আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা : উত্তর চব্বিশ পরগনা – কানাইপদ রায়
প্রাককথন
বিপ্রদাসের মনসাবিজয় এবং আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী, রচিত না হওয়া পর্যন্ত ২৪ পরগনা সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো বিবরণ জানা সম্ভব হয়নি। মনসা-বিজয় কাব্যে (১৪৯৫ খ্রি.) চাঁদ সদাগরের বাণিজ্য যাত্রাপথের বর্ণনা থেকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলের কিছু প্রাচীন জনপদের নাম পাওয়া যায়—কুমারহট্ট, ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, মূলাজোড়, গারুলিয়া, ইছাপুর, বাঁকিবাজার, চানক, বুড়নিয়ার দেশ (টিটাগড়), খড়দহ, সুখচর, কামারহাটি, আড়িয়াদহ প্রভৃতি। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য এইসব জনপদ ধরে ছত্রভোগ হয়ে নীলাচলে গেছেন। আইন-ই-আকবরী (১৫৯৬-৯৭ খ্রি.) গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, তোডরমল্ল কীভাবে সুবে বাংলাকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৯টি সরকার এবং ৬৮২টি মহালে ভাগ করেন। ১৭৭২ খ্রি. মুর্শিদকুলি খাঁ জমি জরিপ করে সারা বাংলাকে ১৩টি চাকলা ও ১৬৬টি পরগনায় ভাগ করেন। ২৪ পরগনা অঞ্চল ছিল সরকার সাঁতগাও’র অধীন। সরকার সাঁতগাও দক্ষিণে সাগরদ্বীপের কাছে হাতিয়াগড় (পরগনা ডায়মন্ড হারবার থেকে সমুদ্র পর্যন্ত), উত্তরে পলাশির উপরভাগ, পূর্বে যশোহরের কপোতাক্ষ নদ এবং পশ্চিমে হুগলির বেশ কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। তখন অবশ্য এই সব অঞ্চল ২৪ পরগনা নামে পরিচিত ছিল না।
পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটার পর ১৭৫৭ খ্রি. ২০ ডিসেম্বর মীরজাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২৪টি পরগনা উপঢৌকন দেয়। এই ২৪টি পরগনা হল—১. আকবরপুর, ২. আমীরপুর, ৩. আজিমাবাদ, ৪. বালিয়া, ৫. বরিদহাটী, ৬. বাসন্দরী, ৭. কলকাতা, ৮. দক্ষিণ সাগর, ৯. গড়, ১০. হাতিয়াগড়, ১১. ইখতিয়ারপুর, ১২. খাড়িজুড়ি, ১৩. খাসপুর, ১৪. মৈদানমল, ১৫. মাগুরা, ১৬. মানপুর, ১৭. ময়দা, ১৮. মুড়াগাছা, ১৯. পৈকান, ২০. পেঁচকুলি, ২১. শতল, ২২. শাহনগর, ২৩. শাহপুর, ২৪. উত্তর পরগনা।
এই ২৪টি পরগনার মধ্যে কলকাতা ছিল অন্যতম। এখান থেকে চলত বাকি পরগনার কাজকর্ম। পরে কলকাতায় ২৪ পরগনা থেকে পৃথক হয়ে যায়। ১৮১৪ খ্রি. XIV রেগুলেশন অনুসারে জনসংখ্যার চাপ কমানো এবং প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ২৪ পরগনা দু-টি জেলায় বিভক্ত হয়—একটি কলকাতার উপকন্ঠের অঞ্চল নিয়ে শহরতলি জেলা—যার মধ্যে ছিল চিৎপুর, মানিকতলা, তাজেরহাট, নওহাজারি এবং শালকিয়া (হাওড়া)। গঙ্গার পূর্ব পাড় ছাড়াও পশ্চিম পাড়ের অংশ শালকিয়া নিয়ে, একজন জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে শহরতলি জেলার কাজ শুরু হয়। ১৮৩২ খ্রিঃ রেগুলেশন VIII অনুসারে শহরতলি জেলার বিলোপ ঘটানো হয়। জেলার রাজস্ব এবং প্রশাসনিক এলাকা মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে ৪৪৪টি এস্টেট ছিল জেলায়। ১৮১৬ খ্রি. বর্ধমান থেকে কিছু এস্টেট স্থানান্তরিত হয়ে এস্টেটের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬৪টি। এই এস্টেটগুলি ১৮৬২ খ্রি. বর্ধমানে স্থানান্তরিত হয়।
বহুদিন পর্যন্ত ২৪ পরগনা জেলা আলিপুর এবং বারাসাত ডিভিশনে বিভক্ত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রথমে দেওয়া অঞ্চল নিয়ে গঠিত হল আলিপুর ডিভিশন এবং নদিয়া ও যশোহরের কিছু পরগনা নিয়ে ১৮৩৪ খ্রি. গঠিত হল বারাসাত যুগ্ম জেলা। ১৮৬১ খ্রি. বারাসাত যুগ্ম জেলা অবলুপ্ত হলে ৮টি মহকুমা নিয়ে ২৪ পরগনা জেলা গঠিত হয়। এই ৮টি মহকুমা হল—ডায়মন্ডহারবার, বারুইপুর, আলিপুর, দমদম, ব্যারাকপুর, বারাসাত, বসিরহাট এবং সাতক্ষীরা।
১৮৬১ এবং ১৮৬৩ খ্রি. সীমানার পরিবর্তন করা হলে হুগলি নদীর পশ্চিমের গ্রামগুলি জেলা থেকে বাদ পড়ল। উত্তর দিকের সীমানা বাড়িয়ে সুন্দরবন (সমুদ্রতীর-সহ) যুক্ত করা হল। ১৮৮২ খ্রি. ২৪ পরগনা জেলা থেকে সাতক্ষীরা মহকুমা বাদ পড়ে তা খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৮৩ খ্রি. বারুইপুর মহকুমা, ১৮৯৩ খ্রি. দমদম এবং ব্যারাকপুর মহকুমা অবলুপ্ত হয়। ১৯০৪ খ্রি. ব্যারাকপুর মহকুমা পুনর্গঠিত হয়।
১৮১৬ খ্রি. IX রেগুলেশন অনুসারে একজন কমিশনার ১৮১৬ খ্রি. থেকে সুন্দরবনের ভূমি রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত ক্ষমতার ভার পান। ১৯০৫ খ্রি. সুন্দরবন অ্যাক্ট পাস হলে ১৮১৬ খ্রি. IX রেগুলেশন বাতিল হয়ে যায় এবং দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয় বাখারগঞ্জ, খুলনা, ২৪ পরগনা জেলার কালেক্টরদের মধ্যে। ফলে ২৪ পরগনা জেলার পরিধি বিস্তৃত হল। কিন্তু এই বিস্তৃতি ছেঁটে দেওয়া হল ১ মার্চ ১৯৮৬ খ্রি.। বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে অখন্ড ২৪ পরগনা থেকে জন্ম নিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। এর সদর হল বারাসাত। নাম উত্তর ২৪ পরগনা হলেও দুই ২৪ পরগনার কোনোটিতে ২৪ পরগনা নেই। তা ছাড়া ২৪টি পরগনার বেশিরভাগই ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। এই জেলার উত্তরে নদিয়া, দক্ষিণে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্বে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে হুগলি নদী। ৪০৯৪ বর্গকিমি জুড়ে এই জেলার লোকসংখ্যা ৮৯৩০২৯৫ জন। মহকুমার সংখ্যা পাঁচ—ব্যারাকপুর, বারাসাত, বসিরহাট, বনগাঁ ও বিধাননগর।
উর্বর সাহিত্যভূমি
বহু সাহিত্যসাধক জন্মেছেন এই জেলায়। আবার এই জেলায় জন্মগ্রহণ না করলেও পরবর্তীকালে এখানে বসবাস হেতু তাঁদের সাহিত্য সম্ভারে উর্বর করেছেন এখানকার সাহিত্যভূমি। বিপ্রদাস পিরিলাই বিখ্যাত হয়ে আছেন মনসাবিজয় কাব্য রচনার জন্য। কবি কৃষ্ণরাম দাস ২০ বছর বয়সে কালিকামঙ্গল রচনা করেন। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র : বর্ধমান রাজ্যের অধীন ভরশুট পরগনার পেঁড়া গ্রামে (বর্তমান হাওড়া জেলায়) জন্মগ্রহণ করলেও শ্যামনগরের কাছে মূলাজোড়ে বাড়ি করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেছেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্য অন্নদামঙ্গল এবং বিদ্যাসুন্দর। রামকমল সেন : ইংরেজি, বাংলা অভিধান (১৮৩৪), বঙ্গদেশের পুরাবৃত্ত প্রভৃতি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। দিনেমার উদ্ভিদ বিশারদ ওয়ালিচ রামকমলের সাহায্যে কলকাতা জাদুঘরের সূত্রপাত করেন। ঈশ্বর গুপ্ত : তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি, সংবাদ প্রভাকর, বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘নিত্যনৈমিত্তিকের ব্যাপার রাজকীয় ঘটনা, সামাজিক ঘটনা এসকল যে রসময়ী রচনার বিষয় হইতে পারে ইহা প্রভাকরই প্রথম দেখায়। আজ শিখের যুদ্ধ, কাল পৌষপার্বণ, আজ মিশনারি, কাল উমেদারি, সেসব যে সাহিত্যের অধীন, সাহিত্যের সামগ্রী, তাহা প্রভাকরই দেখাইয়াছিল।’ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ। তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনি পালামৌ বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। তিনি বঙ্গদর্শনও সম্পাদনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র : ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রের উদ্গাতা। আধুনিক পাশ্চাত্য স্টাইলে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী। ১৮৭২ খ্রি. এপ্রিল মাসে তিনি মাসিক বঙ্গদর্শন প্রকাশ করেন। দেবী চৌধুরানী, কপালকুন্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। শম্ভুচন্দ্র মুখার্জি হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও আরও অনেক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ১৮৬১ খ্রি. মুখার্জিস ম্যাগাজিন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় বিশ্বকোষ সম্পাদনার ক্ষেত্রে স্মরণীয়। বিশ্বকোষের দ্বিতীয় ভাগের কিছু অংশ সম্পাদনা করার পর নগেন্দ্রনাথ বসুকে এর স্বত্ব সমর্পণ করেন। জন্মভূমি, আর্যদর্শন, সোমপ্রকাশ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতেন। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় : W. W. Hunter-এর বাংলা গেজেটিয়ার-এ কিছুদিন কাজ করেছিলেন। হাস্যরসাত্মক রচনায় তাঁর খ্যাতি ছিল। কঙ্কাবতী, ডমরুচরিত প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় সহসম্পাদনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সম্পাদনা করেছিলেন রামপ্রসাদ গ্রন্থাবলী। হরিমোহন মুখোপাধ্যায় : তাঁর লেখা বঙ্গভাষার লেখক গ্রন্থে তৎকালীন বাঙালি সাহিত্যিকদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর লেখা কৃষিদর্পণ পত্রিকাটি বিশ্বভারতীতে সংরক্ষিত রয়েছে। সোমপ্রকাশ, হাবরা হিতবাদী, বান্ধব প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতেন। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : নেপাল থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার তাঁর জীবনের একটা বড়ো কীর্তি। বৌদ্ধগান ও দোঁহা, কাঞ্চনমালা, সচিত্র রামায়ণ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। নিখিলনাথ রায়:অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করলেও বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী। বসিরহাটে পল্লীবাণী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হরিনাথ দে : ২০টি ইউরোপীয় এবং ১৪টি ভারতীয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। চীনা ভাষা থেকে নাগার্জুনের মাধ্যমিক দর্শন, তিব্বতী ভাষায় রচিত ডুয়াঙের লজিক প্রভৃতির ইংরেজি অনুবাদ বৌদ্ধদর্শনের আদি ইতিহাসের প্রামাণিক নিদর্শন হিসেবে নির্বাণব্যাখ্যানশাস্ত্রম ও লঙ্কাবতারসূত্র সম্পাদনা করেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ সবিতা। ফুলের ফসল, সন্ধিক্ষণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। মোট ২১টি গ্রন্থ রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ‘নোবেল’ পাবার পর শান্তিনিকেতনের সংবর্ধনা সভায় যে ‘অভিনন্দনপত্র’ পাঠ করা হয়েছিল, তার খসড়া তিনিই প্রস্তুত করেছিলেন। শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ : বঙ্গবাসী, মাসিক বসুমতী, ভারতবর্ষ, হিমাদ্রি প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি লিখতেন। বহু পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। সংস্কৃত সাহিত্য ছাড়াও বাংলা ভাষায় প্রায় দু-শো প্রবন্ধ লিখেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় : পথের পাঁচালি, দৃষ্টিপ্রদীপ, চাঁদের পাহাড়, আরণ্যক প্রভৃতি উপন্যাস, আর গল্পসম্ভার দিয়ে আমাদের সাহিত্যভূমিকে করেছেন উর্বর। রবীন্দ্রপুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ১৯৫১ সালে, মৃত্যুর পরে। বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।
১৯০০ সালের পূর্বের এইসব সাহিত্যসাধক ছাড়াও বলদেব পালিত, গিরীন্দ্রমোহন দাসী, বনলতা দেবী, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং পরবর্তীকালে সমরেশ বসু, হাসিরাশি মুখোপাধ্যায়, বিনয়তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ তাঁদের সাহিত্য সাধনায় এই জেলাকে করেছেন অনন্য।
নাট্যচর্চা
প্রায় দেড়-শো বছর আগেই বাংলা দেশে নাটক নিয়ে যে ধুমধাম শুরু হয়েছিল আজও তাতে ভাটা পড়েনি। উত্তর ২৪ পরগনায় সেকালের তুলনায় একালেই নাট্যচর্চার জোয়ার এসেছে। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় জেলার নাট্যচর্চা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘দি দমদম থিয়েটার’ গঠিত হয়েছিল। সেখানে ইংরেজ কর্মচারীরাই অভিনয় করত। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর (১৬ই পৌষ ১২৭৩) তারিখের সোমপ্রকাশ প্রকাশিত একখানি পত্রে ‘আগরপাড়ার নাট্যশালা’-র কথা জানতে পারি। সোমপ্রকাশ-এ প্রকাশিত চিঠি ১ বৈশাখ ১২৮১ (২১ সংখ্যা) ‘‘মহাশয়! চতুর্দ্দিকেই নাটকাভিনয়ের ধূম পড়িয়াছে। … প্রাচীন পিতামহ সম্প্রদায় খেঁউর গাইয়া ও কবির লড়াই করিয়া আসর হইতে অপসৃত হইলে যুবক সম্প্রদায় বঙ্গভূমে অবতীর্ণ হইলেন। তাহারা সখের যাত্রা করিতে আরম্ভ করিলেন। … এঁড়িয়াদহ, দক্ষিণেশ্বর প্রভৃতি স্থানে স্থানে আকড়া আরম্ভ হইল ও যুবক সম্প্রদায় একাগ্রচিত্তে তাহাতেই প্রবৃত্ত হইল।’’ সংবাদপ্রভাকর : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদপ্রভাকর-এ শকুন্তলা অভিনয়ের আয়োজন সম্পর্কে লেখা হয় :
আমরা শ্রুত হইলাম। ৺বাবু আশুতোষ দেব মহাশয়ের ভবনস্থ জ্ঞানপ্রদায়িনী সভার সভ্য হইলে শ্রীযুক্ত নন্দকুমার রায়ের কৃত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ নাটকের অনুরূপ দর্শাইবার নিমিত্ত শিক্ষা করিতেছেন, কৃতকার্য্য হইতে পারিলে উত্তম বটে, বহু দিবস আমাদিগের কলিকাতায় বাঙ্গালা নাটকের অনুরূপ হয় নাই…।’’
হিন্দু পেটরিয়ট : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে ‘শকুন্তলা’র প্রথম অভিনয় হয়। এই অভিনয় সম্বন্ধে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি হিন্দু পেটরিয়ট-এ লেখা হয়,
… বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল। নাট্যশালা বলিয়া আমাদের যে একটা জিনিস ছিল, তাহাও আমরা ভুলিয়া গেলাম। এমন সময় একটি নিমন্ত্রণপত্র পাইয়া আমরা জানিতে পারিলাম যে, পূর্ব্ববর্ত্তী নাট্যশালার ভস্মাবশেষের উপর ফিনিক্স-পক্ষীর ন্যায় আরেকটি বঙ্গীয় নাট্যশালা আবির্ভূত হইয়াছে। এই নিমন্ত্রণের মধ্যে আরও উৎসাহের বিষয়—যে নাটকটির অভিনয় হইবে, উহা একটি সত্যকার বাংলা নাটক—কালিদাসের বিখ্যাত নাটক ‘শকুন্তলা’র বঙ্গানুবাদ। হিন্দু পাইয়োনিয়ার : বরানগরের শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক কিশোরের অভিনয় প্রসঙ্গে—১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ অক্টোবর বাবু নবীনচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত নাট্যশালায় বিদ্যাসুন্দর নাটকের অভিনয় হত। ২২ অক্টোবর ‘হিন্দু পাইয়োনিয়ার’-এ লেখা হয়, ‘‘এই নাটকে সুন্দরের ভূমিকা বরানগরের শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি কিশোর যুবক কর্তৃক অভিনীত হইয়াছে। প্রশংসার্হ উদ্যম সত্ত্বেও সে এই ভূমিকায় সমুচিত উৎকর্ষ দেখাইতে পারে নাই।
একসময় নাট্যকার হিসেবে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন খড়দহের ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, ভাটপাড়ার মহামহোপাধ্যায় শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ (সংস্কৃত নাটক), নিমতার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মনমোহন বসু, নন্দকুমার রায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখ।
সাহিত্য ও সংবাদধর্মী পত্রপত্রিকায় উজ্জ্বল এই জেলা
১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে প্রকাশিত হত বিদ্যাদর্শন, ছোটো জাগুলিয়া হিতৈষি মাসিক পত্রিকা, হালিশহর পত্রিকা, হিতমিহির, বরাহনগর বার্ত্তাবহ, আর্য্যাবর্ত্তরীতিবোধিকা, বঙ্গদর্শন, মধুকরী, বরাহনগর সমাচার, বিজ্ঞানবিকাশ, কাঁচরাপাড়া প্রকাশিকা, ভ্রমর, ভারত শ্রমজীবী, হিন্দু বিলাসী, বিচারক, হিন্দু ললনা, কৃষি পদ্ধতি, প্রচার, আর্য্য প্রতিভা, অরুন্ধতি, অন্তঃপুর, সংসার তত্ত্ব, অলৌকিক রহস্য, হিতৈষিণী প্রভৃতি পত্রপত্রিকা। বঙ্গদর্শন-এর পরেই হালিসহর পত্রিকা এবং ভারত শ্রমজীবী পত্রিকা উল্লেখযোগ্য। ১২৭৮ বঙ্গাব্দে ১ বৈশাখ হালিসহর থেকে প্রকাশিত হয় হালিশহর পত্রিকা। হালিসহর নিবাসী উমাচরণ মুখোপাধ্যায়ের অর্থ সাহায্যে জানকীনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। শ্রীরামপুরের শ্রীযুত হরিশ্চন্দ্র মহাশয়ের বিশেষ আনুকূল্যে শ্রীরামপুর আলফ্রেড যন্ত্রে এই পত্রিকা মুদ্রিত হত। প্রথম বছর মাসিক, দ্বিতীয় বছর পাক্ষিক এবং তৃতীয় বছর সাপ্তাহিক হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তৃতীয় বছর থেকে সংবাদ, রাজনীতি এসবের আলোচনা থাকত। জানকীনাথ তাঁর পত্রিকায় সরকারি কার্যের কঠোর সমালোচনা করতেন। ভারনাকুলার প্রেস অ্যাক্ট ১৮৭৮ অনুযায়ী এই পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং জানকীনাথের চাকরিও চলে যায়।
সচিত্র ভারত শ্রমজীবী পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বরানগর থেকে। এটি প্রকাশ করতেন শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল্য ছিল ১ পয়সা। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮। আয়তন ডিমাই কোয়ার্টার। মাসে ১৫ হাজার মুদ্রিত হত। এই সংবাদপত্রে শ্রমিকদের উদ্দেশে উপদেশ ও পরামর্শ দেওয়া হত। অলসে দেহর পীড়া পরিশ্রমে নেয়/বিনা ব্যবহারে ছুরী মরচে পড়ে যায়—এ-রকম উপদেশ ছাড়াও—যে তাহার সন্তানকে পরিশ্রম করিতে শিখাইয়াছে সে তাহাদের সন্তানদের জন্য লক্ষ টাকা জমা করিয়াছেন। এ ধরনের পরামর্শ দেওয়া হত শ্রমিকদের উদ্দেশে।
জেলার পুরাকীর্তি
বেড়াচাঁপায় আবিষ্কৃত হয়েছে বাংলার সবচেয়ে পুরোনো প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শন—চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষ। চন্দ্রকেতুগড়ে প্রথম এসেছিলেন লর্ড হার্স্ট সাহেব ১৯০৬ সালে। এরপর এসেছিলেন ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৭ সালে শুরু হয় খননকার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়াম অগ্রণী ভূমিকা নেয়। চন্দ্রকেতুগড়ে পাওয়া একটি সূর্যমূর্তি প্রত্নবিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখানকার সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নানা ধরনের পাত্রের ভাঙা টুকরো। যেসব পাত্র পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে পানীয় পাত্র, প্রদীপ, ছোটো ছোটো ঘট, থালা ইত্যাদি। এসব পাত্রের গঠনরীতির সঙ্গে সাদৃশ্য হয়েছে মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতার। নানা বর্ণের নানা ঢঙের পুঁতি পাওয়া গেছে এখানে। বেশ কিছু তামা ও রুপোর মুদ্রাও পাওয়া গেছে। মুদ্রার গায়ে ঘোড়া, হাতি, সূর্য, গাছ, জাহাজ প্রভৃতির চিহ্ন রয়েছে। বাংলা দেশে সর্বপ্রথম মুদ্রা আবিষ্কৃত হয় চন্দ্রকেতুগড়ের অন্তর্ভুক্ত ঝিকরা গ্রামে। বেড়াচাঁপাতেই একটি ঘটের মধ্যে প্রায় ২০০টি মুদ্রা পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে নানা ধরনের সীল। এখানকার পাওয়া জীবজন্তুর মূর্তির মধ্যে পশু ও পক্ষীর যুগল মূর্তিও রয়েছে। পোড়া মাটির পাত্রের গায়ে ব্রাহ্মীহরফ প্রত্নতাত্ত্বিকদের অবাক করেছে। খনাবরাহের নামের সঙ্গে এই অঞ্চলের নাম জুড়ে গেছে। তবে এটি আনুমানিক ধারণা। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৩৩ সালে শারদীয় বসুমতী-তে লিখেছেন :
যে সমস্ত অতি প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে স্থানটি ভারতবর্ষের অতি পুরাতন স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিয়াছিলেন ‘বঙ্গসংস্কৃতির বেদীমণি রচনা করিয়াছিল চন্দ্রকেতুগড়।’
উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় অতীতের বহু অভিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে পথে পথে—দমদম ক্লাইভ হাউস, বনগাঁর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ে বসতবাড়ি, বনগাঁ-ব্যারাকপুরের সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি, মণিরামপুরের রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি, নৈহাটীতে বঙ্কিম ভবন ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বাড়ি, বারাসাতে হেস্টিংস ভিলা, ধান্যকুড়িয়ার জমিদারবাড়ি, গোবরডাঙা জমিদারদের কাছারিবাড়ি, ব্যারাকপুরের ‘টেম্পল অব ফেম’ ও ফ্ল্যাগস্টাফ হাউস, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির, কাঁচরাপাড়ার কৃষ্ণরায় মন্দির, হালিশহরের রামপ্রসাদ ভিটে, ভাটপাড়ার পাঁচমন্দির, মূলাজোড়ে ব্রহ্মময়ী মন্দির, পানিহাটিতে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ রাঘবপন্ডিতের সমাধি, খড়দহের নিত্যানন্দের বাসস্থান ও শ্যামসুন্দর মন্দির, গোবরডাঙার প্রসন্নময়ী মন্দির, তারাগুনিয়ার তারাখ্যাপা মন্দির, টিটাগড়ের বিশালাক্ষ্মী মন্দির, ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দির, সাঁইবনার নন্দদুলাল জিউ-এর মন্দির, বসিরহাটের শাহী মসজিদ, হাড়োয়ার রাঙা মসজিদ ও গোরাচাঁন্দপীরের মসজিদ, কাজিপাড়ার বড়ো মসজিদ, হালিশহরের বাগের মসজিদ, ব্যারাকপুরের সেন্ট জোসেফ গির্জা ও বার্থলময় ক্যাথিড্রাল, শ্যামনগরের বোধিবিহার যেখানে শ্রীলঙ্কার বোধিবৃক্ষের চারা এখানে পল্লবিত হচ্ছে। এ ছাড়াও অসংখ্য প্রতিষ্ঠান জেলার ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
হেরিটেজ বাড়ি
এই জেলা গর্ব করতে পারে তার ঐতিহ্যশালীরূপে ঘোষিত কীর্তির জন্য। জেলার পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ সরকার হেরিটেজ হিসাবে ঘোষণা করেছে—পানিহাটির গোবিন্দকুমার হোম—এখানে রবীন্দ্রনাথ জীবনের ‘প্রথম বাহির যাত্রা’য় এসেছিলেন। পানিহাটির গান্ধীজি মেমোরিয়াল আশ্রম—গান্ধীজি এই আশ্রমকে বলতেন তাঁর দ্বিতীয় আবাসস্থল। দাঙ্গা থামানো এবং বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কয়েকবার তিনি এখানে এসেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্রও এই বাড়িতে এসে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করেছেন। হালিশহরের রামপ্রসাদ ভিটা—আমরা যখন দেখি ভারত সরকার মানবসম্পদ উন্নয়ন নামে পৃথক দপ্তরের সূচনা করেছে তখন রামপ্রসাদের কথা মনে পড়ে। কত বছর আগেই তিনি লিখে গেছেন ‘এমন মানবজমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলত সোনা।—হালিশহরের চৈতন্য ডোবা—‘ভারত ভ্রমণকালে নিমাই চৈতন্য/গুরুর ভিটায় আসি হইলেন ধন্য।’ গুরুদেব ঈশ্বরপুরীর ভিটেই চৈতন্যদেবের আগমনের স্মৃতিবিজড়িত এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের বসতবাড়ি—কলকাতায় জন্মগ্রহণ করলেও ১৮৮১ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যারাকপুর-মণিরামপুরে বসবাস করেছেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি উত্তর ব্যারাকপুর পুরসভার পুরপ্রধান ছিলেন। উত্তর ব্যারাকপুর পৌরভবনটিও হেরিটেজের স্বীকৃতি পেয়েছে।
শিক্ষা
কৃষি, শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষার ক্ষেত্রে ঐতিহ্য রয়েছে এই জেলার। ভাটপাড়া একসময় ন্যায়চর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল। হালিসহরের টোলচতুষ্পাঠী শিক্ষায় অন্যতম স্থান অধিকার করেছিল। টাকির জমিদার কালীনাথ মুনশি ১৮৩২ সালে টাকিতে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পানিহাটিতে জমিদার নির্মিত স্কুল (১৮৩৪), ব্যারাকপুরে লর্ড অকল্যাণ্ড প্রতিষ্ঠিত ইডেন স্কুল (বর্তমান ব্যারাকপুর রাষ্ট্রীয় উচ্চবিদ্যালয়), বারাসাত সরকারি স্কুল (১৯৪৬), বারাসাতের বালিকা বিদ্যালয় (১৮৪৭) জেলার শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এখন প্রাথমিক ও মাদ্রাসা-সহ মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫১৩৫, কলেজের সংখ্যা ৫৭—এর মধ্যে ৩টি সরকারি কলেজ। এ ছাড়া আছে ৮টি বি-এড কলেজ, ১টি সরকারি শারীরশিক্ষা কলেজ, ১টি বেসরকারি আইন কলেজ এবং একটি আর্ট কলেজ। শিক্ষা ক্ষেত্রে নবতম সংযোজন পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বরানগরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট’ সংখ্যাতত্ত্ব বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রটি এই জেলার গর্ব।
জেলার তিন প্রধানমন্ত্রী
এই জেলা গর্ব করতে পারে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান গরিফার রামকমল সেনের পুত্র হরিমোহন সেন দেশীয় রাজা জয়পুরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন (১৮৮৫)। এরপর ওই রাজ্যেরই প্রধানমন্ত্রী হন শ্যামনগরের কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি ‘তাজিম সর্দার’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। লর্ড কার্জন তাঁকে দুর্ভিক্ষ কমিশনের সদস্যপদ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। জয়পুর রাজ্যের শেষ বাঙালি প্রধানমন্ত্রী সোদপুর নাটাগড়ের সংসারচন্দ্র সেন।
জেলার চিড়িয়াখানা
জেলার একমাত্র চিড়িয়াখানা ছিল চানক-ব্যারাকপুরে। আজকের আলিপুর চিড়িয়াখানাই হল ব্যারাকপুরের চিড়িয়াখানা। অতীতের ‘চানক’ আজকের ‘ব্যারাকপুর’। ‘চানকের বাগান’, ‘ব্যারাকপুর পার্ক’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘মঙ্গল পান্ডে উদ্যান’। ১৮০০ সাল নাগাদ ওয়েলেসলি প্রস্তাবিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য পশু-পাখি সংগ্রহ করতে আদেশ দেন। কিন্তু ডিরেক্টরসদের সম্মতি না মেলায় তিনি ১৮০৪ সালে ব্যারাকপুরে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর পরিকল্পিত পশুশালা, যা ‘ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানা’ নামেই পরিচিত। বাঘ, সিংহ, নীলসা হরিণ প্রভৃতি ধরনের বহু পশু এবং অদ্ভুত ধরনের পাখি ছিল এই চিড়িয়াখানায়। ২৫ অগস্ট ১৮২১ সালে সমাচার দর্পন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় কত রকমের পশু-পাখি এই চিড়িয়াখানাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। ব্যারাকপুরে লাটসাহেবের বাড়ি আজ পুলিশ হাসপাতাল। এই বাড়ি আর বাগানে কলকাতা থেকে আসতেন গবর্নর। সেকথা তখনকার দিনে খবরের কাগজে ছাপা হত—
চার ঘোড়ার গাড়ি চোড়ে
গত দিনে বেকালে গো।
গিয়াছেন গবর্নর চানকের
বাগানে গো।।
আন্দোলন-বিদ্রোহে এই জেলা
নীলকর সাহেবদের আন্দোলন থেকে তেভাগার আন্দোলন, এ-রকম বহু আন্দোলনের সাক্ষী এই জেলা। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের করুণ কথা ছড়িয়ে রয়েছে এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। নীলগঞ্জ আজও তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। নীলকর সাহেব বানুর পায়ে জীবনপুর কুঠির এক অত্যাচারিত বৃদ্ধ মৃত্যুর আগে এমন কামড় বসিয়ে দেয় যে বানুর মৃত্যু হয়। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ ছিল এক রুখে দাঁড়াবার কাহিনি। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছেন নীলদর্পণ।
১৮৩৩ সালে ওয়াহাবি ধর্মের প্রচারক তিতুমীর নারকেড়বেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালিয়েছিলেন তা আজও এলাকায় মুখে মুখে ঘোরে—
হেই বন বন ঘোরে লাঠি তিতুমীরের হাতে
ফট ফটাফট গুলি চলে বাঁশের কেল্লা ফতে।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল এই জেলারই ব্যারাকপুরে। সিপাহি বিদ্রোহের বহরমপুরের বীজটিই ব্যারাকপুরে অঙ্কুরিত হয়ে বিকশিত হয়েছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। ইউরোপীয় অফিসারকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলিটি চালানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন ব্যারাকপুরের ৩৪ নং রেজিমেন্টের দেশীয় সিপাহি মঙ্গল পান্ডে। তাঁকে দু-টি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ১. ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ তলোয়ার ও মাস্কেট-সহ ব্যারাকপুরে কোয়ার্টার গার্ডের সামনে প্যারেড গ্রাউণ্ডে বিদ্রোহ ঘটানো এবং রেজিমেন্টের অন্য সিপাহিদের উত্তেজিত করা। ২.ঊর্ধ্বতন অফিসারদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো; লেফটেনান্ট এবং সার্জেন্ট মেজর হিউসনকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করা। মঙ্গল পান্ডেকে দু-টি অভিযোগেই অভিযুক্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয় ৮ এপ্রিল ১৮৫৭। কর্তব্যে অবহেলা করে মঙ্গল পান্ডেকে সহায়তা করার জন্য দেশীয় অফিসার ঈশ্বরী পান্ডেরও ফাঁসি হয়।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের আগেই ১৮২৪ সালের ২ নভেম্বর ব্যারাকপুরে ঘটে গিয়েছিল এক ভয়ানক বিদ্রোহ। দেশীয় বাহিনী বার্মা যুদ্ধে অংশ নিতে না চাইলে প্রায় ২০০ সিপাহিকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লাইট কোম্পানির সিপাহি বিন্দা তেওয়ারি। ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে এক মন্দিরে বিন্দার এক কাল্পনিক মূর্তি কল্পনা করে সিপাহিরা আজও তাঁকে পুজো করে আসছেন।
কুটিরশিল্প ও মৎস্যচাষেও জন্য এই জেলা খ্যাতি অর্জন করেছে। একসময় গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বৃহৎ কলকারখানা। বিশেষ করে চটশিল্প এবং বস্ত্রশিল্পের জন্যই খ্যাতি ছড়িয়েছিল ব্যারাকপুর অঞ্চলের। সেইসব কারখানার বেশ কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। তবু ব্যারাকপুর আজও শিল্পাঞ্চল হিসাবে তার পরিচয় বহন করে চলেছে।
এই জেলা হারিয়েছে অনেক। নেই টিটাগড়ের জাহাজ কারখানা আর কাগজের কল। বালান্দার সভ্যতাও লুপ্ত। বন্ধ হয়ে রয়েছে দেগঙ্গার খননকার্য। ইতিহাস চাপা পড়ে আছে মাটির তলায়। গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়েছে খড়দহে রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। নেই লর্ড ওয়েলেসলির চিড়িয়াখানা, ব্যারাকপুরের বিখ্যাত ঘৌড়দৌড়, আর সবুজের বুক চিরে সর্পিল গতিতে ছুটে যাওয়া ‘কু ঝিকঝিক’ মার্টিন রেল। তবু ইতিহাসের এক বৃহৎ ভান্ডার আজও আগলে রয়েছে এই জেলা। ইছামতি আর হুগলি জেলার বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও বয়ে চলেছে নীরবে।