আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম
এই আমার ঠাকুর, বিশ্ব-বেপরোয়া। কারো তোয়াক্কা করেন না। মনোরঞ্জনের কোন ব্যাপার নেই। বড়লোক দেখলে তোয়াজ করব, দরিদ্রকে দেখলে মুখ ফেরাব। না, ওসব নেই। উদ্দেশ্য তো একটাই, ভাল আধার দেখলে চৈতন্য ভরে দেব। আছ কোথায়! যাচ্ছটা কোথায়! কি নিয়ে যাচ্ছ সঞ্চয়! আবার যে আসতে হবে খেয়াল আছে সেটা? এবারের পাওনা আগামীবার পাবে। মনে রাখলে ভাল, না রাখলে আমার কাঁচকলা। যদি তোমার আঁকুপাঁকু থাকে এস আমার কাছে, না থাকে আমার সময় নষ্ট করো না। আমার কাছে আসার একটিমাত্র গেটপাস—বিশ্বাস। প্রশ্ন আমার একটাই—ঈশ্বর আছেন এইটা কি জেনেছ? যদি উত্তর হয়—জেনেছি, তাহলে বলব তুমি জ্ঞানী, তখন তোমাকে আমি বিজ্ঞানী করার জন্য উঠেপড়ে লাগব।
কাঠে নিশ্চিত আগুন আছে যে জেনেছে সে জ্ঞানী। কিন্তু কাঠ জ্বেলে রাঁধা, খাওয়া, হেউঢেউ হয়ে যাওয়া যার হয় তার নাম বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীর কি হবে? অষ্টপাশ খুলে যাবে—কাম-ক্রোধাদির আকার মাত্র থাকে। “ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ।”
কিরকম জান? একখানা জাহাজ সমুদ্র দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার যত লোহালক্কড়, পেরেক, ইস্তুপ উপড়ে যেতে লাগল। কেন? না, কাছে একটা চুম্বকের পাহাড় ছিল তাই সব লোহা আলগা হয়ে উপড়ে যেতে লাগল। আমার ঈশ্বর হলেন ভয়ঙ্কর এক আকর্ষণী শক্তি। তোমার সব কূটকচালে বন্ধন সেই আকর্ষণী শক্তিতে খুলে আলগা হয়ে যাবে। তোমাকে আমি ঠেলতে ঠেলতে সংসার-বন্ধনের বাইরে নিয়ে গিয়ে সেই ম্যাগনেটিক ফিল্ডে ফেলে দেব। তখন তুমি হয়তো আমার মতো বেপরোয়া বলতে পারবে—
“আমি কৃষ্ণকিশোরের বাড়ি যেতাম। একদিন গিয়েছি, সে বললে, ‘তুমি পান খাও কেন?’ আমি বললাম, ‘খুশি পান খাব—আরশিতে মুখ দেখব…!’ কৃষ্ণকিশোরের পরিবার তাকে বকতে লাগল—বললে, ‘তুমি কারে কি বল? রামকৃষ্ণকে কি বলছ?”
এই অবস্থায় তুমি পৌঁছাতে চাও? তাহলে জ্ঞানের পথ ধরে বিজ্ঞানে এস। ‘ঈশ্বর আছেন’ বলে পাশ ফিরে শুয়ে থাকলে হবে না। তরোয়াল খাপে আছে। আছে তো আছে। ব্যবহার না করলে মরচে ধরে ভোঁতা হয়ে যাবে। জ্ঞানখড়কে বলির কাজে লাগাতে হবে। কি রকম! রামপ্রসাদের গানে আছে—
“ধর্মাধর্ম দুটো অজা, তুচ্ছ খোঁটায় বেঁধে থুবি।
(যদি) না মানে নিষেধ তবে জ্ঞানখড়ো বলি দিবি।।”
সেই বিরাট এত বিরাট, তাঁকে পেলে কাম-ক্রোধাদি দগ্ধ হয়ে যায়। ভিতরে একটা ওলটপালট। শরীরের কিছু হয় না; অন্য লোকের শরীরের মতো দেখতে সব—কিন্তু ভিতর ফাঁকা আর নির্মল।
তুমি কি সত্যিই চাও অমন একটা অনুভূতিতে পৌঁছাতে! না, সবটাই তোমার একধরনের শৌখিনতা! অ্যাডভেঞ্চার! দায়টা যেন একা ঈশ্বরেরই, তোমার কোন কসরত নেই। পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো। তাঁকে এসে প্রমাণ করতে হবে, তিনি আছেন। তখন তুমি চোখ উলটে গদগদ হয়ে বসবে। নয়তো ধর্মসভায় গিয়ে হাই তুলবে, আর মনে মনে ভাববে, এ কী গেরো! ওদিকে বক্তা আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করবেন—
শুকদেবের কি উচ্চ অবস্থা! অনিন্দ্যসুন্দর, ষোড়শবর্ষীয় বালক শুকদেব ভাগবতে প্রবেশ করছেন। মৃত্যুপথযাত্রী রাজা পরীক্ষিতকে কৃষ্ণকথা শোনাবেন। মায়ের কাছে তাঁর কথা শুনেছেন। মাতৃগর্ভে একবার মাত্র তাঁর দর্শন পেয়েছিলেন, তাঁর সেই জীবনদাতার। ব্যাসদেবের কী বর্ণনা! যেন জীবন্ত ছবি! কামনা-বাসনা-শূন্য, দেহবোধবর্জিত শুকদেব আসছেন। সম্পূর্ণ উলঙ্গ, তেমনি রূপবান। ভ্রূক্ষেপ নেই কোন। ছেলেরা পাগল ভেবে ঢিল ছুঁড়ছে, মেয়েরা সেই রূপের আকর্ষণে পিছন পিছন ছুটে আসছে, আলোর আকর্ষণে পতঙ্গের মতো। শুকদেবের কোন দৃপাত নেই। তিনি আসছেন। প্রবীণ ঋষিরা বসে আছেন রাজাকে ঘিরে। সাতদিন মাত্র সময়। জীবনের মেয়াদ। রাজা পরপারের পাথেয় সংগ্রহে অভিলাষী। শুকদেব প্রবেশ করে কোন নির্দেশের অপেক্ষা না করে নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করলেন। সেই বিশিষ্ট আসনটি যে তাঁরই জন্য চিহ্নিত, এ যেন তিনি জানতেন। ঋষিরা পাদ্যার্ঘ্য দিয়ে বন্দনা করলেন। কী অপূর্ব দৃশ্য! কে এই শুকদেব! আজন্ম তপস্বী—”ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।” “সমঃ সর্বেষু ভূতেষু”। বক্তা বোঝাতে চাইছেন, কলিহত সংসারী জীবের জন্য এ এক স্বাদু, স্বাদু, সুস্বাদু বার্তা—
“নিম্নগানাং যথা গঙ্গা দেবানামচ্যুতো যথা
বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভুঃ পুরাণানামিদং তথা।।
ক্ষেত্রাণাঞ্চৈব সর্বেষাং যথা কাশী হ্যনুত্তমা।
তথা পুরাণব্রাতানাং শ্রীমদ্ভাবগবতং দ্বিজাঃ।।” (ভাগবত, ১২।১১।১৬-১৭)
—নদীর মধ্যে যেমন গঙ্গা, দেবতাদের মধ্যে যেমন অচ্যুত, বৈষ্ণবদের মধ্যে যেমন শম্ভু, পুরাণসমূহের মধ্যে ভাগবতও সেইরকম সর্বোত্তম
তুমি ডাকতে জান না, তোমার বাসনাজড়িত ক্ষীণকণ্ঠ তাঁর গোলকের আসন পর্যন্ত পৌঁছায় না। থাক, তোমাকে আর ডাকতে হবে না। তুমি শুধু কান পেতে শোন, তিনিই তোমাকে ডাকছেন। জীবকে ‘আকর্ষণ’ করেন বলেই তিনি ‘কৃষ্ণ’। “অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষীং তনুমাশ্রিতঃ।” তোমাকে অনুগ্রহ করার জন্যই তিনি মানুষের রূপে এসেছিলেন।
দুটো কান। এদিকে ঢুকল, ওদিকে বেরিয়ে গেল। সে কতকাল আগের কথা, মন ছটফট করছে ‘চুনাও কা পরিণাম’ জানার জন্য। নেক্সট পি. এম. কে! এরই মাঝে দত্তমশাইয়ের আমেরিকা-প্রবাসী বহুমূল্য ছেলেটির সঙ্গে নিজের আদুরী মেয়েটির বিয়ে পাকা হয়ে গেল। এরই মাঝে একজন ভাল বাতের ডাক্তারের ঠিকানা লেখা হয়ে গেল।
তুমি বৌ-ছেলের জন্য ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলবে, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য একফোঁটাও নয়! এ তো মজা মন্দ নয়! তাঁর অদর্শন-ব্যথায় যার ভিতরটা গামছা নিংড়াবার মতো নিংড়ায় তারই হয়। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন :
“কথাটা এই, সচ্চিদানন্দে প্ৰেম।
“কিরূপ প্রেম? ঈশ্বরকে কিরূপ ভালবাসতে হবে? গৌরী বলত, রামকে জানতে গেলে সীতার মতো হতে হয়, ভগবানকে জানতে ভগবতীর মতো হতে হয়—ভগবতী যেমন শিবের জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন, সেইরূপ তপস্যা করতে হয়। পুরুষকে জানতে গেলে প্রকৃতিভাব আশ্রয় করতে হয়—সখীভাব, দাসীভাব, মাতৃভাব। আমি সীতামূর্তি দর্শন করেছিলাম। দেখলাম, সব মনটা রামেতেই রয়েছে। হাত, পা, বসনভূষণ—কিছুতেই দৃষ্টি নাই। যেন জীবনটা রামময়—রাম না থাকলে, রামকে না পেলে, প্রাণে বাঁচবে না।”
মণি—আজ্ঞা হাঁ, যেন পাগলিনী।
ঠাকুর—উন্মাদিনী! ইয়া। ঈশ্বরকে লাভ করতে গেলে পাগল হতে হয়। কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হয় না। কামিনীর সঙ্গে রমণ, তাতে কি সুখ! ঈশ্বরদর্শন হলে রমণসুখের কোটিগুণ আনন্দ হয়। গৌরী বলত, মহাভাব হলে শরীরের সব ছিদ্র—লোমকূপ পর্যন্ত—মহাযোনি হয়ে যায়। এক-একটি ছিদ্রে আত্মার সহিত রমণসুখ বোধ হয়!
তাহলে কথাটা তুমি প্রেমিকের গানেই শোন —
“পাবি না ক্ষেপা-মায়েরে ক্ষেপার মতো না ক্ষেপিলে,
সেয়ানপাগল কুঁচকিবগল, কাজ হবে না ওরূপ হলে।।
শুনিসনে তুই ভবের কথা, এ যে বন্ধ্যার প্রসবব্যথা,
সার করে শ্রীনাথের কথা চোখের ঠুলি দে না খুলে।।
মায়া-মোহ ভোগতৃষ্ণা দেবে তোরে যতই তাড়া
বোবার মতো থাকবি বসে, সে-কথায় না দিয়ে সাড়া;
নিবৃত্তিরে লয়ে সাথে ভ্রমণ কর তত্ত্বপথে,
নৃত্য কর প্রেমে মেতে, সদা কালী কালী বলে।
মজা আছে এ পাগলে জানবি আসল পাগল হলে,
‘আয়রে পাগল ছেলে’ বলে ঐ পাগলী মায়ে নেবে কোলে;
ফুরাবে পাগলের মেলা ঘুচিবে ত্রিতাপের জ্বালা,
শান্তিধামে করবি লীলা এ যুক্তি প্রেমিক বলে।।”
শোন, আগে বিশ্বাস তারপর কর্ম। যাঁকে পেতে চাইছ, তাঁকে পেলে এই পৃথিবীর সব ক্ষণস্থায়ী মায়া ঐশ্বর্য ধূর্ হয়ে যায়। পেয়ে দেখ। পরীক্ষা করে নাও। আমি মিথ্যা বলছি না। বলে লাভ? কর্ম করতে গেলে আগে একটি বিশ্বাস চাই, সেইসঙ্গে জিনিসটি মনে করে আনন্দ হয় তবে সে-ব্যক্তি কাজে প্রবৃত্ত হয়। মাটির নিচে এক ঘড়া মোহর আছে—এই জ্ঞান, এই বিশ্বাস প্রথমে চাই। ঘড়া মনে করে সেইসঙ্গে আনন্দ হয়—তারপর খোঁড়ে। খুঁড়তে খুঁড়তে ঠং শব্দ হলে আনন্দ বাড়ে। তারপর ঘড়ার কানা দেখা যায়। তখন আনন্দ আরো বাড়ে। এইরকম ক্রমে ক্রমে আনন্দ বাড়তে থাকে। দাঁড়িয়ে দেখছি—সাধু গাঁজা তয়ের করছে আর সাজতে সাজতে আনন্দ।
এখন বাবা নিজেকে বোঝাও, কোটা বাড়াবে? টাকার সুদ, না জীবনের আনন্দ!