আগ্রা – ৭

৭.

মান সিংহের শিবিরে অপেক্ষা করছিলেন ভগবান দাস। তাই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না সে। বাইরে অপেক্ষা করে। সে জানে, সময় হলে মান সিংহ নিজেই ডাকবেন তাকে। ডেকে হুকুম দেবেন। এই হুকুম সম্বন্ধে তার নিজেরও কৌতূহল কম নয়। এই হুকুম তিনি দেবেন বাদশাহের সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শের পর

কিন্তু এবারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে না সে। ভগবান দাসের সঙ্গে মান সিংহের কথোপকথন শুনতেই হবে তাকে। বাদশাহের শিবিরের পাশে উৎকর্ণ হয়ে থাকার বিপদ রয়েছে। কিন্তু এখানে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। সে সরে আসে এমন একটি জায়গায় যেখানে থেকে, খুব নিম্নস্বরে কথা না হলে সব কিছুই শুনতে পারবে। সে জানে, এইভাবে আড়িপাতা অন্যায়, ঘোরতর অন্যায়। তবু উপায় নেই। যে কাজে সে নেমেছে তাতে এত বাছ-বিচার করলে সফলতা লাভ করা অসম্ভব।

মান সিংহ বলেন,–শেষে আমিই একটি বুদ্ধি দিলাম।

ভগবান দাস প্রশ্ন করেন,—কি বুদ্ধি দিলে?

—রণথম্ভোরে চিঠি পাঠাবো আমি। মুঘলদের দলে থেকে তাদের হয়ে যুদ্ধ করলেও আমি রাজপুত, একথা ওরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবে না। আপনার কি মত?

—ওদের স্বীকার আর অস্বীকারে কী এসে যায়?

মান সিংহের হাসি শুনতে পায় জিৎ সিং, তিনি বলেন,—এক্ষেত্রে যথেষ্ট এসে যায়। যদি ওরা অস্বীকার করে তাহলে আমার কৌশল কোনো কাজে আসবে না।

—ধর, ওরা মেনে নিল তুমি একজন পবিত্র রাজপুত। তারপর?

—তারপর তো সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে। রাজপুতদের নিয়ম আপনি ভুলে গেলেন এর মধ্যে? আদর্শ আর ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিতে তারা নিজের নাকও কাটতে পারে।

জিৎ সিং-এর কান দুটো গরম হয়ে ওঠে। মান সিংহের কথার শ্লেষ তাকে আহত করে। কিন্তু এসব কথা গায়ে মাখবার সময় নেই তার। সে ভগবান দাসের বিস্ময়-ভরা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়,– তুমি—

—হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। আমি চিঠি দেব রাজা রাওকে। লিখব, আমি একা তাঁর দুর্গ পরিদর্শন করতে চাই। তিনি আমার অনুরোধ এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এড়িয়ে যেতে হলে বহুদিনের একটি নিয়মকে লঙ্ঘন করতে হয়। রাজপুত হয়ে সেটি তাঁর পক্ষে অসম্ভব হবে।

—তোমার উদ্দেশ্য কী?

—ওদের হালচাল জেনে নেওয়া।

—–সেকথা তো ওরাও বুঝবে।

—বুঝবে। একজন রাস্তার লোকও বুঝবে। তবু ওরা আমায় আমন্ত্রণ জানাবে। ওরা রাজপুত। মান সিংহ হোহো করে হেসে ওঠেন।

সেই হাসি জিৎ সিং-এর কানে গরম লোহা ঢেলে দেয়। তার হাত অজ্ঞাতে গিয়ে পড়ে তলোয়ারের হাতলের ওপর। এই সময়ে শিবিরের ভেতরের দুই রাজপুত রাজাকে হত্যা করা কত সহজ। সোজা ভালোমানুষের মতো এগিয়ে গিয়ে দুজনের মুণ্ডদুটো দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাটিতে ফেলে দেওয়া যায়। কিন্তু সে তা করবে না। সে গুপ্তচর। যে গুপ্তচরকে লীলাবতী মনে-প্রাণে ঘৃণা করে। কিন্তু সে গুপ্তঘাতক নয়। সারা জীবন ধরে সাধনা করলেও বোধহয় গুপ্তঘাতক হতে পারবে না!

কিছুক্ষণ নিম্নস্বরে কথাবার্তা চলে দুই রাজপুত সেনাপতির। তারপর মান সিং জিৎ সিং-কে ডাকেন।

ভেতরে যেতেই তিনি ভগবান দাসকে বলেন,—এই ছেলেটি।

জিৎ সিং বুঝতে পারে, তার সম্বন্ধে কথা হয়েছে। তার আপাদমস্তক কয়েকবার দেখে নেন ভগবান দাস। তারপর বলেন,—হুঁ। দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে।

—ভালো মানে? বেশ ভালো।

—কিন্তু অত বড় একখানা তলোয়ার ঝুলিয়েছে কেন?

মান সিংহ হাসেন। তারপর বলেন,—আমিও লক্ষ্য করেছি এই তলোয়ার। হয়তো সখ করে রেখেছে। মানুষের কতরকম সখ থাকে।

—তাই বলে, নিজের চেয়ে ভারী অস্ত্র বয়ে বেড়াবার সখ অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে।

—–কত রাজা নিজের মাথার চেয়ে ভারী মুকুট পরে।

—সে রাজা যুদ্ধ করে না।

—এও যুদ্ধ করেনি এ পর্যন্ত।

—হুঁ। ঠিক আছে। এর হাতেই পাঠাও। কালই পাঠাও। দেখা যাক কৌশল কিরকম কাজে লাগে।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরে নেচে ওঠে। মান সিংহের পেছনে পেছনে থেকে আফিম খাওয়া বাদশাহের বিষাক্ত চেহারা দেখবার সুযোগ এ পর্যন্ত না মিললেও, অন্য একটি সুযোগ মিলে গেল। সে ভবঘুরের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি আর। যার জন্যে মনে মনে নিজেকে অপরাধী বলে ভাবছিল সে। ভবঘুরে হয়তো রোজই সেই বটগাছে নীচে আসে। অপেক্ষা ক’রে ক’রে শেষে বিফল মনোরথ হয়ে দুর্গে ফিরে যায়। ভবঘুরের মনে সন্দেহ জাগাও বিচিত্র নয় যে মুঘলদের ঐশ্বর্য আর বিলাসে মুগ্ধ হয়ে গা-ছেড়ে দিয়েছে সে। এই বারে সব সন্দেহের অবসান হবে।

ভবঘুরেকে বুঝিয়ে বলবার সুযোগ পাবে সে, যে সেই প্রথম দিনের তিন-তিনটে হত্যাকাণ্ডের দরুন মুঘলরা কতখানি সজাগ হয়ে গেছে। তফিলউদ্দিন ওরফে রাম সিং এর দল একটি মুহূর্তের জন্যেও নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে নেই। কারণ বাদশাহ্ সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনা আবার ঘটলে তফিলের শির থাকবে না।

নিজের চিন্তায় যখন মশগুল জিৎ সিং সেই সময়ে মান সিংহ বলেন,—তুমি আর একটু বাইরে যাও। আমি একটা চিঠি তোমায় দেব। সেই চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে রণথম্ভোর দর্গে। তার উত্তরও নিয়ে আসতে হবে সেখান থেকে।

—আজকে যেতে হবে হুজুর?

—না। কাল সকালে।

জিৎ সিং শিবিরের বাইরে এসে আগের জায়গায় দাঁড়ায়।

ভগবান দাসকে সে বলতে শোনে,–তোমার কৌশল বাদশাহের পছন্দ হয়েছে তো?

—শুধু পছন্দ? বহুদিন পরে আজ আবার তাঁর মুখে হাসি দেখলাম। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো, আফিমের ডিবেটা বিরক্তির সঙ্গে তিনি সরিয়ে রেখে দিলেন। আমার কাছে উঠে এসে আমার দিকে হাত রেখে বললেন,–এই জন্যে রাজা মানসিংহ আমার পক্ষে অপরিহার্য। রাস্তাঘাটে কত লোক কত কথা বলে। আমি শুনি আর হাসি, তারা মান সিংহ-কে চেনে না।

ভগবান দাসের গম্ভীর স্বর শোনা যায়—হুঁ।

জিৎ সিং অতিকষ্টে হাসি চাপে। ভগবান দাসের মনের দুঃখ সে বুঝতে পারে

মান সিংহ বলেন,—আর একটা কথা তো এখনো বলিনি। সব চেয়ে শেষে বলব বলে রেখে দিয়েছি।

—আরও কথা আছে নাকি?

—হ্যাঁ। এবং সেইটাই সেরা কথা। শুনে আপনি চমকে উঠবেন। আমি বাজি ধরতে পারি। জিৎ সিং মানসচক্ষে দেখতে পায়, মান সিংহ মুচকি মুচকি হাসছেন আর ভগবান দাস তীব্র কৌতূহল-ভরা দৃষ্টি নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

—কতক্ষণ আর ঝুলিয়ে রাখবে? বলে ফেল। সেরা কথাটা বলে কৃতার্থ কর আমায়।

—বাদশাহ্ নিজে আমার সঙ্গে যাবেন।

—কী বললে?

—ভুল শোনেননি। ঠিক শুনেছেন।

জিৎ সিং-এর পা দুটো কাঁপতে শুরু করে। ভগবান দাসের চেয়ে সে কম চমকায়নি। কারণ এমন অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা সে শোনেনি আগে। দেখা তো দূরের ব্যাপার।

—কিন্তু কি ক’রে তা সম্ভব মান?

—আকবর শাহের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তিনি ছদ্মবেশে যাবেন। আমার পেছনে পেছনে আমারই দণ্ডধারী হয়ে।

আশ্চর্য সাহস!

—নতুন দেখলেন?

—না। তবে এমন দুঃসাহসের কথা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

—আপনি বাদশাহের সঙ্গে বহুদিন ধরে থাকলেও তাঁর সঙ্গে শিকারে যাননি কখনো। তাই একথা বলতে পারলেন। বীরবলকে প্রশ্ন করলে জানতে পারবেন, কতখানি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে একা তিনি বন্য পশুর পেছনে ছোটেন। নিজের প্রাণের ওপর বিন্দুমাত্র মায়া নেই তাঁর। কিংবা দৃঢ়বিশ্বাস রয়েছে তাঁর, কোনো অবস্থাতেই মৃত্যু এসে তাঁকে পৃথিবী থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

—আমার কিন্তু বিশেষ ভালো বোধ হচ্ছে না। যদি ধরা পড়েন?

—পড়বেন না।

—বিশ্বাস কি? তাঁর ওই অতি পরিচিত চেহারা হিন্দুস্থানের অনেকেরই জানা। দুর্গের ভেতরে তেমনলোক কি আর থাকতে পারে না?

—থাকলেও ক্ষতি নেই। কারণ তিনি বাদশাহের বেশে যাচ্ছেন না। তাঁর ছদ্মবেশ নিখুঁত।

কিছুক্ষণ উভয়ে নীরবে। জিৎ সিং বুঝতে পারে। পত্র লিখতে ব্যস্ত ওঁরা।

শেষে তার ডাক আসে।

ভেতরে প্রবেশ ক’রে মান সিংহের হাত থেকে পত্রটি নেয় সে। নেবার সময় তার বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে দেহ তার গরম হয়ে ওঠে। বুঝতে পারে রক্ত সঞ্চারণ খুবই দ্রুত হচ্ছে।

মান সিংহ ভালোভাবে নির্দেশ দেন। সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর বাইরে চলে আসে। আগামী কাল সকালে যাত্রা করার আগে পর্যন্ত পত্রটিকে সযত্নে রাখবার দায়িত্ব তার।

.

সারাটা দিন ছটফট করে জিৎ সিং। সন্ধ্যা আর হতে চায় না। সন্ধ্যা হবে—তারপর রাত আসবে। সে বেশ বুঝতে পারে দীর্ঘ রজনী নিদ্রাহীন অবস্থাতেই কাটবে। তারপর সকাল। জীবনের অনেক প্রভাতের মধ্যে আগামী যে প্রভাতটি আসবে তার একটি বিশেষ মূল্য রয়েছে।

আর একটি প্রভাতের কথা মনে পড়ে তার। চিতোর থেকে বিদায় নেবার পরের প্রাত। সেই বনের সীমান্তে এক প্রান্তরে কালপীর দলের সঙ্গে সে গিয়ে পৌঁছেছিল। রিক্ত, নিঃস্ব, পিতৃহীন অবস্থায়। সেই প্রভাতেও সূর্য উঠেছিল। সে সূর্যের কিরণও ছিল প্রতিদিনের মতো সুবর্ণময়। কিন্তু কারও চোখে পড়েনি সেদিন। চোখের সামনে শুধু ভাসছিল অনাগত ভবিষ্যতের অন্ধকার রূপ।

কিন্তু সেই রকম দিনেও জিৎ সিং-এর একটি লাভ হয়েছিল। লীলাবতীর সঙ্গে বনের মধ্যে সাক্ষাৎ এবং তার ক্লান্ত শরীর বয়ে নিয়ে আসবার সময় এক অদ্ভুত প্রেরণা পেয়েছিল সে। কে যেন বার বার তার মনের মধ্যে বলছিল, ভবিষ্যৎ কেন অন্ধকার হবে জিৎ সিং? এগিয়ে যাও। অন্ধকার পথটুকু পার হও। আবার আলো দেখতে পাবে। যারা অদূরদর্শী, তারাই সামনে সামান্য রাস্তাটুকু আঁধার দেখে হতাশ হয়ে পড়ে।

সেই প্রেরণার কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ। আজ লীলাবতী বেঁচে থেকেও তার জীবন থেকে মুছে যেতে বসেছে। আজও তার ভবিষ্যৎ, চিতোর ছেড়ে আসার দিনের মতোই অনিশ্চিত। যেটুকু আলো সে দেখেছিল, তা আলেয়ার আলো। দপ করে জ্বলে ওঠে আবার নিভে গেছে, অন্ধকারকে গাঢ়তর ক’রে দিয়ে।

অথচ আজও সে আগামীকালের প্রভাতের কথা চিন্তা ক’রে আনন্দ অনুভব করছে। আজ সে কিছুতেই ভাবতে পারছে না তার জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। জীবন বোধহয় কখনো মূল্যহীন হয় না, হতে পারে। এই ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতনের ফলে এমন এক রসের সঞ্চার হয়, যে রস পান ক’রে বেঁচে থাকে জীবন। শান্ত আর সরল-সহজ পথে চলে যে জীবন, সে জীবন রস পায় না। তাই বেঁচে থাকলেও নির্জীব হয়ে বাঁচে।

তৃপ্তিভরে মান সিংহের লেখা পত্রখানি আর একবার অনুভব করে সে। এই পত্র পৌঁছে দিয়ে ভবঘুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। বলবে, মান সিংহের দুর্গ পরিদর্শন নিছক কৌতূহল নয়। তার পেছনে গূঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে। অবশ্য সেই উদ্দেশের কথা বুঝতে ওদেরও অসুবিধা হবে না। তবু ওরা রাজপুত। মান সিংহ তাঁর কণ্ঠের মধ্যে যে শ্লেষ ঢেলে নিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন রাজপুত, ওরা সেই রাজপুত। তাই আমন্ত্রণ জানাবে। কিন্তু বাদশাহের মতলবের কথা যখন শুনবে ওরা তখনো কি আমন্ত্রণ জানাবে? তখন আমন্ত্রণ জানানোর একটিই অর্থ হতে পারে।

জিৎ সিং আপন মনে মুঘল-ছাউনির আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। চারদিকের দৃশ্য দেখে মনে হয়, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। শান্তি স্থাপিত হয়েছে। কারণ সকাল থেকে একবারও বারুদের গন্ধ পাওয়া যায়নি। একবারও কোনো কামান ধুম উদ্গীরণ করেনি। গতকালের পর থেকে তাদের যেন মৃত্যু হয়েছে। যেগুলি পড়ে রয়েছে, সেগুলি তাদের শব

একটি কামানের সামনে দাঁড়ায় জিৎ। তার ওপর হাত রাখে। শীতল, যেন মৃত্যুর মতো সেটিকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে চায়। সে ভ্রূক্ষেপ করে না। সে শুধু ভাবে—ভবঘুরে ঠিক সময়ে রণথম্ভোরে না এলে যুদ্ধক্ষেত্রের সাজানো কামানগুলির এই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখবার এই ভাগ্য হত না তার। এগুলি এযাত্রা আর উত্তপ্ত হবার অবকাশ পাবে বলে মনে হয় না। কোনোদিনই কি আর উত্তপ্ত হয়ে ওঠবার অবকাশ পাবে বাদশাহ আকবর শাহের পরিচালনাধীনে? মান সিংহের দণ্ডধারী হয়ে যে মানুষটি রণথম্ভোরের ভেতরে প্রবেশ করবেন, তিনি আর কি কখনো বাইরে বেরিয়ে আসবেন?

এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারে না। সে শুধু পত্র-বাহক। উত্তর বোধহয় দিতে পারে ভবঘুরে। কিন্তু ভবঘুরেও হয়তো দেবে না। সে শুধু জানিয়ে দেবে রাওকে। সবকিছু নির্ভর করবে রাও-এর সেই সময়কার মনোভাবের ওপর।

কামান ছেড়ে জিৎ সিং আরও এগিয়ে যায়।

সেই সময়ে দেখতে পায় দূরে অর্জুন হাজমকে। অর্জুন হাজম তার দিকেই দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে আসছে।

জিৎ সিং অবাক না হয়ে পারে না।

কাছে এসে অর্জুন বলে,–তোমার কথাই ভাবছিলাম। দেখা হয়ে ভালো হল। নইলে খবরটি দেওয়া হত না।

জিৎ সিং অর্জুনকে যথারীতি সম্মান দেখিয়ে বলে,—আমার সৌভাগ্য যে আপনি আমার জন্যে কষ্ট করলেন এত।

—ওসব কিছু না। মানুষের উপকার সব সময় মানুষই করে। বনের হিংস্র পশু এসে তোমার উপকার ক’রে দিয়ে যাবে না।

—সত্যি কথা বলেছেন, খুবই খাঁটি কথা। অথচ জগতে কয়জন এই সরল সত্যি কথাটা বুঝতে পারে বলুন। মহৎ ব্যক্তি ছাড়া এ-জিনিস বোঝবার ক্ষমতা কারই বা আছে?

অর্জুন হাজম জিৎ সিং-এর প্রশংসাবাক্য হজম ক’রে নিতে একটু সময় নেয়। তারপর বলে, —কমলাবতীর খোঁজ পেয়েছি।

ভয়ে ভয়ে জিৎ সিং তাকে প্রশ্ন করে,—আপনি শেষে সালিমা বেগমকেই জিজ্ঞাসা করলেন?

—না, সে ভয় নেই। বৈদ্য শালিবাহনেরই শরণাপন্ন হলাম। আশ্চর্য মানুষ এই শালিবাহন। কারও কোনো খবর রাখে না, অথচ কমলাবতীর নাম করতেই শিরদাঁড়া সোজা ক’রে বসল।

—কেন, শিরদাঁড়া সোজা করলেন কেন তিনি?

—বুঝলে না? কমলাবতী সম্বন্ধে তার নিজেরও আগ্রহ রয়েছে।

—অদ্ভুত তো?

—মোটেই অদ্ভুত নয়। লোকটি মনে মনে রানী দুর্গাবতীকে দেবীর মতো পুজো করে। সেই দুর্গাবতীরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া হয়ে এত নিশ্চিন্তে কী ক’রে বসে রয়েছে কমলাবতী, ভেবে সে অবাক হয়। কয়েকবার নাকি কমলাবতীর চিকিৎসার জন্যে ডাক পড়েছিল শালিবাহনের। প্রতিবারই সে কৌশলে জানতে চেয়েছে, হারেমের জীবন তার ভালো লাগে কি না। প্রত্যাশা করেছিল, উত্তরে কমলাবতী বলবে—অসহ্য লাগে। প্রত্যাশা অনুযায়ী জবাব পেলে বেচারা বৈদ্য শান্তি পেত। কারণ দুর্গাবতীর জীবন আর কমলাবতীর উক্তির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য দেখতে পেত। কিন্তু হতাশ হয়েছে বৈদ্য শালিবাহন।

—কেন, হতাশ হলেন কেন তিনি?

কমলাবতীর উক্তি তার চরম মর্মবেদনার কারণ হয়েছে। কমলাবতী যে কথা বলেছে, সেকথা শুনে অবধি স্বাভাবিকভাবে চলতে ফিরতেও নাকি অসুবিধে হয় বেচারার

—কী এমন কথা বলেছে কমলাবতী?

—বলেছে, মুঘল বাদশাহের হারেম ছাড়া পৃথিবীতে সে অন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয়ের কথা কল্পনা করতে পারে না। সে সুখে আছে। এত সুখ এত ঐশ্বর্য সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি কখনো।

জিৎ সিং-এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

—ওকি! তোমার মুখও শালিবাহনের মতো হয়ে গেল কেন? তুমিও কি কথাটা শুনে আঘাত পেলে?

জিৎ সিং হেসে ওঠে। বলে,—না, আমি আঘাত পেতে যাব কেন? কমলাবতী আমার কে? তাছাড়া সে যদি আমার বোনও হত, একথা শুনে আমি আনন্দে নৃত্য করতাম। কারণ, মুঘল দরবারে আমার আসন পাকা হত।

—দারুণ ছেলে দেখছি তুমি! বৈদ্যকে তোমার কথা বলব। সে হয়তো সান্ত্বনা খুঁজে পাবে।

—তিনি এখনো মনমরা হয়ে আছেন নাকি?

—হ্যাঁ। সদ্য পেয়েছেন কিনা আঘাতটা।

—সদ্য?

—হ্যাঁ মাত্র তিনদিন আগে।

—কমলাবতী তবে এখানে এসেছেন, বাদশাহের সঙ্গে?

—হ্যাঁ দেখো। কী ভুলো মন। আসল খবরটা আগে দেব তোমায়, তা না যত সব আজেবাজে কথা বলছিলাম।

—ভালোই করেছেন, আজেবাজে কথা একটুও বলেননি। খুব মূল্যবান কথা বলেছেন

অর্জুন হাজম চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে জিৎ সিং। কমলাবতীর উক্তি তাকেও কম আঘাত করেনি। ভবঘুরে মুখে যাই বলুক, মনে মনে হয়তো সে জানে কমলাবতী এখনো তাকে আগের মতো ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই যমুনার তীরে এসে চোখের দেখা দেখে যায়, দু’ফোঁটা অশ্রু ফেলে যায়। কিন্তু সেই অশ্রুপাতও যে এক রকমের বিলাস, এ খবর ভবঘুরের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সে কোনোদিন জানতেও পারবে না। কারণ জিৎ সিং তাকে কখনো স্পষ্ট করে বলবে না। কমলাবতীকে হারিয়েও যে সান্ত্বনাটুকু খুঁজে পেয়ে সযত্নে আঁকড়ে রেখেছে ভবঘুরে, সেই সান্ত্বনা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না সে

কমলাবতী! নামটি মিষ্টি, অথচ মনটি তার মিষ্টি নয়। তরল মন কখনো মিষ্টি হয় না। তরল মন না হলে ঐশ্বর্য এত বড় হয়ে উঠত না তার কাছে। ঐশ্বর্য আর বিলাসের মধ্যে জীবনটাকে উপভোগ করতে চায় ওই নারী। তবু ভবঘুরেকে দেখতে চায় কমলাবতী। কারণ একঘেয়ে ভোগবিলাসের মধ্যে এই জিনিসটি প্রতিদিন একটা নতুন স্বাদ আনে তার জীবনে। যে চোখের জল যমুনার ধার ফেলে, সেই চোখের জল ভোগবিলাসের সুখকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

.

পরদিন সকালে বিদায় নেবার আগে মান সিংহের সঙ্গে দেখা করে সে। শেষবারের মতো মান সিংহ তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন সব। তারপর বলেন,–তোমার ওই তলোয়ারখানা খুলে রেখে যাবে না?

সঙ্কোচের সঙ্গে জিৎ সিং বলে,—আজ্ঞে, এটিকে আমি সব সময় কাছে রাখি। বাবার আদেশ।

—ওঃ, বেশ যাও।

—তফিলউদ্দিনের দল দুর্গের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় শুনেছি। ভুল করে আমার বিপদ ঘটাবে না তো?

—না। তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বাদশাহ্ নিজে। সে আশঙ্কা তোমার নেই।

জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়। সে মান সিংহের শিবির ছাড়ে। তারপর একা দৃঢ়পদে এগিয়ে যায় রণথম্ভোর দুর্গের দিকে।

এই দ্বিতীয়বার সে এগিয়ে চলেছে ওদিকে। একবার শুধু পেছনে ফিরে দেখে সে, সমস্ত মুঘলবাহিনী কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে তারদিকে। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব স্থানে দাঁড়িয়ে। তারা প্রস্তুত। বাদশাহ্ আদেশ করলে এখন তারা কামানের পেছনে আগুন লাগিয়ে দেবে। কিন্তু বাদশাহ গতকাল সে আদেশ দেননি। আদেশ আজও দেবেন না। ওরা শুধু দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পা ব্যথা করবে।

কিছুদূর এগিয়ে লক্ষ্য করে জিৎ সিং প্রান্তরের শ্যামল শোভা অনেকটা অন্তর্হিত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে গোলাগুলি চালানোর জন্যে। অনেক গাছ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে। অনেক আগাছা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বড় বড় গাছের পাতা ঝলসে ঝরে পড়ছে।

জিৎ সিং আরও এগিয়ে যায়। সেই সময়ে একটু দূরে দেখতে পায় তফিলউদ্দিনকে। একটু অস্বস্তি অনুভব করে জিৎ সিং। কিন্তু তফিলউদ্দিন তার দিকে আসে না। বাদশাহের হুকুম নেই সম্ভবত। কারণ তাহলে শত্রুপক্ষ সন্দেহ করবে। তফিলউদ্দিন দাঁড়িয়ে থাকে একটি একটি গাছের আড়ালে। সেখান থেকে সে জিৎ সিং-এর দিকে ফিরে চায়। কিন্তু ওই দূরত্ব থেকে জিৎ সিং-কে চিনতে পারবে না। জিৎ সিং কিন্তু তফিলউদ্দিনকে চিনতে পারে। কারণ সে জানে রাম সিং রয়েছে এখানে। না জানলে সেও চিনতে পারত না। রাম সিং-এর থুতনিতে দাড়ি গজিয়েছে। তার দেহের পোশাক মুসলমানের।

গাছের আড়াল থেকে একটু জোরে মন্তব্য করে তফিল,–শেষে একজন রাজপুতকেই পত্রখানা দিলেন বাদশাহ?

জিৎ সিং বিকৃতস্বরে বলে ওঠে,—রাজপুত মুঘল বলে কথা নয়। মগজ বড় দেখে দিয়েছেন। -চোপ্রহ্।

—ভয় দেখাচ্ছ? এসো, মারো। দেখি একবার কতখানি হিম্মৎ।

তফিলউদ্দিন চুপ ক’রে থাকে। কিন্তু সে গাছের আড়ালে আড়ালে জিৎ-কে অনুসরণ করে।

—আরে আরে, তোমার তরোয়ালখানা—এদিকে দেখি। দেখি মুখ ফেরাও তো?

—চুপ কর। আমার মুখ দেখে কি হবে তোমার?

—অতবড় তলোয়ার ঝুলিয়েছ কিনা, তাই। অমন একজন পরিচিত লোক ছিল।

—অস্বাভাবিক নয়। আগ্রায় অনেক রকমের লোকই রয়েছে।

—আগ্রায় নয়।

—তবে আমি নই। আমি চিরকাল আগ্রায় থাকি। আর এসো না তুমি, আমি সাবধান ক’রে দিচ্ছি। সামনে চেয়ে দেখো, দুর্গের ওপর থেকে কতগুলো লোক আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটু অসাবধান হলেই ওখানে ধোঁয়া দেখবে।

তফিলউদ্দিন থেমে যায়।

জিৎ সিং আরও কিছুদূর এগিয়ে দুর্গের প্রধান দ্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

দ্বার খুলে যায়।

ভেতরে প্রবেশ ক’রে জিৎ সিং মানুষগুলোর চেহারার দিকে চেয়ে বিস্মিত হয়। সে দেখতে পায় সবাই নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। অথচ সবাই যেন বড় বেশি শীর্ণ। তাকে ঘিরে যে কয়জন এসে দাঁড়ালো, তাদের চেহারাও রুক্ষ। তাদের চলার গতিতে দুর্বলতা।

আসল সত্য কল্পনা ক’রে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না জিৎ সিং-এর। দুর্গের খাদ্য-ভাণ্ডার নিঃশেষিত না হয়ে যায়, তারই জন্য বোধহয় এরা নিয়ন্ত্রিত খাদ্য খেয়ে লড়ে চলেছে। কিংবা হয়তো খাদ্য-ভাণ্ডার নিঃশেষিত হয়ে আসছে। আর কিছুদিন অবরোধ ক’রে থাকলে আপনা হতেই সম্ভবত এরা আত্মসমর্পণ করত। কিংবা এদের লোকেরা বিদ্রোহ করত।

জিৎ সিং-এর হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মান সিংহকে যদি এখানে আসতে অনুমতি দেন রাজা রাও, তাহলে এক নজরে সবকিছু বুঝে নিতে পারবেন তিনি এবং বাদশাহ্। তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না তাঁদের।

ধীরে ধীরে সোপানের পর সোপান অতিক্রম করে সে পৌঁছোয় এসে দরবার কক্ষের মতো একটি মস্ত বড় ঘরে। সেখানে বিশিষ্ট আসনে বসেছিলেন যিনি, তাঁকে জীবনে না দেখেও বুঝতে অসুবিধা হয় না জিৎ সিং-এর যে তিনিই সুরজন রাও।

সে অভিবাদন জানিয়ে পত্রটি তাঁর হাতে দেয়।

সুরজন পত্রটি না খুলে একদৃষ্টে জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীরস্বরে বলেন,—তুমি রাজপুত তো?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—পত্রবাহক?

—এক্ষেত্রে আমি পত্রবাহক।

—তার মানে, অন্য কাজও তুমি কর?

—আজ্ঞে, যখন যা আদেশ হয়।

—কে দিয়েছেন এই পত্র? বাদশাহ্?

—আজ্ঞে না। রাজা মান সিংহ।

—মান সিংহ!

সুরজন রাও-এর আশপাশে যে কয়জন বিশিষ্ট রাজপুত উপবিষ্ট ছিলেন, তাঁরাও বিস্ময় প্রকাশ করলেন মান সিংহের নাম শুনে। মান সিংহ পত্র দেবেন, একথা তাঁরা ভাবতে পারেননি।

সুরজন রাও বলেন,– আচ্ছা, তুমি অপেক্ষা কর। রাজপুত দেখলে আমাদের আনন্দ হয়। কিন্তু তুমি যে-পক্ষ থেকে এখানে এসেছ, তোমাকে দেখে আনন্দিত হতে পারছি না বলে কিছু মনে করো না।

তিনি জিৎ সিং-এর পাশের একজনকে ইঙ্গিত করেন তাকে নিয়ে যাবার জন্যে।

জিৎ সিং বলে,—আমার একটি নিবেদন আছে।

—তোমার নিবেদন? পত্রবাহকের নিবেদন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার এখানে আমার একজন পরিচিত লোক গেছেন। তাঁর দেখা পেলে বড় ভালো হত।

—তোমার পরিচিত লোক? আমার এখানে? কোথাকার লোক তুমি? বাড়ি কোথায়?

—আজ্ঞে মেবারে।

—ও মেবার। খুবই স্বাভাবিক। যে দেশের রানা দুর্গ ছেড়ে পাহাড়ে পালায়, সে-দেশের প্রজা মুঘলদের পদলেহী হবে, এ আর বেশি কথা কি? কিন্তু তুমি পত্রবাহক। তোমায় আমি অসম্মান করতে পারি না। মুখ দিয়ে যেকথা হঠাৎ বের হয়ে গেল, তার জন্যে মনে কিছু করো না।

জিৎ সিং দৃঢ়স্বরে বলে,—আমি কিছু মনে করিনি রাজা।

—মেবারের লোক কেউ এখানে নেই। তুমি ভুল করেছ।

—আমি যার কথা বলছি তাঁর বাড়ি মেবার নয়। অন্য কোথাও তাঁর বাড়ি।

—কোথায়?

—ঠিক জানি না। তবে যতদূর মনে হয় এককালে তিনি ছিলেন রানী দুর্গাবতীর গণ্ডোয়ানায়

—গণ্ডোয়ানা?

সুরজন সিং সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জিৎ সিং-এর চোখের দিকে চেয়ে বলেন,—তুমি পত্রবাহক। গুপ্তচর নও, একথা বিশ্বাস করে নিতে পারি তো?

গুপ্তচর কথাটা জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরে কোথায় যেন সজোরে আঘাত হানে। সে বোবা হয়ে থাকে কিছুক্ষণের জন্যে। কানের ভেতরে শুধু একটি কথাই ঝংকৃত হয় বার বার—গুপ্তচর–গুপ্তচর। সুরজনের চোখ লাল হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তিনি বলেন,—তুমি তবে গুপ্তচর?

—আমাকে ভুল বুঝবেন না। এখানকার কোনো গুপ্ত সংবাদ নেবার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই।

—তুমি গুপ্তচর কি না সেকথার উত্তর দাও।

—আমি মুঘলদের গুপ্তচর নই।

—এখানকার সংবাদ জেনে নেবার উদ্দেশ্য তোমার নেই?

—আজ্ঞে না। এখানকার সংবাদ জানতে হলে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না রাজা রাও। এখানকার সংবাদ লেখা রয়েছে দুর্গের প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে দেহে। বাইরে থেকে দুর্গের ভেতরে পালকের জন্যে মাথা বাড়িয়ে দিতে পারলেই বোঝা যায় এখানকার অবস্থা।

গর্জে ওঠেন রাজা,—কী বলতে চাও তুমি!

—আপনাদের খাদ্যাভাব ঘটেছে। আপনার লোকেরা খেতে পাচ্ছে না ঠিকমতো। বাদশাহ্ আকবর আর পনেরো দিন অবরোধ চালালেই আপনি আত্মসমর্পণ করবেন।

সুরজন ব্যতীত অন্য সবাই আসন ছেড়ে চিৎকার ক’রে ওঠে,–পত্রবাহক।

জিৎ সিং ধীর কণ্ঠে বলে,—কিন্তু এ খবর আমি বাদশাহকে দেব না। এ খবর আমি কাউকে দেব না। যে পত্র আপনাকে দিয়েছি তার জবাব পেলে সেটি নিয়ে শুধু রাজা মান সিংহের হাতে পৌঁছে দেব। আমি পত্রবাহক মাত্র।

সুরজন রাও নীরব। সবাই নীরব। তারা পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে। প্রতিদিন তারা নিজেদের দেখে বুঝতে যা পারেনি, একজন বাইরের লোক এসে সহজেই তা ধরে ফেলেছে। তারা শীর্ণ হয়েছে, তারা দুর্বল।

জিৎ সিং সসম্মানে বলে,—রাজা, অনুগ্রহ করে সেই লোকটির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিন।

—আমি বুঝছি না, তুমি কার কথা বলছ। নাম বলতে পার?

—নাম জানি না। সে নিজেকে বলে ভবঘুরে। সাধুদের মতো গেরুয়া পরে।

একজন বলে ওঠে,—সাধুজী। সাধুজীর কথা বলছে পত্রবাহক।

জিৎ সিং বলে,—সম্ভবত তিনিই হবেন। মাস তিনেক আগে এখানে এসেছিলেন।

রাও বলেন,—হ্যাঁ সাধুজীই হবেন। কিন্তু তুমি কি ক’রে জানলে তিনি এখানে এসেছেন?

—–আসবার সময় বলে এসেছিলেন আমাকে।

জিৎ সিং জানে, একথায় সুরজন রাও কোনো সন্দেহ করবেন না। কারণ রণথম্ভোরে একজন সাধু কিংবা ভবঘুরে আসবে, এ এমন বেশি কথা নয়। তিনি আগ্রার কাউকে বলে এলেও সেকথা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাধুদের গতি সর্বত্র।

সাধুজীকে ডেকে আনবার জন্যে লোক পাঠান রাজা রাও।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। একটু পরেই ভবঘুরে সভার মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। সে জিৎ সিং-এর দিকে একবার চেয়েই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

সুরজন রাও বলেন,–এই পত্রবাহককে আপনি চেনেন সাধুজী?

—একটু আগে একে আসতে দেখেছিলাম বটে দুর্গের দিকে।

রাগে গরম হয়ে ওঠে জিৎ-এর সর্বাঙ্গ। দেখেও এগিয়ে তবে আসেনি ভবঘুরে। তাকে তাচ্ছিল্য করে। তাকে সন্দেহ করে।

সুরজন রাও বলেন,—এ বলছে আপনি নাকি আগ্রা ছেড়ে আসবার সময়ে একে বলে এসেছিলেন যে রণথম্ভোরে আসছেন।

—হতে পারে। কত লোককে কত কথা বলি। সব কি মনে থাকে? পথে পথে ঘুরি।

জিৎ সিং-এর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। ভুলে যায় সে রাজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভুলে যায় যে তার ভূমিকা সামান্য পত্রবাহকের। কঠোর কণ্ঠে বলে,—ওসব ভণিতা থাক ভবঘুরে। অনেক দরকারী কথা রয়েছে। যদি শোনবার আগ্রহ থাকে বলতে পারি।

সবাই বিস্মিত হয় জিৎ সিং-এর ব্যবহারে। সুরজন বিরক্ত হয়ে একজনকে আদেশ করেন, জোর ক’রে জিৎ সিং-কে সভার বাইরে টেনে নিয়ে যেতে। সে এসে জিৎ সিং-এর গায়ে হাত দিতে উদ্যত হলে ভবঘুরে খপ করে চেপে ধরে তার হাত। ক্রেধ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠে, এর গায়ে হাত দেবার আগে কাশীর গঙ্গায় গিয়ে একশো আটটি ডুব দিয়ে এসো অপদার্থ।

সুরজন অবধি ভবঘুরের কথায় চমকিত হন। তিনি বলেন,–এর মানে কি সাধুজী?

—পরে বলব। আপনি একে আমার সঙ্গে যেতে অনুমতি দিন।

—একটু আগে তবে কেন বললেন, চেনেন না?

ভবঘুরে হো হো শব্দে হেসে ওঠেন,—অভিমান। সাধু সেজেছি, ভবঘুরে সেজেছি, কিন্তু অভিমান যায়নি।

জিৎ সিং একটু হেসে বলে,—পশ্চিমের বটগাছের নীচে আসা কিছুতেই সম্ভব হয়নি।

—ওকথা থাক। তুমি এসেছ, এই যথেষ্ট

জিৎ সিং চেয়ে দেখে রাজা রাও তখনো হাতের মধ্যে মান সিংহের পত্রখানি ধরে রেখেছেন। খুলে দেখবারও সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাঁর।

বাইরের এক নির্জন স্থানে জিৎ সিং-কে বসতে বলে, নিজে তার পাশে বসে ভবঘুরে বলে,—এবারে বল।

জিৎ সিং মান সিংহের চিঠির কথা বলে।

—কি লেখা হয়েছে ওতে?

—তিনি দুর্গ পরিদর্শন করতে চান।

—মান সিং বড় টোপ ফেলেছে দেখছি। নিজের মর্যাদা রাখতে সুরজন এ-টোপ গিলবে।

—আমি জানি না দুর্গ রক্ষা করতে রাজা কতদূর অগ্রসর হতে পারেন। যদি তিনি বিবেকের বাধা কাটিয়ে উঠতে দ্বিধাবোধ না করেন, তবে এ-টোপ গিললে মস্ত সুযোগ মিলে যাবে তাঁর। এমন এক সুযোগ মিলবে, যার সদ্ব্যবহার করলে শুধু রণথম্ভোরই অজেয় থাকবে না, আরও সুদূর প্রসারী ফল ফলবে সারা হিন্দুস্থানে

—কি রকম?

—মেবারের রানা চিতোর ফিরে পাবেন। আর—

—আর?

—আর আপত্তি না হলে আপনি ফিরে পাবেন কমলাবতীকে।

—তুমি বলছ কি জিৎ সিং! বারুদের ধোঁয়া কি তোমার মস্তিষ্কে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে?

—না। বারুদের ধোঁয়ায় আমার মাথা আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার হয়েছে। তাই বলছি একথা।

ভবঘুরে জিৎ সিং-এর হাত চেপে ধরে বলে,—হেঁয়ালী ছেড়ে স্পষ্ট ভাষায় কথা বল।

—রাজা মান সিংহকে যদি দুর্গে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে তাঁর পেছনে আসবে একজন দণ্ডধারী। রাজা একা এলেও, একজন দণ্ডধারীর আসার পক্ষে কোনো বাধা নেই, সেটুকু প্রতি রাজারই প্রাপ্য।

—সে তো জানা কথা। কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? মান সিংহ এসেই তো বুঝতে পারবেন খাদ্য ফুরিয়ে যাওয়ায় দুর্গের লোকেরা আধপেটা খেতে শুরু করেছে।

—তাতে কিছু এসে যাবে না, যদি রাজপুত-সুলভ বিবেককে কিছু সময়ের জন্যে নির্বাসিত করতে পারেন সুরজন রাও।

—তুমি এখনো সোজা ভাষায় কথা বলছ না জিৎ সিং।

—এবারে বলছি। যে দণ্ডধারীটি রাজা মানের সঙ্গে আসবে তার দিকে আপনি একটু ভালোভাবে চেয়ে দেখবেন। অবহেলা করে চোখ বন্ধ করে রাখবেন না। রাজার পাশের দণ্ডধারীর দিকে কারও নজর পড়ে না। পড়বার কথাও নয়। কিন্তু এই দণ্ডধারীকে লক্ষ্য না করলে আপনি ঠকবেন। কারণ এই একই ব্যক্তিকে আপনি আর একবার দেখেছিলেন সঙ্গীত সম্রাট তানসেনের গৃহে মুশকিল আসানের ভূমিকায়

ভবঘুরে উত্তেজিত হয়। উত্তেজিত হয়ে কোনো কথা না বলে শুধু জিৎ সিং-এর ডান হাতখানা ধরে সজোরে চাপতে থাকে।

জিৎ সিং হেসে বলে,—এবারে আপনি স্থির করুন কী করা উচিত। সেই অনুযায়ী রাজাকে পরামর্শ দিন। সাধুজীর কথার মূল্য দেবেন রাজা।

—তোমার কি মত? কি করা উচিত?

—আমি কিছুই বলব না। আমার কোনো মতামত নেই। আমি গুপ্তচর। আমার কাজ খবর পৌঁছে দেওয়া।

বাদশাহকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা চৌহান বংশের কারও পক্ষে সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

—তাহলে মান সিংহকে এখানে আমন্ত্রণের পরামর্শ দেবেন না।

—দেবো। বাদশাহকে চিনে ফেলতে পারলে ইচ্ছে মতো শর্তে সন্ধি করানো যেতে পারে। আবার হাসে জিৎ সিং। বলে,—আপনি মস্ত ভুল করতে বসেছেন। বাদশাহ্ চৌহান বংশের কেউ নন। তিনি রাজপুতও নন। খুঁজলে তাঁর রক্তের মধ্যে এখনো দেখতে পাবেন জগতের দুই দুর্দান্ত পুরুষের দেহের অণু-পরমাণু কিলবিল করছে। পুরুষ দুইজন হলেন—তৈমুর আর চেঙ্গিস খাঁ। ধরা পড়লে সব শর্তে সম্মত হবেন, কিন্তু মুক্তিলাভের পরমুহূর্তে ভিন্নমূর্তি ধারণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবেন না তিনি। তবে যদি বাদশাহের অধীনতা স্বীকার ক’রে নেন রাজা, তবে হয়তো বিশেষ কতকগুলো সুবিধা আদায় ক’রে নিতে পারেন।

ভবঘুরে বলে ওঠে—অধীনতা? এতদিনের প্রতিরোধের পরে অধীনতা?

—আমি সবই খুলে বলেছি আপনাকে। এবারে আপনি গিয়ে পরামর্শ দিন আমি অপেক্ষা করছি। বেশি দেরি যেন না হয়। মান সিং সন্দেহ করতে পারেন।

ভবঘুরে উঠে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই জিৎ সিং আবার ডাকে তাকে।

—একটা কথা আপনাকে বলতে একেবারে ভুলে গেছলাম। কমলাবতী এখন যেখানে রয়েছেন সেখান থেকে আপনার দূরত্ব খুব বেশিদূর নয়।

ভবঘুরে কথা না বলে চেয়ে থাকে জিৎ সিং-এর মুখের পানে। সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারে না জিৎ সিং। বুঝতে চেষ্টাও করে না। কারণ তার কানে এখন বাজছিল কমলাবতীর সেই উক্তিটি, বৈদ্য শালিবাহনকে যে-কথা সে বলেছিল। ভবঘুরে যদি সেই কথা শোনে তবে তার ওই উন্নত বুক অনেক নীচে নেমে যাবে। জীবনে আর কখনো এখনকার মতো অত উঁচু হয়ে উঠতে পারবে না। সে ভবঘুরেকে জানাবে না শালিবাহনের ব্যাপার।

সে শুধু বলে,—কমলাবতীও রণথম্ভোর অভিযানে বাদশাহের সঙ্গে এসেছে। আপনি অনুমতি দিলে উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারি।

চিৎকার ক’রে ওঠে ভবঘুরে,—না না জিৎ সিং। খবরদার ওকাজ করো না। সাধ্য থাকলেও সে চেষ্টা করো না কখনো। মস্ত ভুল হবে। কমলাবতী আমার কাছে ফিরে এসে শান্তি পাবে না। শান্তি পেতে পারে না। তার মন অন্য ধাতুতে গড়া। তার মনের প্রথম চাহিদা ঐশ্বর্য। তারপর পুরুষ প্রেম ইত্যাদি।

—আপনি জানেন একথা?

—জানব না? আমি যে তাকে ছেলেবেলা থেকে চিনি।

—তবে কেন তাকে ভালোবাসলেন?

ভবঘুরে নির্বিকার হাসি হেসে বলে,–বিচার-বিবেচনা করে কি কেউ কোনোদিন ভালোবাসে? কখনো দেখেছ সব দিক রক্ষা ক’রে ভালোবাসার পথে মানুষকে অগ্রসর হতে? তুমি এখনো ছেলেমানুষ, কি-ই বা দেখেছ জগতের।

মনে মনে জিৎ সিং বলে, দেখেছি বৈ কি। সব না দেখলেও কিছু দেখেছি। ভালোবেসেও ভালোবাসার পাত্রকে প্রত্যাখ্যান করতে দেখেছি। মুখে বলে,—কিন্তু সে কেন আপনাকে যমুনার তীরে দেখবার জন্যে পাগল হয়?

—পাগল সে কখনোই হয় না। তবে দেখতে সাধ হয় তার। অমন অদ্ভুতমত সাধ অনেক মানুষেরই অনেক সময় হয়। ওসব কথা আলোচনা করে লাভ নেই জিৎ। কমলাবতীকে তার নিজের জায়গায় নিশ্চিন্তে থাকতে দাও।

ভবঘুরে চলে যায়।

জিৎ সিং আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে একা একা বসে। এই সেই রণথম্ভোর—দুর্জয় রণথম্ভোর। সারা ভারতে চিতোরের পরেই এর স্থান। এই রণথম্ভোর জয়ের জন্য মুঘল বাদশাহের উদ্যমের অন্ত ছিল না। চিন্তারও অবধি ছিল না। সেই চিন্তার পরিসমাপ্তি ঘটবে আজই অথবা কাল। কী ভাবে পরিসমাপ্তি ঘটবে কেউ বলতে পারে না। সুরজন রাও নিজেও বলতে পারবেন না। দণ্ডধারীর বেশে বাদশাহ্ আকবরকে দেখে, সেই মুহূর্তে তার মনের অবস্থা কেমন হবে তা তিনি নিজেও জানেন না। যদি সমস্ত আদর্শ, ঐতিহ্য আর ধার্মিকতা সেই মুহূর্তটুকুর জন্যে জলাঞ্জলি দিতে পারেন তিনি তবে আকবর শাহ্ জীবিত অথবা মৃত কোনো অবস্থাতেই কোনোদিন রণথম্ভোরের বাইরে যেতে পারবেন না। বাবরের বংশের অবলুপ্তি ঘটবে এইখানেই।

জিৎ সিং জানে, একটি পুত্রলাভের জন্যে কত চেষ্টাই না করেছেন আকবর শাহ্। সম্প্রতি তাঁর আকুলতার সীমা ছিল না। আগ্রা থেকে দশ পনেরো ক্রোশ দূরে কোনো স্থানের এক ফকির সাহেব তাঁকে নাকি আশ্বাস দিয়েছেন ভয়ের কোনো কারণ নেই। অপুত্রক তিনি থাকবেন না। ফকির সাহেবের নাম সেলিম চিস্তি। আকবর শাহ ফকিরের পায়ের কাছে বসে সজল চোখে বলেছেন,—যদি সত্যি হয় আপনার কথা, তবে পুত্রের নাম আমি সেলিমই রাখব। আপনার নামের স্মৃতি থাকবে তার নামের মধ্যে। ফকির সাহেব বাদশাহের কথা শুনে হেসেছিলেন। বলেছিলেন,–তোমারি রাজপুত বেগমদের একজন তোমার প্রথম পুত্রের জননী হবে। তাদের মধ্যে কাউকে নিশ্চয়ই তুমি ভালোবাস। বাদশাহ ফকির সাহেবের কথা শুনে কানে আঙুল দিয়ে বলে উঠেছিলেন,—না না, একি কথা বলছেন। সালিমা বেগম থাকতে—। তাঁর কথা শেষ হবার আগেই পেছন থেকে সালিমা বেগম বলে উঠেছিল-লজ্জা কি বাদশাহ্। সম্মান আমায় যথেষ্ট করছ। ভালোবাসা আর সম্মান তো এক জিনিস নয়। তুমি আমাকে বিশ্বাস ক’রে থাক, বরাবর আমার ওপর নির্ভর করেছ, এইটুকুই যথেষ্ট। পুরুষ মানুষের অত লজ্জা ভালো নয়।

এত সব কথা জিৎ শুনেছে উধমের কাছে। পৃথ্বীরাজ আর রানী নিজেদের মধ্যে যে সমস্ত কথা বলাবলি করেন তার অনেক কিছুই উধমের কানে যায়। আসলে উধমের কাছে গোপন রেখে এসব কথা পৃথ্বীরাজ বলেন না। উচ্চকণ্ঠেই বলেন, উধমের নির্বিকারত্বের নীচে চাপা পড়া এক কর্মঠ, তৎপর এবং রসিক ব্যক্তির খোঁজ সমস্ত আগ্রায় বোধহয় একমাত্র পৃথ্বীরাজই জানেন। রানীও জানে না। রানী উধমকে ভাবে অত্যন্ত অনুগত এবং সক্ষম এক রক্ষীমাত্র। তাই পৃথ্বীরাজের উচ্চকণ্ঠে সচকিত হয়ে রানী মাঝে মাঝে তাঁকে ভর্ৎসনা করেন। কিন্তু যেটুকু শুনিয়ে দেবার ঠিকই শুনিয়ে দেন পৃথ্বীরাজ।

চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয় জিৎ সিং-এর।

সুরজন রাও-এর লোক এসে জানায়, ডাক পড়েছে তার।

সে গিয়ে পৌঁছোতেই, দু’তিনজন সভাসদ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে রাও-এর পাশে একটি আসনে বসিয়ে দেয়। যে লোকটি প্রথম দুর্গদ্বার থেকে এখানে এনেছিল, সে বিস্ময়ে চেয়ে থাকে।

সুরজন হেসে বলেন,—আমি কোনোদিনই লোক চিনতে পারি না জিৎ সিং।

জিৎ সিং জবাব না দিয়ে সামান্য একটু হাসে। সে ভবঘুরের দিকে চায়। কিন্তু ভবঘুরের চোখদুটো নির্বোধের চোখের মতো ভাষাশূন্য। সে বুঝতে পারে না, ভবঘুরে কতখানি প্রকাশ করেছে রাজার কাছে।

সুরজন জিৎ সিং-কে একটি পত্র দিয়ে বলে,—এই নাও। বেশি কিছু লিখলাম না। দু’কথায় উত্তর দিয়ে দিলাম।

জিৎ সিং গম্ভীরভাবে পত্রটি নেয়। অনুসন্ধিৎসা প্রবল হলেও সে প্রশ্ন করতে পারে না পত্রের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে। কারণ সে পত্রবাহক মাত্র। প্রশ্ন করা শোভা পায় না।

জিৎ সিং উঠে দাঁড়ায়। সবাইকে যথারীতি সম্মান জানিয়ে বের হয়ে আসবার মুখে রাজা বলে ওঠেন,–এ ঋণ আমি জীবনে ভুলব না জিৎ সিং।

জিৎ সিং কথা বলে না, সে চুপ ক’রেই থাকে। পৃথিবীর কাউকেই সে ঋণী করতে চায় না। কাউকে সে কৃতজ্ঞতা-পাশে আবদ্ধ রাখতে চায় না। তাই সুরজনের এই বিগলিতভাব তার ভালো লাগে না।

ভবঘুরের ওপর রাগ হয় তার। সে যদি এতগুলো লোকের সামনে সব কথা প্রকাশ করে দিয়ে থাকে, তবে মস্ত ভুল করেছে। যদি বাদশাহ্ আকবর এখান থেকে নিরাপদে ফিরে যান আগ্রায়, তবে হয়তো তার নিজের আগ্রায় থাকার দিন ফুরিয়ে যাবে। এদের মধ্যে কেউ-ই কি কোনোদিন আজকের এই ঘটনার কথা সোজাসুজি কিংবা কারও মাধ্যমে বাদশাহের কানে তোলবার চেষ্টা করবে না? ভারতবর্ষের সব চাইতে প্রতাপান্বিত ব্যক্তিটির অনুগ্রহ কে না যাচ্ঞা করে? তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টিতে ফকির উজির হয় তাঁর বিষদৃষ্টিতে উজির রসাতলে যায়।

জিৎ সিং কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসবার সময় তীব্র দৃষ্টিতে একবার ভবঘুরের দিকে চেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। তার চিন্তা বিক্ষিপ্ত।

ভবঘুরে হাসিমুখে এগিয়ে আসে।

জিৎ সিং থমথমে মুখে বলে,—ভুল করেছেন আপনি।

—তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি সেইরকম কিছু একটা ভেবেছ।

—আপনি কাউকে বলেননি?

—শুধু রাজা রাও আর তাঁর খুল্লতাত জানেন। তাঁদের দুজনকে আড়ালে ডেকে বলেছি। জিৎ সিং-এর মুখের অন্ধকার কেটে যায়। সে প্রশ্ন করে,—কি বললেন তাঁরা?

—বৃদ্ধ যে ব্যক্তিটি রাজার পাশে বসেছিলেন, তিনিই হলেন খুল্লতাত। রাজা নিজে কখনো আকবর শাহকে চোখে দেখেননি। তাঁর খুল্লতাত বার কয়েক দেখেছেন। ঠিক হল, দণ্ডধারীকে তিনি চিনে ফেলবেন। সেটাই স্বাভাবিক হবে। নইলে বাদশাহের মনে সন্দেহের ছায়াপাত ঘটবে। তিনি মূর্খ নন। আর সন্দেহ যদি করেন তিনি, তবে একদিন-না-একদিন আসল সত্য তিনি জানবেন।

জিৎ সিং হেসে বলে,—ওরা তাহলে মাথা খাটিয়ে ঠিক করেছেন যে আসল সত্য জানবার সুযোগ বাদশাহকে দেওয়া হবে?

—সেকথা তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম জিৎ সিং। সুরজন রাও তাঁর বংশমর্যাদাকে কলঙ্কিত করবেন না কিছুতেই। জীবন গেলেও নয়।

জিৎ সিং চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে দুর্গের চারদিকে চেয়ে দেখে ক্রমাগত কয়েকমাস ধরে মুঘলেরা গোলাবর্ষণ করেছে এর ওপর। সেই গোলার আঘাতে বহু অংশই ধসে গেছে দুর্গটির, বহু জায়গায় আগুনে পোড়া দাগ। তবু রণথম্ভোর এ পর্যন্ত স্বাধীন, এখনো সে ওই অর্ধভুক্ত সৈন্যদের মতো মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে নিজের এলাকায় সুরজন রাও আর তার সৈন্যদলকে আশ্রয় দিয়ে তৃপ্ত—গর্বিত। কিন্তু এই গর্ব স্থায়ী হল না। কালই রণথম্ভোরের ওই উন্নত অথচ রক্তাক্ত মস্তক নুয়ে পড়বে। নুয়ে পড়বে মুঘল বাদশাহের পায়ের কাছে।

জিৎ সিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার চোখের কোণ একটু সজল হয়ে ওঠে। রাজোয়ারার শেষ শক্ত ঘাঁটি দখল করে নেবেন মুঘল বাদশাহ্। রাজোয়ারার শেষ আশা, শেষ ভরসাও বিলুপ্ত হবে।

ভবঘুরের দিকে চোখ ফিরিয়ে নীরস কণ্ঠে জিৎ সিং বলে,—তবে আসি।

ভবঘুরে জিৎ সিং-এর দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। সে জানে এইসব সংবাদ সংগ্রহ ক’রে তৈরি খাদ্যের মতো তাদের সামনে হাজির করতে কত মেহনত করতে হয়েছে জিৎ সিং-কে জীবনকে কতভাবে বিপদগ্রস্ত করতে হয়েছে। ভারতের দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি বোধ হয় কোনো রাজপুত রাজার হাতের ওপর মুঘল বাদশাহের জীবনকে এভাবে কখনো তুলে দিতে পারবে না। জিৎ সিং অসাধারণ যুবক। তাই এই সুযোগ সে এনে দিতে পেরেছিল। অপরাধীর মতো মাটির দিকে চোখ নামিয়ে ভবঘুরে বলে,–এসো জিৎ। ইতিহাস তোমায় হয়তো ভুলে যাবে, কিন্তু এই রণথম্ভোরের পাষাণ তোমায় কখনো ভুলতে পারবে না।

—আমি রাজপুত ভবঘুরে। আবেগ আমারও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু প্রশ্রয় দিই না সেই আবেগকে। সুতরাং এইসব ভাবের কথা আমায় শোনালেও মনে কোনোরকম রেখাপাত করতে পারবে না। আজ চলি তবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে আবার দেখা হবে আগ্রায়। যমুনার তীরে কমলাবতী যেমন মিথ্যে চোখের জল ফেলে, তেমনি অনেক বিষয়ে মিথ্যে পরামর্শ চাইব আপনার।

জিৎ সিং-এর পশ্চাতে দুর্গের প্রধান ফটক ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। সে একবারও দেখতে চেষ্টা করে না, ভবঘুরের মুখের সমস্ত রক্ত কিভাবে সহসা অন্তর্হিত হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *