প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বর্ধমান – বারিদবরণ ঘোষ

আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : বর্ধমান – বারিদবরণ ঘোষ

বর্ধমানে পড়তে এসেছিলাম স্কুলের গন্ডি পার করে। সেই জড়িয়ে গিয়েছিলাম। শেষের দিকে উচ্চশিক্ষা এখানেই। বড়ো হয়ে বসবাসও। বিধিবদ্ধভাবে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আমি দলের ঊর্ধ্বে থাকতে চেয়েছি। বহুজনই আমাকে তাঁদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন নিজ গুণে। সে কী স্মরণযোগ্য ইতিবৃত্ত। বর্ধমান ছেড়ে চলে এসেছি সাংসারিক প্রয়োজনে। তবুও যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি, শিথিল হয়েছে বটে। যখন চলে এসেছি তখন প্রতিষ্ঠানগতভাবে আমাকে আনুষ্ঠানিক স্মরণ করেছেন, আমাদের বর্ধমান সুপার ট্রেনের নিত্যযাত্রী বন্ধুবর্গ এবং সৌরভ গোষ্ঠী। সেই সম্মাননা আমাকে কৃতজ্ঞ রেখেছে। তারই অনুক্রমে এখানে এসেছি। এই অনুষ্ঠানে আমার পাঠ্যাংশ অগৌণ এবং বিরক্তি উদ্রেককারী। কিন্তু এটিকে আমার কৃতজ্ঞতা নিবেদনের অঙ্গ ভেবে মার্জনা করতে পারবেন সহজে।

বর্ধমানে থাকতে থাকতে বর্ধমানের ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহল জাগত মাঝে মাঝে। বর্ধমান বইমেলার উদ্যোগে বর্ধমান ইতিহাস রচনার প্রকল্পে জড়িয়ে পড়ি। নানান বই পড়ার আগ্রহ জাগে। কিন্তু ইতিহাস রচনার ইচ্ছা জাগেনি, অধিকারের বাইরে বলে। কিন্তু অগৌণে লক্ষ করে গেছি একদল মানুষ তাদের ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানগত উদ্যোগে এই ইতিহাসচর্চার উপকরণ সংগ্রহ করে চলেছেন। অনেক বই বের হয়েছে—কিন্তু কেউই দাবি করবেন না যে তিনি সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তকার। তা সম্ভবপরও নয়। এই যেমন, জনপদবাসীদের জীবনযাত্রার ইতিবৃত্ত প্রায় কোনো বইতে ধরা পড়েনি। বড়ো মানুষের, খ্যাতিমান মানুষের ইতিহাসই ইতিহাস নয়—তৃণমূল স্তরে মানুষের ইতিহাস কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইংরেজরা কিছুটা চেষ্টা করেছেন। হান্টারের রুরাল বেঙ্গল তার উদাহরণ। পাদ্রি লালবিহারী দে তাঁর বেঙ্গল পেজান্টস লাইফ বা গোবিন্দ সামন্তে এর উপকরণ রেখে গেছেন। এই সব কথা মনে হয়েছে পূর্ণতর ইতিহাস যাঁরা লিখবেন অথবা লিখেছেন, তাঁরা আরও লিখবেন—তাঁদের কথা ভেবেই।

এই মঞ্চে কোনো উপদেশ দেওয়ার অবকাশ বা সামর্থ্য কিছুই নেই। আসলে এইটুকুই আমার কথা। বাকি যা বলব তা আর শোনবার মতো নয়। তবে অশ্রাব্যও নয়। কারণ একে ইতিহাস, তার ওপরে ইতিহাসের ইতিহাস। গোদের ওপর বিষফোঁড়া। তবে যতটা নীরস প্রতীয়মান হচ্ছে, ততটা বোধকরি নয়। কারণ এই ইতিহাসে অংশ নিয়েছেন যেমন ব্যক্তিগত মানুষ তেমনি সংবাদ ও সাময়িক পত্র। তেমনি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান—সরকারি ও বেসরকারি এবং দুই-ই। বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক স্মরণিকাও ইতিহাসের উপকরণ জুগিয়েছে। একটা কথা আমার আগেই বলে নেওয়া উচিত। আমি এমন কোনো গ্রন্থপঞ্জি রচনা করছি না যে, যেখানে বর্ধমানের কথা আছে, তারই নাম উল্লেখ থাকছে। ধরা যাক মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদার শের আফগানের কথা লিখেছেন; স্বভাবতই সেখানে বর্ধমানের প্রসঙ্গ আসবেই। আমি এমনতর বইপত্রের নামোল্লেখ করছি না। আবার এমন স্মৃতিকথা যদি পাই, যার মধ্যে বর্ধমানের কথা নানা ভাবে এসেছে—তাকে তো বাদ দিতে পারিনে। আর একটা জরুরি কথা বলে নিই। আমি ঐতিহাসিক নই, ইতিহাসে ইতিবৃত্তে অনুরাগ আছে মাত্র। হয়তো আমার তালিকায় কারো নাম বা কোনো বইয়ের নাম উল্লেখিত হল না। সেক্ষেত্রে আমার অক্ষমতাকে তিরস্কার করবেন, কাউকে অবহেলা-অমর্যাদা করছি এমনটি ভেবে নেবেন না। এটি একটি খসড়া যার ওপর খবরদারি করা যাবে যথেচ্ছ। এবং চাইছি তা থেকে পূর্ণতর তথ্য এবং সংবাদ বেরিয়ে আসুক। কাঠামো করার দায়িত্ব নিয়েছি—প্রাণপ্রতিষ্ঠা করুক ভবিষ্যত উদ্যোগ।

বর্ধমান নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রায় দেড়-শো বছর ধরে ক্রমবর্ধমান লক্ষ করেছি। প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু বাইশ খন্ডে বাংলা ভাষায় রীতিমতো বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন (রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের নামও এই প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য) ১৮৮৬ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে। এর সপ্তদশ খন্ডে আছে ‘বর্ধমান’ প্রসঙ্গটি। রয়্যাল সাইজের ঢাউস বইয়ের ৬২৬-৬৩৭ পৃ. জুড়ে। এ ছাড়া রানিগঞ্জ, কাটোয়া ইত্যাদির পৃথক ভুক্তি আছে। উল্লেখ্য, পূর্ববাংলার রেলপথের সূচনায় হাওড়া থেকে কানু জংশন পর্যন্ত ট্রেন চলেছিল ১৫ আগস্ট ১৮৫৮ তারিখে। এই যে কানু জংশন, এখন যার নাম খানা জংশন—তার উল্লেখ রয়েছে বিশ্বকোষে। মজার ব্যাপার, যে উগ্রক্ষত্রিয়েরা বর্ধমানে উগ্র বচনে সমুপস্থিত এখন—তাদের নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই এই বইতে।

নগেনবাবুর কথা যখন উঠলই তখন আর একটা কথা সেরে নিই। এঁর সম্পাদিত বর্ধমানের ইতিকথা (প্রাচীন ও আধুনিক) প্রকাশিত হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। এই কালের মধ্যে বর্ধমান দেবগ্রাম থেকে ছড়া সংগ্রহ করে কুঞ্জলাল রায় ১৩০৩ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। স্বয়ং নগেন্দ্রনাথ লেখেন কাশীরাম দাসের জন্মস্থান, বর্ধমানের কথা, এবং বর্ধমানের পুরাকথা যথাক্রমে ১৩১৯ ও ১৩২২ বঙ্গাব্দে দু-টি। ১৩২২ (ইং ১৯১৫) বঙ্গাব্দে রাখালরাজ রায় লেখেন ‘বর্তমান বর্ধমান’ নামে একটি প্রবন্ধ। আসলে ১৩২২ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি বর্ধমানচর্চার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হয়েছিল। এর একটা কারণ ছিল—এই সময় বর্ধমানে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের একটি বিশেষ অধিবেশন হয়েছিল, নগেন্দ্রনাথ যার ইতিহাস শাখার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি রাখালরাজ এবং নিজের প্রবন্ধ-সহ আরও কয়েকটি প্রবন্ধ সংগ্রহ করে তৎসহ নিজে বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে তার ইতিহাস সংগ্রহ করে এই বইটি প্রকাশ করেন। বর্ধমানের ইতিহাসচর্চার প্রথম যুগে প্রকাশিত বইটি নিজেই ইতিহাস হয়ে গেছে। দুষ্প্রাপ্য এই বইটিতে উজানি ও মঙ্গলকোট নিয়ে লিখেছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিদাস পালিত ও মণীন্দ্রনাথ বসুর মতো কৃতবিদ্য ব্যক্তিরা। অম্বিকাচরণ ব্রহ্মচারী লিখেছেন ‘শূরনগর’ প্রবন্ধ (এর পরিচিতি নাম শুউরো) এবং নগেন্দ্রনাথ কাঁটোয়া, দাঁইহাট, বিল্লেশ্বর ও কুলাই, কেতুগ্রাম, অট্টহাস, অগ্রদ্বীপ, ঘোড়াইক্ষেত্র এবং বিক্রমপুর নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষামূলক নিবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা ভূমিকার অংশ-বিশেষ উদ্ধার করেছি—এটি অবধানযোগ্য :

যে বর্ধমান সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন হইয়াছে—এই বর্ধমান কতদিনের? কোন সময় হইতে বর্ধমান নামকরণ হইয়াছে? বর্ধমানের কোন অংশ সর্বপ্রথম সভ্যতার আলোকে আলো প্রবেশ করে? কোন কোন স্থান প্রাচীন ও অতীত গৌরবের নিদর্শন? বর্তমান তাহার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিবার জন্য বর্ধমানের অভ্যর্থনা সমিতি আমার উপর ভারার্পণ করেন। আমিও সমিতির আহ্বান শিরোধার্য করিয়া প্রথমে বর্ধমান জেলার পূর্বাংশ পরিদর্শনে বাহির হই। কিন্তু যে যে স্থান দর্শন করিব আশা করিয়াছিলাম দৈব বাধা বিপত্তিতে ও সময়াভাবে তাহার অনেকস্থান দেখিবার সুযোগ ঘটে নাই।

উল্লিখিত ১৩২২ থেকে তিনি যেসব গ্রাম ঘুরেছিলেন তা সূচিতে পেয়েছি। একাজে বর্ধমানের মহারাজ ও অগ্রদ্বীপের জমিদার রমাপ্রসাদ মল্লিক নিজেদের হাতি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এই বইটিকে আমরা বিশ শতকে বাংলা ভাষায় বর্ধমানের বিধিবদ্ধ ইতিবৃত্ত রচনার প্রথম উদ্যোগ বলে সম্ভবত চিহ্নিত করতে পারি। লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই কাটোয়া বানান তিনি লিখেছেন কাঁটোয়া, কারণ কণ্টকনগর থেকে এর উৎপত্তি। এই সময় বর্ধমান রাজ এস্টেটের ম্যানেজার বনবিহারী কাপুরের প্রবর্তনায় রাখালদাস মুখোপাধ্যায় লিখেছেন বর্ধমান রাজবংশের কাহিনি ‘রাজবংশানুচরিত’—বর্ধমানরাজ ইতিহাসের একটি অংশকে মাত্র নিয়ে।

নগেন্দ্রবাবু বর্ধমানের বাইরের লোক ছিলেন—হুগলি মাহেশ তাঁর আদিনিবাস হলেও তিনি পুরোদস্তুর ‘কলকাত্তাইয়া’ ছিলেন। অন্যদিকে বলাই দেবশর্মা খাঁটি বর্ধমানের খাঁটি লোক ছিলেন। আমার তারুণ্যে তাঁকে আমি বর্ধমান শহরে ময়ূরমহলের বাড়িতে দেখেছি। তাঁর লেখা তথা বর্ধমানের মানুষের কথা, বর্ধমান ইতিহাস সম্পর্কিত এই বর্ধমানের ইতিহাস আমার সংগ্রহে রয়েছে। এটিও দুষ্প্রাপ্য তালিকাভুক্ত হয়ে পড়েছে। তাঁকে এই ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তৎকালীন বর্ধমান জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ও সম্পাদক বিজয়কুমার ভট্টাচার্য এবং নারায়ণ চৌধুরি। বিজয়বাবু কলানিকেতনের এবং নারায়ণবাবুও বর্ধমানের ইতিহাস রচনার অন্যতম পুরোধা পুরুষ। নগেনবাবুর বইটি ছিল প্রবন্ধ সংকলন—বলাইবাবুর বইটি বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসচর্চার নিদর্শন। বলাইবাবুর আর্য্য ও শক্তি পত্রিকায় বর্ধমান নিয়ে কত লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলির সংকলন হয়নি কেন জানি না। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে দৈনিক বসুমতীতে তিনি বর্ধমানচর্চার যে সূত্রপাত করেছিলেন তাই পরে তাঁকে গ্রন্থ রচনায় প্রেরণা দেয়। প্রাচীন ও আধুনিক বর্ধমানের বিবিধ প্রসঙ্গ তাঁর বইতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে স্বাধীনতার আন্দোলনে বর্ধমানের ভূমিকার প্রসঙ্গই। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের শিষ্যের পক্ষে এইটা স্বাভাবিক ছিল। সব বইয়েরই দীর্ঘ সুদীর্ঘ আলোচনা তো করা যাবে না—অতএব প্রসঙ্গান্তরে যেতেই হয়।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাঁরা বর্ধমান-ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেছেন তার তালিকা সুদীর্ঘ। প্রবন্ধ-তালিকায় আমি যাব না, প্রকাশিত গ্রন্থাদির উল্লেখ আমি করছি। যে নারায়ণ চৌধুরির কথা একটু আগে বলেছি তিনি অনুকূলচন্দ্র সেনের সঙ্গে যুগ্মভাবে বর্ধমান পরিচিতি রচনা করেন ১৯৬৬-৬৭ সালে। বর্ধমানের ইতিহাস লেখা আরও সংঘবদ্ধ রূপ পেলেও সেই বড়ো আকারের বইটিও আমি আর চোখে দেখি না।

অভাববোধ চলছিল, এহেন সময় সুধীরচন্দ্র দাঁ বর্ধমানচর্চার একটি প্রশস্ত আঙিনার সন্ধান দিলেন। অধৈর্য হবেন না, তাঁর আগে আগেই অভিযান গোষ্ঠী এগিয়ে এসেছেন—কিন্তু তার কথা বলব প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ পর্বে—এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগ পর্বে আমরা রয়েছি। সুধীরবাবু (আর এক সুধীরবাবুর কথা মনে পড়ছে—প্রয়াত সুধীর অধিকারী, বর্ধমানচর্চায় তাঁরও ভূমিকা স্মরণযোগ্য ছিল) একক উদ্যোগে বর্ধমানের ইতিহাস লিখেছেন, বর্ধমান পরিক্রমা—১৯৯২ সনে। তিনি অনেক গ্রহণ করেছিলেন, কিছু বর্জনও। কিন্তু পূর্ণাঙ্গতার রূপ পেল, অনেক আলোচিত রাঢ় প্রসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হল শিক্ষার আন্দোলনও। তিনি থেমে থাকেননি, পরে পরে লিখেছেন—যেমন বর্ধমানের বড়মানুষ। তাঁর রাঢ় সংস্কৃতি পরিষদ থেকে প্রকাশ পেয়েছে এটি ১৯৯৮ সালে। রামাই পন্ডিত থেকে হরেকৃষ্ণ কোঙার—প্রায় ৯০ জন বর্ধমান সন্তানের জীবনী লিখে জীবনী-ভিত্তিক ইতিবৃত্ত এগিয়ে এনেছেন। তাঁর লেখা আরও একটি বই দেখেছি—ডিভিসি পঞ্চাশ বর্ষ:প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি—বর্ধমান ইতিহাসের অংশবিশেষ।

তাঁর সময়, প্রায় একক উদ্যোগে বর্ধমানের ইতিহাস রচনা করে চলেছিলেন যজ্ঞেশ্বর চৌধুরি। তাঁর তিন খন্ডে প্রকাশিত বর্ধমান : ইতিহাস ও সংস্কৃতি যখন খন্ডে খন্ডে প্রকাশিত হচ্ছিল ১৯৯০-৯৪ কালপর্বে, আমাদের মনে হয়েছিল, হ্যাঁ এবারে প্রার্থিত বইটিই পেলাম। অধ্যবসায়, নিষ্ঠা এবং সততার সমন্বয়ে রচিত একটি ঐতিহাসিক ইতিহাসগ্রন্থ। কিন্তু এর পরেও আমাদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মূল্যবান কাগজে সুমুদ্রণে, চিত্রাবলি সম্পদে দুই খন্ডে প্রকাশিত হল একনিষ্ঠ গবেষকের চল্লিশ বছরের ফসল—এককড়ি চট্টোপাধ্যায়ের বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোক সংস্কৃতি অক্টোবর ২০০১ সালে। বইটিকে আমার পড়ার টেবিলের সামনেই সযত্নে রাখি আর হারিয়ে যাই আমার ৪৭ বছরের বর্ধমানের নানা রঙের স্মৃতিতে। জানতে চাই জানতে পারি এই কোষগ্রন্থ থেকে কত জিজ্ঞাসার উত্তর। মনে মনে এঁদের সবাইকে প্রণাম জানাই। একটাই আক্ষেপ, আমার আস্বাদটুকু রচনায় আপনাদের আমি সঞ্চারিত করতে পারছি না সময়াভাবে। ভরসা, পরের মুখে ঝাল না খেয়ে আপনারাই স্বাদ গ্রহণে তৎপর হবেন।

এবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রচিত কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করি। যদিও বর্ধমান-কেন্দ্রিক নয়, তবুও অনেকখানি বর্ধমান জুড়ে রয়েছে বর্ধমানের মাস্টারমশাই সুকুমার সেনের দিনের পর দিন যে গেল স্মৃতিচারণ গ্রন্থে। বিশেষ করে প্রথম খন্ডে। অতীত বর্ধমানের অনেক কথা। এখানকার বর্ধমান সিনেমা, লাইব্রেরির কথা, বর্ধমান স্টেশনে রবীন্দ্রনাথকে দেখা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ। তাঁর ভাই সুশীলকুমার সেনও দু-টি বই উপহার দিয়েছেন। প্রধানত স্মৃতিকে কেন্দ্র করে বর্ধমানের কথা (১৪০১ বঙ্গাব্দ) এবং পুরানো বর্ধমানের কথা (১৪০৩ বঙ্গাব্দ)। যেখানে ১৯৪২-এর বর্ধমান, বর্ধমানে ফুটবল খেলার আদিপর্ব, বীরহাটা-কালীতলা অঞ্চল ইত্যাদি নিজের চোখে দেখা ব্যাপারগুলো উঠে এসেছে। মূল্যবান কিছু ছবি আছে—ছাপার নিচুমানের কারণে গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। ভব রায় মশাই তাঁর সরগ্রাম শ্রীপাট নিয়ে যেমন একটি গ্রামকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন, তেমনি তাঁর রাঢ় বাংলার মাটি মানুষ ও সংস্কৃতিতে উঠে এসেছে বর্ধমানের একটি সাংস্কৃতিক ইতিহাস, যেখানে তিনি তৃণমূলীয় মানুষকে ধরার সাধু প্রয়াস পেয়েছেন। সৈয়দ বসিরুদ্দোজা প্রধানত বর্ধমানবাসী ডোকরাদের জীবন নিয়ে লিখেছেন রাঢ়ের শিল্প ডোকরা। বর্ধমানের গৌরবকাহিনী লিখেছেন সলিল মিত্র, বর্ধমানের দেব-দেবীদের নিয়ে সচিত্র বই লিখেছেন নীরদবরণ সরকার নগর বর্ধমানের দেবদেবী (১৯৯১)। তাঁর আর একটি বই প্রাচীন বর্ধমানের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনা। বই দু-টির নাম থেকেই বোঝা যায় তিনি অধ্যাত্ম-বর্ধমানের আত্মাকে বুঝতে চেয়েছেন। সংস্কৃতির আলোকে বর্ধমান একাধিক খন্ডে লিখে বর্ধমানের আজকের মানুষদের কথা বলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন জয়ন্ত সোম—ভবিষ্যৎ ইতিহাসের উপকরণ হয়ে রয়েছে এটি। বইটি তাঁর যোগাযোগের ফসল। আর স্মৃতিমূলক রচনায় বর্ধমানের সংগীত ও ক্রীড়াজগতের অংশবিশেষ ধরা পড়েছে স্মৃতিসত্তার বর্ধমান বইটিতে। ২০০১-এর এমন এক আগস্টেই এ বইটি প্রকাশ করেছিলেন রাখহরি সরকার। বর্ধমানের ইতিহাসের একটা বড়ো অংশ লুকিয়ে আছে বর্ধমান থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার মধ্যে। তার একটি মনোরম ইতিবৃত্ত ধরা আছে কবিতা মুখোপাধ্যায়ের বর্ধমানের সাময়িক পত্র মননের দর্পণে (১৯৯৬)। এ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে বর্ধমানের ইতিহাসচর্চাকে এখনও পূর্ণাঙ্গতর করা যেতে পারে। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য বরাবরই বর্ধমান বিষয়ে উৎসাহী। তাঁর বর্ধিষ্ণু বর্ধমান:জেলাভিত্তিক ইতিহাস (১৯৯৮) বৃহত্তর বর্ধমানের ইতিবৃত্ত। গোটা বর্ধমান জেলার মেলাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিটি কেউ যাদি জানতে চান তাঁকে পড়তে হবে ড. গোপীকান্ত কোঙারের বর্ধমান জেলার মেলা:সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা (১৯৮৭)। তার সম্পাদনায় এখন প্রকাশিত হয়েছে বর্ধমান সমগ্র (২০০০)। বর্ধমান পরিচিতি লিখেছেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য এবং বর্ধমান জেলার নদনদী নিয়ে লিখেছেন ননীগোপাল দত্ত। দ্বিতীয় বইটি একটু যাকে বলে non-conventional জল মাটির বর্ধমান এখানে ধরা পড়ে গেছে। বর্ধমান রাজসভাশ্রিত বাংলা সাহিত্য (১৯৯১) রচনা করে একদা সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ড. আব্দুস সামাদ এবং এই বিষয়ে এই ধরনের এইটিই একমাত্র নির্ভরযোগ্য বই। যেমন, একসময় স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে ফকিরচন্দ্র রায়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায় বইটি এই বিষয়ের নির্ভরযোগ্য বই। পড়ে দেখিনি, তবে অনুমান করি—একই বিষয় নিয়ে তিনি একদা লিখেছিলেন First spark of revolution। স্বাধীনতা আন্দোলনের মতোই জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিবৃত্তটি রচনা করে গেছেন সৈয়দ শাহেদুল্লাহ। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত তার বর্ধমান জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত প্রসঙ্গ, এই বিষয়ে আকরগ্রন্থ বিশেষ। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্রের জাল রাজার গল্প, পড়তে গিয়ে অবশ্যই আবার পিছিয়ে যেতে হয় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জাল প্রতাপচাঁদ-এ। পিছিয়ে পড়া নয় পিছিয়ে গিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো ইতিহাস। সঞ্জীববাবুই বর্ধমানকে নিয়ে অতএব ভাবুকদলের প্রথম।

বর্ধমানের উল্লেখযোগ্য শহর দুর্গাপুর, আসানসোল, কাটোয়া, কালনা নিয়েও কম বই লেখা হচ্ছে না। তাদের সবারটা আমি জানি না। এ আমার দীনতা। যেটুকু জেনেছি তাঁর বেশি কেউ আমাকে জানালে আমার অজ্ঞতার পরিমাণ একটু কমতে পারে। শহর কাটোয়া ও তাঁর সাংস্কৃতিক ইতিহাস লিখেছেন অজয় পত্রিকা-র সম্পাদক তারকেশ্বর চট্টরাজ। কাটোয়া দর্শন লিখেছেন ডা. কালীচরণ দাস। একটু প্রসারিত হয়ে কাটোয়া মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব পরিচয় লিখেছেন মহ. আয়ুব হোসেন। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে যাচ্ছে বঙ্কিম ঘোষের কাটোয়া সম্পর্কিত বই স্বাধীনতা আন্দোলনে কাটোয়া মহকুমা ও সমীর চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধগুলির কথা। কালনার ইতিহাস লিখেছেন তরুণ ভট্টাচার্য। একই নামে একটি বইয়ের লেখক দীপককুমার দাস। কালনার অনতিদূরে পূর্বস্থলি মাদুর শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এই স্থানের ইতিহাস লিখেছেন মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল। তাঁর বইটির নাম বৃহত্তর পূর্বস্থলীর ইতিবৃত্ত। দুর্গাপুর আসানসোল রানিগঞ্জের মন্ডলের বেশ কয়েকটি ইতিহাসের খোঁজ পেয়েছি। ১৯৮৪ সালে দুর্গাপুরের ইতিহাস লিখেছেন প্রবোধ চট্টোপাধ্যায়। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের সাহিত্যচর্চা নিয়ে এবং শিল্পাঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বইয়ের লেখক মধু চট্টোপাধ্যায় কয়লাখনি অঞ্চলের সংস্কৃতির একটা হিসেবনিকেশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে সুশীল ভট্টাচার্য ও ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের লেখালেখির কথাও মনে পড়ে যায়। অগ্নিযুগে রানিগঞ্জ নামের একটি বইতে গোপাল নন্দা এই অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্ত স্মরণ করেছেন। উদয় দাস লিখেছেন রানিগঞ্জের সংস্কৃতি আন্দোলন। আসানসোল নিয়েও একাধিক বই পেয়েছি। শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন আসানসোলের পরিক্রমা। অনেকের লেখা সংকলন করে সম্পাদন পূর্বক আসানসোলের ইতিবৃত্ত প্রকাশ করেছেন নন্দদুলাল আচার্য। এই ফাঁকে গাইড জাতীয় কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করি। এইগুলোর উদ্দেশ্য ইতিহাসচর্চা নয়। কিন্তু আবশ্যিকভাবে এগুলোতে কিছু ইতিহাস উপকরণ থেকে যায়। আসানসোল গাইড যেমন পেয়েছি তেমনি বর্ধমান গাইডও কয়েকটি দেখেছি। একসময় সুধীর অধিকারীর সম্পাদনায় বের হয়েছিল লায়ন্স ডিস্ট্রিক্ট গাইড। উদয়সংঘ একদা প্রকাশ করেছিলেন বর্ধমান পরিচিতি, বর্ধমান সমাচার পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে চলেছে বর্ধমান সহায়িকা। বর্ধমান পৌরসভা প্রকাশ করেছেন দেখি পুরী বর্ধমান। অন্যান্য শহরেও নিশ্চয়ই এই ধরনের বইপত্র আছে। আমি সবগুলির খোঁজখবর পাইনি।

বর্ধমান ইতিহাস রচনায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও লক্ষ করার মতো। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ কাজে উদ্যত হয়ে ইতিহাসচর্চাকে বেগবান করেছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড়ো মাপের উদ্যোগ নেয় বর্ধমান অভিযান গোষ্ঠী। তারা ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে বর্ধমান বইমেলার সময়ে দু-টি খন্ডে বর্ধমানচর্চা প্রকাশ করে সাম্প্রতিককালের বর্ধমান ইতিহাসচর্চায় প্রবল বেগ সঞ্চার করেন। খন্ড দু-টি সম্পাদনা করেন শ্যামাপ্রসাদ কুন্ডু। পরে তাঁরা আরও বিষয়বস্তুর সংযোজন করে একটি খন্ডে বর্ধমানচর্চা প্রকাশ করেন। বর্ধমান ইতিহাসচর্চার প্রধান বইগুলির পাশে সমমর্যাদায় ঠাঁই করে নিয়েছে (২০০১)। বৃহত্তর বর্ধমান এতে অন্তর্ভুক্তি পেয়েছে। এই উদ্যোগের সমান্তরাল উদ্যোগ নিয়ে বর্ধমান ২০০০ নামে একটি সংস্থা কবিতা মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় জনপদ বর্ধমান স্মারক গ্রন্থ প্রথম প্রকাশ করে ২০০০ সালে। পরের বছর এর একটা সংযোজন খন্ড মুদ্রিত হয়। বর্ধমান জেলা পরিষদ, রামসেবক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অমিত সান্যালের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন বর্ধমান জেলার পুরাকীর্তি ও সংস্কৃতি। বর্ধমান জেলা পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি ১৯৬২ সনে একদা প্রকাশ করেন বর্ধমান স্মরণিকা।

স্বভাবতই বেশ কিছু স্মরণিকার কথা আমাদের মনে রাখতে হয়েছে। এগুলিতেও বর্ধমানের ইতিহাসের অজানা উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বর্ধমান পৌরসভা ১৪০৭ সালে প্রকাশ করেছিলেন স্মরণিকা বর্ধমান উৎসব। কালনা পৌরসভা ১৯৯৪ সনে প্রকাশ করেন কালনা পৌরসভা ১২৫ বর্ষ, ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতির ৩৭তম রাজ্য সম্মেলন স্মরণিকা প্রকাশ পায়। ৩৯তম সম্মেলনেও অনুরূপ স্মরণিকা প্রকাশ পায়। বর্ধমান জেলা কংগ্রেস প্রগতির পথে নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছিলেন। বর্ধমান নবাবহাটের ১০৮ শিবমন্দির দ্বিশত বছর উদ্যাপন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থটি পেয়েছি ১৯৮৯ সালে। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুল শতবার্ষিকী স্মরণিকা (১৯৮৩), বর্ধমান রাজ কলেজের স্মারক গ্রন্থ (১৯৮১), পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ৬৮তম সম্মেলন (১৯৯৪) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থগুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগত ইতিহাসচর্চার নিদর্শন। ১৯৬৫-তে প্রকাশিত হয় বর্ধমান পৌর শতবার্ষিকী স্মরণিকা (১৮৬৪-১৯৬৫)। কাটোয়া মহকুমার প্রদর্শনী স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। তবে যে দু-টি স্মরণিকা প্রকৃত পক্ষে বর্ধমানের ইতিকথা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ নিয়ে (এখানে সংযুক্ত কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘বর্ধমান স্টেশনকে’ কবিতাটি ভোলা যায় না) অঞ্চলের ইতিহাসচর্চার বেগ সঞ্চার করেছিল ‘বর্ধমান সম্মেলনী’-র দু-টি স্মরণিকা। এর মধ্যে হীরক জয়ন্তী স্মরণিকাটির (১৯০৭-১৯৫৭) তুলনা হয় না। প্রসঙ্গত এই বর্ধমান সম্মেলনী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩১৪ বঙ্গাব্দে। সৌভাগ্যক্রমে আমার সংগ্রহে এই দু-টি সংখ্যা থাকায় আমি খুব উপকৃত হয়েছি। ১৯৭০ সালে ৩৬তম বঙ্গীয় গ্রন্থাগার সম্মেলন স্মরণিকা উল্লেখ করার মতো। এতসব কথা বলার শেষে যে স্মরণিকাটি শিরোভূষণ হয়ে আছে স্মারক গ্রন্থাদির মধ্যে—সেটি অষ্টম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের স্মরণগ্রন্থটি। বর্ধমান রাজকলেজে এর একটি খন্ড আছে। কৌতূহলীরা দেখে নিতে পারেন। নগেন্দ্রনাথ বসু প্রসঙ্গে এই সম্মেলনের কথা আপনাদের অবগত করিয়ে এসেছি।

সবশেষে আপনাদের কাছে উল্লেখ করি ইতিহাসের সূতিকাগার কয়েকটি পত্রপত্রিকার কথা, যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংখ্যা প্রকাশ করে বর্ধমানের ইতিহাসচর্চাকে মুক্ত প্রবাহমান রেখেছে। এদের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে শতবর্ষ অতিক্রম করে বেঁচে আছে কালনার পল্লীবাসী পত্রিকা। বর্ধমানের পুরোনো এবং আধুনিক বহু পত্রিকার কথা আপনারা কবিতা মুখোপাধ্যায়ের বইটি থেকে জানতে পাবেন। আমি বিশেষ কোনো পত্রিকার তালিকা দিতে চাইছি না—দু-শো ছ-খানি হাড়ের প্রতি আমার মায়া আছে, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে আমি ডর পাই। যার নাম উল্লেখ করব না তিনি অপ্রসন্ন হবেন। এই শনিবারের বারবেলায় সেই কাজটি অতএব করব না। শুধু তাদের পৃষ্ঠাগুলিতে যে বর্ধমানের ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা অনুসন্ধান করে যদি একটি চয়নগ্রন্থ প্রকাশ করা যায় তবে আমরা ঘোড়ার মুখের সংবাদগুলি পেতে পারব। একটি সংখ্যার কথা বলছি কারণ সরকারের ওপর রাগ করে কেউ ভাত খাওয়া বন্ধ করবেন না জানি—পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকার বর্ধমান জেলার সংখ্যাটি।

এর পরে আমাদের বাকি থেকে যাচ্ছে ইংরাজিতে লিখিত বইগুলির হিসাব দিতে। সবচেয়ে পুরনো যে দু-টি বইয়ের উল্লেখ পেয়েছি তা আমাদের খুশি করবে না সম্ভবত। ১৮৫৯ সালে কলকাতা থেকে বের হয় নানান নথিপত্র নিয়ে পাথুরে বর্ধমানের কথা Burdwan Stone Co-operative Limited। এখানে প্রকাশিত হয়েছে Burdwan Fever নিয়ে একটি প্রতিবেদনও। পাথর ও অসুখবিসুখ নিয়ে শুরু, অতএব… Rennels Map of Burdwan Districtও বেশ পুরোনো নথি। সত্যি বলতে ১৯১০ সালে প্রকাশিত পিটারসনের Burdwan Gazetteer-ই বর্ধমান ইতিহাসচর্চার বিধিবদ্ধ প্রথম প্রয়াস। এরই অনুক্রম ১৯১৪ সালে। অশোক মিত্র মশাই (বর্ধমানের বিদ্যালয়ের ছাত্র) Bengal Historical Records—Burdwan (vol-2) এবং District Census Handbook Burdwan, ১৯৫১ রচনা করে কাজটিকে পূর্ণাঙ্গতর করেছেন। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় A short note of the intensive agricultural district programme—Burdwan।

এই ধরনের আর একটি শাশ্বত বই Annual plan of agricultural 1990-2000 : Burdwan District। নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে West Bengal District Records—new series Burdwan 1788-1802 (1905)। District Hand Book of Agricultural Marketing for the District Burdwan (1970)। হান্টারের Statistical Record of Bengal-Burdwan District একটি দামি বই।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বর্ধমান জেলা দফতর ১৯৭২ সালে প্রকাশ করেন Burdwan Brochure for the State Cabinet। বর্ধমান Congress Centenary Committee ১৯৮৫ সালে শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশ করে Burdwan District Centenary Volume। এই সময় ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় ও রমাকান্ত চক্রবর্তীর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় Freedom Movement in Burdwan 1800-1939 বইটি। মনে পড়ে যায় ফকিরচন্দ্রের First Spark of Revolution বইটির কথা। Durgapur Development Committee Administration Report গুলির মতো উল্লেখযোগ্য S. C. Bose-Hl The Damodar Valley Project (1948)। The Antiquities of Katwa Past and Present আঞ্চলিক ইতিহাস দলিল। গৌতম সরকার লিখেছেন ১৯৮৯ সালে Heritage of Burdwan Agro-Economic Perspective। বর্ধমান জেলা সাক্ষরতা সমিতির Momments to Remember বইটি উল্লেখযোগ্য।

পুনশ্চ : ‘বর্ধমান ইতিহাস সন্ধান’ ও সৌরভ গোষ্ঠীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে আমি শেষ করছি।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রাক্তন অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *