প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হাওড়া – শিবেন্দু মান্না

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হাওড়া – শিবেন্দু মান্না

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার সূচনাকালে কিংবা তার পরবর্তীকালেও, যাঁরা বিষয়টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে থেকেছেন, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন পেশার মানুষজন দেখতে পাওয়া গেছে। স্থানীয় কোনো ইতিহাস-মনস্ক মানুষ, বিদ্যালয়-শিক্ষক, আদালতের উকিল-মোক্তাররাই বোধহয় এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হবেন। বলা বাহুল্য, এঁরা প্রায় সকলেই হলেন ‘অপেশাদার ঐতিহাসিক’, অর্থাৎ ‘নন-অ্যাকাডেমিক’ ব্যক্তি। ফলে, এঁরা এঁদের জ্ঞান-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা এবং পড়াশোনার ভিত্তিতে স্থানীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের খোঁজ-সন্ধান করে, সেই কথাগুলিই বিবৃত করেছেন—এঁদের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ, যত অকৃত্রিম হোক-না-কেন, ‘অ্যাকাডেমিসিয়ান’রা প্রায়শ এঁদের অবজ্ঞা করেন, ‘অ্যাকাডেমিক’ জগতে এঁদের কোনো স্থান নেই বললেই চলে। তথাপি এই কথাটি পুনর্বার বলতেই হচ্ছে যে, এই ধরনের আঞ্চলিক ইতিহাসবেত্তাগণ যতই কেন শিক্ষাবিদরা উপেক্ষিত, গবেষক-অনাদৃত এবং প্রকাশক পরিত্যক্ত হোন, বাংলার ‘ইতিহাস-পটকথা’-য় এঁদের একটা স্থান আছেই।

এই প্রসঙ্গ কথার ভিত্তিতেই আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় হাওড়া জেলার স্থান বিষয়ে আলোকপাত করার উদ্যোগ গ্রহণ।

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হাওড়ার পটভূমিকায়

খ্রিস্টীয় উনিশ শতকের প্রারম্ভ ভাগ অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ ১৮০১-০২ সন থেকে শুরু করে মোটামুটিভাবে খ্রিস্টাব্দ ১৯৫০ সন পর্যন্ত দেড়শো বছরের সময়সীমাকে, আলোচনার সুবিধার্থে আমরা কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নিতে পারি। যেমন, খ্রিস্টাব্দ ১৮০১-০২ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৮৫০ সন পর্যন্ত প্রথম পর্ব; খ্রিস্টাব্দ ১৮৫১ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৮৭৫ সন পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব; খ্রিস্টাব্দ ১৮৭৬ সন থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৯০০ সন পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব এবং খ্রিস্টাব্দ ১৯০১ সন থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৯২৫ সন পর্যন্ত চতুর্থ পর্ব; আর খ্রিস্টাব্দ ১৯২৬ সন থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৯৪৭-৫০ সন পর্যন্ত পঞ্চম পর্ব। এরপর ষষ্ঠ পর্ব। এই কয়টি পর্বে সমগ্র বাংলার (অখন্ড বঙ্গ-সহ) বিভিন্ন জেলায় বা অঞ্চলে একইভাবে আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থাদি রচিত হয়নি। সত্যি কথা বলতে কী, প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাবৃত্ত-কথা, সমাজ ও ইতিহাসের দিক থেকে বাংলার বিভিন্ন জেলার মধ্যে কোনোপ্রকার সমতা নেই, আর বাস্তবে তা থাকা সম্ভবও নয়; সুতরাং হেরফের হওয়া, বিশেষত মানদন্ডের দিক থেকে খুবই স্বাভাবিক এবং এই কারণেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নথি-পুথি, দলিল দস্তাবেজ, লোকশ্রুতি ও বৃদ্ধদের স্মৃতিকথা আশ্রিত আঞ্চলিক ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোর পড়েছে সরেজমিন ক্ষেত্রসমীক্ষার উপর, এবং এটা সঠিক যে, চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা অর্জন ও নথি-পুথি-দস্তাবেজ প্রভৃতির ‘যুগলমিলন’—এই জুটির কোনো তুলনাই হয় না। একজন আঞ্চলিক ইতিহাস রচয়িতাকে বহু বিষয় জানতে হয়, বহু বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে হয়। রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে ‘এই জানার কাজটি উত্তেজনার কাজ নয়, অভিনিবেশের কাজ। এতে মাদকতা নেই, সাধনা আছে। এই জন্য এই কাজ কঠিন।’

জেলাটির জন্মের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টীয় ১৭৬৯ সনে, তা কিছু পরিমাণে রূপলাভ করেছিল ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে, যখন বর্ধমান জেলা থেকে পৃথক করে হুগলি ও হাওড়াকে একত্রিত করে জেলা হুগলির সৃষ্টি করা হয়েছিল, তার পরবর্তী স্তরের সূচনা খ্রিস্টাব্দ ১৮৪৩ সনে, আর সর্বশেষ ধাপটি হল ১ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সনে, যেদিন থেকে হাওড়া জেলার জন্য স্বতন্ত্র কালেক্টরেট বিভাগ, পুলিশ, আদালত, প্রশাসন প্রভৃতির সূচনা হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ধারা আলোচ্য জেলায় খুব একটা কার্যকর রূপগ্রহণ করেনি বটে, কিন্তু খন্ড-বিখন্ড ও বিচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা একটা ছিলই। এই কারণে, আঞ্চলিক ইতিহাসের নিরিখে জেলা হাওড়ার পূর্ব ইতিহাস কিছু বলতেই হয়। খ্রিস্টীয় ১৭১৩ সনে দিল্লিতে মোঘল সম্রাট ফারুকসিয়র (খ্রিস্টাব্দ ১৭১৩-১৯)-এর সিংহাসন আরোহণ কালে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল কাউন্সিল হুগলি-ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরবর্তী, বোরো পাইকান পরগণার পাঁচটি মৌজা যথাক্রমে সালিকা, হাড়িড়া, কাসুনদিহ, রামকৃষ্ণপুর এবং বাট্টের—এর পত্তনী প্রার্থনা করেছিল নিম্নোক্তরূপ বার্ষিক খাজনার বিনিময়ে—

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : হাওড়া

আইন-ঈ-আকবরী গ্রন্থেও এই ধরনের তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। সেকালে ‘বাট্টের’ (অধুনাকালের বেতড় অঞ্চল)-এর অবস্থান ছিল হুগলি-ভাগীরথী ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে; আদতে এটি ছিল সরস্বতী নদী তীরবর্তী বিখ্যাত বন্দর ‘সাত গাঁ’ অর্থাৎ নৌ-বন্দর সপ্তগ্রাম-এর প্রবেশদ্বার (গেটওয়ে অব সপ্তগ্রাম), তাই মোগল আমলে বাট্টের বা বেতড়-বন্দরের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। এই প্রকার ঘটনার ভিত্তিতে বলা চলে, অস্ফুটভাবে হলেও হাওড়া জেলান্তর্গত কোনো কোনো স্থানের নামোল্লেখ ও ইতিহাসের এক একটা টুকরোর সন্ধান এইভাবেই পাওয়া যায়। এর আগে-পরের পর্যায়টিও প্রায় একই প্রকার। বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে (খ্রিস্টাব্দ ১৪৯৫ সন) পাওয়া যায় বেতড়ের উল্লেখ। যথা—‘বেতড় চাপায় ডিঙ্গা চাঁদ মহারথা’; আবার কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে (আনুমানিক খ্রিস্টাব্দ ১৫৩৯-১৫৯৪) বেতড়ের উল্লেখ করেছেন এইভাবে—‘বেতড়ে চন্ডীপূজা কৈল সাবধানে। সমস্ত গ্রামখানা সাধু এড়াইল বামে।।’—অর্থাৎ বণিক চাঁদ সদাগর বেতড়ে চন্ডীপূজা সমাপন করেছিলেন। ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে (খ্রিস্টাব্দ ১৫৬৭ সন) সিজার ফ্রেডারিক নামের এক ভেনিসীয় বণিক বেতড় বন্দরের উল্লেখ করেছেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই।

এ ছাড়া, ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত ভ্যানডেন ব্রুকের মানচিত্র, ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে অঙ্কিত ভ্যালেনটাইনের মানচিত্রে কিংবা ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত স্ট্রেনশ্যাম মাস্টারের ডায়েরি সূত্রে, হুগলি-ভাগীরথী নদীর পশ্চিমতীরে অবস্থিত ‘তান্না দুর্গ’ (থানা মাকুয়া) প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য মোগল আমলের বহুপূর্বে, সেনরাজ লক্ষ্মণ সেন-এর আমলে (খ্রিস্টাব্দ ১১৮৫-১২০৬) সম্পাদিত গোবিন্দপুর তাম্রশাসনে পশ্চিম খাটিকার মধ্যে বেতড্ড চতুরক-এর অবস্থান উল্লিখিত হয়েছে। তবে এসবই হল ইতিহাসের টুকরো কথা—ইতিহাসের খন্ডচিত্র, আধুনিক ধারায় পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা প্রথম পরিলক্ষিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় ১৮৭২ সনে।

চন্দ্রনাথ ব্যানার্জি (ওরফে সি. এন. ব্যানার্জি) রচিত অ্যান অ্যাকাউন্ট অব হাওড়া পাস্ট অ্যাণ্ড প্রেজেন্ট নামীয় গ্রন্থখানিই আঞ্চলিক ইতিহাস জগতে, জেলা হাওড়ার প্রথম পদক্ষেপ এবং উল্লেখযোগ্যভাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, হাওড়া জেলাকেন্দ্রিক বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা, গ্রন্থখানির মধ্যে লভ্য। বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে—প্রাকৃতিক ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিচয় (নদীনালা-খালবিল, চাষাবাদ ইত্যাদির বিস্তৃত পরিচয়-সহ), জেলা গঠনের প্রথম পর্যায়ের ইতিহাস, জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ইতিহাস, জেলার বিচার বিভাগের পরিচয়, ভূমিরাজস্ব আদায়ের ইতিবৃত্ত, উল্লেখযোগ্য প্রধান প্রধান সড়কপথ, অধিবাসীদের পরিচয়, মেলা ও পূজা-পার্বণের পরিচয়, উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষালয় প্রভৃতির বর্ণনা, খ্রিস্টীয় উপাসনালয় ও সমাধিক্ষেত্রগুলির পরিচয় এবং ইউরোপীয় ধাঁচের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, দেশীয় রঙ্গালয়, ব্রাহ্মসমাজ ইত্যাদি ব্যতিরেকে তৎকালীন হাওড়ার পোতাশ্রয় ও জাহাজ সারাই কারখানা (মাড ডক), হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রকারের চিকিৎসালয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও হাটবাজার প্রভৃতি নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তবে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বলতে হবে, সি. এন. ব্যানার্জি তাঁর গ্রন্থে যতটা পরিমাণে শহর হাওড়াকে স্থান দিয়েছেন, হাওড়া জেলার গ্রামাঞ্চল ততটা গুরুত্ব পায়নি।

এরপর উল্লেখ করতে হয়, এল. এস. এস. ও’ ম্যালি এবং মনোমোহন চক্রবর্তী সম্পাদিত, খ্রি. ১৯০৯ সনে প্রকাশিত, বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স : হাওড়া শীর্ষক সরকারি প্রকাশনটির। প্রকৃতপক্ষে, হাওড়া জেলার ক্ষেত্রে বিষয়কেন্দ্রিক প্রকাশনার মধ্যে, সরকারি গ্রন্থগুলিই, অন্তত খ্রিস্টাব্দ ১৯৫০ সন পর্যন্ত তো বটেই, তার পরবর্তীকালেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। এ প্রসঙ্গে খ্রিস্টাব্দ ১৯১৩ সনে প্রকাশিত, বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স সিরিজের অন্তর্গত হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট (বি. ভল্যুম)—স্ট্যাটিসস্টিকস : ১৯০০-১৯০১ টু ১৯১০-১৯১১ ছাড়াও খ্রিস্টাব্দ ১৯৫০ এবং খ্রিস্টাব্দ ১৯৬০ সনের হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক দু-টির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। হাওড়া জেলার সার্বিক পরিচয়, গ্রন্থ কয়খানির মধ্যে লভ্য। এ ছাড়া খ্রিস্টাব্দ ১৯৭২ সনে প্রকাশিত, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স : হাওড়া গ্রন্থখানিতে পরিশিষ্ট-সহ মোট সতেরোটি অধ্যায়ে জেলা হাওড়ার বিস্তৃত পরিচয় বিধৃত হয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে, জেলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত প্রয়াস বা উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হতে থাকে। এখানে সংক্ষিপ্তাকারে তার একটি তালিকা পেশ করা গেল;—সামগ্রিকভাবে জেলা পরিচয়-যুক্ত গ্রন্থাদির নামের তালিকাটি এইরূপ :

 হুগলি ও হাওড়া জেলার ইতিহাস : বিধুভূষণ ভট্টাচার্য; ১৯৫২ খ্রি.

 হাওড়া জেলার লোক উৎসব : তারাপদ সাঁতরা, ১৯৬২ খ্রি.

 হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি : তারাপদ সাঁতরা, ১৯৭৬ খ্রি.

 (এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ)

 পাঁচশো বছরের হাওড়া : হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯২ খ্রি.

 হাওড়া জেলার ইতিহাস (২ খন্ড) : অচল ভট্টাচার্য

 (১ম খন্ড-১৯৮০ খ্রি.; ২য় খন্ড-১৯৮২ খ্রি.)

 হাওড়া ইন পারসপেকটিভ : ড. কল্যাণকুমার গাঙ্গুলি, ১৯৮৩ খ্রি.

 লোকসংস্কৃতির আলোকে হাওড়া : ড. পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য, ১৯৯৩ খ্রি.

 হাওড়া জেলার ইতিহাস : হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৯ খ্রি.

 হাওড়া জেলা গঠনের ইতিহাস : শৈবালকান্তি রক্ষিত, ১৯৯৯ খ্রি.

স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়া জেলা : দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী, ১৯৯৯ খ্রি.

 হাওড়া : তারাপদ সাঁতরা, ২০০০ খ্রি.

 হাওড়া জেলা পরিক্রমা (১ম খন্ড) : হাওড়া জেলা পরিষদ এবং হাওড়া জেলা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ২০০৩ খ্রি.

 হাওড়া জেলায় তে-ভাগা আন্দোলন : দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী, ২০০৪ খ্রি.

করাঙ্গুলি গণনীয়, এই কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থে হাওড়া জেলার কতক কতক পরিচয় বিধৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি কয়েকখানি পুস্তক-পুস্তিকা মধ্যে হাওড়া জেলার কোনো কোনো অংশের পরিচয় গাঁথা হয়ে আছে; সেগুলির মধ্যে উল্লেখ্য এবং স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে প্রকাশিত—

 সংক্ষিপ্ত পল্লিচিত্র : যোগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ১৯১৩ খ্রি. (১৩২০ ব.)

 খড়ি-অপ বার্তা : হরিদাস কাব্য স্মৃতিতীর্থ, ১৯১৪ খ্রি.

 শিবপুর-কাহিনি : অন্নদাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ১৯১৯ খ্রি.

 বালীর ইতিহাসের ভূমিকা : প্রভাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৩৬ খ্রি.

 স্মৃতির অর্ঘ্য : বসন্তকুমার পাল, ১৯৪০ খ্রি.

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রকাশিত অনুরূপ গ্রন্থাদির মধ্যে রয়েছে—

 মাজুগ্রামের ইতিকথা : জীবনহরি ঘোষাল, ১৯৭৪ খ্রি.

 শালিখার ইতিবৃত্ত : হেমেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮২ খ্রি.

 বালীগ্রামের ইতিহাস : নলিনচন্দ্র মিশ্র, ১৯৮৩ খ্রি.

 শতাব্দীর পরিক্রমায় বালীগ্রামের ইতিকথা : সীতাংশুমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮৮ খ্রি.

 উলুবেড়ের আদিপর্ব : তারাপদ সাঁতরা, ১৯৯৬ খ্রি.

 আমতার ইতিহাস ও সংস্কৃতি : তপন মন্ডল (সম্পাদিত), ১৯৯৯ খ্রি.

 জগৎবল্লভপুর জনপদকথা : শিবেন্দু মান্না, ২০০০ খ্রি.

 জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম (বাগনান থানা ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চল) : বিমলকৃষ্ণ পাল (সম্পাদিত), ১৯৭২ খ্রি.।

এই পুস্তক-পুস্তিকাগুলি ব্যতিরেকে আরও কয়েকটি প্রকাশনার কথা উল্লেখ করা দরকার, যেগুলির মধ্যে হাওড়া শহরাঞ্চলের ইতিহাস গ্রন্থিত হয়েছে। যথা—

 হাওড়া সিভিক কম্প্যানিয়ন (২ খন্ড) : সম্পাদনা—জিতেন্দ্রিয় ব্যানার্জি, ১৯৫৫ খ্রি.; (প্রকাশক—হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটি।)

 হাওড়া শহর কত পুরাতন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ : ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯০ খ্রি.

 নগর হাওড়া : ড. অলোককুমার মুখোপাধ্যায়, ১৯৯০ খ্রি.

 হাওড়া : এ স্টাডি ইন আরবানাইজেশন—ড. অলোককুমার মুখোপাধ্যায়, ১৯৯২ খ্রি.

 হাওড়া শহরের ইতিবৃত্ত (২ খন্ড) : ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, (১ম খন্ড—১৯৯৪ খ্রি., ২য় খন্ড—১৯৯৫ খ্রি.

জেলার বিশিষ্ট পরিবারগুলির পরিচয়মূলক ইতিহাস কয়েকটি পুস্তক-পুস্তিকা সূত্রে পাওয়া যায়। যথা—

 বাঙ্গলার পারিবারিক ইতিহাস (৩য় খন্ড) : শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী, ১৯৩৭ খ্রি.

 রামকৃষ্ণ রায় ও রসপুর রায় বংশের কথা : পাঁচুগোপাল রায়, ১৯৬৪ খ্রি.

 হাওড়া রামকৃষ্ণপুর দত্ত পরিবার ও বঙ্কিমচন্দ্র দত্ত : গুরুপ্রসাদ দত্ত, ১৯৯৬ খ্রি.

 হাওড়া মহিয়াড়ীর কুন্ডু চৌধুরি পরিবারের পারিবারিক ইতিহাস : অনুপম মুখোপাধ্যায়, ২০০২ খ্রি.।

তালিকানিবদ্ধ গ্রন্থগুলি ব্যতিরেকে আরও কিছু কিছু সরকারি প্রতিবেদন এবং ব্যক্তিগত প্রয়াসের কথাও এখানে উল্লেখ করা দরকার। যেমন—

 সার্ভে অব ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট (ভল্যুম-২) : সি. এম. পি. ও.

 ফাইন্যাল রিপোর্ট অন দ্য সার্ভে অ্যাণ্ড সেটলমেন্ট অপারেশনস ইন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব হাওড়া (খ্রি. ১৯৩৪-৩৯) : আর. সি. সেন অ্যাণ্ড এস. চ্যাটার্জি, ১৯৪০ খ্রি.

 এ সামারি অব দ্য চেঞ্জেস ইন দ্য জুরিসডিকশন অব ডিস্টি=ক্টস ইন বেঙ্গল (১৭৫৭-১৯১৬) : মনোমোহন চক্রবর্তী, ১৯১৮ খ্রি. (পুনর্মুদ্রণ : ১৯৯৯ খ্রি., সম্পাদনা-কুমুদরঞ্জন বিশ্বাস, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স)

 ইতিহাসের আলোকে গ্রাম-জনপদ : তারাপদ সাঁতরা, ১৪০৮ বঙ্গাব্দ

 মহিষগোট ভিলেজ সার্ভে ১৯৬৭ খ্রি. : ড. জি. মন্ডল, ও এন. ব্যানার্জী

 স্বাধীনতা-সংগ্রাম শতবার্ষিকী : গ্রামসেবা সংঘ, মুগকল্যাণ, হাওড়া :

 হাওড়া জেলা পরিষদ শতবর্ষপূর্তি স্বরণিকা, ১৯৮৬ খ্রি.

 বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন, দ্বাদশ অধিবেশন : দুর্গাদাস লাহিড়ী, ১৯২০ খ্রি.

 লেট মিডিভ্যাল টেম্পলস অব বেঙ্গল : ডেভিড ম্যাককাচ্চন, ১৯৭২ খ্রি.

 বাঙ্গলার সারস্বত অবদান (১ম খন্ড) : দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ১৩৫৮ ব.

 ছোটোদের হাওড়া : চারুচন্দ্র পাল ও রাজেন্দ্রলাল সোম।

এ সকল গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটিতে পশ্চিমবঙ্গের অপরাপর জেলার তথ্যাদি পরিবেশনের পাশাপাশি জেলা হাওড়ার তথ্যাদিও বিবৃত হয়েছে।

আলোচ্যক্ষেত্রে বলা বাহুল্য, শৈবালকান্তি রক্ষিত সম্পাদিত তথ্য অনুসন্ধান সংবাদ সাময়িক পত্রে, বিগত ১৫.০২.২০০২ থেকে ০১.০২.২০০৩ তারিখের মধ্যে মোট দশটি কিস্তিতে অন্যূন ১২৫টি হাওড়া জেলার ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থাদির নামোল্লেখ ও পরিচয় বিবৃত করেছি, সেই তালিকা এখানে পুনঃপ্রকাশ করা সম্ভব নয়, তবে পূর্বোধৃত তালিকা মধ্যস্থ কোনো কোনো গ্রন্থ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে।

বিধুভূষণ ভট্টাচার্য প্রণীত হুগলি ও হাওড়া জেলার ইতিহাস গ্রন্থখানিতে বিধৃত অধ্যায়গুলি এইপ্রকার—

প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় : হুগলি, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় : হাওড়া, শিরোনামযুক্ত হলেও আদতে জেলার প্রাকৃতিক পরিচয় বর্ণিত হয়েছে; পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায় দু-টির শিরোনাম যথাক্রমে ‘হিন্দুযুগ’ এবং ‘বৌদ্ধযুগ’; সপ্তম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘হিন্দুযুগ-অনুবর্তন’ এবং ‘শশাঙ্কদেব’; অষ্টম অধ্যায়—‘রাষ্ট্রীয় সংহতিভেদ ও মাৎস্যন্যায়’; নবম অধ্যায় ‘কুলশাস্ত্রমতে আদিশূর প্রসঙ্গ, … আদিশূর তত্ত্ব ও ব্রাহ্মণ, পালরাজগণের শাসনে নবযুগ; এবং দশম অধ্যায় ‘সেন রাজবংশ : বিজয় সেন, বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন’।

এখানে প্রকৃতপক্ষে শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে বিধুভূষণ ভট্টাচার্য কতক পরিমাণে ইতিহাস এবং কতক পরিমাণে লোকশ্রুতি-নির্ভর হয়ে পড়েছেন; এই জাতীয় অধ্যায় বিভাগ যেমন আধুনিক চিন্তাসম্মত নয়, তেমনি আনুপূর্বিক বর্ণনাও বহুল পরিমাণে ইতিহাসের সত্য-তথ্যভিত্তিক নয়। কিন্তু এই প্রকারে হাওড়া জেলার প্রাচীনত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টাও অপর কোনো গ্রন্থমধ্যে বিশেষ দেখা যায় না। এই প্রসঙ্গে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে বলতে বাধ্য যে, হাওড়া জেলার যথাযথ পরিচয়, পূর্ণাঙ্গরূপে বিবৃত হয়েছে, এমন কোনো গ্রন্থ বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত রচিত বা প্রকাশিত হয়নি, যদিও বহু গ্রন্থেই জেলার ইতিহাস শিরোনাম দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছেই। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, অঞ্চল বিশেষের ইতিহাস রচনা করতে হলে, কোন পদ্ধতি সাধারণভাবে অবলম্বন করা উচিত?—এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, ড. কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায় রচিত হাওড়া ইন পারসপেকটিভ : ট্রাডিশন অ্যাণ্ড কালচার গ্রন্থখানি প্রসঙ্গে ড. গৌতম সেনগুপ্ত (বর্তমান অধিকর্তা, প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার)-এর বক্তব্য অনুধাবনীয়—‘‘ইতিহাসচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক পরিমন্ডলের বাইরে যে সজীব, অপেশাদারী ধারাটি আজও প্রবহমান, কল্যাণকুমার তাকে পরম মমতায় লালন করেছেন আজীবন। আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন অনেককেই। নিজেও লিখেছেন হাওড়া জেলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে একটি পুস্তিকা, হাওড়া ইন পারসপেকটিভ (বাগনান, ১৯৮৩)। নিজস্ব শৈলীতে হাওড়া জেলার ইতিহাস আলোচনায় এসে পড়ে রাঢ়দেশের কথা, বর্ধমানভুক্তি আর কর্ণসুবর্ণনগর প্রসঙ্গ, কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক অথবা সেনযুগের তাম্রপট্টোলীতে বেতড্ড-চতুরকের কথা।

আঞ্চলিক বা স্থানিক ইতিহাস রচনার পদ্ধতি বা গঠন কীরকম হবে, এ প্রশ্ন বাঙালি ঐতিহাসিক ও পাঠক সমাজকে ভাবিত করেছে বিভিন্ন সময়ে। হাওড়া জেলা বিষয়ক পুস্তিকাটিতে কল্যাণকুমার তাঁর অভীষ্ট ছকটি উপস্থাপন করেছেন। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে বাংলার ইতিহাস, বাংলার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একটি বিশেষ অঞ্চল।

—এই সূত্রে আমার ধারণা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ‘বাগীশ্বরী অধ্যাপক’ ড. কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণ-কথাপ্রসঙ্গে একটি অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় ব্যাখ্যাত হয়েছে (উৎস : পুরাবৃত্ত-১, কলকাতা, মে, ২০০০)। (বাঁকা হরফ বর্তমান প্রবন্ধকারকৃত, বক্তব্যের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।)

হাওড়া জেলাকে বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বা উপায়ে দেখেছেন আঞ্চলিক ইতিহাসবেত্তা তারাপদ সাঁতরা; এই বিষয়টি, তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই ধরা পড়ে যায়। তথাপি, তারাপদবাবু হাওড়া জেলার সামগ্রিক ইতিহাস রচনায় কেন যে ব্রতী হননি, তা আমার কাছে দারুণ রহস্যজনক মনে হয়। জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে হাওড়া নামীয় পুস্তকখানি রচনা করেছিলেন, এবং বহুলাংশে জেলার ইতিহাস রচনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ছক তিনি উপস্থাপন করেছিলেন। এই গ্রন্থটি মুষ্টিভিক্ষা হলেও স্বর্ণমুষ্টি-সমতুল, কারণ এই ধারা অনুসরণ করে জেলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা সম্ভব।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অধ্যাপক ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত হাওড়া শহরের ইতিবৃত্ত (২য় খন্ড) গ্রন্থমধ্যে ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু, হাওড়া শহরের বিবর্তন, নব্যশিক্ষা, গ্রন্থাগার, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বিভিন্ন পাড়া-পরিচয়, রাজনৈতিক আন্দোলন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন প্রভৃতি আলোচিত হওয়ায়, অনেকটা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছে। কিন্তু ‘শহর হাওড়া’র বহির্ভূত মনে ভেবে নেওয়ার জন্য বেলুড় ও বালী অঞ্চলের কথা কিছুমাত্র লেখা হয়নি। এই খন্ড-দৃষ্টির দরুন গ্রন্থখানি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

হাওড়া জেলার পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন এবং আধুনিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা তথা শিক্ষা-আন্দোলন এবং গ্রন্থাগার আন্দোলন নিয়ে মাত্র দু-খানি পুস্তিকার কথা জানা আছে। এই দু-খানি মূল্যবান পুস্তিকার লেখক হলেন বিদ্যালয়-করণিক শৈবালকান্তি রক্ষিত। পুস্তিকা দু-টির নাম হল—হাওড়া জেলায় ইংরাজি শিক্ষার ইতিহাস (১৯৯৫ খ্রি.), এবং ‘উনবিংশ শতাব্দীতে হাওড়া জেলায় গ্রন্থাগারের সূচনা (১৯৯৫ খ্রি.)। অথচ শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যালয় এবং গ্রন্থাগার, দুই মিলিয়ে হাওড়া জেলায় রয়েছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান।—এদের ‘ইতিহাস’ লেখার কোনো উদ্যোগ তো নজরে পড়ে না। সমাজ গঠনে এদের ভূমিকার কোনো মূল্যায়ন হয়নি।

‘বটতলার পুঁথি’ অথবা ‘বটতলার বই’ বাংলা সাহিত্য ধারার ইতিহাসে একটি স্থান যে অধিকার করে আছে, এটা নিঃসন্দেহ ঘটনা। একটি হিসাব অনুসারে জানা গেছে, সাড়ে চার হাজার-এর অধিক ‘বটতলার বই’ প্রকাশিত হয়েছিল, যার এক উল্লেখযোগ্য অংশেরই রচয়িতাগণ ছিলেন বর্তমানকালের হাওড়া জেলার অধিবাসী। এঁদের বিষয়ে বিশদভাবে তথ্য অনুসন্ধান কখনো করা হয়নি বলেই জানি। মাত্র কয়েকজনের নাম উদ্ধার করা গেলেও অধিকাংশটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন।

এ-যাবৎ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া ‘বটতলার বই’ ও তার হাওড়াবাসী লেখকদের ‘নামাবলি’ এখানে বর্ণিত হল, এই কারণে যে, আঞ্চলিক ইতিহাসবৃত্তে, বিশেষত হাওড়া জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে এঁরা উপেক্ষনীয় নন—

বটতলার বই এবং তার হাওড়াবাসী লেখকদের নাম-তালিকা দেখে অনেকের নাসিকাকুঞ্চন হতে পারে, তবে এটাও জেনে রাখা ভালো যে, বাংলা বইয়ের মুদ্রণ ও বাণিজ্যিক সফলতা, উনিশ শতকে ‘বটতলার বই’-এর মারফতই শুরু হয়েছিল, সেই ক্ষেত্রে হাওড়া জেলাবাসী মানুষজনের ‘পাঞ্জা-ছাপ’ রয়ে গেছে সমগ্র বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতে। আজ কে এসবের সন্ধান করে?

কথায় কথায় পুথি যায় বেড়ে। হাওড়া জেলার দেবালয়গুলি (মঠ-মন্দির-মসজিদ) সম্পর্কিত ইতিহাস একটি মাত্র গ্রন্থে সুচারুভাবে বিধৃত আছে। সেটি হল, তারাপদ সাঁতরা গ্রন্থিত হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি (প্রকাশ সন খ্রি. ১৯৭৬), অথচ খ্রি. ১৯০৯ সনে প্রকাশিত হাওড়া জেলা গেজেটিয়ার গ্রন্থে মন্তব্য করা হয়েছিল।

No old remains have yet been found in this district, probably because the rivers have changed their courses so much, that ancient sites, if any, have been washed away.

—এই বিরূপ মন্তব্য খন্ডন করেছেন তারাপদ সাঁতরা। ওই গ্রন্থখানি প্রকাশের পর বিগত পঁচিশ-ত্রিশ বছরে, আরও কিছু পরিমাণ প্রত্নবস্তু ও পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলি নথিবদ্ধ ও আলোচিত হওয়া দরকার। তারাপদবাবু তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থমধ্যে প্রায় আশিটি পুরাকীর্তি-র পরিচয় বিবৃত করে গেছেন, কিন্তু তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণকারী কোথায়?

শেষের কথা

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার জগতে, বিগত শতাধিক বৎসরের সময় সীমার মধ্যে, হাওড়া জেলার অবস্থান, উদ্যোগ এবং আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের কথা বলা গেল। আক্ষেপ এই যে, শিক্ষিত জনমানসে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা অত্যন্ত সীমিত; বহু বর্ধিষ্ণু ও ইতিহাসসমৃদ্ধ গ্রাম-জনপদের ইতিহাস এখনও লিখিত হয়নি; উপরন্তু গোলোকায়ন ও বিস্মৃতির ঝোড়ো হাওয়ার প্রভাবে এবং ইতিহাস মনস্কতার অভাবে প্রাচীন ইতিবৃত্ত যেন জীর্ণ বল্কল,—জীর্ণপত্রের মতন মাটিতে শেষ আশ্রয় নিচ্ছে, আর ‘জননী জন্মভূমি’ অনাদরে, অবহেলায় সীতার মতো পাতাল প্রবেশ করছে, নিদারুণ লজ্জায় মুখ ঢাকা দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *