আজব গোয়েন্দার দেশে – আবুল বাশার

আজব গোয়েন্দার দেশে – আবুল বাশার

আবিরমামার মুখে ভূতের গল্প শোনা আমাদের চিরকেলে অভ্যেস। মামা মুখ বদলাবার জন্য আজ একটি নতুন প্রস্তাব দিলেন। চুনোর মুখের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে চেয়ে থেকে বললেন, “গোয়েন্দাগিরির চমৎকার গল্প বইয়ে পড়েছিস বিস্তর, কিন্তু চুনো, ম্যাজিক দেখিয়ে আততায়ী বা চোর ধরার গল্প তোদের জানা নেই। তাও ফের পি. সি. সরকারের ম্যাজিক নয়, সেটি হচ্ছে, যাকে বলে, ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’।”

ব্ল্যাক ম্যাজিক? ইংরেজিতে একটা নতুন লজ শুনলাম এমন বলব না, তবে কথাটার আবছা মানে মনে নিয়ে মামার গল্প শোনা ঠিক নয়। মামাই বললেন, “পি. সি. সরকারের ম্যাজিক অনেকটাই বিজ্ঞানভিত্তিক, অলৌকিক কিছু নয়, তাতে কোনও অতিপ্রাকৃত ঘটনা থাকে না। একজন আধুনিক জাদুকর, তুকতাকে বিশ্বাস করেন না। মন্ত্র মানেন না। বাণমারা, তুক করা, আত্মার কারসাজি, ভূতপ্রেত কোনও কিছুই মডার্ন ম্যাজিকে আসে না। এমনকী ‘ভোজবাজি’ কথাটা আমরা ব্যবহার করি, কোনও কিছুকে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করার জন্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ মন্ত্রতন্ত্র মানে, অলৌকিক ঘটনার দিকে তাদের ভয়ানক টান। ‘সম্মোহন’ শব্দটা নিশ্চয় শুনেছিস চুনো!”

আমাদের বোন কিরণ বলল, “আচ্ছা মামা, নজরবন্দি কাকে বলে?”

মামা নিঃশব্দে মিঠে হেসে বললেন, “সেটাই তো সম্মোহন রে! সাদা বাংলায় একটা কথা আছে ‘গুণ করা’। গুণ মানে জাদু। এটাই ব্ল্যাক ম্যাজিক। ইংরেজিতে Magus বলে একটা শব্দ আছে। প্রাচীন পার্শি পুরুতকে বলা হত মেইগ্যাস। Magus বলতে একজন জাদুকর জ্ঞানী ব্যক্তিকে বোঝাত, এই শব্দটা থেকেই Magi এবং তা থেকে Magian এবং শেষে Magician শব্দ এসেছে। সম্মোহন সংক্রান্ত বিদ্যাই আসলে কালো জাদু। একজন অগ্নি উপাসক পুরোহিতের জ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই ছিল অলৌকিকত্ব এবং তিনি সম্মোহন বিদ্যাবলে মানুষকে অভিভূত করতে পারতেন। এই পুরুতরা ছিলেন স্বপ্নবিদ, এঁরা মানুষের স্বপ্নের নানারকম ব্যাখ্যা দিতে পারতেন। এঁদের সম্বন্ধে বিশদ কিছু আর বলছিনে, পরে একদিন বলা যাবে। আজ আমি একজন বেঙ্গলি মেইগ্যাসের গোয়েন্দাগিরির একটা অকাট্য গল্প শোনাতে চাই।” বলে একটুখানি দম নেওয়ার জন্য থামলেন আবিরমামা।

মামা এবার রুপোর বুড়ো আঙুল প্রমাণ কৌটো থেকে আঙুলের চিমটি করে খানিকটা নস্য নাসিকার ছিদ্রে গুঁজে সাদা ধবধবে রুমালে নাকের ডগা রগড়ে মুছে সিধে হয়ে বসবেন। তাঁর চোখের ডিমে হালকা অশ্রু চিকচিক করে উঠবে। অতঃপর তিনি গল্পটা পাড়বেন, সব গল্পই মামার অভিজ্ঞতার গল্প। সংসারে যা ঘটেনি, মামা তা বলেন না।

মামা বললেন, “বেঙ্গলি মেইগ্যাস বলতে বাংলার এই জাদুকর-গোয়েন্দা ছিল পেশায় খেয়াদার পাটনি। ভৈরবের যে ত্রিমোহনী ঘাট, সেই ঘাটে খুঁটোবাধা একখানা ডিঙি ছিল গুণীলালের সম্বল। চরের জমি থেকে পাকা ধান আঁটি বেঁধে ওই ডিঙি করে পারে। নিয়ে যেত গেরস্তরা, তা ছাড়া মানুষ-ছাগল-মুরগি সব ওই ডিঙি করেই পারাপার হত। গুণীর খেয়াল চড়লে পয়সা দিতে হত না, দিতে হত ষান্মাসিক পাঁজা।

“পাঁজা কী মামা?” প্রশ্ন করলাম।

মামা রুমালে নাকের ডগা রগড়ে পকেটে রুমাল ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, “কথাটা হচ্ছে পাঞ্জা। হাতের পাঞ্জা যাকে বলে, এখানে ধরতে হবে মুঠোয় করে যতটা ধরা যায়, তাই হচ্ছে পাঞ্জা বা পাঁজা। মুঠোয় যতটা সামগ্রী উঠল, ধান-গম- ছোলা-পাট তাই দিয়ে দাও গুণীলালকে। আসলে একমুঠো না দশ-বিশ মুঠো, সেটাই ধর্তব্য। ধান-পাটের সময় ধান-পাট, রবিখন্দের সময় ছোলা-গম— ছ’মাস অন্তর। মানুষ গুণীকে সাধ্যমতো দেবে, মুঠোভরে দেবে। তাই বলে, গুণীকে ভিক্ষে দিচ্ছ ভেবো না, সে তোমার ফসল পার করেছে, তোমাকে খেয়া দিয়েছে। তুমি তার ডিঙি করে ফসলের মাঠে গেছ, হাটে গেছ, মকদ্দমা করতে শহরে যাবে, ত্রিমোহনী পার হয়ে গঞ্জের সদরে বাস ধরবে, তার আগে ঘাটপারে যাবে, গুণীই তোমার পাটনি। দশ হাতা পাট, পাঁচসেরি হেটোর ভরতি ধান তুমি অন্তত দেবে, চৈতালি ফসলও দেবে হেটো মেপে।”

“হেটো কী মামা?”

“তা-ও জানো না! বেতের বোনা এক ধরনের পাত্র।”

“ও, আচ্ছা।”

“সবাই তো আর পাঁজা দেওয়ার ক্ষ্যামতা রাখে না। যারা দেবে না, তারা কি ঘাট পারে যাবে না? যাবে। তারা হল ফ্রি-সার্ভিসের প্যাসেঞ্জার। গুণীর হিসেব ছিল, সে সকলের কাছে পাঁজা চাইত না।” বলতে বলতে মামা আবার একদণ্ড চুপ করলেন।

আবিরমামা তারপর হঠাৎ বললেন, “গুণীর পেশা সম্বন্ধে, না, একে বলে উপজীবিকা, সে সম্বন্ধে সাত কাহন বলা যায়। এই মানুষটাই ছিল আমার ছেলেবেলার গ্রাম্য গোয়েন্দা, থানার দারোগা যা পারত না, গুণী সেই রহস্য ভেদ করতে পারত। খেয়া পারে যায় না, এমন মানুষ গ্রামে নেই। সবারই নাড়িনক্ষত্র জানত গুণী। তা ছাড়া সে ছিল স্বপ্নবিদ। শতডিহার পড়তি জমিদার অম্বরপ্রসাদ ওরফে মধুবাবু পর্যন্ত তার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইতেন। একবার মধু মজুমদার তাঁর বালাখানায় গুণীকে ডেকে পাঠালেন।”

এতক্ষণে বুঝলাম, গল্প শুরু হয়ে গেছে। মামা বললেন, “মধুবাবু গুণীকে ডেকে কোনও ভূমিকা না করেই বললেন, শোন গুণীলাল, আমার মনে হচ্ছে, তোকে একটিবার বাটি চালান করতে হবে বাবা। চোর লেগেছে। আমার হরিণ-ঘর থেকে শিং চুরি যাচ্ছে। বাঘের চামড়া পর্যন্ত চোট হয়েছে। স্বপ্ন দেখলাম, আমি মরে গেছি। মরে গিয়েও নিস্তার নেই, মরে গিয়েও আমার দৃষ্টি বেঁচে রইল, দেখলাম, গুপ্তঘরের দেওয়াল থেকে পয়জন টেস্টিং ডিশ কে একজন পেড়ে নামাচ্ছে। পি টি ডিশ চলে গেলে ডোরা বাঁচবে কী করে? তুই দয়া করে পারশি বাটি চালিয়ে দে গুণী। আমি তোকে এই এত পাঁজা দেব, উপরি পাবি।”

“বাটি চালান কী জিনিস? পি টি ডিশ?” চুনোর কান বিস্ময়ে খাড়া হয়ে উঠেছে।

চুনোর কানের দিকে চেয়ে মামা বললেন, “দাঁড়া সব বলছি। আগে মধু মজুমদারের কথা শুনে গুণী কী ডায়ালগ দিলে, বলে রাখি। বললে, বাটি চালিয়ে অর্থ-সামগ্রী নিতে পারব না বাবু। গুরুর মানা আছে। মন্ত্রসিদ্ধি করে বাটি হাঁকে, মাগনা তো চলে না, ধাক্কা দিয়ে চালানো পাপ, বাটি চলে বশীকরণে, মন্ত্রে। ওই যে গাছের শিকড়, ওই হচ্ছে ড্রাইভার। আপনি বুঝবেন বাবু, খাবারে বিষ পড়লে ডিশ ফেটে যায়, বাটির পেটে শিকড় রাখলে বাটি মাটির ওপর দিয়ে চলতে শুরু করে। একে বলে আজ্ঞে দ্রব্যগুণ।”

চুনো বোধহয় বাটি চালানের ম্যাজিক খানিকটা অনুধাবনের চেষ্টা করছিল। সে কল্পনা করছিল, একটি অদ্ভুত ধরনের দুধ-কাঁসার বাটি মাটির ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর পাঁচ আঙুলে ভর দিয়ে একটি হাত। গুণীর হাত। বাটির পেটে কীসের একটা শিকড়।

মামা বললেন, “গল্পটা এবার আমি গুণীর হাতে ছেড়ে দেব। সে যেমন করে পারবে চালাবে।

“অম্বরপ্রসাদের কাছে পৌঁছতে অনেক ঘর এবং সরু বারান্দা পার হয়ে আসতে হয়। ঘরের ভেতরে ঘর, ঘরের এক মস্ত গোলকধাঁধা। ডাকাত পড়লে, তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। প্রাসাদটা যেন একটা দুর্গ। মেয়েরাই ডাকাতদের আড়াল থেকে অতর্কিতে বঁটিকাটা করতে পারে। ফলে জমিদার বাড়িতে ডাকাত পড়ার ঘটনা নেই। কিন্তু হরিণ-ঘর থেকে বাঘ-হরিণের চামড়া এবং হরিণের প্রশাখাময় শিং চুরি গেল কী করে! হরিণ-ঘরটা কোথায়?

“গুণী বলল, ‘আপনি স্বপ্নে মারা গেলেন বাবু। আপনার দৃষ্টি মরল না। হরিণ-ঘরের দেওয়াল থেকে পি টি ডিশ পেড়ে নামানো হচ্ছে, দেখতে পেলেন! তা হলে চলুন, হরিণ-ঘরে গিয়ে দেখি ক’টা জিনিস চোট হয়েছে।’

“‘আমি কি তা হলে বাঁচব না গুণীলাল?’ ককিয়ে জানতে চাইলেন মধুবাবু।

“‘কেন বাঁচবেন না বাবু! স্বপ্নের মধ্যে মরতে পারলে আয়ু বৃদ্ধি। তবে স্বপ্নে মৃতাবস্থায় দৃষ্টি সজাগ থাকলে অঘটন ঘটে, লাশ যা দেখে তার অনেক কিছুই ফলে যায়। আপনি ডিশ নামাতে দেখেছেন, ডিশ তা হলে নেমে গেছে।’

“গুণীলাল এক দফা কথা শেষ করেই ভয়ংকর কুকুর ডোরার মুখের দিকে বাঁকা তেরছা দৃষ্টিতে চেয়ে একটা ঢোক গিলল। বুকের ভেতরটা তার গুড়গুড় করে উঠল।

“গুণীলাল বুঝতে পারছিল বাবুর খাটের বিছানায় পড়ে থাকা লম্বা ত্যানার মতো ডোরা আসলে ত্যানা নয়, খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ালে পিলে চমকে যাবে। বাঘের মতো ঘ্রাউ করে গা মোচড়ায়, চোখ দু’টো ধকধক করে জ্বলছে।

“ঘরের দরজায় ঝুলছে ভারী পরদা। জানলা-কপাট বন্ধ। কোথা থেকে ক্ষীণ রেখার আলো এসে মেঝেয় পড়ে দিনের বেলাতেও ঘরের অন্ধকারকে ধাঁধিয়ে তুলেছে। এই আঁধারে এসে দাঁড়ালে গা কেমন ছমছম করতে থাকে। মেঝেয় চোখ পড়ল গুণীলালের। সে বেশ অবাক হয়ে দেখল, একখানা ডিশ দু’ভাগ হয়ে ভেঙে পড়ে রয়েছে, সেখানে খাবার ছড়ানো। গুণী বুঝতে পারল, ডিশের খাবারে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

“মধুবাবু বললেন, ‘ডোরা ঘাড় নামিয়ে খেতে যাবে, এমন সময় ফট করে ফেটে গেল।’

“গুণী গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, ‘খেতে কে দেয়?’

“লবঙ্গ। প্রায় এক যুগ আমার সংসারে আছে। খুবই করিৎকর্মা। ভারী বিশ্বাসী মেয়ে। ডোরা ওর হাতে ছাড়া খায় না। আমার নির্দেশ আছে, লবঙ্গ ছাড়া কেউ যেন ডোরার খাবার বেড়ে না দেয়। বাড়ির বউদের পর্যন্ত এক্তিয়ার নেই। কোনও পুরুষ ওকে খেতে দেবে না। এক টুকরো বিস্কুট অবধি না।’

“‘লবঙ্গই খেতে দিয়েছিল?’

“‘হ্যাঁ। কাজের মেয়ে লবঙ্গ। বারো বৎসর আমার হেঁসেল ঠেলছে। আমার সৎভাই বিষ্টু মজুমদার, যাকে লোকে হাবিলদার বলে জানে, সন্ন্যেসি গোছের মানুষ, পুব পাড়ার ডিহিতে থাকে, ওইই তো এই লবঙ্গকে জোগাড় করে এনেছিল। কথা হচ্ছে, লবঙ্গ বিষ মেশাবে, প্রত্যয় হয় না গুণীলাল।’

“‘আপনি তা হলে কাকে সন্দেহ করছেন?’ গুণীলালের প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলেম মধু মজুমদার। তারপর ডোরার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘সন্দেহ কাকে করব? ডিশ ফেটে গেল দেখে লবঙ্গ ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। বেলা গড়িয়ে গেছে, এখনও বেচারি খায়নি, মুখ শুকনো করে বসে আছে। ডোরাকে ভালও তো বাসে। বউগুলি তো রীতিমতো স্তম্ভিত। কে কী করল বুঝেই পাচ্ছি না। তবে সন্দেহ নেই, ডোরাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত। শুরু হয়ে গেছে। ও মরলে, আমিও মরব। চল তোকে হরিণ-ঘরটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।’ বলে খাট থেকে গা তুলে উঠে দাঁড়ালেন অম্বরপ্রসাদ।

“প্ৰসাদ জমিদার উঠে দাঁড়াতেই ডোরাও খাটের ওপর উঠে দাঁড়াল, গা ঝাড়া দিল। গা ভরতি বড় বড় সোনালি লোম, এত লোমশ কুকুর গুণী কোনও কালেই কোথাও দেখেনি। দেখেই মনে হয় স্বপ্নের কুকুর, যেন কোনও ম্যাজিকগুণে জন্ম নিয়েছে।

“কিন্তু পরদার তলায় মিলিটারি বুটপরা দু’খানি পা দেখে আঁতকে উঠল গুণীলাল। ‘ও কে?’ বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল। তখনই পরদা ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল হাবিলদার। তাগড়াই চেহারা। বাড়ি থেকে পালিয়ে মিলিটারিতে যোগ দিয়েছিল। ফিরে এসে আধা-সন্ন্যেসি হয়ে গেছে। মধুবাবুর কাছে পড়তি জমিদারির অংশ দাবি করেনি, বিষয়-সম্পত্তি সম্বন্ধে উদাসীন। একলা থাকে, বিয়েথা করেনি। এই মানুষটা এখনও গ্রামের পথে একাকী প্যারেড করে বেড়ায়, প্রতিটি ধাপ এত নিখুঁত মাপের যে, চোখে না দেখেও পথ দিয়ে যথাস্থানে চলে যেতে পারে। হাবিলদার আসলে ইদানীং তান্ধ। শোনা যায়, যুদ্ধে গিয়েই নাকি চোখে চোট পেয়েছিল। ধীরে ধীরে চোখের আলো নিভে গেছে। বছর দুই আগেও নাকি ঝাপসা দেখত। লেফ্‌ট-রাইট করতে করতেই ঘরের গোলকধাঁধা পেরিয়ে এই অবধি চলে এল আজ। তাজ্জব মানুষ। সন্ন্যেসিই নয়, আধা পাগলও বটে।

“ঘরের ভেতরে ঢুকে এসে হাবিলদার বলল, ‘লবঙ্গকে কি আমি নিয়ে যাব দাদা? বিষ দিক না দিক, কোনও মানুষই যখন সন্দেহের উর্ধ্বে নয়, তখন ওকেও এখানে রাখা ঠিক হবে না। আমিই ওকে কাজ দিয়েছিলাম, আমি না দিলে, তুমি নিতে না। অতএব লবঙ্গ চলে যাক।’ বলে অন্ধ মানুষটা চোখ পিটপিট করল বারকতক।

“মধুবাবু দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আমি তো ওকে কোনও সন্দেহ করিনি বিষ্টু, তুই কেন খামোকা গরম হচ্ছিস।’

“‘না, এটা আমার প্রেস্টিজ খানিকটা, কারণ আমিই ওকে দিয়েছিলাম। দ্যাখো, আমাদের জমিদারি প্রায় ফৌত হয়ে গেছে, কিন্তু ঠাটবাট তো যায়নি। গণ্ডা গণ্ডা কাজের লোক, ঝি, কে কী সরিয়ে নিয়ে পালাবে বলা যাচ্ছে না। আমি চাইব, লবঙ্গ বিশ্বাসী, সে বিশ্বাস রেখে চলে যাক। কী বল, গুণীলাল?’

“গুণীলাল বুঝল, সে যে মধুবাবুর কাছে এসেছে, তা কিন্তু গোপন নেই। মধুবাবু বললেন, ‘তোর প্রেস্টিজ আবার খুব ঠুনকো বিষ্টু। তুই লবঙ্গকে দিয়েছিস তো কী হয়েছে! আমি ওকে অবিশ্বাস করিনি। কেন করব, ওই তো ভোরার আপন।’

“হাবিলদার এবার কিছুটা নরম হয়ে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, লবঙ্গকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে এখান থেকে ‘আউট’ করতে পারলে কারও হয়তো সুবিধে হয়।’

“‘ঠিক বলেছিস বিষ্টু। আমারও তাইই মনে হয়েছে।’

“‘আচ্ছা দাদা, স্কুলের ডোনেশনের ব্যাপারে কী ভাবলে। দ্যাখো, এটাও কিন্তু প্রেস্টিজ। আমি পাগল-সন্ন্যেসি-হাবিলদার যাইই হই, লোকে স্কুলের জন্য চাঁদা চাইলে… যাকগে, আমিও কিন্তু জমিদার, আমি তোমার ভাই। আমার মর্যাদা গেলে, তোমারও থাকবে না। আমি আমার ভাগ থেকে ডোনেট করব। কখনও তোমার কাছে কিছুই চাইনি।’

“‘বেশ, বেশ। দেব তো বলেছি।’

“‘কবে!’

“‘আগে বাটি চলুক, তারপর।’

“‘ওহ, চোর ধরবে! দেখো গুণী, ভুল লোকের পায়ে যদি বাটি লাগাও, আমি তা হলে তোমাকে ছাড়ব না। বন্দুক হাতে করে সিধে চলে যাব। তোমাকে ডিঙির ওপর গিয়ে গুলি করে আসব। আমি সব দেখতে পাই, পা, আমি পা দিয়ে দেখি।’ বলে বুটের প্যারেড করে শব্দ তুলে হাবিলদার চলে গেল।

“‘পাগল।’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অম্বরপ্রসাদ।

“তা দেখে গুণী বলল, ‘হাবিলদার কিন্তু পাগল নয় বাবু। ওর ভাগ ওকে হিসেব করে দিয়ে দেন। খুব গরম, গুমোর আছে। চলুন, হরিণ-ঘরটা দেখি।’

“হরিণ-ঘরে এসে দেখা গেল, দেওয়ালের দু’টি স্থান ফাঁকা ডিশ নেই। একখানা ডিশ ফেটে গেছে, দু’খানা চুরি হয়েছে। শিং এবং ছালও কিছু চোট হয়েছে।’

“‘ডোরা আমার বডিগার্ড গুণী। ওর কাছে আমার সিন্দুকের চাবি আছে!’ বলে দরজার দিকে চাইলেন মধুবাবু। মনে হল, পরদার ওপারে কীসের একটা ছায়া সরে চলে যাচ্ছে। ঘর ছেড়ে দ্রুত বাইরে ছুটে এল গুণীলাল। দেখা গেল, ছোটবউ একটা ঝাড়ন হাতে চলে যাচ্ছে, তার সম্মুখে কেউ হয়তো ছিল।

“গুণীলাল ভয় পাচ্ছিল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, এই প্রাসাদে চোর ঢুকেছে। ডোরাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা চলেছে। ডোরার কাছে চাবি আছে, কিন্তু কীভাবে সেটা আছে, কোথায় আছে, ভেবে পাচ্ছিল না জাদুকর।

“দিনসাতেকের মধ্যেই পি টি ডিশ সমস্ত চোট হয়ে গেল। একদিন ঘোর সন্ধ্যার মুখে অন্ধ হাবিলদারকে কারা মুখোশ পরে বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটিয়ে কোথায় নিয়ে গেল। প্রাসাদে ডাক পড়ল গুণীলাল পাটনির। সে এসে পৌঁছতেই মধুবাবু বললেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে গুণী। তুই শিগগির বাটি চালিয়ে দে বাবা। ডোরার পায়ে লোমের তলায় ডোর দিয়ে বাঁধা সাংকেতিক চাবি ছিনতাই হয়েছে। ক’দিন আমিই ওকে খেতে দিয়েছি। পি টি ডিশ নেই। এ ঘরে কে কখন ঢুকল বুঝতে পারছি না। ডাকাতরা বিষ্টুকে সাবাড় করে দিত, কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচেছে। কী হবে গুণীলাল?’

“পাটনি শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি একবার লবঙ্গকে ডাকুন।’

“লবঙ্গ এল।

“গুণী বলল, ‘বউদের ডাকুন।’

“বউরা এল। ভাইরা এল। কাজের লোকরা সব এল। হাবিলদার পর্যন্ত এল।

“পাটনি হাবিলদারকে প্রশ্ন করল, ‘কারা ওরা?’

“‘কারা?’

“‘ওই যে আপনাকে বন্দুক উচিয়ে নিয়ে গেল।’

“‘কী করে বলব? চোখে তো দেখি না।’

“‘কোনও প্রশ্ন করেননি?’

“‘হ্যাঁ, তারা বলেছে, সরিষাপুরের ডাকাত।

“‘বেশ। আপনার কাছে কী চাইল?’

“‘চাবি। কিন্তু আমি কোথায় পাব বল! মনে হচ্ছে, এ-বাড়িতে ডাকাত পড়বে। দাদা, তুমি আজই লবঙ্গকে বিদায় করো।’

“হঠাৎ গুণী বলে উঠল, ‘কাল ভোরে বাটি চালান হবে। গাঁয়ে ঢেঁড়া দিন জমিদারবাবু। আমার মনে হচ্ছে চাবিটা পাওয়া যাবে।’

“কথা শেষ করেই পা বাড়ায় গুণীলাল। প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে বালাখানায় দাড়িয়ে হঠাৎ সে পুনশ্চ উক্তি করে, ‘লবঙ্গকে বিদায় করবেন না বাবু। ওকে একবার ফের ভাকুন তো!’

“‘কথা বলবে?’ মধুবাবু জানতে চান।

“গুণী বলল, ‘একটা কথা বলে যাই। আচ্ছা বাবু, চাবিটা দেখতে কেমন?’

“অম্বরপ্রসাদ বললেন, ‘গোল চাকতি মতন। সরু আর শক্ত লাল আংটা বাঁধা। চাকতির গায়ে সংখ্যা আর সংকেত লেখা আছে। যেভাবে আছে ঠিক সেভাবে সংখ্যা-সংকেত মিলিয়ে সিন্দুকের তালা ঘোরাতে হবে।’

“‘থাক, আর বলতে হবে না। আচ্ছা, ডোরাকে চান করাত কে? আপনি? স্নানের সময় চাকতি ডোরার সোনালি লোমের ভেতর থেকে ডোর খুলে বার করা হত? ভোরাকে খাওয়ানোর সময় গায়ে হাত বুলিয়ে দিত কে? আপনি?’

“‘না, লবঙ্গই দিত।’

“‘লবঙ্গকে ডাকুন।’

“লবঙ্গ ভিড় ঠেলে সম্মুখে এল। তাকে দেখেই গুণী বলে উঠল, ‘তুমি এক সন আগে আমার ডিভি করে পার হয়েছ লবঙ্গ। তারপর এই সাতদিন আগেও একদিন সরিষাপুর গেলে? যাওনি?’

“‘মধুবকুল গেলাম। মায়ের কাছে একবেলার জন্যে।’

“‘সরিষাপুরে কে আছে তোমার?’

“‘আমি মধুরকুলের মেয়ে।’

“‘তুমি কিন্তু সরিষাপুরে গিয়েছিলে। যাওনি? ঠিক আছে, কাল তোমার সঙ্গে কথা হবে, তুমি তা হলে লবঙ্গ নও?’

“‘সে কী গুণীলাল। আমিই আমি নই। তোমার কি মাথা খারাপ হল গুণীলাল! তুমি মানুষকে এতদূর অপদস্থ করতে পারলে। হায়, মানুষকে মানুষ গণ্যি করে না। তুমিই কিনা বাটি চালিয়ে মানুষ ধরবে। দেখুন হাবিলদারবাবু, কী বলে লোকটা! হায় হায় রে! আমি কোথায় যাব, কী করব।’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠল লবঙ্গ। ছাতা হাতে গুণীকে মারবার জন্য তেড়ে এল বিষ্টু মজুমদার। মধুবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘বিষ্টু, ঘটনা সন্দেহজনক। কথা বার করবার জন্য সত্যমিথ্যা জেরা করে মানুষ। গুণী বললেই লবঙ্গ কিন্তু দারুচিনি হয় না। তুমি সংযত হও, ছাতা নামাও!’ দাদার ধমকে বিষ্টু নিরস্ত হল।

“পরের দিনই হাটে ঢোলশহরত হল। সমস্ত দিগরের মানুষ জেনে গেল, শতডিহার ফৌত জমিদার মধুবাবুর বালাখানায় বাটি চালিয়ে চোর ধরা হবে। চাই কি ডাকাতও ধরা পড়তে পারে।

“তল্লাটের মানুষ ভেঙে পড়ল গুণীলালের বাটি চালান দেখতে। গুণীলাল কেবলই ভাবছিল অন্ধ মানুষ হাবিলদার ওরফে বিষ্টুবাবু কী করে তার মাথায় ছাতার বাঁট তুলে মারতে গেল? বিষ্টু মজুমদার কি দেখতে পায়? এ প্রশ্ন গুণী করেনি। মনে মনে ভেবেছে।

“বালাখানা লোকে লোকারণ্য, বালাখানা উপচে জনস্রোত পথ পর্যন্ত সার বেঁধে দাঁড়িয়ে— গুণী প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার কাঁধের থলেতে পারশি বাটি রয়েছে। রয়েছে বাটি চালানের শিকড়।

“শিকড় রাখা হল বাটির পেটে। আঙুল দিয়ে বাটির ওপর ভর দিল গুণিলাল। এবার বাটি এগোবে। থানা থেকে দারোগাও তাঁর দলবল নিয়ে এসে মানুষের স্রোত ঠেকিয়ে রেখে গুণীর কাজের সুবিধে করে দিচ্ছেন। এই বাটি মাটির ওপর দিয়ে ঘষে ঘষে এগিয়ে যাবে। অপরাধীর পায়ের কাছে এসে থামবে।

“বাটি চলতে শুরু করল। ডোরা এগোচ্ছে গুণীর পিছু পিছু। যেন সে-ও চোর ধরতে বার হয়েছে। যেন সে বুঝতে পারছে, তার লোমের তলে লুকনো চাবিটা গাপ হয়েছে। তাকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা। হয়েছে। সে মরলে, মধুবাবুও আর বাঁচবেন না।

“ডোরা এক সময় গুণীর কানের কাছে মুখ ঠেলে এনে বলল, তুমি কী করে বুঝলে লবঙ্গ আসলে লবঙ্গ নয়, অন্য কেউ? আমি তো গন্ধ শুঁকে ধরেছি। বলো তো, লবঙ্গর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেচারিকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিই, বলি, তুমি কে গো?’

“গুণী বলল, ‘দাঁড়া ভোরা। গন্ধ শুঁকে ধরলেই তো হবে না, অকাট্য প্রমাণ দিতে হবে। আগে বাটিটা লবঙ্গর পায়ে গিয়ে পৌঁছক। লোকে দেখুক, কীসে থেকে কী হচ্ছে!’

“সত্যি সত্যিই লবঙ্গর পায়ের কাছে এসে বাটিটা থেমে গেল। লবঙ্গ ভো ভয়ে কাঠ হয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। আজ কিন্তু বিষ্টু মজুমদার অন্ধেরই মতন চুপ করে রইলেন।

“গুণী বলল, ‘আমি গুণীলাল পাটনি, খেয়া দিই ত্রিমোহনী ঘাটে। তুমি কি ঘাট পারে যাও?’

“‘না’ বলে উঠল লবঙ্গ।

“‘আচ্ছা বেশ। তুমি কে?’ প্রশ্ন করল গুণী।

“উত্তর এল, ‘লবঙ্গ।’

“‘তোমার চোখ ক’খানা?’

“‘দু’খানা। দুইটা চোখ। তুমি কি কানা নাকি?’

“বেশ। কান দুটি?”

“‘হ্যাঁ। নিশ্চয়।’

“‘সবাই দুইটা-দুইটা? হাত দু’খানা? জবাব দাও।’

“‘কী দিব? আমি কি দুর্গা? আমি লবঙ্গ। দুইটাই হাত, দুশখানা পাব কোথা?’

“‘পা?’

“‘তা-ও দুইখানা। সবাই দেখছে।’

“‘পিত্যেক হাতে কয়টা আঙুল?’

“‘পাঁচ।’

“‘পায়ে, ডান পায়ে কয়টা আঙুল?’

“‘পাঁচ। তুমি মশকরা করছ গুণীলাল!’

“‘না। বাঁ পাখানা দেখাও। কয়টা আঙুল? শাড়ির তলা থেকে বার করো পা।’

“হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল গুণীলাল, ‘পা দেখাও। বার করো। দেখি কয়টা আঙুল। খেয়াপারে এই পা আমি দেখেছি। তুমি লবঙ্গ নও। এই দেখুন, বড়বাবু। আসুন, বাঁ পায়ে ছয়টা আঙুল। এ লবঙ্গ নয়। এর নাম দারুচিনি। লবঙ্গ-দারুচিনি দুই বোন। যমজ। অবিকল এক দেখতে। পার্থক্য শুধু আঙুলে।’

“থানার বড়বাবু ছুটে এসে বাঁ পা বাড়িয়ে ধরা দারুর আঙুল দেখলেন। বাস্তবিক ছ’টা আঙুলই বটে। মধুবাবুও দেখলেন এবং শিউরে উঠলেন।

“জমিদারবাড়ির বধূরা আঙুল দেখে হতবাক। গুণীলাল বলল, ‘এক সন আগে, এই দারুই ঘাট-পারে যাওয়ার সময় বলেছিল, তার পায়ে ছ’টা আঙুল। কারণ নৌকায় ওঠার সময় আমি সেই পা দেখে ফেলি। দারু বলেছিল, তার এক বোন মধুরকুলে থাকে। তার পাঁচটাই আঙুল। আমি থাকি সরিষাপুরে। পায়ে তফাত, গায়ে মুখে এক। সাতদিন আগে লবঙ্গ জমিদারি ছেড়েছে। নৌকায় উঠে বসলে, আমি তার বাঁ পায়ে লক্ষ করি, পাঁচটাই আঙুল। সকালে গেল লবঙ্গ, বিকেলে এল দারু। আচ্ছা, আপনি কি এ ঘটনা জানতেন বিষ্টুবাবু!’ বলেই বাটির দিকে চাইল গুণীলাল। বাটি নড়ে উঠল।

“বাটি নড়ে উঠে চলতে শুরু করল। দ্রুত বেগে ধেয়ে এসে হাবিলদারের পায়ের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

“‘চাবিটা আপনার কাছেই আছে হাবিলদারবাবু। দিয়ে দেন। দারু আপনাকে সংকেত-চাবি দিয়েছে। সিন্দুকের আশরফি মোহর আপনি আত্মসাৎ করতে চান।’

“‘না। চাবি আমার কাছে নেই গুণী। ডাকাতরা নিয়ে গেছে।’

“‘চাবি আপনার কাছে ছিল?’

“চুপ করে রইল বিষ্টু মজুমদার। মধুবাবু এগিয়ে এলেন, ‘শেযে তুই ডাকাতি করলি বিছু? চাইলে কি আমি দিতাম না?’

“‘না, তুমি কিছুই দিতে না দাদা। আমি বাধ্য হয়ে দারুকে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু চাবি আমার কাছে নেই। সরিষাপুরের ডাকাতরা নিয়ে গেছে। চল দেখাচ্ছি, কোথায় ঠেলে নিয়ে গিয়ে চাবি কাড়ল। ধাপ গুনে যাব। আসুন ওসি সাহেব, ডাকাতদের আস্তানা দেখবেন।’

“হঠাৎ গুণী প্রশ্ন করল, “আচ্ছা বিষ্টুবাবু। দারুকে আপনি সরিয়ে দেওয়ার জন্য এত পেড়াপিড়ি করছিলেন কেন?’

“‘কেন করব না। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। চোবের ওপর বাটপাড়ি হয়েছে। আমাকে চড় মেরে চাবি কেড়ে নিয়েছে দারুর লোকেরা। কী ভুলই না করেছি দাদা। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি অত্যন্ত নীচ, লোভী।’ বলে অন্ধ বিষ্টু মধুর পায়ে পড়ল।

“অন্ধ হাবিলদার চলেছে ডাকাতদের আস্তানা দেখতে। ধাপ গুনে তার কাজ। পুবে এত ধাপ, দক্ষিণে এত ধাপ, পশ্চিমে এত এবং উত্তরে এত। এভাবে পৌঁছনো গেল পুরনো জমিদারির বাগানে। ধাপ গুনে একটি মস্ত কোটরঅলা কাঁঠাল গাছের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বিষ্টু।

“বিষ্টু বলল, ‘এখানে খুঁজে দেখুন। এখানেই কোথাও পি টি ডিশ হয়তো লুকনো আছে। ডাকাতরা আমাকে মেরে চাবি কেড়ে নিল।’

“কোটরে কী আছে! পুলিশ সেখানে উঠে পি টি ডিশ পেড়ে নামিয়ে আনল। চাবি সেখানে নেই।

“জনস্রোত বাগান অবধি এসেছিল। একজন পুলিশ দারুকে বাগান পর্যন্ত পাকড়ে টেনে এনেছিল।

“গুণীলাল দারুকে বারবার জেরা করতে লাগল— ‘বল, কোথায় চাবি?’ দারু মড়াকান্না কাঁদতে লাগল, কিছুই বলতে পারল না। কেবলই একটা কথা তার মুখ দিয়ে বার হচ্ছিল, ‘লবঙ্গ আমাকে বলেছিল, ডোরাকে খেতে দিয়ে বারবার গায়ে হাত বুলিয়ে দিবি, নইলে বেচারি খেতে চাইবে না। লবঙ্গর দোষ নেই দারোগাবাবু। হাত বুলাতে গিয়ে চাবিটা হাতে ঠেকল গুণীলাল। না হলে পাপ হয় না।”

“মধু মজুমদার চরম আশ্চর্য হয়েছেন। বললেন, ‘এই ডিশ তুইই সরিয়ে রেখে কাজ ফতে করলি দারু? কে জানত, লবঙ্গ-দারুচিনি দুই বোন, যমজ। আঙুলের তফাত। দে দারু, চাবি দে।’

“কোথা থেকে দেবে দারুচিনি। বাগান থেকে ফিরে যাচ্ছিল জনস্রোত এবং পুলিশ। হঠাৎ পেছনে দেখা গেল, ডোরা বিষ্টুর ওপর মারাত্মক তেজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিষ্টুর জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন করে দিল। আঁচড়ে দিল নখ দিয়ে, দাঁত দিয়ে চিবিয়ে দিল। দেখতে দেখতে অর্ধনগ্ন বিষ্টুর কোমরে ডোরে বাঁধা লাল আংটার সাংকেতিক চাবি চোখে পড়ে গেল। হাবিলদার পালাচ্ছিল, তার পালানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, লোকটা অন্ধ নয়।

“মধুবাবুর পায়ে তখনও ধরে পড়ে আছে দারু। ডুকরাতে ডুকরাতে বলে চলেছে, ‘লবঙ্গের কোনও দোষ নাই বাবু! ওকে তাড়িয়ে দিয়ো না, ভালবেসেও মানুষ কুকুরের গায়ে হাত বোলায় জমিদারবাবু। লবঙ্গ কিছু জানে না গুণী!’ গুণী বলল, ‘বাটির শেকড়েও সে-কথা লেখা আছে দারুচিনি।”

৭ এপ্রিল ১৯৯৯

অলংকরণ: সুব্রত চৌধুরী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *