আঞ্চলিক ইতিহাসের পুরোধা ব্যক্তিত্ব – প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র
সুধীরকুমার মিত্রের খ্যাতি বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে। তাঁর লেখা হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড) তাঁকে বঙ্গসাহিত্যে স্থায়ী আসনে বসিয়েছে। তিনি ক্ষেত্রানুসন্ধানে ব্রতী ছিলেন। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি তথ্য সংগ্রহ করতেন। মন্দির-মসজিদ-গির্জায় গিয়ে তাদের বর্ণনা দিতেন, জনশ্রুতি ও লোককথাকে যাচাই করে তথ্যনির্ভর ইতিহাস রচনা করতেন। কিন্তু তাঁর বিশাল মেধা শুধু আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি লিখেছেন বহু জীবনী গ্রন্থ, বংশ পরিচয়, দক্ষিণের দেবস্থান, হুগলি জেলার দেবদেউল, দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী, ইন্ডিয়াজ ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ, সোসাইটি রিলিজিয়ন অ্যাণ্ড কালচার অব বেঙ্গল প্রভৃতি তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ। এ ছাড়া লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, যা ছড়িয়ে আছে খ্যাত-অখ্যাত বহু পত্রিকায়। এর এক দীর্ঘ তালিকা আলোচ্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা থেকে সুধীরকুমার মিত্রের বহুবিস্তারী মনীষার প্রমাণ পাওয়া যায়।
আলোচ্য গ্রন্থটি আয়তনে ক্ষুদ্র, মাত্র ১০৮ পৃষ্ঠার। কিন্তু বিষয়গৌরবে ও তথ্য সংকলনে সমৃদ্ধ। তারকেশ্বর বাংলার প্রধান শৈবতীর্থ, একমাত্র কালীঘাটে শক্তিতীর্থ কালীমন্দিরের সঙ্গে তুলনীয়। এই দুই কেন্দ্র শিব ও শক্তির সাধনার সুযোগ করে দিয়ে অসংখ্য মানুষের অধ্যাত্মচেতনাকে জাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সুধীরকুমার মিত্রের গ্রন্থটি পড়লে মনে হয়, তারকেশ্বর শুধু শৈবতীর্থ নয়, ধর্মীয় সংহতির একটি কেন্দ্রভূমি। এখানে শিব-এর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীনারায়-এর মন্দির আছে যা একই সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এক দিকে যেমন শিব-এর গাজন হয়, অন্য দিকে তেমনই হয় লক্ষ্মীনারায়ণকে উদ্দেশ করে দোলের উৎসব। এগুলিতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই অংশগ্রহণ করে।
আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকায় পল্লব মিত্র সুধীরকুমার মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিপিবদ্ধ করে তাঁর সাহিত্যকৃতির একটি মূল্যায়ন করেছেন। এর পর আছে গ্রন্থকারের লেখা তিনটি প্রবন্ধ: ‘তারকেশ্বরের ইতিকথা’, ‘তারকেশ্বরের দোল-উৎসব’, আর ‘তারকেশ্বরের গাজন-উৎসব’। প্রথমে প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, ‘ষোড়শ শতাব্দীতে তারকেশ্বর প্রকটিত না-হইলেও উক্ত স্থানেই তিনি ছিলেন, কিন্তু স্থানটি জঙ্গলাকীর্ণ ছিল বলিয়া উহা সর্বসাধারণের অগোচরে ছিল।’ তারকেশ্বরের ইতিহাস রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক। জৌনপুরের কাছে হরিহরপুরের রাজা বিষ্ণুদাস উদ্বাস্তু হয়ে হরিপালের কাছে রামনগরে আশ্রয় নেন। নবাব মুর্শিদকুলি খানের কাছে জ্বলন্ত লৌহশাবল হাতে নিয়ে সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নতুন স্থানে বসবাসের অনুমতি পান। রাজবাড়ির গাভীরা বনের মধ্যে এক শিলাখন্ডে দুধ দিত। এই দেখে রাজার গোয়ালা রাজভ্রাতা ভারামল্লকে জানায়। সংবাদটি সত্য প্রমাণিত হলে তিনি শিলাটি তুলে আনবার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। রাত্রে রাজা বিষ্ণুদাস স্বপ্নে দেখেন শিবঠাকুর তোলবার চেষ্টা বন্ধ রেখে ওই স্থানেই মন্দির করতে বলেন। দুই ভাই মিলে মন্দির স্থাপন করেন। পরে বর্ধমানের মহারাজা মন্দির পুনর্নিমাণ করেন। এই ছোটো মন্দির ঘিরে জনৈক গোবর্ধন রক্ষিত বড়ো মন্দির তৈরি করেন। এখন দুই মন্দিরই দেখা যায়। পরে কেউ তৈরি করেন নাটমন্দির, কেউ বাঁধিয়ে দেন পুকুরঘাট, রাস্তা। মারোয়াড়ি সম্প্রদায় করেছেন কয়েকটি যাত্রীনিবাস।
রাজা ভারামল্ল মন্দির পরিচালনার জন্যে ভার দেন মায়াগিরি ধূম্রপান মোহন্তর উপর। ‘তারকেশ্বরের মোহন্তগণ দশনামী সন্ন্যাসী এবং ব্রহ্মচারীরূপে দেবসেবা করিবেন ইহাই ভারামল্ল নির্দেশ দিয়া যান।’ এক মোহন্ত মারা গেলে তাঁর প্রধান শিষ্য পরবর্তী মোহন্ত হবে, এটাই প্রথা ছিল।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে দু-টি ঘটনার বিশদ বিবরণ চিত্তাকর্ষক। এক, মোহন্ত শ্রীমন্ত গিরি তাঁর রক্ষিতা বেশ্যার উপপতিকে খুন করে ফাঁসিকাঠে প্রাণ দেন। দুই, মোহন্ত মাধব গিরি এলোকেশী নামে এক মহিলার সতীত্ব নাশ করে কারাগারে ঘানি টানেন। এলোকেশী মোহন্ত আর নবীনের ঘটনা বঙ্গীয় সমাজে চাঞ্চল্য জাগায়। কয়েকটি নাটক অভিনীত হয় এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে, দেবগণের মর্ত্যে আগমন গ্রন্থেও বর্ণিত হয়। অনেক গান জনপ্রিয় হয়। এসব তথ্য জানা যায় আলোচ্য গ্রন্থ থেকে। কালীঘাটের পটও কাহিনির চিত্ররূপকে স্থায়ী করে রেখেছে।
মন্দির পরিচালনায় সংস্কারের জন্য তারকেশ্বরে সত্যাগ্রহ শুরু করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতা। অতুল্য ঘোষের ‘কষ্টকল্পিত’ থেকে এই সত্যাগ্রহের বিবরণের দীর্ঘ উদ্ধৃতি গ্রন্থটিতে আছে।
তারকেশ্বর দুর্নীতি, কদাচার, অত্যাচার সত্ত্বেও বিশেষ জনপ্রিয়। ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে মহাদেব’ বলতে বলতে গঙ্গাজলের বাঁক কাঁধে নিয়ে দন্ডী কেটে হাজার হাজার নর-নারী শিব-এর মাথায় জল দিয়ে পুণ্যার্জন করতে ছুটে যায়। এ ছাড়াও শিব-এর গাজন ও লক্ষ্মীনারায়ণ-এর দোল উৎসবের বর্ণনাও আলোচ্য গ্রন্থের বিশেষ সম্পদ।
সুধীরকুমার মিত্রের ভাষা প্রাঞ্জল, প্রসাদগুণসম্পন্ন। রচনা তথ্যনির্ভর ও বিশেষজ্ঞের উক্তির উদ্ধৃতিবহুল। এই গ্রন্থটি পড়তে বসলে শেষ না-করে ওঠা যায় না।