আগ্রা – ৮

৮.

অনুমান ব্যর্থ হয়নি জিৎ সিং-এর।

পরদিন সকালে মুঘল শিবিরের প্রতিটি লোক বিমূঢ়-বিস্ময়ে চেয়ে দেখল দুর্জন সেনাপতি রাজা মান সিংহ একা এগিয়ে চলেছেন রণথম্ভোর দুর্গপ্রাকারের দিকে। আর তাঁর পেছনে পেছনে চলেছে একজন মাত্র দণ্ডধারী। বাদশাহের শিবিরের পাশে কর্তব্যপরায়ণ প্রহরীরা শুধু দৃশ্যটি ভালোভাবে উপভোগ করতে পারল না। তারা তাদের জায়গা ছেড়ে নড়তে পারে না। কারণ শিবিরের ভেতর বাদশাহের প্রাণ নির্ভর করছে তাদের সতর্কতার ওপর। তবে তারা মান সিংহের যাত্রাটুকু দেখেছে। কারণ বাদশাহের অনুমতি নিয়ে বাদশাহের শিবির থেকেই তিনি রওনা হয়েছেন। তার অবাক হয়েছিল মান সিংহের অনুসরণকারী দণ্ডধারীকে দেখে। কারণ লোকটিকে তারা মান সিংহের সঙ্গে শিবিরে প্রবেশ করতে দেখেনি। তবু তারা হৈচৈ করেনি, করতে সাহস পায়নি। অনেক সতর্কতা সত্ত্বেও চোখ যদি কোনো কিছু হঠাৎ এড়িয়ে যায়, তবে তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষত রাজা মান সিংহ সন্দেহজনক ব্যক্তি নন।

দুপুর গড়িয়ে যায়। জিৎ সিং ঠায় বসে থাকে দুর্গের দিকে চেয়ে। তারপর বিকেলের দিকে সহসা দেখতে পায়, ফিরে আসছেন মান সিংহ। তাঁর দণ্ডধারীও ফিরে আসছে। হ্যাঁ, তাঁর দণ্ডধারীকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ফিরে আসছেন। তবে দণ্ডধারী এবারে তাঁকে অনুসরণ করছে না। দণ্ডধারী আসছে তাঁর পাশে। কখনো বা রাজার সামনে। তার হাতের দণ্ড রেখে এসেছে সে দুর্গের মধ্যে।

আর কেউ না জানুক, জিৎ সিং জানে, রণথম্ভোর জীবনে আর কখনো মুঘল সৈন্যের বিরুদ্ধে গোলাবর্ষণের স্পর্ধা দেখাবে না। মরে গেল রণথম্ভোর।

ঝাপসা চোখেও দেখতে পায় জিৎ সিং মুঘল সৈন্যদের মধ্যে হঠাৎ এক সাংঘাতিক আলোড়ন শুরু হয়েছে। তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা চিনতে পেরেছে মান সিংহের সঙ্গীকে। ভগবান দাস চিনিয়ে দিয়েছেন।

বাদশাহের শিবিরে প্রহরীরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে দেখে, তাদের অতিসাবধান চোখের সামনে দিয়ে শূন্য শিবিরে আকবর শাহ্ মান সিংহকে নিয়ে প্রবেশ করেন।

জিৎ সিং-এর ডাক পড়ে কিছু পরেই।

বাদশাহ্ তাঁর দিকে চেয়ে স্মিত হেসে বলেন,–তোমার কাজে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।

জিৎ সিং এবারে চোখের জল রোধ করতে পারে না। ভবঘুরে ঠিকই বলেছে। রণথম্ভোর তাকে মনে রাখবে। তবে অন্যভাবে। রণথম্ভোর তার প্রতিটি পাষাণের মুখ দিয়ে চিরকাল অনুচ্চারিত কণ্ঠে বলতে থাকবে, জিৎ সিং তাকে সম্মানের সঙ্গে মরতেও দিল না। জিৎ সিং তাকে জোর করে মুঘল-হারেমে নিয়ে তুলেছে। সে রাজপুত হয়েও কুলাঙ্গার

মান সিংহ জিৎ সিং-এর চোখের জল লক্ষ্য ক’রে তাড়াতাড়ি বাদশাহকে বলেন,–ও এখনো ছেলেমানুষ জাহাঁপনা। তাই আপনার প্রশংসায় আনন্দে কেঁদে ফেলেছে। ওকে ক্ষমা করুন।

—না। আমি কিছুই মনে করিনি। ওকে আমি এই অসিটি দিতে চাই।

জিৎ সিং তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে যথারীতি ‘সিজদা’ করে বাদশাহের কাছ থেকে অসি গ্রহণ করে। সে ভাবে, এই কারুকার্য খচিত অসিটিকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার প্রথম সুযোগ আগ্রায় পৌঁছুবার আগে সে পাবে না। কারণ ফেলতে হলে এমন জায়গায় ফেলতে হবে, যেখান থেকে পৃথিবীর কোনো লোক কোনোদিনও সেটিকে উদ্ধার করতে না পারে।

সুরজন রাও-এর সঙ্গে সন্ধির শর্তের কথা জানতে সময় লাগে না বেশি। ভগবান দাসের সঙ্গে মান সিংহ যখন আলোচনা করলেন তখনি সব স্পষ্ট হয়ে গেল। অনেক দুঃখের মধ্যে এইটুকুই সান্ত্বনা পেল জিৎ সিং যে রাজা রাও সব ব্যাপারেই অন্যান্য রাজপুত রাজাদের চেয়ে মর্যাদা পাবেন অনেক বেশি। তাঁর বংশের কোনো রানী বা কন্যাকে নওরোজের দিনে মীনা বাজারে যেতে হবে না। রাজা স্বয়ং মুঘল দরবারে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন, যে অধিকার অন্য কোনো রাজা কিংবা আমীর ওমরাহদের নেই। তাছাড়াও দরবারে প্রবেশ করে অন্য সবার মতো সিজদা করতে হবে না রাজা রাওকে। এছাড়াও শর্তে রয়েছে, কোনো যুদ্ধে কোনো মুসলমান সেনাপতির অধীনে তিনি কাজ করবেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা হল মুঘল বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি করতে হলে ডোল হিসাবে বাদশাহের হারেমে কোনো রানীকে প্রেরণ করার যে প্রথা আছে রাজা রাও সেই প্রথা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন।

জিৎ সিং জানে শর্তভঙ্গ অন্তত করবেন না বাদশাহ। তিনি তেমন ব্যক্তি নন। অনেক হতাশার মধ্যে এইটুকুই সান্ত্বনা জিৎ সিং-এর একটির পর একটি রাজপুত রাজ্য যখন বিনা শর্তে আত্মসমৰ্পণ করে চলেছে, যখন কথায় কথায় লাঞ্ছিত হচ্ছে রাজপুত বীর আর রমণীগণ, তখন তার প্রচেষ্টায় এইটুকু অন্তত সফল হল। ভবঘুরে যদি আরও শক্ত হতে পারত, সে যদি কথার আগুনে রাজা রাও-এর মনের সংস্কার আর আদর্শের জঞ্জালকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারত তবে হয়তো আগ্রার ইতিহাস আজ থেকে অন্যভাবে রচিত হত। রাজোয়ারা স্বাধীন হতে পারত আবার। চিতোর তার অধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলত। সে আবার ফিরে যেতে পারত চিতোরে। নিজের গৃহে গিয়ে উঠতে পারত। পিতা অজিত সিং-এর স্মৃতির স্থায়ীরূপ দিতে পারত। লীলাবতী আর কালপীর দল আবার ফিরে আসত চিতোরে। সেখানে লীলাবতী তাকে গ্রহণ না করলেও অন্তত চোখের দেখা থেকে সে বঞ্চিত হত না।

কিন্তু কিছুই হল না। একলিঙ্গের ইচ্ছা তা নয়। একলিঙ্গের আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে আকবর শাহের ওপর। তিনি নিশ্চয়ই জানেন আকবর শাহ্ যোগ্যতম ব্যক্তি। তিনি জানেন অনেক পাপ, অনেক দুর্বলতা পুঞ্জীভূত হয়েছে রাজোয়ারায়। তারই প্রায়শ্চিত্ত চলছে এখন। নিদারুণ প্রায়শ্চিত্ত। যার চাপে কিকার মতো অসাধারণ ব্যক্তির মনের শান্তিও একদিন হয়তো সহসা অন্তর্হিত হবে। সেদিনই ঘটবে রাজোয়ারার ভরা-ডুবি।

.

রণথম্ভোর জয় সমাপ্ত হল। অধীনতা স্বীকারের পুরস্কার-স্বরূপ বাদশাহ্, রাজা রাওকে করলেন হিন্দুতীর্থ কাশীধামের অধিপতি। তারপর মুঘল সৈন্যের সঙ্গে সঙ্গে জিৎ সিং একদিন ভগ্নহৃদয়ে ফিরে এল আগ্রায়।

আগ্রায় ফিরে এসে নিজের সরাইখানায় পর পর দুদিন চুপচাপ পড়ে রইল সে। পৃথ্বীরাজের গৃহে যাবার আগ্রহ হল না। বীরবল-কন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করারও উৎসাহ পেল না।

মালিক ব্যাপার দেখে বলে,—যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আপনি একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছেন। রণথম্ভোর জয় ক’রে আগ্রায় ফিরে এসে সবাই স্ফুর্তি করছে কত, আর আপনি চুপচাপ শুধু শুয়ে রয়েছেন। বাইরে এদিকে আপনারই জয়-জয়কার। সবাই শুনেছে আপনার কীর্তি অমন একটা দুর্গকে দখল করা কম কথা নয়। সেই হিম্মত একজনেরই রয়েছে এই বিশ্বসংসারে। তাঁর সঙ্গে আবার আপনি যোগ দিয়েছিলেন।

জিৎ সিং সব শুনে যায়। জবাব দেবার প্রবৃত্তি হয় না তার।

মালিক রকম-সকম দেখে আর কিছু বলে না। বেশি ঘাঁটাতে সাহস পায় না সে। এখন আর কারও জানতে বাকি নেই যে জিৎ সিং রাজা মান সিংহের নিজের লোক। কি বলতে কি বলে ফেলে শেষে মান সিংহের বিরাগভাজন হয়ে সরাইখানা খুলে দু-পয়সা রোজগারের আশা তো তিরোহিত হবেই, সেই সঙ্গে জীবন নিয়ে টানাটানি হওয়াও বিচিত্র নয়। মান সিংহ কি যে সে লোক? রণথম্ভোর জয়ের পর তাঁর সম্মান অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দলের নেতা ছিলেন আকবর শাহ্, বুদ্ধি দিয়েছেন রাজা মান সিংহ, আর কাজ করেছে তারই সরাইখানার ওই ছেলেটি।

জিৎ সিং আরও একদিন খায়দায় আর শয্যার ওপর শুয়ে দিবারাত্র ওপর দিকে চেয়ে চেয়ে চিন্তা ক’রে কাটায়। কিছুতেই যেন শক্তি পায় না সে। দেহ ও মনের সব শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।

শেষে পৃথ্বীরাজের বাড়ি থেকে উধম এসে উপস্থিত হয় একদিন। জিৎ সিং ব্যস্ত হয়ে উঠে বসে। একপাশে সরে গিয়ে উধমের বসবার জায়গা করে দেয়।

উধম কিছুক্ষণ চুপ ক’রে চেয়ে চেয়ে দেখে জিৎ সিং-কে। তারপর বলে,—রানীমা কাঁদছেন কদিন ধরে।

—কেন? কি হয়েছে তাঁর?

—তাঁর ধারণা রণথম্ভোরে আপনি দেহরক্ষা করেছেন।

জিৎ সিং গম্ভীর হয়ে বলে,—পারলে ভালো হত। কিন্তু হঠাৎ এ-ধারণা হল কেন রানীর? আমি তো আর ততটা অখ্যাত নই। এই সরাইখানার মালিকও জানে আমি এখন বিখ্যাত ব্যক্তি। এছাড়াও রাজা মান সিংহ ঘোষণা করেছেন আমাকে স্থায়ীভাবে বড় রকমের একটি পদ দেবেন। সে খবর অনেকেই শুনেছে। অন্তত পৃথ্বীরাজ রাঠোরের মতো ব্যক্তির কানে সে খবর পৌঁছে যাওয়া উচিত।

—তাঁর কানে পৌঁছেছে। রানীমাকে বার বার বলেছেন তিনি। কিন্তু রানীমা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না। রাজা নাকি তাঁর কাছে গোপন করে যাচ্ছেন আসল খবর। রক্তমাংসের শরীর নিয়ে যতক্ষণ না আপনি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন ততক্ষণ স্বয়ং একলিঙ্গকেও নাকি তিনি বিশ্বাস করবেন না।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরের শক্ত নিরেট একটা দলা যেন দ্রবীভূত হতে শুরু করে। এই শক্ত দলাটি এতদিন তার জীবন থেকে সজীবতাটুকু শুষে নিচ্ছিল। এবারে যেন কিসের স্পর্শ পেয়ে সেই সজীবতাটুকু আবার উদ্গীরণ ক’রে দিচ্ছে। একটু শক্তি ফিরে পায় জিৎ সিং। তার বোন আকুল হয়েছে তার জন্যে। সত্যিই আকুল হয়েছে। আকুল না হলে দিনের পর দিন কেউ চোখের জল ফেলতে পারে না ক্রমাগত।

—আমি যাব উধম। আমার বোনের কাছে যাব।

—কখন?

—কাল।

—উঁহু। এখনি না গেল শক্তি প্রয়োগ করতে হবে আমায়। স্ত্রীলোকের কান্না আমার ধাতে ঠিক সহ্য হয় না।

রণথম্ভোর ছেড়ে আসবার দিন থেকে যে বিষণ্ণভাবে জিৎ সিং-এর মনের ওপর ভারী পাথরের মতো চেপে বসেছিল, সে-ভাব ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। উধমের কথায় সে আনন্দ পায়। বহুদিন বাদে মুখে ফুটে ওঠে তার মৃদু হাসির রেখা।

সে বলে,—আমার শক্তির পরিমাণ সম্বন্ধে তোমার ধারণা আছে নিশ্চয়ই।

—হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আছে।

—বল শুনি।

—ওই দীর্ঘ অস্ত্রটিকে বাদ দিয়ে আপনার শক্তির পরিমাণ আমার তুলনায় একেবারে শূন্য তবে ওটি হাতে থাকলে আপনি দুর্জয়।

জিৎ সিং জবাব দিতে পারে না। সে কথা ঘুরিয়ে বলে,—রণথম্ভোরে গিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে উধম।

—খুবই স্বাভাবিক।

—যুদ্ধ একটা হল বটে।

—হতেই হবে। দিনের পর দিন দুপক্ষের কামান সমানে গর্জে যাওয়া কি কম কথা?

—তুমি বিদ্রূপ করছ?

—না। আমিও রণথম্ভোর সম্বন্ধে কৌতূহলী ছিলাম। তবে কামান গর্জনের ওপর আর কৌতূহল নেই। আমার কৌতূহল সেই মানুষটি সম্বন্ধে যিনি পত্রবাহকের কাজ করেছিলেন।

—এর মধ্যেই শুনে ফেলেছ?

—হ্যাঁ। অমন একটি জটিল মুহূর্তে পত্রবাহকের কাজের ভার সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয় না। যাকে দেওয়া হয় সে নতুন হলেও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়ে। অন্তত তার নামটি।

—একই নামের অনেক মানুষ থাকে উধম।

—হ্যাঁ। কিন্তু সব জিৎ সিংই অত বড় তলোয়ার ঝুলিয়ে বেড়ায় না।

জিৎ সিং উত্তেজিত হয়ে উধমের হাত চেপে ধরে বলে,—আমার নামের সঙ্গে ওই কথাটি রটেছে?

—হ্যাঁ।

স্তব্ধ হয়ে যায় জিৎ সিং। পিতার মৃত্যুর সময় সে প্রতিজ্ঞা করেছিল তলোয়ারটি সর্বদা সঙ্গে রাখবে। আজ এই প্রথম, সেই প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে আফশোস হয়। যে কাজে নেমেছে সে, তাতে বিখ্যাত হওয়ার সমূহ বিপদ। জিৎ সিং নামে যে রাজপুতটি সহসা রাজা মান সিংহের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে, সে তার চেহারার অনুপাতে অনেক দীর্ঘ তলোয়ার সঙ্গে নিয়ে ঘোরে—কথাটা রটে গেছে। রাস্তায় নামালেই সবাই নিঃসংশয়ে চিনে ফেলবে তাকে। তফিলউদ্দিনও চিনে ফেলবে। এতদিনে চিনেছে কি না কে জানে। এতলোক শুনল, সে-ও কি শোনেনি? দুশ্চিন্তার রেখা পড়ে জিৎ সিং-এর ললাটে।

উধম সব কিছু লক্ষ্য করেও নির্বিকার কণ্ঠে বলে, চলুন।

—আমার অবস্থা তুমি ঠিক বুঝছ না উধম।

—বুঝেছি। অন্য সবাই যা বুঝেছে, তার চেয়েও বেশি বুঝেছি আমি। আমি বুঝতে পারছি রাজা রাও-এর খুল্লতাতের পক্ষে আকবর শাহের ছদ্মবেশ ধরে ফেলা অসম্ভব ছিল।

চমকে ওঠে জিৎ সিং উধমের কথায়। সে উধমের মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে চায়। সেই মুখ ভাবলেশহীন।

—তুমি—কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে উধম। বাদশাহকে চিনতে পেরেছিলেন সেই বৃদ্ধ।

—হ্যাঁ, চিনতে পেরেছিলেন। নিশ্চয় পেরেছিলেন। কিন্তু কিভাবে পারলেন? রণথম্ভোর বিজয়ের সব ঘটনার মধ্যে এইটুকুই শুধু আজ দু’দিন ধরে সব সময় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

উধম কি বাদশাহের চর? আগ্রায় যত রাজপুত রয়েছে সবার বাড়িতে কি একজন ক’রে চর নিযুক্ত রয়েছে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে? কিন্তু তেমন তো মনে হয় না তাকে। পৃথ্বীরাজ নিজে উধমকে নিয়ে এসেছেন বলে শুনেছে সে। তবে কি এই সমস্ত অনুচরদের মোটারকম অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে দলে টানেন বাদশাহ্? অসম্ভব নয় কিছু। কিন্তু উধমের কথাবার্তা চাল-চলন এবং তার মুখের বীরত্ব-ব্যঞ্জক অভিব্যক্তি দেখে একথা বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর।

উধম হেসে বলে,—আরও চিন্তায় পড়লেন তো? ভয় নেই নিশ্চিন্ত থাকুন।

–তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না উধম।

—বুঝতে চেষ্টা করবেন না। আমার কথা আমার প্রভুও বুঝতে পারেন না, তাই তিনি আমায় ভালোবাসেন।

—তোমার ঠিক আগের মতো বিশ্বাস করতে পারছি না।

—পারছেন না তো? অমার প্রভুও একদিন এই কথাই বলেছিলেন। তারপর থেকে বেশি মাত্রায় বিশ্বাস করেন।

—আমি তবে বিশ্বাস করতে পারি?

—নিশ্চিন্তে। চলুন।

—এখন আমি যাব না।

—চলুন। আর একটি কথা আপনাকে বলা হয়নি। বীরবলের বাড়িতে দু-তিনবার করে গাড়ি নিয়ে যেতে হচ্ছে।

—কেন?

—তাঁর কন্যা বড় বেশি আসতে শুরু করেছেন, দু’তিনদিন হল। শুকনো মুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে সেই পরীর মতো সুন্দরী মেয়েটি বাড়ি ফিরে যান। যাবার সময় কড়া দৃষ্টিতে চাইতে চাইতে যান। যেন সব দোষ আমার।

—কী বলতে চাও তুমি উধম?

—কিছু না। আপনি চলুন।

উধম নাছোড়বান্দা। অগত্যা উঠতে হয় জিৎ সিংকে।

.

জিৎ সিং কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করতেই রানী ছুটে আসে সামনে। এসেই থেমে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে থাকে।

জিৎ সিং এগিয়ে গিয়ে বলে,–আমার অপরাধ হয়েছে বোন।

উদাস স্বরে রানী বলে,—না। কোনো অপরাধ হয়নি। সব আমার ভাগ্য। আমার রাখীর সে-শক্তি নেই যে-শক্তি ভাই-এর মতো ভাই মিলিয়ে দেয়। হয়তো আজকাল কোনো রাখীরই আগের সেই শক্তি নেই। নইলে রাজোয়ারার এ-দশা হবে কেন?

—কিন্তু শক্তি আছে বোন। এত শক্তি রয়েছে, যা তুমি কল্পনা করতে পার না। শক্তি যদি না থাকত তবে ভগ্নমন নিয়ে—

—থেমে গেলে কেন জিৎ? বল।

জিৎ সিং মনে মনে নিজের ওপর বিরক্ত হয়। রানীর সামনে এভাবে সব কিছু বলতে যাওয়া মূর্খতা। যুদ্ধ জিতে ফিরে এলে ভগ্নমনের প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে? রানী তার বোন হতে পারে, রানী মেবারকে ভালোবাসতে পারে, কিন্তু রাজা ও রানী উভয়েই মুঘল বাদশাহের প্রতি বিশ্বস্ত। নিজে যে কাজে নেমেছে তার বিন্দুবিসর্গও যাতে এরা কোনোদিন সন্দেহ করতে না পারে, সেই চেষ্টাই করা উচিত। কারণ এরা সন্দেহ করলে, কিংবা জেনে ফেললে বাদশাকে সেকথা বলতে পারবে না। বলতে না পারলে সেটি হবে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। পৃথ্বীরাজ আর তাঁর স্ত্রীকে মনে মনেও নিজেদের বিশ্বাসঘাতক ভাবতে দিতে চায় না সে। তবে উধম যেন কিছুটা অনুমান করতে পেরেছে। কিছুটা কেন, ভালোরকমই অনুমান করতে পেরেছে বোধহয়। তার দিকে নজর রাখতে হবে।

রানী জিৎ সিং-এর হাত ধরে বলে,—বল ভাই। বলতে বলতে থেমে গেলে কেন?

—সে অনেক কথা বোন। সব কথা কি সব সময়ে বলা যায়?

—হ্যাঁ যায়। বোনের কাছে সব কথা বলা যায়।

—হয়তো তুমি সত্যি কথা বলছ। তবে আমার এমন কতকগুলো ভাবনা রয়েছে যে ভাবনার কষ্টটুকু আমি একা ভোগ করতে চাই। তাতেই আমার আনন্দ। তোমাকে সেই কষ্টের অংশীদার করব না। তুমি রাগ করলেও নয়।

—কিন্তু তোমার মন ভেঙে গেল কেন?

জিৎ সিং ছোট্ট একটু মিথ্যার আশ্রয় নেয়,—ঠিক জানি না। রণথম্ভোর থেকে ফিরে আসার পর থেকে কিছু ভালো লাগত না। কিন্তু তোমার রাখী আমায় বাঁচিয়ে দিল।

—কেমন ক’রে।

—ঘরের মধ্যে একা শুয়ে থাকতাম সবসময়। সেই সময়ে উধম গিয়ে উপস্থিত। উধমকে দেখেই তোমার কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে বসলাম। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। আমি হাসলাম। তার পরে তার সঙ্গে চলেও এলাম এখানে। রাখীর যদি শক্তি না থাকত তবে কি এত.সব সম্ভব হত বোন?

রানীর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে না সে। তারপর হঠাৎ জিৎ-এর গাল দুটো টিপে দেয়।

জিৎ-এর মুখ লাল হয়ে ওঠে।

—লজ্জা পেয়ে গেলে ভাই? ভেবেছ দাড়ি-গোঁফ উঠেছে বলে বয়স বেড়েছে? কিই বা এমন বয়স?

—বাঃ, আমি বড় হইনি বলতে চাও?

—মোটেই না। আমার কাছে অন্তত নয়। তবে আর একজনের কাছে তুমি—

—কি বললে?

রানী খিলখিল করে হেসে উঠে বলে,–আমি সব জানি।

—কী জান?

—জানি ভাই জানি। নারী হয়ে নারীর হালচাল বুঝব না? অতই বোকা ভাব নাকি।

—–কোন্ নারীর হালচাল বুঝেছ তুমিই জান।

—তুমিও জানো মশায়। নইলে সে অতটা পাগল হত না।

জিৎ সিং চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে বীরবল-কন্যা একটু বেশিরকম বাড়াবাড়ি ক’রে ফেলেছে। আদর আর প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হলে এমনিই হয়। ধৈর্য বলে পদার্থটি চরিত্রের মধ্যে জায়গা খুঁজে নিতে পারে না। অথচ লীলাবতী? ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, কত অশান্ত, আবার কত শান্ত। কত কঠিন, আবার কত কোমল। কিন্তু তার কথা ভেবে আর কী লাভ? কোনো লাভ নেই। সে সরে গেছে তার জীবন থেকে। নিজেকে লীলাবতী সরিয়ে নিয়েছে ঘৃণ্য গুপ্তচরের কাছ থেকে, যে গুপ্তচর মানুষের মতো মানুষ পেলে রণথম্ভোরের শেষ দিনে মুঘল ইতিহাসের দিক-পরিবর্তন ক’রে দিতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয় তেমন মানুষের সাক্ষাৎ পায়নি সে। পৃথিবীর মাটির ওপর যে-মানুষ ঘুরে বেড়ায় সেই মানুষের মনে সবরকম সদ্‌গুণের পাশাপাশি রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ছলনা, চাতুরী ইত্যাদি যাবতীয় অসদ্‌গুণও পাকাপোক্তভাবে বাসা বেঁধে তাকে আরও উপযুক্ত আরও দুর্জ্ঞেয় ক’রে তোলে তেমন মানুষের সাক্ষাৎ সে পায়নি রণথম্ভোরে। তাই বাদশাহ্ আকবর সুরজন রাওকে কৃতার্থ ক’রে দিয়ে হাসিমুখে রণথম্ভোরের জঠর থেকে বের হয়ে এলেন মানসিংহের আগে আগে। একা বাদশাহ্ আকবর রণথম্ভোর জয় করে নিলেন।

তেমন মানুষের সাক্ষাৎ সারা রাজোয়ারায় সে পাবে কি না সন্দেহ। কিকাকে সে বিশ্বাস করে। কিন্তু কিকাও তেমন মানুষ নন। তবে তাঁর সদ্‌গুণাবলী এত বেশি প্রবল, এত বেশি শক্তিশালী যার কাছে সব অসদ্‌গুণ হার মানে। এইটুকুই ভরসা, এইটুকুই ভবিষ্যতের আশা। এই আশা নিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হবে। লীলাবতী-হীন জীবনে এই আশাই তার সামনে একমাত্র ক্ষীণ আলোকবর্তিকা।

লীলাবতী ঘৃণা করে তার কাজকে। ঘৃণা করে তাকে। তাই আজ প্রিয়া এসে উপস্থিত হয়েছে তার জীবনে। প্রিয়াকে সে প্রথম দিনে সহ্য করতে পারেনি। তারপর একটু একটু ক’রে যত তার গর্ব খসে পড়েছে, ততই ভালো লেগেছে। আজকাল তো তাকে বেশ ভালোই লাগে। নইলে রানীর কথা শুনে, উধমের কথা শুনে একটু একটু আনন্দ হচ্ছে কেন তার? দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন লীলাবতীর দেশের মেয়ে প্রিয়াকে? প্রিয়া নামটি তার নিজের দেওয়া। এই নাম, আর, এই নামের অধিকারিণীকে আঁকড়ে ধরে লীলাবতীকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হবে।

—চুপ ক’রে রয়েছ কেন ভাই? তার চিন্তায় ডুবে গেলে?

—হ্যাঁ। তার চিন্তা। সেই সঙ্গে আরও অনেক চিন্তা।

—সে যদি তোমার বউ হয়, খুব ভালো হবে। চমৎকার মেয়ে। তোমারও কপাল খুলে যাবে। জিৎ সিং রানীর চোখের দিকে চেয়ে বলে,– ওভাবে কপাল খুললে তুমি খুশি হবে?

একটু ভেবে নিয়ে রানী বলে,—যদি খুশি হই?

—বুঝবো রাখীর শক্তি সত্যিই কমে গেছে।

—আমি খুশি হবো না ভাই। ওভাবে কপাল ফিরলে তোমার ভেতরের আগুন নিভে যাবে। তোমায় হয়তো আমি ঘৃণাও করব।

—তবে?

—কিন্তু তাকে যে তুমি ভালোবাস জিৎ।

—বাসি কি না জানি না এখনো।

—ও তোমায় ভালোবাসে।

—সে স্বাধীনতা ওর রয়েছে।

রানী হেসে বলে,—স্বাধীনতার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছে মেয়েটি।

—আমার দুর্ভাগ্য।

বাইরে শকটের শব্দ শোনা যায়। রানী জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,–এইবারে তোমরা বোঝাপড়া কর। সে এসে গেছে। আমি চললাম। অনেক ঝড় বইবে, জল ঝরবে হয়তো। আমি অন্য ঘরে যাই।

—হ্যাঁ। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখো।

—ছিঃ, আমি তোমার দেশের মেয়ে জিৎ।

—আমার দেশের মেয়ে বুঝি পৃথিবীর অন্য দেশের মেয়েদের চেয়ে স্বতন্ত্র? শুনিনি তো?

রানী ফিক্ ক’রে হেসে বলে, —মেয়েদের সম্বন্ধে খুব দ্রুত জ্ঞান লাভ করছ দেখছি। কিন্তু সত্যিই আমি ওসব পারি না ভাই।

রানী ঘর ছেড়ে চলে যাবার ঠিক পরই বীরবল-কন্যা প্রবেশ করে সেখানে। জিৎ সিংকে দেখে সে যেন প্রবল ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। তার নড়বার ক্ষমতা থাকে না। শুধু তার দুই চোখের দৃষ্টি আঁকড়ে ধরে জিৎ সিং-এর মুখ। সে দৃষ্টি পলকহীন, পাছে সেই অবসরে জিৎ সিং আবার অদৃশ্য হয়।

জিৎ বুঝতে পারে না সে কি করবে। এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি? কিন্তু এগিয়ে গিয়েই বা কি বলবে সে? এই দুদিন কেন সে দেখা দেয়নি। কেন সে একটি তরুণীকে প্রতীক্ষার ব্যথায় ভুগতে দিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব সে নিজেও খুঁজে পায় না। তাই অপেক্ষা করে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

সে দেখতে পায় বীরবল-কন্যার চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। গিরো উপত্যকা থেকে বিদায়ের আগের দিনে উদয়সাগরের স্নানের পর লীলাবতী যখন কেঁদেছিল, তখনো ঠিক এমনি দেখাত তাকে। আশ্চর্য সাদৃশ্য। জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সে এগিয়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় বীরবল-কন্যার সামনে।

কিন্তু কিছুই বলতে পারে না সে। বলবার কিছু খুঁজে পায় না। তাই খুব আস্তে আস্তে ডাকে,—প্রিয়া।

প্রিয়া জিৎ সিং-এর বুকের ওপর ভেঙে পড়ে। এমনভাবে ভেঙে পড়ে, যে সরে যাবার কিংবা সাবধান ক’রে দেবার সময়টুকুও দেয় না সে। কারণ সে ভালোরকম জানে, রানী না দেখলেও, উধম কাছে-পিঠে কোথাও না কোথাও রয়েছে। সবই দেখছে সে। একটা অস্বস্তিতে ভরে যায় জিৎ-এর মন। অথচ এই আকুলা মেয়েটিকে ঠেলে দিতে পারে না। ঠেলে দেবার মতো শক্তিও যেন পায় না। কারণ গিরো উপত্যকায় ছেড়ে আসা অনেক আগের এক অনুভূতি নতুনভাবে তাকে আচ্ছন্ন করে।

কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জিৎ সিং। বুকের ভেতরে বীরবল-কন্যা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে ফুলে ওঠে। তার অন্তহীন ক্রন্দন জিৎ সিং-এর মনকে আর্দ্র ক’রে তোলে। এতক্ষণে সে যেন একটু একটু করে বুঝতে পারে মেয়েটির প্রতি তার সত্যিই আকর্ষণ রয়েছে। মেয়েটিকে সে যেন একটু ভালোবেসেও ফেলেছে। কেনই বা বাসবে না ভালো? তার অদর্শনে যে-নারী এতটা আকুল হয়ে ওঠে তাকে ভালোবাসতে পারা পাপ নয়। বরং পুণ্য। এ হয়তো তার আসল পরিচয় জেনে তাকে দূরে ঠেলে দেবে না। তাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করবে। লীলাবতীর চেয়ে এর মন হয়তো অনেক উদার।

প্রিয়ার মুখখানি ধীরে ধীরে তুলে ধরে জিৎ। উধমের কথা তার মনে থাকে না।

রানীর কথাও নয়। পৃথিবীকে সে ভুলে যায় সেই মুহূর্তটুকুর জন্য।

—প্রিয়া।

—তোমার জন্যে আমি এ-দুদিন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, তবু তুমি এলে না।

জিৎ সিং ভাবে, এমন সরল স্বীকৃতি লীলার পক্ষে সম্ভব হত না। অথচ এই মেয়েটিরই গর্বের সীমা ছিল না। সেই গর্ব একেবারে পরিত্যাগ করেছে প্রিয়া। এখন সে নিঃস্ব।

—আমি অসুস্থ ছিলাম প্রিয়া।

জিৎ সিং-এর আপাদমস্তক চেয়ে দেখে সে। তার পর বলে,—হ্যাঁ। তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। কি হয়েছে তোমার?

—জানি না।

—সরাইখানায় আর কতদিন থাকবে? ওখানে কি শরীর টেকে? আমি ব্যবস্থা করে দেব।

—না। ওসব কিছু করতে যেও না, আমি ভালোই আছি।

প্রিয়া একবার জিৎ সিং-এর মুখের দিকে চেয়ে থেমে যায়। সে বুঝতে পারে জিৎ সিং বিরক্ত হয়েছে একটু। তাই হেসে বলে,–বেশ তো। তুমি ওখানেই থাকো। তবে শরীরের দিকে একটু নজর দিও।

—তোমার শরীর ভালো আছে তো প্রিয়া?

—হ্যাঁ। খুব ভালো আছে। দেখতে পাচ্ছ না? তুমি যখন রণথম্ভোরে ছাউনির নীচে কষ্ট ভোগ করছিলে, তখন আমি দিব্যি আরামে বসে বসে দেহটাকে আরও মসৃণ আরও কোমল ক’রে তোলবার চেষ্টা করছিলাম।

—কেন?

—কেন? তা জানি না। তবে মেয়েদের বোধহয় এইটিই স্বভাব। পুরুষেরা সময় পেলে বসে বসে চিন্তায় ডুবে যায়। জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর জট খোলার চেষ্টা করে তারা। আর মেয়েরা নিজেদের দেহকে আরও সুন্দর করার চেষ্টা করে।

—এতসব জানলে কি ক’রে?

—দেখে দেখে। মুঘল হারেম দেখেছি, মুঘল দরবারও দেখেছি। দুটোর তফাত আমি বুঝতে পারি না।

—কিন্তু তোমার অবসর তো এই প্রথম নয় প্রিয়া। তোমার অবসর তো চিরদিনই রয়েছে।

—হ্যাঁ। কিন্তু তখন এটাকে অবসর বলে বুঝতে পারতাম না। তাছাড়া তখন দেহের দিকে চাইতাম অভ্যাসবশে। এভাবে নজর দিইনি কখনো। এতদিনে বোধহয় আমার বয়স হল।

—তোমায় দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে।

প্রিয়ার মুখ লজ্জায় আর আনন্দে রাঙা হয়ে ওঠে। সে বলে,—কবে যাচ্ছো?

—কোথায়?

—আমার ওখানে।

—যাওয়া কি খুব নিরাপদ হবে?

—নিরাপদ কোনোদিনই নয়। তবু তুমি না গেলে আমি—তুমি যেও।

—যাব।

—কবে?

—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

—আজ?

—না প্রিয়া। অনেক কাজ বাকি রয়েছে।

প্রিয়া কিছুক্ষণ চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে। সে চেয়ে চেয়ে দেখে জিৎ সিংকে। এতদিন দেখতে পায়নি তাকে সেই না-দেখাটুকু পুষিয়ে নিতে চায়।

একটু হেসে সে বলে,—রণথম্ভোরে তুমি রাজা মান সিংহের খুব আস্থাভাজন হয়েছিলে।—কে বলল, রানী?

—না। বাবার মুখে শুনেছি।

—বীরবল? তিনি আমায় চেনেন?

—না। তিনি শুধু নামটি জানেন। আর জানেন, মস্ত তলোয়ার সব সময় তোমার সঙ্গে থাকে। মস্ত তলোয়ার তোমার ছাড়া আর কারও নেই। ও নাম অবশ্য অনেকেরই থাকতে পারে। তাই আমিও চিনে ফেললাম।

জিৎ সিং চিন্তিত হয়ে পড়ে। তলোয়ার তাকে সত্যিই ছাড়তে হবে এবারে। নইলে খুব শিগগিরই আগ্রায় অতি বিখ্যাত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হবে সে। তাতে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

রানী এসে প্রবেশ করে। বীরবল-কন্যাকে দেখে কপট-বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,—তুমি কখন এলে?

—একটু আগে।

—জিৎ সিং কেমন যেন রুক্ষ হয়েছে রণথম্ভোরে গিয়ে। তাই না?

—তাই বুঝি?

—কেন, তুমি বুঝতে পারছ না?

—অতটা খেয়াল করিনি।

—কথাবার্তা বিশেষ বলেনি বোধহয় তোমার সঙ্গে। বললে বুঝতে পারতে।

প্রিয়ার দৃষ্টি বিদ্যুতের মতো জিৎ সিং-এর চোখের ওপর একবার পড়েই আবার ফিরে যায় রানীর চোখের দিকে।

সে দৃষ্টিতে অনেক কথা।

.

কথা দিয়েও কথা রাখতে পারেনি জিৎ সিং। প্রিয়ার বাড়িতে যাওয়া এ পর্যন্ত হয়ে উঠল না। অনেকদিন কেটে গেল, যাবো যাবো ক’রে।

তার মনের মধ্যে অনেক দুশ্চিন্তা কাজ করতে শুরু করেছে। প্রথমত রাম সিং তাকে চিনে ফেলেছে কি না, সে বুঝে উঠতে পারছে না। যদি জিনেই থাকে, তবে কেন সে এখনো তার সামনে এগিয়ে আসছে না? ইচ্ছে করলেই তো সে তাকে বাদশাহের দরবারে নিয়ে গিয়ে হাজির করতে পারে। একদল সাক্ষী সংগ্রহ ক’রে প্রমাণ করে দিতে পারে সে গুপ্তচর। তবু কেন সে আসছে না? তবে কি এখনো সে চিনতে পারেনি? কিংবা মান সিংহের জন্যে কিছু করতে সাহস পাচ্ছে না?

জিৎ সিং-এর দ্বিতীয় দুশ্চিন্তা বাদশাহের পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে। রণথম্ভোর-বিজয় সমাপ্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের সব চাইতে শক্ত তিন ঘাঁটির দুইটি এখন তাঁর করতলগত। বাকি রয়েছে শুধু আর একটি—কালাঞ্জর দুর্গ।

এবারে তাঁর অভিযান কোন্ দিকে হবে? মেবারের রানা-বংশকে বিলুপ্ত ক’রে দিতে মনে মনে সঙ্কল্প করেছেন কি তিনি? মান সিংহের সঙ্গে অনেকবার দেখা করেছে জিৎ সিং বাদশাহের উদ্দেশ্য জেনে নেবার জন্যে। কিন্তু সফল হয়নি। মান সিংহ নির্বিকার। তিনি জিৎকে পছন্দ করলেও বাদশাহের গোপন উদ্দেশ্য কখনো প্রকাশ ক’রে দিতে পারেন না। কিংবা বাদশাহ্ নিজেই হয়তো কোনো কথা কাউকে বলেন না আগে থেকে।

জিৎ সিং এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে মরে খবরের আশায়।

ঠিক সেইসময় একদিন উধম আসে আবার সরাইখানায়।

—কি খবর উধম?

—যথারীতি রানীমা আপনার দর্শনপ্রার্থী।

—অনেকদিন যাওয়া হয়নি।

—হুঁ! প্রায় তিনমাস হতে চলল।

চমকে ওঠে জিৎ সিং,—এতদিন হয়ে গেল? হতে পারে। বড় দুর্ভাবনায় আছি।

—স্বাভাবিক। আসল জায়গা ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় ঘুরে মরলে অমন ভাবনা হয়ে থাকে। জিৎ সিং তড়িতগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে উধমের কাঁধ চেপে ধরে বলে,–তোমার কথার অর্থ?

—আমার সব কথাই নিরর্থক।

—না, স্পষ্ট বল। নইলে আজ আমি তোমায় ছাড়ব না। অনেকদিন ধরে তোমার একটি কথা আমাকে দগ্ধ করছে। তোমায় আমি চিনে উঠতে পারছি না। আজ সব কথা বলতে হবে। মনে রেখো উধম, আজ আমার তলোয়ার আমার কোমরে রয়েছে।

—তাই তো দেখছি। কিন্তু এতটা উত্তেজিত কেন হঠাৎ?

—ওসব কথা বলে আমায় ধোঁকা দিতে পারবে না। তোমায় আমি খুবই পছন্দ করি উধম। তোমার স্বভাব আমার খুব প্রিয়। তোমার শক্তি আর বুদ্ধিতে আমার শ্রদ্ধা রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু আজ যদি হেঁয়ালি না ছাড়ো, তবে এ-ঘর থেকে আমি তোমায় বের হতে দেব না। আমি খুবই দুঃখিত উধম। কিন্তু উপায় নেই।

জিৎ সিং কোষ থেকে তার দীর্ঘ অসিটি বের করে।

নিরস্ত্র উধম তার মুখের দিকে চেয়ে ধীরে বলে,—কোন কথা জানতে চান আপনি?

—সব।

—সব, কিসের সব? আমার দেশ, আমার বংশ পরিচয়?

জিৎ সিং একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর হয়ে বলে,—তুমি নির্বোধ নও উধম। আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে যা-কিছু বলার প্রয়োজন তাড়াতাড়ি বল। বেশি সময় অপেক্ষা করতে পারব না।

—একটি একটি ক’রে প্রশ্ন করুন।

—আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, রণথম্ভোর থেকে ফিরে আসার পর তুমি বলেছিলে, সুরজন রাও-এর খুল্লতাত কীভাবে বাদশাহকে চিনে ফেলল, এই কথাটা তোমায় সবচেয়ে বেশি চিন্তিত করেছে। তোমার ধারণা ছদ্মবেশী আকবরকে চেনা বৃদ্ধের পক্ষে অসম্ভব ছিল।

—হ্যাঁ।

—কেন?

—কারণ বৃদ্ধ কখনওই চিনতে পারত না বাদশাহকে, যদি না অপর কেউ আগে থেকে বলে দিয়ে যেত।

—সেই অপরজন কে হতে পারে?

—পত্রবাহক।

জিৎ-এর তলোয়ার উধমের মাথার ওপর ঝলসে ওঠে।

—দাঁড়ান। অত তাড়াতাড়ি তলোয়ারের কসরত দেখাবেন না। একটু ধৈর্য ধরুন।

—সময় নেই। তুমি আমাকে চিনে ফেলেছ। পৃথিবীতে আমি সাক্ষী রাখতে পারি না উধম। আমি সত্যিই দুঃখিত।

—বেশ তো। কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাবেই সব কৌতূহলের নিবৃত্তি হল? অন্য কোনো প্ৰশ্ন করার থাকলে, জেনে নিন এই বেলায়। আমাকে মেরে ফেললে সবই তো অজানা থেকে যাবে।

উধমের কথা সংগত বলে ভাবে জিৎ সিং। সে বলে,—একটু আগে তুমি বললে, আসল জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ালে অমন ভাবনা হয়। কথাটার অর্থ কি উধম?

—আপনি দুর্ভাবনায় রয়েছে বললেন, তাই একথা বললাম। একটি দুর্ভাবনা আমার জন্যে ছিল, একথা আমি জানতাম। কারণ আপনি সন্দেহ করেন। বাকিটা আশা করি মেবারের জন্যে? মেবার আক্রমণের আশু কোনো সঙ্কল্প রয়েছে কি না বাদশাহের এই কথা জানবার জন্যে আপনি ব্যস্ত হয়েছেন, তাই তো?

—হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। তোমার বুদ্ধির তারিফ করি।

—আপনি জানতে পারবেন না।

—কেন?

—আসল জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন বলে।

—আসল জায়গা কোনটি?

—বীরবলের গৃহ। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি সাহসী হতে পারেন, কিন্তু আপনি মূর্খ। মূর্খ না হলে অমন সুযোগ পেয়েও কেউ যেচে হারায় না।

জিৎ সিং একটু ভেবে নিয়ে বলে,–সে গৃহে প্রবেশে কতখানি বিপদ ঘটতে পারে তোমার ধারণা নেই।

—ধারণা আছে। কিন্তু বিপদকে মেনে নিয়েই না আপনি এপথে নেমেছেন?

জিৎ সিং ফিসফিস করে বলে,—তুমি আমার সব কথাই জান দেখছি।

—তা বলতে পারেন।

—কীভাবে জানলে?

—পরে বলছি। তার আগে একটি কথা বলে নিতে দিন। আপনি যদি আপনার ওই ‘প্রিয়ার’ কাছে মাঝে মাঝে যেতেন, তাহলে কালাঞ্জর দুর্গ অবরোধে মুখল সৈন্যকে নাজেহাল করতে পারতেন।

জিৎ সিং লক্ষ্যও করল না যে তার ‘প্রিয়া’ সম্বোধন উধম শুনে ফেলেছে। সে চিৎকার করে’ ওঠে,—কালাঞ্জর!

—হ্যাঁ, যে কালাঞ্জর দখল করতে গিয়ে দিল্লীর মসনদের সব চাইতে যোগ্য সম্রাট শের শাহ্ দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। সেই বুন্দেল-খণ্ডের কালাঞ্জরের কথাই আমি বলছি। তাকে ঘিরে এই মুহূর্তে মুঘল বাহিনী অপেক্ষা করছে। আর রাজা রামচন্দ্র দুর্গের ভেতরে মুখ শুকনো ক’রে ভেবে চলেছেন, কী করবেন তিনি।

—কালাঞ্জর অবরুদ্ধ?

—হ্যাঁ। একথা আমি অনেক আগেই জানতে পেরেছি, অথচ আপনি জানেন না। যদিও এইসব জানতেই আপনি আগ্রায় এসে কষ্ট ক’রে সরাইখানায় পড়ে রয়েছেন।

উধমের কথার মধ্যে বিদ্রূপ ফুটে বের হয়। সেই বিদ্রূপ জিৎ সিং-কে ক্রুদ্ধ করতে পারে না। সেই বিদ্রূপ তাকে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়। কারণ বিদ্রূপই তার প্রাপ্য। কালাঞ্জর। আগেই তার বোঝা উচিত ছিল—এবারে কালাঞ্জরের পালা। কিন্তু বুঝতে সে পারেনি। তার ধারণা ছিল আগের বারের মতো এবারেও আকবার বাদশাহ্ নিজে যাবেন অভিযানে। বিশেষত কালাঞ্জর অভিযানে গেলে। তাই নিশ্চিন্ত ছিল। সে জানত, বাদশাহ্ গেলে মান সিংহও তাঁর সঙ্গে যাবেন। আর মান সিংহ গেলে তাকেও সঙ্গে নেবেন।

বাদশাহ্ সুচতুর। তিনি হয়তো তাঁর সূক্ষ্ম বুদ্ধি দ্বারা অনুভব করেছিলেন, যে তাঁর অভিযানকে ব্যর্থ ক’রে দেবার চক্রান্ত চলছে। তাই নিজে না গিয়ে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছেন সবার অজ্ঞাতে। রাজা মান সিংহও হয়তো খবর রাখেন না এই অভিযানের। রাখলে তাকে বলতেন অন্তত।

বাদশাহ্ কি তবে রাজা মান সিংহের মতো ব্যক্তিকেও সন্দেহ করতে শুরু করেছেন? যদি সন্দেহ করেন, তবে জীবনের সব চাইতে বড় রকমের ভুল ক’রে বসবেন। কারণ সন্দেহ করতে একবার শুরু করলে তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ ক’রে সীমাহীন হয়ে ওঠে। তার ফলে হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক। মান সিংহকে সন্দেহ করলে দিল্লীর বাদশাহ্ হলেও আকবর শাহ্ নিজের মৃত্যু-বীজ বপন করবেন বলতে হবে।

উধম সিং বলে,—আর কিছু জানতে চান?

—না, যথেষ্ট বলেছ তুমি। এত বেশি বলেছ যে এখান থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরে যাওয়া তোমার পক্ষে অসম্ভব। তবু একটি প্রশ্ন তোমায় করব। প্রশ্নটি হল,–এত সব জানলে কোথা থেকে?

উধম মৃদু হেসে বলে,—অনুমান করুন।

—একটি অনুমানই শুধু করতে পারি। অনেকের মতো তুমিও নিযুক্ত হয়েছ বাদশাহ্ কর্তৃক রাজপুতদের শেষ প্রচেষ্টার মূলে কুঠরাঘাত করতে।

—ভুল!

—তবে?

—যে লোকটিকে আপনি রণথম্ভোরে পাঠিয়েছিলেন, তাঁকে আমি চিনতাম। তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল।

—ভবঘুরে?

—হ্যাঁ, আপনি তাঁকে জানতেন ভবঘুরে বলে।

—তিনি কি তবে ভবঘুরে নন?

—ভবঘুরে বৈ কি? তবে তাঁর আসল পরিচয় কেউই জানে না, আমিও না।

—ভবঘুরে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এতক্ষণে আমি বুঝতে পারছি রণথম্ভোর থেকে আকবর শাহের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের আসল কারণ রাজা রাওকে তিনি চরম ব্যবস্থা করতে দেননি।

—আপনি কিছুই বুঝতে পারেননি। ভবঘুরে বিশ্বাসঘাতক, একথা স্বপ্নেও কখনো চিন্তা করবেন না। ঘোরতর পাপ হবে। তিনি দেবতা ছিলেন। তাঁর দেবদুর্লভ গুণাবলীর মধ্যে একটিমাত্র দুর্বলতা ছিল। আপনি জানেন সে কথা। তিনি ভালোবেসেছিলেন একজন স্বার্থপর নারী, কমলাবতীকে। সেই ভালোবাসার মূল্য দিয়েছেন তিনি।

এতদিনের পরিচয়ের মধ্যে এই প্রথম উধমের চোখদুটি সজল হয়ে উঠতে দেখে জিৎ সিং। সে বিস্মিত হয়। এত বিস্মিত হয় যে উধমকে হত্যা করার কথা ভুলে যায়।

সে বলে,—হ্যাঁ। আমি জানি সেকথা। কিন্তু তুমি ওভাবে কথা বলছ কেন উধম? তোমার চোখে জল? ভবঘুরে কোথায়? কোথায় তিনি?

হাত উল্টে উধম বলে,—নেই।

—নেই!

—নেই। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

জিৎ সিং-এর শরীর একটু কেঁপে ওঠে। তারপর সে শক্ত হয়। তবু হাতের তলোয়ার এই প্রথম বড় বেশি ভারী বলে মনে হয় তার কাছে। সে উধমের জানুর ওপর সেটি রেখে দেয়। বুঝতে বাকি থাকে না তার, তারই মতো সামান্য যে কয়জন রাজপুত ভবিষ্যতের উজ্জ্বল দিনের প্রত্যাশায় আগ্রায় মাটি কামড়ে পড়ে থেকে অবিরাম চেষ্টা করছে, উধম তাদেরই একজন। আর একজন ছিল ভবঘুরে।

উধমের পিঠের ওপর হাত রেখে ধীরে ধীরে জিৎ সিং বলে,—আমায় ক্ষমা কর ভাই।

—সাবধান তোমায় হতেই হবে জিৎ সিং। এতে ক্ষমা চাইবার প্রশ্ন ওঠে না।

—সব কিছু খুলে বল আমায়।

—তুমি ফিরে আসবার পরের দিনই ভবঘুরে ফিরে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন রণথম্ভোরে তোমার অদ্ভুত কাজের কথা। তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। এত তাড়াতাড়ি মান সিংহের বিশ্বাসভাজন হয়ে এভাবে গোপন কথা টেনে বের করা আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না জিৎ। তোমার চেহারা, তোমার কথাবার্তা, আর তোমার দুর্জয় সাহসেই ওই দুরূহ কাজ অত সহজে সম্ভব হয়েছিল। তবু কোনো ফল হল না। ভবঘুরে সেই দুঃখই করছিলেন।

—কিন্তু তাঁকে হত্যা করল কে?

—কে হত্যা করেছিল জানি না। কী ঘটেছিল, সেইকথা বলছি। রণথম্ভোর থেকে ফিরে আসার পথে তিনি এক দুঃসাহসের কাজ ক’রে বসলেন। তোমার কাছে নাকি তিনি শুনেছিলেন কমলাবতী বাদশাহের সঙ্গে রণথম্ভোরেই রয়েছেন।

—হ্যাঁ। আমি খোঁজ নিয়ে জানিয়েছিলাম সেকথা।

—না জানালে বোধহয় ভালো হত। অবিশ্যি, তুমি মানুষের কাজই করেছ। কারণ কমলাবতীর প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা তাঁর সমস্ত কপট বিরক্তি আর নির্বিকার ভাবের মধ্যেও ফুটে উঠত।

—শুধু তাই নয়। আমি অকপট হৃদয়ে চেয়েছিলাম বাদশাহ্ যদি রণথম্ভোর থেকে আর কোনোদিনও বাইরে না আসেন তাহলে কমলাবতীকে অন্তত যেন ভবঘুরে ফিরে পান। বহুদিন হারেমে কাটিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন সুযোগ পেল ভবঘুরে তাকে বুকে তুলে নিতেন নিশ্চয়। নিশ্চয়ই নিতেন উধম।

—হ্যাঁ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর শোন। রণথম্ভোর থেকে যখন মুঘল সৈন্য তাদের শিবির উঠিয়ে নেয়, তখন কমলাবতীকে দর্শনের অত্যুগ্র বাসনা তাঁর মতো মানুষকেও চঞ্চল করে তুলল। তিনি সাধুর বেশেই তো থাকতেন সব সময়। কিন্তু এবারে নিলেন প্রকৃত সন্ন্যাসীর বেশ। সেই বেশে তিনি বেগমদের শিবিকার পাশে পাশে চললেন। কেউ সন্দেহ করল না তাঁকে। দিনের পর দিন তিনি শিবিকাগুলোর পাশে পাশে চলেছেন, আর একে ওকে ডেকে তাদের ভাগ্য গণনা করেছেন। এইভাবে তিনি একদিন সালিমা বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেন। সালিমা বেগমকে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন। তাই তাঁর অতীতের কথা বলেন হুবহু। ভবিষতের কথাও অনেক বললেন। বেগম সাহেবা চমৎকৃত হলেন। সেইসঙ্গে অন্যান্য বেগমরাও এইভাবে চলতে চলতে একদিন সন্ধ্যার পর কমলাবতীকে একান্তে পাওয়ার সুযোগ মিলে গেল তাঁর। পরিচয় দিতেই কমলাবতী চমকে উঠে প্রশ্ন করল,—তুমি কিভাবে এলে? সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে ভুল করে বসলেন ভবঘুরে। তিনি বহুদিন পর কমলাবতীকে অত কাছে পেয়ে তার হাত নিজের হাতের মধ্যে ভাগ্যগণনার ছুতো ক’রে তুলে নিয়ে, তার মুখের দিকে চেয়ে ভুলে গেলেন যে, সেদিনের কমলাবতীর মধ্যে শৈশবের কমলাবতীর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি বলে ফেলেছিলেন যে, যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের দুর্গের মধ্যে তিনি ছিলেন। কমলাবতী মিষ্টি কথায় জেনে ছিল, কত আগে থেকে তিনি রণথম্ভোর দুর্গে এসেছিলেন। তারপর অকস্মাৎ তার চোখমুখের চেহারা পালটে গেল। পিশাচীর মতো খনখনে হাসি হেসে বলে উঠল,—তুমি ভুল করেছ। আমার এই বুকের মধ্যে তোমার জন্যে একরত্তি স্থানও অবশিষ্ট নেই। আকবর বাদশাহ্ই আমার সব। তার ঐশ্বর্য যেমন অতুলনীয়, তার মত্ত দেহের পটুতাও তেমনি অপরিসীম। আমি তাকে ভালোবাসি।

বলতে বলতে উধম সিং-এর চোখদুটো ধক্থক্ করে জ্বলতে থাকে। তার চাহনি দেখে মনে হয়, সে যেন জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে নেই চেয়ে রয়েছ কমলাবতীর দিকে। সে তার জানুর ওপরে রাখা জিৎ সিং-এর তলোয়ারখানা চেপে ধরে। তারপর সহসা বুঝতে পারে সে ভুলে করছে। তলোয়ার থেকে হাত টেনে নিয়ে সে আবার বলে, –কমলাবতীর সেই হাসির মধ্যে এতই বেশি গরল ছিল যে ভবঘুরে মুহূর্তের মধ্যে বুঝে নিলেন যে কমলাবতীর কথার প্রতিটি অক্ষর সত্য। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। কমলাবতী বলে উঠল,—এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, রণথম্ভোরে আসলে কোন্ ব্যক্তি বাদশাহকে চিনেছিল। ওদের কেউ নয়—নিশ্চয়ই তুমি! চিনতে পেরে ওদের বলে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলে বাদশাহকে হত্যা করতে পারলে তোমার সাধ পূর্ণ হবে। আমি ঘৃণা করি। তোমায় আমি বরাবর ঘৃণা করব। যদিও বেশিদিন সেই ঘৃণা আর করতে হবে না।

সেই সময় সরাইখানার মালিক এসে বলে,—আপনার খানা প্রস্তুত।

উত্তেজিত জিৎ সিং ধমকে ওঠে। তারপরেই নিজের ভুল বুঝতে পারে। মালিককে মিষ্টি কথায় বলে,—আমার মাথার ঠিক ছিল না। কিছু মনে করো না।

মালিক বিগলিতভাবে হেসে বলে,–ঠিক আছে। মনে কিছুই করিনি। মেজাজ কি মানুষের সব সময় সমান থাকে? তাহলে তো মানুষ দেবতা হয়ে যেত।

জিৎ সিং দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলে,—ঠিক বলেছ।

মালিক চলে যায়।

উধম প্রশ্ন করে,—লোকটি ফিরে আসবে না তো?

—না।

—লুকিয়ে শুনতে পারে?

—এই ঘরে আড়ি পাতা যায় না। নইলে নিশ্চয় শুনত।

উধম নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,—ভবঘুরে কমলাবতীর কথার মর্মার্থ সহজেই বুঝলেন। তিনি অসহায়ের মতো একবার ঝুঁকে পড়ে নিজের পায়ের কাছে হাত রাখলেন। সেখানেই সাধারণত বাঁধা থাকত তাঁর ছুরিকা।

—আমি জানি।

—কিন্তু সেটি ছিল না সেখানে। সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করলে সেটিকে লুকিয়ে রাখা যায় না। তাই ফেলে এসেছিলেন রণথম্ভোরে। এ কথা মনে ছিল না তাঁর। অভ্যাস বশে তাই হাত দিয়েছিলেন। তার পর হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে ক্ষিপ্রগতিতে হাত বাড়িয়ে দিলেন কমলাবতীর গলা টিপে ধরে শ্বাস রুদ্ধ করবার জন্যে। কিন্তু কমলাবতী বুঝতে পেরেছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বুঝতে পারাই স্বাভাবিক। কত ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে সে। জানত কতখানি তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী তার এককালের প্রেমাস্পদ। সে জানত, ভবঘুরে তাকে আকবর বাদশাহের কাছে ফিরে যাবার আর সুযোগ দেবে না। তাই ঠিক সময়ে দুপা পেছনে সরে গিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। কিন্তু তার চিৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার আগেই ভবঘুরে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তাঁকে ওরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কত বার তাঁর পাশ দিয়েও চলে গেছে। কিন্তু খুঁজে পায়নি। ভবঘুরে আগ্রাতেই ফিরে এলেন, অন্য পথ দিয়ে। ঘটনাটা তোমাকে জানিয়ে দেবার জন্যেই তাঁর আগ্রায় ফিরে আসার উদ্দেশ্য। অথচ তোমার সঙ্গে সোজা গিয়ে দেখা করা নিরাপদ বোধ করেননি। কারণ তিনি চিহ্নিত, আর তুমি হয়ে পড়লে রাতারাতি বিখ্যাত। তোমার কাছে এলে বাদশাহের সন্দেহ তোমার ওপর গিয়ে পড়ত। তাই গোপনে রাতের অন্ধকারে আমাকে এসে বলেছিলেন। পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি তো আর সরাইখানা নয়।

—কিন্তু কে তাঁকে হত্যা করল?

—জানি না। বাদশাহের লোক নিশ্চয়ই।

—কমলাবতী বাদশাহকে জানিয়ে দিতে একমুহূর্তও দেরি করেনি তাহলে।

—না।

—কোথায় তাঁকে হত্যা করা হয়?

—যমুনার তীরে।

—না না উধম। সেখানে তিনি যেতে পারেন না। সেখানে কমলাবতী আসে।

—কিন্তু অনেকে দেখেছে যে।

—তারা কী বললে?

—আমি জানতে চাইনি। খোঁজও নিইনি। না নেওয়াই নিরাপদ নয় কি?

—হুঁ। তবে আমি খোঁজ নেব। আমি ছেড়ে দেব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *