আগ্রা – ৩

৩.

সহজেই সৈন্যদলে জায়গা মিলল।

রাজা মানসিংহ বিশেষ কিছুই প্রশ্ন করেন না তাকে। বাদশাহ্ নিজে তাঁর কাছে আসতে বলেছেন শুনে শুধু একবার ভালোভাবে জিৎ সিং-এর চেহারা দেখে নিলেন। তারপর বললেন,

—এখানে এসে মাঝে মাঝে খবর নিও।

জিৎ সিং বাইরে আসে। দ্বিতীয়বার মানসিংহকে দেখল সে। প্রথম দিনে এতটা ভালোভাবে দেখেনি। চেহারার মধ্যে রাজপুতসুলভ গাম্ভীর্য রয়েছে। হাতের কব্জি দেখলেই চেনা যায় অসিযুদ্ধে তিনি পারদর্শী। তবু তাঁকে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারল না জিৎ সিং। মনে মনে ঘৃণা হল। এ-ঘৃণা পৃথ্বীরাজ রাঠোরের কথা ভাবলে হয় না। মানসিংহ যদি নিজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন তাহলে হয়তো এতটা বিরূপ হত না তার মন। কিন্তু ঐশ্বর্যের বিনিময়ে, নিরাপত্তার বিনিময়ে তিনি নিজের আত্মীয়দের সমর্পণ করেছেন আকবরের হারেমে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য রাজপুত-নৃপতিদের এই একই পথ অবলম্বনের জন্যে প্ররোচিত করেছেন। মানসিংহ রাজপুত- কলঙ্ক।

আকবর শাহের কথা ভাবে জিৎ সিং। তাঁর অনেক কুকীর্তির কথা এই কদিনের মধ্যে কানে এসেছে তার। চিতোরে তাঁর অকথ্য অত্যাচারের সে সাক্ষী। তবু তানসেনের গৃহে তাঁকে দেখে একটা শ্রদ্ধাভাবে উদয় হয়েছিল তার মনে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে বুকে অসি বিঁধিয়ে দিতে পেছপা হবে না সে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কোনোদিনই ঘৃণা করতে পারবে না সে—যেমন পারবে মানসিংহকে।

আকবর শাহ্ এক অসাধারণ পুরুষ। তাঁর অনেক দোষের মধ্যেও তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব সূর্যের মতো সব সময় জ্বলজ্বল করে। কিকা আজ যদি এক বিরাট রাজ্যের রাজা হতেন, তবে তিনিই শুধু এই বিরাট পুরুষের যোগ্য প্রতি দ্বন্দ্বী হতে পারতেন। কিন্তু সে কি কখনো সম্ভব হবে কিকার পক্ষে? যদি ভাগ্যগুণে তিনি মেবারের আসনও অলংকৃত করেন, তবু উভয়ের মধ্যে থাকবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেই পার্থক্য লোকবলের, সেই পার্থক্য অর্থবলের।

অনির্দিষ্ট ভাবে পথ চলে জিৎ সিং। শিরস্ত্রাণে হাত ছোঁয়ায় সে। একলিঙ্গের নির্মাল্য রয়েছে সেখানে। শুধু নির্মাল্য নয় আর একটি জিনিস রয়েছে তার কাছে। সেটি শিরস্ত্রাণে নেই, রয়েছে বুকের কাছে। চিতোর ছাড়ার পর জিৎ সিং মুহূর্তের জন্যেও সেটি কাছ ছাড়া করেনি। কাপড়ে বাঁধা এক টুকরো হাতের লেখা।

নির্মাল্য দিয়েছে লীলাবতী। লীলাবতী তার মঙ্গল চায়—অথচ ফিরে গেলে তাকে গ্রহণ করতে চায় না। কালপীর মেয়ে লীলাবতী। কালপীর মেয়ে শংকরীর মতোই সে তেজস্বিনী। শংকরী তবু পিতার অবাধ্য না হ’য়ে বিয়ে করেছিল। লীলাবতী কি করবে কেউ বলতে পারে না। জিৎ সিং-এর সঙ্গে মিলন সম্ভব নয় দেখে হয়তো আজীবন অবিবাহিতই থেকে যাবে। সর্দার গোপাল সিং যশোবন্তকে যে অনুরোধ ক’রে গিয়েছিল, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতে, সেই অনুরোধ রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হবে না বৃদ্ধের পক্ষে। ভগ্নহৃদয়ে একদিন প্রাণত্যাগ করবে উদয়সাগরের তীরে। তারপর তার নশ্বরদেহ গিয়ে মিশবে উদয়সাগরের তীরভূমিতে, তার জলে আকাশে বাতাসে। আর তার আত্মা ছুটে যাবে শংকরীর কাছে। যাবার আগে গোপাল সিং-এর সঙ্গে দেখা করে যাবে। বলবে তুমি তো সবই দেখলে। চেষ্টার আমি ত্রুটি করিনি। কিন্তু মর্ত্যে ভাগ্য আর নিয়তিই হল প্রধান।

অন্যমনস্কভাবে পথ চলতে চলতে জিৎ সিং-এর দেখা হয় সেই প্রথম দিনের উটওয়ালার সঙ্গে।

—কেমন আছো আব্বাস খাঁ?

—কে? আব্বাস খাঁর চোখে জিজ্ঞাসা।

—চিনতে পারলে না?

এবারে ভালোভাবে দেখেই সে চেঁচিয়ে ওঠে,—আরে চেনাই যায় না যে। এমন সুন্দরী পোশাক গায়ে উঠেছে চিনব কি ক’রে? দেখে মনে হচ্ছে যেন হিল্লে হয়ে গেছে একটা।

—হ্যাঁ। তা হয়েছে। রাজা মানসিংহের দলে ভিড়ে গেলাম।

—তাই নাকি? খুব ভালো হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে। আনন্দ হল।

—–তোমার বিবির খবর ভালো? ছেলে হতে কত দেরি?

—সে কথা যখন জানতে চাইছ তো বলি, গলা অবধি হয়ে গেছে—মুখটা হলেই হয়ে যায়! জিৎ সিং হেসে ওঠে।

উটওয়ালাও হাসে। তারপর বলে,—তা তুমি কোন্ দলে? কাজের সময় কাজী নাকি? –তোমার কথা বুঝলাম না ভাই।

—বুঝলে না? জানতাম, বুঝবে না। বাদশাহের দুই জাতের সিপাহী আছে। প্রথম জাত হল চিরকালের সিপাহী। তারা সংখ্যায় কম। যুদ্ধের সময়ে যুদ্ধ করে আর অন্য সময়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়। শুধু সময় মতো বেতন নেয়। দ্বিতীয় জাতকে আমরা বলি, কাজের সময় কাজী। কোথাও যুদ্ধে যেতে হলে শুধু তাদের ডাক পড়ে। অন্য সময়ে নিজেদের পেটের চিন্তা নিজেরাই করে তারা। বাদশাহ্ তাদের কোনো হুকুম করেন না। তাদের হুকুম করেন তাদের আমীর ওমরাহ রাজা। তুমি কোন্ দলে?

—আমি কাজের সময় কাজী। কিন্তু ভাই, আমি তো কোনো রাজার অধীনে নই। রাজা মানসিংহের দলে গেলাম বটে, কিন্তু আমি তাঁর প্রজা নই।

—একটু অদ্ভুতই বটে! তবে এমন সেপাহীও আছে কিছু। তারা শুধু যুদ্ধ করে। বাদশাহ্ শিগগির কোথাও যাচ্ছেন নাকি?

—বলতে পারি না।

—বলতে পারো না? সে আবার কি কথা? মানসিংহের সঙ্গে দেখা হয়নি?

—হয়েছিল।

—তিনি কিছু বলেননি?

—বললেন, মাঝে মাঝে গিয়ে খবর নিতে।

—তবেই হয়েছে। তুমি দেখছি ফালতু লোক। যতদিন কোথাও না যাচ্ছো, চালাবে কি ক’রে?

—তাই তো ভাবছি।

ভাবলে পেট ভরবে না। একটা জুটিয়ে নাও তাড়াতাড়ি। তোমার মতো ফালতু সিপাহী যারা আছে, তারা একবার যুদ্ধে যাবার সুযোগ পেয়ে লুটের মাল নিয়ে এসে বড়লোক হয়ে যায়। গণ্ডোয়ানায় গিয়ে কমসে কম হাজার সিপাহীর বরাত ফিরে গেছল ভাই। কিন্তু সে সব হল ভবিষ্যতের কথা। তাড়াতাড়ি কিছু জুটিয়ে নাও।

—তোমার উটের পিঠে বসতে দেবে?

—তোমার ঘোড়া কই?

—সেটি খোয়া গেছে।

উটওয়ালা কোনোরকম বিস্ময় প্রকাশ না করে বলে,—জানতাম। নিশ্চয় রহিমবক্সের দলের কাজ।

জিৎ সিং অবাক হল। রহিমবক্সকে উটওয়ালাও চেনে। আমীর ওমরাহদের হয়ে বোধ হয় উটও কেনে সে। বলে,—আমীরদের সঙ্গে বুঝি খুব খাতির আছে রহিমবক্সের?

—খাতির? খাতির থাকতে যাবে কেন? তবে ভালো ঘোড়া নিয়ে যদি সামনে হাজির করা হয় তবে লোভ হয় না কার? ওরা তো আর দেখতে যায় না জিনিসটি আসছে কোথা থেকে।

—রহিমবক্সের পেশা কি শুধু চুরি?

—শুধু চুরি নয়। ডাকাতি কিছু খুন-খারাপি। তার দল রয়েছে মস্ত

জিৎ সিং-এর ক্রোধ হয়। এইরকম একজন জঘন্য লোক যে তাকে ঠকিয়েছে ভাবতে গা জ্বালা করে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এর উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে রহিমবক্সকে। খুব শিগগিরই দিতে হবে। কারণ রণথম্ভোর অভিযানের জন্যে যখন-তখন ডাক আসতে পারে।

—রহিমবক্সের আস্তানা কোথায় জান?

—পাগল হয়েছ নাকি? ওদের আস্তানার কথা জানাও পাপ।

—কোথায় গেলে জানতে পাবো?

—কেন? ভেবেছ, ওই ঘোড়া তুমি ফিরে পাবে? স্বপ্নেও ভেবো না সেকথা। ওর হাতে একবার যায়, তা আর ফেরে না। চিরকালের মতো চলে যায়। তোমাদের ধর্মের সেই অগস্ত্য মুনির মতো।

আব্বাস খাঁ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে।

জিৎ সিং বলে,—চেষ্টা করব তবু।

—চেষ্টা? বেশ করো। কিন্তু ঘোড়াকে খুঁজে পেলেও, ফিরে পাবে না। ওর কপালে এতক্ষণে বসরার গোলাপের ছাপ পড়ে গেছে।

—বসরার গোলাপের ছাপ কেন?

—কেন? ওই দেখো। ওই ঘোড়াটার কপালের দিকে চেয়ে দেখো।

জিৎ সিং দেখে, একজন লোক ঘোড়ায় ক’রে পথ চলছিল। উচ্চপদস্থ কোনো কর্মচারী হবে। বেশবাসের খুব পারিপাট্য। উটওয়ালার কথামতো সে ঘোড়াটির কপালের দিকে চায় গোলাপের ছাপ কপালে।

—দেখলে তো?

—ওই ছাপের অর্থ!

—বাদশাহের সব ঘোড়ারই ওই ছাপ। ওটি হল বাদশাহী ঘোড়ার চিহ্ন।

—যদি অন্য কোনো আমীর কিনে নেয় আমার ঘোড়া?

—ইচ্ছে করলে তিনি নাও দিতে পারেন ওই ছাপ। কিন্তু আগ্রায় বসে বাদশাকে তুষ্ট করতে সবাই চায়। তাই তাঁদের ঘোড়াও ছাপমারা।

—রাজা মানসিংহের?

—তাঁর ঘোড়াদেরও ওই চিহ্ন রয়েছে।

—পৃথ্বীরাজ রাঠোর?

—না তিনি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সবাই এই কথাই বলে শুনি। বাদশাহ্ তাঁকে খুবই পছন্দ করেন, অথচ তিনি নিজের মতো চলেন। আমাদের মুসলমান ভাইরা বাদশাহের এই দুর্বলতা পছন্দ করে না। তারা ফিসফিস ক’রে অন্য কথা বলে।

—কী কথা?

—সেকথা শুনে তোমার কাজ নেই ভাই। সে সব হল নোংরা কথা।

—বল না। এককালে তো তুমি হিন্দুই ছিলে। এখনই না-হয় ইসলাম ধর্ম নিয়ে নিয়েছ।

—সে সব বিশ্রী কথা ভাই। পৃথ্বীরাজের রানীর নামকে জড়িয়ে নিয়ে সব ব্যাপার। রানীর মতো খুব-সুরত্ জেনানা কিন্তু সত্যিই দুর্লভ। আমি দেখেছি।

আক্রোশে দু-হাতের মুঠো বন্ধ ক’রে জিৎ সিং। অথচ কিছুই করতে পারে না। গুজবকে কখনো ক্রোধ দেখিয়ে বন্ধ করা যায় না। অসি চালিয়েও গুজব থামানো যায় না। তাই কোনো উত্তর দেয় না জিৎ সিং। তার চোখের সামনে শুধু ভাসে পৃথ্বীরাজের রানীর অপূর্ব মুখখানি তার বোন সে, মেবারের মেয়ে। জিৎ সিং নিজের হাতখানা একবার সামনে তুলে ধরে। সে হাতে রাখী বাঁধা। জ্বলজ্বল করছে সেই রাখী।

উটওয়ালা বলে, আচ্ছা চলি ভাই।

—দাঁড়াও না একটু। রহিমবক্সের ঠিকানা কোথায় পাওয়া যায়?

—তাও বলতে পারব না। তবে এক জায়গায় চেষ্টা করে দেখতে পার।

—কোথায়? জিৎ সিং-এর কণ্ঠস্বরে আগ্রহ ঝরে পড়ে।

—এই রাস্তা ধরে সোজা চলতে চলতে ডান দিকে একটা ভাঙা মসজিদ দেখবে। সেই মসজিদের পাশে একটা ছোট্ট বাজার বসে। ওই বাজারে এক কসাই আছে। তাহের তার নাম। মাংস বিক্রি করে—গোস্ত। যে গোস্তের নাম তোমরা মুখে আনো না, সেই গোস্ত। ওই তাহেরের সঙ্গে নাকি তার যোগাযোগ আছে। ওর কাছে গিয়ে চেষ্টা করতে পার।

—ধন্যবাদ আব্বাস খাঁ। তুমি সত্যিই আমার উপকার করলে।

—উপকার করলাম? কী জানি, বলতে পারি না। অপকারও করতে পারি। কারণ, তুমি যদি ঘোড়া ফিরে পাবার সামান্য চেষ্টাও কর, তবে আগ্রার পথে তোমাকে আর ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে না। মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধেও যেতে পারবে না।

উটওয়ালা চলে যায়।

জিৎ সিং সোজা পথে চলতে শুরু করে। তার দৃষ্টি রাস্তার ডান দিকে। মসজিদটি তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। তাহেরের সঙ্গে সে যোগাযোগ করবে। আজই, এখনি।

.

অনেকটা দূর হেঁটে যাবার পর মসজিদ দেখতে পায় সে। ভাঙা মসজিদই বটে। এত বড় রাজপথের ওপর ভগ্ন অবস্থায় ওইভাবে মসজিদটি পড়ে থাকা খুব আশ্চর্যের। সংস্কার ক’রে নেবার অর্থের অভাব নেই আগ্রার কারও। হয়তো কোনো ইতিহাস আছে পেছনে

জিৎ সিং মসজিদ-সংলগ্ন খোলা জায়গাটি দেখতে পায়। বাজার বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নয়। দু-চারটে ছোটখাটো দোকান-পাট রয়েছে শুধু। একপাশে চাটাই-এর ওপর স্তূপীকৃত গম পড়ে রয়েছে। হয়তো বিক্রির জন্যে।

মাংসের দোকান খুঁজে বের করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না জিৎ সিং-এর। সে সামনে দাঁড়াতেই ক্রেতার এবং বিক্রেতাদের মুখগুলি তার দিকে ঘুরে যায়। তাদের চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে।

মাংসওয়ালা বলে ওঠে,—সে কি? পথ ভুলে গেছ?

—না।

—তবে? নতুন মুসলমান হয়ে পোশাক বদলাবার টাকা পাচ্ছ না?

—আমি হিন্দু।

—হিন্দু হয়ে এই দোকানের সামনে, বল কি গো? তোমার জাত যাবে না?

—না।

মাংসওয়ালা এবারে বিজ্ঞের হাসি হেসে বলে,—ও বুঝেছি। গোপনে গোপনে চালাচ্ছ বোধহয়?

—আমি সেজন্য আসিনি। আমি অন্য খোঁজে এসেছি।

—কিসের খোঁজে?

—তোমার নাম তাহের?

লোকটি জিৎ সিং-এর দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর হয়ে বলে,—কি প্রয়োজন তোমার?

—যদি তুমি তাহের হও, একটু বাইরে এসো। কথা আছে।

লোকটি ক্রেতাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে, জিৎ সিং-কে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলে, —আমি তাহের। কি কথা বল।

—আমি রহিমবক্সের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

—কে বলল, আমি রহিমবক্সকে চিনি?

—একজন বলেছে আমাকে। এখন আমিই বলছি, তুমি রহিমবক্সকে চেন। না চিনলে অন্যভাবে কথা বলতে।

—বেশ, আমি চিনি। কিন্তু কেন দেখা করতে চাও?

—আমার দরকার আছে।

—কী দরকার?

—সেকথা বলব না।

—তবে দেখাও হবে না।

জিৎ সিং হাত উল্টে বলে,—না দেখা হলে আমার ক্ষতি নেই, রহিমবক্স ঠকবে।

তাহের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চায় জিৎ সিং-এর দিকে। তার সারামুখের ছোট ছোট ক্ষতের চিহ্ন মুখখানাকে বীভৎস ক’রে তোলে। সে বলে,—ওসব প্যাঁচ কষে বিশেষ কাজ হবে না। আমি বুঝেছি দেখা করার গরজ তোমার। সব খুলে বল।

জিৎ সিং জানে, সরাইখানার ছোকরা চাকরটিও রহিমবক্সের পাত্তা রাখে। তাকে পয়সার লোভ দেখালে, সেও বলে দেবে। তবে তার সাহায্য নেয়নি সে। কারণ খোঁজ বলে দিয়ে, খবরটা রহিমবক্সকে পৌঁছে দিতে পারে। তাতে অসুবিধে অনেক। তবু তাহের যদি তাকে না বলে দেয় তবে সেই মাধবের কাছেই যেতে হবে।

তাহেরের কথায় জিৎ সিং হাসে। বলে,—তুমি যদি না বলতে চাও আমার ক্ষতি নেই। তোমাকে যেমন খুঁজে বের করেছি, রহিমবক্সকেও পারব। রহিমবক্স বিখ্যাত লোক। সে তোমার মতো আজেবাজে কেউ নয়। তার কাছে পৌঁছোবার হাজার পথ রয়েছে।

জিৎ সিং চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই তাহের তার হাত চেপে ধরে। তার হাতের কর্কশতা অনুভব করে জিৎ সিং। সারাদিন মাংস কেটে কেটে কোমলতা বলে কিছু নেই। হাতের ত্বক নষ্ট হয়ে গেছে। ওপরদিকে ঘা হয়েছে। তাহেরের গায়ের গন্ধ পায় জিৎ সিং। মাংস ঘাঁটলে বোধহয় অমন গন্ধ বের হয়।

তাহের চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,—চলে যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না।

—গায়ের জোরের কথা বলছ দেখছি।

—আলবত।

—এত লোকের সামনে গায়ের জোর দেখাবে কি করে? ওর বাধা দেবে না? তাহেরের মুখে কুৎসিত হাসি ফুটে ওঠে। বলে,—ওরা? ওরা আমার লোক।

—তোমার? তুমি এই বাজারের বাদশাহ্ নাকি?

তাহের তার কথায় কান না দিয়ে সজোরে ঝাঁকি দেয় তার হাতে। আচমকা ঝাঁকিতে জিৎ সিং ব্যথা পায়। সেই সঙ্গে সে বুঝতে পারে, তাহের শক্তিশালী পুরুষ। তার কব্জির জোর মামুলি নয়।

—কেন এসেছ এখানে?

—বলিনি সে কথা? রহিমবক্সের সঙ্গে দেখা করতে।

—ঠাট্টা রাখো। মুখে এক গুঁতো দিলেই ঠাট্টা বন্ধ হয়ে যাবে। কেন দেখা করতে চাও রহিমবক্সের সঙ্গে?

—তুমি আমাকে বোকা ভাব নাকি? আমি কি ক’রে বুঝবো তুমি রহিমবক্সের বন্ধু? শত্রুও তো হতে পার। তোমাকে বললে, শেষে তার বিপদ হবে। তা আমি হতে দেবো না। তার কাছে নিয়ে চল আমায়, সেখানেই সব বলব। তুমিই শুনো তখন।

—আমাকে না বললে, রহিমবক্সের সঙ্গে দেখা হবে না।

—বেশ, ভালো কথা। আমি চলে যাচ্ছি, হাত ছাড়ো।

—একবার যখন এসে পড়েছ, অত সহজে কি ছাড়া পাবে? পেটের কথা বের ক’রে নেব।

—কি ক’রে বের করবে?

—পেটে লাথি মেরে। ভেবেছ অত বড় তলোয়ার ঝুলিয়েছ বলে ভয় পাব? আমি জানি ওটি তুমি তুলতেও পারবে না। কার তলোয়ার ওটি, তোমার ঠাকুর্দার?

জিৎ সিং অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রাখে। সে বুঝতে পারে একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এ সময়ে ভয় পাওয়া যেমন উচিত নয়, ক্রোধে জ্ঞান হারিয়ে ফেলাটাও ঠিক হবে না। এ সময়ে মেজাজকে ঠাণ্ডা রেখে সব দেখে যেতে হবে। নিজেকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। তাহেরকে সে চিনে ফেলেছে। ঘৃণ্যতম কাজ করতেও বাধে না এর। সে আরও বুঝতে পারে, এই অপেক্ষাকৃত নির্জন বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতা সবাই একই গোষ্ঠীর লোক। তাহের একবার চেঁচিয়ে উঠলে মুহূর্তের মধ্যে ওরা সবাই এসে ঘিরে ধরবে তাকে।

জিৎ সিং হঠাৎ হাসতে শুরু করে।

—এই, হাসছ কেন?

জিৎ সিং হেসেই চলে। কথার জবাব দেয় না।

তাহের তার হাত ছেড়ে দিয়ে মাথার ওপর সজোরে কিল দিয়ে বলে,—চুপ কর শালা।

জিৎ সিং-এর হাসি থেমে যায়। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,—মারলে যে?

—হাসছ কেন?

—হাসব না, হাসির ব্যাপার হলে হাসব না? তোমার মতো লোক আমি কোথাও দেখিনি। দিল্লী ঘুরলাম, পাঞ্জাব ঘুরলাম, গুজরাট ঘুরলাম, কত জায়গায় ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু এমন বোকা মানুষ আমি কোথাও দেখিনি।

তাহের বিদ্রূপের স্বরে বলে,—এত জায়গায় ঘুরলে? তাই নাকি? পেট থেকে পড়েই ঘুরতে শুরু করেছ নাকি?

—পেট থেকে পড়ে, মোটেই নয়। পেটে থাকতে থাকতেই ঘুরতে শুরু করেছি। বাবার তো কাজই ছিল, বড় বড় জায়গায় গিয়ে ঘোড়া নিয়ে সরে পড়া। মাকে সঙ্গে রাখত বাবা।

—ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ত, তার মানে?

—তার মানে আবার বলে দিতে হবে নাকি? ঘোড়া নেবার মানে জানো না? তবে তো আমি ঠিকই ধরেছি। তুমি রহিমবক্সের লোক নও

—চুপ। আমি রহিমবক্সের লোক।

—তাহলে ঘোড়া নিয়ে সরে পড়ার মানে জানতে চাও কেন?

—ওসব ছাড়। নতুন কিছু আছে নাকি?

—আছে, রহিমবক্সের কাছে নিয়ে চল। নইলে বলব না।

—আরে শালা, সে এখন নেই আগ্রায়। আমার কাছেই বলতে হবে।

—কোথায় গেছে?

—সেকথা বলে যায় নাকি? বলেছে, ফিরতে দু-তিন দিন দেরি হতে পারে। আজই তো গেল। জিৎ সিং-এর একটু ভাবনা হয়। শেষে তার ঘোড়াকে নিয়ে সরে পড়ল না তো? তাড়াতাড়ি বলে সে,—তবে নিশ্চয়ই ঘোড়া নিয়ে গেছে। বাবার কাছে শুনেছি আগ্রার বাইরে পা বাড়ালেই ঘোড়া চাই রহিমবক্সের।

—তোমার বাবা ছাই জানে। ঘোড়া নিয়ে সে এক পাও চলে না। তোমার বাবা যখন দেখেছে, তখন কি করত বলতে পারি না।

—বাবা মিথ্যে বলে না। এখন হয়তো বদলে গেছে সে।

—ঠিক আছে। এবারে বল।

জিৎ সিং মুহূর্তের জন্যে চিন্তা ক’রে নেয়। রহিমবক্স যদি ঘোড়া না নিয়ে যায় তবে কিকার ঘোড়াটি এখনো হয়তো আছে। গোলাপ ফুলের ছাপ নাও পড়তে পারে তার কপালে। কিন্তু ঘোড়াটি কোথায় আছে জানা দরকার। এদের একটা ঘোড়াশালা থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেই ঘোড়াশালার হদিশ জানতে হলে তাহেরকে চটিয়ে লাভ নেই।

—তোমাকে বিশ্বাস করেই বলছি কিন্তু। জানি না তুমি রহিমবক্সের শত্রু কি না। সরাইখানার ঘোড়াটা দেখেছ?

তাহেরের চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। সে আবার জিৎ সিং-এর হাত চেপে ধরে বলে,—সেই খবর তুমি কোথায় পেলে?

—কোথায় পেলাম, তোমার জানার দরকার নেই। রহিমবক্স এলে তাকে বলবে কিষণ এসেছিল। কিষণ বললেই চিনবে সে। আর বলো, ওই ঘোড়ার চেয়েও তেজী জিনিসের খবর আছে।

তাহের একটু উত্তেজিত হয়। বলে,–কোথায়?

—সে খবর তোমায় দেবো না দোস্ত। সেটি নিজের মুখেই তাকে জানাবো।

একটু ভেবে নিয়ে জিৎ সিং আবার বলে,কিন্তু তোমায় জানাতেই বা ক্ষতি কি? ঘোড়াটি আমার কাছেই রয়েছে।

—তোমার কাছে? কোথায় থাকো তুমি?

—ও বাবা। এ দেখছি সব খবরই নিতে চায়। বয়েস কাঁচা হলেও, অত কাঁচা আমি নই। তার চেয়ে, তিন দিন পরে ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে আমি আসব। রাজি?

তাহের জিৎ সিং-এর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, –রাজি।

জিৎ সিং দেখে, তাহের তার হাতের যে জায়গায় ধরেছিল, সেখানে দাগ পড়ে গেছে। শুধু শক্তভাবে ধরবার জন্যই ও দাগ নয়। ওখানে গোস্তের চর্বি আর শুকনো রক্তও লেগে রয়েছে। সেই রক্তের দাগ পৃথ্বীরাজ রাঠোরের রানীর দেওয়া রাখীকে স্পর্শ করেছে।

ক্রেতারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল তাদের দুজনাকে, আর নিজেদের মধ্যে অনুচ্চ কণ্ঠে আলোচনা করছিল। তাড়া নেই কারও। তাদের জন্যে তাহেরের কোনো উদ্বেগও নেই। ক্রেতারা তারই দলের লোক। অন্য কোথাও মাংসের জন্যে তারা যায় না।

তাহের দোকানের দিকে অগ্রসর হবার ভান করে। মনে মনে সে স্থির করে রেখেছে এই রাজপুত ছোকরাকে কখনই সে ছাড়বে না। তবু একবার দেখতে চায় এর মতলব কি।

জিৎ সিং বলে ওঠে,—একটু শোন তাহের ভাই।

ঘুরে দাঁড়ায় তাহের।

জিৎ সিং বলে,–ঘোড়াটিকে কোথায় আনতে হবে?

—এখানে।

—পাগল হয়েছে নাকি? এই খোলা জায়গায় এনে ধরা পড়ব শেষে?

—সন্ধ্যার পর এনো।

—তবু এখানে আনতে পারব না। অত সাহস আমার নেই। দরদাম ঠিক করতে সময় লাগবে। এক কথায় রহিমবক্স রাজি হবে না, আমিও হবো না। এতক্ষণ এই ফাঁকা জায়গায় রাখা চলবে না। তাছাড়া বাবার উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। বাবা বলেছে, এসব জিনিসের আদান-প্রদান খোলামেলা জায়গায় কখনো করা উচিত নয়।

তাহের একটু চুপ ক’রে থেকে বলে,—আচ্ছা দাঁড়াও। আমি খবর নিচ্ছি।

দোকানে ঢুকে কয়েকজনের সঙ্গে ফিসফিস করে আলোচনা করে সে। তারপর একজনকে কিছু বলতেই লোকটি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।

জিৎ সিং অপেক্ষা করে।

তাহের মাংস বিক্রির দিকে মন দেয়।

জিৎ সিং এবার সবার দিকে নজর দেবার অবসর পায়। এদের মধ্যে কেউ-ই সাধারণ শান্তিপ্রিয় নাগরিক নয় মোটেই। এদের হাব-ভাব কথাবার্তা সবই একটু অন্য ধরনের। অনেক কথা এরা ইঙ্গিতে বলে চলেছে। অনেক কথার অর্থ বোঝা যাচ্ছে না। অথচ নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে সেই সব কথাবার্তা নিয়ে। তাহের এদের মাংস দিয়ে চলেছে। বিক্রেতা হয়েও তার দাপটই সব চাইতে বেশি।

কিছুক্ষণ পর লোকটি ফিরে আসে। তাহেরের কানে কানে কি যেন বলে। শুনে একটু স্তব্ধ হয়ে থাকে তাহের। তারপর তার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। সে জিৎ সিং-এর কাছে এসে বলে,—ঠিক আছে। চল।

—কোথায়?

—ঘোড়া নিয়ে আসবার জায়গাটা দেখবে না?

—হ্যাঁ। চল।

তাহের অপর একজনকে মাংসের দোকানে বসিয়ে রেখে জিৎ সিং-কে সঙ্গে নিয়ে চলে। জিৎ সিং লক্ষ্য করে তার পেছনে পেছনে আরও দু-তিনজন নির্বিকার ভাবে চলেছে। যেন ওইদিকেই তাদের বাড়ি। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না জিৎ-এর। তাহের ঝুঁকি নিতে চায়নি। যদিও তার বিশ্বাস জিৎ সিং-এর কোমরে বাঁধা তলোয়ার শুধু শোভাবর্ধনের জন্যে।

অনেক অলি-গলি ঘুরে তাহের ওকে নিয়ে চলে। একটু চিন্তিত হয় জিৎ সিং। সন্ধ্যা হতে যদিও অনেক বাকি, তবু এক এক জায়গায় সূর্যের আলোর চিহ্নমাত্র নেই। দুপাশে ছোট ছোট ঘর। ঘরের ওপরে বড় বড় গাছ রীতিমতো অন্ধকারের সৃষ্টি করেছে। আগ্রার মতো নগরীতেও এই রকমের জায়গা আছে ধারণা ছিল না জিৎ সিং-এর।

আর কিছুটা চলার পর তাহের এক জায়গায় এসে থামে। সেখানে দুইটি পাকা বাড়ির মাঝখান দিয়ে একটি সরু গলির মধ্যে জিৎ সিং-কে প্রবেশ করতে বলে। বিনা দ্বিধায় জিৎ সিং সেখানে ঢুকে পড়ে।

গলিটা পার হতেই একটি ফাঁকা জায়গা। জায়গাটির চারদিক বড় বড় বাড়ি ঘিরে রেখেছে আর সেখানে আট-দশটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে কিকার ঘোড়াটি অনেক রোগা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। তবে তার কপালে এখনো গোলাপ ফুলের ছাপ পড়েনি। এখানকার কোনো ঘোড়ার কপালেই ছাপ-মারা নেই। এগুলি রয়েছে বিক্রির জন্যে। এখনো মালিক জোটেনি।

জিৎ সিং-এর ভেতরটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। তার বুকের ভেতর দপদপ করে। সে ভাবে, ঘোড়াটির লাগাম নেই। তবু সুযোগ পেলে ওটিকে নিয়ে ছুটে বের হয়ে যাওয়া যায়। যথেষ্ট শিক্ষিত ঘোড়া। পিঠের ওপর চাপলেই বুঝতে পারবে কে চেপেছে। কিন্তু চাপবার সুযোগ সে পাবে না। এরা দেবে না সেই সুযোগ। দিলেও এই অচেনা গলির মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা সম্ভব নয়। গলির দুপাশের ঘরে এদেরই লোকজন বাস করে। তারা আটকে দেবে তার পথ। একবার আটকে দিতে পারলে ভাগ্যে কি রয়েছে, বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই।

ঘোড়াটি মুখ ফেরায়। জিৎ সিং-এর দিকে তার চোখ পড়ে। ডেকে ওঠে সে। বেচারা! ভালোভাবে খেতেও পায় না। তাই হয়তো আশা জন্মেছে ওর মনে। মনে করেছে এবারে পেট ভরে দানা খাবে। জানে না, এখানে তার চেয়েও অসহায় সে।

তাহের পিঠে চাপ দিয়ে বলে,—কি হল? অমন চুপচাপ কেন? যেদিন আসবে, এখানে নিয়ে আসবে তোমার ঘোড়া।

—ঠিক আছে।

—চিনতে পারবে তো?

—ফিরে যাবার সময় পথটা ভালো ক’রে দেখে নেব।

তাদের হেসে ওঠে। যেন মজার কথা বলছে জিৎ সিং।

—হাসলে কেন? চিনতে পারব না ভাবছ?

তাহের উত্তর দেয় না।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে, যে গলি দিয়ে সে ভিতরে এসেছে, তার ঠিক বিপরীত দিকে একটি বড় প্রবেশ-পথ রয়েছে। দেখে মনে হয়, সেইটিই প্রধান পথ এখানে আসবার। কিন্তু সেই চওড়া পথটি ঢাকা রয়েছে একটি মোটা নোংরা পর্দায়। অদম্য কৌতূহল নিয়ে জিৎ সিং ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যায়।

তাহের এক লাফে তার কাছে এসে কাঁধ চেপে ধরে বলে,—ওদিকে যাচ্ছ কোথায়?

—এমনিই দেখছি, জায়গাটি সুন্দর। কোনো গোলমাল নেই।

—ওদিকে যেও না।

জিৎ সিং ফিরে আসে। সে ঘোড়াগুলো দেখতে শুরু করে। একটি একটি ক’রে দেখতে দেখতে একসময়ে নিজের ঘোড়ার কাছে যায়। কানে কানে তাকে বলে,–তোকে আমি উদ্ধার করবই। আমার প্রাণ দিয়েও তোকে উদ্ধার করার চেষ্টা করব। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু। কিন্তু তুইও আমায় সাহায্য করবি, বুঝলি?

শিক্ষিত অশ্বটি পেছনের দু-পা দিয়ে বারকয়েক মাটি ঠুকে সায় দেয়।

তাহের দুর থেকে আড়চোখে তাকায়। বলে,—ওদিকে বুঝি ভালো লেগে গেল?

—চমৎকার জিনিস। এটি নিশ্চয়ই সেই সরাইখানার। তাই না?

—ঠিক চিনেছ।

—তোমার সঙ্গে যারা এসেছিল, তারা কোথায় গেল?

—আমার সঙ্গে তো কেউ আসেনি। এদিকে কয়েকজনের ঘর আছে, তারাই এসেছিল। জিৎ সিং জানে তাহের মিথ্যে কথা বলছে। তারা অপেক্ষা করছে, বাইরে দাঁড়িয়ে আদেশের অপেক্ষা করছে।

সে বলে,—এই ঘোড়াটিকে একটু হাঁটিয়ে দেখব? সুন্দর জিনিস। তবে আমারটি এর চেয়েও তেজী, একটু হাঁটাবো?

তাহের হাসে। বলে,—উহুঁ।

—একটু দেখতেও দোষ?

—নিশ্চয় দোষ। এখানে একবার যে জিনিস এসে পৌঁছেছে তাকে আর নিজের বলে দাবি করতে পার না।

—তার মানে?

—মানে, ন্যাকা সাজছ? আমরা বুঝি কিছুই বুঝি না? তোমাকে দেখে ওই ঘোড়াটির ছটফটানি কেমন বেড়ে উঠল দেখিনি ভাবছ?

জিৎ সিং-এর হাত তলোয়ারের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে থেমে যায়। না না, এখন নয়। হয়তো অনুমানে বলছে তাহের। বাজিয়ে দেখছে সে।

সজোরে হেসে জিৎ সিং বলে,–বাঃ বাঃ! দারুণ কথা বলেছ তো। এত বুদ্ধি?

—চোপরও, বেশি চালাক ভেবো না নিজেকে।

জিৎ সিং অবিচল দাঁড়িয়ে থাকে। সে আবার হাসে।

তাহের হাঁকে,—জাফর?

একটি যুবক বের হয়ে আসে মুহূর্তের মধ্যে।

—জাফর। এখানে দাঁড়া, আমি আসছি। একে একপা নড়তে দিবি না। একটু যদি নড়তে চায়, খতম করে দিবি। তা যদি না পারিস, তৰে তোকে খতম করব আমি।

জাফর অবহেলার দৃষ্টিতে একবার চায় জিৎ সিং-এর দিকে। তার যা চেহারা, তাতে সে যে-কোনো মানুষের দিকেই অবহেলার দৃষ্টিতে চাইতে পারে। অমন ভীষণ আর মজবুত শরীর খুব কমই দেখা যায়। জাফরের হাতে ছোরা ছিল, কোমরে তলোয়ার।

—ঠিক আছে দোস্ত, তুমি যাও!

তাহের এগিয়ে যায়। সে যায়, যেদিকে ভারী পর্দাটি ঝুলছিল। জিৎ সিং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেইদিকে।

অতি সন্তর্পণে পর্দা তোলে তাহের। কিন্তু সেই সময় কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে পর্দাটিকে আরও একটু উঠিয়ে দেয়। আর তার ভেতর দিয়ে জিৎ সিং মুহূর্তের জন্যে দেখতে পায় পর্দার অপর দিকটি। তার শরীরের রক্ত অতি দ্রুত ছুটতে শুরু করে। ওপাশে খুব কাছেই দেখতে পায় সে সেই ভাঙা মসজিদটি, যার পাশে রয়েছে তাহেরের মাংসের দোকান।

সব পরিষ্কার হয়ে যায় জিৎ সিং-এর কাছে। ঘোরা পথে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। কোন্ উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে এখনো বুঝতে পারে না। তবে চোরাই ঘোড়া পৌঁছে দেবার জন্যে যে নয়, এটুকু বুঝতে পারে।

জাফর তার দিকে চেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখে মিষ্টি হাসি। মুখখানি তার তাহেরের মতো কুৎসিত নয়। কিন্তু ওই মিষ্টি হাসির আড়ালে কতখানি হিংস্রতাকে ঢেকে রাখতে পারে জাফর কে জানে? তাহেরের চেয়ে বলবান হয়েও লোকটি তাহেরের আজ্ঞাবহ। মনে হয়, শুধু শরীরটিই সার তার, মগজে কিছু নেই। যদি তাই হয়, তবে এই মুহূর্তটুকুই হল পালিয়ে যাবার সব চাইতে উপযুক্ত সময়।

জিৎ সিং-এর কপালের দুপাশের রগ দপদপ ক’রে ওঠে। সে শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করে,—তাহের কোথায় গেল?

—তোমার বাপের কাছে।

—সাবধানে কথা বল জাফর।

—ইস! রোগা টিমটিমে শরীর, তেজ তো দেখি খুব।

জিৎ সিং আফশোস করে মনে মনে। লোকটিকে রাগিয়ে দিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং ভালোভাবে কথা বললে কাজ হতে পারে।

—মাঝে মাঝে অমন হয়ে যায় জাফর ভাই, মনে কিছু করো না। একটা কথা ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি।

—কি?

—তাহেরের মতো চারটেকে তুমি একা শেষ করতে পার। তার চেয়েও বুদ্ধি তোমার ধারালো। তবে কেন সে তোমাকে হুকুম করে? তাহেরের ডাকে তোমাকে সুড়সুড় করে আসতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।

—ওই ব্যাটা রহিমবক্সের জন্যে সব মেনে নিতে হয়। ব্যাটা মোটা টাকা দেয় কিনা। নইলে তাহেরকে কবে শেষ করে দিতাম।

—আমিও ওইরকম কিছু ভেবেছিলাম। টাকার জন্যে অমন অনেক কিছুই করতে হয়। আমি যেমন টাকার জন্যে ঘোড়া চুরি করি।

—থামো থামো, ওসব বাজে বুকনি ছাড়তে হবে না।

—তার মানে? বাজে কথা বললাম আমি?

—আলবত। তুম ঘোড়া চোর মোটেই নও। ওই ঘোড়াটি নিতে এসেছ, আমরা সবই জানি।

জাফর কিকার ঘোড়া দেখিয়ে দেয়।

জিৎ সিং বুঝতে পারে, যতটা বিপদ সে ভেবেছিল, তার চেয়েও অনেক বড় বিপদের মধ্যে সে পড়েছে।

কণ্ঠস্বরকে স্বাভাবিক করে সে বলে,—ভালো জিনিস বলেছ। এতক্ষণে বুঝলাম, তাহের তোমার ওপর হুকুম চালায় কেন।

—চোপ, শেষ করে দেব বলছি। রহিমবক্স আসবার আগেই শেষ করে দেব।

—সে তো আগ্রাতে নেই।

—নেই আবার। মাংসের দোকানের পেছনে পরে এল যে, দেখতে পাওনি। দেখলে চিনতে পারতে ঠিকই। সরাইখানায় তো দেখা হয়েছে তোমার সঙ্গে।

আর অপেক্ষা করা চলে না। এরা এতক্ষণ ধরে খেলা করছিল তার সঙ্গে। জেনেশুনে খেলা করছিল। রহিমবক্সের সঙ্গে তার প্রথমেই দেখা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু দেখা হলে ঘোড়ার খবর সে বলত না নিশ্চয়ই। তাহলে হয়তো সে এতখানি বিপদে পড়ত না। কিন্তু এই বিপদটুকু মেনে না নিলেও চলত না। এতে একটি লাভ হয়েছে। সে জানতে পেরেছে ঘোড়াটি কোথায় আছে।

মুহূর্তের মধ্যে তলোয়ার টেনে নেয় জিৎ সিং। কিন্তু সেই একই সময়ে জাফরের হাতের ছোরা তীরের মতো ছুটে আসে তার দিকে। একপাশে সরে যায় জিৎ। ছোরাটি পেছনের মাটির মধ্যে আমূল বিঁধে যায়।

পলকের জন্যে জাফরের চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। এভাবে, এত কাছে থেকে তার অস্ত্র আগে কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সে রাগে বিশ্রী গালাগাল দিয়ে কোমরের অস্ত্রে হাত দেয়। জিৎ সিং অস্ত্র বের করার সুযোগ দেয় না তাকে। তার আগেই তার তলোয়ারের অগ্রভাবে জাফরের কব্জিতে গিয়ে বেঁধে। আর্তনাদ ক’রে ওঠে জাফর।

জিৎ সিং ছুটে যায় কিকার অশ্বের দিকে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন অসীম মূল্যবান। জাফর অসি ধরতে সক্ষম হবে না বটে, কিন্তু তার আর্তনাদ এখন কত জাফরের কানে গিয়ে পৌঁছেছে কি না কে জানে।

অশ্বের দড়ি কেটে দেয় জিৎ সিং। তারপর তার পিঠে লাফিয়ে উঠে বলে,—শিগগির চল, তোর ওপর আমার প্রাণ নির্ভর করছে।

অশ্বের মুখ পর্দার দিকে ফিরিয়ে দিতেই জিৎ সিং-এর শরীর হিম হয়ে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাহের, আর তার পাশে রহিমবক্স। রহিমবক্স নিরস্ত্র হলেও, তাহেরের হাতে অস্ত্র। উভয়ের চোখে আগুন।

রহিমবক্স বিদ্রুপের স্বরে বলে ওঠে,—অনেক খেল দেখিয়েছ। এবার নেমে পড়।

এদের আর তোষামোদ ক’রে কোনোই লাভ নেই। একবার যখন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তখন অস্ত্র দিয়েই পথ পরিষ্কার করা ছাড়া গতি নেই।

জিৎ সিং চিৎকার করে বলে,—খেল আরও বাকি আছে রহিমবক্স। আমার ঘোড়া চুরি করলে অত সহজে খেল শেষ হয়ে যায় না, পথ ছাড়ো।

রহিমবক্স হেসে ওঠে। তার সযত্নে পাতা ফাঁদের মধ্যে পড়ে গিয়েও ছোকরাটির সাহস তাকে আনন্দ দেয়। তবে সে বুঝে উঠতে পারে না, জাফরের মতো জোয়ানকে কিভাবে সে ঘায়েল করল। নিশ্চয়ই আচমকা আক্রমণ করেছিল। জাফরটা বরাবরই বোকা। ঠিক হয়েছে।

জিৎ সিং তার পেছনের দিকে অনেক লোকের কথা শোনে। বুঝতে পারে, যে-পথে সে এসেছিল, সেই পথে সবাই তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

জিৎ সিং পর্দার দিকে এগিয়ে যেতেই তাহের বলে ওঠে,—দিক ভুল হয়ে গেল নাকি? কোন্ পথে এসেছ মনে নেই? চলে যাও সাহস থাকে তো।

এই অবস্থার মধ্যেও তাহেরের কথায় জিৎ সিং আনন্দ পায়।

তাহের ধারণা করতেও পারেনি যে মসজিদে যাওয়ার সোজা পথ জিৎ সিং জেনে গেছে। এই সুযোগে হাতছাড়া করা চলে না। ওরা প্রস্তুত থাকলেও ততটা প্রস্তুত নেই। কারণ ওরা জানে, ওদের দিকে জিৎ সিং যেতে পারে না।

সহসা ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় জিৎ সিং। রহিমবক্সের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে। জিৎ সিং পর্দা ছিঁড়ে বের হয়ে যাবার আগে তাহেরের অস্ত্র ধরা হাতের ওপর তলোয়ার চালিয়ে দেয়। চিৎকার ক’রে বসে পড়ে তাহের। জিৎ সিং বুঝতে পারে নিজের হাতে জীবনে আর মাংস কাটতে পারবে না বেচারা। দোকানে বসে শুধু নির্দেশ দিতে হবে।

ঠিক সেই সময়ে বাহুতে তীব্র বেদনা অনুভব করে জিৎ সিং। চেয়ে দেখে একটি ছোরা বিঁধে রয়েছে সেখানে। একটু পরেই হাতটি অবশ হয়ে যাবে হয়তো। তলোয়ার খসে পড়বে আপনা থেকে। সে জানে, রহিমবক্স নিরস্ত্র। এমন সম্ভাবনা কল্পনা করেনি রহিমবক্স। তাই অস্ত্র আনেনি সঙ্গে। রাগে কাঁপছিল সে। তার দিকে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দেয় জিৎ সিং। তাই দেখে রহিমবক্সের রাগ জল হয়ে যায়। সে অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে।

—রহিমবক্স, ঘোড়া চুরির শাস্তি নেবে না?

—দাও। তবে তুমিও বাঁচতে পারবে না।

জিৎ সিং সপ্রশংস দৃষ্টিতে চায় রহিমবক্সের দিকে। সাহসী বটে লোকটি। এত নোংরা কাজ করা সত্ত্বেও সাহস তার একটুও কমেনি। সাহসী লোকদের প্রতি তার একটা অহেতুক দুর্বলতা রয়েছে।

সে বলে—না, তোমায় কিছু করব না। তোমায় কিছু করলে ভবিষ্যতে পাঞ্জাষায় অসুবিধা হবে। ভেবেছিলাম ডান হাতটা কেটে নামিয়ে দেব। কিন্তু তুমি নিরস্ত্র। পরে দেখা হবে রহিমবক্স।

—বহুৎ আচ্ছা।

জিৎ সিং ঘোড়া ছোটায়। সে শুনতে পায় বহুলোকের কলরব। ওরা ছুটে আসছে, কিন্তু ওদের ঘোড়া নেই। জিৎ সিং কিকার অশ্বের পিঠে থাবা দিয়ে বলে—তোকে আমি চিরকাল মনে মনে পুজো করব রে। লাগাম নেই, কিছু নেই, তবু অদ্ভুত খেলা আজ দেখালি।

বাহুর ব্যথা তীব্রতর হয়। কে ছুড়েছে ছোরাটা দেখতে পায়নি সে। কিছুদূর গিয়ে সে ছোরাটা টেনে খুলে ফেলে। ভেতর থেকে রক্ত বের হয়ে আসে। এভাবে পথ চলা বিপজ্জনক। নগরবাসীর দৃষ্টি পড়লে রক্ষা নেই। সন্ধ্যা হতেও দেরি নেই বেশি। সে বুঝে উঠতে পারে না, কোথায় যাবে। সরাইখানায় যাওয়া ঠিক হবে না। রহিমবক্স জানে সে আহত হয়েছে। সে নিজে সাহসী হলেও, অন্য সাহসী লোকের মর্যাদা রাখে কি না ঠিক নেই। না রাখার সম্ভাবনাই বেশি।

তবে, কোথায় যাবে সে? এমন কোথাও যাওয়া দরকার যেখানে হাতের শুশ্রূষা হয়, ঘোড়াটাকেও নিরাপদে রাখা যেতে পারে।

কব্জির দিকে নজর পড়ে জিৎ সিং-এর। বোনের দেওয়া রাখী তাহেরের চর্বিমাখা হাতের চাপেও অনুজ্জ্বল হয়ে যায়নি।

নিশ্চিন্তের দীর্ঘশ্বাস ফেলে পৃথ্বীরাজ রাঠোরের গৃহের পানেই চলে সে।

পৃথ্বীরাজ বাড়ি ছিলেন না।

প্রথমেই দেখা হয়ে যায় সেদিনের সেই শকট-চালকের সঙ্গে। লোকটি ছুটে আসে। জিৎ সিং-এর রক্তাক্ত বাহু তার নজরে পড়ে। সে অশ্বের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,—একা নামতে পারবেন?

জিৎ সিং একটু ভেবে লোকটির নাম মনে ক’রে নিয়ে বলে,—হ্যাঁ উধম, বিশেষ কিছু হয়নি।

উধম আর কিছু প্রশ্ন করে না। জিৎ সিং মাটিতে নামলে সে ঘোড়াটিকে দানা দেবার জন্যে নিয়ে যেতে উদ্যত হলে জিৎ প্রশ্ন করে,—রানী বাড়িতে আছেন?

—হ্যাঁ। মাইজী সাধারণত বাইরে যান না!

—রাজা?

—তিনি নেই। দরবারে।

—ভেতরে যেতে পারি?

—একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন। আপনার হাতের ওই রাখী আমার চোখের আড়ালে বাঁধা হলেও আমি সাক্ষী।

জিৎ সিং হাসে। উধম কর্তব্যপরায়ণ। সে গম্ভীর। তবু রসিক।

ভেতরে প্রবেশ করতেই একজন পরিচারিকা তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে আর্তনাদ ক’রে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে আরও দু-তিনজন ছুটে আসে। তারা জিৎ সিং-এর রক্তাক্ত দেহের দিকে চেয়ে বলে,—কাকে চাই আপনার?

—রানীমাকে।

—রানীমা? আপনি কে? আপনাকে তো দেখিনি কখনো।

—তোমরা না দেখলেও তিনি দেখেছেন। তাঁকে ডেকে দাও।

ওদের মধ্যে একজন প্রবীণা বলে ওঠে—না। আপনার পরিচয় না দিলে তাঁকে ডাকতে পারি না।

—বল, তাঁর ভাই এসেছে।

—ভাই? তাঁর কোনো ভাই নেই।

—ছিল না। কিন্তু এখন হয়েছে।

—না। আপনার কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। আপনি চলে যান। যদি না যেতে চান, লোক ডাকব। ভাববেন না যে বাড়িতে পুরুষ নেই।

জিৎ সিং বিরক্ত হয়। ক্লান্ত শরীরকে একটু বিশ্রাম আর ক্ষত স্থানের পরিচর্যার আশায় সে এসেছিল। এত বাধা রয়েছে জানলে সে কখনই আসত না। এখন রানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে উধমকে ডেকে আনা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু তাকে ডাকবার মতো মনের অবস্থা নেই। তার প্রধান মাথা ব্যথা ছিল ঘোড়াকে নিয়ে। তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে। এখন হাতের জখমের জন্য যে কোনো হাকিমের কাছে গেলেই চলবে।

জিৎ সিং বলে,—ঠিক আছে। তাঁকে ডাকতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।

—হ্যাঁ। চলে যান। এ-বাড়ি অরক্ষিত নয়।

আর একজন বলে ওঠে,—উধম আজকাল বড় ফাঁকি দেয়! কে এল, কে গেল চেয়েও দেখে না। কবে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

জিৎ সিং-এর মাথায় রক্ত উঠে যায় কথা শুনে। রানীকে মেবারের মেয়ে জেনে, আর তাঁর চোখের জল দেখে রাখী বাঁধতে দিতে আপত্তি করেনি সেদিন। ভুল হয়েছিল খুবই ভুল হয়েছিল। সে ভুলে গিয়েছিল এ সাধারণ মেয়ে নয়, এ রানী।

জিৎ সিং ফিরে যায়। বাড়ি থেকে বের হবার আগে একবার চেয়ে দেখে ঘোড়াটিকে দেখা যায় কি না। না। উধম তাকে ভালো জায়গাতেই নিয়ে গেছে। বাইরে থেকে অন্তত দেখা যাবে না। একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

কিন্তু কোথায় যাবে সে? সন্ধ্যা আরও গাঢ় হয়ে এসেছে। সরাইখানায় চলে যেতে পারত যদি আহত না হত। আহত স্থানের রক্ত জমাট না বেঁধে বের হয়ে আসছে। কোনো বৈদ্য বা হাকিমের কাছে না গেলে চলবে না। রক্ত বন্ধ হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। তাছাড়া আহত স্থান বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।

জিৎ সিং পথ চলতে চলতে দুপাশের দোকানের দিকে চাইতে চাইতে যায়। কোথায় যেন সে দেখেছে একটা হাকিমের দোকান। কিছুতেই মনে আসছে না।

আরও এগিয়ে যায় সে। পথ দিয়ে অনেকেই চলছে। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাবার জন্যে তার বাহুর রক্ত তাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। সেদিক দিয়ে ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। নইলে এতক্ষণে হৈচৈ শুরু হত। যে পথ দিয়ে চলছে সে, সেই পথে স্পষ্ট রক্তের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। কখন বন্ধ হবে? এমন তো আগে কখনো হয়নি। আহত সে আগেও হয়েছে দু-একবার। বাবার কাছে অস্ত্র শিক্ষার সময়েও একবার সে ভীষণ আহত হয়েছিল। কিন্তু সেবারও এভাবে রক্ত বের হয়ে যায়নি। ছোরাটা কতদূর বিঁধেছিল, বাহু থেকে তুলে ফেলবার সময় সে চোখ দিয়ে দেখেনি।

একটু দুর্বলতা অনুভব করে এতক্ষণে। বাহুটির অবশ ভাব সমস্ত হাতখানায় সঞ্চারিত হয়। এইভাবে আরও কিছুক্ষণ ঘুরলে তার আগ্রায় আসার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ সে বাঁচবে না তাহলে। শরীরের সব রক্ত বেরিয়ে গেলে কেউ বাঁচে না। অবিশ্যি সে না বাঁচলে কারও কোনো ক্ষতি নেই। কারও নয়। আশ্চর্য! নিজেই অবাক হয়ে যায় জিৎ সিং কথাটা ভেবে। তার মতো মানুষ পৃথিবীতে কত আছে কে জানে!

আজ যদি লীলাবতীর সঙ্গে দেখা হত? সে উদ্বিগ্ন হত ঠিকই। সারা রাত জেগেও থাকত শিয়রের কাছে বসে। কিন্তু একটু সুস্থ দেখেই বিদায় চাইত। কারণ সে থাকতে পারে না তার কাছে। গুপ্তচরের সঙ্গে লীলাবতীর কোনো সম্পর্ক নেই। উদয়সাগরের তীর থেকে বিদায় নেবার আগের মাঝ রাতে কপাটে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে যেটুকু আনন্দ সে দিয়েছিল সেটুকু বোধহয় শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। তাছাড়া তখনো সে গুপ্তচর হয়নি। সেই রাতে ভালোভাবে অনুভব করবার মতো হুঁশ কিংবা অবসর যদি থাকত জিৎ সিং-এর তবে অভিনয় নিশ্চয়ই ধরা পড়ে যেত। লীলাবতী তাকে যত আনন্দই দিক না কেন বিদায়ে রাতে তত আনন্দ সে নিজে পায়নি। কারণ লীলাবতী তাকে ভালোবাসেনি। আসল ভালোবাসা যাকে বলে, সেই জিনিস লীলাবতীর অন্তরে কখনই জেগে ওঠেনি। কারণ তেমন ভালোবাসার কাছে মিথ্যে আদর্শ বড় হয়ে উঠতে পারত না। ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সব কিছুই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

জিৎ সিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই সঙ্গে তার গা গুলিয়ে ওঠে। বমি বমি ভাব। সেই কখন বের হয়েছিল। তারপর পেটে আর কিছুই পড়েনি। একবিন্দু জলও নয়।

তবু জোর ক’রে চলতে থাকে সে। হাকিম কিংবা বৈদ্যকে খুঁজে বের করতেই হবে। চলতে চলতে আবার লীলাবতীর মুখখানা সামনে ভাসে। এবার সে-মুখে জিৎ দেখে পরিপূর্ণ প্রেমের চাহনি। মনে মনে বিড়বিড় করে জিৎ-আমি জানি লীলা, তুমি আমায় সত্যিই ভালোবাসো। তবু মাঝে মাঝে অমন সন্দেহের মেঘ উড়ে আসে কোথা থেকে যেন। এসে আমার মনকে ঢেকে দেয়।

উষ্ণীষে হাত রাখে জিৎ। অনুভব করে একলিঙ্গের সেই নির্মাল্য। লীলা দিয়েছিল বিদায়ের শেষ রাতে। সেই সঙ্গে বুকের কাছে আর একটি জিনিস অনুভব করে। এটিও তার সঙ্গে রয়েছে চিতোর থেকে।

জিৎ সিং আর চলতে পারে না। একটি কুটিরের সামনে সে বসে পড়ে। কুটিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক বৃদ্ধ। জিৎ সিং তাকে আবছা আবছা দেখতে পায় মাত্র। কারণ তখন তার অচেতন হবার পূর্বমুহূর্ত।

তার জ্ঞান ফিরে আসে আরও রাত হলে। চোখ মেলে চেয়ে দেখে একটি দারিদ্র্যপীড়িত গৃহের জীর্ণ শয্যার ওপর শুয়ে রয়েছে সে। একটু দূরে নীচে তেলের বাতি জ্বলছে। তার কম্পমান শিখায় ঘরের কঠিন পদার্থগুলির ছায়া দুলছে অপর দিকের দেয়ালে, ছাদে

জিৎ সিং ধীরে ধীরে তার মাথার দিকে চায়। সে চাইবার সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রাচ্ছন্ন একজন তরুণী চমকে ওঠে তার শিয়রে। সংকোচে এবং লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে ব্যস্ততার সঙ্গে সে কক্ষত্যাগ করে। সে বোধহয় আশা করতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি এই অপরিচিত যুবকের জ্ঞান ফিরে আসবে।

এক নজরে জিৎ সিং বুঝতে পারে এটি মুসলমানের গৃহ। গৃহের স্ত্রীলোকেরা পর্দানশীন। দয়াবতী রমণী অসুস্থ মানুষের জন্যে জাগ্রত অবস্থায় মাথার কাছে বসে কাটিয়েছে। কিন্তু তার জ্ঞান ফিরতেই সে পর্দার আড়ালে চলে গেল।

পাশের ঘরে তার অনুচ্চ কন্ঠস্বর শোনা যায়। কাকে যেন ডেকে তুলছে ঘুম থেকে। একজন পুরুষ জেগে ওঠে। কাশির শব্দ শুনে বোঝা যায় যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার।

এতক্ষণে নিজের ওপর রাগ হয় জিৎ সিং-এর। সামান্য একটি ছোরার আঘাতে সে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল। এই যদি তার সহনশীলতার নমুনা হয়, তবে এর চেয়ে আরও কঠিন আঘাত আরও কঠোর পরিশ্রমের সম্মুখীন কেমন ক’রে হবে সে?

বৃদ্ধই বটে। ও-ঘর থেকে এ-ঘরে আসতেও লাঠির প্রয়োজন হয়েছে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে তার দেহ।

কাছে এসে সে বলে,—এখন ভালো বোধ করছ?

—হ্যাঁ। এবারে আমি যাব।

—সেকি? এখন অনেক রাত। এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না। তোমার কিছু খাওয়া দরকার। না খেয়েই অমন হয়েছিল। হাতের জখম মারাত্মক নয়। হাকিম বলেছে কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।

—হাকিম এসেছিল?

—হ্যাঁ। না এলে চলবে কি ক’রে? তোমার গায়ের কামিজটা কিন্তু কেটে খুলতে হয়েছে। এমনিতে কিছুতেই খোলা গেল না। নতুন কামিজ।

জিৎ সিং-এর মন খারাপ হয় একটু। তারপরই একটি কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,—ওটি কোথায়?

—সেলাই ক’রে কেচে দিয়েছে। কাল সকালে শুকিয়ে যাবে।

—কিন্তু ওর ভেতরে যে আমার জিনিস রয়েছে।

—সব বের করে নিয়ে কাচতে দিয়েছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এবারে কিছু খেয়ে নাও। নইলে ঘুম আসবে না।

জিৎ সিং দেখতে পায় সেই রমণী বোরকা পরে এসেছে এবার। হাতে তার একটি বড় বাটিতে দুধ।

জিৎ সিং বিনা দ্বিধায় দুধটুকু পান করে।

বৃদ্ধ তাকে কী যেন বলবার জন্যে ঝুঁকে পড়েই সঙ্গে সঙ্গে আবার মাথা সরিয়ে নেয়। বলে, —না। এখন থাক। কালই কথা হবে।

জিৎ সিং অবাক হয়ে দেখে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় কাঁপছে। তার কণ্ঠ প্রায় বাষ্পবুদ্ধ চোখ সজল। আরও লক্ষ্য করে সে বোরকা পরা রমণীও উত্তেজিত। তার হাবভাবে এক অকথিত ব্যাকুলতা প্রকাশ পায়। কিসের এই ব্যাকুলতা? জিৎ সিং অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারে না।

সে কিছু প্রশ্ন করার অবকাশ পায় না। তার আগেই ওরা দুজনা ঘর ছেড়ে চলে যায়।

একটু পরে জিৎ সিংও ঘুমিয়ে পড়ে। দুধটুকু পান ক’রে সুস্থ ব্যক্তির মতো ঘুমোয় সে এবারে।

ঘুম ভেঙে যায় খুব ভোরে একটি কচি হাতের স্পর্শে।

এমন স্পর্শ সে জীবনে আর কখনো অনুভব করেনি। ভোরের শান্ত পরিবেশের মধ্যে এই দরিদ্রের কুটিরেও স্পর্শটুকু অমৃতের মতো মনে হয় তার। চোখ বুজে ঘুমের ভান ক’রে থাকে সে

আধো আধো স্বরে একটি শিশু ডাকে,–এই। এই।

জিৎ সিং চুপ ক’রে শুয়ে থেকে উপভোগ করে শিশুর ডাক, তার স্পর্শ।

—এই। দেখো দেখো ছব্বাই উঠেছে। শুধু তুমি ঘুমিয়ে আছো।

এবারে চোখ মেলে জিৎ সিং। চেয়ে দেখে বছর তিনেক বয়সের ফুটফুটে ছেলে একটি। শিশুর মুখের দিকে চেয়ে সে হাসে।

শিশুটিও হাসে এবারে। বলে,–বাবা আছবে।

—তোমার বাবা কোথায়?

—উ—ই দিকে। আছবে। তাই না?

—হ্যাঁ। আসবেই তো।

—কী মজা। তাই না?

—হ্যাঁ মজাই তো। বাবা এলে সবারই মজা হয়।

ছেলেটি তার কথায় আনন্দ পায়। খিলখিল করে হেসে ওঠে সে।

সেই সময়ে কপাটের আড়ালে একটি মিষ্টি হাসতে ভরা মুখ সে দেখতে পায়। চোখ পড়তেই নিমিষে মুখটি অদৃশ্য হয়ে যায়। ওই রমণীই কাল তার শিয়রে জেগে বসে ছিল। শিশুটি ওই রমণীরই পুত্র নিশ্চয়।

একটু পরেই বৃদ্ধ আসে। হাসতে হাসতে শিশুটিকে পাশে টেনে নিয়ে বলে,—এটি আমার নাতি। আমার একমাত্র নাতি। একে রেখে আমার ছেলে যখন চলে যায়, তখন এ আরও ছোট।

জিৎ সিং বুঝতে পারে না বৃদ্ধের পুত্র কোথায় গেছে। মৃত্যুর পরপারে নয় নিশ্চয়ই। কারণ তাহলে বৃদ্ধের মুখে এমন সরল-সুন্দর হাসির রেখা ফুটে উঠত না। আর ছেলেটি যখন ‘বাবা আছবে’ বলছিল, তখন কপাটের আড়ালে মুখখানিতে অমন সুন্দর হাসি ভেসে উঠত না। তাই বৃদ্ধের কথায় সে দুঃখ না ক’রে শুধু বলে,—ও।

—কিন্তু তুমি সুস্থ বোধ করছ তো এখন?

—হ্যাঁ। আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করব না। আপনি বৃদ্ধ ব্যক্তি। কিছু যদি বলতে যাই বাচালতা প্রকাশ পাবে।

—না না। তোমার কৃতজ্ঞতা জানাবার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কৃতজ্ঞতা জানাবো বরং আমারই। আমাদের কাছে আসতে গিয়েই তুমি কোনো খারাপ লোকের হাতে পড়ে আহত হয়েছ।

জিৎ সিং-এর মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। বৃদ্ধের কথার অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয় না। সে আমতা-আমতা ক’রে বলে,—আপনাদের কাছে?

বৃদ্ধ প্রাণ খুলে হেসে ওঠে,—হ্যাঁ। তুমি বুঝি জানো না এখনো? আমারই ভুল হয়েছে। তোমার তখন জ্ঞান ছিল না। তুমি ঠিক আমার বাড়ির সামনে এসেই বসে পড়েছিল। আমি বাইরে গিয়ে হঠাৎ তোমায় দেখতে পাই।

তবু জিৎ সিং বুঝে উঠতে পারে না। সে ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে বৃদ্ধের পানে। সেই সময়ে কপাট একটু নড়ে ওঠে। বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। সে জিৎ সিং-এর জামা নিয়ে এসে বলে, —শুকিয়ে গেছে। এই রইল। তোমার পাগড়ি ওই যে রয়েছে। ওর ভেতরে ছোট্ট মতো কি যেন ছিল। তাও বাঁধা রয়েছে একধারে।

জিৎ সিং বুঝতে পারে একলিঙ্গের নির্মাল্যের কথা বলছে বৃদ্ধ। একলিঙ্গের কথা মনে হতেই সে প্রণাম জানায়। তিনি এই বৃদ্ধের কুটিরে তাকে পৌঁছে দিয়ে সেবা যত্নের মধ্যে তাকে আবার সুস্থ করে তুলেছেন।

বৃদ্ধ বলে,—কিন্তু তোমার কামিজের ভেতরের ওই জিনিসটি আমি আর দেব না। ওটি আমার কাছেই থাক।

জিৎ সিং উত্তেজিত হয়ে বলে,—না না। ওটির প্রয়োজন রয়েছে আমার। ওটি আমি চাই।

বৃদ্ধ হাসে। পাশের ঘরের রমণীর কণ্ঠের অনুচ্ছ হাসিও তার কানে আসে। জিৎ সিং-এর কাছে এদের হাসি রহস্য-ভরা বলে মনে হয়!

বৃদ্ধ বলে,—এখনো বুঝতে পারাল না?

—কিসের কথা বলছেন?

—তুমি আমার কাছেই আসছিলে। আমার কাছেই তোমাকে পাঠিয়েছে ইসলাম। আমিই তার বাবা ইব্রাহিম।

জিৎ-এর সমস্ত দেহ-মন একসঙ্গে প্রচণ্ডতম ঝাঁকি খায়। কিছুক্ষণের জন্যে সে কিছুই দেখতে পায় না। তারপর ধীরে ধীরে তার সামনে ভেসে ওঠে বৃদ্ধের মুখ। কিন্তু পরক্ষণেই সে মুখ আবার মিলিয়ে যায়। পরিবর্তে ভেসে ওঠে চিতোরে সেই সর্বনাশা দিনে তার পিতা অজিত সিং-এর শয্যার পাশের ভয়ংকর দৃশ্যটি। শয্যার ওপর পিতার মৃত্যুশীতল দেহ। মাটিতে পড়ে রয়েছে তাঁর একখানি খণ্ডিত হাত। তারই পাশে পিতার তলোয়ারের আঘাতে (যে তলোয়ার এখন তার শয্যার পাশে রক্ষিত আছে) রক্তাক্ত মুঘল সৈন্যের মৃতদেহ। সেই মৃতসৈন্যের কোমরে ছিল মোহরের থলি। তার বুকের পাশে ছিল অতি সযত্নে রাখা সেই ঠিকানাটি। সেই থেকে ওটিকে সে সব সময়ে কাছে রাখত। তার অবচেতন মনে, বাবার একটি ইচ্ছাই নিশ্চয়ই কাজ করেছিল। সেটি হল প্রতিশোধ গ্রহণ। নইলে মৃত সিপাহীর ঘরের ঠিকানা কেন সে অত যত্নে এতদিন বয়ে নিয়ে বেড়াবে?

আজ প্রতিশোধ গ্রহণের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। ওই তো বৃদ্ধ বসে রয়েছে। ওই যে শিশু। আর কপাটের পাশে ওই তরুণী। এমন সুযোগ কখনো আসবে না। ওই তো শয্যার পাশে খাড়া করা রয়েছে সেই একই তলোয়ার। বাঁ-হাত বাড়িয়ে ওটি তুলে নিয়ে বাঁ-হাতে শেষ করে দিতে পারে এদের। কোনোরকম চিৎকার করবারও অবকাশ পাবে না এরা। শকুনও জানতে পারবে না, কুটিরের মধ্যে পড়ে রয়েছে তিনটি মৃতদেহ

কিন্তু কই উঠতে তো ইচ্ছে হচ্ছে না। মনেও হচ্ছে না এই পরোপকারী বৃদ্ধটি ইসলামের বাবা। তাকে যখন অচৈতন্য অবস্থায় তুলে এনেছিল বৃদ্ধ তখন পুত্রের হাতের লেখা ঠিকানা দেখে তুলে আনেনি। রাতের বেলায় শিয়রের কাছে অতন্দ্র বসে থাকা রমণীটি তার স্বামীর খবরের প্রত্যাশাতেই শুধু সেবা করেনি। তাদের এই মানবতা বোধ, এই মমতা ভেতরের জিনিস। স্বার্থপ্রসূত নয়।

মৃত সিপাহীর মুখখানি মনে আনতে চেষ্টা করে জিৎ সিং। পারে না। তবে এটুকু সে মনে করতে পারে, ইসলাম খাঁয়ের বয়স ছিল কম। বাইশ কিংবা তেইশ। সে-ও হয়তো তার বৃদ্ধ পিতার মতোই ভালো লোক ছিল। শুধু ভিন্ন অবস্থায় পড়ে সাময়িক ভাবে তার স্বভাবের পরিবর্তন হয়েছিল। এমন প্রায়ই হয়। এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধ মানুষের মনুষ্যত্বকে সাময়িকভাবে ঢেকে রাখে। মানুষ তখন পশু হয়ে যায়। পশু না হলে মৃতের স্তূপ জমে উঠত না যুদ্ধক্ষেত্রে।

আজ এতদিন পরে ইসলাম খাঁয়ের জন্যে দুঃখ অনুভব করে জিৎ সিং। সম্ভব হলে তার জন্যে দু’ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব নয়।

বৃদ্ধের ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে জিৎ সিং-এর আচ্ছন্নতা কেটে যায়,—তুমি কথা বলছ না কেন? ইসলামের কথা শুনে চুপ ক’রে গেলে কেন?

—আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।

—তবু ভালো। আমি ভয় পেয়ে গেছলাম। জানই তো যুদ্ধের ব্যাপার। আমি জানি, ইসলাম এখন চিতোরে আছে। সেখানে বাদশাহের অনেক সৈন্য আছে। তবু ভয় যায় না। বুঝতেই পার বাপের মন। তার ওপর এরা দুজন রয়েছে। এদের দেখবার তো কেউ নেই। রাতের বেলায় তাই কতবার বিশ্রী স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়।

জিৎ সিং-এর মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে

—তুমি এখনো দুর্বল আছো। আরও একটু শুয়ে থাকো। পরে কথা বলব।

—না না। আমি বেশ সুস্থ হয়েছি। এবারে আমি যাব।

জিৎ সিং তার কামিজ পরে ফেলে। বাঁ হাত দিয়ে পাগড়ি টেনে নেয়।

—তোমার এভাবে কে আক্রমণ করেছিল বলবে

—দস্যুরা। ভেবেছিল অনেক পয়সাকড়ি রয়েছে সঙ্গে।

যা মনে আসে, তাই বলে যায় জিৎ সিং। এই বৃদ্ধের সামনে থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচে। এ অসহ্য। এই বাড়ি থেকে সে ছুটে বের হয়ে যেতে চায়। চোখ বুজে ছুটে বের হয়ে যাবে, যাতে কোনোদিন এপথে এলেও বাড়িটিকে চিনতে না পারে।

তাড়াতাড়ি পাগড়ি বেঁধে ফেলে সে মাথায়। ডান হাতে ব্যথা লাগা সত্ত্বেও তাড়াতাড়ি করে সে। একলিঙ্গের নির্মাল্য ভালোভাবে গুঁজে রাখে। তারপর শয্যা ছেড়ে তলোয়ার তুলে নেয়।

—তুমি এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? তোমার খাবার তৈরি হচ্ছে। শুধু একবাটি দুধ খেয়েছিলে রাতে। তাতে কি শক্তি পাওয়া যায় দুর্বল শরীরে? বস।

—আমি বেশ শক্তি পাচ্ছি। একটুও দুর্বল বোধ করছি না।

—তুমি কি আবার চিতোরে চলে যাবে? তা তো যাবে না। শত হলেও তোমরা রাজপুত। রাজা ভগবান দাসের লোক হলেও চিতোরের অবস্থা দেখে তোমাদের মন খারাপ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। একটু বস। ইসলাম কি বলে দিয়েছে বলে যাও।

—কিছু বলেনি।

—তা কি কখনো হয়? নিশ্চয়ই বলেছে। তুমি ভুলে গেছ। আর কিছু না বলুক, ওর ছেলের কথা তো বলেছে। ছেলেকে যে বড় ভালোবাসে ইসলাম।

শিশুটি আবার চেঁচিয়ে ওঠে,–বাবা আছবে।

—হ্যাঁ দাদু। বাবা তো আসবেই। তার কথাই হচ্ছে।

কপাটের শব্দ হয়। বৃদ্ধ উঠে যায়। আর শিশুটি জিৎ সিং-এর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, –বাবা আছবে।

জিৎ সিং-এর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। সে শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।

বৃদ্ধ হাতে ক’রে খাবার নিয়ে এসে হেসে বলে,—খেয়ে নাও। ওর বাবা ছেলেবেলায় অমনি ছিল।

—আমি খাবো না। সত্যিই কিছু খাবো না। আমায় যেতে দিন। আমার অনেক কাজ আছে। অনেক দরকারি কাজ।

বৃদ্ধ বিস্মিত দৃষ্টিতে একটু চায় জিৎ সিং-এর দিকে। কাঁপা হাতে খাবারের থালা নামিয়ে রেখে বলে,—তবে বলে যাও ইসলাম কবে আসবে। আমি জানি, তুমি জান। বল। দয়া ক’রে বলে যাও। বুঝতে পারছ না, আমি তার বাপ? আমার একমাত্র ছেলে সে। এইভাবে কতদিন আর তার সংসার আগলে রাখব? বলে যাও, সে কি আসবে তাড়াতাড়ি?

—না।

—না? সে আসবে না? কত দেরি হবে তার?

—আমি জানি না।

—তুমি—তুমি কিছু গোপন করছ না তো?

বৃদ্ধ জিৎ-এর মুখের দিকে তার ঘোলাটে দৃষ্টিকে যথাসম্ভব তীব্র ক’রে নিয়ে চেয়ে চিৎকার করে পুত্রবধূকে ডেকে বলে,—জিন্নৎ, নিয়ে এসো সেই লেখা। আমার সন্দেহ কি তবে সত্যি?

রমণী কপাটের আড়াল থেকে হাত বাড়ায়। বৃদ্ধ পাগলের মতো সেই লেখাটি নিয়ে ভালোভাবে দেখে।

আপন মনে সে বলে,—এ দাগ তবে কিসের? কিসের এই দাগ?

জিৎ সিং-এর দিকে চায় বৃদ্ধ। সে জবাব না দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

—বল। বল। সত্যি কথা বল। কিসের দাগ এ? রক্তের? সে কি ফিরবে না কোনোদিনও?

কোনোমতে জিৎ সিং বলে,—না।

কপাটের আড়ালের রমণী যেন প্রবল ধাক্কা খেয়ে সামনের দিকে চলে আসে। আপ্রাণ চেষ্টায় সে কপাট চেপে ধরে। বোরকা নেই তার। গৌরবর্ণ মুখের সমস্ত রক্ত অন্তর্হিত। কেমন ভাবলেশহীন বড় বড় চোখে সে জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টি জিৎ সিং সহ্য করতে পারে না। বুঝতে পারে, রমণী আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভূতলে লুণ্ঠিত হয়ে পড়বে।

বৃদ্ধের দিকে চাইবার চেষ্টা না ক’রে সে ছুটে বেরিয়ে যায়। তার কানে শিশুর চিৎকার ভেসে আসে,—মা, বাবা আছবে। দাদু, বাবা আছবে। বাবা-বাবা আছবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *