আগুন সব পোড়াতে পারে না
ছ’মাস হয়ে গেল। গত ৩রা জানুয়ারি অপরাহ্ন বেলায়, সূর্যাস্তের সময়, সূর্যাস্তের শীতার্ত পথে হাসপাতালের হিমঘরে যখন দিব্যেন্দুদাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমি মনে করতে চাইছি তাঁর সেই গল্পের কথা। মা আছেন বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের সন্তানরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে। সকলেই কৃতী। কী বেদনায় আবিষ্ট করেছিল সেই গল্প। এখনো ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদেরও বয়স হচ্ছে যে। মনে করতেই পারলাম না নামটি। হিমঘরে ঢুকে গেলেন তিনি, নামটি বলে গেলেন, ‘মুখগুলি’। কত মানুষের মুখ তাঁর লেখায়। নিঃশব্দে চেয়ে আছে সকলে। মূকাভিনয়ের চরিত্ররা যেন।
ভাগলপুরের সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবক ১৬ বছর বয়সে ছন্দপতন নামে একটি গল্প পাঠিয়েছিলেন কলকাতার প্রধান সংবাদপত্রের রবিবাসরীয়র জন্য। সেই গল্প ছাপা হয়েছিল। ভাগলপুর বহু কৃতি ও শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম দিয়েছে একসময়। উত্তর বিহারের পূর্ণিয়া, ভাগলপুর এবং দ্বারভাঙা ছিল কৃতি বাঙালির উপনিবেশ। তপন সিংহ, সুমিত্রা দেবী, ছায়া দেবী, কিশোরকুমারদের বিখ্যাত গাঙ্গুলি পরিবার ভাগল- পুরের। বনফুল বাস করতেন ভাগলপুরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাগলপুরেই গঙ্গাতীরে বড়বাসায় একটি বাড়িতে থাকতেন। তখন তিনি কলকাতার খেলাৎ ঘোষদের জমিদারির নায়েব। জমি বন্দোবস্ত দিতেই তাঁর ওখানে থাকা। শুনেছি পথের পাঁচালী লেখা হয়েছিল ভাগলপুরে বসেই। বড়বাসা। শরৎচন্দ্রের মামা বাড়ি ভাগলপুরে। শ্রীকান্ত উপন্যাস আরম্ভ হয় ভাগলপুরের গঙ্গায়। গঙ্গার উত্তাল স্রোতে ইন্দ্রনাথ বটের ঝুরি ধরে নেমে যাচ্ছিল। বিচিত্রা পত্রিকার উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ভাগলপুরেই। দ্বারভাঙায় থাকতেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। পূর্ণিয়ায় সতীনাথ ভাদুড়ী। দিব্যেন্দু পালিত সাহিত্যের সেই পরিমণ্ডল থেকেই কলকাতায় এসেছিলেন লিখবেন বলে। অনিশ্চিত যাত্রা বলতে পারি। লেখক হতে এসে কতজন পারে সিদ্ধিতে পৌঁছতে? লেখক তো কেউ একদিনে হয় না। সমস্ত জীবন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়। দিব্যেন্দুদা পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে আলো আর ছায়া রেখে গেছেন তা থাকবে। নিশ্চিত থাকবে। নগর মননের এমন লেখক আমাদের সাহিত্যে দুর্লভ। তিনি নৈঃশব্দের কথাকার। গল্প বলি উপন্যাস বলি, নৈঃশব্দই যেন তার প্রধান উপাদান। কী আশ্চর্য পরিমিতি বোধ ছিল তাঁর। সেই সব কথা বলব। বলি সেই যুবকের কলকাতায় আসার কথা। পড়বেন। লিখবেন। কলকাতায় এলে হয়তো লেখার সুবিধে হবে। বাবা মারা গেছেন। দাদা একা চাকুরে। সমস্ত সংসারের ভার তাঁর উপর। তাঁরও একটি জীবিকার দরকার। দিব্যেন্দুদার কাছেই সব শোনা। শোনা সেই কঠিন দিনগুলির কথা। নিরাশ্রয় হয়ে কিছুদিন শিয়ালদা স্টেশনেও তাঁকে থাকতে হয়েছিল। সারাদিন খাওয়া হয়নি, শিয়ালদা স্টেশনে উদ্বাস্তুদের ভিড়। শিয়ালদা নর্থের টিকিট কাউন্টারের সামনে একটা খুব মোটা পুরু বেঞ্চি পাতা থাকত। সেইটাই ছিল আমার রাত্রে শোয়ার জায়গা। সেখানে রাতে শুতেন, কিন্তু খেতে পেতেন না। একদিন খাবার জোটেনি। খিদের জ্বালায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছিলেন দেখে এক উদ্বাস্তু বৃদ্ধা তাঁর কাছে এসে শালপাতায় তিনটে রুটি আর তরকারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের ছেলে। খাওয়া হয়নি। তুমি এটা খাও বাবা।’ সেদিন তিনি সেই যুবককে অনাহার থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এসব কথা আমি ভাবছিলাম মেঘমল্লারের নিচে শায়িত দিব্যেন্দু পালিতের সমুখে বসে। অনাহার, অন্ধ হয়ে যেতে যেতে বুদ্ধদেব বসুর স্নেহে চোখের আলো ফিরে পাওয়া, সবই ঘটেছিল সেই নিঃশব্দ যুদ্ধের দিনগুলিতে। এসব আমি শুনেছি তাঁর মুখে। তাঁর জীবন গেছে নির্মম সত্যকে স্পর্শ করতে করতে। তিনি আদ্যন্ত নাগরিক মননের লেখক। আর তিনি মধ্যবিত্তকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন এমন এক আয়নার সামনে যে আয়নায় সে তার অন্তরাত্মা দেখে মুখ নিচু করে থাকে। তাঁর কন্ঠস্বর উঁচু নয়। নিম্নস্বরে কথা বলা তার গল্প থেকে শেখা যায়। যিনি দেখেছেন অনেক তাঁকে উঁচু গলায় কথা বলতে হয় না। অনুচ্চ কন্ঠস্বর যে কত তীব্র হতে পারে, মিতভাষণ যে কত কঠিন সত্যকে উচ্চারণ করতে পারে, তা দিব্যেন্দু পালিতের গল্প আর উপন্যাস পড়লে শেখা যায়। নগর সভ্যতা মানুষের মনের যে জটিলতা যে অসহায়তা যে নিরূপায়তাকে ধারণ করে তা দিব্যেন্দু পালিতের গল্প আর উপন্যাসে রয়ে গেছে। সহযোদ্ধা, আমরা, অনুভব, ঘরবাড়ি, সোনালী জীবন, ঢেউ, বৃষ্টির ঘ্রাণের মতো উপন্যাস ও জেটল্যাগ, গাভাসকার, হিন্দু, জাতীয় পতাকা, ত্রাতা, মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ, মাড়িয়ে যাওয়া, ব্রাজিল, আলমের নিজের বাড়ি, মূকাভিনয়, মাইন নদীর জল, মুখগুলি, গাঢ় নিরুদ্দেশে-গল্পের পর গল্পের কথা মনে পড়ে। আপাদ মস্তক এক রুচিশীল স্নেহময় মানুষ, যত না লিখতেন, পড়তেন অনেক বেশি। সহযোদ্ধা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। সেই যে ঘটনা ঘটেছিল সত্তর দশকের এক কালো সময়ে, একটি হত্যাকাণ্ড দেখে মানুষটি চুপ করে থাকতে পারল না, বিবেক তাকে সত্যভাষণে প্ররোচিত করল। পুলিশের জেরা, পুলিশি আতঙ্ক, তার নিজের উপর আস্থা নষ্ট করতে পারেনি, যা চোখে দেখেছে সে, তা অবিশ্বাস করবে কী করে? তার সাজানো জীবন নষ্ট হয়ে গেল। পুলিশ তাকে নিজের হেফাজতে নিল। হত্যাকাণ্ডে যে পুলিশই জড়িয়ে ছিল। সহযোদ্ধা উপন্যাসের একটি বাস্তবতা আমরা জানি। সাংবাদিক বিপ্লবী সরোজ দত্তের অন্তর্ধানেই লুকিয়ে ছিল সহযোদ্ধার সত্য, সেই ভয়ানক নিরুদ্দেশের কথা কীভাবে উপন্যাসে শিল্পিত ভাবে লিখে রাখা যায়, তা তিনিই দেখিয়েছিলেন। এমন উপন্যাস লিখে তিনি তাঁর দায় পালন করেছিলেন যেন। আর একটি উপন্যাসের কথাও মনে পড়ে, অন্তর্ধান। তপন সিংহ ছবি করেছিলেন। তারও এক বাস্তবতা ছিল এক কিশোরীর অপহরণ এবং তাকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাবার অদ্ভুত মৃত্যু, ঘটমান বাস্তবতা এবং শিল্পের বাস্তবতাকে আমরা একসঙ্গে ছুঁয়ে থেকেছিলাম। নিশ্চুপ মৃদুভাষী মানুষ, কিন্তু ভিতরে যে কতটা আগুন ছিল, কোলাহল ছিল তা ‘সহযোদ্ধা’ পড়লে ধরা যায়। ‘অন্তর্ধান’ উপন্যাসে বোঝা যায়।
দিব্যেন্দুদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়র ঘরে। সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী। দুজনেই খুবই গম্ভীর মানুষ। আমাকে বললেন, পড়েছি লেখা, ভালো। এই পর্যন্ত। রমাপদ চৌধুরীর ঘরে যে আড্ডা হতো তা ছিল শুধুই সাহিত্যের। আমি চুপ করে অগ্রজ বড় লেখকদের কথা শুনতাম। অনুধাবন করতে চাইতাম তাঁদের কথা। কথা শুনতে শুনতে শেখা। দিব্যেন্দুদা আলব্যের কামু ও ফ্রানজ কাফকার কথা বলতেন। আউট সাইডার, প্লেগ, মেটামরফোসিসের কথা বললেন একদিন। তিনি অনুজপ্রতিম তরুণ লেখকদের বলতেন বিশ্ব সাহিত্য বদলে দিয়েছেন এই দুই লেখক, এঁদের পড়। পড়েছি তখন, খুব বেশি নয়, সামান্য, কিন্তু সামান্য পড়ে কথা বলার চেয়ে শোনাই ভালো। ১৯৮২-৮৩ হবে। তাঁর ‘ঘরবাড়ি’ উপন্যাসটি বেরিয়েছে তখন। একটি আত্মহত্যার কাহিনি ছিল তা। বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল বধুটি। পড়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। এরপর পড়ি ‘ঢেউ’। তারপর ‘সহযোদ্ধা’। সহযোদ্ধা আগেই লেখা, পরে পড়া। যা লিখেছেন এই কলকাতাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সে লেখা কখনোই নিরুপায় মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। নিরুপায় মানুষের কথা পাওয়া যায় তাঁর গল্পে, যে গল্পে নৈঃশব্দই প্রধান। মূকাভিনয় গল্পটির কথা মনে করি। মহারাষ্ট্রের গণেশ মানকড়ের একটি নাটকের দল আছে। তারা অভিনয় করে। কিন্তু তা মূকাভিনয়। প্রথম পুরুষে লেখা গল্প। কথক সেই মানকড়ের নাটকের দলে ছোট ছোট নাটক লেখে। মূকাভিনয় হয় সেই নাটকের। নাট্য অভিনয়ের পিছনে থাকে যে ধারাবিবরণ, তাও কথককে বলতে হয়। মানকড় ভালো বাংলা জানে না। কত আধুনিক এবং জটিল জীবন-ধর্মের কথা এই গল্প। কত নীরবতার গল্প। মূকাভিনয় এক প্রাচীন রোমান নাট্যশিল্প যা যে কোনো মানুষের কাছে অনায়াসে পৌঁছতে পারে। অভিনেতার অভিব্যক্তিই না বলা ভিতরের কথাকে যেন সমুখে নিয়ে আসে। মানকড়ের দল প্রচার নাটক করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে। মূকাভিনয় করতে করতে তারা নিজেরাই যেন মূক হয়ে গেছে। স্বামী স্ত্রী নরেন্দ্র এবং রাধা, রাজেন্দ্র এবং পদ্মা…তাদের ভিতরেও যেন যোজন যোজন নীরবতা। এই গল্প শাসক এবং শাসিতের। কিংবা শোষক এবং শোষিতের। নীরবতা, মূক হয়ে থাকা মানুষের নীরব অভিব্যক্তি যে কত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তা নিয়েই এই কাহিনি। পড়ার পর নীরবতাই যেন গ্রাস করে পাঠককে।
আমি সেই ‘মুখগুলি’র কথা বলি। দিব্যেন্দুদার সব গল্পই যেন মুখগুলি। মূকাভিনেতাদের মুখ, কিশোরী মুন্নির মুখ (মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ), যার পা মাড়িয়ে দিয়েছিল অনিল, সেই শিশুটির মুখ(মাড়িয়ে যাওয়া)। মুখগুলি গল্পের মায়ের মুখ, মায়ের সন্তানদের মুখ। কোনো কোনো গল্প পাঠকের হৃদয়কে এমন ভাবে ছুঁয়ে যায় যে সে ভোলে না ভোলেনা কিছুতেই। আর দিব্যেন্দু পালিত যেন সময় থেকে সব সময়ই এগিয়ে ছিলেন কয়েক পা। মুখগুলি গল্প যখন বেরোয়, তখন ওল্ড এজ হোমের ধারণা তেমন স্বচ্ছ ছিল না আমাদের কাছে। সবে তা আসছে এই শহরে, শহরতলীতে। মা গেলেন ওল্ড এজ হোমে। বাবার মৃত্যুর পর মা তাঁর ছেলে মেয়েদের ভিতরে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন একটু একটু করে। ভাগ হয়ে কখনো বালিগঞ্জ, কখনো ভবানীপুর, কখনো বাগবাজার কখনো রিষড়ায় ঘুরে ঘুরে আশ্রয় পায়। কিন্তু তারপর ও মা হয়ে যাচ্ছিলেন ভার। মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছিল যে তা টের পেয়েছিল তাঁর পুত্র কন্যারা। তাই গোল টেবিলে বিচার হয়ে গিয়েছিল মা সুধা ওল্ড এজ হোমে যাবেন। সুধা কোনো অনুযোগ করেন নি। গভীর রাতে দিবাকরের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, সে মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি কুঁকড়ে শুয়ে আছে মা। মিলিত সিদ্ধান্তে মা সকাল হলে চলে যাবে। মা গিয়েছিল। মাকে সেখানে রেখে দিয়ে আসতে পেরে সবাই নিশ্চিন্ত। দিবাকর মাকে কিছু খাম পোস্ট কার্ড আর ড্রাইভারের কাছ থেকে চেয়ে তার সস্তার ডট পেনটি দিয়ে এসেছিল। সুধা চিঠি লিখবে। সুধার চিঠি আসে। সেই চিঠির কথা দিয়েই গল্প আরম্ভ। পরম কল্যাণীয় স্নেহের বাবা দিবাকর…, মা সকলের কুশল জানতে চেয়েছে, নাতি নাতনি, বৌমা। মা খবর দিয়েছে হোমের কৌশল্যাদি নামের একজন মারা গেছে। তাঁর ছেলে থাকে বিলেতে, মেয়ে বাচ্চা হবার জন্য হাসপাতালে। কেউ আসেনি। হোমের ওরাই তাকে কালো গাড়ি করে শ্মশানে নিয়ে গেছে। মা খবর দিয়েছে, রানি পরমেশ, মেয়ে জামাই, তাকে দেখতে এসেছিল। কমলালেবু আর আপেল এনেছিল। ছোট ছেলে ভাস্কর এসেছিল মাকে দেখতে। মায়ের ওল্ড এজ হোমে আর এক কন্যার চিঠি এসেছে। মা সেখানে বসেই বড়ছেলে দিবাকরকে অনুনয় করে, ছোটছেলে ভাস্করকে একটা ভাল চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। মায়ের চিঠি পড়েই ধরা যায় মা ভাল আছে। হোমে সকলেই গিয়ে যোগাযোগ রাখছে মায়ের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশিই। দিবাকর গিয়েছিল হোমে মাকে দেখতে। সারি সারি বেতের চেয়ারে বসে আছেন যাঁরা বেশিরভাগই বৃদ্ধা। বৃদ্ধও আছেন দু-একজনা। তাদের একজনকে মা বলে ভুল করেছিল দিবাকর। পরে ভুল ভাঙল। মায়ের ভিজিটর হয়ে সে বসেছিল ভিজিটরস্ রুমে। মায়ের সঙ্গে তার যে তেমন কোনো কথা ছিল না তা টের পেয়েছিল দিবাকর। মা বলেছিল, ‘খুব ভাল আছি আমি, আমার জন্য ভাবিস নে।’
দিব্যেন্দু পালিতের এই গল্প ক্রমশ ডুবিয়ে নিতে থাকে আমাকে তাঁর মগ্নতায়। মায়ের সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারে না দিবাকর। মায়ের অনেক জিজ্ঞাসা, হুঁ, হাঁ করে উত্তর দিয়েই সে হোম ছেড়ে আসে। কদিন আগে কারা যেন মাকে কমলালেবু আপেল দিয়ে এসেছে। দিবাকর তাই কিছু নিয়ে যায় নি। মা একা আর কত খাবে। ফলগুলো পচবে। মায়ের চিঠি আবার আসে। এই চিঠিতেও হোমের আর একজনের মৃত্যু সংবাদ, গিরীনবাবু মারা গেছেন। … মায়ের চিঠিতে আসলে সত্য যেমন থাকে, থাকেও না। তাঁর কাছে কেউ যায় না তেমন। দিব্যেন্দু পালিত আমাদের মুখের সামনে এক আয়না ধরেছেন। যে কথায় আরম্ভ করেছিলাম, তিনি হিমঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে গিয়েছিলেন, মুখগুলি। মনে রেখ কত মুখ। কত রকম মুখ। ফ্রেদেরিকো ফেলিনির একটি ছবি দেখেছিলাম চল্লিশ বছর আগে। অ্যামারকর্ড। কত মুখ দেখেছিলাম সেই ছবির এক এক দৃশ্যে। মনে আছে সেই মুখগুলি। মনে আছে নিঃসঙ্গ সুধা মায়ের কথা। মুখগুলি আমি ভুলতে পারিনি এখনো।দুপুরের খাবার পর মায়ের বুকে পেন হয়েছিল তারপর…। এই গল্পে যেন পুত্র দিবাকরও এক নিরূপায় মানুষ। মা নিরূপায় হয়েও সব কিছু মেনে নিয়েছে। ছেলেদের কথা ভেবেছে, পুত্র কন্যাদের নিষ্ঠুরতাকে আড়াল করেছে। আড়াল করে নিজের কল্পিত সুখ আহরণ করেছে। গল্পটি যতবার মনে করি আর্দ্র হয়ে পড়ি। গল্পের মুখগুলি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ভেসে ওঠে সারি সারি বেতের চেয়ার, অস্পষ্ট মুখগুলি তাকিয়ে আছে গেটের দিকে। গেট পেরিয়ে রাস্তা। ধুলো উড়লে মেঘ ঘনাত, সন্ধে হত তাড়াতাড়ি। ওখান থেকে মায়ের মুখটি মুছে গেছে আজ। এই গল্প আমার স্মৃতি থেকে মুছবে না এক বিন্দুও। দিব্যেন্দুদা, লেখা আর বন্ধুতা নিয়ে আপনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। লেখকের মৃত্যু হয় না। আমি এখন মুখগুলির পাতা খুলছি। খুলতে খুলতে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। মুন্নির সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছি। কী অপরূপ মুখ মুন্নির। মুখের ছবি তো শুধু মুখেই নয়। অভিব্যক্তিতে, জলের মতো সরল কথায়। আমি সেই অনিল যে মাড়িয়ে দিয়েছিল শিশুটির পা। অভিযুক্ত হয়েছিল শিশুটির উদ্ধত তর্জনীর সামনে। সেই মুখ সারাদিন তাড়িয়ে বেড়ায় অনিলকে। শেষে বাড়ি ফিরে নিজের সন্তানের পায়ের উপর জুতো তুলে দিয়ে তাকিয়ে দেখে তার মুখ।
গতবার মনে হয় শীত বেশিই পড়েছিল। হাড়ে কাঁপুনি দিয়েছিল যেন। তাই হয়তো চুল্লীর আগুনের দিকে অতি বিভ্রমে সারিবদ্ধ যাওয়া প্রিয় মানুষগুলির। দিব্যেন্দুদা, পিনাকী ঠাকুর, মৃণাল সেন, নীরেন্দ্রনাথ… পরপর সকলে চলে গেলেন। এখন ভয়ানক গ্রীষ্ম। চিতার আগুন যেন নেভেনি। মুখগুলি আর ফিরবে না, লকলক করে জ্বলছে। জ্বলুক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা থাকবে। আছে। আমরা পড়ছি। আগুন তা পোড়াতে পারে না।