আগুন মেয়ের গুলিতে
শুধু ভারতবর্ষ বলে নয়, এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মহিলা অপরাধীর সংখ্যা পুরুষ অপরাধীর তুলনায় কম। আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে সেই ব্যবধান আরও প্রকট ছিল। কোন নারী আসামি সাব্যস্ত হলে মানুষের কৌতূহলের কোনো সীমা থাকত না। বিশেষত, সেই নারী যদি হয় কোনো উচ্চশিক্ষিতা বনেদি পরিবারের সুন্দরী কন্যা। যে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিতে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিল খোদ ভালোবাসার মানুষটিকেই।
আসুন চলে যাই আজ থেকে বাহান্ন বছর আগের এক বৈশাখ মাসের সকালে।
১৯৬৬ সালের ৭ মে। পটভূমি উত্তর প্রদেশের লখলউ শহর।
রাজা আজিজুর রহমান কান্ধারী লেনে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি ‘মীর মঞ্জিল’—এর দোতলার অন্দরমহলে প্রকাণ্ড পালঙ্কে শুয়ে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। প্রচণ্ড ব্যথায় তাঁর মুখের একাংশ নীল হয়ে গেছে। বুকের বাঁ—দিকটা হাতের তালুতে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চিপছিলেন তিনি।
উৎকণ্ঠায় তাঁর মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল রহমান সাহেবের একমাত্র কন্যা বাইশ বছরের শামিম। শামিম রহমানি।
পাশে তার মাও রয়েছেন।
শামিম ঘরের প্রকাণ্ড দেওয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। একটু উষ্মার সঙ্গে বলল, ”উফ! দাদা গেছে তো গেছে, আসার আর নাম নেই!”
শামিমের মা বেগম সিকান্দারও চিন্তা করছিলেন, তবে মেয়ের মতো নয়। মেয়ে তার বাপকে ভীষণ ভালোবাসে। বাপের সম্মতিতেই তো শামিম এতদূর এগিয়েছে। না—হলে এই ষাটের দশকে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে বিএসসি পাশ করে এমএসসি—তে ভরতি হয়েছে—এমন ক—জন আছে ভূভারতে?
বেগম সিকান্দার স্বামীর কষ্ট লাঘব করতে জোরে জোরে তাঁর বুকটা ডলছিলেন, বললেন, ”অত ভয় পাস না শামিম! ডাক্তারসায়েব তো জিভের তলায় ওষুধটা দিয়ে গেলেন, আমির এক্ষুনি এসে পড়বে গাড়ি নিয়ে।”
শামিম গজগজ করল, ”বললাম আমি গাড়িটা গ্যারাজ থেকে বের করে বাবাকে নিয়ে চালিয়ে চলে যাই হসপিটাল, কেউ আমার কথা শুনলে তো!”
”আরে নিয়ে যাওয়াটাই তো কথা নয়, অ্যাম্বুলেন্স একেবারে নিয়ে এলে ভরতিতে সুবিধা হবে, তুই একটু শান্ত হয়ে বোস তো!” মা বেগম সিকান্দরের কথা শেষ হল না, হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল আমির আহমেদ, শামিমের দাদা।
সঙ্গে শামিমের ছোটোভাই মহম্মদ আর খুড়তুতো ভাই ইকবালও রয়েছে। তারা হসপিটাল থেকে স্ট্রেচার নিয়ে এসেছে, আজিজুর রহমান সাহেবকে ধরাধরি করে তোলা হল সেটায়, তারপর সবাই মিলে গাড়ি করে রওনা দিল লখনউ—এর বলরামপুর হসপিটালে।
শামিম ছুটে চলে এল নীচের গ্যারাজে, অন্য একটা গাড়ি বের করে সেও সাথে সাথে রওনা দিল হসপিটাল। বাবা পৌঁছোনোর আগেই গিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকবে, যাতে সইসাবুদে একটুও দেরি না—হয়।
এই হল শামিম রহমানি। যেমন সুন্দরী, তেমনই তেজি এই মেয়ে। পড়াশুনোয় তার যেমন মেধা, মেজাজও তার তেমনই চাবুকের মতো। একবার যদি কিছু মাথায় চাপে, পৃথিবী রসাতলে গেলেও শামিম সেটা করেই ছাড়বে।
কলেজ জীবনের শুরুতে সে একবার একটা প্রেমপত্র পেয়েছিল। তারই এক সহপাঠী পাঠিয়েছিল। তাতে সেই ছেলেটা শামিমকে সম্বোধনও করেছিল ‘অগ্নিকন্যা’ নামে।
ভয়ে নিজের নামই লেখেনি ছেলেটা, কে জীবনের ঝুঁকি নিতে যাবে? বলা যায় না, শামিম হয়তো কলেজে সবার সামনেই তাকে মেরে আধমরা বানিয়ে দিল!
শামিমের বাবা আজিজুর রহমান ছিলেন লখিমপুর— খেরির তালুকদার। তাঁর প্রভূত বিত্ত আর বনেদিয়ানার জন্য মানুষ তাঁকে রাজা বলেই ডাকত। উত্তরপ্রদেশের এই রহমান পরিবার ভীষণ খানদানি মুসলিম বংশ, যেমন ঠাটবাট তেমনই বংশমর্যাদা।
কিন্তু রহমান সাহেব ছিলেন একটু আলাদা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যুগের সঙ্গে নিজেদের অভিযোজিত করতে হবে, না হলে তাল মেলানো যাবে না। অধিকাংশ মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের মতো তাঁর বাড়ির মেয়েরাও কূপমণ্ডূক হয়ে থাকুক, তা তিনি চাননি। তাই তিনি পর্দা প্রথা তো মানতেনই না, ষাটের দশকের ভারতে তিনি তাঁর মেয়েকে কো—এডুকেশনাল কলেজে পড়তে পাঠিয়েছিলেন।
শামিম নিজেও ছিল অত্যন্ত আধুনিকমনস্কা। লেখাপড়ায় তো তুখোড় ছিলই, সঙ্গে গাড়ি চালানো, খেলাধুলো সবেতেই সে ছিল পারদর্শী। রহমান সাহেব মেয়ের খেয়াল খুশিতে বাধা দিতেন না। বড়োলোকের একমাত্র খামখেয়ালি মেয়ে, সে একবার টেনিস খেলছে, তো একবার ভরতি হচ্ছে সেতারের ক্লাসে। এই তো, মাস্টার্স করতে ঢোকার আগেই তার কী খেয়াল হল, দুম করে এক ফিরিঙ্গিসাহেবের কাছে গিয়ে বন্দুক চালানোও শিখে ফেলল।
শামিমের মা বেগম সিকান্দর রহমানি আবার মেয়ের চেয়েও বেশি সুন্দরী। বয়স সবে চল্লিশ পেরিয়েছে, কিন্তু কে বলবে! অনেকেই তাঁকে শামিমের দিদি ভেবে ভুল করে। কিন্তু তিনি মেয়ের মতো এত সাহসী নন, স্বামী আধুনিক হলেও তিনি মনে মনে প্রাচীন প্রথাগুলোকে মানতে চেষ্টা করেন।
যাইহোক, সেদিনের ঘটনায় ফিরে আসি। রহমান সাহেবকে নিয়ে বলরামপুর হসপিটাল যাওয়ার পর সেই যাত্রায় রহমান সাহেবের প্রাণ বেঁচে গেল ঠিকই, কিন্তু ডাক্তাররা তখনও তাঁকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করলেন না। রাজা আজিজুর রহমান বলে কথা। তাঁরা কয়েকজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করলেন। সেই অনুযায়ী কিছুদিন ট্রিটমেন্ট চলল। তারপর অবস্থা একটু স্থিতিশীল হতে একজন ডাক্তারের ওপর রহমান সাহেবের সারাক্ষণ দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হল।
ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারের নাম ডা হরিওম গৌতম, বয়স বত্রিশ—তেত্রিশ। শুধু এমবিবিএস ডিগ্রির অধিকারী হলেও হাতযশ এবং কর্তব্যপরায়ণতার জন্য এর মধ্যেই সে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। তার ওপর সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার হিসেবে তার বিরাট একটা গুণ, কিছুতেই ধৈর্য হারায় না, মাথা খুব ঠান্ডা। দেখলেই আপনা থেকেই রুগিদের মধ্যে একটা সম্ভ্রম চলে আসে। ডাক্তারবাবুকে দেখতে ঠিক ফিল্মের হিরোর মতো, লম্বা ঋজু চেহারা, বলিষ্ঠ দেহ, সুন্দর কাটা কাটা মুখশ্রী, সব মিলিয়ে আদ্যন্ত সুপুরুষ।
শামিম তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। সে লোকজন মানে না, বা কে কী ভাববে, তার পরোয়া করে না, ড গৌতমের সামনেই হাসপাতালের সুপার ড চতুর্বেদীকে বলল, ”ডাক্তারবাবু, বাবার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ভালো ডাক্তার নেই? মানে হায়ার ডিগ্রিধারী বা স্পেশালিস্ট কেউ …!”
ড চতুর্বেদী সামান্য হাসলেন, ”আমি রাজাসাহেবের চিকিৎসার ভার উপযুক্ত লোকের হাতেই দিয়েছি মিস রহমানি। ডাক্তারের ক্ষমতা শুধু তাঁর অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি দিয়ে বিচার করবেন না।”
দিন যায়। শামিমের এমএসসি ফাইনাল ইয়ার চলছে। সে প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় বলরামপুর হাসপাতালে যায়, ডা গৌতমের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞাসা করে, নার্স বাবার ঠিকমতো শুশ্রূষা করছে কিনা কড়া চোখে দেখে, তারপর ক্লাসে চলে যায়। শামিমের মা বেগম সিকান্দর রহমানিও আসেন, কিন্তু সপ্তাহে একবার। তিনি উচ্চবিত্ত পরিবারের ব্যক্তিত্বময়ী বধূ, তার ওপর নজরকাড়া সুন্দরী। সারা লখনউ শহর তাঁকে বেগমসাহেবা নামে চেনে। বেগম এলেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শশব্যস্তে তদারকি করে।
প্রথমদিকে ডা গৌতম শামিমের সঙ্গে হু হাঁ ছাড়া বাক্যালাপ করত না। প্রথমদিনের শামিমের সেই অপমানজনক কথা সে তখনও ভুলতে পারেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বরফ গলতে শুরু করল।
শামিমের বিদ্যুতের মতো রূপ, স্মার্টনেস, সপ্রতিভ ব্যবহারে সে ক্রমশ আকৃষ্ট হতে শুরু করল। উলটোদিকে বাইশ বছরের তরুণী শামিমও এই সুপুরুষ ডাক্তারের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল।
ডা হরিওম গৌতম কার্যক্ষেত্রে যতই দক্ষতার পরিচয় দিক, ব্যক্তিগত পরিসরে সে যে চরিত্রবান ছিল, এত বড়ো মিথ্যাচারণ তার অতিবড়ো শত্রুও করতে পারবে না। নারী তার কাছে ছিল শুধুমাত্র ভোগের বস্তু। বাড়িতে স্ত্রী এবং তিনটে সন্তান থাকা সত্ত্বেও নার্স, মহিলা ডাক্তার, উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে সে নিয়মিত মেলামেশা করত। বলাই বাহুল্য, সেই মেলামেশা অনেক সময়েই বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে যেত। ডা গৌতমের স্ত্রী ছিল সাধাসিধে এক গ্রাম্য মহিলা। সে স্বামীর এই বিশ্বাসঘাতকতা ঘুণাক্ষরেও টের পেত না।
ডা গৌতম যখন দেখল শামিমের মতো সুন্দরী, শিক্ষিতা এক ধনী পরিবারের আধুনিকারও তার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে, সে সরে আসা তো দূর, আরও এগিয়ে গেল।
শামিম রোজই ক্লাসে যাওয়ার আগে চলে আসে, বাবাকে দেখতে আসাটা এখন একটা ছুতো, মুখ্য কারণ হল ডা গৌতম।
একদিন শামিম বাবাকে দেখতে এসেছে, কিন্তু তখন আজিজুর রহমান ঘুমোচ্ছেন। তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। নার্সও বেরিয়েছে কোথাও। ডা গৌতম সেদিন আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না, পরিবেশের কথা বিস্মৃত হয়ে চেপে ধরল শামিমের হাত।
যত তেজি মেয়েই হোক, বাইশ বছর বয়সে নিজের ভালোবাসার পুরুষ হাত চেপে ধরলে সব মেয়েরই বুক কাঁপতে থাকে। শামিম তার বড়ো বড়ো আয়তাকার চোখদুটো আরক্ত হয়ে নীচের দিকে নামিয়ে নিল, অস্ফুটে বলল, ”বাবা আছেন। আ—আমি যাই, ক্লাস আছে।” হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হল ও।
ডা গৌতম বাঁধন আলগা করল না।
শামিম এবার ছটফটিয়ে উঠল। যেকোনো মুহূর্তে ঘরে কেউ চলে আসতে পারে, তখন এক কাণ্ড হবে। লখনউয়ের লখিমপুর—খেরির তালুকদার রাজা আজিজুর রহমানের মেয়ে একেই শিক্ষাদীক্ষা, আচার—ব্যবহার, আরও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হওয়ায় শহরের মানুষের কৌতূহলের বস্তু; তার ওপর স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের হিন্দু ডাক্তারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হওয়ার খবর উল্কার চেয়েও দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়বে।
শামিম কপট রাগ করে বলল, ”ছোড়িয়ে মুঝে, কোই আ যায়গা! দিমাগ খারাপ হো গয়া কেয়া আপকা?”
ডা গৌতম নারীমন কীভাবে পেতে হয়, সেই ব্যাপারে ছিল রীতিমতো পোক্ত। চোখে—মুখে আকর্ষণ ফুটিয়ে সে বলে উঠল, ”মেরা দিল অউর দিমাগ আব সব তুমহারে হ্যায় রহমানিসাহেবা!”
শামিম এবার ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আনন্দে উত্তেজনায় সে তিরতির করে কাঁপছে। বাইশ বছরে জীবনে প্রেমপত্র সে অনেক পেয়েছে, কিন্তু ডা হরিওম গৌতমের মতো কারুর প্রতি সে নিজের দিক থেকে এমন আকর্ষর অনুভব করেনি।
ইউনির্ভাসিটিতে গিয়েও তার ক্লাসে মন বসল না, কেবলই মনে হতে লাগলো ডা গৌতমের সেই হাত চেপে ধরার কথা।
এইভাবে প্রায় তিনমাস কেটে গেল। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে আজিজুর রহমানের শারীরিক উন্নতি নিয়ে বলরামপুর হাসপাতালের ডাক্তাররা আর একবার মিটিং করলেন। ওঁর সব রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখে সবাই মোটামুটি একমত হলেন যে রহমান সাহেবের শরীরের যা অবস্থা, তাতে উনি বেশিদিন বাঁচবেন না, মেরেকেটে আর মাসদুয়েক।
এই সময়টা অনর্থক হাসপাতালে না—থেকে পরিবারের সঙ্গে কাটানোটাই ভালো। ডা চতুর্বেদী রহমান সাহেবকে রিলিজ করে দিলেন।
রহমান পরিবারের একজন গৃহচিকিৎসক ছিলেন। রহমান সাহেব বাড়ি চলে আসার পর সেই গৃহচিকিৎসক রোজ এসে একবার করে দেখে যান। কিন্তু দেখার আর আছেটাই বী কী! রহমান সাহেব যন্ত্রণায় ছটফট করেন, তাঁর সেই কষ্ট উপশমের জন্য গৃহচিকিৎসক তাঁকে কখনো পেনকিলার, কখনো—বা ঘুমের ওষুধ দেন।
কিন্তু শামিম তো আর বুঝল না যে তার বাবার আয়ু আর মাত্র কয়েক দিন, ডাক্তাররা চাইছেন তিনি শান্তিতে যেন চলে যেতে পারেন। ওর ঠিক সন্তুষ্টি হয় না। ওর খালি মনে হয় গৃহচিকিৎসক বাবার ঠিকমতো যত্ন নিচ্ছেন না। ও বেগমকে গিয়ে ছটফটিয়ে বলল, ”মা! ডাক্তারচাচা এসে রোজ রোজ কী ওষুধ দিচ্ছেন, বাবা কেমন ঝিমিয়ে থাকছেন।”
”হ্যাঁ রে। উনি তো ঘুমের ওষুধ দিচ্ছেন।” বেগম সিকান্দর মেয়ের দিকে তাকান।
”সেটাই তো বলছি মা। ঘুমের ওষুধ কি বেশি খাওয়া ভালো?” ভ্রূ কুঁচকে তাকাল শামিম, ”একেই বাবা এত বড়ো অসুখ থেকে উঠলেন, তার ওপর রোজ এই মুঠো মুঠো ওষুধ … আমার একটুও ভালো লাগছে না! এর চেয়ে হাসপাতালে ডা গৌতম ঢের ভালো করে দেখতেন বাবাকে।”
শামিমের দুই ভাই আমির আর মহম্মদ শান্ত প্রকৃতির, দোর্দণ্ডপ্রতাপ বোনের দাপটে তারা বেশি ট্যাঁ—ফোঁ করতে পারে না। শামিমের খুড়তুতো ভাই ইকবাল আবার মুসলিম প্রথা অনুযায়ী ধরেই নিয়েছে শামিমের সঙ্গেই তার বিয়ে হবে। সে মাঝে মাঝেই ভবিষ্যৎ স্ত্রীর প্রতি অধিকার ফলাতে যায়, কিন্তু শামিম তাকে পাত্তাও দেয় না, উলটে দেখলেই দুরদুর করে। বাবা চলে আসার পর থেকে ডাক্তারের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ, তার ওপর বাবার যত্ন—আত্তিও হচ্ছে না বিশেষ। কাজেই শামিমের কথাই রইল। প্রায় দুই দশকের গৃহচিকিৎসককে বাতিল করে ডা হরিওম গৌতমকে নিয়ে আসা হল বাড়িতে। ঠিক হল, প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় রহমান সাহেবকে দেখে যাবেন ডা গৌতম।
লিখতে লিখতে ভাবছিলাম, এটাই হয়তো ‘খাল কেটে কুমির আনা’—র আদর্শ উদাহরণ।
ডা গৌতম জানতই যে রহমান সাহেবের আয়ু বেশিদিন নেই। সে এসেই বলল, ”যা ওষুধ চলছিল তাই চলবে। রাজাসাহেব ভালোমন্দ যা খেতে চাইছেন তাই করে দেবেন, কোনো অসুবিধা নেই।”
শামিম এতদিন বাদে তার স্বপ্নের পুরুষকে দেখছিল। ডা গৌতমের কথা শুনেই সে উজ্জ্বল চোখে মা—র দিকে তাকাল। ভাবখানা এমন, ‘দেখেছ মা! পুরোনো ডাক্তারজেঠু কত কী নিষেধ করছিলেন, কিন্তু না—খেয়ে বাবা দিনদিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। আর ইনি এসেই কেমন সব কিছু খেতে বলছেন।”
সে পরেপর মাকে বলল, ”শোনো তুমি মুরাদকে বলে দিও, ওরা যেন ভালো ভালো রান্না করে বাবাকে খাওয়ায়।”
ডা গৌতম প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা মীরমঞ্জিলে আসতে লাগল। রহমান সাহেবের চিকিৎসা করা তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, আসল কারণ ছিল অন্য।
রহমান সাহেব বেশিদিন বাঁচলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই জাগতিক সব মায়া কাটিয়ে তিনি চলে গেলেন অন্যলোকে। কিন্তু ডা গৌতমের আসা বন্ধ হল না। প্রতিদিন সন্ধ্যে হলেই সে আসতে লাগল শামিমদের বাড়ি।
ডাক্তারের কি শুধুই শামিমের সঙ্গলাভ উদ্দেশ্য ছিল? না। তার ছিল এক ঢিলে দুটো পাখি মারার দুরভিসন্ধি। একদিকে সে তরুণী শামিমের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে, অন্যদিকে শামিমের মা বেগম সিকান্দরের সুবিধা—অসুবিধায় সাহায্য করে ঘনিষ্ঠ হতে চায়।
শামিম অল্পবয়সী চটকদার সুন্দরী, তার শারীরিক মোহ যেমন প্রবল, তেমনই রাজা আজিজুর রহমান গত হওয়ার পর তাঁর বিপুল ধনসম্পত্তির একমাত্র মালকিন বেগম সিকান্দর। তাঁকে কোনোরকমে হাত করতে পারলে রানি রাজকন্যা দুটোই মিলবে। না, বিয়ে সে কাউকেই করবে না, বাড়িতে তার বউ—তিনটে বাচ্চা আছে। সমাজে নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হোক, এমন কোনো কাজ সে করবে না। শুধু এই রহমান পরিবারকে শুষে নিয়ে ঐশ্বর্য বাগিয়ে কেটে পড়বে।
এই ঘটনার তথ্য সংগ্রহে যতই ডা হরিওম গৌতমকে জানছিলাম, ততই ঘৃণায় ভরে যাচ্ছিল মন। ডাক্তারির মতো একটা মহৎ প্রোফেশনে যুক্ত থাকা মানুষের চরিত্র এত হীন, এত নোংরা! মুহূর্তে বুদ্ধদেবের জাতকের গল্প মনে পড়ল, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে নির্মম এক পাখিশিকারী ব্যাধকে বুদ্ধদেব সবচেয়ে সুন্দর এবং নির্মল মনের অধিকারী হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন। আসলে পেশাটা কোনো মাপকাঠি নয়—সবই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মানসিকতার ওপরে।
ধীরে ধীরে ডা গৌতমের মীর মঞ্জিলে যাতায়াত বাড়তে লাগল। শামিমের সঙ্গে সে দেখা করে সন্ধ্যেবেলায়। শামিমের মহলে আলগা রোম্যান্সে, শায়েরিতে হুস করে কেটে যায় ওইটুকু সময়, বেগম সিকান্দর ওইসময় থাকেন না।
ডাক্তার আবার আসে সকালে ডিউটিতে যাওয়ার সময়, তখন শামিম ইউনিভার্সিটিতে, নারীমন বুঝতে পটু ডা গৌতম এইটুকু জানে, শামিমের ফর্মূলাতে বেগম সাহেবাকে বশ করা যাবে না। তিনি মধ্যবয়স্কা অভিজাত রমণী, তাঁকে বশ করতে হবে কর্তব্যবোধ দিয়ে।
আগেই বলেছি, শামিমের দুই ভাই আমির এবং মহম্মদ ছিল একটু সরল প্রকৃতির। এস্টেটের কাজকর্ম তাদের উপর দিয়ে বেগম সাহেবা ঠিক ভরসা পেতেন না। তাঁর ঠিক এই দুর্বলতার স্থানটাই অধিকার করল ডা গৌতম। কৌশলে ম্যানেজার বা অন্যান্য কর্মচারীদের একরকম অকর্মণ্য করে দিয়ে লখিমপুর —খেরির তালুকের মুকুটহীন অধিপতি হয়ে উঠতে লাগল সে। সরাতে লাগল লক্ষ লক্ষ টাকা।
কান্ধারী লেনের ২৩ নম্বর বাড়ি মীর মঞ্জিলে সকলের অলক্ষ্যে এভাবেই ঘনিয়ে আসতে লাগলো কালবৈশাখীর অকাল ঝড়।
এভাবেই চলছিল। হয়তো চলতও। ধীরে ধীরে তালুকের সব টাকা আত্মসাৎ করত ওই ডাক্তার। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসেই হোক বা অভিশাপে, একদিন শামিমের চোখে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল দুটো ব্যাপার।
শামিমের ছোটবেলার এক বান্ধবী গুরমিত বলরামপুর হাসপাতালে নার্স হিসেবে ঢুকল। সে গরিবের মেয়ে, অনেক কষ্ট করে নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে চাকরিটা পেয়েছে। দু—জনের পারিবারিক অবস্থার আকাশ—পাতাল পার্থক্য থাকলেও বন্ধুত্বে তা কখনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। শামিম গুরমিতকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। ওর অভাবের দিনে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করত বন্ধুকে।
দুই বন্ধুর কথা হয়েছিল, চাকরি পেলেই গুরমিত শামিমকে মিষ্টি খাওয়াবে।
সেইমতো গুরমিত একদিন ইউনিভার্সিটিতে দেখা করতে এল বান্ধবীর সঙ্গে। তার চাকরির সবে দু—মাস পূর্ণ হয়েছে।
সেটা ১৯৬৮ সালের মার্চ মাস।
শামিমের দুটো ক্লাসের মধ্যে প্রায় দু—ঘণ্টা গ্যাপ ছিল, সেই ফাঁকে গুরমিত আসতেই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে সে উঠে বসল ল্যান্ডো গাড়িতে। বাড়ির ড্রাইভারকে হুকুম দিল, ”ভাইয়া, আমিনাবাদ চলো।”
”আমিনাবাদে কোথায় মিষ্টি খাবি তুই?” গুরমিত তাকাল।
”মিষ্টি তো খাবই। তার আগে দু—জন গড়বরঝালায় জমিয়ে চুড়ি কিনব চল। আজ আমার মনটা খুব ভালো আছে।” শামিম বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে উত্তর দিল।
”কেন, কোন ছেলেকে চড়—থাপ্পড় মারলি যে মনে এত খুশি? তোর তো লোকজনকে না পেটালে মেজাজ ভালো থাকে না।” গুরমিত বলল।
শামিম হেসে ফেলল। আমিনাবাদ লখনউ—এর প্রায় নবাব আমলের পুরোনো বাজার। তার মধ্যেই রয়েছে গড়বরঝালা, কাচের চুড়ির বিশাল বাজার। দুই বন্ধু মনের সুখে অনেক কেনাকাটা করল, তারপর কথামতো দু—জনে গেল মিষ্টি খেতে।
গুরমিত শামিমের যত ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোক, ডা গৌতমের সঙ্গে চলা গুপ্ত প্রণয়ের কথা শামিম কাউকে জানায়নি। একে সে মুসলিম, ডাক্তার হিন্দু ব্রাহ্মণ, কোথা থেকে কী হবে তার ঠিক আছে?
ঠান্ডা লস্যিতে চুমুক দিয়ে শামিম বলল, ”কেমন লাগছে তোর বলরামপুর হাসপাতাল? বাবা তো ওখানেই ভরতি ছিলেন।”
”হ্যাঁ, জানি তো। ওমা মনে নেই আমি দেখতে গিয়েছিলাম? চরিত্রবান গৌতম দেখত তো কাকাবাবুকে।” গুরমিত মুখ ভরতি মালাই নিয়ে বলল।
শামিম সহসা বিষম খেল, ”চরিত্রবান গৌতম! মানে? কার কথা বলছিস?”
”আরে ওই যে ডাক্তার হরিওম গৌতম! যা নচ্ছার চরিত্রহীন লোক, আমরা তো আড়ালে ওকে ওইজন্য চরিত্রবান গৌতম বলে ডাকি।” গুরমিত বলল।
শামিম কোনোমতে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছিল, ”কী আজেবাজে বকছিস! ডা গৌতম চ—চরিত্রহীন?”
”তা নয় তো কী? বাড়িতে বউ, তিনটে বাচ্চা, এদিকে একবার এই নার্সের সঙ্গে ঢলাঢলি, একবার ওই নার্সের সঙ্গে। রুগিদের অবধি ছাড়ে না, সুন্দরী দেখলেই নোলা চকচক করে। বাজে লোক, আমি তো পারতপক্ষে কথা বলি না।”
শামিম সেদিন আর বাকি ক্লাস করতে ইউনিভার্সিটিতে ফিরল না। তার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরোচ্ছে। চোখ—মুখ লাল। কেউ একঝলক দেখে ভাববে বুঝি তার ভীষণ জ্বর এসে গেছে।
উদ্ভ্রান্তভাবে সে বাড়ি ফিরল অসময়ে।
বাড়ি ঢুকে সে দ্বিতীয় ধাক্কা খেল।
তার মা বেগম সিকান্দরের মহলের শোবার ঘরের খাস পালঙ্কে মুখোমুখি বসে রয়েছে ডাক্তার গৌতম আর বেগম সাহেবা। ডাক্তার গৌতম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, আর হেসে হেসে কথা বলছে।
দু—জনের ভঙ্গী দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই নির্জন দুপুরে তারা এইভাবে বসে গল্প করাতে খুবই স্বচ্ছন্দে।
শামিমের মাথাটা যেন বোঁ করে ঘুরে গেল। ভাইয়েরা কেউ এইসময় বাড়ি থাকে না, ও নিজেও ফেরে বিকেলের পর, এইসময় ডাক্তার তার মায়ের শোবার ঘরে কী করছে?
শামিমকে দেখে বেগম সাহেবা ঈষৎ চমকালেও দ্রুত সামলে নিলেন, ”তুই এইসময়ে? দ্যাখ না, ডাক্তারবাবু এসেছেন, ওই এস্টেটের কিছু সই করাতে।”
শামিম ডাক্তারের দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি হেনে মায়ের কথায় কোনো উত্তর না—দিয়ে হনহন করে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
কিন্তু ঘরে গিয়েও সে শান্তি পেল না। যাকে সে নিজের শরীর—মন সব সমর্পণ করে এত ভালোবাসল, তার এত বড়ো প্রতারণা?
ওর হঠাৎ মনে হল, ওর মা এখনও চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। বয়সে ডাক্তারের চেয়ে কিছু বড়ো হলেও পুরুষমহলে মা এখনও আকর্ষণের পাত্রী। ডাক্তার কি তার মা আর সে, দু—জনের সঙ্গেই প্রেমের খেলা খেলছে?
রাগে তখন শামিমের ব্রহ্মতালু জ্বলছে। কিছুক্ষণ নিজের ঘরে ছটফট করে সে চলে গেল নীচে। গাড়ি বের করে রওনা দিল। ডাক্তারের বাড়ি কোন পাড়ায় সে জানে। যদিও কখনো যায়নি, তবু সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের বাড়ি খোঁজা নিশ্চয়ই কঠিন হবে না।
ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে শামিম গিয়ে দেখল, গুরমিতের কথাই সত্যি। ডাক্তার গৌতমের স্ত্রী এবং তিনটে বাচ্চা বর্তমান। শুধু তাই নয়, সর্বকনিষ্ঠ বাচ্চাটি মাত্র দেড় মাসের। অর্থাৎ ডাক্তার একইসাথে তাকে এবং তার স্ত্রীকে ঠকিয়ে গেছে।
আরও না জানি কতজনকে ঠকিয়েছে। প্রাণপণে নিজের রাগ সংবরণ করে সে নিজের পরিচয় দিল। রাজা রহমান সাহেবের মেয়ে বলে কথা, ডা গৌতমের স্ত্রী শশব্যস্ত হয়ে আপ্যায়ন করল। শামিমও মিষ্টি হেসে গল্পগুজব করল, বাচ্চাগুলোকে গাড়ি চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে চকোলেট কিনে দিল, মজার মজার গল্প শোনাল।
ডাক্তারের বাচ্চারা খুশি হয়ে বলল, ”গোরি ফুফা, তুমি আবার এসো কিন্তু!”
গোরি মানে ফর্সা, আর ফুফা মানে পিসি।
শামিম শান্তভাবে হাত নেড়ে বেরিয়ে এল। কেউ ধারণাও করতে পারলো না ওর মনের ভেতর আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোত কতটা দ্রুত পাক খাচ্ছে।
বাড়ি ফিরে সে গুম হয়ে রইল। মা কিছু বলতে এলে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তীক্ষ্নস্বরে বলল, ”দুপুর বেলা ওই ডাক্তার এসে বসেছিল কেন? তুমি কি ওকে নিকাহ করবে নাকি মা?”
বেগম সাহেবা চমকে উঠলেন, ”এসব কী বলছিস! ইয়ে, গৌতম আমার দেওরের মতো শামিম!”
”দেওরের মতো যখন, তখন ফাঁকা বাড়িতে এসে তোমার খাটে বসে থাকে কেন?” চিৎকার করে উঠল শামিম।
”বললাম তো কাজে এসেছিল। ও—ই তো ভালোমন্দ সব দেখে। মার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস?” ফুঁসে উঠলেন বেগম, ”এইসব আজেবাজে কথা না—বলে জলদি পড়া শেষ কর, তোর বিয়ে দেব আমি।”
শামিম রুখে দাঁড়াল, ”তুমি ভেবো না আমি ওই ইকবালকে বিয়ে করব।”
”তো কাকে বিয়ে করবে তুমি? ইকবাল তোমার চাচাতো ভাই। ও—ই তো সবদিক থেকে উপযুক্ত।”
”মরে গেলেও আমি ওই অপদার্থকে বিয়ে করব না, তুমি দেখে নিও।” শামিমের উত্তেজনার পারদ ক্রমশ চড়ছিল।
”তাহলে তুমিও শুনে নাও, ওই গৌতমের সঙ্গেও তোমার বিয়ের কোনো প্রশ্নই নেই। একে ও হিন্দু, তার ওপর বিবাহিত। তিনটে বাচ্চা আছে। সিনেমার হিরোর মতো দেখতে যতই হোক, তোমার চেয়ে অনেক বড়ো।”
শামিম এত রেগে গেল, আর কিছু বলতে পারলো না, ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।
সেখানে গিয়ে দেখল ইকবাল বসে আছে ওর খাটের ওপর। ওর মাথাটা অনেকক্ষণ ধরে দপদপ করছিল, এবার গরম লাভ ফেটে বেরিয়ে এল বাইরে, ”শয়তান, অপোগণ্ড একটা! তোর সাহস কী করে হয় তুই আমার বিছানায় বসিস?” শামিম ইকবালের চুলের মুঠি ধরে ঠেসে ধরল দেওয়ালে, চড়—ঘুষি চালাতে লাগল দুমদাম, ”বেরিয়ে যা এখান থেকে। আর কোনোদিনও যদি দেখি এখানে এসেছিস, পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দেব।” শামিম ঠেলে বের করে দিল ইকবালকে।
ইকবাল হতভম্ব হয়ে গালে হাত বোলাতে বোলাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ডাক্তার বুদ্ধিমান লোক, বাড়ি গিয়েই সে খবর পেল শামিম এসেছিল। সে শামিমকে বেশ কয়েক দিন ঘাঁটাল না, রাগটা কমে যেতে দিল।
দিন সাতেক পর শামিমের ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল সে।
সত্যিই শামিমের রাগ ততদিনে অনেকটা কমে এসেছিল, তবু ও না দেখার ভান করে ডাক্তারকে এড়িয়ে চলে যেতে লাগল।
ডাক্তার গিয়ে দ্রুত হাতে ওকে চেপে ধরল, ”আমি জানি তুমি খুব রেগে আছ আমার ওপর। নিজে নিজে সব ধারণা না—করে নিয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগটা অন্তত দাও, তারপর তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি মাথা পেতে নেব।”
মেয়ের মন। শামিম যতই তেজি হোক, ডাক্তার ওকে ঠিক আবার পটিয়ে ফেলল। ডাক্তার ভালো করে মগজধোলাই করল যে পরিস্থিতির চাপে পড়ে ওকে বিয়ে করতে হয়েছিল। তবে বাড়ির অমতে যতই ও বিয়ে করতে বাধ্য হোক, ওর মনের মধ্যে যে শামিম ছাড়া কেউ নেই, সেটা বারবার বোঝাতে লাগল ডাক্তার। আর হাসপাতালের নার্স … ধুর! ওটা তার চরিত্রকে কলঙ্কিত করার ষড়যন্ত্র। এই বয়সে তার এই উন্নতি অনেকেই মানতে পারে না, তাই এইসব কুৎসা রটায়। সব আসলে হিংসা।
শামিম দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় ফিরে এল বাড়িতে। প্রেমিকের কথা অবিশ্বাস করতে কার মন চায়? হয়তো সত্যিই, ডাক্তার পরিবারের চাপে বউকে ছাড়তে পারছে না, এদিকে মনপ্রাণ সব জুড়ে আছে শামিই!
দিনদুয়েকের মধ্যে বাড়িতে চিঠি এল ডাক্তারের,
”মেরে দিল কি মালিকা হাম আব তুমহারে বিনা রেহনাহি সকতা! না মুমকিন আপনে দিল কি করিব তুমহে রাত অউর দিন দেখনা চাহতি হু! কাশ কি তুম মেরে দিল কি আওয়াজ শুনতো সাকো!——তুমহারি ওল্ড ম্যান।”
শামিম আবার ডাক্তারের প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ল। এবার আর রাখঢাক নেই। উদ্দাম প্রেম, শামিম আর লোকভয়ের তোয়াক্কা করে না, ডাক্তারের স্কুটারের পেছনে বসে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে ওড়না উড়িয়ে চলে যায় দূর দূরান্তে।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। দাবানলের মতো এই বিবাহবহির্ভূত কেচ্ছা ছড়িয়ে পড়তে লাগল গোটা লখনউনগরীতে। একী অনাচার, হিন্দু ব্রাহ্মণ, তায় বিবাহিত, এমন পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে খানদানি মুসলমান রহমান বংশের কন্যা?
গুরমিত খবর পেয়ে বান্ধবীর কাছে দৌড়ে এল, ”তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? ওই লম্পট ডাক্তারের সঙ্গে ঘুরছিস? জানিস সেদিন তোকে স্কুটারে নিয়ে ঘোরার পরেই ফিরে এসে আমাদের নার্স নয়নাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল?”
”শোন গুজব ছড়াবি না।” শামিম আঙুল উঁচিয়ে বলল, ”গৌতম অমন নয়। তোরা সবাই ওকে হিংসে করিস।”
”হিংসে করি!” গুরমিত অবাক, ”কেন হিংসে করতে যাবো কেন?”
সব কেনর কোনো উত্তর হয় না। প্রেমের কোনো যুক্তি হয় না, প্রেমে অন্ধ হয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাওয়ারও কোনো পূর্বাভাষ পাওয়া যায় না। শামিমেরও সেটাই হয়েছিল। না হলে একজন এমএসসি পড়া ঝকঝকে যুবতী এতটা বিশ্বাস কেন করে বসবে?
মাঝখান থেকে কথা কাটাকাটিতে শামিমের সঙ্গে গুরমিতের এতদিনের বন্ধুত্বে ছেদ পড়ল। শামিম চিরকালের মাথাগরম, তার দুমদাম কথায় গুরমিত আঘাত পেয়ে চলে গেল।
একদিন শামিম ক্লাস সেরে ফিরছে, গাড়ির পেছনের সিটে বসে স্পষ্ট দেখল, পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল ডাক্তার হরিওম গৌতম, পেছনে এক তরুণী ঘনিষ্ঠভাবে বসে।
পরে চেঁচামেচি করতে ডাক্তার তার ভুবনভোলানো হাসি হেসে বলল, ”আমাকে এত ভালোবাসো বলে সবজায়গায় আমাকেই দেখতে পাও তুমি। তুমি যে সময়ের কথা বলছ, আমি তখন অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম শামিম! তুমি অন্য কাউকে দেখেছ।”
এইভাবে চলতে চলতে শামিমের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে লাগল। ডাক্তার ওকে প্রেমপত্র পাঠায়, ওর জন্য ডাক্তারের চোখে—মুখে কামনা ফুটে ওঠে, কিন্তু এই সম্পর্ককে পরিণতি দেওয়ার কোনো উচ্চবাচ্য ভুলেও করে না সে।
এভাবে কতদিন চলবে?
একদিন শামিমের মেজাজ সেইরকম খাপ্পা, শরীরটাও ভালো নেই। সে আর ইউনিভার্সিটি যায়নি। মা বেগম সিকান্দর বাড়ি নেই, তিনি গেছেন পিত্রালয়ে। ফিরবেন দু—দিন পরে।
দিনটা হল ১৯৬৮ সালের ১১ জুলাই। বৃহস্পতিবার।
ছোটোভাই মহম্মদ নিজের ঘরে বসে পড়াশুনো করছে, শামিম রেকর্ড প্লেয়ারে পুরোনো গান শুনছিল। এমন সময় ডাক্তার এসে হাজির। ওকে দেখে থতমত খেল, ”ইয়ে, ভাবি নেই?”
এমন অসময়ে ডাক্তারের সহসা আগমনে শামিমের বুকটা নেচে উঠেছিল, ”না।”
ডাক্তার গৌতম প্রমাদ গুণল। ইদানীং শামিমের হৃদয়ের আবেগ যেন বড়ো বেশি প্রবল হয়ে থাকে। এই ফাঁকা বাড়িতে ডাক্তারকে একা পেলেই সে ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। শামিমের প্রতি তার এখন আর তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। দেহজ মোহ বড়োই সাময়িক, তা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তার ওপর নারী সহজলভ্যা হয়ে নিজেই আত্মসমর্পণ করতে চাইলে তো ডাক্তার গৌতমের মোহ বিরক্তিতে পরিণত হয়।
শামিম রহমানির আর তাকে কিছু দেওয়ার নেই। বরং তার মা বেগম সাহেবা অনেক উপকারে আসবে এখন।
ডাক্তার বলল, ”আমি যাই, পরে আসব।”
শামিম মুহূর্তে রেগে আগুন হয়ে গেল। জ্বলন্তদৃষ্টিতে ডাক্তারের দিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপল, ”বউ গেল, শামিম রহমানি গেল, এবার কি বেগম সিকান্দর তোমার মনে ধরেছে?”
ডাক্তার থমকে গেল। শামিমকে তার এখন যতই বিরক্তিকর মনে হোক, এ মেয়ে আগুনের গোলা, অন্য সবার মত ছুড়ে ফেলতে গেলে জ্বলে উঠবে। তার চেয়ে কৌশলে মানাতে হবে। ও মিষ্টি হেসে এগিয়ে এসে শামিমের হাতটা ধরল, ”কী যে আজেবাজে বলো। কার সাথে কার তুলনা! তুমি হলে আমার সব। মেরে মেহবুবা, মেরে দিল কি ধড়কান!”
শামিম এতদিন পরে প্রেমিকের হাতের স্পর্শ পেয়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলো না। দু—হাতে ডাক্তারের গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে ও কেঁদে ফেলল, ”এভাবে আর কতদিন চলবে হরি! তুমি তো জানো দিনদিন কেমন জটিল হয়ে উঠছে সব কিছু!”
”শান্ত হও শামিম!” ডাক্তার ওর মাথায় নরম চুমু খেল।
”তুমি কবে আমাকে বিয়ে করবে বলো। পরিবারের চাপে তোমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল, তারপর বাচ্চা। আমি সব না—হয় মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এখন ওই বউকে ছাড়ো, তোমায় বিয়ে করতেই হবে আমাকে।” শামিম ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ”তুমি এখান থেকে দূরের কোনো হাসপাতালে বদলি নিয়ে নেবে, আমরা অনেক দূর চলে যাবো।”
ডাক্তার গৌতমের এবার বিরক্তি উত্তরোত্তর বাড়ছিল। বাড়িতে ওর নিজের বাবা মার কানে ইতিমধ্যেই শামিমের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কথা গিয়ে পৌঁছেছে। তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বাড়ির নিরপরাধ বউকে গৌতম ত্যাগ করলে তাঁরা ওকে ত্যাজ্যপুত্র করবেন। সেক্ষেত্রে গৌতম পৈত্রিক সম্পত্তি কিছুই পাবে না, এদিকে শামিমের চক্করে পড়ে ওর মার সঙ্গে সম্পর্কের আয়ুও মনে হচ্ছে বেশিদিন নেই।
এইভাবে চলতে গেলে তো সে পথে বসবে!
ওদিকে শামিম ওকে ঝাঁকাচ্ছে, ”বলো! বলো কবে আমাকে নিয়ে যাবে বিয়ে করে?”
ডাক্তারের ধৈর্যের বাঁধ এবার ভাঙল। রুক্ষস্বরে ও বলল, ”কী আজেবাজে বকছ! আমার বউ আছে, বাচ্চা আছে, ওদের আমি ছাড়ব কেন?”
শামিম দারুণ অবাক হয়ে ডাক্তারের বুক থেকে মাথা তুলল, ”মানে!”
ডাক্তার ঝাঁঝিয়েই বলল, ”মানে সোজা। আমি তোমাকে ভালোবাসি ঠিক আছে, কিন্তু বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” কথাটা বলে ও একটু হলেও স্বস্তি পেল। এই কথাটা শামিমকে বলা খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। এতটা নির্লজ্জ মেয়ে ও জীবনে দেখেনি। দু—হাত দিয়ে ঠেলে ও শামিমকে সরিয়ে দিল, ”আর তুমি এত বেহায়া কেন? বিয়ে বিয়ে করে লাফাচ্ছ? তোমাকে আমি ভদ্র মেয়ে ভাবছিলাম।”
শামিম থমকে গেল, স্থির হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর একটাও কথা না—বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ডাক্তার ভাবল, যাক শেষমেশ ঝামেলা মিটল।
কিন্তু শামিম ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কি ডাক্তার ওর চোখ ভালো করে দেখেছিল? তাকালে হয়তো দেখতে পেত আহত বাঘিনির মতো সেখান থেকে চুইয়ে পড়ছে রাগ।
সমস্ত শিরার রক্ত যেন একত্র হয়েছে শামিমের ফর্সা সুন্দর মুখে, টোকা দিলেই যেন সেখান থেকে ছলকে পড়বে রক্ত!
শামিম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ডাক্তার কী করবে বুঝতে পারলো না, একটু বাদে সে বেরিয়ে পড়ে রওনা দিল হাসপাতালের দিকে।
অবশেষে এল ১৯৬৮ সালের ১১ জুলাইয়ের সেই কালরাত্রি।
ডাক্তার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে স্ত্রী—সন্তান নিয়ে একটা কাছের বিয়েবাড়ি গিয়েছিল নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। খেয়ে দেয়ে রাত দশটা নাগাদ বেরোবে, এমনও সময় রহমান বাড়ির এক ড্রাইভার এসে সেলাম ঠুকে তার হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিল।
কী ব্যাপার?
চিরকুটে কোনো সম্বোধন নেই, নেই কোনো প্রেরকের নাম।
”যদি কোনোদিনও এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ভালোবেসে থাকো, তবে এক্ষুনি এসো একবার! এই শেষ বার!”
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এটা শামিমের লেখা। কিন্তু এত রাতে … ডাক্তার চিন্তিত মুখে স্ত্রী—পুত্র—কন্যাদের একজন আত্মীয়ের গাড়িতে তুলে দিল। ওর হঠাৎ মনে পড়ল, আরে! আগামীকাল তো বারো তারিখ, শামিমের এম এস সি ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের শেষ দিন। শামিম আবার বিশ্বাস করে, ডাক্তার নিজে ফর্ম ফিল আপ করে দিলে তার রেজাল্ট ভালো হবে, নির্ঘাত সেইজন্যই ডাকছে!
ডাক্তার হরিওম গৌতম জানতেও পারলো না, এই তার শেষ যাওয়া ওর মীর মঞ্জিলে।
কল্পনাও করতে পারলো না সেই রাতে লখনউ—এর কান্ধারী লেনের রাজাসাহেবের বাড়িতে দু—একটা ভৃত্য ছাড়া কেউ নেই।
আগেই বলেছি বেগমসাহেবা কয়েক দিনের জন্য বাড়ি ছিলেন না, শামিমের দুই ভাই ছিল অন্যত্র।
অতঃপর ডাক্তারের মীর মঞ্জিলে প্রবেশ, কিছু কথাকাটাকাটি এবং একটা কানফাটানো গুলির শব্দ।
কীভাবে খবর পেয়ে শামিমের বড়ো ভাই আমীর ছুটে এল। তারপর রাত সাড়ে এগারোটার সময় দেখা দিল সে মীর মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে নিকটস্থ কৈসরবাগ থানায় গিয়ে রিপোর্ট করছে, ”হুজুর, ডাক্তার হরিওম গৌতমকে কেউ বা কারা খুন করেছে।”
রাত সাড়ে এগারোটায় খবর পেলেও পুলিশ এল দুটোর সময়।
শামিম তখন খাটের ওপর বসে নীরবে কাঁদছে। পুলিশকে দেখেই আবেগতাড়িত গলায় বলে উঠল, ”আমি ওকে মেরেছি। ও দিনের পর দিন ঠকিয়েছে আমায়, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমায় ফাঁসি দিন!”
পুলিশ সকাল আটটা অবধি বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করল। ডাক্তারের মাথায় একটা দোনলা বন্দুক দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে, কিন্তু বন্দুকে কোনো হাতের ছাপ পাওয়া গেল না।
পুলিশ শামিম আর তার দাদাকে গ্রেফতার করল।
পরের দিন সকালে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে বেরল, “Govt doctor shot dead by a girl student; Assailant arrested!”
হইহই পড়ে গেল গোটা দেশে। রক্ষণশীল মুসলিম উচ্চবিত্ত পরিবারের কন্যা গুলি করে খুন করেছে এক ডাক্তারকে। কী কাণ্ড! মুসলিম মেয়েরা পর্দার বাইরেই বেরোয় না, আর এমেয়ে গুলিও চালিয়ে দিল?
যথাসময়ে শামিম রহমানি বনাম উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মামলা উঠল লখনউ—এর দায়রা আদালতে। আজও সেই সময়ের আইনজীবী, সাংবাদিকরা শামিম রহমানির কথা উঠলেই চমকে ওঠেন। সিনিয়র জার্নালিস্ট প্রদীপ কাপুর লিখেছিলেন, “Most sensational case of 60’s!”
অনেকেই খুনের অব্যবহিত পরে আবেগমথিত হয়ে অপরাধের কথা স্বীকার করে ফেলে, পরে অস্বীকার করে। শামিম রহমানিও তাই করেছিল। খুনের দিন রাতে কৈসরবাগ থানার পুলিশের কাছে সে মৌখিকভাবে অপরাধ কবুল করলেও পরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলল, ”হুজুর, আমি নির্দোষ। ডা হরিওম গৌতমকে কে খুন করেছে আমি জানি না। ডাক্তারের অনেক মেয়ের সঙ্গে লুচ্চামি করত, তাই তার অনেক শত্রু। সেইরকমই কেউ হয়তো খুন করে লাশটা মীর মঞ্জিলে ফেলে দিয়ে গেছে।”
বিচারপতি এস এন শুক্লা বললেন, ”ডাক্তার হরিওম গৌতমের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক ছিল?”
শামিম ঠোঁট কামড়ে ধরে একমুহূর্ত থামল, তারপর বলল, ”আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। ব্যস, ওইটুকুই!”
আদালতের বাইরের ক্যাম্পাস তখন কৌতূহলী জনতার স্রোতে প্রায় ভেঙে পড়েছে। পুরুষ খুনি আকছার দেখা যায়, কিন্তু অভিজাত পরিবারের উচ্চশিক্ষিতা তরুণী খুনি ক—টা দেখা যায়? তাও আবার বিষ খাইয়ে মেয়েলি ছাঁদে খুন নয়—একদম বন্দুক তুলে গুলি করে খুন!
সবাই একবার শামিমকে চোখের দেখা দেখতে চায়।
মীর মঞ্জিলের একদম উলটোদিকে এক দর্জির দোকান ছিল। সেই দর্জি আদালতে সাক্ষ্য দিল, দূর থেকে জানলা দিয়ে সে দেখেছে শামিম ডাক্তারকে গুলি করছে।
জাফরিয়াব জিলানি, গুলাম হুসেন নকভি—র মতো বাঘা বাঘা আইনজীবীরা এই কেসে জড়িয়ে পড়লেন।
একে একে ডাকা হল শামিমের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী গুরমিত থেকে শুরু করে ডাক্তার গৌতমের কর্মস্থল বলরামপুর হাসপাতালের কর্মীদের। সবাই একবাক্যে সাক্ষ্য দিল ডাক্তার গৌতমের চরিত্রহীনতার কথা সুবিদিত। একইসাথে তারা এও জানাল, গৌতম এবং শামিমকে তারা অনেকবার রাস্তাঘাটে, সিনেমা হলে দেখেছে।
সবদিক বিবেচনা করে ট্রায়াল পর্ব শেষ হতে দায়রা আদালতের বিচারক এস এন শুক্লা বললেন, ১৯৬৯ সালের ৫ অক্টোবর তিনি এই মামলার রায় ঘোষণা করবেন।
সকাল থেকে সাংবাদিক, উকিল, জনসাধারণের ভিড় উপচে পড়ল কোর্ট চত্বরে। সময়মতো শামিম রহমানকে পুলিশ কাস্টডি থেকে হাজির করা হল এজলাসে।
তার চোখ উদাস, পরনে সাদা একটা চুড়িদার। হাজার হাজার লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেও নির্বিকার। ওর দাদা আমীর আহমেদও আসামি, হত্যার প্রমাণ লোপাট এবং পুলিশকে বিভ্রান্ত করার অপরাধ ধার্য করা হয়েছে তার ওপর।
মাননীয় বিচারপতি মধ্যাহ্নের পর রায় পড়তে শুরু করলেন। ১১৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায়, অনেকক্ষণ সময় লাগল তাঁর পড়তে। শেষ লাইনটি তিনি জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”অতএব সব প্রমাণ এবং তথ্য খতিয়ে দেখে লখনউ নিবাসী শামিম রহমানিকে ডাক্তার হরিওম গৌতমকে হত্যার অপরাধে ৩০২ ধারায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল। সাক্ষ্যগোপন করার অপরাধে আমীর আহমেদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল।”
শামিম রায় শুনে এমন হতবাক হয়ে গেল, স্থান—কাল ভুলে সে কেঁদে ফেলল।
বিচারপতি শামিমের দিকে একঝলক তাকিয়ে বলতে লাগলেন, ”তবে একজন সরকারি চিকিৎসকের মতো সম্মানীয় পদে থেকে ডা হরিওম গৌতম যে নিন্দনীয় কাজ করেছেন, একজন তরুণীর সাথে তঞ্চকতা করেছেন, আদালত তার প্রখর নিন্দা করছে।”
শামিম বা আমীর, কারুরই অর্থের অভাব ছিল না। দায়রা আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তারা আপিল করল সুপ্রিম কোর্টে। এই ঘটনা আগ্নেয়গিরি থেকে বেরনো লাভার মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল গোটা দেশে।
সুপ্রিম কোর্টে এই চাঞ্চল্যকর মামলার বিচারপতি ছিলেন এন এল উন্টয়ালিয়া এবং সৈয়দ এম ফজল আলি। দুই পক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন যোগেশ্বর প্রসাদ, ও পি রানার মতো তাবড় তাবড় অ্যাডভোকেটরা। সেইসময় মাসের পর মাস দেশের সমস্ত সংবাদপত্রে বিবরণ থাকত এই মামলার অগ্রগতির, বিবরণ থাকত শামিম—গৌতমের সরস প্রেমকাহিনির।
অবশেষে ১৯৭৫ সালের ২৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টও শামিমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দিল।
এমন অভিজাত বংশের বিদুষী কন্যার ফাঁসি হওয়া নিয়ে জল্পনা যখন দেশজুড়ে তুঙ্গে, তখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাননীয় ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ সেই বছরেরই ৫ মে আসামির প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করলেন।
শামিমের মৃত্যুদণ্ড রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় পালটে গিয়ে পরিণত হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।
চমকের এখনও কিছু বাকি আছে।
বেশ কয়েক বছর পর শামিম মুক্তি পেল। জেলে ভালভাবে থাকলে যাবজ্জীবনের মেয়াদ কমে যায়, তার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল।
সংবাদপত্রে বেরল আরেকটা অদ্ভুত খবর, ”কয়েক বছর আগে উত্তরপ্রদেশের ডাক্তার হরিওম গৌতমকে হত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শামিম রহমানি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। তিনি খুব শীঘ্রই হিন্দি চলচ্চিত্রের নায়িকা হতে চলেছেন।”
হ্যাঁ, শামিম রহমানি তার নতুন জীবন শুরু করেছিল। রূপে—গুণে অতুলনীয়া মেয়েটির খুব ইচ্ছে ছিল সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্রর বিপরীতে অভিনয় করবে, সংবাদমাধ্যমে জানিয়েও ছিল সেকথা।
তার সেই স্বপ্ন ভবিষ্যতে আংশিক পূর্ণ হয়েছিল। সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্র না হলেও তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সতীশ কউল এবং রাকেশ পাণ্ডে।
লখনউতে কান্ধারী লেনের সেই ২৩ নম্বর বাড়ি মীর মঞ্জিল আজ আর নেই। কিন্তু এখনও অনেক মানুষ সেই রাস্তায় গিয়ে খোঁজ করে, ”আচ্ছা, সেই যে শামিম রহমানি খুন করেছিল এক ডাক্তারকে … তার বাড়ি কোনটা ছিল?”