আছে ও নেই
সেদিন সকালে এক বৃদ্ধ এসে হাজির হলেন আমার কাছে। তিনি প্রায় কাতর স্বরে বললেন, চাচাজী, আমার একটা সাপের চাউট্টা (আঁচিলের আকৃতির এক ধরনের পরজীবী) দরকার। নাতিনডার খুব অসুখ, কবিরাজ কইছে, অসুধ বানাইতে সাপের চাউট্টা লাগব। লোকটার কথা শুনে বুঝলাম, তার ধারণা আমার বাড়িতে সাপের খামার জাতীয় একটা কিছু আছে। অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন। কারণ সাপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই শৈশব কাল থেকে। এক অজানা আকর্ষণের ফলশ্রুতিতে বার বার আমি ওদের কাছে ছুটে যাই। কত কিছুই না করেছি ওদের নিয়ে। সাপ ধরা, সাপের ছবি তোলা, দিনের পর দিন এদের বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়া। বিভিন্ন পত্রিকায় সাপের উপর আর্টিকেল আর গল্প লেখা-আমার এসব পাগলামির কথা তাই অনেকেরই জানা। সেই থেকে এই বৃদ্ধের মত অনেকের মনে। নানা ধরনের ধারণার জন্ম হয়েছে। কোথাও সাপ দেখা গেলে মানুষ আমার কাছে ছুটে আসে, একবার সাপে কাটা রোগী পর্যন্ত আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এলাকার পল্লী চিকিৎসক আমজাত ডাক্তারের চেম্বারে সাপে কাটা রোগী আসার সাথে সাথে আমার কাছে খবর পাঠানো হয়। অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে আমাকে এসব বিষয় মোকাবেলা করতে হয়। কারণ আমি কোনও সর্প বিশারদ কিংবা পেশাদার ওঝা নই, সাপ আমার নেশা। সেদিন ওই বৃদ্ধ যা চেয়েছিল তা আমার কাছে না থাকলেও, যেখানে থাকতে পারে, আমি তাকে সেই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
সাপের পাশাপাশি আমার আর একটি ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় হচ্ছে জিন। পৃথিবীর বুকে এদের অস্তিত্বের কথা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সেই ছোটবেলায় প্রথম জিনে ধরা মানুষ দেখেছিলাম নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। গ্রামের এক মহিলা দুপুর বেলা জঙ্গলে গিয়েছিল লাকড়ির সন্ধানে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাড়ি ফিরে না আসায় লোকজন বনে ঢুকে তাকে প্রায় অচেতন অবস্থায় খুঁজে পায়। তখন তার শরীর জুড়ে প্রচণ্ড খিচুনি আর মুখ দিয়ে গেঁজলা ঝরছিল। নানা বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল মহিলার বাড়ি। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর সবাই গেল দেখতে, সাথে আমিও। সেখানে যাওয়ার পর ওই মহিলার প্রচণ্ড খিচুনি আর ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি আমার ছোট্ট মনে দারুণ ভয় এনে দিল। এরপর প্রায়ই আমি নানা বাড়ির সামনের বিলের ধারে দাঁড়িয়ে ওপারের বনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওই যে দূরে ঘন বন, ওখানে বাস করে ভয়ঙ্কর জিন, গেলেই ধরবে-কথাগুলো মনে আসতেই আমি এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে যেতাম। সেই আমার জিনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
তারপর কৈশোরে একদিন হেঁটে যাচ্ছিলাম আমাদের গ্রামের কাদির মুন্সির বাড়ির পাশ দিয়ে। কাদির মুন্সি প্রয়াত পীর আলী নেওয়াজ মুন্সির ছেলে। জনশ্রুতি আছে আলী মুন্সির একাধিক অনুগত জিন ছিল। কাদির মুন্সিরও বাবার মত জিনের কারবার। প্রায়ই তার ওখানে জিনে ধরা রোগী নিয়ে আসা হয়। বাড়ির সামনে লোকজনের জটলা দেখে, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে গিয়ে উৎসুক জনতার কাঁধের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। আট ন বছরের একটা মেয়েকে দুজন শক্ত সমর্থ লোক দুদিক থেকে ধরে রেখেছে। মেয়েটার চুল। এলোমেলো, চোখদুটি রক্তের মত লাল। সে ক্রমাগত চেঁচিয়ে চলেছে, যামু না, আমি যামু না, আমার লগে বাড়াবাড়ি করিস না, জানে মারা পড়বি। তখন কাদির মুন্সি এগিয়ে এসে নিজের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মেয়েটার কড়ে আঙুল চেপে ধরল। সাথে সাথে সে কী গগন বিদারী চিত্তার-মুন্সি, তোর ক্ষতি হইব কইতাছি, আমারে ছাইড়া দে।
মুন্সির চেহারা ভাবলেশহীন। তিনি শীতল গলায় বললেন, মাইয়াডারে কোন জায়গা থাইক্যা ধরছছ আগে হেইডা ক।
মেয়েটি কিছু বলল না। মুন্সির নখ গম্ভীর হয়ে চেপে বসল মেয়েটির কড়ে আঙুলের পিঠে। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল, মাইয়াডা এমবি সাবের পুষ্কনির পার আইছিল দুপুর বেলা। হেইখান থাইক্যা ধরছি। ওটা আসলে আমাদেরই পুকুর। আমার বাবা ডা. ফজলুল করিম পাঠান এলাকার মানুষের কাছে এমবি (এম.বি.বি.এস-এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ) সাহেব নামে পরিচিত। এখন দেখা যাচ্ছে মানুষের জগতের বাইরে জিনের দুনিয়ায়ও তার পরিচিতি রয়েছে! মেয়েটার অবস্থা দেখে আমি তখন হতবিহ্বল, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। এই ছোট্ট বালিকা কীভাবে এসব কথা বলছে?
মেয়েটার (নাকি জিনের) সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে কাদির মুন্সি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, এই, মোস্তফা, বাঁশ ঝাড় থাইক্যা কয়টা কঞ্চি কাইট্যা লইয়া আয়। মোস্তফা দৌড়ে গিয়ে কয়েকটা কঞ্চি কেটে আনল। শুরু হলো কাদির মুন্সির দ্বিতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা। সপাং-সপাং কঞ্চির আঘাত পড়তে লাগল মেয়েটির গায়ে, আমি আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।
বাবা ছিলেন অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। তার চিন্তা-চেতনার সমান বিচরণ ছিল বাস্তব আর পরাবাস্তবে। দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর যেমন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তেমনি সম্পর্ক ছিল বিখ্যাত আলেম-ওলামা, তান্ত্রিক ফকির আর পীর-এ-কামেলদের সাথে। মাঝে মধ্যে তিনি অদ্ভুত সব কাজ করতেন। একবার এক জিন সাধকের সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি গাজীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে হাজির হলেন। বাড়ি খুঁজে বের করে নিজের পরিচয় দিতেই জিন সাধক যেন আকাশ থেকে পড়লেন, এই বিখ্যাত চিকিৎসককে গাজীপুরের কে-না চেনে? প্রত্যন্ত অঞ্চলের কত মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটে যায় ওঁর কাছে। এ মধ্যবয়সী-স্বাস্থ্যবান জিন সাধক তাঁকে সাধন কক্ষে বসিয়ে বললেন, স্যর, অজু ছাড়া ডাকলে জিনে আইৰ না, আপনে একটু বসেন আমি অজু কইরা আসি। সাধক অজু করতে চলে যাওয়ার পর বাবা ঘরটাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। জানালাগুলো ভোলা থাকায় তার কাজ সহজ হলো। (এ কাহিনি লিখছিলাম নদীর ধারে এক নির্জন ঘরের খোলা জানালার পাশে বসে। তখন রাত দশটা বিশ। মাত্র দুমিনিট আগে বিকট শব্দে জানালার পাশের একটি কলাগাছ পানিতে ভেঙে পড়ল, নিজের অজান্তে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল, চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই দেখলাম, গাছটা পাতা ছড়িয়ে পড়ে আছে কচুরিপানার দামের উপর।) সাধকের সমস্ত ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা মাত্র কাঠের চৌকি।
কিছুক্ষণ পর জিন সাধক ঘরে ঢুকে সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বিছানায় উঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে সামনে রেখে পদ্মাসনে বসলেন। এই বিশেষ পরিবেশে যে কোনও মানুষের পক্ষে সামান্য হলেও ঘাবড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু বাবার নার্ভ ছিল ইস্পাতের মত কঠিন। তাই তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে গোটা বিষয়টা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। চোখ বন্ধ করে অদৃশ্য জিনের উদ্দেশে সালাম দিলেন সাধক। সালামের প্রত্যুত্তরের সঙ্গে সঙ্গে গমগম করে উঠল সমস্ত ঘর। জিন আর সাধকের কথোপকথন চলল কিছুক্ষণ। তারপর বেশ কিছুটা সময় ধরে বাবার সঙ্গে জিনের প্রশ্নোত্তর পর্ব চলল। একসময় বাবাকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিল জিন। আর তৎক্ষণাৎ তিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইরে তখন জিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকজন মানুষ অপেক্ষমাণ। তাঁরা নানা সমস্যার সমাধান পেতে এখানে এসেছেন। তিনি তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকে প্রথমে সমস্ত জানালা খুলে ফেললেন, এরপর চৌকিটাকে ধরে এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। গোলাকার একটা গর্ত ভেসে উঠল সবার চোখের। সামনে। বাবা সেই গর্তের কাছে গিয়ে বললেন, বাইরে বেরিয়ে এসো, জিন বাবাজী, নইলে এখনই গরম পানি ঢেলে দেব। সাথে সাথে অতিকায় ইঁদুরের মত শীর্ণকায় এক যুবক বেরিয়ে এল গর্তের মুখ গলে। সাধক আর জিন দুটোই গিয়ে পড়ল বাবার পায়ে।
বিশ বছর পরের কথা। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র, বাবা ষাট বছরের তরুণ! এই বয়সেও তিনি স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ান বাইক নিয়ে, প্রায়ই রোগী দেখতে যান দূরবর্তী গ্রামে। এক সকালে তিনি আমাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে রওনা দিলেন চরনগরদী গ্রামের দিকে। আমি ভেবে পেলাম না হঠাৎ তিনি আমায় নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন। চরনগরদী বাজারে পৌঁছে মসজিদের পাশে বাইক রেখে তিনি পার্শ্ববর্তী একটি চৌচালা টিনের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরজার কড়া নাড়তেই পাকা আলেম টাইপের এক লোক বেরিয়ে এলেন। বাবাকে সালাম জানিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বাইরে যা দেখেছি ভিতরে সম্পূর্ণ অন্যরকম, ঘর তো নয়, যেন এক রাজ দরবার। কাঠের সিলিং-এর বিশাল ঝাড়বাতি, মেঝেতে মখমলের কার্পেট, ঘরময় আতরের তীব ঘ্রাণ-যেন এক সম্মোহনের রাজ্য। তিনি গিয়ে বসলেন ঝলমলে গালিচা বিছানো এক রাজকীয় খাটে। তাঁর ঠিক সামনে একটা বাক্স, ঠিক আড়তদারদের ক্যাশ বাক্সের মত। আমরা বসেছি বাক্সের ঠিক সামনে, পাশাপাশি দুটো চেয়ারে। খাটের পাশে রাখা সুদৃশ্য অ্যাকুয়ারিয়ামে শোভা পাচ্ছে বর্ণালি মাছের ঝাঁক। সাধারণ এক গ্রামের বাজারে এসব দেখে আমার রীতিমত ভিরমি যাওয়ার অবস্থা। আসলে এ হচ্ছে সাধারণ মানুষদের অন্যমনস্ক করার একটা কৌশল। তবে লোকটা যে এত দিনে অগাধ ক্ষমতার মালিক হয়ে গেছে তা এই ঘরের বিত্ত-বৈভব দেখেই বোঝা যায়। পোশাক আশাকে সুফী হলেও লোকটার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি ঠিক নেশাগ্রস্ত মানুষের মত।
বাবা এক সময় হাসতে হাসতে বললেন, আপনার কেরামতির অনেক গল্প শুনেছি, আজ নিজের চোখে দেখতে এলাম। তাঁর কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই লোকটা তাঁর খালি হাত বাবার সামনে মেলে ধরলেন, পরক্ষণেই সেটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের মুখের সামনে এক পাক ঘুরিয়ে মেলে ধরলেন। তার হাতের তালুতে দেখা গেল ছোট সাইজের একটা ফুট কেক। তিনি আমার দিকে কেকটা এগিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই তাঁর হাতে শোভা পেল আঙুরের আকৃতির কিছু টকটকে লাল ফল। আমার দিকে এগুলো এগিয়ে দেয়ার সময় তিনি বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ হচ্ছে অচিন ফল, জিন ছাড়া এই ফল আনার সাধ্য আর কারও নাই। কেকটা আমার খুবই চেনা, থানা সদরের বিভিন্ন কনফেকশনারী দোকানে পাঁচ টাকা দরে বিক্রি হয়। ফলগুলো চিনতে পারলাম না। একটা মুখে দিতেই মনে হলো এগুলো তাজা নয়। কোনও কিছু মিশিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমি তখন প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই করলেন না। আরও কিছুক্ষণ লোকটার সঙ্গে হাস্যরসাত্মক কথা বলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাবার আচরণ আমাকে হতাশ করল, তিনি কি বুড়িয়ে যাচ্ছেন, নাকি আমাকে নতুন এক ভেলকিবাজির জগতের সঙ্গে পরিচয় করাতে এখানে নিয়ে এসেছিলেন? তবে কি অতীন্দ্রিয় জগতের সঙ্গে ভেলকিবাজির কোনও সম্পর্ক কিংবা যোগসূত্র আছে? এ নিয়ে কি নতুন করে কিছু ভাবছেন তিনি? জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাওয়া গেল না। তবে আমি জানি এক সময় তিনি সবই আমার কাছে ব্যাখ্যা করবেন, সেটা দুদিন পরেও হতে পারে কিংবা দুবছর পর। বাবা এরকমই ছিলেন। সেদিন বিদায় নেয়ার আগে ওই লোকটা শূন্য থেকে একটা তাবিজ ধরে এনে আমায় দিয়েছিলেন, লেখাপড়ার উন্নতির জন্যে। তাবিজে কাজ হয়নি।
.
বছর খানেক পর এক সকালে খবর পেলাম টেকপাড়ার রাজ্জাক মিয়ার মেয়ের লাশ ঝুলে আছে বাড়ির অদূরে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর। প্রায় দৌড়ে গেলাম ঘটনাস্থলে। দুর্ভেদ্য কাঁটাঝাড়ি বাঁশ ঝাড়ের ঠিক মাঝখানে মাটি থেকে প্রায় দশ ফুট উপরে গলায় শাড়ি পেঁচানো অবস্থায় ঝুলে আছে তরুণীর নিষ্প্রাণ দেহ। যেখানে মেয়েটা ঝুলে আছে তার চারদিক বাঁশ আর কঞ্চিতে ভরা, সেখানে তার পক্ষে তো দূরের কথা কোনও শক্ত-সমর্থ যুবকের পক্ষেও ওঠা সম্ভব নয়। কেউ যে তাকে হত্যা করে এমন জায়গায় নিয়ে ঝুলিয়ে রাখবে, সে চিন্তাও কারও মাথায় এল না। দুপুরের দিকে পুলিশ আসার পর বেশ কয়েকটা বাঁশ কেটে মেয়েটার লাশ নামিয়ে আনা হয়েছিল। সবাই তখন বলাবলি করছিল, এইটা হইতাছে চাড়াল জিনের কাজ, জিনের মধ্যে তারাই হইতাছে সবচাইতে বদ। এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে রহস্যপত্রিকায় ফাল্গুনের আঁধার রাতে নামে একটি গল্পও লিখেছিলাম।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরের কথা। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে মাসুম ভূইয়ার বাড়িতে এক মহিলা বেড়াতে এলেন। দুএক দিনের মধ্যে গ্রামময় রটে গেল মহিলার জিন সাধনার খবর। একের পর এক লোক আসতে লাগল মাসুমের বাড়িতে। একেকজনের একেকরকম সমস্যা। কারও মেয়েকে তাবিজ করে নষ্ট করেছে কেউ, কারও বাচ্চা হয় না, কারও বিয়ে হয় না, কেউ চাকরি পাচ্ছে না আবার কেউ বউ পাচ্ছে না-নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল দিনে দিনে।
এক সকালে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হলাম মাসুমের বাড়িতে। মাসুম আমার চাইতে বছর পাঁচেকের বড়, ওর বউকে ভাবী বলেই ডাকি। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই পান্না ভাবী আমাকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠলেন। মৃদু হেসে বললাম, আপনাদের মেহমানের সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি। আর কিছু বলার আগেই ভাবী আমাকে জানালেন, এই মহিলা তার দূরসম্পর্কের খালা, বহু অনুরোধের পর এই প্রথমবারের মত তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর কথা আমার কাছে সত্যি বলে মনে হলো না। তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় আমাকে দক্ষিণের ভিটার ছোট্ট দোচালা ঘরে নিয়ে গেলেন।
চৌকির উপর বসে থাকা মহিলার বয়স নিঃসন্দেহে পঞ্চাশ পেরিয়েছে বছর কয়েক আগে। বয়সের সঙ্গে বেমানান রঙচঙে একটা শাড়ি পরেছেন তিনি, কাঁচা-পাকা চুল ছড়িয়ে আছে কাঁধের উপর। আমি ঘরে ঢুকতেই তিনি হেসে উঠে বললেন, কীয়ের লাইগ্যা আইছচ, ভাই, কী সমস্যা তোর?
কোনও রকম ভণিতা ছাড়া সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি জিন বিশ্বাস করি না, আপনি যদি আমাকে জিন দেখাতে পারেন তবে বিশ্বাস করব।
আমার কথায় প্রথমে তিনি চমকে উঠলেন, পরক্ষণেই রেগে উঠে প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, এই কতা আরও একজন কইছিল, জিনে আইস্যা তারে এমুন মাইর দিল, ছয় মাস হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে থাকতে হইছিল। আমার লগে যেইডা থাকে হেইডা হইল বদরাগী জিন; আমারেও মারে। এরপর তিনি আমার সামনে তার হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালি মেলে ধরলেন, জায়গাগুলো স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা ফোলা। মহিলার বাতজ্বর থাকতে পারে। তাই এসব দেখে আমি মোটেও বিচলিত হলাম না। আর তাতে তিনি আরও খেপে গিয়ে আচমকা বলে উঠলেন, ওই দেখ কী বড় সাপ, চাইয়া দেখ, ভাল কইরা চাইয়া দেখ, বেশি তেরিবেরি করলে এই সাপে তরে খাইব। তাঁর দৃষ্টি ঘরের মেঝেতে। আমার পাশে বসা পান্না ভাবীও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। পান্না ভাবী যে সাপ দেখছেন তাতে কোনও ভুল নেই, ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ভেসে আছে তার মুখে। শুনেছি এই মহিলা অনেককেই এভাবে সাপ দেখিয়েছেন।
কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। সরাসরি সেটা না বলে বললাম, আমি সাপ ভয় পাই না।
বাকিটা পান্না ভাবীই খোলসা করলেন, ওনায় সাপ ধরে, সাপ নিয়া খেলা করে, শুনছি সাপের মাংসও খায়।
কথাগুলো শোনার পর মহিলার, চোখ দুটোতে কেমন এক শীতল আভা নেমে এল। তারপর ঠিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ঠিক আছে, তোর যখন এতই শখ, আইজ রাইত বারোটায় আইবি।
মাসুমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মনটা কেমন যেন করে উঠল, এই ভেলকিবাজ মহিলার সঙ্গে লাগতে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? আসলে আমার মধ্যে তখন একটা চিন্তাই কাজ করছিল, যে কোনও উপায়ে এই মহিলাকে এলাকা থেকে তাড়াতে হবে। বিপদগ্রস্ত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে। পানিপড়া, তিলপড়া, তাবিজ-কবচ, এসব দিয়ে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
বিকেল পর্যন্ত বাড়িতে না গিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা। বলে জেনে নিলাম ওই মহিলার উপর জিন ভর করলে তিনি কী ধরনের আচরণ করেন। আরও জেনে নিলাম সেখানে সমবেত লোকজন কীভাবে কথা বলে জিনের সঙ্গে। এসব জানার পর আমার ভিতরটা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। কারণ যাদের সঙ্গে কথা হলো তাদের প্রায় সবারই বিশ্বাস, ওই মহিলা জিন ডেকে আনতে পারে। আরেকটা বিষয় খুবই অবাক লাগল, ওই সব লোকদের কয়েকজন আবার শিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
রাত তখন ঠিক বারোটা। আমার সামনে আনকোরা কাপড় পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তিনি বসে আছেন। নতুন শাড়ি না পরলে নাকি জিন বিরক্ত বোধ করে। আমাদের মাঝখানে পানিতে ভরা অ্যালিউমিনিয়ামের গোল পাত্র। লম্বা একটি বাঁশের কঞ্চি ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে পাত্রের জল থেকে খোলা জানালা পর্যন্ত। মহিলা তখন একদম চুপ। কিছুক্ষণ আগেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি শান্তই ছিলেন। রাগারাগী করেননি কিংবা আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টাও করেননি। আসলে আমি নিজেই তখন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। লোকজনের কাছে শুনেছি, তারা সবাই জিনকে হুজুর বলে সম্বোধন করে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর কি আসছেন? আমার ভিতরটা কেঁপে উঠল। জিনের সঙ্গে কথা বলা, এ তো কোনও সাধারণ বিষয় নয়! আমি সালাম জানিয়ে বললাম, হুজুর, আপনার আসতে এত দেরি হলো কেন?
সালামের উত্তর জানিয়ে জিন বলল, সিলেটের দরগায় জিকিরে
আছিলাম। কিছুটা নীরব সময় পেরিয়ে গেল। আসলে কেন জানি না আমি তখন কোনও প্রশ্ন বা কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর এক সময় নীরবতা ভাঙল জিনের কণ্ঠ, তুই সাপ নিয়া খেলা করস, এই সাপের হাতেই তর মরণ হইব।
এমন কথার আকস্মিক ধাক্কায় প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, হুজুর, যে সাপ নিয়ে খেলে সে মৃত্যুকে পরোয়া করে না।
তখন মহিলা আচমকা মাথার ঘোমটা সরিয়ে ফেললেন। আমি সোজা তাঁর চোখের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, এর কি জীবনের মায়া নাই।
খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম, কে এই সুন্দর দুনিয়া ছেড়ে যেতে চায়?
তখন দ্রুত তার ডান হাতটি মাথার পেছন দিক থেকে ঘুরে এল। আমার সামনে মুঠি খুলে ধরতেই নীল পাথর বসানো একটি সোনার আংটি চোখে পড়ল। পরক্ষণেই তিনি আবার সেটাকে অদৃশ্য করে ফেললেন। বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না, তিনি চাইছেন আমি যেন তার কাছে আংটিটা দাবি। করি, বিপদ মুক্তির আশায়। আমার সাহস ফিরে এল। তার কথায় কিংবা চোখের ভাষায় মোটেও প্রকাশ পাচ্ছে না যে তার উপর কোনও কিছু ভর করেছে। একমাত্র হাতের কারসাজিই তার সম্বল। তখন হঠাৎ আমার দৃষ্টি চলে গেল। জানালার বাইরের আকাশে, আহা, কী সুন্দর চাঁদ! অবলীলায় আমার মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এল, হুজুর, আপনারা তো আগুনের তৈরি, নিশ্চয় চাদে যেতে পারেন, আমায় চাঁদের গল্প বলুন।
আর ঠিক তখনই ওই মহিলা পাশে রাখা ঝাড়-ফুক করার ঝাড় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হুজুর, আপনি শান্ত হোন, আমি এখনই চলে যাব। মহিলা বসলেন আর আমি পকেটে হাত রাখলাম। কয়েকদিন আগে গ্রামের পথে হাঁটতে গিয়ে টেনিস বলের আকৃতির একটা লোহার বল কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ওটা ইদানীং প্রায়ই আমার পকেটে থাকে, এখনও আছে। বলটা বের করে মহিলার হাতে দিলাম, ওজন দেখে তিনি মনে হয় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। তারপর ওটা তার কাছ থেকে আমার হাতে ফিরিয়ে এনে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললাম, হুজুর, কাল যদি আপনি আসেন তা হলে এটা সোজা আপনার পেছন দিক দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। কথাটা বলেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। পরদিন মাসুমের বাড়িতে গিয়ে কেউ আর মহিলার দেখা পেল না।
জিন নিয়ে ভাবনার যে জিন সদা আমার শরীর কোষে বিরাজমান, তা এসেছিল বাবার কাছ থেকে। কত কিছুই না জানার ছিল তার কাছে। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা তিনি চলে গেলেন সেই মহাপ্রশ্নের না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যু আমাকে এক বেপরোয়া জীবন এনে দিল। কারণ তিনিই ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় ভালবাসা, সবচেয়ে বড় ভয়। থাক সে কথা। বাবার মৃত্যুর বছর চারেক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে এক স্বাধীন জীবন বেছে নিলাম। এখন মনের সুখে ছবি তুলি, গল্প লিখি, ঘুরে বেড়াই নানান জায়গায়। মাঝে মধ্যে কিঞ্চিৎ মদ্যপান করি, মন্দ লাগে না। আর সাপের ভাবনা, জিনের চিন্তা এসব তো সঙ্গে আছেই।
এক সন্ধ্যার কথা। টেকপাড়ার রিকশা চালক ফালু দেখা করতে এল আমার সঙ্গে। তার মুখে গভীর বিষণ্ণতার ছাপ। সে বলল, ভাইজান, বড় বিপদের মধ্যে আছি, ছোড় মাইয়াড়ার উপর জিন ভর করছে আইজ আট দিন, আপনেরে নিতে আইছি।
ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, আমি গিয়ে কী করব, তুমি বরং কাদির মুন্সির কাছে যাও অথবা শুক্রবারে জেলা সদরে একজন ভাল মনোচিকিৎসক আসে, মেয়েকে নিয়ে তার কাছে যাও।
ফালু নাছোড়বান্দা। সে বার বার বলতে লাগল, আপনারে একবার যাইতেই হইব, আপনে গেলে একটা না একটা কিছু ঘটব।
সাপের চাউট্টা নিতে আসা বৃদ্ধের মত ফালুর মনেও হয়তো ধারণা, গোপনে আমি জিনের সাধনা করে থাকি। আসলে আমি ওখানে গেলে তেমন বিশেষ কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই, নিতান্ত একজন দর্শক ছাড়া আমি যে আর কিছুই নই। তবু ফালু যখন চাইছে আর আমার নিজেরও আগ্রহের কমতি নেই, তাই তাকে বললাম, ঠিক আছে, কাল বিকেলেই আমি তোমার বাড়িতে যাব।
গ্রামের দক্ষিণের টিলার মত উঁচু জায়গায় টেকপাড়ার অবস্থান। বিকেলের সোনারোদ মাথায় নিয়ে লাল মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফালুর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাড়িটার অবস্থান লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে। চারদিকে বিশাল সব গাছপালা, বিশেষ করে বাড়ির দক্ষিণ দিকের প্রাচীন তালগাছের সারি চোখে পড়ার মত। একটা বিস্তৃত বাঁশ ঝাড়ও নজরে পড়ল। জায়গাটার নির্জনতা আমার মনে ধরল, একটা অতিপ্রাকৃত ভাব আছে বটে! এসব ভাবতে ভাবতে পা চালিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়লাম, বিশাল বাগানের মাঝখানে ছোট্ট এক বাড়ি। আসলে এই গোটা সম্পত্তির মালিক রফিক ব্যাপারি, তিনি ফালুকে এখানে বাড়ি করে থাকতে দিয়েছেন জায়গাটা দেখশোনা করার জন্য।
ছোট্ট বাড়িটার ঝকঝকে উঠনে তখন কম করে হলেও পনেরোজন মহিলা অর্ধচন্দ্রাকারে বসে আছেন আর তাঁদের সামনে বারান্দায় বসে আছে বছর আষ্টেকের এক শিশুকন্যা। আমায় দেখে দৌড়ে এল ফালু। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, কিছুক্ষণ আগে মেয়েটার উপর জিন ভর করেছে। আরও জানলাম, এই জিন মানুষের অতীত ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, চিকিৎসা জানে নানা অসুখের। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মেয়েটার কার্যক্রম নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। তখন এক মহিলা জিনের উদ্দেশে নিজের সমস্যার কথা বলে চলেছেন, আইজ পাঁচ বছর হয় আমার স্বামী নিরুদ্দেশ, তাইনে কই আছে, দয়া কইরা আমারে কইয়া দেন।
মহিলার কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথে মেয়েটি বলল, তর জামাই মইরা গেছে দুই বছর আগে, হ্যায় আর ফিরা আইব না কোনওদিন।
এ কথা জানার পর মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর পাশের এক মহিলা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, বহু ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছেন কিন্তু কিছুতেই অসুখ ছাড়ছে না। মহিলার কথা শেষ হওয়ার পর মেয়েটা বসা থেকে উঠে হনহন করে উঠান পেরিয়ে বাড়ির পাশের ঝোঁপ-জঙ্গলে পূর্ণ বাঁশ ঝাড়ের ভিতর ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ পর হাতে একটা গাছের শেকড় নিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর মহিলার কাছে গিয়ে শেকড়টা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই, শিকড় গরম সরিষার তেলে ডুবাইয়া রোজ রাতে বুকে মালিশ করবি, সব ঠিক হইয়া যাইব।
আমার সকল চিন্তা-চেতনা তখন বিস্ময়ের চূড়ায়। এতটুকু একটা মেয়ে, অথচ কী পরিপক্ক মানুষের মত আচরণ করে চলেছে! কী তার চাহনি! কী তার কথা বলার ধরন! সে বুড়ো মানুষের মত একের পর এক পান চিবিয়ে চলেছে, পানের রস গড়িয়ে পড়ছে তার চিবুকের দুপাশ বেয়ে। আরও একটা পান মুখে পুরে পানের বাটায় হাত দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল, ফালু, এই, ফালু, হাদা (তামাক পাতা) শেষ, তাড়াতাড়ি হাদা লইয়া আয়।
ফালু তখন আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে পাশের ঘরে ঢুকল। তামাক পাতা হয়তো খুঁজে পাচ্ছিল না, তাই বেরিয়ে এল কিছুক্ষণ পর। তামাক পাতা হাতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। মেয়েটার নাম মীম, এতক্ষণ মনে করতে পারছিলাম না। মীম হাতের ইশারায় তাকে ওর সামনে বসতে বলল। ফালু মাটিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে মীম তার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে বলল, হাদা আনতে এত দেরি হইল ক্যান, শয়তানের বাচ্চা?
ফালু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আর এমুন হইব না, আমারে মাপ কইরা দেন।
তৎক্ষণাৎ আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম, পরক্ষণেই বুঝলাম, ইদানীং এমন থাপ্পড় ফালুকে প্রায়ই খেতে হয়।
সন্ধ্যার একটু আগে উঠন ফাঁকা হয়ে গেল। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে বসলাম। এখানে আসার আগে বাজার থেকে কিছু চকলেট কিনেছিলাম। পকেট থেকে সেগুলো বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম। চকলেটের দিকে এক পলক তাকিয়ে পরক্ষণেই সে তাকাল আমার চোখের দিকে। সে কী অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! যেন আমার ভিতরটা পড়ে নিতে চাইছে। মিনিট খানেক এভাবে তাকিয়ে থাকার
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, এই লোক এইখানে আইছে ক্যান, ফালু? হ্যারে বিদায় কর, নইলে এর সর্বনাশ হইব কইতাছি।
আমি তখন আরও সন্নিকটে গিয়ে মীমের বাম হাত ধরলাম। তারপর তার কড়ে আঙুলের নখের ঠিক নীচে নিজের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে চাপ দিলাম (কৌশলটা কাদির মুন্সির কাছ থেকে শেখা।) মীম হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল, তুই চইল্লা যা, চইল্লা যা তুই।
বেশ স্বাভাবিক গলায় বললাম, আমি বেশিক্ষণ থাকব না, আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেই চলে যাব। এই কথায় কিছুটা শান্ত হলো সে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী?
সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার নাম ফাতেমা, তয় আমি একলা না, আমার লগে আরও একজন আছে।
জানতে চাইলাম, আপনারা কেন এর উপর ভর। করেছেন? মীম কিছু বলল না। কড়ে আঙুলে বুড়ো আঙুলের চাপ বাড়ালাম।
সাথে সাথে খেপে ওঠা গোখরোর মত ফোঁস ফোঁস করে বলল, বেশি কতা কইলে মাইয়াডারে মাইরা থুইয়া যামু।
আমি অনুনয়ের সুরে বললাম, দেখুন, মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে আর বাড়ির মানুষগুলো খুব বিপদে আছে। দয়া করে আপনারা চলে যান।
মীম হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। তখন দূরের মসজিদ থেকে ভেসে এল মাগরিবের আযানের ধ্বনি। আমি ওর হাত ছেড়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে বললাম, শুনেছি আপনারা এ বাড়ির সবাইকে নামাজ পড়তে বারণ করেছেন, আমি মাগরিবের নামাজ আদায় করে এখান থেকে যাব। মীমের হাত ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন ভেসে উঠল, চোখ দুটি যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এল, গাড়ির পিস্টনের মত ওঠানামা করতে লাগল বুক। ফালু আমার পাশ থেকে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটার খুব কষ্ট হচ্ছে।
ফালু মেয়ের দেহটা বুকে চেপে ধরে বলল, ভাইজান, এইভাবেই জিকির দিয়া জিন আসে আবার জিকির উঠাইয়া চইল্লা যায়।
এরপর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চেতনা হারিয়ে বাবার বুকে এলিয়ে পড়ে মীমের ছোট্ট দেহটি। আমি মাদুর বিছানো দাওয়ায় মাগরিবের নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে যাই।
নামাজ শেষ হওয়ার পর ফালু আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। হারিকেনের আলোয় দেখলাম, মীম তার পুতুলের বাক্স খুলে বসেছে। আমি গিয়ে পকেট থেকে চকলেটগুলো বের করে তার সামনে মেলে ধরলাম, সাথে সাথে লুফে নিল সে। নিষ্পাপ কোমল মুখটি খুশিতে ঝলমল করে উঠল। আমার কাছে তখন মনে হলো, এই দুনিয়া সত্যিই বড় রহস্যময়।
বিদায় নেয়ার আগে ফালুকে আমি আগের সিদ্ধান্তের কথাই জানালাম। হয় কাদির মুন্সি নয়তো মনোচিকিৎসক। আমি ওই দুজায়গাতেই এসব অসুস্থ মানুষদের অনেককে সুস্থ হতে দেখেছি।
মীমদের বাড়ি থেকে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। গ্রামীণ পথ ধরে কিছু দূর এগিয়ে আসার পর কী মনে করে পেছন দিকে তাকালাম। পরিষ্কার তারার আলোয় প্রাচীন গাছগুলোকে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো দানবের মত লাগছিল। আমার তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে, কী গভীর আতঙ্কে ওই বাড়ির মানুষগুলোর রাত কাটে!
এ কাহিনি লেখার প্রথম দিকে যে কলাগাছটা ভেঙে পড়েছিল, পরদিন নদীতে নেমে ওটাকে কিনারায় টেনে তুলতেই রহস্যের সমাধান পাওয়া গেল। গাছের মাথায় আলিশান সাইজের ছড়া। গ্যাড়া সুন্দর জাতের কলার ছড়া যেমন বড় হয় গাছও তেমনি বিশাল। ছড়ার ভারেই বিরাট কলাগাছটি নদীতে ভেঙে পড়েছিল। তবে কথা হচ্ছে-গাছ ভাঙার আর সময় ছিল না?
অরণ্য সরওয়ার
Ei golpotar kono aga matha pelam na ami