আগ্রা – ১২

১২.

পথে অসংখ্য মানুষকে নানাভাবে প্রশ্ন ক’রে শেষে জিৎ সিং এসে উপস্থিত হয় ঢোলপুরে তার গন্তব্যস্থলে। বুঝতে পারে সে, ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। জয়পাল সিং-এর বাসগৃহ সুরক্ষিত বলে প্রসিদ্ধি রয়েছে। কিন্তু দু’শো অশ্বরোহীর সঙ্গে লড়বার মতো শক্তি তার রয়েছে কি না জানো নেই। যদি থাকত তাহলে তফিলউদ্দিন আরো বেশি লোক সঙ্গে নিয়ে আসত। তফিলউদ্দিন একবারে মূর্খ নয়। সে দরবারে গিয়ে জয়পাল সিং সম্বন্ধে ভালোভাবে খোঁজ নিয়েই এসেছে। দরবারে বাদশাহী এলাকার সমস্ত গণ্যমান্য লোকেদের নাড়ির খবর জেনে নেওয়া সম্ভব

দূর থেকে জয়পালের বাসগৃহের চেহারা দেখেই জিৎ সিং-এর মনের ভেতরটা কেমন ক’রে ওঠে। মাঝে একটি রাত অতিবাহিত হয়েছে। আর একটি রাতও আগতপ্রায়। কারণ সূর্যের লাল রশ্মি আর বেশিক্ষণ ওই বাড়িটির মাথাকে স্পর্শ করে থাকবে না। একটু পরেই ওই লাল রঙ সরে যাবে বাড়ির চেয়েও উঁচু কোন কিছুকে পেলে তাকে স্পর্শ করতে।

জিৎ সিং দেখে, বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে শিবির পড়েছে। বুঝতে দেরি হয় না, ওই শিবিরই তফিলউদ্দিনের শিবির। ওখানে যাওয়া এখন কোনোমতেই সম্ভব নয়। একবার গেলে, আর কখনো ফিরে আসতে হবে না। আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। অন্ধকার গাঢ় হবার আগে পর্যন্ত তাকে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে হবে। যদিও এইভাবে এখানে বসে থাকা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। কারণ প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান এখন। লীলাবতীর জীবন কিংবা তার সম্মান এই মুহূর্তটুকুর ওপর হয়ত নির্ভর করছে।

কিংবা সবই হয়তো শেষ হয়ে গেছে। লীলাবতীর কথা এখন বোধহয় তফিলউদ্দিনের দলের কাছে পুরনো গল্প। তারা আরও তাজা খবর আলোচনায় ব্যস্ত।

অন্ধকার একটু বেশি হতেই জিৎ সিং আড়ালে শিবিরের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়। ঘোড়াটিকে সে একটি ঝোপের মধ্যে বেঁধে রেখে আসে। তারপর আরও কাছে আসে শিবিরের। ওদের কথার টুকরো হয়তো কানে আসতে পারে।

কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর সে লক্ষ্য করে একটি শিবির থেকে একজন মাত্র লোক বের হয়ে আসে। দু’শো লোকের ঘোড়াকে যেখানে রাখা হয়েছে লোকটি সেদিকে চলে যায়। জিৎ বুঝতে পারে ঘোড়াগুলোকে পরিচর্যা আর পাহারা দেবার জন্যে প্রথম প্রহরের প্রহরী নিযুক্ত হল। সে ধীরে ধীরে সেইদিকে এগিয়ে যায়।

এভাবে এগিয়ে যাওয়ায় অনেক বিপদের সম্ভাবনা। কারণ সে জানে না কতগুলি লোক এখন রয়েছে ঘোড়ার দলের কাছে। তাছাড়া লোকটি তাকে দেখে চিৎকার করে উঠলে মুহূর্তের মধ্যে অনেকে এসে জড়ো হবে। তবু ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। লীলাবতীর জন্যে সব ঝুঁকি নিতে সে প্রস্তুত। যে লীলাবতী গুপ্তচর বলে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তার পক্ষে তফিলউদ্দিনের হাতে সম্মান দেওয়ার চেয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়া অনেক সহজ। সে নিজেও হয়তো সুযোগ পেলে তাই করবে। তার ছুরিকা সবসময় কাছেই থাকে। কিন্তু সে যদি আত্মহত্যা করতে না পারে, আর তাকে যদি উদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তাহলে, অন্তত তাকে হত্যা করবে জিৎ।

জিৎ সিং সহসা দেখে লোকটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। অন্ধের মতো এগিয়ে আসছে। কারণ সে কল্পনাও করতে পারেনি একজন শত্রু তাদের ঘোড়াগুলোর মধ্যে এসে সুযোগ খুঁজছে।

লোকটি কাছে এলেই জিৎ সিং লাফিয়ে পড়ে তার ওপর। লোকটি খুবই স্থূল। অশ্বারোহীর পক্ষে এতটা স্থূল হওয়া বেমানান। যদিও স্থূল থাকে কেউ কেউ, তাদের শরীর থাকে মজবুত কিন্তু লোকটির দেহে থলথলে মেদ। জিৎ সিং সামান্য আয়াসেই তাকে মাটির ওপর ফেলে দিয়ে তার অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। তারপর বুকের ওপর পা রেখে বলে,—চিৎকার করো না। বাঁচতে চাও?

হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটি বলে,—হ্যাঁ চাই, আমি বাঁচতে চাই।

—তাহলে গুটিকতক প্রশ্ন করি, সত্যি উত্তর দাও। জয়পাল সিং বাধা দিয়েছিল।

—হ্যাঁ। কিন্তু মাত্র ত্রিশজন ছিল ওদের।

—কোথায় গেল তারা?

—অনেকে মরেছে।

—জয়পালের কি হয়েছে।

—মৃত্যু।

—তার স্ত্রী? লীলাবতী?

—তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

জিৎ সিং তার বুকের ওপর পা ঠুকে বলে,—সত্যি কথা বল।

—আমি সত্যি কথাই বলছি। আমি মিথ্যে কথা বলব না। আমি বাঁচতে চাই। আমার অনেক কটি ছেলেমেয়ে?

—কোথায় গেল লীলাবতী?

—কেউ বলতে পারছে না। হয়তো আমাদের আসবার খবর পেয়ে জয়পাল সিং আগে থাকতেই তাকে সরিয়ে ফেলেছে। কিংবা লুকিয়ে রয়েছে কোথায়ও। তবে তাঁর বাড়ি ভালোভাবে খুঁজেও পাওয়া যায়নি তাকে।

—তফিলউদ্দিন কি করবে এর পরে?

—অপেক্ষা করবে আরও দু-চারদিন। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি বাড়িটির প্রতিটি ঘর বার বার তন্ন তন্ন করে খুঁজবে। আশেপাশের গ্রামেও লোক পাঠাবে। তবুও যদি তাকে না পাওয়া যায়, অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে মজনুন খাঁয়ের সামনে।

জিৎ সিং কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করে। তারপর বলে,—তুমি ওঠ।

—আমায় মেরে ফেলবে না তো?

—না। কথা যখন দিয়েছি, মারব না। তবে মেরে ফেলাই উচিত। কারণ বিপদ যদি আমার কিছু ঘটে, তোমার জন্যেই ঘটবে।

লোকটি উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারের মধ্যেও তার চোখদুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে উঠেছে। অমন চোখ দেখলে করুণার উদ্রেক হয়। কিন্তু জিৎ সিং-এর অত কিছু দেখার সময় ছিল না। লীলাবতীকে পাওয়া যায়নি শুনে সে কিছুটা নিশ্চিত হয়েছে, তবু সবটা নয়। কারণ আত্মহত্যার পথ সর্বক্ষণ‍ই উন্মুক্ত তার। জয়পাল সিং-এর মৃত্যুর খবর শুনে কিংবা স্বচক্ষে দেখে সে হয়তো আত্মঘাতী হয়েছে কোনো গোপন স্থানে। তেমন হলে, তবু ভালো! সম্মান বিকিয়ে দিতে হয়নি তাকে। লোকটির দিকে তীব্রদৃষ্টিতে চেয়ে কড়াভাবে সে বলে,—যা বলি ঠিকমতো ক’রে যাও। তোমার পোশাক খুলে ফেল।

—পোশাক? কিন্তু?

—কোনো প্রতিবাদ নয়। খুলে ফেল।

লোকটি জিৎ সিং-এর আদেশ অনুযায়ী সমস্ত পোশাক, খুলে ফেলে কাঁপা হাতে। জিৎ সিং একটি ঘোড়ার দড়ি দিয়ে স্থূল লোকটিকে বেঁধে ফেলে। নিজের পোশাকের ওপর লোকটির পোশাক পরে নেয়। ঘামে সপসপ করছিল পোশাক। ভ্রূক্ষেপ করে না জিৎ। সে বলে, বাড়িটির কোনো পাহারা রয়েছে? সত্যি বল? নইলে ফিরে এসে তোমায় মেরে রেখে যাব।

—রয়েছে। একজন। সারা রাতে বদিল হবে চারবার।

জিৎ সিং লোকটির মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। তারপর তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটি ঢালু জায়গায় গড়িয়ে দেয়। প্রাণে মরবে না লোকটি। তবে দিনের আলো ভালোভাবে ফুটি ওঠার আগে ওকে কেউ খুঁজে পাবে না। এই দীর্ঘ সময় কষ্ট সহ্য করতে হবে।

এবারে নিশ্চিন্ত হয়ে সে বাড়িটির দিকে অগ্রসর হয়। তাকে আর কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। সে এখন তফিলউদ্দিনের দলের লোক।

বাড়ির সামনে যেতেই প্রহরী এগিয়ে আসে। অন্ধকারের মধ্যে জিৎ সিংকে বলে,–তোমায় আবার পাঠালো কেন?

—দুজনের প্রয়োজন।

লোকটি বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে,–একেই বলে একরাতের নবাবী। একসঙ্গে দু’শো লোক পেয়েই তফিলউদ্দিন মিয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কি করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। কালাঞ্জরে মজনুন খাঁকে তো দেখেছি। অত বড় দল, অথচ একেবারে ঠাণ্ডা। ঠিক যেন হিমালয়ের চুড়ো।

—খাঁটি কথা বলেছে। মজনুন খাঁয়ের সঙ্গে তফিলউদ্দিনের তুলনা? ছোঃ।

—তুমিও দেখছি আমারই মতো। কিন্তু কে তুমি? চেনা বলে মনে হচ্ছে না তো?

—তুমিও তো আমার অচেনা। দুশো জনের সবাইকে চিনি না।

—আমি অনেককেই চিনি। তোমার নাম কি?

—এইভাবে তুমি আজেবাজে কথা শুরু করলে। পাহারায় এসে ঘরের কথা বলতে আরম্ভ করলে অন্যমনস্ক হবো আমরা। ওসব ছাড়ো। আমি বাড়িটার ওইদিকে থাকব।

—ঠিক আছে।

—আচ্ছা একটা কথা শুধু জিজ্ঞাসা ক’রে যাই। জয়পাল সিং-এর দলের কতজন মরেছে বলে তোমার ধারণা?

—সেকি? যখন গোনা হয়, তুমি ছিলে না?

—না। আমার ঘোড়ার পায়ে চোট্‌ লেগেছিল। তাই ওপাশে ছিলাম। এমন কি মৃতদেহগুলো কোথায় রয়েছে তাও জানি না।

—কী বললে?

—শুনলেই তো, কি বললাম। মড়াগুলো কোথায় ফেলেছে তুমি জান?

লোকটি আঙুল তুলে একটি জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বলে,—এবারে কাছে এসো তো দেখি। দুশো জনেরই মুখ আমার মোটামুটি জানা। কাছে এসো। দেখি।

—দেখবে? সত্যি দেখবে?

—হ্যাঁ।

—আমার মুখ দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু।

—বাজে কথা বলো না। কাছে এসো। আমাকে এমনিতে পাহারায় রাখা হয়নি। সামান্য সন্দেহ হলেই আমি যাচাই ক’রে নেব।

কিন্তু যাচাই তাকে আর করতে হয় না। তার আগেই পলকের মধ্যে জিৎ সিং তার অসি বের করে। তার অসির অগ্রভাগ গিয়ে বেঁধে লোকটির বুকের বাঁ-পাশে। সে পড়ে যায়। জিৎ সিং তাকে নিয়ে গিয়ে অন্যান্য মৃতদেহের পাশে ফেলে রেখে আসে। হত্যা না ক’রে উপায় ছিল না। লীলাবতীর নিরাপত্তার জন্যে সে যেন কোনো লোককে হত্যা করতে পারে। লীলাবতীর রহস্য তাকে ভেদ করতে হবে। তাকে জানতে হবে কোথায় রয়েছে লীলা। না জেনে সে ফিরে যেতে পারবে না।

বাড়িটির সামনে যায় জিৎ সিং। মুহূর্তের জন্যে ভেবে নিয়ে সে একা অন্ধকার ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে কিছুই দেখতে পায় না সে। তবু দেওয়াল হাতড়ে একটির পর একটি ঘর অতিক্রম করে।

সমস্ত বাড়িটি স্তব্ধ। শুধু তার পায়ের মৃদু শব্দ বাড়িটির স্তব্ধতা সামান্য ভঙ্গ করছে। কখনো কখনো হোঁচট খায় জিৎ। সেই হোঁচটের শব্দ বাড়িটিকে কম্পিত করে যেন। মাঝে মাঝে এক একটা বিদঘুটে আওয়াজ শুনতে পায় সে। আবার সব নীরব হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আবার মনে হয়, তার ঠিক পাশেই নিম্নস্বরে দু’জন মানুষ যেন কথা বলে চলেছে। সে তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনে। কিন্তু কিছুই আর কানে আসে না। আবার কখনো মনে হয়, কে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল তার পাশটিতে। চমকে উঠে তলোয়ার চেপে ধরে সে। কিন্তু কেউ নেই। বুঝতে পারে, পর পর কয়েক রাতের অনিদ্রা, দুর্ভাবনা আর পরিশ্রম তার মস্তিষ্ককে খুবই ক্লান্ত করে ফেলেছে। তাই এইসব কল্পিত শব্দ তার কানে আসছে। এই সব শব্দের জন্মস্থান তার পরিশ্রান্ত মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলিতে।

আরও কয়েকটি ঘর পার হয়ে জিৎ সিং একটি স্থানে এসে দাঁড়ায়। এভাবে অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে বেড়ালে কাজের কাজ কিছুই হবে না। দিনের আলোয় অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। কিংবা একটি বাতির প্রয়োজন। জিৎ সিং আবার প্রতিটি ঘরের আনাচেকানাচে আসবাবের আশেপাশে হাতড়াতে শুরু করে এই বাতির সন্ধানে। কারণ তফিলউদ্দিন যতদিন এখানে থাকবে, ততদিন দিনের আলোয় সে খুঁজতে সুযোগ পাবে না। যা-কিছু করার এই রাতেই করতে হবে তাকে। কিন্তু বাতি সে খুঁজে পায় না। হতাশ হয়ে পাথরের ঠাণ্ডা মেঝের ওপর বসে পড়ে সে। কী কর্তব্য এখন তার? সে কি আবার ফিরে যাবে? ফিরে তাকে যেতেই হবে, এই রাতের মধ্যেই। দিনের আলোয় এদের চোখে ধুলো দেওয়া যাবে না। ধরা পড়তে হবে। ধরা তাকে আগেও পড়তে হতে পারে। কারণ দুই-একটি স্থানের পাহারারত প্রহরীদের অনুপস্থিতি রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরেই আবিষ্কৃত হবে। তখনই খোঁজ খোঁজ রব পড়ে যাবে। সেই মোটা লোকটিকে খুঁজে পেলেই তো সব জেনে ফেলবে ওরা। তারপর কপালে কি লেখা রয়েছে কে জানে।

জিৎ সিং আবার উঠে দাঁড়ায়। দেওয়ালে হাত দিয়ে এগিয়ে যায়। খুঁজবে সে, অন্ধের মতোই খুঁজবে। রাতের সবে শুরু। শেষ হতে অনেক বাকি। এর মধ্যে আর একবার চেষ্টা করতে হবে। অন্ধকারে থাকতে থাকতে তার চোখ অনেকটা অভ্যস্ত হয়েছে। সে এখন অস্পষ্টভাবে একটু যেন দেখতে পাচ্ছে। এইভাবেই সে এক সময়ে ওপরে ওঠার রাস্তা খুঁজে পাবে নিশ্চয়ই। তার দৃঢ় ধারণা লীলাবতীকে না পেলেও তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো বাড়ির সুউচ্চ কোনো স্থান থিকে নিচে লাপিয়ে পড়েছে লীলা। তবে নিজের কাছে ছুরি থাকতে সেভাবে মৃত্যুবরণ নাও করতে পারে। বুকের মধ্যে ছুরিটা আমূল বিধিয়ে দিয়েছে বোধহয়। বিধিয়ে দেবার আগে কোনো গোপন জায়গায় গিয়ে লুকিয়েছিল হয়তো। তার ভয় হওয়া স্বাভাবিক যে তফিলউদ্দিন তার মৃতদেহ নিয়েও কুৎসিত দৃশ্যের অবতারণা করতে দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু আক্রমণকারীদের মধ্যে কি তফিলউদ্দিনকে চিনতে পারা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। প্রথমত, দু’শো লোকের মধ্যে চেনা লোককেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় বেশির ভাগ সময়। তার ওপর তফিলউদ্দিনের মুখ এখন দাড়ি-গোঁফের আড়ালে। সেই দাড়ি গোঁফের আড়াল থেকে আগেকার রাম সিংকে খুঁজে বের কার সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। যুদ্ধরত অবস্থায় দূর থেকে রাম সিংকে দেখে চিনে ফেলা লীলাবতীর পক্ষে অসম্ভব। লক্ষ্মণ তাকে চিনেছিল আগ্রার পথে, কারণ সে ছিল একেবারে সামনাসামনি।

এত যুক্তি খাড়া ক’রেও কিন্তু অন্তর থেকে কেন যেন দৃঢ় বিশ্বাস হয় জিৎ সিং-এর, তফিলউদ্দিনকে লীলাবতী চিনতে পেরেছিল। লীলাবতী অনেকদিন আগে একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিল তাকে, মেয়েরা যাকে ভালোবাসে আর সবচেয়ে যাকে ঘৃণা করে, গায়ের ঘ্রাণে তাদের চিনে ফেলতে পারে। আবার অনেক দূর থেকে দেখেও চিনে ফেলতে পারে। সময়ের যত ব্যবধানই হোক না কেন?

জিৎ সিং যখন এত কথা ভাবছিল, ঠিক সেই সময় অন্ধকারের ভেতর থেকে তার বাহুতে একটি তীক্ষ্ণ অস্ত্র এসে বেঁধে।

সেই সঙ্গে নারীকণ্ঠের অট্টহাসি।

আর্তনাদ করবার পর্যন্ত অবকাশ পায় না জিৎ। কারণ হাসির ধরনটি তার পরিচিত না হলেও, কণ্ঠস্বর অতি পরিচিত।

—লীলা!

—কে?

—আমি জিৎ।

—জিৎ! তুমি? তোমায় আমি মেরে ফেললাম?

—না। আমার গায়ে দুটো পোশাক। বেশিদূর প্রবেশ করেনি তোমার অস্ত্র। তাছাড়া আঘাত লেগেছে শুধু আমার বাহুতে, বুকে নয়।

—একলিঙ্গ বাঁচিয়েছেন। তোমার মৃত্যু হলে আমায় আত্মহত্যা করতে হত। কারণ এককালে তুমি আমায় ভালোবাসতে। কিন্তু জিৎ, এত নীচে নেমেছ? আমার পত্র পেয়ে ক্ষেপে গিয়ে রাম সিং-এর দলে যোগ দিয়েছ? আমার স্বামীকে তোমরা হত্যা করলে?

—আমি নই।

লীলাবতী পাগলের মতো হেসে উঠেবলে,—না, তুমি নয়। তোমার হয়তো সংকোচ হয়েছিল। তাই পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের লেলিয়ে দিয়েছিলে।

—লীলা!

—চলে যাও জিৎ।

—তুমি উত্তেজিত হয়েছ লীলা। তুমি ভুল বুঝছ। সব কথা তোমায় বলব। কিন্তু তার আগে তুমি চল, এখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাই।

—আমি যাবো না। তোমায় আমি বিশ্বাস করি না। শুনলাম রাম সিং-এর নাম হয়েছে তফিলউদ্দিন। তোমার নতুন নাম কি হয়েছে জিৎ?

—আমি জিৎ সিংই রয়েছি। আমি যে গুপ্তচর। মুঘলদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তিই আমার পেশা। আমি কি ধর্ম বদলাতে পারি। তবে কাজের সুবিধার জন্যে মাঝে মাঝে মুঘল সাজতে হয়। যেমন এখন সেজেছি।

—যাক্, তবু একটু সান্ত্বনা পেলাম।

—আমার ক্ষত দিয়ে রক্ত পড়ছে লীলা। যদিও খুব গভীর হয়েছে বলে মনে হয় না, তবু এখনি বেঁধে ফেলা দরকার। কোনো ব্যবস্থা আছে কি?

—আছে। তবে তোমায় সেখানে নিয়ে যেতে পারি না। তুমি তোমাদের শিবিরে চলে যাও। জিৎ সিং একটু হাসে। সেই হাসির মৃদু শব্দ লীলাবতীও শোনে।

জিৎ বলে,—আমার কোনো শিবির নেই, আমি একা এসেছি। এসেছি অনেক দেরিতে। ঠিক সময় পৌঁছোতে পারলে হয়তো জয়পাল সিং-এর মৃত্যু হত না।

অন্ধকারের মধ্যেও জিৎ সিং বুঝতে পারে লীলাবতী অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। জিৎ-এর মুখ যেমন সে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না, তার কথাও তেমনি বুঝতে পারছে না।

—লীলা, তুমি চুপ ক’রে আছো কেন? আমি জানি কতখানি আঘাত তুমি পেয়েছ। তবু সময় নষ্ট করার উপায় নেই। এখুনি এই গৃহ ছেড়ে চলে যেতে হবে। তোমার সম্মান আর জীবন রক্ষার সেটাই একমাত্র সুযোগ।

—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না জিৎ, তুমি কি বলতে চাইছ। তুমি ঠিক সময়ে আসতে পারলে আমার স্বামীর মৃত্যু হত না?

—না। রাম সিং-এর দলের আগমন বার্তাটুকু অন্তত তোমার স্বামীকে আগে থাকতে পৌঁছে দিতে পারতাম। তিনি প্রস্তুত হবার সময় পেতেন। তা না পারলে অন্তত তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতেন নিরাপদ কোনো স্থানে।

—তুমি রাম সিং-এর দলের নও?

—না লীলা। আমি কিভাবে রাম সিং-এর দলে হব। তুমি কি এখনো বুঝতে পারছ না, তফিলউদ্দিন এসেছে তোমায় জোর ক’রে ধরে নিয়ে যেতে। সে এসেছে তোমাকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে তোমার নারীত্বের অবমাননা করতে। সে এসেছে তোমার গর্ব, আর আত্মাভিমানকে পদাঘাতে চূর্ণ ক’রে তোমাকে এক মুঘল সেনাপতির কামনার বলি হিসাবে উৎসর্গ করতে। আমি কেমন ক’রে সেই দলের সঙ্গে আসব লীলা?

—তবে?

—আমি এসেছিলাম তোমাকে আর তোমার স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা করতে। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। তাই তোমার স্বামীর মৃত্যু আমি রোধ করতে পারলাম না। আসবার আগে রাম সিং আমার হাত আর পা বেঁধে এক জঘন্য দুষ্কৃতকারীর আওতায় ফেলে রেখে এসেছিল। বন্ধ ঘরের স্যাঁতসেঁতে কোণে মেঝের ওপর পড়ে পড়ে শুধু মাথা কুটছিলাম আমি। কোনো উপায়ই ছিল না। এমন কি হাত-পা খোলা থাকলেও ওখান থেকে পালানো সম্ভব হত না, কারণ বাইরে ছিল পাহারাদার। তবু একলিঙ্গ মুখ তুলে চাইলেন। ওদের মধ্যেও মানুষ রয়েছে। যে লোকটি ওদের দলপতি একবার তাকে হত্যা করার সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারই প্রতিদানে সে এসে চুপি চুপি আমায় মুক্তি দিল। আমার তলোয়ারখানাও ফিরিয়ে দিল। তখুনি ছুটতে শুরু করেছি। তবু দেরি হয়ে গেল।

জিৎ সিং-এর বাহুর কামিজ রক্তে ভিজে উঠেছিল। সে লক্ষ্য করে বাহুতে আঘাত লাগলেই তার রক্তপাত বেশি হয়। আগের বার রহিমবক্সের ওখানে আঘাত পেয়েও তাই হয়েছিল। তবে আর একটি কারণ থাকতে পারে এই অত্যধিক রক্তপাতের। দু’বারই হয়তো প্রধান ধমনীতে আঘাত লেগেছে।

লীলাবতীর গলা একটু কেঁপে ওঠে জিৎকে ডাকতে। তবু সে তার নাম ধরে ডাকে,—জিৎ!

—একলিঙ্গের আশীর্বাদ রয়েছে বলতে হবে যে অন্তত তোমাকে জীবিত দেখতে পেলাম। তাই বিশ্বাস হচ্ছে এখন তোমায় নিয়ে এদের আওতা থেকে পালিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে আসাও সম্ভব হবে।

—কোথায় নিয়ে যাবে আমায়?

—যেখানে তুমি বলবে। কোথায় যেতে চাও?

—জানি না আমি। সম্ভবত কোথাও না। কোথাও যাবার মতো ইচ্ছার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই আমার মনে।

—যশোবন্তের কাছে?

—না।

—তবে?

—এখানে থাকাই কি ভালো নয় জিৎ। এখানেই থাকব। ওরা চলে গেলে তুমি আমার জন্যে একটি চিতা সাজিয়ে দিও জিৎ। যদি আমার স্বামীর মৃতদেহ খুঁজে পাও, নিয়ে এসে সেই চিতায় স্থাপন ক’রো। সেইভাবে মৃত্যুবরণই কি ভালো হবে না জিৎ ঠিক রাজপুত রমণীর মতো হবে না?

—আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার ওই দিবারাত্রির সাথী ছুরিটির সাহায্য নিয়েছ। আমি তোমার মৃতদেহ খুঁজে বের করব আশা করেছিলাম।

—তুমি ঠিকই আশা করেছিলে। আমি চেষ্টা করেছিলাম আত্মহত্যা করতে। কিন্তু পারিনি। স্বামীর মৃত্যুতে ততটা আঘাত আমি পাইনি। তাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম জিৎ, কিন্তু ভালো তো বাসিনি। তাই তাঁর মরণের সাথী হবার জন্যে তোমার সাহায্য চাইছি। সাহায্য করবে তো?

—সে সুযোগ পারে কি? তার আগেই রাম সিং-এর দলের হাতে ধরা পড়তে হবে।

—না। ওরা আমাদের ধরতে পারবে না। এত চেষ্টা করেও তো পারেনি ধরতে।

—কোথায় থাকো তুমি লুকিয়ে?

—এসো।

জিৎ সিং লীলাকে অনুসরণ করে। ঘরের পর ঘর পার হয়ে যায় তারা। শেষে একটি জায়গায় এসে লীলাবতী থেমে যায়। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,—এই জায়গাটি প্রথম দিনেই আমার স্বামী আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন? এখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখবার একটি চোরা কুঠরী রয়েছে।

জিৎ সিং অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পায় একটি সিঁড়ি উঠে গেছে দেয়ালের কিছুদূর অবধি।

—খুব সাবধানে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে। আমি আগে উঠছি। মাত্র পাঁচটা থাক রয়েছে সিঁড়িটির। তবু আস্তে উঠবে কিন্তু। হাল্কা কাঠের তৈরি। এসো আমার পেছনে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে জিৎ দেখতে পায় একটি চৌকো গর্তের ভেতরে প্রবেশ করে লীলাবতী। সেও অতি কষ্টে তার ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরটা আরও অন্ধকার।

একটু দাঁড়াও জিৎ। সিঁড়িটা টেনে নি।

—পারবে তুমি?

—হ্যাঁ। আমার চেয়ে দুর্বল মেয়েও পারবে।

—কিন্তু দেওয়ালের গায়ে ওই রাস্তা বন্ধ করবে কি দিয়ে?

সিঁড়ি টেনে নিয়ে লীলা বলে,—এই যে পাথর রয়েছে। পাতলা পাথর। এটিকে ওখানে বসিয়ে দেব। দেওয়ালের সঙ্গে একেবারে মিশে যাবে।

—চমৎকার। কিন্তু আমার মনে হয় লুকিয়ে থাকবার এর চেয়ে আরও ভালো জায়গা অনেক প্রাসাদে আর দুর্গে রয়েছে।

—নিশ্চয় রয়েছে। তবে এখানে সুবিধে হল এই যে, এত ছোট বাড়িতে এমন একটি জায়গা থাকতে পারে কেউ সন্দেহ করে না। তাই অনেক নিরাপদ।

ছোট্ট একটি ঘর। লীলাবতী বাতি জ্বালায়। বাতি জ্বালিয়েই সে আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জিৎ সিং-এর দিকে। আর জিৎ সিং চেয়ে থাকে লীলাবতীর দিকে। কতদিন পর, যেন কত যুগ কেটে গেছে, দুজন দুজনাকে এইভাবে দেখছে।

জিৎ ভাবে, লীলা আরও অনেক সুন্দর হয়েছে। প্রিয়ার চেয়ে সে অনেক বেশি সুন্দর। অনেক-অনেক।

লীলা দেখে, জিৎ সিং-এর কোমল মুখ আরও কঠিন হয়েছে। তার গায়ের রঙ আগের চেয়ে অনেক বেশি তাম্রবর্ণ। সেই বর্ণ তার চেহারাকে দিয়েছে বীরত্বপূর্ণ সুষমা। কিন্তু তার চোখের সেই অন্তহীন দৃষ্টি তেমনি অটুট।

ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে ওঠে লীলাবতীর। তার হাতের বাতিও কাঁপে। মুখ ফিরিয়ে কোনোরকমে বাতিটিকে একটি স্থানে রাখে। ঘরের এক কোণে চলে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। তারপর ফিরে এসে বলে,–তোমার হাত যে রক্তে ভেসে যাচ্ছে জিৎ।

—হ্যাঁ।

ছোট্ট একটি শয্যা পাতা ছিল। তার ওপর জিৎকে শুইয়ে দেয় লীলাবতী। নিজের হাতে তার গায়ের পোশাক খুলে ক্ষতস্থান পরিচর্যায় মন দেয়। শুয়ে শুয়ে উপভোগ করে জিৎ।

—জিৎ।

—বল লীলাবতী।

—তুমি অনেক বড় হয়েছ।

জিৎ চুপ ক’রে থাকে। ভাবে, এক বছর দেড়বছরের মধ্যে যতটা বড় হওয়া উচিত, তার চাইতে হয়তো বেশি বড় হয়েছে সে। তবে লীলাবতী বড় হয়নি। ঠিক তেমনিই রয়েছে। শুধু তার মুখে যেন একটা গাম্ভীর্য এসেছে।

—কথা বলছ না কেন জিৎ?

—চুপ করেই থাকতে ভালো লাগছে।

—বেশ, চুপ ক’রেই থাকো।

—তোমার মনে তো কোনো দ্বিধা নেই লীলা?

লীলার হাত থেমে যায়। সে প্রশ্ন করে,—কিসের দ্বিধা?

—এইভাবে আমাকে—মানে আমি যে গুপ্তচর।

লীলা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কোনো জবাব দেয় না। তারপর ধীরে ধীরে জিৎ-এর ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে শুরু করে।

—একটা কথা তোমায় বলব লীলা?

—বল।

—তুমি যখন আমায় ছুরি দিয়ে আঘাত করলে ঠিক সেই মুহূর্তে আমি কি ভাবছিলাম জান?

—কি?

—আমি ভাবছিলাম তোমারই একটি উক্তির কথা। অদৃষ্টের এমনি পরিহাস, ঠিক সেই মুহূর্তেই তোমার ক্ষুদ্র অস্ত্রটি আমার হাতে বিধল।

—আমার কোন্ কথা ভাবছিলে জিৎ?

—তুমি বলতে, মেয়েরা যাকে ঘৃণা করে কিংবা ভালোবাসে চোখে না দেখে ঘ্রাণেই তাদের উপস্থিতি টের পায়। আবার, অনেক দূর থেকে দেখেও চিনে ফেলতে পারে তাকে। তুমি এককালে আমায় ভালোবাসতে, এখন আমায় ঘৃণা কর। অথচ আমায় চিনতে পারলে না। তোমাদের অনেক কথাই কি শুধু মুখের কথা?

—না জিৎ?

—তবে?

—তোমার ঘ্রাণ আমি পাইনি। আমি পেয়েছিলাম অন্য ঘ্রাণ। এই শয্যায় তোমার পোশাক খুলে ফেলবার আগে পর্যন্ত তোমার ঘ্রাণ তেমন পাইনি। তাই ভুল হয়েছিল।

—কেন এমন হল?

—এই মুঘল পোশাকটি কোথা থেকে সংগ্রহ করলে। কারও গায়ে ছিল?

—হ্যাঁ।

—ঘামে ভিজে ছিল নিশ্চয়ই। তারই গায়ের গন্ধ রয়েছে এতে। তার গায়ের উৎকট গন্ধ তোমার গায়ের মৃদু গন্ধকে ঢেকে রেখেছিল। নইলে আমি বুঝতে পারতাম তোমার উপস্থিতি

ক্ষতস্থান বাঁধা হয়ে যায়। জিৎ সিং শয্যার ওপর উঠে বসে।

—এবারে চল লীলাবতী।

—কোথায়।

—এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও।

—সে কি জিৎ? ওরা চলে না যাওয়া অবধি অপেক্ষা কর। আট দশদিনের খাদ্য মজুত রয়েছে এই ঘরে। ওরা চলে যাক। তারপর তুমি আমার চিতা সাজিয়ে দেবে।

—না।

—কি বললে? তুমি মরতে দিতে চাও না?

—না। যাকে তুমি ভালোবাসতে না, তার সঙ্গে সহমরণে যাওয়া বাতুলতা।

লীলাবতী গম্ভীর হয়। সে জিৎ-এর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,–তোমার উদ্দেশ্য কি জিৎ? তুমি কি আমাকে—

—না। আমি তোমায় কোথাও নিতে চাই না। আমি তোমার ইচ্ছে মতো কোথাও পৌঁছে দেব তোমাকে। একথা আগেও বলেছি। তবে আমার মনে হয় উদয়পুরে যাওয়াই মঙ্গল হবে তোমার পক্ষে।

—সেই উদয়পুর? যেখানে হাজার স্মৃতি আমাকে অহরহ পাগল করে তুলত?

—তুমি শক্ত মেয়ে লীলাবতী। যত সহজে পাগল হবে ভাবছ, অত সহজে পাগল তুমি হবে না। লক্ষ্মণের মুখে আমি শুনেছি তোমাদের দল ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। উদয়সাগরের তীরের সেই কুটিরগুলি দিনের পর দিন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তুমি সেখানেই যাও লীলা। তোমার পিতার দলকে তুমি নেতৃত্ব দাও। সেখানে এমন আর কেউ নেই যে তাদের ধরে রাখতে পারে।

লীলাবতী অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে না। সময় চলে যেতে থাকে দ্রুত। জিৎ সিং-এর অস্বস্তিও সেই সঙ্গে বেড়ে যায়। ঘোড়াটিকে যদিও সে আড়ালে বেঁধে রেখে এসেছে, তবু তফিলউদ্দিনের দলের কারও চোখে পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। রহিমবক্সের মতো লোকের হাত থেকে উদ্ধার করা কিকার উপহারের সামগ্রীটি সে এখানে খোয়ালে তার আফশোসই শুধু বাড়বে না, বিপদও দেখা দেবে।

—কি ঠিক করলে লীলাবতী?

—আজ রাতের মতো ভেবে দেখতে দাও।

—রাত? আমি আর কয়েক মুহূর্ত সময় দিতে পারি।

লীলা একটু ভেবে নিয়ে বলে,–বেশ। আমি তোমার সঙ্গেই যাব। তোমার সঙ্গে আমি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব। তবে উদয়পুরে ফিরে যাব কি না কথা দিতে পারছি না। কোনো নিরাপদ স্থানে পৌঁছে ভেবে দেখতে হবে।

—আপাতত সেইটুকুই যথেষ্ট।

জিৎ সিং পোশাক পরে নেয়। নিজের পোশাকের ওপর মুঘল অশ্বারোহীর পোশাকটি পরে না এবারে। লীলাবতীও একটি আঁটোসাঁটো পোশাক পরে, যা পরলে দীর্ঘপথ ঘোড়ার পিঠে চলতে অসুবিধা কম হবে। জিৎ সিং চেয়ে দেখে লীলাবতীর নতুন রূপ। উদয়পুর হলে এই মুহূর্তে সে লীলাকে বুকের ভেতরে চেপে ধরত। কিন্তু এ উদয়পুর নয়, ঢোলপুর। তাছাড়া লীলা এখন বীর জয়পাল সিং-এর বিধবা পত্নী। আর সে নিজে গুপ্তচর, যে গুপ্তচর লীলার ঘৃণার পাত্র।

একটি দীর্ঘশ্বাস চাপে জিৎ সিং।

—তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে চাইছিলে জিৎ। কেন?

—কিছু না। এমনি।

—কোন্ কথা ভাবছ তুমি আমি জানি। ভেবেছিলাম আজ রাতের মতো নিশ্চিন্তে তোমাকে কাছে রাখব। কিন্তু তুমি দিলে না।

চমকে ওঠে জিৎ,—কাছে রাখবে?

—হ্যাঁ, শুধু কাছেই রাখব। তুমি এই শয্যার ওপর শুয়ে ক্লান্তিতে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়বে, আর আমি ওই বাতির আলোয় সারারাত জেগে চেয়ে চেয়ে দেখব ওই ঘুমন্ত মুখখানি।

—তাতে লাভ?

—লাভ? লাভ আছে বৈ কি জিৎ।

—কিন্তু আমি—

—জানি। বার বার কেন ওকথা বলছ? আমি জানি, তুমি কী। তবে সবার ওপর তুমি হলে জিৎ। উত্তেজিত হয়ে জিৎ সিং বলে,—হ্যাঁ, আমি জিৎ। যে জিৎকে ভালোবেসেও তুমি কাছে ডাকতে পারলে না। আদর্শে বাধল।

—ছিঃ, মাথা খারাপ করো না। আমার বুকের ভেতরে কী হচ্ছে, তা কি জান না?

—জানি। জানি বলেই অবাক হই, তোমরা সত্যিই অদ্ভুত জাতি লীলাবতী।

—হ্যাঁ। আমরা তোমাদের মতো সোজাভাবে চলতে পারি না। আমাদের মনে নানান জিনিসের

ছায়াপাত ঘটে। তাই সর্বদাই আমাদের দ্বিধা ভাব। এ আমাদের স্বভাব। এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাব কি ক’রে বলে দিতে পার?

—পারি। যাকে ভালোবাস তার ওপর নির্ভর কর।

লীলাবতী কোনো উত্তর দেয় না। সে জানে, কত বড় সত্যি কথা বলেছে জিৎ সিং। সাধারণ নারী হলে হয়তো নির্ভরই করত। কিন্তু সে ঠিক সাধারণ নয়। তার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিত্ব, রয়েছে যুক্তি। এই দুটি জিনিসকে অগ্রাহ্য করে সে পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করতে পারেনি। সব সময়ই তার ভয় হয়েছে, জিৎকে সে কোনো না কোনো সময়ে হয়তো ঘৃণা ক’রে ফেলবে, অবজ্ঞা ক’রে ফেলবে। এই ভীতি এ জীবনে তাকে প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলিত হতে দিল না। একলিঙ্গের কাছে সে প্রার্থনা করে, আসছে জন্ম থেকে প্রতিটি জন্মে জিৎই যেন হয় তার স্বামী, তার প্রিয়তম।

—লীলাবতী?

—বল।

—আজ যদি তুমি জয়পাল সিং-এর স্ত্রী না হতে তবে কি আমায় আহ্বান জানাতে পারতে?

—না জিৎ। পারতাম না। আমি যে তোমায় ভালোবাসি।

—আর শুনতে চাই না। আমি একথা জানতাম। তাই আগ্রায় তোমায় ভুলবার জন্যে তোমাদেরই কালপীর একটি মেয়ে, ঠিক তোমারই মতো দেখতে, তার কাছে যাতায়াত করতে শুরু করেছি। সে আমায় ভালোবাসে। তার বিশেষ ঢঙে আমায় ভালোবাসে। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি, তাকে বুঝি ভালোবাসি। ভালোবাসি বৈ কি? প্রিয়াকে আমি ভালোবাসি।

লীলাবতীর মুখের রক্ত অন্তর্হিত হয়। সে কোনোরকমে বলে,—প্ৰিয়া।

—হ্যাঁ। প্রিয়া। আমারই দেওয়া নাম।

ঢোক গিলে লীলা বলে,—ভালোই করেছ। নইলে চলবে কি করে?

—চলত, যদি জানতাম বিশ বছর পরে গেলেও তোমার পাশে আমার জায়গা আছে।

লীলাবতীর চোয়ালের হাড়দুটো উঁচু হয়ে ওঠে। সে বলে,—না জিৎ নেই।

ওরা দুজনা আবার কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দেয়। নীচে নামে ধীরে ধীরে। কেউ কোনো কথা বলে না। দুজনেই নিজের নিজের চিন্তায় মগ্ন

বাইরের দিকে অগ্রসর হয় ওরা। এখনো প্রহরী বদলের সময় পার হয়ে যায়নি। এখনো মৃত এবং রজ্জুবদ্ধ সৈনিক দুজনার খোঁজ পড়েনি। খোঁজ পড়লে অসংখ্য মশালের ছোটাছুটি দেখতে পেত এতক্ষণে! জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়। অন্ধকারের মধ্যে মাঝে মাঝে লীলার গায়ের স্পর্শ ওর নিশ্চিন্ততার মধ্যে একটু সুখেরও সৃষ্টি করে।

দরজার বাইরে আসে ওরা। এসেই পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে যায়। কারণ তারা বাইরে পা দিতেই তিনটি মশাল জ্বলে ওঠে একসঙ্গে। সেই লালচে আলোয় বিস্মিত চোখে জিৎ সিং দেখতে পায় রাম সিং ওরফে তফিলউদ্দিনকে।

তফিলউদ্দিনও কম অবাক হয়নি। কিন্তু অবাক হতে গিয়ে একটুও অন্যমনস্ক হল না সে। মুখে কঠিন হাসির রেখা টেনে সে বলে,—ওরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। করুক। এক হিসাবে ভালোই হল। তুমি এসেছ বলেই লীলাবতী গর্ত থেকে বের হয়ে এসেছে। তা ছাড়া লীলাবতীর সামনে তোমাকে হত্যা করে আমি কম আনন্দ পাব না।

জিৎ সিং দেখে বিপক্ষে তিনজন দাঁড়িয়ে, আর সে একা। তবু মুহূর্তের মধ্যে তলোয়ার টেনে নিয়ে বলে,–তোমার ছুরি ঠিক আছে লীলা?

—হ্যাঁ।

—আমায় মরতে দেখলে ওদের হাতে ধরা দিও না।

কথা শেষ হবার আগেই ওদের তিনজনের মধ্যে দুজন মশাল ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। জিৎ সিং তার লম্বা অসি নিয়ে দেওয়ালের পাশে সরে যায়। শত্রুরা সংখ্যায় বেশি। একটি দিক অন্তত নিরাপদ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই একটি দিক নিরাপদ রাখতে সে রাম সিংকে একবার উপদেশ দিয়েছিল। কিকা যখন রাম সিংকে আহত ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে যাবার আদেশ দিয়েছিলেন মহরত কা শিকারের দিনে, সেদিন সবাই স্থান ত্যাগ ক’রে চলে যাবার পর জিৎ সিং তার কাছে ফিরে গিয়ে খানকতক রুটি দিয়ে বলেছিল, পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসে থাকতে। কারণ হিংস্র পশুরা পশ্চাৎদিক থেকে অন্তত আক্রমণ করতে পারবে না।

আজ সে-ও তিনটি হিংস্র পশুর সম্মুখীন। তাই লীলাবতীকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে তার সামনে নিজের খাড়া রেখে ওদের আক্রমণ প্রতিহত করে সে।

কিন্তু ওরা দুজন। দুজনার কারও অসির জোর একেবারে নগণ্য নয়। একজনকে যদিও বা আহত করা যায়, সঙ্গে সঙ্গে মশালধারী লোকটি এগিয়ে এসে আহতের শূন্যস্থান পূর্ণ করবে।

রাম সিং চিৎকার ক’রে ওঠে,–তোমার ভাগ্য ভালো জিৎ। বন্দুকটি সঙ্গে আনিনি।

—আমি আগেই সেকথা ভেবেছি।

আর কোনো কথা হয় না। শুধু অস্ত্রের ঝনঝনানি। জিৎ সিং বুঝতে পার, এভাবে আর বেশিক্ষণ লড়তে পারবে না সে। কারণ সে ক্ষুধার্ত। লীলাবতী তাকে খাদ্য দিতে ভুলে গেছল। তার আহত স্থান থেকে খুব বেশি না হলেও, একেবারে কম রক্ত বের হয়নি। মনে মনে সংকল্প করে সে আহত হবার ঝুঁকি নিয়েও এদের একজনকে অন্তত কাবু করতে হবে। সে নিজের বাঁ দিকটা মুহূর্তের জন্যে অরক্ষিত রেখে রাম সিং-এর সাহায্যকারীর বাহুমূলে তলোয়ারের আঘাত হানে। লোকটি আর্তনাদ ক’রে বসে পড়ে। তার অস্ত্র খসে পড়ে হাত থেকে। কিন্তু সেই মুহূর্তটুকুর মধ্যেই রাম সিং-এর অস্ত্রের অগ্রভাগ জিৎ-এর বাঁ ঊরুতে বিদ্ধ হয়। সদা জাগ্রত রাম সিং-এর দুটি চোখ আর তার মন। সে কখনো সুযোগ হারিয়ে পরে আফসোস করে না।

জিৎ সিং বুঝতে পারে না কতটা গভীর হয়েছে তার ক্ষত। বুঝবার উপায়ও নেই। কারণ যতক্ষণ শক্তি থাকবে ততক্ষণ লড়তেই হবে।

রাম সিং হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,–আত্মসমর্পণ করলেও বাঁচতে পারবে না জিৎ সিং। তোমায় আমি হত্যা করব।

জিৎ নিজেকে রক্ষা ক’রে চলে। প্রতি আক্রমণ সম্ভব হবে না দুজনার বিপক্ষে। আহত ব্যক্তিটি তলোয়ারখানা আবার তুলে নেবার চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হয়। তখন মশালধারী তার হাতের মশালটি আহতের হাতে দিয়ে এগিয়ে এসে আক্রমণ করে

জিৎ সিং ক্লান্তি অনুভব করে। এক এক সময়ে তার মনে হয় হাতের তলোয়ার বুঝি খসে পড়বে। তার বাঁ হাতের বাহুতে বেদনা অনুভূত হয়। তার বাঁ ঊরুতেও ব্যথা।

ওদের আক্রমণ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। জিৎ সিং-এর ক্লান্তি ওরা ধরে ফেলেছে। ঠিক সেই সময় জিৎ সিং দেখতে পায় লীলাবতী বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ছিটকে বের হয়ে আসে তার পেছন থেকে। সে অপর লোকটির পিঠে তার ছুরিকাটি আমূল বিদ্ধ ক’রে দেয়।

এই দৃশ্য দেখে রাম সিংও ক্ষণেকের তরে স্তম্ভিত হয়। এমন পরিণাম সে কল্পনা করেনি। এবারে সে একা। একটা দ্বিধা ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে। তার আফশোস হয় জীবনে প্রথম, মাত্ৰ তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে আসবার জন্যে। কারণ ইচ্ছে করলে আরও অনেককে সে নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু সে তা চায়নি। সে চেয়েছিল গোপনে জয়পাল সিং-এর গৃহের ওপর নজর রাখতে প্রথম থেকেই তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, লীলাবতী এই গৃহেরই গোপন স্থানে লুকিয়ে রয়েছে।

রাম সিং-এর ইচ্ছে হয়, ছুটে চলে যায় নিজের দলের কাছে। তাদের ডেকে নিয়ে এসে এদের ঘিরে ফেলা মোটেই কষ্টকর হবে না। কারণ জিৎ সিং কিছুটা আহত, আর লীলাবতী শত হলেও নারী। এই স্থান ত্যাগ ক’রে গেলেও বেশিদূর তারা এগিয়ে যেতে পারবে না।

কিন্তু জিৎ সিংকে ছেড়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। সুযোগ দেবে না সে। এতক্ষণ আত্মরক্ষা ক’রে চলেছিল সে, এবারে আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে। এই আক্রমণের মুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। পৃথিবীর সব চাইতে ধুরন্ধর অসিধারীও পারবে না। সে আবার আফশোস করে বন্দুকটি সঙ্গে আনেনি বলে। সে ভেবেছিল একা লীলাবতীর জন্যে ভারী বন্দুক বয়ে নিয়ে আসা অর্থহীন। লীলাবতীকে কোনো অবস্থাতেই হত্যা করার কথা তার মনে হয়নি। হত্যা করলে তাকে উপভোগ করা যাবে না। এই উপভোগের তীব্র লালসা তাকে ছেলেবেলা থেকে দিনে রাতে নিদ্রায় জাগরণে জ্বালিয়ে মেরেছে। আজ তা সার্থকতার কিনারায় এসে পৌঁছেও হাতছাড়া হবার মুখে।

ক্রুদ্ধ হয়ে হুংকার দিয়ে রাম সিং আক্রমণ করে জিৎকে। কিন্তু সেই আক্রমণ ব্যর্থ হয়। সম্মুখে একজন মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে জিৎ-এর উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। তার ক্লান্তিও যেন ততটা নেই। সে এখন ঠাণ্ডা মাথায় সহজভাবে অসি চালিয়ে যাচ্ছে।

রাম সিং জিৎকে রাগান্বিত করবার জন্যে দু’চারটে বিদ্রুপবাণ ছুড়ে দেয় তার প্রতি। কোনো ফলই হয় না তাতে। বরং হাসি ফুটে ওঠে জিৎ-এর মুখে।

লীলাবতীর ছুরির আঘাতে আহত লোকটি এতক্ষণ ছটফট করছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে স্থির হয়ে যায়। মশালধারী আহত লোকটি সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার ক’রে ওঠে। তার চিৎকারে এত বেশি ভয় ছিল যে রাম সিং-এর বুক অবধি কেঁপে ওঠে। সে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে ওঠে সে,—জিৎ, বন্ধ কর।

—না। তা হয় না।

—জিৎ, লীলাবতীকে আমি চাই না।

জিৎ-এর তলোয়ারের অনেকখানি রাম সিং-এর পাঁজরের ভেতরে চলে যায়। পাথরের মেঝের ওপর নিঃশব্দে পড়ে যায় রাম সিং। তার একপাশের পোশাক তাজা রক্তে ভিজে ওঠে। মশালের আলোয় সেই রক্ত বড় বেশি লাল দেখায়। গাঢ় লাল।

সেই অবস্থাতেই রাম সিং বড় বড় চোখে অতি কষ্টে বলে,–তোমার কথাই শেষে সত্যি হল জিৎ। আমার মৃতদেহ দেখেও অনেক দিন বাঁচবে।

জিৎ সিং প্রশ্ন করে,–তোমরা ঘোড়া এনেছিলে রাম সিং?

মশালধারী লোকটি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,—হ্যাঁ হ্যাঁ এনেছি, আমার সঙ্গে আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।

—কিন্তু তোমায় আমি বাঁচতে দিতে পারি না।

—না না। আমি মরব না। আমায় আপনি মারবেন না।

—তুমি আমার নাম জেনে ফেলেছ। আমি চাই না কেউ আমার নাম জানুক।

জিৎ লোকটির বাঁ হাত থেকে মশাল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে জোরে আঘাত করে।

লীলাবতী উত্তেজিত হয়ে বলে,—তুমি এতটা নিষ্ঠুর হয়েছ জিৎ?

জিৎ সিং লোকটির নিষ্প্রাণ দেহের দিকে চেয়ে বলে,—নিষ্ঠুর? হ্যাঁ, হয়েছি বৈকি। আমি যে গুপ্তচর। গুপ্তচরকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক সময়ে অনেক নিষ্ঠুর কাজ করতে হয়।

জিৎ রাম সিং-এর কাছে দ্রুত ফিরে আসে। বলে,—রাম সিং তুমি বেঁচে আছো?

আহত রাম সিং-এর মুখখানা একটু বিকৃত হয়। সে তার মুদিত আঁখি মেলে বলে,—হ্যাঁ।

—রাম সিং আমি গুপ্তচর। এই বৃত্তি নিয়ে হয়তো মেবারের কোনো উপকারই করতে পারব না। তবু যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ ক’রে প্রাণ দেবার চেয়ে এর মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। আজ তুমি মৃত্যুর পরপারে চলে যাচ্ছ, তাই জানিয়ে দিলাম।

রাম সিং-এর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তবু সে রক্তশূন্য মুখে চেয়ে থাকে দুজনার দিকে। সে দ্রুত অবসন্ন হয়ে পড়ছে। কোনোরকমে উচ্চারণ করে,—পারবে না জিৎ। কিছুতেই পারবে না। আকবর শাহ্ অসাধারণ ব্যক্তি।

জিৎ সিং চিন্তিতভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,—জানি।

সে মশালটা নিবিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর লীলার হাত ধরে ওদের ফেলে রেখে বাইরের অন্ধকারের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে লীলার চিন্তা এখন বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হয়ে অনেক দূর চলে গেছে।

—লীলা!

—বল জিৎ।

—তোমার ছুরি আমার বেলায় অমন সাংঘাতিক ভুল করে বসল কেন?

—সেকথা আমিও ভেবেছি জিৎ। ভেবেছি, আর কৃতজ্ঞতায় একলিঙ্গকে স্মরণ করে অসংখ্যবার মাথা কুটছি। আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল সেই অন্ধকারের মধ্যে, যে তোমার বাহুই তোমার বুক।

—এরপর থেকে চোখে না দেখে, ধারণার বশবর্তী হয়ে কখনো কিছু করতে যেও না।

রাম সিং-দের একটি ঘোড়া টেনে নিয়ে জিৎ লীলার সঙ্গে নিজের ঘোড়ার কাছে আসে। নিজের ঘোড়াটিতে লীলাকে উঠিয়ে দিয়ে অপরটিতে নিজে চড়ে সে প্রশ্ন করে,—এবারে কোথায় যাবে লীলা? উদয়পুর?

—তুমি সঙ্গে যাবে?

—যেতেই হবে। উপায় নেই। একা তোমায় আমি ছাড়তে পারি না।

—অসুবিধা হবে তোমার?

—একটু অসুবিধা হবে। সিক্রি থেকে ঘুরে এসে বাদশাহের মেবার আক্রমণের কথা আছে। সে আয়োজনকে বন্ধ করবার চেষ্টা করতে পারব না।

—কতদিনের মধ্যে বাদশাহ্ মেবারে আক্রমণ করতে পারেন?

—বলা কঠিন। তিনি খুব তাড়াতাড়ি কালাঞ্জরে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন।

—মেবার মানে তো উদয়পুর?

—নিশ্চয়ই।

—তোমার তাহলে তো সত্যিই অসুবিধা হবে।

—হ্যাঁ, লীলা।

—স্পষ্ট করে বলছ না কেন? দেশের মঙ্গলের জন্যে উদয়পুর ছেড়ে এসে, শেষে আমারই জন্যে তোমার ওই নতুন আদর্শকে বিসর্জন দেবে?

—এ দ্বন্দ্ব আমার আমৃত্যু থাকবে লীলাবতী।

লীলাবতীর স্বর সহসা কঠোর হয়ে ওঠে। সে বলে,—না। এ দ্বন্দ্ব তোমার নেই। আমার প্রতি তোমার কর্তব্যটুকু শুধু অবশিষ্ট রয়েছে। কর্তব্যের খাতিরেই তুমি ঢোলপুরে এসেছ। কর্তব্যের খাতিরে তুমি আমায় উদ্ধার করেছ। আর এখন কর্তব্যের পথ চেয়েই মেবারের আশু বিপদের আশঙ্কা জেনেও আমার সঙ্গে যেতে চাইছ। তোমার অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে জিৎ।

জিৎ সিং একথার জবাব দেয় না। সে নিঃশব্দে অন্ধকারের মধ্যে লীলাবতীর পাশাপাশি চলতে থাকে।

—জিৎ! –বল লীলা।

—তোমার দেশ রয়েছে। আর রয়েছে প্রিয়া। ও দুটি অমূল্য সামগ্রী ছেড়ে কেন মিছিমিছি আসছ আমার সঙ্গে? সংকোচ হচ্ছে বলে কি?

—জিৎ-এর ইচ্ছে হয়, লীলাকে তার অশ্ব থেকে তুলে নিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে সজোরে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। মুঘল রাজত্ব ছাড়িয়ে, রাজোয়ারা ছাড়িয়ে, গুজরাটকে পেছনে ফেলে আরও পশ্চিম দিকে ধাবিত হবে সে, যতক্ষণ না সীমাহীন সমুদ্র দেখা দেয় সামনে। তারপর সমুদ্র দেখেও সে থামবে না। এগিয়ে যাবে, আরও এগিয়ে যাবে। এই জগতে বেঁচে থেকে সে যখন লীলাকে পেল না, তখন অন্তত মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তাকে পাবে।

কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তাই লীলার অশ্বের কাছেও সরে গেল না সে। তাকে বলতে পারল না—প্রিয়াকে আমি কিছুতে ভালোবাসতে পারি না বলেই ওর নাম ‘প্রিয়া’ রেখেছি লীলা। নামটির মাধুর্য যাতে নেশার মতো আমাকে সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন করে রেখে ভাবতে দেয়, আমি তাকে ভালোবাসি। নইলে, নইলে তুমি কি বুঝতে পার না কাকে আমি ভালোবাসি?

—কথা বলবে না জিৎ?

—বলব।

—বল। তোমার কি সংকোচ হচ্ছে?

—না। আমি সত্যিই ভুলে গেছলাম বাদশাহের আয়োজনের কথা। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারব না লীলা।

—আর প্রিয়া?

—হ্যাঁ, প্রিয়াও বটে। আমি এখান থেকেই বিদায় নিতে চাই লীলা।

—আরও কিছুটা আমায় এগিয়ে দাও। আমার স্বামীর একজন বন্ধু রয়েছেন। এপথে চললে শেষ রাতে তাঁর ওখানে পৌঁছে যাব। সেখান থেকে তুমি ফিরে এসো।

—উদয়পুরে গিয়ে কিকাকে সংবাদ দিও লীলা। বলো তাঁকে, যদি বাদশাহের মনোযোগ মেবারের ওপর থেকে ফিরিয়ে নিতে পারি আমি, তাঁকে জানাবো। অবিশ্যি উধমের লোক তোমার আগেই পৌঁছে যাবে। তবু বলো তুমি। বলবে, এখনকার মতো বাদশাহকে নিবৃত্ত করতে হবে।

—উধম কে জিৎ?

—আমার মতো একজন হতভাগ্য। তবে কোনো মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে বলে আমার জানা নেই।

—তুমি আগ্রায় কোথায় থাকো জিৎ?

—সরাইখানায় ছিলাম। সেখান থেকে উঠে এসেছি উধমের কাছে। উধম পৃথ্বীরাজ রাঠোরের গৃহে কাজ করে।

—পৃথ্বীরাজ রাঠোর?

—হ্যাঁ। চেনো না তাঁকে?

—তাঁর নাম রীতিমতো শুনেছি। তাঁর রানী মেবারের মেয়ে, তেজস্বিনী নারী। একথা আমার বাবা বলেছিলেন।

—তোমার বাবা ঠিক কথাই বলেছিলেন। পৃথ্বীরাজের রানী অনুগ্রহ ক’রে আমায় রাখী পরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আমার বোন।

—তোমার সৌভাগ্য। কিন্তু তিনি জানেন কি কেন আগ্রায় রয়েছ তুমি?

—না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ চলে ওরা। তারপর লীলা শুধোয়,—আমার রাখীটা পেলে তুমি কি করতে?

—জানি না।

—না পেয়ে ভালোই হয়েছে।

—হ্যাঁ।

শেষে গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছোয় তারা।

সেই সময়ে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছিল আকাশে। সেই আলোয় আর একবার ভালো ক’রে দেখে নেয় লীলা জিৎ-এর মুখ। সে মুখ আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃপ্ত আর অনেক তীক্ষ্ণ। তবু আগের সেই সরলতা এখনো নষ্ট হয়নি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লীলা।

জিৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। এবার তাকে বিদায় চাইতে হবে। বিদায় চাইতে তার বুকের ভেতরটা গুমরে উঠছে। তবু কোনো উপায় নেই। আগ্রায় তাকে ফিরতে হবে। ফিরতে হবে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। তার বাহুর আঘাত অতটা সাংঘাতিক নয়। কিন্তু তার আহত ঊরু কষ্ট দিচ্ছে খুব। তবে রক্তপাত কম।

—উদয়পুরে পৌঁছে সংবাদ পাঠিও লীলা।

—পাঠাবো।

—যশোবন্তকে আমার শ্রদ্ধা জানিও, যদি সে জীবিত থাকে। আর তুমি দলের ভার নিয়ে তাদের ভালোভাবে গড়ে তুলো। তোমার দলের মূল্য কিকার কাছে অপরিসীম। আর কিকাকে তাঁর এই ঘোড়াটি ফেরত দিও। আমি এই ফুলের ছাপমারা ঘোড়া নিয়ে যাব।

—জিৎ!

—বল লীলা।

—আমাকে খুব জোরে ধরে ঝাঁকাতে পার জিৎ?

—কেন লীলা?

—এসব যদি স্বপ্ন হয়। এই যে আমি জয়পাল সিং-এর বিধবা স্ত্রী, এই যে তুমি আগ্রায় থাকো, এসব যদি স্বপ্ন হয়? হয়তো আমরা এখনো উদয়সাগরের তীরেই রয়েছি, ঠিক আগের মতো।

লীলার কথা শেষ হবার আগেই জিৎ সহসা অশ্বের মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর বিদ্যুৎবেগে চলে যায় আগ্রার পথে। সে একবারও পেছন ফিরে দেখে না পাংশু চাঁদের আলোয় একটি দুঃখিনীর মূর্তি কেমন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে দেখতে চায় না। সে জানে, ওই মূর্তির আঁখি থেকে এখুনি অশ্রুজল গড়িয়ে পড়বে, যে জল জয়পাল সিং-এর মৃত্যুর পরও ঝরে পড়বার অবসর পায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *