প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : মুর্শিদাবাদ – প্রকাশদাস বিশ্বাস

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : মুর্শিদাবাদ – প্রকাশদাস বিশ্বাস

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ধারায় মুর্শিদাবাদচর্চার একটা আলাদা গুরত্ব আছে। কেউ কেউ তো বলেইছেন মধ্যযুগে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসই বাংলার ইতিহাস। সে-দিক থেকে দেখতে গেলে বাংলার সমস্ত ইতিহাসকেই মুর্শিদাবাদচর্চার ফসল হিসাবে গণ্য করা উচিত। তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেগুলিকে আলোচনায় আনব না।

বাংলা ভাষায় মুর্শিদাবাদচর্চার প্রথম নিদর্শন শ্যামধন মুখোপাধ্যায়ের মুরশিদাবাদের ইতিহাস। অবশ্য এর আগে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে রেভিনিউ সার্ভেয়ার জে. ই. গ্যাস্ট্রেলের মুর্শিদাবাদের পরিসংখ্যান ও ভূগোল সংক্রান্ত বিবরণী।

মুর্শিদাবাদচর্চার প্রথম উদ্যোগ হিসাবে শ্যামধনের বইয়ের গুরুত্ব অসীম হলেও ক্ষীণতনু এই বইটি কোনোমতেই মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস নয়, এটি আসলে মুর্শিদাবাদ নগরী ও মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের ইতিহাস। গ্যাস্ট্রেলের বিবরণী থেকে আহরিত তথ্যাদি এই বইয়ে ব্যবহৃত হলেও তা দিয়ে এই বইকে জেলাচর্চার অভিজ্ঞান হিসাবে গণ্য করা সমীচিন নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর সাতের দশকেই প্রকাশিত হতে থাকে ডব্লু. ডব্লু. হান্টারের স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট-এর খন্ডগুলি। এর নবম খন্ডে প্রকাশিত হয় মুর্শিদাবাদ ও পাবনা জেলার ইতিহাস (১৮৭৬)। সরকার স্বীকৃত পরিসংখ্যান-এর সহজলভ্যতা আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকে যে কিছুটা সহজসাধ্য করে তোলে তা বলাই বাহুল্য মাত্র। ওই শতাব্দীর শেষের দিকে বহরমপুরে বহিরাগত বিদ্বজ্জন সমাবেশ ও বঙ্গদর্শনের যাত্রারম্ভ স্থানীয় শিক্ষিত ভদ্রসমাজকে জেলার ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এ বিষয়ে নানা দিক থেকে নানা ব্যক্তিগত উদ্যোগও আসতে থাকে। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের দেওয়ান খন্দেকার ফজলে রব্বী ফারসি ভাষায় মুর্শিদাবাদের ইতিহাস রচনার উদ্যোগ নেন। শম্ভুচরণ মুখোপাধ্যায় নামে আরেক উদ্যোগীও জেলার ইতিহাস রচনার জন্য বেশ কিছু উপকরণ সংগ্রহ করেন। মুর্শিদাবাদ নগরীর ইছাগঞ্জের বাসিন্দা আনন্দচন্দ্র ঘোষ এবং কৈলাশ রায় নামে দু-জন ইতিহাস অনুসন্ধানী মুর্শিদাবাদের ইতিহাস রচনার কাজে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৮৮২ সালে তাঁরা তাঁদের পরিকল্পিত ইতিহাস রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। শুধু নবাব পরিবারই নয় তারা জেলার বহু প্রাচীন রাজবাড়ি ও জমিদারবাড়ি থেকে বহু মূল্যবান উপকরণ, দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ করেন। বই লেখা শেষ হলেও তা প্রকাশের আগেই আনন্দচন্দ্রের মৃত্যু হওয়ায় এ বই প্রকাশিত হয়নি।

এইসব ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সংঘটিত উদ্যোগও ছিল। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট (না সেপ্টেম্বর?) মাসে মুর্শিদাবাদের শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত সমাজের উদ্যোগে ও ডি. জন বেটন সাহেবের বিশেষ উৎসাহে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস রচনার জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মুর্শিদাবাদের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দীনবন্ধু সান্যালও এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। মূলত তাঁর পরিকল্পিত ইতিহাস রচনার রূপরেখা অঙ্কনের জন্যই এই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভা বিষয়ে ১৮৮৭-এর ১৬ সেপ্টেম্বর স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে বিস্তারিত বিবরণ মেলে। দীনবন্ধুবাবু এই ইতিহাস রচনার কাজে অনেকদূর অগ্রসর হলেও বইটি শেষপর্যন্ত মুদ্রিত হয়নি। তবে দীনবন্ধুবাবুর বই প্রকাশিত না হলেও আরও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে জেলার ইতিহাস রচনায় উদ্যোগী হন এবং এ-রকমই ব্যক্তিউদ্যোগের ফসল হল নিখিলনাথ রায়ের মুর্শিদাবাদ কাহিনী (১৩০৪) এবং কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙ্গালার ইতিহাস (নবাবী আমল) (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ)। মুর্শিদাবাদ কাহিনী অনেকগুলো ছোটো বড়ো প্রবন্ধের সংকলন। এ বই প্রকাশিত হয়েছিল বহরমপুর থেকেই। পরবর্তীকালে নিখিলনাথ লিখলেন মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলের বিস্তৃত ইতিহাস মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, (১৩০৯ বঙ্গাব্দ), মুর্শিদাবাদ কাহিনী যেন তারই সলতে পাকানো পর্ব।

কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদের নিজামত স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সেই সূত্রে হাজারদুয়ারিতে সংরক্ষিত ইতিহাসের বিপুল উপকরণ তাঁর হাতের নাগালে ছিল। বইয়ের ভূমিকায় তিনি নবাব বাহাদুরের দেওয়ান খন্দেকার ফজলে রব্বীর ঋণ অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। বহরমপুর কলেজের মৌলবি মফিজুদ্দিন সাহেব এবং নিজামত সেরেস্তাদার মৌলবি আবদুস আলিম ফারসি নথির পাঠ ও অনুবাদে সহায়তা করেছিলেন কালীপ্রসন্নকে। নাম বাঙ্গালার ইতিহাস হলেও আদতে এটি মুর্শিদাবাদেরই ইতিহাস।

নিখিলনাথ ও কালীপ্রসন্নর সমসময়েই পূর্ণচন্দ্র মজুমদার ইংরেজিতে লিখেছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবি ইতিহাস দি মসনদ অব মুর্শিদাবাদ (১৯০৫) এবং মেজর টুল ওয়ালস লিখেছিলেন হিস্ট্রি অব মুর্শিদাবাদ (১৯০২) ওয়ালস-এর বইয়ে নবাবদের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে জেলার বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

নিখিলনাথ এবং কালীপ্রসন্নর পর বাংলাভাষায় মুর্শিদাবাদচর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নামটি হল শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পাঁচথুপি নিবাসী শ্রীশচন্দ্রের পাঁচ খন্ডের বৃহৎবপু মুর্শিদাবাদ কথা বের হয়েছিল এক দশক (১৯৩২-৪২) ধরে। জেলাচর্চার বহু মূল্যবান উপকরণ এ বইয়ে অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে আছে। নবাব রাজারাজড়া বা জমিদারদের পরিচয়, ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থানগুলির বর্ণনা, উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণের পাশাপাশি শ্রীশচন্দ্র জেলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিরও যথাসাধ্য বিবরণ দিয়েছেন। সে-দিক দিয়ে দেখলে শ্রীশচন্দ্রই প্রথম ঐতিহাসিক যিনি জেলা মুর্শিদাবাদের একটা সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

শ্রীশচন্দ্রের পরে বেশ কিছুদিন জেলাচর্চার ধারায় একটু ভাটা পড়ে। ব্যক্তি উদ্যোগে জেলাচর্চার ধারায় ভাটার টান এলেও ওই কালপর্বেই জেলা নিয়ে অসাধারণ কাজ হয় সরকারি পর্যায়ে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত বিজয়বিহারী মুখার্জির মুর্শিদাবাদের সার্ভে ও সেটেলমেন্ট রিপোর্ট মুর্শিদাবাদের গ্রাম সম্পর্কে বহু তথ্য পরিবেশন করে। পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত অশোক মিত্র সম্পাদিত ড্রিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক (১৯৫১ সালের জনগণনার রিপোর্ট)-ও এ সম্পর্কে আরও বহু তথ্য সরবরাহ করে। প্রকৃতপক্ষে সেই প্রথম জেলার রাজরাজড়া নবাব পরিবারের ইতিবৃত্তের বাইরে জেলার প্রায় দু-হাজার গ্রাম সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা হল। এই হ্যাণ্ডবুকের ‘ভিলেজ ডিরেক্টরি’ এক অসামান্য সংযোজন। গ্রামের আভ্যন্তরীণ শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে বহু তথ্য মেলে এ বইতে। অশোক মিত্র সম্পাদিত পশ্চিমবঙ্গের পূজাপার্বণ-এর দ্বিতীয় খন্ডে (১৩৭৫?) এ জেলার বৈচিত্র্যময় বহু লোকউৎসবের খবর পাওয়া যায়।

১৯৫১ সালে অশোক মিত্র মহাশয় ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক-এর ভিলেজ ডিরেক্টরির মাধ্যমে গ্রামের বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় তুলে ধরার যে চেষ্টার সূচনা করেন পরবর্তী জনগণনায় (১৯৬১) তা আরও পূর্ণাঙ্গ করে তোলার চেষ্টা হয়। তবে দু-টি জনগণনার হ্যাণ্ডবুক পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য পরিষ্কার ধরা পড়ে। শ্রী মিত্র জমির মালিকানাকে ভিত্তি করে মুর্শিদাবাদের গ্রামের আভ্যন্তরীণ শ্রেণিবিন্যাস-এর একটা বাস্তবচিত্র হাজির করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কিন্তু বীরেশ্বর রায় সম্পাদিত ১৯৬১ সালের জনগণনার ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক সে-পথে না হেঁটে গ্রামীণ মুর্শিদাবাদের কর্মী ও কর্মীদের দশটি শ্রেণি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে। ওই হ্যাণ্ডবুকে ড. নন্দদুলাল ভট্টাচার্যের ‘এ স্টাডি ইন সেটলমেন্ট জিওগ্রাফি ইন দি ডিস্ট্রিক্ট অব মুর্শিদাবাদ’ একটি অসাধারণ সংযোজন। জেলার জনবসতি ভূগোল নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা সম্ভবত সেই প্রথম।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সরকারি এইসব প্রকাশনা জেলাসংক্রান্ত বহু তথ্য পরিসংখ্যান সুলভ করে দেওয়ায় ব্যক্তি উদ্যোগে জেলাচর্চার ধারা নতুন করে পল্লবিত হয়ে ওঠে। এই পর্বে জেলাচর্চার অগ্রণীরা হলেন কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতিভারঞ্জন মৈত্র, পুলকেন্দু সিংহ, প্রফুল্লকুমার গুপ্ত প্রমুখ। সাংবাদিক কমল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিত ছিলেন ‘মুর্শিদাবাদের এনসাইক্লোপিডিয়া’ নামে। তাঁর মুর্শিদাবাদ (১৩৮০), মুর্শিদাবাদ কাহিনী (তারিখ নেই), মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি (১৩৮০-৮২) বইগুলো সমকালে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর সম্পাদিত ‘মুর্শিদাবাদ সমাচার’-এ তিনি জেলাচর্চার এক নতুন ধারা উন্মোচিত করেছিলেন এবং তাঁকে দেখে ও তাঁরই উৎসাহে যে বহু লেখক জেলাচর্চায় প্রাণিত হয়েছিলেন সে-কথাও অনস্বীকার্য। কমল বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যরঞ্জন বকশির যৌথ রচনা মুর্শিদাবাদের রাঢ় এলাকাও (১৯৮৩) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

জেলাচর্চার আঙিনায় প্রতিভারঞ্জন মৈত্রের আবির্ভাব ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদ (১৯৫৮) নিয়ে। পর্যটকদের উপযোগী করে মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলির বর্ণনা ঠাঁই পেয়েছে এই পুস্তিকায়। ১৯৫৮ সালেই বের হয়েছিল সৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সিপাহী যুদ্ধে বহরমপুর। সিপাহি বিদ্রোহের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে লেখা এই বইটিতে বহু তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছিল। প্রতিভারঞ্জন মৈত্রের মুর্শিদাবাদের ইতিহাস প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে। এটি জেলাচর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কালেক্টরেট মহাফেজখানার তথ্যাদি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন শ্রী মৈত্র। কালেক্টরেট লাইব্রেরির মূল্যবান গ্রন্থ ও নথি সংগ্রহ ব্যবহার করার ফলে শ্রী মৈত্রের বহু প্রবন্ধেই বহু নবতর তথ্যের সন্ধান মেলে যা অন্য অনেক জেলাচর্চাকারীর রচনাতেই দুর্লভ। এখানে ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত শ্রী মৈত্র সম্পাদিত মুর্শিদাবাদচর্চা বইটির উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এই বইটিতে মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত ১০টি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। পুলকেন্দু সিংহের জেলাচর্চাটা একটু অন্যগোত্রের। এযাবৎকাল অনাদৃত লোকায়ত মুর্শিদাবাদকেই তিনি বেছে নেন তাঁর চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে। তাঁর মুর্শিদাবাদের লোকায়ত সংগীত ও সাহিত্য প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৩৭৭-এ। এর পনেরো বছর পর (১৩৯২) প্রকাশিত হয় লোকায়ত মুর্শিদাবাদ (প্রবেশিকা পর্ব)। ২০০৩ সালে বেরিয়েছে তাঁর মুর্শিদাবাদের লোকশিল্পী বইটি। শ্রী সিংহ এখনও তাঁর জেলাচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। শ্রী সিংহের মতোই শক্তিনাথ ঝা-র চর্চার বিষয়ও লোকায়ত মুর্শিদাবাদ। জেলার আউল, বাউল, পির ফকির নিয়ে তাঁর অজস্র প্রবন্ধ ছড়িয়ে আছে খ্যাত-অখ্যাত বহু পত্রিকার পাতায়।

মুর্শিদাবাদের আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় আরেক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের পুরাসম্পদ গ্রন্থমালার মুর্শিদাবাদ খন্ডের প্রকাশ ঘটে ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে। বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ও অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত এই বইটি জেলাচর্চায় এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। এই বইতে জেলার প্রতিটি থানা ধরে ধরে কোন গ্রামে কী পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে; মন্দির, মসজিদ, মূর্তি—তাঁর বিবরণ রয়েছে। এই গ্রন্থ রচনার আগে শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় গেছেন জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে, করেছেন সরেজমিন সমীক্ষা, সংগ্রহ করেছেন লোকবিশ্বাস কিংবদন্তি, তারপর বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেসব বিন্যাস্ত করেছেন তাঁর বইয়ে। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাচীন মুর্শিদাবাদ কর্ণসুবর্ণ ও মহীপাল (২০০২) এবং শহর বহরমপুর (২০০৩) বই দু-টিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। প্রথম বইটির উপজীব্য মুর্শিদাবাদের দু-টি প্রাচীন রাজধানী ও তার গৌরব গাথা এবং দ্বিতীয় বইটি বৃহত্তর বহরমপুরের পরিচয়জ্ঞাপক।

জেলার ঐতিহাসিক ইতিবৃত্ত, পুরাতত্ত্ব, লোকায়ত জীবন নিয়ে এসব কাজের বাইরে অধ্যাপক সৌম্যেন্দ্রকুমার গুপ্ত বেছে নিয়েছেন জেলাচর্চার এক নিভৃত ক্ষেত্র। মুর্শিদাবাদ জেলার অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক জীবন নিয়ে তাঁর কাজ অবিস্মরণীয়। এযাবৎ প্রকাশিত তাঁর একমাত্র বই চেনা মুর্শিদাবাদ অচেনা ইতিবৃত্ত সম্পর্কে যাই-ই বলি না কেন তা কম হবে।

মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়েও কম চর্চা হয়নি। প্রথাগত গবেষণার পাশাপাশি সখের চর্চাও এক্ষেত্রে নেহাত কম নয়। সৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সিপাহী যুদ্ধে বহরমপুর-এর কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। প্রফুল্লকুমার গুপ্তের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুর্শিদাবাদ (১৯৭৫) সনৎ রাহার দুই খন্ডের কমিউনিস্ট আন্দোলনে মুর্শিদাবাদ (১৯৮০, ১৯৮২), ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুর্শিদাবাদ (১৯৮৭), বিজয়কুমার ঘোষালের মুর্শিদাবাদ জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস (১৯৮২), সুধীন সেনের আমাদের অভিজ্ঞতায় মুর্শিদাবাদ জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলন (জানুয়ারি, ২০০২) বর্তমান লেখকের দেশবিভাগের ক্রান্তিকাল মুর্শিদাবাদ (২০০১) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। প্রথাগত গবেষণার ফসল বিষাণকুমার গুপ্তের পলিটিক্যাল মুভমেন্টস ইন মুর্শিদাবাদ, ১৯২০-১৯৪৭ (১৯৯২) এবং খাইরুল আনমের দি রোল অব কৃষ্ণনাথ কলেজ অ্যাণ্ড রেভোলিউশনারি মুভমেন্ট ইন মুর্শিদাবাদ, ১৯০৩-১৯৪৭, (২০০৪) ও ইন্ডিয়ান ফ্রিডম মুভমেন্ট অ্যাণ্ড মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট ১৯০৫-১৯৪৭ (২০০৮) এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বই দু-টি সমসাময়িক বহু খুঁটিনাটি তথ্যের আকর-বিশেষ। উল্লেখ্য দীপংকর চক্রবর্তী, শক্তিনাথ ঝা, সৌম্যেন্দ্রকুমার গুপ্ত ও তপন ভট্টাচার্য সম্পাদিত বিপ্লবী অনন্ত ভট্টাচার্য স্মারক গ্রন্থ মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারা, ১৯২৫-১৯৭৫ (১৯৯৩) গ্রন্থটিও।

শ্যামধন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে ১৮৬৪ সালে জেলাচর্চার যে সূচনা হয়েছিল বহু বিচিত্র খাত ধরে তা আজও প্রবাহিত হয়ে চলেছে। জমা হয়েছে বহু ফসল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জগন্নাথ মজুমদারের মুর্শিদাবাদ ইতিকথা (১৩৪৮), শ্যামাপদ বিশ্বাসের মুর্শিদাবাদের দ্রষ্টব্য স্থান এবং দেবালয়সমূহ (১৩৮৮/১৯৮১), বিশ্বনাথ রায়ের এ পিপ থ্রু দি হাজারদুয়ারি প্যালেস (১৯৮১) শশাঙ্কশেখর সান্যালের হাজারদুয়ারীর হাজার নিঃশ্বাস, রতন লাহিড়ির মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস (১৯৮৪) দেবব্রত ধরের কৃষ্ণনাথ রামদাস হুইলার ও সমসাময়িক মুর্শিদাবাদ সমাজ (১৯৯০), ফজলুল হকের মুর্শিদাবাদ নবাব ও নবাবী (১৩৭৩), শ্যামল দাসের পুস্তিকা হাজারদুয়ারীর একাল সেকাল (১৯৯৭), রামপ্রসাদ পাল ও শ্যামল দাসের হাজারদুয়ারীর নবাব, সুবে বাংলার শেষ নাজিম (১৯৯৮), আশীষ মন্ডলের সিপাহী বিদ্রোহে বহরমপুর (১৪০১), শুভ চট্টোপাধ্যায়, রকিবউদ্দিন ইউসুফ, হাতেমূল ইসলাম ও চিরসুন্দর সিংহ সংকলিত মুর্শিদাবাদ ব্যক্তিত্ব (২০০০), বর্তমান লেখকের মুর্শিদাবাদের মনীষী (২০০১), মুর্শিদাবাদের পথ ও পরিবহনের সেকাল একাল (২০০৩), প্রভাতকুমার সাহার মুর্শিদাবাদ জেলার মসজিদ, নুরুল আমিন বিশ্বাস-এর মুর্শিদাবাদ বন্যা ও ভাঙনের রূপরেখা, রামপ্রসাদ পালের প্রসঙ্গ : শহর মুর্শিদাবাদ (২০০৩), অপরেশ চট্টোপাধ্যায়ের কান্দি বীক্ষণ (২০০৭) প্রভৃতি।

১৯৫১ বা ১৯৬১-র ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক-এর মতো পরবর্তীকালে ১৯৭১, ১৯৮১ বা ১৯৯১ সালে জনগণনার পরও ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলি ধারে ও ভারে কোনোটিই ১৯৫১ বা ১৯৬১-র ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক-এর ধারে-কাছে যেতে পারেনি। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় ওয়েস্টবেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার মুর্শিদাবাদ। বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য সম্পাদিত স্বাধীনতার পর প্রকাশিত এই গেজেটিয়ারটি ১৯১৪ সালে প্রকাশিত এল. এস. এস. ও’ম্যালির গেজেটিয়ার থেকে আরও বিস্তৃত বিবরণে সমৃদ্ধ হলেও এতে হান্টার এবং ও’ম্যালির প্রভাব খুবই স্পষ্ট।

মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ারের সর্বশেষ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৩-এর নভেম্বরে। এই গেজেটিয়ারটির সংকলন ও পরিমার্জনের দায়িত্বে ছিলেন বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্রশংকর সেনগুপ্ত ও বতর্মান লেখক। এক অর্থে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই প্রথম বাংলা ভাষায় বেরোল কোনো জেলা গেজেটিয়ার (বাংলার কথা এখানে বিবেচ্য নয়) এবং এই প্রথম সরকারি কর্মচারীদের বাইরেও একদল জেলাচর্চাকারী তাঁদের রচনা দিয়ে সমৃদ্ধ করলেন জেলা গেজেটিয়ারকে।

সখের বা নেশার ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি নামী ঐতিহাসিক বা খ্যাতিমান পুরাতাত্ত্বিকদের মুর্শিদাবাদচর্চার দৃষ্টান্তও কম নেই। কালীকিঙ্কর দত্তের আলিবর্দী অ্যাণ্ড হিজ টাইমস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯-এ। একই গোত্রের বই নন্দলাল চট্টোপাধ্যায়ের ‘মিরকাশিম, দি নবাব বেঙ্গল ১৭৬০-১৭৬৩’। যদুনাথ সরকারের বেঙ্গল নবাবস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। অতুলচন্দ্র রায়ের দি কেরিয়ার অব মীরজাফর প্রকাশিত হয় ১৯৫৩-তে। দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বের হয় আব্দুল করিম-এর মুর্শিদকুলি খান অ্যাণ্ড হিজ টাইমস। বিভিন্ন নবাব ও তাদের সমসময় নিয়ে লেখা এইসব গবেষণাগ্রন্থে সমকালীন মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার তথ্যনিষ্ঠ পরিচয় মেলে।

জে. এইচ. লিটল-এর দি হাউস অব জগৎশেঠ (১৯৬৭) এবং খান আব্দুল মজিদ খানের দি ট্রানজিসন ইন বেঙ্গল (১৯৬৯) সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। মুর্শিদাবাদচর্চার ক্ষেত্রে এসব গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭৩ সালে দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলা দেশ থেকে প্রকাশিত হয় এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট ইন ট্রানজিসান : মুর্শিদাবাদ ১৭৬৫-১৭৯৩ শীর্ষক এক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ। জেলাচর্চায় খান মহম্মদ মহসীন-এর এই গবেষণাগ্রন্থ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বন্দর কাশিমবাজার। কাশিমবাজারের গৌরবময় অতীত ও তার ক্রমাবনতির বিশ্বস্ত চিত্র পাওয়া যায় এই বইতে। ওই বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর অবিস্মরণীয় গবেষণাপত্র লাইফ অ্যাণ্ড টাইমস অব কান্তবাবু, দি বেনিয়ান অব ওয়ারেন হেস্টিংস-এর প্রথম খন্ড। ১৯৮১-তে বেরোল এই বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডটি। কাশিমবাজার রাজবাড়ির নিজস্ব নথিপত্র, হিসাবের খাতা এবং ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে সংগৃহীত উপকরণের সমন্বয়ে এই বই হয়ে উঠেছে সময়ের দর্পণ। ১৭৪২ থেকে ১৮০৪ পর্যন্ত জেলা তথা বাংলার সমাজ, অর্থনীতির নির্মোহ ধারাবিবরণী এই বইটি। এর অব্যবহিত পরের সময়সীমা ধরা রয়েছে তাঁর আরেকটি অসাধারণ গ্রন্থ হিস্ট্রি অব কাশিমবাজার রাজ ইন দি নাইনটিনথ সেঞ্চুরি, ১৮০৪-১৮৯৭ (১৯৮৬)-তে।

অতুলচন্দ্র রায়, অনিরুদ্ধ রায়, মহম্মদ কামরুদ্দিন ও রত্নাবলী চ্যাটার্জি সম্পাদিত মুর্শিদাবাদ অ্যাফেয়ারস ১৮২১- ৫০, রেকর্ডস ফ্রম মুর্শিদাবাদ কালেক্টরেট প্রকাশিত হয় ১৯৯৫-এ। এ বইয়ে হৃতগৌরব মুর্শিদাবাদের এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদ নিজামত লেটারস ইস্যুড, পার্ট-১ (১৮০২-১৮৩১) এবং মুর্শিদাবাদ লেটারস ইস্যুড, পার্ট-৩, (১৮৩৪-১৮৭২)-এর কথাও উল্লেখ্য। ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্রের এ প্রসঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ামস করসপণ্ডেস-এর কথাও মনে পড়া স্বাভাবিক।

ধূসর হয়ে আসা মুর্শিদাবাদের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে সুধীররঞ্জন দাসের অসাধারণ গ্রন্থ কর্ণসুবর্ণ মহানগরী প্রকাশিত হয় ১৯৯২-এর আগস্টে। আগ্রহী পাঠকের এ প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে শ্রীদাসের রাজবাটীডাঙ্গা : ১৯৬২ (১৯৬৮) নামক গ্রন্থটির কথা। চিরুটি বা যদুপুরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে যেসব তথ্যাদি আবিষ্কৃত হয় তারই বিবরণ এই বইটি। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় রজতকান্ত রায়ের পলাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ নামক গ্রন্থটি। দেবশ্রী দাসের মুর্শিদাবাদ জেলার সাংস্কৃতিক মুক্তধারা : ঐতিহাসিক সমীক্ষা (২০০২), সুশীল চৌধুরির পলাশির অজানা কাহিনী (২০০৪), নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ (২০০৪) এই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন।

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার ধারায় মুর্শিদাবাদচর্চার এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি জেলা থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি স্মারকগ্রন্থের গৌরবময় ভূমিকা উল্লেখ না করা হয়। স্মারকগ্রন্থসমূহের প্রথমেই বলতে হয় কৃষ্ণনাথ কলেজ শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ-এর। এই স্মারকগ্রন্থে মেধা ও বৈদগ্ধ্যের যে বিরল সমাবেশ ঘটেছে তেমনটা খুব কম স্মারকগ্রন্থেই ঘটে থাকে। কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ (১৯৫৪), জঙ্গিপুর গ্রন্থমেলা স্মারকগ্রন্থ (১৯৬৩), চক ইসলামপুর এস. সি. এম. হাইস্কুল শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ (১৯৭৮), জঙ্গীপুর সংস্কৃতিমেলা স্মারকগ্রন্থ (১৯৭৮) মুর্শিদাবাদ উৎসব স্মারকগ্রন্থ (১৯৯১), ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব স্মারকগ্রন্থ (রঘুনাথগঞ্জ ১৯৯২), জঙ্গিপুর পুরসভা ১২৫তম বর্ষপূর্তি উৎসব স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৫) সদ্যপ্রকাশিত বহরমপুর পৌরসভা ১৩০ বর্ষপূর্তি স্মারকগ্রন্থ (২০০৮) ইত্যাদি স্মারকগ্রন্থগুলি জেলাচর্চার বহু মূল্যবান উপকরণে সমৃদ্ধ।

জেলাচর্চায় জেলার বেশ কিছু সাময়িকপত্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। যেকোনো আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাকারীই তার সংগৃহীত উপকরণসমূহ প্রকাশের জন্য সাময়িকপত্রের দ্বারস্থ হন। এতে সংগৃহীত উপকরণের প্রামাণিকতা অনেকটাই যাচাই হয়ে যায়। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নবাবি আমলের পরিকল্পনা প্রথম ঘোষিত হয়েছিল বহরমপুরের সৎসঙ্গ পত্রিকায়। নিখিলনাথ রায়ের মুর্শিদাবাদ কাহিনীর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ হিতৈষী পত্রিকায়। পত্রিকার সম্পাদক বনোয়ারীলাল গোস্বামী ছিলেন জেলাচর্চার উৎসাহী ব্যক্তিত্ব। নিখিলনাথের বইয়ের প্রকাশক হতেও তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। মুর্শিদাবাদ হিতৈষীর ধারা মেনেই জেলাচর্চায় উৎসাহী ছিল কমল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত মুর্শিদাবাদ সমাচার। তবে বেসরকারি উদ্যোগে জেলাচর্চা প্রথম মাইক্রোলেভেলে (গ্রামচর্চা) পৌঁছোয় মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত বর্তিকার হাত ধরে। গ্রামবাসীদের লেখা প্রশ্নমালাভিত্তিক গ্রাম সমীক্ষা বর্তিকাতে প্রকাশিত হতে থাকায় গ্রামচর্চার নতুন একটি ধারা উন্মোচিত হল। অশোক মিত্র সম্পাদিত ডিস্ট্রিক্ট সেন্সাস হ্যাণ্ডবুক-এ পরিসংখ্যানভিত্তিক গ্রাম বিবরণীর (ভিলেজ ডিরেক্টরি) যে ধারা অনুসৃত হয়েছিল তারই পরিপূরক হয়ে উঠল বর্তিকার প্রশ্নমালাভিত্তিক গ্রাম সমীক্ষা। বর্তিকার ধারা অনুসরণ করেই বিগত শতাব্দীর আশি এবং নব্বই-এর দশকে প্রাণরঞ্জন চৌধুরি সম্পাদিত পাক্ষিক গণকন্ঠ-এর বার্ষিক সংখ্যাগুলিতে গ্রামচর্চার এক নতুন জোয়ার দেখা গেল। ১৯৯২ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ৯টি বার্ষিক সংখ্যায় মুর্শিদাবাদের মোট ১৭০টি গ্রাম বিবরণী প্রকাশিত হয়েছিল গণকন্ঠ-তে। গ্রাম সমীক্ষা বা গ্রামের তথ্যমূলক পরিচিতি যাই-ই বলা হোক না কেন, ছাব্বিশটি প্রশ্নমালার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগুলোতে জেলাচর্চার বহু মূল্যবান উপকরণ সঞ্চিত রয়েছে। গণকন্ঠ পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যাগুলোতে গ্রামচর্চার হাত ধরেই আবির্ভূত হয়েছে জেলাচর্চার একদল নবীন গবেষক যাদের জেলাচর্চা এখনও অব্যাহত। গণকন্ঠের সমসময়েই রাধারঞ্জন গুপ্ত সম্পাদিত জনমত, শম্ভুনাথ সরকার সম্পাদিত জ্ঞাপয়িতা, অতুল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত চেতনিক সত্যরঞ্জন বকশি (পরবর্তীকালে গৌরী বকশি) সম্পাদিত মুর্শিদাবাদ সন্দেশ, দীপংকর চক্রবর্তী সম্পাদিত মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ, নবকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কান্দী বান্ধব, অনুত্তম পন্ডিত সম্পাদিত জঙ্গীপুর সংবাদ, দুলালচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত জলসিড়িতেও জেলাচর্চার একটা ধারা লক্ষ করা যায়। এই ক্ষীণ ধারাই কল্লোলিনী হয়ে আবির্ভূত হয় জেলার নামকরণের তিন-শো বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে, ২০০৪ সালে। অরূপচন্দ্র সম্পাদিত বাসভূমি, অচিন্ত্য সিংহ সম্পাদিত ঝড়, দুলালচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত জলসিড়ি, ওই উপলক্ষ্যে বের করে একাধিক বিশেষ মুর্শিদাবাদ সংখ্যা। বার্ষিক মুর্শিদাবাদ বীক্ষণের মুর্শিদাবাদ জেলার অর্থনীতি (১৯৯২), মুর্শিদাবাদ জেলার এক দশক (১৯৯৪), মুর্শিদাবাদ জেলার নগর সংস্কৃতি (১৯৯৫) মুর্শিদাবাদ : ফিরে দেখা (১৯৯৬), মুর্শিদাবাদ : আন্দোলনের ঐতিহ্য (১৯৯৮) প্রভৃতি সংখ্যাগুলি, বাসভূমি পত্রিকার মুর্শিদাবাদ ইতিবৃত্ত প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড এবং ঝড় পত্রিকার বিষয় : মুর্শিদাবাদ-এর তিনটি সংকলন জেলাচর্চার মাইলস্টোন-বিশেষ। বিভিন্ন মানের লেখা বহন করলেও নিবিষ্ট পাঠক এগুলোকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। জেলাচর্চার বহু অমূল্য নিদর্শন জেলার খ্যাত-অখ্যাত আরও নানা পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে।

তথ্যসূত্র

১. মুখোপাধ্যায় শ্যামধন—মুরশিদাবাদের ইতিহাস, সংকলন ও সম্পাদনা; শেখর ভৌমিক, কলকাতা, ২০০৬।

২. ঘোষ সুনীলবিহারী (সম্পাদনা)—বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চা গ্রন্থপঞ্জী, ১৮০৯-১৯৯০, কলকাতা, ১৯৯৮।

৩. মৈত্র প্রতিভারঞ্জন—মুর্শিদাবাদ ইতিহাসচর্চা, গণকন্ঠ, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৮৮।

৪. গুপ্ত সৌম্যেন্দ্রকুমার—ভূমিকার বদলে, বার্ষিক মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ, ১৯৯৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *