-প্রণালী আবিষ্কৃত হলেও ধর্মীয় সাহিত্যের প্রয়োজনে তা তখনও ব্যবহৃত হত না এবং এই সাহিত্য যে-তিনটি উচ্চতর বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁরা মনে করতেন যে এ ধরনের সাহিত্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় নিগূঢ় রহস্যময় চরিত্র লেখন-পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে বিপন্ন হবে। সুতরাং নূতন যুগের সাহিত্যও স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য প্রস্তুত করা হল। কিন্তু বিষয়বস্তু স্বভাবত শুষ্ক ও বন্ধ্যা হওয়ার ফলে স্মৃতিশক্তির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ল। তাই বাধ্য হয়েই ভাষাকে সমস্ত কিছু পরিহারযোগ্য উপাদান বর্জন করে কেবলমাত্র সেই অংশটুকু রক্ষা করতে হল, যা বিবক্ষিত বস্তুর সঙ্গে সাধারণ ভাবে পরিচিত জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে। এটা যথার্থ যে, গদ্যে রচিত ব্রাহ্মণগুলিও স্মৃতিতে ধারণ করা হত; কিন্তু তখন যজ্ঞ অনেক বেশি জীবন্ত ছিল বলে স্মৃতিকে আকর্ষণ করতে সমর্থ ছিল। তা ছাড়া সাহিত্যগত ভাবেও ব্রাহ্মণগুলি পরিপূর্ণতর ভাষায় রচিত বলে সহজে স্মরণযোগ্য রচনা ছিল। অন্য দিকে সূত্র-সাহিত্যে সেই দেবকাহিনির কোনও স্থান ছিল না, যা ব্রাহ্মণ-সাহিত্যকে বহু ক্ষেত্রে সজীবতা দান করেছে; এমনকী এতে কোনও আলঙ্কারিক সৌষ্ঠব বা কাব্যগুণও নেই। উপরন্ত এই শুষ্ক ও নির্জীব সাহিত্য মনুষ্যরচিত বলে স্বীকৃত, তাই পূর্ববর্তী যুগের সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা থেকেও তা পুরোপুরি বঞ্চিত ছিল। সূত্রসাহিত্য মৌখিক ভাবে সম্প্রচারিত হত বলে অধ্যায়ের সমাপ্তি স্পষ্ট করার জন্য একটি বিশেষ রীতি অবলম্বিত হত। শেষ সূত্রটি ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদে প্রাপ্ত দৃষ্টান্ত অনুযায়ী অধ্যায় বা বিভাগের শেষে একবার পুনরাবৃত্ত হত, এতেই একটি পরিচ্ছেদ বা অধ্যায়ের অবসান সূচিত হত।

শিক্ষা

প্রথমে বেদাঙ্গের অধিকতর বিধিবদ্ধ দিকগুলি আলোচনা করছি: এই পর্যায়ে রয়েছে শিক্ষা (ধ্বনিতত্ত্ব), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (ব্যুৎপত্তি শাস্ত্র) এবং ছন্দ। এদের মধ্যে শিক্ষা আমাদের প্রথম আলোচ্য বিষয়, কারণ সর্বাধিক সংখ্যক রচনা শিক্ষা সম্পর্কে প্রণীত হয়েছে।

শিক্ষাবিষয়ক রচনাগুলিতে আমরা প্রাচীন ভারতবর্ষে ধ্বনিতত্ত্ব অনুশীলনের পরিচয় পাই। শিক্ষা-গ্রন্থগুলি ধ্বনি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত উচ্চারণপদ্ধতি, বাক্যন্ত্র ও আস্য-প্রয়াস সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে: সংক্ষেপে বলা যায়, বেদমন্ত্র উচ্চারণ প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কিছুই এই গ্রন্থের পরিধিভুক্ত।

বহু শিক্ষাগ্রন্থের নাম আমাদের কাছে পৌঁছলেও এ সমস্ত রচনাগুলি এখন আর পাওয়া যায় না। সমস্ত শাখার চলিত সাধারণ শিক্ষাগ্রন্থগুলি হল পাণিনীয়, সর্বসম্মত ও সিদ্ধান্ত। মন্ত্রের বিভিন্ন অংশ, গানের প্রণালী, সংহিতাপাঠকে পরিশীলিত করে সুর-সমন্বিত করার পদ্ধতি, উচ্চারণ পদ্ধতি এবং গান ও বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের সহযোগী অঙ্গভঙ্গি, ইত্যাদি এই সব গ্রন্থের প্রধান বিষয়বস্তু। শিক্ষা সংগ্রহ গ্রন্থটি তুলনামূলক ভাবে নবীনতর ও বহু বিষয়-সমৃদ্ধ রচনা। এ ধরনের গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত পাণিনীয় শিক্ষা যথার্থ উচ্চারণ, সন্ধিবিচ্ছেদ ও সংহিতা পাঠে পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রধান বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করেছে। এই গ্রন্থে ব্যাস, নারদ, শৌনক, প্রভৃতি বিশেষজ্ঞরা উল্লিখিত হয়েছেন। পাণিনির উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রচলিত গ্রন্থটি স্বয়ং পাণিনির দ্বারা রচিত নয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে শিক্ষাকে অক্ষর, স্বর, সম্বোধনের স্বর-দৈর্ঘ্য, শ্বাসাঘাত, মন্ত্রোচ্চারণ ও সন্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সবগুলি শিক্ষাগ্রন্থেই এই বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। তা ছাড়া পাণিনীয়-শিক্ষার মতো প্রধান শিক্ষাগুলি বিষয়বস্তুর গভীরে অবগাহন করে পদের উৎস এবং উচ্চারণের মৌখিক কলাকৌশল আলোচনা করেছে, কেননা প্রাতিশাখ্যগুলি যেখানে ধ্বনির শ্রবণগত দিক সম্পর্কে উৎসাহী, শিক্ষা সেখানে ধ্বনি উচ্চারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর্য-প্রযত্ন সম্পর্কে আলোচনা করেছে। প্রাচীনতর বৈদিক সাহিত্যে স্বরন্যাস উচ্চারণের তীব্রতা অনুযায়ী নির্ধারিত হত কিন্তু কালক্রমে অবৈদিক উচ্চারণ রীতির সঙ্গে নিরন্তর পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফলে তা ধীরে ধীরে ও নিশ্চিত ভাবে শ্বাসাঘাতমূলক স্বরন্যাসে বিবর্তিত হয়। কৃষ্ণ-যজুর্বেদের সময় থেকে এটা বিধিতে পরিণত হয়ে উপনিষদের কাল পর্যন্ত প্রচলিত থাকে।

এ ছাড়া আমরা অন্য যে সব শিক্ষাগ্রন্থের কথা শুনি, তাদের মধ্যে কেশব, মাধ্যন্দিনীয়, লোমশ ও অমোঘনন্দিনী শুক্ল-যজুর্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের মধ্যে অমোঘনন্দিনী প্রধানত উচ্চারণবিধি সম্পর্কিত সাতান্নটি শ্লোকে গ্রথিত সংক্ষিপ্ত একটি রচনা; মাধ্যন্দিনীয়তে রয়েছে সাতাশটি এবং কেশবে মাত্র নয়টি শ্লোক। গার্গ্যাচার্য রচিত লোমশী গ্রন্থটি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর রচনা; এতে চারটি খণ্ড ও চল্লিশটি শ্লোক রয়েছে।

ভারদ্বাজ, চারায়ণীয়, আরণ্য ও ব্যাসশিক্ষা তৈত্তিরীয় সংহিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। একশো তেত্রিশটি শ্লোকে রচিত ভারদ্বাজ গ্রন্থটি একটি ব্যবহারিক নির্দেশিকা যা প্রতিশব্দগুলির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে ও যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করতে শেখায়। তৈত্তিরীয় সংহিতা পাঠের বিশুদ্ধতা রক্ষাই এর লক্ষ্য। দশটি অধ্যায় ও তিনশো পঁয়ত্রিশটি শ্লোক-সংবলিত চারায়ণীয় একটি দীর্ঘতর রচনা; এর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে সন্ধি, সমাস, আবৃত্তির নিয়ম, স্বরন্যাস, যতি, বিভিন্ন পদের দৈর্ঘ্য, ছন্দ, ইত্যাদি। বিষয় পরিধির ক্ষেত্রে আরণ্য ক্ষুদ্রতম, কেননা এই গ্রন্থ তৈত্তিরীয় আরণ্যকের স্বরন্যাসেই সীমাবদ্ধ। এর দাবি হল যে, অন্য ন’টি শিক্ষাগ্রন্থ থেকে এ-গ্রন্থ তার বিষয়বস্তু আহরণ করেছে। ব্যাসশিক্ষা সম্ভবত প্রাচীনতম এবং তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য নামক গ্রন্থের উপর নির্ভরশীল। এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি অন্য বহু শিক্ষার তুলনায় বিষয়বস্তুর দিক থেকে ব্যাপকতর।

অথর্ববেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাণ্ডুকী শিক্ষা ষোলোটি অধ্যায় ও একশো চুরাশিটি শ্লোকে গ্রথিত দীর্ঘ রচনা; বশিষ্ঠ-শিক্ষা নামক অতি ক্ষুদ্র রচনাটিতে শুধুমাত্র অক্ষরের দ্বিত্ব বা ‘আবৃত্তি আলোচিত হয়েছে। গদ্যে রচিত আপিশলী শিক্ষায় বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষরের শ্রেণিবিভাগ ও যথার্থ উচ্চারণ ও ধ্বনির উৎপত্তি আলোচিত হয়েছে।

সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নারদীয় শিক্ষার দুটি প্রপাঠকের প্রতিটিই আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে মোট দুশো চল্লিশটি শ্লোক ও কিছু গদ্য-স্তবক রয়েছে; সামবেদের পাঠকে সুরের নিয়ম অনুযায়ী বিন্যস্ত করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। সামবেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাসশিক্ষা দীর্ঘতম শিক্ষাগ্রন্থ এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলির অন্যতম। সামবেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এটি তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্যকে এত বিশ্বস্ত ভাবে অনুসরণ করেছে যে, প্রকৃতপক্ষে শেষোক্ত গ্রন্থের একটি ভিন্ন ধরনের পদ্য-সংস্করণ হয়ে পড়েছে। এই গ্রন্থে আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে প্রায়োগিক পরিভাষা, স্বরন্যাসের বিধি, দ্বিত্ব-বিধি, ইত্যাদি।

অন্যান্য রচনার উল্লেখ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শিক্ষাশ্রেণিভুক্ত সমস্ত গ্ৰন্থ শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। এমন প্রায় চোদ্দোটি নাম পাওয়া যায় যা এখন আমাদের নিকট লুপ্ত। পাণিনি তাঁর রচনাকে সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ এবং কয়েকটি প্রাচীনতম শ্রৌতসূত্রের প্রায়োগিক দিকের সাহায্যে প্রণয়ন করেছিলেন। সোমশর্মা রচিত যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষার বিষয়-পরিধি পাণিনীয়ের অনুরূপ; তবে এটা বহু পরবর্তিকালের রচনা— অন্তত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর, যখন গুপ্ত সাম্রাজ্যের যুগে নূতন ভাবে যজ্ঞধর্মের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হচ্ছিল তার পূর্ববর্তী তো নয়-ই। এর চেয়েও পরবর্তী রচনা হল কাত্যায়ন-শিক্ষা, যদিও কোনও কোনও বিখ্যাত গবেষকের মতে এটি যাজ্ঞবল্ক্য শ্রৌতসূত্র অপেক্ষা প্রাচীনতর, যেহেতু প্রথমোক্ত রচনা থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি শেষোক্ত গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে আমাদের মনে হয়, উভয় গ্রন্থই সম্ভবত কোনও বিলুপ্ত প্রাচীনতর রচনা থেকে বিষয়বস্তু আহরণ করে থাকবে। অনুমান করা যায়, কাত্যায়ন-শিক্ষা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। এর শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্য— উভয়ক্ষেত্রে বিষয়সূচি প্রায় এক; তবে প্রথমোক্ত রচনা উচ্চারণ-প্রয়াসের প্রকৃতি সম্পর্কে অধিক মনোযোগী এবং দ্বিতীয়োক্ত রচনায় উচ্চারিত ধ্বনির শাব্দিক চরিত্র আলোচিত। এই দুই শ্রেণির রচনার প্রকৃত পার্থক্য একটি বিধিতে আভাসিত হয়েছে: যখন শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্য পরস্পরবিরোধী অভিমত দেয় তখন প্রাতিশাখ্যই প্রামাণ্য বলে গণ্য হবে; কেননা বৈদিক ধর্ম ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হওয়ার ফলে বাচনভঙ্গিতে যে বৈচিত্র্য ও উচ্চারণবিধিতে যে পরস্পর-বিরোধিতা দেখা দেয়, তার ফল বহু ভাষাভাষী জনসাধারণের কাছে সর্বজনগ্রাহ্য নির্দিষ্ট বিধি প্রণয়ন করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রত্যেক অঞ্চল কোনও নির্দিষ্ট শাখার প্রচলিত প্রয়োগবিধির দ্বারা পরিচালিত হত। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, অপেক্ষাকৃত নবীনতর শিক্ষাগুলি বিষয়-বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে প্রাতিশাখ্যের তুলনায় পূর্ণতর ও রচনা-বিন্যাসের ক্ষেত্রে উন্নততর। তবে প্রথম দিকে সম্ভবত একটিমাত্র শিক্ষা প্রচলিত ছিল এবং পাণিনির বৈদিক ধ্বনিতত্ত্ব-বিষয়ক প্রাচীনতম রচনাটি ছিল এই শিক্ষা, যা দীর্ঘকাল ধরে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে রূপান্তরিত হয়। লক্ষণীয় যে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ‘শিক্ষা’ শব্দটি একবচনে প্রযুক্ত হয়েছে; (৭:২:১); এতে মনে হয় যে এটা শ্রেণিনাম ও সম্ভবত বিভিন্ন শাখায় প্রচলিত বেশ কিছু রচনার সাধারণ নাম। আমাদের কাছে যে সব শিক্ষাগ্রন্থ পৌঁছতে পেরেছে, সেগুলিকে বেদাঙ্গসূত্রের প্রাচীনতম পর্যায়ের কাছাকাছি স্থাপন করতে হবে; কিন্তু প্রাতিশাখ্যগুলি অন্ততপক্ষে চার বা তিন শতাব্দী পরে রচিত— নবীনতম প্রাতিশাখ্যগুলি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল।

প্রচলিত প্রাতিশাখ্যগুলি হল শৌনকের ঋক্-প্রাতিশাখ্য, যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য, শুক্ল যজুর্বেদের অন্তর্গত কাত্যায়ন-রচিত বাজসনেয় প্রাতিশাখ্য, অথর্ববেদের অন্তর্গত শৌনক রচিত অথর্ব-প্রাতিশাখ্য বা চতুরধ্যায়িকা, এবং সামবেদের অন্তর্গত সাম-প্রাতিশাখ্য (পুষ্প বা পঞ্চবিধ সূত্রের মতো সংক্ষিপ্ত রচনাগুলিও এর সঙ্গে সংযোজিত)। বহু প্রাতিশাখ্য প্রাচীনতর এবং অঞ্চল ও শাখাভেদে ভিন্ন ভিন্ন; এদের মধ্যে থেকেই বিমূর্তায়ন ও সাধারণীকরণের প্রবণতার ফলস্বরূপ শিক্ষাগ্রন্থগুলি উদ্ভূত হয়। উবট ভাষ্যে আমরা এর প্রমাণ পাই যেখানে তিনি বলেছেন যে, এই বিশেষ বেদাঙ্গটি (অর্থাৎ প্রাতিশাখ্য) হচ্ছে সমস্ত বেদের শিক্ষা ছন্দ ও ব্যাকরণগুলিতে সাধারণ ভাবে প্রাপ্ত সূত্রগুলির সংকলন; তাছাড়া কোনও নির্দিষ্ট শাখার প্রয়োগরীতি অনুযায়ী সাধারণ নিয়মগুলি এতে পরিশীলিত হয়েছে বলেই এ ধরনের রচনাকে প্রাতিশাখ্য বলা হয়। খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ঋক্ প্রাতিশাখ্য নিজেকে বেদাঙ্গরূপে বর্ণনা করেছে; (১৬:৬৯) যদিও পরিচিত তালিকাগুলি শিক্ষাকেই অন্তর্ভুক্ত করেছে, কারণ সম্ভবত প্রাতিশাখ্য থেকে শিক্ষা গঠিত হওয়ার পরই সেই তালিকা সংকলিত হয়েছিল। উবট তাঁর প্রাতিশাখ্য তালিকায় শিক্ষাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং শেষোক্ত রচনাগুলিকে তিনি ‘পার্ষদ’ বা বিদ্বজ্জনমণ্ডলীরূপে অভিহিত করেছেন। শৌনকের ঋক্-প্রাতিশাখ্য শাকল শাখার অন্তর্গত, এর আঠারোটি ‘পটল’ দুটি প্রধান ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে বর্ণমালাসম্পর্কিত একটি অধ্যায় যাকে ধ্বনিগত উৎস অনুযায়ী কয়েকটি সমরূপযুক্ত ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে; (১ম পটল) এ ছাড়া রয়েছে চোদ্দো রকম সন্ধি ও সন্ধি-প্রতিষেধ (২য়) এবং বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সংবলিত আরও চারটি অধ্যায়। দ্বিতীয় ভাগে যে বারোটি পটল (অধ্যায়) রয়েছে, তার মধ্যে দীর্ঘায়িত স্বরবর্ণ, (৭ম) প্লুতস্বরে বৈচিত্র্য, (৮ম ও ৯ম) স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য ক্রম-পদ্ধতি, (১০ম ও ১১শ) ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণ, (১৪শ) ছাত্রদের শিক্ষাদান করার উপায় (১৫শ) ও ছন্দ, (১৬শ) ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।

তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য গ্রন্থে প্রকৃতপক্ষে একই বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে; এছাড়া বিভিন্ন প্রায়োগিক পরিভাষাও আলোচিত হয়েছে।

কাত্যায়নের শুক্ল-যজুর্বেদ-প্রাতিশাখ্য গ্রন্থে আটটি অধ্যায় ও সাতশো সাতাশটি সূত্র রয়েছে। এতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে: সামবেদীয় ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ, শিক্ষকদের দ্বারা নির্দেশিত আবৃত্তির বিচিত্র প্রাচ্যরীতি, শুক্ল যজুর্বেদের পদ ও ক্রমপাঠ, সন্ধিবিধি, স্বরন্যাস, আবৃত্তির জন্য কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, বিভিন্ন জটিল পাঠে প্রতিটি শব্দ পুনরাবৃত্তির পদ্ধতি, ইত্যাদি।

আমরা শুক্ল যজুর্বেদের পনেরোটি ভিন্ন শাখার কথা শুনি, এদের সবগুলিরই একটিমাত্র সাধারণ প্রাতিশাখ্য ছিল। ঋপ্রাতিশাখ্যে ছন্দ আলোচিত হলেও শুক্ল যজুর্বেদ-প্রাতিশাখ্যে তা হয়নি— সম্ভবত এর কারণ এই যে, প্রাতিশাখ্য-রচয়িতা কাত্যায়ন তাঁর ‘সর্বানুক্রমণী’ গ্রন্থে বিষয়টি আলোচনা করেছেন। বিশেষ ভাবে শুক্ল যজুর্বেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ধ্বনিতত্ত্ব এই গ্রন্থে আলোচিত হলেও বহু আপাত-অপ্রাসঙ্গিক বিষয় এতে সন্নিবেশিত হয়েছে; যেমন, স্মৃতি-নিবন্ধ করার প্রয়োজন বা বেদাধ্যয়নের নির্দেশ বা সাঙ্গীতিক প্রণালী বা কিছু কিছু প্রাচীন আচার্য ও তাঁদের অনুসরণকারীদের বিচিত্র আবৃত্তিরীতি। শুক্লযজুর্বেদ প্রাতিশাখ্য অনুযায়ী বর্ণমালায় ৬৫টি বর্ণ রয়েছে, কেননা উচ্চারণের বিভিন্ন সূক্ষ্ম তারতম্যও এতে স্বীকৃত। এ ছাড়া আছে ফলশ্রুতি অংশ, যেখানে আলোচ্য গ্রন্থপাঠ-লব্ধ পুণ্যসমূহ বিবৃত হয়েছে।

সর্বাধিক-সংখ্যক প্রাতিশাখ্য সামবেদের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট; এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরিচিত হল সাম-প্রাতিশাখ্য, পঞ্চবিধ বা পুষ্পসূত্র ও ঋতন্ত্র। ঋতন্ত্র গ্রন্থটি মূলত ব্যাকরণের প্রকৃতিযুক্ত; অন্যান্য রচনাগুলিতে সামবেদের আবৃত্তি ও গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চারণের বিশেষ পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন শাখা ও অঞ্চলভেদে গায়নরীতি প্রচুর পরিমাণে পরিবর্তিত হতে পারে; এই রচনাসমূহে পরিবর্তন-সম্পর্কিত নিয়মাবলি দেওয়া হয়েছে। তাই সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাতিশাখ্যের এত সংখ্যাধিক্য।

সামবেদের প্রাতিশাখ্যগুলি সম্ভবত অথর্ববেদীয় প্রাতিশাখ্য অপেক্ষাও প্রাচীনতর; শেষোক্ত রচনাগুলিতে প্রকৃতপক্ষে সূত্রসাহিত্যের উন্মেষপর্বের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে অথর্ববেদের তিনটি প্রাতিশাখ্যের মধ্যে মাত্র একটি, অথর্ব প্রাতিশাখ্য নামে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অন্য একটি, কৌণক ও সায়ণ শাখার রচনা চতুরধ্যায় নামে পরিচিত; পৈপ্পলাদ শাখার তৃতীয় প্রাতিশাখ্যটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চতুরধ্যায় ও অথর্ব প্রাতিশাখ্যের মধ্যে প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। এর বিষয়বস্তু অন্যান্য প্রাতিশাখ্যগুলির প্রায় অনুরূপ। কিন্তু যেহেতু অন্যান্য পরিচিত সংহিতাগুলির তুলনায় অথর্ববেদের ভাষায় অনেক বেশি ভাষা-তাত্ত্বিক বৈচিত্র্য রয়েছে, তাই এই প্রাতিশাখ্যের অতিরিক্ত গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কারণ, তা এমন একটি দুয়ে ভাষার উপর আলোকসম্পাত করেছে যার মধ্যে একই সঙ্গে ঋকবেদ ও যজুর্বেদ সংহিতার প্রাচীনতর ও নবীনতর, উভয়বিধ নিদর্শনই সংরক্ষিত হয়েছে। এর অন্য বৈশিষ্ট্য হল লেখনপ্রণালীর প্রতি গুরুত্ব আরোপের প্রবণতা; এই অসামান্য বৈশিষ্ট্যের জন্য একে স্পষ্টত সেই সময়ের রচনা বলে চিহ্নিত করা চলে যখন বৈদিক সাহিত্য লিখিত রূপ পরিগ্রহ করছিল। পাণিনি ও পতঞ্জলির আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়ে— সম্ভবত শেষোক্ত জনেরই বেশি কাছাকাছি– এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল। চতুরধ্যায়-প্রচলিত অথর্ববেদ পাঠকে বিশ্বস্ত ভাবে অনুসরণ করেছে যদিও কখনও কখনও স্পষ্টতই তা ত্রুটিপূর্ণ। লক্ষণীয় যে, প্রাতিশাখ্যের বিষয়বস্তুর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যাকে সাধারণত ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়; এদের বিষয়বস্তু প্রায়ই পরস্পরের বৃত্তে অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু প্রাতিশাখ্যগুলি কখনও ব্যাকরণ বলে অভিহিত হয় না, কারণ ভাষার ব্যাকরণ শিক্ষাদান এগুলির প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়, বিভিন্ন বৈদিক শাখার নির্ভুল প্রকরণ বিবৃত করাই এদের লক্ষ্য। অবশ্য এদের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ব্যাকরণের অস্তিত্ব ও পরিশীলন সূচিত হয়; এই সঙ্গে দুটি স্পষ্টত ভিন্ন ধারায় এদের বর্গীকরণের পূর্বাভাসও পাওয়া যায়। প্রাতিশাখ্যগুলিতে ভাষা অধিক তরলায়িত; উচ্চারণ, স্বরভঙ্গি, সন্ধি ও স্বরন্যাসের অসংখ্য আঞ্চলিক বিকল্প রূপ প্রকাশিত হয়েছে। পৃথক বিষয়-রূপে ব্যাকরণের উদ্ভবের ফলে এগুলি আরও কঠোর ভাবে বিধিবদ্ধ হয়েছিল।

পদপাঠের প্রণেতা শাকল্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাস্ক বা শৌনক অপেক্ষা প্রাচীনতর। পদপাঠ ছাড়াও সংহিতাকে স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য অন্যান্য পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল; যেমন, জটা, মালা, রথ, ধ্বজ, ঘন, রেখা, শিখা ও দণ্ড। সংহিতাপাঠের যথাযথ পৌর্বাপর্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিভিন্ন পারস্পর্যে সংহিতার শব্দসমূহ প্রাগুক্ত স্মৃতিসহায়ক পদ্ধতি অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হত।

ব্যাকরণ

অধ্যয়নের বিষয়রূপে ব্যাকরণ নিশ্চিত ভাবেই দীর্ঘকাল ধরে বহু গবেষক দ্বারা অনুশীলিত হচ্ছিল— বিভিন্ন বেদাঙ্গে প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের অভিমত বহুবার উল্লিখিত হওয়ার মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবু একমাত্র পাণিনির বৈদিক ব্যাকরণটিই আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে, তাও আবার ধ্রুপদী ব্যাকরণ-বিষয়ক রচনার বৈদিক ব্যাকরণ-সংক্রান্ত বিষয় একটিমাত্র অধ্যায়েই নিহিত। এখানে পাণিনি ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার অপ্রচলিত স্বরন্যাস এবং প্রাচীনতর ভাষার বিচিত্র ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে প্রণীত এই রচনায় ভাষা-আলোচনার ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি লক্ষ্য করা যায়, কেননা বৈদিক ভাষা তত দিনে সম্পূর্ণ অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে; দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা এবং সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের উপভাষা ও ধ্রুপদী প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বৈদিক ভাষার বিকল্প হয়ে উঠেছিল।

পাণিনির দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি অতুলনীয় এবং সম্পূর্ণত বৈজ্ঞানিক। বৈদিক অধ্যায়টি সংক্ষিপ্ত; ধ্রুপদী ভাষার অধ্যায়ে প্রযুক্ত পারিভাষিক শব্দ এখানেও ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া ধ্রুপদী ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার আভাস এই সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টিতে পরিস্পুট। আরও পরবর্তিকালে পতঞ্জলি বৈদিক ভাষাকে ‘ছন্দঃ’ এবং কথ্য ভাষাকে ‘লৌকিক’ বা ‘ভাষা’ নামে অভিহিত করেছেন। পাণিনির মৌলিক অবদান সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা সহজ নয়, কারণ তাঁর পূর্বসূরীদের রচনার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির ফলে (এঁদের মধ্যে অনেকের নাম পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে উল্লেখ করেছেন) আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না ব্যাকরণের কী কী ধারণা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করেছিলেন আর কোন অংশ তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন। তবে মনে হয়, প্রত্যয় ও বিভক্তির মতো পারিভাষিক শব্দ এবং বর্ণমালা-সংক্রান্ত প্রাথমিক নিয়মাবলি যেমন শিবসূত্র, গণ, ইত্যাদি পাণিনির নিজস্ব অবদান। পাণিনি স্পষ্টতা, সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবিহীনতার পক্ষপাতী; তাঁর সমগ্র ব্যাকরণ-প্রকরণে এই পূর্বানুমান আভাসিত যে, সাহিত্য শ্রুতি-সঞ্চরণের উপর নির্ভরশীল, যদিও তত দিনে লিখন-প্রক্রিয়া প্রবর্তিত হয়ে গেছে। চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ততার আদর্শরূপে তাঁর ব্যাকরণ সেই সূত্র-শৈলীর চমৎকার নিদর্শন বোধ হলে যেখানে বাহুল্য একটি অক্ষরও বর্জিত হয়ে থাকে। যে যুগে সংস্কৃত আর কথ্য ভাষা ছিল না, সেই সময়েই পাণিনি ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন, তাই তিনি প্রচলিত শব্দভাণ্ডারকে ব্যাপক ভাবে অনুশীলন করেছিলেন; এতে অনুমান করা যায় যে, ইতোমধ্যে সংস্কৃত মৃত ভাষা হয়ে পড়েছিল। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, পাণিনির প্রচেষ্টায় সংস্কৃত ভাষা তৎকালে প্রচলিত রূপে চূড়ান্ত স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিল। অন্য ভাবে বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এই বৈয়াকরণের আবির্ভাব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; কেননা তাঁর রচনা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ও মধ্যভারতীয় আর্যভাষার মধ্যে জলবিভাজন রেখারূপে বর্তমান। তৎকালীন ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষাটি ছিল জটিল; বৈদিক, প্রত্ন-ধ্রুপদী সংস্কৃত ও কথ্য উপভাষাগুলি সে সময় পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থান করছিল। কিন্তু মধ্যভারতীয় আর্যভাষা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও দুই সহস্রাব্দের বেশি কাল ধরে সংস্কৃত ও কথ্য উপভাষাগুলি পরস্পরের সঙ্গে বিদ্বদ্বত্তার একমাত্র মাধ্যম হয়ে রইল; পাণিনির ব্যাকরণ দ্বারা কঠোর ভাবে তা নিয়ন্ত্রিত হত। তাই ভারতীয় বিদ্বৎসমাজে পাণিনির সম্মানিত প্রতিষ্ঠা অবিসম্বাদিত।

শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্য, ব্যাকরণ ও নিরুক্ত স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে, বৈদিক ভাষা কালক্রমে অপরিচিত ও বিরল হয়ে পড়েছিল। বস্তুত খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে বৈদিক ভাষা যেহেতু বিশেষ সহায়ক ব্যতীত দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে তাই কতকটা অনিবার্য ভাবেই একটি পবিত্রতার ধারণা যুক্ত হয়ে পড়ল। শুধুমাত্র বৃত্তিধারী পুরোহিত ও শিক্ষকদের কাছেই ওই ভাষা বোধগম্য ছিল। এই বিশেষ ভাষাগত পরিপ্রেক্ষিতে— পবিত্রীভূত বৈদিক সাহিত্যের ভাষা থেকে যখন কথ্যভাষার কিছু কিছু অনুপুঙ্খ স্পষ্ট ভাবে পৃথক হয়ে পড়েছিল তখন শিক্ষা, ব্যাকরণ, প্রভৃতির উত্থান ঘটায় এদের চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যে ওই পরিপ্রেক্ষা ধরা পড়েছিল। শিক্ষাগ্রন্থগুলিতে এমন অনেক কিছু পাওয়া যায় যা ইতোপূর্বে প্রাতিশাখ্যগুলিতে বিবৃত হয়েছিল; কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত রচনাগুলিতে এমন অনেক নিয়ম ছিল, যাদের সঙ্গে বেদমন্ত্র আবৃত্তিকারীদের কোনও সম্পর্ক ছিল না; তাই বিশুদ্ধ ভাবে বেদমন্ত্র আবৃত্তি করার জন্য উপযুক্ত বিধিসম্বলিত সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ প্রণয়ন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। ওই সব বিধিকে একই সঙ্গে বোধগম্য ও সহজে স্মরণযোগ্য আঙ্গিকে সন্নিবেশিত করার জন্যই ‘শিক্ষাগুলি রচিত হল; যখন বেদমন্ত্রের আবৃত্তি এত কৃত্রিম হয়ে পড়ল যে অপেক্ষাকৃত সরল প্রাতিশাখ্যের নিয়মের সাহায্যে তাদের যথাযথ ব্যাখ্যাদান আর সম্ভব হল না, সে সময়ে এ-ধরনের গ্রন্থ প্রণয়ন আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। তাছাড়া প্রতিবেশী ভাষা অর্থাৎ অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর প্রভাবে পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা আরও বেশি রূপান্তরিত হল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষা উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরবর্তী শতাব্দী থেকে বৌদ্ধসাহিত্য ক্রমশ অধিকমাত্রায় পালি ভাষায় রচিত হতে থাকে। এমনকী, ঋগ্বেদেও প্রাকৃত ভাষার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়; খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে অথর্ববেদ চতুর্থ বেদরূপে স্বীকৃতিলাভের পরে ধর্মগ্রন্থের শব্দভাণ্ডারে বহু লোকায়ত ও আঞ্চলিক ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান প্রবিষ্ট হতে থাকে।

গ্রিক, শক, কুষাণ, হূন, প্রভৃতি বৈদেশিক জাতির আক্রমণের পরে উচ্চারণ ও স্বরভঙ্গির ক্ষেত্রে সংশয় যেমন বহুগুণ বর্ধিত হল, তেমনই স্বরন্যাসের চরিত্রও আমূল পালটে গেল। পরস্পরের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত জনসাধারণ পাশাপাশি বসতি করে নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করল। এই পরিস্থিতির সুদূরপ্রসারী পরিণতি হল এই যে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যের বৈদিক ভাষা ব্রাহ্মণ শ্রেণির সীমাবদ্ধ অধিকারে পর্যবসিত হল। এঁরা বিভিন্ন কৌম ও গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দূতের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন (যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট কৌমের প্রতি তাঁরা আনুগত্য প্রকাশ করতেন না )। ব্রাহ্মণরা প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক আর্যভাষায় তাঁদের ধর্মানুষ্ঠান পরিচালনা করলেও, এটা ছিল সেই সময় (৫০০–২০০ খ্রিস্টপূর্ব) যখন বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তার ফলে বৈদিক ধর্ম ও তদনুগামী ভাষার মহিমা ক্রমশ খর্ব হয়ে পড়েছিল। এই ভাষাগত সংশয়দীর্ণ জটিলতার পরিবেশে পুরোহিত সম্প্রদায়কে তাঁদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। কিন্তু কঠোর ধর্মচর্যা ও প্রয়োজনীয় ভাষাগত প্রশিক্ষণের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অনীহার ফলে ভাষার ক্ষেত্রে সমস্যা নিশ্চিতই প্রবল সংকট সৃষ্টি করেছিল। পবিত্র বৈদিক সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষার ক্ষেত্রে সংকট-সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পুরোহিতরা সংরক্ষিত ঐতিহ্যকে বিধিবদ্ধ করার জন্য যত্নবান হয়ে উঠেছিলেন; আঞ্চলিক রূপভেদকে তাঁরা স্বাভাবিক ও কখনও কখনও অনুমোদনযোগ্য বিকল্প হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন।

প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের নামোল্লেখ (যাঁদের রচনা আমাদের কাছে পৌঁছয়নি) প্রমাণ করে যে, বৈদিক সাহিত্যের অন্তিম পর্যায়ের সময় থেকে কথ্যভাষা ক্রমাগত প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় শেষোক্ত ভাষা অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে; যে-সমস্ত বিশেষজ্ঞের তত্ত্ব উপযুক্ত নমনীয়তা ও ব্যাপকতার জন্যে নিজেদের চিন্তাধারায় বিভিন্ন ভাষাগত রূপান্তরকে যথাযথ স্থান দিতে পেরেছে, শুধুমাত্র সেই সব গ্রন্থই নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। দ্ব্যর্থবিহীন স্পষ্টতার প্রয়োজনে সৃষ্ট সামঞ্জস্যবিধানের প্রবণতা বিভিন্ন প্রাতিশাখ্যে বিশেষজ্ঞের অভিমত দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই, যদিও আমরা প্রতিটি বেদের অনেক শাখা, এমনকী অনেক প্রাতিশাখ্যের কথাও শুনি, প্রত্যেক বেদের জন্য একটি মাত্র প্রাতিশাখ্যই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। সংক্ষেপে, বৈদিক আবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী ভাষাবিষয়ক নিয়মাবলি সূত্রে পরিণত হওয়া অনিবার্য; তাই এ ধরনের নূতন অর্ধ-লোকায়ত পদ্ধতির উদ্ভব ও বেদাঙ্গরূপে তাদের স্বীকৃতিলাভ সম্ভব হল।

নিরুক্ত

যাস্কের নিরুক্তই শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে পৃথিবীর প্রথমতম গ্রন্থ। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ থেকে ৫০০ অব্দের মধ্যে এর রচনাকাল বলে পণ্ডিতরা মোটামুটি একমত। অবশ্য, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি একে সংস্থাপিত করাই অধিক সম্ভব বলে মনে হয়। নিরুক্ত তিনটি কাণ্ড ও পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত। নৈঘন্টুক কাণ্ডরূপে পরিচিত প্রথম তিনটি অধ্যায়ে প্রতিশব্দ; নৈগম কাণ্ড বা ঐকপদিকরূপে অভিহিত চতুর্থ অধ্যায়ে সমার্থক শব্দ; এবং দৈবত কাণ্ড-রূপে পরিচিত পঞ্চম অধ্যায়ে বৈদিক দেবতাদের নামের ব্যুৎপত্তি আলোচিত হয়েছে। ঐকপদিক-এ আলোচিত শব্দসমূহের অধিকাংশ ঋগ্বেদের চূড়ান্ত পর্যায়ের রচনা থেকে সংগৃহীত। নৈঘণ্টুক-এর তিনটি অধ্যায়ের প্রথমটিতে বায়ু, জল, পৃথিবী, ইত্যাদির মতো ভৌত উপাদান; দ্বিতীয়টিতে মানুষ, তার দেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আবেগ, প্রভৃতি এবং তৃতীয়তে মূলত দেবতা ও তৎসংসৃষ্ট কিছু বিমূর্ত ধারণাসমূহ আলোচিত হয়েছে। নিরুক্ত-র দুটি অর্ধে মোট বারোটি পরিচ্ছেদ; প্রথম ছ’টি পরিচ্ছেদে নৈঘন্টুক-এর প্রথম দুটি কাণ্ড এবং শেষের ছ’টি পরিচ্ছেদে দৈবত কাণ্ড ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রতি অর্ধে মৌলিক বিধি ও আলোচ্য বিষয়ের পরিধি সম্পর্কে সাধারণ ভূমিকা রয়েছে; তাতে সম্ভবত রচনার দুটি স্তরের মধ্যবর্তী ব্যবধান আভাসিত।

নিরুক্ত ব্যাকরণ ব্যুৎপত্তির কাঠামো ও আঙ্গিকগত দিক সম্পর্কে অবহিত; অন্য দিকে এতে শব্দের অর্থান্তর-সংক্রমণের তত্ত্বও বিশ্লেষিত হয়েছে। বহুলাংশে কাল্পনিক এবং অবাস্তব হলেও ব্রাহ্মণসাহিত্যে এবং নিতান্ত প্রাথমিক রূপে ঋগ্বেদেও ব্যুৎপত্তির দেখা পাওয়া যায়। যাস্ক তাঁর গ্রন্থে অন্তত ষোলোজন পূর্বসূরি শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত উল্লেখ করেছেন। এতে মনে হয়, যাস্কের কয়েক শতাব্দী পূর্বেও ব্যুৎপত্তি শাস্ত্র অনুশীলিত হত। আমরা দেখেছি যে, ছদ্মযুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তিতে শব্দের অর্থসংক্রমণগত উৎস নির্ধারণের প্রথম অনুমাননির্ভর প্রচেষ্টার নিদর্শন পাওয়া যায় ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে। যাস্ক তাঁর পূর্বসূরী হিসাবে সংহিতা (সবগুলি শাখায় বিন্যস্ত রূপে), ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও প্রাতিশাখ্যগুলিকে পেয়েছিলেন। এ সব রচনা থেকে তিনি উপাদান আহরণ করেছিলেন এবং এগুলির উপর ভিত্তি করেই নিজস্ব বক্তব্য গঠন করেছিলেন। সে যুগে বেদাধ্যয়ন যে পরিশীলিত স্তরে উপনীত হয়েছিল, তা বেদ বিষয়ক চিন্তার বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে যাস্কের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয়: যাজ্ঞিক, বৈয়াকরণ, নৈদান ও ঐতিহাসিক এর উদাহরণ। বৈদিক মন্ত্রগুলিকে যিনি অর্থহীন বলে মনে করতেন, সেই কৌৎসের অভিমত সম্পর্কে নিরুক্ত-র আলোচনা (১:১৫) কিংবা ঐতিহাসিক পক্ষের অস্তিত্ব (৩:১২) থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, বস্তুবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছিল।

নিরুক্ত গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিলুপ্ত শব্দের তালিকার উপর ভাষ্য; একটি পৃথক শব্দ-তালিকা রূপে যদি কখনও তার অস্তিত্ব থেকে থাকে, ভাষ্যকৃত শব্দগুলি থেকে এখন তার পুনর্নির্মাণ করা যেতে পারে। এই তালিকাকে ‘নিঘণ্টু’ বলা হত; তাই প্রথম অধ্যায় সম্পর্কে নৈঘটুক নামটি প্রযুক্ত হয়। মনে হয় যে নিঘণ্টু বলতে মূলত প্রতিশব্দ-বিষয়ক গ্রন্থই বোঝাত; পরবর্তিকালে অভিধার বৃত্তকে প্রসারিত সমার্থক শব্দ ও দেবনামকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার কারণে প্রবল ভাবে সীমাবদ্ধ হয়েও যাস্ক নিরুক্ত-তে ব্যুৎপত্তি অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন; তিনি দৃঢ় ভাবে এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, শব্দসমূহের নির্বাচন সম্ভব, তবে এই অভিমতের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপের ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভট ব্যুৎপত্তির সন্ধান দিয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে কোনও মূল ধাতু থেকেই ব্যুৎপত্তি সন্ধানের প্রবণতার ফলে তিনি ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন; অনুরূপ ভাবে একটি দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ব্যুৎপত্তি অনুশীলন প্রক্রিয়ার অভাবের ফলে শব্দের বহুমুখী নির্বাচন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এই সব ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও যাস্ক একটি বিস্ময়কর সতর্ক ও যুক্তিনিষ্ঠ মনের পরিচয় দিতে পেরেছেন; তিনি বিরোধীপক্ষের সম্পূর্ণ প্রতিবাদী অভিমতকেও স্বীকৃতি দিতে ইতস্তত করেননি; ফলত, তাঁর মূলগত ভাবে নৈর্ব্যক্তিক অবদানের মূল্য বহুগুণ বর্ধিত হয়েছে। যাস্ক-র বিশ্বাস, ব্যুৎপত্তি কখনওই অর্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়; কারণ নিছক ব্যাকরণের নিয়ম কোনও শব্দের উৎস নির্ণয়ে সফল না হলেও শব্দার্থ পরিবর্তনগত অনুষঙ্গকে অবলম্বন করে আমরা সেই শব্দের সম্ভাব্য উৎসস্থলে উপনীত হতে পারি। তাই যাস্ক সর্বদা ব্যুৎপত্তি নির্ণয় প্রক্রিয়াকে শব্দাথ-পরিবর্তন তত্ত্ব ও শাব্দিক প্রসঙ্গে সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।

যাস্ক চার ধরনের পদকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন: নাম (বিশেষ্য, বিশেষণ ও সর্বনাম), আখ্যাত (ক্রিয়া), উপসর্গ ও নিপাত (অব্যয়); এ আলোচনায় তিনি আশ্চর্য স্পষ্টতা ও বিজ্ঞানসম্মত ঋজুতার পরিচয় দিয়েছেন। কখনও কখনও যেন সেই সব ধ্বনিতাত্ত্বিক নিয়মের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, যেগুলি পরবর্তিকালে পাণিনি তাঁর ব্যাকরণে ব্যবহার করেছিলেন; কখনও বা কোনও ব্যুৎপত্তিতে বহু সম্ভাব্য ধাতুর সম্পর্ক নির্ণয় করে তিনি তার বিষয়বস্তুতে আশ্চর্য অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রেখেছেন। তাত্ত্বিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে তিনি বহু ভাষাতাত্ত্বিক প্রবণতাকে উপভাষার প্রভাব ও আঞ্চলিক চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য এবং তৎপ্রসূত ভাষাগত সংমিশ্রণের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। যে সব ক্ষেত্রে তিনি সমন্বয়সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেও আমাদের বিবেচনার জন্য বহু তাৎপর্যপূর্ণ সূত্র রেখে গেছেন। যাস্ক স্পষ্টতই বহু বৈয়াকরণ ও ব্যুৎপত্তিবিদের দীর্ঘায়ত ঐতিহ্যের পরিণত পর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর নিজস্ব অবদান এত অসামান্য ছিল যে, তা পূর্বসূরীদের কীর্তিকে সম্পূর্ণ ম্লান করে দিয়েছিল। নিরুক্ত-র ভাষার মধ্যে বৈদিক ভাষার বিবর্তনের নিদর্শন স্পষ্ট; তাই যাস্ক বহু বৈদিক শব্দকে ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে পরবর্তী অধিকতর প্রচলিত রূপের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।

ব্যুৎপত্তি শাস্ত্রের অন্যতম প্রাচীনতর বিশেষজ্ঞ শাকটায়ন মনে করতেন যে, সমস্ত বিশেষণকে ধাতু থেকে নিষ্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু ব্যুৎপত্তিবিদরূপে যাস্ক অধিকতর ভারসাম্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন, এ ধরনের চরম অভিমতকে সমর্থন করেননি। তাছাড়া কৌৎসের বক্তব্যকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু আবার, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেও যে কৌৎস বৈদিক মন্ত্রসমূহকে অর্থহীন বলে ঘোষণা করে মৌলিক প্রতিবাদী চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তা আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে।

জ্যোতিষ

বৈদিক যুগে রচিত জ্যোতিষ-সংক্রান্ত কোনও গ্রন্থ আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়নি; এ-সম্পর্কে যজুর্বেদই একমাত্র উৎস হিসাবে গণ্য। অবশ্য লগধ প্রণীত জ্যোতিষ-বেদাঙ্গ বা বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়; এর প্রচলিত দুটি পাঠই পদ্যে বিন্যস্ত। ঋগ্বেদীয় পাঠে ছত্রিশটি এবং যজুর্বেদীয় পাঠে তেতাল্লিশটি শ্লোক পাওয়া যায়। উভয় পাঠেই নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে: উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সময়ে সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থান, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সঠিক সময়, সাতাশটি চান্দ্র আবর্তনের স্থিতি এবং এ-সব গণনার নিয়মাবলি। অবশ্য জ্যোতির্বদ্যা সম্পর্কে এই আগ্রহ তখনও পর্যন্ত বিশুদ্ধ বিদ্যাচর্চার প্রয়াস হয়ে ওঠেনি; যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযোগী যথার্থ সময় নির্ণয়ের উদ্দেশে যজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণসাহিত্যে নক্ষত্রের অবস্থানের উল্লেখ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এগুলির মধ্যে দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল, যা কয়েক শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধতর অভিব্যক্তি অর্জন করেছিল। এ ছাড়া কৃষকদের পক্ষে বিশেষ সহায়ক নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার পক্ষে এ শাস্ত্র অত্যন্ত সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

প্রাচীন সংস্কৃতিগুলিতে জ্যোতির্বিদ্যার উন্নতি বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে; বর্ষপঞ্জি চিন, ব্যাবিলন ও মিশরে যাজকশ্রেণির প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত হয়েছিল, কেননা এর সাহায্যে সে সব দেশের মানুষ যজ্ঞানুষ্ঠানের পক্ষে সঠিক সময় নির্দেশ করতে পারত। কৃষকসমাজ একে সাদরে গ্রহণ করেছিল, কারণ এর সাহায্যে বৃষ্টিপাত সম্পর্কে যথার্থ ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হল; এতে যাজকশ্রেণির পুঁথিপত্রের গৌরব আরও বর্ধিত হল এবং আপাত-দুর্বোধ্য কলাশাস্ত্র ও বিজ্ঞানের অনুশীলনের যথার্থতাও প্রমাণিত হল।

বিবিধ সূত্র

প্রধান বেদাঙ্গ গ্রন্থগুলি রচিত হওয়ার পরেও বহুসংখ্যক সহায়ক গ্রন্থ প্রণীত হয়েছিল; এদের প্রধান বিষয়বস্তু হল প্রকৃত যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে উদ্ভুত সমস্যাসমূহ এবং প্রাচীনতর রচনাগুলিতে আলোচিত বিষয়, যথা, বৌধায়ন, গৌতম ও হিরণ্যকেশী প্রণীত পিতৃমেধসূত্রগুলি, শৌনক পৈপ্পালাদ, কাত্যায়ন ও মানব শ্রাদ্ধকল্পগুলি, আশ্বলায়ন ও বৌধায়ন প্রণীত পরিশিষ্টসমূহ, গোভিলের কর্মপ্রদীপ, গোভিলপুত্রের গৃহ্যাসংগ্রহ, অর্থবপরিশিষ্ট। শৌনকের বৃহদ্দেবতা গ্রন্থ দেবতা ও প্রত্নকথাসমূহের সংক্ষিপ্তসার; তাঁর ঋগ্বিধা একটি মিশ্রবিষয়যুক্ত অর্বাচনী রচনা। এরূপ সম্পূরক গ্রন্থ প্রণয়নের ঐতিহ্য নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই চলছিল; ফলে আমরা বেশ কিছু অনুক্রমণী পেয়েছি, যেখানে ঋষি, ছন্দ ও দেবতার নাম এবং গ্রন্থবিভাগের বিস্তৃত বিবরণের শ্রেণিবদ্ধ সূচিপত্র হয়েছে। শৌনক ছটি ঋগ্বেদীয় অনুক্রমণীর রচয়িতা এবং কাত্যায়ন বিখ্যাত সর্বানুক্রমণী-র প্রণেতা। এই গ্রন্থসমূহ বৈদিক ঐতিহ্যের সমাপ্তি সূচিত করছে; এর পরবর্তিকালে যা কিছু রচিত হল, তা মূলত এই ঐতিহ্য থেকে স্বতন্ত্র— পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতির উপযোগী, রূপান্তরসাধনের প্রয়োজনে সে সব গ্রন্থ প্রচুর অবৈদিক উপাদান আত্মসাৎ করেছিল।

যে চার বা পাঁচ শতাব্দী ধরে ছন্দোবদ্ধ রচনা ক্রমোন্নতি লাভ করেছিল, বৈদিক ছন্দশাস্ত্রও সে সময় ক্রমশ জটিল হয়ে উঠল। এ-বিষয়ে দুটি রচনা পাওয়া যায়: নিদানসূত্র ও পিঙ্গলছন্দঃ সূত্র। নিদানসূত্রের প্রথম দশটি প্রপাঠক সামবেদের সঙ্গে সম্পর্কিত: এখানে মুখ্যত উথ, স্তোম, গান, প্রভৃতি সামবেদীয় বিষয়ই বিবৃত হয়েছে; কারও কারও মতে এই অংশ পতঞ্জলির রচনা। এর ভাষা কৌতূহলজনক, কারণ, এতে নিহিত ব্যাকরণের চরিত্র কতকটা অদ্ভুত। বৃহদ্দেবতা গ্রন্থে সে সমস্ত শ্লোক নিদানসূত্র থেকে উদ্ধৃত বলে বর্ণিত হলেও নিদানসূত্রে কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। এই গ্রন্থে বিবৃত সমস্ত ছন্দই বৈদিক। কিন্তু পিঙ্গলছন্দঃসূত্র অর্বাচীন রচনা। এর দুটি পাঠভেদ ঋগ্বেদ ও সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বৈদিক ছন্দের পাশাপাশি কিছু কিছু বেদোত্তর অর্থাৎ ধ্রুপদী ছন্দও এতে আলোচিত হওয়ায়, গ্রন্থে অর্বাচীনতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে; পিঙ্গলকেই এর রচয়িতা বলে বলা হয়।

কল্পসূত্র

সূত্র সাহিত্যের ছ’টি শ্রেণির মধ্যে কল্পসূত্রগুলি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কল্পসূত্রগুলি আবার চার ভাগে বিন্যস্ত: শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শুল্ক। এদের মধ্যে বেদের সঙ্গে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পর্কিত হল শ্রৌত সূত্র; প্রধান, বিশেষত সামূহিক ভাবে পালনীয়, যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির বিভিন্ন অনুপুঙ্খ এতে বিবৃত হয়েছে। শ্রৌতসূত্রে আলোচিত অনুষ্ঠানগুলি মুখ্যত তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়:

(ক) নিত্য অর্থাৎ আবশ্যিক অনুষ্ঠান— প্রাত্যহিক ও সাময়িক; যেমন, অগ্নিহোত্র ও দর্শপূর্ণমাস; আর্য পুরুষকে সমগ্র জীবনব্যাপী এই অনুষ্ঠানগুলি পালন করতে হত;

(খ) নৈমিত্তিক অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ সময়ে পালনীয় অনুষ্ঠান যেমন রাজসূয়, বাজপেয়;

এবং

(গ) কাম্য অর্থাৎ পুত্র, গোধন, বৃষ্টিপাত, বিজয়লাভ প্রভৃতি বিশেষ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অনুষ্ঠান।

যজ্ঞের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় মনে হয় যে, শ্রৌতসূত্রগুলি বিভিন্ন পুরোহিত পরিবারেই উদ্ভূত হয়েছিল এবং সম্ভবত এগুলি প্রাচীনতম সূত্র-সাহিত্যের নিদর্শন। প্রতি বেদে, এমনকী তার প্রতি শাখায় যজ্ঞসম্পাদক পুরোহিতদের নিজস্ব শ্রৌতসূত্র ছিল। ঋগ্বেদের দুটি শ্রৌতসূত্র ছিল: আশ্বলায়ন ও শাঙ্খায়ন। অধিকাংশ শ্রৌতসূত্রের অধ্যায়গুলি ‘প্রশ্ন’ নামে অভিহিত; তাই অনুমান করা যায় যে, এই গ্রন্থগুলি যজ্ঞের যথার্থ পালন-বিধি সংক্রান্ত শিক্ষানবীশ পুরোহিতের প্রশ্ন ও শিক্ষকের উত্তর প্রত্যুত্তর প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। অবশ্য প্রচলিত পাঠে এখন আর এই দান্দ্বিক আঙ্গিক খুঁজে পাওয়া যায় না, কেননা সম্ভাব্য প্রশ্নসমূহ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে; তবে উৎসগত বিচারে প্রাগুক্ত আঙ্গিক ও অব্যবহিত পূর্ববর্তী উপনিষদ সাহিত্যের সঙ্গে শ্রৌতসূত্রের নিবিড় সাদৃশ্য রয়েছে।

আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রে বারোটি অধ্যায় আছে। বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রের নামকরণ শিক্ষকের নামে হয়েছিল, কিন্তু আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের ক্ষেত্রে ছাত্রের নামই রয়েছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রকৃত রচয়িতা যদিও শৌনক, তিনি তাঁর শিষ্য আশ্বলায়নের নামে রচনাটিকে পরিচিত হতে অনুমতি দিয়েছিলেন, হয়তো আশ্বলায়ন কিছু পরিমার্জন করেছিলেন। অশ্বমেধ, প্ৰবৰ্গ ও রাজসূয় ব্যতীত প্রায় সমস্ত প্রাচীনতর ও প্রধান যজ্ঞানুষ্ঠান এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে; তা ছাড়া এতে হোতা, মৈত্রাবরণ, অচ্ছাবাক ও গ্রাবষ্টুদের মতো ঋগ্বেদীয় পুরোহিত এবং অথর্ববেদীয় পুরোহিত ব্রহ্মা ও যজমানের কর্মপদ্ধতি সংক্রান্ত নিয়মাবলি বিবৃত হয়েছে। অন্যান্য অর্বাচীন শ্রৌতসূত্রের মতো আশ্বলায়নে মন্ত্রবিশ্লেষণের সাধারণ নিয়মাবলি সংক্রান্ত পৃথক ‘পরিভাষা’ অধ্যায় নেই; এ ধরনের নিয়ম গ্রন্থের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে এবং প্রসঙ্গ অনুযায়ী এদের আবির্ভাব ঘটেছে। নিয়মগুলি জটিল, তাই রচনাও দুরূহ।

শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র আশ্বলায়ন অপেক্ষা প্রাচীনতর এবং ঋগ্বেদের বাঙ্কল শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু আশ্বলায়ন শাকল ও বাঙ্কল— এই উভয় শাখার সঙ্গে সম্পর্কিত; শঙ্খ পরিবারভুক্ত সুযজ্ঞ আলোচ্য গ্রন্থের রচয়িতা। সতেরোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত শাঙ্খায়নে শ্রৌতসূত্রে সবগুলি নিবিদ বিবৃত হয়েছে। (৮:১৬-২৩) শেষ দুটি অধ্যায়ে আলোচিত মহাব্রত অনুষ্ঠানটি পরবর্তিকালে সংযোজিত; একই শাখার আরণ্যকে বিন্যস্ত অনুরূপ অধ্যায়টির নিবিড় অনুসরণ এখানে স্পষ্ট। শাঙ্খায়নের অবশ্য একটি পৃথক পরিভাষা আছে। আশ্বলায়নের তুলনায় এই গ্রন্থে অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক যজ্ঞ আলোচিত হলেও এর তালিকায় কয়েকটি অনুষ্ঠান যুক্ত হয়েছে, যা থেকে আমরা প্রাচীন যজ্ঞের কিছু কিছু নূতন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হই। পুরুষমেধ সম্পর্কে এই গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ ও বিবিধ অনুপুঙ্খযুক্ত অংশ রয়েছে; তবে স্পষ্ট বোঝা যায়, বহু পূর্বেই অনুষ্ঠানটি অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিল। ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে ব্রাহ্মণসাহিত্যের সঙ্গে এর প্রবল সাদৃশ্য স্পষ্ট, এতেও গ্রন্থটির অধিকতর প্রাচীনতা প্রমাণিত হয়।

তৈত্তিরীয় সংহিতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু শ্রৌতসূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়; পুরোহিতের কার্যকলাপের সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত বিধিগ্রন্থের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, বিশেষ ভাবে, বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ভূত বিভিন্ন শাখার আনুষ্ঠানিক কর্মপদ্ধতি পরস্পর ভিন্ন হতে বাধ্য তৈত্তিরীয় শাখার শ্রৌতসূত্রগুলির সময়ানুক্রমিক তালিকা এ ভাবে দেওয়া যায়: বৌধায়ন ও বাধুল; তার পর ভরদ্বাজ, আপস্তম্ব, সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী এবং শেষে বৈখানস।

আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র ত্রিশটি প্রশ্ন বা অধ্যায়ে বিন্যস্ত একটি প্রাচীন গ্রন্থ। এতে প্রায় সমস্ত প্রধান যজ্ঞানুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে; এগুলির মধ্যে সৌত্রামণী, বাজপেয়, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও সর্বমেধের মতো নবীনতর অনুষ্ঠানও আছে। পিতৃপুরুষের তালিকা-সহ একটি পৃথক পরিভাষা অংশ, মন্ত্রসংগ্রহ এবং হোতৃশ্রেণির পুরোহিতের কর্মপদ্ধতি এখানে বিবৃত হয়েছে। অন্য শ্রৌতসূত্রগুলির তুলনায় এটি পূর্ণতর এবং প্রকৃতপক্ষে একটি সম্পূর্ণ কল্পসূত্র; কারণ এর একটি করে গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্বসূত্র আছে। তৈত্তিরীয় শাখার ভরদ্বাজ শ্রৌতসূত্রের সঙ্গে আলোচ্য আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্রের প্রভূত সাদৃশ্য সুস্পষ্ট। এটা আরও কৌতূহলপ্রদ, কারণ অন্য সহযোগী রচনা থেকে ঋণ গ্রহণে এর কুণ্ঠা নেই।

ত্রিশটি প্রশ্নে বিন্যস্ত বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র সম্ভবত প্রাচীনতম; বাধুল সম্ভবত একই যুগ কিংবা সামান্য পরবর্তিকালের রচনা। বৌধায়নে আলোচিত বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে প্রধান যজ্ঞগুলি এবং প্রবর্গ ও অশ্বমেধ এবং কয়েকটি অপরিচিত বিষয়। স্পষ্টতই এটি এমন যুগে রচিত যখন শ্রৌতবিষয়ক মুখ্য রচনাংশেই এমন সমস্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছিল যা পরবর্তী পর্যায়ে পৃথক সহায়ক রচনাসমূহে স্থান পেয়েছিল। তাই এতে কর্মান্ত অনুষ্ঠান, প্রায়শ্চিত্ত ও প্রবর-তালিকা সম্বলিত বিভিন্ন অংশ এবং শুল্কসূত্রের উপযোগী একটি অংশ পাওয়া যায়। রচনা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রচলিত গ্রন্থটি একাধিক লেখকের রচনা; বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির রচনারীতির নিদর্শন রয়েছে। এই প্রাচীন গ্রন্থে অনেক প্রাচীনতর বিশেষজ্ঞদের অভিমত উদ্ধৃত হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, শ্রৌতসূত্রগুলি রচনার পশ্চাতে সুদীর্ঘ একটি ইতিহাস রয়েছে। তৈত্তিরীয় সংহিতার উল্লেখ থাকায় মনে হয় সূত্র রচিত হওয়ার পূর্বেই এই সংহিতা তার প্রচলিত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অবশ্য কাঠক সংহিতার সঙ্গেই এই সূত্রের সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। লিপিগত সাক্ষ্য থেকে মনে হয় বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র দক্ষিণাঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল। সম্ভবত দক্ষিণাঞ্চলের পাণ্ডুলিপি রাণায়নীয় ও উত্তরাঞ্চলের পাণ্ডুলিপি কৌথুম শাখার পাঠ আমাদের কাছে পৌঁছেছে।

তৈত্তিরীয় শাখার দীর্ঘতম শ্রৌতসূক্ত হল সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী রচিত গ্রন্থ। ঊনচল্লিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বহু সূত্র উভয়ের মধ্যে সাধারণ। বিষয়বস্তুর তালিকাটি দীর্ঘ এবং একটি পৃথক পরিভাষা অংশ এর প্রথম অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। অর্বাচীনতর যজ্ঞসমূহের মধ্যে প্রবর্গ, বাজপেয়, রাজসূয়, সৌত্রামণী, অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সর্বমেধ, মহাব্রত ও গবাময়ন এতে আলোচিত হয়েছে। চরক ও কৌকিলী নামক সৌত্রামণীর দুটি রূপভেদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। ‘সব’ যজ্ঞের নিয়মাবলি এতে বিবৃত; তা ছাড়া ভরদ্বাজ প্রণীত পিতৃমেধের বিশেষ রূপভেদও এতে রয়েছে। গৃহ্য, শুল্ক ও ধর্ম সূত্রের অন্তর্ভুক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য গ্রন্থটি ব্যাপক সূত্র ঐতিহ্যের অন্তর্গত।

পনেরোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বাধুল শ্রৌতসূত্র সূত্রসাহিত্যের প্রাচীনতম পর্যায়ের অন্যতম, সম্ভবত তা বৌধায়নের সমকালীন। অধ্যাপক কাশীকারের মতে গ্রন্থটি হয়তো তৈত্তিরীয় সংহিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না, এর সঙ্গে বিশেষ সাদৃশ্যযুক্ত অন্য কোনও পাঠভেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। পরিভাষা বিষয়ক কোনও পৃথক অধ্যায় এতে নেই; তবে প্রধান যজ্ঞগুলির বিবরণ ছাড়াও এতে ‘ব্রাহ্মণ’ নামক কয়েকটি অংশও রয়েছে (তুলনীয় পশুবন্ধ বা অগ্নিচয়ন ব্রাহ্মণ)। এতে একই সঙ্গে রচনাটির প্রাচীনত্ব এবং ব্রাহ্মণসাহিত্যের সঙ্গে কালগত সান্নিধ্য প্রমাণিত হচ্ছে। তাই একে আমরা সূত্রব্রাহ্মণের যুগলবদ্ধ রূপ হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। এই গ্রন্থে বাধুলের নাম স্পষ্ট ভাবে উল্লিখিত; পণ্ডিতরা মনে করেন যে, এটা প্রকৃতপক্ষে গোষ্ঠীনাম, যা যাস্ক ও ভৃগুদের সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে বদ্ধ ছিল। এই শ্রৌতসূত্রের লেখক আপস্তম্বের প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে আবির্ভূত হয়ে অগ্নিবেশ্যকে শিক্ষাদান করেছিলেন— অগ্নিবেশ্যের গৃহ্যসূত্র আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে। বাধুল শ্রৌতসূত্রের প্রাচীনতা নানা ভাবে প্রমাণ করা যায়; যেমন, রচনার মিশ্র সূত্র-ব্রাহ্মণ চরিত্র, বহু গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্তি, মন্ত্রের ব্যাপক সংগ্রহ এবং কোনও কিছুকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ না-করার মনোভাব- ঐতিহ্যগত নির্দেশগুলিকে সংক্ষিপ্ত ভাবে উল্লেখ না করে এটি প্রতিটি অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছে।

বৈখানস শ্রৌতসূত্র ‘ঔখীয়সূত্র’ নামেও পরিচিত; একুশটি প্রশ্নে বিন্যস্ত এই রচনাটি তৈত্তিরীয় শাখার অপর প্রধান সূত্র। কোনও কোনও পাণ্ডুলিপিতে গৃহ্যসূত্র শ্রৌতসূত্রকে অনুসরণ করেছে; ওই গৃহ্যসূত্রে এগারোটি প্রশ্ন রয়েছে। একটি পরিভাষা অধ্যায় ছাড়াও তাতে বহু প্রধান যজ্ঞানুষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রয়েছে; তবে অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সর্বমেধ বা রাজসূয়ের মতো অর্বাচীন যজ্ঞসমূহ আলোচিত হয়নি। সোমযাগগুলির উপর প্রধান গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। ইষ্টি ও সোমের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ক দুটি অংশ এতে রয়েছে, সেগুলিই এর শেষ দুটি অধ্যায়। তৈত্তিরীয় শাখার মধ্যে বৈখানস শ্রৌতসূত্র যে অর্বাচীনতম রচনা, তা এর সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকেই প্রমাণিত। এটা স্পষ্টত বৈষ্ণব ধারার গ্রন্থ; এতে নারায়ণের স্তুতি এবং নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী ভস্ম দিয়ে ললাট চিহ্নিত করার বিশেষ বৈষ্ণবীয় আচারের বিবরণ আছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, গার্হপত্য অগ্নি থেকে আহরণ করতে হত ভস্ম। সম্প্রদায়কেন্দ্রিক পৌরাণিক বিশ্বাস যে ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে, তা নিম্নোক্ত প্রতিশ্রুতিতে স্পষ্ট: ‘এই ভস্ম-চিহ্ন যে ব্যবহার করে সে পূণ্য অর্জন করে শেষ পর্যন্ত পরমাত্মার সঙ্গে সম্মিলিত হয়’। মনে হয়, একদা এই শাখার জন্য একটি পৃথক ব্রাহ্মণ ছিল; কিন্তু পরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বৈখানস নিজস্ব মন্ত্রসংহিতার অস্তিত্বকে অনুমান করে নিয়েছে, তবে তার সমগ্র রূপটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি। এর ভাষা ব্রাহ্মণসাহিত্যে প্রযুক্ত গদ্যের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরী, তাই বহু দুর্বোধ্য ও ত্রুটিপূর্ণ রীতির অস্তিত্ব তার বৈশিষ্ট্য সূচিত করছে।

পনেরোটি প্রশ্নে বিন্যস্ত সংক্ষিপ্ত ভরদ্বাজ শ্রৌতসূত্র মাত্র দশটি যজ্ঞ আলোচনা করেছে। জ্যোতিষ্টোম ছাড়া অন্য কোনও সোমযাগ এতে আলোচিত হয়নি; তবে এতে অধ্বর্ষ শ্রেণির পুরোহিতদের ভূমিকা সম্পর্কে একটি এবং পূর্বানুমিত প্রায়শ্চিত সম্পর্কে আরেকটি অংশ রয়েছে। সম্ভবত মূল গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ রূপটি আমাদের কাছে পৌঁছয়নি, কারণ পরবর্তী সাহিত্যে আরও কিছু যজ্ঞ সম্পর্কে ভরদ্বাজ শ্রৌতসূত্রের এমন সব বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে, যা প্রচলিত পাঠে পাওয়া যায় না। এ রকম একটি যজ্ঞ হল অশ্বমেধ। কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এই রচনার সঙ্গে বৌধায়ন শ্রৌতসূত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

কাঠক শ্রৌতসূত্রের পাঠটি নামমাত্রে পর্যবসিত; কারণ এর সামান্য কিছু অংশই মাত্র আমাদের কাছে পৌঁছেছে— রচনার বিপুল অংশই এখনও বিলুপ্ত। এ রকম একটি প্রচলিত অংশে আমরা পিণ্ডপিতৃযজ্ঞের যে নির্দেশাবলি পাই, তাতে শ্রৌতসূত্রে আলোচিত হওয়ার যৌক্তিকতা সংশয়াতীত নয়, কেননা গৃহ্যসূত্রেই এগুলি অধিক মানানসই।

মৈত্রায়ণী শাখায় দুটি শ্রৌতসূত্র রয়েছে: মানব ও বরাহ। মানব শ্রৌতসূত্র নানা ভাবে পরিচিত: মানব মৈত্রায়ণীয় বা শুধু মৈত্রায়ণীয়। এর একুশটি অধ্যায়ে বহু প্রধান যজ্ঞ আলোচিত হয়েছে; কিছু কিছু অংশে বিচিত্র বিষয়বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যযুক্ত কিছু কিছু বৈষ্ণব অনুষ্ঠান এবং গোনামিক ও অনুগ্রাহিক। এছাড়া এতে আছে পিতৃপুরুষের একটি তালিকা, একটি পরিশিষ্ট, শ্রাদ্ধবিষয়ক একটি অংশ এবং একটি সংশ্লিষ্ট শুল্বসূত্র।

বারাহ শ্রৌতসূত্র নামক অর্বাচীন রচনাটি তেরোটি অধ্যায়ে ও তিনটি পৃথক অংশে বিন্যস্ত। কয়েকটি প্রধান যজ্ঞের সঙ্গে (এদের মধ্যে সোমযাগের বিবিধ রূপভেদই প্রধান) মহাব্রত এবং উৎসর্গিণাম্ অয়ন ও একাদশিনী-র মতো অপ্রচলিত অপ্রধান অনুষ্ঠানও এতে আলোচিত হয়েছে। মানব শ্রৌতসূত্রের সঙ্গে এর নিবিড় সাদৃশ্য লক্ষণীয়; একমাত্র পার্থক্য এই যে, বারাহে পরিভাষা অংশ অনুপস্থিত। এর শব্দভাণ্ডারে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়; এতে এমন কিছু শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে, যা অন্য কোনও সূত্র গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

বাজসনেয়ী শাখার কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন— এই উভয় পাঠে একটিমাত্র শ্রৌতসূত্র রয়েছে; কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র; এর সঙ্গে তৎসংশ্লিষ্ট গৃহ্যসূত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, যদিও সেই গৃহ্যসূত্রের নামকরণে কাত্যায়ন অনুপস্থিত। এই শাখার গৃহ্যসূত্রকে পারস্কর গৃহ্যসূত্র বলা হয়। পারস্কর সম্ভবত কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রেরও রচয়িতা, কারণ এই সূত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাত্যায়ন এবং সর্বানুক্রমণীয় রচয়িতা অভিন্ন নন। এতে পরিভাষা সম্পর্কে একটি পৃথক অধ্যায়, বিভিন্ন গোষ্ঠীর পিতৃপুরুষের একটি তালিকা এবং কৌকিলী, সৌত্রামণী, পিতৃমেধ ও দাক্ষায়ণ যজ্ঞের মতো কিছু কিছু স্বল্প প্রচলিত অনুষ্ঠানের বিবরণ আছে। বাজসনেয়ী সংহিতা ও শতপথ ব্রাহ্মণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ; যদিও এমন কিছু অনুষ্ঠান এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা সংহিতায় পাওয়া যায় না, তবু সূত্রটি প্রাগুক্ত সংহিতাকে বিশ্বস্ত ভাবে অনুসরণ করেছে।

সামবেদের পাঁচটি শ্রৌতসূত্র আমাদের কাছে পৌঁছেছে: লাট্যায়ন, দ্রাহ্যায়ণ, জৈমিনীয়, আর্যেয়কল্প ও নিদানসূত্র। লাট্যায়ন ও দ্রাহ্যায়ণ— এই দুটিকেই কৌথুম ও রাণায়নীদের দশটি শ্রৌতসূত্রের তালিকার মধ্যে পাওয়া যায়। এই দুটি গ্রন্থ নিশ্চিতই প্রাচীনতর, যেহেতু নিজেদের শাখায় এগুলি প্রথম সূত্র। লাট্যায়ন দশটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত; প্রতিটি প্রপাঠক আবার বারোটি করে কণ্ডিকায় বিভক্ত। সামবেদীয় রচনারূপে এতে প্রধানত উদ্গাতা শ্রেণির পুরোহিত ও তাঁর সহায়কদের দায়িত্ব এবং সোমযাগে ব্রহ্মা শ্রেণির পুরোহিতদের কর্মপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। এতে কয়েকটি অনুষ্ঠান বিবৃত হলেও এই সব যজ্ঞে গীত মন্ত্ৰসমূহই প্ৰধান বিবক্ষিত বস্তু। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের প্রচুর উদ্ধৃতি এই সূত্রে রয়েছে। বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতিতে বহু প্রাচীন বিশেষজ্ঞদের নাম উল্লিখিত হওয়ার ফলে এই গ্রন্থের পশ্চাদবর্তী দীর্ঘ ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা অবহিত হই।

দাহ্যায়ণ শ্রৌতসূত্রের রূপটি স্পষ্ট নয়; কারণ এর বত্রিশটি পটলের মধ্যে মাত্র পনেরোটি এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি পটল আবার চার খণ্ডে বিন্যস্ত। মোট সাতটি যজ্ঞ এতে বিবৃত হয়েছে, মূলত এগুলি হল সোমযাগের রূপভেদ। লাট্যায়ন ও দ্রাহ্যায়ণ একই বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়েছে বলে এবং ভাষারীতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক নিবিড় সাদৃশ্যযুক্ত হওয়াতে এদের একটি অভিন্ন গ্রন্থের সামান্য ভেদযুক্ত দুটি শাখা হিসাবে গণ্য করা হয়। অবশ্য, এদের মধ্যে লাট্যায়ন সংবদ্ধতর এবং দ্রাহ্যায়ণে প্রাপ্ত অনুষ্ঠানতত্ত্ব অংশ প্রথমোক্ত গ্রন্থে বর্জিত হয়েছে বলে বিশুদ্ধতর পাঠ এতে সংরক্ষিত।

জৈমিনীয় শ্রৌতসূত্র একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ; এতে মাত্র বিশটি খণ্ড আছে। অগ্নিচয়ন অনুষ্ঠানে গীত সামমন্ত্রগুলি বিবৃত হওয়ার পরেই রয়েছে প্রবর্গ অনুষ্ঠান বিষয়ক একটি পৃথক অংশ। মন্ত্র-গানের ক্রম বর্ণনার ক্ষেত্রে জৈমিনীয় বৌধায়নকে অনুসরণ করেছে।

চোদ্দোটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত আর্যেয়কল্প মশক কল্পসূত্র নামেও পরিচিত; আবার, শেষ তিনটি প্রপাঠক নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্ৰসূত্র। এই গ্রন্থের রচয়িতা মশক এবং তা নিশ্চয়ই লাট্যায়ন ও দ্রাহ্যায়ণ অপেক্ষা প্রাচীনতর, যেহেতু এই দুটি গ্রন্থের নিকট অর্যেয়কল্প পরিচিত ছিল। এতে যে আটটি যজ্ঞ আলোচিত হয়েছে মূলত সে সব সোমযোগেরই রূপভেদ; এই যজ্ঞগুলিতে গীত সামমন্ত্রের তালিকা ছাড়াও প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ে একটি অংশও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণকে নিবিড় ভাবে অনুসরণ করেছে; অবশ্য দ্বিতীয়োক্ত রচনায় যে সব অনুষ্ঠান বিশদ ভাবে আলোচিত হয়েছে, সে সব এতে বর্জিত হয়ে গেছে। যে গ্রামগেয়, আরণ্যগেয়, ঊহ, ঊহ্য গানগুলি আর্যেয়কল্পে প্রদত্ত সামমন্ত্রের ক্রমকে অনুসরণ করেছে বলে মনে হয়, তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ যোগসূত্র রয়েছে। এই গ্রন্থ মোটামুটি ভাবে সুসংবদ্ধ, পুনরাবৃত্তির প্রবণতা থেকেও মুক্ত। ক্ষুদ্রসূত্রের নামকরণের সম্ভাব্য কারণ হল রচনার সংক্ষিপ্ততা; এতে মাত্র তিনটি অধ্যায় আছে। পরবর্তিকালের সামবেদীয় সহায়ক রচনাগুলিতে এটি এই বর্ণনাত্মক নামেই পরিচিত ছিল। উপগ্রন্থসূত্র নামক কাত্যায়ন রচিত ক্ষুদ্রসূত্রের অংশবিশেষ প্রতিহার নামক সামমন্ত্রের বিশেষ একটি শ্রেণি ব্যাখ্যাত হয়েছে। ভাষাগত বিচারে একে আর্যেয়কল্প অপেক্ষা প্রাচীনতর বলে মনে হয়।

দশটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত নিদানসূত্র প্রকৃতপক্ষে আর্যেয়কল্প গ্রন্থের পাঠান্তর; সামবেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণসমূহ এর প্রত্যক্ষ পূর্বসূরি। গৌতম তাঁর পিতৃমেধসূত্র গ্রন্থে আলোচ্য রচনার যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাতে নিদানসূত্রের রচয়িতারূপে পতঞ্জলির নাম উল্লেখিত হয়েছে। রাণায়নীয় বা কৌথুম শাখার পাঠভেদের সঙ্গে এর কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই বলে কেউ কেউ মনে করেছেন, এটি ভাল্লবেয় শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। রচনাটি বহু ঐতিহাসিক ও সাহিত্যবিষয়ক তথ্য জোগান দিয়েছে বলে এটি বেশ কৌতূহলজনক। এর প্রথম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হল বৈদিক ছন্দ। দুটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত কল্পনুপদসূত্র নামক পরিশিষ্টকে ক্ষুদ্রসূত্রের বিভিন্ন অংশ-সম্পর্কিত ভাষ্য বলে মনে হয়। নিদানসূত্রের নবীনতা ভাষাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকেই স্পষ্ট; তবে প্রচলিত পাণ্ডুলিপি বিকৃক্তিমুক্ত নয়।

বৈতান ও কৌশিক— অথর্ববেদের এই দুটি সূত্রে একটি অসাধারণ ক্রম পরিলক্ষিত হয়; কেননা গৃহসূত্রের বৈশিষ্ট্যযুক্ত কৌশিক সূত্র বৈতানের পূর্ববর্তী। বিভিন্ন লেখকের রচনা হলেও এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক লক্ষণীয়। বৈতানসূত্রের রচয়িতা কৌশিকের উপর নির্ভরশীল এবং এ থেকে বেশ কিছু উদ্ধৃতিও চয়ন করেছেন; শাস্ত্র-অংশে আশ্বলায়নের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রচনাটি যদিও শৌনক শাখার অন্তর্গত, তবু এটি পৈপ্পালাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈতানসূত্রে আটটি অধ্যায় ও তেতাল্লিশটি কণ্ডিকা রয়েছে; রচনার প্রথম শব্দ অনুযায়ী এর এরূপ নামকরণ হয়েছে। পরিভাষা অধ্যায় দিয়ে গ্রন্থের সূত্রপাত; এ ছাড়া এতে প্রধান যজ্ঞসমূহ, বিশেষত সোমযাগুলি এবং রাজসূয়, বাজপেয়, সৌত্রামণী, অশ্বমেধ, পুরুষমেধ, সর্বমেধ ও গবাময়ন আলোচিত হয়েছে। রাজাদের উপযোগী বিশেষ অনুষ্ঠানগুলির উপর প্রচুর গুরুত্ব আরোপিত হতে দেখা যায়; কারণ আমরা জানি, অথর্ববেদের পুরোহিত মূলত রাজপুরোহিত। গ্রন্থটি অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন; অথর্ববেদের স্বীকৃতিলাভের পরে, তবে সম্ভবত গোপথ ব্রাহ্মণের উদ্ভবের পূর্বে, এটি রচিত হয়েছিল।

শৌনক শাখার অন্তর্গত কৌশিকসূত্রে প্রায়শ বিকল্প অনুষ্ঠানই বিবৃত হয়েছে; এই গ্রন্থটি অবশ্য যথার্থ শ্রৌতসূত্র-পদবাচ্য নয়। এতে বহু গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানও আলোচিত হয়েছে; যেমন, জন্ম ও মৃত্যুসংক্রান্ত এবং ঐন্দ্রজালিক ও ডাকিনীবিদ্যা বিষয়ক অনুষ্ঠান। একে অবশ্য কোনও একজন মাত্র লেখকের রচনারূপেও গ্রহণ করা যায় না; আলোচিত বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে আমরা এই স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এটি পরস্পরবিচ্ছিন্ন রচনাংশের একটি সংগ্রহ। গোপথ ছাড়াও অন্য একটি ব্রাহ্মণ সম্পর্কে এ গ্রন্থ অবহিত ছিল, অবশ্য সেই ব্রাহ্মণটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বৈতান বা কৌশিক, কোথাওই প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কিত কোনও অংশ নেই; কারণ, সম্ভবত, প্রায়শ্চিত্তসংক্রান্ত নিয়মাবলি অথর্ব প্রায়শ্চিত্তানি নামক ছ’টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত একটি পৃথক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। পরবর্তিকালে তাকে বৈতানের আটটি অধ্যায়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে মোট চোদ্দোটি অধ্যায়ে সম্প্রসারিত করা হল, যাতে সমসংখ্যক অধ্যায়ে বিন্যস্ত কৌশিকসূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়; আনুষ্ঠানিক শিথিলতার উপর অথর্ববেদীয় শ্রৌতসূত্রের গুরুত্ব আরোপ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কারণ, আনুষ্ঠানিক বিচ্যুতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠানের বিধান-দানই ব্রহ্মাশ্রেণির পুরোহিতের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। চৈনিক ধর্মানুষ্ঠানবিষয়ক পুঁথি ‘লি খী’র মতো শ্রৌতসূত্রগুলিও যথাযথ নির্দেশ-সহ প্রকৃত অনুষ্ঠানের বিবরণ, অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট সময়, কার্যপরিচালকদের নির্বাচন করার নিয়ম, সংখ্যাবিষয়ক বিধি এবং যজ্ঞ আয়োজনের পদ্ধতি, অবস্থান ও উদ্দেশ্যসংক্রান্ত নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেছে।

সহায়ক সূত্র

অধিকাংশ শ্রৌতসূত্র প্রণীত হওয়ার পরে পরিশিষ্ট হিসাবে কয়েকটি সহায়ক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠান সংক্রান্ত এবং কয়েকটি যজ্ঞতত্ত্ববিষয়ক। পাঁচটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত ঋতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাতিশাখ্য জাতীয় রচনা, যাতে মন্ত্রসমূহের পদে প্রয়োগকালীন পরিবর্তন সম্পর্কিত নির্দেহ বিবৃত হয়েছে। বৌধায়ন, ভরদ্বাজ ও গৌতম পৃথক ভাবে কয়েকটি পিতৃমেধ সূত্র রচনা করেছিলেন; এদের মধ্যে মৃত পূর্বপুরুষের উদ্দেশে পালনীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসমূহ বিবৃত হয়েছে। এই বিষয়বস্তু যেহেতু শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রের পক্ষে সমভাবে প্রযোজ্য, সে কারণে, এগুলিতে এই উভয়বিধ সূত্র সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত রচনার সন্ধান পাওয়া যায়। শাঙ্খায়ন ও মানব-শাখার পিতৃমেধ-সূত্রগুলি তৎসংশ্লিষ্ট শ্রৌত সূত্রগুলি অন্তর্গত, আবার কৌষীতক, আশ্বলায়ন, বৈখানস ও অগ্নিবেশ্য রচিত গ্রন্থগুলি এই সব শাখা সংশ্লিষ্ট গৃহ্য সূত্রগুলির অন্তর্ভুক্ত। আপস্তম্ব এবং এমনকী বৈখানস ও আশ্বলায়ন নিজেদের পিতৃমেধ-সূত্রগুলিতে শ্রৌত ও গৃহ্য সূত্রের মধ্যে সমান ভাবে স্থাপন করেছেন।

এই নির্দিষ্ট শ্রেণির রচনা ‘পরিশিষ্ট’রূপে অভিহিত; যে সমস্ত বিষয়বস্তু প্রচলিত শ্রৌতসূত্রগুলিতে অপর্যাপ্ত ভাবে আলোচিত হয়েছে কিংবা একটুও উল্লিখিত হয়নি, সে সবই এখানে বিবৃত হয়েছে। আশ্বলায়ন, কাত্যায়ন ও বারাহ-শাখার পরিশিষ্টসমূহ এই প্রবণতার ফলেই রচিত। অন্য দিকে মানবশাখার রচনায় পুরোহিতদের দক্ষিণার কথাটি আলোচিত হয়েছে। বৌধায়ন ও আপস্তম্ব রচিত হৌত্রসূত্র গ্রন্থে হোতা শ্রেণির পুরোহিতদের দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে।

সামগানের বিধিসংক্রান্ত গৌণ সূত্রগুলির সংখ্যা অনেক। এদের মধ্যে প্রধান হল, পুষ্প সূত্র বা ফুল্ল সূত্র। দশটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত গ্রন্থটিতে গ্রাম ও অরণ্যগেয় গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামমন্ত্রগুলিকে অন্য মন্ত্রসমূহের উপযোগী করে পুনর্বিন্যাসের নিয়মসমূহ এবং অন্যান্য অনুরূপ প্রয়োগিক বিধি বিবৃত হয়েছে। এই নিয়মগুলি বিধিবদ্ধ ভাবে বিন্যস্ত। পুষ্পসূত্র এতটাই সম্পূর্ণ, যথাযথ ও সুশৃঙ্খল যে এতে উত্তরগানের অস্তিত্ব আভাষিত হয়েছে। এই রচনার পরিশিষ্ট সামমন্ত্ররূপে পরিচিত। এর তেরোটি প্রপাঠককে পুষ্পসূত্রে অনুল্লিখিত দুটি বিষয়, অর্থাৎ ঊহগান ও ঊহ্যগান আলোচিত হয়েছে।

দুটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত পঞ্চবিধ সূত্র-তে বর্ণিত হয়েছে কী ভাবে সামমন্ত্র পাঁচটি অপরিহার্য উপাদানে বিভক্ত হয়: প্রস্তাব, উদ্‌গীথ, উপদ্রব, প্রতিহার ও নিধন। প্রতিহার-সূত্রও প্রস্তাবসূত্র প্রস্তোতা ও উদ্‌গাতার দ্বারা সোমমন্ত্রের নির্দিষ্ট অংশে গানের পদ্ধতি বিবৃত করেছে। তিনটি পটলে বিন্যস্ত গায়ত্র বিধান সূত্র গায়ত্র গানের বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের মন্ত্রকে পুনর্বিন্যস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। তিনটি খণ্ড ও তেতাল্লিশটি শ্লোকে বিন্যস্ত স্তোভানুসংহার গ্রন্থে সামমন্ত্রের সঙ্গে স্তোত্রকে যুক্ত করার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তিনটি খণ্ডিকার বিভক্ত মাত্রালক্ষণ সূত্র নামক সংক্ষিপ্ত রচনায় মন্ত্রের অক্ষরসমূহের দৈর্ঘ্য আলোচিত হয়েছে; সহায়ক শ্রৌতসূত্র অপেক্ষা একে প্রাতিশাখ্য রূপে গ্রহণ করাই সমীচীন।

শ্রৌতসূত্রগুলি বৈদিক যজ্ঞচর্যার চূড়ান্ত পর্বের রচনা; এই পর্যায় প্রকৃতপক্ষে যজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণের সঙ্গে শুরু হয়েছিল— প্রসারণশীল যজ্ঞতত্ত্ব তখন জীবন্ত শক্তিরূপে বিদ্যমান ছিল। ভৌগোলিক সীমার প্রসারণ, ক্রমবর্ধমান সংমিশ্রণ, নির্দিষ্ট কিছু পরিবার ও বিভিন্ন অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক প্রয়োগবিধির বৈচিত্র্যের ফলে এই সব ক্রমাগত, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্যভাবে, পরিবর্তিত হল। যজ্ঞানুষ্ঠানগুলিকে সাংকেতিক ভাষায় লিপিবদ্ধ করা এবং এদের ব্যাখ্যাগম্য ও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলা ছাড়াও ব্রাহ্মণসাহিত্যের অর্থবাদ অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। সূত্রসাহিত্যের প্রতি শাখা (যজ্ঞতত্ত্ব, জ্যামিতি, জ্যোতিষ বা নিরুক্ত নির্বিশেষে)— গৃহ্য ও ধর্মসূত্রের সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ছাড়া– ব্রাহ্মণসাহিত্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এই পর্যায়ের অন্য সীমায় যখন যজ্ঞানুষ্ঠান দ্রুত শক্তি হারিয়ে নিঃশেষিত-প্রায় হয়ে উঠেছিল, তখন ক্ষীয়মান ধর্মচর্যাকে সংরক্ষিত করার নূতন ধরনের প্রয়োজন অনুভূত হল— গড়ে উঠল সূত্রসাহিত্য। কোনও কোনও সূত্রের প্রাথমিক রূপ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্মিত হয়েছিল; কিন্তু সেই স্তরে তা ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের অভিন্ন অংশ হিসাবে গণ্য হত। সূত্র ও ব্রাহ্মণের ভাষাগত নিবিড় সাদৃশ্যের কারণকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের মনে হয়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে সর্বাধিক সূত্রসাহিত্য রচিত হয়েছিল।

শ্রৌতসূত্রগুলিতে আমরা এমন একটি সমাজের ছবি দেখতে পাই, যা যজ্ঞানুষ্ঠানের সমস্ত রকম জটিলতাসহ সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছিল এবং বেশ কিছু শতাব্দী ধরে তাতে বিভিন্ন শাখার অস্তিত্ব জাগরুক ছিল।

গৃহ্যসূত্র

যেখানে শ্রৌতসূত্রগুলিতে প্রধান সামূহিক যজ্ঞসমূহ বিবৃত হয়েছে, সেখানে গৃহ্যসূত্রগুলিতে গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানবিষয়ের নিয়মাবলি আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে পারিবারিক অনুষ্ঠানসমূহ— সন্তানসম্ভাবনা থেকে মৃত্যুর বহু পরবর্তী পারলৌকিক ক্রিয়া পর্যন্ত সে সব বিস্তৃত। এগুলি তাদের লক্ষ্য, বিষয়পরিধি ও ক্রমিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে শ্রৌত অনুষ্ঠান অপেক্ষা ভিন্ন। শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলি মূলত সমগ্র গোষ্ঠীর সামুহিক কল্যাণ কামনা করে; গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহ সে ক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, কেননা এগুলি সর্বতো ভাবে পরিবারকেন্দ্রিক। গৃহ্যসূত্রগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের মধ্যে পাকযজ্ঞ নামে অভিহিত প্রায় চল্লিশটি অনুষ্ঠানের নিয়মাবলি বিবৃত হয়েছে। এদের আবার তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়: (ক) হুত অর্থাৎ যখন অগ্নিতে আহুতি অর্পণ করা হয়; যেমন বিবাহে বা গর্ভবতী রমণীর সীমন্তোন্নয়নে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে; (খ) অহুত অর্থাৎ যেখানে আহুতি আদান-প্রদান হয়; যেমন উপনয়নে ও স্নাতকদের জন্য দীক্ষান্ত অনুষ্ঠানে; (গ) প্রহুত অর্থাৎ যেখানে বিশেষ ধরনের আহুতি অর্পণ করা হয়; যেমন জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠানে। প্রধান অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে বহু গৌণ সহায়ক আচারও রয়েছে; যেমন, গর্ভাবস্থার অনুষ্ঠানগুলি— এদের মধ্যে আছে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন।

জন্মের পর নবজাত শিশুর কল্যাণের জন্য জাতকর্ম অনুষ্ঠিত হয়। তারপর একে-একে পালিত হয় আদিত্যদর্শন, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চৌল বা চূড়াকরণ, গোদান ও উপনয়ন অনুষ্ঠান। উপনয়নের পরে বেদাধ্যয়ন বা স্বাধ্যায়ের সূচনা হয়; এই সঙ্গে থাকে অনধ্যায় ও শেষে সমাবর্তন। তারপর স্নাতক গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পাণিগ্রহণ, অগ্নিপরিগ্রহণ, অশ্বারোহন, সপ্তপদী ও লাজহোম। বিবাহিত গৃহস্থকে প্রতিদিন আবশ্যিক নিত্যকর্ম ও বিভিন্ন সাময়িক যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়।

এই সব প্রধান অনুষ্ঠান ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সমস্ত সম্ভাব্য ক্ষেত্রের জন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠান রয়েছে; যেমন, গৃহনির্মাণ, বীজবপন, শস্য আহরণ, সর্প ও বিষাক্ত কীট বিতাড়ন, অতিথিকে খাদ্য ও আশ্রয়দান, আরোগ্যলাভ, দারিদ্র্য নিবারণ, বিভিন্ন উদ্যোগে সফলতা, অমঙ্গলসূচক লক্ষণ, এমনকী অশুভ স্বপ্নের জন্য উপযুক্ত প্রতিবিধান। মানুষের সমগ্র জীবন প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠান দ্বারা আবৃত ছিল; আদিম মানুষের মানসিকতায় ধর্মীয় ও লোকায়িত জীবনধারার মধ্যে কোনও স্পষ্ট ভেদরেখা ছিল না। এই মানসিকতায় পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ অসংখ্য অমঙ্গল শক্তির দ্বারা আকীর্ণ ছিল; এদের মধ্যে রয়েছে জীবনের সুখকর ভোগ থেকে বঞ্চিত মৃত মানুষের আত্মা— এরা জীবিত মানুষ সম্পর্কে অসূয়াপরায়ণ হয়ে সর্বদা ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করে, এমন বিশ্বাস ছিল। জীবনকে যেহেতু নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক শক্তি থেকে রক্ষা করতে হবে, তাই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যযুক্ত পরিস্থিতির জন্য কোনও না কোনও অনুষ্ঠান নির্দেশিত হয়েছিল, যার সাহায্যে এই সব অমঙ্গলপ্রদ শক্তিকে শান্ত, সন্তুষ্ট, বিতাড়িত বা সংগ্রামে প্রতিহত করা যায়। তাই শ্রৌতসূত্রগুলির তুলনায় গৃহ্যসূত্রসমূহ অনেক বেশি স্পষ্ট ভাবে ঐন্দ্রজালিক। এটা সত্য যে সূত্র-সাহিত্য রচিত হওয়ার সময় ভারতীয়রা আদিম অবস্থা থেকে বহুদূর সরে এসেছিলেন; কিন্তু সূত্রগুলি বহু সহস্র বৎসরের পুরাতন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলিকে বিধিবদ্ধ করেছে মাত্র। জীবনের প্রতি প্রাক্-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অতিপ্রাকৃতিক স্তরে মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করতে প্ররোচিত করেছে।

রচনা পরিচয়

ঋগ্বেদের সাতটি গৃহ্যসূত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে; পরবর্তী সাহিত্যে উল্লিখিত হওয়ায় আমরা এদের নাম জানতে পেরেছি: শৌনক, শাকল্য, ঐতরেয়, বহুবৃচ, ভারবীয়, পারাশর ও পৈঙ্গি ঋগ্বেদের দুটিমাত্র গৃহ্যসূত্র— শাঙ্খায়ন ও আশ্বলায়ন— আমাদের কাছে পৌঁছেছে। শুক্লযজুর্বেদের গৃহ্যসূত্রগুলির মধ্যেও দুটি এখন পাওয়া যায়: বাজসনেয় ও পারস্কর (‘কার্ষীয়’ নামেও পরিচিত— কাত্যায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত); ‘বাজবাপ’ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে কৃষ্ণযজুর্বেদের ন’টি গৃহ্যসূত্রের সবগুলি আমরা পেয়েছি। এদের মধ্যে ছ’টি তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত: বৌধায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, হিরণ্যকেশী সত্যাষাঢ়, বৈখানস ও অগ্নিবেশ। অবশিষ্ট তিনটি মৈত্রায়ণ শাখার অন্তর্গত: মানব, কাঠক (বা লৌগাক্ষি) ও বারাহ। সামবেদের সঙ্গে চারটি গৃহ্যসূত্র সংশ্লিষ্ট: গোভিল, জৈমিনীয়, খাদির (দ্রাহ্যায়ণ নামেও পরিচিত) এবং কৌথুম। শেষোক্ত গ্রন্থের সামান্য কিছু অংশমাত্র পাওয়া যায়; এইগুলি বিশ্লেষণ করে মনে হয়, একে যথার্থ গৃহ্যসূত্র অপেক্ষা ‘পদ্ধতির প্রকৃতিযুক্ত সহায়ক শ্রেণির রচনা বলাই সঙ্গত। অথর্ববেদের কৌশিক সূত্র মিশ্রশ্রেণির রচনা— শ্রৌতসূত্র পর্যায়ে আমরা ইতিমধ্যে এর আলোচনা করেছি।

গৃহ্যসূত্রের রচনাকাল

রচনাকাল অনুযায়ী প্রধান গৃহ্যসূত্রগুলিকে তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে: আশ্বলায়ন, গোভিল, বৌধায়ন, মানব ও কৌথুম। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে: ভারদ্বাজ, আপস্তম্ব, শাঙ্খায়ন, কাঠক ও পারস্কর। তৃতীয় বা শেষ স্তরে রয়েছে: সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী, জৈমিনীয়, খাদির ও দ্রাহ্যায়ণ। এই সব সূত্রের যথাযথ রচনাকাল নির্ণয় প্রায় অসম্ভব; বিষয়বস্তু অর্থাৎ গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহ কোনও বিস্মৃত যুগের ধূসর অতীতে উদ্ভুত হয়েছিল। এই সব অনুষ্ঠান পালনের বিধিসমূহ সাংকেতিক সূত্রে চূড়ান্ত ভাবে গ্রথিত হওয়ার পূর্বে অসংখ্য প্রজন্মের মধ্য দিয়ে পরিশীলিত হয়েছিল। অনুমান করা হয়, সূত্রগুলি খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০ অব্দের মধ্যে সংগৃহীত ও বিধিবদ্ধ ভাবে বিন্যস্ত হয়েছিল।

গৃহ্যসূত্রের বিষয়বস্তু

কয়েকটি প্রধান গৃহ্যসূত্র পরীক্ষা করে আমরা এদের বিষয়বস্তু প্রকৃতি ও বিশেষ চরিত্রলক্ষণ সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। গৃহ্য অনুষ্ঠানে প্রযুক্ত মন্ত্রসমূহকে পাঁচটি ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে: (ক) ধর্মানুষ্ঠানসংশ্লিষ্ট: এ-ধরনের মন্ত্রই সূত্রসাহিত্যে সর্বাধিক পাওয়া যায়, যার অধিকাংশ বিবাহ ও পারলৌকিক ক্রিয়ায় ব্যবহৃত হত; (খ) দেব-আহ্বানসূচক: এখানে অনুষ্ঠানের আযোজকের প্রতি আশীর্বাদ বর্ধিত হয়েছে; (গ) দেবকাহিনি-বিষয়ক: এখানে প্রার্থনা অপেক্ষা কোনও দেবতা ও তৎসংশ্লিষ্ট প্রত্নকথা অধিক গুরুত্বপূর্ণ; (ঘ) আহুতিসংক্রান্ত: এখানে অনুষ্ঠান অপেক্ষাও আহুতির উপর তৎসম্পর্কিত মন্ত্রের প্রভাব বেশি; (ঙ) আকস্মিক: এ-ধরনের মন্ত্রের ক্ষেত্রে কিছু বিক্ষিপ্ত শব্দ বা বাক্যাংশ ছাড়া অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনও প্ৰত্যক্ষ যোগসূত্র থাকে না।

এই বিশ্লেষণ থেকে গৃহ্যসূত্রগুলিতে অভিব্যক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা সম্পর্কে আমরা অবহিত হই। মন্ত্ৰসমূহ ক্রমশ তাদের যথার্থ বৈদিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এর দুটি কারণ বলা যেতে পারে: (ক) একটি নতুন যৌগিক প্রত্ন-পৌরাণিক ধর্মের উদ্ভবের ফলে বৈদিক যজ্ঞধর্মের ক্রমিক অবনতি, এবং (খ) প্রাচীনতর ঐতিহ্যের সঙ্গে কাল্পনিক ভাবে হলেও সূক্ষ্ম একটি যোগসূত্র রক্ষা করার জন্য প্রাচীন মন্ত্রসমূহের উচ্চারণ মনস্তাত্ত্বিক কারণে প্রয়োজনীয় বিবেচিত হওয়া। বর্তমান ভারতীয় সমাজে সম্পূর্ণত পৌরাণিক গার্হস্থ্য অনুষ্ঠান পালিত হওয়ার মধ্যে এই প্রবণতা স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাই আয়োজিত অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত মুখ্যত বৈদিক মন্ত্রই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

আশ্বলায়ন চারটি অংশে বিভক্ত; প্রথম অংশে গার্হপত্য-তে অগ্নি প্রজ্বলনের বিধি ও আর্যজীবন গর্ভাধান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত অনুষ্ঠানসমূহ আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়নির্ভর অনুষ্ঠান, যেমন, প্রধানত সর্পের বিরুদ্ধে আয়োজিত বর্ষাকালীন শ্রাবণ-যাগ এবং পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শীতকালে করণীয় অষ্টকা ও অন্বাষ্টক্য-যুক্ত আশ্বযুজ। তা ছাড়া রথারোহণ ও তিনটি উচ্চতর বর্ণের গৃহনির্মাণের উপযোগী অনুষ্ঠানসমূহ এই অংশে বিবৃত হয়েছে। তৃতীয় অংশে রয়েছে বিবিধ বিষয়বস্তু; এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, গৃহস্থদের পঞ্চবিধ অনুষ্ঠান, বেদাধ্যয়ন, লোকায়ত ধর্মবোধের উপাদান, ঋষিদের তালিকা, কাম্যেষ্টি, অশুভ-লক্ষণ ও তজ্জনিত প্রায়শ্চিত্ত, ছাত্রাবস্থা ও স্নাতকের আচারবিধি, ইত্যাদি। এখানে বিশেষত রচনাটির অর্বাচীনতার লক্ষণ পরিস্ফুট। শেষ অংশে রয়েছে রোগ, মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত নানাবিধ আলোচনা, সপ্তবিধ শ্রাদ্ধ এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির জন্য রুদ্রের প্রতি নিবেদিত বিশেষ অনুষ্ঠান।

ত্রিশটি কণ্ডিকায় বিন্যস্ত আশ্বলায়ন-গৃহ্যপরিশিষ্ট মহাকাব্যিক ছন্দে গ্রথিত পরবর্তিকালের সম্পূরক রচনা। এর ব্যাকরণ, ছন্দ ও পদান্বয়রীতি ত্রুটিপূর্ণ; ছন্দোগত বিচ্যুতি-পূরণের জন্য বারে বারে অব্যয় প্রযুক্ত হয়েছে। গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত ঋগ্বেদীয় মন্ত্রগুলিকে ব্যাখ্যা করা ও প্রয়োগপদ্ধতির ভাষ্য রচনা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।

ঋগ্বেদের অপর গৃহ্যসূত্র, অর্থাৎ শাঙ্খায়ন, বাঙ্কল শাখার অনুগামীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। লেখকের নাম হিসাবে সুষজ্ঞ শাঙ্খায়ন উল্লিখিত হয়েছেন; তবে গ্রন্থকর্তারূপে নিম্নোক্তদের নামও পাওয়া যায়: কৌষীতকি, মহাকৌষীতকি, ঐতরেয়, মহৈতরেয়, আশ্বলায়ন ও কহোল। প্রথম অধ্যায়ে সপ্তবিধ পাকযজ্ঞ বিবৃত হয়েছে: অষ্টকা, শ্রাবণী, অগ্রহায়ণী, চৈত্রী, আশ্বযুজী ও নির্দিষ্ট সময়ে আয়োজিত শ্রাদ্ধসমূহ। প্রধান বর্ণনীয় বিষয় হল শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানের পদ্ধতি ও আমন্ত্রণযোগ্য অতিথি। ক্রমশ বিবাহ অনুষ্ঠান, গর্ভাবস্থা, জন্মসংক্রান্ত অনুষ্ঠান, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, ইত্যাদিও আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপনয়ন, বেদাধ্যয়ন ও বিদ্যার্থীদের আচরণ-বিধি বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে গৃহনির্মাণ পদ্ধতি, শ্রাদ্ধ, ইত্যাদি। চতুর্থ অধ্যায়ে উপকরণ, অনধ্যায়, ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। তারপর গুরুর প্রতি কৃত অন্যায় ও তজ্জনিত প্রায়শ্চিত্ত বর্ণনা-প্রসঙ্গে ঋষিদের বিভিন্ন বর্গে বিভক্ত করা হয়েছে। এই তালিকায় ব্যাসের চারজন শিষ্য উল্লিখিত হওয়ায় মনে হয়, আলোচ্য গৃহ্যসূত্র মহাভারতের চূড়ান্ত রচনাপর্বের সমকালীন। পুরুষ ঋষিদের সঙ্গে গার্গী বাচক্নবী, বড়বা আতিথেয়ী ও সুলভা মৈত্রেয়ীর মতো ঋষিকাও এতে উল্লিখিত হয়েছেন। তা ছাড়া দেবগৃহে প্রদক্ষিণের বিধি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, তখন মন্দির ও দেবপ্রতিমা প্রদক্ষিণ করার নিয়ম প্রচলিত ছিল। শ্রাবণ আহুতিতে বিভিন্ন লোকের সর্পের উল্লেখ লক্ষণীয়। পরিশেষে রয়েেেছ বিভিন্ন ঋতুর অনুষ্ঠান ও রুদ্রহোম। পঞ্চম অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে বৈশ্বদেব, প্রায়শ্চিত্ত এবং কূপ, দীঘি ও উদ্যান শুদ্ধীকরণের অনুষ্ঠান এবং পরিশেষে অশুভ লক্ষণ, ব্যাধি ও বিবিধ প্রয়োজনীয় আচারসহ প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুষ্ঠানের বিবরণ। শেষ অধ্যায়ে স্বাধ্যায় বা বেদাধ্যয়নের বিষয়বস্তুরূপে আরণ্যক হোমের নির্দেশাবলি এবং সেই সঙ্গে কর্মবিরতির তালিকা ও বেদমন্ত্র আবৃত্তির পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে।

বিভিন্ন গৃহ্যসূত্রে বিষয়সূচি খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়; শুধুমাত্র গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে এদের পারস্পরিক ভিন্নতা নিরূপিত হতে পারে। শুক্লযজুর্বেদের পারস্কর গৃহ্যসূত্র প্রকৃতপক্ষে কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রের পরিশিষ্ট; তাই তা কাতীয় নামেও পরিচিত। এর তিনটি অংশ কয়েকটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অংশের সূচনায় রয়েছে গার্হপত্য অগ্নি প্রজ্বলনের প্রস্তুতি, ও অতিথি-আপ্যায়নের পদ্ধতি। লক্ষণীয়, বলা হয়েছে অতিথির উপযুক্ত খাদ্য হল গোমাংস। তারপর পাকযজ্ঞ ও বিবাহসংক্রান্ত বিভিন্ন অনুপুঙ্খ বর্ণিত হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের প্রাধান্য তর্কাতীত; সপ্তপদী অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্যত্র যে প্রত্নকথা বা অনুষ্ঠানের গঠনের পিছনে লোকায়ত লঘু ঐতিহ্যের অনুষ্ঠানবিধির প্রধান প্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জন্মবিষয়ক অনুষ্ঠানের বহু অবৈদিক জনপ্রিয় দেবতাকে আহ্বান করা হত, যাদের নাম এইখানেই প্রথমবার শোনা গেল: ষণ্ড, মর্ক, উলূখলের মতো ব্রাহ্ম্য উপদেবতা ছাড়াও শোনা গেল মলিল্লুচ, দ্রোণাশ, চ্যবন, আলিখৎ, অনিমিষ, কিংবদন্ত উপশ্রুতি, হর্ষক্ষ, কুন্তী, শত্রু-হন্তুমুখ ও সর্যপারুণ, প্রভৃতি নাম। এই নামগুলিতে লঘু ঐতিহ্যের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের বিস্তর ইঙ্গিত মেলে।

দ্বিতীয় অংশে রয়েছে শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণভোজনের বিধি, উপনয়ন, বেদাধ্যয়ন, অনধ্যায়, প্রায়শ্চিত্ত, হলকর্ষণ, বিভিন্ন ঋতুর উপযুক্ত যজ্ঞ, ইত্যাদি। তৃতীয় অংশে প্রাগুক্ত যজ্ঞসমূহের বিবরণ ছাড়াও রয়েছে শ্রাদ্ধ, গৃহনির্মাণ, শিরঃপীড়ার উপশম, ভৃত্যের পলায়ন রোধের জন্য ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠান, রুদ্রের প্রতি রক্তের আহুতিপূর্ণ অনুষ্ঠান। সম্পূর্ণ এই অভিনব আচরণে সম্ভবত প্রত্নতান্ত্রিক ধর্মের উপাদান অভিব্যক্ত হয়েছে। তারপর বিভিন্ন ধরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ, পশুযাগ, প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। দেবতার পক্ষে অনুকূল পবিত্র স্থানের ধারণা বৈদিক যুগের প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়নি; এখানে তার প্রকাশ ঘটায় একে আমরা সেই প্রত্ন-পৌরাণিক যুগের লক্ষণ রূপে গ্রহণ করতে পারি, যখন বিভিন্ন পবিত্র বন, বৃক্ষ, নদী, ইত্যাদির কল্পনা ক্রমশ লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে; তা ছাড়া মন্দির ও প্রতিমার ধারণা দেখা দেয়। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিচারালয়, বশীকরণ; পরবর্তী দুটি অধ্যায়ে রথ বা হস্তী আরোহণ ও বিভিন্ন দেবতার আহ্বান এবং ষোড়শ অধ্যায়ে জনৈক বৈদিক বিদ্যার্থীর মর্মস্পর্শী প্রার্থনা ব্যক্ত হয়েছে।

পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত ঋগ্বিধান গ্রন্থটি অর্বাচীনতর সূত্র-জাতীয় রচনা। এর একমাত্র বিষয়বস্তু হল ইন্দ্রজাল এবং প্রধান উদ্দেশ্য, ঋগ্বেদীয় মন্ত্রের ঐন্দ্রজালিক প্রয়োগবিধির নির্ধারণ। গ্রন্থের অধিকাংশই মহাকাব্যিক অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। যদিও লেখকরূপে শৌনকের নাম উল্লেখ করা যায়, তবুও এই গ্রন্থে দীর্ঘ বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত রচয়িতাদের প্রচেষ্টার নিদর্শনও রয়েছে। ঋগ্বেদের সঙ্গে এর যোগাযোগ ক্ষীণ ও কৃত্রিম, কেননা কোনও প্রকৃত আন্তরিক প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই বিচ্ছিন্ন ভাবে উদ্ধৃত মন্ত্রসমূহ প্রেতনিবারণ, অশুভলক্ষণ-দূরীকরণ, অভিচার ও অন্যায্য ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে— মূল লক্ষ্য বা প্রয়োগের সঙ্গে এগুলির পার্থক্য মৌলিক। এ দিক দিয়ে সামবিধানের সঙ্গে এর সাদৃশ্য নিবিড়; কেননা তা ব্রাহ্মণরূপে অভিহিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ব্রাহ্মণ শ্রেণির রচনা নয়। তেমনই কৌশিকসূত্র বা ঋগ্বিধানকেও প্রকৃত গৃহ্যসূত্র বলা যায় না, এরা নিরবয়ব প্রত্নপৌরাণিক ধর্মীয় সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। ঋগ্বিধানের শেষ অংশে রয়েছে ফলশ্রুতি বা রচনা-মাহাত্ম্য— যা পরবর্তী ধর্মীয় সাহিত্য, বিশেষত মহাকাব্য ও পুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এতে যে সমাজ চিত্রিত হয়েছে তা ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণে— যাঁরা শুধুমাত্র যজ্ঞানুষ্ঠানই করতেন না, কল্যাণ ও অকল্যাণপ্রদ ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠানেও নিরত থাকতেন। তাঁরা নানাবিধ প্রেত ও লোকদেবতাকে আহ্বান জানাতেন; পদ্মফুল, চন্দন, তৈল, লবণ, বিল্বপত্র ও শালগ্রাম শিলার সাহায্যে পূজা করতেন। ভক্তি, মন্দির, প্রতিমা, কৃচ্ছ্রসাধন, যোগ, জপ, উদ্ভিজ্জ আহুতি দিয়ে পূজা, রক্ষাকবচ, ন্যাস, প্রতিমূর্তির ঐন্দ্রজালিক অঙ্গচ্ছেদ, আতিশয্যের প্রবণতা— এ সমস্তই বেদোত্তর হিন্দু ঐতিহ্য-সম্পৃক্ত সাহিত্যের চারিত্র্যলক্ষণ। আহূত দেবতাদের অধিকাংশই পৌরাণিক, তান্ত্রিক ও বৈষ্ণবীয় ধারার অন্তর্গত: এমনকী, এ সমস্ত সম্প্রদায়ে প্রচলিত পূজাপদ্ধতিও প্রাধান্য পেয়েছে। জাতিভেদপ্রথা দুর্লঙ্ঘ্য সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে; এ-পর্যায়ে পুরোহিতদের দক্ষিণার বৈচিত্র্য ও পরিমাণ বহুগুণ বর্ধিত, যেহেতু ইতোমধ্যে তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রকৃতপক্ষে অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছিল।

ঋগ্বিধানের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশ শুধুমাত্র বহু পৌরাণিক বিষয়বস্তু, অর্চনাপদ্ধতি ও অর্চিত বস্তুর অন্তর্ভুক্তির মধ্যেই প্রমাণিত নয়— মূল বৈদিক সমাজ থেকে এর প্রচুর দূরত্বের মধ্যেও এই তথ্য অভিব্যক্ত। আধ্যাত্মভাবনায় নিষ্ণাত ঋগ্বেদের অস্যবামীয় সূক্তকে এখানে পাপমোচনের জন্য আবৃত্তি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; তেমনই বন্ধনদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শুনঃশেপ উপাখ্যান আবৃত্তি করার যান্ত্রিক নির্দেশ লক্ষ্য করা যায়। রতি, প্রদ্যুম্ন, কেশব, মাধব, গোবিন্দ, মধুসূদন, ত্রিবিক্রম, বামন, শ্রীধর, হৃষীকেশ, পদ্মনাভ ও দামোদরের মতো দেবতারা শুধু পৌরাণিক দেবতার অস্তিত্বই প্রমাণ করে না, বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুতরাং আলোচ্য গ্রন্থকে বৈদিক ও পৌরাণিক ঐতিহ্যের অন্তর্বর্তী তাৎপর্যপূর্ণ যোগসূত্ররূপে যথাযথ ভাবে গ্রহণ করা সমীচীন। আরও কয়েকটি অর্বাচীন গৃহ্যসূত্রের সঙ্গে এই গ্রন্থটি আমাদের নিকট নিশ্চিত ভাবে যুগসন্ধিক্ষণের লক্ষণসমন্বিত প্রত্নপৌরাণিক ও প্রাক্-হিন্দুযুগের ধর্মীয় কাঠামোটি তুলে ধরে— আপন অবৈদিক কাঠামো অবৃত করার জন্যই তাকে বৈদিক পরিচ্ছেদের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, উন্নতিশালী যে বণিক সম্প্রদায় তৎকালীন অর্থনীতি ও ফলত কিছু কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতাও নিয়ন্ত্রণ করত, তারা সে-যুগের প্রধান ধর্মীয় প্রবণতাগুলিরও নিয়ামক হয়ে উঠেছিল। এই বণিক সম্প্রদায় যে অরক্ষণশীল অথবা অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের সঙ্গে বিশেষ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করেছিল— তা তাদের ক্রমোন্নতির ইতিহাস থেকেই স্পষ্ট; এ ছাড়া কিছু কিছু লোকদেবতার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিল।

তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্র বাধুল শাখার উপবিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত। রচনাটি তিনটি প্রশ্নে বিন্যস্ত হয়েছে। এদের মধ্যে পুংসবন থেকে সন্ন্যাস পর্যন্ত সবগুলি গৃহ্য অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। শেষ প্রশ্নে রয়েছে বিবিধ বিষয়বস্তু: শ্রাদ্ধ এবং গর্ভবতী ও সংসার-পরিত্যাগীর জন্য অনুষ্ঠান ছাড়াও ‘নারায়ণ-বলি’র মতো পিতৃপুরুষের উদ্দেশে আয়োজিত অনুষ্ঠান ও ‘শকল-হোমে’র মতো গৌণ আচারও এতে রয়েছে। আবার এই গ্রন্থে বিবৃত কয়েকটি অনুষ্ঠান অন্য কোথাও পাওয়া যায় না: ‘স্থাগরালঙ্কার’ নামক বিচিত্র অনুষ্ঠানে আটটি বস্তু ব্যবহৃত হত— মালাবার অঞ্চলে এটি সাধারণত ‘অষ্টমাঙ্গল্য’ নামে পরিচিত এবং বঙ্গদেশে অনুষ্ঠিত আচারের সঙ্গে এর সাদৃশ্য বেশ স্পষ্ট। অনেকটা তান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত দেবতারাধন অংশে ‘যন্ত্র’ উল্লিখিত হলেও প্রতিমার কোনও উল্লেখ নেই— সম্ভবত তা পরবর্তিকালে সংযোজিত হয়েছিল। বোধায়ন, কুশহারীত, পুষ্করসাদি ও কৌষীতকি— এই চারজন শিক্ষকের নামও উল্লিখিত হয়েছে।

অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্রকে অর্বাচীন রচনা বলে মনে হয়; বৌধায়ন শাখার সঙ্গে এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে— সম্ভবত তা এর বিকল্প পাঠান্তর। মহাকাব্যিক অনুষ্টুপ ছন্দে দীর্ঘ স্তবকগুলি রচিত হওয়ার মধ্যে এর নবীনতা স্পষ্ট; তবে এই শ্লোকগুলি পরবর্তিকালের সংযোজনও হতে পারে। এমনকী, প্রাচীন সূত্র আঙ্গিকে রচিত অংশ অপেক্ষা এর গদ্যাংশ অনেক বেশি সম্পূর্ণতর। যদিও রচনার মধ্যে বেশ কিছু অপাণিনীয় শব্দ ব্যবহার রয়েছে, তবু এর ভাষাকে খুব একটা প্রাচীন বলা যায় না।

কৃষ্ণযজুর্বেদের অন্তর্গত হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র দুটি প্রশ্নে বিন্যস্ত এবং প্রতি প্রশ্ন আটটি পটলে বিভক্ত। প্রথম প্রশ্নে বিবৃত উপনয়ন উৎসবে আমরা ‘শাক’ ও ‘জঞ্জভ’ নামে দুটি নূতন গ্রহের কথা জানতে পারি। ঐন্দ্রজালিক আচার সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ অংশের পরে বিবাহ অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ আকস্মিক দুর্ঘটনা ও অবস্থা সম্পর্কে আচার ও ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠান। গুরুগৃহ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মাতাপিতার প্রতি বিদ্যার্থীর কর্তব্য ও বিবাহের পর গার্হস্থ্য আশ্রমের সূচনা এবং তদুপযোগী প্রার্থনা বর্ণিত হয়েছে। প্রার্থিত বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের মধ্যে সে যুগের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির নিদর্শন পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রথম প্রশ্নে রয়েছে যজ্ঞাগ্নির প্রজ্জ্বলন ও গৃহনির্মাণ। দ্বিতীয় প্রশ্নের সূচনা হয়েছে জন্মপূর্ববর্তী অনুষ্ঠান দিয়ে; তার পর জন্মকালীন অনুষ্ঠান, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। শিশুর একটি গোপন নামের ব্যবস্থায় আদিম মানুষের মানসিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত রহস্য ও ঐন্দ্রজালিক চেতনা অভিব্যক্ত। কৈশোরকালীন অনুষ্ঠানগুলির পরে আচারগত বিচ্যুতি ও তজ্জনিত প্রায়শ্চিত্ত বর্ণিত হয়েছে। বিবিধ সারমেয়-দানবের মধ্যে ‘দুলা’ নামটি পাওয়া যায়; ছ’জন কৃত্তিকার অন্যতমা এই নামেরই অধিকারিণী। তৎপরবর্তী অনুষ্ঠান শূলগব’-এ বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে চন্দন উল্লিখিত হওয়ায় দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আভাসিত হয়েছে, যেহেতু কেবলমাত্র সেই অঞ্চলেই চন্দনবৃক্ষ দেখা যায়। রুদ্রের পানীয়রূপে সুরা নির্দেশিত হওয়ায় আমাদের মনে হয়, এর অন্তরালে রয়েছে কোনও আদিম লৌকিক দেবতা বা অশুভ আত্মার উপস্থিতির প্রভাব। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের একটি বিচিত্র প্রার্থনায় যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিথিলতার ইঙ্গিত রয়েছে। অষ্টকা অনুষ্ঠানে পিতৃপুরুষের প্রতি গোমাংস নিবেদিত হয়েছে। বশিষ্ঠ ও পরাশরের উল্লেখে একে একে শ্রাবণ অনুষ্ঠান, স্নাতক অনুষ্ঠান, প্রাচীন শিক্ষকদের তালিকা এবং জ্বর, ক্রোধ, ধর্ম, প্রভৃতি বিশুদ্ধ বিমূর্ত বস্তুর সঙ্গে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন, বাজশ্রব, বিষ্ণু, রুদ্র, স্কন্দ ও কাশীশ্বর, প্রমুখের কথা আছে। অধ্যয়নের বিষয়সমূহের মধ্যে ইতিহাস ও পুরাণ উল্লিখিত হওয়ায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে আলোচ্য গ্রন্থ পরবর্তিকালে রচিত হয়েছিল। পদপাঠের রচয়িতারূপে আত্রেয়, ভাষ্যকাররূপে কৌণ্ডিণ্য ও সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশীর উল্লেখ এবং অরণ্যবাসী মুনি, শিক্ষক ও যতিদের বর্ণনা এবং একপত্নীক ব্যক্তিদের প্রশংসা থেকে তৎকালীন সমাজের পরিস্থিতি সম্পর্কে কতকটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

খাদির গৃহ্যসূত্র দ্রাহ্যায়ণ নামেও পরিচিত; এর পাঁচটি পঞ্চিক-এর প্রত্যেকটি কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। এতে কয়েকটি নূতন বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে, যেমন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের যথাযথ সময় ও ক্রিয়াপদ্ধতি, গৃহের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান এবং সমৃদ্ধিকামী ব্যক্তির আচরণীয় ক্রিয়া। হোতা ও ব্রহ্মাশ্রেণির পুরোহিতদের ক্রিয়াকর্মকে সংযুক্ত করার জন্য প্রদত্ত একটি নির্দেশে আমরা সেই যুগের অভিব্যক্তি দেখি যখন একজন মাত্র পুরোহিত যজ্ঞ সমাধা করতেন। যজ্ঞ সম্পর্কিত কিছু কিছু নির্দেশ থেকে বিলাসী সমাজের চিত্র পাওয়া যায়।

সামবেদের গোভিল গৃহ্যসূত্র কৌথুম শাখার মন্ত্র-ব্রাহ্মণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। চারটি প্রপাঠকে বিন্যস্ত এই গ্রন্থটি কয়েকটি কণ্ডিকায় বিভক্ত; তবে এই বিভাগ নিতান্ত কৃত্রিম। যদি প্রতি ভাগকে একটি দিনের পাঠরূপে গ্রহণ করা যায়, শুধুমাত্র তা হলেই এর অর্থবোধ হতে পারে। প্রধানত সূত্রশৈলীর গদ্যে রচিত এই গ্রন্থে অল্প কয়েকটি শ্লোকও পাওয়া যায়। স্নান, শ্রাদ্ধ ও সান্ধ্য অর্চনা সম্পর্কিত আরও পাঁচটি গ্রন্থের রচয়িতা রূপে গোভিলের নাম উল্লিখিত হয়ে থাকে। গোভিল গৃহ্যসূত্রের বিষয়বস্তু অনুরূপ; এখানে শুধু সামমন্ত্র গায়ক ছাত্রের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। পক্ষিমাংস ভক্ষণ তার পক্ষে নিষিদ্ধ হওয়ায় মনে হয়, এটি সহানুভূতিনিষ্ঠ ইন্দ্রজালের প্রতি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত— সুরশিক্ষার্থীর পক্ষে সুরস্রষ্টা জীবের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে নিরস্ত করার অভিপ্রায়েই এ নির্দেশ পরিকল্পিত। গোভিলপুত্র রচিত গৃহ্য-সংগ্রহ প্রকৃতপক্ষে গোভিল গৃহ্যসূত্রের পরিশিষ্ট এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের প্রয়োজন নির্বাহ করার জন্য এর পরিকল্পনা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গার্হপত্য অগ্নি যে ছত্রিশটি ভিন্ন ভিন্ন নাম পরিগ্রহ করে, তার বিবরণ দিয়ে এই গ্রন্থের সূত্রপাত; এই অগ্নিতে আহুতিদানের তাৎপর্য, মহত্ত্ব ও তার যথার্থ পদ্ধতি এবং উপযুক্ত ইন্ধন প্রয়োগের উপর এখানে গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। প্রধানত যে সমস্ত বিষয় এই রচনায় আলোচিত, তার মধ্যে রয়েছে, আনুষ্ঠানিক আসনভঙ্গি, যজ্ঞবিষয়ক দেবতার পবিত্রতা, কুশ-ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র, আনুষ্ঠানিক স্নান, সুরার ব্যবহার, বালিকাদের বিবাহের উপযুক্ত বয়স, উপনয়ন, আহুতি প্রদান, শ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মণভোজন, আনুষ্ঠানিক অশুচিতা ও তার প্রতিবিধান, স্বকীয় বৈদিক শাখার প্রতি আনুগত্য এবং তদ্‌ভাবে অনৌচিত্য, ইত্যাদি।

লৌগাক্ষি গৃহ্যসূত্র (কাঠক, চরক ও চারায়ণীয় নামেও পরিচিত) কৃষ্ণ যজুর্বেদের কাঠক শাখার অন্তর্গত; এর শ্লোকসমূহ মহাকাব্যিক শৈলীতে রচিত হওয়ায় মনে হয়, এটি পরবর্তিকালের গ্রন্থ। বিষয়বস্তুর বিন্যাসে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ নেই। মানব ও বরাহ গৃহ্যসূত্রের সঙ্গে এই গ্রন্থের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। সাধারণত অন্যান্য গৃহ্যসূত্রে যে সমস্ত বিষয়বস্তু পরিলক্ষিত হয়, লৌগাক্ষি গৃহ্যসূত্রেও সে সব পাওয়া যায়। তবে নববধূর শুদ্ধীকরণ ও বধূবরণ অনুষ্ঠানের উপর এতে কিছু গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে; এ ছাড়া দেবপূজায় প্রযুক্ত পবিত্র সঙ্গীতও কিছু গুরুত্ব পেয়েছে। যোগ্য ছাত্রদের তালিকায় ধনদাতা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই তথ্য স্পষ্টত আভাসিত হচ্ছে যে, ইতোমধ্যে শিক্ষাজগতেও কিছু পরিমাণ বাণিজ্যিক মনোভাব সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। বৈদিক বিদ্যার পক্ষে উপযুক্ত অন্যবিধ ব্যক্তিরূপে শিক্ষকের জন্য কায়িক পরিশ্রমে নিরত কর্মকৃৎ নির্দেশিত হয়েছে। বালিকাদের বিবাহের উপযুক্ত বয়স ছিল দশ বা বারো; কুমারীদের জন্য দুটি বিশেষ উৎসব ছিল ‘রাকা’ ও ‘হোলকা’। গার্হস্থ্য অমঙ্গল মোচনের জন্য পরিকল্পিত বিভিন্ন সাময়িক অনুষ্ঠান, রাক্ষস, মুষিক ও কপোতের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হত। পিণ্ডপিতৃযজ্ঞ নামক পিতৃপুরুষের উদ্দেশে নিবেদিত অনুষ্ঠানে প্রযুক্ত অন্ন দিয়ে ব্রাহ্মণদের ভোজন করাতে হত। এই শেষোক্ত অনুষ্ঠানটি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও এইরূপ ব্রাহ্মণদের সমাজে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়, সম্ভবত প্রাচীনতর কালেও এঁরা সামাজিক ভাবে হেয় ছিলেন। যে সব অমঙ্গলপ্রদ অপশক্তিকে বিতাড়নের চেষ্টা করা হয়, তাদের মধ্যে অধিকাংশ নাম অন্যান্য গৃহ্যসূত্রে পাওয়া গেলেও একটি নূতন নামও পাওয়া যায়— চুপনি। ছয়জন কৃত্তিকার অন্যতমা চুপুনিকা নামটির উৎস যদিও এখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত রয়ে গেছে।

তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র চারটি প্রশ্নে বিন্যস্ত; এদের মধ্যে প্রথমটি বিবাহক্রিয়া দিয়ে শুরু; গর্ভাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলির চূড়ান্ত রূপটি দিয়ে এর সমাপ্তি। দ্বিতীয় প্রশ্নের শুরুতে রয়েছে জন্মকালীন অনুষ্ঠান এবং ক্রমে ক্রমে এতে বাল্যাবস্থা, বেদাধ্যয়ন ও গার্হস্থ্যসংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলি আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় প্রশ্নে বিবৃত হয়েছে বিবিধ আনুষ্ঠানিক বিচ্যুতি ও প্রায়শ্চিত্ত, সর্প ও অন্যান্য উপদেবতার শাস্তিবিধান এবং কল্যাণবিধানের জন্য কিছু কিছু অনুষ্ঠান। শেষ অধ্যায়ে বিবিধ আকস্মিক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত নিয়মাবলি কথিত হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে ভাবী অমঙ্গলসূচক লক্ষণ এবং তৎপ্রসূত অমঙ্গল নিবারণের উপযোগী অনুষ্ঠানসমূহ। রচনার প্রধান অংশের পরে যে পরিভাষা অংশটি রয়েছে তাতে আনুষ্ঠানিক স্নান, শুভদিন ও গৃহস্থের পক্ষে অবশ্য পালনীয় পঞ্চবিধ অনুষ্ঠানের নিয়মাবলি বিবৃত হয়েছে। এর পরবর্তী অংশটি গৃহ্যশেষ রূপে অভিহিত; যে-সমস্ত বিষয় পূর্বসূরিদের রচনায় যথাযথ ভাবে আলোচিত হয়নি, এতে সে-সব স্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে বিষ্ণু, রুদ্র, দুর্গা, রবি, জ্যেষ্ঠ, বিনায়ক, ঈশান, প্রভৃতি দেবতার প্রতিমায় প্রাণ-প্রতিষ্ঠার এবং নারায়ণের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনের নিয়মাবলি— এই অংশে আমরা পৌরাণিক যুগের প্রাথমিক পর্বে প্রবেশ করেছি। পিতৃমেধ ও পিতৃমেধ-শেষ সম্পর্কে বৌধায়ন রচিত আরও দুটি সম্পূরক রচনার সন্ধান পাওয়া যায়। তেইশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্রের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এর পার্থক্য খুব সামান্য— তবে গার্হপত্য অগ্নিপ্রজ্বালন এবং নববধূর সঙ্গে সম্পর্কিত অনুষ্ঠানসমূহের উপর এতে অধিকতর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। অপর স্ত্রী গ্রহণ করা থেকে স্বামীকে নিবৃত্ত করার জন্য এবং স্বামীর মন আকৃষ্ট করার জন্য পত্নী কর্তৃক পালনীয় অনুষ্ঠানও এখানে রয়েছে। বিবাহমণ্ডপে উপস্থিত হওয়ার পর বরকে একটি গোদান করে তবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হত। বধূ ও বরের মধ্যে শুভ ও অশুভসূচক লক্ষণ নির্ণয়ের চেষ্টায় লোকায়ত বিশ্বাসের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠানে ইন্দ্রজালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অষ্টকা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে গোমাংস অর্পিত হওয়ায় মনে হয় গোমাংস ভক্ষণ সম্পর্কে সামাজিক নিষেধ তখনও পর্যন্ত ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল না। তুলনামূলক ভাবে নূতন দেবতারূপে ঈশানকে কেন্দ্র করে পৃথক চর্যাবিধি যে গড়ে উঠেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্পূরক রচনা অর্থাৎ গৃহ্যাশেষে আমরা একটি বিশেষ ধরনের চেষ্টার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি লক্ষ্য করি, যেখানে গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানের সীমাকে নূতন যুগের ধর্মবোধে প্রসারিত করে ক্রমোন্নতিশীল পৌরাণিক পূজা-পদ্ধতিকে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়া দেখা যায়। এই গৃহ্যাশেষ ছাড়াও আমরা একটি আপস্তম্ব গৃহ্যপরিশিষ্টের সন্ধান পাই, যা আপস্তম্ব শাখার গৃহ্য অনুষ্ঠান-বিষয়ক রচনার পদ্যে গ্রথিত ও পরবর্তিকালে প্রণীত পরিশিষ্ট। বধূসম্প্রদানের সময় বধূ ও বরের মাতামহ ও পিতামহের নাম আমরা উল্লিখিত হতে দেখি কিন্তু তাদের মাতামহী ও পিতামহীর নাম উল্লিখিত হয় না— এটি পূর্ণবিকশিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই নিদর্শন। ইতোমধ্যে গ্রহগুলি দেবতায় পরিণত হয়ে পূজা পেতে শুরু করেছে। গ্রহগুলি প্রতিমারূপে পূজিত হত; প্রত্যেক প্রতিমার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিমাপ ছিল এবং গোষ্ঠীগত অবস্থানে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ভূমিকাও ছিল সুপরিমিত। রাজা ও ব্রাহ্মণের উপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, তাঁরা উপাসকদের যথোপযুক্ত প্রতিদান দিয়ে থাকেন এবং অবজ্ঞাকারীদের বিনাশ করেন। কূপ ও পুষ্করিণী খননের মতো পূর্তকর্ম সম্পর্কে যে সমস্ত নিয়ম বিবৃত হয়েছে— তার মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণদের বিপুল দক্ষিণা ও ভোজ্যদ্রব্য অর্পণের নির্দেশ। এ ছাড়া এতে স্বাধ্যায় সম্পর্কিত যে সব নির্দেশ রয়েছে, তা থেকেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইতোমধ্যে উপনিষদের জনপ্রিয়তা বিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মানব গৃহ্যসূত্র কৃষ্ণযজুর্বেদের মৈত্রায়ণীয় শাখার অন্তর্গত। এর দুটি খণ্ড আবার পঁয়তাল্লিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। ছাত্রাবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানগুলি এখানে সানুপুঙ্খ আলোচিত হয়েছে এবং এই অনুষ্ঠানগুলি দিয়ে গ্রন্থ সূচনা হওয়ার পর গার্হস্থ্য জীবনের সূচনা যে বিবাহ অনুষ্ঠান, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। শেষ অংশে বিভিন্ন ঋতুকালীন যজ্ঞ এবং দৈবদুর্বিপাকের সঙ্গে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। আরও কয়েকটি গৃহ্যসূত্রের মতো মানব গৃহ্যসূত্রেও এই বিদ্যার্থীদের সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অংশ রয়েছে যারা উপনিষদ অধ্যয়নের পক্ষে অধিকারী। ছাত্রাবস্থায় কৃত পাপ সম্পর্কিত আলোচনায় বলা হয়েছে যে, কোনও মহাপাতকের উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত হল যুদ্ধে মৃত্যুবরণ। বিবাহের পাঁচটি উদ্দেশ্য কল্পিত হয়েছে: সম্পদ, সৌন্দর্য, জ্ঞান, বুদ্ধি ও সাহচর্য। যদি সবগুলি এক সঙ্গে পাওয়া না যায়, তবে পূর্বোক্ত ক্রম অনুযায়ী প্রথম তিনটি বর্জন করা যেতে পারে। অতিথিকে আপ্যায়নে গোমাংস নিবেদন করা ছিল বাধ্যতামূলক; তবে গৃহস্থের কর্তব্যও ছিল অতিথিদের সঙ্গে আরও চারজন ব্রাহ্মণকে মাংস-ভোজনে আমন্ত্রণ করা। কর্ম সঙ্ঘ অনুষ্ঠানে সীতা ও রেবতী নামে দুজন নূতন দেবতা উল্লিখিত হয়েছেন। বিনায়ক কল্প’ ও ‘ষষ্ঠীকল্পে’র মতো নূতন অনুষ্ঠানও এই গ্রন্থে প্রথম পাওয়া যায়।

তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র তিনটি প্রশ্ন ও সাতাশিটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। গৃহ্যসূত্রের সমস্ত প্রচলিত বিষয়বস্তু এতে আলোচিত হয়েছে; এতে রয়েছে বিবাহ, গৃহস্থের পালনীয় অনুষ্ঠান-সমূহ, বিশেষ জরুরি কিছু আচার, প্রায়শ্চিত্ত এবং মৃত্যু, অন্ত্যেষ্টি ও প্রেতক্রিয়ামূলক অনুষ্ঠান। এই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে, বুদ্ধিমতী নারীকে বিবাহ করা উচিত এবং এই সঙ্গে উপযুক্ত পত্নী নির্বাচনের জন্য কিছু কিছু শুভ লক্ষণের তালিকাও রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলা হয়েছে যে, সমস্ত শুভ লক্ষণ বর্তমান থাকলেও নিজস্ব মানসিক প্রবণতা অনুযায়ী এমন বধূ নির্বাচন করা উচিত, যে স্বামীর হৃদয় এবং চক্ষু, এই দুইয়ের পক্ষেই প্রীতিকর হবে। তৎকালীন পরিস্থিতির পক্ষে এরূপ উদারতাপূর্ণ মনোভঙ্গির প্রকাশ সত্যিই বিস্ময়কর। এই ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্রটি প্রাচীনতর ও দীর্ঘতর গৃহ্যসূত্রগুলির অন্যতম।

মৈত্রায়ণীয় শাখার অন্তর্গত বারাহ গৃহ্যসূত্র চরক উপশাখায় বিন্যস্ত এবং সম্ভবত তা খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থটি সতেরেটি খণ্ডে বিভক্ত, এদের মধ্যে প্রথমটি প্রকৃতপক্ষে মৈত্রায়ণীর সূত্রের পরিশিষ্ট। বাকি অংশসমূহে গৃহ্যসূত্রের প্রচলিত বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে; যেমন নবজাত শিশুর জন্য অনুষ্ঠান, দীক্ষা, বেদাধ্যয়ন ও অনধ্যায়-এর নিয়মাবলি, বিবাহ, গর্ভবতী নারীর উপযোগী অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

বৈখানস-সূত্র অর্বাচীনতম সূত্রসাহিত্যের নিদর্শন। সাতটি প্রশ্নে বিন্যস্ত বৈখানস গৃহ্যসূত্র আবার কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত। এই গ্রন্থে যথাক্রমে আনুষ্ঠানিক স্নান এবং চতুরাশ্রমের জন্য মুখ-প্রক্ষালন, অগ্নিবিষয়ক অনুষ্ঠান, পিতৃপুরুষের উদ্দেশে অনুষ্ঠান, স্নাতক, বিদ্যার্থী ও গৃহস্থদের জন্য অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে। বহু অনুষ্ঠানে অপরিচিত দেবতা বা প্রেতাত্মাকে আহ্বান জানানো হত। বাসভবন শুদ্ধীকরণের জন্য অনুষ্ঠানের পরে প্রচলিত গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলি অর্থাৎ গর্ভাধান থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্ত সমস্ত আচার আলোচিত হয়েছে। শ্রাদ্ধ এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসমূহ এই রচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তারপর আকস্মিক দুর্ঘটনা ও অশুভ লক্ষণ নিরাকরণের উপযোগী প্রায়শ্চিত্ত বর্ণিত হয়েছে; আনুষ্ঠানিক অশৌচ অবস্থা সম্পর্কেও আলোচনা এতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে রচিত হয়েছিল। বইটির অষ্টম ক্ষেত্রে দশম প্রশ্নের নাম বৈখানস ধর্মসূত্র।

অথর্ববেদের শৌনক শাখার অন্তর্গত কৌশিক সূত্র বা সংহিতা বিধিই একমাত্র অথর্ববেদীয় গৃহ্যসূত্ররূপে পরিচিত। এর নামকরণের মধ্যে ‘গৃহ্য’ শব্দটি উল্লিখিত হয়নি, একে শুধুই সূত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনুরূপ ভাবে বৈতানসূত্র নামের মধ্যে শ্রৌত কথাটি অনুল্লিখিত থাকলেও বিষয়গুলির দিক থেকে শ্রৌতসূত্ররূপে তা গৃহীত হওয়ার পক্ষে কোনও বাধা নেই। কৌশিকসূত্র বিশুদ্ধ গৃহ্যসূত্র বা বিশুদ্ধ শ্রৌতসূত্র নয়— বরং এই উভয়ের সংমিশ্রণ। অথর্ববেদ সংহিতার সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত এই গ্রন্থটি অথর্ববেদীয় মন্ত্রের যজ্ঞীয় বিনিয়োগ নির্দেশ করতে চেয়েছে এবং বহুবার একই মন্ত্রের জন্য একাধিক অনুষ্ঠানের বিধান দিয়েছে। যেমন বিবাহ ও তৎসম্পর্কিত স্ত্রী-আচার, জন্মকালীন অনুষ্ঠান ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। যদিও এটি শৌনক শাখার অন্তর্গত, তথাপি সূত্রসাহিত্যের অর্বাচীনতম গ্রন্থগুলির অন্যতমরূপে এটি কখনও কখনও অন্য তিনটি অথর্ববেদীয় শাখা, অর্থাৎ জলদ, জাজল ও ব্রহ্মদেব শাখায় প্রচলিত আচার-পদ্ধতির উল্লেখ করেছে। একদিক দিয়ে কৌশিকসূত্রকে আমরা অথর্ববেদ সংহিতার অনুষ্ঠানমূলক ভাষ্যরূপে গ্রহণ করতে পারি। অপেক্ষাকৃত পরবর্তিকালের রচনা হলেও এর বিষয়বস্তু অথর্ববেদের প্রাচীনতম অংশেরই সমকালীন।

গৃহ্যসূত্রের উৎস

একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল এই যে যখন, গৃহ্যসূত্রগুলি ব্রাহ্মণ সাহিত্য ও অথর্ববেদ থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে উদ্ভব হয়েছে, তখন শ্রৌতসূত্রগুলি উদ্ভূত হয়েছে শুধু ব্রাহ্মণ সাহিত্য থেকে। অথর্ববেদ সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এতে যে অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও আদর্শগত বাতাবরণ সৃষ্ট হয়েছিল তার এক দিকে ছিল তিনটি বেদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রয়োগবিধি-জনিত একমুখী সংস্কৃতি এবং অন্য দিকে অথর্ববেদ, যা কিছু মৌলিক দিক দিয়ে অন্য তিন বেদের তুলনায় শুধুমাত্র ভিন্নই ছিল না, এদের সম্পূর্ণ বিরোধিতাও করেছিল। পরবর্তিকালে অথর্ববেদের স্বীকৃতিলাভের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই ধারায় প্রচলিত গৃহ্য অনুষ্ঠানসমূহের প্রবল উপস্থিতি। সামাজিক জীবন সম্পূর্ণত সামূহিক শ্রৌত অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল; জনসাধারণ তাদের পারিবারিক, গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনযাপনে এমন বহুবিধ বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হত, ব্রাহ্মণসাহিত্য বা শ্রৌতসূত্রগুলি দিয়ে যাদের পুরোপুরি সমাধান করা যেত না। এই সব ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজনসমূহ ছিল নিতান্ত বাস্তব ও পৌনঃপুনিক; এইগুলি অবস্থার উন্নতিসাধন, শান্তিবিধান, প্রেতবিতাড়ন ও আশীর্বাদ প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত আনুষ্ঠানিক প্রতিবিধান অনিবার্য করে তুলেছিল। অথর্ববেদ তার ব্যবস্থা করেছিল; অথর্ববেদীয় পুরোহিতরা সুদূর অতীত কাল থেকে বৈদিক ধর্মের পশ্চাৎপটে সক্রিয় ছিলেন এবং জনসাধারণের বিপদে তাঁদের শরণাপন্ন হতেন। তারপর ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্রমোন্নতিশীল ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রধানরা প্রতিবেশী রাজাদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত হওয়ার জন্য ঐন্দ্রজালিক প্রতিরক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। প্রাচীনতর ধর্মে এ ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা খুব কমই ছিল; তাই অথর্ববেদীয় পুরোহিত যখন উদ্যোগী হলেন, তাঁকে রাজপুরোহিতরূপে নিয়োগ করা হল এবং কালক্রমে তাঁর গোষ্ঠী ও মতবাদ বিলম্বিত স্বীকৃতি লাভ করল। এই স্বীকৃতি প্রাথমিক ভাবে নিশ্চিত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু রাজপুরোহিতরূপে অথর্ববেদীয় পুরোহিত যেহেতু একটি ক্ষমতাসম্পন্ন অবস্থান থেকে দরকষাকষি করতে সমর্থ ছিলেন তাই তিনি আপন অধিকার অর্জন করে নিলেন। এই জয়ের স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে: সমগ্র যজ্ঞদক্ষিণার অর্ধেক অংশ একা ব্রহ্মার প্রাপ্য, বাকি অর্ধেক হোতা, উদ্গাতা ও অধ্বর্যুর। অন্য ভাবে বলা যায়, অন্য তিনজন পুরোহিত একত্রে যা লাভ করতেন, ব্রহ্মাশ্রেণির পুরোহিত একাই তা পেয়ে যেতেন। অথর্ববেদীয় পুরোহিতের ক্ষমতার অপর এক বাস্তব উৎস নিহিত ছিল গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে— সেখানে তাঁর মতবাদ ও ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপ অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল। সমগ্র সূত্রসাহিত্য যেহেতু পরবর্তিকালে রচিত, গৃহ্যসূত্রগুলিতে শুধুমাত্র অথর্ববেদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিজয়ই প্রতিফলিত হয়নি; অন্যান্য বেদের শাখাগুলিতেও তার অন্তর্ভুক্তি প্রমাণিত হয়েছে। অথর্ববেদের পরিগ্রহণের পশ্চাতে রয়েছে লোকায়ত ধর্মের স্বীকৃতি অর্থাৎ নিজস্ব দেবতা, আচার-অনুষ্ঠান, প্রত্নকথা ও বিশ্বাসসহ লঘু ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি। তাই এখানে আমরা বহু-সংখ্যক অপরিচিত অর্ধদেবতা, উপদেবতা, দানব ও পিশাচ প্রভৃতির সম্মুখীন হই, কেননা লোকায়ত ধর্ম মূলত এদেরই সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সময়ে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের উল্লেখ লক্ষ্য করি: হস্তরেখা-বিচার, সর্ববিধ ভবিষ্যৎ-কথন, জ্যোতির্বিদ্যা অর্থাৎ অন্তরিক্ষ-সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ থেকে আহৃত শুভাশুভ গণনা, স্বপ্নবিশ্লেষণ করে আসন্ন ঘটনার পূর্বাভাস, বস্ত্রে মূষিকদংশনের ফলে উদ্ভূত চিহ্ন ব্যাখ্যা করে ভবিষ্যদ্বাণী, অগ্নির উদ্দেশে যজ্ঞ, বহুবিধ দেবতার প্রতি অর্পিত অর্ঘ্য, শুভাশুভ স্থান নিরূপণ, প্রেত-সঞ্চালন, সর্প-নিয়ন্ত্রণ বিদ্যা, প্রেতাবিষ্ট বালিকার মাধ্যমে দেবতাদের পরামর্শ গ্রহণ, পরমদেবতার উপাসনা, ব্রতপালন ও মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা সন্তান-উৎপাদনের শক্তি, সৃষ্টি বা ধ্বংস, ইত্যাদি।

এই পর্যায়ে জনপ্রিয় ধর্মের মধ্যে বৃহৎ ও লঘু ঐতিহ্যের যে বিচিত্র সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়, তার সম্ভাব্য কারণ এই যে, দুটি ধারার মধ্যে পরস্পর অভিমুখীনতা সর্বদা অব্যাহত ছিল। তাই দীর্ঘ-নিকায়ের মহাসময়সুত্তন্ত অংশে পৃথিবী ও বিশাল পর্বতসমূহের আত্মা, দিকসমূহের চারজন অধিপতি, গন্ধর্ব, নাগ, গরুঢ়, দানব এবং ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও সনৎকুমার উল্লিখিত। বেদাঙ্গগুলিতে বিদেহী আত্মার উপাসনা অধিকতর প্রকট; কারণ আদিম মানুষের মানসিকতায় বিশ্বজগৎ সেই সব বৈরিতাকামী মন্দ আত্মায় পরিপূর্ণ যারা নিয়ত মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও সুখকে আক্রমণ এবং ধ্বংস করতে উদ্যত। তাই বহুদূর পর্যন্ত গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলি আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক, মুখ্যত অমঙ্গল দূর করাই এগুলির উদ্দেশ্য।

শ্রৌত ও গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে বিপুল অংশ এক সাধারণ বৃত্তের অন্তর্গত; যেমন অগ্নিহোত্র, দর্শপূর্ণমাস, পিণ্ডপিতৃযজ্ঞ এবং কিছু কিছু চাতুর্মাস্য অনুষ্ঠান উভয়বিধ গ্রন্থেই আলোচিত হয়েছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মাত্র কল্পসূত্রই প্রচলিত ছিল; পরবর্তিকালে অনুষ্ঠানসমূহ বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুযায়ী রচনাকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছিল। তিনটি যজ্ঞাগ্নির প্রয়োগদ্বারাও নির্ধারিত হত, কোন বিষয় কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে; শ্রৌত যাগে যেহেতু এই তিনটি অগ্নিরই প্রয়োজন ছিল, তাই এই তিনটির যে কোনও একটি অগ্নি দ্বারা অনুষ্ঠিত যে কোনও যজ্ঞ প্রাচীনতম শ্রৌতসূত্রগুলিতে আলোচিত হয়েছিল এবং ফলত প্রত্যেকটি গৃহ্য অনুষ্ঠান তার অন্তর্ভুক্ত হল। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে এমন কিছু বিষয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে যা গৃহ্যসূত্রগুলির পক্ষে উপযোগী; স্পষ্টত এর কারণ এই যে, সে সময় কোনও পৃথক সূত্র সাহিত্যেরই অস্তিত্ব ছিল না— গৃহ্যসূত্রের তো প্রশ্নই ওঠে না। উপনয়ন, গার্হপত্য অগ্নির প্রতিষ্ঠা, বিবাহ, মৃত্যু ও মরণোত্তর শ্রাদ্ধাদি এ সবই মূলত গৃহ্যানুষ্ঠান; ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতেও এগুলি আলোচিত হয়েছে। সূত্রগুলি যখন পৃথক শ্রেণির রচনারূপে রচিত হতে লাগল, তখনও যে মিশ্র বিষয়বস্তু-নির্ভর একটি সূত্র ছিল, আপস্তম্ব সূত্র থেকে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। শ্রৌতসূত্রটি এই গ্রন্থের প্রথম চোদ্দোটি অধ্যায়ে গঠিত; তারপর যথাক্রমে পরিভাষা ও গৃহ্যসূত্রের মন্ত্রপাঠ অংশ পাওয়া যায়; শেষ দুটি অধ্যায়ে ধর্ম ও শুল্ক সূত্রগুলি গঠিত হয়েছে। এর থেকে আমরা কল্পসূত্র সাহিত্যের স্পষ্ট ঐতিহাসিক স্তর সম্পর্কে অবহিত হই; এর প্রাথমিক স্তরে প্রতি শাখা নিজ স্ব বৈশিষ্ট্য রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল।

সামূহিক বৈদিক যজ্ঞে তিনটি অগ্নি প্রয়োজনীয় ছিল— আবহনীয়, দক্ষিণা ও গার্হপত্য। মোটামুটি ভবে এগুলি দেবতা, পিতৃপুরুষ ও মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এদের মধ্যে শুধুমাত্র গার্হপত্য অগ্নি গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যবহৃত হয়। শতপথ ব্রাহ্মণের একটি দেবকাহিনিতে ইড়া বা শ্রৌত যাগের যজ্ঞীয় হব্যের উৎস বর্ণিত হয়েছে। এটা যেহেতু মনু কর্তৃক নিবেদিত প্রথম পাকযজ্ঞে উদ্ভূত হয়েছিল, তাই কোনও পাকযজ্ঞে ইড়া নেই। প্রকৃতপক্ষে এই অনুপস্থিতি সামূহিক ও গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলির প্রধান প্রতীকী পার্থক্যকে সূচিত করেছে। এ দিক দিয়ে এই শেষোক্ত অনুষ্ঠানগুলি প্রাচীনতর ও অধিকতর সর্বজনীন— সম্ভবত ইড়া আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে কোনও সময়ে এর উদ্ভব হয়েছিল।

ধর্ম

গৃহ্যসূত্রগুলি ভারতবর্ষের ধর্মীয় ইতিহাসের একটি অত্যন্ত কৌতূহলজনক ও তাৎপর্যপূর্ণ স্তরের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই সাহিত্য বৌদ্ধযুগের পরবর্তী এমন একটি সময়ে রচিত, যখন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিত্তি কঠোরতম আঘাতে পতনোন্মুখ। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম একদিক দিয়ে তাকে যে উন্মেষশীল দর্শনের সঙ্গে একটি আপোসে উপনীত হতে বাধ্য করেছিল, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় উপনিষদগুলিতে। অন্য দিক দিয়ে অবৈদিক অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, প্রত্নকথা, আচারবিধি প্রভৃতির অস্তিত্বকে স্বীকার করতে তা বাধ্য হয়েছিল এবং অব্যাহত ও ব্যাপক আর্যীকরণের মাধ্যমে এই স্বীকৃতি একটি বিশেষ চরিত্র অর্জন করল। এই প্রক্রিয়া বহুমন্ত্রের অসংগতির মধ্যে আভাসিত হয় যাদের সঙ্গে আলোচ্য অনুষ্ঠানের কোনও সম্ভাব্য সম্পর্ক নেই। এই ধর্মমতের মধ্যে প্রতিমা, মন্দির, পবিত্র অরণ্য, ব্রতকথা এবং অন্যান্য পৌরাণিক উপাদান অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল; এই সব পৌরাণিক উপাদানকে আর্যরূপ দান করার একটি অন্তিম প্রচেষ্টার দ্বারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আয়ুষ্কাল প্রসারিত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। বৈদিক ও অবৈদিক গার্হস্থ্য অনুষ্ঠান সংমিশ্রিত হয়ে একটি চরিত্রের গার্হস্থ্য ধর্ম উদ্ভূত হয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে সংযোজিত হয়; গৃহ্যসূত্রগুলি এই আচার-পদ্ধতিকে বিধিবদ্ধ করে তাদের সম্ভ্রম ও নিষ্ঠার গুণে অন্বিত করতে চেয়েছিল।

সমাজ

গৃহ্যসূত্রে প্রফিলিত সমাজচিত্র থেকে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, সমাজতান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্ক ও পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। কৃষিক্ষেত্রের শ্রমিক, গ্রামীণ কারুশিল্পী ও গৃহভৃত্যরূপে যে শূদ্ররা কর্মে নিরত থাকত, তাদের প্রায়ই নারী ও হীনতর জন্তুর সঙ্গে একত্র উল্লেখ করা হয়েছে; শূদ্রকে অপরিচ্ছন্ন ও সামাজিক ভাবে হেয় বলে বিবেচনা করা হত। শূদ্রের জন্য কোনও গৃহ্য অনুষ্ঠান নির্দেশিত হয়নি। এর একটি কারণ সম্ভবত এই যে, আদিম অধিবাসীদের বিপুল অংশ, বিশেষত যারা আর্যদের দ্বারা পরাজিত বা সামাজিক ভাবে অধিকৃত হয়েছিল, তারা নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি অব্যাহত রেখেছিল; এবং আর্যরা এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আর্য সংস্কৃতির বৃত্তে একাত্মীভূত করে নিতে চায়নি তারা এই জনগোষ্ঠীকে তাদের অভ্যস্ত রীতিতে জীবননির্বাহ করতে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও বাধা দেয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত এরা অল্প মূল্যে নিজেদের শ্রমশক্তি জোগান দিয়ে গেছে। আর্যদের জীবনদৃষ্টিতে কখনও ধর্মান্তরীকরণের প্রাধান্য ছিল না। শূদ্র দাসগণ যে প্রায়ই পালিয়ে যেতে চাইত, তা বিশেষ ভাবে তাদের সম্পর্কে প্রয়োজ্য ঘৃণা ও অমানবিক শাস্তিবিধান থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বস্তুত প্রাচীনতর সাহিত্যের নিদর্শন থেকেও শূদ্রের সামাজিক হীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়: পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, যে শূদ্র কোনও দেবতার আশ্রয় ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে (৬:১:১১) এবং জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে যে অপরের পাদ প্রক্ষালন করেই শূদ্র জীবনধারণ করে। (১:৬৮, ৬৯)

নারীরা অনেকেই অনার্য পরিবার-সম্ভূত হওয়ায় যজ্ঞানুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণের কোনও অধিকার ছিল না। যে কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়, সে সব ক্ষেত্রেও মন্ত্রপাঠের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। অবশ্য গোভিল গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে যে, নারী সন্ধ্যায় গৃহে বৈশ্বদেববলি অর্পণ করতে পারে। অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠানের একটি নিয়ম অনুযায়ী পত্নী প্রভাতে ও সন্ধ্যায় আহুতি অর্পণ করতে পারে যেহেতু, গোভিল গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী ‘পত্নী হল গৃহ এবং অগ্নিগৃহ্য’ (১:৩:১৬); কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সে মন্ত্রোচ্চারণে অধিকারিণী ছিল না। স্বামীর ইচ্ছাই যে স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করত, তা বিবাহের মন্ত্র থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায়। (পারস্কর গৃহ্যসূত্র ১:৮:১১) স্ত্রীর প্রাথমিক কর্তব্য ছিল স্বামীর প্রীতি-বিধান এবং সন্তান— বিশেষত পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়া। সমাজের নিম্নতম স্তরে বহু দাসীর উপস্থিতি ছিল— প্রকৃতপক্ষে যারা বারাঙ্গনা অপেক্ষাও হীন অবস্থায় জীবনযাপন করত।

গৃহ্যসূত্রগুলি বিশ্লেষণ করে আমরা যে কৌতূহলজনক তথ্য সম্পর্কে অবহিত হই, তা হল, বিদ্যার্থীর দীক্ষাগ্রহণ (উপনয়ন) এবং বিবাহের অনুষ্ঠান ও মন্ত্রের মধ্যে প্রশ্নাতীত সাদৃশ্য, যা দুটি অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অনুপুঙ্খের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত। এর কারণ হয়তো এই যে, উভয় সম্পর্কই সামাজিক উৎপাদন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিক চুক্তিরূপে গণ্য হত। কেননা, বিবাহ হল সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশে অনুষ্ঠেয় কর্ম, যে সন্তানপরম্পরা কায়িক ভাবে আর্য জনগোষ্ঠীর ধারাবাকিতা অক্ষুণ্ণ রাখে; আবার, বেদাধ্যয়নে দীক্ষিত হয়ে আর্য পুরুষ স্বজাতির আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরম্পরা অব্যাহত রাখে। যে যুগে অক্ষরজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়নি, তখন, জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় রক্ষার পক্ষে এই প্রক্রিয়া ছিল আবশ্যিক; তাই দীক্ষানুষ্ঠান অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ ও বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত ছিল।

তখনকার পারিবারিক ব্যবস্থার একক ছিল প্রধানত যৌথ পরিবার; যদিও কিছু কিছু ইঙ্গিত থেকে মনে হয়, একই গৃহে বিভিন্ন শাখার জন্য পৃথক পাকশালা ও পাকের ব্যবস্থা ছিল। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের উপর বিপুল গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল। পরলোকগত আত্মা ভোগের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পীড়িত হয়ে জীবিত মানুষের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত হবে; তাই তাদের যথাযথ ভাবে শান্ত করা প্রয়োজন; বস্তুত এইখানেই শ্রাদ্ধের গভীর তাৎপর্য। পুরোহিতদের পক্ষেও এটি ছিল অত্যন্ত লাভজনক অনুষ্ঠানগুলির অন্যতম। দ্রুত প্রসারণশীল দেবসঙ্ঘে এই পর্যায়ে কয়েকজন সম্পূর্ণ নূতন দেবতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। অমঙ্গলপ্রদ ও শুভসূচক আত্মার সংখ্যা ও ক্রিয়া যেহেতু ক্রমশ বর্ধিত হল, তাদের শান্ত, নিয়ন্ত্রিত ও বরদানের পক্ষে অনুকূল করে তোলার জন্য যথাযথ অনুষ্ঠানের প্রয়োজনও বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান জ্ঞান ও সমুদ্রযাত্রায় তার উপযোগিতা অনুভূত হওয়ায় গ্রহ-পূজার নূতন প্রবণতা দেখা গেল। ব্রহ্মাশ্রেণির পুরোহিতের আসনে কুশ-নির্মিত প্রতীকী পুত্তলিকা স্থাপন করে যজমান নিজেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারতেন; এতে মনে হয় যে, গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানগুলিতে পুরোহিত নিয়োগ অপরিহার্য ছিল না।

গৃহ্যসূত্রগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল গর্ভধারণের পূর্ব পর্যন্ত স্বতন্ত্র সামাজিক এককরূপে নারীর জন্য কোনও পৃথক অনুষ্ঠানের বিধান ছিল না; পুত্রসন্তানের সম্ভাব্য জননীরূপে অবশ্য নারীর কতকটা গুরুত্ব ছিল। অন্যান্য সমস্ত গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানে নারী কেবলমাত্র স্বামীর সহায়করূপে সক্রিয় থাকত কিন্তু কখনও মন্ত্র উচ্চারণ করত না। শূদ্রের মতোই নারী কোনও আনুষ্ঠানিক পরিচিতির অধিকারী ছিল না। অবশ্য শূদ্রদের সামাজিক পরিচিতিও ছিল না; গৃহ্য ও ধর্মসূত্রগুলিতে শূদ্রকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, যদিও কৃষিক্ষেত্রে ও ক্ষুদ্র শিল্পে শূদ্রগণ প্রধানত শ্রমশক্তির জোগান দিত। শূদ্র ভৃত্যের ত্রুটি লক্ষ্য করলে প্রভু তার ইচ্ছা মতো নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি দিতে পারত; গৃহ্যসূত্র সাহিত্যের বিপুল অংশে এ ধরনের শাস্তিকে অনুমোদন করা হয়েছে। ভৃত্য বা দাস সম্পূর্ণরূপে প্রভুর দয়ার অধীন ছিল; তাকে রক্ষা করার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। কোনও শূদ্র বা পতিত ব্যক্তি বা কুকুরের স্পর্শ লাগা খাদ্য অনুষ্ঠানের পক্ষে অশুদ্ধ বিবেচিত হত— আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের এই তালিকাটি (১:৫:১৬, ২১, ২২, ৩০) কোনও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। শূদ্র ও নারী, উভয়কে সম্পত্তিরূপে বিবেচনা করা হত, এমনকী এরা ছিল সামাজিক মর্যাদারও নিদর্শন; এদের সর্বদা কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হত। অত্যন্ত বিরল কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া গৃহ্যসূত্রে জনসাধারণের বিপুল অংশের জীবনের চিত্র এমনই নৈরাশ্যজনক; ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু ব্যতিক্রম বস্তুত নিয়মকেই প্রমাণিত করে।

সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণের অভ্যুত্থান ছিল আর একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তবে আমরা যেন এই তথ্য বিস্মৃত না হই যে, সমাজে ব্রাহ্মণের তর্কাতীত প্রাধান্য, কর থেকে অব্যাহতি বা অন্যান্য বর্ণের জন্য আইনের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার থেকে ব্রাহ্মণের অব্যাহতি, বিভিন্ন প্রকার দানগ্রহণে তাদের স্বাভাবিক যোগ্যতা, এ-সবই সামাজিক প্রতিপত্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত ভাবে কেবলমাত্র জন্মপরিচয়ের উপরই নির্ভারশীল ছিল। কিন্তু এই সমস্তই ছিল সমাজের পরবর্তী কালপর্বের পরিচায়ক। খ্রিস্টপূর্ব তিনশো থেকে খ্রিস্টীয় একশো অব্দের মধ্যে কোনও শিলালিপিতে ব্রাহ্মণ বা সুনির্দিষ্ট ব্রাহ্মণ্য অনুষ্ঠান বা মন্দিরের উল্লেখ নেই। ব্রাহ্মণের প্রতি ভূমিদান লিপি প্রথম উৎকীর্ণ হয়েছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে এবং এ ধরনের ভূমিদান পরবর্তী দুই শতাব্দীর মধ্যে অসংখ্যবার লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এই যুগেই গৃহ্যসূত্রের অন্তিম পর্যায়টি আত্মপ্রকাশ করে। যাই হোক, বৈদেশিক আক্রমণকারীদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে কঠোর বর্ণবিভক্ত সমাজের ভিত্তিভূমি প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। তাই সম্ভবত সূত্রসাহিত্যে সমাজপতিদের প্রাচীন সমাজ-সংগঠন অক্ষুণ্ণ রাখার প্রায়সই শুধুমাত্র অভিব্যক্ত হয়নি, শূদ্র এবং সমাজের অন্যান্য নিপীড়িত অংশের প্রতিরোধের লক্ষণও প্রতিফলিত হয়েছে। এরা সম্ভবত ক্রমেই অস্পষ্ট ভাবে হলেও এই উপলব্ধিতে উপনীত হচ্ছিল যে সমাজের উৎপাদক-শক্তিরূপে তাদের মৌলিক অবদান রয়েছে।

গৃহ্যসূত্রের মন্ত্রসমূহ সংহিতা থেকে কখনও প্রত্যক্ষ ভাবে ঋণ হিসাবে গৃহীত হয়েছে আবার কখনও বা অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ ভাবে রচিত হয়েছে। এই দুই ধরনের মন্ত্র বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এরা শুধু দুটি ঐতিহ্যের প্রতিনিধিমাত্র নয়, সূত্র সাহিত্যের দুটি সুস্পষ্ট স্তরেরও নিদর্শন। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য রচিত এবং সংহিতা ও ব্রাহ্মণসাহিত্যের অন্তর্গত নয় এমন মন্ত্র নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে উপযোগী ও প্রয়োজনীয় হলেও যে সব মন্ত্র সংহিতা ও ব্রাহ্মণ থেকে গৃহীত হয়েছে, তাদের অধিকাংশই কৃত্রিম ভাবে নির্বাচিত এবং তাদের উপযোগিতাও নেই বললেই চলে। এটা থেকে সম্ভবত এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলি একটি বিশেষ পর্যায়ে শ্রৌত অনুষ্ঠান অর্থাৎ সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের সঙ্গে অসম্পৃক্ত ভাবে বিরাজিত ছিল। যজ্ঞধর্ম যখন বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রবল ভাবে আক্রান্ত হল, তখনই গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিকে প্রামাণ্য ও সাম্মানিত করে তোলার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হল— অথর্ববেদের স্বীকৃতিলাভের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই নিবিড়; রক্ষণশীল বৃহৎ ঐতিহ্যে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে নিবেদিত অনুষ্ঠানসমূহ অর্ধদেবতা এবং বিভিন্ন ধরনের যক্ষ, অপ্সরা, পিশাচ, দানব ও রাক্ষস, প্রভৃতির উদ্ভব ও স্বীকৃতিলাভের ফলে কতকটা যান্ত্রিক ভাবেই গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিতে সংহিতা ও ব্রাহ্মণের মন্ত্রগুলি গৃহীত হল। সেই সঙ্গে সেই বৈদিক যুগের অন্তিম পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটল, যার সূচনা হয়েছিল ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল ও ব্রাহ্মণসাহিত্য রচনার মধ্যে দিয়ে। বিবাহ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অধিকাংশ ইন্দ্রজালতুল্য মন্ত্র যে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল থেকে গৃহীত হয়েছে, তাতেও এ অনুমানের সমর্থন পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে শুধু বৈদিক মন্ত্রের সাহায্যে গৃহ্য অনুষ্ঠানগুলিকে পরিশীলিত করার প্রক্রিয়াই হয়নি, প্রাচীনতর ভাসমান লোকায়ত উপাদানের স্বীকৃতিদানও ঘটেছিল। লোকবিশ্বাস ও আচারের যে সব উল্লেখ সূর্যাসূক্তে পাওয়া যায় এবং গন্ধর্বচর্যার সঙ্গে তার যে সম্পর্ক আভাসিত তা সুস্পষ্ট ভাবে লঘু ঐতিহ্যেরই অন্তর্গত। এই পর্যায়েই তা রক্ষণশীল শাস্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল।

ধর্মসূত্র

ধর্মসূত্রের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি নূতন যুগে প্রবেশ করি, কারণ তা বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিক সাহিত্যের অংশ হলেও যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ধর্মসূত্রগুলিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য— এই প্রথম তিন বর্ণের জীবনের চতুরাশ্রমকে (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও যতি) কেন্দ্র করে সামাজিক জীবনধারার পরিচয় পাওয়া যায়। সামাজিক সামঞ্জস্য রচনা যদিও এদের প্রধান লক্ষ্য, তবু উপনিষদের পরে এই সমাজে বর্ণভেদ প্রথা ধীরে ধীরে কঠোরতর হয়ে উঠেছিল। বর্ণগুলির মধ্যে চলিষ্ণুতা ক্রমেই অতীতের বস্তু হয়ে পড়ছিল। পূর্ববর্তী যুগগুলিতে অসবর্ণ বিবাহের ফলে যে-সমস্ত অসংখ্য নতুন মিশ্রবর্ণের উৎপত্তি হয়েছিল, তাদের জন্য সমাজে উপযুক্ত স্থান ও যথাযথ কর্তব্য, অধিকার ও অপরিহার্য দায়িত্ব নির্দেশ করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তিকালে ভারতীয় সামাজিক জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার পক্ষে ধর্মসূত্রগুলি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। এই যুগে জনসাধারণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যে বিপুল পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, তার নিম্নোক্ত নিদর্শনগুলি উল্লেখ করা যায়: লৌহনির্মিত অস্ত্র এবং কৃষি ও শিল্প সম্পর্কিত যন্ত্র ও উপকরণের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, বাণিজ্য, নগররাষ্ট্রের উদ্ভব, বণিকদের হাতে বিপুল সম্পদের কেন্দ্রীভবন, প্রাথমিক উৎপাদকদের ক্রমাগত দারিদ্র্যবৃদ্ধি, উৎপাদক ও উৎপন্ন দ্রব্যের ভোক্তার মধ্যে সুস্পষ্ট বিচ্ছেদ, শ্রেণিভেদ, কারুশিল্প, ও কুটিরশিল্প-নির্ভর অর্থনীতিতে শূদ্রের বিপুল শোষণ এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অংশত রাজনৈতিক শক্তি সেই সব ব্যক্তিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া, যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল খনি ও খনিজদ্রব্য এবং যারা সশস্ত্র রক্ষীরূপে বাণিজ্য শকটের অনুগমন করত। অর্থাৎ সমাজের নতুন প্রভু ছিল নবোদ্গত বণিকশ্রেণি ও অভিজাতবর্গ, অর্থাৎ বিত্তবান ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্প্রদায়। যেহেতু তিনটি আর্যবর্ণের পুরুষরা শক্তিশালী পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিল, তাই শূদ্র ও নারী ক্রমশ অধিকতর নিষ্পেষণের সম্মুখীন হল।

বিভিন্ন জাতির মধ্যে কয়েক শতাব্দীব্যাপী মিশ্রণ এবং সমস্ত প্রকার সম্ভাব্য পারস্পরিক বিনিময় ও সংযোগের মাধ্যমে বহু উপবর্ণের উত্থানের ফলে এমন একটা সময় উপস্থিত হল যখন বর্ণপ্রথা-শাসিত সমাজের সীমারেখা কতকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল; ফলে সমস্ত নবোদ্ভূত বর্ণের সামাজিক অবস্থান ও কর্তব্য নির্দেশ করা সম্ভব হল। অনুরূপ ভাবে, গৃহস্থদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য অর্থাৎ নিয়মিত যজ্ঞ সম্পাদনের উপর বৈদিক সাহিত্যের অতি স্পষ্ট গুরুত্ব আরোপ এবং সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী বা ভ্রমমান যোগীদের প্রভাবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী প্রক্রিয়ার মধ্যে সুদীর্ঘ দ্বন্দ্বের সংগ্রামের পরে শেষ পর্যন্ত আপোসের একটি পথ আবিষ্কৃত হল— অরণ্যে অবসর জীবনযাপন এবং ভ্রমমান সন্ন্যাসীর জীবনকে মানুষের জীবনের শেষ দুটি স্তররূপে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর কতকটা সামাজিক সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যার ফলে কোনও প্রকার প্রধান প্রতিবন্ধক ছাড়াই সামাজিক জীবনের প্রবাহ অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে। বিদ্রোহ বা আপসবিরোধী মনোভাবের বিশেষ কোনও প্রমাণ যেহেতু আমাদের হাতে নেই, তাই আমরা এটাও ধরে নিতে পারি না যে, এই সুদীর্ঘ পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। বস্তুত এই যুগে বহু বৈদেশিক আক্রমণ, সামাজিক সংগঠনে অনেক নতুন উপাদানের আত্মীকরণ, বহু সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, পরস্পরবিরোধী ও পররাজ্য অধিকারের জন্য নগর ও রাষ্ট্র-মধ্যবর্তী যুদ্ধ, ইত্যাদি আমরা লক্ষ্য করেছি; সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, এই যুগে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ছিল সংঘাতে আকীর্ণ।

এ ধরনের সামাজিক দ্বন্দ্বকে ন্যূনতম পর্যায়ে হ্রাস করে আনাই ছিল ধর্মসূত্রগুলির দায়িত্ব। এই পর্যায়েই কর্ম ও জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব বিশেষ অভিব্যক্তি লাভ করল— এই দুটি অতুলনীয় মতবাদ সমস্ত প্রকার সামাজিক অসাম্যের চমৎকার ব্যাখ্যা দান করে সমাজে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে পরোক্ষ ভাবে সহায়তা করেছিল। এই যুগের ধর্ম ও দর্শন মৌল ভাবাদর্শগত ভিত্তি স্থাপন করার ফলে ধর্মসূত্রের রচয়িতারা উপযুক্ত নিয়ম প্রণয়ন করে সামাজিক বিধিব্যবস্থাকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা দিতে চাইলেন এবং সেই সঙ্গে বিভেদকামী শক্তিগুলিকে অধার্মিক ও অসামাজিক আখ্যা দিয়ে চূর্ণ করে দিতে চাইলেন। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, অনুষ্ঠানগুলির সংখ্যাবৃদ্ধি এবং নতুন অর্চনাপদ্ধতি ও নতুন দেবতাদের প্রবর্তন রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত; এটাই সে যুগের বিশিষ্ট চারিত্র্যলক্ষণ। নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সার্বভৌম নগররাষ্ট্রের শাসকরা জনসাধারণের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে বিভ্রান্ত করার কৌশলরূপে পুরোহিত ও অনুষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করতেন।

ধর্মসূত্রের বিধিসমূহের প্রকৃত ক্ষেত্র হল বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমগুলি; তবে বাস্তবে এদের ক্ষেত্র আরও বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। ধর্মসূত্রগুলিতে শ্রৌতসূত্র ও গৃহ্যসূত্রসমূহের প্রাগাবস্থান আভাসিত এবং প্রকৃতপক্ষে সেগুলি এদের সম্পূরক। ধর্ম কী, এই প্রশ্নের উত্তরে জৈমিনি তাঁর মীমাংসা সূত্রে বলেছেন: ‘ধর্ম মানুষকে যথার্থ শ্রেয় আচরণে প্রণোদিত করে।’ এই শ্রেয় আচরণের তৎকালীন ভিত্তি ছিল বর্ণাশ্রম।

রচনা

প্রধান ধর্মসূত্রগুলির রচয়িতা আপস্তম্ব, আশ্বলায়ন, গৌতম, বৌধায়ন, বশিষ্ঠ, বৈখানস, দ্রাহ্যায়ণ, কাত্যায়ন, অগস্ত্য, শাকল্য, সত্যাষাঢ় হিরণ্যকেশী ও সবণীয়। এদের মধ্যে শুধু প্রথম ছয়জনের রচনা অধিকতর পরিচিত; এ ছাড়াও বিষ্ণুস্মৃতি নামে একটি রচনার সন্ধান পাওয়া যায়— সম্ভবত বিষ্ণু নামে কোনও ব্যক্তি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

অধিকাংশ ধর্মসূত্র খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল, যদিও এর উচ্চতর ও নিম্নতর সীমা আমরা আরও কিছু দূর প্রসারিত করতে পারি। এই কালসীমা ভারতবর্ষের ইতিহাসে চূড়ান্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ পরবর্তী দুই সহস্র বৎসর ধরে যে সব চিন্তা ও ধারণা ভারতীয় ধর্ম ও সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে সেগুলির উদ্ভব এই যুগেই।

ধর্মসূত্র সাহিত্য প্রধানত গদ্যে রচিত হলেও কোনও কোনও গ্রন্থে কয়েকটি শ্লোকও বিক্ষিপ্ত ভাবে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ভাষা ধ্রুপদী সংস্কৃতের সমীপবর্তী; যদিও কিছু কিছু অধ্রুপদী বৈশিষ্ট্য তখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে, তবু সামগ্রিক ভাবে ভাষা বৈদিক অপেক্ষা ধ্রুপদী সংস্কৃতের অধিক নিকটবর্তী। গ্রন্থগুলি বিভিন্ন প্রশ্নে বিভক্ত, প্রশ্নগুলি প্রায়ই অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং অধ্যায় ও কখনও কখনও খণ্ডে বিভক্ত। অবশ্য কোনও ধরনের সম্পাদনা প্রক্রিয়ার নিদর্শন খুব সামান্যই পাওয়া যায়, কেননা বিভিন্ন অধ্যায় ও উপবিভাগগুলি সাধারণত নির্বিচারে বিভক্ত করা হয়েছে, কোনও অন্তর্নিহিত আদর্শ অনুযায়ী হয়নি। সাধারণত ধর্মসূত্র একই গ্রন্থকার রচিত গৃহ্যসূত্রের ধারাবাহিক রচনা; এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল ‘বৈখানস ধর্ম প্রশ্ন’ যা বৈখানস রচিত গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্রের যথেচ্ছ সংমিশ্রণ। বৈদিক সাহিত্যের সঙ্গে ধর্মসূত্রের যোগসূত্র নিরতিশয় ক্ষীণ— শুধুমাত্র কয়েকটি আকস্মিক বৈদিক উদ্ধৃতির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ।

বিষয়বস্তু

সামবেদের গৌতম ধর্মসূত্র (ধর্মশাস্ত্র নামেও পরিচিত) সম্ভবত প্রাচীনতম রচনা; তা আঠাশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। ছত্রিশতম অধ্যায়টি সামবিধান থেকে হুবহু উদ্ধৃত হয়েছে; প্রায়শ্চিত্ত ও শুদ্ধীকরণ সংক্রান্ত যে সব বিবরণ রচনায় উল্লিখিত, তাদের মধ্যে ন’টি বিখ্যাত সামমন্ত্ৰ স্থান পেয়েছে— এগুলি সামবেদের সঙ্গে গৌতম ধর্মসূত্রের যোগসূত্রটি প্রতিষ্ঠিত করে। যবন শব্দের উল্লেখ থেকে মনে হয়, এই গ্রন্থের উচ্চতম সীমা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি।

দীক্ষানুষ্ঠান নিয়ে রচনার শুরু; ক্রমে ক্রমে এতে প্রায়শ্চিত্ত ও শুদ্ধীকরণ অনুষ্ঠান এবং ব্রহ্মচর্য আলোচিত হয়েছে। এর অব্যবহিত পরে যথাক্রমে সন্ন্যাসী, বানপ্রস্থী ও গৃহস্থের জীবন সম্পর্কিত নিয়মাবলি বিবৃত হয়েছে। এই চতুরাশ্রমের পরে চতুবর্ণের উপযুক্ত অভিবাদন বিধি, বিভিন্ন অবস্থান এবং আপতিক অবস্থার জন্য উদ্ভাবিত বিশেষ নিয়মাবলি স্থান পেয়েছে। অষ্টম অধ্যায় রাজা ও বেদবিদ ব্রাহ্মণকে পৃথিবীর নৈতিক শৃঙ্খলার নিয়ন্তারূপে অভিহিত করে ব্রাহ্মণের বিশেষ অধিকারগুলি বিবৃত করেছে। পরবর্তী অধ্যায়ে কতকটা আকস্মিক ভাবে স্নাতকদের কর্তব্য ও অধিকার আলোচনা করে চতুর্বর্ণের যথাযোগ্য বিধিসম্মত বৃত্তির তালিকা দিয়েছে। দশম অধ্যায়ে রাজার কর্তব্য, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন এবং সাক্ষ্যদান সংক্রান্ত আইন লিপিবদ্ধ হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলির বিষয়বস্তু হল আনুষ্ঠানিক অশুচিতা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্ঘ্য, বেদাধ্যয়ন এবং খাদ্যাখাদ্য বিচার। নারীর দায়িত্ব ও অধিকার সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ের পরে নয়টি সম্পূর্ণ অধ্যায়ে বিবিধ অপরাধের জন্য (আনুষ্ঠানিক, সামাজিক ও পারিবারিক) তপস্যার কথা আলোচিত হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে রয়েছে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিধিগুলি।

কালানুক্রমিক বিচারে মনে হয়, বৌধায়ন ধর্মসূত্রের স্থান ঠিক এর পরেই। গৌতমের মতো এটিও দাক্ষিণাত্যে উদ্ভূত হয়েছিল। আলোচ্য রচনাটি যে শুধু গৌতম ধর্মসূত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিল, তাই নয়; প্রকৃতপক্ষে এর তৃতীয় অধ্যায়টি শেষোক্ত গ্রন্থের ঊনিশতম অধ্যায় থেকে প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেছে। বৌধায়নের প্রথম দুটি অধ্যায়ে রয়েছে বিস্তর পুনরাবৃত্তি। মোটামুটি ভাবে এই গ্রন্থ বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে গৌতমের অনুরূপ; বস্তুত উল্লিখিত বিষয়সমূহ সমস্ত ধর্মসূত্রের পক্ষেই সাধারণ, তবে আলোচ্য গ্রন্থে বিষয়বস্তু ও বিন্যাস-পদ্ধতিতে শৃঙ্খলা অপেক্ষাকৃত কম। তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত হলেও বৌধায়ন অন্যান্য অনেক শাখার মধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং একে বহু ধর্মসূত্রের প্রধান আকর গ্রন্থরূপে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তৃতীয় প্রশ্নের ষষ্ঠ অধ্যায়ের সঙ্গে বিষ্ণুস্মৃতির আটচল্লিশতম অধ্যায়ের নিবিড় সাদৃশ্য লক্ষণীয়। বৌধায়ন অবশ্য কল্পসূত্রের চতুর্বিত্র রচনায় বিন্যস্ত সম্পূর্ণ সূত্র-সাহিত্যের নিদর্শন রেখে যায়নি; বৌধায়ন রচিত বিভিন্ন অংশ যে-আঙ্গিকে উপস্থিত হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মূল রচনার বিপুল অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে এবং প্রচলিত সূত্রগুলিও অপটু ভাবে সংরক্ষিত। অনেক বিক্ষিপ্ত অংশই স্পষ্টত পরবর্তিকালে রচিত হয়েছিল। গ্রন্থের প্রায় সমস্ত অংশই গদ্যে রচিত, শুধু চতুর্থ প্রশ্ন মূলত পদ্যে গ্রথিত; এতে পরবর্তিকালের প্রত্নপৌরাণিক দেবতা এবং এমনকী, তান্ত্রিক উপাসনা পদ্ধতিও আলোচিত হয়েছে।

বৌধায়নের বিষয়বস্তু অন্যান্য ধর্মসূত্রগুলির অনুরূপ— এতে প্রথম তিনটি বর্ণের উপযোগী চতুরাশ্রমের কথা আলোচিত হয়েছে। খাদ্য সম্বন্ধে বিধিনিষেধ, একত্রভোজন বিষয়ে নিয়ম, শ্রাদ্ধ, তপস্যার বিবিধ পদ্ধতি, আইন ও বিচারপদ্ধতি, জীবনের তৃতীয় চতুর্থ আশ্রমে কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ ও উপযুক্ত আচারবিধি, ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধের বৃত্তে বহু যতি-সম্প্রদায় ও তাদের আচরিত জীবনযাপন পদ্ধতিকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়, কেননা এ সম্প্রদায় ক্রমশই প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করায় এদের আর অবহেলা করা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধ ও তৎসংশ্লিষ্ট শাস্তির সংখ্যা ক্রমাগত বর্ধিত হচ্ছিল; পাপ, অপরাধ ও শাস্তি-বিষয়ক বিপুল কলেবর আলোচনার মধ্যে তা প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতবর্ষে কখনও কোনও সুবিন্যস্ত কেন্দ্রীয় ধর্মশাসকমণ্ডলী ছিল না; তাই কেন্দ্রীয় যাজকমণ্ডলীর স্বাভাবিক কর্তব্য রাজনৈতিক শাসকদের উপর অর্পিত হয়েছিল; এঁরা নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অপরাধের জন্য শাস্তিবিধান করতেন। এ কাজে শাসকের পরামর্শদাতারূপে পুরোহিত ও অমাত্যরা সক্রিয় ছিলেন; তাদের ব্রাহ্মণ পরিচয়ের ফলে তারা রাষ্ট্রের ধর্মযাজক ও রাজনৈতিক বাহুরূপে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পরিবার, সম্পত্তি, রাষ্ট্র ও ধর্ম, তাদের অধিকার ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের সীমা— এই জটিল প্রায়োগিক পদ্ধতির দ্বারা কেন্দ্রীভূত করে তুলেছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে রাজা তাঁর ব্রাহ্মণ উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন কার্য পরিচালনা করতেন।

ত্রিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রের বিষয়বস্তু অন্যান্য গ্রন্থগুলির অনুরূপ। সম্ভবত এর একমাত্র মৌলিক উপাদান হল সেই অংশটি যেখানে চতুর্বর্ণের উৎপত্তি ও নারীর স্বাভাবিক অপবিত্রতা বর্ণিত হয়েছে। জঘন্য পাপের শাস্তিরূপে সমাজ থেকে বহিষ্কার এবং উপযুক্ত তপস্যার পর পুনর্গ্রহণের অনুমতির উল্লেখ থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এর দীর্ঘতম অংশের বিষয়বস্তু হল তপস্যা। এখানে ব্রাহ্মণদের অগ্নিতুল্য সম্মানের অধিকারী বলা হয়েছে এবং তাদের প্রাপ্য দক্ষিণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। বিষয়বস্তুর প্রকৃতি থেকে রচনার অর্বাচীনতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

দুটি প্রশ্নে বিন্যস্ত আপস্তম্ব ধর্মসূত্র এই শ্রেণির অন্যতম প্রধান রচনা এবং বৌধায়নের পরেই এর স্থান। বক্তব্যের মৌলিক ভাবনার বিচারে আপস্তম্ব ব্রাহ্মণসাহিত্যের অধিক নিকটবর্তী। এই গ্রন্থের প্রথম সূত্রেই সমগ্র রচনার পরিধিকে যুগোপযোগী আইন ও সামাজিক ভাবে অনুমোদিত প্রথার সঙ্কলনরূপে সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে; ধার্মিক ব্যক্তির আচরণ এবং বেদকে এ-ব্যাপারে দুটি প্রামাণ্যরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

প্রথম তিনটি বর্ণের আচরণ আলোচ্য গ্রন্থের প্রধান বর্ণনীয় বিষয়; তাই এই তিন বর্ণের সেবাকে শূদ্রের একমাত্র কর্তব্যরূপে এখানে নির্দেশ করা হয়েছে। ধর্মসূত্রগুলির মধ্যে এটি প্রাচীনতর রচনার অন্যতম, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মিশ্র উপবর্ণ সম্পর্কিত নিয়মাবলির অনুপস্থিতি, গোমাংস ভক্ষণ সম্বন্ধে অকুণ্ঠ অনুমোদন এবং তেজারতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিয়মাবলি থেকে। ব্রাহ্মণ্য সমাজের রীতিনীতি ও আচার আচরণকে সমর্থন জানানো ও বিধিবদ্ধ করাই যেন এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। এতে একাদিক্রমে জীবনের চতুরাশ্রম আলোচিত হয়েছে; এর সূত্রপাত ব্রহ্মচর্য পর্যায়ে করণীয় ও অকরণীয় বিষয়গুলির বর্ণনায়— তপস্যা সংক্রান্ত নিয়মাবলি থেকে স্খলিত হলে তা নরকবাসের কারণরূপে নির্দেশিত হয়েছে। আচার্যের প্রতি ব্যক্তিগত সেবা ও অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশের মধ্যে তন্ত্র জাতীয় প্রতিবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে গুরুর ভূমিকার গুরুত্ব আভাসিত। এই গ্রন্থে প্রতিফলিত সমাজে বর্ণভেদ সম্পর্কিত নিয়মাবলি স্পষ্টতই কঠোর ভাবে পালিত হত; বিভিন্ন বর্ণের আচরণ সম্পর্কিত নির্দেশের অসংখ্য অনুপুঙ্খ থেকে আমরা এই সম্পর্কে অবহিত হই। বিস্ময়ের ব্যাপার, নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকায় গোমাংস ও কুক্কুট মাংস অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যে সব জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্যগ্রহণে বাধা ছিল, তাদের বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা থেকে একত্র আহার ও সামাজিক ভাবে জাতিচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রচলিত নিয়মাবলি সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পাই; এই তালিকার মধ্যে রয়েছে লোকশিল্পী ও কারিগর, যোদ্ধা, অর্থের বিনিময়ে আতিথ্যদানকারী ব্যক্তি, চিকিৎসক, কুসীদজীবী, নপুংসক, রাজভৃত্য, উন্মাদ, রুগ্‌ণ, পাপী ও ব্রাহ্মণ-বিধি-বহির্ভূত ভাবে তপস্যায় নিরত ব্যক্তি।

জীবনের চারটি স্বীকৃত লক্ষ্য, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ, সম্বন্ধে এখানে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। আপাত-নীরস বিষয়বস্তুর মধ্যে কখনও কখনও বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক চিন্তাসমৃদ্ধ শ্লোক সন্নিবিষ্ট হয়েছে। সাধারণত প্রতি আচরণবিধি সম্পর্কেই অতিরিক্ত সূক্ষ্ম অনুপুঙ্খ পাওয়া যায়। হত্যার পাপ-ক্ষালন সম্পর্কিত নির্দেশাবলি থেকে আমরা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস বিষয়ে ভালমতো ধারণা পাই; যেমন, বলা হয়েছে, ক্ষত্রিয়-হত্যার প্রায়শ্চিত্ত একসহস্র গো-দান, বৈশ্য-হত্যার জন্য একশত এবং শূদ্র বা নারী-হত্যার জন্য দশটি গরু ও একটি ষাঁড় দান করতে হবে। ব্রাহ্মণ হত্যা মহাপাপ বলে গণ্য হত। এর যথাযথ প্রায়শ্চিত্ত ছিল অরণ্যে দ্বাদশবর্ষব্যাপী কঠোর তপস্যা কিংবা অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন। বিবিধ শ্রেণির পাখি, নীচ প্রাণী এবং নারী ও শূদ্র-হত্যার একই প্রায়শ্চিত্ত নির্দেশ করা হত। আপাতদৃষ্টিতে প্রত্যেক জঘন্য পাপের জন্যই প্রায়শ্চিত্ত বিহিত হয়েছিল। কখনও কখনও আমরা মানবতাবাদেরও আশ্চর্য আভাস পাই। কিছু কিছু প্রায়শ্চিত্তের পদ্ধতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদের নিদর্শনও পাওয়া যায়। চতুর্বর্ণের উপযুক্ত কর্ম এবং আপতিক অবস্থা সম্পর্কিত নিয়মাবলির পরেই দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। আট প্রকার বৈধ বিবাহ-প্রক্রিয়ার মধ্যে কেবলমাত্র প্রথম তিনটিকে প্রশংসা করা হয়েছে; গান্ধর্ব বিবাহ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিবাহ-রীতিকে তুলনামূলক ভাবে হীনতর ভাবা হয়েছে। তা ছাড়া যৌতুক অপেক্ষা কন্যা-শুল্ককে অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হত। বিভিন্ন বর্ণের পত্নীর পুত্রদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে বর্গীকরণ করা হত— পিতা ও জন্মদাতার প্রতি তাদের দায়িত্বও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। পত্নীকে স্বামীর সম্পদের যৌথ অধিকারিণী বলে ভাবা হত; অবশ্য তা দান বা বিক্রয়ে তার অধিকার ছিল না, ধর্মীয় কর্ম, পুণ্য ও সম্পদ ভোগের ব্যাপারে পত্নী তার স্বামীর সমান অংশ-ভাগিনী হতেন এমন কথাও কোথাও কোথাও আছে। ক্রমশ শ্রাদ্ধ অধিকতর তাৎপর্য অর্জন করেছে; বহু অংশে প্রচুর অনুপুঙ্খসহ শ্ৰাদ্ধ বিষয়ে নানাবিধ নিয়ম লিপিবদ্ধ হয়েছে। বিশেষত গরু ও মোষের মাংস পিতৃপুরুষের পক্ষে অত্যন্ত প্রীতিপদ বলে বিবেচিত হত। মাছ এবং গণ্ডার সমেত অন্যান্য জন্তুর মাংস অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পক্ষে উপযুক্ত খাদ্যার্ঘ্য রূপে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বৈরাগ্য; এই বিশেষ পর্যায়ে জীবনযাপন প্রণালী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নিয়ম প্রণীত হয়েছিল। এই সমস্ত নিয়মের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে অভিব্যক্ত; তবে বৌদ্ধধর্ম অপেক্ষা অধিক কঠোরতা এদের মধ্যে নির্দেশিত হয়েছে। এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সন্ন্যাসমূলক ধর্মের প্রবণতার মধ্যে প্রবল বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। প্রতি ধারার গুণাবলি যথাযথ ভাবে বর্ণিত হয়েছে; তবে শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মের ওপরেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কেননা সন্ন্যাসধর্মকে শুধুমাত্র অত্যন্ত বৃদ্ধ ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অবশ্য অহিংসাকে জীবনের মূল চালিকাশক্তিরূপে প্রশংসা করায় যজ্ঞধর্মের গুরুত্ব অনেকটা যেন হ্রাস পেয়েছে। রাজপ্রাসাদ, এর স্থাপত্য, রাজকীয় অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে একটি অংশ গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট আছে; এতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন এবং ব্রাহ্মণের প্রতি রাজকীয় দান আলোচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, ব্রাহ্মণরা করদান থেকেও অব্যাহতি পেতেন; অবশ্য সেই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী, নারী, শিশু এবং সন্ন্যাসীদেরও কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত— অবশ্য এই শেষোক্তদের সম্পত্তিতেই কোনও অধিকার ছিল না, যা ব্রাহ্মণের ছিল। একটি মানবিক বিধি অনুযায়ী রাজা ধর্ষিতা নারীকে ভরণপোষণ দিতেন; অপরাধী পুরুষকে হত্যা করে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান দেওয়া হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে অবহেলার ফলে শস্যহানি ঘটলে সে জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।

তিনটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বৈখানস ধর্মসূত্র সম্ভবত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে রচিত। শ্রৌতসূত্র ও ধর্মগ্রন্থগুলির একই গ্রন্থে ক্রমান্বয়ে সন্নিবিষ্ট হয়েছিল; এই দুটি অংশকে একত্রে ‘বৈখানস প্রশ্ন’ রূপে অভিহিত করা হয়। রচনাটির নাম তাকে একটি বিশিষ্ট সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে; বস্তুত এই রচনা জীবনের চতুর্থ পর্যায়কে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করে বিভিন্ন যতি-সম্প্রদায়ের রীতিনীতিকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে। এই গ্রন্থকে চারটি প্রধান ভাগে বিন্যস্ত করা যায়, যার প্রতিটি অংশে তপস্যার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির আলোচনা করা হয়েছে। তবে গ্রন্থটির নামকরণে যে বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত রয়েছে, তার সঙ্গে প্রকৃত সংজ্ঞার ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। তা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পরিধির মধ্যে সন্ন্যাসমূলক ধর্মাচারকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা এবং সে চেষ্টার সাফল্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই রচনা সেই তাৎপর্যপূর্ণ যুগের অন্তর্গত, যখন মোক্ষদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অনানুষ্ঠানিক উপাসনা-পদ্ধতির প্রতি উপনিষদের বিশেষ সুবিধাদানের প্রবণতা বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছিল। নীতিগত ভাবে যখন মৌলিক আপোসের প্রবণতা গৃহীত হল, বিভিন্ন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার জটিল ও দুরূহ কর্তব্য সম্পাদনের ভার সমাজের উপর এসে পড়ল; তত দিনে ওই সব সম্প্রদায়ের নাম অতিপরিচিত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে, ফলে শেষ দুটি আশ্রমে এদের স্থান নির্দেশ করা হল।

বৈখানস ধর্মসূত্র অরণ্যে অবসরগ্রহণের পর্যায়কে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছে: পত্নীসহ ও একাকী বানপ্রস্থ গ্রহণ। এদের মধ্যে প্রথম ক্ষেত্রে পাঁচটি ও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একত্রিশটি উপরিভাগ রয়েছে। চতুর্থ আশ্রমের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম সক্রিয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বানপ্রস্থের সারমর্ম ও বিশদ বিবরণ রয়েছে; তা ছাড়া এতে বিস্তৃত ভাবে আচরণবিধি ও কর্তব্যে শিথিলতার জন্য প্রায়শ্চিত্ত বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায় গৃহস্থের কর্তব্য দিয়ে শুরু হলেও পুনরায় জীবনের শেষ দুটি অধ্যায় আলোচিত হয়েছে। কেশব, নারায়ণ ও দেবেশের মতো নবাগত প্রত্ন-পৌরাণিক দেবতারা সর্বশক্তিমানরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। নিরামিষ ভোজনের প্রশংসা ও মিশ্রবর্ণ সম্পর্কিত আলোচনা থাকার ফলে এই গ্রন্থের তুলনামূলক অর্বাচীনতা স্পষ্ট। উপযুক্ত আচরণের নিয়মগুলিও এতে ভিন্ন, কারণ এই পর্যায়ে তা বর্ণভেদ ও সামাজিক অবস্থান নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, মানবিক ভাবনা তত গুরুত্ব পায়নি।

বিষ্ণুস্মৃতি ধর্ম-সূত্ররূপে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে বহু অর্বাচীন কালের ও অপেক্ষাকৃত অপ্রামাণ্য গ্রন্থ। এতে পাপ ও শাস্তির উপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং অপরাধীদের জন্য নির্দিষ্ট নরকের সংখ্যাও এতে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

শুল্বসূত্র

শুল্বসূত্র নামে পরিচিত সূত্র সাহিত্যের একটি ক্ষুদ্র অংশে যজ্ঞবেদী ও যজ্ঞগৃহের মতো যজ্ঞীয় স্থাপত্যের জ্যামিতিক ভিত্তি আলোচিত হয়েছে। শুল্ব শব্দটির অর্থ প্রমাণসূত্র (বা মাপবার ফিতে)। শুল্বসূত্রের নিদর্শনরূপে খুব বেশি সংখ্যক রচনা আমাদের কাছে পৌঁছয়নি। আমরা মোট সাতটি শুল্বসূত্রের সন্ধান পেয়েছি: বৌধায়ন, কাত্যায়ন, আপস্তম্ব, সত্যাষাঢ়, মানব, বারাহ ও মৈত্রায়ণী। এই গ্রন্থসমূহের বিষয়বস্তু যেহেতু পরিমাপ এবং তৎসংশ্লিষ্ট জ্যামিতি ও গণিত তাই এদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। বেদি ও যজ্ঞগৃহের একই ধরনের জ্যামিতিক পরিমাপের জন্য সবগুলি গ্রন্থ একই ধরনের প্রয়োগিক পরিভাষা ব্যবহার করেছে।

সংক্ষেপে কাত্যায়ন ও আপস্তম্ব রচিত দুটি শুল্বসূত্রের আলোচনা করা যায়; অবশিষ্ট রচনাগুলির মধ্যে বোধায়নের গ্রন্থটি সেই শাখার শ্রৌতসূত্রেরই অনুপূরক গ্রন্থ, শুল্বসূত্রটি প্রকৃতপক্ষে পূর্বোক্ত গ্রন্থের ত্রিশতম, অর্থাৎ শেষ প্রশ্নেই পাওয়া যায়। বারাহ ও মানব নামমাত্র ভিন্ন, কেননা এদের রচনায় কিছুমাত্র প্রভেদ নেই। এই দুটি রচনাই তিনটি অংশে বিভক্ত; মানবশুল্ব নামে পরিচিত প্রথম অংশটি পদ্যে রচিত ও চারটি অংশে বিন্যস্ত। উত্তরাষ্টক নামে পরিচিত দ্বিতীয় অংশটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত এবং মূলত গদ্যে রচিত— শুধু শেষ খণ্ড পদ্যে রচিত। বৈষ্ণব নামে পরিচিত তৃতীয় অংশ মূলত পদ্যে রচিত ও সাতটি খণ্ডে বিন্যস্ত। এই গ্রন্থগুলিতে পদ্যের প্রাধান্য রচনার অর্বাচীনতার ইঙ্গিত বহন করছে, বিশেষত যখন আমরা স্মরণ করি যে, প্রাচীনতর গদ্য রচনাগুলির ভাষ্যকাররা নিজেদের ভাষ্যের সমাপ্তিতে বেশ কিছু সংখ্যক শ্লোক ব্যবহার করেছেন। আশ্বলায়ন ও শুল্বসূত্র মৈত্রায়ণী শাখার অন্তর্গত এবং সত্যাষাঢ় ও আপস্তম্ব শুল্বসূত্র সম্পূর্ণ ভাবে পরস্পরের অনুরূপ। রচনাগুলি কয়েকটি পটল ও খণ্ডে বিন্যস্ত।

কাত্যায়ন শুল্বসূত্র ছ’টি অধ্যায়ে বিভক্ত একটি ক্ষুদ্র গ্রন্থ। এর সূচনায় রয়েছে বৃত্ত সম্পর্কিত প্রয়োগিক নির্দেশ এবং সেই সঙ্গে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক নির্ণয়ের পদ্ধতি। বৃত্ত, আয়তক্ষেত্র ও অর্ধবৃত্ত— এই তিনটি ভিন্ন আকৃতিতে তিনটি ভিন্ন অগ্নির জন্য যজ্ঞগৃহ নির্মাণের উদ্দেশে বিবিধ জ্যামিতিক অনুপুঙ্খ আলোচিত হয়েছে। পূর্বোক্ত যজ্ঞগৃহগুলির যথাযথ অবস্থান ও পারস্পরিক পূরত্ব পরিমাপ করাই এই গ্রন্থের প্রকৃত বিষয়বস্তু। এর অব্যবহিত পরে বিভিন্ন যজ্ঞ সংশ্লিষ্ট উপকরণ রাখার নির্দেশাবলি বিবৃত হয়েছে।

বিভিন্ন খণ্ডে বিন্যস্ত মোট ছ’টি পটলে গ্রথিত আপস্তম্ব শুল্বসূত্রেরও একই লক্ষ্য। অর্থাৎ যজ্ঞগৃহ ও বেদি নির্মাণ। গ্রন্থের সূচনায় রয়েছে যজ্ঞগৃহ পরিমাপের প্রমাণসূত্রের বর্ণনা এবং পরে কুড়িটি বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে একমটি বর্গক্ষেত্রের মধ্যে বৃত্তাকৃতি বস্তু স্থাপনের স্থাপত্য-বিষয়ক সমস্যার জ্যামিতিক সমাধান। অন্তিম অংশগুলিতে সোম, দর্শপূর্ণমাস, সৌত্রামণী, অশ্বমেধ, নিরূঢ়-পশুবদ্ধ, প্রভৃতি প্রধান যাগগুলির জন্য প্রয়োজনীয় যজ্ঞবেদি নির্মাণ পদ্ধতি। এই গ্রন্থে ব্যবহৃত এগারোটি প্রায়োগিক পরিভাষা থেকে কৃষিকার্য ও স্থাপত্য সংশ্লিষ্ট ব্যবহারিক জ্যামিতিবিষয়ক উন্নততর জ্ঞানের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা অবহিত হই। এ ছাড়া এই গ্রন্থে গণিত ও বীজগণিত সম্পর্কিত জ্ঞানেরও পরিচয় রয়েছে।

প্রত্যাশিত ভাবেই শুল্বসূত্রগুলির বিশিষ্ট চারিত্র্যলক্ষণ হল, গণিত শাস্ত্রের উপযোগী যথার্থতা; তবুও রচনাশৈলীতে ব্যাকরণ গ্রন্থের তুলনায় ওইগুলি কম রহস্যময় ও সংক্ষিপ্ত। কারণ, সম্ভবত স্থাপত্য ও যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য প্রায়োগিক নির্দেশ অধিকতর স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতা দাবি করে এবং এদের কখনও অতিরিক্ত মাত্রার সংক্ষেপিত বা সঙ্কুচিত করে আনা সম্ভব নয়। কাত্যায়ন শুল্বসূত্রের সমাপ্তিতে ভাষ্যকাররা প্রয়োগিক পরিভাষা ও অনুপুঙ্খ সম্পর্কে বেশ কিছু সংখ্যক শ্লোক সংযোজিত করেছেন। এর সম্ভাব্য কারণ এই যে, প্রকৃত যজ্ঞানুষ্ঠান বন্ধ বা ধ্বংসোন্মুখ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সব পরিভাষা সম্পর্কিত জ্ঞান ক্রমশ ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হয়ে পড়ছিল। শ্রৌত, গৃহ্য ও ধর্মসূত্রগুলির সঙ্গে চিন দেশের বিখ্যাত গ্রন্থ “লি-খি’র প্রবল সাদৃশ্য রয়েছে। এই গ্রন্থের রণনৈতিক, প্রশাসনিক, আনুষ্ঠানিক, সামাজিক ও পারিবারিক আচরণ সম্পর্কে নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে সূত্র সাহিত্য ‘লি-খি’র মতো কোনও প্রকৃত অনুষ্ঠানের যথার্থ ইতিহাস প্রণয়ন করেনি, যেহেতু ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণসাহিত্যে তা পূর্বেই আলোচিত হয়েছিল।

কল্পসূত্রে প্রতিফলিত জীবন ও সমাজ

শ্রৌত, গৃহ্য ও ধর্মসূত্রগুলি সম্মিলিত ভাবে অন্তত সাত শতাব্দী-ব্যাপ্ত ভারতীয় সমাজের বিপুল চিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেছে— এর মধ্যে ভারতবর্ষের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের সমাজব্যবস্থা প্রতিফলিত হয়েছে। এই বিপুল কালপরিধি-ব্যাপী ও বৃহৎ-ভূখণ্ড-জোড়া জীবনধারা সম্পর্কে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেমন কঠিন ও অনৈতিহাসিক, তেমনই অবৈজ্ঞানিকও। তবে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, সমাজে যখন ক্ষমতা, প্রভূত্ব ও সামাজিক সম্মান উচ্চবর্গীয় জনগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছিল, তখন সম্পূর্ণত পরস্পরবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বরূপে শ্রেণি ও বর্ণসমূহের স্থবিরত্ব প্রাপ্তির দৃঢ় প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। অবশ্য অর্থনৈতিক উৎপাদন-সম্পর্কিত প্রয়োগিক কুশলতা এবং উৎপাদন সম্পর্কসমূহ এই পর্যায়ে সংঘটিত অধিকাংশ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। তবে প্রাথমিক গতি ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর আদর্শগত ভিত্তি ততক্ষণই নিজস্ব পথে অগ্রসর হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও সম্পূর্ণরূপে বিরোধী প্রক্রিয়া এই গতিকে রুদ্ধ, ব্যাহত বা রূপান্তরিত না করে। কল্পসূত্রের পর্যায়ে পৌরাণিক সমাজের উদ্ভবের পক্ষে প্রয়োজনীয় সুদৃঢ় ভিত্তি ক্রমে ক্রমে নির্মিত হয়েছিল; এই যুগের প্রবণতা শুধুমাত্র পরবর্তী যুগের পূর্বাভাসই দেয়নি, কিছু দূর পর্যন্ত নতুন ধারার সূচনাও করেছিল।

পরিণতির আলোকে বিচার করে বলা যায়, এই যুগে বিভিন্ন বর্ণ ও উপবর্ণের নির্দিষ্ট রূপ কঠোর ভাবে সূত্রবদ্ধ হয়েছিল; সমাজে প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট অমোঘ ও অপরিবর্তনীয় অবস্থান এবং উপযুক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য বিবৃত হয়েছিল। যদিও বর্ণের তালিকায় অসবর্ণ বিবাহের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তবু এ ধরনের অসবর্ণ-বিবাহজাত সন্তানদের নামকরণে কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের ইঙ্গিত রয়েছে। মোট একচল্লিশটি বর্ণনামের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যেমন রয়েছে, কর্মকার, ধীবর, মাহিষ্য, মণিকার, নাবিক, রজক, রথকার, সূচিক, শূলিক, সূত, উদ্ধন্ধক, বেণুক, প্রভৃতির মতো বৃত্তিমূলক নাম, তেমনই নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত নামও পাওয়া যায়, যেমন মাগধ, বৈদেহক, প্রভৃতি।

জীবনের তৃতীয় পর্যায়ে অরণ্যে বানপ্রস্থ-গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য ত্রিশটি ভিন্ন ধরনের জীবনযাপন প্রণালী রয়েছে: ধ্যানের জন্য গৃহীত আসনের বৈচিত্র্য অনুযায়ী দশ প্রকার এবং খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী আরও কুড়িটি পদ্ধতি। খাদ্য-পরিহারজনিত কৃচ্ছ্রসাধনও চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল, তাই কেউ কেউ শুধু ধূম, কেউ বা শুধু ফেনা পান করে জীবননির্বাহ করতেন। স্পষ্টত, সমাজ তখন সেই সব সমাজ-বহির্ভূত গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোসের চেষ্টা করছিল, যারা বহু শতাব্দী ধরে কঠোর তপস্যায় নিরত ছিল; সিন্ধু উপত্যকায় জনসাধারণের প্রাগ্‌বৈদিক আগম-ধর্মে এ ধরনের কঠোর সাধনা প্রচলিত ছিল, এমন বিশ্বাস যদি ঠিক হয়, তা হলে এই সাধনধারার আয়ুষ্কাল ছিল প্রায় এক হাজার বছর। ব্রাহ্মণ্যধর্মের বৃত্তে এদের অন্তর্ভুক্ত করার একটি পথ ছিল জীবনের শেষ দুটি আশ্রমে ধ্যান ও আত্মোপলব্ধির প্রামাণ্য পদ্ধতিরূপে তাদের স্বীকৃতিদান। অনুরূপ ভাবে বহু শতাব্দী ধরে চতুর্বর্ণের অন্তর্গত জনসাধারণ মোটামুটি ইচ্ছামতো অসবর্ণ বিবাহ করছিল; সমাজ যদি শুধু প্রাচীনতর বৈদিক যুগের চতুর্বর্ণকেই স্বীকৃতি দিত তা হলে সমাজের একটি বিপুল অংশের বৃত্ত-বহির্ভূত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হত। তাই এই যুগে বহু প্রতিবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর দ্বারা রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও তৎসংশ্লিষ্ট বর্ণগত ভেদ ও নিষেধ যখন প্রত্যাহ্বানের সম্মুখীন হল, তখন নবোদ্ভূত উপবর্ণগুলিকে সামাজিক গণ্ডির অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে উঠল। আগামী বহু শতাব্দীর জন্য ধর্মসূত্রগুলি সামাজিক সংহতি সাধনের এই কর্তব্য সফল ভাবে সমাধা করেছিল।

সামাজিক মূল্যবোধ কীভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছিল, তা আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখেছি; তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেল শূদ্র ও নারীর ক্ষেত্রে, কেননা উভয়েই সামাজিক মানদণ্ডে নিম্নস্তরে অবনমিত হয়েছিল। শূদ্রদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য তাদের অবনমনকে আরও প্রকট করে তুলেছিল; এরা খেতমজুর, ধাতুশিল্পী, কুম্ভকার ও গৃহভৃত্যরূপে কাজ করত; এদের সামাজিক অধিকার ছিল খুবই নগণ্য, এরা জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বৃত্তি মাত্রই পেত এবং নিপীড়ন থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল সামান্যই। শূদ্রের একমাত্র ধর্ম ছিল উচ্চতর তিন বর্ণের সেবা। তার জন্য কোনও অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট ছিল না এবং আনুষ্ঠানিক ও ধর্মগত ভাবে শূদ্র আর্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়েই বাস করত। এমনকী সাক্ষাতের পর শূদ্রের প্রতি কোনও ধরনের অভিবাদনের বিধান নেই। বণিক ও ব্যবসায়ীদের লালসার স্বাভাবিক পরিণতিরূপে নির্বিচারে শোষণ বর্তমান ছিল এবং কর্মবিমুখ ভৃত্য বা দাসের জন্য নিষ্ঠুর ব্যবস্থার মধ্যে গৃহভৃত্য এবং দাস-শ্রেণির সামাজিক অবস্থান সুস্পষ্ট। এটা খুবই বিস্ময়ের যে, শূদ্ররা উচ্চতর বর্ণগুলির জন্য রান্না করতে পারত, কিন্তু প্রকাশ্যে তা উল্লেখ করতে পারত না কিংবা অন্নগ্রহণের জন্য তাদের আহ্বানও করতে পারত না।

পাণিনি জানিয়েছেন যে গৃহভৃত্য, দ্বাররক্ষী, বারিবাহক, প্রভৃতি অন্নবস্ত্রের বিনিময়েই নিযুক্ত হত; যদি বা সামান্য মজুরি তারা লাভ করত, তা তাদের শ্রমের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত না হয়ে জীবনযাত্রার নিম্নমান অনুযায়ী নির্ণীত হত। এ ভাবে সমাজের দরিদ্রতর ও অধিকতর নিঃসম্বল অংশের শ্রমশক্তির শোষণ ছিল স্বীকৃত সত্য। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল সমাজের মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে। যদিও সোমযাগ ছিল সবচেয়ে ব্যয়বহুল, তবুও এ যুগে প্রায়ই তা অনুষ্ঠিত হত; কেননা আত্মিক ও পার্থিব পুণ্যলাভের প্রতিশ্রুতি ছাড়াও সোমযাগ অনুষ্ঠান সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সোম অবশ্য তত দিনে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে; তাই গৌতম ধর্মসূত্রের দ্বিতীয় খণ্ডে সোমের অনেকগুলি বিকল্পের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে— অবশ্য এদের মধ্যে একটিও উত্তেজক পানীয় নয়, ফলে স্বভাবতই সোমযাগ ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে গেল।

কৃষিভিত্তিক সমাজে তিনটি উচ্চতর বর্ণের নারীরা যেহেতু প্রত্যক্ষ ভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তাই স্বভাবতই তাঁদের স্থান গৃহে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল— যেখানে তাঁরা কোনও স্বীকৃত অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন না। এ ছাড়া নারীর সামাজিক অবনমনের অন্যান্য হেতুও ছিল; যেমন, মূলগত ভাবে পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ সমাজে অনার্যগোষ্ঠীভুক্ত পত্নীরা নির্দিষ্ট কিছু কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তা ছাড়া, পৃথিবীর সর্বত্র সামন্ততান্ত্রিক সমাজভুক্ত নারী সামাজিক ভাবে হীনতর বলে বিবেচিত হত। গর্ভবতী নারী যেন পুত্রসন্তানের জননী হবে, এই উদ্দেশে প্রসূতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিহিত থাকার মধ্যে পূর্বোক্ত তথ্য প্রতিফলিত। পুংসবন নামক বিশেষ অনুষ্ঠানে পুত্রসন্তান-প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত হলেও কন্যাসন্তানের জন্য কোনও অনুষ্ঠান পরিকল্পিত হয়নি। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে যদিও পুত্রের সঙ্গে কন্যাও উদ্দিষ্ট হয়েছে, তবু কন্যা-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে কোনও মন্ত্রের ব্যবহার না হওয়াাটা বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যজ্ঞে পত্নী যদিও স্বামীর পাশে উপবেশন করতেন, সেখানে তাঁর ভূমিকা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও নির্বাক পুত্তলিকার মতো; কখনও কখনও যজ্ঞকর্মে স্বামীর সহায়তা করলেও মন্ত্র উচ্চারণ করার কোনও অধিকার তাঁর ছিল না। অনিচ্ছুক পত্নীকে তাড়না করার নির্দেশ যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনই প্রয়োজনবোধে তাকে প্রহার করার বিধান ছিল; তাকে যৌন সংসর্গে বাধ্যও করা হত। বিশ্বাসঘাতিনী সন্দেহে পত্নীকে বলপ্রয়োগে অপমানিত করে অমানুষিক ও ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতার সঙ্গে শাস্তিবিধান করা হত। যদিও বলা হয়েছে যে, এরূপ নারীকে উপভোগ করার পক্ষে কোনও বাধা নেই। পাণিনি যদিও ভল্ল ও বর্শাধারিণী নারীর উল্লেখ করেছেন তবু নারী সাধারণ ভাবে সমাজে হীন ছিল ও পুরুষের দ্বারা নিপীড়িত হত। বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্বেই বিবাহ অনুষ্ঠান ক্রমশ অধিকতর মাত্রায় প্রথারূপে গৃহীত হচ্ছিল। উচ্চতর তিন বর্ণের দরিদ্র পিতা কোনও শূদ্রের নিকট থেকে জোর করে যৌতুকের উপকরণগুলি কেড়ে নিতে পারতেন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে নারী ধীরে ধীরে অধিকতর অবনমিত হয়ে অস্থাবর সম্পত্তি বা দ্রব্যমাত্রে পরিণত হচ্ছিল। কন্যাপণের পরিবর্তে যৌতুকদান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল— বধূকে পরিবারের কাছেই সম্প্রদান করা হত। কিছু কিছু নিয়মে অবশ্য মানবিক চিন্তার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়: ‘সমস্ত বর্ণের পুরুষের কর্তব্য— সম্পত্তি অপেক্ষাও অধিক মূল্যবান বিবেচনায় পত্নীকে রক্ষা করা।’ (বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২:৪২) কিন্তু এখানেও নারী পুরুষের সম্পত্তি। আবার অন্য দিকে দেখি, স্বামী বন্ধ্যা বা কন্যাসন্তানের জননী বা মৃতবৎসা পত্নীকে পরিত্যাগ করতে পারত। তা ছাড়া শূদ্রের পত্নীকে অন্য তিন বর্ণের পুরুষেরা যথেচ্ছ ভোগ করতে পারত। (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:১০:২৭:১০) পুত্রের উপর শুধু পিতারই অধিকার ছিল, মাতার নয়। অর্থনৈতিক ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলিতে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বর্ধিত হওয়ার ফলে জীবনযাত্রার বিশেষ কোনও উন্নতি বা বৈচিত্র্য দেখা যায়নি। পুরোহিতরা সমাজের প্রহরীরূপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলেন— সামাজিক ও ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য নিয়মগুলির মধ্যে কোনও গৌণ নিয়মও কোথাও ভঙ্গ হচ্ছে কিনা, যাতে সেই অনুযায়ী যথাযথ প্রায়শ্চিত্তমূলক নিয়ম ও অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিতে পারেন। স্পষ্টত, সামাজিক ভাবে সর্বাধিক অসহায় শূদ্র ও নারীরা এই প্রক্রিয়ায় বিধ্বস্ত হতেন। নারীর আচরণ বিষমানুপাতিক ভাবে সমাজপতিদের কঠোর মনোযোগ আকর্ষণ করত ও সামান্যতম যৌন স্খলনেও তাকে নির্মম ভাবে শাস্তি প্রদান করা হত। প্রাচীন ইহুদিদের মধ্যেও কুমারীত্ব ও সতীত্বের উপর অনুরূপ গুরুত্বদানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভারতবর্ষে পুরুষের ত্রুটিকে কলঙ্করূপে বিবেচনা করা হয়েছে সামান্যই। সাধারণত পূর্বোক্ত দুটি নৈতিক আদর্শের জন্য শুধুমাত্র নারীই নিপীড়িত হয়েছে।

কল্পসূত্রে প্রতিফলিত ধর্ম, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে অনুসৃত ধর্ম অপেক্ষা মূলগত ভাবে ভিন্ন নয়। দেবসঙ্ঘে নবাগত দেবতারা পৌরাণিক ধর্মের পূর্বসূরি। প্রেততত্ত্ব এই পর্যায়ে স্পষ্টতর ভাবে প্রচারিত হয়েছে, কেননা পূনর্জন্ম ও কর্মবাদ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত তথ্যে পরিণত হয়ে একটি দৃঢ় ও যুক্তিনিষ্ঠ ভিত্তিতে স্থাপিত হয়েছে। অধ্যাত্মবিদ্যায় নানাবিধ ভিন্ন ভিন্ন পূর্বানুমান স্বীকৃতি লাভ করেছে, কেননা, এই পর্যায়ে বিচিত্র ধরনের চিন্তাধারা স্পষ্ট ভাবে বিকশিত। নিরীশ্বরবাদ এ যুগে বিভ্রান্ত ও বিপথচালিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অভিমত বা দর্শনরূপে অভিহিত হয়েছে; এমনকী অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে বিচারও নাস্তিকের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। প্রতীক উপাসনা, প্রতিমা ও মন্দিরের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া গেছে এবং পিতৃ-উপাসনা ক্রমশ প্রভূত গুরুত্ব লাভ করেছে। সূত্রসাহিত্যের একটি নতুন গ্রন্থ রচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণ বর্ধিত হওয়ার ফলে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিল আতিশয্য ও প্রতিরোধ। প্রতিমাপূজা যে ইতোমধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়েছে, তা পাণিনির একটি নিয়মে প্রতিফলিত; ওই নিয়মে প্রতিমা নির্মাণ ততক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়েছে, যতক্ষণ সেটি বিক্রয়ের দ্রব্য হিসাবে বিবেচিত না হচ্ছে। অর্থাৎ ভাস্কর্যজাত বস্তুর মধ্যে প্রতিমাও বাণিজ্যের উপাদান ছিল।

ধর্মসূত্র সাহিত্যের বিষয়বস্তুকে স্থূল ভাবে মোট চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়: ১. চতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রমের জন্য পালনীয় আচার; ২. আচারবিধি ভঙ্গ করার প্রায়শ্চিত্ত; ৩. দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের মামলা (ব্যবহার); এবং ৪. রাজধর্ম। সম্মিলিত ভাবে এগুলি কোনও ব্যক্তির সামাজিক জীবনের প্রায় অসম্পূর্ণ পরিধিকে স্পর্শ করে; এর পেছনে এই সংস্কার সক্রিয় যে বৈদিক সাহিত্য বা শ্রুতি অর্থাৎ দৈব প্রেরণাজাত সাহিত্য মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। অবশ্য প্রকৃতপক্ষে কল্পসূত্রের সমাজ, এমনকী, বৈদিক যুগের শেষ পর্যায় থেকেও স্পষ্টত বহু দূরে সরে এসেছে। সামাজিক সংগঠনে অনেক বেশি মাত্রায় জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার ফলে বিচিত্র ধরনের বিধি, উপবিধি, ব্যতিক্রম ও প্রায়শ্চিত্তের অদ্ভূত সহাবস্থান দেখা দিল। এটা যেহেতু নিয়ত প্রসারণশীল বিষয়, তাই আমরা পরবর্তী স্মৃতিযুগে ধর্মশাস্ত্রের অন্তত কুড়িজন লেখকের নাম জানতে পারি। প্রাচীনতম উপনিষদ ও নবীনতম সূত্রগুলির মধ্যে সময়ের ব্যবধান এক সহস্রাব্দ; এই যুগে সাহিত্যিক মানের পীড়াদায়ক অবনমন প্রকট হয়ে উঠেছে। ধর্মও সাহিত্যকে অনুপ্রেরণা দিতে পারেনি, যেহেতু ইতোমধ্যে তা নিতান্ত শূন্যগর্ভ নির্মোকে পরিণত।

কল্পসূত্রে আমরা দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তিকে সক্রিয় দেখি: ব্যাপক অর্থে মানবতাবাদ, সামাজিক কিছু কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যেগুলির মধ্যে সমন্বয়ী প্রবণতা নিহিত এবং যা সর্বদাই সমাজের দ্বিতীয় মৌল শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; এই দ্বিতীয় মৌল শক্তি হল, সংকীর্ণ সাম্প্রদায়কেন্দ্রিক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ব্রাহ্মণ ও বিত্তবানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এক পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবিভক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই দুটি শক্তির আততি ও সংঘর্ষের ফলেই কল্পসূত্রগুলির উদ্ভব এবং এই দুটি ধারার স্পষ্ট নিদর্শন এদের মধ্যে নিহিত রয়েছে। অর্বাচীনতর উপনিষদগুলি রচিত হওয়ার সময়ে বিভিন্ন কৌম ও গোষ্ঠীর খণ্ডিত হওয়ার প্রক্রিয়া সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল; এর পরেই আমরা অসংখ্য বর্ণ ও উপবর্ণের উদ্ভব লক্ষ্য করি। আর্যদের দ্বারা জাতিগত, সংস্কৃতিগত ও বৃত্তিগত ভাবে প্রাগার্য সামাজিক সংগঠন আত্মীকৃত হওয়ার ফলেই এটা ঘটেছিল। পরবর্তিকালে অর্থাৎ সূত্র-সাহিত্যের যুগে বর্ণগুলি এতটা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও কঠোর শ্রেণিভেদ অনুযায়ী বিন্যস্ত হয়েছিল যে, বর্ণভেদ যে কোনও ধরনের সামাজিক প্রগতির পক্ষে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল। বিশেষত অর্বাচীনতর ধর্মসূত্র-সাহিত্য এই নৈরাশ্যজনক চিত্রই তুলে ধরেছে।

সূত্রযুগের সমাজ সার্বিক পশ্চাদগতির এক বিষণ্ণ চিত্র উপস্থাপিত করেছে, যখন দেশের সীমান্ত-বহির্ভূত অঞ্চলসমূহের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল এবং আত্মসংবৃত ও আত্মসন্তুষ্ট গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বহিঃপৃথিবীর বিভিন্ন নগর ও দেশের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্বন্ধ সম্পূর্ণ রহিত হয়ে যাওয়ার ফলে সমাজ ক্রমশ স্থবির হয়ে পড়েছিল। নৌ-বাণিজ্যকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছিল; যা কিছু অন্তর্বাণিজ্য অবশিষ্ট ছিল তা শুধুমাত্র নগরগুলির উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ ছাড়া আমরা পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতি সম্পর্কেও আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করি— যদিও একমাত্র বিজ্ঞানচর্চাই সে যুগের মানসিক অবসাদ দূর করতে পারত। সমালোচকরা লক্ষ করেছেন যে, ভারতীয়দের মতো গ্রিকরাও নিরীক্ষা-নির্ভর বিজ্ঞানের উন্নতিসাধনে ব্যর্থ হয়েছিল, কেননা তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী দার্শনিকরা ভদ্রলোক এবং ভদ্র-ব্যক্তি কখনও কায়িক শ্রম করেন না। পরোক্ষ ভাবে বহির্জগতের সঙ্গে গ্রামগুলির সম্পর্কে যে সামাজিক নিষেধ জারি হয়েছিল, তার ফলেও গ্রামবাসীরা বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন একটি সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ল যা মনের স্বাভাবিক ও সুস্থ বুদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ধর্মসূত্রের বিভিন্ন বিধিনিষেধের মধ্যে এর পরিণতি সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে অভিব্যক্ত। এই রচনাগুলি বিভিন্ন বর্ণ ও আশ্রমের কর্তব্য সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান অনাবশ্যক অনুপুঙ্গে পরিপূর্ণ; ব্যক্তির আত্মিক উন্নতির প্রতি তা খুবই সামান্য মনোযোগ দিয়েছে। বস্তুত, সমাজে মানুষের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে তীক্ষ্ণ সচেতনতা বৃদ্ধিতে তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। খাদ্যগ্রহণ সম্পর্কে অসংখ্য বিধিনিষেধ এবং আনুষ্ঠানিক পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা, অন্ত্যেষ্টি-বিষয়ক অনুষ্ঠান ও প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কে অসংখ্য বিধানের উদ্ভাবন দীর্ঘকাল ধরে আধ্যাত্মিক জীবনীশক্তির ক্রমাগত ক্ষয়ই প্রতিফলিত করেছে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং তার সমৃদ্ধ ও সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহুবিধ শিল্প ও বিজ্ঞানের চর্চার ফলে যদিও সাংস্কৃতিক পরিশীলনের সূত্রপাত হয়েছিল, তবুও তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংকুচিত পরিসরে বন্দি ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র গ্রামীণ সমাজের নিষ্প্রাণ গতানুগতিকতা দূর করার জন্য বিশেষ কোনও ভূমিকা নিতে পারেনি। বস্তুত, তৎকালীন সমাজের বিপুল অংশের পক্ষে বাস্তব পরিস্থিতি ছিল নিতান্ত নির্মম। নগরগুলিতে পরিশীলিত সংস্কৃতির বিকাশ হলেও দেশে অসংখ্য মানসিক কুহেলিকা, সংস্কারসর্বস্বতা, ব্যক্তিত্বহীনতা ও তন্দ্রাচ্ছন্নতার অবগুণ্ঠন নেমে আসে; একমাত্র বর্ণভেদ ও চতুরাশ্রমই ছিল চূড়ান্ত সত্য।

পৃথক বৈশিষ্ট্যের অভাবে গ্রামগুলির মধ্যে পারস্পরিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়; তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মসংবৃত বিচ্ছিন্ন অর্থনীতিতে মুদ্রার কোনও ভূমিকাই প্রায় ছিল না। নিষ্ক্রিয়তা ও স্থবিরতা আধ্যাত্মিক নিষ্প্রাণতার জন্ম দিয়েছিল— সার্থক ভাবে কাল অতিবাহন সম্পর্কে কোনও চেতনাও গড়ে ওঠেনি। এমনকী গ্রামবাসীর মধ্যেও বর্ণগত ভেদের ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। এরা স্বভাবত এত আত্মতৃপ্ত ছিল যে, অসংখ্য প্রজন্ম ধরে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার জীবনযাপন করতে তাদের পক্ষে কোনও বাধা সৃষ্টি হয়নি। সাহিত্যে প্রকৃত সৃজনশীলতার পক্ষে যে সব বৃদ্ধি, সংঘাত, টানাপোড়েন ও আদর্শগত দ্বন্দ্ব আবশ্যক, সে সব সর্বব্যাপী আত্মিক তুচ্ছতার মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে সৃজনশীল শক্তিরূপে বৈদিক ধর্মের প্রেরণা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই কল্পসূত্রগুলির মধ্যে আমরা একটি বন্ধ্যা, প্রেরণাহীন তুচ্ছ-প্রয়োজন-কেন্দ্রিক ও যুক্তিহীন মতবাদনিষ্ঠ সাহিত্যরূপের সঙ্গে পরিচিত হই।

ধর্মসূত্রগুলির মধ্যে আমরা এমন ধরনের সামাজিক আচারবিধির পরিচয় পাই যা বহুপূর্বে তার ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে সমাজের উপর জগদ্দল ভারের সৃষ্টি করেছিল। বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও অন্যান্য প্রতিবাদী সন্ন্যাস-নির্ভর ধর্ম-আন্দোলনগুলির বৈদিক ধর্মের ভিত্তিমূলক সপ্রশ্ন প্রত্যাহ্বান জানানোর ফলে ব্রাহ্মণ্য যজ্ঞধর্মের যান্ত্রিক ধারাবাহিকতা কালধর্ম-বিরুদ্ধ ও অবাস্তব হয়ে পড়েছিল। এতে বৈদিক যজ্ঞকেন্দ্রিক প্রাচীন ধর্মীয় উন্মাদনার ধর্মগত জীবনশক্তির পুনরুত্থানের কোনও ইঙ্গিত আমরা পাই না, বরং এমন একটি আধ্যাত্মিক অবসাদের লক্ষণ দেখি যা পরিবর্তনশীল সামাজিক বাস্তবতার প্রত্যাহ্বান-সমূহের সম্মুখীন হতে অস্বীকার করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *