আগ্রা – ১০

১০.

উধমের কাছে এসে জিৎ বলে,–কি ব্যাপার? অমন ক’রে মাটি কাঁপাচ্ছে কেন?

উধম কিছুক্ষণ গুম্ হয়ে থেকে বলে,—সব কিছুরই বাড়াবাড়ি খারাপ।

—হ্যাঁ। শুধু প্রেম ছাড়া।

—কিন্তু সময়ের জ্ঞানটুকু না হারানোই উচিত।

—বলছ কি উধম? প্রেমের সময় যে অনন্ত। প্রেমের বেলায় সময় নিজেই তার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে থাকে। তাছাড়া তুমিই না বলেছ, এ-সুযোগ হাতছাড়া করা মূর্খতা।

—এখনো বলি সেকথা।

—তুমি ঠিক কথাই বলেছ উধম। প্রিয়া হল খবরোত্রী।

—খবরোত্রী? সেটি আবার কি জিনিস।

—গঙ্গোত্রীর মতো আর কি। সব খবরই প্রিয়ার মুখ থেকে নিঃসৃত হয়। আজ যেমন হল।

উৎসুক উধম প্রশ্ন করে,—কোন্ খবর?

—আগ্রা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হচ্ছে।

—কোথায়?

—সিক্রিতে।

—সম্ভব নয়।

—বাদশাহ্ নিজের মুখে বলেছেন প্রিয়াকে।

—কিন্তু সেখানে যে জলাভাব। অত মানুষ বাস করবে কিভাবে?

—বাদশাহ্ ইচ্ছে করলে জলাভাব দূর করতে পারেন না?

—হয়তো পারেন। কিন্তু প্রচুর খরচ।

—খরচ তিনি করবেন।

—দেখা যাক।

জিৎ বলে,—খবরটা আগে থেকে যখন পাওয়া গেল, তখন তার সদ্ব্যবহার করলে হয় না?

—ভেবে দেখব জিৎ।

—ভাবো। আমিও ভাবি।

—ভাববার আগেই একটি জিনিস আমার মাথায় এসে গেছে। বিশ্বস্ত একজন লোককে পাঠিয়ে একটা সরাইখানা খুলতে হবে। আমার থাকার জায়গা মিলবে ওখানে গেলে। কিন্তু তোমার তো নেই। অথচ ইচ্ছে করলেই জুটিয়ে নিতে পার।

—কি রকম?

—রাজা মান সিংহ অনেকবার তোমাকে সৈন্যদলে ভালো চাকরি দিতে চেয়েছেন। অন্তত পাঁচশো লোকের সেনাপতি হতে পারবে তুমি।

—আমাকে নিতে বলছ?

—বুঝে উঠতে পারছি না।

—বুঝে আর দরকার নেই উধম। বেশ আছি। স্বাধীন। কেউ খবরও নেয় না কখন কোথায় যাই। মান সিংহের দলে গেলে আমার গতিবিধি হয়ে পড়বে সীমাবদ্ধ।

—তোমার বন্ধু তফিলউদ্দিন সম্ভবত এতক্ষণে জেনে ফেলেছে তুমি এখানে রয়েছ।

—তুমি সত্যি কথা বলছ উধম?

—হ্যাঁ। খবরটা তোমায় দেব বলেই এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছটফট করছিলাম। আজই এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যেখানে দৈব্যক্রমে আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু তার আগে একটি ছোট্ট প্রশ্ন করব জিৎ। কিছু মনে করবে না তো?

জিৎ সিং তার মনের উত্তেজনাকে যথাসম্ভব প্রশমিত করে বলে,—না। তাড়াতাড়ি বল।

—লীলাবতীকে এখনো মনে রেখেছ তুমি?

জিৎ সিং উধমের হাত দুটো সাঁড়াশীর মতো শক্ত করে চেপে ধরে। তার ওষ্ঠদ্বয় থরথর ক’রে কেঁপে ওঠে। সে আপ্রাণ চেষ্টায় কয়েকবার ঢোক গিলে ফিসফিস ক’রে বলে,–কোথায় জানলে তুমি এ নাম? কোথায়? বল।

উধম চেষ্টা ক’রেও তার হাতদুটো জিৎ সিং-এর মুঠো থেকে মুক্ত করে নিতে পারে না। বাবার তলোয়ারখানা চেপে ধরার মতো সে উধমের হাত দুটো চেপে ধরে রাখে।

শেষে নিরুপায় হয়ে উধম বলে,—সব বলছি। একটু শান্ত হাও, স্থির হও জিৎ। বলব বলেই তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি প্রকৃতিস্থ হও। তোমায় তো কোনো অবস্থাতেই এত বেশি বিচলিত হতে দেখিনি।

জিৎ সিং-এর হাতের মুঠো শিথিল নয়। সে উধমের মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে।

উধম বলে,—একজন নতুন মুখের রাজপুতকে আজ সকালে দেখা গিয়েছিল আগ্রার রাজপথে নতুন মুখের রাজপুত দেখলেই আমি তাকে অনুসরণ করি। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই অর্থোপার্জনের জন্যে এখানে এলেও এক-আধজন তোমার মতো কঠিন সংকল্প নিয়েও আসতে পারে, এই আমার আশা। এ পর্যন্ত আমার আশা একবারও পূর্ণ হয়নি। অথচ হাল ছাড়িনি আমি। নতুন লোক দেখলে এখনো যাই। আজও সেইরকম যাচ্ছিলাম নতুন লোককে অনুসরণ ক’রে। লোকটিকে দেখে মনে হল, সে খুব সতর্কতার সঙ্গেই পথ চলছে। কাউকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা না ক’রে সে প্রতিটি লোকের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে তার পাশে গিয়ে উপস্থিত হই। সে আমাকে দেখে একটু যেন চমকে ওঠে। আমি তাকে প্রশ্ন করি—কাউকে খুঁজছে নাকি সে। উত্তরে সে ঘাড় নাড়ে। আমার কিন্তু সন্দেহ যায় না। ঠিক সেই সময়ে তোমাদের তফিলউদ্দিন ঘোড়ায় চড়ে সেই পথ ধরে যাচ্ছিল। রাজপুত দেখতে পেয়ে সে এগিয়ে আসে। কাছে এসেই তার মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক ধ্বনি বার হয়। আর লোকটিও তফিলউদ্দিনের চাপদাড়ি ভেদ করে তাকে চিনে ফেলে। অবাক্ হয়ে বলে ওঠে—রাম সিং? ব্যাপার দেখে আমি দূরে সরে গিয়ে অপেক্ষা করি। তফিলউদ্দিনের সঙ্গে তার কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। কি কথা হয় আমি শুনতে পাই না। তবে তখনি তফিল ঘোড়া থেকে মাটিতে নেমে পড়ে। নেমেই, রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে লোকটির দেহে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান চালায়। আমি লক্ষ্য করি তফিলউদ্দিন যখন লোকটির দেহ অনুসন্ধান ব্যস্ত তখন সে গোপনে তার হাতের মুঠো থেকে একটি জিনিস মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে ধরে। তারপর তফিলউদ্দিন তাকে নিয়ে ঘোড়াটির লাগাম ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। দেখে মনে হল, লোকটির কাছে সে যা জানতে চেয়েছিল লোকটি তা বলতে অস্বীকার করছে। তাই অত্যাচার করে তার পেট থেকে কথা বের করে নেবার জন্যেই ধরে নিয়ে গেছে। তারা চলে গেলে, আমি লোকটির ফেলে দেওয়া জিনিসটি তুলে নিয়েছিলাম।

—সেই জিনিসটি কি?

—একটি পত্র। তোমাকেই লেখা। লিখেছে লীলাবতী নামে একজন স্ত্রীলোক।

—কোথায় সেই পত্র?

উধম ধীরে ধীরে সেটি বের করে বলে,—এই নাও।

কম্পিত হস্তে পত্রটি নিয়ে জিৎ সিং সেখানেই মাটির ওপর বসে পড়তে চায়। উধম বাধা দিয়ে বলে,—এখানে নয় জিৎ। একটু পরেই বীরবল-কন্যা আসবে। তার চেয়ে পেছনের দিকে অশ্বশালায়। তোমার ঘোড়াটিকে বহুদিন দেখোনি, দেখবে চল। কেমন যত্নে রেখেছি। কারণ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই পত্রটির সঙ্গে ওই ঘোড়ার কোনো যোগসূত্র রয়েছে।

উধমের কোনো কথা জিৎ সিং-এর কানে যায় না। সে আচ্ছন্নের মতো উধমকে অনুসরণ করে অশ্বশালার পাশে একটি গাছের গোড়ায় বসে পড়ে।

দীর্ঘপত্র। পত্রটির মধ্যে যা লেখা রয়েছে তা জিৎ সিং-এর অবচেতন মনে পোষিত এক আশাকে কঠিন আঘাতে ভেঙে চুরমার করে দেয়।

জিৎ‍,

তোমায় কখনো পত্র লিখতে হবে ভাবিনি। অথচ আজ জীবনের এক মহা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছে না লিখেও থাকতে পারছি না। এ পত্র কবে তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছবে জানি না। আদৌ পৌঁছবে কি না তাও জানি না। কারণ এখনো এমন লোককে পাইনি যার হাতে এটিকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি। কাল উদয়পুর (জায়গাটিকে সবাই এখন এই নামে ডাকতে শুরু করেছে) ছেড়ে যাব। চিরদিনের মতো ছেড়ে যাব। যদি কোনো লোককে ঠিক করতে না পারি তবে এই পত্র যশোবত্তের হাতে দিয়ে যাব। সে-ই আগ্রায় পাঠাবার ব্যবস্থা ক’রে দেবে।

জিৎ, তোমার আমার মনোভাবের কথা তোমার অজানা নয়। তুমি চলে যাবার পর এমন একটি রাতও কাটেনি, যে রাতে স্বপ্নের মধ্যে তোমাকে শিমুলগাছের নীচে কিংবা উদয়সাগরের তীরে না দেখেছি। এক একটি স্বপ্ন এতই মধুর যে স্বপ্ন বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত। অত সোহাগ, অত আদর বাস্তবেও তোমার কাছে পেয়েছি কিনা মনে নেই। কিন্তু জিৎ, স্বপ্নে তো অন্য কোনো কথা মনে থাকে না। স্বপ্নে মনে থাকে না—তুমি কোন্ কাজে এখন ব্যাপৃত রয়েছ তাই ঘুম ভেঙে গেলে প্রতিবারই কেঁদেছি। কেঁদেছি, কারণ সত্যিই যদি ওভাবে তুমি আসতে আমার কাছে, আমি বরণ ক’রে নিতে পারতাম না। তুমি বলবে সংস্কার। হয়তো তাই, কিন্তু এই, সংস্কার আমার জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা রয়েছে। এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই জিৎ। তুমি আমার কাছে থাকবে, অথচ মুহূর্তের জন্যেও তোমায় আমি অশ্রদ্ধা করব, মুহূর্তের জন্যেও তোমার প্রতি আমার মনে কোন ঘৃণাভাবের উদ্রেক হবে এ চিন্তা অসহনীয়। তাই একান্ত তোমার হয়েও আজ আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি জিৎ।

দূরে সরে যাচ্ছি বলেই এই চিঠি আর তার সঙ্গে এই রাখী। রাখীটি তোমার হাতে পরে নিও রাগ করো না। শুধু এই রাখীর সম্পর্ক ছাড়া আর অন্য সম্পর্ক রাখার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। তোমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারলেই বোধহয় ভালো হত। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি দুর্বল। তাই এই রাখী। তুমি হয়তো বলবে—ঘৃণিত ভাইকেও তো পরিত্যাগ করা উচিত। হয়তো তাই, তবু ঘৃণা করেও ভাই-এর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার যে স্বর্গীয় সম্পর্ক তার মধ্যে সামান্যতম ঘৃণা মিশলে সব নষ্ট হয়ে যায়।

জিৎ, এই পত্রটি বড় তাড়াতাড়ি লিখছি। পাশের কুটিরে যশোবন্ত মাঝে মাঝে রোগযন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠছে। তার কাছে আমায় যেতে হবে। কিছুদিন হলে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শয্যা ছেড়ে কোনোদিন আবার উঠবে কি না জানি না। একলিঙ্গের আশীর্বাদ থাকলে নিশ্চয়ই উঠবে। নইলে কালপীর এই দলকে এত দুর্ভগ্যের মধ্যে দিয়ে কে চালনা ক’রে নিয়ে যাবে? যশোবন্তকে আজ সারারাত ধরে সেবা করব। কারণ সেবা করার সুযোগ আর কোনোদিনই পাবো না। আমার বাবা মৃত্যুর আগে আমার ভার দিয়ে গিয়ে ছিলেন এই সর্দারের ওপর। বৃদ্ধ হয়েও সর্দার তা সুষ্ঠুভাবে পালন করেছে। সর্দারের সহায়তাতেই একদিন তোমার সঙ্গে মিলতে পেরেছিলাম আমি। আজ তুমি থেকেও নেই, তাই সর্দার বড় চিন্তাকুল হয়ে পড়েছিল,তারপর যখন সে অসুস্থ হয়ে পড়ল, তখন মনের জোর কিছুই অবশিষ্ট রইল না তার। প্রতিদিন সে চোখের জল ফেলত আর বলত —গোপাল সর্দারকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না লীলা।

তাই উদয়সাগরের তীরে বেড়াতে এসে প্রৌঢ় জয়পাল সিং যখন আমায় দেখতে পেয়ে যশোবন্তের শয্যার পাশে গিয়ে আমার পাণি প্রার্থনা ক’রে বসলেন, তখন বৃদ্ধ সর্দারের চোখের মধ্যে যে আকুলতা ফুটে উঠল, সেই আকুলতাকে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না। আজ এই নিঝুম রাতে আমার বুক কান্নায় ফেটে যাচ্ছে জিৎ, তবু মনে হচ্ছে এ বরং ভালোই হল। সারা জীবন একা একা কাটত। তার চেয়ে বরং আশ্রয় মিলল। যশোবন্তও শান্তিতে চোখ বুঝতে পারবে। বৃদ্ধের প্রতি এই আমার কর্তব্য।

জিৎ, তোমার জীবন থেকে আমি অনেক দূরে সরে গেলাম। কিন্তু তোমাদের আগ্রার অনেক কাছে চলে যাব আমি। জয়পাল সিং ঢোলপুরের লোক। শুনেছি আগ্রার দূরত্ব সেখান থেকে নাকি সামান্যই। সেখানে জয়পাল সিং-এর একটি গৃহ রয়েছে। গৃহটি নাকি দুর্গের মতো সুরক্ষিত। আমি চলেছি সেই দুর্গের কর্ত্রী হয়ে।

বিদায় জিৎ—
লীলাবতী।

চিঠিখানা পড়ে অনেকক্ষণ একইভাবে বসে থাকে জিৎ সিং। তারপর সেটিকে সযত্নে ভাঁজ করে বুকের ভেতর রেখে দেয়।

সে চোখ বন্ধ করে। অনেকক্ষণ বন্ধ ক’রে বসে থাকে। তার খেয়াল থাকে না। দু’চোখ বেয়ে সমানে জল গড়িয়ে পড়ছে। যখন খেয়াল হয়, সে লজ্জিত হয়ে মুছে ফেলে উধমের দিকে চায়

—রাখীটি কোথায় উধম?

—পাইনি, সম্ভবত সেটি আলাদা জায়গায় ছিল। তফিলউদ্দিন পেয়ে থাকবে।

—তোমার কাছে আমার কিছুই লুকোনো রইল না।

—হ্যাঁ। এতদিনে বুঝলাম, বীরবল-কন্যার মতো মেয়েকে পেয়েও কেন তুমি অবহেলা কর যে মেয়ে এমন চিঠি লিখতে পারে, বীরবল-কন্যা তার পায়ের উপযুক্তও নয়।

—কিন্তু লীলাবতী অতি সাধারণ মেয়ে উধম।

—লীলাবতী খাঁটি রাজপুত নারী। যে সামান্য কয়েকজন রমণীকে আমি শ্রদ্ধা করি, আজ থেকে তার আর একটি সংখ্যা বৃদ্ধি পেল।

—কিন্তু আমি প্রিয়াকে ভালোবাসতে শুরু করেছি উধম।

উধম একটু হাসে। বলে,—ভালো কথা। পারলে তো ভালোই। তবে আমার বিশ্বাস হয় না। তুমি লীলাবতীকে ভুলে যাবার জন্যে নিজেকে ভুল বোঝাচ্ছ জিৎ। তুমি তোমার প্রিয়াকে সামনে রেখে লীলাবতীকে কল্পনা করে তাকে ভালোবাসছ।

জিৎ সিং প্রবল প্রতিবাদ করে। তার প্রতিবাদের তীব্রতা উধমকে স্তব্ধ ক’রে দেয়। সে উঠে জিৎ সিং-এর ঘোড়াটির কাছে যায়। তাকে আদর করে কিছুক্ষণ। তারপর আবার ফিরে আসে চিত্তাকুল জিৎ-এর পাশে।

—আমি ভাবছি জিৎ, অদৃষ্টের পরিহাসের কথা

—কার অদৃষ্টের কথা বলছ উধম?

—লীলাবতীর। সেই রমণী কেন তোমায় গ্রহণ করতে পারেননি আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এত লোক থাকতে শেষে জয়পাল সিং-এর ঘরে গেলেন তিনি?

—কেন? জয়পাল সিং কে?

—আগ্রার কাছাকাছি আমাদের যে স্বল্পসংখ্যক হিতৈষী রয়েছেন তিনি তাঁদেরই একজন। যদি কখনো কোনো বিপদে পড়, সোজা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাবে ঢোলপুরে। তিনি আশ্রয় দেবেন। এমন ভাবে আশ্রয় দেবেন যে কারও সাধ্য নেই খুঁজে বের করে। তাঁর গৃহে নাকি চোরা-কুঠুরী রয়েছে। সম্ভবত এই সব কারণেই তাঁকে উদয়পুর থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কে তাঁকে ডেকে পাঠাবে? উদয় সিং? বিশ্বাস হয় না।

জিৎ সিং-এর সব হতাশা, সব মনোকষ্ট দূর হয়। সে সোজা হয়ে বসে বলে ওঠে,—কিকা। কিকা ছাড়া আর কেউ নয়। হয়তো আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তিনি জয়পাল সিংকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

—অসম্ভব নয়।

—কিন্তু কিকাকে তাঁর কথা কে জানালো?

—এসব জানতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। কত লোকই তো আগ্রায় যাতয়াত করে। তাদের সবাই কি আর মুঘল-প্রভুত্বে খুশি? তাদেরই কেউ হয়তো বলে থাকবে জয়পাল সিং-এর কথা। কিংবা আর একজনকে ভুলে যাচ্ছ কেন? ভবঘুরে। তিনি দিতে পারেন এই খবর

—হ্যাঁ, ভবঘুরে গিয়েছিলেন বটে ওখানে। একলিঙ্গের ঠাঁই-এও তিনি থেকেছিলেন কিছুদিন।

—তাই বলছিলাম জিৎ, এরই নাম অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। লীলাবতীর অদৃষ্ট। জয়পাল সিং তোমারই গোত্রের।

—না উধম। জয়পাল সিং দেশপ্রেমিক হতে পারেন। তিনি গুপ্তচর নন আমার মতো। লীলাবতী গুপ্তচরকে ঘৃণা করে উধম।

উধম কোনো কথা বলে না। বলবার মতো কিছু মনেও আসে না তার। সে একদৃষ্টে তার সম্মুখের সুদর্শন যুবকটির দিকে চেয়ে থাকে।

হঠাৎ একসময় জিৎ সিং গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। উধমকে বলে,—আমার সঙ্গে একটু যাবে?

—কোথায়?

—সেই রাজপুতের খোঁজ করব। তাকে কি কিল্লার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?

—না। ভেতরে নিয়ে গেলে বাদশাহের সামনে হাজির করতে হবে। তাঁর সামনে হাজির করতে হলে প্রমাণের প্রয়োজন। তফিলউদ্দিন সে-প্রমাণ পায়নি। সে নিজেই চেষ্টা করবে কথা আদায়ের। তার জন্যে যতটা নিষ্ঠুর হবার প্রয়োজন, হবে সে। ওকে আমি আগে থেকে চিনি জিৎ। তখন জানতাম না ওর ব্যক্তিগত ইতিহাস। ও ছিল বীরবলের বাড়ির রক্ষক। প্রহরীদের দলপতি বলতে পার। ওর নিষ্ঠুরতার অনেক কাহিনী আমার জানা আছে। সেইজন্যেই বোধহয় এত তাড়াতাড়ি উন্নতি ক’রে ফেলেছে। মুঘল-রাজত্বে নিষ্ঠুরতার দাম আছে জিৎ। সব রাজত্বেই হয়তো আছে। তবে আমি সে সব খবর রাখি না।

—চল উধম।

—এখুনি?

—হ্যাঁ, যদি দেরি হয়ে যায়?

—বেশ চল। তবে যাবার আগে রানীমাকে বলে যাব। বীরবল-কন্যা নিশ্চয়ই এতক্ষণে চলে গেছে। তার নিজের শিবিকা আসার কথা ছিল। তবু তুমি একটু সাবধানে বাইরে যাও।

জিৎ সিং অশ্বের দিকে একবার চায়। উধম সত্যিই বড় যত্নে রেখেছে তাকে। বাড়ির পেছনে যতটুকু খোলা জায়গা রয়েছে, তার মধ্যেই ছোটাছুটি করায় দুবেলা। অন্য ঘোড়ার সঙ্গে বাইরে পাঠাবার উপায় নেই। এর মাথায় তো ফুল-ছাপ নেই। ঘোড়াটির কাছে গিয়ে পিঠে হাত দিতেই সে ঘোঁত ক’রে আদরের প্রত্যুত্তর দেয়। তার দু-পা বার বার ওঠানামা করে। ভাবখানা, তোমার জন্যে আর কত অপেক্ষা করব? আমায় একটু ছুটিয়ে দেখ। আগের মতোই চট্‌পটে রয়েছি। তোমার মতো সওয়ার পেলে আমি পক্ষীরাজ হতে পারি।

জিৎ সিং ঘোড়াটির মুখের সঙ্গে মুখ ঘষে। বিড়বিড় ক’রে অনেক কথা বলে তার কানে। তারপর ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যে, রাস্তায় এসে উধমের জন্যে অপেক্ষা করে।

উধম একটু পরেই আসে।

—কোন্‌দিকে যাবে জিৎ?

—যেদিকে রাজপুতকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

—কোন্‌দিকে শেষপর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলতে পারি না। তবে প্রথমে কোন্‌দিকে গিয়েছিল আমি জানি। চল সেদিকেই যাই।

ওরা দুজনা এগিয়ে যায়। রাস্তার দুপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে রাখতে অনেকদূর এগিয়ে যায়। উধম তার পরিচিত যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তাদের কাছে রাজপুতটির হদিশ জানবার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। বলতে না পারাই স্বাভাবিক। আগ্রার রাস্তায় দিনের মধ্যে অমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্রোতের অঙ্গ এটি।

শেষে একসময় জিৎ সিং চেয়ে দেখে সেই পুরোনো মসজিদটির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। উধমকে বলে,—সামনেই রহিমবক্সের আড্ডা।

—ও হ্যাঁ। তাই তো। এক কাজ করলেই পারতে। তোমার ঘোড়াটাকে সঙ্গে আনলে পারতে। রহিমবক্সের হাতে দেওয়া যেত। বেচারা।

—রহিমবক্স মোটেই বেচারা নয়। সে সুযোগের জন্যে ওত পেতে বসে রয়েছে।

—চল আর একবার দেখা করে আসি।

—না।

—ভয় পাও নাকি?

—না। তবে মসজিদের পাশে আমি যেতে চাই না।

—তবে চল পথটুকু ঘুরে যাই।

জিৎ সিং হঠাৎ উধমের হাত চেপে ধরে বলে,—দাঁড়াও, দাঁড়াও। মাধব বের হচ্ছে দেখছি ওখান থেকে। কী ব্যাপার?

—মাধব কে আবার?

—সরাইখানায় সেই ছোকরা চাকর। মালিকের দূত। আমি প্রথম যেদিন সরাইখানায় গিয়ে উঠি, সেদিন ওকেই মালিক পাঠিয়ে ছিল রহিমবক্সের কাছে। আজ আবার কেউ ঘোড়া নিয়ে এসেছে নাকি সেখানে? চল, সরাইখানায় যাই। সাবধান ক’রে দিতে হবে লোকটিকে।

ছোকরাকে ডেকে জিজ্ঞাসা কর।

—না। সন্দেহ করবে। সরাইখানায়। চল।

সেখানে গিয়ে তারা হতাশ হয়। কোনো ঘোড়া নেই। নতুন অতিথিও নেই। মাধব এক জায়গায় বসে অভিনিবেশ সহকারে রাতের খাবারের আয়োজন করতে ব্যস্ত। খুব তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছে সে। মালিক অনুপস্থিত।

—কর্তা কোথায় মাধব?

—তিনি একটু বাইরে গেছেন।

—ও। তুমি একটু এসো তো আমার ঘরে।

জিৎ সিং এভাবে কখনো ডাকে না ছেলেটিকে। সে একটু অবাক্ হয়ে তাই। হাত মুখ মুছে নিয়ে এক পা এক পা ক’রে জিৎ সিং-এর ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়।

সে এসে দাঁড়াতেই জিৎ সিং উধমকে বলে,–এর কথাই বলছিলাম। চমৎকার ছেলে। খুব চট্‌পটে। চুপচাপ কাজ ক’রে যায়। এর মতো ছেলে পেলে বাদশাহ্ নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হবেন।

উধম প্রথমটা অবাক হয়। তারপর জিৎ-এর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে মাধবের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির সম্মুখে মাধব সংকুচিত হয়।

উধম ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,—হুঁ তুমি ঠিকই বলেছ। বাদশাহ্ পছন্দ করবেন। পৃথ্বীরাজ রাঠোরকে আজই গিয়ে বলব। দু-চারদিন পরেই খবর পাবে তুমি। তখন একে পাটিয়ে দিও, মোটা টাকা মিলবে। ছোকরার ভাগ্য ফিরে যাবে। তোমার দয়াতেই ও বড়লোক হয়ে যাবে।

মাধব বিহ্বল দৃষ্টিতে একবার উধম, একবার জিৎ সিং-এর দিকে চায়।

জিৎ বলে,–কিন্তু একে এখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি। রাজি নাও হতে পারে। সরাইখানায় হয়তো মোটা পয়সা পাচ্ছে।

চিৎকার করে ওঠে মাধব,—আমি রাজি। আমি এক্ষুনি যেতে রাজি আছি। এখানে মানুষ থাকে? শুধু চোর-ডাকাতের খোশামোদ করা। কবে দুটো পয়সা পাবো, তার জন্যে হাঁ করে পড়ে থাকো। আপনারা দয়ালু। তাই আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করবার জন্যে এগিয়ে এসেছেন।

জিৎ সিং অবাক্ হবার ভান করে বলে,—কিন্তু চোর-ডাকাতের কথা কি বলছ মাধব?

চোর নয়? ডাকাত নয়? তবে কি? রহিমবক্স ভালোমানুষ? আপনার ঘোড়া কে চুরি করেছিল? আপনি তো জানেনই। আপনাকে খুনও করত এতদিনে। প্রথমে ভয়ে পারেনি। আর এখন তো পারবেই না। আপনি রাজা মান সিংহের লোক। আপনি সব কথা রাজাকে জানিয়ে রেখেছেন। সরাইখানায় যদি আপনি খুন হন, ও ব্যাটাদের গর্দান যাবে। তাই শুধু চেপে আছে। নইলে কবে শেষ হয়ে যেতেন। আমি সব জানি।

ছেলেটি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার এতদিনের জমানো আক্রোশ আর দুঃখ বাঁধ ভেঙে যেন নিসর্গ হয়ে পড়ে। তার বুকের হাড়গুলো ওঠানামা করে। জিৎ সিং প্রথম লক্ষ করে ছেলেটি কত রুগ্‌ণ। তার মন সমবেদনায় ভরে ওঠে। মনে মনে স্থির করে প্রথম সুযোগেই ছেলেটিকে এখান থেকে উদ্ধার করবে সে।

উধম উঠে গিয়ে মাধবকে কাছে বসায়। এভাবে জিৎ সিং-এর শয্যায় বসতে সে কখনওই সাহস পেত না। কিন্তু এখন সে স্বাভাবিক নয়। তার জ্ঞান নেই, সে উত্তেজনায় কাঁপছে। চোখের জলে তার বুক ভাসছে।

উধম তাকে শান্ত করে অনেক চেষ্টায়।

জিৎ ধীরে ধীরে বলে,—রহিমবক্স সত্যিই খারাপ মাধব? সে খুনে?

—হ্যাঁ।

—তবে তুমি আর কাছে যেতে কেন?

—মালিক পাঠাতো। গেলে পয়সা পেতাম। মালিক আমাকে শুধু খেতে দেয়। পয়সা দেয় না।

—একটু আস্তে কথা বল। কখন সে চলে আসবে ঠিক নেই।

—এখন আসবে না। আমি জানি সে কোথায় গেছে।

—তুমি বললে সে বাইরে গেছে?

—হ্যাঁ বাইরে। কিন্তু কোথায়, তাও জানি। আমি সেখান থেকেই আসছি। মালিকের আসতে দেরি হবে বলে, আমাকে পাঠিয়ে দিল।

—কোথায় গেছে সে?

—রহিমবক্সের ওখানে। একজন রাজপুতকে ধরে নিয়ে এসেছে, রহিমবক্সের এক দোস্ত। তাকে ধরে কী ভীষণ মারল ওরা। মারতে মারতে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছে।

উধম আর জিৎ সিং-এর মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় নয়। শান্ত কণ্ঠে উধম প্রশ্ন করে,—কেন মারছে তাকে ওরা?

—সে প্রথমে কথা বলতে চাইছিল না। এখন বলছে। এখন ওদের কথার জবাব দিচ্ছি একটু একটু। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে অনেক কথারই জবাব দিচ্ছে।

—তুমি শুনেছ সব?

—না। আমায় শুনতে দেবে না বলেই পাঠিয়ে দিল। সব বুঝি আমি

এবারে জিৎ সিং প্রশ্ন করে, –একটুও শোনোনি তুমি?

—হ্যাঁ, একটু শুনেছি। আপনার নাম বলছিল লোকটি। আর বলছিল ঢোলপুরের কথা। ওর কথা শুনে রহিমবক্সের দোস্ত কী বিশ্রী হাসি হাসছিল।

জিৎ সিং কেঁপে ওঠে। লোকটি লীলাবতীর চিঠি পড়েছে কি না সে জানে না। পড়লেও বুঝতে পেরেছে কি তার কাজের কথা? লীলাবতী শুধু লিখেছে—’স্বপ্নে মনে থাকে না, তুমি কোন্ কাজে এখন ব্যাপৃত আছ।’ এর থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা কি সম্ভব?

জিৎ সিং ঘরময় পায়চারি শুরু করে। লোকটিকে যত শীঘ্র সম্ভব তার চাই। আসল সত্য জেনে নিতে হবে তার কাছ থেকে। সে উধমের সামনে এগিয়ে যায়।

উধম হাত উঁচিয়ে তাকে শান্ত হতে বলে ছেলেটিকে প্রশ্ন করে,—রাজপুতকে ওরা ছেড়ে দেবে কি?

—শুনলাম ছেড়ে দেবে। রহিমবক্সের দোস্ত-এর দেশের লোক নাকি সে। এককালে দুজনার মধ্যে ভাবও ছিল খুব।

—ঠিক আছে আমাদের সঙ্গে তোমার যে সব কথা হল, কাউকে বলো না। তোমার চাকরি কিছু দিনের মধ্যেই ঠিক করে দেব।

ছেলেটির কান্না অনেক আগেই বন্ধ হয়েছিল। ঘর ছেড়ে যাবার সময় তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

জিৎ উধমকে প্রশ্ন করে,—এবারে?

—মসজিদের কাছে অপেক্ষা করতে হবে লোকটির জন্যে।

—রহিমবক্সের সঙ্গে রাম সিং-এর এত মাখামাখি, অথচ সে জানত না আমি এখানে আছি?

—সে হয়তো কল্পনাই করেনি আগে।

—রণথম্ভোরে সন্দেহ হবার পরও?

—সম্ভবত।

জিৎ সিং হেসে বলে,—তফিলউদ্দিন আর যাই হোক বুদ্ধিমান নয়। অবিশ্যি বুদ্ধিমান না হয়েও সে আমাকে প্রায় কোণঠাসা করে এনেছে। জানি না রাজপুতটি আমার সম্বন্ধে কতখানি বলেছে।

আবার পথে বের হয় তারা দুজনা। মসজিদের কাছে উধমের একটি চেনা দোকানে তারা উভয়ে অপেক্ষা করে। জিৎ সিং বাইরে বসতে ভরসা পায় না। দোকানদারের পেছনে একটি আসনে বসে থাকে সে। উধম বাইরের দিকে বসে রাস্তার পানে চেয়ে থাকে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়। কেউ বাইরে আসে না মসজিদের পাশের সেই বাজারের গলি দিয়ে। তফিলউদ্দিন হয়তো অনেক আগেই চলে গেছে। রহিমবক্স তার দলবল নিয়ে ভেতরে বসে আড্ডা জমিয়েছে এতক্ষণে। সরাইখানার মালিকও নিশ্চয় রয়েছে সেই দলে।

সন্ধ্যা একটু গাঢ় হয়।

উধম জিৎ সিংকে বাইরে ডাকে। ফিসফিস করে বলে,—তফিলউদ্দিন এতক্ষণ ছিল ওখানে। এইমাত্র চলে গেল। ওই দেখ তোমার সরাইখানার কর্তাটি হেলতে দুলতে বের হয়ে আসছে।

—আমি ভেতরে যাই।

—কোনো প্রয়োজন নেই। ওরা এদিকে আসবে না।

—দোকানদার লোকটি ভালো তো?

—খুব ভালোমানুষ। মাঝে মাঝে কাজের অবসর পেলে ওখানে এসে বসি আমি। সন্দেহ করে না। তবে এখন যদি আবার তুমি তার পেছনে বসতে চাও তবে কী হবে জানি না। ভালো মানুষের মধ্যেও বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে একটু আধটু।

সেই সময়ে একজন লোক মসজিদের পাশ থেকে বের হয়ে আসে। তার দেহে অসীম ক্লান্তি। সে পা দুখানি টেনে টেনে চলে। যে কোনো মুহূর্তেই যেন পড়ে যাবে।

উভয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটির দেহের ক্লান্তি আর বেদনা তারা নিজেদের রক্তমাংস আর স্নায়ু দিয়ে যেন অনুভব করে। বেচারা হয়তো অনেক কথাই বলে ফেলছে। কিন্তু তাতে তার দোষ হয়নি। কেউ তাকে শিখিয়ে দেয়নি সব কিছু গোপন রাখতে। তার ওপর বড়জোর নির্দেশ ছিল, পত্রটি অন্য কারও হাতে যেন না পড়ে। সেই নির্দেশ সে যথাসম্ভব পালন করেছে। কৌশলে পত্রটি পায়ের কাছে ফেলে দিয়েছে।

লোকটি ধীরে ধীরে দোকানের পাশে আসে। দোকানের সামনে বসবার স্থানটির দিকে লোলুপদৃষ্টিতে চায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেই মাথা ঝাঁকায়। বসতে চায় না সে। এগিয়ে যেতে চায়। বোধহয়, পত্রটি রাস্তার যে জায়গাটিতে ফেলেছিল, সেখানে যেতে চায়। পত্রটিকে উদ্ধার করাই তার উদ্দেশ্য। কারণ শুধু ওইটির জন্যই সে গিরো উপত্যকা ছেড়ে এতদূরে ছুটে এসেছিল। যথাস্থানে সেটিকে পৌঁছে না দিয়ে কোন্ মুখ নিয়ে সে ফিরবে নিজের দলের মধ্যে। সে ফিরতে পারে না। অনেক রাজপুতই ফেরে না। তারা আত্মহত্যা করে।

রাজপুতটি উধমের দিকে তাকায়। কিন্তু চিনতে পারে না তাকে। তার চোখে তখন পৈশাচিক নির্যাতনের অবসাদ। তবে দৃষ্টির জ্যোতি অন্তর্হিত। সে বিড়বিড় ক’রে কী যেন বলে। সে দু-পা এগিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে দোকানের সামনে।

অনেক কষ্টে একটু ঢোক গিলে পানীয় জল চায়।

দোকানদার তার অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়। সে তাড়াতাড়ি উঠে ভেতরে যায় জল নিয়ে আসতে। আর জিৎ সিং তার দিকে চেয়ে তাকে এক মুহূর্তেই চিনে ফেলে। লোকটির নাম তার ঠিক মনে পড়ে না। তবে কালপীর দলে যে প্রৌঢ় ব্যক্তিটি রয়েছে, তার সঙ্গে এর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে আপ্রাণ ভাবতে চেষ্টা করে তার নাম। লক্ষ্মণ—খুব সম্ভব লক্ষ্মণ কিংবা ‘ল’ দিয়ে অন্য কিছু।

দোকানদার জল এনে দেয়। সে পান করে। তাড়াতাড়ি পারে না। একটু একটু ক’রে পান করে, যেন গরম দুধ পান করছে। তারপর সুস্থির হয়। কিছুক্ষণ মাথা নীচু ক’রে থেকে সে বলে,

—বন্ধুও শত্রু হয়, জানেন?

দোকানদার হেসে বলে,–এ আর নতুন কথা কি? বন্ধু তো সর্বত্রই শত্রু হয়। রাজপুত মাথা ঝাঁকায়।

দোকানদার আবার বলে,—কেন, আপনি জানতেন না?

—না।

লোকটি এগিয়ে যায় অন্ধকারের মধ্যে। সন্ধ্যা গাঢ়তর হয়ে উঠেছিল।

উধম আর জিৎ সিং তাকে অনুসরণ করে। অনেকদূর এগিয়ে যায় সে টলতে টলতে। শেষে সেই আগের জায়গাটিতে এসে দাঁড়ায়। এইখানেই তফিলউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে মাটির দিকে চেয়ে চারদিকে খুঁজতে শুরু করে।

উধম তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে,—কিছু খুঁজছেন?

সে উধমের দিকে তাকিয়ে বলে,–না, কিছু না। কিন্তু আপনাকে কোথায় দেখছি?

—এইখানেই। তফিলউদ্দিন আপনাকে নিয়ে যাবার আগে, আমার সঙ্গেই তো কথা বলেছিলেন আপনি

—ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তফিলউদ্দিন, ওর নাম তফিলউদ্দিন হয়েছে বটে।

—ওকে আপনি চিনতেন বুঝি?

—হ্যাঁ। চিনতাম বৈ কি। ওর স্বভাবের পরিচয় পেয়েও ওকে পছন্দ করতাম এক সময়ে।

—এখন আর করেন না পছন্দ?

—এখন? লোকটি হেসে ওঠে। ভাঙা ভাঙা হাসি। সে আর কিছু না বলে খুঁজতে থাকে পথের এদিকে ওদিকে।

সেই সময় জিৎ সিং একটু দূর থেকে ডেকে ওঠে,—লক্ষ্মণ।

চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ায় লোকটি। উধমকে বলে,–কে, কে ডাকল?

উধম তার আঙুল দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে জিৎ সিংকে দেখিয়ে দেয়।

—কে ও?

জিৎ সিং এবারে একেবারে কাছে আসে। তবু তাকে চিনতে পারে না লক্ষ্মণ। উধম রাস্তার পাশের একটি বাড়ি থেকে মশাল নিয়ে আসে। সেই মশালের আলোয় জিৎ সিংকে দেখে সে চিৎকার ক’রে ওঠে,—জিৎ সিং। আমি যে তোমাকেই খুঁজছি ভাই তোমার কাছেই আমি এসেছি সেখান থেকে। কিন্তু যে-জন্যে এলাম, তা তো দেওয়া হল না। হারিয়ে ফেললাম সেটা। চল, তোমরা সঙ্গে কথা আছে। অনেক কথা।

উধমকে দেখিয়ে জিৎ বলে,–এর সামনেই বলতে পার।

—বলব? লীলাবতীর একখানা পত্র এনেছিলাম। রাম সিং-এর জন্যে সেটি তোমায় দিতে পারলাম না। তবে রামও পায়নি।

—আমি সেটি পেয়েছি লক্ষ্মণ। ইনিই রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আমায় দিয়েছেন।

—ওঃ পেয়েছ, তুমি পেয়েছ? ইনি দিয়েছেন?

রাজপুতটি কেঁদে ফেলে। আকুল হয়ে কাঁদে এবারে। কিছুক্ষণ কান্নার পর চোখ মুছে ফেলে বলে,—এমনভাবে হয়তো কাঁদতাম না। কিন্তু আমার দেহে কোনো আবেগ চেপে রাখবার মতো সামর্থ্য নেই। রাম সিং এখন হয়েছে তফিলউদ্দিন। কিন্তু তার স্বভাব আগের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

—আমি জানি, আমি সব জানি। তোমার ওপর কতখানি নির্যাতন চালিয়েছে তাও জানি।

—কিন্তু এখনো পর্যন্ত তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি দেখে অবাক হচ্ছি।

—সে জানত না আমি আগ্রায় আছি।

লোকটি যেন আঁতকে ওঠে,–জানত না, সে জানত না? কিন্তু আমি যে তাকে বলে ফেললাম? আমি বলে ফেললাম, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। চিঠির কথা অবিশ্যি বলিনি।

—আমি জানি, তুমি আমার কথা বলেছ। তাই সে জানতে পারল, আমি আগ্রায় আছি। কিন্তু আর কি বলেছে তাকে লক্ষ্মণ? আমি কেন আগ্রায় এসে বসে আছি। জানতে চায়নি সে?

—চাইবে না কেন? তুমি আর পাঁচজনের মতো অর্থোপার্জনের জন্যে এসেছ। একথা সবাই জানে। এতে তো দোষের কিছু নেই। তাই সে জানতে চাইবার সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছি।

জিৎ সিং নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,—ভালোই করেছ। তোমার ওপর ওরা নির্যাতন চালালো কেন?

—রাম সিং লীলাবতীর খোঁজ চেয়েছিল। আমি প্রথমটা বলিনি। লীলাবতীর ওপর ওর কিরকম ঝোঁক সেকথা আমি চিতোর থেকেই জানি। চিতোরে মায়ের মন্দিরে লীলাবতীর দেহের স্পর্শ লাভের জন্যে সে যেত। যাবার সময় মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গে নিয়েছে। আমি তখন অতটা বুঝতাম না। তারপর ধীরে ধীরে সব বুঝলাম। উদয়সাগরের পাড়ে লীলাবতী সম্বন্ধে হতাশ হয়ে তাকে অপহরণের ষড়যন্ত্র অবধি করেছে। তাই আমি লীলাবতীর খবর তাকে জানতে দিতে চাইনি। কিন্তু সে হিংস্র হয়ে উঠল। এতখানি হিংস্র হবে আমি ভাবতে পারিনি। তবু আমি অনেক সহ্য করলাম। শেষে আর পারলাম না। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই বোধহয় আমার মনে হল, এখন লীলাবতী যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে তাকে চুরি করে আনা ওই তফিলউদ্দিনের সাধ্য নেই। তাই বলে ফেললাম।

লক্ষ্মণ আরও অনেক কথা বলে। জিৎ সিং শুনে যায়। তারপর যখন কথা বলা শেষ হয় লক্ষ্মণের, তখন প্রশ্ন করে,—কতদিন আগে সে ঢোলপুরে এসেছে?

—প্রায় দু’মাস।

—এতদিন হয়ে গেল? তোমার আসতে দেরি হল কেন?

—পথে ভীষণ অসুখ হয়েছিল আমার। বাঁচার আশা ছিল না। সেখানে অনেকদিন নষ্ট হল। তাছাড়া শেষের দিকে হেঁটে আসতে হয়েছে। ঘোড়াটি চুরি হয়ে যায়।

জিৎ সিং লক্ষ্মণের কাছে কালপীর দলের কথা শোনে। যশোবন্ত অসুস্থ হবার পর দল ভেঙে যেতে বসেছে। অনেকে চলেও গেছে এদিক-ওদিকে। নিজের দেশ কালপীতেও ফিরে গেছে দু’একটি পরিবার এতদিন পরে। তবে বেশির ভাগ লোক এখনো রয়েছে। তাদের আশা দলের ভেতর থেকে আর একজন নেতা বের হয়ে যশোবন্তের স্থান নেবে। এই এই আশা কতদিন স্থায়ী হবে বলা যায় না।

ওদের কথার মাঝখানে একজন ফকির অন্ধকারের ভেতর লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে সামনে দাঁড়ায়। মশালের আলোয় তার রুগ্‌ণ চেহারা স্পষ্ট চোখে পড়ে। তার দুঃসহ হাঁপানির টানের শব্দে ওরা অস্বস্তি অনুভব করে। সে পয়সা চায় ওদের কাছে।

—পয়সা নেই।

ফকির কোনোরকমে মুখের সামনে হাত তুলে ইশারায় জানায়, পয়সা না থাকলে কিছু খেতে দাও।

উধম বলে,—রাস্তার ওপর এখন কোথায় খাবার পাব বল? আমাদের বাড়ি যাবে?

অতিকষ্টে ফকির বলে,—কতদূরে?

—অনেকদুর। পৃথ্বীরাজ রাঠোরের বাড়ি।

বৃদ্ধ ঘাড় নাড়িয়ে বলে, সে অতদূর যেতে পারবে না। নিরাশ হয়ে সে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে যেতে থাকে। জিৎ সিং সমবেদনার দৃষ্টিতে চায় তার দিকে।

বৃদ্ধ কাছের একটি গলিতে অদৃশ্য হতেই সে চিৎকার ক’রে ওঠে, আরে?

উধম প্রশ্ন করে,—কি হল?

—লক্ষ্য করনি? বৃদ্ধে পা দুটো হাঁটুর কাছ থেকে বাঁকা। শিগগির চল।

ওরা ছুটে যায় গলির ভেতরে। কিন্তু বৃদ্ধ ততক্ষণে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে কর্পূরের মতো।

জিৎ সিং কপালে করাঘাত করে বলে,–কেমন বোকা বানিয়ে দিয়ে চলে গেলেন বাদশাহ্। তিনজন রাজপুতকে অন্ধকারের মধ্যে কথা বলতে দেখে সন্দেহ করেছিলেন। আমার মনে হয় রণথম্ভোরের পরে তাঁর নীতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

লক্ষ্মণ বোকার মতো প্রশ্ন করে,—সত্যিই কি উনি আকবর শাহ্?

—কোনো সন্দেহ নেই তাতে। ছেলেবেলা থেকে ক্রমাগত ঘোড়ার পিঠে থাকতে থাকতে ওঁর পা দুটো বাঁকা। অমন বাঁকা পা আগ্রায় খুব কম অশ্বারোহীরই আছে। যাদের আছে তারা আর যাই হোক রাস্তার ভিখারী নয়। কিংবা তারা ছদ্মবেশও ধারণ করে না।

—কিন্তু ওঁর পেছনে গিয়ে তোমরা কি করতে পারতে? ওঁকে চিনে ফেলে তোমাদের পদোন্নতি হত কি?

উধম আর জিৎ সিং-এর মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হয়। জিৎ সিং বলে,—হতে পারত, আবার গর্দানও যেতে পারত।

—তাহলে না চিনে ভালোই করেছ জিৎ। নিজের উন্নতির জন্যে যখন মেবারের মতো দেশকে ছেড়ে আসতে পেরেছ, তখন শুধু জীবনকে বিপন্ন করতে যাওয়া কেন?

লক্ষ্মণের কণ্ঠস্বরে একটু শ্লেষ মেশানো ছিল। সেই শ্লেষে জিৎ সিং অবাক্ হয়। সে প্রশ্ন করে, -তুমি কি আমায় ঘৃণা কর লক্ষ্মণ?

—করি বৈ কি! লীলাবতীর মতো মেয়ে যাকে ভালোবেসেও ত্যাগ করেছে, তাকে ঘৃণা করব না? লীলাবতী আমাদের সর্দারের কন্যা। কালপীর দলে গোপাল সর্দারের মতো সর্দার কখনো দেখা যায়নি। তাই আমিও লীলাবতীর মতো তোমায় ঘৃণা করি, আবার পছন্দও করি।

জিৎ সিং কথা বলে না আর। উধমও চুপ করে থাকে।

আরও পরে লক্ষ্মণ এক সময় বিদায় নেয়। পরদিনই সে রওনা হবে উদয়পুরে। তার কাজ শেষ হয়েছে। সে সফল হয়েছে।

জিৎ সিং উধমকে বলে, সরাইখানায় আর থাকা উচিত নয় আমার।

—হ্যাঁ। তুমি মান সিংহের লোক বলে সে ছেড়ে কথা বলবে না। তফিলউদ্দিন রহিমবক্স নয়। সে বাদশাহের নোকর। তুমি আমার ঘরে থেকো।

—কিন্তু রানী যদি দেখে ফেলে?

—তিনি দেখতে পাবেন না। আমার ঘর অশ্বশালার পাশে। কিছুদিন অন্তত লুকিয়ে থাকতে পারবে সেখানে। কেউ যায় না আমার ঘরে। কাল সরাইখানা থেকে তোমার জিনিসপত্র আমি নিয়ে আসব। মাধব এখন আমাদের দলে। অন্তত কিছুদিনের জন্যে তো নিশ্চয়ই।

সাতদিন পর রাতের প্রথম প্রহরে জিৎ সিং বীরবলের খিড়কির দরজার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। প্রিয়া ঠিক কথাই বলেছিল। আকবর শাহ্ সকালের দিকে দলবল নিয়ে চলে গেছেন ফতেপুর সিক্রিতে। ফিরতে দেরি হবে কয়েকদিন। সেখানে তিনি সেলিম চিস্তির আতিথ্য স্বীকার করবেন। আতিথ্য স্বীকার ক’রে প্রমাণ করবেন যে সারা হিন্দুস্থানের বাদশাহ্ হয়েও দীন-দুনিয়ার যিনি আসল মালিক তাঁর কাছে তিনি তৃণাদপি তুচ্ছ। তাই তাঁরই উপাসক যাঁরা, তাঁদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অপরিসীম।

আসলে বাদশাহের মনে এখন আনন্দে টে-টম্বুর। তাঁর হারেমের একটি বিশেষ কক্ষে এক সুস্থ সবল শিশু কিছুদিনের মধ্যেই শূন্যে লাথি ছুঁড়তে থাকবে। সেই শিশুপুত্রের মুখ দেখে প্রতিদিন তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্যেও রাজ্যের সমস্ত অশান্তির কথা ভুলে গিয়ে স্বর্গীয় আনন্দের মধ্যে ডুবে থাকবেন। হারেমের এক একটি কক্ষ এক এক রাতে প্রবেশ করায় যে শিহরণ রয়েছে এতে তা নেই। কিন্তু এতে এমন এক জিনিস রয়েছে যা সময় বিশেষে সেই শিহরণের চেয়েও অনেক উঁচুতে।

জিৎ সিং চিন্তামগ্ন অবস্থায় খিড়কির দরওয়াজায় হাত রাখে। প্রিয়া তাকে আসতে বলেছে। সে কথা দিয়েছিল সেদিন, তাই এসেছে। কথা না দিলেও সে হয়তো আসতে চেষ্টা করত ইতিমধ্যে। কারণ সারা পৃথিবীতে আজ শুধু একজনই তার মনকে অন্তত কিছুটা ভরিয়ে তুলতে পারে। প্রিয়া! হ্যাঁ, প্রিয়াই পারে। পৃথিবী খুঁজলে আজ আর দ্বিতীয় কোনো রমণীর সাক্ষাৎ মিলবে না, যে তার জন্যে অপেক্ষা করবে। যে ছিল বলে সে একান্ত সংগোপনে আশা করত, সে নেই। নেই। সে ছেড়ে গেছে তাকে। যাবার সময় রেখে গেছে মিষ্টি কথায় ভরা একখানি পত্র। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে সেই পত্রে। যেন লীলাবতী ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। যেন লীলাবতী তার দেহের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। যেন লীলাবতী তাকে ত্যাগ করলে জীবন তার ব্যর্থ হয়ে যাবে। পুরুষকে এরা কী যে ভাবে, এরাই জানে। পুরুষ যদি সংকল্প করে যে, সে তার নিজের জীবন কোনোমতেই ব্যর্থ হতে দেবে না, তাহলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠা রমণীর কঠিনতম আঘাতও তাকে বিচলিত করতে পারে না। তবে না বুঝে ভালোবেসে ফেলে প্রথমটা নিজেকে কিছুটা অসুবিধার মধ্যে ফেলতে পারে মাত্র।

মনে মনে ভাবে জিৎ, নারী চরিত্র সে চিনে ফেলেছে। ওরা পুরুষের কাছে আর সবই চায়, চায় না শুধু প্রকৃত ভালোবাসা। ওরা চায় পুরুষ ওদের মনের মতো হোক। ওরা যখন যা চাইবে তখন তাই পূরণ করতে হবে। ওরা যখন চাইবে পুরুষ ওদের সোহাগে আদরে ভরিয়ে দিক তখন তাই করতে হবে। ওরা যখন চাইবে পুরুষ ওদের দুর্নিবার কামনার নিবৃত্তি ঘটাক, তখন তাই ঘটাতে হবে। কিন্তু এক পাও স্বাধীনভাবে যেন অগ্রসর না হয়। অগ্রসর হলেই বিপদ। তখন পুরুষ তাদের কাছে জঞ্জাল। তখন পুরুষ পরিত্যজ্য।

জিৎ সিং-এর চিন্তাস্রোত বন্ধ হয়। খিড়কির দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়ায় সেই একই প্রহরী, রাম সিং-এর শাগরেদ। মনটা দমে যায় জিৎ সিং-এর। এতদিন রাম সিং একেও হয়তো জানিয়ে দিয়েছে আগ্রায় তার উপস্থিতির কথা। প্রিয়ার সঙ্গে দেখা করার অত্যুগ্র আগ্রহে এর কথাটাও মনেও ছিল না তার। থাকলে সাবধান হতে পারত। প্রধান দ্বারের সেই বিরাট প্রহরী, যাকে সে চাচা বলে ডেকেছিল প্রথমদিনে, তার কাছ হতে কৌশলে জেনে নিতে পারত খিড়কির দরওয়াজায় কার কখন প্রহরা। মস্ত ভুল হয়েছে। এই ভুলের খেসারত না দিতে হয়।

জিৎ সিং মুখখানাকে একপাশে হেলিয়ে রাখে। যদিও এভাবে হেলিয়ে রাখার কোন অর্থ নেই। কারণ রাম সিং বলে থাকলে প্রথম দর্শনেই তাকে চিনে ফেলেছে। আকাশে কোথাও চাঁদ নেই। শুধু তারা। তারার আলো নিষ্প্রভ। সেই আলোয় পরিচিত লোকলেও চেনা যায় না। প্রহরীর হাবভাবে মনে হয়, রাম সিং এখনো এসে তাকে খবরটা জানিয়ে যায়নি। কারণ যে কল্পনা করতে পারে না। যে তারই প্রভুর গৃহে তার সব চাইতে বড় শত্রু সাদরে অভ্যর্থিত হচ্ছে প্রভুকন্যার আমন্ত্রণে। জিৎ সিং-এর মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে।

দৃঢ়পদে ভেতরে প্রবেশ করে জিৎ। খিড়কির দরওয়াজা বন্ধ হয়ে যায়। জিৎ তার পরিচিত পথে অনেকটা দূর অগ্রসর হয়ে এক জায়গায় এসে থেমে যায়। প্রিয়া কখনো এতটা পথ তাকে একা আসতে দেয়নি। বাগানের মধ্যেই কোথাও না কোথাও দেখা হয়েছে। তবে কি প্রিয়া গৃহে নেই। সে-ও কি বাদশাহের অনুরোধে পিতার সঙ্গে সিক্রির পথে রওনা হয়েছে? কিন্তু তাই বা হবে কি করে? সে ভেতরে না থাকলে প্রহরী তাকে জানাতো।

জিৎ সিং গৃহের দিকে দৃষ্টি ফেলে। যথারাতি ঝাড়-লণ্ঠনের আলো দেখা যায় কয়েকটি কক্ষে। কিন্তু সে-সব কক্ষে মানুষের কোনো ছায়া সে দেখতে পায় না।

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জিৎ সিং।

ঠিক সেই সময়ে কে যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে। সেই একই কৌশল প্রিয়ার। সে ভাবে, জিৎ সিং বুঝি ভয় পাবে এতে।

ভয় না পেলেও, ভয়ের ভান করে জিৎ সিং। তাতে প্রিয়া আনন্দ পাবে। তাই সে একটানে গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে দেয়।

প্রিয়া ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে ওঠে।

—ও, তুমি?

—আর কে হবে? উঃ আমার হাত বোধহয় ভেঙে গেল।

জিৎ সিং প্রিয়া হাতের ওপর হাত বুলিয়ে দিয়ে অনুতপ্তের স্বরে বলে,—আমায ক্ষমা কর প্রিয়া। আমি বুঝতে পারিনি।

—সে তো আমি জানি। তুমি ইচ্ছ ক’রে কখনো আমায় ব্যথা দিতে পার? কিন্তু তোমার এত ভয় কিসের?

জিৎ সিং বলে,–আমার জীবনটির ওপর অনেকের ঝোঁক প্রিয়া। সবাই আমায় ঈর্ষা করে। তাদের ধারণা খুব শিগগিরই রাজা মান সিংহ দরবারে আমার জন্যে একটি সম্মানের আসন সংগ্ৰহ ক’রে দেবেন।

—আমার বাবাও দিতে পারেন সে-আসন।

—পারেন বৈ কি? তিনি ইচ্ছে করলে কী না পারেন? তবে আমি তো তাঁর পরিচিত নই। আমি তাঁর কন্যার পরিচিত শুধু।

প্রিয়া হাতের ব্যথার কথা ভুলে হেসে ওঠে,–ও, তাতে বুঝি মহাশয়ের মনে খুব দুঃখ?

—নাঃ! একটু না। তাঁর মেয়ে যদি চিরজীবন এই একই ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে, এইভাবে হাসে, তাহলে আমি স্বয়ং বাদশাহেরও মুখ দেখতে চাই না।

—ইস্।

—সত্যি বলছি প্রিয়া।

—তারা উভয়েই অন্ধকারের মধ্যে পথ থেকে দূরে একটি গাছের পাশে গিয়ে বসে।

—একটা কথা জিজ্ঞাসা করব জি?

—নিশ্চয়ই।

—তুমি কি ঘোড়ায় চড়ে এলে?

—না? কেন বল তো?

—তোমার গায়ে সেইরকম গন্ধ পাচ্ছি।

জিৎ সিং মনে মনে উধমকে অভিশাপ দেয়। উধমের ঘরে প্রথমদিনে রাত কাটাবার সময় সে-ও একথা জিজ্ঞাসা করেছিল তাকে। ঘোড়ার কাছে থেকে থেকে ঘোড়ার সব কিছুকে পছন্দ ক’রে ফেলেছে উধম। খুব অন্যায়। ঘরের আশেপাশে যাতে অন্তত ময়লা না জমতে পারে সেটুকু লক্ষ্য রাখা উচিত তার।

—না প্রিয়া। তবে বিকেলের দিকে একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছিলাম।

—কোথায়? আমিও তো গিয়েছিলাম। তোমায় দেখতে পেলাম না তো?

—হয়তো আমি আগে কিংবা পরে গিয়েছিলাম।

—সম্ভবত তাই হবে। আমি গিয়েছিলাম সালিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন একসঙ্গে বেড়াবেন বলে। বাদশাহের পুত্র হওয়ায় তাঁর খুব আনন্দ দেখলাম। যেন তাঁর নিজের পেটের ছেলে।

—নিজের বৈ কি।

—তাই কখনো হয়? নিজের গর্ভের না হলে ছেলে কখনো আপন হয় না।

—কথাটা একটু অন্যরকম শোনাল যেন?

প্রিয়া জিৎ সিং-এর কোলের মধ্যে মুখ লুকোয়। জিৎ সিং তার রেশমের মতো চুলে হাত বুলিয়ে চলে।

কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে প্রিয়া বলে,—তফিলউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হল। আমাদের এখানে আগে থাকত সে। তার কথা তো তোমায় বলেছি। বেশ উন্নতি করেছে দেখলাম। সালিমা বেগমের শকট তারই পাহারায় ছিল। বড় ভালো লোকটি।

—কী বলল তফিলউদ্দিন?

—শুধু সেলাম করল। মনে হল কোনো ব্যাপারে একটু চিন্তিত আছে।

জিৎ সিং কথাটা গায়ে রাখে না। তফিলউদ্দিন এমন কেউ নয়, যার জন্যে অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশ করতে হবে।

—সালিমা বেগম একটা ভালো খবর দিলেন জিৎ।

—কী খবর?

—বাদশাহ্ সিক্রি থেকে ফেরার পর আবার মেবার অভিযানের আয়োজন করবেন। জিৎ সিং নিজের বুকের নিঃশ্বাস চেপে রেখে বলে,–কেন? চিতোর দখল তো হয়ে গেছে।

—তবু তিনি নাকি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। তিনি আশা করেছিলেন এর মধ্যে কোনদিন উদয় সিংহ স্বয়ং আগ্রায় আসবেন কিংবা লোক পাঠিয়ে নিয়মমাফিক বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু উদয় সিংহ তা করেননি। তাই ঠিক শান্তি পাচ্ছেন না বাদশাহ্। উদয় সিংহকে তাঁর ততটা ভয় নেই। ভয় তাঁর আর একজনকে।

—কে সে?

—বাদশাহ্ তাঁকে এক অদ্ভুত নামে ডাকেন। উদয় সিংহের একপাল ছেলেদের মধ্যে তিনি একজন। বাদশাহ্ তাঁকে ডাক নামেই চেনেন। নাম কিকা। এই কিকার সম্বন্ধে রাজধানীতে নানান্‌ উদ্বেগজনক খবর এসেছে।

জিৎ সিং বুকে হাত দিয়ে দেখে তার হৃৎপিণ্ডটা সত্যিই চলছে কি না।

প্রিয়া বলে, আচ্ছা, কিকা কথাটার কোনো মানে আছে জিৎ।

—আছে বৈ কি। রাজোয়ারার সব ছেলেদেরই কিকা বলে। আবার রানার ছেলেদেরও কিকা বলে ডাকা হয়। কিন্তু কিকা বলতে এখন শুধু একজনেই সবাই চেনে, বাদশাহ্ যাঁর খবর শুনেছেন।

—তুমি তো মেবারের লোক। এই কিকাকে চেনো?

—দেখেছি কয়েকবার।

—নিশ্চয় খুব খারাপ দেখতে সে, তাই না? কোনো দস্যুর মতো—

—না। দেখতে ঠিক দেবতার মতো।

—বল কি জিৎ? চেহারা ভালো হলে লোক কখনো খারাপ হতে পারে?

—হ্যাঁ পারে। ভালো খারাপ হওয়া চেহারার ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু কিকা খারাপ, একথা তোমায় কে বললে?

—কেন? বাদশাহ্ নিজে বলেছেন। সালিমা বেগমও বলেছেন আজ। লোকটি নাকি গোঁয়ার।

—হয়তো তাই। আচ্ছা প্রিয়া, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। কিকা যদি নিজের দেশকে ভালোবেসে তাকে স্বাধীন করার চেষ্টা করেন, সেটা কি খারাপ?

চিন্তিত কণ্ঠে প্রিয়া বলে, —খারাপ নয়?

—কেন?

—সে যে বাদশাহের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। বাদশাহের বিরুদ্ধে যে দাঁড়ায়, সে কি ভালো হতে পারে!

—দেশকে ভালোবাসা তবে অন্যায়?

—তুমি এসব অদ্ভুত কথা বলছ কেন জিৎ? দেশকে ভালোবাসা অন্যায় কি ন্যায়, আমি জানি না। আমি শুধু চাই বাদশাহ্ নিরাপদে থাকুন, শান্তিতে থাকুন। কারণ তাঁর নিরাপত্তার ওপর আমার বাবার নিরাপত্তা নির্ভর করে। আর বাবার নিরাপত্তার ওপর আমার জীবন নির্ভর করে।

—একটা কথা জিজ্ঞাসা করব প্রিয়া। তুমি কিছু মনে করবে না?

—না। দ্বিধা করছ কেন জিৎ? সব কথাই তুমি আমায় বলতে পার।

—তুমি আমায় ভালোবাসো?

প্রিয়া জিৎ-এর বুকের ওপর নিজের দেহটিকে এলিয়ে দিয়ে মুখখানাকে তার চিবুকের কাছে নিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলে,—এখনো সন্দেহ?

—না প্রিয়া, সন্দেহ নয়। কিন্তু কতখানি ভালোবাসো?

প্রিয়া একটি হাত উঁচু করে আকাশ দেখিয়ে বলে,—এই যে আকাশে তারা দেখছ? ওই তারা পার হয়ে আরও দূরে। তার কোনো আদি নেই অন্ত নেই।

—প্রিয়া!

—জিৎ!

—আমি যদি আমার দেশের জন্যে বাদশাহের বিপক্ষে যাই, তবু তুমি আমায় ভালোবাসবে? আমায় সহ্য করবে তুমি?

ছিটকে দূরে সরে যায় প্রিয়া। অন্ধকারেও তার চোখে যেন একটু আতংক ফুটে উঠতে দেখা যায়। সে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে বলে,—তুমি—তোমার আজ কি হয়েছে জিৎ। এমন অর্থহীন কথা বলছ কেন?

জিৎ সিং হেসে ওঠে। বলে,–এমনি। রোজই তো অর্থপূর্ণ কথা বলি। আজ না হয় আমার কথাগুলো অর্থহীনই হল। ক্ষতি কি?

—না। এসব কথা মুখে আনাও খারাপ।

—তাহলে সেই অবস্থায় তুমি আমায় ভালোবাসতে পারবে না।

—জানি না।

—বল প্রিয়া। তোমার জবারের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

প্রিয়া একটু ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে বলে,—নিজের সুখ, নিজের সম্পদ, সব কিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু কি ভালোবাসাকে সম্বল করে জীবন কাটানো যায়? আমি জানি না জিৎ, আমি বলতে পারি না। কোনো ধারণাই নেই আমার।

—ধারণা না থাকলেও মোটামুটি জবাব পেয়েছি।

—তুমি বড় ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। চল, ভেতরে চল। তোমার জন্যে খাবার রেখেছি। আমি নিজের হতে খাইয়ে দেব। কতদিনের সাধ। তুমি রণথম্ভোরে চলে যাবার আগে, এই সাধ আমার প্রথম হয়!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিৎ নিজের সমস্ত শরীরকে ঢিলে করে দিয়ে বলে,—চল। তোমার সাধই পূৰ্ণ হোক।

প্রিয়া জিৎ সিং-এর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *