আজাদি ও ইসলামী রাজনীতি

আজাদি ও ইসলামী রাজনীতি

জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলিম। সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে ইসলামের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। বিশেষত জনবহুল কাশ্মীর ভ্যালি ও জম্মুর মুসলিম অধ্যুষিত ৪/৫টি জেলায়। স্বভাবতই, সশস্ত্র ‘আজাদি সংগ্রামের সঙ্গে ইসলাম ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। সেক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীই আলোচনা পর্যালোচনার কেন্দ্র হওয়ার কথা। কারণ, এই দলটি দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেই ইসলামী রাজনীতির প্রতিনিধিত্বের দাবিদার। বিশ্বব্যাপী রয়েছে তাদের আদর্শ ও কর্মসূচির প্রসার।

কাশ্মীরে স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দলটির ভূমিকা নিয়ে জানার চেষ্টা ছিল সবিস্তারে। যা জানা গেছে তা হলো, দলটি ১৯৭২ সাল থেকে নির্বাচনমুখী ছিল। প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পাঁচটি আসনে জয় পেয়েছিল। ১৯৭৭-এর নির্বাচনে পেয়েছিল একটি আসন। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিল ইউনাইটেড মুসলিম ফ্রন্টের ব্যানারে। সৈয়দ আলী শাহ গিলানীসহ ওই ফ্রন্ট পাঁচটি আসনও পেয়েছিল। তবে, ১৯৮৭’র নির্বাচনে ভোট কারচুপির ঘটনায় নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে অন্য অনেকের মতো জামায়াতও বেছে নিয়েছিল অস্ত্রের পথ।

তারপর থেকে তারা ভোটমুখী রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। ভারতের কাছে তারা তখন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বা ‘পাকিস্তানপন্থী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় দলটি। নির্বাচিত এমপিরা সৈয়দ আলী শাহ গিলানীর নেতৃত্বে পদত্যাগ করেন সংসদ থেকে। তারপর তৈরি করা হয় অল পার্টি হুরিয়াত কনফারেন্সে (৩৩টি দলের মিলিত স্বাধীনতাকামী মোর্চা যা এখন কয়েক ভাগে বিভক্ত)।

হিজবুল মুজাহিদীন নামে এক সশস্ত্র সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে দলটি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হিজবুল মুজাহিদীন’ গ্রুপটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, দুর্দমনীয়। এই গ্রুপটিতে ছিল জামায়াতে ইসলামীর অসংখ্য ক্যাডার। প্রায় প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, এটি জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী গ্রুপ। ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থার লোকেরা এটা উপলব্ধি করেছিল যে, জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই গ্রুপ দমন করা কঠিন। জামায়াতের দাবি, ভারতীয় সংস্থার মূল টার্গেট ছিল জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও দ্বিতীয় সারির নেতারা।

৯০ ও শূন্য দশকের শুরুর দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা মারা যায়। স্বাধীনতাকামীদের মধ্যেও একটি গ্রুপ জামায়াত নেতাদের টার্গেট করেছিল বলে জামায়াতের দাবি। ওই গ্রুপটি স্থানীয়ভাবে ইখওয়ানি’ হিসেবে পরিচিত। ২০০২ সালে ভারতীয় চাপে’ নতিস্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের তৎকালীন আমীর গোলাম মোহাম্মদ বাট সংবাদ সম্মেলন করে জানান, হিজবুল মুজাহিদীনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না, নেই। সৈয়দ আলী শাহ গিলানী তখন জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক শাখার প্রধান। তিনি ছিলেন জেলখানায়। জামায়াতের আমীরের এই ঘোষণার পর সৈয়দ গিলানী তা মেনে নেননি।

তার মতে, আল্লাহর কথা মানুষকে বলার জন্য আগে আমাদের ভূ-খণ্ড স্বাধীন করা জরুরি। জামায়াতের বক্তব্য ছিল, আজাদি আসুক বা না আসুক, আল্লাহর কথা প্রচার করতে হবে। যুদ্ধ, সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করাই জামায়াতের অবস্থান। তবে, এখনও তারা নির্বাচনে অংশ নেন না। এক গণমাধ্যম সাক্ষাৎকারে ২০১৫ সালে জামায়াত আমীর মো. আবদুল্লাহ ওয়ানি বলেছিলেন, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ভারতের অধীনে না আমেরিকার অধীনে আছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। আফসাপা (আর্মড ফোর্স স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট) এখনও বিদ্যমান, যুবক ছেলেদের যখন-তখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে-এ অবস্থায় আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি

অপর এক জামায়াত নেতা এই লেখককে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী মনে করে, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর একটি বিরোধপূর্ণ এলাকা। পাকিস্তান, ভারত ও জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের প্রকৃত জনপ্রিয় নেতৃত্বের অংশগ্রহণে আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধান আশা করে দলটি। সমাধান হিসেবে তাদের দলের অবস্থান হচ্ছে, অবাধসুষ্ঠু গণভোট।’ আজাদি আন্দোলনে সশস্ত্র ভূমিকার প্রশ্নে ভিন্নমতের কারণে সৈয়দ আলী গিলানী জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হন। এছাড়া নানা কারণেই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে একদিকে আজাদি আর অন্যদিকে শান্তিপূর্ণভাবে মানুষকে ইসলামের মৌলিক চর্চার দাওয়াত এই দুই মত আলাদা হয়ে গেল।

অন্যান্য দেশের মতো ওখানেও জামায়াতে ইসলামী একটি ক্যাডারভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক লিমন মাজীদ লিখেছেন, জামায়াতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ক্যাডারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অনেকে মনে করেন, দলটির গণমুখী (Mass based) পার্টি হিসেবে কাজ শুরু করা উচিত। কিন্তু, গণমুখী দল হতে হলে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। একটা দল যখন ধারাবাহিকভাবে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব খুঁজে পায় না তখন তা বংশীয় শাসনে পরিণত হয়। এটা দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ গণমুখী দলের বৈশিষ্ট্যে

পরিণত হয়েছে। অপরদিকে জামায়াত তার ক্যাডারভিত্তিক দলীয় ব্যবস্থার কারণে, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের চেয়ে শৃঙ্খলা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে প্রধান্য দিয়েছে। ফলে, পীর সাহেবের হাতে প্রতিষ্ঠার পরও এটি বংশীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়নি।(6) এই রাজনৈতিক দলটি এখন নির্বাচনী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেই। কোনো নির্বাচনে তাদের দলের মূল-সদস্যরা (রুকন) ভোট দেন না। তাদের রুকনের সংখ্যা হাজার পাচেক। আর অসংখ্য সাধারণ কর্মী ও সমর্থক রয়েছে। তারা নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ১৯৮৮ সালে নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা ফালাহ-এ-আম নামে এক ট্রাস্ট গঠন করে বিভিন্ন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা শুরু করে। তাছাড়া, নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চালাচ্ছেন ‘ইসলামী-সামাজিক কার্যক্রম। সৈয়দ আলী শাহ গিলানী ‘আজাদিপন্থী বা সেপারেটিস্ট দল তেহরিক-ই-হুরিয়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখনও কাশ্মীরের একটা বড় সংখ্যক স্বাধীনতাকামী জনসংখ্যা মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের লক্ষ লক্ষ মানুষের আজাদি আন্দোলনের রক্ত দিয়ে হাত ধুয়ে ঘরে উঠেছে। অধ্যাপক শেখ সওকত হুসাইন লিখেছেন, জামায়াতের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষণীয়, যারা জামায়াতকে ‘রেডক্রসের ইসলামী সংস্করণ হিসেবে চালিয়ে নিতে চায়। তারা বিপন্নদের সেবা করবে। কিন্তু, নিজেরা সংঘাতে জড়াবে না। কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে তারা কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

এই প্রবণতাকে ইতিমধ্যে জীবন ও সম্পদ খুইয়ে সর্বহারা কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা বলেও মনে হয়। অনেকে মনে করেন, ভারতের বিভিন্ন সংস্থার নির্যাতন ও আক্রমণের কাছে জামায়াতে ইসলামী অসহায় ছিল। তাই তারা পরিস্থিতির শিকার। আবার অনেকেই মনে করেন, ১৯৯০-এর দশকে সশস্ত্র সংগ্রামে কর্মী ও রুকনদের পাঠিয়ে দিয়েই জামায়াতে ইসলামী ভুল করেছে। কারণ, ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে আজাদির জন্য লড়তে কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, আন্তর্জাতিকভাবে কারা তাদের কোনো ধরনের সহায়তা দিচ্ছে, কে প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে কথা বলবে এগুলোর হিসাব না করেই জামায়াত সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত করেছে অসংখ্য কর্মীকে। অন্যান্য স্বাধীনতাকামী গ্রুপ যেমন জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) আদর্শ হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। কিন্তু জামায়াতের আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র বড় এই দুটি গ্রুপের আদর্শিক ভিন্নতাও তাদের স্বাধীনতা প্রপ্তির জন্য বাধা হয়ে কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

মজার বিষয় হলো, ১৯৪৭ সাল থেকে উপমহাদেশের সব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জামায়াতের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং স্রোতের বিপরীতে। জামায়াত সচারাচর এটা অস্বীকার করেছে। আবার কখনো স্বীকার করেছে। ১৯৪৭’র দেশ বিভাগের মাধ্যমে মুসলমানদের আলাদা ভূ-খণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মাওলানা মওদুদীর প্রশ্ন ছিল, নতুন পাকিস্তান কী ইসলামী দেশ হবে? তাহলে নেতৃত্বকে

ইসলামী হতে হবে। জামায়াতে ইসলামী সব সময় চেয়েছে পাকিস্তানের নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণ করতে। সেখানে কখনও সফল হয়েছে, কখনও হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নেও তাদের অবস্থান ছিল একই। তাদের প্রত্যাশিত ইসলামী পাকিস্তান যদিও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত ছিল না, তবুও তারা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়ার বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে দলটি। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পরও তারা অব্যাহত চেষ্টা করেছে বাংলাদেশকে ইসলামী বাংলাদেশে পরিণত করতে। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্নেও জামায়াতের অবস্থান একই দেখা গেছে। তারা সবসময়ই বলতে চেয়েছে, ইসলামের ভিত্তিতে চলবে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের সমাজ।

আর, স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদী অন্যান্য অনেকেই বলেছে, ইসলামের সঙ্গে স্বাধীন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে হিজবুল মুজাহিদীন অনেক জাতীয়তাবাদী মুসলিম ও হিন্দু নেতাকে হত্যা করেছে বলেও জানা যায়। আবার বিপরীত ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। সেকুলার জেকেএলএফ-ই হিন্দুদের হত্যা শুরু করেছিল। জাতীয়তাবাদীরা সবসময়ই বলেছেন, গিলগিত, বালতিস্তান, লাদাখ, জম্মু এবং কাশ্মীর ভ্যালি নিয়ে মূল জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের একটি স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার কথা। সেখানে হিন্দু ও মুসলিম, বৌদ্ধ সবই থাকবে।

জামায়াতের অবস্থান ছিল ইসলাম। জামায়াতের এক তরুণ নেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০১৫ সালের মে মাসে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি আমার পরিচয় দিয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম তাদের দলের অবস্থান কাশ্মীর প্রেক্ষিতে। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘হিজবুল মুজাহিদীনকে জামায়াত সমর্থন করেছিল। তবে, এটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে না। হিজবুল মুজাহিদীনের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ সালাহউদ্দীন (আসল নাম সাইয়েদ ইউসুফ শাহ) এর সঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কিছু নেতার সুসম্পর্ক ছিল (পরে জানতে পেরেছি তিনি জামায়াতের একটি জেলা পর্যায়ের নেতা ছিলেন) সেই সম্পর্কের সুবাদে হিজবুল নেতা প্রেস কনফারেন্সে দাবি করেন, আমরা জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করছি। ইতোমধ্যে কাশ্মীরের যুবকদের মধ্যে বন্দুকের নলের প্রতি একধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।

সুতরাং, জামায়াতের কর্মী ও নেতাদের অনেকেই নিজ দায়িত্বে জাড়িয়ে পড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে। জামায়াত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হচ্ছে, দলটির কার্যক্রম সবসময়ই টপ-ডাউন ধরনের। উপরের সিদ্ধান্ত ছাড়া এর কর্মীরা কখনোই সিদ্ধান্ত নেয় না। সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার মতো একটা চরম সিদ্ধান্ত এ দলের প্রশিক্ষিত কর্মীরা নিজেরাই নিয়ে ফেলেছে এটা মানতে আমার দ্বিধা আছে। যদি তা হয়ই, তাহলে এটা স্পষ্ট যে, নব্বইয়ের দশকে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল ছিল। জামায়াতের ওই নেতার বক্তব্য অনুসারে, তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মনে হচ্ছিল, দ্রুতই কাশ্মীর স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। সরকার বলতে কিছু তখন ছিল না। চিফ

মিনিস্টার ফারুক আবদুল্লাহ তখন দায়িত্ব ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। কিন্তু, দ্রুতই ভারত সরকার পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তখন আর কিছুই করার ছিল না। এ প্রসঙ্গে জাস্টিস জিএন গওহরের মন্তব্য খুবই মানানসই। তিনি লিখেছেন,

The Jama’t leadership was against armed revolt but, as the gun attained the seal of popularity, their “elected’ legislators (in total five) resigned and associated themselves with this revolt. Within a month militancy swayed the public and the militant acquired the halo of the savior of the nation. A dominant section of Jamat-eIslami felt attracted to the popularity of the gun and so a militant outfit, under the name of J&K Hizbul Mujahideen, took birth from the womb of JKLF. The state Jamat declared it as its military wing.)

বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবকেই ব্যর্থতার কারণ বলে মনে করে জামায়াত। ওই নেতা জানান, ইখওয়ানি নামে একটা গ্রুপ ছিল। তারাও সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিল। মূলত, তাদেরকে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে কাউন্টার ইনসারজেন্সি গ্রুপ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। পরে, তারাই হিজবুল মুজাহিদীন ও জামায়াত নেতাদের হত্যা করেছে যা ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। মজার ব্যাপার হলো, কাশ্মীরের প্রায় অধিকাংশ মানুষের কাছে ‘ইখওয়ানি’ শব্দটি একটি অভিশাপ হিসেবে বিবেচিত। যেমনটা বাংলাদেশে রাজাকার’। জামায়াতের কাছে তাদের দলের নিহত নেতাকর্মীর সংখ্যার কোনো হিসাব নেই।

হাজার-হাজার। ওই নেতা আমাকে জানিয়েছিলেন, মোটামুটি ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সের যত মেধাবী নেতৃত্ব ছিল তার প্রায় সবই শহীদ হয়েছে। এখন নতুন করে আমাদের শুরু করতে হয়েছে। তবে, এখনও তারা মনে করে, স্বাধীনতা কাশ্মীরের মানুষের শিরায় শিরায় বহমান। এদের দমিয়ে রাখা যাবে না। মজার ব্যাপার হলো, দল হিসেবে তারা পাকিস্তানই কাশ্মীরের গন্তব্য মনে করে। তরুণ এক নেতার বক্তব্য ছিল, কাবা শরীফের পর দ্বিতীয় প্রিয় কোনো স্থান যদি থাকে অধিকাংশ কাশ্মীরির কাছে সেটা পাকিস্তান। সৈয়দ আলী গিলানীও নিজেকে পাকিস্তানের পক্ষে দাবি করেন। তিনি তা প্রকাশ্যেই বলে থাকেন। গণমাধ্যমে তাকে বলা হয় প্রোপাকিস্তান সেপারেটিস্ট লিডার’। সৈয়দ আলী গিলানীকে জামায়াতে ইসলামী এখনও বিশেষ ক্যাটাগরিতে দলের সদস্য হিসেবে দাবি করে। অর্থাৎ, জামায়াত ও তেহরিক-ই-হুরিয়াত এই দুই সংগঠনের যুগপৎ সদস্য হিসেবে কাজ করেন সৈয়দ গিলানী। ২০০৪ সালে তেহরিক-ই-হুরিয়াতের ও জামায়াতে ইসলামী এক

সমঝোতায় আসে। সে অনুসারে, গিলানীসহ ছয়জন নেতাকে এই দ্বি-দলীয় সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে জামায়াত। তরুণ ওই নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরে তো অনেক ধরনের মানুষ আছে। জম্মু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লেহ (লাদাখ)। শিয়া অধ্যুষিত কারগিল (লাদাখ)। ওই সব এলাকায় জামায়াতের কার্যক্রম আছে কি? তিনি জানিয়েছেন, ‘না’। অর্থাৎ, শুধুমাত্র কাশ্মীর ভ্যালি ও জম্মুর সুন্নী মুসলিমদের (মোট জনসংখ্যার আনুমানিক ৬৫%) নিয়েই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক পরিকল্পনা ঘুরপাক খায়।

ওই নেতা আরও বলেছিলেন, “আমরা কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চাই। প্রয়োজনে জম্মুর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি জেলা ভারতকে ছেড়ে দিতে আমরা রাজি আছি। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সৈয়দ নাজীর আহমেদ খাসানি। যিনি ২০০৩-২০০৬ সাল সময়ে জামায়াতের আমীর ছিলেন। ১৯৯০’র দশকে তিনি জামায়াত থেকে দূরে ছিলেন। ২০১৫ সালে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর একাধিক গণমাধ্যম নিবন্ধে জেনেছিলাম, দূরদর্শী এই নেতা ৯০’এ ঘটে যাওয়া জামায়াতের অনেক ঘটনাকে সমালোচনা করেছিলেন।

Khshani was critical of many things that happened in Jama’t after 1990s. Someone within Jama’t has to take that tradition of criticism further. When Khasani Sahab joined, he found his questions answered in the form of Jama’t. When he left, he left a bagful of questions for Jama’t to answer.(8)

অপর এক নিবন্ধে এজাজ উল হক লিখেছেন, “১৯৯০ এর সশস্ত্র সংগ্রামে জামায়াত যখন অগ্রভাগে দাঁড়িয়েছিল তখন খানি ছিলেন ক্ষীণকণ্ঠী স্বল্প সংখ্যক মানুষের একজন যাদের মতামত সহিংস হুংকারের কাছে ডুবে গিয়েছিল। খাসানি ছিলেন জামায়াতের সেই পক্ষের ব্যক্তি যিনি স্রোতের সঙ্গে মিশতে চাননি, বরং স্রোতের বিপরীতে থাকাকেই সঠিক মনে করেছিলেন। তিনিই কেবল বুঝতে পেরেছিলেন, সশস্ত্র পথ কেবল গণআত্মাহুতির দিকে নিয়ে যাবে’। ১৯৯০ সালে সাবেক আমীরের এই অবস্থান থেকে ধারণা করা যায়, ১৯৯০ সালে জামায়াত তার রাজনৈতিক অবস্থানে ঐক্যবদ্ধ ছিল না।

সুসংবদ্ধ এই রাজনৈতিক দলটি হুজুগের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, যদি ১৯৯০ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হতো, আর যদি জামায়াত সশস্ত্র সংগ্রামের বাইরে থাকত, তাহলে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের জামায়াতের অবস্থা বাংলাদেশ জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী’ হতো। তার চেয়ে বরং যুদ্ধে যোগ দিয়েই তারা ঠিক করেছিল কিনা? স্পষ্টত, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১-এ যা করেছে,

সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে করেছে। ঘটনার ৪০ বছর পরও তারা সেই অবস্থানকে সমস্ত উপায়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বিপরীত দিকে, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের ৯০’র স্বাধীনতার আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ দলীয় রাজনৈতিক কৌশলের অংশ ছিলই কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। এ বিষয়ে কাশ্মীরি লেখক (তিনি ইসলামপন্থী বলে আমার মনে হয়েছে) অধ্যাপক শেখ সওকত হোসেনের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা যায়। তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, বিশ শতকের প্রথমার্ধে শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ছিলেন অত্যাচারী রাজার শোষণের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণের সংগ্রামের প্রতিনিধি।

আর শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ্বে, সাংস্কৃতিক আগ্রসন ও গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেছে জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠন। অর্থাৎ, ভারতীয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কাশ্মীরি মুসলমানদের প্রতিরোধে জামায়াতে ইসলামীর শক্ত অবদান রয়েছে। এই জামায়াতে ইসলামী কাশ্মীরে কিভাবে প্রতিষ্ঠা ও বিকশিত হলো তাও এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়া জরুরি। বিশুদ্ধবাদী’ ইসলামী এই দলটিকে ১৯৪০-এর দশকে কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা সা’দ উদ্দিন নামে এক স্কুল মাস্টার। সর্বত্রই দলটি স্থানীয় জনপ্রিয় সুফি সংস্কৃতির বিরোধী। ফলে মাওলানা সা’দ উদ্দিনের জনসভাগুলোতে সাধারণত লোকজন আসত না।

এসব সামাজিক বাধা এড়িয়ে তিনি ৩/৪ জন লোকের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। এভাবেই, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি হয় দলটির। মার্কসিস্ট গবেষক ড, সাজাদ পাডের বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী হলো একটি ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক (Socio-Politico-Religious) সংগঠন। ১৯৮৪ সালে এই মাওলানা দল থেকে অব্যাহতি নেন। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার ওই মাওলানার অব্যাহতির পরই দলটি স্বেচ্ছায় অথবা পরিস্থিতির চাপে ভারত বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এবং যখনই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয় দলটির কর্মীরা সেই পক্ষে ঝুঁকে পড়ে। এই বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট, যদিও সশস্ত্র দলে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কর্মীরা স্রোতের সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু, ভারতের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে দলটির অগ্রগণ্য ভূমিকা নিঃসন্দেহ।

কেবল জামায়াতের কথা বললেই ইসলামী রাজনীতির প্রসঙ্গ শেষ হয় না। কারণ, কাশ্মীরের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করেছে এমন গোষ্ঠী শুধু জামায়াতই নয়। বলতে গেলে সকলেই ধর্মকে মিশিয়েছেন কাশ্মীরে। অসাম্প্রদায়িক শেখ আবদুল্লাহও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। শেখ আবদুল্লাহ ও তার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স সম্পর্কে ৯০-এর দশকের জেঅ্যান্ডকে-রাজ্যের গভর্নর জাগমোহনের উক্তিটি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, এমনকি শেখ আবদুল্লাহ ও তার দলকে জামায়াতে ইসলামীর জমজ বোন বলা হয়ে থাকে। কাশ্মীরের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট হতে আরও একটি পরিবার সম্পর্কে ধারনা নেওয়া

জরুরি। তা হলো, মৌলবি ইউসুফ শাহ পরিবার। ইউসুফ শাহ ছিলেন কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদের খতিব, যাকে কাশ্মীরি ভাষায় বলা হয় মীরওয়াইজ বা প্রধান বক্তা। কয়েকশ বছর ধরেই ওই পরিবার কাশ্মীরের প্রধান ধর্মপ্রচারকের আসনে আসীন। একে অনেকে তুলনা করেছেন দালাই লামা’র ইসলামী সংস্করণ হিসেবে। আর মীরওয়াইজের বয়ানের কেন্দ্র যে জামে মসজিদটি, সেটিও প্যাগোড়া আকৃতির কারণে অনেকেই তাকে কাশ্মীরিদের বৌদ্ধ সংস্কৃতির লিগ্যাসি বলে মনে করেন।(১৪)

বহু বছরের পুরনো হলেও মীরওয়াইজ পদের এই বিশেষ গুরুত্ব কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠা পায় আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালীর সময়ে, যিনি দিল্লির আলেম হজরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ’র বিশুদ্ধবাদী ইসলামী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ফলে, কাশ্মীরের জামে মসজিদে প্রতিষ্ঠিত মীরওয়াইজ পরিবার মূলত শরিয়তভিত্তিক ইসলামী প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই পরিচিত। বিখ্যাত আরব সাংবাদিক মুহাম্মদ আসাদ কাশ্মীরে এসে এই ইউসুফ শাহের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৪ সালে। হাদিস গ্রন্থ বুখারির ইংরেজি অনুবাদক মুহাম্মদ আসাদ। তিনি সেই অনুবাদের কাজও করেছিলেন কাশ্মীরে বসে। অবশ্য, শরীয়ত আর তরিকতের মধ্যে বিরোধ সেখানে অব্যাহত ছিল।

জামে মসজিদ থেকে মাত্র মাইল খানেক দূরে অবস্থিত অপর একটি প্রতিষ্ঠান খানকাহ-ইমওলা ছিল তরিকত পন্থীদের আস্তানা। ডোগরা শাসনামলে এই দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এমনকি সেটা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। ফলে, সে সময় মহারাজা ডিক্রি জারি করে শ্রীনগরের মসজিদগুলোকে দুই পক্ষের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছিলেন। মীরওয়াইজ পরিবারই কাশ্মীরে প্রথম ইসলামিয়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে। বলা হয়ে থাকে, ডোগরা মহারাজারা ওই মৌলবিকে আস্থায় রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন অভিজাত আলেম। শেখ আবদুল্লাহ রাজনীতিতে আসার শুরুতে এই মৌলবির পৃষ্ঠপোষকতা পান।

১৯৩১ সালে যখন শেখ আবদুল্লাহ যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তখন এই মৌলবির নেতৃত্বে ভাগ বসে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ১৯৩১ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলন শুরুর সময়ে শেখ আবদুল্লাহ স্কুল মাস্টার ছিলেন। আন্দোলন দমাতে তাকে গ্রামে বদলি করা হয়। আবদুল্লাহ তখন খনকায় গিয়ে চাকরি ছাড়ার ঘোষণা দেন। বিপরীতক্রমে, ইউসুফ শাহকে মহারাজার পক্ষ থেকে ৬০০ রুপি মূল্যের একখানা ওয়াজিফা উপহার দেওয়া হয়। মীরওয়াইজ মহারাজার কৌশল বুঝতে না পেরে তা গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহও এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মীরওয়াইজের বিপরীতে নিজেই জননেতা হয়ে ওঠেন। শেখ আবদুল্লাহ তখন জামে মসজিদের বিপরীতে তরিকতপন্থী খানকাহ-ই-মওলায় আশ্রয় পেয়েছিলেন। খানকাহ-ই-মওলায় শেখ আবদুল্লাহ সুরা আর রাহমান তেলাওয়াত করতেন। আর মহারাজার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতেন। অন্যদিকে জামে

মসজিদে ইউসুফ শাহ দিতেন ইসলামী বয়ান। খানকাহ-ই-মওলা ছিল কিছুটা সুফি ঘরানার বা তরিকতপন্থী। পরে অবশ্য শেখ আবদুল্লাহ হজরতবালেও তার রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিস্তার ঘটান। কিন্তু জামে মসজিদে আবদুল্লাহ ও তার ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। মৌলবি ইউসুফ শাহ কাশ্মীরে জিন্নাহকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে জিন্নাহকে কাশ্মীরে আমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল আবদুল্লাহ ও চৌধুরী গোলাম আব্বাসের মধ্যে সমঝোতা করানো। কিন্তু, সমঝোতা হয়নি। জম্মুর নেতা চৌধুরী গোলাম আব্বাস দেশভাগের আগে মুসলিম কনফারেন্স পুনর্গঠন করেছিলেন ইউসুফ শাহের সহযোগিতায়।

পরে, ১৯৪৭ সালে চৌধুরী গোলাম আব্বাস, মীরওয়াইজ ইউসুফ শাহ, সাংবাদিক পণ্ডিত প্রেমনাথ বাজাজসহ অনেকেই কাশ্মীর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ফলে, কাশ্মীরের একক ক্ষমতা রয়ে যায় আবদুল্লাহর হাতেই। আর অন্যরা পাকিস্তান শাসিত অংশে চলে যান। পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী গোলাম আব্বাস। মৌলবি ইউসুফ শাহ চলে গেলে তার এক ভাতিজা আতিকউল্লাহ শাহ জামে মসজিদে নায়েব-এ-মীরওয়াইজ হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। তিনি মারা যান ১৯৬২ সালে (১৫) পরে মীরওয়াইজ হন মৌলবি মোহাম্মদ ফারুক। তিনিও পারিবারিক ধারা অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৩ সালে হযরতবালের মুঈ-মুকাদ্দাস চুরির প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়।

তখন আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। তার নেতা ছিলেন মীরওয়াইজ মোহাম্মদ ফারুক। ওই সময়ে এই নতুন মীরওয়াইজকে মোকাবিলার জন্যই নেহরু শেখ আবদুল্লাহকে জেলখানা থেকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন বলে কথিত আছে। তখন কাশ্মীরের রাজনীতি আবদুল্লাহকেন্দ্রিক একমেরু অবস্থা থেকে আবারও দ্বিমেরু অবস্থায় (মীরওয়াইজ বনাম আবদুল্লাহ) ফেরত যায়। কিন্তু মীরওয়াইজ সেই অবস্থা ধরে রাখতে পারেননি। ওই ষাটের দশকেই জামায়াতে ইসলামী নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করে। ফলে, আবদুল্লাহর জন্য মীরওয়াইজ ঐতিহ্যবাহী প্রতিপক্ষ হলেও মৌলিক প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ে জামায়াত এবং তার রাজনৈতিক শাখার নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানী।

মীরওয়াইজ পরিবারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর স্থায়ী সমঝোতা হয়নি। কারণ, জামায়াত কখনও মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে বংশপরম্পরা সমর্থন করেনি। তবে, কাশ্মীরের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী জনমত তৈরিতে এবং শেখ আবদুল্লাহর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে মীরওয়াইজ আর জামায়াতের মধ্যে ঐক্য হয়েছে বারবার। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনেও মীরওয়াইজের আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি জামায়াতের নেতৃত্বে ইউনাইটেড মুসলিম ফ্রন্টকে (এমইউএফ) সমর্থন করে। পরে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যখন কাশ্মীরি তরুণেরা ঝুঁকে পড়ে তখন এই মৌলবি পরিবারটি ছিল দ্বিধান্বিত। মীরওয়াইজ ফারুক সে অবস্থায় রিমোটকন্ট্রোলড

রাজনীতিকের মতোই দ্বিধান্বিত অবস্থান নেন। ১৯৯০ সালে মোহাম্মদ ফারুক নিহত হন। তখন তার ছেলে ওমর ফারুক আসীন হন মীরওয়াইজ পদে। ২০০০ সালের পর কাশ্মীরে সশস্ত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়। অলপার্টি হুরিয়াত কনফারেন্স নামে স্বাধীনতার দাবিদার প্রায় ৩৩টি দল একসঙ্গে হয়। সৈয়দ আলী গিলানী তার নেতা হন। মীরওয়াইজ ওমর ফারুকও সেখানে অংশ নেন। পরে আবার হুরিয়াত বিভক্ত হয়।

মীরওয়াইজ ওমর ফারুকের নেতৃত্বে হুরিয়াতের একাংশ এখন হুরিয়াত (এম) বলে পরিচিত। তিনি এখনও কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যে প্রভাবশালী। স্মার্ট এই মৌলবির ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে গোটা মুসলিম বিশ্বে। এখনও জুমা ও ঈদে তিনি তেজস্বী বয়ান করেন জামে মসজিদে। মাঝে মধ্যেই নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সেখানে অংশ নিতে আরোপ করা হয় বিধিনিষেধ। প্রতিবার ঈদের নামাজের পর জামে মসজিদ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় মুসল্লিদের। সৈয়দ আলী গিলানীর নেতৃত্বে অপর অংশ হুরিয়াত (জি) নামে পরিচিত। এই গিলানী অংশই জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয়।

নোট/সূত্র

১. ১৯৪১ সালে নিখিল ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোটে এ দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর দলটি জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর এই তিনটি অংশে বিভক্ত হয়। একেক স্থানে একেক ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নে দলটির পূর্ব পাকিস্তান অংশের নেওয়া ভূমিকা সৃষ্টি করে এক ঐতিহাসিক বিতর্ক। পরে ১৯৭৭ সালে। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে বাংলাদেশেও কার্যক্রম শুরু করে দলটি।

২. মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট (মাফ) ছিল আবদুল্লাহ পরিবারের নেতৃত্বাধীন ভারতমুখী ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিপরীতে সকল দলের নির্বাচনী জোট। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে তারা ৮৫টি আসনের মধ্যে ৫টি আসন পায়। একমাত্র ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমর্থকরা ছাড়া কাশ্মীরের প্রায় সবাই স্বীকার করে যে ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ওই নির্বাচনে মাফ’র পাঁচটি আসনের মধ্যে একটি ছিল জামায়াতের সৈয়দ আলী শাহ গিলানীর। মাফের সবাই একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। পরে মকবুল ভাট, ইয়াসিন মালিকসহ চারজন পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে জেকে লিবারেশন ফ্রন্ট শুরু করে। পরে জামায়াত একই পথ অনুসরণ করে।

৩. Interview; Abdullah Wani; January 26, 2015; http://www.kashmirlife.net/issue-45-vol-06-72231; (Accessed on: 08 April 2015)

৪. Lymon Majid; Jama’at: What Next?; Kashmir Life; Aug 30-Sep 5, 2015; Pp: 12-13.

৫. Shaikh Showkat Hussain; Facets of Rescurgent Kashmir, Srinagar: Kashmir Institute; 2008. 87.

৬. G N Gauhar; Military Operation in Kashmir; Delhi: Manas; 2001. P155.

৭. প্রাগুক্ত, ১৪৪

৮. Riyaz Khaliq; Jama’t to get New Head in JK; Kashmir Life, 29th August, 2015 (Online)

৯. Mahmood Ur Rashid; Khshani: In context, as context; Greater Kashmir; 16th May, 2015; P9.

১০. Ajaz Ul Haque, Write Hand: Kashani Goes; Greater Kashmir; 17 May, 2015; P: 10.

১১. Shaikh Showkat Hussain; Facets of Rescurgent Kashmir; Srinagar: Kashmir Institute; 2008. P85.

১২. প্রাগুক্ত, ৮৭

১৩. Jagmohan (2011); My Frozen Turbulence in Kashmir, New Delhi: Allide; P: 181.

১৪. Shaikh Showkat Hussain; Facets of Rescurgent Kashmir, Srinagar: Kashmir Institute; 2008. 97-99.

১৫. http://www.hindustantimes.com/india/mirwaizmohammad-yusuf-shah/

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *