আটে অষ্টবসু

আটে অষ্টবসু

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে ঢুকে প্রথমা দেখল, তিনি মন দিয়ে টিভি দেখছেন। সোফায় বসে প্রথমা বলল, ‘আমাকে ডেকেছিলেন?’

ঘাড় না ঘুরিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘বসে পড় প্র্যাট।’

সোফায় বসে প্রথমা দেখল অন্য একটি সোফায় বসে রয়েছেন—ইন্ডিয়ান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ উন্নি কৃষ্ণন নায়ার, যাঁকে সবাই ইউ. কে. নায়ার বা আরও ছোট করে নায়ার বলে ডাকেন। রঞ্জিতের চেয়ারের পিছনে যে দেওয়াল, তাতে মাউন্ট করা আছে বিশাল এলইডি মনিটর। সেখানে ওয়ারিস্তানের সরকারি নিউজ চ্যানেল ‘ডাব্লিউ টিভি’-র একটি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং চলছে। তাতে জেলখানার একটি ‘সেল’ বা ঘর দেখা যাচ্ছে। গরাদের ওপারে, মেঝেতে বসে রয়েছেন বছর চল্লিশের এক পুরুষ।

ক্যামেরা পিছিয়ে আসতে দেখা গেল, গরাদের এপারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডাব্লিউ টিভির সঞ্চালক আকিরা। তিনি বলছেন, ‘আমরা ফিরে এসেছি উত্তর ওয়ারিস্তানের আওয়ারাবাদ জেলের আন্ডা সেলে। আন্ডা সেল মানে সলিটারি কনফাইনমেন্ট বা একক কারাবাস। এখানে রাখা হয় সেই সব অপরাধীদের, যারা মানব সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।’

প্রথমা রঞ্জিতকে জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকটা কে?’

রঞ্জিত বললেন, ‘চুপ করে শোন! সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।’

আকিরাবলছেন, ‘নিউ অ্যান্ড ইনোভেটিভ ন্যানো-টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। সংক্ষেপে N AND I, N, I. আরও সংক্ষেপ করলে, ‘NANDINI’ বা ‘নন্দিনী’। ওয়ারিস্তানের ন্যানো-টেকনোলজি বিষয়ক একমাত্র গবেষণাকেন্দ্র। ওয়াটার পিউরিফায়ার থেকে ওয়াশিং মেশিন, সানস্ক্রিন লোশন থেকে দেওয়ালের পেন্ট, ডার্ট রেজিস্ট্যান্ট জামা থেকে স্পোর্টস ইকুইপমেন্ট, শরীরের নির্দিষ্ট কোষে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া থেকে ক্যানসারের চিকিৎসা—সব ক্ষেত্রেই ন্যানো-টেকনোলজির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্প্রতি নন্দিনীর গবেষকরা কাজ করছিলেন গোপন একটি বিষয় নিয়ে। তাতে সাফল্যও এসেছিল। খবর পেয়ে গবেষণা চুরি করতে আওয়ারাবাদে হাজির হয়েছিল আটজন চোরের একটি টিম। আমার সামনে এখন উপস্থিত তাঁদেরই একজন। আসুন, তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’

আকিরা গরাদের ফাঁক দিয়ে বুম ঢুকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম?’

লোকটি বললেন, ‘ভব বসু।’

‘বাবার নাম?’

‘মনোরঞ্জন বসু।’

‘আপনারা কেন ওয়ারিস্তানে এসেছিলেন?’

ভব চুপ।

আকিরা বললেন, ‘আপনাদের ভাইবোনের নামগুলো বলুন।’

ভব থেমে থেমে বললেন, ‘আমার দিদির নাম সোমা। আমার নাম ভব। আমার পরে আছেন অনল, বিষ্ণুপ্রত্যুষা, অনিল, প্রভা এবং ধ্রুবিকা।’

আকিরা বললেন, ‘আপনাদের বাবা মনোরঞ্জন বসু পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও উদ্যোগপতি। উনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন অপটিক্স নিয়ে পড়াশুনো করতে। সেই সময়ে তিনি পাঁচটি অরিজিনাল রিসার্চের ওপরে পেটেন্ট নেন। পরে ইন্ডিয়ায় ফিরে সেই পেটেন্ট কাজে লাগিয়ে শুরু করেন মনিটর তৈরির ব্যাবসা। কোম্পানির নাম, ‘বসু ভিশান’। সাদাকালো টিভির আদিযুগ থেকে আজকের এলসিডি এবং এলইডি টিভির যুগেও ‘বসু ভিশান’-এর একচেটিয়া ব্যবসা। ‘বসু ভিশান’ পৃথিবীর এক নম্বর মনিটর প্রস্তুতকারী সংস্থা। মনোরঞ্জন মারা যাওয়ার পরে কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে আছেন আট ভাইবোন। ভব, এবার আপনি বলুন।’

ভব মাথা নিচু করে বললেন, ‘কিছুদিন আগে সিএনএন চ্যানেলের খবর দেখে জানলাম যে নন্দিনী ‘ইনভিজিবল ক্লোক’ আবিষ্কার করেছে। এই ক্লোক গায়ে জড়ালে যে কেউ অদৃশ্য হয়ে যাবে।’

আকিরা বললেন, ‘নন্দিনীর গবেষকরা ‘মেটা-মেটিরিয়াল’ নামে এক রকমের পার্টিকল তৈরি করেছেন। আলো কোনও বস্তুতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে বলেই সেটিকে আমরা দেখতে পাই। যার কেতাবি নাম ‘রিফ্লেকশান’ বা ‘প্রতিফলন’। কেউ যদি মেটা-মেটিরিয়ালের চাদর জড়িয়ে থাকে, তা হলে ওই আলো চাদরের দু’পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেভাবে জলধারা পাথরের দু’পাশ দিয়ে বয়ে যায়। তখন সেই বস্তুকে আর দেখা যাবে না। এটাই অদৃশ্য হওয়ার পিছনের বিজ্ঞান। যেটা চুরি করতে আট ভাইবোন আওয়ারাবাদে এসেছিলেন। তাই তো, ভব?’

ভব উত্তর দিলেন না।

আকিরা বললেন, ‘আপনি কি কিছুই বলবেন না?’

ভব বললেন, ‘বড়দি সোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত। ওয়ারিস্তানে ওর চেনা উকিল আছে।’

টিভি বন্ধ করে দিলেন রঞ্জিত। প্রথমা এবং নায়ারের দিকে ফিরে বললেন, ‘বসু পরিবারের এই আট ভাইবোন বা অষ্টবসু লোভে পড়ে একটা জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছেন। ওঁরা নকল পাসপোর্ট বানিয়ে আলাদা আলাদা দেশ থেকে আলাদা আলাদা সময়ে ওয়ারিস্তানে পৌঁছন। ওঠেন আওয়ারাবাদের হোটেলে। হোটেলটা নন্দিনীর কাছে। বৃহষ্পতিবার রাতে নন্দিনীতে ঢুকে মাস্টার কম্পিউটার থেকে ডেটা চুরি করে এক ঘণ্টার মধ্যে হোটেলে ফেরত আসেন। শুক্রবার ওয়ারিস্তানে জাতীয় ছুটির দিন। ওইদিন নন্দিনী বন্ধ থাকে। কাজেই চুরি ধরা পড়ার আগে ওঁদের হাতে চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ছিল।’

‘মুশকিল হল অন্য জায়গায়।’ এই প্রথম মুখ খুলেছেন ইউ. কে. নায়ার,’শুক্রবার আওয়ারাবাদ বিমান বন্দরে একটা বিষ্ফোরণ ঘটে। কুড়িজন আহত ও পাঁচজন নিহত হয়। ওয়ারিস্তানে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে জারি হয় রেড অ্যালার্ট। ইনবাউন্ড এবং আউটবাউন্ড সমস্ত ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে যায়। অষ্টবসু হোটেলে আটকে পড়েন। শনিবার সকালে নন্দিনীতে ঢোকামাত্র বিজ্ঞানীরা বুঝে যান, ইনভিজিবল ক্লোকের ডেটা চুরি হয়েছে। চোরেদের খুঁজে বার করতে সময় লাগেনি। বিদেশি ট্যুরিস্টদের ডেটা ছানবিন করতেই জাল পাসপোর্ট চিহ্নিত হয়ে যায়। ধরা পড়েন অষ্টবসু। ওয়ারিস্তান আর্মি ওঁদের কাস্টডিতে নেয়।’

এই অবধি শুনে প্রথমা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘বসু পরিবারের ছোট মেয়ের নাম ধ্রুবিকা। এ কি সেই ধ্রুবিকা যাকে আমি কাইমেরা থেকে বার করে দিয়েছিলাম?’

রঞ্জিত বললেন, ‘হ্যাঁ। এ সেই ধ্রুবিকা।’

প্রথমা বলল, ‘এইসব ছিঁচকে চোরের জন্যে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি কেন?’

রঞ্জিত বললেন, ‘কারণ ধ্রুবিকা এখন র-এর এজেন্ট। কাইমেরায় আমিই ওকে এনেছিলাম। তোর সঙ্গে ওর সমস্যা হয়েছিল জানার পরে ওকে র-এ সরিয়ে দিয়েছিলাম।

প্রথমা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওকে কাইমেরা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময় আপনাকে যে ইমেল আমি পাঠিয়েছিলাম, তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ধ্রুবিকার চরিত্রে সততার অভাব আছে। তার পরেও আপনি ওকে র-এ রেখেছিলেন?’

রঞ্জিত ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ধ্রুবিকাকে তুই পছন্দ করিস না। কিন্তু ও আমার ভ্যালুয়েবল এজেন্ট। ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমি জান লড়িয়ে দেব।’

প্রথমা চুপ। তার মনে পড়ে যাচ্ছে দু’বছর আগে, কাইমেরায় যোগদানের পরে ধ্রুবিকার কীর্তিকলাপের কথা…

ধ্রুবিকা যে অত্যন্ত ইনটেলিজেন্ট সেটা প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিল প্রথমা। কম কথা বলে, সব সময় গ্যাজেট বা বইতে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে। নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ার এবং ব্যালিস্টিক্স নিয়ে আগাধ পাণ্ডিত্য। মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছিল প্রথমার। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ধ্রুবিকার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার খেয়াল করে প্রথমা। ধ্রুবিকা কম্পিউটার থেকে ক্লাসিফায়েড ফাইল পড়ে দেখছে।

‘ক্লাসিফায়েড’ মানে গোপন। নতুন যারা যোগদান করে, তাদের সেইসব ফাইলে অ্যাকসেস থাকে না। ধ্রুবিকা অফিসের কম্পিউটার হ্যাক করে একাধিক ফাইল পড়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরায় প্রথমা দেখতে পায়, ধ্রুবিকা ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ফাইল কপিও করছে। প্রথমা ধ্রুবিকাকে সেই ফুটেজ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘অফিসের কম্পিউটার হ্যাক করে ডেটা চুরি করলে পৃথিবীর যে-কোনও অফিসে যে-কোনও কর্মচারীর চাকরি চলে যায়। আর এটা ইনটেলিজেন্স উইং-এর অফিস! কেন এমন কাজ করছ?’ ধ্রুবিকা কোনও উত্তর দিতে পারেনি। সেই দিনই কাইমেরা থেকে ধ্রুবিকাকে সরিয়ে দেয় প্রথমা। তথ্যটি জানিয়ে রঞ্জিতকে মেলও করে।

পুরোনো কথা মাথা থেকে সরিয়ে প্রথমা বলল, ‘আমাকে কেন ডেকেছেন?’

নায়ারের দিকে তাকিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘আপনি বলুন।’

নায়ার বললেন, ‘অষ্টবসুকে গ্রেফতার করার পরে ওয়ারিস্তান যে কাজ করছে, সেটা ভয়াবহ। কোনও পুলিশি অনুসন্ধান ছাড়া, কোর্টে বিচার ছাড়া ধরে নেওয়া হয়েছে যে অষ্টবসু তথ্য চোর। বিষ মেশানো ইনজেকশান দিয়ে রোজ একজনকে মেরে ফেলা হচ্ছে। দিন কয়েক আগে সন্ধে সাতটার সময়ে সোমাকে অন ক্যামেরা জেরা করে আকিরা। জেরায় সোমা স্বীকার করেন যে তাঁরা ইনভিজিবল ক্লোকের গবেষণাপত্র চুরি করেছেন। স্বীকারোক্তির পরেই আওয়ারাবাদ জেলের ওয়ার্ডেন ইনস্পেকটার রাফাল হাজারী বিষ মেশানো ইনজেকশান দেন সোমাকে। পরদিন সকালে জানা যায়, সোমা মারা গেছেন।’

‘এ তো খুন!’ প্রথমা অবাক।

নায়ার বললেন, ‘অবশ্যই খুন। এবং বাকি ভাইবোন জানতেও পারছেন না যে তাঁদের বিনা বিচারে খুন করা হচ্ছে। যে ইন্টারভিউটা দেখলাম, তাতে ভব সোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। অর্থাৎ ভব জানেন না, আগের রাতে সোমা মারা গেছেন।’

রঞ্জিত বললেন, ‘সোমার পরে একে একে খুন হয়েছেন ভব, অনল, বিষ্ণুএবং প্রত্যুষা। আজ অনিলের পালা। আমার কনসার্ন ধ্রুবিকাকে নিয়ে। ওয়ারিস্তান সরকার এখনও জানে না যে ধ্রুবিকা র-এর এজেন্ট। সেটা জেনে গেলে কেলেঙ্কারি হবে। প্রথমা, সেই জন্যেই তোকে ওয়ারিস্তান যেতে হবে।’

‘আমি গিয়ে কী করব?’ বাজ পড়েছে প্রথমার মাথায়।

‘ওরা যে ছকে এগোচ্ছে, সে ছকে কাল সকালে জানা যাবে যে অনিল মারা গেছেন। বাকি রইলেন প্রভা এবং ধ্রুবিকা,’ পেপারওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে রঞ্জিত বললেন, ‘অর্থাৎ আমাদের হাতে দু’দিন সময় আছে। তুই ওয়ারিস্তানে যাবি ভবর বিধবা পত্নী মন্দিরা হিসেবে। তোদের বয়সের রেঞ্জ এবং প্রোফাইল মোটামুটি ম্যাচ করে।’

‘আমাকে কী করতে হবে?’

‘প্রভা মারা যাবেন। কিছু করার নেই। কিন্তু যে ভাবেই হোক না কেন, ধ্রুবিকাকে দেশে ফেরত আনতে হবে। যে করে হোক ওর মৃত্যু আটকাতে হবে।’

প্রথমা ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তার জন্যে আমাকে কী করতে হবে? আমি জেলে ঢুকে ধ্রুবিকার জায়গায় থেকে যাব আর ধ্রুবিকা মন্দিরা হয়ে বেরিয়ে আসবে?’

‘সেটা শেষ অপশন।’ বললেন রঞ্জিত।

প্রথমা অবাক হয়ে ভাবল, ধ্রুবিকাকে বাঁচানোর জন্যে রঞ্জিত কন্যাসম প্রথমার প্রাণও বাজি ধরতে রাজি আছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘লাইফ বিফোর কানট্রি। জয় হিন্দ স্যার!’

রঞ্জিত মাথা নিচু করলেন। নায়ার প্রথমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

নায়ারের অফিসে বসে কথা বলছে প্রথমা আর নায়ার। ছ’মাস বাদে নায়ার ইন্ডিয়ান আর্মির প্রধানের পদ থেকে অবসর নেবেন। এতদিন পর্যন্ত তিনি কাইমেরা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। আজ সকালে রঞ্জিতের কাছ থেকে জেনেছেন। নিজের চেয়ারে বসে তিনি প্রথমাকে বললেন, ‘নতুন ভারতবর্ষের নতুন ইন্টেলিজেন্স উইং দেখে বুঝতে পারছি, আমি বুড়ো হয়ে গেছি।’

‘ওভাবে বলবেন না স্যার। আপনার অভিজ্ঞতা আর আমার সাহস এই দুয়ের মিশ্রণ না ঘটলে এই মিশন সফল হবে না।’

ডেস্কটপ কম্পিউটারে ছবি দেখাচ্ছেন নায়ার, ‘বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আওয়ারাবাদের জেলখানার বিল্ডিং একতলা। চারিদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ইলেকট্রিক ফেন্সিং আছে, মোশন সেন্সর বসানো আছে। পালানো অসম্ভব। একতলায় শুধু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং। আসল জেলখানাটি মাটির তলায়। প্রতি সেলে একজন করে কয়েদি থাকে। ওখানেই রাখা হয়েছে বা হয়েছিল অষ্টবসুকে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গেও ওঁদের কোনও যোগাযোগ নেই। ওঁরা জানেনও না যে প্রতিদিন সন্ধেবেলা একজনকে বিষাক্ত ইনজেকশান দিয়ে খুন করা হচ্ছে।’

‘আন্ডা সেলের ভিতরের কথা কী করে জানলেন?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।

‘তার কারণ আওয়ারাবাদ জেলের ওয়ার্ডেন রাফাল হাজারী এখন আমাদের লোক।’

‘এখন? আমাদের লোক?’ থেমে থেমে বলল প্রথমা, ‘এই কথার মানে কী?’

‘রাফালের এক বছর হল বিয়ে হয়েছে। ওঁর বউ মিশা ভারতীয়। গত তিনমাস ধরে মিশা মুম্বইয়ে বাপের বাড়িতে ছিলেন। এই মুহূর্তে উনি আমাদের জিম্মায়।’

‘বউকে তুকে এনে বরকে মানসিক চাপে রাখা?’ চিন্তিত প্রথমা, ‘ব্ল্যাকমেল খুব রিস্কি বিজনেস। কখন মানবপ্রেমের জায়গায় দেশপ্রেম জেগে উঠবে বোঝা শক্ত।’

‘তোমার কাজ মাথার মধ্যে গেঁথে নাও। ভবর বিধবা পত্নী মন্দিরা হিসেবে তুমি আগামীকাল আওয়ারাবাদ পৌঁছচ্ছ। হোটেলে ওঠার পরে ওয়ারিস্তানের ভারতীয় হাই কমিশনের মিস্টার শর্মা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তারপরে আসবেন ডাব্লিউ টিভির আকিরা। ওঁর সঙ্গে তুমি জেলখানায় যাবে। সেখানে তোমার দায়িত্ব নেবেন রাফাল।’

‘রাফাল কি জানেন আমি কে?’

‘এখনও জানেন না। তোমার ফ্লাইট কাল দুপুরে। তার আগেই আমি ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে তোমার সম্পর্কে ব্রিফিং করে দেব।’ চেয়ার থেকে উঠলেন নায়ার। প্রথমার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ‘হোপ ফর দ্য বেস্ট।’

প্রথমা জানে, এই কথাটার আসল মানে হল, ‘প্রিপেয়ার ফর দ্য ওয়ার্স্ট’। তাকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যে তৈরি হতে হবে। এবং সেটা হল মৃত্যু।

বিকেল সাড়ে চারটের সময় আওয়ারাবাদ এয়ারপোর্টে নামার পরে ভবর বিধবা পত্নী মন্দিরা ওরফে প্রথমা দেখল যে ওয়ারিস্তান সরকারের তরফ থেকে একটি গাড়ি তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, পাথুরে চেহারার এক সৈন্য তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘ওয়েলকাম টু ওয়ারিস্তান।’ অভিবাদন শুনে প্রথমা কেঁপে উঠল।

ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলার পরে প্রথমা পৌঁছল পাঁচতারা হোটেল ডেস্টিনি ইন্টারন্যাশনালে। ফ্রন্ট ডেস্কের যে স্টাফ প্রথমাকে রিসিভ করল, তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে হোটেলের কেউ নয়, ওয়ারিস্তান আর্মির লোক।

পাঁচতলা হোটেলের পঞ্চম তলার কোণের দিকের ঘরে জায়গা পেল প্রথমা। এই ফ্লোরের অন্যরুমগুলো খালি পড়ে রয়েছে। করিডোরে ওয়ারিস্তান আর্মির সৈন্যরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রুমে ঢোকা মাত্র ফোন এল। ফ্রন্ট ডেস্কের স্টাফ জানাল, ‘ভারতীয় হাই কমিশন থেকে মিস্টার শর্মা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

‘পাঠিয়ে দিন।’ বলল প্রথমা।

রুমে ঢুকেই শর্মা বললেন, ‘প্রথমেই বলি, এই ঘরটিতে একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। মাইক্রোফোনও প্রচুর। কাজেই আপনি গোপনে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।’

প্রথমা ঘাড় নাড়ল।

শর্মা বললেন, ‘আপনার স্বামী ভব বসু মারা গেছেন। আট ভাইবোনের মধ্যে সাতজন মারা গেছেন। শুধু ছোট বোন ধ্রুবিকা এখনও জীবিত। ওয়ারিস্তানের নিয়ম হল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইমরাজ চাইলে প্রাণদণ্ডের শাস্তি মকুব করতে পারেন। আপনি এক্ষুনি ধ্রুবিকার প্রাণভিক্ষার আবেদন লিখে আমাকে দিন। আমি নিজে ওটা ইমরাজের হাতে তুলে দেব।’

টেবিল থেকে রাইটিং প্যাড আর পেন নিয়ে প্রথমা লিখে ফেলল আবেদনপত্র। সেটা পড়ে খুশি হয়ে ঘাড় নাড়লেন মিস্টার শর্মা। কাগজটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘরে ঢুকল ডাব্লিউ টিভির সঞ্চালক আকিরা। সঙ্গে দু’জন টেলিভিশান ক্রু। একজন ক্যামেরা ধরেছেন, অন্যজন ফ্ল্যাশ। আকিরা রুমে ঢুকেই বললেন, ‘মন্দিরা, আপনি রেডি হয়ে নিন। আমরা এখনই আওয়ারাবাদ জেলে যাব।’

প্রথমা বলল, ‘আমি রেডি।’

আওয়ারাবাদের জেলখানার ত্রিস্তর সিকিয়োরিটি পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল প্রথমা। ঘড়িতে সাড়ে ছ’টা বাজে। জেলের ওয়ার্ডেন রাফাল প্রথমার দিকে একটা ওভারল বাড়িয়ে দিলেন। চেঞ্জিং রুমে গিয়ে নিজের পোশাক বদলে সেটা পরে নিল প্রথমা। বাইরে বেরোনো মাত্র রাফাল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিশা কেমন আছে?’

প্রথমা বলল, ‘মিশা এখন মুম্বইতে নেই। দিল্লিতে বহাল তবিয়তে আছে।’

রাফালের কঠিন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘ধ্রুবিকাকে বাঁচাতে গেলে একটাই জিনিস লাগবে। সেটা হল দু’ঘণ্টা সময়।’

‘মানে?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।

‘এখন পৌনে সাতটা বাজে। আমার ওপরে অর্ডার আছে, রোজ সন্ধে সাতটার সময়ে এদের বিষ মেশানো ইঞ্জেকশান দিতে হবে। ঠিক সাতটা বাজলেই আমি কাজটা করব। ধ্রুবিকার প্রাণভিক্ষা চেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপনি আবেদন করেছেন। আমি নিশ্চিত, সেই আবেদন মঞ্জুর হবে। সাত ভাইবোনকে খুন করে সারা পৃথিবীর কাছে ওয়ারিস্তানের অনেক নেগেটিভ পাবলিসিটি হয়েছে। ছোট বোনকে বাঁচিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার পালা। সমস্যা হল প্রধানমন্ত্রীর উত্তর এখানে আসতে রাত ন’টা বাজবে।’

কথা বলতে বলতে আন্ডা সেলের সামনে চলে এসেছেন রাফাল। সঙ্গে প্রথমা।

দু’বছর বাদে ধ্রুবিকাকে দেখল প্রথমা। ধূসর রঙের পোশাক পরে মেঝেতে বসে রয়েছে। প্রথমাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মন্দিরা! তুমি প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমি আর পারছি না।’

দ্রুত আন্ডা সেলের সামনে থেকে সরে এল প্রথমা। রাফালকে বলল, ‘ইমেল, ফ্যাক্স বা টেলিফোন করেও তো অর্ডার দেওয়া যায়।’

‘অবশ্যই যায়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আমার কাছে ফোনই আসবে। কিন্তু সেটা রাত ন’টার পরে। কেন না উনি এখন সিনচানের বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি মিটিং করছেন। মিটিং-এর মাঝখানে ওঁকে বিরক্ত করা যাবে না। এদিকে কোর্ট অর্ডার অনুযায়ী আজই সন্ধে সাতটার সময়ে ক্যামেরার সামনে ধ্রুবিকাকে ইনজেকশান না দিলে আমার চাকরি চলে যাবে।’

‘তা হলে উপায়?’ প্রথমার ভুরু কুঁচকে গেছে।

‘আমি যখন আছি তখন একটা উপায় বেরোবেই,’ গর্বের সঙ্গে বললেন রাফাল, ‘আমার কাছে দুটো সিরিঞ্জ আছে। একটায় বিষ আছে। অন্যটায় ডিসটিলড ওয়াটার। আমি ধ্রুবিকার শরীরে জলভরা সিরিঞ্জটা পুশ করব। ওর কিছু হবে না। তার মধ্যে ইমরাজের কাছ থেকে প্রাণদণ্ড মকুবের ফোন চলে আসবে।’

প্রথমা রাফালের কথা মন দিয়ে শুনে বলল, ‘সিরিঞ্জ দুটো কোথায়?’

‘এই যে,’ ইউনিফর্মের পকেট থেকে দুটো এক রকমের দেখতে সিরিঞ্জ বার করে দেখালেন রাফাল।

‘কোনটায় বিষ নেই কী করে বুঝছেন?’

‘বোঝার কোনও উপায় নেই। আমার ডান পকেটে বিষাক্ত সিরিঞ্জ। আর বাঁ-পকেটে নির্বিষ সিরিঞ্জ।’

‘বুঝলাম,’ মাথা নিচু করে ভাবছে প্রথমা, ‘আপনি যে মিথ্যে কথা বলছেন না তার প্রমাণ কী?’

‘মিথ্যে কথা বলে আমার লাভ?’ ম্লান হাসলেন রাফাল।

প্রথমা বলল, ‘আপনি টেনশানের চোটে ভুল সিরিঞ্জ পুশ করে দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনি সিরিঞ্জ দুটো আমাকে দিন। আমি ঠিক সময়ে আপনার হাতে তুলে দেব।’

রাফাল ভুরু কুঁচকে প্রথমার দিকে তাকালেন। ‘আমি যখন কথা দিয়েছি তখন কথা রাখব। আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?’

প্রথমা হিশহিশ করে বলল, ‘আমি এখন নিজেকেও বিশ্বাস করছি না। সিরিঞ্জ দুটো দিন। আকিরা এল বলে।’

আকিরার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাফাল দ্রুত ডান পকেটের সিরিঞ্জ বার করে প্রথমার হাতে দিলেন। প্রথমা সেটা ওভারলের ডান পকেটে ঢোকাল। রাফাল এবারে বাঁ-পকেট থেকে সিরিঞ্জ বার করে দিলেন। প্রথমা সেটা ওভারলের বাঁ-পকেটে ঢোকাল।

আকিরা ঘরে ঢুকেছেন। সঙ্গে ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরা চালু হতেই আকিরা বললেন, ‘আজকের পরিস্থিতি জানতে আমরা চলে এসেছি ওয়ার্ডেন রাফালের কাছে। রাফাল, কী খবর?’

হাত মুছে, প্রথমাকে দেখিয়ে রাফাল বললেন, ‘মনোরঞ্জন বসুর ছেলের বউ মন্দিরা বসু ধ্রুবিকার প্রাণভিক্ষা করে যে চিঠি লিখেছেন সেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইমরাজের কাছে পৌঁছে গেছে। উত্তর কখন আসবে জানি না। আমাকে আমার কাজ করতেই হবে…’

‘আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ফোনের জন্যে অপেক্ষা করবেন না?’

রাফাল নিষ্ঠুর হেসে বললেন, ‘এই জেলখানা মৃত্যু ছাড়া কারও জন্যে অপেক্ষা করে না।’ তাঁর কথা শুনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন আকিরা।

আন্ডা সেলের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন রাফাল। পিছন পিছন প্রথমা। তার দিকে হাত পাতলেন রাফাল।

আন্ডা সেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আকিরা বলছেন, ‘ভারতীয় গুপ্তচর ধ্রুবিকা বসু এখন কথা বলছেন বউদি মন্দিরা বসুর সঙ্গে।’

প্রথমা ওভারলের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিরিঞ্জ বার করে রাফালের হাতে তুলে দিল। রাফাল সিরিঞ্জের সূচ গেঁথে দিলেন ধ্রুবিকার হাতে। তার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে বর্ণহীন তরল। চোখ বুঁজে আসছে। হঠাৎ চোখ খুলে সে বলল, ‘মন্দিরা! তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি আর পারছি না!’

রঞ্জিতের অফিসে ঢুকে প্রথমা দেখল, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি অরুণ মুখার্জি বসে রয়েছেন। তিনি ছাড়া ঘরে হাজির নায়ার। রঞ্জিত প্রথমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যারকে ব্রিফ করছি। সামান্যই বাকি আছে। তারপরে তোর সঙ্গে কথা বলছি।’

‘আচ্ছা।’ নায়ারের পাশে বসল প্রথমা। নায়ার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

রঞ্জিত বললেন, ‘রাফালের স্ত্রী মিশাকে ওয়ারিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রাফাল আর মিশা দু’জনেই এই নিয়ে মুখ খুলবেন না।’

অরুণ টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘সংসদ বাংলা অভিধান জানাচ্ছে দক্ষ প্রজাপতির কন্যা বসুর আট পুত্রকে বলা হত অষ্টবসু। তাদের নাম যথাক্রমে ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণুঅনল, অনিল, প্রত্যুষ এবং প্রভাস। মহাভারতের আখ্যান মতে এই অষ্টবসু বশিষ্ঠ মুনির সর্ব সুলক্ষণা গাভী নন্দিনীকে অপহরণ করেছিলেন। মহাভারতের আখ্যানের সঙ্গে তোমার এই আখ্যান মিলে যাচ্ছে রঞ্জিত!’

রাষ্ট্রপতির কথা শুনে হাসলেন রঞ্জিত। মূল বিষয়ে ফিরে বললেন, ‘রাফালের মোবাইলে ধ্রুবিকার মৃত্যুদণ্ড মকুব করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী ইমরাজের ফোন এসেছিল রাত ন’টার সময়ে। ততক্ষণে ধ্রুবিকা মারা গেছে।’ তারপর প্রথমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাফাল জানিয়েছেন, উনি তোর কাছে দুটো সিরিঞ্জ রাখতে দিয়েছিলেন। একটায় বিষ ছিল। অন্যটায় ডিসটিলড ওয়াটার। তুই জেনেশুনে রাফালের হাতে বিষভর্তি সিরিঞ্জ তুলে দিয়েছিলি কেন?’

প্রথমা বলল, ‘কারণ আছে।’

রঞ্জিত উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘প্রফেশনাল জেলাসির জন্যে একজন ট্যালেন্টেড এজেন্টকে মেরে ফেললি? অথচ আমার অর্ডার ছিল, যে কোনও মূল্যে ধ্রুবিকাকে ফেরত আনতে হবে। আমি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি তৈরি করছি। সেই কমিটি দেখবে, ধ্রুবিকাকে মেরে ফেলে কার লাভ হল।’

প্রথমা শ্রাগ করে বলল, ‘আমি ধ্রুবিকাকে মারতে বাধ্য হলাম, কারণ ও ডাবল এজেন্ট। ওকে বাঁচিয়ে রাখলে ভারতবর্ষে ফিরে ও সব ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট ওয়ারিস্তানে চালান করত।’

‘মেয়েটাকে খুন করেও আশ মিটল না। এখন ওর চরিত্র হনন করছিস? ছিঃ প্র্যাট!’ রঞ্জিতের গলায় ধিক্কার।

কান্না কাকে বলে ভুলে গিয়েছিল প্রথমা। আজ তার কান্না পাচ্ছে। এলিট ইনটেলিজেন্স উইং কাইমেরার পোড় খাওয়া এজেন্টের চোখে জল আসি আসি করছে। যে লোকটাকে সে বাবার মতো ভালোবাসে, সেই লোকটা তাকে ভুল বুঝছেন কেন?

প্রথমা নিচু গলায় বলল, ‘আমি আবারও বলছি, ধ্রুবিকা ডাবল এজেন্ট। সেটা আমি বুঝতে পারলাম। আর আপনারা পারছেন না?’

‘না। পারছি না।’ ঠান্ডা গলায় বললেন রঞ্জিত, ‘তুই বুঝিয়ে বল।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমা বলল, ‘নায়ার, আপনি আওয়ারাবাদ জেল নিয়ে কী বলেছিলেন মনে আছে?’

‘আমি তোমাকে ব্রিফ করেছিলাম।’

‘ওইভাবে বললে হবে না,’ নিজের মোবাইল থেকে অডিও ক্লিপ চালু করল প্রথমা। সবাই শুনল নায়ার বলছেন, ‘আওয়ারাবাদের জেলখানার বিল্ডিং একতলা…প্রতি সেলে একজন করে কয়েদি থাকে। ওখানেই রাখা হয়েছে বা হয়েছিল অষ্টবসুকে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গেও ওঁদের কোনও যোগাযোগ নেই। ওঁরা জানেনও না যে প্রতিদিন সন্ধেবেলা একজনকে বিষাক্ত ইনজেকশান দিয়ে খুন করা হচ্ছে।’

‘তুমি আমার কথা রেকর্ড করে রেখেছিলে?’ অবাক হয়ে বললেন নায়ার।

‘হ্যাঁ।’ নায়ারের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রঞ্জিতের দিকে তাকাল প্রথমা, ‘আপনার টিভিতে ডাব্লিউ টিভির অনুষ্ঠানগুলোর রেকর্ডিং স্টোর করে রাখা আছে?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘একবার ভবর সাক্ষাৎকারটা দেখতে চাই।’

প্রথমার কথা শুনে তার দিকে রিমোট এগিয়ে দিলেন রঞ্জিত। প্রথমা রিমোট টিপে এক জায়গায় এসে থামল। টিভি চালু হতে দেখা গেল ভব বলছেন, ‘বড়দি সোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত। ওয়ারিস্তানে ওর চেনা উকিল আছে।’ কথা শেষ হওয়া মাত্র রিমোটের পজ বাটন টিপে সাক্ষাৎকার থামিয়ে দিয়েছে প্রথমা।

রঞ্জিত শ্রাগ করে বললেন, ‘তো?’

প্রথমা আবার রিমোট টিপল। এবার দেখা যাচ্ছে ধূসর রঙের পোশাক পরে চেয়ারে বসে রয়েছে ধ্রুবিকা। তার হাতে ইনজেকশান দেওয়া হচ্ছে। সে প্রথমাকে বলল, ‘মন্দিরা! তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি আর পারছি না!’

প্রথমা বলল, ‘এটা তো অন ক্যামেরা আবেদন। মৃত্যুর ঠিক আগে। আমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তেও ধ্রুবিকা এই কথাটাই বলেছিল। সেটা আমি আর রাফাল ছাড়া কেউ শোনেনি।’

রঞ্জিত উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘কাম টু দ্য পয়েন্ট প্র্যাট!’

প্রথমা ক্রুর হেসে বলল, ‘নায়ারের কথা অনুযায়ী, আন্ডা সেলে থাকা অষ্টবসু একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। ভব জানতেও পারেননি যে সোমা অলরেডি মারা গেছেন। জানলে দেখা করার জন্যে আবেদন করতেন না। আমার প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতিতে আন্ডা সেলে থাকা ধ্রুবিকা জানল কী করে যে আমি মন্দিরা সেজে আওয়ারাবাদে ঢুকেছি? ও তো আমাকে প্রথমা বলেই চেনে!’

‘তাই তো!’ বিড়বিড় করে বললেন অরুণ।

প্রথমা রঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি যে মন্দিরা সেজে যাচ্ছি এটা জানতেন আপনি এবং নায়ার। নায়ার আমাকে বলেছিলেন, উনি রাফালকে আমার আসল পরিচয় জানিয়ে দেবেন। অর্থাৎ রাফাল জানতেন, আমি মন্দিরা নই, মন্দিরা সেজে যাচ্ছি। অর্থাৎ সাকুল্যে তিনজন আমার আসল পরিচয় জানতেন। এই ক্লাসিফায়েড ইনফর্মেশান ধ্রুবিকা কী করে জানল?’

রঞ্জিতের মাথা নিচু।

প্রথমা বলল, ‘ওয়ারিস্তান চেয়েছিল ধ্রুবিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে। ওরা ডাবল এজেন্ট হিসেবে ধ্রুবিকাকে র-এর অফিসে প্লান্ট করতে চেয়েছিল। জলভর্তি সিরিঞ্জ, দু’ঘণ্টা বাদে ফোন আসা এই সবই হল ইনভিজিবল ক্লোক। আমাদের মনে হত, আমরা ধ্রুবিকাকে বাঁচিয়ে আনলাম। কিন্তু ওই ক্লোকের আড়ালে ওয়ারিস্তান আমাদের মধ্যে একজন এজেন্টকে প্লান্ট করত।’

রঞ্জিত চেয়ার থেকে উঠে বললেন, ‘আমি সরি প্রথমা!’

প্রথমা বলল, ‘আপনি একজন এজেন্টের কাছে কেন দুঃখপ্রকাশ করবেন? তার প্রয়োজন নেই। আমার অনুরোধ, আপনার অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি কাজ করুক। তারা দেখুক, ধ্রুবিকাকে মেরে ফেলে কার লাভ হল? আর বাঁচিয়ে রেখে ভারতে ফিরিয়ে আনলে কার লাভ হত।’

‘তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস?’ চিৎকার করে উঠলেন রঞ্জিত।

‘আপনি আমাকে সন্দেহ করতে পারেন, আর আমি আপনাকে করতে পারি না?’ চোখ থেকে জল পড়ছে প্রথমার। অশ্রু মুছে সে বলল, ‘আমি আপনাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করি। ভবিষ্যতেও করব। কিন্তু আমার দায়বদ্ধতা একমাত্র এবং একমাত্র ভারতবর্ষের প্রতি। লাইফ বিফোর কানট্রি! জয় হিন্দ স্যার!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *