৫.
বীরবলের বাড়ির সামনে এসে যখন পৌঁছোয় জিৎ সিং তখন বেশ রাত হয়েছে। তবে মধ্যরাত হতে অনেক বাকি তখনো। সরাইখানার মালিককে বলে এসেছে রাতে ফিরবে সে, তা যত রাতই হোক।
পুব আকাশের চাঁদটা বেশ বড় হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার দিন বোধ হয়। জিৎ সিং সেই চাঁদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। চিতোরেও এই একই চাঁদ উঠত, একই রকম দেখতে। অথচ তখন কত আনন্দ হত দেশে। বোধহয় চাঁদ দেখে আনন্দ উপভোগের বয়স তার পার হয়ে এসেছে। কিংবা চিতোর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার মনের মধ্যে আগের ভাব আর জাগে না। সেই বিশেষ তন্ত্রীটি হয় ছিঁড়ে গেছে কিংবা অবশ হয়ে রয়েছে।
জিৎ সিং একটু দূর থেকে লক্ষ্য ক’রে বীরবলের বাড়ির সামনে সজাগ প্রহরী। একজন নয়, একাধিক। এদের সবার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব বলেই মেয়েটি খিড়কির পথ দিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু সে পথই বা কোনদিকে?
ভালোমানুষের মতো সে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলে।
একজন প্রহরী গর্জে ওঠে,—থাম।
জিৎ সিং প্রশ্ন করে,—আমায় বলছ সিপাহী জী?
—হ্যাঁ, তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি এখানে?
—কেউ নেই, তা তো জানি না।
—চুপ কর, এদিকে এসো।
—মারবে না তো?
—এদিকে এসো।
—মেরো না সিপাহী জী।
—এসো বলছি।
—জিৎ সিং গুটি গুটি গিয়ে কাছে দাঁড়ায়।
সিপাহী তার আপাদমস্তক ভালোভাবে লক্ষ্য করে। তারপর তার নজর গিয়ে পড়ে জিৎ সিং-এর কোমরে দোদুল্যমান অতিদীর্ঘ তলোয়ারের দিকে। নজর পড়তেই সে হোহো ক’রে হেসে ওঠে।
—হাসছ কেন সিপাহী জী? আমার মুখে কি কালি লেগে রয়েছে?
—আরে না, ওই তলোয়ার কার?
—আমার।
—ঠিক করে বল, ওটি কেন ঝুলিয়েছ?
—বাঃ, সবাই ঝোলায়, আমি ঝোলাব না?
—সবাই তো কাজের জন্য ঝোলায়। তুমি এটা তুলতে পার?
—তা পারি না বটে, কিন্তু কেউ তো সেকথা জানে না। তাই চোর ডাকাতরা ভয়ে আমাকে কিছুই বলবে না। রাত হলে আমি সেজন্যে এটা নিয়ে বের হই।
—তুমি একটা আস্ত বোকা। চোর ডাকাত তোমার মতো মূর্খ নয়, তারা এক নজরেই বুঝতে পারবে, তুমি একটা বাচ্চা ছেলে। তাদের বুঝতে একটুও অসুবিধা হবে না, ওই অস্ত্র জীবনে কখনো তুমি কাঁধ সমান উঁচু করতে পারবে না।
—সত্যি বলছ সিপাহী জী, সত্যি তারা বুঝতে পারবে? আমার যে ভয় করছে।
—সে আমি জানি। যাও বাড়ি গিয়ে মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে পড় গে। রাতের বেলায় কেন মিছিমিছি ঘুরে বেড়াচ্ছ?
জিৎ সিং কপট ক্রোধ দেখিয়ে বলে,—তুমি আমাকে যা খুশি তাই বলে যাচ্ছ? তোমার না হয় গায়ে জোর আছে। তাই বলে আমিও ছোট নই যে মায়ের কোলের ভেতরে গিয়ে শোবো।
সিপাহী হেসে বলে,—তবে কি তুমি বড়? চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলেকে কেউ বড় বলে?
জিৎ সিং কৌতুক অনুভব করে। এতটা কম বয়সী তাকে ভাবল কি ক’রে লোকটা? চিতোরে সেই মুঘল সৈন্যদের মধ্যে যে তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, সেই লোকটিও বোধহয় তাই ভেবেছিল। বীরবলের বাড়ির প্রহরী খুব লম্বা-চওড়া জোয়ান। তাই বোধহয় তাকে এত ছোট ভাবছে। সন্তুষ্ট হতে পারে না জিৎ সিং লোকটির মন্তব্যে। নিজের চেহারার ওপর রাগ হয় তার। তবে এর মধ্যেও সান্ত্বনা এইটুকু যে লীলাবতী তাকে তেমন ভাবে না। আর এই সামনের বাড়ির কর্তার কন্যাটিও তেমন ভাবেনি। ভাবলে অনেক অসুবিধা হত। নারীদের চোখে বোধহয় পুরুষের ঠিক বয়সটাই ধরা পড়ে।
সিপাহী বলে,—যাও, বাড়ি যাও।
—এ বাড়িটা কার ভাই?
—ভাই! আমি তোমার ভাইয়ের বয়সী? তিরিশ বছর পার হয়েছে, বল চাচা।
—হ্যাঁ চাচা, বাড়িটা কার?
—বীরবলের ভেতরে যাবে?
—না, পাগল নাকি? এ-বাড়ির ভেতরে আমি যাব কেন?
সিপাহী হেসে ওঠে জিৎ সিং-কে একহাতে কাছে টেনে ধরে বলে,—যদি আর একটু বয়স হতো তোমার, তাহলে এখুনি ছুটতে ভেতরে।
—কেন, কেন? ওকথা বললে কেন?
—সে তুমি বুঝবে না, ভেতরে জিনিস আছে। আমরা সিপাহী হয়েছি বলে তো চোখের মাথা খাইনি। চোখে পড়ে যায়।
—কি পড়ে যায় চোখে?
—সেই জিনিস। চোখ ঝলসে যায়।
—তবে আমিও ভেতরে যাব, চোখ দুটো একটু ঝলসে নেব
সিপাহী হোহো করে হেসে ওঠে।
—হাসলে যে?
—হাসব না, হাসির কথা বললে হাসব না? ও জিনিসে তোমার চোখ ঝলসাবে না। আরও চার পাঁচ বছর অপেক্ষা কর। বয়স উনিশ কুড়ি হোক, তারপর।
—বেশ! এরপরে যেদিন আসব, সেদিন কিন্তু ভেতরে যেতে দিতে হবে চাচা। বড় লোকদের বাড়ি দেখিনি আমি।
—আমি কিভাবে যেতে দেব ভেতরে? আমি তো একা নই।
—তুমিই তো সব, তুমি ইচ্ছে করলে বাড়ির মালিককে অবধি রুখে দিতে পার। আমি কি সেকথা জানি না ভাবছ? কী বিরাট চেহারা তোমার। সবাই ভয় পাবে দেখলে।
দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিয়ে লোকটি আত্মসন্তুষ্টির হাসি হাসে। বলে,—তা যা বলেছ।
—দেবে তো যেতে চাচা?
—এসো একদিন, চেষ্টা করব। বেশ সুন্দর কথা বল তুমি। অল্পবয়স্ক হলে কি হবে, কথাগুলো পাকাপাকা। সময় কাটল বেশ। দরওয়াজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে সময় আর কাটতে চায় না। তাই কারও সঙ্গে কথা বলতে পারলে বেশ আনন্দ হয়। কিন্তু তাও কি বলার উপায় আছে। কে কেমন লোক, কেউ বলতে পারে না। হয়তো আমি অন্যমনস্ক হবার সঙ্গে সঙ্গে আমারই গর্দানটা নিয়ে নিল।
—ঠিক কথা বলেছ চাচা। ও কাজও করো না। কারও সঙ্গে কথা বলো না। কার পেটে কি আছে কিছুই বলা যায় না। তার চাইতে যদি কাজকর্ম না পাই, তবে আমি বরং মাঝে মাঝে এসে গল্প ক’রে যাব।
—কিন্তু আমি তো সব সময়ে থাকি না।
—সে আমি দেখব। দূর থেকেই তো বুঝতে পারব, কে রয়েছে। যেই দেখব আমার চাচা রয়েছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসব।
—তাই এসো।
—আচ্ছা চাচা, এ বাড়ির কি একটাই রাস্তা। এতবড় বাড়ি, মাত্র একটা রাস্তা ভেতরে যাবার?
—–না, আর একটা আছে। খুব ছোট্ট একটা দরওয়াজা, একজন লোক যেতে পারে।
—সেটা কোনদিকে চাচা?
সিপাহী হাত উঁচিয়ে বলে,—ওই তো, ওইদিকে গিয়ে বাঁয়ে ঘুরলে দেখা যাবে।
জিৎ সিং সিপাহীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা চলে যায় সদর রাস্তা ধরে। তারপর অন্যদিক দিয়ে ঘুরে খিড়কির সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। খিড়কি বন্ধ। জিৎ সিং বুঝে উঠতে পারে না, দরওয়াজায় ধাক্কা দেবে কি না। তেমন কোন নির্দেশ মেয়েটি দেয়নি তাকে। সুযোগ পেলে হয়তো সবই বলত। কিন্তু তেমন সুযোগ পাওয়া যায়নি। তাই দ্বিধাগ্রস্ত মনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সে। খিড়কির প্রহরী নিশ্চয়ই ভেতরে রয়েছে। মেয়েটি যদি প্রহরীকে জানিয়ে দিয়ে থাকে, তবে সে হয়তো তারই জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু যদি না জানিয়ে থাকে? তেমন ভুল তো এইসব ধনীদের দুলালীর প্রায়ই হয়। খেয়ালের বশে একটা কথা বলে শেষে ভুলে যায়। মেয়েটি যদি ভুলে গিয়ে থাকে, তবে কপালে অনেক দুঃখ রয়েছে। কারণ সব প্রহরীই তার বয়স ভুল করবে না, সব প্রহরীই চাচা হতে চাইবে না।
অনেক ভেবেচিন্তে জিৎ সিং দরওয়াজায় আস্তে টোকা দেয়। মুহূর্তের মধ্যে দরওয়াজা খুলে যায়। যে দাঁড়ায়, চাঁদের আলোর মধ্যেও তাকে দেখে জিৎ সিং-এর সর্বাঙ্গ হিম হয়ে যায়। রাম সিং-এর দুই বন্ধুর একজন, যারা উদয়সাগরের তীর থেকে শংকরীকে হত্যার পর আগ্রায় এসে পৌঁছেছে।
জিৎ সিং পাশ ফিরে দাঁড়ায়। সে বুঝতে চেষ্টা করে লোকটি তাকে চিনতে পেরেছে কি না। কি যেন নামটা ওর? জিৎ সিং কিছুতেই মনে করতে পারে না। পরে এক সময়ে মনে হবে নিশ্চয়।
লোকটি জিৎ সিং-এর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর বলে,—আপনার আসবার কথা ছিল তো?
গলার স্বরকে বিকৃত ক’রে জিৎ বলে,—হ্যাঁ!
—প্ৰমাণ?
—কি প্রমাণ চাই?
—কার কাছে এসেছেন আপনি?
একটু ইতস্তত করে জিৎ সিং বলে,—বীরবলের কন্যার কাছে।
—ঠিক আছে, ভেতরে আসুন।
জিৎ সিং সতর্ক অবস্থায় ভেতরে যায়।
লোকটি তাকে পথ দেখিয়ে বলে,—ওইদিক দিয়ে সোজা এগিয়ে যান।
সে অগ্রসর হতেই লোকটি তাড়াতাড়ি বলে,—একটু দাঁড়ান তো?
থেমে যায় জিৎ।
লোকটি কাছে আসে। চাঁদের আলো ছাড়া অন্য কোনো আলো নেই সেখানে। সেই আলোও সোজাসুজি আসতে পারছে না দু’একটি বড় গাছের জন্যে। তবু জিৎ সিং অস্বস্তি অনুভব করে।
লোকটি তার তলোয়ারের দিকে চেয়ে বলে,–এইরকম একজন অসিধারীকে আমি চিনতাম।
–কেন, এর কোনো বিশেষত্ব আছে নাকি?
—আপনার তুলনায় এটি অনেক বড় নয় কি?
—তা বটে।
—এটি কার?
—কুড়িয়ে পেয়েছি, তাই ঝুলিয়ে রাখি। আসলে এটি হল নিষ্কর্মা।
—আচ্ছা, আপনি যান।
জিৎ সিং এবারে বুঝতে পারে, লোকটি তাকে চিনি চিনি ক’রেও, শেষ পর্যন্ত চিনে উঠতে পারেনি। সে নিশ্চিন্ত মনে অগ্রসর হয়।
খিড়কির পথে অট্টালিকায় পৌঁছতে হলে একটি উদ্যান পার হতে হয়। সেই উদ্যানে ছোট বড় সব রকম গাছই রয়েছে। জিৎ সিং ধীরপদে এগিয়ে যায়। সে জানে না, উদ্যানের মধ্যে অন্য কোনো প্রহরী আছে কি না। থাকলেও, তাকেও নিশ্চয় বশ করেছে মেয়েটি। তবু সে নিঃশঙ্ক চিত্ত হতে পারে না। উধমের উক্তিটি মনে পড়ে তার। উধম উপলব্ধি করেছিল কত বড় ঝুঁকি নিতে চলেছে সে।
গাছের পাতার শব্দে থেমে পড়ে জিৎ। চাঁদের আলোয় যে-কোনো সাদা জিনিসই মানুষ বলে ভুল হচ্ছে, পাতার শব্দ যেন মানুষের পদশব্দ। হঠাৎ একটি গাছের আড়াল থেকে তার হাত চেপে ধরে কে যেন। চমকে অসিটি কোষ থেকে বের করে সে বিদ্যুৎগতিতে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারে। হাতটি কোমল।
—শেষে নারীহত্যা করবেন নাকি?
জিৎ সিং হেসে বলে,—অসম্ভব নয়। মিত্রপুরীতে প্রবেশ করিনি।
—আমি তবে শত্রু?
—না, কিন্তু এত বড় পুরীতে একজন মিত্র যথেষ্ট নয়।
জিৎ সিং দু-পা এগিয়ে বলে,—খিড়কির প্রহরীটিকে কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন?
—খুব সম্মান দিয়ে তো কথা বলছেন আমার সঙ্গে?
—কেন, নিজেকে খুব ছোট বলে ভাবেন নাকি আপনি?
—মোটেই নয়। বাদশাহ আকবর স্বয়ং আমার সঙ্গে প্রায়ই কথা বলেন।
—তবে?
—তবু, এত কাণ্ডের পর এতখানি সম্মান আমি আশা করিনি।
মেয়েটির মনোভাব বুঝতে জিৎ সিং-এর তিলমাত্র দেরি হয় না। বড্ডো তাড়াহুড়ো করছে মেয়েটি। এমনটি সে আশা করেনি। তার মতো পুরুষের সঙ্গে আগে কি কখনো সাক্ষাৎ হয়নি এর? তাও কি সম্ভব? বীরবলের গৃহে মুসলমান ছাড়াও অনেক হিন্দুর যাতায়াত রয়েছে। তারা পদবীতে মোটেই নগণ্য নয়। নগণ্য হলে সামনের ফটক দিয়ে না এসে তার মতো পেছনের খিড়কি দিয়ে আসত। সেই সব হিন্দুদের মধ্যে কি এমন একজন যুবককে দেখেনি মেয়েটি যাকে এইভাবে কাছে ডাকতে পারত?
জিৎ সিং সত্যিই বিস্মিত হয় কথাটা ভেবে। কিংবা নগণ্য লোককে পথ থেকে কুড়িয়ে এনে এইভাবে তুলে ধরতে সে নতুন রকমের আনন্দ পাচ্ছে? হয়তো তাই। তবে এটাই তার পেশা না—এটুকু বুঝতে পারে। মেয়েটি খারাপ ধরনের নয়, বরং ভালোই। লীলাবতীর সঙ্গে যার চেহারার সাদৃশ্য রয়েছে, সে খারাপ হতে পারে না। কিন্তু এইভাবে এগিয়ে যেতে হলে অল্পদিনের মধ্যেই লীলাবতীর ভালোবাসা তার কাছে অসম্মানিত হতে বাধ্য। তা কি হতে দেওয়া উচিত হবে? লীলাবতী তাকে গ্রহণ না করতে পারে, কিন্তু তার ভালোবাসা তো মিথ্যা নয়।
জিৎ সিং-এর মনে দ্বিধা দেখা দেয়। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেই দ্বিধাভাব কাটিয়ে ওঠে সে। সবাই ওপর মেবার—চিতোর। সে হেসে বলে,–বেশ, তুমি যখন চাও না, তখন আর অহেতুক সম্মান দেখাব না তোমায়।
চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় মেয়েটিকে অপূর্ব দেখতে লাগছিল, তার হাসি আরও অপূর্ব বলে মনে হয় জিৎ সিং-এর কাছে। সে হাসিতে লজ্জা জড়ানো।
—আমি কিন্তু অত তাড়াতাড়ি আপনাকে অসম্মান করতে পারব না, মেয়েরা তা পারে না।
তার কথার উত্তর না দিয়ে জিৎ সিং শুধু হাসে। কারণ অন্য কোনো উত্তরই মানানসই হত না। সে বলে,—এখানেই বসি, কি বল।
—হ্যাঁ, জায়গাটা খুবই নিরিবিলি, কিন্তু আমার নাম ধরে তো একবারও ডাকছেন না। আমার নাম জানেন তো আপনি?
—যে নামে সবাই ডাকে তোমায়, সে নামের ওপর আমার বিন্দুমাত্র মোহ নেই।
মেয়েটি অবাক হয়ে জিৎ সিং-এর দিকে চায়।
—তোমার নাম আমি জানি। প্রথম যেদিন দেখলাম সেদিন থেকেই জানি। প্রথম সেই শকটের বন্ধ কপাটের ফাঁকে ওই আঁখি দুটি যখন দেখলাম, তখন থেকেই জানি। সে নাম পৃথিবীর আর কেউ জানে না।
বীরবল-কন্যা ঝুঁকে পড়ে। ঝুঁকে পড়ে জিৎ সিং-এর মুখের কাছে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস জিৎ সিং-এর চিবুক স্পর্শ করে। সে আবেশজড়িত কণ্ঠে বলে,—কী? শুনি।
—প্ৰিয়া।
মেয়েটি কেঁপে ওঠে একটু। জিৎ সিং অনুভব করে সে কেঁপে ওঠে। ঠিক অমনি ভাবে লীলাবতীর মতো শক্ত মেয়েও কেঁপে উঠেছিল একদিন। প্রথম দিন।
মন খারাপ হয়ে যায় জিৎ সিং-এর। অন্যায় করছে সে। কিন্তু সত্যিই কি অন্যায়? একে তো ভালোই লাগছে তার। বেশ ভালো লাগছে। লীলাবতীর সঙ্গে তার জীবনে হয়তো আর সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এর সঙ্গে এর পরেও কতবার দেখা হতে পারে।
সব চিন্তা দূরে ঠেলে ফেলে দিয়ে জিৎ বলে,–এ নাম শুধু তুমিই জানবে, আর কেউ নয়। আর কারও সামনে এ নাম ধরে তোমায় ডাকতে পারব না। আরও কারও সামনে তোমায় চিনতেও পারব না, নামও জানব না।
—সত্যিই তাই। ভেবে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। আর কারও সামনে আমরা মিলতে পারব না।
—কোনোদিনও কি মিলতে পারব না প্রিয়া?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি বলে,—বলতে পারি না।
তার দীর্ঘশ্বাস জিৎ সিং-এর মনে সন্দেহ জাগায়। তবে কি শুধু সখ মেটাবার জন্যে তাকে ডেকে এনেছে এখানে? কোনোদিন মিলনের আশা নেই জেনেও তাকে কাছে ডেকেছে, শুধু ভালো লাগছে বলে? বিশ্বাস হয় না। নিজেকে অসহায় জেনেই বোধহয় একথা বলল সে। নিজের পছন্দ মতো পুরুষ নির্বাচনের অধিকার তার নেই হয়তো। জিৎ সিং-এর চেয়ে সহস্রগুণ বেশি ক্ষমতার অধিকারিণী হয়ে সে অসহায়। সে নারী। তাই জিৎ সিং-কে ভালোলাগা সত্ত্বেও সে জোর ক’রে কিছু বলতে পারছে না। হয়তো ভালোবেসেও ফেলেছে। অন্তত ভালোবাসার প্রথম সোপানে উঠে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু জিৎ সিং দাঁড়ায়নি। ভালো লাগলেও সে ভালোবাসতে হয়তো কোনোদিনও পারবে না। অন্তত লীলাবতীকে যতদিন ভুলতে না পারে। সে শুধু অভিনয় করছে। ভালো লাগছে বলে অভিনয় করছে। এটা ঠিক নয়। আজ আর সে অগ্রসর হবে না। সে একটু সময় নেবে। ভেবে দেখবে, দেশের জন্যে যেমন অজস্র মানুষকে হত্যা করা যায়, তেমনি নারী-হৃদয়কে ভেঙে চুরমার ক’রে দেওয়া যায় কি না।
—অত ভাবছেন কি? নাম ধরে তো ডাকছেন না? আমার নতুন নাম ধরে?
—ডাকব প্রিয়া। কিন্তু আমি ওই খিড়কির প্রহরীর কথাটাই ভাবছিলাম। কোথা থেকে ওকে আনা হয়েছে বললে না তো?
প্রিয়া গম্ভীর হয়। তার মনের মধ্যে ভীষণ রকমের ছন্দপতন ঘটে। তবু জিৎ সিং-এর কথাটাকে উড়িয়ে দিতে পারে না সে। কারণ যত ভাবেই সে রাস্তা পরিষ্কার রাখুক না কেন, এখানে আসায় জিৎ সিং-এর যথেষ্ট বিপদ রয়েছে।
সে বলে,—ওই প্রহরীর সঙ্গে আরও দুজনা ছিল। আগ্রার পথের ধারে একদিন বন্দুক নিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল। বাবা সেই পথে যাচ্ছিলেন। এদের দেখে তাঁর খুব পছন্দ হয়ে যায়। এনে কাজে লাগিয়ে দেন।
—বন্দুক রয়েছে এদের সঙ্গে?
—একজনের ছিল একটি। তবে এখন আর নেই। আগ্রায় বাস করতে হলে যেমন সব ঘোড়ার মাথায় ফুলের ছাপ পড়ে, তেমনি সব আগ্নেয়াস্ত্র তত্ত্বাবধানে রাখতে হয়। বাদশাহ্ বলেন, এদেশে আগ্নেয়াস্ত্র বেশি নেই।
—এরা তিনজনেই পালা ক’রে পাহারা দেয় বুঝি?
—হ্যাঁ। তবে ওদের ভেতরে একজন কিছুদিন হল চলে গেছে। তার নাম ছিল রাম সিং। বেশ উন্নতি করেছে সে। পঞ্চাশজন সিপাহী এখন তার অধীনে।
—কি ভাবে উন্নতি করল?
—খুব সোজা উপায়ে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক’রে ফেলল সে। বাবা নিষেধ করেছিলেন। শুনল না নিষেধ। শুনলাম, এখন তার নাম হয়েছে তফিলউদ্দিন।
—আর দুজন?
—তারা এখনো ধর্ম ছাড়তে পারেনি। তফিলউদ্দিন অনেক চেষ্টা করেও তাদের ধর্ম ছাড়াতে পারেনি। তাই এখানেই পড়ে রয়েছে। নইলে তাদেরও উন্নতি হত। কারণ ওরা তিনজনই পাকা নিশানী।
—কোথাকার লোক ওরা?
—সেকথা জিজ্ঞাসা করলে, মিথ্যে কথা বলে। তবে বাবা অনেক জেরা করে বুঝে ফেলেছেন। ওরা আমাদেরই দেশের লোক, মানে বাবার দেশের লোক। কালপী। কিন্তু চিতোরে ছিল বহুদিন।
জিৎ সিং-এর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। আজ খিড়কির দরওয়াজায় রাম সিংও থাকতে পারত। সে থাকলে এক নজরে চিনে ফেলত জিৎ সিংকে। চিনলে কিছুতেই ছাড়ত না। একটা গোলমালের সৃষ্টি করত তাকে বিপদে ফেলবার জন্যে।
ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন বলতে হবে যে রাম সিং চলে গেছে এখান থেকে। তার সঙ্গী তাকে সন্দেহ করলেও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি। চিনলে ওভাবে প্রশ্ন করত না। কিন্তু আজ সে না চিনতে পারলেও পরের দিন চিনবে, সেদিনেরও যদি না চেনে তার পরের দিন ঠিকই চিনবে। এরা মানুষের চেহারা অত সহজে ভুলে যায় না। বিশেষ করে শত্রুকে এরা ভালোভাবেই চিহ্নিত করে রাখে। উদয়সাগরের তীর থেকে বহু দূরে আগ্রা নগরীতে বীরবলের মতো ব্যক্তির খিড়কির দুয়ারে তারই একমাত্র সুন্দরী কন্যার আহ্বানে মধ্য রাতে উপস্থিত এক দুঃসাহসী যুবককে সে জিৎ সিং বলে কল্পনা করতে পারেনি বলেই হিসাবে একটু গরমিল হয়ে গেছে। কিন্তু এই গরমিল বেশি দিন থাকবে না।
অস্বস্তি অনুভব করে জিৎ। সে উঠে দাঁড়ায়।
—ওকি, আপনি এর মধ্যেই চলে যাবেন?
—ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনে হয়, আজকে বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো প্রিয়া। প্রিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কী যেন বুঝতে চেষ্টা করে সে জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে
—ভুল বুঝো না প্রিয়া। আমার মনে হয় তোমার প্রহরী খুব বিশ্বাসী নয়।
—এই কথা? তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এদের তিনজনের মতো বিশ্বাসী লোক বাবা খুব বেশি পাননি। তাছাড়া ওরা বোঝে, আগ্রায় বাস করে বীরবল-কন্যাকে চটিয়ে কোনো লাভ নেই। তাতে এখানে থাকবার পরমায়ু শুধু কমে যাবে। কারণ আমাকে স্বয়ং বাদশাহ্ স্নেহ করেন।
—তোমার কথা খুবই সত্যি প্রিয়া। তবু যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না। আজ বরং আমি যাই। তুমি এদের ভালোভাবে পরীক্ষা ক’রে নাও আগে। কারণ খিড়কির পথ দিয়ে বাইরে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথাটাকে ঘাড় থেকে আলাদা ক’রে দেবার মতো ইচ্ছা আপাতত আমার নেই।
প্রিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,—চলুন।
—তুমি কোথায় যাবে?
—আপনার সামনে প্রহরীর সঙ্গে কথা বলব।
—না, প্রিয়া। সেটা ঠিক হবে না। অমন প্রকাশ্যে ওসব করতে নেই।
—তবে আপনি যেতে পারবেন না। থাকতে হবে আপনাকে। থাকতেই হবে।
এতক্ষণে জিৎ সিং বুঝতে পারে, লীলাবতীর সঙ্গে এই মেয়েটির পার্থক্য। অনেক সাদৃশ্যের মধ্যেও এই পার্থক্যটুকু উভয়ের স্বভাবকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ প্রদান করেছে। লীলাবতী স্বভাবতই তেজী, সরল ঋজু। কিন্তু প্রেমের বেলায় সে লাজুক, সে কোমল সে নমনীয়। তখন ভুলে যেতে হয় ওই লীলাবতীই ছোরা খেলায় পারদর্শিনী, অশ্ব চালনায় সে দক্ষ, দেহের শক্তি তার অনেক পুরুষের চেয়ে বেশি। কিন্তু এই মেয়েটি? প্রথম দর্শনে লাজুক, ভীরু। জীবনে কখনো দেহচর্চা করেছে বলে মনেও হয় না। সুখ আর ঐশ্বর্যের মধ্যে বড় হয়ে উঠে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে মাত্র। সেই সৌন্দর্যে লীলাবতীর দেহের মতো প্রখরতা নেই, রয়েছে কমনীয়তা। কিন্তু প্রেমের ব্যাপারে সে নির্লজ্জ, সে মরিয়া। প্রথম দিনের পরিচয়ে লীলাবতী কখনো তাকে নিজের বাড়িতে আহ্বান করার কথা ভাবতে পারত না, গোপন আহ্বান তো দূরের কথা। কিন্তু এই মেয়েটির পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। কারণ সে নিশ্চয় এমন ঘটনা আগেও দেখেছে। শুনেছেও। লীলাবতী সাধারণ এক সর্দারের মেয়ে। কিন্তু প্রিয়া হল বীরবলের মেয়ে, যে-বীরবল দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ ক’রেও ভাগ্যগুণে আজ বহুদুর উঠে গেছে। এই এক জীবনে এতটা যে ওঠে, তার মধ্যে ক্ষমতাপ্রিয়তা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। বীরবল যত ভালো লোকই হোক না কেন, তার মধ্যে ক্ষমতার লালসা রয়েছে কিছু না কিছু। তারই ছোঁয়াচ লেগেছে এই মেয়েটির স্বভাবে। তাই যে-প্রেমের বেলায় অতি সাবধানে, অনেক ভয়ে ভয়ে ভিক্ষার পাত্র নিয়ে বিনীতভাবে অগ্রসর হতে হয়, সেখানে মেয়েটি আজ মাথা উঁচু ক’রে এগিয়ে এসেছে দখল করে নিতে। তাই জিৎ সিং চলে যেতে চাইলে, সে যেতে দেয় না। থাকবার জন্যে অনুরোধ না ক’রে, জোর করে। যাকে সে প্রেমিক বলে ভাবতে চায় তার মনের দিকে একবারও দেখতে চেষ্টা করে না।
জিৎ সিং মনে মনে তার কর্তব্য ঠিক ক’রে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। একটু আগে চাঁদের আলোর মধ্যে যার হাসি দেখে সে লীলাবতীকে ভুলতে বসেছিল, এখন তার উগ্ররূপ দেখে ব্যথিত হয়। এই সৌন্দর্যের সঙ্গে এই স্বভাবের আকাশপাতাল তফাত। দুঃখ পায় জিৎ সিং। দুঃখ পায় কারণ সে নিজেও জানে না অবচেতন মনে সে লীলাবতীকে ভুলতে ক্রমাগত চেষ্টা ক’রে চলেছে। কাউকে আশ্রয় করতে চাইছে তার মন। এই মেয়েটি তাই তার অজ্ঞাতে তার মনের গভীর কোণে সামান্য একটু আশার আলো জ্বালিয়ে তুলেছিল। সেই আলো নিভে যেতে বসেছে।
আর নিভে যেতে বসেছে বলেই কর্তব্য ঠিক ক’রে নিতে কিছুমাত্র বিলম্ব হয় না তার। অভিনয় করবে সে। হ্যাঁ, অভিনয়ই করবে। আগাগোড়া অভিনয়। এর জন্যে যতদূর যেতে হয় যাবে সে। কারণ যেদিন মেয়েটি বুঝতে পারবে আসল সত্য, সেদিন রাগে দুঃখে জ্বলে উঠলেও জীবন তার ব্যর্থ হয়ে যাবে না। যেতে পারে না। কারণ প্রকৃত ভালোবাসা কখনো ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে আসে না। মেয়েটি ভাবছে, সামনের এই যুবকটিকে সে ভালোবাসে। কিন্তু আসলে তা নয়। সে প্রকৃত ভালোবাসার খোঁজ পায়নি বলেই এমন ভাবছে।
জিৎ সিং মেয়েটিকে বাঁ হাতে পাশে টেনে নিয়ে বলে,–তোমার আদেশ শিরোধার্য প্রিয়া। আমি থাকব।
খুশির হাসি হেসে ওঠে প্রিয়া। জিৎ-এর তলোয়ার ধরে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে,—তবে চলুন। ঘরে যাই।
ইতস্তত করে জিৎ সিং বলে,—কিন্তু এখানেই তো বেশ ভালো ছিল।
—না।
—আচ্ছা চল।
চলতে চলতে মেয়েটি বলে,—আপনি সব ব্যাপারে অত আপত্তি করেন কেন বলুন তো?
—আপত্তি করলে যে তুমি জোর কর। আমার খুব ভালো লাগে।
—আমারও।
—কি?
জোর করতে ভালো লাগে।
—লাগবেই।
—জানতেন?
—জানবো না? এই জন্যেই তো আমরা তোমাদের ক্রীতদাস হয়ে আছি। বিশেষ করে তোমার মতো রূপসীদের।
এবার খিলখিল ক’রে হেসে ওঠে প্রিয়া। জিৎ সিং-এর ডান হাতখানা বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে সে বলে,—কী সুন্দর কথা বল তুমি।
ডান হাতের আহত স্থানে ব্যথা পায় জিৎ সিং। ঘা এখনো সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়নি। তার মুখখানা সামান্য একটু বিকৃত হয় ব্যথায়। চাঁদের আবছা আলোয় প্রিয়া দেখতে পায় না সে মুখ। জিৎ সিং ঢোক গিলে ব্যথাকে হজম ক’রে নিয়ে বলে,—এবার আমার সম্মান রাখলে না তো।
হাত ছেড়ে দিয়ে প্রিয়া দাঁড়িয়ে বলে,—একথা বললে কেন?
—’আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’তে এলে।
প্রিয়া জিৎ-এর পাশে সরে এসে বলে—মন খারাপ হল বুঝি?
—না। আনন্দ হল।
—কতখানি?
—এখান থেকে ওই চাঁদ অবধি।
—আমরা যখন প্রথম অসম্মান করি, তখন নিজেরাও বুঝতে পারি না। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে যায়। তাই বোধহয় তোমরা আনন্দ পাও
—এত সব জানলে কি ক’রে?
—শুনেছি। এ-বাড়িতে অনেক মহিলা আসেন। হারেম থেকেও এসেছেন দু-একজন।
ওরা দুজনা সোপানে পা দিতেই একজন ভীত-চকিত দাসী ছুটে আসে। খবর দেয় বীরবল এসে পৌঁছেছেন এইমাত্ৰ।
প্রিয়ার মুখও যেন বিবর্ণ হয়ে যায় কথাটা শুনে। সে জানে তার পিতা এসে প্রথমেই তাকে খুঁজবে। তারই কক্ষে যাবে। এই অসময়ে তার অনুপস্থিতির কোনো কারণ দেখানো সম্ভব নয়। এতক্ষণে হয়তো তার কক্ষে গিয়ে তাকে না দেখে বিস্মিত হয়েছে, চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে, ক্রোধান্বিত হয়েছে বীরবল। কারণ ঘুম থেকে জাগিয়েও বহুবার তাকে শিকারে নিজের ও বাদশাহের কৃতিত্বের কথা বলেছে তার পিতা। আজ রাতে ফিরে আসবার কোনই সম্ভাবনা ছিল না বীরবলের। তাই জিৎ সিং-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সে।
জিৎ সিং-এর গলা জড়িয়ে ধরে ব্যস্ত হয়ে সে বলে,—আজ তুমি যাও। এক্ষুনি চলে যাও।
জিৎ সিং একমুহূর্ত অপেক্ষা না ক’রে ছুটে চলে আসে খিড়কির কাছে। প্রহরী গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেলে। প্রেমিকের এই দুর্দশা দেখে সবারই হাসি পায়। জিৎ সিং-এর ব্যস্ত ভাব দেখে সে অনুমান করেছিল ব্যাপারটা। জিৎ সিং দেখেও দেখে না তার হাসি। এর সামনে যত কম থাকা যাবে, এর সঙ্গে যত কম কথা বলা যাবে ততই মঙ্গল। নইলে চিনে ফেলবে। একবার চিনতে পারলে বিপদ ঘটবেই।
প্রহরী কপাট খুলে দেখার আগে, আর একবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করে। চাঁদের আলোকে সূর্যকিরণের মতো তীব্র বলে বোধহয় জিৎ সিং-এর কাছে। সে মুখটি একপাশে ঘুরিয়ে অন্যমনস্ক হবার ভাব করে বিকৃত স্বরে বলে,—খুলে দাও।
—আবার ফিরে আসবেন কি?
—আজ নয়।
প্রহরী খুলতে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,—এটা যদি আগ্রা না হত তাহলে আর একজন ভেবে আপনাকে খুন ক’রে ফেলতাম।
—অমন হয়।
জিৎ সিং কপাটের বাইরে এসে দ্রুতগতিতে চলতে থাকে।
.
জয়মল্ল আর পট্টের মূর্তি দুখানি আগ্রার কিল্লার দুইপাশে দুই বেদি নির্মাণ ক’রে তার ওপর স্থাপন করতে সময় নিল তিন মাস। শিল্পী নিজে এসে বেদি করল পাথর কেটে। আশেপাশের উৎসুক জনতাকে কাছে আসতে না দেবার জন্যে স্থানটিকে ঘিরে দেওয়া হল। শিল্পী যাতে একমনে কাজ করে যেতে পারে।
তারপর একদিন কাজ শেষ হল। সেদিন বাদশাহ্ প্রথম এসে দেখলেন মূর্তি দুটিকে। দেখে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন। আমীর ওমরাহরাও দেখল। তাদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন বাদশাহের মতো খুশি হল।
আগ্রার পথচারীরা বিস্ময়ে চেয়ে রইল মূর্তি দুটির দিকে। বেদির উচ্চতা আর দূরত্ব সে দুটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে। বীরত্বপূর্ণ তেজস্বী অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে দুই প্রস্তর নির্মিত মুখমণ্ডলে পৃথিবীর সমস্ত শক্তিকে তুচ্ছ করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও দুটি।
আগ্রাবাসী সমস্ত রাজপুত গিয়ে দেখল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
জিৎ সিংও গেল দেখতে। বহুক্ষণ ধরে চেয়ে চেয়ে দেখল সে। সেদিন বলদের গাড়ির ওপর শোয়ানো মূর্তি দুটিকে দেখে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু আজ দেখল মুখের প্রতিটি রেখা কী অপূর্ব কৌশলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পট্টের মুখখানি কত কচি। অথচ এই কচি মুখে কী তেজস্বীতা। যেন আগুন চাপা রয়েছে ওতে। কোথায় পেল শিল্পী এই মুখ। কে তাদের দেখালো? সে নিজে তো এদের কাউকেই দেখেনি। তবে? আকবর শাহের বর্ণনার সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে এমন জিনিস কি নির্মাণ করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব। নইলে নাম তার শিল্পী হবে কেন? শিল্পীরা তো রানা নয়, বাদশাহ্ও নয়। কিন্তু তারাই সব।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একসময় মনে হয় জিৎ সিং-এর—সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। উদয়সাগর থেকে এতদূর ছুটে আসার কোনো অর্থই রইল না আর। পরাস্ত করার পরও যে-ব্যক্তি শত্রুকে এতখানি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে তার বিরুদ্ধে মনের মধ্যে কোনো বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করা বৃথা। বাদশাহ্ আকবরকে কোনো দিনই হয়তো সে আর ঘৃণা করতে পারবে না। তাঁর কোনোরূপ ক্ষতি করা কোনোদিনই হয়তো আর তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই যদি হয়, তবে কেন অকারণ পড়ে থাকবে সে আগ্রায়। সে ফিরে যাবে লীলাবতীর কাছে। এখনো হয়তো সময় আছে। এখনো হয়তো লীলা তাদের উভয়ের মধ্যে প্রাচীর তুলে দেয়নি।
ঠিক সেই সময়ে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর একখানি মুখ। রানা উদয় সিংহের পুত্র কিকার মুখ যেন সে দেখতে পায়। যে দুর্বলতা তাকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলেছিল ধীরে ধীরে, সেই দুর্বলতা মুহূর্তের মধ্যে কেটে যায়। সে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। আকবর শাহ্ যত সম্মানই দেখিয়ে থাকুক না কেন, চিতোরকে তিনি সেই সম্মানের প্রমাণস্বরূপ কখনো মুক্তি দেবেন না। শত শত রাজপুতের মূর্তি গড়ে তুললেও, সমস্ত মেবারকে কুক্ষিগত করবার প্রথম সুযোগ তিনি কখনই হাত ছাড়া করবেন না।
মূর্তি দুটির সামনে দাঁড়িয়ে যখন জিৎ সিং-এর মনে এই সমস্ত চিন্তা ভেসে ভেসে উঠছিল ঠিক সেই সময়ে কে যেন তার পিঠে হাত রাখে। মুখ ফিরিয়ে সে তার পরিচিত উটওয়ালাকে দেখতে পায়। উটওয়ালার চোখে জল।
—কাঁদছ কেন ভাই? জিৎ সিং প্রশ্ন না করে পারে না।
—কেন কাঁদছি। কান্না পেয়ে গেল, তাই
—বিবির মেজাজ বুঝি খুব কড়া আজ?
—না। সে কড়া হতে মোটেই জানে না। তার স্বভাবই তেমন নয়।
—তবে?
উটওয়ালা চোখের জল মুছে নিয়ে বলে,—তুমি মাথা ঝাঁকাচ্ছিলে কেন একা একা দাঁড়িয়ে?
—জানি না তো, বোধহয় কিছু ভাবছিলাম।
—আমিও ভাবছিলাম। তুমি যেমন মূর্তি দুটির দিকে চেয়ে আপন মনে ভাবছিলে, আমিও তেমনি ভাবছিলাম। হঠাৎ চোখে জল এসে গেল।
—কেন এমন হল আব্বাস খাঁ।
—নামটি আমার আব্বাস খাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম সেকথা। সব ভুলে গিয়েছিলাম। একবার চেয়ে দেখ দেখি ওই মূর্তি দুটির দিকে—ছেলেবেলা থেকে যে-মূর্তি কল্পনা ক’রে এসেছ, তার সঙ্গে মেলে কি না? একজন খাঁটি রাজপুতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সবটুকুই কি ওই দুটি মুখের মধ্যে, ওই দৃপ্তভঙ্গির মধ্যে ফুটে ওঠেনি?
বিহ্বল জিৎ সিং ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে জানায়, হ্যাঁ।
—তবে, তবে কেন প্রশ্ন করছ কাঁদছি কেন? সবাই কি তোমার মতো পাগল যে শুকনো চোখে শুধু শুধু মাথা ঝাঁকাবে?
জিৎ সিং এবারে আব্বাস খাঁয়ের একখানি কর্কশ হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, —এতই যখন ভালোবাস রাজোয়ারাকে, তখন ধর্মকে ছাড়লে কেন?
—এসব আবেগ বেশিক্ষণ থাকে না ভাই, বেশিক্ষণ থাকে না। একটু পরেই মিলিয়ে যায়। তখন আবেগে পেট ভরবে না। পেট ভরাতে চাও, মুসলমান হতেই হবে, আগ্রায় আসতেই হবে। কেন, তুমি আসোনি?
—এসেছি।
—হ্যাঁ, এই তো তিন চারমাস হল এসেছ। আরও কিছুদিন কাটুক, বুঝতে পারবে। দেখবে, বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। তখন তুমিও হবে জব্বর খাঁ। অনেক তো দেখলাম।
জিৎ সিং নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে।
আব্বাস খাঁ সহসা প্রসঙ্গ বদলে বলে ওঠে,—ভালো কথা, তোমায় আমি অনেক খুঁজেছি, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে হয়রান হয়েছি।
—আমাকে হঠাৎ খুঁজলে কেন?
—খুঁজবো না। তাহেরের পাত্তা যেদিন তোমায় জানালাম, সেদিনই সে হাতের আঙুলগুলো খোয়ালো। জাফরের মতো মরদও ঘায়েল হল, শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। বুঝতে বাকি রইল না কার কীর্তি ওসব। শুনলাম ঘোড়াটিকেও ওরা রাখতে পারেনি। আশ্চর্য! এই দেহে এত শক্তি দেখলে মনে হয় না। কেউ যদি রাতের বেলায় তোমায় দেখে ভাববে বুঝি চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে। সত্যি বলছি, তুমি নিজেই জানো না, কতখানি অসম্ভবকে সম্ভব করেছ তুমি। শুধু শক্তি থাকলে অমন হয় না, বুদ্ধিও থাকা চাই। তোমার ভাই তুলনা নেই। তোমার সম্বন্ধে আমার ধারণা পালটে গেছে।
—ওসব কথা থাক।
—থাকবে কেন? তোমার জন্যে আমার গর্ব হচ্ছে, রীতিমতো গর্ব। বেঁচে থাকলে তুমি একজন সাঙ্ঘাতিক লোক হবে বলে দিচ্ছি। এইবেলায় মুসলমান হয়ে যাও, তোমার উন্নতি কেউ আর রুখতে পারবে না।
—তোমার উপদেশ আমার মনে থাকবে আব্বাস। তুমি সত্যিই আমার হিতাকাঙ্ক্ষী।
—কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি, ওরা তোমায় ছাড়বে না। আমি রহিমবক্সের কথা বলছি। তার দল তোমায় শাস্তি দেবার জন্যে ওত পেতে বসে আছে। প্রতি পদে তোমার বিপদ, খুব সাবধান। কোথায় থাকো আজকাল।
সেই সরাইখানাতেই।
—আমি প্রথম দিনে তোমায় যেখানে যেতে বলেছিলাম?
—হ্যাঁ।
—হা ঈশ, মানে আল্লা। অথচ তোমার জন্যে আমি কোথায় যাইনি বল।
—রহিমবক্সের দলের এত খবর রাখো, অথচ আমি কোথায় থাকি জানতে পারনি?
—তাদের সঙ্গে কি আমার দোস্তি আছে? তাদের দলের একজনের সঙ্গে একটু পরিচয় রয়েছে। সে-ই মাঝে মাঝে এসে যা বলে শুনি। হ্যাঁ, ভালো কথা। আমার একটা ছেলে হয়েছে।
—তাই নাকি! খুব আনন্দ হল, সত্যিই খুব আনন্দ হল।
উটওয়ালা হাসে। সে আর একবার মূর্তি দুটির দিকে দৃষ্টিপাত করে, হাত তুলে সেলাম জানায় তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। একটু দুরেই তার উটটি বাঁধা রয়েছে।
জিৎ সিংও চলতে শুরু করে। কোথায় যাবে, বুঝতে পারে না সে। পৃথ্বীরাজের গৃহে কিছুদিন যাওয়া হয়নি। বীরবল-কন্যার সঙ্গেও দেখা হয়নি কয়েকদিন হল। প্রথম দিনের পর আর মাত্র চার পাঁচদিন সাক্ষাৎ হয়েছে দুজনার মধ্যে। তার মধ্যে একদিন শুধু সে গিয়েছিল ওদের গৃহে। সেদিন খিড়কির পথে অন্য প্রহরী ছিল। সেদিন বীরবল সত্যিই বাড়ি ছিলেন না। সেদিন প্রিয়া নিজেকে উজাড় ক’রে দিয়েছিল। কিন্তু সে ঘটনাও অনেকদিন হতে চলল।
তারপর উধম এসেছিল একদিন সরাইখানায়। সেখানে এসে জানিয়েছিল, প্রিয়ার চোখের কোলে নাকি সামান্য কালির ছোঁয়াচ দেখা যায়। প্রিয়া নাকি পৃথ্বীরাজের বাড়িতে প্রবেশ ক’রেই কেমন হতাশ হয়ে যায়। তারপর যতক্ষণ থাকে সেখানে, বার বার পথের দিকে দৃষ্টি ফেরায়।
শুনতে মন্দ লাগে না জিৎ সিং-এর। প্রিয়ার মধ্যে বোধহয় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। হয়তো সে সত্যিই ভালোবাসতে শুরু করেছে জিৎ সিং-কে। কিংবা তার জেদী মন জিৎ সিং-এর অবাধ্যতায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কোটি সত্যি, বুঝে ওঠা কঠিন।
ভাবতে ভাবতে চলতে চলতে একসময় সে পৃথ্বীরাজের গৃহের সামনে এসে পৌঁছোয়। উধম দাঁড়িয়েছিল যথারীতি দ্বারের সম্মুখে।
সে বলে,—আপনার কথাই ভাবছিলাম। এইমাত্র রাজা খবর আনলেন, কাল প্রত্যুষেই বাদশাহ্ রণথম্ভোরে রওনা হবেন, আর দেরি করবেন না।
—জিৎ সিং চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
ভবঘুরে এতদিনে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে সেখানে। সাধ্যমতো আয়োজনও শুরু হয়ে গেছে সেখানে। এককালের বিখ্যাত চৌহান বংশের রাজা আজ মুঘল বাদশাহের জন্যে উদ্বিগ্ন। রাতে তাঁর ঘুম নেই। ভবঘুরে পৌঁছে যাবার পর থেকেই বোধহয় নিদ্রাদেবী বিদায় নিয়েছেন তাঁর কাছ হতে। ইতিহাসের চাকা এইভাবেই ঘোরে, আরও ঘুরবে। তখন এই মুঘল বংশও থাকবে না আর। অন্য কোনো জাতি কিংবা অন্য কোনো লোক দখল করে বসবে সারা ভারতবর্ষ। এরই নাম গতি—ইতিহাসের গতি।
জিৎ সিং-এর আফসোস হয় খবরটা শুনে। অশ্বটিকে সে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। নিয়ে গেলে তারও কপালে ফুলের ছাপ পড়বে। অন্য কোনো রাজপুত রাজার অশ্ব হলে কোনো কথা ছিল না। তাঁদের একটি ঘোড়াও অচিহ্নিত নেই। কিন্তু কিকার ঘোড়াকে সে অমন হতে দিতে পারে না। কিকা স্বাধীন। জিৎ সিং-এর দৃঢ় বিশ্বাস উদয় সিংহ যাই করুক না কেন, কিকা কখনো কিছুতেই কারও অধীনে থাকতে পারেন না। তিনি চিরস্বাধীন, তাই তাঁর অশ্বটিও স্বাধীন। দাসত্বের ছাপ তার দেহে এঁকে দিতে পারে না সে।
—উধম সিং, আমিও তো যাব সঙ্গে। তুমি ঘোড়াটিকে যত্নে রেখো, ফিরে এসে এটি আমি নেব।
—রানীমার সঙ্গে দেখা করবেন না?
—সন্ধ্যাবেলা আসব আবার।
জিৎ সিং-এর মনে তখন অন্য চিন্তা। ইতিমধ্যে সে মান সিংহের সঙ্গে অনেকবার দেখা করেছে। ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে কিছুটা। প্রভু-ভৃত্যের ঘনিষ্ঠতা, তবু নিজের ব্যবহারে মান সিংহের মনকে সে অনেক নরম ক’রে ফেলেছে এটুকু জানে। এর সুযোগ নিতে হবে। রণথম্ভোরের পথে এই ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়িয়ে তুলতে হবে। বিশ্বাসের সৃষ্টি করতে হবে।