আঙটি
হীরার আঙটির হীরাটা যখন আল্গা হইয়া যায় তখন আর তাহা আঙুলে পরিয়া বেড়ানো নিরাপদ নয়। হীরা অলক্ষিতে পড়িয়া হারাইয়া যাইতে পারে। বিষয়ী, সাবধান।
ক্ষেত্রমোহনের আঙটির হীরা অনেকদিন আগেই হারাইয়া গিয়াছিল। শোকটা সে সহজেই কাটাইয়া উঠিতে পারিয়াছিল এবং ঝুটা পাথর দিয়া কাজ চালাইতেছিল। অপরিচিত কেহ হয়তো হঠাৎ দেখিয়া ভুল করিতে পারিত, কিন্তু অন্তরঙ্গদের মনে কোনও মোহ ছিল না।
ক্ষেত্রমোহন যে একজন ভদ্রবেশী মিষ্টভাষী জুয়াচোর তাহা তাহার স্ত্রী চপলা জানিত। চপলার বয়স বাইশ বছর। রূপ ও যৌবন দুই আছে—সন্তানাদি হয় নাই। তাহার রূপ-যৌবনের মধ্যে একটা তীব্র তেজস্বিতা ছিল—চোখ-ধাঁধানো উগ্র প্রগল্ভতা। বাইশ বছর বয়সে বাঙালী মেয়ের যৌবন সাধারণত থাকে না—যাহা থাকে তাহা পশ্চিম দিগন্তের অস্তরাগ। চপলার মধ্যে কিন্তু কোনও অভাবনীয় কারণে যৌবন টিকিয়া গিয়াছিল। তাহার মনের উপর যে নিগ্রহ হইয়াছিল, তাহারই ফলে হয়তো এমনটা ঘটিয়াছিল। মনের সহজাত বৃত্তি ও সংস্কারগুলি যখন নিপীড়িত হইয়া অন্তর্মুখী হয়—তখন তাহারা কোন্ পথে কি রূপ ধরিয়া দেখা দিবে, বলা দেবতারও অসাধ্য। ফ্রয়েড সাহেব এই অতল সমুদ্রে চাট্গেঁয়ে খালাসীর মতো ‘পুরণ’ ফেলিতেছেন বটে—কিন্তু বাম্ মিলে না।
ক্ষেত্রমোহন লোকটা নিরম্বু বদ্মায়েস। মোসাহেবী করা ছিল তাহার পেশা। বড়লোকের সদ্যবয়ঃপ্রাপ্ত সন্তানদের অপ্সরালোকের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দেওয়া ছিল তাহার জীবিকা। কিন্তু সে নিজের স্ত্রীকে ভালবাসিত। বেহুঁশ মাতালের পকেট হইতে মনি-ব্যাগ চুরি করিতে তাহার বাধিত না। কিন্তু সে নিজে মদ খাইত না। এবং অন্য মকার সম্বন্ধেও তাহার একটা স্বাভাবিক নিস্পৃহতা ছিল। অপ্সরালোকের দ্বার পর্যন্ত গিয়া সে ফিরিয়া আসিত।
শঙ্করাচার্য সত্যই বলিয়াছেন—এ সংসার অতীব বিচিত্র!
চপলা যখন প্রথম স্বামীর চরিত্র জানিতে পারে তখন ভীত বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল। তারপর কিছুদিন কান্নাকাটির পালা চলিল। ক্ষেত্রমোহন সস্নেহে যত্ন করিয়া চপলাকে নিজের চার্বাক নীতি বুঝাইয়া দিল। অতঃপর ক্রমে ক্রমে চপলা উদাসীন হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার মনে আর মোহ ছিল না।
ট্রাম-ঘর্ঘরিত সদর রাস্তার উপর একটি সরু বাড়ির দোতলায় গোটা দুই ঘর লইয়া ক্ষেত্রর বাসা। শয়নঘরের একটা জানালা সদর রাস্তার উপরেই। সেখানে দাঁড়াইলে পথের দৃশ্য দেখিবার কোনও অসুবিধা নাই।
সেদিন বৈকালে চপলা সেই জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রাস্তার দিকে তাকাইয়া ছিল, এমন সময় সিঁড়িতে জুতার শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল। উৎফুল্লমুখে ক্ষেত্রমোহন ঘরে ঢুকিল।
ক্ষেত্রর বয়স ত্রিশ—সুশ্রী চট্পটে বাক্পটু। সে হাসিতে হাসিতে চপলার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘সব ঠিক করে ফেলেছি। আজ রাত্তিরেই—বুঝলে? গুদাম সাবাড়—মাল তস্রুপাত!’
চপলা তাহার মুখের পানে চাহিয়া হাসিল—জ্বলজ্বলে চোখ-ঝলসানো হাসি। তাহার দাঁতগুলি যেন একরাশ হীরা, আলোয় ঝকমক করিয়া উঠিল। ক্ষেত্রর এ হাসি অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, তবু সে লোভ সামলাইতে পারিল না, একটা চুম্বন করিয়া ফেলিল।
বুকে হাত দিয়া তাহাকে একটু ঠেলিয়া দিয়া চপলা বলিল, “কি হল?
চপলার কাছে ক্ষেত্রর কোনও কথাই গোপন ছিল না। বরং কেমন করিয়া কাহার নিকট হইতে টাকা ঠকাইয়া লইল, কাহাকে মাতাল করিয়া পকেট-বুক হইতে নোট চুরি করিল—এসব কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে চপলার কাছে গল্প করিতে সে ভালবাসিত, বেশ একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করিত। এখন সে জানালার গরাদ ধরিয়া সোৎসাহে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘তোমাকে অ্যাদ্দিন বলিনি। এক নতুন কাপ্তেন পাকড়েছি; বেশ শাঁসালো জমিদারের ছেলে—কলকাতায় ফুর্তি করতে এসেছে। নরেন চৌধুরী নাম। ফড়েপুকুরে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে একলা আছে। তাকে মাসখানেক ধরে খেলাচ্ছি।
‘ছোঁড়ার বয়স বেশী নয়—তেইশ-চব্বিশ। কিন্তু হলে কি হবে, এরই মধ্যে অনেক বুড়ো ওস্তাদের কান কেটে নিতে পারে। একেবারে একটি হর্তেল ঘুঘু। এই দেখ না, একমাস ধরে তেল দিচ্ছি এখনো একটি সিকি পয়সা বার করতে পারিনি। শালা মদ কিনবে তাও আমার হাতে টাকা দেবে না; নিজে গিয়ে বোতল কিনে আনবে, নয়তো দারোয়ান ব্যাটাকে পাঠাবে। তার থেকে দু পয়সা বাঁচাব, সে গুড়ে বালি। পাঁড় মাতাল—কিন্তু মদের গেলাস ছোঁবার আগে কি করে জান? টাকাকড়ি, মায় হাতের আঙটি পর্যন্ত দেরাজে বন্ধ করে চাবিটি ঐ শালা দারোয়ানের হাতে দিয়ে বলে—যাও, মৌজ কর! এই বলে তাকে একেবারে বাড়ির বার করে দেয়। তারপর আমার দিকে চেয়ে মুচকে মুচকে হাসতে থাকে—চণ্ডাল ব্যাটাচ্ছেলে।’
চপলা মন দিয়া শুনিতেছিল, এই আকস্মিক উত্তাপে সকৌতুকে হাসিয়া ফেলিল; বলিল, ‘তবে যে বললে সব ঠিক করে ফেলেছি?’
ক্ষেত্র মুখের একটা বিরক্তিসূচক ভঙ্গি করিয়া বলিল, ‘দেখলুম ও শালা পগেয়া বদমায়েসকে সহজে ঘাল করা যাবে না—একেবারে ঘাড় মটকে নিতে হবে। আমারও রোখ বেড়ে গেছে—আজ রাত্রে ঠিক করেছি ব্যাটার দেরাজ ফাঁক করব। এই দেখ, চাবি তৈরি করিয়েছি।’ বলিয়া পকেট হইতে কয়েকটা চক্চকে চাবি বাহির করিয়া দেখাইল।
‘চুরি করবে?’
‘হ্যাঁ। ঢের খোশামোদ করেছি, আর নয়; এবার একহাত ভানুমতীর খেলা দেখিয়ে দেব। টাকাকড়ি ব্যাটা দেরাজে বেশী রাখে না—কোথায় রাখে ভগবান জানেন; কিন্তু একটা হীরের আঙটি আছে, রাত্রে বেরুবার সময় সেটা দেরাজে বন্ধ করে রেখে যায়। সেইটের ওপর টাঁক করেছি। উঃ! কী হীরেটা মাইরি; চপলা, যদি দেখো চোখ ঝলসে যাবে। দাম হাজার টাকার এক কাণাকড়ি কম নয়। যদি পাঁচশো টাকাতেও ছাড়ি, কেষ্ট স্যাকরা লুফে নেবে।’
‘কিন্তু যদি ধরা পড়?’
‘সে ভয় নেই। বন্দোবস্ত সব পাকা করে রেখেছি। আজ এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে ব্যাটা বেরুবে—সমস্ত রাত বাড়ি ফিরবে না—’ বিমনাভাবে ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘কোথায় যাবে কিছুতেই বললে না; হয়তো নটরাজ থিয়েটারের সৌদামিনীর কাছে—কিন্তু সৌদামিনী তো মেনা মিত্তিরের—; যাক গে, যে চুলোয় খুশি যাক। আসল কথা, এগারোটার পর ব্যাটা বাড়ি থাকবে না। দারোয়ানটাও বেরুবে—তার ব্যবস্থা করেছি। ব্যস, গলির মোড়ে ওৎ পেতে থাকব, কর্তারাও বাড়ি থেকে বেরুবেন আর আমিও সুট্ করে গিয়ে ঢুকব। তারপরেই গুদাম সাবাড়—মাল তস্রুপাত। শালা লুট লিয়া—শালা লুট লিয়া—’ রাস্তার দিকে তাকাইয়া ক্ষেত্র উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল।
কিন্তু পরক্ষণেই বিড়ালের মতো লাফ দিয়া জানালার সম্মুখ হইতে সরিয়া আসিয়া চাপা গলায় বলিল, ‘সরে এস—সরে এস, ওপাশের ফুটপাথ দিয়ে যাচ্ছে!’
চপলা সরিল না, বলিল, ‘কে?’
‘নরেন চৌধুরী—সরে এস।’
‘কি দরকার? আমাকে তো আর চেনে না।’
‘তা বটে।’ তারপর ঘরের ভিতরের অন্ধকার হইতে উঁকি মারিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, ‘ঐ দেখতে পাচ্ছ, ফর্সা মত চেহারা, গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি, হাতে হরিণের শিঙের ছড়ি? উনিই নরেন্দ্র চৌধুরী। হাতের আঙটিটা দেখতে পাচ্ছ?’
‘পাচ্ছি।’ চপলা বাহিরের দিকে তাকাইয়া হাসিল; পড়ন্ত দিনের আলো তাহার মুখের উপর পড়িয়াছিল, মনে হইল যেন একরাশ হীরা ঝরিয়া পড়িল—‘হীরেটার দাম কত বললে?’
‘হাজার টাকা’। ক্ষেত্র বিছানার উপর গিয়া বসিল—‘বেশীও হতে পারে। এবার তোমার ঝুম্কো গড়িয়ে দেবই, বুঝেছ? ঐ কেষ্ট স্যাকরাকে দিয়েই গড়িয়ে দেব—সস্তায় হবে। অনেকদিন থেকে তোমায় বলে রেখেছি—’
রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়াই চপলা বলিল, ‘হুঁ।’
ক্ষেত্র জিজ্ঞাসা করিল, ‘চলে গেছে, না এখনো আছে?’
চপলার ঠোঁটের উপর দিয়া একটা ক্ষণিক হাসি খেলিয়া গেল, ক্ষেত্র তাহা দেখিতে পাইল না। চপলা বলিল, ‘মোড় পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসছে।’
‘ফিরে আসছে?’ ক্ষেত্রর কপালে উৎকণ্ঠার ভ্রূকুটি দেখা গেল। ‘তাই তো, আমার বাসার সন্ধান পেয়েছে নাকি? ব্যাটা যে রকম কুচুটে শয়তান! তুমি সরে এস। কে জানে—’
চপলা জানালা দিয়া গলা বাড়াইয়া রহিল, খানিক পরে সরিয়া আসিয়া বলিল, ‘চলে গেছে।’
‘যাক, তাহলে বোধ হয় এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছিল।’ বলিয়া ক্ষেত্র একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিল।
চপলা যেন অন্যমনস্কভাবে ক্ষেত্রর মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, টাকার জন্যে মানুষ সব করতে পারে—না?’
ক্ষেত্র একগাল হাসিল—‘পারে না! টাকার জন্যে পারে না এমন একটা মানুষ দেখাও তো দেখি। খুন জখম জাল ফেরেব্বাজি—দুনিয়াটা চলছে তো ঐ টাকার পেছনে। আর তাতে দোষই বা কি? টাকা না হলে কারুর একদণ্ড চলে? তবে আমি যে ব্যাটার ঘাড় ভাঙতে যাচ্ছি তার মধ্যে আমার অন্য স্বার্থও আছে। ব্যাটা আমাকে বড় হয়রান করেছে। যেমন করেই হোক ওর ঐ আঙটি গাপ করবই।’
আলস্যভরে দুই হাত মাথার উপরে তুলিয়া চপলা গা ভাঙিল। তারপর বলিল, ‘যাই, চুল বাঁধি গে।’
রাত্রি সাড়ে দশটার সময় ক্ষেত্র গলির মোড়ে আড্ডা গাড়িল। ঠিক সম্মুখ দিয়া ফড়েপুকুরের রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে চলিয়া গিয়াছে, গলির মুখ যেখানে গিয়া তাহার সহিত মিশিয়াছে সেখানে একটা কাঠের আড়ত আছে—সেই আড়তের গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইলে সহজেই পথচারীর দৃষ্টি এড়ানো যায়। রাস্তার গ্যাস কাছাকাছি নাই।
এখান হইতে নরেন চৌধুরীর বাসার সদর বেশ দেখা যায়—বড় জোর বিশ গজ। রাস্তার উপরেই দরজা। দরজা খুলিলে ভিতরে একটা ছোট গলি, গলির দুই ধারে দুইটি ঘর, রাস্তার উপরেই। বাহিরের দিকে জানালা আছে।
ক্ষেত্র দেখিল, পাশের একটা ঘরে আলো জ্বলিতেছে। এইটাই আসল ঘর। ঘরে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল আছে, সেই টেবিলের ডান দিকের দেরাজে—
ক্ষেত্র পকেটে হাত দিয়া দেখিল, চাবি ঠিক আছে। সে মনে মনে হিসাব করিল—কাজ শেষ করিয়া বাহির হইয়া আসিতে মিনিট দশেকের বেশী সময় লাগিবে না। তাহার হাত নিশপিশ করিতে লাগিল, একটা স্নায়বিক অধীরতা তাহার শরীরকে চঞ্চল করিয়া তুলিল। লোকটা কতক্ষণে বাড়ির বাহির হইবে?
ক্ষেত্র বিড়ি ও দেশলাই বাহির করিল। বিড়িতে ফুঁ দিয়া ঠোঁটে ধরিয়া দেশলাই জ্বালিতে গিয়া সে থামিয়া গেল। না, কাজ নাই। গলিতে লোকজনের যাতায়াত বন্ধ হইয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু গলির দুইধারে বাড়ি। কে জানে, যদি কেহ দেশলায়ের আলো দেখিতে পায়। ধূমপানের সরঞ্জাম ক্ষেত্র আবার পকেটে রাখিয়া দিল।
হাতে ঘড়ি ছিল, চোখের খুব কাছে আনিয়া দেখিল, এগারোটা বাজিতে পাঁচ মিনিট। সময় হইয়া আসিতেছে।
এমন সময় নরেন চৌধুরীর ঘরে বৈদ্যুতিক আলো নিবিয়া গেল। ক্ষেত্র নিশ্বাস বন্ধ করিয়া একদৃষ্টে সদর-দরজার পানে তাকাইয়া রহিল। তারপর আস্তে আস্তে নিশ্বাস ত্যাগ করিল। এইবার!
সদর-দরজা খুলিয়া নরেন চৌধুরী বাহির হইয়া আসিল। ক্ষেত্র কাঠ-গোলার দেয়ালে একেবারে বিজ্ঞাপনের পোস্টারের মতো সাঁটিয়া গেল। নরেন ফুটপাথে দাঁড়াইয়া সিগারেট ধরাইল। ক্ষেত্র সহস্ৰচক্ষু হইয়া দেখিল, তাহার হাতে আঙটি আছে কিনা। না, নাই। আবার সে ধীরে ধীরে চাপা নিশ্বাস ফেলিল। নরেন ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে চলিয়া গেল।
এইবার ক্ষেত্র অন্ধকারে দাঁত বাহির করিয়া হাসিল। নরেনের পরিপাটি সাজসজ্জা সে এক নজরে দেখিয়া লইয়াছিল। এইসব নিশাচর প্রজাপতিদের প্রতি তাহার মনে একটা অবজ্ঞাপূর্ণ ঘৃণার ভাব ছিল। সে মনে মনে বলিল, ‘মাণিক অভিসারে বেরুলেন!’ কোনও একজন স্ত্রীলোক ইহাকে দোহন করিয়া অন্তঃসারশূন্য করিয়া শেষে ছোবড়ার মতো দূরে ফেলিয়া দিবে, ইহা ভাবিয়া সে মনে বড় তৃপ্তি পাইল। করুক, করুক, সোনার চাঁদকে একেবারে ন্যাঙটা করিয়া ছাড়িয়া দিক।
কিন্তু এদিকে দারোয়ানটা এখনো বাহির হইতেছে না কেন? খোট্টাটার আবার কি হইল? ভাঙ খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ে নাই তো?
আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া ক্ষেত্র ঘড়ি দেখিল—সওয়া এগারোটা! তাই তো! কি হইল? দারোয়ান আগে বাহির হইয়া যায় নাই তো! না, তাহা হইলে নরেন দরজায় তালা লাগাইয়া যাইত। তবে—দারোয়ানটা কি সত্যই ঘুমাইয়া পড়িল? তাহাকে সরাইবার জন্য ক্ষেত্র এত মেহনৎ করিয়াছে—সারকুলার রোডে ময়দা-কলের বস্তিতে তাড়ির আড্ডার সন্ধান বলিয়া দিয়াছে, আর শেষে—
এই সময় খোট্টা দারোয়ান বাহির হইল। দরজার তালা লাগাইয়া পাগড়ি বাঁধিতে বাঁধিতে নাগরা ঠকঠক করিয়া প্রস্থান করিল।
এইবার সময় উপস্থিত। দারোয়ানের নাগরার শব্দ মিলাইয়া যাইবার পর, ক্ষেত্র কাঠগোলার ছায়ান্ধকার হইতে বাহির হইয়া আসিল। পথ নির্জন—বাধা বিপত্তির কোনও ভয় নাই। কিন্তু দুই পা অগ্রসর হইয়া ক্ষেত্র আবার ফিরিয়া আসিল। কাজ নাই, আর একটু যাক। যদি দারোয়ানটা কিছু ভুলিয়া ফেলিয়া গিয়া থাকে, হয়তো আবার ফিরিয়া আসিবে।
দশ মিনিট কাটিয়া গেল, দারোয়ান ফিরিল না। তখন ক্ষেত্র অন্ধকার হইতে বাহির হইল। বেশ স্বাভাবিক দ্রুতপদে, যেন নিজের বাড়িতে যাইতেছে এমনভাবে, দরজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া, বেশ শব্দ করিয়া দরজা খুলিল। তারপর ভিতরে প্রবেশ করিয়া দরজা ভেজাইয়া দিল!
ক্ষেত্রর পকেটে একটা ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ ছিল, সেটা এবার সে জ্বালিল—একবার চারিদিকে ফিরাইয়া দেখিয়া লইল। তারপর বাঁ দিকের দরজার উপর ফেলিল।
দরজায় তালা লাগানো। ক্ষেত্র আর একটা চাবি বাছিয়া লইয়া তালায় পরাইল, খুট করিয়া শব্দ হইল। তালা খুলিয়া গেল।
টর্চের আলো নিবাইয়া ক্ষেত্র ঘরে ঢুকিল। ঘরে কোথায় কি আছে সবই তাহার জানা ছিল; সে অন্ধকারে হাতড়াইয়া গিয়া রাস্তার দিকের জানালাটা বন্ধ করিয়া দিল। তারপর ঘরের দিকে ফিরিয়া টর্চ জ্বালিল।
টর্চের আলো একটা টেবিলের উপর গিয়া পড়িল। টেবিলের উপর বিশেষ কিছু নাই—কাগজ-চাপা, ব্লটিং প্যাড, দোয়াত, কলম। টেবিলের আশেপাশে দুই-তিনটা চেয়ার অস্পষ্টভাবে দেখা গেল।
ক্ষেত্র আর কালক্ষয় না করিয়া কাজে লাগিয়া গেল। টেবিলের সম্মুখে চেয়ারে বসিয়া সে দেরাজ খুলিতে প্রবৃত্ত হইল। ডান ধারের দেরাজগুলা খোলা, কিন্তু বাঁ ধারের দেরাজের সম্মুখে একটা কবাট আছে—তাহার গায়ে চাবির ঘর। ক্ষেত্র সেই কবাটের গায়ে চাবি প্রবেশ করাইয়া সন্তর্পণে ঘুরাইল। কবাট খুলিয়া গেল।
চারিটি দেরাজ। নরেন উপরের দেরাজে আঙটি রাখে—ক্ষেত্র দেরাজের ভিতর আলো না ফেলিয়াই তাহার ভিতর হাত ঢুকাইয়া দিল। কাগজপত্র ও পানের ডিবা তাহার হাতে ঠেকিল—কিন্তু আঙটির পরিচিত ক্ষুদ্র কেসটি হাতে ঠেকিল না। তখন সে দেরাজের ভিতর আলো ফেলিয়া দেখিল—আঙটি নাই।
আঙটি নাই? কোথায় গেল? প্রথমটা ক্ষেত্র কিছু বুঝিতেই পারিল না। সে এতই স্থিরনিশ্চয় ছিল যে, এই অভাবনীয় ব্যাপারে যেন হতভম্ব হইয়া গেল। তারপর তাহার বুকের ভিতরটা দুরদুর করিয়া উঠিল।
তবে কি—?
সে সভয়ে একবার ঘরের চারিপাশে চাহিল, টর্চটা ঘরের কোণে কোণে ফেলিয়া দেখিল, না, কেহ নাই। সে ভয় করিয়াছিল, নরেন তাহাকে ধরিবার ফাঁদ পাতিয়াছে—তাহা নয়।
হয়তো আঙটিটা দ্বিতীয় দেরাজে আছে। মেঝেয় হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া ক্ষেত্র দ্বিতীয় দেরাজ খুলিল। একেবারে শূন্য—তাহাতে একটা আল্পিন পর্যন্ত নাই।
তৃতীয় দেরাজ! সেটাও শূন্য। চতুর্থ দেরাজও তাই। ক্ষেত্রর কপালে ঘাম ফুটিয়া উঠিল। নাই—কিছু নাই। আঙটি তো দূরের কথা, একটা পয়সা পর্যন্ত নাই।
আলো নিবাইয়া অন্ধকারে ঘরে ক্ষেত্র কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আবার তাহার বুক ধকধক করিতে লাগিল। নরেন নিশ্চয় সন্দেহ করিয়াছিল, তাই তাহাকে ঠকাইবার জন্য—
কিন্তু, না, নিশ্চয় আছে। হয়তো তাড়াতাড়িতে নরেন ডান দিকের খোলা দেরাজেই আঙটি রাখিয়া গিয়াছে। ক্ষেত্র আবার আলো জ্বালিয়া ডান দিকের দেরাজগুলা খুঁজিতে লাগিল। কিন্তু কোনওটাতেই কিছু পাইল না। কতকগুলা মদের বিজ্ঞাপন, স্ত্রীলোকের ছবি, গোটাকয়েক অশ্লীল বিলাতি উপন্যাস—
এতক্ষণে ভূতের মতো একটা ভয় ক্ষেত্রকে চাপিয়া ধরিল। তাহার মনে হইল, শূন্য বাড়িখানা তাহার চুরির ব্যর্থ প্রয়াস দেখিয়া নিঃশব্দে অট্টহাস্য করিতেছে। এই ঘরটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হইয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। সে ধরা পড়িয়া গিয়াছে, আর পলাইতে পারিবে না।
এই সময় দূরের কোনও গির্জায় ঢং ঢং করিয়া বারোটা বাজিল। ঘড়ির আওয়াজ ক্ষেত্রর কানে বোমার আওয়াজের মতো লাগিল। বারোটা! এতক্ষণ সে এখানে আছে! যদি কেহ আসিয়া পড়ে? নরেনই যদি ফিরিয়া আসে?
ক্ষেত্র আর দাঁড়াইল না। দেরাজগুলা খোলাই পড়িয়া রহিল, সে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল। তারপর বাড়ির বাহির হইয়া ভয়ার্ত চোখে একবার চারিদিকে তাকাইল। কাহাকেও দেখিতে পাইল না, পাড়া সুষুপ্ত। তখন স্খলিত হস্তে সদরের তালা বন্ধ করিয়া হন হন করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।
তাহার বাসা যেদিকে, সে ঠিক তার উল্টা মুখে চলিয়াছে তাহা সে জানিতেই পারিল না।
একটার সময় ক্ষেত্র নিজের বাসার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। এতক্ষণে তাহার মাথা বেশ ঠাণ্ডা হইয়াছে, ভয় আর নাই। এমন কি, অহেতুক ভয়ে দেরাজগুলা খোলা রাখিয়া পলাইয়া আসার জন্য সে একটু লজ্জা বোধ করিতেছে। কিন্তু বিস্ময় তাহার কিছুতেই ঘুচিতেছে না। নরেন কি তাহাকে সন্দেহ করিয়াছিল? তাহাই বা কি করিয়া সম্ভব—নরেন আঙটি পরিয়া বাহির হয় নাই, ইহা সে স্বচক্ষে ভাল করিয়া দেখিয়াছে। তবে আঙটিটা গেল কোথায়?
ক্ষেত্র নিজের সিঁড়ির দরজার কড়া নাড়িল। তাহার উপরে উঠিবার সিঁড়ি স্বতন্ত্র, নীচের তলার বাসিন্দার সহিত কোনও সংযোগ নাই। তাই, প্রতিবেশীকে না জাগাইয়া রাত্রে যখন ইচ্ছা সে বাড়ি ফিরিতে পারে।
কিছুক্ষণ পরে চপলা আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। ক্ষেত্র কোনও কথা না বলিয়া উপরে উঠিয়া গেল। চপলা সিঁড়ির দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া শয়নঘরে ফিরিয়া আসিল, তারপর বাঙ্নিষ্পত্তি না করিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল।
ক্ষেত্র জামা খুলিতে খুলিতে ভাবিতেছিল, চপলা জিজ্ঞাসা করিলে কি উত্তর দিবে! কিন্তু চপলা যখন কোনও প্রশ্ন করিল না, তখন সমস্ত কথা বলিবার জন্য তাহার নিজের মন উসখুস করিতে লাগিল। মুখে চোখে জল দিয়া, আলোটা কমাইয়া দিতে দিতে সে বলিল, ‘আজ ভারি আশ্চর্য ব্যাপার হল! ঘুমুলে নাকি?’ ব্যর্থতার কুণ্ঠায় তাহার স্বর নিস্তেজ।
চপলা উত্তর দিল না, কেবল গলার একটা শব্দ করিল মাত্র। ক্ষেত্র বিছানায় প্রবেশ করিয়া দেখিল, চপলা চিৎ হইয়া শুইয়া আছে, তাহার ডান হাতটা চোখের উপর রাখা। অল্প আলোয় চপলার মুখ ভাল দেখা গেল না।
‘আঙটিটা পেলুম না—বুঝলে?’
চপলার নিকট হইতে কোনও সাড়া আসিল না। সে ঘুমাইয়াছে কি না দেখিবার জন্য ক্ষেত্র তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গেল—‘জেগে আছ, না ঘুমুলে?’
চপলার চোখের উপর হাতটা একটু নড়িল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার আঙ্গুলের উপর আলো ঝিকমিক করিয়া উঠিল।
ক্ষেত্র সূচীবিদ্ধের মতো বিছানায় উঠিয়া বসিল। চপলার হাতখানা টানিয়া নিজের চোখের সম্মুখে আনিয়া বিকৃত চাপা গলায় বলিয়া উঠিল, ‘আঙটি!–এ আঙটি তুমি কোথায় পেলে!—তুমি কোথায় পেলে—’
২৬ কার্তিক ১৩৪১