আগ্রা – ১৩

১৩.

আকবর-পুত্র সেলিমের আদরের নাম শেখবাবা। ওই নাম এখন সব সময় বাদশাহের মুখে। এমন কি দরবারে মধ্যেও সুযোগ পেলেই শেখুবাবার কথা শুনিয়ে দেন আমীর ওমরাহদের। তার বিস্ময়কর কীর্তি-কলাপের কথা বলে তোষামুদে লোকদের মুখের হাঁ অনেক বড় করে দেন। সেই শেখুবাবা নাকি একদিন স্বপ্নের মধ্যে কেঁদে উঠে একটা দারুণ কথা বলে ফেলেছে। কথাটা হল—সিক্রি। যে শিশুর কথা বলতে অনেক দেরি, তার মুখে এই অদ্ভুত কথা। সালিমা বেগম স্পষ্ট শুনেছেন। কারণ তাঁরই কোলের ওপর ঘুমিয়ে ছিল শেখ। কথাটা শেখুর মুখ থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে একজন দাসীর কাছে শিশুকে দিয়ে তখনি তিনি ছুটে গিয়ে ছিলেন বাদশাহের কাছে। স্বপ্নের কথা বলে মন্তব্য প্রকাশ করলেন,—সিক্রিতে খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে। সেখানে না গেলে এ শিশু বাঁচবে না।

সালিমা বেগমের কথা আর কোর-আন শরিফের মধ্যে কোনো প্রভেদ দেখেন না আকবর। বৈরাম খাঁয়ের মৃত্যুর পর থেকে কোনো দিনই দেখেন কি। তাই তখনি শুরু হয়ে যায় রাজধানী স্থানান্তরের আয়োজন। আমীর ওমরাহেরা বুঝেছিল বাধা দিয়ে লাভ নেই। চিন্তা শুধু জলের জন্যে। সিক্রিতে নিদারুণ জলাভাব।

বাদশাহ্ বুঝেছিলেন তাদের মনের কথা। তাই জলের চাহিদা মেটাবার জন্যে সব রকম ব্যবস্থা ক’রে ফেলে একদিন দরবারে ঘোষণা করলেন, কাল থেকে স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে।

জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়। সে মনে মনে সালিমা বেগমকে ধন্যবাদ দেয়। সব চেয়ে বেশি ধন্যবাদ দেয় শেখুবাবাকে। তার গলায় যদি দুধ খাবার পর অবশিষ্ট একটুখানি আটকে না থাকত তাহলে ‘সিক্রি’ জাতীয় কোনো শব্দ বের হওয়া সম্ভব ছিল না। জন্ম জন্ম ধরে এভাবে যেন একটু একটু দুধ আটকে থাকে শেখবাবার। এরপর যেন মেবার অভিযানের ঠিক আগে আকবরের সামনে ঘুমের মধ্যে ‘যেও না’ গোছের কিছু বলে বসে তাহলে মেবার অভিযান কিছুকালের জন্যে অন্তত স্থগিত রাখা হবে।

ঢোলপুর থেকে ফিরে আসবার পর বীরবল-কন্যার সঙ্গে দেখা হয়নি জিৎ সিং-এর! তার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেখানে রয়েছে তফিলউদ্দিনের বন্ধুটি। সে তার পরিচয় জানে।

পৃথ্বীরাজের বাড়িতে বসে অপেক্ষা করেছে জিৎ প্রিয়ার জন্যে। একবার দেখা হলে ভালো হত। কিন্তু আসেনি প্রিয়া। কেন আসেনি, বুঝতে পারে না সে। হয়তো রাগ হয়েছে তাকে না বলে অদৃশ্য হবার জন্যে। কিংবা হয়তো রাম সিং-এর বন্ধুর কাছ থেকে জেনে ফেলেছে যে তফিলউদ্দিনকে সে-ই নিহত করেছে। রহিমবক্সের ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যাবার কাহিনী বন্ধুটি নিশ্চয়ই শুনেছে। তারপর অনুমান ক’রে নিতে কষ্ট হয়নি ঢোলপুরে তফিলউদ্দিনের মৃত্যুর মূলে কে রয়েছে। তাছাড়া যে লোকটির পোশাক সে কেড়ে নিয়েছিল সে জীবিত রয়েছে। সে কি আর বলতে বাকি রেখেছে ঢোলপুরে কেন ব্যর্থ হল তারা? জিৎ সিং-এর বর্ণনা কি সে আর দেয়নি? তার তলোয়ারের বর্ণনা? এদিকে রহিমবক্স তো সবই জানে। তবে সে একথা কখনো প্রকাশ করবে বলে বিশ্বাস হয় না। রহিমবক্স যত খারাপই হোক, সে খাঁটি।

জিৎ ভাবে সিক্রিতে রাজধানী উঠে যাবার হিড়িকে তার লাভ হল। নইলে অনেক দিক দিয়েই পদে পদে অসুবিধার সৃষ্টি হত। এখানে অনেক লোক তাকে জেনে ফেলেছে। সিক্রি নতুন জায়গা। পুরোনো পরিচিত লোকের অনেকেই সেখানে যাবে। রহিমবক্স যাবে। কিন্তু মাংসের দোকান তুলে দিয়ে তাহের হয়তো যেতে চাইবে না। আর সিক্রির প্রাসাদের এলাকায় যখন প্রিয়ার বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে, তখন রাম সিং-এর বন্ধুকে প্রহরী রাখবার প্রয়োজন হবে না।

সিক্রিতে থাকবেও সে নিশ্চিন্তে নিজের সরাইখানায়। প্রিয়ার মুখে প্রথম যেদিন শুনল সে যে সেখানে রাজধানী স্থানান্তরিত হচ্ছে, সেদিন কিছুক্ষণ বাদেই সে উধমকে বলেছিল এই কথাটা সঙ্গে সঙ্গে উধম সরাইখানা খুলতে বলেছিল সেখানে। দূরদৃষ্টি আছে তার বলতে হবে। নইলে লোক পাঠিয়ে তখুনি পাকাপাকি ব্যবস্থা করে রাখত না। এমন কি মাধবকেও সে দলে টেনে রেখেছে। মাধবই হবে সিক্রির সরাইখানার ভৃত্যদের মধ্যে প্রধান। অথচ এত সব কাণ্ড উধম নিজে নিজে করেছে। একথা জিৎকে বলেনি আগে। বলেছে ঢোলপুর থেকে ফিরে আসবার পরে। শুনে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে জিৎ সিং।

শেষে একদিন সালিমা বেগম একা রওনা হয়ে গেলেন নতুন রাজধানীতে। আমীর ওমরাহদের দো-মনা ভাবকে কাটিয়ে তুলতে তিনিই পথ দেখালেন প্রথম। তিনি একা গেলেন তাঁর নিজের লোকজন নিয়ে।

শেখবাবা আর তার নিজের মাকে সঙ্গে নেবার জন্যে বাদশাহ্ অনুরোধ করেছিলেন সালিমা বেগমকে। তিনি তা শোনেননি। বলেছিলেন,—ওরা যাবে স্বয়ং বাদশাহের সঙ্গে। সেই অধিকার ওদেরই সব চাইতে বেশি।

বাদশাকে বিমর্ষ মুখে দরবারে আসতে দেখে রাজা মান সিংহ বললেন,-আমি কাল সকালে যাচ্ছি।

—আপনি যাবেন কাল?

—হ্যাঁ জাহাঁপনা।

—শুনে আনন্দ হল।

.

মানসিংহের চলে যাবার খবর শুনে জিৎ সিং পৃথ্বীরাজের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা ক’রে বলে,– তুমি কবে যাচ্ছ বোন?

—কর্তা যেদিন নিয়ে যাবেন।

—কর্তা কবে যাচ্ছেন?

—বলা মুশকিল। ওখানে ঘরবাড়ি এখনো সব তৈরি হয়নি। কোথায় গিয়ে উঠব তাই ভাবছি।

—কোনো অসুবিধা নেই। জায়গা না পেলে আমাদের সরাইখানায় উঠো।

—তোমাদের সরাইখানা?

—হ্যাঁ। আমাকে দেখে যতটা বোকা ভাব, অতটা বোকা আমি নই। আগে থাকতেই সরাইখানার ব্যবস্থা ক’রে বসে আছি। তবে তোমরা দুজনা শুধু থাকতে পারবে। তোমাদের জিনিসপত্র গাড়ি ঘোড়ার ব্যবস্থা নিজেদের।

রানি হেসে বলে,–তোমাদের সরাইখানায় বারোভূতের মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। আমার স্বামী রাজা, কত বড় লোক। আমি তার রানী হয়ে শেষে সম্মান বিসর্জন দেব ভাবছ? বোনের মর্যাদা শেষে এইভাবে পথের ধুলোয় লুটিয়ে দিতে চাইছ ভাই?

—আমরা যে অযোগ্য ভাই। আমরা সব পারি।

—বেশ। তবে বীরবল-কন্যাকে সেখানে নিয়ে যাও।

—সেকি? তার জন্যে যে বাদশাহ্ বাদশাহী মহলে আলাদা বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন। তুমি জান না?

রানী গম্ভীর হয়ে বলে,—জানি। বীরবল যেন বড় বেশি সুবিধা নিচ্ছেন। এর পরিণামে কি আছে কে বলতে পারে?

জিৎ চুপ করে থাকে। সে অনুভব করে রানীর মনের বেদনা। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে সে বলে,—তাঁর কন্যা সংবাদ কি? এ বাড়িতে দেখছি পদধূলি পড়ে না আর তার! ব্যাপার কি?

—নিশ্চয়ই তুমি কিছু বলেছ তাকে।

—আমি? আমি কি বলব তাকে?

—তবে হয়তো অসুখ-বিসুখ করেছে।

—তুমি গিয়ে খবর নিলেই তো জানা যায়।

—এখন তো আর যাওয়া সম্ভব হবে না। সিক্রিতে গিয়ে দেখা যাবে।

—তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ বোন।

—মন খারাপ হল?

—না। আচ্ছা চলি। সরাইখানার জন্যে জিনিসপত্র কেনাকাটা আছে। কাল সকালে পাঠাতে হবে। পরশু থেকে কাজ শুরু হবে।

জিৎ সিং ঘরের বাইরে পা বাড়াতেই রানী ডাকে,–শোনো।

রানীর কণ্ঠস্বর এবারে সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাতে এমন কিছু ছিল, যা আগে কখনো শোনেনি সে। অবাক্ হয়ে যায় জিৎ।

—জিৎ সিং!

—বল।

—লীলাবতী নামে মেয়েটি কে?

কোনো কথা বলতে পারে না জিৎ। নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে সে। চোখের পলক অবধি পড়ে না। ভেবে উঠতে পারে না, ওই নাম এ জানল কোথা থেকে। উধম শেষে এতটা সস্তা হয়ে গেল? বিশ্বাস হয় না। তার মতো লোক লীলাবতীর কথা বলতে পারে না রানীকে।

—জবাব দাও জিৎ?

—তুমি কার কথা বলছ?

—ছিঃ জিৎ। নিজের বোনকে কোনো কথাই লুকোতে নেই। আমি তোমার কাছে কোনো কথা লুকিয়ে রাখব না। তাছাড়া, আমি সব শুনেছি। আমি একথাও জানি যে উধম সব জানে। তবু সে একটি কথাও আমায় বলেনি। আমি শুনেছি, বীরবলের বাড়িতেই। তাঁর মেয়ের মুখে। ঢোলপুরের ঘটনার কথা দরবারের সবাই জানে জিৎ। কিভাবে তুমি তফিলউদ্দিনকে নিহত করেছ, তাও সবাই অনুমান করেছে।

জিৎ সিং রীতিমতো বিচলিত হয়। সব কিছু জেনে নেবার জন্যে সে প্রশ্ন করে,—কিন্তু আমি এসব করেছি কে বলল? অন্য কেউ করতে পারে।

—না। তুমি ছাড়া অন্য কেউ নয়। তোমার তলোয়ারই তার সাক্ষী। অত বড় তলোয়ার আর কারও নেই। তফিলউদ্দিনের দলের কে যেন দেখেছে তোমাকে।

জিৎ সিং বুঝতে পারে কে দেখেছে। ঠিকই সন্দেহ করেছিল সে। সেই মোটা লোকটি। তার পোশাক এখনো বোধহয় ঢোলপুরের চোরা কুঠরীর ভেতরে পড়ে রয়েছে। আপশোস হয় জিৎ সিং-এর। তাকে হত্যা করাই উচিত ছিল।

রানী বলে,—তাছাড়া তুমি ফিরে আসবার পর আমি গোপনে তোমার ওপর লক্ষ্য রেখেছি। আমাকেও তুমি যতটা বোকা ভাব, অতটা আমি নই। আমিও মেবারের মেয়ে। তুমি যে সরাইখানা ছেড়ে এসে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছ, এ খবর জানতে আমার সাতদিনের বেশি দেরি হয়নি। তোমার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছি বলেই আমি বলে দিতে পারি, তোমার শরীরে দুটি আহত স্থান আছে। একটি হল বাহুতে, আর একটি—

উত্তেজিত জিৎ সিং একটু রূঢ়স্বরে বলে,–বেশ বেশ। এখন একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমার নিশ্চিন্ত কর। ঢোলপুরের ঘটনার কথা কি বাদশাহ্ও শুনেছেন?

—হ্যাঁ।

—কি বললে? তিনি জানেন সব?

—জানেন। তোমার কথাও জানেন।

—কী বলছেন তিনি?

—ভয় নেই জিৎ, তিনি তোমায় সমর্থন করেছেন। একজন রাজপুত রমণীর অমর্যাদা হতে দেখতে আর একজন রাজপুত তাকে রক্ষা করবে, এ খুবই স্বাভাবিক। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, তুমি ঠিক কাজ করেছ। তাছাড়া দুশোজন মানুষের বিরুদ্ধে একা গিয়ে তুমি এত সব কাজ করেছ। তিনি বলেছেন, তোমার হিম্মত আছে। তিনি নাকি তোমার কথা মনে রাখবেন। সিক্রিতে গিয়ে দরবারে একদিন ডেকে পাঠাবেন তোমায়।

জিৎ সিং রানীর মতো আনন্দিত হয়ে উঠতে পারে না। বাদশাহের আসল মতলব বুঝতে পারা খুবই কঠিন। তবু কিছুদিনের জন্যে অন্তত নিশ্চিন্ত হয় সে।

সে আবার চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়। রানী তার হাত চেপে ধরে বলে,—উঁহু এখনো আমার কথার জবাব দাওনি।

—কোন্ কথা?

—লীলাবতী মেয়েটি কে?

জিৎ সিং একটু ভেবে নিয়ে বলে,—সত্যিই যদি লীলাবতীর কথা শুনতে চাও, আমি সিক্রিতে গিয়ে বলব। সব কথা তোমায় বলব। এখন আমায় যেতে দাও।

—বেশ। তখনি শুনব। কিন্তু একটা কথা বলে যেতে হবে। আগ্রার কেউ জানবে না। বাদশাহও না। শুধু আমায় বলে যাও। ঢোলপুরে গিয়ে লীলাবতীকে রক্ষা করতে পেরেছ কি?

—কখনো প্রকাশ করবে না?

—না।

জিৎ সিং কিছুক্ষণ রানীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর ঢোক গিলে বলে,–পেরেছি। রানীর মুখ আনন্দে উৎসাহে রাঙা হয়ে ওঠে। সে জিৎ-এর হাত সজোরে চেপে ধরে বলে, –তোমার মতো ভাই-এর জন্যে আমি গর্বিত। আমি মরে গেলেও এ গর্ব আমার সঙ্গে স্বর্গে ধাওয়া করবে।

—হুঁ, এবারে হাত ছাড়ো তো বোন। অনেক কাজ আছে।

—হ্যাঁ ছাড়ছি। তবে তুমি যেকথা জানতে চেয়েছিলে, তা জেনে যাও। বীরবল কন্যা অত্যন্ত ক্ষেপে রয়েছে। সে বলেছে, এতদিন তুমি তার সঙ্গে খেলা করেছ। আসলে লীলাবতীই তোমার

সব।

—তুমি কি বলনি, যে সে জয়পাল সিং-এর বিধবা স্ত্রী?

—বলেছি। সে-ও জানে সেকথা। তবু মত বদলায়নি। সত্যি কথা বলতে আমি হলেও বদলাতাম না। আগ্রা থেকে অত দূরে একা দু’শো অশ্বারোহীর পেছু ধাওয়া করলে তুমি। নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান ক’রে, তাদের কয়েকজনকে নিহতও করলে। এতে ওই একটি কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাগ করো না জিৎ। বীরবল-কন্যা আমারই মতো একজন নারী।

—ভবিষ্যতে যদি তার মত বদলাবার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হব কি?

—খুব সম্ভব ব্যর্থ হবে। তবে তুমি পুরুষ। পুরুষের আপন চেষ্টায় অসাধ্যসাধন করে। নারীর মতবাদ তো তুচ্ছ জিনিস।

জিৎ সিং মৃদু হেসে বলে,—আশা রইল তবে।

রানীও হাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *