আগ্রা – ৬

৬.

রণথম্ভোর দুর্গের চতুর্দিকে অবরোধ রচনার পূর্ব মুহূর্তে মান সিংহ বাদশাহ্ আকবরের শিবিরে উত্তেজিত অবস্থায় প্রবেশ করেন। জিৎ সিং তাঁর পেছনেই ছিল, সে শিবিরের বাইরে থেমে যায়। আগ্রা থেকে রণথম্ভোর অবধি আসতে যতটা পথ পার হতে হয়েছে, আর যে-কদিন অতিবাহিত করতে হয়েছে তার মধ্যে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী জিৎ সিং এই প্রতাপশালী ব্যক্তিটির অনেক কাছে আসতে সমর্থ হয়েছে। এখন প্রায় সব ব্যাপারেই মান সিংহের প্রয়োজন হয় তাকে। সে এখন আর সাধারণ সৈন্য নয়। সে মান সিংহের ব্যক্তিগত অনুচর।

মান সিংহ বাদশাহকে উচ্চকণ্ঠে বলেন—আমি অবাক হচ্ছি বাদশাহ্।

—আমি হয়েছিলাম প্রথমটা।

—আমি বলছি ওদের আয়োজনের কথা।

—আমিও সেই কথাই বলছি। ওদের আয়োজন বিরাট। এই আয়োজন রাও-এর পক্ষে অল্পদিনে সম্ভব নয়।

—আপনি তবে—

—হ্যাঁ, খবর পৌঁছে গেছে অনেক-অনেক আগে।

—কিন্তু কে খবর দেবে, কেউ তো জানত না। আমিও কি বেশিদিন জেনেছি? কে এই নেমকহারামি করবে?

—আমিও তাই ভাবছি।

—আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন বাদশাহ্?

—না, বিশেষ কাউকে করি না। তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে কোনো রাজপুত রয়েছে এর মধ্যে।

মান সিংহের মুখ লাল হয়ে ওঠে। সেই মুখের দিকে চেয়ে বাদশাহ্ বলেন,—আপনি খুব ভাবপ্রবণ রাজা।

—না, আমি একটুও ভাবপ্রবণ নই। তবে ঠিক এই মুহূর্তে সমস্ত রাজপুত জাতির মধ্যে আমি একা শুধু আপনার সামনে দাঁড়িয়ে।

আকবর আসন ত্যাগ ক’রে বলেন,—ওসব কথা থাক। চলুন সব ব্যবস্থা ক’রে আসি। রাও যত আয়োজনই করুন, মুঘল শক্তির চাপে এক সময়ে তাঁর সমস্ত আয়োজন ভেঙে পড়বে।

উভয়ের কথাবার্তা জিৎ সিং-এর কানে যায়। সে একটু সরে দাঁড়ায়। শিবিরের আশেপাশে অনেক রক্ষীই ছিল। কিন্তু তাকে বাধা দেয়নি তারা। কারণ সে এসেছিল রাজা মান সিংহের সঙ্গে। রাজা মানের সর্বত্র অবাধ গতি।

বাদশাহ্ বাইরে আসতেই জিৎ সিং তাঁকে যথারীতি সম্মান জানায়। বাদশাহ্ থেমে যান। তাঁর ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে ওঠে। রাজাকে তিনি প্রশ্ন করেন, এ কে?

—আমার সঙ্গে এসেছে। চমৎকার ছেলে। বুদ্ধিমান এবং কর্মঠ।

বাদশাহ্ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে বলেন,—একে আমি যেন কোথায় দেখছি।

মান সিংহ চুপ ক’রে থাকেন। তাঁর মনে নেই বাদশাহের অভিপ্রায় অনুযায়ীই তাকে দলে নিয়েছেন তিনি। কত লোককেই তো নেওয়া হয়, সব কথা কি মনে থাকে? মনে থাকা সম্ভব নয়।

বাদশাহ্ আবার বলেন,—আমি দেখেছি একে। কোথায় দেখেছি তোমাকে?

জিৎ সিং উপলব্ধি করে, রাজা মান সিংহ এবং বাদশাহ্ এক ধাতুতে গড়া নন। বাদশাহ্ একবার যাকে দেখেন তাকে ভুলে যান না। ঠিক মনে রাখেন।

সে জবাব দেয়,—সংগীত সম্রাট তানসেনের গৃহে জাহাঁপনা।

—ঠিক। এবারে মন পড়েছে। তোমার সঙ্গে সেদিন আর একজন অদ্ভুত ধরনের লোকটি ছিল। সে কোথায়?

—জানি না জাঁহাপানা। সেদিনের পর তার সাথে আর দেখা হয়নি। লোকটি পাগল গোছের।

—হুঁ।

বাদশাহ্ রাজা মান সিংহের সঙ্গে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণের জন্যে এগিয়ে যান। জিৎ সিং বুঝে উঠতে পারে না সঙ্গে যাবে কি না। একটু ভেবে নিয়ে সে অন্য পথে যায়। সে জানে সন্ধ্যার আগে অবরোধ রচনার কাজ শেষ হবে না। তাই ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যে রণথম্ভোর দুর্গের দিকে এগিয়ে যায়। মুঘল সৈন্যদের মধ্যে আরও অনেকেই নিশ্চয় এইভাবে এগিয়ে এসেছে। রাতের বেলাতেও তাদের মধ্যে অনেকে ঘুরে বেড়াবে দুর্গের আশেপাশে। দেখে নেবে আক্রমণ করার দুর্বলতম স্থান। আর দেখে নেবে ওদের সৈন্যদের অবস্থিতি।

অনেক দূর অগ্রসর হবার পর সে একটি ঝোপের পাশে বসে পড়ে। বসে পড়ে, পরিশ্রমে, নয়—চিন্তা করতে। ভবঘুরে রয়েছে ওই দুর্গে। এতক্ষণে সে-ও হয়তো বাইরের দিকে চেয়ে দেখছে মুঘল সৈন্যের গতিবিধি। কিন্তু কিভাবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব? কালই হয়তো গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা শুরু হয়ে যাবে। তারপর আর কি দেখা করা সম্ভব হবে?

সূর্যের তেজ কমে আসে। জিৎ সিং উঠে দাঁড়ায়। আর একটু এগিয়ে যাবে সে। একেবারে দুর্গের নীচে, এইভাবে এগিয়ে যাবার বিপদ খুব। কারণ দুর্গের ভেতর থেকে একটি তীর কিংবা গুলি ছুটে এসে তাকে মৃত্যুর পরপারে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এদিকে মুঘল চরদের সামনে পড়লেও তারা তাকে সহজে রেহাই দেবে না। ধরে নিয়ে যাবে রাজা মান সিংহ কিংবা বাদশাহের কাছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বাদশাহের কাছে সোজা চলে যাবার স্বাধীনতা রয়েছে তাদের। কারণ এখানে তারা বাদশাহের চোখ, যে চোখের কথা ভবঘুরে আগ্রায় তাকে বলেছিল। আগ্রায় কিংবা অন্য বাদশাহের চোখদের যে গুরুত্ব, এখানকার গুরুত্ব তার চাইতে বহুগুণ বেশি।

জিৎ সিং আরও এগিয়ে যায়। সূর্যকে আর বেশিক্ষণ দেখা যাবে না। এর মধ্যে অন্তত সে নিজের চেহারাটাকে দেখিয়ে নিতে চায়। ভবঘুরে যদি চেয়ে থাকে এইদিকে, তবে নিশ্চয়ই দেখতে পাবে তাকে। পরবর্তী পন্থার ভার তার ওপর। কারণ এখানকার হালচাল, রাস্তাঘাট গোপন পথ সবই এতদিনে সে জেনে নিয়েছে।

সহসা সে দেখতে পায় সামনের একটি বড় পাথরের পাশ থেকে বের হয়ে আসছে ভবঘুরে। অপ্রত্যাশিত আনন্দে চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায় সে। বলা যায় না, আশেপাশে মুঘল চর থাকতে পারে।

ভবঘুরে বলে,—আমি এই রকমই কিছু আশা করেছিলাম তোমার কাছে। এই রকমই মাথাভাঙা গোছের কিছু।

জিৎ সিং প্রশ্ন করে,—মাথা-ভাঙা কেন?

—মাথা-ভাঙা নয়? দুর্গ থেকে একটি তীর এসে তোমায় শেষ ক’রে দিতে পারত।

—তাই যদি হত, তাহলে মরবার সময় জেনে যেতে পারতাম যে সুরজন রাও দুদিনেই পরাস্ত হবেন।

—কেন?

—একটি মাত্র লোক যদি সমস্ত মুঘল সৈন্যকে পেছনে ফেলে রেখে সোজা এগিয়ে আসে, তবে সে নিশ্চয় পাগল। পাগলকে কেউ মারে?

ভবঘুরে হাসে। বলে,—অমন পাগল তো অনেকেই হয় সময় বিশেষে।

—তবু এই সময়ে নয়। তাছাড়া একজনকে মারবেই বা কেন? সে কি করে, তার হাবভাব কেমন, আগে দেখে নেবে তো?

—ঠিক আছে। তুমি বুদ্ধিমান আমি জানি। এবারে খবর বল।

—কোনো খবর নেই। আমিই জানতে চাই খবর।

—এরা প্রস্তুত। খুব ভালোভাবেই প্রস্তুত। আমি মুঘলসৈন্যের সংখ্যা দেখেছি। দেখেও বলছি, ওরা মাসের পর মাস বসে থাকলেও সূর্য অধিকার করতে পারবে না। সুরজন রাও পালিয়ে যাননি উদয় সিংহের মতো।

জিৎ সিং-এর মুখ কালো হয়ে যায়। সে ধীরে ধীরে বলে,—কিকার কথাটা মনে রাখবেন।

—রাগ হয়ে গেল অমনি?

জিৎ সিং কথা বলে না।

—শোন জিৎ, কাল থেকে তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হবার আর সম্ভাবনা নেই। দুর্গের পশ্চিম দিকে একটা মস্ত বটগাছ রয়েছে। যদি কখনো নতুন কোনো খবর থাকে, ওখানে এসো সন্ধ্যার পরে। আমি রোজ অপেক্ষা করব।

—কী করে সম্ভব? আক্রমণ চলবে তো।

—চলবে। তবে ওদিকে আক্রমণ চালানো একটু কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে। সহজ রাস্তা ছেড়ে বাদশাহ্ ওদিকে যাবেন না। নতুন খবর পেলেই চলে এসো।

ঠিক সেই সময়ে তাদের একেবারে পাশে এসে দাঁড়ায় দুজন মুঘল চর। হাতে তাদের আগ্নেয় অস্ত্র। একজন গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে,—নতুন খবর দেয়া-নেয়ার পালা এইখানে শেষ করতে হবে।

জিৎ সিং স্থির দৃষ্টিতে ভবঘুরের দিকে তাকায়। দেখতে পায় ভবঘুরে নির্বিকার। পাশে যে ওরা এসে দাঁড়িয়েছে একথা যেন সে জানেই না।

—ওঠ শয়তান। একজন মুঘল চরের চোখ দপ করে জ্বলে ওঠে।

ওরা দুজনা উঠে দাঁড়ায় ভালোমানুষের মতো।

ভবঘুরে প্রশ্ন করে,—কোথায় নিয়ে যেতে চাও আমাদের?

—সোজা। বাদশাহের কাছেই নিয়ে যাব।

—তার চাইতে এখানেই কাজ হাসিল ক’রে দাও না। সুবিধে হবে। অতদূরে টেনে নিয়ে যেতে হবে না।

—চুপ কর কুত্তা। কি করতে হবে আমি ভালোরকম জানি। তোদের বলতে হবে না।

অপরজন ধীর-মস্তিষ্কের লোক। সে বলে,–শেষ ক’রে দিলে যে মজাটা ফুরিয়ে যাবে বাপজান্। বাদশাহ্ তোমাদের দেখে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের হাতে মোহর গুনে দেবেন যে। একি কম কথা? এখানে মেরে ফেলে রাখলে হয়তো তিনি বিশ্বাস করবেন না।

হঠাৎ জিৎ সিং-এর দিকে ভালোভাবে চেয়ে দেখে দ্বিতীয় ব্যক্তি। সে বিস্মিত হয়ে বলে ওঠে, —আরে। একে যে রাজা মান সিংহের পেছনে পেছনে কুত্তার মতো ঘুরতে দেখেছি। বেশ মজার ব্যাপার তো? এবারে সব বুঝেছি। আসল ব্যক্তি হচ্ছে মান সিংহ। ব্যাটা বাদশাহের তোয়াজ করে আর তারই সর্বনাশের ধান্ধায় থাকে। এবার ফাঁসবে বাছাধন

জিৎ সিং একটু যেন হতাশ হয়। ওদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র না থাকলে চেষ্টা করা যেত। ভবঘুরের কাছেও কোনো অস্ত্র নেই। তবু ওরা যদি আগ্নেয়াস্ত্রের পরিবর্তে অন্য কোনো অস্ত্র বহন করত তাহলে দুজনার বিরুদ্ধে তলোয়ার দিয়ে একবার লড়ে দেখা যেত। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সেই অবস্থায় বিপদ কেটে যেতেও পারত। কিন্তু তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এক্ষুনি ওরা তাদের দুজনকে সামনে ঠেলে দিয়ে পেছনে পেছনে বন্দুক উঁচিতে যাত্রা শুরু করবে। সেই যাত্রার শেষ হবে বাদশাহের শিবিরের অভ্যন্তরে পৌঁছে।

দুঃখে জিৎ সিং-এর মন ভরে যায়। সব আশা সব সম্ভাবনার বিনাশ হতে চলল অঙ্কুরেই।

—চল, সামনে চল।

জিৎ সিং-কে ওদের একজন ঠেলে দেয়।

ঠিক সেই মুহূর্তে আর একজনের আর্তনাদ কানে যায় তার। চকিতে পেছন ফিরে জিৎ সিং দেখতে পায় অপর মুঘল সৈন্যটি লুটিয়ে পড়েছে। একটি ছোরা আমূল বিঁধে রয়েছে তার বুকে। আর তার বন্দুক ভবঘুরের হাতে।

কিন্তু এত সব জিনিস একমুহূর্তে দেখে নিল জিৎ সিং। কারণ তখন প্রতিটি মুহূর্তের অসীম মূল্য। সে দেখল দ্বিতীয় মুঘলটি বন্দুক উঁচিয়েছে ভবঘুরেকে লক্ষ্য করে। ভবঘুরের বন্দুকও প্রায় তৈরি। কিন্তু ভবঘুরের পক্ষে বন্দুক ব্যবহারে বিপদ রয়েছে। সে বন্দুকের গুলি ফসকে গেলে জিৎ সিং-এর গায়ে লাগবে। নিমেষের মধ্যে কর্তব্য স্থির করে নেয় জিৎ সিং। কোষ থেকে তলোয়ার বের ক’রে সে মুঘল সৈন্যের মস্তকের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে।

ভবঘুরে হেসে বন্দুক নামিয়ে বলে,—চমৎকার। আমার একটা মুঘল পরিচ্ছদের প্রয়োজন ছিল। বরাত গুণে পেয়ে গেলাম। তেমন দরকার হলে তোমার শিবির অবধি ধাওয়া করব।

—কিন্তু দেহ দুটো? এখানে পড়ে থাকবে?

—থাকুক। বাদশাহ্ নিশ্চয়ই খবর পাবেন। বুঝবেন, চৌহান বংশের সলতে এখনো জ্বলছে।

ভবঘুরে ক্ষিপ্রগতিতে একজনের পোশাক খুলে নেয়। তারপর বলে,—চলি তবে আজ। তুমিও যাও। অন্ধকার হয়ে এল।

—আমি ভেবেছিলাম আপনি নিরস্ত্র ছিলেন।

—ভাবাটা ভুল হয়েছে। দুর্গ থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় কেউ বের হয় কখনো?

—কিন্তু কী ভাবে এমন ঘটল আমি বুঝতে পারিনি এখনো। বন্দুকের সামনে ছোরা বের করার অবকাশ পেলেন কিভাবে?

—যখন দেখলাম একবার আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দিলে আর উপায় থাকবে না। তখন ওই পাথরটিতে ইচ্ছা করে হোঁচট খেলাম। এমনভাবে মুখ বিকৃত করলাম, যেন খুবই ব্যথা পেয়েছি। আমার প্রয়োজন ছিল কোনোরকমে হাতটিকে হাঁটুর নীচে নিয়ে যাওয়া। কারণ ওখানেই ছিল ছোরাটি। সুযোগ মিলে গেল। লোকটি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল। আচ্ছা চলি জিৎ। মনে থাকে যেন—পশ্চিমের বটগাছ।

ভবঘুরে মিলিয়ে যায় অন্ধকারের মধ্যে। জিৎ সিং তলোয়ারের রক্ত ভালোভাবে মুছে নিয়ে চলতে শুরু করে।

চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। এদিকে-ওদিকে গাছের ওপর বাদুড় উড়ছে। অন্ধকারের মধ্যেও তাদের অস্পষ্ট দেখতে পায় জিৎ সিং। তাদের পাখার ঝাপটা শুনতে পায়।

আরও কিছুদুর চলে জিৎ সিং। মুঘল শিবিরের আলো দেখতে পায় সে। ওই আলোর পাশে বসে অনেকে তাদের ছেঁড়া পোশাক সেলাই করছে। অনেক ধর্মাত্মা পড়ছে পবিত্র কোর্-আন্-শরিফ কিংবা রামায়ণ মহাভারত। নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা এসব।

শিবিরের এদিক ওদিকে আগুন জ্বলছে। রান্নার আয়োজন শুরু হয়েছে। যুদ্ধ কর, আর যাই কর পেটে কিছু দিতেই হবে। পেট খালি থাকলে কিছুই হয় না। এই সময়ে বাদশাহের পেটে অবশ্য অন্য জিনিস পড়ে। সে জিনিস কখনো তরল, আবার কখনো কালো কালো গুলির মতো অনেক সময়ে দুই জিনিসই একসঙ্গে মুখের মধ্যে ফেলতে শুরু করেন বাদশাহ্। সবাই তাজ্জব বনে যায়। কারণ ওর একটিকে ঠিকমতো রপ্ত করতে অনেকের জীবন কেটে যায়। বাদশাহ্ এই বয়সেই অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন। অথচ চেহারা কিংবা আচরণে কোনোরকম বৈলক্ষণ নেই। ওসব খেয়ে যেন সাধারণ মানুষের চেয়ে শতগুণ উৎসাহ পান, শক্তি পান। আফিম খেয়ে লোকে ঢুলতে বসে। বাদশাহ্ নাকি একদলা আফিম মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে পাগলা হাতির পেছনে ছোটেন। অসাধারণ মানুষ।

—এই। উৎকটভাবে কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে পেছন থেকে।

জিৎ সিং তলোয়ারের হাতলে হাত রেখে থেমে যায়। অপেক্ষা করে সে।

একজন সিপাহী কাছে এসে বলে,এখানে কি করছিলে হে?

—তুমি কি করছ?

—চোপ্ রহ্, কার সঙ্গে কথা বলছ জানো না তুমি।

জিৎ সিং চুপ ক’রে থাকে। কারণ এর হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র। বাদশাহ্ তাঁর সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দলটির অধিকাংশ লোকের হাতে বন্দুক দিয়েছেন।

—কথার উত্তর দাও

—দেবো। আগে বাদশাহের কাছে নিয়ে চল। রাজা মান সিংহের কাছে নিয়ে গেলেও চলবে। লোকটি ক্ষেপে ওঠে,–এই রাজপুতদের জন্যেই বাদশাহের সর্বনাশ হবে। ব্যাটারা ভালো মানুষ সেজে বসে থাকে। অথচ ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করে।

—এত বড় কথা দ্বিতীয়বার আর উচ্চারণ করো না বলে দিচ্ছি।

—চোপ।

নরম কিংবা গরম, কোন্ ধরনের কথায় লোকটিকে ফাঁকি দেওয়া যায় বুঝতে পারে না জিৎ সিং। গরম কথায় বিশেষ ফল হবে মনে হচ্ছে না। তাই একটু হেসে বলে,—রাগছ কেন? তুমি যে কাজে এসেছ, আমিও সেই কাজেই এসেছি। শুধু শুধু মাথা গরম করে লাভ কি?

চেঁচিয়ে ওঠে লোকটি,–মিথ্যে কথা। আমাদের সঙ্গে কোনো রাজপুত আসেনি। আমি ভালোরকম জানি। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনি। না চিনলে চলে না আমাদের।

—আমি তোমাদের সঙ্গে আসিনি ঠিকই। তবে রাজা মান সিংহ আমায় পাঠিয়েছেন একটু দেখে নিতে। একলা বেশি দূর যেতে সাহস হল না এই অন্ধকারে। তাই অল্প কিছুটা গিয়ে ফিরে যাচ্ছি। দুর্গের আশেপাশের খবর রাখো?

লোকটি হেসে ওঠে। বলে,—তবু ছাড়ছি না। আমাদের কত্তা এদিকেই আসবে, তাকে সব বল।

–তোমাদের কত্তা কে?

—তফিলউদ্দিন।

নামটা শুনে চমকে ওঠে জিৎ সিং। দিনের আলো থাকলে লোকটি হয়তো তার ভাবান্তর বুঝতে পারত। অন্ধকার বলেই টের পেল না কিছু। তফিলউদ্দিন নামটি জিৎ সিং শুনেছে আগে। বীরবল-কন্যার মুখ শুনেছে সে। রাম সিং-এর নতুন নাম তফিলউদ্দিন। কিন্তু সেই তফিলউদ্দিন নাও হতে পারে। এক নাম পৃথিবীতে শুধু একজনেরই থাকে না। অনেক লোকের থাকে।

জিৎ সিং অপেক্ষা করে। সুযোগ খোঁজে সে। সুবিধে হলে তলোয়ারটিকে দ্বিতীয় বার রক্ত-স্নান করিয়ে নেবে। কারণ তফিলউদ্দিন যদি সত্যিই রাম সিং হয় তবে চিনে সে ফেলবেই। একবার চিনে ফেললে রাম সিং তাকে ছেড়ে দেবে না। চিনতে পারলে আজকের এই দিন রাম সিং-এর সারাজীবনের মধ্যে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।

লোকটি বলে,—অমন ছটফট করো না। ছটফটে মানুষকে আমি পছন্দ করি না, সহ্যও করি না।

—আমিও না। রাজা মান সিংহ আর রাজা ভগবান দাস আবার মূর্খ লোকদের সহ্য করতে পারেন না। মূর্খরা কর্তব্যের নামে অনেক ক্ষতি ক’রে ফেলে বহু সময়ে। তাই প্রথম সুযোগেই তাঁরা মূর্খদের সরিয়ে দেন।

লোকটি আবার হেসে ওঠে।

জিৎ সিং বুঝতে পারে কঠিন জায়গায় এসে ঠেকেছে সে। এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। তবু সাফল্য লাভের আশা কম

এই সময়ে সামান্য দূর থেকে একজন চিৎকার করে ডাকে,—হালিম?

তার গলা শুনে জিৎ সিং-এর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না তফিলউদ্দিন এবং রাম সিং একই লোক।

হালিম উত্তর দেয়,—আমি আছি।

—শিগগির। দুজন খুন হয়েছে আমাদের।

—খুন! স্বগতোক্তি করে হালিম। একটু বিচলিত হয়। জিৎ সিং-কে নিয়ে কি করবে ভেবে পায় না।

জিৎ সিং ব্যস্ততার ভান করে বলে—চল, শিগগির চল। কোথায় খুন হয়েছে কে জানে? দাঁড়িয়ে রইলে কেন? রাজা মান সিংহকে জানাতে হবে।

হালিমের হঠাৎ সন্দেহ হয়। সে অন্ধকারের মধ্যে জিৎ সিং-এর মুখের দিকে চাইবার চেষ্টা করে। তারপর চিৎকার করে বলে,–একজন রাজপুতকে ধরে রেখেছি। মুঘল দলের—

জিৎ সিং দূর থেকেও রাম সিং-এর চাপা অভিশাপ শুনতে পায়।

—ধরে রাখ, আসছি। হালিম এতক্ষণ বন্দুক উঁচিয়ে ধরে ছিল। এবারে নিশ্চিন্ত মনে সেটিকে মাটির ওপর খাড়া করে রেখে হাসতে থাকে। সুযোগ নিতে জিৎ সিং এক মুহূর্তও দেরি করে না। সে জানে, হালিমের পেশীগুলোও এবারে ঢিলে হয়ে রয়েছে। সেগুলোকে সক্রিয় করতে কয়েক মুহূর্ত বেশি সময় লাগবে। অনর্থক মানুষ খুন করতে চায় না সে। অথচ পর পর দুজনকে খুন করতে হল। কারণ এদের বাঁচিয়ে রাখলে তাকে মরতে হত। কিন্তু মরতে এখন সে চায় না। রাম সি-এর হাতেও পড়তে চায় না। কারণ রাম সিং-কে অন্য রকম কথা বলেছিল সেই বরাহ শিকারের দিনে। তাকে বলেছিল, তার মৃত্যুর পরেও সে বাঁচবে।

কোষ থেকে তলোয়ার বের করে সেই একই টানে সে সোজা চালিয়ে দেয় হালিমের গলায় হালিমের মুখের হাসি মিলিয়ে যাবার সময় পায় না। সে পড়ে যায়। জিৎ সিং তার বন্দুকটি নিয়ে একপাশের কাঁটা গাছের মধ্যে ছুড়ে দেয়। সেটিকে হাতে রেখে কোনো লাভ নেই।

—এই হালিম। কোথায় তুমি?

রাম সিং আরও কাছে চলে আসে। তার পায়ের শব্দ এবারে শুনতে পায় সে। এক মুহূর্ত দেরি না ক’রে রাম সিং যে-পথে আসছে, সেই পথ ধরেই সে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হামা দিয়ে এগিয়ে যায়। কারণ সে ভালোভাবে জানে মৃতদেহ দেখেই ক্ষেপে উঠবে রাম সিং। একটু আগেই যে-লোকটি কথা বলেছিল, সে রক্তাক্ত দেহে পড়ে রয়েছে, এ-দৃশ্য সহ্য করা খুবই কঠিন হবে তার পক্ষে। সেই সঙ্গে আরও দুটি মৃতদেহ, যা সে আগেই দেখেছে।

ভয়ও পাবে রাম সিং। কারণ সে জানবে, শত্রুপক্ষ খুব কাছেই রয়েছে। এবং শত্রুপক্ষ রাজপুত। হালিম সেকথা জানিয়ে দিয়েছে তাকে। ভয় আর ক্রোধ একত্রে মিলে মরিয়া ক’রে তুলবে রাম সিং-কে। সে খুঁজতে চেষ্টা করবে শত্রুকে। খুঁজতে খুঁজতে সে সামনের দিকে যাবে—যে পথে এসেছে সে পথে নয়। তাই জিৎ সিং রাম সিং যে পথ ধরে আসছে, ঝোপের মধ্যে দিয়ে সেদিকেই এগিয়ে যায়।

জিৎ সিং দুই হাঁটুর ওপর বসে দেখে, রাম সিং তার পাশ দিয়ে চলে গেল। একটু পরেই সে শুনতে পায় বিস্ময়-সূচক কণ্ঠস্বর।

তারপরই রাম সিং নির্বিচারে গুলি চালায়। কালপীর রাম সিং এখন তফিলউদ্দিন হলেও, হাতের বন্দুক তার আগের মতোই খেল দেখায়। জিৎ সিং মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়ে যায়।

জিৎ সিং অতি সাবধানে এগিয়ে চলে মুঘল শিবিরের দিকে। সে এতক্ষণে ভাবতে পারে, তার হাতে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া দুটি মনুষ্য জীবনের কথা। ভবঘুরের হাতে যে মরছে তার কথাও সে ভাবে। এদের মৃত্যু সে চায়নি, অথচ মারতে হল। এরা অন্যায় করেনি কর্তব্য করেছিল। অন্যায় করেছে সে। একা সে। ভবঘুরে এখন শত্রুপক্ষের দুর্গে রয়েছে। অন্যায় তাকেও স্পর্শ করেনি।

আজ যাদের সে হত্যা করল, তাদের ঘরেও বৃদ্ধ পিতা মাতা থাকতে পারে, যুবতী স্ত্রী রয়েছে। সেই সুন্দর ছেলেটির মতো দেখতে ছেলেও রয়েছে হয়তো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিৎ সিং। এই জন্যেই লীলাবতী তাকে ছেড়ে গেছে। লীলাবতী তার জীবনে আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না।

কিন্তু আজ যদি রণথম্ভোর মুঘলের সমস্ত চাপ সহ্য ক’রে টিকে থাকতে পারে, আজ যদি সুরজন রাও মুঘলকে আঘাত হানতে পারে, তবে রাজোয়ারার একটি বিখ্যাত দুর্গ বেঁচে যাবে। শুধু দুর্গ নয়, এই সাফল্য রাজপুতদের মৃতপ্রায় চিত্তের ওপর অমৃত-বারি সিঞ্চন ক’রে তাদের আবার সজীব করে তুলবে। অপর দিকে, মুঘল সৈন্যরা এরপরে আর কোথাও ততখানি আত্মবিশ্বাস নিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে না। বাদশাহ্ স্বয়ং সঙ্গে থাকলেও নয়।

না। সে অন্যায় করেনি। সে যে কাজ করছে সাধারণ বিচারে তা ঘৃণ্য হলেও উদ্দেশ্য তার মহৎ। এসব ব্যাপার নিয়ে কখনো আর সে ভাববে না। আর কখনো মনকে এভাবে খারাপ হতে দেবে না। লীলাবতী তার জীবন থেকে সরে গেছে। সে আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না। তার জন্যে মনের মধ্যে আক্ষেপ পোষণ ক’রে রেখে লাভ নেই। লীলাবতী নারী হতে পারে। কিন্তু সে নিজে পুরুষ। অমন অনেক আঘাতই পুরুষকে পেতে হয় জীবনে। তার জন্যে সংকল্পচ্যুত হওয়া উচিত নয়।

সংকল্পই পুরুষের জীবন। সংকল্পই তার পুরুষত্ব, তার চরিত্র। প্রচলিত নীতি অনুযায়ী সে অন্যায় করছে। কিন্তু এই নীতির প্রচলন বহু—বহু বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। তখন মানুষের জীবন এতটা জটিল হয়ে ওঠেনি। তার স্বভাব এতটা নোংরামিতে পরিপূর্ণ হয়নি।

জিৎ সিং দৃঢ়পদে এগিয়ে যায়। রাজা মান সিংহ ইতিমধ্যে হয়তো তার খোঁজ করেছেন। মান সিংহ তাকে ভালোবেসে ফেলেছেন।

জিৎ সিং একা একা হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ভাবে, এমনি ভাবে বাদশাহ্ও যদি তাকে ভালোবাসতেন খুব ভালো হত। তাহলে আর বীরবল-কন্যার কাছে গোপনে যেতে হত না।

প্রিয়া!

নামটি সে ভালোই দিয়েছিল। এই নামটা লীলার কাছে শিখেছিল সে। কোনো এক ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তে লীলাকে সে প্রশ্ন করেছিল একদিন,—তুমি আমার কে হও লীলাবতী? উত্তর নিমীলিত চক্ষে অস্ফুট স্বরে সে বলেছিল,—আমি? আমি তোমার প্রিয়া।

বলে ফেলেই লজ্জা পেয়েছিল লীলাবতী। মুহূর্তের তরে চোখ মেলে চেয়েই দু-হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলেছিল।

সেই সব দিনের কথা স্মৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। সে সব যেন কত যুগ আগের কথা। জীবনে আর কখনো লীলা সেই কথা বলবে না। ভালোবাসলেও নয়। কারণ উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করতে না পারলে সে কথা বলা আর সম্ভব নয় তার পক্ষে। জীবনে তার সঙ্গে দেখাও কি হবে আর? হয়তো না। দেখা হয়েও লাভ নেই, তার চাইতে বরং বীরবল-কন্যাকে মাঝে মাঝে যদি কাছে পাওয়া যায় মন্দ কি? মেয়েটি আগের চেয়ে অনেক নরম হয়ে এসেছিল। প্রথম দিনের সেই দাম্ভিকতা অনেক কমে এসেছিল। তার উদ্ধত স্বভাবের পরিবর্তন হচ্ছিল।

জিৎ সিং দেখে অবাক হত। রণথম্ভোরে আসার আগের দিনে পৃথ্বীরাজের বাড়ি থেকে বের হয়ে যমুনার তীরে শেষ বারের মতো দেখেছিল প্রিয়াকে। বিদায়ের পূর্বক্ষণে অমন সুযোগ মিলবে সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু তাকে দেখে চমকে উঠেছিল জিৎ সিং। সেদিন প্রিয়ার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল বিচ্ছেদের ব্যথা। সে অনুনয় করেছিল জিৎ-কে আগ্রা ত্যাগ ক’রে চলে না যেতে হাত ধরে চোখের জল ফেলেছিল।

প্রিয়ার ভালোলাগা ক্রমে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হচ্ছিল। সেই ভালোবাসার রূপ দেখে জিৎ সিং ভীত হয়ে উঠেছিল। সেই ভালোবাসার সুযোগ সে নিতে চায় না।

মুঘল শিবিরে পৌঁছে জিৎ সিং দেখে রণথম্ভোর দুর্গ অবধি চোরা-সুড়ঙ্গ কাটবার আয়োজন হয়েছে। রাতের বেলাতেই শুরু করা হবে কাজ। চিতোরেও ওরা এমনি করেছিল।

.

দিন যায়। মাসও যায়।

প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি মুঘল বাহিনী বার বার দুর্গের দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু প্রতিবারই তারা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসে। মাটির নীচের সুড়ঙ্গ দিয়ে গিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারে না ওরা। আহত আর নিহতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে শুধু।

প্রতিদিন একই ঘটনার পুনর্ঘটন। ঝাঁকে ঝাঁকে কামান আর বন্দুকের গুলি ছুটে যায় দুর্গের ওপর। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ও-পক্ষ থেকেও গর্জে ওঠে কামান। ধরাশায়ী হয় মুঘলদের অনেকে। সমস্ত মুঘল বাহিনী নিয়েও স্বয়ং বাদশাহ্ সুরজন রাও-কে একবিন্দু টলাতে পারেন না। তাঁর ললাটে কুঞ্চিত রেখার আভাস দেখা যায়। রাজা মান সিংহ আমীর ওমরাহ সবাই অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর। কারও মুখে দিনে রাতে একটি সময়ের জন্যেও সামান্য হাসি ফুটে ওঠে না।

প্রথম প্রথম এসে বাদশাহ্ তাঁর শিবিরে শরাবের তুফান বইয়ে দিতেন। এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু তাঁকে দেখা যায়, কথা বলতে বলতে পাশের সুদৃশ্য একটি কৌটা থেকে ঘোর কালো রঙের আফিম দলা ক’রে মুখের মধ্যে ফেলে দিতে। রাজা মান সিংহ সেদিন আফশোস ক’রে ভগবান দাসকে বলছিলেন, বাদশাহের রক্ত নাকি বিষাক্ত হয়ে গেছে। তাঁর আফিম সেবনের মাত্রা অসম্ভব রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতেও বিরক্ত বোধ করছেন।

কথাটা শুনে জিৎ সিং-এর আনন্দ হল। সে বাদশাহের চেহারা একবার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবার প্রলোভন সংবরণ করতে পারে না। তাই সব সময় রাজা মান সিংহের পেছনে পেছনে ঘোরে। যদি দৈবাৎ বাদশাহের শিবিরে যাবার সুযোগ মিলে যায়। সে জানে, রাজা মান সিংহের মতো ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে থাকার অর্থ অনেক লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সেই অনেক লোকের মধ্যে রয়েছে রাম সিং—এখানকার তফিলউদ্দিন। তবু কিছুতেই নিবৃত্ত হতে পারে না।

একদিন রাজা মান সিংহ বাদশাহের শিবিরে প্রবেশ করেন।

জিৎ সিং ভালো মানুষের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে দেখতে পায় মান সিংহের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাদশাহের খাস ক্ষৌরকার অর্জুন হাজম বাইরে বের হয়ে আসে। সে তাড়াতাড়ি অর্জুনের সামনে গিয়ে বিনয়ের সঙ্গে অভিবাদন করে।

অর্জুনও একটু হতচকিত হয়। তোয়াজ তাকে অনেক রথী মহারথীরাই ক’রে থাকে। কারণ প্রত্যহ একবার গোপনে বাদশাহকে দর্শনের সুযোগ রয়েছে সারা ভারতবর্ষে মাত্র দুটি প্রাণীর তার মধ্যে একজন অর্জুন হাজম। বদরাগী বাদশাহের মেজাজ সকালে কেমন রয়েছে তার খোঁজ দিতে পারে একমাত্র অর্জুন হাজম। সকালের মেজাজের ওপর সারাদিনের মেজাজ অনেকটা নির্ভরশীল। তাই আগ্রায় বাদশাহের খাসমহল থেকে যখন অর্জুন বের হয়ে আসে তখন তার নিষ্ক্রমণের পথেই দুই ধারে বিজয়ীর বীরকে সম্মান জানোনোর মতো খানদানী আদমী ভিড় করে থাকে। অর্জুনের বুঝতে বাকি থাকে না তারা কি জানতে চায়। কারণ এ হল প্রাত্যহিক ব্যাপার। তাই সে গাম্ভীর্য বজায় রেখে এক একদিন নিজের মর্জি মাফিক এক একরকম মন্তব্য করে। সেই মন্তব্যে সারি বাঁধা অতগুলো বুক আশায় ফুলে ওঠে কিংবা হতাশায় চুপসে যায়।

অর্জুন হাজম সম্বন্ধে অনেক কাহিনীই প্রচলিত আছে আগ্রায়। তার প্রতিদিন প্রাতঃকালের মন্তব্য যে সব সময় সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় একথা সবাই জানে। যারা তার রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় তারাও জানে। তবু একবার না দাঁড়ালে যেন দিনের কর্তব্য স্থির করতে পারে না তারা। অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া অর্জুন অনেক সময়ে সত্যি কথাও বলে। জিৎ সিং এ-সব জেনেই অর্জুনের সামনে দাঁড়ায়। তবু তার মধ্যে একটুখানি নতুনত্ব আনবার জন্যে অভিবাদন করে। সে জানে, এই তৎপর অভিবাদনের প্রভাবে পড়ে অনেক রাজা মহারাজাও বিপরীত কাজ করে বসে। অর্জুন তো তুচ্ছ।

অর্জুন হেসে বলে,—কি খবর? কি চাই?

জিৎ সিং তাকে কয়েকবার দেখলেও, অর্জুন কখনো জিৎ সিং-কে লক্ষ্য করেনি, একথা সে জানে। তবু আর একবার অভিবাদন ক’রে বলে-আমাকে চিনে ফেলেছেন নিশ্চয়ই?

—হ্যাঁ হ্যাঁ। তোমাকে চিনতে অসুবিধা হবে কেন?

—না। অসুবিধা কিছুই হবে না জানতাম। তবু আপনাদের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে হলে অন্যভাবে তো অগ্রসর হওয়া যায় না।

অর্জুন একটু ফুলে ওঠে। যদি সম্ভব হত, হাতের ক্ষৌরকর্মের সরঞ্জামাদি লুকিয়ে ফেলত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই হেসে বলে,–কেমন আছো?

—ভালোই। তবে বাদশাহের জন্যে বড় দুশ্চিন্তা হয়েছে। শুনেছি। আফিমের মাত্রা নাকি বাড়িয়ে দিয়েছেন।

—ওসবের জন্যে শুধু শুধু চিন্তা করো না। হ্যাঁ, বাড়িয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ওতে উনি কাবু হবেন না। তবে আমার একটা দুর্ভাবনা হচ্ছে।

—কী দুর্ভাবনা?

—সেকথা কি তোমার বলা উচিত হবে? তুমি অনেক ছোট।

—ঠিক। তাছাড়া, আপনি আমাকে আরও ছোট দেখেছেন। কিন্তু আমি যে বিয়ে করেছি, এখবর আপনি পেয়েছেন কি না জানি না।

—সেরকম শুনেছিলাম বটে।

জিৎ সিং লজ্জিতভাবে আর একবার অভিবাদন করে। সে দেখতে পায় শিবিরের চারদিকের রক্ষীরা হাঁ করে চেয়ে রয়েছে তার দিকে।

প্রহরীদের মুখের দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে সে বলে,—বিবাহিত ব্যক্তিরা তো সবই শুনতে পারে।

—সে কথা ঠিক। শোনো তবে। আমার দুর্ভাবনার কথা। রাজা মান সিং-কে বলেছি। বাদশাহের রক্ত বোধহয় বিষ হয়ে গেছে।

—তবে? তিনি কি বাঁচবেন না?

—তিনি ঠিকই বাঁচবেন তবে তাঁর সংস্পর্শে যারা আসবে তার বোধহয় বাঁচবে না।

—মানে? আপনি রাজা মান সিংহ-এঁরা? আপনারাই তো সংস্পর্শে আসেন বাদশাহের।

—দূর দূর। ওকথা বলছি না। ওই জন্যেই তো বলতে চাইছিলাম না। বিয়ে করেছ, অথচ কথার মানে বোঝ না। আমি বলছি তাঁর হারেমে যারা তাঁর সংস্পর্শে আসবে তারা বাঁচবে না। বিষক্রিয়া শুরু হবে। এককালে এমন অনেক হত এই দেশে। বিষকন্যার নাম শুনেছ? তফাতের মধ্যে হল, তারা ছিল মেয়ে, আর আমাদের বাদশাহ্ হলেন পুরুষ। তবে ব্যাপার একই

জিৎ সিং থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এও কি সম্ভব! নইলে রাজা মান সিংহ ওকথা বলছিলেন কেন? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে জিৎ সিং-এর, হারেমের অনেক বেগমকে বাদশাহ্ সঙ্গে এনেছেন। ওই তো ওখানে তাদের অস্থায়ী হারেম। তেমন কিছু হলে এর মধ্যে একজন বেগম অন্তত বিষক্রিয়ায় মারা পড়ত। অর্জুন হাজম বেশি বুঝতে শুরু করেছে। আর দুর্গ জয়ের ব্যর্থতায় চিন্তাগ্রস্ত মান সিংহও তার কথা ভালোভাবে না ভেবেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন

সে মুখে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে অর্জুনকে প্রশ্ন করে, এখানকার হারেমে কয়জন বেগম রয়েছেন?

—আমি ঠিক বলতে পারি না। আছেন অনেকই। তাঁদের সাবধান ক’রে দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে ফল হবে না। বাদশাহ্ সবরকমের মৃত্যুদণ্ডই দিতে পারেন। এও এক ধরনের মৃত্যুদণ্ড।

অর্জুন হাজম নরসুন্দর-সুলভ চতুরতার হাসি হাসে।

জিৎ সিংও সে হাসিতে যোগ দেয়। হাজম যখন হেসেছে, তাকে হাসতে হবেই। নইলে রাগ হতে পারে হাজমের। রাগ হলে ভবিষ্যতে আর কোনোদিনও কাজে আসবে না সে।

অর্জুন হাসি থামিয়ে একটু কেশে নিয়ে বলে,—আচ্ছা চলি, দেখা হয়ে আনন্দ হল।

—আমারও। কোথায় আগ্রা, আর কোথায় এই রণথম্ভোর। এতদূরে এসে নিজের লোকের দেখা পেলে খুব আনন্দ হয়।

—–আচ্ছা, বাদশাহ্ সঙ্গে করে যে হারেম এনেছেন, তার মধ্যে কি কমলাবতী আছেন?

—কোন্ কমলাবতী?

—গণ্ডোয়ানার।

—আমি বলতে পারি না। হারেমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। বাদশাহ্ ছাড়া সেখানে আর একজন মাত্র পুরুষ যেতে পারেন।

উৎসুক জিৎ সিং প্রশ্ন করে,–কে তিনি?

—বৈদ্য শালিবাহন। অসুখ-বিসুখ হলে তাঁকে যেতেই হয়। তাঁর মতো বৈদ্য কোথায় পাবেন বাদশাহ। তবে তিনি তো চোখ কান খুলে চলেন না। আধা-ক্ষেপা মানুষ। হারেমের কোন্ বেগমের কি নাম এ-খবর তিনি কখনোই দিতে পারবেন না।

জিৎ সিং আর একবার অভিবাদন করে। রক্ষীদের চোখ থেকে অগ্নিবর্ষণ শুরু হয়। জিৎ সিং-এর অভিবাদনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবারই তারা চমকে চমকে উঠছে। প্রতিবারই ভাবছে, বাদশাহের শিবির থেকে বের হলো। অথচ তাদের চোখের সামনেই সব ঘটছে। জেনে-শুনেও তারা চমকে উঠছে। তারা আরও রেগেছে অন্য কারণে। এরপর থেকে হাজম-ব্যাটা তাদের কাছ থেকেও সম্মান প্রত্যাশা করবে। না পেয়ে, মনে মনে রেগে গিয়ে বাদশাহকে ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যে কথা বলে হয়তো তাদের সর্বনাশ করবে।

জিৎ সিং আর একবার তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল ক’রে চেয়ে নিয়ে বলে,—আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। কিছু মনে করবেন না।

—না না, কিছু মনে করিনি। চেনা মানুষ, দেখা হলে কথা বলবে না? তুমি কমলাবতীর খোঁজ চাইলে আমি চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি।

—খুব ভালো হয় তাহলে।

—হারেমের একজনের সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয়। আগ্রাতেও দেখা হত, এখনো হয় তাঁর কাছ থেকে জেনে নেব।

—কে তিনি?

—সালিমা বেগম।

জিৎ সিং ভয় পেয়ে যায়। সালিমা বেগমের ক্ষুরধার বুদ্ধির কথা সে শুনেছে। হাজমের কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিতে একটুও দেরি হবে না বেগমের, কে কমলাবতীর খোঁজ চায়। সে তাড়াতাড়ি বলে,—না না, ওটি করবেন না। সালিমা বেগম কমলাবতীকে একটুও দেখতে পারেন না। কমলাবতীর কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে হয়তো।

—বেশ, তবে বৈদ্যকেই প্রশ্ন করব।

অর্জুন চলে যায়।

জিৎ সিং সালিমা বেগমের কথা ভাবে। এই রমণী মোটেই সামান্য নয়। বহুবার তার পরিচয় মিলেছে।

সারা ভারতবর্ষের যে দুইজন প্রতিদিন নিরালায় বাদশাহের সান্নিধ্য লাভ করে, তাদেরই অপরজন হল এই সালিমা বেগম। বাদশাহের ওপর এই বেগমের প্রভাবের কথা দেশের সবাই জানে।

অথচ এই রমণী যখন ষোড়শী, তখন ছিলেন অপরজনের বেগম। সেই অপরজনটি যদি হুমায়ুনের মৃত্যুর আগে এবং পরে শক্ত হাতে মুঘল সাম্রাজ্যের লাগাম টেনে না ধরতেন, তবে আজ এই শিবিরের ভেতরের অনেক যুদ্ধ-জয়ের বীরনায়ক, অনেক শৌর্যপরাক্রমের কেন্দ্রবিন্দু চিতোর নগরীর অধিকারী এবং রণথম্ভোরের অবরোধকারী জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবরের অস্তিত্ব অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। হ্যাঁ, আকবর শাহ্ তাহলে এই বিশাল সাম্রাজ্যের মসনদে বসতে পারতেন না। হুমায়ুনের যখন মৃত্যু হয় সেই সময়ে আকবর শাহ্ পিতার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক শত্রু শের শাহের বংশধর সিকান্দর সুরের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন, একথা আগ্রার সবাই জানে। তারা আরও জানে, হুমায়ুনের মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্ত হবার পর কলানৌবের এক অতি নির্জন স্থান সামান্য এক ইষ্টক বেদীকার ওপর বসিয়ে সম্পূর্ণ অনাড়ম্বরের মধ্যে আকবরের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করেছিলেন যে বিরাট পুরুষ তিনি বহু ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিয়ে তাঁকে সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়েছিলেন। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে সেই পুরুষই শেষে নিজের হাতে গড়ে তোলা আকবরের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, এবং পরাস্ত হলেন। তিনি বোধহয় আকবরের ওপর তাঁর ধাত্রীমাতার অপরিসীম প্রভাব সহ্য করতে পারেননি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আকবর বিপথে যেতে বসেছে। যে কারণেই হোক, যুদ্ধ ক’রে তিনি পরাস্ত হলেন। শেষে ভারতবর্ষ ছেড়ে মক্কা যাবার পথে তিনি নিহত হলেন। এই পুরুষ হলেন বৈরাম খাঁ।

বৈরাগ খাঁ।

জিৎ সিং বার বার উচ্চারণ করে নামটি। সে জানে, ইতিহাস যদি আকবর শাহকে বাঁচিয়ে রাখে তাহলে বৈরাম খাঁকেও বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য। বৈরাম খাঁর সহায়তা ছাড়া আকবর যেমন এমনিতে বেঁচে থাকতে পারতেন না—তেমনি ইতিহাসের মধ্যেও বাঁচতে পারতেন না।

এই বৈরাম খাঁয়েরই নব-পরিণীতা বধু ছিল সালিমা বেগম। বৈরামের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আকবর পরম সমাদরে নিজের হারেমে স্থাপন করেছিলেন সালিমা বেগমকে। সেই থেকে তাঁর ওপর সালিমা বেগমের প্রভাব অপ্রতিহত গতিতে চলেছে। বাদশাহকে ছেড়ে সে থাকতে চায় না বড় একটা। তাতে প্রভাবের গতি ক্ষীণ হতে পারে, রুদ্ধ হতে পারে।

জিৎ সিং জানে, বৈরাম খাঁয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তাঁর পুত্রকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলেছেন বটে বাদশাহ্, কিন্তু সালিমার প্রতি অতখানি শ্রদ্ধার পেছনে শুধু কৃতজ্ঞতা কাজ করছে না। অন্য কারণও রয়েছে। আকবর শাহ্ মূর্খ নন। মহিলার ভেতরে তিনি নিশ্চয় দেখেছেন অসাধারণত্ব, যা দুর্লভ! তাই অর্জুন হাজম যখন কমলাবতীর কথা সালিমা বেগমের কাছ থেকে জানবে বলল, তখন জিৎ সিং সত্যিই ভয় পেয়েছিল। কারণ সালিমা বেগম অতটা সরলভাবে জিনিসটিকে নিত না কিছুতেই। সে আরও গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করত। তার সেই জেরার মুখে পড়ে অর্জুন হাজমকে সব কিছু বলতে হত।

অর্জুন হাজম চলে যাবার পরও জিৎ সিং দাঁড়িয়ে থাকে। বাদশাহের শিবিরে তখন রাজা মান সিংহ গভীর পরামর্শে রত। রণথম্ভোর তাঁদের স্নায়ুর ওপর উঠেছে। এভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে সৈন্যবাহিনীর মনোবল নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতেই দু’চারটে ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যার লক্ষণ খুব শুভ নয়। অধৈর্য হয়ে এরা মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করছে। শিবিরের আশেপাশে স্ত্রীলোকের মৃতদেহও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কখনো। সুড়ঙ্গ কেটে যুদ্ধ ক’রে বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি বাদশাহ্। ও-পক্ষের প্রতিরোধ খুবই বলিষ্ঠ। এতদিনের মধ্যে একটুও ফাটল ধরেনি। ভবঘুরেকে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না জিৎ।

চিতোর থেকে যদি রানা উদয় সিংহ পালিয়ে না যেতেন, তাহলে হয়তো চিতোর রক্ষা করাও সম্ভব হত। তাহলে জয়মল্লের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জহরব্রতের হিড়িক পড়ে যেত না।

একজন রক্ষী চাপা গলায় জিৎ সিং-কে ডাকে। সে এগিয়ে যায় কাছে।

রক্ষীটি বলে,—ব্যাপার কিহে? ওই ব্যাটাকে অত তোয়াজ কেন?

—তবে কি তোমায় তোয়াজ করব?

—না, আমায় কেন? আমি তো মুখ্যু। নইলে এইভাবে প্রহরের পর প্রহর দাঁড়িয়ে থাকি হাঁ ক’রে? আমার তোয়াজ করতে বলছি না। তবে মান সিংহের মতো ব্যক্তির ন্যাজে ন্যাজে ঘুরেও নাপিতকে অত খাতির করলে বলে বলছি।

জিৎ সিং উত্তর দেবার আগেই মান সিংহ বাদশাহের শিবির থেকে বের হয়ে আসেন। তার মুখ দেখে মনে হয় দীর্ঘ পরামর্শের পর একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে পেরেছেন ওঁরা।

জিৎ সিং-কে ডেকে মান সিংহ বলেন,–একটা কাজ করতে হবে তোমায়।

জিৎ সিং অপেক্ষা করে মান সিংহের হুকুম শোনবার জন্যে।

মান সিংহ এদিকে ওদিকে চেয়ে নিয়ে শেষে বলেন,– আচ্ছা চল। আমার শিবিরে চল। সেখানেই বলব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *