১১.
রাত তখন অনেক।
প্রিয়ার ঘর থেকে জিৎ সিং ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে। প্রিয়া শয্যার ওপর গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এ নিদ্রা কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ভেঙে যাবে। ভেঙে গেলে আকুল হয়ে তার হাত দুখানি পাশের একটি পেশীবহুল দেহকে খুঁজবে। খুঁজে পাবে না। কিছুক্ষণ মন-মরা হয়ে পড়ে থাকবে সে, কিছু সময় অনিদ্রায় কাটাবে। তারপর নিজের অজ্ঞাতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বে। প্রিয়ার মধ্যে ভাবাবেগ থাকলেও, সেই ভাবাবেগের একটা সীমা রয়েছে। তাই সে জিৎ সিংকে কাছে না পেয়ে হা-হুতাশ করবে না। যতটুকু কাছে পেয়েছে তাতেই সে তৃপ্ত আপাতত। তার বেশি পেতে হলে যে উদ্যমের প্রয়োজন সেই উদ্যমের ঘাটতি পড়বে না পরবর্তী সুযোগ এলে। কিন্তু এখন সে এর চাইতে বেশি চায় না। যেমন চায় না জিৎ সিংও। লীলার চিঠিখানি পেয়ে সে প্রিয়ার জন্যে মনে মনে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যেন চিঠিখানার উপযুক্ত জবাব ওইভাবেই দেবার একমাত্র পথ খোলা রয়েছে। পেয়েও গেল প্রিয়াকে। কিন্তু দেখল সে, এই নারীর মধ্যেও সেই অতলান্ত ভালোবাসার আস্বাদ প্রত্যাশা করা মূর্খতা। তাই সে মনস্থির করে ফেলেছে। বেশি আর চাইবে না কখনো। যতটুকু পাবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে। পৃথিবীতে রমণী হয়ে যারা জন্মেছে তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করলে আঘাত পেতেই হবে। প্রিয়া তাকে বাদশাহের একান্ত অনুগত জেনে তার অগভীর ভালোবাসার মধ্যে জিৎ সিংকে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করুক। সেও হাত পা মাথা গুটিয়ে তার মধ্যে ডুবে গিয়ে নিজের মনকে আর প্রিয়াকে বুঝিয়ে দেবে সত্যিই সে ডুবে রয়েছে।
জিৎ সিং আপন মনে হেসে ওঠে।
হাসিটা একটু জোরে হয়েছিল। কারণ তার আগে পথ দেখিয়ে চলছিল প্রিয়ার যে একান্ত বিশ্বস্ত পরিচারিকা, সে থমেক দাঁড়িয়ে পেছনে ফেরে। তারপর নিজেও ফিক করে হেসে ওঠে।
জিৎ সিং প্রশ্ন করে—তুমি হাসলে যে?
—আপনার হাসি শুনে, হাসি পেয়ে গেল।
—ও।
—দিদিমণি বুঝি হাসির কথা বলেছিল?
—অ্যাঁ? হ্যাঁ, বলেছিল বটে।
—দিদিমণি খুব রসিক।
রসিকা। গিরো উপত্যকার শংকরীর কথা মনে পড়ে যায় জিৎ সিং-এর। সে-ও ছিল রসিকা। কিন্তু সে রসিকার মনের মধ্যে অবিরত অশ্রু ঝরে পড়ত। সর্বক্ষণ প্রিয়তমের পাশে পাশে থেকেও শেষ মুহূর্তের আগে পর্যন্ত নিজের পরিচয় দিয়ে মনের ভার লাঘব করবার চেষ্টা করেনি সে। সেই শংকরীর সঙ্গে পৃথিবীর আর একটি মেয়েরও কি তুলনা হয়? অমন মেয়ে কি আজকাল আর সৃষ্টি করা না তুমি একলিঙ্গ?
একি ভাবছে সে। নিজের সুখদুঃখ, নিজের স্বার্থকে বড় বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছে। প্রিয়াকে কাছে পেয়ে সাময়িকভাবে এক ধরনের আনন্দ পেয়েছে সে। কিন্তু কেন এই সান্নিধ্য! সংবাদ সংগ্রহের জন্যেই তো? সংবাদের কথা সে একবারও চিন্তা করেনি। বাদশাহ্ যে সিক্রি থেকে পিৰেই মেবার আক্রমণের আয়োজন করবেন। তার কি ব্যবস্থা করা যায়? উদয়পুরে খবর পাঠাতে হবে। খবর পাঠাতে খুব অসুবিধা হবে না। উধমের হাতে লোক রয়েছে। কিন্তু সংবাদ পাঠিয়েই সব কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না। মেবার এখন মুঘল সৈন্যের বিরুদ্ধে কখনও দাঁড়াতে পারবে না। মেবারের সেই শক্তি এখনো হয়নি। তাই অন্য পথ দেখতে হবে। উদয়পুরে সংবাদ পাঠিয়ে, আক্রমণ বিলম্বিত করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।
চিন্তিত চিৎ সিং ধীরে ধীরে খিড়কির দিকে এগিয়ে যায়। প্রহরী তাকে সম্মান জানিয়ে দ্বার খুলে দিয়ে বলে,—আবার আসবেন।
জবাব না দিলে জিৎ সিং বাইরে পা দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের ভেতর থেকে অনেকগুলো সবল হাত তাকে চেপে ধরে। তলোয়ার নেবারও সময় পায় না সে।
অট্টহাসিতে শান্ত পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। সেই হাসি রাম সিং ওরফে তফিলউদ্দিনের।
তফিলউদ্দিন বলে,–এলেম আছে বটে তোমার। আগ্রায় এসে সেরা ফুলগুলিতে ঘুরে ঘুরে মধু খেয়ে বেনাচ্ছ। আমরা তো ওসব ফুলের দিকে মুখ তুলে চাইতেই সাহস পাই না।
—আমাকে ধরেছ কেন?
—ছেড়ে দেব বলে নিশ্চয়ই নয়।
—কি করবে?
—দরবারে নিয়ে গিয়ে হাজির করব। বাদশাহের সামনে ফাঁস করে দেব তোমার কীর্তিকলাপ।
জিৎ সিং ওদের হাতের মধ্যে কেঁপে ওঠে। সব কি জেনে ফেলেছে রাম সিং? অসম্ভব নাও হতে পারে। তবু সে উদ্ধত স্বরে বলতে চেষ্টা করে—কোন্ কীর্তিকলাপের কথা বলছ তুমি?
—কেন? বুঝতে কষ্ট হচ্ছে? আজকে কেন তুমি এখানে এসেছিলে, সেই কথাই বলব। এতগুলো সাক্ষীকে অস্বীকার করতে পারবে না। অস্বীকার করলেও বাদশাহ্ বিশ্বাস করবেন না। তোমার মৃত্যুদণ্ড অবধারিত।
জিৎ সিং-এর মনের ভার লাঘব হয়। রাম সিং জানে না তার উদ্দেশ্যের কথা। তাই মাথা উঁচু করে হেসে ওঠে সে। বলে,—মৃত্যুদণ্ড যদি কারও হয়, তবে তোমার হবে রাম সিং।
—চোপ্। আমি রাম সিং নই। কোনোকালে ও-নাম ছিল হয়তো। সে সব মুছে গেছে।
—বেশ। না হয় তফিলউদ্দিনই হলে। তবু বাদশাহের দণ্ড তেমনি বহাল থাকবে। তোমার নাম তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।
না।
—নামই বাঁচাবে।
—ভুল করছ তফিলউদ্দিন। বাদশাহ্ তোমাকে বীরবল-কন্যার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করবেন
তফিলউদ্দিন চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে সে।
অন্ধকারের মধ্যে জিৎ সিং-এর নজর যায়। সে দেখতে পায় আরও চারজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন রহিমবক্স, অপরজন জাফর।
রহিমবক্স তার চোখের দিকে চেয়ে হাসে। কিন্তু জাফরের মুখে হিংস্রতা ফুটে ওঠে। সে হয়ত এতক্ষণে তাকে শেষ করে দিত। শুধু রহিমবক্স উপস্থিত রয়েছে বলেই হাত দুটো নিশপিশ করা সত্ত্বেও কিছু করতে পারছে না।
তফিলউদ্দিন ওদের দিকে চেয়ে বলে,–এর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ঠিকই বলেছে। বাদশাহের সামনে হাজির করলে বিপরীত ফলও ফলতে পারে। বীরবল কন্যা আর মানসিংহের কথার পর আমাদের একশোজন সাক্ষীর কথাও কাজে লাগবে না। তার চেয়ে চল, নিয়ে যাই একে।
—রহিমবক্সের ঘোড়া চুরির দলে কবে নাম লেখালে তফিল?
কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের ওপর এসে পড়ে প্রচণ্ড আঘাত। সে চারদিকে অন্ধকার দেখে। টলে পড়ে মাটির ওপর।
পেছন দিকে লাথি খেয়ে আবার উঠে দাঁড়ায় জিৎ সিং। চেয়ে দেখে রাগে জাফর ফুঁসছে। বুঝতে পারে এদের মধ্যে জাফরই সব চাইতে মূর্খ। কারণ আঘাত সে-ই করেছে। তার ধৈর্য নেই।
জাফর বলে—আজেবাজে কথা বললে আবার মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে।
জিৎ সিং-এর প্রচণ্ড ক্রোধ হয়। কিন্তু এখন ক্রোধে মাথা খারাপ করার সময় নয়। এখন তাকে নির্বিকার থেকে সব কিছু ভালোভাবে লক্ষ করে যেতে হবে। কারণ তফিলউদ্দিনের মুখেব দিকে চেয়ে বুঝতে পারে, সে পরবর্তী কার্যক্রম সম্বন্ধে মনে মনে একটা ছক বেঁধে ফেলেছে। বাদশাহের কাছে হাজির করার চেয়ে তা কম মারাত্মক হবে না। এবং সে কথা জানে বলেই তাকে সুবিধেজনক অবস্থার মধ্যে পেয়েও শক্ত কথা বলছে না আগেকার রাম সিং। অনেক উন্নতি হয়েছে তার। সম্ভবত ঠেকে শিখেছে।
তফিলউদ্দিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,–তোমায় বাদশাহের সামনে হাজির করব না জিৎ সিং। তোমার বিচার করব আমি নিজে। সে বিচারের ফলাফল তোমার মতো চালাক ছেলে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ।
তফিলউদ্দিন চুপ করে। সে আশা করে জিৎ সিং কোনো জবাব দেবে। কিন্তু জিৎ সিং জবাব দেয় না।
—কথা বলছ না কেন জিৎ সিং? ভয় পেয়ে গেলে? মনে আছে সেই বরাহ-শিকারের দিনের কথা? বনের মধ্যে গর্ব-ভরে বলেছিলেন আমার মৃতদেহ দেখবার পরেও তোমার মুখের হাসি অক্ষয় হয়ে থাকবে। সেই থেকে আমি দিন গুনছি। আমি জানতাম একদিন আমার হাতে তোমায় পড়তেই হবে। তবে আগ্রাতে যে তুমি আসবে আমি কল্পনা করিনি। ভেবেছিলাম মুঘল সৈন্যের সঙ্গে উদয়পুর গিয়ে তোমায় ধরব। কিন্তু সে কাজ তুমিই সহজ করে দিলে জিৎ।
—এখন আমায় কোথায় নিয়ে যাবে?
—তোমারই পরিচিত জায়গায়। যেখান থেকে তোমার নিজের ঘোড়াটিকে উদ্ধার করেছিলে। সেখান থেকে পালিয়ে যাবার রাস্তা তোমার জানা আছে। তাই না জিৎ?
—সেখানে কেন আমায় নিয়ে যাচ্ছ?
এবারে তফিলউদ্দিনের কণ্ঠস্বর বদলে যায়। সে রূঢ় এবং কর্কশভাবে বলে ওঠে, কেন? ছোট কথায় বলতে হয়, মেরে ফেলব বলে। এই মুহূর্তেই তোমাকে হত্যা করা যায়। কিন্তু তাতে আমি তৃপ্তি পাবো না। তোমায় কষ্ট দিয়ে মারতে চাই। সামনে দাঁড়িয়ে সেই কষ্ট আমি দেখব আর হাসব। তাহেরের কথা মনে আছে? বেচারা বাঁহাতে পশুর মাংস কাটতে পারে না। কিন্তু সেই বাঁহাতে যদি ছুরি ধরিয়ে দাও তাহলে মানুষের মাংস সুন্দরভাবে কেটে কেটে আলাদা করে দেবে। বিশেষত তোমার মাংস। তোমার মাংসের ব্যাপারে তার পক্ষপাতিত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি তাকে পায়ের দিক থেকে শুরু করতে বলব।
জিৎ সিং আবার একটু কেঁপে ওঠে। সে ভালোভাবেই জানে রাম সিং মুখে যা বলে, অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে।
—তুমি যেন কেঁপে উঠলে বলে বোধ হল জিৎ সিং।
—হ্যাঁ। তোমার কল্পনার মধ্যে বেশ একটু নতুনত্ব আছে।
—আলবত আছে। নইলে এই অল্পসময়ের মধ্যে এতটা উন্নতি করতে পারতাম না। তোমার মতো তো চেহারা সেই আমার। তবে আমার কল্পনার সবটা তোমায় বলিনি এখনো। বলব পরে। তখন দেখবে, এতক্ষণ যা বলেছি সে সমস্ত কিছুই নয়।
ওরা বীরবলের গৃহের খিড়কির দরওয়াজা থেকে রওনা দিয়ে অনেক পরে রহিমবক্সের আস্তানায় এসে হাজির হয়। জিৎ সিং-এর কোমর থেকে স্বহস্তে তলোয়ার খুললে নিয়ে রহিমবক্সের হাতে দেয় তফিলউদ্দিন। তার পর তাকে ভালোভাবে বেঁধে মেঝের ওপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়।
এতক্ষণে জাফরের মুখে কুৎসিত হাসি ফুটে ওঠে। সে ঘরের ভেতরে একটা বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বলে,—তাহেরকে তাহলে ডেকে আনি।
তফিলউদ্দিন প্রশ্ন করে,–কেন?
—ছুরি দিয়ে পা থেকে ভেল্কি দেখাতে শুরু করে দিক।
—না।
—অ্যাঁ?
—এখন না।
—সে কি! এত কষ্ট করে নিয়ে এলে!
—তুমি চুপ কর জাফর। একে আজ রাতে মেরে ফেলা হবে না। দু’তিন দিন দেরি হবে। সেই কয়দিন তুমিই পাহারায় থাকবে, যাতে তিন দিনের মধ্যে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে
—সে আমি দেখব। কিন্তু এত দেরির মানে হয় না।
—তর্ক করো না। যা বললাম ক’রে যাও।
—কিন্তু ও যদি আজেবাজে কথা বলে, আমি সহ্য করব না বলে দিচ্ছি।
—করো না সহ্য।
—আমি খতম করে দেব।
—যদি সত্যিই তেমন আজেবাজে কথা বলে, তবে খতম করে দিও। আমি আপত্তি করব না। তবে যা কিছু করবে রহিমবক্সের সামনে করো। রহিমবক্সের আড়ালে যদি কিছু করেছ, তোমার গর্দান বাঁচাতে পারবে না।
জাফর আহ্লাদে ঘাড় কাত ক’রে মেনে নেয় তফিলউদ্দিনের কথা। সে জানে, বেফাঁস কথা একবার না একবার বলবেই জিৎ সিং। কারণ মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে এসে তাকে খুঁচিয়ে উত্ত্যক্ত করে তুলবে। একবার যদি বেফাঁস কথা বলতে শুরু করে, তবে রহিম বক্সকে ডেকে এনে শুনিয়ে দিলেই হবে। তখন আর রহিমবক্সের আপত্তি থাকবে না। ব্যাটা তাকে ফাঁকি দিয়ে চোখের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে পালিয়েছিল। সেই অপমান কি সহজে ভোলা যায়? এর রক্ত দেখবার আগে অবধি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
তফিলউদ্দিন বলে,—জিৎ সিং, কেন তোমায় এখন মারছি না জান? ভোরবেলার আগেই আগ্রা ছাড়তে হবে আমায়।
—তুমি কাজের মানুষ
তফিলউদ্দিন বিশ্রী হাসি হেসে বলে—হ্যাঁ, খুব কাজের মানুষ। কালাঞ্জর-বিজয়ী সেনাপতি মজনুন খাঁ এত লোক থাকতে আমার ওপর নির্ভর করলেন সব চাইতে বেশি। মজনুন খাঁয়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। পথেঘাটে বাদশাহের চেয়েও তাঁর কথা এখন বেশি বলছে সবাই। সেই মজনুন খাঁয়ের এখন একজন প্রকৃত সুন্দরী বেগমের সাধ হয়েছে। অনেকে অনেক নারীকে এনে দেখিয়েছে। পছন্দ হয়নি তাঁর। তিনি চান তাঁরই মতো শক্ত সমর্থ তেজী একজন রমণী। তাঁর অন্য বেগমেরা সব নাকি তুলোর পুতুল। পুতুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তাঁর মেজাজ গেছে বিগড়ে। তাই আমি তাঁর বেগম পছন্দ করে দেবার ভার নিয়েছি। আমি জানি যাকে আমি এনে দেব, এক নজরেই তাকে তিনি পছন্দ করে ফেলবেন।
—তোমার আত্মবিশ্বাসের তুলনা নেই তফিলউদ্দিন।
—হ্যাঁ। সত্যিই তুলনা নেই। শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, আমার প্রতিশোধস্পৃহারও তুলনা নেই। নইলে এতদিন পরে তুমি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমার পায়ের কাছে ওভাবে পড়ে থাকতে না। শোন জিৎ, তেমাকে সব চাইতে বেশি কষ্ট দেবার কৌশলটি এবার প্রকাশ করব। মন দিয়ে শোন। আজ ভোর না হতেই আমাকে আগ্রা ছেড়ে দূরে যেতে হবে। মজনুন খাঁ আমাকে দু’শো লোক দিয়েছেন তাঁর সেই কল্পনার নারীকে উদ্ধার ক’রে এনে সামনে উপস্থিত করবার জন্যে। সেই দু’শো সৈন্যের দলপতি হয়ে আমি রওনা দিচ্ছি ভোর রাতে। কোথায় যাচ্ছি জান? জানলেও বুঝতে পারবে না? কারণ যে লোকটি আগ্রার পথে পথে ঘুরছিল তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে, আমিই তাকে আগে ধরে ফেলেছিলাম। ধরে ফেলে, পেটের সব কথা বের ক’রে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এমন অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছি তাকে, যে সে নিশ্চয়ই আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি আগ্রা ত্যাগ করতে। সেই লোকটিই খবর এনেছিল, তোমার প্রাণের লীলাবতী তোমাকে ছেড়ে অন্য পুরুষের ঘরণী হয়েছে। তোমার জন্যে সে আর অপেক্ষা করে থাকতে পারল না জিৎ। শুনে আমারই কষ্ট হচ্ছে। তোমার চেয়ে একজন প্রৌঢ়ের মূল্যও তার কাছে বেশি হয়ে উঠল শেষ পর্যন্ত। তুমি জান না জিৎ, লীলাবতী এখন ঢোলপুরের জয়পাল সিং নামে এক প্রৌঢ় রাজপুতের স্ত্রী।
তফিলউদ্দিন থামে। সে ঘরের বাতিটা সামনে এনে জিৎ-এর মুখের দিকে আগ্রহ ভরে চেয়ে থাকে। সে ভেবেছিল, ক্ষোভে, দুঃখে জিৎ-এর চোখ ফেটে জল বের হবে। কিন্তু কিছুই হল না। বিস্মিত হয় তফিল। বিস্মিত হয়, কেননা জানে না লক্ষ্মণকে যতটা সাদাসিধে বলে সে চিরকাল মনে ক’রে এসেছে, ততটা সে নয়। নয় বলেই লীলাবতীর লেখা চিঠিখানাকে সে তফিলের হাতে পড়তে দেয়নি। চিঠিখানা ভাগ্যগুণে আসল ব্যক্তির হাতেই পৌঁছেছিল।
তফিলউদ্দিন হতাশ হয়ে আরও নিষ্ঠুরভাবে বলতে শুরু করে,—কিন্তু বুড়ো জয়পাল সিং-এর ভোগেও লাগল না লীলাবতী। এক হিসাবে ভালো হয়েছে, লীলাবতীর মতো মেয়েকে সে সুখী করতে পারত না। তোমায় আমি বলেছি জিৎ যে, আমার প্রতিশোধ স্পৃহা অত্যন্ত উগ্র। হ্যাঁ উগ্ৰ। উগ্র বলেই, সেই কবে আমায় অপমান করেছিল লীলাবতী, এখনো তা বুকের ভেতরে তেমনি দগ্দগ্ করছে। তাই প্রতিশোধ নিতে চলেছি, ভোরের আলো ফুটে ওঠবার আগেই। তাকে ভোগ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আজ আমার নেই। আল্লার কৃপায় আমি অনেক পেয়েছি এই আগ্রায় এসে। তবু তাকে চূড়ান্ত অপমান করব আমি। তার লোক দেখানো সতীত্ব ধুলোয় লুটিয়ে দেব। তারপর তাকে এনে উপহার দেব মজনুন খাঁয়ের কাছে। মজনুন তাকে হারেমে রেখে দেবেন।
জিৎ সিং ছটফট ক’রে ওঠে। সে বুঝতে পারে তার দৃষ্টির ভেতরে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। তাড়াতাড়ি বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। লীলাবতীকে আজই এরা অপহরণ করতে যাবে। অথচ সে এখানে রহিমবক্সের হেফাজতে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় অসহায়ের মতো পড়ে থাকবে। এ কী করে সম্ভব? কী ক’রে সে সহ্য করবে এই নিদারুণ যন্ত্রণা? তার চেয়ে ওরা তাকে এই মুহূর্তে হত্যা করুক। কেন তাকে লীলাবতীর অদৃষ্টের কথা শোনাবার জন্যে বাঁচিয়ে রাখবে? এতদিন পরে সুযোগ পেয়ে তফিলউদ্দিন হিংস্র হয়ে উঠেছে। সে সুদে আসলে সব তুলে নিতে চায়। তাই সে অত্যাচারিতা লীলাবতীকে সাজিয়ে গুজিয়ে মজনুনের সামনে হাজির করবে। তারপর চিরদিনের জন্যে সে হয়ে পড়বে হারেমের বন্দিনী। না, না। সে কখনই সম্ভব নয়।
জিৎ সিং এপাশ-ওপাশ করতে চেষ্টা করে।
তফিলউদ্দিন হেসে ওঠে,–এতক্ষণে ওষুধ ধরেছে। ধরতেই হবে। ওষুধটা খুব তেজী।
জিৎ সিং কথা বলে না।
—তাহলে তুমি শান্তিতে ঘুমোও জিৎ সিং। রাত প্রায় শেষ হতে চলল। আমার যাত্রার সময় হয়ে এসেছে। মজনুনের সেই দু’শো লোক এতক্ষণে হয়তো কিল্লার সামনে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
—এই সর্বনাশ তুমি করো না রাম সিং। এতটা সইবে না।
—হেঁ হেঁ, দেখা যাক সয় কি না।
—তাহলে আমাকে মেরে রেখে যাও।
—ছি ছি, ওকথা বলো না। ফিরে এসে তোমায় সব কথা বলব যে। খুঁটিনাটি সব বলব। কিছু বাদ দেব না। বলব, কিভাবে ওই বালিকা শেষ পর্যন্ত অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করল। সেই সব স্বাদু কাহিনী না শুনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাও জিৎ সিং? এতটা কাপুরুও তুমি অন্তত নও।
জিৎ সিং বুঝতে পারে রাম সিং-এর কাছে আবেদন নিবেদনের কোনো অর্থ নেই। সে অসহায়ের মতো তার গমনপথের দিকে চেয়ে থাকে। রহিমবক্সও তার সঙ্গে ঘরের বাইরে যায়। মেঝের ওপর স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে সে একা। তার বুকের ভেতরটা একেবারে শূন্য হয়ে যায় তার মাথা ঘুরতে থাকে।
কতক্ষণ এভাবে পড়ে ছিল সে জানে না। হঠাৎ জাফরের পায়ের চাপে সংবিৎ ফেরে। জাফরের দাঁতগুলো স্বল্প বাতির মধ্যেও চক্চক্ ক’রে ওঠে।
—কেমন লাগছে দোস্ত?
জিৎ সিং নিজেকে সংযত রেখে বলে, –মন্দ নয়।
—তা তো লাগবেই। এখনো তাহেরের হাত পড়েনি যে।
—তোমায় দেখে বহুদিনের পুরনো একটা কথা মনে পড়ে গেল জাফর।
—বল বল শুনি। তোমার মুখে সব কথাই এখন মিঠে শোনাবে।
—খুব ছেলেবেলায় আমি একটা বাঁদর পুষেছিলাম, তোমায় দেখতে ঠিক তার মতো।
—কী! আমি বাঁদরের মতো দেখতে?
—পাগল? ঠিক তার মতো নয়। তার চেয়ে একটু বেশি কুৎসিত।
জাফর জিৎ-এর পিঠে সজোরে পদাঘাত করে। জিৎ সিং-এর মনে হয় তার শিরদাঁড়া ভেঙে দুখানা হয়ে গেল। তবু সে কোনো কথা বলে না।
জাফর রাগে ফুলতে ফুলতে বলে,—আমি আগেই বলে দিয়েছি, অপমান আমি সহ্য করব না। এখুনি ডেকে আনছি রহিমবক্সকে। তারপর তোমায় আমি খতম করব।
জাফর চলে যায়। জিৎ সিং নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে থাকে। সে জানে, জাফরকে আর একটু বেশি মাত্রায় ক্ষেপাতে পারলে, লীলাবতীর দুর্ভাগ্যের ইতিহাস তাকে ইনিয়েবিনিয়ে বসবার অবকাশ পাবে না তফিলউদ্দিন।
রহিমবক্স এসে সব শোনে। শুনে ঘন ঘন মাথা নাড়ে। তারপর জাফরকে বলে,—সারাদিন খুব খেটেছিস জাফর। একটু বিশ্রাম নে। তোর মাথা অল্পতেই গরম হয়ে উঠেছে। তাই বুঝতে পারছিস না, ও নিজের মৃত্যুর জন্যে তোকে রাগিয়ে দিচ্ছে।
রহিমের কথা শুনে জাফর একটু অবাক্ হয়। পৃথিবীতে কেউ নিজের মৃত্যু চায়, এ ধারণা তার নেই। তাই অবাক্ হলেও রহিমবক্সের সমান বুদ্ধি ধরে এই ভান করে গম্ভীর হয়ে বলে, —আমি তা বুঝতে পেরেছি। তাই তোমায় ডেকেছিলাম। নইলে তখনি খতম ক’রে দিতাম।
—তুই বিশ্রাম নে গো।
—কিন্তু একে পাহারা দেবে কে?
—বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দে। তার আগে একবার ভালো ক’রে দেখে নে বাঁধন ঠিক আছে কি না।
—ও আর দেখতে হবে না। আমার হাতের বাঁধা কাউকে খুলতে হবে না।
ওরা দুজনা দরজা বন্ধ ক’রে চলে যায়। জিৎ সিং একা পড়ে থাকে মেঝের ওপর। সে ভাবতে চেষ্টা করে, এতক্ষণ রাম সিং কিল্লার সামনে অপেক্ষমাণ দুশো লোকের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে কি না। না পৌঁছলেও পৌঁছে যাবে শিগগিরই। তার কিছুক্ষণ পরেই তারা রওনা হবে। সোজা চলে যাবে ঢোলপুর। ঢোলপুরে কোথায় লীলাবতী থাকে রাম সিং নিশ্চয়ই জেনে নিয়েছে। জেনে নিতে আর বিন্দুমাত্র অসুবিধাও নেই। হাতে তার অনেক লোক। আসলে সে তো রাম সিং নয়, সে তফিলউদ্দিন।
ভাবতে ভাবতে শরীরের অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও একটু তন্দ্রা এসেছিল জিৎ সিং-এর। সেই সময়ে খুট ক’রে শব্দ হয় দরওয়াজায়। চমকে চেয়ে দেখে জিৎ, দরওয়াজা খুলে একটি ছায়ামূর্তি ভেতরে আসছে। ভেতরে বাতির আলো ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। তাই প্রথমটা চিনতে পারেনি জিৎ। মূর্তিটি আর একটু কাছে এলে সে চিনতে পারে। রহিমবক্স।
চোখ বন্ধ করে জিৎ। ঘুমের ভান ক’রে থাকে। কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে রহিমবক্সের? নিজেরই আস্তানায় চোরের মতো কেন আসছে সে? সে-কি খুন করতে চায় তাকে? ঘোড়া নিয়ে যাবার প্রতিশোধ? তাহের আর জাফরকে আহত করার প্রতিশোধ? তফিলউদ্দিনের দ্বারা ধৃত ব্যক্তিকে সে আর কারও সামনে শেষ ক’রে দিতে চায় না। তাই বোধহয় কৌশলে জাফরকে তখন সরিয়ে দিল। দলের কাউকে বিশ্বাস নেই। তফিলকে বলে দিতে পারে জাফর। আর তফিল হল স্বয়ং বাদশাহের কর্মচারী।
জিৎ সিং মনে মনে একলিঙ্গকে প্রণাম জানায়। এ তুমি ভালোই করলে ঠাকুর। শাপে বর হল আমার। লীলাকে রক্ষা করার ক্ষমতা যখন নেই আমার, তখন তার লাঞ্ছনার আগেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো। আমার প্রার্থনা তুমি শুনেছি ঠাকুর। তোমার দয়ার অন্ত নেই।
চোখ বুজে শান্তভাবে অপেক্ষা করে জিৎ সিং।
রহিমবক্স কাছে আসে। ঝুঁকে পড়ে জিৎ-এর ওপর। তারপর তাকে মৃদু ধাক্কা দেয়।
—কে? রহিমবক্স?
—হ্যাঁ আমি। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই।
—তাতে তো আমার কিছু এসে যায় না।
—এতক্ষণে ওরা ঢোলপুরের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অশ্বারোহীর দল।
জিৎ সিং-এর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সে রহিমবক্সের মুখের দিকে চাইতে পারে না। কারণ রহিমও তাকে কষ্ট দিতে এসেছে। কষ্ট দিয়ে সে-ও কিছুটা সুখ পেতে চায়। তার মনেও রয়েছে অপমানের জ্বালা। তারই ঘাঁটি থেকে অশ্বটিকে ও-ভাবে নিয়ে যাওয়ায় তার সুনামের ওপর যথেষ্ট কালি লেপে দেওয়া হয়েছে।
রহিমবক্স ফিসফিস করে বলে,—জিৎ সিং, আমি তোমায় মুক্ত ক’রে দিতে এসেছি।
জিৎ সিং ভাবে এও এক ধরনের রসিকতা।
তার নির্বিকার চোখের দিকে চেয়ে রহিম আবার বলে,—আমার কথায় বিশ্বাস কর জিৎ এই দেখ অস্ত্র এনেছি তোমার বাঁধান কেটে দেব বলে।
জিৎ সিং বিস্ময়ে চেয়ে দেখে সত্যিই রহিমবক্স তৎপরতার সঙ্গে একটির পর একটি দড়ি কেটে দেয়।
—তুমি সত্যিই আমায় ছেড়ে দিচ্ছ রহিমবক্স?
—হ্যাঁ।
—কিন্তু কেন?
—কৃতজ্ঞতা বলতে পার। সেদিন তুমি আমায় সুযোগ পেয়েও হত্যা করনি। তারই প্রতিদান। নিজেকে আমি ঋণী রাখি না জিৎ সিং। আমি খাঁটি মুসলমান। আমার বাবা দিনের অধিকাংশ সময় কোর-আন্-শরীফ পাঠ করে কাটাতেন। তাঁর ছেলে হয়েও সঙ্গদোষে আমি খারাপ হয়েছি। তাই বলে নষ্ট হয়ে যাইনি। আমি খাঁটি মুসলমান জিৎ।
জিৎ সিং কিছুক্ষণ পরে মেঝের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে একদৃষ্টে রহিমবক্সের দিকে চেয়ে থাকে। তার চোখের পলক পড়ে না।
রহিমবক্স জিৎ-এর তলোয়ারখানা কোষ সমেত হাতে এনে দিয়ে বলে,—পালাও। জাফর কখন উঠে পড়বে ঠিক নেই। তার মগজ নেই, কিন্তু সে কর্তব্যপরায়ণ।
—কিন্তু!
—কোনো কিন্তু নয়। চলে যাও।
—আমি ফিরে এলে আমার ঘোড়াটা তোমায় এমনিতে দিয়ে দেব রহিম।
—কারও দান আমি চাই না। যদি পারি চুরি ক’রে নেব। কিংবা তোমাকে খুন ক’রে নেব এখন আর আমি কোনোরকম কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ নই।
—বেশ। আমিও তোমায় পেলে ছাড়ব না।
রহিমবক্স জিৎ সিং-এর পিঠ থাবড়ে আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে,–এই তো মরদের মতো কথা। শোধবোধ। এর পর দেখে নেব।
জিৎ সিং রহিমবক্সের হাতে সজোরে চাপ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে বের হয়ে যায়। যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। ভোরের আলো ভালোরকম ফুটে উঠেছে। উধমের কাছে গিয়ে ঘোড়াটিকে নিতে হবে। তারপর ছুটতে হবে ঢোলপুরের দিকে। একা সেখানে গিয়ে, কিছুই হয়তো সে করতে পারবে না। তবু তাকে চেষ্টা করতে হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। উধম যথার্থ অনুমান করেছিল। লীলাবতীর পত্র পেয়ে সে জিৎকে বলেছিল, এই পত্রটির সঙ্গে অশ্বের কোনো যোগসূত্ৰ রয়েছে। উধমের অনেক অনুমানই এই রকম ঠিক নয়।