আচমকা এক টুকরো ২
আগে থেকে ভেবেচিন্তে, এক-দেড়মাস আগে ট্রেনের টিকিট কেটে, গন্তব্যে পৌঁছবার আগেই থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করে ভ্রমণে বেরুনো আমার ভাগ্যে বিশেষ ঘটে না। উঠল বাই তো কটক যাই এবং কটক যেতে যেতেও চলে গেলুম কাঠমান্ডু, এরকমও হয়েছে বহুবার। ট্রেনে যেতে যেতে একটা বেশ সুন্দর স্টেশন দেখে পছন্দ হয়ে গেলে সেখানে নেমে পড়তেই বা বাধা কী? সেই রকমভাবেই আমি একবার নেমে পড়েছিলুম ধলভুমগড়ে। তার আগে আমি আমার চেনাশুনো কারওর কাছ থেকে ধলভুমগড়ের নামও শুনিনি। সেই হিসেবে আমার নিজের কাছে অন্তত, ধলভূমগড় জায়গাটি আমারই আবিষ্কার।
আমার মুখে এরকম দু’একটা জায়গার গল্প শুনে দু-একজন প্রশ্ন করেছিল, লোকে তো ট্রেনে চাপে কোনও বিশেষ জায়গায় যাবে বলেই সেখানকার টিকিটি কেটে। তুমি কি অনেক দূরের জায়গার টিকিট কেটে মাঝপথে নেমে পড়ো? এর উত্তর খুব সহজ। টিকিট না কেটেও তো ট্রেনে চাপা যায়! বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ একটা সামাজিক অপরাধ? তা কি আর আমি জানি না! কিন্তু কে বলেছে যে আমি একখানা বিরাট দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সমাজ সেবক? যে-সমাজ লক্ষ-লক্ষ বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরি দিতে পারে না, যে-দেশ এখনও লক্ষ-লক্ষ ভূমিহীন কৃষক আর কর্মহীন মজুরকে বছরের অর্ধেক দিন অভুক্ত রাখে, সেখানে বহু লোক তো ট্রেনের ভাড়া ফাঁকি দেবেই। আমার মুখে একটু বেশি বড়-বড় কথা হয়ে গেল? তা, কুঁজোরও তো মাঝে-মাঝে চিত হয়ে শুতে সাধ হয়!
একবার ঠিক ট্রেনে চেপে নয়, গাড়িতে আসতে আসতে একটা বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল!
সেবার আমি ঝিলিমিলি, মুকুটমণিপুর, শুশুনিয়া পাহাড়ের দিকটা ঘোরাঘুরি করে এসে পৌঁছেছি বাঁকুড়া শহরে। এবার কলকাতায় ফেরার পালা। সন্ধে হয় হয়, বাস ডিপোতে কী কারণে যেন প্রচণ্ড ভিড়, আজ আর ফেরার আশা নেই। বাঁকুড়া শহরে আমার ঠিক রাত্রিবাসের জায়গা নেই, কিন্তু কাছাকাছি বেলেতোড় গ্রামে, শিল্পী যামিনী রায়ের এক নাতির সঙ্গে ক্ষীণ পরিচয়ের সূত্রে থাকার জায়গা পাওয়া যেতে পারে।
বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কীভাবে বেলেড়ে যাব তাই নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় একটা জিপগাড়ি আমাকে ছাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে থেমে গেল, আবার ব্যাক করে চলে এল আমার কাছে। পূর্বপরিচিত মুরুব্বি দাদাগোছের একজন মুখ বার করে বলল, কী রে হা করে আকাশের দিকে চেয়ে তারা গুনছিস নাকি?
আমাকে যেমন বিনা দোষে পুলিশে ধরে নিয়ে মেরেছে, একবার আমাকে একজন অন্যলোক ভেবে একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে অপমান করা হয়েছিল, সেই রকমই হঠাৎ হঠাৎ এমন সৌভাগ্যেরও উদয় হয়। আমার সেই দাদাটি তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তির জিপে কলকাতায় ফিরছেন। জিপের আসল মালিকের মতামত না নিয়েই তিনি আমাকে বললেন, উঠে পড়, উঠে পড়! পেছন দিকে সর্বাঙ্গে চাদর মুড়ি দিয়ে একজন লোক বসে ঢুলছিল, আমার স্থান হল তার বিপরীত দিকে। লোকটি একবার আমার দিকে তাকালও না। আমি দুটি ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলুম। কলকাতায় ফেরার জন্য আমার কোনও ভাড়া লাগছে না। ঘণ্টা-পাঁচেকের রাস্তা, মাঝখানে এরা খাবারের জন্য নিশ্চয়ই কোথাও থামবে, তখন আমাকেও খেতে ডাকবে নিশ্চয়ই। সুতরাং আমার সমুখের লোকটির দৃষ্টান্তে অমিও ঘুমিয়ে পড়তে পারি! অন্ধকার রাস্তায় জিপের পিছন দিকে বসলে আর কীই-বা করার থাকতে পারে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ঘুম ভেঙে গেল। জিপটা থেমে আছে একটা ঘুরঘুট্টি জায়গায়। আমার দাদাটি বললেন, এই নেমে আয়, নেমে আয়, গাড়ি ঠেলতে হবে।
তাতে আমার আপত্তি নেই। গাড়ি যারা চাপে, তাদের সকলকেই কোনও না কোনওদিন গাড়ি ঠেলতেই হয়। গাড়ির মালিকরাও বাদ যায় না। এটা হচ্ছে গাড়ির কৌতুক। বেশি কৌতুকপ্রবণ গাড়িগুলো ইচ্ছে করে খুব গণ্ডগোলের জায়গায় খারাপ হয়ে বসে।
বাঁকুড়া থেকে বিষ্ণুপুর আসার পথে খানিকটা ঘন জঙ্গল আছে। সেখানে ডাকাতির বেশ সুখ্যাতি আছে। প্রাইভেট গাড়ি জিপ তো আকছার, এমনকী সেই অকুতোভয় ডাকাতরা যাত্রী ভরতি বাসেও হামলাও করে মাঝেমাঝে। শুনলুম, জিপটা সেই জঙ্গল পেরিয়ে এসেছে। একটু নিরাশই হলুম বলতে গেলে, আমাদের জীবনে রোমাঞ্চের এত অভাব মাঝেমাঝে একটু ডাকাতি ফাঁকাতির অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই তো!
এই জাগয়গাটি নির্জন দুপাশে বড় বড় গাছ রয়েছে, কিন্তু জঙ্গল নয়। অনেক দূরে মিটমিট করছে কোনও গ্রামের আলো।
আসলে জিপটি খারাপ হয়েছে প্রায় আধঘন্টা আগে। জিপের ড্রাইভার এতক্ষণ খোঁচাখুচি করেও ইঞ্জিনটা সচল করতে পারেনি। এখন উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়িটাকে ঠেলে ঠেলে কোনও লোকালয়ে পৌঁছনো। রাস্তার মাইলপোস্টে কোনও অত্যুৎসাহী বঙ্গ প্রেমিকের দল আলকাতরা লেপে দিয়েছে। আমরা যে ঠিক কোথায় আছি, তা বোঝা যাচ্ছে না। দূরে যে আলোর বিন্দু দেখে গ্রাম মনে হয়েছিল, সেটা অবশ্যই মরীচিকা, কেন না, গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গদলঘর্ম হতে হতে মনে হচ্ছিল, এইভাবেই এক সময় কলকাতায় পৌঁছে যাব।
একটা বাঁক ঘুরতেই অবশ্য একটা জনপদ চোখে পড়ল। খুব ছোটখাটো জায়গাও নয়, সেখানে বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। একটি দুটি দোকানও খোলা রয়েছে। তাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে কোনও গাড়ি সারাবার ব্যবস্থা নেই, একজন মেকানিক আছে বটে, কিন্তু রাত্তিরে তাকে দিয়ে কোনও কাজ হবে না।
সেই শহরে একটি ডি ভি সি-র অফিস এবং সংলগ্ন গেস্টহাউসও রয়েছে, রাত্তিরের জন্য জায়গা পাওয়া গেল সেখানে। ডিমের ঝোল এবং গরম ভাতেরও ব্যবস্থা হল, তারপর মশার গান শুনতে-শুনতে ঘুম।
সকালে উঠে, একটুখানি বাইরে এসেই আমি যাকে বলে চমৎকৃত।
ছোট্টখাট্টো, অপূর্ব সুন্দর, ছিমছাম একটি রেল স্টেশন। জায়গাটার নাম সোনামুখী। সেই স্টেশানের প্রাঙ্গণেই বড় বড় সরল, উন্নত শাল গাছ। এমন পরিচ্ছন্ন স্টেশন আমি বহুঁকাল দেখিনি।
সোনামুখী নামটা তো আগে শুনেছি নিশ্চয়ই, কিন্তু জায়গাটা যে কীরকম সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না, কোনওদিন সোনামুখীতে বেড়াতে যাওয়ার উপলক্ষও ঘটেনি বা সেরকম পরিকল্পনাও আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু দিনের আলোয় প্রথম দর্শনেই আমার জায়গাটা ভালো লেগে গেল।
পশ্চিমবাংলায় মফসসল শহর মানেই সরু সরু রাস্তা, গরুর গাড়ি ও সাইকেল রিক্সার যান জট, খোলা ড্রেন নীল ডুমো মাছি, বাতাসে পেঁকো-পেঁকো গন্ধ, ভ্রমণের পক্ষে আকর্ষণীয় কিছুই থাকে না। সোনামুখী যে সেই তুলনায় বিরাট কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম তা নয়, কিন্তু এই পুরোনো শহরটির রাস্তাঘাট তেমন নোংরা নয়, গোলমাল কম। প্রাতরাশের জন্য একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে কয়েকটা জিলিপি ও সিঙারা খেয়ে চমকে উঠলুম, খাবারগুলোতে কেমন যেন অচেনা খাঁটি খাঁটি স্বাদ। এরপর দুটো রসগোল্লা খেয়ে চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। মাত্র চার আনায় এমন সাইজের এমন সুস্বাদু রসগোল্লা পৃথিবীতে এখনও কোথাও থাকা সম্ভব?
গাড়ি সারাবার নিয়ম হল, একজন মেকানিক খুঁটখাট করবে আর পাঁচজন সেখানে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নানারকম মন্তব্য করবে। আমি গাড়ির কলকবজা বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করব! কিন্তু আমি একটু অন্যদিকে পা বাড়াতে গেলেই আমার সেই দাদাটি ধমকে ওঠেন, অ্যাই, কোথায় যাচ্ছিস। এক্ষুণি গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে আমরা স্টার্ট করব।
মেকানিকটি যে-পরিমাণ যন্ত্রপাতি খুলে ফেলেছে, সেসব আবার জোড়া লাগাতে যে খুব কম সময় লাগবে না, সেটুকু অন্তত আমি বুঝি। মাঝেমাঝে ওখান থেকে পালিয়ে গিয়ে এক ঝলক করে সোনামুখী শহরটা দেখে আসি। একবার বাজারের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে একটা মাটির হাঁড়ি-কলসির দোকানে কিছু পুতুল দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়লুম। বাঁকুড়ার লম্বা কানওয়ালা ঘোড়ার খ্যাতি সুবিদিত, সোনামুখীতে দেখলুম রয়েছে মাটির হাতি। তারও বেশ বৈশিষ্ট্য আছে। এই হাতিগুলোও এখানে কোনও একটা পুজোয় লাগে, কিন্তু ঘর সাজাবার পক্ষেও অনবদ্য। বেশ শস্তা দেখে কিনে ফেললুম এক জোড়া। তাই দেখে জিপ গাড়ির দাদারা কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল, আমার ওপর অর্ডার হল আরও গোটা ছয়েক হাতি কিনে আনার। হাতিগুলো নেহাত ছোট নয়, ছ’খানা আমি আনব কী করে?
‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হস্তি লোফেন যখন তখন’-এর স্টাইলে নিয়ে আসব? তার চেয়েও ভালো উপায় আছে, সেই ফাঁকে সোনামুখীর মন্দিরটা দেখে এসে জানালুম, যাঃ, সব হাতি শেষ!
এইরকম ভাবে একটু একটু সোনামুখী দেখতে লাগলুম আর মনেমনে জোর প্রার্থনা চালালুম, হে বাবা, বিশ্বকর্মা, আজ যেন কিছুতেই ওই জিপ গাড়িটা ঠিক না হয়। আরও জখম করে দাও বাবা, আরও একটা দিন সোনামুখীতে থেকে যাই।
তা অবশ্য হল না। সোনামুখীর একমাত্র দক্ষ মেকানিক দুপুরের দিকে সবকিছু জোড়াতালি দিয়ে জিপটাকে এক অদ্ভুত অবস্থায় দাঁড় করাল। জিপটা অতি আস্তে, প্রায় শম্বুক গতিতে ধক ধক শব্দ করে চলতে পারে।
সেই অবস্থায় জিপটাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে গেলে অন্তত দু’তিন দিনের ধাক্কা, তা ছাড়া মাঝপথে আবার সবকিছু খুলে পড়ে যেতে পারে। গিয়ার বক্সে নাকি গুরুতর কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, ইঞ্জিন ডাউন করতে হবে, সে সাধ্য সোনামুখীর মেকানিকের নেই। কাছাকাছির মধ্যে একমাত্র বিষ্ণুপুরে সারাবার ব্যবস্থা হতে পারে। বিষ্ণুপুর মানেই আবার পিছিয়ে যাওয়া। অগত্যা তাই যেতে হল। সেখানেও লেগে গেল দুতিন ঘন্টা। আমি আবার বিষ্ণুপুরের আটচালা ও টেরাকোটার কাজ করা মন্দির দেখে নিলুম। আগের দিন বিকেল-সন্ধের সন্ধিক্ষণে, ছ’টা বেজে পাঁচ মিনিটে বাঁকুড়া শহরের বাস ডিপোর কাছাকাছি বড় রাস্তায় আমি যদি না দাঁড়াতুম, সেই সময় কোথাও চা খেতে যেতুম বা বাসে উঠে পড়তুম, তাহলে আমার সোনামুখী দেখা হত না। আমার জীবনের ম্যাপে সোনামুখী নামটা যুক্ত হয়ে গেল, আবার সেখানে যাওয়া পাওনা রইল।