আজ তিন তারিখ
কল্যাণ কলিং বেল টিপে অপেক্ষা করছে।
পুরোনো দিনের প্লাস্টিকের কলিং বেল। ঢিপির মতো গোল, কালো, ওপরে সাদা বোতাম। দেখলে মনে হয়, কলিং বেল নয়, কালো চাদর গায়ে কোনও বুড়ো মানুষ। ধূসর ভুরু কুঁচকে এখনই ধমক দিয়ে উঠবে।
‘অ্যাই, তুমি এ বাড়িতে আসো কেন? জান না এখানে একজন মেয়েমানুষ একা থাকে? তার পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে। জান না তার স্বামী নেই? একা থাকা মেয়েমানুষের বাড়িতে এভাবে আসা উচিত?’
‘স্যার, আজ মাসের তিন তারিখ।’
‘ওসব তোমার অজুহাত।’
‘আমি তো একবছর ধরে আসছি স্যার। পাঁচ মিনিটও থাকি না। বেশিরভাগ দিন দরজার বাইরে থেকে চলে যাই।’
বুড়ো আরও জোরে ধমকে উঠবে, চুপ করও। আমাকে বোকা ভেব না।’
কলিং বেল থেকে মন সরাল কল্যাণ। শান্তা দরজা খুলছে না কেন? সে কি বাড়ি নেই? তা কী করে হবে? আসবার আগে প্রতিবারের মতো আজও অফিস থেকে ফোন করেছিল।
‘আমি আসছি।’
ফোন ধরে শান্তা হকচকিয়ে যায়। প্রতিবারই যায়। এমন ভাবে চুপ করে থাকে যেন গলা চিনতে পারছে না। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে, আপনি।’
কল্যাণ বলে, ‘হ্যাঁ, আজ তিন তারিখ।’
শান্তা গলা নামিয়ে বলে, ‘মনে ছিল না। কখন আসবেন?’
কল্যাণ বলে, ‘ওই যেমন যাই, অফিস থেকে বেরিয়ে। ছ’টা-সোয়া ছ’টা। অসুবিধে হবে?’
শান্তা চুপ করে রইল। কল্যাণ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আজ এক বছর হল।’
শান্তা এবার ফোন কেটে দিল। এক বছরের কথাটা কি শুনতে পেল না? তাই হবে। মেয়েটার গলা আজ ভারি ঠেকল। ঠান্ডা লেগেছে? লাগতে পারে। ওয়েদার ভালো যাচ্ছে না। ফোন কেটে দেওয়ার পরও হাতে ধরা মোবাইলটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কল্যাণ। এই তার এক অদ্ভুত স্বভাব। শান্তার সঙ্গে কথা বলবার পর মুহূর্তখানেকের জন্য হলেও ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন শান্তার কথাগুলো দেখতে চায়। হুঁশ ভাঙল ‘দত্তদা’র ডাকে। দত্তদা বসে পাশের টেবিলে।
‘ওই পুচকে ফোনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে কী হবে? এবার একটা ভালো জিনিস কিনে ফেল বাপু। হাতের মুঠোয় সব পাবে।’ কথা শেষ করে চোখ টিপলেন।
উলটো টেবিল থেকে শঙ্কর বলল, ‘হাতের মুঠোয় সব পেতে ফোন দরকার কী? এবার একটা বিয়ে করো কল্যাণ। বয়স তো বাড়ছে।’
কল্যাণ উত্তর দিল না। মুচকি হেসে ফাইল টেনে নিল। অফিসে তাকে নিয়ে এই মশকরা প্রায়ই হয়। আইবুড়ো থাকবার সমস্যা। তবে এবার থেকে মনে করে ঘরের বাইরে গিয়ে ফোন করতে হবে। যদিও সব ‘তিন তারিখ অফিসে থাকা হয় না। শনি-রবি আছে, ছুটিছাটাও পড়ে যায়। তিন তারিখ সবসময়ে শান্তার ওখানে যাওয়াও হয় না। ঝড়-বৃষ্টি, বন্ধ, ট্রেনের গোলমাল থাকে। কল্যাণ তাও চেষ্টা করে।
শান্তা বলে, ‘আপনি তারিখ নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।’
কল্যাণ ঢোঁক গিলে বলে, ‘নানা, ব্যস্ত হইনি।’
শান্তা বলে, ‘এমাসটা থাক না। পরের মাসে একসঙ্গে।’
কল্যাণ তাড়াতাড়ি বলে, ‘তা কী করে হবে? আমি উদয়কে কথা দিয়েছিলাম।’
শান্তা বলে, ‘প্রতিবার দিনক্ষণ ধরে আসতে হবে এমন তো নয়। রনোর বাবার সঙ্গে আপনার কী কথা হয়েছিল জানিনা। আপনাকে তো বলেছি এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। টাকাপয়সা নিয়ে ও কখনও আমাকে কিছু বলত না। আপনার অসুবিধে হতে পারে, তাই বলছিলাম।’
কল্যাণ নিচু গলায় বলে, ‘আমার তো একদিন অসুবিধে, তুমি তো পাকাপাকি অসুবিধের মধ্যে থাকো শান্তা। কটা টিউশন, সামান্য কিছু সেলাইয়ের কাজ দিয়ে চলতে হয়। বাচ্চাটাও রয়েছে।’
শান্তা কথা ঘোরায়। বলে, ‘চা খাবেন?’
‘চা খাবেন?’ কথাটা বলার মধ্যে অনিচ্ছে থাকে। কল্যাণ বুঝেও যেন বুঝতে চায় না। বলে, ‘দাও।’
চায়ের কাপ রেখে ফের ভিতরে চলে যায় শান্তা। যাওয়ার আগে বলে, ‘একটা এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। ওরা হিসেবপত্রের কিছু কাজ দিয়েছে কালই দিতে হবে। আমি ভিতরে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলি?’
কল্যাণ একা বসে চা খায়। এমনটাই হয়। যে এক-দুদিন ভিতরে ঢোকে, রেলিং ঘেরা একচিলতে বারান্দায় বসিয়ে ছুতোনাতায় ভিতরে চলে যায় শান্তা। চা অর্ধেক খেয়ে উঠে পড়ে কল্যাণ। কিছু না বলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। প্রতিজ্ঞা করে, আর আসবে না। পারে না। তিন তারিখ এলে অস্বস্তি হয়, খচখচ করে। কে যেন, কী যেন তাড়া করে।
ঘুপচি দেড় কামরার ফ্ল্যাট। দিনেরবেলাতেও আলো জ্বালাতে হয়। একবছর আগে উদয় একরকম জোর করেই নিয়ে এসেছিল। হাতল ভাঙা চেয়ার আর মোড়া নিয়ে বারান্দাতে বসবার ব্যবস্থা। সেদিনও শান্তা চা নিয়ে এসেছিল। কল্যাণের সেই প্রথম দেখা। চমকে ওঠে। অথচ চমকানো মতো বাড়তি কিছু ছিল না মেয়েটার। এই জন্যই কি বলে জীবন যুক্তিহীন? চমকে দেওয়ার জন্য তার কারণ লাগে না। শান্তা নীল আর সাদায় মেশানো খুব সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি পরেছিল। সঙ্গে আরও ম্যাড়ম্যাড়ে সাদা ব্লাউজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, গেস্ট আসায় দ্রুত হাতে কাপড় বদলেছে। কোনওরকমে হাত খোপা বেঁধেছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সেটাও ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের ওপর। রোগা, গায়ের রং ময়লার দিকে। মুখে প্রসাধনের ছাপ মাত্র নেই। এমনকি একটা টিপও নয়। মুখ তুলে হাত জোড় করে নমস্কার করল। বুকটা ধক করে উঠেছিল কল্যাণের। স্নিগ্ধ, ছলছলে দুটো চোখ! যেন এই মুহূর্তে কান্না মুছে এসেছে। পঁয়ত্রিশ বছরের পুরুষজীবনে নারী কম দেখা হয়নি কল্যাণের। এই বিষয়ে তার কোনও উৎসাহ নেই। বরং এড়িয়েই চলে। তারপরেও শান্তাকে দেখে মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর মেয়ের সঙ্গে তার আগে কখনও দেখা হয়নি।
উদয় হেসে, চোখ নাচিয়ে বলেছিল, ‘এই আমার বউ শান্তা। কেমন সুন্দর বল। হাতে টাকাপয়সা নেই বলে এই মেয়েকে বিয়ে না করে থাকা যায়? কোন শালা নিয়ে ভাগত, তার ঠিক আছে?’
কল্যাণ লজ্জা পেয়েছিল। উদয়টা আগেও এরকম ছিল। যা মুখে আসত বলে ফেলত। শান্তা ভুরু কুঁচকে তাকাল। উদয় বলল, ‘আরে বাপু লজ্জার কিছু নেই। একসময়ে এই ছেলের সঙ্গে এক কোম্পানিতে চাকরি করেছি। ভালো কোম্পানি ছিল। এই বেটা সরকারি চাকরি পেয়ে পালাল। কোম্পানিও এখান থেকে পাততাড়ি গোটাল। আমি লাট খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত বিজনেসে এসে আটকেছি। আট বছর পর হারামজাদার সঙ্গে লঞ্চঘাটে দেখা। গত বুধবার। জড়িয়ে ধরে চিল্লামিল্লি শুরু করল, এতদিন কোথায় ছিলি? বললাম, নির্বাসনে। একদিন বাড়ি আয়। সুন্দরী বউ দেখে যা।’
কল্যাণ চাপা গলায় বলল, ‘আবার বাজে কথা।’
শান্তা মাথা নামিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘আপনার বন্ধু শুধু বাজে কথা বলতে জানে।’
শান্তা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে উদয় খপ করে তার হাত ধরল। হেসে বলে, ‘আরে ঠাট্টা করছিলাম। একটু বসে যাও। কল্যাণের সঙ্গে দুটো কথা বলো।’
বসেনি শান্তা। ভিতর থেকে শিশুর কান্না ভেসে আসায় তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিল। এতক্ষণ যে খোঁপা ঘাড়ে ভেঙেছিল, এবার একরাশ চুল হয়ে বুকে ছড়িয়ে পড়ে। কল্যাণের শরীর শিরশির করে ওঠে। ঘোর ভাঙে উদয় মুচকি হেসে হাতে হাত রাখলে। বলে, ‘রাতে খেয়ে যাবি। শান্তা শুধু দেখতে সুন্দর নয়, ভালো রাঁধেও।’
কল্যাণ তাড়াতাড়ি বলে, ‘নানা। আজ নয়, পরে একদিন হবে।’
ফিরে যাওয়ার পথে উদয় অন্ধকার গলিতে ফের হাত চেপে ধরল। নিচু গলায় বলল, ‘একটা উপকার করতে হবে ভাই। চাকরি চলে যাওয়ার পর ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবে গিয়েছি। গলা পর্যন্ত ধার। বাড়ি ভাড়া দিতে পারি না। যে কোনোদিন বউ-বাচ্চাকে নিয়ে পথে বসতে হবে। বেশি নয়, মাত্র দু’হাজার টাকা করে যদি মাসে দিস… সিচ্যুয়েশন একটু ঠিক হলেই ফিরিয়ে দেব…তোর পায়ে পড়ি কল্যাণ…প্লিজ হেল্প মি। বিয়ে থা করিসনি, তোর খরচপাতি কম। যদি চাস, নিজে মাসে একদিন এসে শান্তার হাতে টাকা দিয়ে যাবি। রাতে খেয়েও যাবি। ওই সময়ে আমি বাড়ি থাকব না।’
কল্যাণ ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে বলল, ‘ছিঃ উদয়। এতো নিচে নেমেছিস!’
এতো ঘেন্নার পরও সেদিন রাতে কল্যাণ স্বপ্ন দেখল। শান্তা তাকে যত্ন করে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। কাঁধের পাশ দিয়ে বুকের ওপর এক ঢাল চুল এসে পড়েছে।
সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে উদয়ের সঙ্গে আবার দেখা। ছুটির দিন ছিল। গঙ্গা পারাপারের শেষ লঞ্চে উঠেছিল কল্যাণ। যাত্রী হাতে গোনা কয়েকজন। নির্জন ডেকের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল উদয়। তাকিয়ে ছিল অন্ধকার জলের দিকে। দেখতে পেয়ে নিজেই এগিয়ে এসেছিল।
‘রাগ করিস না ভাই। অভাবে মাথার ঠিক থাকে না। পাগলের মতো কী বলতে কী বলে ফেলি। বউ-বাচ্চার জন্যই তো বলি। প্লিজ, রাগ করিস না।’
কল্যাণ বলে, ‘ঠিক আছে। শান্তার কানে এসব গেলে কী হবে বল তো? অমন সুন্দর, নরম মনের মেয়ে।’
উদয় অন্ধকারে হাসল। বলল, ‘যাবে না। ও জানে ওকে আমি খুব ভালোবাসি।’
কল্যাণ নরম গলায় বলল, ‘টাকা পয়সা লাগলে বলিস।’
‘বলব।’
কথা বলতে বলতে কল্যাণকে ফেলে উদয় রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেল। লঞ্চ তখন মাঝগঙ্গায়। চাপা স্বরে ভোঁ ডাক দিয়েছে। একসময়ে উদয় দুহাতে রেলিঙে ভর দিয়ে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘কল্যাণ, এখন যদি আমি জলে ঝাঁপ দিই? মরে যাব? শান্তা একা হয়ে যাবে?’
শরীর ঝিমেঝিম করে ওঠে কল্যাণের। চাপা গলায় বলে, ‘কী পাগলের মতো বকছিস? নাটক করছিস?’
উদয় তার ডান পা রেলিঙের ওপর তোলে। কল্যাণ কী করবে ঠিক করতে পারে না। ছুটে গিয়ে চেপে ধরবে? চিৎকার করবে? নাকি…।
কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার ছিল। উদয় আলতো ভাবে রেলিঙ টপকে যায়। কল্যাণ সময় নিয়ে, শান্ত ভাবে ডেক থেকে নিচে নামে। সেটাও ছিল তিন তারিখ।
আরও একবার বুড়ো বেলে হাত বাড়াতেই শান্তা দরজা খুলল। চোখ মুখ থমথম করছে। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন। ভিতরে আসুন।’ সত্যি তার গলা ভারি। জ্বর হয়েছে? কাঁদছিল না তো? চা বানিয়ে শান্তা অন্ধকার বারান্দায় আসে। মোড়া টেনে কল্যাণের মুখোমুখি বসে। এই প্রথম। কল্যাণের হালকা অস্বস্তি হয়।
‘নিন, এবার বলুন।’
থতমত খেয়ে কল্যাণ বলল, ‘কী বলব?’
শান্তা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তিন তারিখ কী হয়েছিল?’
কল্যাণ মাথা নামিয়ে বলল, ‘কিছুই হয়নি। একসময়ে তোমার স্বামীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম। বলেছিলাম একসঙ্গে ফেরত দিতে পারব না, মাসে মাসে শোধ দেব। তিন তারিখ দিন ঠিক হয়েছিল। মাঝখানে অনেকগুলো বছর তার খোঁজ পাইনি। সেই টাকাই তোমাকে দিতে আসি। উদয় তো নেই।’
শান্তা একটু চুপ করে থেকে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখে মোছে। বলে, ‘মিথ্যে কথা। এরকম কিছুই হয়নি। একবছর ধরে আপনি গল্প বানিয়ে আমাকে টাকা দিতে আসেন। আমি অন্য তিন তারিখের কথা শুনতে চাই।’ কল্যাণ মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। শান্তা উঠে দাঁড়ায়। চাপা গলায় বলে, ‘অনেকদিন অপেক্ষা করেছেন, এবার আমার শোওয়ার ঘরে আসুন। ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
ঘর আরও অন্ধকার। শান্তা বুকের আঁচলটুকু শুধু সরায়। বিহ্বল হয়ে পড়ে কল্যাণ। এ এক অন্য শান্তা! নগ্ন হবার আগেই সে এত সুন্দর!
‘আমি তোমাকে ভালবাসি শান্তা।’
এগিয়ে এসে কল্যাণের মুখে হাত চাপা দেয় শান্তা। গায়ে গা লাগিয়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘আমি আপনাকে ঘেন্না করি কল্যাণবাবু। কেন করি জানেন? করি কারণ আজ তিন তারিখ। একবছর আগে আপনার বন্ধু আপনার চোখের সামনে যেদিন জলে ঝাঁপ দিয়ে মরে, সেদিনও তিন তারিখ ছিল। ইচ্ছে করলে সেদিন আপনি ওকে আটকাতে পারতেন। তা করেননি। ওকে মরতে দিয়েছিলেন। কে জানে আলতো ঠেলে দিয়েছিলেন হয়তো।’
কল্যাণ বিস্ফারিত চোখে বিড়বিড় করে বলল, ‘বাজে কথা। আমি ওকে ঠেলিনি, ধরতে গেলে হাত ফসকে যায়।’
শান্তা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘সেই জন্য সত্য গোপন করেছেন? আজ লঞ্চ ঘাটে গিয়েছিলাম। তিন তারিখ বলেই গিয়েছিলাম। ওখানকার কর্মীরা আমাকে বললেন, সেদিন একজনকে তারা নিচে নেমে আসতে দেখেছিলেন। বর্ণনা শুনে বুঝলাম, সেই লোক আপনি। অথচ আপনি আমাকে আর পুলিশকে বলেছিলেন, আপনি লঞ্চের নিচে ছিলেন। ডেকের খবর জানতেন না। উদয়ের ডেডবডি তোলবার পর তাকে দেখেন এবং চিনতে পারেন। তাই না?’
কল্যাণ থমকে যায়। তার ভয় করে। এই তেজি শান্তাকে সে চেনে না। ঠেলে সরিয়ে দিতে যায়। বলে, বাজে কথা।’
শান্তা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘এখনই ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন! এতো অপেক্ষার পর? কোন অপরাধ চাপা দিতে মাসে মাসে টাকা দিতে আসেন কল্যাণবাবু? নাকি আমাকে বিছানায় পেতে? তবে বিছানায় আসুন।’
কল্যাণ বিড়বিড় করে বলে, ‘ভালোবাসা অপরাধ?’
শান্তা আঙুল তুলে বলে, ‘শাট আপ। এই আপনার ভালোবাসা। আপনি ক্রিমিনাল। আপনি চলে গেলে, আমি পুলিশের কাছে যাব। বলব, সাহায্য করবার ছুতোয় ঘরে ঢুকে জোরজবরদস্তি করেছেন। আমার শাড়ি টেনেছেন, ব্লাউজ ছিঁড়েছেন। আপনার সবকটা খাম রাখা আছে কল্যাণবাবু। ওপরে ভালোবেসে নিজের হাতে নাম লিখেছেন। খুনের মামলা তামাদি হয় না। আমার মরা বর জানুক, আমি তাকেই ভালোবাসি।’ কথা শেষ করে শান্তা খাটের ওপর বসে পড়ে। দু’হাতে মুখে ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার আঁচল পড়ে থাকে মেঝেতে।
বিধ্বস্ত কল্যাণ বাড়ির গেট খুলে পথে নামে। ফিনকি দেওয়া জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। সে এখন কী করবে? শান্তা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। তার কাছে যে কটা টাকা ছিল মুঠো করে এনে মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘নিন, বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। আর কোনোদিন যেন না দেখি।’ কিন্তু উদয়? সে কি ক্ষমা করবে? অন্ধকারে গলিপথে টলমল ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় কল্যাণ। থানাটা কোনদিকে?