প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বাঁকুড়া – শেখর ভৌমিক

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বাঁকুড়া – শেখর ভৌমিক

জ্ঞানকে ক্ষমতার উৎস গণ্য করে ইংরেজরা তাদের ভারতবর্ষ নামে উপনিবেশটির ইতিহাস, ভূগোল, প্রচলিত রাজস্ব ব্যবস্থা, রোগব্যাধি, জলবায়ু, প্রকৃতি গভীরভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে নিখাদ অনুসন্ধিৎসা কতটা আর কতটাই বা দেশটাকে জেনে তাকে আরও ভালোভাবে দোহন করার বাসনা তা আলোচনার জায়গা স্বতন্ত্র। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে একটা উপকার অন্তত হয়েছিল। সাহেবদের হাত দিয়ে আমরা আমাদের চিনলাম। এখানকার মানুষ তার নিজের ইতিহাস আগে লেখেননি তা বলা ভুল। কিন্তু দু-য়ের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে। তা ছাড়া ইংরেজ আমলে এই ধরনের লেখাপত্রের সংখ্যাগত শ্রীবৃদ্ধিও প্রশ্নাতীত। এইসব লেখার আবার একটা নির্দিষ্ট রীতি ছিল এবং সব জায়গায় কমবেশি এই এক পদ্ধতি, ঘরানা অনুসৃত হতে দেখা গিয়েছে। আর এখানে থেকেই জেলাওয়ারি ইতিহাসচর্চার (একে ইতিহাসই বলি) সূচনা।

দেশ স্বাধীন হবার আগে বাঁকুড়া বিষয়ক বইপত্র বা যাবতীয় লেখা ছিল প্রকৃতপক্ষে সরকারি বা আধা-সরকারি প্রতিবেদন। তার একটি বড়ো অংশ আবার গেজেটিয়ার। সেখানে জেলার যাবতীয় তথ্য, যেমন কৃষি, বাণিজ্য, ইতিহাস, দ্রষ্টব্য স্থান ইত্যাদি পরিবেশিত হয়েছে। বাঁকুড়া শহর সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায় ওয়াল্টার হ্যামিলটনের লেখা Geographical, Statistical and Historical Description of Hindoostan and the Adjacent Countries (প্রথম খন্ড, লণ্ডন, ১৮২০) গ্রন্থে। জেমস গ্যাস্ট্রেল সাহেবের লেখা Statistical and Geographical Report of the District of Bankura (কলকাতা, ১৮৬৩) বইতে জেলার দুই প্রধান শহর বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়ার জনসংখ্যা, নদী-নালা, হ্রদ, ভৌগোলিক অবস্থা, চাষাবাদ, রাজস্ব ব্যবস্থা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। হান্টারের A Statistical Account of Bengal (চতুর্থ খন্ড, লণ্ডন) প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। এখানেও জেলার কৃষি, শিল্প, জনগণের পেশা, তাদের অবস্থা, পথঘাট, পাহাড়, জঙ্গল, বনজ ও খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ভূমি রাজস্ব, কারা ও আরক্ষা দপ্তরের পরিসংখ্যান, জলবায়ু, দেশজ গাছপালা, রোগব্যাধি, ভূতত্ত্ব ইত্যাদি খুঁটিনাটি আলোচিত হয়েছে। ১৯০৮ সালে ও’ম্যালির প্রথম গেজেটিয়ারটি প্রকাশিত হয়। আর বাঁকুড়ার দ্বিতীয় গেজেটিয়ার প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে অমিয় ব্যানার্জির হাত দিয়ে। ১৯২৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় এফ. ডব্ল্যু. রবার্টসনের লেখা Final Survey and Settlement Operations in the District of Bankura। নাম থেকে যার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। এই বইতে মানুষজন, তাদের প্রকৃতি, ধর্ম, জাতি, আর্থিক অবস্থা, দুর্ভিক্ষ, অভাবের কারণ, জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রধানত সাঁওতালদের নিয়ে লেখা হলেও এম. সি. ম্যাকআলপিনের Report on the Condition of Sonthals in the Districts of Birbhum, Bankura, Midnapore and North Balasore (কলকাতা, ১৯০৯) বইটিতে জেলার দক্ষিণ ও পশ্চিমভাগের বিভিন্ন থানা এলাকায় শুঁড়ি ও তাম্বুলি আড়তদার-মহাজনদের কথা, কোথায় কোথায় ধোপা ও তাঁতি সম্প্রদায়ের মহাজনরা ছিলেন তেমন দু-চারজনের উল্লেখ বা পোদ্দারদের কথা রয়েছে।

বেসরকারি উদ্যোগে লেখা সেকালের কোনো কোনো ইংরেজের লেখাতেও প্রসঙ্গক্রমে বাঁকুড়া এসেছে। ভূতত্ত্ববিদ ভি. বল-এর লেখা Jungle Life in India:Or, the Journeys and Journals of an Indian Geologist (লণ্ডন ১৮৮০) বইতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-পরবর্তী সময়ে খাতড়া-সহ বাঁকুড়ার কয়েকজন জমিদারের কথা আছে। ঠিক যেমন এদেশে কর্মরত কেরানি চালস পার্কস-এর স্ত্রী ফ্যানি পার্কস-এর লেখা Wanderings of a Pilgrim, in Search of the Picturesque, during four and twenty years in the East with revelations of life in the zenana Vol. I, (লণ্ডন ১৮৫০) বইতে বাঁকুড়ার কথা আছে। খুব ভালো কথা অবশ্য বলেননি লেখিকা—বলছেন বাঁকুড়ার বদনাম আছে। এখানে গেলেই ঘোড়া কোমরের দিকে দুর্বল হয়ে পড়ে।

সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে লেখা সাহেবি প্রতিবেদনের বাইরে প্রথম যে বঙ্গসন্তানের লেখায় (অবশ্য ইংরাজি ভাষায়) বাঁকুড়ার কথা পাই তিনি ডিরোজিও-শিষ্য হরচন্দ্র ঘোষ। তিনি একটি বিবরণী লিখেছিলেন ১৮৩৮ সালে। লেখাটির নাম A Topographical and Statistical Sketch of Bankoorah। এখানে প্রথম বাঁকুড়া শহর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তথ্য পাওয়া গিয়াছে। যেমন শহরের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া ৩৫ ফিট প্রশস্ত রাস্তা, জেল, হাসপাতাল, বিচারকজের আবাস, ফৌজদারি কাছারির কথা, শহরের ৫৬টি পাকাবাড়ি-সহ মোট ১,৫৯৮টি বাড়ি ও ৫৪০টি দোকানের কথা, গৃহকরের পরিমাণ এবং আনুমানিক জনসংখ্যা, তার কতজন মুসলমান ইত্যাদি বেশ কিছু তথ্য লেখাটিতে পাওয়া যাচ্ছে।

বিদেশি শাসকের ভাষাতেই আরও একজন মানুষ তার নিজের জেলার প্রাক-ঔপনিবেশিক দেশীয় শাসকের ইতিহাস লিখেছিলেন। কলকাতা থেকে ১৯২১ সালে প্রকাশিত অভয়পদ মল্লিকের এই বইয়ের নাম History of Bishnupur Raj। মল্লদের উত্থান থেকে অবক্ষয় পর্যন্ত দীর্ঘ ইতিহাস-সহ মল্ল প্রশাসন, সভ্যতা, শিল্প, শিক্ষা, মন্দিরবৃত্তান্ত এবং উৎসব-পার্বণের কথা রয়েছে এখানে। বাংলা ভাষায় বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস প্রথম পাওয়া গেল ফকিরদাস চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘বাঁকুড়া জেলার বিবরণ’ রচনাটিতে। সাহিত্য-সংহিতা পত্রিকায় ১৩১২ সালে দুই কিস্তিতে (ফাল্গুন ও চৈত্র) লেখাটি প্রকাশিত হয়। বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের পাশাপাশি কয়েকটি সামাজিক বিষয় এবং জেলার উৎসব-অনুষ্ঠানের কথা এখানে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

কেঞ্জাকুড়ার রামানুজ করের লেখা বাঁকুড়া জেলার বিবরণ গ্রন্থটি বাঁকুড়া থেকে প্রকাশিত হয় ১৩৩২ সালে। বহু জায়গায় গেজেটিয়ার বা জনগণনা প্রতিবেদনের বঙ্গানুবাদ বলে মনে হলেও বইটিতে অভিনবত্ব রয়েছে। বইটি একজন ভারতবাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। সেই সঙ্গে রচনায় কোম্পানির বিরুদ্ধে এবং বিষ্ণুপুর জমিদারির প্রধান ক্রেতা বর্ধমানরাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ভাষায় কোম্পানির রাজস্ব বিধানে ‘স্বাধীনতার লীলাভূমি মল্লভূম হতশ্রী’। আবার বর্ধমান রাজ বাঁকুড়া জেলা থেকে ‘গত ১১৮ বৎসরে’ দু-কোটি টাকা নিয়ে গেলেও প্রজাদের মঙ্গলের জন্য তিনি কোনো দিন এককালীন ৫,০০০ টাকা দান করেননি বলে রামানুজ কর দুঃখপ্রকাশ করেছেন। ঋণগ্রস্ত ছাতনা, রায়পুর, অম্বিকানগর জমিদারির কথাও তিনি লিখেছেন। তাঁর রচনায় জেলা স্কুল, বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজ সম্পর্কে বেশ কিছু মূল্যবান আলোকপাত করা হয়েছে। সমবায় সমিতি, মহন্ত, সোনামুখীর ‘পাগল হরনাথ’, জেলার নানাস্তরের কিছু বিশিষ্ট মানুষ সম্পর্কে পরিচিতি, পার্বণ, মেলা ও সংবাদপত্র-সহ জেলার বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীদের নাম ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা তাঁর গ্রন্থটিতে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে।

রামানুজ অবশ্য এই বই প্রকাশিত হবার বছর ১২ আগে, ১৩২১ সালে তাম্বুলি পত্রিকা-র কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘কেঞ্জাকুড়ার ইতিহাস’ নামে ছাতনা থানার অন্তর্ভুক্ত তার নিজ গ্রামের একটি ছোটো ইতিহাস লেখেন। গ্রামের ইতিহাস আরও একটি লেখা হয়েছিল। বাঁকুড়া শহর থেকে ১৩৪৮ সালে সংলগ্ন শানবান্দার ইতিহাস ছাপা হয়েছিল শানবান্দা গ্রামের ইতিবৃত্ত নামে। লেখক বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের অধ্যাপক শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিজের জন্মস্থান এই গ্রামে। গ্রামের কয়েকটি পরিবারের ইতিহাস এখানে রয়েছে, যাদের অনেক ঔপনিবেশিক বাঁকুড়া শহরে বিশিষ্ট বলে পরিচিত ছিলেন।

১৩৩৬ সালে বাঁকুড়া থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সুধীরকুমার পালিতের লেখা পালিতের বাঁকুড়ার ভূগোল ও ইতিবৃত্ত। এই বইয়ের বিশেষত্ব এই যে, জেলার তৎকালীন সমস্ত থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের নাম, সংখ্যা এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত গ্রামের সংখ্যা এখানে পরিবেশিত হয়েছে। বাঁকুড়া জেলার উল্লেখযোগ্য রাস্তা, মটর সার্ভিস, শিল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ইত্যাদি বিষয় লেখক উল্লেখ করেছেন।

১০ বছর পর ১৯৩৯ সালে আরেকটি বই প্রকাশিত হয় বাঁকুড়া জিলা : ভূগোল ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ নামে। লেখক জনৈক কালীকান্ত রায়। বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ-এ বইটির খবর রয়েছে। সন্ধান পাওয়া যায়নি। পৃথক বই আকারে না হলেও বইয়ের কোনো কোনো অংশে বাঁকুড়ার প্রসঙ্গ আছে অনেকের লেখায়। যেমন যদুনাথ সর্বাধিকারীর তীর্থ-ভ্রমণ-এ (নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৩২২), কোতলপুর, বালসীর ‘তেলিদিগের বাটীতে…লক্ষ্মীনারায়ণ শিলা’র কথা, পাত্রসায়েরে স্কুলের কথা, সোনামুখির কথা আছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঁকুড়া বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। যেমন অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি (কলকাতা, ১৯৭১), বাঁকুড়ার মন্দির (কলকাতা, ১৩৭১), ডেভিড ম্যাককাচ্চন লিখিত The Temples of Bankura District (কলকাতা, ১৯৭২), মানিকলাল সিংহের পশ্চিমরাঢ় তথা বাঁকুড়া সংস্কৃতি (বিষ্ণুপুর, ১৩৮৪), অনুকূলচন্দ্র সেন-এর বাঁকুড়া পরিক্রমা (কলকাতা, ১৩৭৬) ইত্যাদি। মানিকলাল সিংহের বইতে মল্লভূমের সাহিত্য, কয়েকটি উৎসব, বিষ্ণুপুরী তাস, বিষ্ণুপুরের রাজাদের আনুকূল্যে রাজকার্যে নিয়োজিত থাকা কয়েকটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের কথা, প্রত্নতত্ত্ব ও অন্যান্য বিষয়, বিষ্ণুপুর ছাড়া আরও কয়েকটি অঞ্চলের কথা প্রকাশিত হয়েছে। শেষের গ্রন্থটি গেজেটিয়ারের আদলে রচিত। জেলার আদি ইতিহাস থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, লোকদেবতা, বৈষ্ণবধর্মের প্রসার, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে।

বিষ্ণুপুরকে নিয়েও কম বই লেখা হয়নি। গঙ্গাগোবিন্দ রায় রচিত মল্লভূম কাহিনী (বিষ্ণুপুর, ১৯৫৫), চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তের বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা (বিষ্ণুপুর, ১৩৮৬) বা ফকিরনারায়ণ কর্মকারের বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী (কলকাতা, ১৩৭৪), গুরুপ্রসাদ কর্মকারের মল্লসংস্কৃতির পটভূমিকায় বিষ্ণুপুরের রাসোৎসব (বিষ্ণুপুর, ১৯৮০) উল্লেখযোগ্য। গবেষণামূলক গ্রন্থের সংখ্যা দু-টি—তারাশঙ্কর পাণিগ্রাহীর The British Rule and the Economy of Rural Bengal : A Study of Mallabhum from 1757 to 1833 (নয়াদিল্লি, ১৯৮২) এবং প্রভাতকুমার সাহার লেখা Some Aspects of Malla Rule in Bishnupur (1590-1806 A.D.) [কলকাতা, ১৯৯৫]। প্রথম ৪টি বইয়ের নাম থেকে তার বিষয়বস্তু সহজে অনুমেয়। শেষ বইয়ের বিষয় ষোলো শতকে বীর হাম্বিরের রাজত্বকাল থেকে বিষ্ণুপুর বংশের আনুষ্ঠানিক পতন পর্যন্ত তার রাজনৈতিক ইতিহাস। পাশাপাশি কিছু অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় (মন্দির নির্মাণ, সংগীত, লোকসংগীত ইত্যাদি) আলোচিত হয়েছে।

বিষ্ণুপুর নিয়ে নৃতত্ত্ববিদরাও কিছু কাজ করেছেন। অ্যাকস অস্টরের Culture and Power: Legend, Ritual, Bazaar and Rebellion in a Bengali Society (নয়াদিল্লি, ১৯৮৪) ও The Play of the Gods : Locality, Ideology, Structure and Time in the Festivals of a Bengali Town (শিকাগো, ১৯৮০)। দ্বিতীয়টি বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন পুজোপার্বণ বিষয়ক। প্রথমটি বিষ্ণুপুরকে কেন্দ্র করে বাংলার সমাজে কিংবদন্তি, পুজো, উৎসব, সামাজিক স্তর ও বিন্যাস, চিরাচরিত শক্তির অস্তিত্ব ইত্যাদি সন্ধান করতে চেয়েছে। অবশ্যই তাত্ত্বিকতা দু-টি বইতে অধিকমাত্রায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা কুমকুম চট্টোপাধ্যায় এই তালিকায় আরও একটি সংযোজন করেছেন। Indian Economic & Social History Review-তে (Vol. 46, No. 2, 2009) ‘Cultural Flows and Cosmopolitanism in Mughal India : The Bishnupur Kingdom’ নামে তাঁর প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। এই সঙ্গে হিতেশরঞ্জন সান্যালের দু-টি প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি বিষ্ণুপুর সম্পর্কিত। [‘Mallabhum,’ in Surajit Sinha (ed.), Tribal Polities and State Systems in Pre-Colonial Eastern and North Eastern India (কলকাতা, ১৯৮৭)] দ্বিতীয়টি সমগ্র জেলা সংক্রান্ত,—‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন : বাঁকুড়া জেলা’ (স্বরাজের পথে, কলকাতা, ১৯৯৪)। তার বাইরেও বাঁকুড়া জেলা ও জেলার কিছু কিছু অঞ্চল সম্পর্কে অনেকে লিখেছেন, কখনো গ্রন্থাকারে, কখনো বা পুস্তিকা, প্রবন্ধ। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের ছাতনার ইতিহাস বিষয়ক পুস্তিকাটি—স্বর্গাদপি গরীয়সী [সামন্তভূমের ইতিবৃত্ত] (ছাতনা, ১৩৮২)। এই ধরনের লেখা হয়তো সন্ধান করলে আরও অনেক পাওয়া যেতে পারে।

সাম্প্রতিক কালের দু-টি বইতে জেলার ইতিহাস বিশদে আলোচিত হয়েছে। একটির লেখক তরুণদেব ভট্টাচার্য। পদস্থ সরকারি আধিকারিকরূপে বাঁকুড়ায় দীর্ঘকাল ছিলেন। বইটির নাম বাঁকুড়া (কলকাতা, ১৯৮২)। প্রাচীনকাল থেকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার সঙ্গে শিক্ষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও পত্রপত্রিকা-সহ বিভিন্ন বিষয় তিনি আলোচনা করেছেন। কয়েকটি প্রাচীন পরিবারের কথাও লিখেছেন। কিন্তু জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু যে শহরকে কেন্দ্র করে, তার কথা প্রায় অনালোচিত রয়ে গিয়েছে। ভাবতে ভালো লাগছে একালের কোনো কোনো সরকারি প্রশাসকও এই ধরনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছেন। বাঁকুড়া নং ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক হিসাবে একসময় সেখানে ছিলেন সুদীপ্ত পোড়েল। ইতিহাসচর্চার টানে তিনিও একটি বই প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি।

দ্বিতীয় বইটিতে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। বইয়ের নামকরণে অবশ্য মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে—বাঁকুড়াজনের ইতিহাস-সংস্কৃতি (বাঁকুড়া, ২০০০)। লেখক রথীন্দ্রমোহন চৌধুরি দীর্ঘ ৩৬ বছর বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। নানা দিক থেকে এই বইয়ের বিশেষ মূল্য রয়েছে। প্রথমত, আমাদের দেশে আঞ্চলিক ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে জাতীয় ইতিহাসের অনুকরণে। ফলে বহু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাস হয়ে ওঠে জাতীয় ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। বইটি এই অর্থে অনেকটা ব্যতিক্রমী। স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে আলোচনা থাকলেও অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আর্থ-সামাজিক বিষয়ে। এখানে রোগ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, নিম্নবর্গীয় জীবন, জনজীবনে জেলা বোর্ডের অবদান, নতুন সামাজিক শ্রেণি, নীলকর বা মিশনারিদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।

হরচন্দ্র ঘোষের বিবরণী থেকে হিসাব করলে বাঁকুড়া বিষয়ক প্রকাশনার সূচনা ১৮৩৮ সালে। পরবর্তী ১৭১ বছরে এই তালিকা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। সাময়িকপত্রেও উনিশ শতক থেকে বাঁকুড়া নিয়ে লেখা কম নেই। ফকিরদাস চট্টোপাধ্যায়ের কথা আগে বলা হয়েছে। ১৩০১ সালের বাসনা পত্রিকায় (কার্তিক, লেখক অজ্ঞাত) বাঁকুড়ার ইঁদ পরব নিয়ে লেখার কথা মনে পড়ছে। তারও আগে পুরোহিত পত্রিকায় (মাঘ, ১৩০০) অম্বিকাচরণ গুপ্ত লিখেছিলেন ‘বিষ্ণুপুরের প্রাচীন অবস্থা’, নিখিলনাথ রায় লিখেছিলেন ‘শুশুনিয়া শৈলে’ ভারতবর্ষ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩০) পত্রিকায় আর ‘বিষ্ণুপুরের কথা’ লিখেছিলেন পঞ্চপুষ্পয় (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৭)। ‘বিষ্ণুপুরের বিবরণ’ লিখেছিলেন পরমেশপ্রসন্ন রায়, ভারতবর্ষ (আষাঢ়, ১৩২৪) পত্রিকায়। সুপ্রভাত এ ‘বাঁকুড়ার কথোপকথনের বাঙ্গালা’ লিখেছিলেন প্রকাশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (চৈত্র, ১৩১৮)। ব্যোমকেশ মুস্তফী গৃহস্থ (আশ্বিন, ১৩২০) সংখ্যায় লিখলেন ‘বাঁকুড়া জেলার ঐতিহাসিক অনুসন্ধান/আলোচনা’। রামানুজ কর ‘বাঁকুড়া জেলার বিবরণ’ লিখেছেন প্রবাসী পত্রিকায় (চৈত্র, ১৩২৭)। আর ধারাবাহিকভাবে তিনি ১৩৪১-এর অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত ৪টি সংখ্যায় লিখেছেন ‘বর্ত্তমান বাঁকুড়া’। এ ছাড়াও যোগেশ বিদ্যানিধি, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বা হেমেন্দ্রনাথ পালিতের বাঁকুড়া বিষয়ক অজস্র লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রবাসী বা Modern Review-তে। এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এখনও বর্তমান। বাঁকুড়া শহরের বাঁকুড়ার খেয়াল, বাঁকুড়া হিতৈষী, পশ্চিমরাঢ় গবেষণা সাময়িকী কিংবা খাতড়া সমীক্ষা তারই সাক্ষী। এখানে যেসব প্রবন্ধ/নিবন্ধ ফি মাসে প্রকাশিত হয় তা ব্যবহার করে অনেকদূর অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। হিন্দুবাণী পত্রিকায় ১৩৭১-৭২ সালে ধারাবাহিকভাবে শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঁকুড়া সহরের গোড়ার কথা’ নামে যে প্রবন্ধটি লেখেন অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে তেমনটি পেলে উত্তরকালের গবেষকরা বর্তে যেতেন সন্দেহ নেই। একথা অবনী নাগের পারাবত-এ বহুকাল আগে প্রকাশিত মানিকলাল সিংহের লেখাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে একটু আবেগ, স্থানপ্রীতি বর্জন করতে পারলে, আর একটু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে লিখলে, ক্ষেত্র-সমীক্ষায় আন্তরিক থাকলে এইসব লেখা অনেক অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। আগামীদিনে তেমনটি হোক সেটাই কাম্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *