আগ্রাসন ও সংস্কৃতি: প্রসঙ্গ বাংলাভাষা – বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

আগ্রাসন ও সংস্কৃতি: প্রসঙ্গ বাংলাভাষা – বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

‘ভাষার মৃত্যু’ বিষয়টি এখন অনায়াস এক প্রস্থান। নানারকম বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে একটি ভাষার দাপটে অন্য ভাষা অবলুপ্ত হয়। নেপথ্যে ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠী, অভিবাসন, রাজনৈতিক টানাপোড়েন অনেক স্বার্থ কাজ করে থাকে। এযেন ঠিক, অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো। সেখানে যেমন বড় এবং শক্তিশালী মাছের দাপটে দুর্বল মাছ ধরাশায়ী হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও দুর্বল ভাষা অপসৃত হয়। ভাষিক এই মৃত্যু বলতে পুরো ভাষাগোষ্ঠী নয়, কিন্তু গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তার কিছু মানুষ নিজেদের ভাষা ছেড়ে দিচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে সেভাষা একেবারেই শেখাচ্ছে না। কিছু মানুষ চাকরি সূত্রে, অভিবাসনের জন্য উদ্বাস্তু হয়ে নিজেদের ভাষা ব্যবহারের সুযোগ একেবারেই পাচ্ছে না। পরিবর্তিত অবস্থানের ভাষার সঙ্গে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রস্তুত হচ্ছে। প্রবাসী বাঙালি এবং তাদের আগামী প্রজন্ম এই সমস্যার প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হয়। পরিবর্তিত দেশে বিবাহসূত্রে তারা বিদেশী বা বিদেশিনীর সঙ্গে আবদ্ধ হলে পরবর্তী প্রজন্ম একেবারেই তাঁর বাবা-মায়ের মাতৃভাষার স্পর্শ অনুভব করতে পারবে না। এই প্রতিনিয়ত ভাষাক্ষয়ের বিপরীতে আছে ভাষারক্ষণ। ভাষীরা নানাভাবে তাদের মাতৃভাষাকে আঁকড়ে বেঁচে আছে। এই ভাষাক্ষয় এবং ভাষারক্ষণ— দুরকম প্রবণতাই বাস্তব হলেও ভাষাক্ষয়ের পাল্লা যেন ভারী। এটাই আসলে ভাষার আগ্রাসন। সংস্কৃতির আধিপত্য আসলে আগ্রাসনকে ইন্ধন জোগায়। এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতার উপস্থিতির প্রাবল্যে সমগ্র ভাষাগোষ্ঠী বিবেচনার বাইরে থাকতো। সেক্ষত্রে বিষয়টি কিছুটা স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। মাইশোরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় ভারতীয় ভাষা সংস্থান থেকে প্রকাশিত পুস্তিকায় ব্যাঙ্গালোরের বাঙালি অধিবাসীর ভাষা বা দিল্লিতে কন্নড় ছেলেমেয়ের ভাষার রক্ষণ এবং ক্ষয়ের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা ছোটো একটি সমষ্টির ভাষার এই ক্ষয়কে ‘ভাষার মৃত্যু’ হিসেবেই গণ্য করা হতো না। মূল ভাষাভূমিতে ভাষাটি অক্ষত আছে বলেই বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত ভাষার ওপর প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করা হয়েছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা ছোটো একটি সমষ্টির ভাষার ক্ষয়কে ‘ভাষার মৃত্যু’ বলে মনে করা হয়নি। নেপথ্যের মূল ভাষাভূমিতে ভাষাটা অক্ষত আছে বলেই মনে হয়। তাই, বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত সেসবের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলবে না বলেই আগের মত এখনও মনে করা হয়। নিজস্ব ভাষাভূমিতে, নিজের হাজার বছরের ভৌগোলিক এবং সামাজিক প্রতিবেশে লালিত এবং বিকশিত ভাষার বিলয়কেই ‘ভাষার মৃত্যু’ বলা হয়ে থাকে। ভাষা আসলে নিজে তো মরে না, মরে ভাষীরা অর্থাৎ ভাষার বক্তারা। ক্রিস্টাল ২০০০ সালে একটি পরিসংখ্যান তুলেছে যে, এই পরিসংখ্যান তৈরিতে সহায়তা করেছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সামার স্কুল অব লিঙ্গুইসটিক্‌স-এর মুখপত্র Ethnologue এর একটি সমীক্ষা— পৃথিবীতে ৫১টি ভাষায় একজন বক্তা বেঁচে আছে, ৫০০ ভাষার বক্তা ১০০- এ রকম, ১৫০০ ভাষায় ১০০০- এর বেশি নয়, ৩০০০ ভাষায় ১০০০০- এর মত বক্তা আর ৫০০০ ভাষায় বক্তা একলক্ষের কাছাকাছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাষাগুলির বক্তা সংখ্যা উদ্ধার করে বলা যায় যে, ইংরেজির বক্তাদের মৃত্যু হলে সম্পূর্ণ ভাষার মৃত্যু হয়, কথাটি আংশিক সত্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বক্তারা নিজেদের ভাষা ছেড়ে পারিপার্শ্বিক রাজনীতি-অর্থনীতি এবং শিক্ষানীতির চাপে পরিবর্তিত ভাষায় কথা বলা শুরু করে। বিষয়টির নাম ‘ভাষালম্ফন’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষালম্ফন বা স্পষ্টত ভাষা বর্জনের কারণেই ‘ভাষার মৃত্যু’ হয়। দুটো ভাষায় পাশাপাশি কথাবার্তা চলতে থাকলে, ক্রমিক ভাবে নিজের ভাষায় অন্য ভাষার উপাদান যুক্ত হয়। বলা উচিত, অন্য ভাষাই বক্তার জিহ্বাকে দখল করে। অভিবাসী পরিবারের ক্ষেত্রে এই লক্ষণ প্রকট। প্রতিবেশের চাপে স্বীয় ভাষার প্রতি তৈরি হওয়া অবহেলা থেকে ক্ষয় আর তা থেকে সে ভাষার অপমৃত্যু— সমীকরণ এরকম। এজন্যই অনেকে ‘ভাষার মৃত্যু’ বা ‘ভাষার হত্যা’ শব্দবন্ধের চেয়েও ‘ভাষালম্ফন’ বা ‘Language Shift’ শব্দবন্ধে অধিক স্বচ্ছন্দ। ভাষার আরেক ধরনের মৃত্যু অবশ্য আক্ষরিক অর্থে মৃত্যু নয় ঠিক। এটি আসলে বিবর্তনজনিত কারণে মৃত্যু। ভাষা ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছায়, সেখানে আর আগের ভাষার আর ভাষী নেই দেখা যায়। সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষার জন্ম নিতে দেখা যায়। এভাবেই, একদিন ইউরোপে কথ্য লাতিন ভেঙে ফরাসি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ইতালীয় এবং রুমানীয় ভাষার জন্ম হয়েছিল। ভারতে সংস্কৃতের কথিত রূপ থেকে প্রাকৃত ভাষার এবং পরে আবার প্রাকৃত থেকে আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির জন্ম হয়েছে। নতুন ভাষার জন্ম মানেই আগের ভাষার মৃত্যু। নতুন ভাষার অবস্থান মাতৃঘাতী সন্তানের মেটাফরের সঙ্গে সাদৃশ্যে অন্বিত। পুরনো ভাষার মৃত্যুকে বরণ করেই নতুন ভাষা জন্ম নেয়। তাই, ভাষার সঙ্গে নদীর উপমা তৈরি হয়েছে। Ethnologue১ পত্রিকায় প্রকাশিত ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে সেসময় ৬৯১২টি ভাষায় কথা বলা হচ্ছিল। তন্মধ্যে ইউরোপের ভাষা ২৩৯টি এবং আফ্রিকার ভাষা ২০৯২টি। অবশ্য, এসব থাকলেও ভাষার মরণ বাঁচন বিষয়ে দুটি বাক্যে সকলেই দ্বিধাহীন: প্রথমত, মানুষের ভাষা শুরুর সময়ে ভাষার সংখ্যা এই প্রাপ্ত সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ ছিল; বোঝাই যায় যে, মাঝের দীর্ঘ বছরে অর্ধেক ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী সাত আট দশকে বর্তমান জীবিত ভাষার অর্ধেক সংখ্যক ভাষা বিলুপ্ত হবে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষাই বিলুপ্ত হবে। জনসংখ্যার পাশাপাশি ক্ষমতার দিকেও এইজন গোষ্ঠীর ভাষা দুর্বল।

দুই

আলোচনার এই পর্যায়ে ভাষাবিলোপের প্রচলিত আখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র ভাষার ভাষীরা সকলে শক্তিশালী ভাষার দিকে ঝুঁকেছে। শক্তিশালী ভাষার মধ্যে আছে ইংরেজি, স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ ইত্যাদি। সাইবেরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে নিজেদের ভাষার বদলে রুশ ভাষার আধিপত্য। জার্মানির অস্ট্রিয়া অঞ্চলে হাঙ্গেরিয় ভাষা অবলুপ্ত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণে পাপুয়া নিউ গিনিতে কয়েকশো ভাষার প্রতিপক্ষ হয়েছে ‘টোক্‌ পিসিন’ নামক এক মিশ্রভাষা। এক বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রথম ভাষা হয়েছে। উত্তর আমেরিকায় ১৯৬০ সাল নাগাদ প্রায় ২০০ ভাষার অস্তিত্ব থাকলেও গত কয়েক দশকে তার সংখ্যা তলানিতে। অস্ট্রেলিয়াতে দিরবাল এবং মেক্সিকোতে নাহুয়াত্‌ল ভাষা মরণোন্মুখ। এখানেও সেই আধিপত্যের চেনা ছক! আধিপত্যজাত আগ্রাসন আসলে সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক হয়েছে। আমাদের দেশ পুণ্যতোয়া ভারতে এখন ৭৮০ টি ভাষায় কথা বলা হলেও গত পঞ্চাশ বছরে ২২০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলের ক্ষুদ্র ভাষাগুলির মৃত্যু সর্বাধিক। বাংলাদেশে দ্রাবিড় গোত্রের মালপাহাড়িয়া, ভোট-বর্মি গোত্রের খুমি, ঠার-ঠেট, লালং ইত্যাদি ক্ষুদ্র ভাষা বর্তমানে বিপন্ন। সিকিমে নামি মাঝি ভাষার মাত্র ৪ জন বক্তা টিকে আছেন এবং ত্রিপুরার চইমাল ভাষার আছে ৪-৫ জন। ভাষাবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, বর্তমান পৃথিবীতে কথিত ৬৯০০টি ভাষার অর্ধেক ভাষা বর্তমান শতাব্দীতে বিলুপ্ত হবে। ভাষার বিপন্নতারও কয়েকটি পর্যায় দেখা যাচ্ছে। প্রথম পর্যায়, ‘হবু বিপন্ন’ (Potentially Endangered)— যেখানে ভাষাটি একটি বড়ো এবং প্রতাপান্বিত ভাষার সংস্পর্শে এসেছে। দ্বিতীয় পর্যায়, ‘বিপন্ন’ (Endangered)— যখন কচিকাঁচাদের কাছে এ ভাষা শিক্ষণীয় হচ্ছে না। শেষপর্যায় হল, ‘রীতিমতো বিপন্ন’ (Serious Endangered)— যখন ৫০ বছরের কমবয়সিদের মধ্যে উক্ত ভাষার স্বচ্ছন্দ বক্তা বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। ভাষার ‘মৃতপ্রায়’ (Moribund) অবস্থা হল, যখন কিছু বৃদ্ধ কোনো ভাষায় কথা বললেও কমবয়সীরা অন্য ভাষায় কথা বলে। এবারে ভাষার মৃত্যুর কারণ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হওয়া যাক। কোনো কোনো গোষ্ঠী নিজেদের ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় কেন চলে যায়? এর নেপথ্যে আছে তিনটি কারণ (জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী হান্স য়ুর্গেন সাসে-এর অভিমত)। এগুলি ক্রমান্বয়ী— অর্থাৎ, প্রথমটি দ্বিতীয়টির সূত্রপাত ঘটায় এবং দ্বিতীয়টি তৃতীয়টিকে সম্ভব করার ফলে ভাষাবর্জনের ঘটনা হয়ে থাকে। প্রথমটি হল বহির্ব্যবস্থা (ES = External Setting), দ্বিতীয়টি হল ভাষাচার (SB = Speech Behaviour) এবং তৃতীয়টি হল ভাষার শরীরে তার প্রভাব (Structural Consequence)২। ফলে, ভাষার ক্রমিক বদলের মাধ্যমে অন্য ভাষার হয়ে ওঠা— ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’র প্রকল্প! প্রথমটি সবচেয়ে শক্তিশালী। অন্য দুটি ঘটনার কারণ এটাই। বহির্ব্যবস্থা মানে হল, এমন এক দ্বিভাষিক পরিবেশ, যেখানে লুপ্ত ভাষার পাশে আরেকটি শক্তিশালী ভাষায় সে ভাষার ভাষীরা কথা বলবে। আমরা নানাকারণে যে ভাষায় শিখতে বা কথা বলতে বাধ্য হই সেটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। ভাষার শক্তি বা দৌর্বল্যের ভিত্তি ব্যক্তিগত নয়, তা সামূহিক। কোনো ভাষা গোষ্ঠীগত ভাবে শক্তিশালী হয়, যখন সে ভাষা হয় প্রশাসনের ভাষা, স্কুলে শিক্ষার ভাষা, পাঠ্যসাহিত্যের ভাষা, পাঠ্য এবং দৃশ্য-শ্রাব্য সংবাদমাধ্যমের ভাষা। এ সবের পাশাপাশি উক্ত ভাষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বা ধর্মের ভাষাও হয়ে ওঠে। আমাদের বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিষয়টি পরিস্কার করা যেতে পারে। বাংলার মান্য চলিতের সঙ্গে সমীপবর্তী যে-সব উপভাষা, সেগুলি ক্রমশ অভিন্ন হতে চলেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে, টেলিভিশনে এবং পাঠ্যবইতে যথাক্রমে শুনছে, দেখছে এবং পড়ছে মান্য চলিত। যাতায়াতের সুব্যবস্থার ফলে মান্য চলিতের ভিত্তিভূমির সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমবর্ধমান হচ্ছে। বাড়িতে তাই বাড়ির ভাষা বা উপভাষার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সব ছেলেমেয়েরা চাকরি, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কাজকর্মে মান্যচলিত ব্যবহার করবে। মান্য চলিতভাষী কারো সঙ্গেই বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হবে। নিজের গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে শহরের ভাষা, কলকাত্তাইয়া মান্য চলিত ভাষা আয়ত্ত করবে। এদের পরবর্তী প্রজন্ম ঘরের উপভাষায় অভ্যস্ত হবেনা। এভাবেই অনেকে উপভাষা ছেড়ে বাঙালিরা মান্য চলিতে অভ্যস্ত হবেন। এখানেই ‘গোটা ভাষা’র ধারণা সামনে আসে। পৃথিবীর অনেক ভাষাই একাধিক উপভাষার সমষ্টি। স্থানীয় উপভাষা এবং শ্রেণিগত উপভাষা-র ভিত্তিতেই অনেক সময় মান্য একটি ভাষা রূপ পায়। এভাবেই তৈরি হয় ‘গোটা ভাষা’। আমাদের বাংলা ভাষা-ও। তাই একটি বাংলা ভাষা নয়, আদতে তা অনেক রকমের বাংলার সংমিশ্রণ। নানা কারণে অন্য ভাষা শেখার মানে এই নয় যে, মাতৃভাষা ত্যাগ করে সেই ভাষাকে মাতৃভাষানুগ করে তুলতে হবে। ব্যক্তির ভাষার শক্তি এবং তার গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যক্তির ভাষাগত সংহতির ওপরেও বিষয়টি নির্ভরশীল। ভারতের প্রধান ভাষাগুলির ক্ষেত্রেও বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। চাকরির জন্য ইংরেজি শিখলেও দলে দলে নিজস্ব মাতৃভাষা মরাঠি, গুজরাতি, হিন্দি, তামিল, মলয়ালম এবং বাংলা ছেড়ে ইংরেজি ভাষার গহনে স্থায়ী অভিবাসন নেওয়া হচ্ছে না। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। ইউনেস্কোর বিপন্ন ভাষার তালিকায় ইংরেজির ক্রমাঙ্ক ০ (সুতরাং, ইংরেজি আদৌ বিপন্ন ভাষা নয়), মাতৃভাষা বাংলা, মরাঠি এবং অন্যান্য ভাষা আছে ১ ক্রমাঙ্কে— এদের বিপন্নতার মাত্রা এখনো পর্যন্ত খুব কম। ইংরেজির মতো একটি শক্তিশালী ভাষা ঔপনিবেশিকতা এবং বিশ্বায়নের ফলে বাংলা ভাষাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করেছে। বাঙালিরা বিশেষত এই ‘খিচুড়ি’ ভাষা বিষয়ে বিশেষ সচেতন এবং উদ্বিগ্নও বটে (যেমন, বাংলিশ, হিংলিশ ইত্যাদি)। ভাষা অতঃপর অন্য ভাষাকে সব জায়গা ছেড়ে দেবে। ছেড়ে দেওয়া বলতে যেসব ক্ষেত্রে নিজের ভাষা ব্যবহৃত হয়, সেসব ক্ষেত্রে তার ক্রমিক পশ্চাদপসরণ ঘটবে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক আদান-প্রদান— সর্বক্ষেত্রেই শক্তিশালী ভাষা নিজের ভাষার জায়গা নেবে।

তিন

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও আমাদের রাজ্য এবং রাষ্ট্র উভয়েই বহুভাষী। তাই মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাকে ব্যবহারের জন্য সমস্যা তৈরি আছে অনেকদিন থেকেই। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা স্মরণে রেখেও একথা বলা যায়। বহুভাষী রাজ্য বলেই পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর সমস্যা রয়েছে। এখানে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের একাধিক পর্যায় রয়েছে। কিছু সংখ্যালঘুর ভাষা সাহিত্যিক ঐতিহ্যে যথেষ্ট উন্নত। রাজ্যের হিন্দি, উর্দু, তামিল ওড়িয়া, তেলেগু, নেপালী ভাষাগোষ্ঠী সম্পর্কে একথা বলা যায়। রাজ্য সরকার তাদের জন্য বিশেষ ভাষাভিত্তিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাদের ভাষাকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুতরাং, সেসব ভাষায় শিক্ষাদানে সমস্যা নেই। দীর্ঘদিনের সমৃদ্ধ লিখিত সাহিত্য থাকার ফলে পাঠ্যপুস্তক তৈরি এবং যোগ্য শিক্ষক পাবার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে আরেক শ্রেণির সংখ্যালঘু নিয়ে। এঁদের ভাষা প্রশাসনিক স্তরে খুব শক্তিশালী ছিল না, সদ্য স্বীকৃতি পেয়েছে অনেক জায়গাতেই। আমাদের রাজ্যে বিশেষত, সাঁওতালি, বোড়ো, মুন্ডারি, লেপচা সদ্য স্বীকৃত হয়েছে। সাঁওতালি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে, অলচিকি লিপি তাঁদের প্রার্থিত লিপি। সম্প্রতি, লেপচা ভাষার ক্ষেত্রেও নৈতিক স্বীকৃতি মিলেছে। অন্য ভাষাগুলি অবশ্য স্বীকৃত হয়নি। ভাষাগুলি প্রাচীন এবং এগুলিতে আশ্রিত লোকসাহিত্য এবং লোকজ্ঞানের বিপুল ভাণ্ডার। লিখিত সাহিত্য অবশ্য আরম্ভ হয়েছে একশো-দেড়শো বছরের মধ্যে। তাই দেশের আলোকপ্রাপ্ত অংশের সদ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। এঁদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ প্রায় ছিলই না। অস্ট্রিক ভাষাবংশের ভাষা সাঁওতালি হলেও তাঁরা বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এমনকি মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে ছড়িয়ে আছেন। এঁদের পূর্ববর্তীপ্রজন্ম স্থানীয় বৃহৎ ভাষাতেই লেখাপড়া শিখেছেন। কোথাও দেবনাগরি লিপিতে হিন্দি, কোথাও ওড়িয়া লিপিতে ওড়িয়া, কোথাও বাংলা লিপিতে বাংলা ইত্যাদি তাঁদের শিক্ষার মাধ্যম ছিল। সময়ের চলিষ্ণুতায় এঁদের মধ্যেও আলোকিত মধ্যবিত্ত সমাজ এবং গোষ্ঠীর উন্নতিকামী নেতৃত্বের বিকাশ হয়েছে। তাঁরা মাতৃভাষায় জনশিক্ষার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তাঁরা বুঝেছেন যে, মাতৃভাষায় শিক্ষা না করলে খুব বেশি ছাত্রছাত্রী শিক্ষার উচ্চস্তরে পৌঁছতে পারে না। ভারতে ১৮৫৭ সালে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে দেশের অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার বাহন হয়েছিল ইংরেজি। ১৯০১ সালের হিসাব অনুযায়ী, সমকালীন সাক্ষরতার হার মাত্র ৫.৩৫। স্বাধীনতার বছরে এই হার ১৭ শতাংশে এগোয় আর ১৯৫১ তে বেড়ে হয় ২৪ শতাংশ। তন্মধ্যে, ১৯২৯ সালে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাট্রিকুলেশনে মরাঠিকে শিক্ষার বাহন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯০৪ সালে বাংলাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে, সাক্ষরতা ছড়িয়েছে দ্রুত। অবশ্য, দুর্বল এবং পর্যুদস্ত সংখালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার সমস্যার সমাধান হয়নি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এঁদের ভাষা সম্পর্কে প্রশাসনিক নেতৃত্বের সচেতনতা ছিল না। যেসব ভাষার ‘উন্নত’ লিখিত সাহিত্য আছে সেগুলিকে তারা নানাভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। দেশের অষ্টম তপশিলে রেখে কখনো রাজ্যস্তরে প্রশাসনিক ব্যবহারে তা আনা হয়েছিল। দেশের সাহিত্য অকাদেমি থেকে একসময়ে এসব ভাষার সাহিত্যই পুরস্কৃত হত। অবশ্য, এখানে আদিবাসী সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ছিল না। সাম্প্রতিক সময়েও অবস্থা বিশেষ পাল্টায় নি। বস্তুত, এটিই হল ভাষিক আগ্রাসন। আমাদের প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকেরা অনেকেই সরকারি এবং প্রশাসনিক স্তরে সমস্ত কাজকর্ম এবং আদানপ্রদান বাংলা ভাষায় করতে চেয়েছিলেন। সরকারি কাজে ইংরেজিতে চিঠি লিখলে নাকি কদর বেশি। ধারণা অনেকটাই এরকম। বাংলাতে সরকারি কাজ হলেও অনেকসময়েই তা স্তিমিত। অনেকেই বলেন, সমস্যাটা মানসিক। গোলটেবিল বসে আলোচনাও হয়েছে বিস্তর৩। এখনো পর্যন্ত অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। তবে, এসব বিতর্কসভা যখন হয়েছে, তার থেকে অবস্থা অনেকটাই এখন ভালো। অত্যাধুনিক মুঠোফোনের দৌলতে আজ বাংলা সফট্‌ওয়ার হাতের মুঠোয়। তবে, আরো বেশিমাত্রায় সরকারি এবং প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রয়োজন। তবেই, আমরা সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করতে পারবো। আমরা আশাবাদী। অলমিতি।

টীকা

১. রিচার্ড এস. পিটম্যান প্রতিষ্ঠা করেন এই পত্রিকা। প্রথম সংস্করণ ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ছিল বাইবেল অনুবাদের বিষয়ে তথ্যাবলী প্রচার। পরবর্তীতে ভাষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে ২০০৫ সালের একটি পরিসংখ্যান।

২. THE THEORY OF LANGUAGE DEATH AND CONTACT-INDUCED CHANGE: SIMILARITIES AND DIFFERENCES প্রবন্ধে হান্স য়ুর্গেন সাসে-এর অভিমত: “…Three types of phenomena relevant to the study of language death must be clearly distinguished. First of all, there is the entire range of extralinguistic factors, the cultural, sociological, ethno-historical, economic, etc. processes, which create, in a certain speech-community, a situation of pressure which forces the community to give up its language. I will call this the External Setting (ES). …Let me first introduce the second set of phenomena, which I will class under the general term Speech Behaviour. By this I mean the regular use of variables, which, in a given speech community, are bound with social parameters. …The third set of data which is being studied in the investigation of language death is the purely structural, substantial –linguistic set of phenomena, e.g changes in the phonology, morphology, syntax, and lexicon of the language threatened by extinction. I will simply call these Structural Consequences (SC) phenomena.”

৩. এরকম একটি আলোচনা সম্পন্ন হয়েছিল গণশক্তির গোলটেবিলে। পারস্পরিক আলোচনায় তিনজন ছিলেন। প্রথমজন ভাষাতাত্ত্বিক পবিত্র সরকার, দ্বিতীয়জন সরকারি প্রশাসক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃতীয়জন শিল্পপতি অরুণকুমার চন্দ্র। তাঁদের আলোচনার সম্পাদিত অনুলিখন করেছিলেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। অনুলিখন পাঠের জন্য পাঠক পবিত্র সরকার রচিত চম্‌স্কি ব্যাকরণ ও বাংলা বানান (পুনশ্চ, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ২০১৩) দেখতে পারেন।

গ্রন্থপঞ্জি

আকর গ্রন্থ:

১. পবিত্র সরকার, ‘চম্‌স্কি ব্যাকরণ ও বাংলা বানান’, পুনশ্চ, কলকাতা, ২০১৩।

২. মৃণাল নাথ, ‘ভাষা ও সমাজ’, নয়া উদ্যোগ, কলকাতা, ১৯৯৯।

আকর প্রবন্ধ:

১. Hans-Jurgen Sasse, ‘THEORY OF LANGUAGE DEATH AND LANGUAGE DECAY AND CONTACT-INDUCED CHANGE: SIMILARITIES AND DIFFERENCES’, Germany, 1990.

সহায়ক পত্রিকা:

১. এবং মুশায়েরা, মৃণাল নাথ (সম্পাদিত), ‘ভাষা বিশেষ সংখ্যা’, কলকাতা, ২০১৫-২০১৬।

২. শ্রীময়ী, শিশির রায়চৌধুরী (সম্পাদিত), ‘বিশেষ বিষয় – ভাষাতত্ত্ব : উৎস নির্মাণ ও প্রয়োগ’, কলকাতা, ২০১৭।

লেখক পরিচিতি: পিএইচ.ডি গবেষক, বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *