আগ্রা – ২

২.

আগ্রার পথে পথে অনির্দিষ্টভাবে কিছুদিন ঘুরে বেড়ায় জিৎ সিং। দোকানপাটের শোভা দেখে। ইমারত দেখে। বাগিচা দেখে। আর দেখে বিচিত্র পথচারীদের রকমারি পোশাক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির কাছে ঘেঁষতে পারে না সে। ঘেঁষবার পথও দেখতে পায় না।

অথচ যে কাজে সে এখানে এসেছে, তাতে আকবর শাহের কাছাকাছি না থাকলে চলবে না। পোশাক-পরিচ্ছদ কিনেছে সে দরবারে প্রবেশের উপযুক্ত। কিন্তু সেই পোশাক তেমনি তোলা রয়েছে। ব্যবহারের সুযোগ ঘটেনি।

সরাইখানার মালিককে চিনে ফেলে তার সুবিধে হয়েছে। ভুল আর সে করবে না। তাই ভয়ও হয় না কোনো। ঘোড়া চুরির পরদিন রহিমবক্স নামে লোকটি ঠিক এসেছিল তার কাছে। সব শুনে কপট দুঃখ প্রকাশ করেছিল। সে-ও কম যায়নি। রহিমবক্সকে রীতিমতো সহানুভূতি জানিয়েছিল। এবারে দামী ঘোড়া পেলেই রহিমবক্সকে দিয়ে দেবে।

পাশের ঘরের লোকটি সরাইখানা ছেড়ে উধাও হয়েছে দু’দিন হল। সে বলেছিল, তার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন হলে যমুনার তীরে দু-চারবার পায়চারী করতে। দিশে না পেয়ে জিৎ সিং তার কাছে যাওয়াই ঠিক করে।

যমুনার তীরে গিয়ে সে পায়চারী শুরু করে। যমুনার জলের দিকে তার দৃষ্টি যায় না। দুই তীরের শোভাও তার নজরে পড়ে না। তার দৃষ্টি সামনে আর পেছনে।

—এই যে আমি।

চমকে ওঠে জিৎ সিং। বলে,–কোথা থেকে এলেন?

—কাছেই ছিলাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি দেখা করার প্রয়োজন হল তোমার?

—আমিও তাই ভাবছি।

—বাদশাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাও তো?

—হ্যাঁ।

—তাহলে একটা হৈচৈ বাধিয়ে দাও। ধর, কোনো শোভাযাত্রা যাচ্ছে তুমি সামনে দাঁড়িয়ে বল, যেতে দেবো না।

—তা কি সম্ভব?

—সম্ভব তো নয়-ই। কিন্তু এই রকমের অসম্ভব কিছু না করতে পারলে দরবারে গিয়ে পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কিংবা চুরি-ডাকাতিও করতে পার। তবে সেভাবে গেলে বেঁচে ফিরে আসা কঠিন হবে।

জিৎ সিং লোকটির কথাবার্তায় সন্তুষ্ট হতে পারে না। সে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

তার হাবভাব লক্ষ্য করে ভবঘুরে হেসে বলে,—রাগ হল নাকি? তানসেনকে চেনো?

—চিনি বৈকি। তাঁর নাম অনেক শুনেছি। অতবড় সংগীতজ্ঞ ভারতে আর নেই।

—সাধারণ লোকে তা-ই বলে বটে। তার গান শুনবে?

—নিশ্চয়ই। যদিও গান সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞানই নেই, তবে শুনতে ভালো লাগে।

—তাহলেই চলবে। কাল তানসেন তার নিজের বাড়িতে গানের আসর বসাবে। অনেক গুণী লোকের সমাবেশ হবে। তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যাব। দেখো কিছু করতে পার কি না।

—আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

—ওসব কথা এখন বলো না। কৃতজ্ঞতা জানবার আরও ভালো সুযোগ পেতে পার। জিৎ সিং লক্ষ্য করে লোকটির হাবভাব আগের দিনের চেয়ে অনেক সহজ। সে অনেক কাছের মানুষ আজ। তাই হেসে প্রশ্ন করে,—আচ্ছা ভবঘুরে মানুষ হয়ে আগ্রায় পড়ে রয়েছেন কেন? ভবঘুরে তো এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। আমাকে বলেছেন, প্রয়োজন হলেই দেখা করতে। তার মানে, আরও অনেকদিন থাকবেন।

লোকটি জিৎ সিং-এর প্রশ্নে কৌতুক অনুভব করে। একটু চুপ করে থেকে বলে, —হ্যাঁ। আরও কিছুদিন থাকব এখানে। আমি চলে যাবার পর আমাকে আর তোমার প্রয়োজন হবে না। খুব তাড়াতাড়িই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াবে।

—কিন্তু এই কদিনই বা থাকবেন কেন?

—তোমার কৌতূহল খুব তীব্র দেখছি।

—হ্যাঁ, তবে আপনার বলতে আপত্তি থাকলে আমি শুনতে চাই না।

—আপত্তি নেই। একজনের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রয়েছি যে যতদিন সে কিংবা আমি বেঁচে রয়েছি, বছরের একটি সময়ে এখানে এসে দেখা দিয়ে যাব।

—কৌতূহল আরও বেড়ে গেল আমার।

লোকটি এবারে হেসে ফেলে। বলে,—সবটা শুনতে চাও তো?

—হ্যাঁ।

সেই সময়ে একটু দূরেই চিৎকার ওঠে। মানী ব্যক্তিরা রাস্তায় বের হলে অমন চিৎকার করে পথচারীদের সাবধান করে দেওয়া হয়। জিৎ সিং দেখতে পায় যমুনার তীর ঘেঁষে একটি প্রকাণ্ড সুসজ্জিত শিবিকা এগিয়ে আসছে। সেই শিবিকার সম্মুখে আর পশ্চাদ-ভাগে অস্ত্রধারী অশ্বারোহী। কোনো আমীর ওমরাহের গৃহের বেগম হবে হয়তো। নইলে এত ঘটা ক’রে পথ দিয়ে যাবার ক্ষমতা কার রয়েছে? অত মূল্যবান শিবিকাই বা সাধারণ লোকে পাবে কোথা থেকে। শিবিকার বাহকদের পোশাকের বাহার দেখলেই তো চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চিতোরে থাকবার সময়ে রানাবংশের কুলবধূদের শিবিকাও সে দেখেছে। এর সঙ্গে তুলনায় সে সব কিছুই নয়।

অবাক হয়ে চেয়ে থাকে জিৎ সিং।

তাদের দিকে আসছে ওটি। তাদের পাশ দিয়েই চলে যাবে বলে মনে হয়। জিৎ সিং পথের আর একটু ধারে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু তার সঙ্গী একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পা-দুখানি যেন মাটির ভেতরে পুঁতে দিয়েছে কেউ।

শিবিকার চতুর্দিক মণি-মাণিক্যখচিত মহামূল্যবান বস্ত্রদ্বারা আবৃত। তবু সেটি যখন তাদের একেবারে কাছে আসে তখন সেই বস্ত্রের একটি দিক ওপরে উঠে যায়। শিবিকার ভেতর থেকে এক অসামান্য সুন্দরীর মুখ একটুখানি বাইরে বেরিয়ে আসে। রূপের দ্যুতিতে জিৎ সিং-এর চোখ যেন ঝলসে যায়। তবু সে লক্ষ্য করে সুন্দরীর আয়ত চোখের দৃষ্টি এসে নিবদ্ধ হয়েছে ভবঘুরের ওপর। সেই দৃষ্টিতে কী যেন মাখানো। জিৎ সিং বুঝতে পারে না, অথচ অনুভব করতে পারে। সে দেখে ভবঘুরে মাথা নীচু করে। আর সুন্দরীর আঁখিদ্বয় অশ্রুতে পূর্ণ হয়।

শিবিকার বস্ত্র আবার ঢেকে দেয় চারদিক। শিবিকা চলে যায়।

ভবঘুরে তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ মাথা নীচু ক’রে থাকে। তারপর হঠাৎ নিজেকে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলে,–দেখলে তো? মুঘল হারেমের বেগম।

—আশ্চর্য সুন্দরী, কিন্তু পর্দানশীন হয়েও পর্দাটি ওভাবে তুলে ধরল কেন? মনে হল, বিশেষভাবে যেন আপনাকেই দেখছে। চোখেই বা জল এল কেন?

লোকটি গম্ভীর হয়ে বলে,—কারণ, মুঘল হারেমের বেগম হলেও, মেয়েটি আসলে ছিল হিন্দু।

—–কে ও? আপনি চেনেন?

—হ্যাঁ, ওর নাম কমলাবতী। গণ্ডোয়ানার রানীর ভগ্নী কমলাবতী। গণ্ডোয়ানা, চেনো নিশ্চয়ই রানী দুর্গাবতীর গণ্ডোয়ানা। তাঁর পুত্র বীরনারায়ণের গণ্ডোয়ানা।

—রানী দুর্গাবতী। কে না চেনে তাঁকে? প্রাণ দিলেন, অথচ মান দিলেন না যিনি।

—হ্যাঁ। আসফ খাঁর মতো সেনাপতিকেও তাঁর কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল। কিন্তু অতটুকু রাজ্য মুঘলশক্তির সঙ্গে কতদিন লড়বে? মান বাঁচাতে রানী নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে দিলেন। তারপর তাঁর পুত্র বীরনারায়ণ হলেন রাজা। বয়স অল্প হলে কি হবে? তিনিও মায়েরই ছেলে ছিলেন। দুর্গাবতীর স্তনের দুধ খেয়ে তিনি বড় হয়েছেন। শত্রুকে রুখে দাঁড়ালেন তিনি। দুর্গ চৌরগড়কে যতদিন পারলেন রক্ষা করলেন। শেষে তাঁরও পতন হল। বীরনারায়ণ তাঁর দুইজন বিশ্বস্ত কর্মচারীর ওপর জহরব্রতের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর আগুন জ্বলে উঠেছিল চৌরগড় দুর্গের অভ্যন্তরে। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় রাজপরিবারের ফুলের মতো সুন্দরীরা পুড়ে ছাই হয়ে মিলিয়ে গেল। কিন্তু সেই একই সঙ্গে ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। জহরব্রতের চারদিন পরে, আগুন যখন একেবারে নিভে গেল, তখন সেই গোলাকার স্থানটির দরজা যে প্রথম খুলল সে ভেতরে দৃষ্টি ফেলেই চমকে উঠল। সে দেখল এই আগুনের মধ্যেও একটি বিরাট বৃক্ষকাণ্ড একটুও পোড়েনি। হয়তো খুবই কাঁচা ছিল। আর সেই কাণ্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই রমণী। একজন হল এই কমলাবতী, আর অপরজন হচ্ছে বীরনারায়ণের ভাবী স্ত্রী। এই রমণীকে বিবাহ করবার অবকাশ পাননি বীরনারায়ণ। এরপর যা বরাবর ঘটে থাকে তাই ঘটল। আসফ খাঁ আকবর শাহকে তুষ্ট করবার জন্যে এই দুই রমণীকে পাঠালেন আগ্রার হারেমে। হয়তো তিনি পাঠাতেন না, হয়তো ছেড়েই দিতেন এদের। কিন্তু তিনি তখন একটি দুষ্কার্য ক’রে বসেছিলেন। তিনি বাদশাহকে বঞ্চিত ক’রে চৌরগড় দুর্গের অফুরন্ত ধনসম্পত্তি হজম করে বসেছিলেন। সেই ধনসম্পত্তির মধ্যে ছিল আলাউদ্দীন খিলজীর সময়ের একশো ঘড়া সোনার আশরাফী। কমলাবতীকে আগ্রায় না পাঠিয়ে তার উপায় ছিল না।

ভবঘুরে তার কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

জিৎ সিং বলে,—কমলাবতী ভীরু। হিন্দু রমণী হয়েও মৃত্যুকে ভয় পেয়েছে।

—ঠিক। কমলাবতী রূপসী হতে পারে, কিন্তু সে ভীরু। মৃত্যুর চেয়ে মুঘল হারেমও তার কাছে ভালো।

জিৎ সিং থেমে থেকে প্রশ্ন করে,—কমলাবতী কি আপনাকে চেনে?

—হ্যাঁ, চেনে। খুব কম বয়স থেকেই চেনে। একটা সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। সেই সম্বন্ধ এত ঝড় বয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনো ছিন্ন হয়নি। কমলাবতী এককালে আমাকে ভালোবাসত। এখনো নাকি ভালোবাসে। অন্তত সে তো তাই বলে। একবার নয়, বার বার বলে।

—আমি বিশ্বাস করি না।

—না করাই স্বাভাবিক। কারণ তোমার বয়স কাঁচা।

—পরিণত বয়সেও বিশ্বাস করব না। জহরব্রতের আগুন থেকে যে নিজেকে বাঁচায়, সে পৃথিবীতে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না।

—কথাটা তুমি ভুল বলনি, তবে তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু আমি তর্ক করব না।

জিৎ সিং কিছুক্ষণ পরে বলে,—কি ক’রে আগ্রায় আপনাদের সাক্ষাৎ হল প্রথম?

—দৈবাৎ, এই যমুনারই তীরে। সে-ই আমাকে দেখেছিল প্রথম দিন। আমি বুঝতেও পারিনি, পরদিন একটি পত্র ফেলে গেল আমার সামনে। সেটি তুলে নিতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তাতে সে অনুরোধ করেছিল, প্রতিবছর একবার অন্তত আগ্রায় এসে তাকে দেখা দিতে, আমিও দেখা দিই। যতদিন আগ্রায় থাকি প্রায় রোজই দেখা দিই। আমায় দেখে যদি ওর মন ভরে, ক্ষতি কি?

ভবঘুরে উদাস হয়ে যায়।

জিৎ সিং তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলে,—আর আপনার, আপনার মন ভরে না? তার কথায় জবাব না দিয়ে ভবঘুরে হনহন করে কিছুটা দূরে চলে যায়। তারপর থেমে পড়ে সেখান থেকেই উচ্চকণ্ঠে বলে, কাল তবে এখানেই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তানসেনের সংগীত-আসরে নিয়ে যাব।

.

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল।

সংগীত-সম্রাট তানসেনের গৃহ আলোকমালায় সজ্জিত। যেন দেওয়ালী উৎসবের রাত্রি। বাইরে বহু শকটের ভিড়। আগ্রার বাছাই-করা সংগীত-রসিকবর্গ উপস্থিত হয়েছেন তানসেনের গৃহে। কারণ তাঁদের অনেকেই মুঘল-দরবারে গিয়ে সংগীত-সুধা পানের সুযোগ পান না। যাঁরা সুযোগ পান, তাঁদেরও অনেকে এসেছেন। দরবারের সংগীত আর ঘরোয়া পরিবেশে গাওয়া সংগীতের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাছাড়া এ এমনই জিনিস যে, যতবার শোনা যাক তৃষ্ণা আর মেটে না। রবাহূত হয়েও তাই আসতে হয়। এখানে সম্মানের প্রশ্ন নেই, পদগৌরবের কথা ও ওঠে না। সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে সংবেদনশীল মনটুকু নিয়ে শুধু এখানে আসতে হয়। এখানে সবাই পিপাসার্ত। সেই পিপাসার নিবৃত্তি একমাত্র তানসেনের কণ্ঠনিঃসৃত সুধা-ধারা দ্বারাই সম্ভব।

জিৎ সিং অস্বস্তি অনুভব করে। সে ভবঘুরের গায়ে আস্তে হাত রেখে বলে,—বুঝলেন? এসব জায়গায় আমার না আসাই ভালো। একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে শেষে।

—কেন?

—ওরা ধরে ফেলবে, আমি ওদের মধ্যে একজন জলজ্যান্ত বেরসিক। তার চাইতে এই রাস্তা থেকে বিদায় নেওয়াই ভালো।

—ওরা লক্ষ্যই করবে না, ডুবে থাকবে। সারাক্ষণ সংগীতের মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। নিমজ্জিত অবস্থাতেই এসেছে ওরা। এসব জায়গায় আসতে হলে তেমনি ভাবেই আসতে হয়। অবশ্য দু-চারজন অন্য ধরনের লোকও রয়েছে। তারা জগতের সব জায়গাতেই থাকে। তারা বাদশাহের চোখ।

—বাদশাহের চোখ?

—হ্যাঁ। বাদশাহের নিজের তো মাত্র দুটো চোখ। সেই দুই চোখ দিয়ে দুনিয়ার সবকিছু দেখা সম্ভব নয়। তাই তিনি এ-জাতীয় অসংখ্য চোখ ছেড়ে দিয়েছেন সাম্রাজ্যের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। এরা যা দেখে হুবহু সব জানায় বাদশাহের দপ্তরে। জানায় বলেই বাদশাহ্ মানুষ হয়েও সবজান্তা।

জিৎ সিং অবাক হয়। সে বুঝতে পারে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আগ্রায় এসেছে সে, সেই উদ্দেশ্যের পথ যতটা কণ্টকাকীর্ণ বলে ভেবেছিল তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি।

—ওরা তো বুঝবে আমি রসিক-সমাজের কেউ নই।

—না। বুঝবে না। কারণ ওরা নিজেরাও সংগীত বোঝে না। তবে তোমাকে একটি কাজ করতে হবে। সবাই যা করবে তুমি তাই অনুকরণ ক’রে যাবে। মুখে কিছু উচ্চারণ করবে না। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে আর হাত নেড়ে তোমার আবেগ প্রকাশ করবে।

জিৎ সিং হেসে ফেলে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে কয়েকজন বোরকা পরা রমণীকে তানসেন-গৃহে প্রবেশ করতে দেখে তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে।

ভবঘুরে তার পিঠ থাবড়ে বলে,—ভয় পেয়ো না। ওই সব মহিলাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই এসেছে নিজের পুরুষকে দেখতে, ঝরোকার আড়াল থেকে। তুমি ওদের কেউ নও, তাই তোমার দিকে ওরা ফিরেও চাইবে না। একমাত্র তানসেনের গৃহেই মুসলমান রমণীরা আসতে পারে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে। নইলে ওরা পুরোপুরি পর্দানশীন। ওদের জন্যে তোমার কিছুমাত্র বিচলিত হবার কারণ নেই। এসো।

—একটু দাঁড়ান।

জিৎ সিং তার কোমর থেকে তলোয়ারটি খুলে একটি গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে আসে।

ভিতরে প্রবেশ ক’রে জিৎ সিং দেখে, ইতিমধ্যেই অনেকে জড়ো হয়েছে সেখানে। বিরাট কক্ষ। কক্ষের মেঝের ওপর দামী গালিচা পাতা। সেই গালিচার মাঝখানে বাদ্যযন্ত্র সযত্নে রাখা হয়েছে। সেগুলির পাশে বসে রয়েছে তিন-চারজন লোক। এদের ঘিরে বসেছে রসিকের দল।

কক্ষটির একদিকে ঝরোকা। তার পেছনে রয়েছে রমণীকুল। মুখের বোরকা তারা নিশ্চয় তুলে ফেলেছে। জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে দেখতে শুরু করেছে কক্ষের ভেতরের দৃশ্য। জিৎ সিং এবারে আর আড়ষ্ট হয় না। স্থানটির পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে, তাকে ভুলিয়ে দেয়।

ভবঘুরে ফিসফিস করে বলে,—বসে পড়।

জিৎ সিং বসে পড়ে। সে দেখতে পায়, অনেকেই তার দিকে চাইল। কিন্তু সে চাহনির ভেতরে কোনো অর্থ পরিস্ফুট হল না। চাইতে হয়, তাই চাইল। নতুন কে এল, শুধু দেখে নিল একবার। অথচ এদের অনেকেই হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে ভিন্নরূপ ধারণ করে। তখন তাদের শ্যেনদৃষ্টিতে শত্রুপক্ষের সামান্য ত্রুটিও ধরা পড়ে যায়। সেই ত্রুটির সদ্ব্যবহার করতে একমুহূর্তও দেরি করে না তখন।

আরও কিছু লোক আসবার পর একটি দরজা দিয়ে তানসেন প্রবেশ করেন। বিন্দুমাত্র শব্দও শোনা যায় না কোথাও। তানসেনের পায়েও শব্দ নেই। গালিচা তাঁর পায়ের শব্দ বুক পেতে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে এই সংগীতজ্ঞকে। সাধারণ একটি কাপড় পরেছেন তিনি। সাধারণ একখানি চাদর গায়ে জড়ানো। সেই চাদরের কিছুটা অংশ লুটিয়ে পড়েছে একপাশে। কিন্তু মাথায় তাঁর একটা অদ্ভুত গোছের জিনিস। ঠিক হিন্দুর পাগড়ীও নয়, আবার মুসলমানী টোপী বলতেও বাধে। কোনো কোনো হিন্দু-সন্ন্যাসী অনেকটা ওই জাতীয় জিনিস ব্যবহার করেন। তবে অবিকল অমন নয়।

পথে ভবঘুরের কাছে শুনেছে জিৎ সিং যে তানসেন সম্প্রতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। অথচ ছয় সাত বছর আগেও নাকি তিনি গোয়ালিয়রে ছিলেন। সেখানে এক নির্জন স্থানে আপন মনে সংগীত চর্চা করতেন। ভবঘুরে বলেছিল, সংগীত তখন ছিল তানসেনের সাধনার জিনিস। কিন্তু এখন সেই জিনিস ভাঙিয়ে তিনি অর্থ উপার্জন করছেন। সেই জিনিস ভাঙিয়ে তিনি হয়েছেন আকবর শাহের সব চাইতে প্রিয়পাত্রদের মধ্যে একজন। গোয়ালিয়র থেকে যে সুবাস একদিন ভারতের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই সুবাসের কিছুই অবশিষ্ট নেই। গোয়ালিয়রের সেই বন্যফুলকে তুলে এনে প্রাসাদের শ্বেতপাথরের বেদির ওপর স্বর্ণনির্মিত পাত্রে রাখায় তার কৃত্রিম সৌন্দর্য কিছুটা বর্ধিত হলেও আসল সৌন্দর্য আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আরামের স্রোতে একবার গা ভাসালে জেনেশুনেও কিছু করা যায় না। স্রোত তার নিজের গতির সঙ্গে সব কিছু টেনে নিয়ে চলে।

অথচ এই তানসেনই একদিন কেঁদে ফেলেছিলেন আকবর শাহ্ ডেকে পাঠিয়েছেন শুনে। রেওয়ার রাজা রামচাদের কাছে হুকুম ক’রে পাঠালেন বাদশাহ্, তানসেনকে তাঁর চাই-ই। রামচাদের শক্তি ছিল না সে-হুকুম অমান্য করবার। তিনি তানসেনকে সব খুলে বলেছিলেন। শুনে চোখের জল ফেলেছিলেন তানসেন। সেই জলের সঙ্গে তাঁর শিল্পীমনও গলে বের হয়ে গিয়েছিল সেদিন। এখন রয়েছে শুধু শুষ্ক শিল্প। মন-ছাড়া শিল্প। মনটি উধাও।

বাদ্যযন্ত্রের মৃদু শব্দে জিৎ সিং-এর চমক ভাঙে। সে দেখে ভবঘুরে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে তানসেনের দিকে। কী দেখছে কে জানে। যাকে সে এত ঘৃণা করে, তাকে কতখানি শ্রদ্ধা করে তারই পরিমাপ শুরু হয়েছে বোধহয়।

—সংগীত শুরু হয়।

এক অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করে বহুক্ষণ ধরে। না বুঝেও জিৎ সিং অন্য সবার মতো অভিভূত হয়ে পড়ে। যেন অন্য রাজ্যে বিচরণ করছে। তবু তার মধ্যেও ভবঘুরের উপদেশ তার মনে হয়। আড়চোখে এদিকে ওদিকে চেয়ে সবার মতো সেও কখনো ঘাড় দোলায়, কখনো বুঁদ হয়ে বসে থাকে। কিন্তু ভুলেও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বার করে না।

সে দেখে ভবঘুরে তন্ময় হয়ে আছে। লোকটি যে সংগীতজ্ঞ এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। লোকটি সাধারণ স্তরের কোন মানুষও নয়। কমলাবতীর সঙ্গে যার প্রণয় ছিল, সে সাধারণ স্তরের মানুষ হতে পারে না। কোনো সর্দার, কোনো রাজা অথবা কোনো জায়গীরদার কিংবা তাদের কোনো আত্মীয় তো বটেই। অথচ একটি আঘাতেই আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। জিৎ সিং বুঝতে পেরেছে, কমলাবতী যদি জহরব্রতের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত তবে এ দশা হত না মানুষটির। সান্ত্বনা খুঁজে পেত সে। কিন্তু এখানে এসেও এতদিন বেঁচে রয়েছে, আত্মহত্যার কোনো চেষ্টাই করল না এপর্যন্ত—এর কোন যুক্তি নিশ্চয় খুঁজে পায়নি ভবঘুরে। খুঁজে পেলে এমন দশা তার হত না। কমলাবতী হয়তো তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে ভালোবাসার একটা সীমা রয়েছে। সেই সীমানার বাইরে সে কখনো এক পাও অগ্রসর হবে না। অগ্রসর হলে অনেক আগেই হতে পারত। শিবিকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভবঘুরেকে জড়িয়ে ধরে এক পলকে মধ্যে যমুনার জলে গিয়ে দুজনে ডুবে যেতে পারত। যমুনা খুবই কাছে। তার জলের গভীরতাও দুজন মানুষকে ডুবিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু কমলাবতী তা চায় না। সে বেঁচে থাকতে চায়। ভবঘুরের ওপর তার হয়তো টান রয়েছে। কিন্তু টানের চেয়েও ভালোবাসার বিলাসটাই বেশি। হারেমের ঐশ্বর্যের মধ্যে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে সামান্য একটু ঝুঁকি নিয়ে প্রথম জীবনের প্রণয়ীকে দেখে চোখের জল ফেলার মধ্যে বেশ একটা উত্তেজনা, একটা আনন্দ আছে। হারেমে ফিরে গিয়ে সেই ঘটনাকে রোমন্থন করতে করতে নিঃসঙ্গ রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। আকবর শাহ্ তো আর প্রতিরাতেই তার শয্যায় অংশ নিতে পারেন না। দু-চার মাসে একদিন আসাও হয়তো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

আসলে ভবঘুরেই পাগলের মতো ভালোবাসে কমলাবতীকে। আর ভালোবাসে বলেই তার শত অন্যায় শত অধঃপতন দেখেও ছেড়ে যেতে পারে না। কিন্তু তার যুক্তি তার মনে এনেছে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের জ্বালায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ একসময় জিৎ সিং-এর খেয়াল হয়, কক্ষের মধ্যে আবার নীরবতা বিরাজ করছে। তানসেন তাঁর সংগীত বন্ধ ক’রে ধীরে অভিবাদন জানান উপস্থিত সবাইকে। তিনি সবার মুখে প্রত্যাশার পরিতৃপ্তি দেখে একটু হাসেন।

সেই সময়ে সবাইকে, বিশেষ করে জিৎ সিং-কে খুব বেশি মাত্রায় চমকিত ক’রে ভবঘুরে বলে ওঠে,–এ রাগে আপনি আর গাইবেন না তানসেনজী।

—কে? তানসেনের মুখ ফ্যাকাশে দেখায়।

ভবঘুরে গালিচার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি

—কে আপনি?

—আমি একজন সাধারণ মানুষ।

—সাধারণ মানুষ? সংগীত বোঝেন?

—একটু একটু বুঝি বৈকি।

—আমার সংগীতের ওপর কথা বলবার মতো ধৃষ্টতা যখন হয়েছে আপনার তখন ‘একটু বুঝি’ বললে চলবে না।

—তবে আমিও বলি মীর্জা তানসেন সাহেব, সংগীত আমি ভালোই বুঝি। মনে আছে গোয়ালিয়রের কথা? মনে আছে গুরুজীর কথা?

তানসেন কেঁপে ওঠেন,–কে আপনি? গুরুজীকে আপনি চেনেন?

—চিনি। জানি না এখনো তিনি বেঁচে রয়েছেন কি না। যদি বেঁচে থাকেন তবে গিয়ে বলব তাঁকে যে, তাঁরই এক কালের প্রিয়তম শিষ্য ভারতের প্রাচীনতম দুই রাগ-কে হত্যা করেছেন।

জিৎ সিং বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে ভবঘুরের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সে দেখে উপস্থিত সবাই আপ্রাণ চেষ্টায় তাদের ক্রোধকে দমন করছে। ঝরোকার পেছনে মৃদু শব্দ আর ফিসফিসানি। তানসেনের মুখ যেন রক্তশূন্য।

—আপনি তাঁকে ভুল খবর দেবেন।

তানসেনের এই উক্তির মধ্যে কিছুমাত্র ঔদ্ধত্য ছিল না। তাঁর কণ্ঠস্বর রীতিমতো সংযত

—না তানসেন। আমি বিনা কারণে তাঁকে ভুল খবর দিয়ে আঘাত করতে পারি না। বয়স হয়েছে তাঁর। এ আঘাত সহ্য করা তাঁর পক্ষে খুবই কষ্টকর হবে। একটি অনুরোধ আপনাকে জানাই, সংগীত-সম্রাট আপনি, সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্যে আপনার বহু সাধনায় লব্ধ রাগগুলিকে বিকৃত করবেন না ভবিষ্যতে।

—আমি বিকৃত করিনি কখনো।

—যদি আপনার কথা সত্যি হয় অর্থাৎ আপনার ধারণা তাই হয়, তবে বুঝব দরবারে এসে অন্তত দুইটি রাগ আপনি ভুলে গেছেন।

—ভুলে গেছি? তাও কি সম্ভব?

—হ্যাঁ সম্ভব। আপনার পক্ষে খুবই সম্ভব। আপনি নিজেও জানেন সেকথা। সংগীতের স্বপ্ন আর দেখেন কি মীর্জাসাহেব? সংগীত আপনাকে পৃথিবীর সবকিছু ভুলিয়ে দেয় কি আজকাল?

তানসেন চুপ ক’রে থাকেন।

ভবঘুরে কম্পিত কণ্ঠে বলেন,—দুর্ভাগ্য আমাদের যে আমরা চিরকালের জন্যে দু’টি রাগকে হারিয়ে ফেললাম। সেই দু’টিকে শুধু আপনার মতো প্রতিভাধর ব্যক্তির পক্ষেই রক্ষা করা সম্ভব ছিল। শুধু আপনিই পারতেন সেই দুই রাগকে অক্ষত দেহে অপর প্রতিভাধরের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে—যাতে ভারতের বুকে, পৃথিবীর বুকে তারা বেঁচে থাকে। কিন্তু পারলেন না। সস্তা বাহবার মোহে সেই রাগ দুটিকে মোচড় দিয়ে এমন অবস্থায় এনে ফেললেন, যে তাকে আর চেনাও যায় না। তার আগের রূপ কেমন ছিল আপনি নিজেও ভুলে গেছেন। সেই সঙ্গে ভুলে গেল এই ধরিত্রী।

তানসেন মোহাচ্ছন্নের মতো উঠে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে ভবঘুরের কাছে এগিয়ে এসে তিনি বলেন,–কোন্ রাগ দ্বয়ের কথা আপনি বলছেন গুণী?

—হিন্দোল আর মেঘরাগ।

তানসেন যেন স্তব্ধ হয়ে যান। তাঁর মাথাটা ধীরে ধীরে নিচু হয়।

ঠিক সেই সময়ে সমস্ত কক্ষ কম্পিত ক’রে গম্ভীর কণ্ঠে সুর ওঠে,—মুশকিল আসান!

সবার দৃষ্টি একসঙ্গে ঘুরে যায় দ্বারের দিকে। তারা দেখতে পায়, সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাতি হাতে এক অতি বৃদ্ধ ফকিরসাহেব। ফকিরের শ্মশ্রুগুম্ফ সবই সাদা ধবধবে।

ফকিরসাহেবের দৃষ্টি সবার মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে তানসেনকে বিদ্ধ করে। সে আবার সুরেলা কণ্ঠে বলে ওঠে,—ঘাবড়াও মত্। মুশকিল আসান। সব বিপদ কেটে যাবে। এই যে ঝড় উঠেছে, এ ঝড় থাকবে না। শান্তি, শুধু শান্তি করবে বিরাজ।

তানসেন মাথা উঁচু করে ফকিরসাহেবের দিকে তাকান। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। তিনি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ফকিরসাহেবকে ডেকে এনে নিজের জায়গায় বসতে অনুরোধ করেন।

—না না। আমরা বসি না। আমরা শুধু ঘুরে বেড়াই এক দরওয়াজা থেকে অপর দরওয়াজায়। আমরা আল্লার বার্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

—তবু একটু বসুন। আমার একান্ত অনুরোধ আপনি বসুন। কারণ আমি যে মুশকিলে পড়েছি সেই মুশকিলের আসান নেই।

—আমি শুনেছি। সব শুনেই বলেছি—মুশকিল আসান।

কক্ষের সবাই বিরক্ত হয় একজন ফকির সাহেবকে এতটা প্রাধান্য দেবার জন্যে। তাদের কেউ কেউ বলে ওঠে,আজ কি তবে এখানেই শেষ?

তানসেন সেলাম জানিয়ে সবাইকে বলেন,—হ্যাঁ। আজ আমার পক্ষে মনস্থির করে বসা আর সম্ভব হবে না। অন্য দিন আপনাদের নিমন্ত্রণ করার ইচ্ছা রইল। কিন্তু আজ নয়। আপনারা নিজ গুণে মাফ করে নেবেন। সবই তো শুনলেন।

একসঙ্গে উঠে পড়ে সবাই। ভবঘুরের দিকে ক্রোধ-মিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে একে একে কক্ষ থেকে বিদায় নেয়। শুধু ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকে ভবঘুরে আর জিৎ সিং।

জিৎ সিং নিচু গলায় বলে,—চলুন, এই সুযোগ এদের সঙ্গে বের হয়ে যাই। ঝামেলা বাধিয়ে লাভ কি?

—না একটু অপেক্ষা কর। আমি আর একটি জিনিস লক্ষ্য করছি।

—কী জিনিস?

—জানি না এখনো। সঠিক জানি না।

তানসেন ফকিরসাহেবকে বলেন,–এই গুণী ব্যক্তিটি আমার মনে তুমুল ঝড় তুলেছেন।

ফকিরসাহেব মৃদু হেসে বলেন,—উনি খাঁটি কথা বলেছেন।

—আপনিও একথা বলছেন?

—যা সত্যি, তাকে কখনো ঢাকা যায় না মীর্জাসাহেব। কিন্তু ওঁর পাশে আর একজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন দেখছি। উনিও কি একজন সমঝদার?

তানসেন জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে বলেন,—আমি তো চিনি না।

ভবঘুরে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,– ইনি আমার সঙ্গী। একজন রাজপুত। এখানে এসেছেন কাজের খোঁজে। অল্প বয়স হলেও ইনি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী।

জিৎ সিং বুঝতে পারে না ফকিরসাহেবের কাছে এত পরিচয় দেবার কি কারণ ঘটল ভবঘুরের। ফকিরসাহেব সহসা উঠে দাঁড়ান। বাতিটিকে সামনে ধরে দরওয়াজার দিকে পা বাড়িয়ে সুর করে বলে ওঠেন,—মুশকিল আসান!

সহসা জিৎ সিং-কে অবাক ক’রে দিয়ে তানসেন ফকিরসাহেবের সামনে বসে পড়ে মিনতি-ভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন,—যাবেন না জাহাঁপনা।

হাতের বাতি ছুড়ে ফেলে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ফকির সাহেব বলে ওঠেন—চোপও, আমি জানতাম তুমি আমায় চিনতে পেরেছ। কিন্তু এ কি করলে? বাইরের লোকের সামনে এমন মূর্খের মতো কাজ করলে?

—থাকতে পারলাম না।

এবার হেসে ওঠেন তামাম মুঘল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। বলেন,–তোমার জন্যে আমার বাদশাহী অচিরেই ঘুচে যাবে তানসেন।

—না। আপনি নিজেও জানেন, ঘুচবার সময় না এলে কেউ ঘুচিয়ে দিতে পারে না। জানেন বলেই, অযথা অনেক বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন, যে বিপদকে ইচ্ছে করলেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। নইলে এইভাবে ছদ্মবেশে কোন্ বাদশাহ একা একা বার বার প্রাসাদের বাইরে চলে আসেন। এও কি কম ঝুঁকি?

—থামো। ভেবেছিলাম, আজ তোমার বাড়িতে এসে তোমার অজ্ঞাতে সংগীত-সুধা পান ক’রে ফিরব। কিন্তু তা আর হল না। একটি শেষ হতেই এই রাজপুত তর্ক তুললেন। আপনাদের পরিচয় কি?

ভবঘুরে দৃঢ়স্বরে বলে,—আমি ভবঘুরে জাহাঁপনা। এখন আর কোনো পরিচয় নেই।

—আমাকে আপনিও চিনতে পেরেছিলেন।

—আশ্চর্য। আপনি বুঝতে পেরেছেন দেখে বিস্মিত হলাম। হ্যাঁ, আমি চিনতে পেরেছিলাম।

—বড্ড তাড়াতাড়ি করেছিলাম আজ। তাই ধরা পড়ে গেলাম। ভেবেছিলাম দেরি হলে তানসেনের গানের আসরে ঠিক সময়ে হাজির হতে পারব না। সে যাকগে। আসুন না আমার দরবারে। আপনার মতো গুণী ব্যক্তির রাস্তায় পড়ে থাকা শোভা পায় না।

—আমি গুণী নই জাহাঁপনা। তবে গুণী লোকদেরও কিছু কিছু রাস্তায় থাকার প্রয়োজন আছে। সবাই যদি দরবার অলংকৃত করে, তবে দেশের সাধারণ লোকে কি শিখবে? আপনার পরবর্তী বংশধরদের দরবার অলংকৃত করবার জন্যে কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আপনার দরবারের রত্নদের বিবেককে মাঝে মাঝে, খুঁচিয়ে জাগিয়ে দেবার জন্যেও কিছু লোকের বাইরে থাকার দরকার।

জিৎ সিং স্তম্ভিত হয়ে শোনে ভবঘুরের কথা। অদ্ভুত সাহসী লোক। তার এই পরিচয় সে জানত না।

বাদশাহ্ একটু চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন,—হুঁ। মন্দ কথা বলেননি। ঠিক আছে। আমি চলি তানসেন। দাও, আমার বাতিটা কুড়িয়ে এনে জ্বালিয়ে দাও তো।

—একা যাবেন?

—একাই তো এসেছি।

ভবঘুরে জিৎ সিং-কে দেখিয়ে বলে ওঠে,—আপনি একে সঙ্গে নিতে পারেন জাহাঁপনা। জিৎ সিং-এর বুক দুরু দুরু করে।

—ওকে? কেন? এখনো তো ছেলেমানুষ। দেশ কোথায় তোমার?

—মেবার।

—মেবার? সেখান থেকে তো কোনো উপঢৌকন আমি পাইনি।

জিৎ সিং মরিয়া হয়ে বলে,—আমি জানি জাহাঁপনা। তবে বেশিদিন আর এভাবে থাকতে পারবে না ওরা। উপঢৌকন ওদের পাঠাতেই হবে। আগে আর পরে।

—হুঁ। তুমি কাজ চাও?

—হ্যাঁ, জাহাঁপনা।

—যুদ্ধ জানো, শুনলাম না?

—হ্যাঁ, জাহাঁপনা।

—বেশ। কাল রাজা মানসিংহের সঙ্গে দেখা কর।

জিৎ সিং-এর ঘোর কেটে যাবার আগেই সে শুনতে পায় রাস্তায় সুর ক’রে ডেকে চলেছেন ফকিরসাহেব,—মুশকিল আসান!

তানসেন ভবঘুরেকে বলে,—আপনার সঙ্গে আরও আলাপের ইচ্ছা রইল।

—যদি আগ্রায় থাকি, দেখা হবে আবার। চল জিৎ সিং।

বাইরে এসে জিৎ সিং দেখে তখনো একটি শকট দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবাই তো চলে গেল, এটি তবে দাঁড়িয়ে কেন? ভবঘুরেকে সে প্রশ্ন না করে পারে না।

ভবঘুরে শান্ত স্বরে বলে,—সবাই যে চলে গেছে, তা কে বলল তোমাকে?

~নিজের চোখেই তো দেখলাম।

—ঝরোকার পেছনে গিয়ে দেখেছ?

জিৎ সিং চুপ ক’রে যায়। সে দু-চার পা এগিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা তলোয়ারখানা তুলে কোমরে বেঁধে নেয়।

—এখন ইচ্ছে করলে, তুমি ছুটে গিয়ে ফকিরসাহেবকে ধরতে পার। তাঁকে শেষ করে দিতে পার।

—ছিঃ!

—তুমি যে-উদ্দেশ্য নিয়ে আগ্রায় এসেছ সবই তো বলেছ আমাকে। তবে দ্বিধা কেন? একবারের অসি চালনার দ্বারা এর চেয়ে বড় আঘাত মুঘলদের আর দিতে পারবে?

—না, তবু একথা জানিয়ে দিই আপনাকে, আমি ঘাতক নই। আমি যুদ্ধ করি। কিন্তু গোপনে হত্যা করি না। এইটুকু আদর্শ আমি ধরে রাখব। চিতোরে গিয়ে উনি যত অত্যাচারই করুন, ওঁর ভেতরের মানুষটির কিছু পরিচয় পেলাম আজ

—শুনে সুখী হলাম। বড় কাজ করতে হলে হীনতাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। তাছাড়া আকবর শাহকে চেনোনি এখনো। এই মুহূর্তে তুমি ঘোড়া নিয়ে ছুটলেও ফকির সাহেবের সাক্ষাৎ আর পাবে না আগ্রার রাস্তায়। পরিবর্তে হয়তো দেখবে একজন ভিস্তিওয়ালা ঢুলতে ঢুলতে চলেছে। পলকের মধ্যে নিজের ভোল পালটে ফেলতে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। একবার আমার মতো এক ভবঘুরের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এমন অবস্থায় ধরা পড়লেন যে, পোশাক পরিবর্তনেরও অবকাশ ছিল না। তখন তিনি শুধু চোখ আর মুখের ভঙ্গির পরিবর্তন ক’রে ভবঘুরেকে ধোঁকা দিয়ে রক্ষা পেলেন। আশ্চর্য মানুষ এই বাদশাহ্। তুমি যদি এখন ফকিরসাহেবের সাক্ষাত্ত পাও, ভেবো না তিনি নিরস্ত্র। নিজেকে রক্ষা করার অনেক পথ উন্মুক্ত রেখেই অগ্রসর হন আগ্রার হারুন-অল-রসিদ।

আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ভবঘুরে বিদায় নেয়। সে চলে যায় যমুনার দিকে। সরাইখানা ছেড়ে আজকাল সে ওদিকেই থাকে। কোথায় থাকে বলতে চায় না।

জিৎ সিং সোজা পথে সরাইখানা দিকে চলতে শুরু করে। এতক্ষণে সে অনুভব করতে পারে আজকের ঘটনা তাকে কতখানি উত্তেজিত করেছে। তার মাথার দুই পাশের রগ দপদপ করে। তবু সে উৎফুল্ল। বাদশাহের কাছে এত তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে পারবে ভাবেনি কখনো। এত তাড়াতাড়ি কাজ পাবে, তাও কল্পনা করেনি। ভবঘুরে তার অনেক উপকার করেছে। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার কথা মনে হয়েছিল একবার। কিন্তু সংকোচে জানাতে পারেনি। হয়তো বলে উঠত,—আরও সুযোগ আসবে কৃতজ্ঞতা জানাবার

আপন মনে ভাবতে ভাবতে চলে জিৎ সিং। অশ্বটির কথা মনে পড়ে, মন খারাপ হয়ে যায়। কিকার দেওয়া অশ্ব, ওটিকে হারিয়ে ফেলে যেন কিকাকেই অসম্মান করা হয়েছে। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। আতরের দোকানী তাকে সাবধান ক’রে দিয়েছিল। উটওয়ালাও ইঙ্গিত দিয়েছিল।

পেছনে শকটের শব্দ শোনে সে। ফিরে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসছে শকটটি। ভবঘুরের কথা যদি সত্যি হয়, তবে ঝরোকার আড়ালের কোনো পর্দানশীন এতক্ষণে ঘরে ফিরেছেন। তানসেনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো পরিচয় আছে। তানসেনের শিষ্যাও হতে পারেন।

শকটটি জিৎ সিং-এর পাশে এসে থেমে যায়। পথ যাচ্ছে না ভেবে সে রাস্তার একেবারে কিনারায় সরে যায়। তবু শকটটি থেমে থাকে। সহসা জিৎ সিং-এর মনে সন্দেহ জাগে। কোনো ডাকাতের দল নয়তো? নির্জন জায়গায় একাকী পেয়ে তার অনিষ্ট করতে চায় হয়তো।

কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই তলোয়ারখানি শক্ত করে চেপে ধরে সে। এই শকট তানসেনের গৃহের সম্মুখে অপেক্ষমাণ শকটটি নাও হতে পারে।

জিৎ সিং তৈরি হয়ে দাঁড়ায়। এইবার ওরা চার-পাঁচজন একসঙ্গে লাফিয়ে পড়ে তাকে আক্ৰমণ করবে চারদিক হতে।

শকটের পর্দা উঠে যায়। একজন রমণী মুখখানা সামান্য একটু বের করে ডাকে,—শুনুন।

—আমাকে?

—হ্যাঁ।

—আপনি আমায় ডাকছেন?

—হ্যাঁ। পথে তো আর কেউ নেই।

জিৎ সিং একটু অপ্রস্তুত হয়। বেশ রাত হয়েছিল। আশেপাশে কাউকে দেখা যায় না। রাস্তাটাও অন্য সব রাস্তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত জনবিরল। নিশ্চয় ভুল করেছেন রমণীটি। পরিচিত কেউ ভেবে ডাকছেন।

—আপনি ভুল করেছেন। আমি নতুন এসেছি আগ্রায়।

—আমি জানি। তানসেনের বাড়ি থেকে ফিরছেন না?

—হ্যাঁ।

—একটু শুনবেন?

জিৎ সিং ইতস্তত করে। ভেবে পায় না, মহিলা হিন্দু, না মুসলমান। এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে তো?

—আপনার সংকোচের কোনো কারণ নেই। আমি রাজপুত। বয়সেও আপনার চেয়ে বড়ই হব সম্ভবত।

লজ্জিত হয়ে জিৎ সিং কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এক পলকেই বুঝতে পরে, রমণী বয়সে তার চেয়ে বড় হোক আর না হোক, তার সৌন্দর্যের তুলনা নেই। সে ভাবে, আগ্রার সব নারীই বোধহয় সুন্দরী। শ্রেষ্ঠ সুন্দরীরাই বোধহয় আগ্রায় আসে। এসে শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় বাদশাহী হারেমে। ভবঘুরে ইতিমধ্যেই তার মনে হারেমের একটা মোটামুটি ধারণা এনে দিয়েছে। বলেছে—হারেম তো নয়, আলাদা একটি নগর। প্রমীলার রাজ্য, সে-রাজ্যের শাসন-ব্যবস্থা আলাদা। সে-রাজ্যে প্রবেশ করা কল্পনাতীত। কারণ, প্রবেশ করতে হলে অনেক ব্যূহ ভেদ করতে হবে। সেই রাজ্যের একমাত্র পুরুষ বাদশাহ্ আকবর।

জিৎ সিং শুনেছে কমলাবতীর মতো অনেক রাজপুত মেয়েও রয়েছে সেখানে বাদশাহের মন ভোলানোর জন্যে তারাও অন্যান্য বেগমদের মতো অভিনয় করে। পরিতৃপ্ত ও হয় কেউ কেউ।

শকটের মহিলা হারেমেরই কোনো রাজপুত বেগম হয়তো। এত রূপ নিয়ে হারেমের বাইরে থাকতে পারে না সে।

রমণী প্রশ্ন করে,—কি ভাবছেন এত?

—না কিছু না।

—ভয় নেই, আমি হারেমের কেউ নই। আপনার মতোই বাইরের এক সাধারণ নারী।

—বাইরের হতে পারেন। তবে সাধারণ নন।

—কি ক’রে বুঝলেন?

—সাধারণ হলে তানসেনের গৃহের সংগীত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতেন না। ঝরোকার পেছনে জায়গা করে নিতে পারতেন না। আর—

—বলুন, আর কি?

—সবাই তানসেনের গৃহ ত্যাগ ক’রে যাওয়ার পরও নারী হয়ে রাতের বেলায় অপর পুরুষের গৃহে থাকবার দুর্জয় সাহস আপনার হত না।

রমণীর মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। তবু সে শান্ত গলায় বলে,—আপনার কি ধারণা আমার সম্বন্ধে?

—সব ধারণার কথা মুখে বলা যায় না।

—আপনি নিশ্চিন্তে বলুন, আমি কিছু মনে করব না।

—আপনি এমন একজন নারী, যাঁর কাজের কৈফিয়ত চাইবার মতো কেউ নেই।

রমণী এবার হাসে। বলে—ঠিক ধরেছেন। আমার কাজের কৈফিয়ত চায় না কেউ। কারণ কৈফিয়ত চাইবার মতো একমাত্র ব্যক্তিটি জানেন যে, আমি কখনো অন্যায় করি না।

—আমি সেইরকম ভেবেছিলাম। কারণ, অন্যায়ের মাপকাঠি এক এক জায়গায় এক এক রকমের।

—একথা বললেন কেন?

একজন সাধারণ মেয়ের পক্ষে যা অন্যায়, অশালীন, এমন কি মহাপাপের, আপনার কাছে তা অন্যায় নয়। বরং স্বাভাবিক।

রমণীর মুখ এবারে রীতিমতো রাঙা হয়। সেই রাঙাভাব বহুক্ষণ থাকে। নিজেকে সামলাতে কষ্ট পায় সে। কিছুক্ষণ চুপ ক’রে বসে থাকতে হয় তাকে। শকট-চালকের অসি ঝনঝন ক’রে ওঠে। ইঙ্গিত বুঝতে পারে রমণী। তাড়াতাড়ি বলে,—না উধম, ওসব নয়।

জিৎ সিং হেসে বলে,—একা আপনার উধম পারবে না।

—ও, আপনিও বুঝে গেছেন? কী বোকা দেখুন তো। কিন্তু সহ্যই বা করবে কেমন ক’রে? ওর মাইজীকে ও চেনে। জীবনে আমাকে এতটা অপমানিত হতে ও কখনো দেখেনি।

—কিন্তু আমি কিছুই বলিনি আপনাকে।

—সব কথাই কি বলতে হয়? ওর অস্ত্রের ঝনঝনানির মতো আপনার কথাও স্পষ্ট। আপনি আমাকে ভেবেছেন বাঈজী।

—কে আপনি?

—উঠে আসুন।

—না না। তা কি করে সম্ভব?

—সম্ভব। তাতেও কোনো অন্যায় হবে না।

—আপনার পরিচয় না দিলে আমি উঠতে পারি না।

—পৃথ্বীরাজ রাঠোরের নাম শুনেছেন?

—তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। মুঘল বাদশাহের হয়ে লড়লেও তিনি খাঁটি রাজপুত।

—আমি তাঁর স্ত্রী।

—অমায় ক্ষমা করুন।

—সে সব পরে হবে। উঠে আসুন আগে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শকটের ভেতরে যায় জিৎ সিং। ভেতরে অন্ধকার। কোনোরকমে সে রমণীর বিপরীত দিকে জায়গা করে নেয়।

—আপনি মেবারের লোক?

—হ্যাঁ।

—সত্যিই কি কাজের খোঁজে এসেছেন আপনি?

—হ্যাঁ। নইলে এতদূরে আসব কেন?

—সত্যিই কি রণথম্ভোর অবরোধে যাবেন বাদশাহের সঙ্গে?

—রণথম্ভোর! দুর্গ রণথম্ভোর?

—হ্যাঁ।

—বাদশাহ্ অবরোধ করবেন?

—হ্যাঁ। তাই তো লোক নিচ্ছেন তিনি।

—কিন্তু এ খবর আপনি পেলেন কি করে? আর কেউ তো জানে না।

—আমি অনেক খবরই জানতে পারি যা অধিকাংশ আমীর-ওমরাহও জানতে পারেন না।

জিৎ সিং আপন মনে বলে,—রণথম্ভোরও দখল করবেন?

—শুনে দুঃখ পেলেন?

সঙ্গে সঙ্গে জিৎ সিং বুঝতে পারে, নিজের মনোভাবকে বড় বেশি ব্যক্ত করে ফেলেছে সে।

সে হেসে ওঠে।

হাসলেন যে?

—দুঃখ পেলাম কি না জানতে চাইলেন বলে।

—দুঃখ পাননি?

জিৎ সিং বলে,—একটুও না। কাজের খোঁজে এসেছি। যা পাবো, তাই করব।

—আপনি না রাজপুত? রাজপুত হয়ে রাজপুতের বিপক্ষে লড়বেন?

—পৃথ্বীরাজ রাঠোরও রাজপুত।

—আমি জানতাম, আপনি এই উত্তরই দেবেন। কিন্তু তিনি বলতে গেলে শুধু একটি মরুভূমির রাজা। সেই মরুভূমির কোনো লোকবল নেই, কোনো অর্থবল নেই।

—মেবারেরও নেই এখন।

—পরে হবে। হবেই। তাছাড়া সেখানে রয়েছেন রানার পুত্র প্ৰতাপসিংহ।

জিৎ সিং বলে,—তিনি রানার অনেক পুত্রের মধ্যে একজন মাত্ৰ।

—তবু তিনি রয়েছেন। তাঁর ওপর অনেকেই ভরসা রাখেন মনে মনে।

—আমি রাখি না। আমি জানি, তিনিও একদিন আপনার স্বামীর মতো আগ্রার দরবারে সেনাপতি হয়ে শোভা পাবেন।

রমণী এবার অনেকক্ষণ চুপ ক’রে থাকে। যখন কথা বলে, তখন তার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ। কোনোমতে সে বলে,—তবু আপনি রাজপুত। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ তো দিতে পারেন?

—আপনি কাঁদছেন?

—মাঝে মাঝে কান্না পেয়ে যায়। কি করব?

জিৎ সিং ভারি কণ্ঠে বলে—এখানে আসবার আগে আমি অনেক ভেবেছি। তারপর আসবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

—আপনাকে দেখে বোঝা যায় আপনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। তবে বয়সে একেবারে তরুণ বলে হয়তো ততটা অভিজ্ঞতা নেই। আপনি ফিরে যান। আমার অনুরোধ, আপনি ফিরে যান। মেবারের হয়ে যুদ্ধ করুন। আমি জানি মেবার আবার উঠবে। আমি জানি। কারণ আমি মেবারের মেয়ে।

চমকে ওঠে জিৎ সিং। মেবারের কত মেয়েই রয়েছে। সবার খবর তো সে রাখে না। কিন্তু আজ আগ্রার এই নির্জন পথে অন্ধকার শকটের মধ্যে একজন মেবারের মেয়ের পরিচয় পেয়ে বড়ই আপন বলে মনে হয় তার।

সে বলে,—আপনার কথা আমি ভেবে দেখব। এইটুকু অন্তত বলে রাখি আপনাকে, মেবারের বিরুদ্ধে কোনোদিনই অস্ত্র ধরব না। এর বেশি কিছু আপাতত বলতে পারছি না বলে আমিও কম দুঃখিত নই।

শকট চলতে থাকে।

সেই অবস্থায় রমণী জিৎ সিং-এর একটি হাত ধরে। শিহরিত হয় জিৎ সিং।

রমণী বলে,—ভয় পাবেন না। একটা সম্বন্ধ পাতাবো আপনার সঙ্গে। কত বয়স আপনার?

—কুড়ি।

—এত কম? আমার বয়স তেইশ। অনেক বড় আপনার চেয়ে। দেখি, হাত দেখি।

রমণী একটি রাখী পরিয়ে দেয় জিৎ-এর হাতে। বলে,–এ জিনিসকে সব সময়ই কাছে রাখি আমরা। পথ চলতে কখন ভাই-এর সাক্ষাৎ পাবো বলা যায় না। এই আজ যেমন হল। তুমি আমার ভাই। নামটি কি যেন?

মন্ত্রমুগ্ধের মতো জিৎ সিং বলে,—জিৎ সিং।

—সুন্দর নামটি তোমার।

—তবে আমিও বলে রাখি বোন। আমি নিজে থেকে না বললে, আমার কোনো কাজ সম্বন্ধে কিছু জানতে চেয়ো না। শুধু এইটুকু জেনে রেখো, বেঁচে থাকতে রাজপুতদের কোনো অনিষ্ট করব না।

—এইটুকুই যথেষ্ট।

—এখন চলি তবে?

—কোথায় থাকো?

—সরাইখানায়।

—বরাবর?

—হ্যাঁ।

—বরাবর কখনো থাকা যায় সেখানে?

—উপায় নেই বোন

—আমার ওখানে মাঝে মাঝে যেও। দেশের খাবার খাওয়াবো। কী খেতে ভালোবাসো?

—বোনের হাতের সব খাবারই মিষ্টি।

রমণী হেসে ফেলে।

—আমি চলি বোন

—যেও কিন্তু।

শকট থেকে নেমে পড়ে জিৎ সিং। বোনের স্নেহ কী জিনিস জীবনে কখনো আস্বাদনের সুযোগ ঘটেনি তার। তাই আনন্দে নাচতে থাকে তার মন। তবু সেই আনন্দের মধ্যেও চিন্তিত হয়ে পড়ে সে। সে জানে, তার উদ্দেশের কথা পৃথ্বীরাজ জানলেও কখনই বলবেন না বাদশাহকে। কিন্তু মনে মনে নিজেকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে ক্ষতবিক্ষত হবেন। তাই তাঁকে কিংবা তাঁর স্ত্রীকে কোনোদিনই সে বলবে না মেবার ছেড়ে কেন আগ্রায় এসে উপস্থিত হয়েছে সে।

কিন্তু রণথম্ভোর অবরোধের কথা কি ভাবে জানল পৃথ্বীরাজ রাঠোরের স্ত্রী। যতই ভাবে ততই অবাক হয় জিৎ সিং। এত লোক থাকতে পৃথ্বীরাজকেই কি শুধু বাদশাহ্ একথা জানিয়েছেন? হয়তো হবে। যদি তাই হয়, তাহলে এমন আরও অভিযানের কথা সে আগে জেনে নিতে পারবে।

জিৎ সিং-এর হৃদয় বহুদিন পরে পরম তৃপ্তিতে ভরে যায়। এই তৃপ্তির সঙ্গে তার ছেলেবেলার পরিতৃপ্তির মিল নেই। এই তৃপ্তির সঙ্গে তার লীলাবতীর প্রথম দিনের পরিচয়ের সঙ্গেও মিল নেই। এ সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের জিনিস। ভিন্ন আস্বাদ.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *