আঞ্চলিক থেকে জাতীয়
ততদিনে পরপর বেশ কয়েকটা ছবি হিট করেছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে লোকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। পরিচিতির সে স্বাদই ছিল অন্যরকম। ডাক এলো বাংলার বাইরে থেকে- একদিন এক অপরিচিত ভদ্রলোক ফোন করলেন। অজিতকে খুঁজছিল। ও বাড়িতে ছিল না। ভদ্রলোক বললেন- মালায়ালাম ছবি করতে চান আমাকে নিয়ে। আমি তো শুনেই এক বাক্যে না বলে দিলাম। যে ভাষা কখনও শুনিনি, বলতে পারিনা, অমন বিদেশি ভাষায় আমি ছবি করতে পারবো না! অজিত এসে বললো- একেবারে না করে দিলে! একবার শুনে দেখে পারতে”।
বলতে বলতেই আবার ফোন। বুঝলাম ইনি সহজে ছাড়বার পাত্র নন। বাড়িতে ডাকলাম। যিনি ফোন করেছিলেন সেই ভদ্রলোক, সঙ্গে ছবির পরিচালক দু’জনেই এলেন। পরিচালকটি বয়সে তরুণ। তার আগে একটি মাত্র ছবি করেছেন। নাম ‘চেন মিন’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘চিংড়ি মাছ’। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছিল। বাড়িতে এসে আমাকে ওঁর নতুন ছবির পুরো গল্পটা শোনালো। গল্পটা বেশ, কিন্তু মালায়ালাম ভাষায় ছবি করবো কী করে? আমি তো ওসব কিছুই বুঝি না! ছেলেটি আমাকে বললো- আমি একটা ডায়লগ বলছি, আপনি বলুন দেখি! আমি শুনে শুনে দিব্যি বলে দিলাম। বললো- ”এই তো আপনি মালায়ালাম বললেন। এভাবেই হবে”। আমি আপনাকে বাংলায় ট্রান্সলেট করে পুরো স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দেবো। তাতে রোমান হরফে মালায়ালাম উচ্চারণও দেওয়া থাকবে। আপনার কোন অসুবিধেই হবে না। একরকম জোর করেই কথা পাকা করে চলে গেলেন। ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ এর শুটিং করতে করতেই ফ্লাইটের টিকিটও চলে এলো। কিন্তু তখনও হাতে স্ক্রিপ্ট আসেনি। ডায়লগ বলবো কী করে! আমার তো মাথায় হাত! মেজাজ গেল বিগড়ে। মনে আছে এয়ারপোর্টে নেমে ইউনিটের লোকজনদের বেশ উত্তেজিত স্বরে বলেছিলাম- ”আমি ফিরে যাচ্ছি। আমার হাতে এখনও স্ক্রিপ্ট এসে পৌঁছয়নি। এভাবে আমি কাজ করতে পারবো না”। ওরা থতোমতো খেয়ে গেল। জানালো, যে বাঙালি ছেলেটি অনুবাদ করছে সে নাকি কী সব সমস্যায় পড়েছে। তাই একটু দেরি হচ্ছে। যদিও সেদিনই আমার হাতে স্ক্রিপ্ট চলে এসেছিল। আমার চরিত্রটির তেমন ডায়লগ না থাকায় সমস্যায় পড়তে হয়নি। ড্রয়িংরুমে রাখা একটা ছবির দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললেন- ”এটা ওই মালায়ালাম সিনেমা থেকে নেওয়া একটা স্টিল”। ছবিতে আলুথালু চুল, চোখেমুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, একটি বিধ্বস্ত মুখ। গল্পটা জানার লোভ সামলাতে পারলাম না। মালায়ালাম ছবিরও যে এমন অসাধারণ গল্প হতে পারে, আমার জানা ছিল না। বাংলাতেও বোধহয় এমন টানটান চিত্রনাট্য খুব কমই পেয়েছি। আমার চরিত্রটি ছিল একটি গ্রাম্য কেরালিয়ান মেয়ের। নাম তুলসী। গ্রামের হলে কী হবে, মেয়েটি বেশ উচ্চশিক্ষিত। কেরলেও আসলে তাই। ওখানকার মেয়েরা সকলেই প্রায় পড়াশুনো জানা। মেয়েটির চাকরি করার খুব ইচ্ছে। কিন্তু বাড়ি থেকে একেবারেই রাজী নয়। এমন অবস্থায় হঠাৎ মেয়েটির বাবা মারা যায়। একরকম বাধ্য হয়েই চাকরির খোঁজে তাকে পাড়ি দিতে হয় বড় শহরে। চেন্নাই থেকে তুলসী এসে পৌঁছোয় বম্বেতে। চটজলদি শহরের এক বড় কোম্পানিতে ভালো কাজ জুটে যায়। বসের প্রিয় পাত্রী হয়ে ওঠে সে। সেটাই ছিল মেয়েটির ভাঙনের কারণ। কোম্পানির বস একদিন ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়িতে এনে ধর্ষণ করে তুলসীকে। তুলসীর স্বপ্ন তখন ভেঙে চুরচুর! এক ভয়ানক হিংস্র দৈত্য এলোমেলো করে দিয়েছে তার জীবন। অপমানের ভারে অন্তঃস্বত্বা তুলসীর ঠাঁই হয় পতিতাপল্লীতে। গ্রামের সহজ সরল তুলসী হয়ে উঠতে থাকে শহরের নামজাদা নাচনেওয়ালি প্রিয়া। ততদিনে কোম্পানির বস স্ত্রী সন্তান নিয়ে সেটলড। আবার বহুদিন পর দুজনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ। গল্প তখন ক্লাইম্যাক্সে। খদ্দের হয়ে প্রিয়ার ঘরে ঢোকে কোম্পানির বস। হতাশায়, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে প্রিয়ার ভেতরটা। ধর্ষক কোম্পানির বসকে গলার শিরা কামড়ে খুন করে প্রিয়া। দেওয়ালের ওই ছবিটা ঠিক সেই মুহূর্তের। এমন চ্যালেঞ্জিং একটা চরিত্র করার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই তো মালায়ালাম ভাষা সত্বেও কাজ করতে রাজি হয়েছিলাম। পরে শুনেছি আমার কাজ নাকি খুব প্রশংসিত হয়েছিল। ওখানকার পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখিও হয়েছিল আমাকে নিয়ে। আসলে ওখানে তো সবাই লাউড অ্যাক্টিং করে। তাই আমার অমন ন্যাচারাল অভিনয় ওদের মনে ধরেছিল।
ওরা আরও একটা ছবির অফার করেছিল। আমি আর রাজি হইনি। আসলে ওখানে টানা ১০-১২ ঘন্টা কাজ করতে হত। তার মধ্যে খাবার দাবারের ভয়ানক সমস্যা। আমার শরীর দিচ্ছিল না।
ইতিমধ্যে বম্বে থেকে প্রথম হিন্দি ছবির অফার এলো। সুলোচনা চ্যাটার্জীর হাজব্যান্ড ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে হিরোইন করে হিন্দি ভাষার ছবি করতে চান। লোকটার কী ভীমরতি ধরেছে! ভেবেছিলাম হেসে উড়িয়ে দেবো। আমার পেছনে অহেতুক টাকা নষ্ট করে কী লাভ ওদের! কিন্তু ‘না’ বলতে পারলাম না। পরিস্থিতি আমাকে বম্বে টেনে নিয়ে গেল। সময়টা ছিল সত্তরের দশক। বাড়ির বাইরে পা বাড়ালেই ভেতরে একটা উৎকন্ঠা কাজ করত। ঠিকঠাক ঘরে ফিরতে পারবো তো? অবস্থা ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছিল। এন.টি-টু স্টুডিওতে বোমা পড়লো। বেশ কিছুদিনের জন্য বাধ্য হয়েই কাজ বন্ধ করে দিতে হল ইন্ডাস্ট্রির লোকদের। রাজি হয়ে গেলাম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে। সময়টা ১৯৭২ সাল। আরব সাগরের শান্ত উপকূলে শুরু হল আরেকটি নতুন লড়াই।
বম্বেতে তখন পৌরাণিক ছবির ট্রেন্ড চলছে। ‘সম্পূর্ণ বিষ্ণুপুরান’ ছবিতে কাজের অফার এলো। আসিম কুমার আর লিলি চক্রবর্তী। হিরো হিরোইন। কপালে থাকলে বোধহয় এরকমই হয়। কী ভাবে যেন সাড়া পড়ে গেল বম্বেতে। কে এই নতুন মেয়েটি? কোথা থেকে উড়ে এল? শুরু হল খোঁজ। নিজেকে আশ্চর্য করে ডাক এলো পরের পর।
একবার তরুণ মজুমদার এলেন বম্বেতে। ‘ফুলেশ্বরী’র স্ক্রিপ্ট শুনতে গিয়েছিলাম ওঁর কাছে। দেখি মুকুলবাবু বসে আছেন। আমাকে দেখতেই বললেন- ”বম্বে এসেছেন, জানাননি তো!” বললাম- ”আগে থেকে জানালে যে হঠাৎ দেখা হওয়ার আমেজটাই মাটি হয়ে যেত!” আসলে কলকাতা থেকে আর্টিস্টরা বম্বে গেলেই বম্বের বাঙালিদের সঙ্গে আগেভাগে যোগাযোগটা সেরে রাখতো যাতে কাজ পেতে কোন অসুবিধে না হয়। এসব ব্যাপার-স্যাপার চিরকালই আমি একটু কম বুঝি! কেউই প্রায় জানতো না যে আমি বম্বে এসেছি। তাই বোধহয় মুকুলবাবুর কাছে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ঠেকেছিল।