আটপৌরে কবিতা
আমার বেশ কিছুদিনের চেনা এক কবি এর মধ্যে বেশ কিছু কবিতা পড়ে ফেলেছেন আমার। ব্লগেই পড়েছেন। বললেন, আমার কবিতা খুব আটপৌরে। আটপৌরে বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন জানি না। কী? খুব পাশের বাড়ি পাশের বাড়ি, চিনি চিনি ধরনের? খুব ঘরের কিছু, মাছ ভাত, হলুদ নুনএর মতো? পানের বাটা, চালকুমড়ো, দিদিমা দিদিমা, মামা? নাকি মেঝের আল্পনা, মুড়ি ভাজা, দুপুরবেলার উল্টোরথ, দিদিদের শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া? কবি আমাকে ঠিক বলেন নি কী। তবে আটপৌরে শব্দটা উচ্চারণ করতেই মার। পরণের সেই আটপৌরে ধনেখালি শাড়িটা যেন উড়ে এসে আচমকা আমার শরীর, আমার মুখ চোখ ঢেকে দিল। আমি শুধু চোখ বুজে ঘ্রাণ নিলাম আমার মার শরীরের। একটাই ফুল জুই ফুল ঘ্রাণ ছিল মার শরীরে! কত হাজার বছর মাকে দেখিনা।
মা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর আমি ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখতাম। ওই একটা স্বপ্নই আমি প্রতিরাতে দেখতাম। স্বপ্নটা এমন: মা বাড়িতে আছে, হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। ঠিক আগের মতো সবকিছু। মাকে আমরা সবাই খুব আদর যত্ন করছি, খুব ভালোবাসছি, মাও বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিচ্ছে, সবাই খাচ্ছে কিনা, ঘুমোচ্ছে কিনা, বাড়ি ফিরছে কিনা দেখছে। মার শরীরে অসুখ। কিন্তু অসুখটা নিয়েই মা বেঁচে আছে। মা মারা যাবে এরকম ভাবছে অনেকে, কিন্তু মা আসলে মারা যাচ্ছে না। অথবা মারা গিয়েছিলো, কিন্তু কী করে যেন মৃত্যুকে ঠেলে সরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। এই স্বপ্নের নরম পালক কে যেন আমার চোখে মুখে আলতো ছুঁইয়ে ঘুম ভাঙাতো। ঘুম ভাঙার অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার মনে হতো যে স্বপ্নটা বুঝি সত্যি। অনেকক্ষণ, সম্ভবত কয়েক সেকেণ্ড। স্বপ্নের জন্য, ঘোরের জন্য, পরাবাস্তবতার জন্য কয়েক সেকেণ্ডই অনেকক্ষণ। কয়েক সেকেণ্ড পার হলে বুঝে যেতাম, ও স্বপ্ন, মা বেঁচে নেই। খুব কষ্ট হতো। স্বপ্নটা সত্যি হোক, কী যে ভীষণ চাইতাম। মার নামরে যাওয়াটা যদি সত্যি সত্যিই সত্যি হতো। স্বপ্নটাকে সত্যি করে ফেলা আর সত্যিটাকে স্বপ্ন করে ফেলার ইচ্ছেটা আমার ভেতরে চিরকাল বোধহয় রয়েই যাবে। আমি ঠিক জানিনা কেন আজকাল এই স্বপ্নটা আমি আর দেখি না। কেন আমি ওই একই স্বপ্ন প্রতিরাতে দেখতাম, সেও জানি না। মাকে, ঠিকই যে, আজকাল আগের চেয়ে কম মনে পড়ে। মাকে নিয়ে নেই কিছু নেই বইটা লিখে ফেলার পর, আমি লক্ষ্য করেছি, ভেতরে ভেতরে দায়িত্ব পালন করার পর যেমন এক প্রশান্তি জোটে, তেমন জুটেছে। বেদনার তীব্রতা কমে এসেছে ধীরে ধীরে। বইটা লেখার সময় চোখের জল অনেক ঝরেছে। একহাতে জল মুছেছি, আরেক হাতে লিখেছি। লিখলে, আমার বিশ্বাস, দুঃখ কষ্ট অনেক কমে। সে কারণেই বোধহয় ওই স্বপ্নটা আমি আর দেখি খুব ইচ্ছে করে স্বপ্নটা আবার দেখি। আবার দেখি মা বাড়িতে আছে, হাঁটছে, হাসছে, কথা বলছে। ঠিক আগের মতো সবকিছু। লেখকরা কি খুব স্বার্থপর? আমি তো কবিতা লিখেও অনেক বিরহের যন্ত্রণাকে কমিয়ে ফেলেছি। কমিয়েছি নারীবাদী লেখা লিখে বৈষ ম্যের বিরুদ্ধে জমে থাকা দীর্ঘ বছরের রাগকে, ক্ষোভকে।
আমি আটপৌরে জীবনই চাই, আমার কবিতাও আমার জীবনের মতো। একরকম জীবন যাপন করবো, আর আরেক রকম কবিতা লিখবো, তা আমার দ্বারা হবে না। যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষাটাকে, সেই ভাষার শব্দ আর অক্ষরকেই তো রোপন করবো কবিতার মাটিতে। জীবনই তো জন্ম নেবে ছত্রে ছন্দে। জীবনকেই তো তুলে নেবো শব্দ থেকে। তুলে নিয়ে শহর বন্দর গ্রাম খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াবো। যে জীবনটাকে চিনিনা, যে শব্দ আমি প্রতিদিন ব্যবহার করি না, প্রতিদিন শুনি না, যে বাক্য আমি নির্মাণ করি না, যে বাক্য আমি আমার চারপাশের কাউকে নির্মাণ করতে শুনি না, সেই শব্দ বাক্য আমি কবিতায় জড়ো করি না। যে ভাষায় আমি মনে মনে নিজের সঙ্গে কথা বলি না, সে ভাষায় আমি কবিতা লিখি না। লিখলে সেই কবিতাকে, আমি খুব ভালো করে জানি, আমার নিজের কবিতা বলে মনে হবে না। লিখলে সেই কবিতা মিথ্যে কবিতা হবে। মিথ্যের সঙ্গে আমার ওঠা বসা নেই। লেনদেন নেই। কোনও মিথ্যেকে আমি আমার বলে মনে করি না। আমি লেখায় কায়দা খাটাই না, যা-ই লিখি, যা কিছুই লিখি, হৃদয় দিয়ে লিখি। কী লিখলে অত্যাধুনিক কবিতা হবে, কী ঢংএ লিখলে ক্রিটিকদের প্রশংসা পাওয়া যাবে, কী ধরনের ছন্দ হলে নতুন কবিতার ধারাতৈরি হবে, এসব আমার ভাবনার বিষয় নয়। পাঠক আমার লেখা বুঝবে কি না, আমার লেখাকে ভালো বলবে কি না, সে নিয়েও আমি ভাবি না। পাঠককে সুখ আনন্দ জোগাতে আমি কখনও কোনও লেখা লিখিনি। কিছু কথা আমার ভেতর-ঘরে বসে হাঁসফাঁস করে, আমি তাই জানালা দরজাগুলো খুলে দিই। এটুকুই। যা কিছুই লিখি, লিখি আমার মায়ের ভাষায়, যে ভাষা মা আমাকে শিখিয়েছিল সে ভাষায়, হৃদয়ের ভাষায়। ধার করে লিখি না। অনুকরণ করি না। কবিতাকে জাদুঘরে নিয়ে যাই না, কবিতাকে পড়ে থাকতে দিই কলমিলতায় ছেয়ে থাকা পুকুরপাড়ে।
দীর্ঘ নির্বাসনের শেকল ছিঁড়ে যখন কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেছিলাম, দু পুরবেলায় বারান্দার রোদে কাপড় শুকোতো আর হাওয়ায় ভাসতো রান্নার সুগন্ধ, হলুদ মরিচের, ধনে জিরের সুগন্ধ। ঠিক ওই ছবিটিকে আমি স্থির করে রাখতাম মনে, ওই ছবিটিই আমাকে আমার শৈশব দিত, কৈশোর দিত। বিদেশের আধুনিক জীবন যাত্রা তুচ্ছ করে ওই ছবিটির জন্য আমি বাঙালির আটপৌরে জীবনের কাছে ফিরেছিলাম। মার আটপৌরে শাড়ির আঁচলখানির কাছে। আঁচল ছিঁড়ে ফেলেছে লোকেরা।
কিন্তু আমার আটপৌরে কবিতাকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি। ওগুলো ছিঁড়ে টুকরো করতে এখনও পারেনি কেউ। আমার কবিতা থেকে সোঁদামাটির যে ঘ্রাণ আসতো, সে ঘ্রাণ এখনও আসে। সবচেয়ে যে ঘ্রাণটা বেশি আসে, সে আমার মার শরীরের সুঁই ফুল জুই ফুল ঘ্রাণটা। আর কেউ পায় কি না জানি নি, ঘ্রাণটা আমি পাই। ওই ঘ্রাণটা যতক্ষণ না পাই, ততক্ষশ বুঝি যে আমার কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে নি।