আগ্রা – ৪

৪.

সরাইখানায় প্রবেশের মুখে ছোকরা চাকরটির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় জিৎ সিং-এর। চাকরটি আভূমি নত হয়ে জিৎকে প্রণাম জানায়। অবাক হয় সে। হঠাৎ রাতারাতি ভক্তি-বৃদ্ধির কারণ বুঝতে পারে না। কারণ ইতিপূর্বে কোনোদিন প্রণাম করা দূরে থাক, ডাকলে কাছেও আসতে চাইত না মাধব একটা তাচ্ছিল্যভাব ফুটে উঠত তার মুখে।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে চাকরটি একবার তার মুখের দিকে, আর একবার তলোয়ারের দিকে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলে সে কারণটি। রহিমবক্সের দলের দুর্দশার খবর পৌঁছে গেছে এখানে। তাই সমীহ করতে শুরু করেছে।

ভেতরে ঢুকতেই মালিক এগিয়ে আসে একগাল হাসি মুখে মাখিয়ে নিয়ে। সে গদগদ হয়ে বলে,—কাল রাতে আপনার জন্যে কী দুর্ভাবনাই হয়েছিল। কোনোদিন তো বাইরে থাকেন না রাতে।

জিৎ সিং মালিককে আমল না দিয়ে বলে,—কাল বাইরে থাকবার কারণ ঘটেছিল।

—সে তো নিশ্চয়ই। নইলে—। থাকগে ওসব কথা। আমি আপনার জন্যে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি ঘরে। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই ক্লান্ত।

—হ্যাঁ। তাই দাও।

মালিক চলে যেতে গিয়েও থেমে যায়। বলে,—একজন লোক এসেছিল খোঁজ করতে আপনার। আপনি এখানে থাকেন কি না জিজ্ঞাসা করছিল।

—কি বললে তাকে?

—বললাম থাকেন।

—বেশ করেছ। এবারে খাবারটা পাঠিয়ে দাও।

জিৎ সিং এতদিন মালিককে সম্মান দেখাত। আজ তার দিন পালটেছে। মালিক তাকে গুরুত্ব দেওয়ায় সে মালিককে নীচে নামিয়ে দেয়।

মালিক আবার বলে,–লোকটি একা আসেনি। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। মনে হয় গাড়িতে কোনো মহিলা ছিলেন। লোকটি বলল,–সে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি থেকে এসেছে। আপনি এসেই যেন সেখানে চলে যান।

—আদেশ?

—না। ঠিক সেইভাবে বলেনি। রীতিমতো অনুরোধ করেছিল।

—আমি কোথাও যাবো না এখন।

—ঠিকই তো, ঠিক।

মালিক চলে যায়। জিৎ সিং নিজের ঘরে ঢোকে। সেখানে শয্যার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বোজে সে। মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা। সব চিন্তাই এক সঙ্গে জট পাকিয়ে যায়। কোটি আগে ভাববে বুঝে উঠতে পারে না। ইসলাম খাঁর স্ত্রীর মুখখানা সে ভুলতে পারছে না। ভুলতে পারছে না তার শিশুপুত্রের আধো আধো কথা। বৃদ্ধের ব্যাকুলতাভরা ঘোলাটে দৃষ্টি কী করুণ।

ওদিকে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের স্ত্রী খবর পাঠিয়েছে। যেতে বলেছে তাকে। নিজেও নাকি এসেছিল। রাখীবন্ধন ভাই-এর প্রতি তার একান্ত অনুরোধ।

সে যাবে না, কেন যাবে? আবার হয়তো সেই পরিচারিকাদের সঙ্গে দেখা হবে। আবার হয়তো অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হবে।

কিন্তু না যাওয়া কি ভালো হবে? একমাত্র রাঠোরের মাধ্যমে, তাঁরই আনুকূল্যে সে মুঘল দরবারের সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। রাঠোরের রানীর সঙ্গে সম্পর্ক হারালে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি, মান-অপমান আর উচ্ছ্বাসের স্থান এখানে নেই। এ-সবের চেয়ে চিতোর অনেক বড়, চিতোরই সব।

সে যাবে। সে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি যাবে।

রহিমবক্সের কথা মনে পড়ে জিৎ সিং-এর। আজ হয়তো সে চুপ ক’রে গালে হাত দিয়ে ভাবছে। প্রতিহিংসা গ্রহণের চেষ্টা সে করবেই। তার প্রতিহিংসা গ্রহণ করতে হলে, তারই শাকরেদ এই সরাইখানার মালিকের সাহায্য গ্রহণ সব চাইতে সুবিধের। রাতের বেলায় দলবল নিয়ে এখানে আসতে পারে রহিমবক্স যে-কোনোদিন। একা তাদের সবার বিরুদ্ধে অসাবধান অবস্থায় রুখে দাঁড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে। এই সরাইখানা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দেওয়া উচিত। আজ ছাড়তে পারলে সব চাইতে ভালো হয়।

খাবার এসে যায়। জিৎ সিং বাইরে গিয়ে হাতে মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর গোগ্রাসে খাবার খায়। যেন বহুদিন ধরে অনাহারে ছিল সে।

খাবার খেয়ে বাইরে বের হয়ে যায় সে। সরাইখানার মালিক ছুটে আসছিল, তাকে কথা বলবার অবকাশ না দিয়ে সে রাস্তায় নেমে পড়ে। হাতের ব্যথাটা একটু বেড়েছে যেন। আর একবার হাকিমকে দিয়ে দেখিয়ে নিলে ভালো হত। কিন্তু হাকিমের বাড়ি সে চেনে না। আগ্রায় এসে হাকিম বৈদ্যের দরকার হবে তার, একথা ভাবেনি সে। ভাবলে তাদের আস্তানার খবর জেনে রাখত।

পথ চলতে চলতে আকবর শাহের কথা ভাবে জিৎ সিং। ‘মুশকিল আসান’-এর দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অদ্ভুত মানুষ এই বাদশাহ্। অদ্ভুত আর অপূর্ব।

পেছনে শকটের শব্দ হয়।

মুখ ফিরিয়ে দেখে শকটের সামনে উধম সিং বসে। তাকে দেখতে পেয়ে উধম সিং-এর মুখ হাসিতে ভরে যায়। কাছে এসে সে বলে, যাক, আপনাকে পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। এইভাবে কাল সারারাত রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। শুধু আমি একা নই, রানীও।

—রানীও, সত্যি!

—হ্যাঁ, তাঁর মুখখানা দেখে কষ্ট হচ্ছিল। আমি কথা দিয়েছি আপনাকে খুঁজে বের না করে জলস্পর্শ করব না। আমি রাজপুত। কথার খেলাপ করিনি। পিপাসায় ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। এবারে প্রাণভরে জল খাবো।

—এখনো আমায় খুঁজছিলে তুমি?

—হ্যাঁ। ভোরবেলায় আপনার সরাইখানায় গেছলাম আর একবার। দেখলাম আপনার ঘর বন্ধ। মালিককে আর জানাইনি। কাল রাতে যখন গেছলাম রানীও সঙ্গে ছিলেন।

—তুমি রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছ আমাকে?

—বলতে গেলে তাই। তবে এখন আসছি বীরবলের বাড়ি থেকে। উঠে আসুন আমার পাশে।

—কেন ভেতরেই বসি।

উধম চঞ্চল হয়ে ওঠে। ইঙ্গিতে জানায়, ভেতরে মহিলা আছে।

—তুমি চলে যাও উধম, আমি হেঁটে যাচ্ছি।

সেই সময়ে শকটের দ্বার খুলে যায়। ভেতর থেকে দুটি কাজলকালো আঁখি দেখা যায় ওড়নায় ঢাকা।

উধম শকট নিয়ে চলে যায়। জিৎ সিং ধীরে ধীরে চলে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের গৃহাভিমুখে। ভাবে, বীরবলের বাড়ি থেকে যাচ্ছে উধম। মহিলা রয়েছে শকটে, নিশ্চয়ই বীরবলের কেউ হবে।

রানীর কাছে বীরবলের বাড়ির মেয়েদের যাতায়াত আছে তবে। সুখবর বলতে হবে। কারণ আকবর শাহের সঙ্গে বীরবলের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। অনেকে বলে, ঘনিষ্ঠতম। ওই একটি মাত্র মানুষকে নাকি তিনি সব সময়ই কাছে রাখেন। শুধু হারেমে যাবার সময়টুকু ছাড়া। বীরবলের সঙ্গে পরিচয় হলে যথেষ্ট লাভ।

হাতের ব্যথার কথা ভুলে যায় জিৎ সিং। পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ির ভেতরে সে প্রবেশ করে। রানী দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে, তার পাশে শকটের সেই রমণীকে দেখতে পায় না জিৎ সিং। নিশ্চয়ই ভেতরে রয়েছে। একজন অপরিচিত পুরুষের সামনে কখনই আসবে না সে।

জিৎ সিংকে দেখেই রানী ছুটে আসে। ভুলে যায় সে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের স্ত্রী, ভুলে যায় তার লোকজন দাঁড়িয়ে দেখছে।

জিৎ সিং রানীর চোখে অশ্রু দেখতে পায়। অশ্রু দেখে তার রাগ অভিমান সব অদৃশ্য হয়ে যায়। সে হেসে ডাকে,–বোন।

রানী ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে—তোমায় ওরা কাল তাড়িয়ে দিয়েছে। তোমার গায়ে রক্ত দেখেও তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি নিজেকে ক্ষমা করব কেমন ক’রে জিৎ?

—ওরা আমায় চিনত না।

—না চিনলেও, একবার ডাকতে পারত আমায়। বলতে পারত, কী পরিচয় তুমি দিয়েছ। ওদের আমি শাস্তি দেব।

—না বোন, ওরা ঠিক কাজ করেছে। ওরা ওদের কর্তব্য করেছে। মুঘল বাদশাহের রাজধানীতে নানান চরিত্রের মানুষ ঘোরাফেরা করে। কার কী উদ্দেশ্য কেউ বলতে পারে না। এখানে কাউকেই সহসা বিশ্বাস করতে নেই। তোমার স্বামী বাদশাহের প্রিয় হতে পারেন, কিন্তু বাদশাহের এই পক্ষপাতিত্বের জন্যে তিনি কত লোকের চক্ষুশূল হয়েছেন, কেউ কি তা বলতে পারে? তাই বলছি, তোমার পরিচারিকারা ভুল করেনি। তোমার মঙ্গলের কথা ভেবেই অতিরিক্ত সাবধানী হয়েছিল। ওদের শাস্তি দিও না।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে গতকালের সেই প্রধানা পরিচারিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে একটু দূরে। তার চোখে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। সে বুঝতে পারে, এই পরিচারিকা আর তার সহকর্মীরা চিরদিনের জন্যে তার প্রভাবে এসে গেল।

রানী বলে,—কোথায় লেগেছে দেখি?

—এখানে দাঁড়িয়ে?

—না না, ভেতরে চল। আমি বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়, তুমি মোটেই সুস্থ নও। অনেকটা রক্ত গেছে তাই না?

কিছুটা গেছে বৈ কি।

ভেতরে যেতে যেতে রানী বলে,—ছিঃ ছিঃ, কত বিপদে পড়ে এসেছিলে তুমি এখানে। আর ওরা তোমায় তাড়িয়ে দিল। জীবনে কখনো একথা ভুলতে পারব না আমি।

জিৎ সিং রসিকতা ক’রে বলে,—ভালোই তো বোন। এমন দু-চারটে স্মৃতি যদি থাকে, থাকুক না।

রানী ঘরে এসে জিৎ সিং-কে এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নিজের হাতেই তার পোশাক খুলে ফেলে। সযত্নে তার হাত উঠিয়ে নিয়ে দেখে বলে,–কে বেঁধে দিল?

—একজন হাকিম!

—কোন্ হাকিম?

—আমি ঠিক জানি না।

—তুমি জান না? তুমি দেখলে অথচ তুমিই জান না?

—আমি দেখিনি।

রানী স্থির চোখে জিৎ-এর মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,—কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে? সরাইখানায় তো ছিলে না?

জিৎ সিং-এর কানে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসে এক শিশুর আধো আধো কথা, –বাবা আছবে। বাবা আছবে।

সে মাথা নীচু করে।

—জিৎ।

—বল বোন।

—একটা কথা বলব?

—বল।

—কাল তোমাকে কেউ রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল, ঠিক কি না? জিৎ সিং মনে মনে বলে, ডেকে নয়, তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মুখে বলে,—হ্যাঁ।

রানীর দুই চোখ প্লাবিত করে আবার অশ্রু বের হয়।

—ওকি হচ্ছে বোন? তুমি মেবারের মেয়ে—ভুলে যাচ্ছ কেন সে কথা?

—না, আমি ভুলিনি। আমি অবাক হচ্ছি, ভাবছি তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো শুধু একটি রাখীর মাধ্যমে। তবে কেন এই আকর্ষণ? রাখীর এত শক্তি রয়েছে তা তো আগে কখনো অনুভব করিনি?

—শুধু রাখী নয় বোন। মনটিও রয়েছে সেই সঙ্গে। সব জায়গায় মনই আসল।

—তোমার কথা সত্যি। আমার কোনো ভাই ছিল না। অন্যের ভাইদের দেখে আদর করতাম। অন্যের ভাইদের দেখে মায়ের কাছে বায়না ধরতাম একটি ভাই-এর জন্যে। মা দিতে পারেননি। সেই অভাববোধ ভেতরে ভেতরে বরাবরই ছিল। এতদিনে মিটলো সেই অভাব। তাই বোধহয় এমন হয়েছে জিৎ।

—এতদিনে আমি সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি।

রানী সহসা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আহত স্থান খুলে ফেলে। পরিচারিকা ওষুধ নিয়ে আসে। সেই ওষুধ ক্ষতস্থানে লাগিয়ে নতুন করে সযত্নে বেঁধে দেয় রানী। তারপর হেসে বলে,—এসব আমি জানি।

—প্রতিটি রাজপুত রমণীরই এসব জানা উচিত।

—ঠিকই বলেছ। এখন বিশ্রাম কর। আমি একটু খাবার নিয়ে আসি

—আমি খেয়ে এসেছি।

—তবে বিশ্রাম কর। তুমি ক্লান্ত। যদি পার একটু ঘুমিয়ে নাও। স্নান ক’রে খেয়ে তবে যাবে। আমি ততক্ষণে একটু অন্য কাজ ক’রে আসি। বাড়িতে একজন মহিলা এসেছেন।

জিৎ সিং চোখ বন্ধ করে। নিশ্চিন্ত হয়েই বন্ধ করে চোখ। মহিলাটি কোথা থেকে এসেছে সে জানে। বীরবলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার প্রলোভন হলেও সে করে না। উত্থাপন করার যথেষ্ট সময় সে পাবে।

কতক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিল জানে না। এক সময়ে একটু শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখে ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ষোড়শী। সে চমকে ওঠে। লীলাবতী! লীলাবতী তার সামনে এক অপরূপ সাজে দাঁড়িয়ে? কেমন ক’রে হবে? লীলাবতী কি আগ্রায় এসেছে? না না। তবে? তবে সে স্বপ্ন দেখছে!

জিৎ সিং চোখ রগড়ায়। দেখে, পার্থক্য রয়েছে লীলাবতীর সঙ্গে। লীলাবতীর দেহ এতো আদরের দেহ নয়। তার দেহ মজবুত। তার শরীর চাবুকের মতো।

জিৎ সিং-কে ওভাবে চাইতে দেখে মেয়েটির সর্বাঙ্গ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। সে ভাবতে পারেনি এই ভাবে হঠাৎ জেগে উঠবে জিৎ সিং। তাই সম্পূর্ণ অপ্রস্তুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। নড়তেও পারে না। তারপর ছুটে পালিয়ে যায়।

দূরের কোনো কক্ষ থেকে মেয়েলী কণ্ঠের হাসি ভেসে আসে।

খানিক পরে রানী হাসতে হাসতে জিৎ সিং-এর কাছে এসে বলে,—কিছু মনে করো না। ও খুব লজ্জা পেয়ে গেছল। আমার ভাইকে দেখতে এসেছিল।

—উনি কে?

—বীরবলের মেয়ে।

জিৎ সিং লীলাবতীর সঙ্গে বীরবল-কন্যার সাদৃশ্যের কথা ভুলতে পারে না। মুখে বলে,—আমি কিছু মনে করিনি।

রানী আবার চলে যায়। জিৎ সিং বুঝতে পারে দরজার আড়ালেই অপেক্ষা করছিল মেয়েটি। চোখদুটি ওর সত্যিই অপূর্ব। ওই চোখদুটিকেই শুধু শকটের ভেতরে দেখেছিল সে।

কিন্তু লীলাবতীর চোখও কি কম সুন্দর? এই মেয়েটির মতো যত্নে সে মানুষ হয়নি। তাই শরীরের ত্বক হয়তো এতটা মসৃণ নয়। এদের মতো সুখে থাকলে সে-ও প্রায় সুন্দরীর পর্যায়ে পড়ত। বীরবলের মেয়ের ওই সাজসজ্জা লীলাবতী জীবনেও কল্পনা করতে পারবে না। সারা জীবনে সে যত পোশাক পরবে, সব মিলিয়ে বীরবল কন্যার একদিনের পোশাকের মূল্যের সমান হবে না।

কিন্তু কি হবে লীলাবতীর কথা ভেবে? কোনো লাভ নেই। এই মুহূর্তে সে যদি আগ্রা ছেড়ে রওনা হয়ে উদয়সাগরের পাড়ে গিয়ে পৌঁছায়—যদি সেখানে গিয়ে লীলাবতীকে ডাক দেয়, লীলা ফিরেও চাইবে না একবার। গুপ্তচরের ছাপ লেগেছে তার সর্বাঙ্গে। লীলা তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই ভালোবাসা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের নয়। সেই ভালোবাসা অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল।

ঘুম আর আসে না। আসবেও না। উঠে পায়চারি করতে করতে বাইরে উধম সিং-এর কাছে যায় সে। লোকটিকে যতটুকু চিনতে পেরেছে, তাতে খুবই ভালো লেগেছে তাকে। কোনো বিষয়ে কোনো রকমের বাজে কৌতূহল নেই তার। পৃথিবীতে যত কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা সবই তার কাছে স্বাভাবিক। কাল যখন রক্তাক্ত দেহে ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সে তখন একটুও ব্যস্ত হয়নি সে। প্রশ্নও করেনি কিভাবে আহত হল। শুধু ঘোড়াটিকে তার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ আহত অবস্থায় ঘোড়ার পরিচর্যা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কোনো ব্যাপারে অনর্থক ব্যস্ত হয়ে কোনো লাভ নেই, এ জ্ঞান তার রয়েছে। এক কথায় উধম শান্ত এবং পরিণত মস্তিষ্কের একজন বুদ্ধিমান পুরুষ।

জিৎ সিং-কে আসতে দেখে উধম বলে, —চলুন।

—কোথায়?

—আপনি ঘোড়া দেখবেন তো?

—হুঁ।

—সুন্দর জিনিস। আমার লোভ হচ্ছিল।

জিৎ সিং হাসে। ঘোড়ার কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকে আদর করে। উধম সিং-এর সঙ্গে আলোচনা করে। উধম সমঝদার লোক। তার সঙ্গে আলোচনা করে মনে হয় সে একজন অশ্ব বিশারদ। ঘোড়ার এত খুঁটিনাটি জিৎ জানে না। জানবার মতো সুযোগ হয়নি তার।

একসময়ে কৌশলে বীরবলের প্রসঙ্গ টেনে এনে জিৎ সিং বলে,—ওঁর সম্বন্ধে তোমার কতখানি জানা আছে উধম?

—মোটামুটি জানি।

—একটু বলবে?

—আর একদিন।

—আজ নয় কেন?

—আজ সময় নেই। বীরবলের মেয়ে একটু পরেই রওনা হবেন বলেছেন।

জিৎ সিং একটু নিরাশ হয়। তবে সেই নিরাশ ভাব বেশিক্ষণ থাকে না। কারণ সে দেখতে পায় শকটে ওঠবার সময় মেয়েটি তার দিকে আর একবার চায়। সে চাহনিতে শুধু লজ্জাই ছিল। তার পর শকটের দ্বার বন্ধ হলে, সেই বন্ধ দ্বারের ফাঁক দিয়ে তার ঘন কৃষ্ণ আঁখির কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টি জিৎ সিং-এর ওপর পড়ে।

জিৎ সিং ভাবে, এই মেয়েটির সঙ্গে যদি পরিচয় হত, তার খুবই লাভ হত। তাছাড়া মেয়েটির চেহারা বারবার লীলাবতীর কথা মনে করিয়ে দেয়।

.

বীরবল সম্বন্ধে উধমকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি জিৎ সিং। কারণ পর পর তিন চারদিন অন্য কতকগুলি বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি যাওয়া হয়নি তার। কাজগুলির মধ্যে একটি হল ভবঘুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তার আশায় যমুনার তীরে যেতে দেখাও হয়ে যায়।

দূর থেকে তাকে দেখেই দ্রুত পায়ে কাছে এসে ভবঘুরে বলে—ভালোই অগ্রসর হচ্ছ দেখছি।

—–কি করে বুঝলেন?

—খবর রাখি। শুধু ও খবর নয়, রহিমবক্সের ব্যাপারও জানি।

—এত সব জানলেন কোথা থেকে?

—ভুলে যাও কেন, আমি ভবঘুরে। কানে কানে একটা কথা শুনবে?

—কানে কানে কেন? কেউ তো নেই আশেপাশে।

—তবু কানে কানে বলাই ভালো।

—বলুন।

ফিসফিস ক’রে বলে ভবঘুরে, —বীরবলের মেয়েকে ছেড়ো না। আকবর শাহ্ ওকে খুব পছন্দ করে।

—পছন্দ করেন? কি রকম পছন্দ।

—সাধারণ পছন্দের কথাই বলছি। মেয়েটি যে বীরবলের। নইলে অন্য কিছু ভাবতে পারতে। কারণ আকবরের অসাধ্য কিছুই নেই। এই আকবরই কয়েক বছর আগে আগ্রার সমস্ত আমীর ওমরাহের সুন্দরী জেনানাদের হারেমে টেনে নেবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন কিছু পরিমাণে।

—সত্যি বলছেন?

—আমি মিথ্যে বলি না।

—কিন্তু এ যে খুব অন্যায়।

—অন্যায়? তবু তো এখনো নওরোজের কথা শোনাইনি।

—শুনেছি। নওরোজে আমোদ-আহ্লাদ হয় খুব। মেয়েদেরও মেলা বসে।

—তা নয়। তা নয়। এই নওরোজের পেছনেও উদ্দেশ্য রয়েছে আকবর শাহের। -কী উদ্দেশ্য?

—বললে চমকে উঠবে। সেদিন অনেক সুন্দরী মুসলমান আর রাজপুত রমণীর সর্বনাশ হয়ে যায়।

—বলছেন কি আপনি?

—প্রতিবাদ করো না। শুধু শুনে যাও। এই যে বড় বড় সব রাজপুত রথী মহারথী দেখছ, এদের ঘরের খবর কি কেউ রাখে? যদি রাখত তাহলে ঘৃণায় তাদের গা রি রি ক’রে উঠত। কারণ এদের অধিকাংশের স্ত্রী বাদশাহের বাহুবন্ধনে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ধরা দিয়েছে সেই নওরোজের দিনে। যারা অনিচ্ছায় ধরা দিয়েছে, তারা ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস পায়নি। আবার অনেকে প্রথমে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাদশাহের সোহাগের মধ্যে যখন শোনে এই আত্মসমর্পণের পরিবর্তে প্রচুর অর্থ আর অলঙ্কার মিলবে তখন সেই সোহাগে মুখে হাসি ফুটিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে বাদশাহকে পরিতৃপ্তি দান করেছে। অলঙ্কারের ওপর মেয়েদের জন্মগত লোভ।

জিৎ সিং উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। আকবর শাহ্ সম্বন্ধে তার যেটুকু শ্রদ্ধা জন্মেছিল এক ফুৎকারে যেন উড়িয়ে দিল ভবঘুরে। এখন যদি সেদিনের মতো ছদ্মবেশী বাদশাকে সে দেখতে পেত, তাহলে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করত না।

ভবঘুরে বিষণ্ণ হাসি হেসে জিৎ সিং-এর হাত ধরে বলে,—বসো। এত অল্পতেই মাথা গরম করো না।

—অল্প?

—হুঁ।

—বেশি কাকে বলে তবে?

—জানি না। তবে ভরা-ডুবি হতে এখনো বাকি আছে। বাকি আছে মেবার। বাকি আছে আরও দু-চারটে রাজ্য। আর বাকি আছে রণথম্ভোর।

জিৎ সিং চেঁচিয়ে ওঠে, রণথম্ভোর?

—হ্যাঁ। কিন্তু তুমি অমন চিৎকার ক’রে উঠলে কেন?

—না। কিছু না। আপনি বলুন।

—আমার বলা শেষ হয়েছে। শুধু এইটুকু বলে রাখি, রাজপুতদের সঙ্গে আকবর শাহের সন্ধির একটা প্রধান শর্ত হলো, নওরোজের দিনে সেই রাজার রানীদের পাঠাতে হবে মীনাবাজারে। মীনাবাজারে দোকান খুলে নিয়ে বসতেই হবে। নইলে সন্ধি আর সখ্যতার ষোলকলা পূর্ণ হল না।

—মীনাবাজারের কথাটা আগে শুনিনি।

—শুনবে, এখানে এসেছো যখন আস্তে আস্তে সবই শুনবে। নওরোজের দিনে শুধু মেয়েদের যে বাজার বসে তারই নাম মীনাবাজার। সেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ করতে পারেন শুধু স্বয়ং বাদশাহ। কারণ তাঁর উপভোগের জন্যেই এই দোকান সাজিয়ে বসে থাকার নামে নিজেদের সাজিয়ে বসে থাকে মেয়েরা। যাকে খুশি বেছে নেন বাদশাহ্। তিনি ইচ্ছে করলে সঙ্গে তাঁর নির্বাচিত আমীর ওমরাহ্কেও নিয়ে যেতে পারেন।

জিৎ সিং চিন্তিত হয়, তার মাথায় একটি চিন্তাই ঘুরতে থাকে। সেটি হল ‘রণথম্ভোর’। কেউ না জানুক, সে অন্তত দৈবাৎ জেনে ফেলেছে, এই রণথম্ভোরের পতনের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

ব্যস্ত হয়ে ভবঘুরেকে সে প্রশ্ন করে,—রণথম্ভোরের অধিকর্তা রাও সুরজন হর যদি পরাস্ত হন, তাঁরও এ-দশা হবে?

—নিশ্চয়ই, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে আরও কয়েক বছর নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন রাও। কারণ এত তাড়াতাড়ি তিনি রণথম্ভোর জয়ের জন্যে প্রস্তুত হবেন বলে মনে হয় না।

—কিন্তু শিগগিরই যদি বাদশাহ্ সেদিকে অগ্রসর হন? আর আপনি যদি আগে থাকতে সে খবর জানতে পারেন, কী করবেন তবে?

—সুরজন রাওকে গিয়ে খবর দেব। তারা যাতে প্রাণপণে লড়বার সুযোগ পায়।

—তবে আপনি কালই রওনা হয়ে যান।

বিস্ময়ে কিছুক্ষণ জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে থেকে ভবঘুরে বলে,—তার মানে?

—রণথম্ভোর অবরোধের আর দেরি নেই বিশেষ।

—তুমি, তুমি সত্যি কথা বলছ?

—হ্যাঁ, আপনি কালই রওনা হয়ে যান।

ভবঘুরে জিৎ সিং-এর দুই কাঁধ সজোরে চেপে ধরে বলে,–কোথায় পেলে এ খবর? শক্ত হয়ে জিৎ সিং বলে,—এখন বলব না। সুযোগ হলে পরে বলব।

কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে ভবঘুরে উচ্চারণ করে,—বাহাদুর ছেলে বটে।

—না, বাহাদুরীর কিছু নেই এতে। খবরটা দৈবাৎ পেয়েছি।

—এ খবরটা দৈবাৎ পেতে হলেও বাহাদুরীর দরকার। আগ্রায় অগুনতি মানুষের মধ্যে দৈবাৎ এত গোপনীয় খবর পাওয়া সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া তুমি নতুন এসেছ।

জিৎ সিং ভাবে পৃথ্বীরাজের রানীর কথা। এত সহজে খবরটা ফাঁস করে দিল সে? রণথম্ভোরের পতন সে-ও চায় না।

ভবঘুরেকে বলে সে,—আর একটি কথা।

—বল।

—আমিও যাচ্ছি এ যুদ্ধে। মান সিংহের দলে থাকব। তানসেনের গৃহে নিয়ে গিয়ে আপনি এই উপকার করেছেন। পৃথ্বীরাজের রানীর সঙ্গেও সেই জন্যেই পরিচয় হয়। সবকিছুর মূলেই আপনি

—অতটা উচ্ছ্বসিত হয়ো না।

—না, আপনি যদি পারেন রণথম্ভোরে থেকে যাবেন। দেখা হবার সম্ভাবনা থাকবে। তাতে সুবিধে হবে।

—একশোবার।

যমুনার তীরে তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছিল। ভবঘুরের কোনো তাড়া ছিল না। কারণ কমলাবতীর আসবার সময় পার হয়ে গেছে। যে কোনো কারণেই হোক, আজ আর সে এল না। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিংবা হয়তো বাদশাহ্ আগে থাকতে খবর পাঠিয়েছেন সন্ধ্যার পর মেহেরবানী ক’রে তার ঘরেই উপস্থিত হবেন বলে। তাই আনন্দে আটখানা হয়ে শরাব আর আফিমের পাত্র ঠিকমতো গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত বোধহয় ভবঘুরের প্রথম যৌবনের প্রিয়া, কমলাবতী।

সে যাই হোক, তার জন্যে ভবঘুরের মধ্যে কোনো রকমের চাঞ্চল্য দেখতে পায় না জিৎ সিং। সে চুপচাপ থাকে। সাধারণভাবে কথাবার্তা বলে। তবে রণথম্ভোরের খবরটা দেবার পর সামান্য একটু উত্তেজিত হয়েছিল। কিন্তু সে উত্তেজনাও সন্ধ্যার আগমনে মিলিয়ে যাওয়া দিনের আলোর মতো তার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে থিতিয়ে গেছে এক সময়ে।

আরও অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ভবঘুরে বলে,—এবারে আমায় উঠতে হবে।

—রণথম্ভোরে দেখা হবে তবে?

—হ্যাঁ, আমি কাল রওনা হচ্ছি।

—কমলাবতী? তিনি যে দেখতে পাবেন না আপনাকে?

ভবঘুরে একটু ক’রে চুপ করে থেকে বলে,-তার অভ্যাস আছে না দেখার। আজ তো সে নিজেই এল না। ওসব কথা থাক। আবার বলি, বীরবলের মেয়েকে ছেড়ো না।

—কিন্তু এগোতে পারছি না যে।

কেন? না পারার কি আছে? অল্প বয়স তোমার, স্বাস্থ্য আছে, রূপ আছে, নিশ্চয়ই পারবে।

—–আপনি ঠিক বলছেন?

—ঠিক বলছি, ওটাই একমাত্র পথ। এগিয়ে যাও, আমি চলি। রণথম্ভোরে দেখা হবে।

এরপর অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যায় ভবঘুরে। জিৎ সিং সেই অন্ধকারের দিকে আরও বহুক্ষণ চেয়ে থাকে।

কালপীর অধিবাসী এই বীরবল। উধমের মুখে কথাটা শুনে চমকে ওঠে জিৎ সিং। এতদিনে সে লীলাবতীর সঙ্গে বীরবল-কন্যার চেহারায় সাদৃশ্যের একটা কারণ খুঁজে পায়। লীলাবতীও কালপীর মেয়ে। তার পূর্বপুরুষ ছিল কালপীর অধিবাসী।

বীরবল প্রথম জীবনে ছিল খুবই গরীব। গরীব ব্রাহ্মণের ঘরে তার জন্ম। আসল নাম তার মহেশ দাস। রাজা ভগবান দাসের অধীনে কাজ শুরু করে সে প্রথমে। তারপর তার প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ভগবান দাস তাকে পাঠিয়েছিলেন বাদশাহের দরবারে। এখানে এসে ফুলে-ফেঁপে আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে সেদিনের মহেশ দাস। এখন সে মস্ত লোক। তানসেনের মতো না হলেও নামকরা গাইয়ে। তাছাড়া সে কবি। সবাই বলে কবি রায়। এখন তাকে না হলে বাদশাহের একদণ্ডও চলে না। কারণ তার একটি মস্ত গুণ রয়েছে খুব কম মানুষের মধ্যেই সেই গুণটি থাকে। সেটি হল বীরবলের বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা।

কিন্তু এত সব গুণের কথা জিৎ সিং-এর কানে যায় না। সে ভাবছিল ব্রাহ্মণ হলে গোপাল সিং সর্দারের সঙ্গে বীরবলের আত্মীয়তা থাকবার সম্ভাবনা কম। কোনো পুরুষেই হয়তো ছিল না। আর আত্মীয়তা না থাকলে লীলাবতীর চেহারার সঙ্গে বীরবল-কন্যার এ সাদৃশ্য আসবে কোন্ সূত্র থেকে? তবে কি কালপীর আবহাওয়ার গুণে এমন হয়? সেই আবহাওয়া কি এখানকার মেয়েদের এক বিশেষ শ্রী বিশেষ ছন্দ দান করে?

জিৎ সিং ভেবে চলে। উধম সিং তারই পাশে চুপ ক’রে বসে থাকে। জিৎ সিং-এর চিন্তাধারায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করে না সে। সে নীরবে একটি ছোট্ট গাছের মাথা ধরে টেনে তাকে যন্ত্রণা দেয়। তার চোখ ছিল রাস্তার দিকে, আর কান ছিল পেছনের দিকে। রানী কখন ডাকবে কিছু ঠিক নেই। রানী অনেক সময়ে তাকে নিজেই ডাকতে আসে বাইরে। বিশেষত এই দুপুর বেলায়। এই সময় বাড়ির অন্য সবাই বিশ্রাম নেয়।

জিৎ সিং আজ রানীর কাছে আসেনি। সে উধমের কাছেই এসেছিল। ভেতরে না এসে উধমের কাছে বসে পড়েছিল সে। রানী দেখলে হয়তো অসন্তুষ্ট হবে। কারণ উধম তার কর্মচারী মাত্র। কিন্তু জিৎ সিং তাকে শুধু কর্মচারী হিসাবে দেখে না। উধম নিজেও কি নিজেকে শুধু কর্মচারী ভাবে? যদি ভাবত, তাহলে জিৎ সিং কাছে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে সংকোচে একটু দুরে সরে যেত অন্তত। কিন্তু একটুও সংকুচিত হয়নি সে। একটুও সরে যায়নি।

রাস্তার ওপর অনেক কণ্ঠের মিলিত হাঁকডাক শুনতে পাওয়া যায়। ওরা দুজনা তাড়াতাড়ি বাইরে চলে আসে। এই ভরদুপুরে এত গোলমাল সচরাচর শোনা যায় না।

ওরা দেখতে পায় চার-পাঁচখানা বলদের গাড়িতে ক’রে মস্ত মস্ত কি যেন নিয়ে আসছে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক। বলদগুলি বলিষ্ঠ, অথচ টানতে পারছে না গাড়ি। পেছন থেকে লোকগুলি ঠেলছে প্রতি গাড়িকে।

উধম বলে,—পাথরের জিনিস কিছু হবে নইলে এত ভারী হত না।

জিৎ সিং প্রশ্ন করে,—বাদশাহ্ নতুন কোনো ইমারত তৈরি করছেন নাকি?

—না। তেমন কিছু তৈরি হলে জানতে পেতাম।

গাড়িগুলি আরও কাছে আসে। ওরা দেখতে পায় পাথরের দুটি বিরাট মনুষ্য মূর্তি রয়েছে গাড়িগুলিতে। গাড়িগুলি দড়ি দিয়ে একটার সঙ্গে আর একটি জোড়া লাগানো।

—কার মূর্তি উধম?

—জানি না তো? কে গড়ালো তাও জানি না। আগ্রার কেউ নিশ্চয় নয়।

জিৎ সিং একটু এগিয়ে গিয়ে ওদের একজনকে প্রশ্ন করে,—ও দুটি কোথায় যাবে?

—কিল্লায়।

আর একজন সব-জান্তার মতো মুখভঙ্গি করে,—কিল্লার দুই পাশে বসানো হবে।

জিৎ সিং জিজ্ঞাসা করে,—কাদের মূর্তি এ-দুটি?

—তা জানি না। মানে, জানতাম, ভুলে গেছি। তবে তোমাদেরই মতো দুই রাজপুতের।

—রাজপুত?

একজন রোগাটে ধরনের লোক মুখ বিকৃত ক’রে খেঁকিয়ে ওঠে,—আজ্ঞে হ্যাঁ। তোমার মূর্তি গড়াতে চাও? মর তবে।

লোকটির কথায় অসহিষ্ণুতা। জিৎ সিং বুঝতে পারে মূর্তি দুটি এদের খুবই ভুগিয়েছে। অন্তত এই রোগা লোকটির সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে।

সে হেসে ফেলে।

—হাসছ? হাসো। হাসির দিন পড়েছে তোমাদের, হাসবেই তো। নইলে মান সিংহ হয় কত্তা? আর আমরা দিনে পাঁচ-পাঁচবার নামাজ পড়ে হিন্দুর মূর্তি ঠেলে মরি! হাসো। হি হি করে হাসো।

লোকটি গজ গজ করতে করতে অন্যদিকে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে মেশে।

জিৎ সিং গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ভালোভাবে মূর্তি দুটির মুখ দেখে। রাজপুত এবিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু মুখ দেখে চিনতে পারে না। অত বড় মুখ তার নিজের হলেও অত কাছ থেকে চিনতে পারত না। দাঁড় করালে চেনা যেতে পারে।

উধম সিং কাছে এসে বলে,—ভেতরে চলুন। আপনার ডাক পড়েছে।

—তার মানে?

—আপনাকে দেখতে পেয়েছেন রানী মা।

—কি ক’রে দেখলেন?

—গোলমাল শুনে বাইরে এসেছিলেন।

রানীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল না জিৎ সিং-এর। উধমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য একটি দরকারী কাজে যাবে বলে ঠিক করেছিল। একজনের খবর সে জানতে চায়। সেই একজন হল রাম সিং। আগ্রায় এসে সবকিছুর মধ্যেও রাম সিং-কে সে ভোলেনি। তাই রাস্তায় চলার সময় তার চোখ প্রতিটি রাজপুতের মুখ ভালোভাবে দেখে নেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত রাম সিং-কে সে দেখতে পায়নি। লোকটি কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। সে আদৌ এখানে এসেছে কি না তাও বুঝতে পারে না! গিরো উপত্যকা থেকে আগ্রায় আসার দীর্ঘ পথে অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি। পথে প্রাণ হারানো কিছু অসম্ভব নয়। রাম সিং-এর কি সেই রকম কিছু ঘটেছে?

জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হতে পারে না। কারণ সারা আগ্রায়, রাম সিং আর তার দুই শাকরেদ ছাড়া কেউ চেনে না তাকে। ওরাই শুধু তাকে বিপদে ফেলতে পারে, আর কেউ নয়। ওদের সম্বন্ধে সঠিক খবর জানা একান্ত প্রয়োজন।

মান সিংহের দলের দু-চারজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। ওদের কাছ থেকেই রাম সিং এবং তার চেলাদের খবর জানতে হবে কৌশলে। কারণ তারা যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না ক’রে থাকে, তবে ওদের সঙ্গে পরিচিত হতেই হবে।

রানীর ডাকে কাজটা হল না।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাই উধমের সঙ্গে ধীরে ধীরে সে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে এসেই দুর থেকে রানীর পাশে অপর একটি নারী মূর্তিকে দেখে অদম্য কৌতূহল জেগে ওঠে তার মনে। অনিচ্ছাও অন্তর্হিত হয়।

রানীর পাশে দাঁড়িয়েছিল বীরবল-কন্যা।

সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে জিৎ সিং নিম্নস্বরে উধমকে প্রশ্ন করে,—উনি কখন এলেন?

—সকালে এসেছেন। সারাদিন থাকবেন। বীরবল আজ আকবর শাহের সঙ্গে শিকারে গেছেন। মেয়েকে তাই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

—পৃথ্বীরাজ রাঠোর? তিনিও কি গেছেন?

—হ্যাঁ। তিনিও গেছেন। তাঁর শিকারের হাত খুব ভালো। তবে বাদশাহের মতো শিকার করতে গিয়ে ক্ষেপে ওঠেন না। বাদশাহ্ শিকার-পাগল।

জিৎ সিং শিকারের ব্যাখ্যা শুনতে চাইছিল না। শোনবার সময়ও ছিল না। কারণ তারা রানীর কাছাকাছি এসে পড়ে।

জিৎ সিং-এর মনের মধ্যে ভবঘুরের কথাগুলি বার বার ঘুরপাক খায়-বয়স আছে, স্বাস্থ্য আছে, সৌন্দর্য আছে। নিশ্চয় পারবে।

সে ভেবেছিল, তাকে দেখে বীরবল-কন্যা আড়ালে চলে যাবে। কিন্তু যায় না। রানীর পাশে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে। তার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই মেয়েটির মুখে স্মিত হাসির জবাবে সে-ও মুখখানাকে একটু হাসি হাসি করে।

—তোমার হাত কেমন আছে জিৎ? রানী প্রশ্ন করে।

—ভালো।

—এই কদিন কি হয়েছিল?

—ব্যস্ত ছিলাম।

—সে আমি জানি। ভাই তার বোনকে ভুলে থাকলেও, বোন ভাইকে ভোলে না। আহত মানুষটি চলে গেলে—তারপর আর দেখাই নেই। খুব কষ্ট পেয়েছি। দুর্ভাবনাও হয়েছিল। উধমকে পাঠিয়েছিলাম তাই।

—পাঠিয়েছিলে? ও তো বলেনি? জিৎ সিং আড়চোখে একবার উধমের দিকে চায়। এতক্ষণ সে-ও বলেনি। জিৎ-এর চাহনি দেখে সে ধীরে ধীরে স্থানত্যাগ করে।

—বলতে মানা করা হয়েছিল। শুধু শুধু তোমাকে উত্ত্যক্ত করতে চাইনি।

—তাই বলে, আমি অন্যায় করলে শুধরে দেবে না? কেমন বোন হলে তবে?

রানীর চোখ ছলছল করে ওঠে,–এ জিনিস হল মনের। এর ওপর জুলুম চলে না জিৎ।

জিৎ সিং স্বল্প-পরিচিতা মেয়েটির সামনে মাথা নত করে।

রানী এবারে হেসে ওঠে। দু-পা কাছে গিয়ে জিৎ সিং-এর হাতের ওপরে হাত রেখে বলে, —কিন্তু তুমি লজ্জিত হচ্ছ কেন? ভাইরা চিরকালই মাথাভাঙা হয়।

বীরবল-কন্যাও হেসে ওঠে।

জিৎ সিং ভাবে হাসিটি তো বেশ মিষ্টি।

রানী ঘরে এসে বলে,—কি দেখছিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে?

—দুটি মূর্তি নিয়ে গেল কেল্লায়।

—সে তো আমরাও দেখলাম।

—ওরা বলে মূর্তি দুটি রাজপুতের।

—হ্যাঁ। আমিও তাই শুনলাম। এই মাত্র ও বলল আমায়।

জিৎ সিং বীরবলের মেয়ের দিকে চায়। মেয়েটি প্রথম কথা বলে তার সঙ্গে। সে বলে—আপনাদের মেবারের লোক ছিলেন ওঁরা। চিতোর দখলের পর ওঁদের কথা বাদশাহ্ ভুলতে পারেননি। শয়ই দরবারে বসে বলতেন ওঁদের কথা। আমাকেও বলেছেন অনেকবার শেষে সবার অজ্ঞাতে এক ভাস্করকে ডেকে মূর্তি তৈরি করতে দিলেন। সবার সামনে একথা বলতে তাঁর মতো ব্যক্তিও একটু ইতস্তত করেছিলেন। কারণ যাঁদের মূর্তি গড়া হল তাঁরা দুজন হলেন শত্রুপক্ষের। চিতোর অবরোধের সময় তাঁরাই বাদশাহকে সব চাইতে বেশি বাধা দিয়েছিলেন। তাঁদের হাতেই বাদশাহের সব চাইতে বেশি সৈন্য নষ্ট হয়েছিল। আর হয়েছিল কালপীর এক দলের লক্ষ্যভেদের দরুন। প্রকাশ্যে শত্রুর মূর্তি গড়ে সম্মানের সঙ্গে সে মুর্তি স্থাপন করার পথে অনেক বাধা উপস্থিত হবে ভেবে গোপনে একাজ করলেন আকবর শাহ্। আমীর ওমরাহরা তো জানতেই না, এমনকি রাজা মান সিংহও জানতেন না। শুধু আমি জানতাম আর জানতেন বাবা।

মেয়েটি থেমে যায়। একটানা অনেক কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে যেন বুঝতে পারে, এতটা ব্যগ্রভাবে কথা বলায় কোথায় যেন ভুল হয়ে গেছে। কোথায় যেন ধরা পড়ে গেছে সে। চকিতে সে রানীর দিকে চায়। কারণ রানীই সেখানে একমাত্র নারী। নারী হয়ে নারীর মনের কথা সে-ই বুঝতে পারবে শুধু। কী লজ্জা!

রানী কিন্তু সাধারণভাবে বলে,—একথা আমায় বলনি তো আগে? আমিও তো মেবারের মেয়ে।

—ভুলে গেছলাম। কোনো গুরুতর কিছু নয় বলে, একটুও মনে ছিল না। জিৎ সিং প্রশ্ন করে,—মূর্তি দুটি কার?

—চিতোরের দুই বীর, জয়মল্ল আর পট্টের।

জিৎ সিং-এর চোখদুটি সহসা বাষ্পাচ্ছন্ন হয়। মুহূর্তের জন্যে সে ভুলে যায় সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই নারী। এদের সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করা উচিত নয়। যখন খেয়াল হল, একপাশে সরে যায় সে। কামিজের হাতা দিয়ে অলক্ষ্যে চোখ ঘষে নেয়।

অদ্ভুত মানুষ এই আকবর শাহ্। এক এক সময় মনে হয়, তিনি পশুর চেয়েও অধম। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, দেবতাদের মধ্যেও এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কাল যাকে সামনে পেলে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করত না জিৎ সিং, আজ তাঁকে দেখলে সামনে পায়ের কাছে বসে পড়তে গিয়ে একবারও ভাববে না সে। শত্রুকে তার বীরত্বের সম্মান দেখাতে হলে হৃদয়টিও হওয়া চাই উদার। এ উদারতা যার রয়েছে তার অনেক অন্যায়কেও সহ্য করা যায়।

রানীর দিকে ফিরে জিৎ সিং দেখে রানী রীতিমতো চোখের জল ফেলছে। আর মেয়েটি তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে সে আবার হাসে। তার হাসির বিনিময়ে জিৎ সিং আবার হাসে। এবারে তার হাসি দস্তুরমতো উদ্দেশ্যপূর্ণ। সেই হাসির আঘাতে মেয়েটি লজ্জায়, রাঙা হয়ে ওঠে।

রানী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে,—আমি একটু আসছি। কিছু মনে করো না।

রানী চলে যেতেই জিৎ সিং সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলে,—আপনাকে খুবই পরিচিত বলে মনে হয়। যেন অনেকবার দেখেছি।

মেয়েটি আরও রাঙা হয় জিৎ-এর কথা শুনে। কোনোরকমে সামলে নিয়ে সে বলে,—ভালোই তো।

—কেন? ভালো কেন?

—পরিচয়ের প্রয়োজন হবে না।

—তাই কি হয়?

—হয়।

—এমন কখনো হয়েছে বলে শুনিনি।

—কোনোদিনও না দেখে আগে কখনো কাউকে চেনা বলে মনে হয়েছে আপনার?

—না।

—তবে?

জিৎ সিং চুপ ক’রে থাকে। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। বাবার মতোই কথা বলার শিল্প তার আয়ত্তে। মেয়েটি বলে,–একদিন আসুন না।

—কোথায়?

—আমাদের বাড়ি।

ভবঘুরের উক্তি মনে পড়ে জিৎ সিং-এর। তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয় এই মুহূর্তটুকুর মধ্যে। লীলাবতীর কথা ভাবে সে। তার পর বলে,—বেশ।

মেয়েটির লজ্জা কেটে যায়। চোখে মুখে আগ্রহ ফুটে ওঠে তার। সে বলে,—সত্যিই যাবেন আমাদের ওখানে?

—যাব। কিন্তু কিভাবে যেতে হবে? শুনি নাকি, সামনে অনেক প্রহরী থাকে?

—হ্যাঁ। বাদশাহ্ মাঝে মাঝে আসেন। তাই প্রহরীর ব্যবস্থা।

—তবে? কোন্ পরিচয় দেব? রানীর ভাই?

—না না। আপনি অন্য রাস্তায় যাবেন। পেছনেও রাস্তা আছে।

জিৎ সিং চমকে ওঠে। এত তাড়াতাড়ি খিড়কির পথের কথা বলে দিচ্ছে মেয়েটি? একি সরলতার লক্ষণ? না পাগলামী? হয়তো দুই-ই।

সে বলে,–পেছনের দরজায় কেউ থাকে না?

—থাকে। তবে সে আমার অনুগত।

—বেশ। যাবো।

—কখন?

—যখন আদেশ হবে।

চেষ্টা সত্ত্বেও মেয়েটি আনন্দের হাসিটুকু চাপতে পারে না। সে বলে,—আজই?

—আজ? কিন্তু আজ আপনি সন্ধ্যার পরে এখান থেকে যাবেন শুনলাম?

—হ্যাঁ। আপনি তো রাতে যাবেন আমাদের বাড়ি।

দুঃসাহসী বলে মাঝে মাঝে নিজের জন্যে গর্ব হলেও জিৎ একটু ভয় পেয়ে যায়। সম্পূর্ণ অচেনা এক প্রহরাধীন পুরীতে চোরের মতো রাতের বেলা এক সুন্দরী যুবতীর কাছে যাওয়ার মধ্যে যথেষ্ট বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। তবু মেয়েটির সামনে নিজেকে ছোট করা চলবে না। বিপদের ঝুঁকি সে নেবে। সে পুরুষ।

ধীরে ধীরে জিৎ সিং বলে,—যাব।

কথা আর বেশিক্ষণ চলতে পরে না। রানী এসে উপস্থিত হয় চোখমুখ ধুয়ে তাজা হয়ে এসে বলে,–তোমরা তো বেশ কথাবার্তা বলছ দেখছি। এর মধ্যেই সংকোচ কেটে গেল?

জিৎ সিং বলে,—হঠাৎ যেভাবে চলে গেলে। কি করব বুঝতে পারলাম না। তাই কথা বলতে শুরু করলাম।

রানী কিন্তু জিৎ-এর রসিকতায় হাসতে পারে না। সে গম্ভীর হয়ে থাকে। তার চোখে আবার অশ্রু আসার উপক্রম হয়। কোনো রকমে সামলে নিয়ে সে বলে,—যতই ভাবছি, ততই অবাক হচ্ছি জিৎ। জানতাম না, এত মহৎ হৃদয় আকবর শাহের

কিছুক্ষণ স্তব্ধতার মধ্যে কাটে। শেষে রানী ডাকে,—জিৎ।

—বল বোন।

রানী চকিতে বীরবল-কন্যার দিকে চেয়ে বলে,—আচ্ছা থাক। এখন নয়। পরে বলব।

তারপর পরক্ষণেই আবার বলে,—এখন বলতেই বা ক্ষতি কি? তুমি যে চিতোরের লোক একথা তো গোপন করনি। সব কিছু বলেই তো মান সিংহের দলে নাম লিখিয়েছ। অমন অনেকেই আছে। আচ্ছা জিৎ, মুঘল সৈন্য চিতোরে প্রবেশ করলে তুমি যুদ্ধ করনি?

জিৎ সিং কেঁপে ওঠে রানীর কথায়। কেঁপে ওঠে, কারণ তার হৃদয়ের দুর্বলতম স্থানে আঘাত করছে রানী। সে যুদ্ধ করেনি। তার বয়সী ছেলেরা যখন চিতোরের প্রাকারের পাশে দাঁড়িয়ে জয়মল্লের আদেশ পালন করেছে, প্রাণ দিয়েছে, তখন সে পিতা অজিত সিং-এর শয্যার পাশে ঠায় বসে থেকেছে। তাকে পথ্য তৈরি ক’রে দিয়েছে। তার সেবা করেছে। কিন্তু তবু, অহরহ এক অপরাধ-বোধ তার মনের মধ্যে হলের মতো বিঁধেছে। দিনরাত বসে ছটফট করেছে। অসংখ্য বার ঘরের বাইরে ছুটে এসেছে। কিন্তু একবারও অসুস্থ অজিত সিং-এর সামনে উচ্চারণ করতে পারেনি—আমি যাই বাবা। যদি উচ্চারণ করত, একবার যদি মুখ ফুটে বলতে পারত, তাহলে অজিত সিং হেসে তাকে বিদায় দিতেন। জয়মল্লের নিষেধ সত্ত্বেও বিদায় দিতেন।

অবরোধের প্রথম দিনে জয়মল্ল প্রতি বাড়িতে গিয়ে লোকসংগ্রহ করেছিলেন। অজিত সিং-এর কাছে এসে বলেছিলেন,—আপনার পুত্রকে আমি নেবো না। আমার হুকুম সে যেন আপনাকে ছেড়ে না যায়। আমার হুকুম।

জয়মল্লের আদেশের মধ্যে এই ‘হুকুম’ কথাটি থাকবার প্রয়োজন ছিল। তিনি বুঝেছিলেন জোরের সঙ্গে অজিত সিং-কে কথাটি না বললে তিনি ছেলেকে ঘরে রাখবেন না কখনই। ঠেলে পাঠিয়ে দেবেন। নিজের কথা চিন্তা না করেই পাঠিয়ে দেবেন। একবার চিন্তাও করবেন না যে তাঁর মুখে জল দেবার মতোও কেউ থাকবে না জিৎ সিং যুদ্ধে চলে গেলে। তাই জয়মল্ল তর্জনী উঁচিয়ে বলেছিলেন,—আমার হুকুম।

অজিত সিং প্রথমে হেসে উঠেছিলেন। তারপর দেয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন,–বেশ। তুমি যখন রানাহীন চিতোরের নেতা, তখন তোমার আদেশ শিরোধার্য। চিরকাল যুদ্ধ করেছি জয়মল্ল। অন্যায় হুকুম পালন করাও অভ্যাস আছে। কারণ হুকুম অন্যায় হলেও পালন করা অবশ্য কর্তব্য। নইলে শৃঙ্খলা থাকে না। তবে এই আমি পাশ ফিরে শুলাম। তোমার আর মুখদর্শন করব না।

পৃথ্বীরাজ রাঠোরের স্ত্রী জিৎ সিং-এর ভাবলেশহীন চাহনি দেখে অস্বস্তি অনুভব করে। জিৎ সিং-এর একটি হাত তুলে নিয়ে ডাকে,—জিৎ‍ সিং।

—বল।

—কি ভাবছিলে?

—কিছু না।

—আমার কথার উত্তর দিলে না তো?

জিৎ সিং ধীরে ধীরে বলে,—আমি যুদ্ধ করিনি। অস্ত্র স্পর্শ করিনি। এমন কি মুঘল সৈন্যরা দল বেঁধে যখন আমাদের ঘরে ঢুকে আমার অসুস্থ পিতাকে হত্যা করল তখনো নিরস্ত্র অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছি।

বীরবল-কন্যা বলে ওঠে,—তা কি করে সম্ভব?

—সম্ভব না হলেও সম্ভব হয়েছিল সেদিন।

রানী বলে,—ওকথা তবে থাক। কোনো কারণ রয়েছে নিশ্চয়। যদি তোমার আপত্তি না থাকে আর একদিন শুনব।

জিৎ সিং বীরবলের মেয়ের দিকে চায়। মেয়েটি চঞ্চল। কথা বলতে হয় তাই সে বলেছিল। তার চোখদুটি আনন্দে নাচছিল। কেন সেই আনন্দ বুঝতে অসুবিধা হয় না জিৎ সিং-এর। ভবঘুরে সেকথা আগে থেকেই বলে দিয়েছে, যে ভবঘুরে এতদিন রণথম্ভোরের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

মেয়েটির উত্তেজনা জিৎ সিং-এর মনেও সংক্রামিত হয়। যেন একটি নতুন ধরনের খেলা খুঁজে পেয়েছে সে। এ খেলায় বিপদ রয়েছে। অথচ নিপুণভাবে চালিয়ে গেলে তার প্রচুর লাভ হবার সম্ভাবনা। তাই জয়মল্ল আর পট্টের প্রস্তরমূর্তির কথাও সাময়িকভাবে ভুলে যায় সে।

শেষে একসময়ে রানীর কাছ থেকে বিদায় নেয় জিৎ। রানীর অলক্ষ্যে বীরবল-কন্যা ইশারা করে তাকে। সেই ইশারায় সাড়াদেয় জিৎ সিং অল্প একটু মাথা ঝাঁকিয়ে। তারপর বাইরে চলে আসে।

বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পৃথ্বীরাজ রাঠোর।

গম্ভীর মানুষটি জিৎ সিং-কে দেখে এগিয়ে এসে ভারী গলায় বলেন,—তুমিই বুঝি আমার শ্যালক?

জিৎ সিং বুঝতে পারে না, উক্তিটি ক্রোধের, না রসিকতাপ্রসূত। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পৃথ্বীরাজ রাঠোর তার পিঠে হাত রেখে বলেন,—ভয় পেলে নাকি?

—না। ভয় পাইনি। তবে ভাবছি যে আপনার সঙ্গে অনেক আগেই দেখা করা উচিত ছিল।

—কিছু ভেব না। আমার সঙ্গে দেখা না করলেও চলবে। তোমার বোনটির দিকে একটু লক্ষ্য রেখো। কারণ আমাকে বাইরে বাইরেই থাকতে হয়।

—আমি জানি। আজও তো শিকারে যাবার কথা ছিল আপনার?

—হ্যাঁ। কিছুদূর গেছলাম বাদশাহের সঙ্গে। ফিরে এলাম। তিনি ফিরিয়ে দিলেন এক জরুরী কাজে। আজ দুটি পাথরের মূর্তি তৈরি হয়ে এসেছে। সে দুটিকে ঠিকভাবে বসাতে হবে কেল্লার সামনে। এ দুটি যে আজ আসবে, সেকথা একদম ভুলে গেছলেন বাদশাহ্।

—আমরা দেখেছি মূর্তি দুটিকে।

—ও। এপথ দিয়েই নিয়ে যাবার কথা বটে। বল তো কাদের মূর্তি?

—শুনেছি।

—শুনেছ? শুনে অবাক হয়েছ, তাই না? সবাই হবে। কিন্তু বাদশাহ্ অন্য ধরনের মানুষ। তাঁর গুণের অন্ত নেই। শুধু একটি মাত্র দোষ রয়েছে। সে কথা যাক। মানুষ মাত্রেরই দোষ আছে।

জিৎ সিং বলে,—পরে একদিন এসে আলাপ করব তবে।

—কোনো প্রয়োজন নেই ভাই। তোমার সংকোচেরও কোনো কারণ নেই। তোমাকে একবার দেখার ইচ্ছা ছিল, দেখা হয়ে গেল। ব্যস, তোমায় দেখে আমি সন্তুষ্ট।

—আপনি খুব অল্পে সন্তুষ্ট হন।

—হ্যাঁ! রাজপুতদের স্বভাব। তাই অনেক সময়ে অল্পেই ঠকে যায়। একলিঙ্গের ছায়ায় মানুষ কিনা। স্বভাবও তাঁর মতন।

জিৎ সিং-এর বড় ভালো লাগে লোকটিকে।

—তোমার বোন কি করছেন? এবার ভেতরে যেতে পারি?

—সেকি! আপনি ভেতরে যাবেন, তাতে—

—বুঝছ না? নিজের বাড়ি হলে কি হবে, এসব ব্যাপারে ওদের প্রাধান্য দিতে হয়। ওরা খুশি হয়। ওরা খুশি হলে ওদের স্বাস্থ্য ভালো। থাকে। এইটাই আমাদের লাভ। জিৎ সিং হেসে ওঠে। এমন গাম্ভীর্যপূর্ণ রসিকতা সে শোনেনি কখনো।

—হাসছ? সময় হলে বুঝবে আমার কথাই ঠিক।

আরও দু-চারটে কথার আদান-প্রদানের পথ পৃথ্বীরাজ উধমকে ডেকে বলেন,—একে পৌঁছে দিয়ে এসো উধম।

—না না, আমি নিজেই যাব।

—সে তো রোজই যাচ্ছ, একদিন গাড়ি করে গেলে ক্ষতি কি?

জিৎ সিং উধমের সঙ্গে যায়। পৃথ্বীরাজের বাড়ির সামনে শকটের ভেতরে গিয়ে বসলেও, কিছুদূর গিয়েই উদমের পাশে উঠে গিয়ে বসে। উধম কিন্তু নিজে থেকে একটি কথাও বলে না, চুপ করে বসে থাকে। জিৎ সিং অবাক হয়। বাজে কথা খরচ না করলেও, একেবারে এমন চুপচাপ কখনো থাকে না সে। বিশেষত তারা দুজনাই শুধু যখন রয়েছে।

—তোমার কী হয়েছে উধম?

—কিছু না।

—একটাও কথা বলছ না?

—একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

—কিসের চিন্তা?

—ভাবছি বীরবলের বাড়িতে গা-ঢাকা দিয়ে প্রবেশ করা কি সম্ভব?

জিৎ সিং উধমের হাত ধরে চাপ দেয়। তার মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টি ফেলে বলে,—কী ক’রে জানলে বল।

—কিসের কথা বলছেন?

—ভালোভাবেই জান কিসের কথা বলছি। বল, কি ক’রে তুমি জানলে?

—কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় সব দিকে ভালোভাবে দৃষ্টি রেখে বলা উচিত। বিশেষ ক’রে কথাগুলো যদি গোপনীয় হয়।

—তুমি কাছে ছিলে সে সময়ে?

—হ্যাঁ।

জিৎ সিং উধমের হাত ছেড়ে দিয়ে একটু হাসে, একটুখানি চিন্তা করে। তারপর বলে,—ভুল করেছি?

—বলতে পারি না, শেষ না দেখা অবধি বলা সম্ভব নয়।

—যদি আজই শেষ হয়ে যায়।

—হতে পারে, অসম্ভব নয় কিছুই।

—যদি তেমন কিছু ঘটে, তুমি অন্তত আমার জন্যে চোখের জল ফেলো উধম। কারণ রানী তার ভাই-এর ওই পরিচয় পেলে ঘৃণায় শিউরে উঠবে। জান তো, মেয়েদের স্নেহ প্রেম ভালোবাসা ততদিনই কারও ওপর বর্ষিত হয়, যতদিন তার সংস্কার বা ভুয়ো আদর্শের সঙ্গে সংঘাত না বাধে। জান একথা?

—কিন্তু সে তো পরের কথা। আমার চোখে যে জল আসে না। এলে এখনি প্রতিজ্ঞা করতাম।

—এসব কথা রানীকে বলে দেব উধম?

—আমি কাউকে কিছু বলি না।

জিৎ সিং ভালোভাবেই জানে সেকথা। তাই নিশ্চিন্ত মনে সরাইখানার সামনে নেমে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *