আগ্রা – ১

১.

আকবর বাদশাহের খাস নগরী আগ্রা—যে আকবর শাহ্ ইতিমধ্যেই সারা হিন্দুস্থানের রাজা আর নবাবদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছেন। কারণ, মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি রাজপুতদের হৃৎপিণ্ড চিতোরের মতো দুর্জয় দুর্গকেও অধিকার ক’রে নিয়েছেন।

জিৎ সিং আগ্রায় প্রবেশের মুখে অশ্বারূঢ় অবস্থাতেই ভালো ক’রে চেয়ে চেয়ে দেখে নেয়। যেখানে এসে সে থামে, সেখান থেকেই কর্মব্যস্ত নগরীর স্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করতে পারে

চিতোরও কম মুখর ছিল না। কিন্তু আগ্রায় ভালোভাবে প্রবেশের পূর্বেই মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয় সে এই নগরীর সঙ্গে চিতোরের কোথায় যেন বড় রকমের অমিল রয়েছে। চিতোর যেন চারণ কবির কবিতার একটি চরণ। আর আগ্রা? জিৎ সিং প্রথমটা বুঝে উঠতে পারে না, সে আগ্রাকে কি বলবে? কবিতা? না না, আর যাই হোক কবিতা নয়—একথা ঠিক। তবে?

জিৎ সিং মনের মধ্যে উত্থিত প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে অশ্বকে আর একটু ভেতরে চালিয়ে নিয়ে যায়।

অট্টালিকার অভাবে এখানেও নেই। বরং অনেক বেশি মনে হচ্ছে। রাস্তাঘাট আরও প্রশস্ত। মানুষের কোলাহল শুনে মনে হয় সর্বত্রই যেন বাজার বসেছে। জিৎ সিং বিস্মিত হয়ে চারদিকে চেয়ে দেখে, অশ্বকে আবার থামিয়ে দেয়।

চিতোর হল চারণ কবির কবিতার এক চরণ। আর আগ্রা?

সামনের হৈচৈ শুনে জিৎ সিং তার চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দেয়। দেখতে পায় নানান সাজে সজ্জিত একপাল হাতি এগিয়ে আসছে মত্ত ভঙ্গিতে। পথচারীকে সাবধান ক’রে দেবার জন্য চিৎকার করতে করতে ছুটছে একদল লোক।

তাড়াতাড়ি ঘোড়া থেকে নেমে জিৎ সিং রাস্তার একেবারে ধারে সরে এসে ঘোড়ার লাগাম ধরে কাছে টেনে আনে। অনেক দোকানী দোকানের কপাট বন্ধ করে দেয়। অধিকাংশ পথচারী নির্বিকার। তারা হাতি চলে যাবার অপেক্ষায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যাপৃত হয়। জিৎ সিং বুঝতে পারে, এরা অনেক দেখেছে। এরা আগ্রার স্থায়ী বাসিন্দা। তবে কিছু কিছু লোক রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রতীক্ষা করে। তাদের চোখ জ্বলজ্বল ক’রে ওঠে। জিৎ সিং জানে, তার নিজের চোখদুটোও এমনি জ্বলজ্বল করছে।

সম্মুখের হাতির পিঠে বসেছিলেন একজন পুরুষ। চেহারা তাঁর বীরের মতো! স্পষ্ট বোঝা যায় ইনি রাজপুত। বিস্মিত হয় জিৎ, আকবর শাহকে না দেখলেও তাঁর চেহারা সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা তার আছে। তাঁর চেহারার অনেক বর্ণনা সে শুনেছে। ইনি রাজপুত-বেশে আকবর শাহ্ নন, এত দীর্ঘ চেহারা তাঁর নয়।

তবে ইনি কে?

হাতির দল চলে যেতেই দোকানগুলো আবার খুলে যায় একটির পর একটি। জিৎ সিং একটি আতরের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

—কি হে রাজপুত, আতর নেবে? চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধ ক’রে ফিরলে। কি ব্যাপার?

দোকানীর সম্বোধনে জিৎ সিং একটু থতমত খায়। এভাবে জীবনে কেউ তাকে সম্বোধন করেনি। সে যে রাজপুত, এ জিনিসটি চোখে আঙুল দিয়ে কেউ দেখিয়ে দেয়নি তাকে। দোকানীর কথায় মনে হয়, রাজপুত হওয়ার মধ্যে যেন একটি অস্বাভাবিকতা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে দৃষ্টি ফেলে, বুঝতে পারে দোকানীর সম্বোধনের কারণ। যতদূর দৃষ্টি যায়, তার মতো খাঁটি রাজপুতের বেশে কাউকে চোখে পড়ে না। এদের মধ্যে হয়তো রয়েছে অনেকে, তবে বেশবাসের কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়েছে তারা। কারণ খাঁটি রাজপুত-বেশের মতো খাঁটি মুসলমানী পরিচ্ছদও অনেকের নেই।

—কি গো, উত্তর দিচ্ছ না কেন? রাজপুতরাও তো আতর ব্যবহার করছে আজকাল।

—–আচ্ছা, তুমি ওভাবে দোকান বন্ধ ক’রে দিলে কেন হাতি দেখে?

দোকানী হেসে বলে,—ও, তাই বল! তুমি নতুন এসেছ, তাই না?

—হ্যাঁ।

—কোথা থেকে এলে?

—মেবার।

—বল কি? সে যে এখন বাদশাহের শত্রুরাজ্য। একথা বললে মুশকিলে পড়বে। জিৎ সিং চমকে ওঠে। প্রথমেই ভুল করে ফেলল নাকি? সে বলে,—সত্যি বলছ?

—–না, সত্যি ঠিক নয়। ওসব ছোটখাটো ব্যাপারে বাদশাহ্ নজর দেন নাকি? তুমি তো আর রানা নও।

—যদি আমি রানা হতাম?

—তাতেও কিছু এসে যেত বলে মনে হয় না। রানা এলে তোমার মতো একাই আসবেন। সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করতে তো আর আসবেন না।

—কেন? রানা যুদ্ধ করতে পারেন না?

—তোমাদের রানা? হুঃ! যুদ্ধ করতে পারলে চিতোরের মতো দুর্গ ফেলে রেখে পালায় নাকি কেউ? অমন একটি দুর্গ কয়টি আছে হে এদেশে? অমন দুর্গ যখন বাদশাহের হাতে এসেছে, তখন রানা আর কয়দিন?

জিৎ সিং-এর মনে ক্ষোভ জাগে। সে সামলে নিয়ে বলে, —যুদ্ধ সম্বন্ধে তোমার দেখছি জ্ঞান আছে?

—থাকবে না? এই দেখ।

দোকানী তার বুক খুলে দেখায়। বুকের পাশ দিয়ে ঘাড় অবধি গভীর ক্ষতের দাগ। জিৎ সিং গা ঝাঁকায়

—আরও দেখবে?

—না, থাক।

—পায়েও আছে। পায়ে জোর পাই না আর, তাই দোকান খুলে বসেছি। এসব কিন্তু তোমাদের রাজপুতদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে হয়নি। রাজপুতদের একটি গুণ আছে। তারা যদি অমন জায়গায় আঘাত করে, তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে কারও আতরের দোকান খুলে বসা সম্ভব নয়। একথা আমি একশোবার স্বীকার করব।

শুনে গর্ববোধ করে জিৎ সিং। দোকানীকে ভালোও লেগে যায়।

সে মৃদু হেসে বলল,—আমার কথাটার জবাব দিলে না?

—কোন্ কথা?

—হাতি দেখে দোকান বন্ধ করলে কেন?

—কেন আবার? ওদের বিশ্বাস আছে নাকি? ওই মাহুতগুলোর কথা বলছি। মজা দেখার জন্যে এমনভাবে নিয়ে যায় যে দোকানপাট সব নষ্ট হয়ে যায়। ওরা নিজেদের মনে করে বাদশাহ আকবর। রাস্তা দিয়ে যখন হাতি চালায় তখন খোলা দোকান দেখলে সহ্য হয় না ওদের। ভাবে, ওদের অসম্মান করা হল। তাই ইচ্ছে করে নষ্ট ক’রে দেয় দোকান। তবে সব সময় যে ইচ্ছে ক’রে নষ্ট করে, তা নয়। হাতিরও মেজাজ বলে পদার্থ আছে। এমনিতে ভালো মানুষ। কিন্তু একটু বিগড়ে গেলেই ব্যস্, হয়ে গেল।

—কারা গেলেন হাতিতে?

—দেখোনি?

—দেখেছি। কিন্তু কাউকে তো চিনি না।

—রাজা মানসিংহ গেলেন। তাঁকে চেনো না? তিনিও তো রাজপুত।

—ছিলেন বটে এককালে।

—তার মানে? ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন বলে তো শুনিনি।

—গ্রহণ হয়তো করেননি। কিন্তু না করলেও বাকি রয়েছে নাকি কিছু?

দোকানী তার কালো আর শক্ত দাঁতগুলো বের ক’রে বলে,–সে যা বলেছ। অনেকে বলাবলি করে, রাজপুত হয়েও মানসিংহ বাদশাহকে বেশ হাতের মুঠোর মধ্যে এনে ফেলেছেন। আমি বলি, ফেলবেন না কেন? অমন মিষ্টি সম্পর্ক—

জিৎ সিং-এর মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ ক’রে ওঠে।

—কি হল গো? তোমার মুখের রঙ হঠাৎ অমন লাল হয়ে উঠল কেন?

জিৎ সিং ঢোক গেলে। মুহূর্তের মধ্যে অনেক কিছু ভেবে নেয়। এখন থেকেই তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি চাল-চলনের ওপর নির্ভর করবে তার ভবিষ্যৎ। এখন সে আগ্রায়। দোকানীর কথার জবাবে সে বলে, —আনন্দে।

—আনন্দ? তা বেশ—বেশ। এই তো চাই। তুমি ঠিক উন্নতি করবে। বাদশাহের সঙ্গে মিষ্টি সম্পর্ক পাতানোর কথায় যে রাজপুতের পুলক জাগে, তার উন্নতি না হয়ে যায় না। তুমি আজ‍ই দরবারে প্রবেশের জন্যে চেষ্টা শুরু করে দাও।

—আরও কিছুদিন যাক্। দরবারে প্রবেশ করতে হলে ভালো পোশাকের তো দরকার। আমার কিছুই নেই। তবে তুমি যখন আমার দোস্ত হলে, তখন আশা করি সব হবে।

—আমি কারও দোস্ত-ফোস্ত নই। দোকানের সামনে যারা এসে দাঁড়ায়, তাদের সঙ্গে দুটো কথা বলি, এইমাত্র। তাতে সময় কাটে, আর একটা উপকারও হয়। দোকানের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে ভাবে জিনিস খরিদ করছে। তাতে দোকানের সুনাম। বিক্রিবাটা বেশি হয়।

জিৎ সিং একটু দমে যায়। আগ্রায় প্রথম পরিচয়ের লোকটিই একেবারে খাঁটি এ-জগতের মানুষ। সাধারণ রাজপুতদের সঙ্গে-এর মিল নেই। এর এত হাসি, এত কথা, সবই নিজের স্বার্থের খাতিরে।

মুখে হাসি টেনে জিৎ সিং বলে,–তোমার কথা শুনে খুব আনন্দ হল। আমারও তাই মত হাসি, খেলা গল্প সবই করব। কিন্তু আসল জিনিসটির দিকে নজর রেখে। যদি দেখি কানাকড়িও হচ্ছে না, তবে হাসিটাসি সব বন্ধ।

—ঠিক বলেছ। এবারে আমিও হাসি বন্ধ করছি। তুমি সরে পড়। মনে হচ্ছে একজন জেনানা আসছে এদিক পানে। তোমায় দেখে নাও আসতে পারে। এখন তোমার সঙ্গে হাসাহাসি করে উপকার হবে না আমার। যাও।

জিৎ সিং ঘাড় ফিরিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। শুধু দেখতে পায়, একটি ডুলি বয়ে আনছে কয়েকজনে। বুঝতে পারে ডুলির ভেতরেই রয়েছে জেনানা।

সে ঘোড়াটিকে নিয়ে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হতেই দোকানী বলে ওঠে,–শোন শোন। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, দেখে তো তোমায় সাধারণ রাজপুত বলেই মনে হয়। অমন ঘোড়াটি পেলে কোথায়?

—একজন দিয়েছেন আমায়, তিনি পছন্দ করেন আমাকে।

—দোস্তি না পাতালেও, কথাটা যখন তুলেছ তখন একটু সাবধান করে দি। ঘোড়াটিকে আগলে রেখো। ওর ওপর এতক্ষণে নেকনজর পড়ে গেছে।

—কি ক’রে বুঝলে?

—বোঝবার কিছু নেই, এমন হয়ে থাকে। অনেক হতে দেখেছি।

—থাকা খাওয়ার জায়গা-টায়গা মিলবে কোথাও?

—রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু কর। নিজেই দেখতে পাবে।

ডুলি এগিয়ে আসে।

জিৎ সিং ঘোড়ায় চেপে বসে। তার দেহ ধূলিমলিন। ঘোড়ার গায়েও ময়লা লেগেছে অনেক। তবু তারা দুজনে ক্লান্ত হয়ে পড়েনি। কারণ গিরো উপত্যকা ছেড়ে আগ্রায় আসবার সময়ে সে তাড়া-হুড়ো করেনি কখনো। সময়মতো থেমেছে। ঘোড়াকে বিশ্রাম নিতে দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে। কিন্তু আজ আগ্রার রাজপথে চলতে গিয়ে প্রথম নিজের এবং অশ্বটির সম্বন্ধে দুশ্চিন্তার উদয় হল মনে। কারণ, শুনেছে এখানে কারও বাড়িতে অতিথি হওয়া খুবই অসুবিধা। প্রতিদিন তার মতো অনেক পথচারীর আবির্ভাব ঘটে আগ্রায়। অতিথি এখানে কালেভদ্রে আসে না। তাদের আবির্ভাব নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাছাড়া সবার বাড়িতে তো গিয়ে ওঠা যায় না। তাকে খুঁজে বের করতে হবে কোনো রাজপুতের বাড়ি।

হঠাৎ মনে পড়ে জিৎ সিং-এর, কিকা তাঁকে যে দুজন রাজপুতের নাম দিয়েছেন, তারাও ব্যবসা করে। দোকানীদের কাছে প্রশ্ন করলে হয়তো জানা যেতে পারে। সে দোকানগুলোর দিকে চাইতে চাইতে চলে। কোথাও যদি কোনো রাজপুত বিক্রেতাকে দেখতে পাওয়া যায়।

কিন্তু রাজপুত দোকানদারের মুখ আর দেখতে পায় না সে। পর পর যতগুলি বিপণি দেখল, সব কয়টিতেই মুসলমান বসে রয়েছে নানা রকমের পোশাক পরে। তার ধারণা হল, ওরা সবাই মুসলমান হলেও একই দেশের লোক নয়। ওদের দেহের গঠন, রঙের ঔজ্জ্বল্য পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে। হয়তো ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দুস্থানের এই সেরা নগরীতে ছুটে এসেছে ওরা ব্যবসায়ের জন্যে। এখানে পয়সা বেশি, লাভ বেশি। কারণ এখানেই থাকেন স্বয়ং মুঘল বাদশা আর আমীর ওমরাহের দল যাঁদের পয়সার ভাণ্ডার অফুরন্ত।

চিতোরের কথা আবার মনে পড়ে যায় জিৎ সিং-এর। চিতোরেরও ঐশ্বর্য ছিল, চাকচিক্য ছিল। সে চাকচিক্যের এত জমক না থাকলেও, তাতে ছন্দ ছিল।

—হেই, স্বর্গের দিকে চেয়ে রাস্তা চলছ নাকি?

জিৎ সিং তাড়াতাড়ি লাগাম টেনে ধরে। সামনে চেয়ে দেখে এক ব্যক্তি উট নিয়ে চলেছে। তার পোশাক মুসলমানদের মতো। কিন্তু সে ‘স্বর্গ’ কথাটা বলল কেন? সে ‘বেহেস্ত’ বলল না তো?

—কি হল হে। অমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছ কেন? পথ ছাড়ো।

জিৎ সিং অতি সংকোচে প্রশ্ন করে,—তুমি মুসলমান?

—কেন? কেন? ওকথা বললে কেন? সন্দেহ আছে নাকি? বল, বল। এমন সন্দেহ করলে কেন?

জিৎ সিং লোকটির উৎকণ্ঠায় অবাক হয়। তার জবাবের ওপর যেন উটওয়ালার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। সে বলে—তুমি ‘স্বর্গ’ কথাটা ব্যবহার করলে কিনা?

উটওয়ালা কপালে করাঘাত করে,—হা আল্লা। এত আঁটিসুঁটি, তবু ফাঁস হয়ে যায়। কতবার এমন হয়েছে কে জানে!

—কি হয়েছে?

—আরে! ছিলাম তো রাজপুত। মারোয়াড়ে বাড়ি। ইসলাম ধর্ম নিয়েছি। কিন্তু এখনো পুরোপুরি হতে পারলাম না। রক্তের মধ্যে সেই কিনা।

—ভয় কি? তোমার ছেলে পুরোপুরি হবে। ছেলে আছে তো?

—না। তবে হবো হবো ভাব। কিন্তু ব্যাপারখানা কি বল তো?

—কোন্ ব্যাপার?

—তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছি। তোমার সঙ্গে সঙ্গে যেন রাজোয়ারার মরুভূমির একটা দমকা গরম হাওয়া এসেছে এখানে। সেই হাওয়া আমার চোখেমুখে এসে লেগেছিল। তাই অমন বেফাঁস কথা বলে ফেললাম। তোমাকে দেখেই বুঝেছি, সদ্য এসে পৌঁছেছ সে-দেশ থেকে। বল ঠিক কি না?

—ঠিক!

—দেখলে তো? কেমন ধরে ফেললাম? আসলে একটি কথা তোমায় চুপি চুপি বলে রাখি ভাই। তুমি তো নতুন এসেছ, তাই বলি। যতই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কর না কেন, যতই পয়সা কামাও না কেন, দেশের মাটির টান ভয়ানক জিনিস। বুঝলে? সাংঘাতিক জিনিস ওই দেশের মাটি। থেকে থেকে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়। রাতে নিজের বিবির গায়ের ওপর হাত রেখে, তার মুখের কাছে মুখ রেখেও কেমন যেন হু-হু ক’রে ওঠে মনটা। তখন আর সামলাতে পারি না। আপনা হতেই টপটপ ক’রে দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ে চোখ থেকে।

জিৎ সিং বুঝতে পারে লোকটা পেটে কোনো কথা রাখতে পারে না। প্রথম আলাপেই বলে ফেলে সব। ঘরের কথা, পরের কথা—সব। একটু হেসে বলে সে,—বিবি দেখে ফেলে না তোমার চোখের জল?

—আরে না। এসব ব্যাপার হয় বিবিকে সোহাগ আদর করার পর। সে তো তখন বেঘোরে ঘুমোয়। সে না ঘুমোলে ভাববার অবসর কোথায়? হাসালে দেখছি। নিশ্চয় বিয়ে করনি।

—না।

—তাই বল। আচ্ছা চলি ভাই। তোমায় দেখে খুব আনন্দ হল। ঘোড়াটি কোথা থেকে জোটালে?

—একজন দয়া ক’রে দিয়েছেন।

—দারুণ জিনিস দেখছি। কী সুন্দর রঙ। সাবধানে রেখো। এ হল আগ্রা।

—আগ্রায় বুঝি খুব চুরি হয়?

—না না পাগল নাকি? বাদশাহের নাকের ওপর চুরি?

—তবে সাবধানে রাখতে বললে কেন?

—ঘোড়ার ব্যাপার তো। আমীর ওমরাহ সবাই চায়। বিশেষ করে ঘোড়াটি ভালো হলে তো কথাই নেই। সেই সুযোগ নেয় কিছু লোক।

—তোমার নামটি কি?

—আমার নাম আদি—মানে আব্বাস খাঁ। দেখলে তো, তোমায় দেখে সুড়সুড় করে কেমন বাপের দেওয়া নাম মুখ থেকে বের হয়ে আসছিল? সারা জীবনেও খাঁটি মুসলমান হতে পারব না। তবে আমার ছেলে ঠিক হবে। মুসলমান হবে। আমার বিবির তুলনা হয় না। বাদশাহের হারেমেও অমন বিবি পাঁচশতে একটা মেলে। এটা আমার কথা নয়। একজন মস্ত ফকির সাহেবের কথা। আচ্ছা চলি ভাই।

—এখানে থাকা খাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায়?

—সরাইখানায় যাও। তোমাদেরও সরাইখানা আছে। হিন্দুদের সরাইখানা। আকবর শাহের গুণের তুলনা নেই। তিনি জানেন, শুধু মুসলমানই তাঁর প্রজা নন, হিন্দুরাও তাঁর প্রজা। তাই এখানে সবার জন্য ব্যবস্থা আছে। আর একটু এগিয়ে যাও। এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে ঘুরবে।

উটওয়ালা চলতে শুরু করে।

জিৎ সিং ভাবে, চিতোর চারণ কবির কবিতায় একটি চরণ হলেও আগ্রার ব্যাপারে অত সহজে উপমা দেওয়া কঠিন। আগ্রা যেন মুঘল বাদশাহের জীবনচরিত। এতে যেমন ষড়যন্ত্রের প্রাধান্য, তেমনি আবার একটু তলিয়ে দেখলে তার সঙ্গে স্নেহ মায়া মমতা আর মহত্ত্বও মিলে যায়।

.

সরাইখানার মালিক একজন রাজপুত। জিৎ সিং তাকে দেখে নিশ্চিত হয়। লোকটির বাড়ি রাজা মানসিংহের দেশে। মানসিংহের সঙ্গেই এসেছিল। তারপর যুদ্ধ-বিগ্রহ ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা নিয়ে বসেছে।

জিৎ সিং-কে প্রবেশ করতে দেখেই লোকটি বুঝেছিল, নতুন আমদানি। অনেকেই আজকাল রাজোয়ারা ছেড়ে অল্প বয়সে চলে আসছে আগ্রায় ভাগ্যান্বেষণে। অল্পদিন সরাইখানা খুলে বসলেও এর মধ্যে অনেক দেখেছে সে, অনেক শুনেছে। হিন্দুস্থানে জন্মে সারাজীবনের অভিজ্ঞতা কেউ যদি এক বছরের মধ্যে লাভ করতে চায়, তবে তাকে আগ্রার মাটিতে পা দিতেই হবে। এখানকার জল পেটে না পড়লে, এখানকার যমুনায় ডুব না দিলে মানুষ হওয়া যায় না, এ জ্ঞান ভালোভাবেই হয়েছে সরাইখানা মালিকের। রাজপুতদের নীতি আর আদর্শের অসারতা সে অতি অল্পদিনের মধ্যেই মর্মে মর্মে অনুভব করেছে। সেগুলো শৈশব থেকে সেদিন পর্যন্ত তার জীবনের সঙ্গে লেপটে ছিল। অথচ আগ্রার মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো পচে যাওয়া ফলের মতো তার জীবন থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ল। ভাবলে এখনো সে মাঝে মাঝে অবাক হবার চেষ্টা করে। এখন সে প্রকৃত মানুষ। বর্তমান যুগে বেঁচে থাকতে হলে, যেমন মানুষ হতে হয়, তেমনি মানুষ।

জিৎ সিং-কে এগিয়ে আসতে দেখে মালিকের চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। একজন মাত্ৰ লোক এখন রয়েছে সরাইখানায়। সেও আবার সন্ন্যাসীর মতো। বেশি কথাবার্তা বলে না। খাওয়া-দাওয়াও কম মাত্রায়। তার কাছ থেকে লাভের আশা সুদূর পরাহত। কিন্তু এই নবীন যুবকটির পোশাক-পরিচ্ছদ মলিন হলেও, তার মনে আশার সঞ্চার করে। কারণ যুবকটির চেহারা ভালো। আর ভালো তার ঘোড়াটি।

মালিকের দৃষ্টি যত না জিৎ সিং-এর ওপর পড়ে, তার চেয়েও বেশি পড়ে ঘোড়াটির ওপর তেজী তো বটেই, রঙটিও অপূর্ব। রহিমবক্সকে খবর পাঠাতে হবে। খবর পেয়ে নিশ্চয়ই লাফাতে লাফাতে ছুটে আসবে। কালই এসেছিল রহিমবক্স মুখ শুকনো ক’রে। কিছুদিন থেকে নাকি তার কাজ-কারবার বন্ধ। কিছুই হচ্ছে না।

জিৎ সিং কাছে আসার আগেই পাশের একটি কিশোরকে কানে কানে বলে মালিক -যা, শিগগির যা। রহিমবক্সকে খবর দিয়ে বলবি, ভালো জিনিস এসেছে। এখুনি যেন সে চলে আসে।

ছেলেটি জিৎ সিং-এর পাশ দিয়ে ছুটে বাইরে চলে যায়। সে জানে এই খবর ঠিক মতো রহিমবক্সকে পৌঁছে দিতে পারলে সে-ও বখরা পাবে। গোঁফের রেখা এখনো ভালোভাবে উঁকি দেয়নি ছেলেটির মুখে, তবু সে মালিকের মতোই অভিজ্ঞ। কারণ আগ্রার জল ছয় মাস ধরে তার পেটে পড়ে আসছে। তাই এই সরাইখানায় সাধারণ চাকরের কাজ করলেও, তার গোপনে লুকিয়ে রাখা কাপড়ের তৈরি লম্বা থলিটি ইতিমধ্যেই প্রায় ভর্তি হয়ে উঠেছে। শুধু ঘোড়ার ব্যাপারই নয়। লুঠের মাল নিয়ে যুদ্ধ ফেরতা কত সিপাহী ওঠে এখানে। দু-চারদিন স্ফূর্তি করে অবশিষ্ট জিনিস নিয়ে নিজের নিজের গ্রামে ফিরে যায়। ব্যবসা করার আশায় জমানো টাকা নিয়ে ওঠে কত লোক। সব দেখেছে ছেলেটি। সে জেনে ফেলেছে ভগবানকে লাভ করার জন্যে যেমন ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, তেমনি অর্থ উপার্জনের ভিন্ন ভিন্ন পথ।

ছেলেটি অদৃশ্য হ’লে মালিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এত তাড়াহুড়ো করার সংগত কারণ অবশ্যই রয়েছে তার। সে দেখেছে, অনেক সময় ঘোড়াকে শুধু জল আর দানা খাওয়াতে কিংবা গাত্র-মার্জনা ক’রে নিতে অনেকে সরাইখানায় আসে। একটু পরেই আবার চলে যায়।

কিন্তু জিৎ সিং-এর ভাবভঙ্গি দেখে তার ভুল ভাঙে। চট ক’রে চলে যাবার লোক এ নয়। যারা তেমনিভাবে চলে যায়, তাদের ধরন-ধারণ আলাদা। ঘোড়ায় চড়ে আসা যাকে বলে, ঠিক সেইভাবেই আসে।

জিৎ সিং কাছে এলে মালিক বিগলিত ভঙ্গিতে হেসে পাশের চারপায়াটি দেখিয়ে দিয়ে বলে,

—আসুন আসুন। বসুন।

—এখানে থাকবার জায়গা হবে?

—হবে না মানে? সরাইখানা খুলেছি কেন তবে? আপনাদের মতো মহান্ ব্যক্তিরা এসে থাকবেন আহার করবেন, তবেই না আমরা কৃতার্থ হব। যতদিন ইচ্ছা থাকুন। এমন ভালো থাকবার জায়গা আর পাবেন না, অন্য সরাইখানায়।

—আমি মহান্ নই, সাধারণ।

—হেঁ হেঁ। মুখে বললেই তো আপনি সাধারণ হয়ে যাবেন না। আদব-কায়দা, ভাব-ভঙ্গি এসব দেখে আমরা বুঝতে পারি। ব্যবসা করে খাই তো। আপনি ভাবছেন, আপনার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে চিনতে ভুল করব? না। সে ভুল কখনো করব না। আগুন যদি ছাই-চাপাও থাকে, আমরা বুঝতে পারি আগুন রয়েছে। ফুঁ দিয়ে ছাই উড়িয়ে দি আমরা। পোশাকে যত ধুলোই জমুক না কেন, যতই ছেঁড়া হোক না কেন আসলে মানুষের পরিচয় তার মুখে। মুখখানাকে তো চাপা দেওয়া যায় না। আমি ঠিকই চিনেছি।

—জানি না আমার মুখ দেখে কি ভেবেছেন। তবে আমি একজন সাধারণ রাজপুত মাত্ৰ

—আমিও রাজপুত, সাধারণ রাজপুত। তাই তাদের এক নজরেই চিনতে পারি। তারা আপনার মতো এমন চেহারা পাবে কোথায়? কিন্তু একটা কথা—

—বলুন।

—মালিক মনে মনে হাসে। ভাবে ওষুধ ধরেছে বলেই মনে হয়। রহিমবক্সকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না বোধহয়। সে তাড়াতাড়ি বলে,—আপনার তলোয়ারখানা একটু বড় নয় কি?

—হ্যাঁ।

—এটা ব্যবহার করেন আপনি?

—সুযোগ তেমন ঘটেনি।

মালিক মনে মনে বলে, ঘটলেও যেন কত ব্যবহার করার মতো সুযোগ আছে? মুখে বলে, —আশ্চর্য! এতবড় তলোয়ার আমি জন্মে দেখিনি। দেখিনি বললে ভুল হবে। দেখেছি। ‘খঙ্গ-স্বপ্নের’ দিনে বহু পুরোনো অস্ত্রের মধ্যে এত বড় তলোয়ারকেও দেখেছি। তবে তাদের পুজো করা হয়। ব্যবহার করতে পারে না কেউ।

জিৎ সিং একমুহূর্ত চিন্তা ক’রে বলে,—এটি চেয়ে আনা। ওই অশ্বটির মতো এটিও ধার ক’রে এনেছি।

মালিক মনে মনে বলে, তাই বল। শোভা বর্ধন করার জন্যে এনেছে। মুখে তো বলল, ধার করে এনেছে। চোর-ছ্যাঁচড় নয় তো? ওই পুরোনো তলোয়ার আর অমন ঘোড়া কেউ ধার দেয়? যে দেয় সে মূর্খ।

সে মুখে বলে,–ও তাই বুঝি? ঘোড়াটিও ধার করে এনেছেন?

—হ্যাঁ।

—কে ধার দিল?

—মেবারের একজন রাজপুত। ওখান থেকেই আসছি আমি।

—ওরে বাব্বা। মেবার? তা, আপনাদের রানার খবর কি?

জিৎ সিং নাকের ডগায় তাচ্ছিল্য এনে বলে,—চুলোয় যাক রানা। আমি তার খোঁজ রাখি নাকি? দেখুন গে এতদিনে হয়তো সাপ বা বাঘের পেটে পড়েছে।

—এইবার বুঝেছি। আপনি এখানে থাকতে এসেছেন।

—ঠিক ধরেছেন।

—উন্নতি আপনি করবেন। আপনার চেহারা আর চোখমুখ দেখেই বোঝা যায় কেউ আপনাকে রুখতে পারবে না। তবে খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করবার পথ বাতলে দিতে পারি।

—সত্যি? বলুন না!

—ভেট দেবার মতো কিছু এনেছেন?

—ভেট? কাকে দিতে হবে?

—বাদশাহকে নয়। তিনি অনেক উঁচুতে। তবে তাঁর আশে-পাশে যাঁরা থাকেন, তাঁদের একজনকে খুশি না করতে পারলে উন্নতির আশা নেই।

চেষ্টা করব খুশি করতে।

—আপনি তো সহজেই খুশি করতে পারেন। আপনার ওই চমৎকার ঘোড়াটি উপহার পাঠিয়ে দিন ওদের কাউকে। অমন জিনিস পেলে মন আপনা থেকেই ভিজে উঠবে।

জিৎ সিং তার চোখেমুখে পুরোপুরি আগ্রহ ফুটিয়ে বলে—এ তো খুব সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? ওটিকে ফেরত দিতে হবে। আমি বরং আর একটি সংগ্রহ করে দেব।

—তবেই হয়েছে।

—কেন?

—এত সুন্দর ঘোড়া কয়টি আছে? এটিকে ফেরত দিলে, এমন আর একটি যোগাড় করতে আপনার যৌবন চলে যাবে।

—সে-ও একটা কথা বটে। আচ্ছা ভেবে দেখি। এই তো এলাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে খেয়ে-দেয়ে সুস্থ হতে দিন। ঘোড়াটির পেটেও দানা-পানি পড়ুক।

—হ্যাঁ হ্যাঁ। সে তো বটেই। খাওয়া-দাওয়া করুন। বিশ্রাম নিন। সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। চলুন আপনার থাকবার ঘর দেখিয়ে দি।

জিৎ সিং সরাইখানার মালিককে অনুসরণ করে। সে বুঝতে পারে, সব রাজপুতের কাছে সব কথা বলা যায় না। এদের সঙ্গে, এদের একজন হয়েই মিশতে হবে। নইলে সন্দেহ করবে তাকে। সে চায় না কেউ তাকে সন্দেহ করুক।

নিজের ঘর দেখে নিয়ে কোষ থেকে অসি খুলে একপাশে রাখে জিৎ সিং। তারপর ঘোড়ার গায়ে বাঁধা জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসতে আবার বাইরে পা দেয়।

মালিক বলে,—আপনার পাশের ঘরে আর একজন আছেন। তিনিও রাজপুত। আজকাল আগ্রায় রাজপুতের ছড়াছড়ি। হয়েছে ভালো। কে যে কী উদ্দেশ্য নিয়ে আসে বোঝা দায়।

—তিনি ঘরে আছেন?

—না। বাইরে গেলেন। তিনদিন হল এসেছেন। সারাদিন বাইরেই কাটান। ফিরে আসেন সেই রাতে। সন্ন্যাসী মানুষ মশায়। কারও সঙ্গে বড় একটা কথাও বলেন না। কিছু যদি শুধোই, উত্তর পাব ‘হুঁ’ আর ‘হ্যাঁ’। কত রকম মানুষেরই যে আমদানি হয় এখানে। বিচিত্র জায়গা!

মালিকের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে ছিল না জিৎ সিং-এর। সে চায় একটু বিশ্রাম। সে চায় একটু ভাবতে।

কিন্তু অবসর পায় না সে। রহিমবক্সকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে সেই কিশোর। রহিমবক্স কোনোরকম ভূমিকা না করেই জিৎ সিং-এর সামনে এসে বলে,—মুনিম খাঁকে চেনেন? খাঁ জাহাঁকে চেনেন?

লোকটির কথার ধরনে জিৎ সিং অবাক হয়। তারপর ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে বলে,—না।

—চিনবেন। আস্তে আস্তে সবাইকে চিনবেন। মুঘল রাজত্বে বাস করতে হলে বাদশাহের সঙ্গে সঙ্গে এঁদের না চিনে উপায় নেই। এঁরাই হচ্ছেন বাদশাহের ডান হাত, বাঁ হাত, ডান পা, বাঁ পা। আর আমি? আমি হচ্ছি তাঁদেরই পেয়ারের আদমী।

—জেনে সুখী হলাম।

—হয়েছেন তো? এবারে আমার একটি প্রস্তাব আছে।

—বলুন।

—এই ঘোড়াটিকে খরিদ করতে চাই। আমি নিজে খরিদ করব না। যাঁদের নাম আপনাকে শোনালাম, তাঁদেরই একজনের হয়ে আমি কিনব।

জিৎ সিং বুঝতে পারে, আতর-ওয়ালার কথা ফলতে শুরু করেছে। এখানে সবারই ঘোড়ার ওপর বড় বেশি নজর। উটওয়ালা প্রশ্ন করেছে, সরাইখানার মালিকও মন্তব্য করেছে। সে একটু সময় নিয়ে বলে,—কিন্তু আমি তো এখনো ভেবে দেখিনি। কাল আসুন, রাত্রিটা আমাকে ভাবতে দিন।

—না না, তা হবে না। অত সময় নষ্ট করা চলবে না।

—ঘোড়াটা আমার। বিক্রি যদি করি, আমি করব। এতে সময় নষ্টের কি আছে?

রহিমবক্স সরাইখানার মালিকের দিকে চাইতে, মালিক চোখ টেপে। তাই সে তাড়াতাড়ি জিৎ সিং-কে বলে,—তা বেশ। আজ রাতটা ভাবুন। কালই না হয় আসব।

মালিক বলে ওঠে,—হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই ভালো। তুমি বড্ডো তাড়াহুড়ো করছ রহিমবক্স সাহেব। কতদূর থেকে এসেছেন জানো? সেই মেবার থেকে, এখানে থাকতে এসেছেন। এখানেই কাজকর্ম জুটিয়ে নেবেন। তা, আজকের মতো একটু বিশ্রাম নিতে দাও।

—তা ঠিক।

জিৎ সিং-এর কাছ থেকে রহিমবক্সকে ইশারায় একটু দূরে ডেকে গিয়ে বলে,—মড়ার মতো ঘুমোবে আজ রাতে। দেখছিস না কি রকম ক্লান্ত? বিনে পয়সায় পেয়ে যাবি।

—তবে তো কথাই নেই।

—কত দিবি?

—আধাআধি। রাজি?

—হুঁ

রহিমবক্স চলে যায় তখনকার মতো।

কিন্তু সে ফিরে অসে গভীর রাতে। আগ্রার মতো নগরীও তখন প্রায় নিঝুম। শুধু দু-এক জায়গার নাচগানের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছে। আর থেকে থেকে পাহারাওয়ালাদের হুঙ্কার শোনা যায়।

রহিমবক্স টোকা দেয় মালিকের দরজায়

মালিক জেগেছিল। তাড়াতাড়ি কপাট খুলে দেয়। ওধার থেকে ছোকরা চাকরটি পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে।

ফিসফিস ক’রে রহিমবক্স প্রশ্ন করে,—সব ঠিক হ্যায়?

—বিলকুল ঠিক হ্যায়। নিজের ঘোড়া মনে ক’রে টেনে নিয়ে যাও।

—বাঃ তোফা। তোমার মতো মানুষ আমি তামাম হিন্দুস্থানে দেখিনি

—আধাআধি তো?

—আরে হ্যাঁ হ্যাঁ।

—কিন্তু ভাই একটি কাজ করতে হবে। সরাইখানার দৌলতে আমি খাই। আমাকে কেউ অবিশ্বাস করে, তা আমি চাই না। লোকের মনে একবার সন্দেহ ঢুকে গেলে খদ্দের জুটবে না। সরাইখানা বন্ধ ক’রে দিতে হবে।

—কি করতে চাও?

—তুমি আমার হাত-পা শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে দাও। মুখের ভেতরে কাপড় গুঁজে দাও। দড়ি ঠিক ক’রে রেখেছি। তুমি চলে গেলেই মাধব ছুটে যাবে ওর ঘরে। গিয়ে ধাক্কা দেবে আর চিৎকার করবে, ব্যস।

—ইস, কী মাথা!

মালিক এবার ছোকরার দিকে চেয়ে বলে,—ভালো করে শুনে রাখ মাধব। তুই গিয়ে বলবি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তোর। দেখলি, পাঁচ-ছয়জন মানুষ মিলে আমার হাত-পা বেঁধে ফেলছে। দেখেই তুই ছুটে গেছিস, বুঝলি? পাঁচ-ছয়জন। কমও না, বেশিও না।

ছেলেটি মিটমিটে হাসি হেসে ঘাড় কাত করে।

রহিমবক্স মালিককে বেঁধে ঘোড়া নিয়ে চলে যেতেই মাধব ছুটে জিৎ সিং-এর দরজার ওপর গিয়ে পড়ে।

একলাফে উঠে তলোয়ার তুলে নেয় জিৎ সিং তার পাশ থেকে। বাবার মতো সে-ও ওটিকে পাশে নিয়ে ঘুমোনো অভ্যাস করেছে।

দরজা খুলে দাঁড়াতেই ছেলেটি আতঙ্কভরা মুখে বলে,—শিগির চলুন, শিগগির।

—কি হয়েছে?

—মালিককে খুন করেছে।

মাধবের চিৎকারে পাশের ঘরের লোকটিও বের হয়ে আসে।

জিৎ সিং ছুটে যাবার জন্যে চেষ্টা করতেই লোকটি বাধা দিয়ে বলে,—দাঁড়াও। আমায় আলোটা জ্বেলে নিতে দাও। অন্ধকারে গিয়ে কিছুই দেখতে পাবে না।

তারপর শান্ত অথচ ক্ষিপ্রভাবে বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে লোকটি বলে,—এবারে চল।

মালিকের ঘরে তারা গিয়ে দেখে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় সে মাটিতে পড়ে গোঁ গোঁ করছে।

জিৎ সিং বিন্দুমাত্র বিলম্ব না ক’রে তলোয়ার দিয়ে দড়ি কেটে দেয়, মুখের কাপড় হাত দিয়ে যেনে বের করে দেয়।

পাশের ঘরের লোকটি মালিকের পাশে বসে পড়ে বাতি দিয়ে তার দড়ি-বাঁধা জায়গাগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করে।

মালিক আর্তস্বরে কেঁদে ওঠে,– পারলাম না। এত চেষ্টা করেও পারলাম না।

—কি হয়েছে?

—পাঁচ-ছয়জন মিলে আমাকে বেঁধে ফেলল। মেরেই ফেলত, ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে রয়েছি।

—টাকাকড়ি কিছু নিয়ে গেছে?

—না, ওসব ছোঁয়নি। ওসব যদি নিত বরং ভালো হত। আমার সম্মান থাকত। আমার সর্বস্ব লুঠ ক’রে নিলেও আপনাদের সামনে মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু ঈশ্বর সেদিক দিয়ে আমাকে একটুও কৃপা করেননি। ব্যাটারা আমার মাথা নীচু ক’রে দিয়ে চলে গেল।

চকিতে জিৎ সিং ঘুরে দাঁড়ায়। বাতির আলোকে সে দেখতে পায়, তার ঘোড়া নেই।

চেঁচিয়ে ওঠে সে,—আমার ঘোড়া?

—সেই কথাই তো বলছি। পারলাম না, কিছুতেই পারলাম না।

—কে নিয়েছে?

—চিনি না, জীবনে ওদের কখনো দেখিনি

—দিনের বেলায় যে এসেছিল?

—রহিমবক্স? না না, ওকে দোষ দেওয়া মহাপাপ। ও শুধু আমীর ওমরাহদের তোয়াজ করবার জন্যে পয়সা দিয়ে জিনিস কেনে। ও নয়। দেখবেন, কথামতো কাল সকালেই আসবে আবার। এসে ঘটনার কথা শুনে বড়ই হতাশ হবে।

জিৎ সিং তখনি ছুটে যেতে চায় বাইরে। পাশের ঘরের লোকটি তার হাত চেপে ধরে বলে, -লাভ হবে না। তার চেয়ে ঘরে চল, কথা আছে।

জিৎ সিং এতক্ষণে লক্ষ্য করে লোকটিকে। বয়স তেত্রিশ কিংবা চৌত্রিশ। সারামুখ দাড়ি গোঁফে ভর্তি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। ব্যক্তিত্বের ছাপ রয়েছে মুখে, অথচ একটা নিরাসক্ত ভাব। মালিক ঠিকই বলেছে,—সন্ন্যাসী। জটা নেই যদিও, তবু সন্ন্যাসী।

লোকটির কথায় বিশ্বাস ক’রে ফেলে জিৎ সিং। সত্যিই কোনো লাভ হবে না পিছনে ছুটে। ওদের একজন ঘোড়া নিয়ে ভেগেছে। বাকি কয়জন নিশ্চয়ই এদিক ওদিক দিয়ে সরে পড়েছে। নতুন জায়গায় রাস্তায় বেরিয়ে এই রাতে তাদের খুঁজে বের করা অসম্ভব।

লোকটির পেছনে পেছনে তার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে সে।

—আমাদের দুজনার ঘরের মাঝখানে একটি দরজা আছে। আমি খুলে দিচ্ছি, তুমি তোমার ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ক’রে দিয়ে এস।

জিৎ সিং তার কথামতো বন্ধ করে দিয়ে আসে নিজের ঘরের দরজা। ঘোড়াটি চুরি যাওয়ার হতাশায় তার মন ভরে উঠেছে। কিকার শ্রেষ্ঠ ঘোড়ার একটি এটা। আতরের দোকানী সাবধান করে দেওয়া সত্ত্বেও সে সাবধান হয়নি। তার উচিত ছিল ঘোড়ার পাশে শুয়ে রাত কাটানো।

—মন খারাপ হয়ে গেছে, তাই না? স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক। ঘোড়াটিকে আমি দেখেছি, সুন্দর ঘোড়া। রানা উদয়সিংহের পুত্র প্রতাপের অমন একটি ঘোড়া ছিল।

জিৎ সিং রীতিমতো অবাক হয়ে বলে–আপনি চেনেন তাঁকে?

—চিনব না? প্রতাপকে চিনব না? সে যে একলিঙ্গের কাছে প্রায়ই যেত।

—–কে আপনি?

—আমি ভবঘুরে।

——আপনার নাম?

—সন্ন্যাসীদের মতো ভবঘুরেদেরও নাম নেই। তারা গৃহাশ্রমের নাম পরিত্যাগ করে।

জিৎ সিং চুপ করে থাকে।

—প্রতাপকে ওই রকম ঘোড়ায় চাপতে দেখেছি। চমৎকার ছেলে প্রতাপ। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

জিৎ সিং ভেবে পায় না আসল কথা বলে ফেলবে কি না। কার মনে কি আছে, কে জানে। হয়তো মুঘলরা তার পেছনে লাগিয়েছে, একে, পেটের কথা টেনে বের করবার জন্যে।

ভবঘুরে বলে,–-তোমার ঘোড়া পাবে কি করে? মালিক নিজেই যে চুরি করিয়েছে।

—কী বললেন?

—মালিকের সঙ্গে যোগসাজশেই চুরি হয়েছে।

—আপনি দেখেছেন?

হেসে বলে লোকটি,—না। চোখে দেখিনি অবশ্য। কিন্তু সব জিনিসই কি চোখে দেখে জানতে হয়?

—আপনি কি ভাবে জানলেন?

—মালিকের হাত-পায়ের দড়ি-বাঁধা জায়গাগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা ক’রে জেনেছি। তুমি তখন খুব উত্তেজিত, তাই খেয়াল করনি। নইলে দেখতে মালিকের শরীরে কোথাও দড়ির দাগ পড়েনি।

জিৎ সিং অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকে। বুদ্ধির ব্যবহার করব বললেই করা যায় না। তার জন্যে যে কোনো অবস্থাতেই মনটিকে উত্তেজনাহীন এবং ধীরস্থির রাখবার সাধনার প্রয়োজন। সে লক্ষ্য করেছিল, তার সামনে উপবিষ্ট লোকটির আচার-ব্যবহার। ছেলেটির চিৎকারে এতটুকু চাঞ্চল্য প্রকাশ করেনি।

লোকটি হেসে বলে,—মালিক ভুল করেছে। দু-একবার চিৎকার করলে পারত। তার বিপক্ষে যত লোকই থাকুক চিৎকারে বাধা কোথায়? দড়ির বাঁধন আর একটু জোরে হলে ভালো হত। ছেলেটিকেও লক্ষ্য করেছি। অভিনয় করছিল। যতটুকু অভিনয়ের ভার ওর ওপর দেওয়া হয়েছে, ঠিক ততটুকুই করেছে। বেশিও নয়, কমও নয়। মালিকের সামনে আমাদের নিয়ে গিয়েই সে একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছল। তার অভিনয়ের ভার ওই অবধি ছিল।

লোকটি হাসতে থাকে।

জিৎ সিং বলে,—আমি মূর্খ। তাই এসব লক্ষ্য করিনি।

—না। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তোমার চোখের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধির দীপ্তি। তবে আসল সময়ে বুদ্ধির পরিবর্তে শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তোমার অমন রোগাটে চেহারা হলে কি হবে, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারনি। যথেষ্ট শক্তি ধর তুমি। তোমার দেহ চিতাবাঘের মতো তৎপর।

—আপনি আগ্রায় এসেছেন কেন?

—আমি যে ভবঘুরে।

—প্রতাপসিংহকে আপনি পছন্দ করেন?

—ভীষণ।

—আকবর শাহ্কে?

—লোকটি অসাধারণ।

—পছন্দ করেন তাঁকে?

—আমার পছন্দ কিংবা অপছন্দে তাঁর মতো বিরাট ব্যক্তির কিছু এসে যায় না।

—বুঝেছি। আপনি শুনলে হয়তো অবাক হবেন, ওই ঘোড়াটি উদয়সিংহের পুত্র প্রতাপসিংহের।

—অত সহজে আমি অবাক হই না। কিন্তু তুমি কি ক’রে পেলে?

—তিনিই দিয়েছেন আমাকে।

—আগ্রায় আসবার জন্যে?

—হ্যাঁ।

—যাও। বেশ বেশ। কিন্তু একথা দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে কখনো বলতে যেও না।

—আমি দুজন লোকের সন্ধান চাই।

—কারা?

জিৎ সিং উঠে নিজের ঘরে গিয়ে প্রতাপের লেখা নাম দুটো এনে লোকটির হাতে দেয়।

ভবঘুরে নাম দুটির ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে,—এরা কেউ এখন এখানে নেই। একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপরজন ব্যবসা বন্ধ ক’রে দেশে চলে গেছে।

জিৎ সিং একটু হতাশ হয়।

লোকটি তার হাত দুটো চেপে ধরে বলে,—আমি তো আছি। কখনো কোনো দরকার হলে যমুনার তীরে চলে যেও। এদিকে ওদিকে দু-একবার পায়চারী করলেই আমায় দেখতে পাবে।

জিৎ সিং কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। নির্বান্ধব অচিন পুরীতে একজন অন্তত বন্ধু জুটলো।

অশ্বটির কথাও তার মনে হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যেভাবেই হোক কিকার অশ্বকে উদ্ধার করবেই। তার জন্যে রক্ত দিতে হয় দেবে। লোকগুলোকে দেখিয়ে দেবে, ভুল জায়গায় তারা হাত দিতে গিয়েছিল।

নিদ্রার আগে, লীলাবতীর কথা অভ্যাস মতো মনে হয় তার। সতিই কি সে চিরকালের মতো সরে গেল তার জীবন থেকে? ফিরে গেলে সত্যিই কি সে তাকে আর গ্রহণ করবে না? অতটা নিষ্ঠুর হতে পারবে লীলাবতী?

কিন্তু না। লীলাবতীর চিন্তায় নিজেকে আচ্ছন্ন রাখলে চলবে না। পাশের ঘরের লোকটি এক দামী কথা বলেছে। বলেছে বুদ্ধির পরিবর্তে শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তার। ভবিষ্যতে এমন আর কখনো হতে দেবে না সে। তেমন অবস্থায় পড়লে শক্তিকে দাবিয়ে রেখে বুদ্ধির পথকে অর্গলমুক্ত ক’রে দেবার চেষ্টা করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *