আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বীরভূম – পার্থশঙ্খ মজুমদার
দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর বীর রাজাদের শাসনক্ষেত্র বীরভূমি ইংরেজ প্রশাসনের সুবিধা ও প্রয়োজনের কারণে নানাভাবে আকার পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে বর্তমান বীরভূম জেলাতে। এই জেলা তার বর্তমান আকার লাভ করেছে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে।
জেলার আকার নির্মাণের মতো জেলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও ইংরেজ রাজকর্মচারীরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। প্রধানত প্রশাসনিক কারণে হলেও প্রধানত তাদের প্রয়াসের কল্যাণেই বীরভূম ভূখন্ডের ইতিহাসের এক বড়ো অংশের প্রথম লিপিবদ্ধকরণ হয়েছিল। তাদের এই প্রয়াসের মধ্যে ছিল সরকারি প্রতিবেদন এবং গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনা। প্রাচীন ইতিহাস ব্যতীত সমকালীন সময়ের ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়েছিল এই সমস্ত প্রয়াসে।
এই ধরনের প্রথম প্রয়াস ছিল বাংলার রেভিনিউ সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন ডবলিউ. এস. শেরউইল কর্তৃক রচিত জিওগ্রাফিক্যাল অ্যাণ্ড স্ট্যাটিসস্টিক্যাল রিপোর্ট অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব বীরভূম। ১৮৪২-৫২ সময়ে সম্পন্ন জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৎকালীন বীরভূম ভুখন্ডের ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন শেরউইল। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ম্যাজিস্ট্রেট ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার রচিত দি অ্যানালগ অব রুরাল বেঙ্গল, যা ছিল প্রকৃত অর্থে বীরভূম ভূখন্ডের ইতিহাস রচনার প্রথম তন্নিষ্ঠ প্রয়াস। জেলার মহাফেজখানায় রক্ষিত সরকারি উপাদান-সহ ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ড, রাজস্ব বিভাগের নথিপত্র এবং সাধারণ মানুষের বক্তব্যের ভিত্তিতে হান্টার এই ‘সুজলা-ভূমির’ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করেছিলেন। জেলার সম্পূর্ণ ইতিহাস না হলেও ব্রিটিশ কর্তৃত্ব বিস্তারের প্রথম পর্ব সময়কালের জেলার সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব এই গ্রন্থ থেকে। পরবর্তীতে অসীম চট্টোপাধায় কৃত এই গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ গ্রাম বাংলার ইতিকথা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৮৪)।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় হান্টার-এর আর এক মূল্যবান গ্রন্থ এ স্ট্যাটিসস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল গ্রন্থের চতুর্থ খন্ড। এই খন্ডে বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার সঙ্গে বীরভূম জেলার প্রায় প্রতিটি বিষয়ের পরিসংখ্যানকেন্দ্রিক আলোচনা করা হয়েছিল—ভৌগোলিক বিশেষত্ব, জনসমাজ, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রশাসন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগ বীরভূম সংক্রান্ত অংশটি পৃথকভাবে প্রকাশ করেছেন (২০০১)।
পরবর্তীকালে বীরভূম জেলা সম্পর্কে আরও কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল—স্ট্যাটিসস্টিক্যাল রিপোর্ট অব থানা লাভপুর ইন দি ডিস্ট্রিক্ট অব বীরভূম (১৮৭৯), ফাইনাল রিপোর্ট অব দি সেটেলমেন্ট অব দি হুকুমাপুর এস্টেট ইন বীরভূম বিলোংগিং টু দি বারডয়ান রাজ (১৮৯৪), রিপোর্ট অন দি সেটেলমেন্ট অব সানতাল ভিলেজেস ইন দি ডিস্ট্রিক্ট অব বীরভূম (১৯১২), ফাইনাল রিপোর্ট অন দি সার্ভে অ্যাণ্ড সেটেলমেন্ট ইন রামপুরহাট অ্যাণ্ড সিউড়ি সাবডিভিশনস অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব বীরভূম (১৯১৫) এবং ফাইনাল রিপোর্ট অন দি সার্ভে অ্যাণ্ড সেটেলমেন্ট অপারেশন ইন দি ডিস্ট্রিক্ট অব বীরভূম (১৯২৪-৩২)। এই সমস্ত প্রতিবেদন থেকে সমগ্র জেলা বা জেলার একটি নির্দিষ্ট অংশের অতীত ইতিহাস-সহ তৎকালীন সময়ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়।
ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট ই. জি. ড্রেক-ব্রকম্যান রচিত নোটস অব দি আর্লি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব দি ডিস্ট্রিক্ট অব বীরভূম (১৮৯৮) নামক একটি পুস্তিকা এবং লুইস সিডনি স্টুয়ার্ট ও’ম্যালি রচিত বীরভূম জেলার প্রথম গেজেটিয়ার (১৯১০)। ড্রেক-ব্রকম্যান রচিত পুস্তিকা থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনের দশক পর্যন্ত জেলার প্রশাসন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক অবস্থা-সহ বীরভূম, পাঞ্চেত ও পাটকুম জমিদারদের ইতিহাস জানা যায়। অন্যদিকে জেলার ইতিবৃত্ত-সহ ভৌগোলিক অবস্থান, জনসমাজ, শিক্ষা ও কৃষি বিষয়ক পরিসংখ্যান, জনপদ ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত তথ্যের কারণে ও’ম্যালি প্রস্তুত গেজেটিয়ারের বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে সরকারি উদ্যোগে বীরভূম সম্পর্কিত আর কোনো প্রতিবেদন ও গ্রন্থ রচিত বা প্রকাশিত হয়নি। স্বাধীনোত্তর সময়কালে সরকারের নীতির অনুসরণে প্রকাশিত হয়েছে নিউ সিরিজ অব দি ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডস অব বীরভূম, ১৭৮৬-৯৬ অ্যাণ্ড ১৮৫৫ (১৯৫৪), বীরভূম জেলার পুরাকীর্তি (১৯৭২), এবং গেজেটিয়ার (১৯৭৫)। অশোক মিত্র সম্পাদিত প্রথম প্রকাশনা উপরোক্ত সময়কালে বীরভূম কালেক্টোরেট কর্তৃক প্রেরিত এবং গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ চিঠির সংকলন। দেবকুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত দ্বিতীয় গ্রন্থে বীরভূম জেলায় বিভিন্ন স্থানের মূর্তি, মন্দির ও মসজিদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলা ভাষায় বীরভূম জেলার ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনার সূচনা হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে কালিকমল সার্বভৌম কর্তৃক বগুড়ার সেতিহাস রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার সূচনা হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সৃষ্টি হয়েছিল। সম্ভবত এই প্রবণতা বীরভূম জেলার নবোত্থিত শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে নিজস্ব গৌরবকে অন্যদের সামনে প্রদর্শিত করার এক উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল। এই সময়েই প্রধানত এই শ্রেণির মানুষদের উৎসাহে ও প্রয়াসে জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাধিক বিদ্যালয়, সংবাদপত্র (দিবাকর), সাময়িকপত্র (সৎসঙ্গ, বীরভূমি), গ্রন্থাগার (জুবিলি লাইব্রেরি) এবং বীরভূম সাহিত্য পরিষদ।
সাতকড়ি মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত সৎসঙ্গ এবং নীলরতন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত বীরভূমি সাময়িকপত্রের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় নিয়মিতভাবে বীরভূমের ইতিহাসচর্চার সূচনা হয়। অবশ্য ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্রে বীরভূম সংক্রান্ত কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রীশচন্দ্র মজুমদার রচিত ‘মেলা-দর্শন (সাধনা, বৈশাখ ১৩০০), অম্বিকাচরণ গুপ্ত রচিত ‘বীরভূমির অনুসন্ধান’ (অনুসন্ধান, জ্যৈষ্ঠ ১৩০০) এবং পঞ্চানন তর্করত্ন রচিত ‘নান্নুর’ (জন্মভূমি, কার্তিক ১৩০১)। সৎসঙ্গ পত্রিকা অল্প সময়ের জন্য প্রকাশিত হলেও বীরভূমি পত্রিকা কয়েক বছরের বিরতি-সহ দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুই পত্রিকাতেই বীরভূমের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত বীরভূম সম্পর্কিত প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন নীলরতন মুখোপাধ্যায়। ১৩০৫ সালে সৎসঙ্গ পত্রিকায় তার দু-টি দীর্ঘ প্রবন্ধ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল—বীরভূমি (চারটি সংখ্যায়) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (দু-টি সংখ্যায়)। প্রায় একই সময়ে বীরভূমের ইতিবৃত্ত রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন রতন লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা শিবরতন মিত্র। বীরভূম সাহিত্য পরিষদের মুখপত্র বীরভূমি পত্রিকার তিনটি সংখ্যায় ‘বীরভূমের নামতত্ত্ব ও সীমানা’ এবং ‘পুরাতত্ত্ব ও পূর্ব ইতিহাস’ শীর্ষক দু-টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি ইতিবৃত্ত রচনার পরিকল্পনা থেকে সরে এলেও বীরভূমি-সহ বিভিন্ন পত্রিকায় বীরভূমের ইতিহাস, প্রবাদ, সাহিত্য ও ব্যক্তি সম্পর্কে একাধিক মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
দুই-এর দশক থেকে সত্যেশচন্দ্র গুপ্ত, রামতারণ রায়, মহিমানিরঞ্জন চক্রবর্তী ও হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বীরভূমের ইতিহাস সম্পর্কিত নানা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। বীরভূমের ঢেকারু জাতি, খনিজ সম্পদ ও গালাশিল্প সম্পর্কে সত্যেশচন্দ্র গুপ্ত-র চারটি প্রবন্ধ ১৩১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বীরভূমি পত্রিকায়। রামতারণ রায় রচিত ঢেকার রাজা রামজীবন, প্রভু নিত্যানন্দ, বাসুদেব মূর্তি, হাঁটুগাড়া প্রভৃতি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল বীরভূম বার্তা ও গৃহস্থ পত্রিকায়।
সুপুর, একচক্রা, মুলুক প্রভৃতি স্থানের পরিচয়-সহ বীরভূমের নানা বিষয় সম্পর্কে গৃহস্থ, ভারতবর্ষ, সারথি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল মহিমানিরঞ্জনের নিবন্ধ। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ও স্থান-পরিচয়-সহ নানা বিষয়ে বীরভূমি ও গৃহস্থ পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন।
বীরভূমের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে হেতমপুরের জমিদার বংশের মহিমানিরঞ্জনের বিশেষ ভূমিকা আছে। বীরভূমের ইতিহাস সম্পর্কে প্রথম গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। বীরভূম রাজবংশ (১৯০৮-০৯) নামক গ্রন্থে বারোটি পরিচ্ছেদে মহিমানিরঞ্জন বীরভূমের বীর ও পাঠান (রাজনগরবাসী) শাসক বংশের কালানুক্রমিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পরের বছর প্রকাশিত হয়েছিল কিশোরীলাল সরকার রচিত হেতমপুরকাহিনী ও প্রতাপনারায়ণ রায় রচিত বীরভূমের ইতিহাস। তবে এই সমস্ত প্রয়াসই ছিল বীরভূমের খন্ডিত ইতিহাস। গৌরবজনক অতীত-সহ জেলার সম্পূর্ণ ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যে মহিমানিরঞ্জনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বীরভূম অনুসন্ধান সমিতি’ (১৯১৪)। তার আর্থিক সহায়তায় এবং হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় তিন খন্ডে বীরভূম বিবরণ (১৩১৭, ১৩২০, ১৩২৮)। মহিমানিরঞ্জনের অকালমৃত্যুর কারণে এই গ্রন্থের শেষ বা চতুর্থ খন্ড প্রকাশিত হয়নি। জেলার বিভিন্ন স্থানের বিবরণ, ইতিহাস, কাহিনি, প্রবাদ এবং সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল এই তিন খন্ডে। গ্রন্থের এই চরিত্রের কারণেই প্রথম খন্ডে উল্লেখ করা হয়েছিল—‘‘বলিয়া রাখা ভাল ইহা ইতিহাস নহে। বীরভূমের কয়েকটি পল্লী ও তীর্থক্ষেত্রের কহিনী মাত্র।’’
বীরভূম বিবরণ গ্রন্থের এই অসম্পূর্ণতা পূরণে অগ্রসর হয়েছিলেন শিবরতন-পুত্র গৌরীহর মিত্র। ইতিপূর্বে ১৩৩০ সাল থেকে মানসী ও মর্ম্মবাণী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ প্রভৃতি পত্রিকায় বীরভূমের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তার মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ বারো বছর কঠোর পরিশ্রম করে গৌরীহর প্রকাশ করেন বীরভূমের ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খন্ড (১৯৩৬)। গৌরীহর তিন খন্ডে বীরভূমের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথম খন্ডে আলোচিত হয় ‘‘প্রাচীনকাল হইতে ইংরাজ অধিকারের পূর্ব্বকাল পর্যন্ত বীরভূমের ইতিহাস’’। চোদ্দোটি অধ্যায়ে গৌরীহর উপরোক্ত সময়কালের বীরভূমের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চা আলোচনা করেছিলেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দ্বিতীয় খন্ডে ‘‘বীরভূমে পাশ্চাত্য বণিকগণের বাণিজ্যবপ্যদেশে বীরভূমে আগমন এবং ইংরেজধিকারের সূচনাকাল হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্যন্ত সময়ের ধারাবাহিক ইতিহাস সংকলিত’’ হয়েছিল। এই দুই খন্ড বাংলার বিদ্যোৎসমাজের প্রশংসা অর্জন করলেও সম্ভবত অর্থনৈতিক কারণেই গৌরীহর তৃতীয় খন্ড প্রকাশে সমর্থ হননি। ফলে বীরভূম জেলার প্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার প্রয়াস অসম্পূর্ণ থেকে যায়, পরবর্তী সময়েও কেউ এই অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণ করতে অগ্রসর হননি।
স্বাধীনোত্তর সময়ে বীরভূমের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে স্পষ্ট দু-টি পৃথক ধারা দৃশ্যমান। একদিকে নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক পরিচালিত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা এবং অন্যদিকে প্রধানত ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে কোনো স্থান বা ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় ধারার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই প্রথাগত গবেষণার প্রকরণ অনুসরণ না করে স্বাধীনভাবে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়েছেন।
সমগ্র বীরভূমের ১৭৭০-১৮৫৭ সময়কালের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে দীর্ঘ প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার ফসল দি ইকনমিক লাইফ অব এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট : বীরভূম, ১৭৭০-১৮৫৭। আধুনিক গবেষণা পদ্ধতির অনুসরণে সরকারি ও বেসরকারি নথিপত্রের ভিত্তিতে রঞ্জনকুমার গুপ্ত এই গ্রন্থে জেলার কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নগরায়ণের বিস্তৃত ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রায় একই সময়ের বীরভূম জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং সংঘটিত প্রতিরোধ আন্দোলনগুলিকে কেন্দ্র করে রচনা করেন রাঢ়ের সমাজ, অর্থনীতি ও গণবিদ্রোহ : বীরভূম, ১৭৪০-১৮৭১ (২০০১)।
ইংরেজ অধিকারের সূচনাপর্বের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণালাভ করা যায় মানস কুমার সাঁতরা-র গবেষণাগ্রন্থ ল্যাণ্ড রেভেনিউ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন বেঙ্গল আণ্ডার ব্রিটিশ রুল (কেস স্টাডি অব বীরভূম ডিস্ট্রিক্ট, ১৭৬৫-১৮২০) থেকে। বুদ্ধদেব আচার্য সংকলিত সুরুল নথি সংকলন প্রথম খন্ড সুরুল গ্রামের জমিদারদের নথিপত্রের সংকলন যা গবেষণাগ্রন্থ না হলেও জেলার ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা-সহ সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে।
জেলার নগরায়ণের ক্ষেত্রে দুই ধারার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। চিত্তপ্রিয় মুখার্জি প্রথাগত গবেষণার ভিত্তিতে বোলপুর শহরের বিকাশ আলোচনা করেছেন আরবান গ্রোথ ইন এ রুরাল এরিয়া (১৯৭২) গ্রন্থে। অন্যদিকে একই শহরকে কেন্দ্র করে সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় রচনা করেছেন বোলপুর দর্পণ (১৩৯০)। জেলার সদর শহর সিউড়ি সম্পর্কে প্রথাগত গবেষণা না হলেও রচিত হয়েছে দু-টি বই—সিউড়ি ইতিবৃত্ত (পার্থপ্রতিম দে, ১৯৮৯) এবং সিউড়ি শহরের ইতিহাস (সুকুমার সিংহ, ২০০৮)।
বীরভূম জেলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সম্পূর্ণ ইতিহাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য জাতীয় আন্দোলন ও জেলা বীরভূম, ১৯১৫-৪৭ (২০০০) গ্রন্থটি। সরকারি ও ব্যক্তিগত নথিপত্রের সাহায্যে অমিয় ঘোষ এই গ্রন্থে স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত ধারায় বীরভূমের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, আলোকপাত করেছেন অনেক অজানা তথ্যের প্রতি। আর জেলার বৈপ্লবিক আন্দোলন সম্পর্কে একমাত্র গবেষণা গ্রন্থ সশস্ত্র আন্দোলনের ধারায় বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৩৪) ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা (স্বাধীন গুপ্ত, ২০০৭)। এই বিষয়ে দ্বিতীয় ধারার অন্তর্গত একাধিক পুস্তিকা ও গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য—বীর বিপ্লবী জিতেন্দ্রলাল (আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৭৮), স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামী বীরভূম (দীনবন্ধু দাস, ১৩৯৭), স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরভূম (দীনবন্ধু দাস, ১৯৮৫), আমার কুটীরের কথা (প্রফুল্লকুমার গুপ্ত, ১৯৭১), আগুনের পরশমণি : ভারতের অস্ত্র আইনে দন্ডিত প্রথম নারী ছকড়িবালা দেবী (অরুণ চৌধুরি, ২০০৩)।
ঔপনিবেশিক যুগে জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে অমিয় ঘোষ তার পূর্বোক্ত গ্রন্থে সংক্ষেপে আলোচনা করলেও এই বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা সম্পাদিত হয়নি। তবে ১৯৪০-এর দশক এবং তার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস আলোচিত হয়েছে অতীশ দাশগুপ্ত-র গ্রাউণ্ডসওয়েল ইন বেঙ্গল ইন দি নাইনটিন ফর্টিশ (১৯৯৫) এবং মহঃ সেলিম-এর সংগ্রামী বীরভূম (২০০৫) গ্রন্থে। আর তার পরবর্তী সময়ের জেলার রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন ভারতজ্যোতি রায়চৌধুরি তাঁর বীরভূমের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক আন্দোলন : সাতচল্লিশ থেকে সত্তর এবং আগে পরে (১ম পর্ব)।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলের বাইরে ইতিহাসের যে-বিস্তৃত ক্ষেত্র বর্তমান, তার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধেও উল্লেখযোগ্য আলোচনা পরিলক্ষিত হয়।
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বীরভূমের সতেরোটি স্থানের মন্দিরের টেরাকোটা শিল্প সম্বন্ধে বিখ্যাত শিল্পী মুকুল দে প্রস্তুত করেছিলেন এক অসামান্য গ্রন্থ বীরভূমের টেরাকোটাস। বীরভূমের মন্দির সম্বন্ধে একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন সুখময় বন্দ্যোপাধ্যায় (টেম্পলস অব বীরভূম, ১৯৮৪)। এই দুই গ্রন্থে ফোটোগ্রাফ-বদ্ধ অনেক টেরাকোটা ও মন্দিরই বর্তমানে অস্তিত্বহীন।
অমলেন্দু মিত্র রচিত রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর (পুনঃপ্রকাশ ২০০১) জেলার ধর্ম ও সামাজিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বীরভূমের প্রায় প্রতিটি গ্রামে অন্ত্যজ শ্রেণি কর্তৃক পূজিত ধর্মঠাকুর সম্পর্কিত প্রথম গবেষণা-ফসল এই গ্রন্থ। অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়কৃত উত্তর রাঢ়ে শামাঁধর্ম (২০০০) গ্রন্থ জেলার উত্তরাংশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কাহিনি, আচরণীয় ধর্মীয় কৃত্য প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আকরস্বরূপ। একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর প্রসঙ্গ : উত্তর রাঢ় (১৯১১) গ্রন্থটি। অম্বরনাথ সেনগুপ্ত রচিত ষোড়শ শতকে ধর্ম ও সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটে রাঢ়ের বিরল মাতৃপূজা (২০০৫) গ্রন্থটিও ধর্মচর্চার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বীরভূমের নানা স্থানকে কেন্দ্র করে অনেক গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচিত হয়েছে। এই প্রয়াসগুলির অনেকগুলির মধ্যে অপেশাদারিত্বের স্পর্শ ও গৌরবজনক ইতিহাস রচনার প্রতি মোহ প্রদর্শিত হলেও ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য দূরবর্তী গবেষকদের সাহায্য করে। এই ক্ষেত্রসমীক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তিনি বীরভূমের নানা ধর্মীয় স্থান সম্বন্ধে একাধিক পুস্তিকা ও গ্রন্থ রচনা করেছেন—গ্রাম মুলুকের ইতিকথা (১৩৯৩), কঙ্কালীপিঠের কথা (১৩৯৭), বিবাগী মাটি বীরভূম (১৩৯৭), সুপুরের সুরথ রাজা (১৯৮৪) প্রভৃতি। বীরভূমের আর-এক উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রসমীক্ষক আদিত মুখোপাধ্যায়। তার গ্রাম সমীক্ষার ফসল—বীরভূম সমগ্র, প্রথম খন্ড (২০০৬)। এ ছাড়া রয়েছে বক্রেশ্বর দর্শন (অনিমা দে, ১৩৮৮), তীর্থময় বীরভূম (মুক্তিপদ দে, ১৯৮০), তারাপীঠের কথা (আদিত্য মুখোপাধ্যায়, ১৯৮১), পীঠস্থানের দেশ বীরভূম (গোবিন্দগোপাল সেনগুপ্ত, ১৩৯১), বীরভূমের পীরস্থান (এ. মান্নাফ, ২০০৫)।
বীরভূমের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত মেলা। দু-টি মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে দু-টি প্রামাণ্য গ্রন্থ—জয়দেব মেলা সেকালের ও একালের (অজিতকুমার দাস, ১৪০৮) এবং বড়োবাগানের মেলা : ইতিহাসের আলোয় (পার্থশঙ্খ মজুমদার, ২০০৮)।
বীরভূমের বিভিন্ন বিষয়কে গ্রথিত করে সাম্প্রতিক অতীতে দু-টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে—বীরভূম : অতীত ও বর্তমান (মনোজ চক্রবর্তী, ২০০৭) এবং বীরভূম : ইতিহাস ও সংস্কৃতি (অর্ণব মজুমদার, ২০০৬)। বীরভূমের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ দর্শন ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখক এমন কিছু তথ্য সরবরাহ করেছেন যা অন্যত্র মুদ্রিত হয়নি।
পূর্বোক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বীরভূমের ইতিহাসের নানা দিক সম্বন্ধে প্রচুর প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যেগুলি অনেকাংশেই গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। এ ছাড়া আরও অনেক ব্যক্তি এই বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন—অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল মওদুদ, উমাপদ রায়, এম. আবদুর রহমান, কালীমোহন ঘোষ, গৌরীশ্বর ভট্টাচার্য, জলধর সেন, তারাপদ সাঁতরা, দীনেশচন্দ্র সরকার, দুর্গেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, পঞ্চানন মন্ডল, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক। বর্তমানে শুচিব্রত সেন, দীক্ষিত সিনহা, রেবতীমোহন চক্রবর্তী, প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী, কৃষ্ণনাথ মল্লিক, কিশোরীরঞ্জন দাস, আদ্যাপ্রসন্ন রায়, বিজয়কুমার দাস, শ্রীলা বসু প্রমুখ ব্যক্তিরা বীরভূমের ইতিহাসের নানা অংশের প্রতি আলোকপাতে সদাসচেষ্ট।