আগ্রা – ৯

৯.

কালাঞ্জর দুর্গ দখলের সংবাদ আগ্রায় এসে পৌঁছতে বেশিদিন লাগল না।

কয়েক বছর আগে বাদশাহের অনুরোধে তাঁর দরবারে তানসেনকে পাঠিয়ে যে উপকার করেছিলেন রাজা রামচন্দ্র তারই প্রতিদান স্বরূপ এই দুর্গ কেড়ে নিলেন বাদশাহ্ তাঁর কাছ থেকে। এরই নাম বাদশাহী কৃতজ্ঞতা।

এই জয়ের সবটুকু সম্মান পেল একা সেনাপতি মজনুন খাঁ। তাকেই পাঠিয়েছিলেন বাদশাহ্ গোপনে। জিৎ সিং উপলব্ধি করে এই গোপনতার কারণ। রণথম্ভোর দুর্গে তিনি যে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন, কমলাবতীর কাছে সব ঘটনা শোনবার পর জানতে বাকি ছিল না তাঁর। ভবঘুরেকে তাই হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ভবঘুরে এই চক্রান্তের একমাত্র নায়ক হতে পারে না—আকবরের মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তি সহজেই তা অনুমান করেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি এই ষড়যন্ত্রের জাল কতদূর বিস্তৃত। তাই কালাঞ্জরের বেলায় এই গোপনীয়তা।

উধমের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে জিৎ সিং যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছে। সে জানে, বাদশাহ্ তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত চক্রান্ত আমূল উৎপাটন ক’রে ফেলবার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করবেন না। যার ফলে একদিন না একদিন তাঁর হাতের থাবা তার ওপরও এসে পড়তে পারে।

রানীর সঙ্গে সে দেখা করেছে কয়েকবার। নতুন কোনো সংবাদ সে জানতে পারেনি। বীরবল- কন্যার সঙ্গেও দেখা হয়েছে রানীর ওখানে। যথারীতি অনুযোগ শুনতে হয়েছে তার বাড়িতে যায়নি বলে। মিষ্টি কথায় সে শান্ত করেছে প্রিয়াকে। কথা দিয়েছে সুযোগ পেলেই যাবে।

প্রিয়াও কোনো নতুন সংবাদ দিতে পারেনি। সে শুধু বলেছে, বাদশাহ্ আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর হয়েছেন। আগের মতো তিনি আর কথায় কথায় অট্টহাসি হেসে ওঠেন না। সবার দিকে কেমন দৃষ্টিতে যেন চেয়ে থাকেন।

জিৎ সিং মনে মনে হেসেছে প্রিয়ার কথা শুনে। এই দুর্ভাবনাটুকুও যদি বাদশাহকে কিছুদিনের জন্যে পেয়ে বসে তাতেও লাভ। কারণ এই দুর্ভাবনা নিয়ে তিনি নতুন কোনো আক্রমণের কথা চিন্তা করতে পারবেন না। কালাঞ্জর জয়ের কথা চিন্তা করতে পেরেছিলেন, কারণ কালাঞ্জর সহজেই তাঁর হাতের মধ্যে চলে আসবে একথা অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি। চিতোর আর রণথম্ভোরের পতন দেখে রাজা রামচন্দ্র মুঘল সৈন্যকে বাধা দেবার সাহস রাখতে পারেন না। কিন্তু মেবার? মেবারের বেলায় এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি অগ্রসর হতে পারেন না। মেবার এখনো তাঁর দিনের চিন্তা—রাতের দুঃস্বপ্ন। মেবারের রানা ভীরু হলেও তিনি নিঃসঙ্গ নন। তাঁর পেছনে রয়েছেন যে সব বীরপুরুষেরা তাঁরা সম্মানকে সবকিছুর ওপরে স্থান দেন। তাই কালাঞ্জরের বেলায় যা সম্ভব হয়েছে মেবারের বেলায় তা নাও হতে পারে।

আগ্রার পথে পথে উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে ঘুরে বেড়ায় জিৎ। সে জানে এইভাবে ঘুরে বেড়ানো মোটেই নিরাপদ নয় তার পক্ষে। রহিমবক্স এখনো প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করছে বলে শুনেছে সে। তবে সরাইখানার মালিক নাকি এখন আর তার পক্ষে নেই। এদিকে রাম সিং আর তার শাকরেদরা রয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। কিংবা বাদশাহের কোনো চরও সন্দেহ করতে পারে তাকে।

তবু ঘরে বসে সময় কাটে না। তাই মাঝে মাঝে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে সব চাইতে বিপজ্জনক স্থান আগ্রার কিল্লার সামনে এসে উপস্থিত হয়। সে একবার কিল্লার দিকে চায়। বাদশাহ্ এখন কী করছেন?

মুখ ফিরিয়ে নেয় জিৎ সিং। জয়মল্ল পট্টের প্রস্তর মূর্তি দুটি তার দৃষ্টি আর মনোযোগ আকর্ষণ করে। তেমনি বীরত্বব্যঞ্জক মুখ তেমনি উন্নত বক্ষ। মনে মনে প্রণাম জানায় জিৎ সিং।

সেই সময়ে পেছনে চিৎকার শোনে,–এই যে দোস্ত্।

উটওয়ালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।

—আরে আব্বাস খাঁ যে? খবর সব ভালো নিশ্চয়। এত হাসি যখন।

—ভালো বৈ কি। বহুদিন বাদে দেখা। কোথায় ছিলে?

—বাইরে ছিলাম কিছুদিন। বিবির খবর কি?

আব্বাস খাঁ পুলকিত হয়ে বলে,—চমৎকার। ঠিক যেন একদলা মাখন।

—বাঃ, বাঃ, শুনে আনন্দ হল। ছেলে?

—খাঁটি মুসলমান হয়ে উঠছে। দেখে নিও তুমি।

—বেশ বেশ। তা তুমি কি রোজই এখানে এসে থাকো?

আব্বাস খাঁ মূর্তি দুটোর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে,—একবার এসে সেলাম না করে গেলে সারাদিন মনের মধ্যে কেমন যেন খুঁত খুঁত করে।

—তোমার তুলনা হয় না আব্বাস।

—ওসব কথা ছাড়। রহিমবক্সের সঙ্গে আর দেখা হয়েছে?

—না।

—সাবধানে থেকো। তাহের এখনো ক্ষেপে রয়েছে কিন্তু। বেচারা নিজের হাতে মাংস কাটতে পারে না। জাফরও রাগে ফুঁসছে। খুব সাবধান।

—তোমার কথা মনে রাখব।

—হ্যাঁ, মনে রেখো। আজকাল দিনে দুপুরে খুন হচ্ছে।

—সত্যি নাকি?

—হ্যাঁ। আমার চোখের সামনে হয়ে গেল সেদিন। এক সাধুকে বাদশাহের লোক খুন করল। জিৎ সিং কণ্ঠস্বরকে শান্ত ক’রে নিয়ে প্রশ্ন করে,—কতদিন আগের কথা বলছ?

বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। যমুনার তীর ধরে যাচ্ছিলাম। সেই সময় চোখের সামনে ঘটে গেল সব। তাজ্জব বনে গেলাম। সাধুও তেমনি সাধু। কখনো শুনেছ, ছোরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সাধুরা?

—না তো?

—সেই সাধুর কাছে কিন্তু ছোরা ছিল। কোন্ এক বেগমের শিবিকা যাচ্ছিল সেই সময় পথ দিয়ে। সাধুকে দেখেই বেগম চিৎকার ক’রে উঠল,—এই যে। একে মারো। শিবিকার পাশে পাশে যারা চলছিল তারা সাধুকে আক্রমণ করল। কিন্তু তার মধ্যেই পথ করে সাধু ছুরি হাতে ছুটে গেল শিবিকার পাশে। বেগম সাহেবা আর্তনাদ করে উঠল। আর সেই সঙ্গে সাধুর মাথাটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।

—বেগম সাহেবাও খুন হয়েছে?

—কি জানি? ওরা কি আর দেখতে দিল? শিবিকা নিয়ে হন্ হন্ করতে করতে ফিরে চলে গেল। তবে লোকগুলোর চোখে দারুণ আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল।

ভবঘুরের রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায় জিৎ সিং-এর কাছে।

আব্বাস খাঁ বলে,—আমি চলি দোস্ত। আবার দেখা হবে।

—আচ্ছা। খুব আনন্দ হল তোমায় দেখে।

উটওয়ালা কয়েক পা গিয়ে আবার ফিরে এসে বলে,—একটা সুখবর দেওয়া হয়নি তোমায়।

—কোন্ সুখবর?

—আমাদের বাদশাহ্ এতদিন পরে সন্তানের মুখ দর্শন করবেন।

—এ খবর কোথায় পেলে তুমি?

—সিক্রিতে শেখ সেলিম চিস্তির ওখানে লোক গিয়েছিল। তারা শুনে এসেছে। বেগম সাহেবা তো ওখানেই রয়েছেন। বেগম সাহেবা আমাদের রাজা বিহারীমলের মেয়ে। ভালোই হল, কি বল?

নিশ্চয়ই।

—বাদশাহ্ বড় মনমরা হয়ে থাকতেন। এতদিনে হাসি ফুটবে মুখে। এতগুলো বেগম, সব বাঁজা। ছি ছি। আমায় দেখো দেখি। একটি মাত্র জেনানা, অথচ—আচ্ছা চলি।

আব্বাস খাঁ চলে যায়।

.

কিছুদিন পরেই এক প্রভাতে আগ্রার রাস্তার আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করে। বাদশাহ্ আকবরের প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে ফতেপুর সিক্রিতে। পুত্রসন্তান। বাদশাহ্ পুত্রের নাম দিয়েছেন সেলিম। শেখ সেলিম চিস্তির প্রতি এর চাইতে উপযুক্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আর পথ ছিল না। বাদশাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র স্বভাবতই মসনদের উত্তরাধিকারী। যদি কোনো অঘটন না ঘটে তবে এই সেলিম খাঁ একদিন আগ্রার মসনদে উপবেশন করবে। সিক্রির চিস্তি তখন আর জীবিত থাকবেন না। কিন্তু তাঁর নামটি বেঁচে থাকবে হিন্দুস্থানের সেরা ব্যক্তিটির মধ্যে।

জিৎ সিং ভাবে কালাঞ্জরের রামচন্দ্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের যে পথ বেছে নিয়ে ছিলেন বাদশাহ্ এ পথ তার ঠিক বিপরীত। বিপরীত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ রামচন্দ্র দিয়েছেন তানসেনকে, আর চিস্তি সাধনার দ্বারা এনে দিয়েছেন বাদশাহের ঔরসের মধ্যে সন্তানের বীজ। অনেক তফাত। তানসেন যত বড় গায়কই হোন না কেন, যত প্রিয়ই হোন না কেন আকবরের—শিশুপুত্র সেলিমের তুলনায় তার কোটি ভাগের এক ভাগও নয়। সেলিম হল বাদশাহের হৃদয় মরুতে প্রস্ফুটিত একটি মাত্র স্বর্গীয় গুলাব। তাই কালাঞ্জর আজ বাদশাহের পদানত। আর সিক্রি দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধির পথে।

সিক্রিতে বাদশাহ্ রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন।

.

কথাটা পৃথ্বীরাজের বাড়িতে প্রিয়ার মুখে শুনে রীতিমতো নাড়া খেল তার মন। অথচ কত সহজভাবেই না প্রিয়া উচ্চারণ করল এই খবরটি। অবিশ্যি কথা কয়েকটি উচ্চারণ করার আগে অনেক মান-অভিমান অনেক চোখের জলের পালা শেষ করেছিল সে। এই অভিমান আর চোখের জল খুবই স্বাভাবিক তার পক্ষে। কতদিন সে জিৎ সিংকে দেখেনি। মনে হয়েছিল কত যুগ। যদি তার হৃদয়ে জিৎ সিং-এর প্রতি ভালোবাসা না জাগত, তবে একটিমাত্র হুকুমে সে তাকে বেঁধে নিয়ে যেতে পারত তার পায়ের নীচে। কিন্তু তেমন হুকুম সে করেনি। দিনের পর দিন আশা আর নিরাশার দ্বন্দ্ব নিয়ে পৃথ্বীরাজের বাড়িতে এসেছে আর ফিরে গেছে নিজের গৃহে।

এত সব কথা স্পষ্টই বলল সে জিৎকে। আর জিৎ স্তম্ভিত হয়ে শুনল। শুধু শুনল না, দেখলও। দেখল কত অপরূপ দেখাচ্ছে প্রিয়াকে। তার চোখের কোলের ক্লান্ত ভাব আরও অপরূপ। চকিতে একবার চারদিকে দেখে নিল জিৎ সিং। তার রাখীবন্ধন বোনটিকে আশেপাশে দেখতে পেল না সে। উধমও নাকি এখন বাড়িতে নেই। সে তড়িতগতিতে প্রিয়ার কাছে এসে তাকে দু’হাতে চেপে ধরে বুকের মধ্যে। লীলাকে একবারও মনে পড়ল না তার। লীলা যেন তার প্রথম যৌবনের একটি রাতের স্বপ্নমাত্র। অমন অনেক স্বপ্ন মানুষ ভুলে যায়।

জিৎ সিং-এর বাহুর চাপে প্রিয়ার বুকের শ্বাসটুকু বের হয়ে যায়। সে নিমীলিত চক্ষে বলে, —এভাবে মৃত্যু হত যদি।

—না।

—কেন? তুমি তো আমায় চাও না।

—আমি তোমায় চাই প্ৰিয়া।

—চাইলে কি একবারও দেখতে সাধ হয় না?

—হয়, সাধ হয় বৈ কি। কিন্তু বড় ব্যস্ত থাকি আমি।

—ব্যস্ত! বাদশাহ আকবরের চেয়ে ব্যস্ত নিশ্চয়ই থাকো না।

জিৎ সিং ধীরে ধীরে প্রিয়াকে বুক থেকে তুলে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার বাহু দুটি ধরে বলে,—না, বাদশাহের চেয়ে ব্যস্ত থাকা কি করে সম্ভব?

—বাদশাহ্ কিন্তু এর মধ্যে আমার কাছে বহুবার এসেছেন।

জিৎ সিং-এর চোখদুটি তীব্র হয়ে ওঠে। সে প্রশ্ন করে—বাদশাহ্ তোমার কাছে প্রায়ই আসেন তাহলে?

—হ্যাঁ। তোমায় আগেও বলেছি বোধহয়, তিনি আমায় স্নেহ করেন।

—জানি।

—তবে? বুঝতে পারছ, তুমি আমায় চাও না।

উত্তেজিত হয়ে জিৎ সিং বলে,—আমি তোমায় চাই প্রিয়া, আমি তোমায় চাই। তোমার চাইতে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আর কাউকে বেশি চাই না। তুমি বিশ্বাস কর।

প্রিয়ার চোখ অশ্রুতে টলটল করে আবার। তার মুখ কিন্তু হাসিতে ভরে ওঠে। সে জিৎ সিং-এর বুকের ওপর তার নরম হাতখানা রেখে বলে,– কেন গো, এত কেন চাও আমায়? জিৎ সিং-এর মনের ভেতরে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তবু সে বলে ফেলে,–তোমায় ভালোবাসি বলে।

—তোমার কথা আমি বিশ্বাস করব, যদি একটা কাজ করতে পার।

—বল কি কাজ।

—তুমি আজ থেকে সাতদিন বাদে আমার বাড়িতে যাবে। ঠিক মাঝরাতে আমি অপেক্ষা করব। রাজি আছো?

—রাজি।

প্রিয় হেসে বলে, –এত সহজে রাজি হলে যে?

—তোমার মনে বিশ্বাস আনবার জন্যে।

—বিশ্বাস আনার অন্য পথ নেই?

—বোধহয় না। পুরুষের আর কি থাকতে পারে?

—মেয়েদের?

—চোখের জল।

—ছিঃ মেয়েদের তুমি বড় ছোট করে দেখ।

জিৎ সিং চুপ ক’রে থাকে। মেয়েদের সে ছোট ক’রে দেখে কি না জানে না। তবে লীলাবতীর আচরণের ভেতরে সে মহৎ কিছু দেখতে পায়নি। মেয়েরা ছোট না হতে পারে। কিন্তু তারা যে সংস্কারবদ্ধ জীব এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তার।

—জিৎ সিং।

—বল প্রিয়া।

—তোমার মুখে প্রিয়া ডাক শুনে আমি ভুলে যাই আমার অন্য নামও আছে। আসল নামের কথা মনে থাকে না আমার। কেন এমন হয় জিৎ?

—এইটিই যে তোমার আসল নাম।

—সত্যিই কি তাই?

—হ্যাঁ, প্রিয়া।

জিৎ সিং বাতায়নপথে দেখতে পায় উধম প্রধান ফটকের কাছে পায়চারি করছে। বাইরে থেকে ফিরেছে সে। তার আচরণের মধ্যে চঞ্চলতা। হয়তো জিৎ সিংকে তার প্রয়োজন। হয়তো সে কিছু বলতে চায়।

প্রিয়ার মুখের দিকে চেয়ে সে তাই বলে,—এবারে আমাকে বিদায় দাও প্রিয়া।

—এখুনি?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু রানীর সঙ্গে দেখা করে যাবে না?

—তার সঙ্গে তো দেখা হয়েছে একবার।

—যদি তিনি আসেন আবার?

—সে আসবে না। সে জানে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।

—তার মানে? তিনি কি

—হ্যাঁ, সে সব জানে। সে মূর্খ নয় প্রিয়া।

প্রিয়ার মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। সে মাথা নীচু করে। অনেকক্ষণ সেইভাবে থেকে শেষে বলে,—আমি জানতাম না।

—সাতদিন পরে রাতের বেলায় আমার অপেক্ষায় থেকো প্রিয়া। যদি জীবিত থাকি—নিশ্চয়ই দেখা হবে।

—কিন্তু তুমি তো একবারও প্রশ্ন করলে না, সাতদিন পরে কেন তোমায় যেতে বললাম?

—প্রশ্ন করার প্রয়োজন আছে কি?

—না, অন্তত তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি ঠিকই জান, কারণ রয়েছে কোনো। কারণটি বলে নিই তোমাকে। আজ থেকে সাতদিন পরে বাদশাহ্ সিক্রিতে রওনা হচ্ছেন। তাঁর পুত্রের জন্মের পর থেকেই মনে মনে তিনি সিক্রির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই আকর্ষণ এর মধ্যেই দুর্নিবার হয়ে উঠেছে। তিনি কিছুদিন থাকবেন সেখানে। বাবাও সঙ্গে যাবেন।

—সিক্রির সৌভাগ্য বলতে হবে।

—সিক্রিতে বাদশাহ্ তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন।

—কি বললে?

—আগ্রা থেকে আমরা সবাই সিক্রি অভিমুখে রওনা দেব একদিন। খুব শিগগিরই যাব। বাদশাহ্ নিজে আমায় বলেছেন। সেখানে যে চত্বরে প্রাসাদ তৈরি হবে বাদশাহের জন্যে, সেই চত্বরে আমার জন্যেও একটি প্রাসাদ তৈরি করে দেবেন বাদশাহ্। তিনি কথা দিয়েছেন আমায়।

—তোমার খুব আনন্দ, তাই না?

—হবে না?

—হবে বৈ কি। তখন আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে তোমার প্রাসাদের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলব শুধু।

—না মশায়, তা হবে কেন? অন্য কিছুও হতে পারে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে ওই প্রাসাদের সব চাইতে ভালো কক্ষেও থাকতে পার তুমি।

—আমাকে স্বপ্ন দেখাতে চাইছ?

—না না। নিজেকে অত ছোট ভাব কেন?

জিৎ সিং বাতায়ন পথে দেখতে পায় উধম মাটির ওপর পদাঘাত করছে।

—আমি চলি প্রিয়া।

এবারে আর বাধা দেয় না বীরবল কন্যা। তবে তার দৃষ্টি যে আকুল হয়ে জিৎকে অনুসরণ করে এটুকু সে বুঝতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *