আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হুগলি – বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ১৭৯৫-এর ৩৬ নং বিধানে (Regulation XXXVI of 1795) প্রধানত বর্ধমান জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে হুগলি জেলা গঠিত হয়েছিল। এতে মোট ১৩টি থানা ছিল যথা, হুগলি, বাঁশবেড়িয়া, পান্ডুয়া, বেণীপুর, ধনিয়াখালি, হরিপাল, রাজবলহাট, জাহানাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ, চন্দ্রকোনা, ঘাটাল, বাগনান ও আমতা। পরে আরও কিছু অদলবদল ঘটে। কিছু এলাকা হুগলি জেলা থেকে বাদ যায়। যেমন চন্দ্রকোনা ও ঘাটাল থানা মেদিনীপুর জেলায় চলে যায়। হাওড়া পৃথক হয়ে যায় আবার ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বর্ধমান জেলার রায়না থানার শাহলালপুর বর্ধমান থেকে সংযোজিত হয় হুগলি জেলায়। সুতরাং আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে হুগলি জেলার বিবর্তনেরও একটি ইতিহাস রয়েছে, এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ চোখে পড়েনি। ব্যতিক্রম হল M. M. Chakraborty লিখিত A summary to the changes in the jurisdiction of Districts of Bengal. হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় প্রথম সাহায্যকারী হলেন বিদেশি পর্যটক, বণিক, নাবিক এবং প্রশাসকরা। তারপর দেশীয় ঐতিহাসিকদের ইতিহাসচর্চার কথা উল্লেখ করতে হবে। সময়ের বিচারে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে হুগলি জেলা নিয়ে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়। পরে এই চর্চার একটি যুক্তিসঙ্গত, বিস্তৃত, ধারাবাহী এবং চাক্ষুষচর্চার প্রেক্ষিতের নির্মাণ ঘটে সুধীরকুমার মিত্রের হাতে। ক্রমশ এই যুক্তিসঙ্গত, বিস্তৃত, ধারাবাহী এবং চাক্ষুষচর্চার প্রেক্ষিতের নির্মাণ একটি ‘মডেল’ (Model) বা প্রতিরূপ হিসাবে গণ্য হতে থাকে।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পরোক্ষ ঔপনিবেশিক স্বার্থে হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য, তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলার অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করে ইংরাজ রাজপুরুষেরা বিভিন্ন রিপোর্ট ও জার্নাল লিখতে শুরু করেছিলেন। হ্যামিলটন ডেসক্রিপশন অব হিন্দুস্তান লিখেছিলেন উনিশ শতকের প্রথমে। ফ্রান্সিস বুকানন বিভিন্ন জেলার ‘‘Account” লিখতে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে টয়েনবি দু-টি বই লেখেন। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয় এ স্কেচ অব দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব দি হুগলি ডিস্ট্রিক্ট এবং ১৮৯০ সালে এ্যাকাউন্ট অব দি ডিস্ট্রিক্ট হুগলি। টয়েনবির লেখা থেকে হুগলির শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস অনেকটা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০২ সালে ডি. জি. ক্রফোর্ড লিখেছিলেন ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব দি হুগলি ডিস্ট্রিক্ট’, এরপর ১৯০৫ সনে ক্রফোর্ডের লেখা একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘এ রিপোর্ট অন দি এপিডেমিক অব প্লেগ ইন হুগলি’। চুঁচূড়া সন্নিহিত অঞ্চলের কথা এখানে অনেকটা আলোচিত। চুঁচূড়া শহরের কথাও রয়েছে। ইতিহাসের ধারাপথ অনুসরণ করে বলা যায় সরাসরি ঔপনিবেশিক লক্ষ্যে বিদেশিরা যেমন হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা করেছেন তেমনই হিতবাদী মতের দ্বারা প্রভাবিত ইতিহাসচর্চাও ছিল উল্লেখ্য। এঁরা দেখাতে চেয়েছিলেন এলাকায় কীভাবে ব্রিটিশরাজ উন্নতির কাজকর্ম করে হতভাগ্য দেশি মানুষদের উদ্ধার করেছেন। ক্রফোর্ডের লেখা সেই ধারায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার একটি নিদর্শন। শম্ভুচন্দ্র দে প্রণীত হুগলি পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট (১৯০৬) এই ধারার পুস্তক। আসলে ব্রিটিশ ধাঁচ অনুসরণ করে ইতিহাস লেখবার প্রবণতা এর একটি কারণ।
এর ফলে ব্রিটিশ সংগৃহিত উপাদানের উপর ভিত্তি করে হুগলি-সহ অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাস লেখার প্রবণতা বাড়তে থাকে এক শ্রেণির ঐতিহাসিকদের। এর ফলে দেশজ চেতনা থেকে সরে যাবার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। অনেকসময় তা প্রায় অনুবাদকর্ম হয়ে দাঁড়ায়। যেমন শ্যামধন মুখোপাধ্যায় যে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস লিখেছিলেন তা ছিল স্টুয়ার্ট ও মার্শম্যানের ইতিহাস গ্রন্থ এবং রেভেনিউ সার্ভেয়ার জে. ই. গ্যাসট্টেলের প্রতিবেদন নির্ভর। শম্ভুচন্দ্র দে’র হুগলি পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট, এই ধরনের ব্রিটিশ ইতিহাসচর্চা সজ্ঞাত পরিবেশন ছিল। যদিও এরই পাশাপাশি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বারবার নির্দেশ করছিল দেশীয় ইতিহাস, আঞ্চলিক ইতিহাসের সযত্ন লিখনের কথা। এক্ষেত্রে স্টুয়ার্ট ও মার্শম্যানের লিখন পদ্ধতি থেকে, ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, শুধুই রাজবংশের ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসা দরকার ছিল কিন্তু বাঙালি তা পারেনি অনেকদিন। হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ১৮৮৬ সনে এ. জি. বাওয়ার লিখেছিলেন দি ফ্যামিলি হিস্ট্রি অব বাঁশবেড়িয়া রাজ। কুমার মুনীন্দ্রদেব রায় লিখেছিলেন বাঁশবেড়িয়া পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট। ১৯৩৮ সালে লেখা বংশবাটি পরিচয় বইটিতে বরং তাঁর স্বকীয়তা এবং হুগলির একটি বিখ্যাত অঞ্চলের সহজ বর্ণনা পাঠককে আকৃষ্ট করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলার বিভিন্ন জেলা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হচ্ছিল Calcutta Review ও এশিয়াটিক সোসাইটির Journal এ বিষয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার ভেতরে এক ধরনের ‘ন্যারেটিভ’ বা বর্ণনামূলক ইতিহাস লেখারও চেষ্টা চলছিল। জেমস লঙ যেমন জি. টি. রোড এবং ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চলের ইতিহাস লেখেন। যা ‘ন্যারেটিভ’ হিসাবেই অনবদ্য, উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে হয় না। যেখানে হুগলি অঞ্চল অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। ব্র্যাডলে বার্ট ১৯১৮ সনে ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় চন্দননগর নিয়ে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
ইতিহাস সূত্রপরম্পরা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় জনগণনা, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক সমীক্ষা শুরু হয়েছিল প্রাথমিকভাবে ঔপনিবেশিকতার প্রয়োজনে। আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় এগুলি ছিল প্রশাসনিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিন্তু এর মাধ্যমে তথ্য সঞ্চারিত হয়েছিল। জেলাভিত্তিক স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল ১৮৭৫ সাল থেকে। ১৮৮১ সাল থেকে প্রকাশিত হল ইমপিরিয়াল গেজেটিয়ার। এরই ভেতরে পরিচ্ছন্নভাবে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হল স্ট্যাভোয়িনাস, ফ্রাঁসোয়া মার্তা, উইলিয়ম হেজেস, অনন্তরঙ্গ পিল্লাই, হাইণ্ড রেভারেণ্ড প্রমুখের স্মৃতিকথা ও রচনা। হাইণ্ড রেভারেণ্ডের বই দি প্যারিস অব বেঙ্গল (১৮৮৯) চন্দননগর ভ্রমণের স্মৃতি যা ফরাসি উপনিবেশের কাহিনি শোনালো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা গিয়েছিল হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাস লেখবার প্রচুর উপকরণ রয়েছে। ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টারের অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্বজ্জনের কাছে এটি ছিল অনাবিস্কৃত এক অধ্যায়। বিশেষত কলকাতার নবোদিত বুদ্ধিজীবীদের কাছে। ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল পড়ে মানুষ উৎসাহী হয়েছিল বিষ্ণুপুর, বীরভূম এবং তৎকালীন ভাগলপুরের জীবন ও ইতিহাস সম্পর্কে। জেলার বিবরণকেন্দ্রিক একটা আগ্রহ গড়ে উঠছিল যার পরিণতিতে এসেছিল হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাস আরও বিস্তৃত করে লেখবার বাসনা। হান্টারের Imperial Gazetteers (Provincial series—Bengal) বইটির উপযোগিতার কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণে এল।
বিদেশি ঐতিহাসিকদের পাশাপাশি দেশি ঐতিহাসিকেরা নিজেদের এলাকার ইতিহাস লিখতে শুরু করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমে নানা পত্রিকায় জাতীয়তাবাদের আবহাওয়ায় স্বদেশি যুগে লেখা এসব ইতিহাস, যেমন ১৩২১ সনে অম্বিকাচরণ গুপ্ত লিখিত হুগলি বা দক্ষিণ রায় কিংবা ১৩৩২ সালে বিধুভূষণ ভট্টাচার্য লিখিত হাওড়া ও হুগলির ইতিহাস ক্রমশই অতীত গৌরবের পুনরুদ্ধারের দিকে চলে যাচ্ছিল। Glorification of the Past যা অতীতকে গৌরাবান্বিত করে দেখানোর প্রয়াস এসেছিল জাতীয়তাবাদী চাপে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় এর ছায়াপাত ঘটেছিল। ফলে সে সময় পরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত প্রবন্ধ, ‘‘হুগলির পান্ডুয়া’’, (প্রবাসী ২ বর্ষ ১ সংখ্যা ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ) নিখিলনাথ রায় লিখিত প্রবন্ধ, হুগলি জেলা সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ ঐতিহাসিক চিত্র (৭ বর্ষ ১১-১২ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ১৯২৫), যোগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায় (একাধিক প্রবন্ধ) চারুচন্দ্র রায় (একাধিক প্রবন্ধ) হরিহর শেঠ (চন্দননগর সংক্রান্ত একাধিক প্রবন্ধ) অম্বিকাচরণ গুপ্ত (একাধিক প্রবন্ধ) আনন্দলাল মুখোপাধ্যায় (প্রবন্ধ, বলাগড় পরিচয়, পঞ্চপুষ্প, আষাঢ় ১৩৩৯, পৃ. ৭৪-৭৮), উপেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতিরত্ন (সমাচার, মাসিক বসুমতী-তে প্রকাশিত একাধিক প্রবন্ধ) প্রভৃতি অসংখ্য লেখকের লেখা সে যুগের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যার অধিকাংশে হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসের চর্চা ছিল ঠিকই কিন্তু জাতীয়তাবাদের ঝোঁক থাকায় কেবলই অতীত গৌরবের চর্চা থাকায় তা নির্মোহ নিরপেক্ষ আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় রূপলাভ করেনি, কিন্তু হুগলির বিভিন্ন অঞ্চলের রূপ তাতে ফুটে উঠেছিল।
এই সময়ের হুগলির ইতিহাসচর্চায় বিশ্বজনীনতার সঙ্গে আঞ্চলিক চেতনাকে মেলানোর প্রয়াস ছিল অপ্রতুল। অনেকসময় দেশপ্রেমের জোয়ার, অতীত গৌরবের স্মৃতিমেদুরতা এসে তা ভাসিয়ে দিচ্ছিল। সুধীরকুমার মিত্র প্রথমে জেজুরের মিত্র বংশ লিখে তারপর হুগলি জেলার ইতিহাস লিখে সে মোহ ভাঙলেন। হুগলি জেলার ইতিহাসও বঙ্গসমাজে তো আরও পরিস্ফুট হল। তিনি হুগলিকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় প্রসারণ ঘটালেন। আঞ্চলিক ইতিহাস স্পর্শ করেছিল কেন্দ্র থেকে প্রান্তীয় সমাজকে। বিস্তার বেড়েছিল, মাত্রা বেড়েছিল। দলিল দস্তাবেজ নয়, বিদেশি লেখকদের অনুসরণ নয়, পায়ে হেঁটে চাক্ষুস দর্শনের মধ্য দিয়ে হুগলির ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছিল। পুরোনো গ্রন্থগুলির মধ্যে যে ভ্রান্তি ছিল তাকে সরিয়ে সুধীরকুমার মিত্রের হাতে হুগলির ইতিহাস নূতন ভঙ্গিতে লেখা হল। হুগলির জমিদার, রাজা, প্রভৃতি উচ্চবর্গীয় শ্রেণি নয়, নিম্নবর্গের ইতিহাসও রচিত হল।
হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসের চর্চা নিয়ে এই রচনায় মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে এবং অবশ্যই সেটি যৌথ সংস্কৃতি নয় কিন্তু যৌথ সংস্কৃতির উপাদান। সেটি প্রান্তীয় সংস্কৃতি (Marginal Culture)। এই প্রান্তীয় সংস্কৃতির আদিরূপ এবং বিকশিত রূপ দু-টিই সভ্যতার প্রবাহে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ লিখতে গিয়ে সুধীরকুমার মিত্র একটি জেলার ইতিহাসের ভেতরেও প্রান্তিক ইতিহাসচর্চার খোঁজখবর চালিয়েছেন। সুধীরকুমার মিত্রের প্রান্ত থেকে কেন্দ্রীয় ইতিহাসচর্চার আর একটি উদাহরণ তারকেশ্বরের ইতিবৃত্ত। তা ছাড়া হুগলি জেলার দেবদেউলের কথাও স্মরণীয়। ১৯৫৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তারকেশ্বরের ইতিবৃত্ত। এই বইটিতে তারকেশ্বরের দোল উৎসব ও গাজন অংশটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সুধীরকুমার মিত্র কিছু অজানা তথ্য দিয়েছেন এবং ও’ম্যালি সাহেবের বক্তব্য খন্ডন করেছেন। হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাস প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা যায়—সেটি হল ১৯০৪ সালে এইচ. জে. ম্যাকিনডার লিখিত The Geographical pivot of History বইটির কথা। এই বইটির তাৎপর্য অনুসরণ করতে পেরেছিলেন কেউ কেউ। সুধীরকুমারের ইতিহাস লিখনে ভূগোলের স্পষ্ট প্রভাব সেই কথা মনে পড়ায়। হুগলি নদীর ইতিহাস, মানচিত্রের ইতিহাস, মানচিত্রের ব্যবহার, লোককথায় ব্যবহার, ব্রতের ইতিহাস ঘিরে হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকে সুধীরকুমার মিত্র একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যান। যা একটি ‘Model’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে গবেষকদের কাছে। একটি জেলার বিভিন্ন গ্রামের ঘটনা ক্রমান্বয়ে লিখে যাবার ফলে ইতিহাস রক্ষা পেয়েছে। জেমস লঙ ভাগীরথী নদীতীরের ইতিহাস লিখে হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা কতটা ব্যাপক ও ভৌগোলিক হতে পারে তা দেখিয়েছিলেন (দ্রষ্টব্য On the Bank of river Bhagirathi)। ঔপনিবেশিকদের ইতিহাসচর্চায় উপেক্ষিত হয়েছিল প্রান্তীয় সংস্কৃতি। হুগলি এর বাইরে ছিল না। এই ভুল ক্রমশ অপসারিত হতে শুরু করে প্রথমে জেমস লঙ এবং তারপর সুধীরকুমার মিত্রের দ্বারা। এরপর শ্রদ্ধেয় তারাপদ সাঁতরা, দীপকরঞ্জন দাশ, অনন্যদেব মুখোপাধ্যায়, শৈলেন্দুনারায়ণ কুন্ডু (যিনি বাঁশবেড়িয়ার ইতিহাস লিখেছেন) হিতেশরঞ্জন সান্যাল, সৌমিত্রশঙ্কর সেনগুপ্ত, নীহাররঞ্জন রায়, প্রভাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাসচন্দ্র পাল, বিনয় ঘোষ, বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্য প্রমুখ গবেষকদের গবেষণায় হুগলির বিভিন্ন এলাকার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা মূর্ত হয়ে ওঠে। শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভদ্রেশ্বর অঞ্চলের ইতিবৃত্ত, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধায় লিখিত চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রবুদ্ধ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত একটি আলোকপ্রবাহ, উনিশ থেকে একুশ শতক, শ্রীকৃষ্ণগোপাল পাকড়াসী লিখিত তিন-শো বছরের রিষড়ার ইতিহাস, ইন্দ্রাণী রায়ের প্রবন্ধগুলি, হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে নানা বৃত্ত ধরে। সম্প্রতি শুভ্রাংশু রায় চন্দননগরের বিভিন্ন ‘Ward’ ধরে তার অতীত ও বর্তমান ইতিহাস লিখছেন। ডঃ সত্রাজিৎ গোস্বামী এবং তাঁর সহযোগীদের দ্বারা প্রকাশিত সপ্তগ্রাম বিষয়ক জার্নালটিও গুরুত্বপূর্ণ। সৌমিত্রশঙ্কর সেনগুপ্ত শ্রীরামপুরকেন্দ্রিক বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। একেবারে হুগলি জেলার বিষয়ে বা হুগলি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কিছু পত্রিকাও প্রকাশ পাচ্ছে। তার কয়েকটির নাম উল্লেখ করতে গেলে বলতে হয় রবীন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত শ্রীরামপুর-চন্দননগর পৌর নিগমের পত্রিকা পুরশ্রী। সাহিত্য পত্রিকা সাহিত্যসেতুর দ্বারা সম্পাদিত সংকলন হুগলি জেলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, শ্যামলকুমার সিংহ সম্পাদিত প্রসঙ্গ হুগলি-চুঁচূড়া প্রভৃতি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা হুগলি জেলায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় মান বাড়িয়েছে। ড. দীপকরঞ্জন দাস ‘পোর্তুগিজ হুগলির আদিপর্ব’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন শ্যামলকুমার সিংহ সম্পাদিত প্রসঙ্গ হুগলি-চুঁচূড়া’ বলে এবং অনন্তদেব মুখোপাধ্যায় লিখিত ‘পোর্তুগিজ-ওলন্দাজ-দিনেমার কথা’ (প্রকাশিত, হুগলি জেলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাহিতুমেতু পত্রিকা) হুগলি-চুঁচূড়া সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এইসব লেখালেখি সাম্প্রতিক কালের বলা যায়। তবে আজও পোস্ট অফিস, রেলওয়ে প্রভৃতি তথ্য হুগলি জেলার ইতিহাস লিখনে ব্যবহৃত হয়নি। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, যেমন হুগলি জেলা ইতিহাস অনুশীলন কেন্দ্র, ব্যাণ্ডেলের ইতিহাস-সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, ইনস্টিটিউট দ্য চন্দননগর, সবুজের অভিযান, হ্যালো চন্দননগর। গিরিদূত প্রকাশন সংস্থা চন্দননগর ও হুগলির উপর গবেষণামূলকচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে আবার বলা যায় প্রাথমিক পর্যায়ে ঔপনিবেশিক ও প্রশাসনিক লক্ষ্যে হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার শুরু বিদেশিদের হাতে। পরে তা অনুসরণ করেছিলেন বহু বাঙালি ঐতিহাসিক। কিন্তু এরও আগে হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছিল ভ্রমণকারী ও নাবিকদের দ্বারা অথবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদের মাধ্যমে। এই মাধ্যম ছিল ভ্রমণের বিবরণ। প্রথম দিকে তা হুগলি জেলায় নদীপথে উপকূলবর্তী অঞ্চলের ইতিহাস ধরে শুরু হয়। এরপর আসে জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার চাপ। সেই প্রবাহে রচিত হয় অনেকগুলি গ্রন্থ। তারপর সুধীরকুমার মিত্র, বিল্লেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিকদের আগমন যারা নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ সবরকম তথ্যের সমাহার ঘটিয়ে ইতিহাস লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। এরা জেমস লঙ ও হেনরি বেভারিজের চিন্তাধারাকে হুগলি জেলার ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন। ১৮৭৬ সালে হিস্ট্রি অব বাখরগঞ্জ বইটির ভূমিকায় বেভারিজ লিখেছিলেন :
My idea always have been that the proper person to write the history of a district is one who is native of it. Who has lived all his life in it and who has abundance of leisure to collect information. It is only a Bengali who can treat satisfactorily of the production of his country, or of its social condition—its castes, leading families, pecularities of language, customs etc.
সুধীরবাবু ও তাঁর অনুসারী ঐতিহাসিকরা হুগলি জেলায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকে এই জায়গায় আনতে পেরেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র যে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির কথা বলেছিলেন, এবার হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে সেই আত্মবিস্মৃতভাব কেটে গিয়েছিল। এর পরবর্তীকালে অর্থাৎ পঞ্চাশ ও ষাটের দশক পেরিয়ে নব্বই-এর দশক থেকে হুগলির ইতিহাসচর্চায় একটা জোয়ার আসে যেমন ষাটের দশকে দেখা গিয়েছিল। আশীর দশক থেকে হুগলি নদী, সপ্তগ্রাম, সরস্বতী নদী প্রভৃতি নিয়ে গবেষণার যে সম্ভাবনা রচিত হচ্ছিল, নব্বইয়ের দশক থেকে পরপর হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসের উপর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে তার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আরামবাগের ইতিহাস, ভদ্রেশ্বর অঞ্চলের ইতিবৃত্ত, চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রশান্ত ঘোষ লিখিত মসলিন যুদ্ধের ইতিহাস ও সপ্তগ্রাম সভ্যতার ইতিহাস প্রভৃতি প্রকাশিত হতে হতে আজ হুগলি জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা একবিংশ শতাব্দীতে এসে আরও প্রসারলাভ করেছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত এবং প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের ইতিহাসচর্চা চলছে তবে হুগলির ধর্ম ও সমাজবিন্যাস, আর্থ সামাজিক বিকাশের ধারা, জনস্বাস্থ্য, নারী, সংগীত, লোকসংস্কৃতি, বিপ্লবী আন্দোলন, সংস্কৃতির সমন্বয় প্রভৃতি নিয়ে বিছিন্ন প্রবন্ধ চোখে পড়লেও, পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এখনও অনুপস্থিত। এখানে হুগলির আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।