আগামীর কথা
কী হবে তবে ভবিষ্যৎ? এই মৃত্যুর অবধারিত ধারা কি চলবেই? অধ্যাপক সিদ্দিক ওয়াহিদের মন্তব্য ছিল, ‘ভারত শেষ কাশ্মীরিকেও হত্যা করবে। তারা সহজে মুক্তি দেবে না’। বিভেদ-বিভাজন আর সুযোগসন্ধানী শ্রেণির সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। তাহলে কি পাক-ভারত দখলদারিই হবে ভাগ্য। পৃথিবীর অসংখ্য বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। পেনসিলভেনিয়া ও কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী মাহবুব মাকদুমী (কাশ্মীর) লিখেছিলেন নোয়াম চমস্কির মতামত। চমস্কির মন্তব্য ছিল, “৮০র দশকের শেষের দিকের ভুয়া নির্বাচনের পর কাশ্মীরের অবস্থা দেখা যাচ্ছে বীভৎস। এই সংঘাতটা ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্য হাস্যকর।
তবে, অপেক্ষাকৃত বড় শক্তি হওয়ায় ভারত কম ক্ষগ্রিস্থ হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য ভারতের সঙ্গে সমানে সমান লড়তে সকল পুঁজি বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। যা বিধ্বংসী। ভারত গণভোট দেবে বলে আশাবাদী নন তিনি। তার সহাস্য মন্তব্য ছিল, ভারত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পিলবিসাইটের সুযোগ কখনোই দেবে না। সে জানে জনগণ সেখানে তার থেকে রেহাই চায়। পাকিস্তান ও ভারতের উচিত এক ধরনের ফেডারেল কাঠামোতে একমত হওয়া, যা কাশ্মীরকে ‘কমবেশি রকমের স্বাধীনতা’ দেবে। এক ধরনের সেন্সিবেল নেগোসিয়েশন দরকার যা নিরস্ত্রীকরণ, সেনা সংঘাত অবসান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ খুলে দেবে।” পৃথিবীর অনেক বিশেষজ্ঞের মতের পাশাপাশি জনগণের মতামত কি? বিশেষজ্ঞরা নিরপেক্ষ মতামত দেন।
আমিও হয়তো তেমন। আমার কাছে কাশ্মীরের জনগণ, পাকিস্তান কিংবা ভারত প্রত্যেকেই সমান। কারণ, আমি তাদের প্রতিনিধি নই। জাতিরাষ্ট্র আমার পরিচয় আলাদা করে দিয়েছে। আমাকে পরিচিত হতে হয় বাংলাদেশি হিসেবে। আমার হাতের পাসপোর্ট আমার পরিচয় বহন করে। কাশ্মীরের কাছে আমি বহিরাগত। আমিও মানুষ। মানুষের সহদর। এই নীতিতে জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর দুঃসাহস আমরা করি না। কিন্তু, ভ্যালির বাসিন্দারা একটি সক্রিয় পক্ষ। তারা কখনও কখনও বিভ্রান্ত। কিন্তু, যেকোনো সভা-সেমিনারে কিংবা আলোচনায় কাশ্মীরি তরুণদের যে শক্ত মতামত তা বড়ই প্রভাব বিস্তারকারী। অনেকের কাছে তা অবিবেচনাপ্রসূত, অ্যারোগেন্ট। সিংহভাগ জনগণের দাবি, তাদের সুযোগ দেওয়া হোক রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের। এর পাশাপাশি রয়েছে আন্তর্জাতিক নানা ফ্যাক্টর। পাকিস্তান ও ভারতীয় রাজনীতির
পটপরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রেক্ষিত। শুধু খুলছে না। সমাধানের পথ। অভ্যন্তরীণভাবে রাজ্যটির তিনটি প্রকট সমস্যা আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমত, সম্প্রদায়গত বিভেদ। রাজ্যটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে (ভারত শাসিত) জম্মু-কাশ্মীরে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ৮৫ লাখ। হিন্দুর সংখ্যা ৩৫ লাখ। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী (বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান) প্রায় পাঁচ লাখ। অর্থাৎ ৬৮ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা। আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তানের (পাকিস্তানের অধীনস্থ) হিসাব যোগ করলে মুসলিম সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি হবে। কিন্তু সংখ্যালঘু জনসংখ্যার মতামতেরও গুরুত্ব আছে। স্পষ্ট হওয়া জরুরি এই সংখ্যালঘু হিন্দু জনসংখ্যা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়।
বরং, জম্মু অঞ্চলের প্রায় ছয়টি জেলায় তারা মেজরিটি। অর্থাৎ, জনসংখ্যা মূলত দুই প্রান্তে ভাগ করা; হিন্দু মেজরিটি জম্মু আর মুসলিম মেজরিটি কাশ্মীর। গত ৭০ বছরে জেঅ্যান্ডকে’র রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মূলত সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতি। অস্বীকার করার উপায় নেই, কাশ্মীর ভ্যালির হিন্দু-ব্রাহ্মণ ও মুসলিম নাগরিকরা একসঙ্গে বসবাস করে আসছে সহস্র বছর ধরে। তাদের মধ্যে ভিন্নতা ছিল। ভেদাভেদও ছিল। কিন্তু, খড়গহস্ত শত্রুতা ছিল না। কিন্তু, বিগত দশকগুলোর রাজনীতি এই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক শত্রুতার চরম সীমায় নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক সংকট ও লাদাখবাসীর ভিন্নমত একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জম্মুর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পুঞ্চ, রাজৌরি ও কিশতোয়ার নিয়ে রয়েছে আরেক প্রশ্ন। এই এলাকাগুলো কাশ্মীর ভ্যালির সঙ্গে ভালভাবে সংযুক্ত নয়। কিন্তু, অনেক ঐতিহাসিক উদাহরণে তাদের সঙ্গে কাশ্মীরি অতীতের সংযোগ মেলে।
অনেকেই মনে করেন, জম্মুর কয়েকটি জেলা ভারতকে দিয়ে দেওয়া হোক। বাকি সব মিলে আমাদের পাকিস্তানে যেতে দেওয়া হোক। কিন্তু, এই সমস্যার সমাধান কোন পন্থায় হবে? এর জন্য সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান আলোচিত হচ্ছে না এখনও। তৃতীয়ত, কাশ্মীরিদের মধ্যেও সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট ঐক্যবদ্ধ অবস্থা নেই। আবদুল্লাহ পরিবার ও এনসি এখনও ভারতে সঙ্গে যুক্ত থেকে স্বায়ত্তশাসনকেই কাশ্মীরিদের সর্বোচ্চ প্রাপ্য বলে মনে করে।
আর আজাদির দাবিতো আছেই। অনেকে বলে থাকেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা হলেই সব সমস্যা চুকে যাবে। অভ্যন্তরীণ এই সব জটিলতা, বিভেদকেও ছাপিয়ে সামনে হাজির হয় ভারতপাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং কাশ্মীর প্রশ্নে তাদের অবস্থান। স্পষ্টতই, অভ্যন্তরীণ জটিলতাগুলোও অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের অনড় অবস্থানের ফল। এই দুই দেশের সক্রিয় তৎপরতার বাইপ্রোডাক্টও বটে। দুই দেশের সমঝোতার পথে প্রথম যে ইস্যু সামনে আসে তা হলো, সন্ত্রাসবাদ। সাম্প্রতিককালের প্রায় সব সমঝোতার আলোচনায়ই ভারতের পক্ষ থেকে বক্তব্য
ছিল, সন্ত্রাসবাদ দমনে পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে একমত হতে হবে। অর্থাৎ, কাশ্মীরের ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘জিহাদি’ গোষ্ঠীগুলোকে ভারতবিরোধিতার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। স্পষ্টতই, পাকিস্তানের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ওই গোষ্ঠীগুলো এখন কম পায়। তবে, নৈতিক সমর্থন অবশ্যই পায়, এবং তা শতভাগ। কিন্তু, এই প্রশ্নে সমঝোতায় আসতে পাকিস্তানের সেখানে অনীহা রয়েছে। হ্যাপি মুন জ্যাকব লিখেছেন, ‘কৌশলগত কারণেই পাকিস্তান সন্ত্রাস নির্মূলের প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করছে না। কারণ, সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত আর কোনো আলোচনা করবে না। তিনি এও উল্লেখ করেছেন, ভারতের জন্য হুমকি যেসব সন্ত্রাসবাদী সংগঠন- যেমন লস্কর-ই-তৈয়েবা, তারা পাকিস্তানের জন্য হুমকি নয়।
বরং, তারা পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে সীমিত হলেও লড়তে সহযোগিতা দিচ্ছে। অর্থাৎ, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমঝোতায় পৌছা ভারত ও পাকিস্তানের জন্য মৌলিক বিষয় নয়। জিইয়ে থাকা সংঘাত এবং মানুষের ভোগান্তি হলো দুই দেশের স্বার্থসিদ্ধির একটি কৌশলগত উপাদান। দাবার খুঁটি। তবে, ৯/১১ পরবর্তী নানা ঘটনায় কোণঠাসা পাকিস্তান বাহ্যত সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে অনেক ক্ষেত্রে রাজি হয়েছে। স্পষ্টতই, ৯/১১ পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে ভূমিকা রেখেছে। ফলে, এই পরিচিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে পাকিস্তানও কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদীনসহ বিভিন্ন সংগঠনকে সরাসরি সহায়তা বন্ধ করেছে। গোপনে সহায়তা যে করছেনা তা বলা কঠিন।
কিন্তু, আস্থা সৃষ্টির জন্য এটুকুই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া, ৯/১১-এর পর বিশ্বরাজনীতির ফোকাস কাশ্মীর থেকে সরে আফগানিস্তান ও ইরাকে চলে গেছে। এখন তা চলে গেছে সিরিয়ায়। ফলে কাশ্মীর সমস্যা আর বিশ্বদরবারে বড় কোনো সমস্যা নয়। ওয়ার অন টেররিজমের সঙ্গে ভারত অংশ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে, কাশ্মীরের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে এমনকি স্বাধীনতাকামী (আনআরমড) রাজনৈতিক গ্রুপগুলোকেও বৈশ্বিক সন্ত্রাসের অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করণের প্রচেষ্টা ভারতের পক্ষ থেকে আছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বাইল্যাটারালিজম বনাম পাকিস্তানের আন্তর্জাতিকায়ন পরস্পরবিরোধী। এ হলো কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মৌলিক বিভেদ।
ভারতই কাশ্মীর সমস্যাকে প্রথম জাতিসংঘে নিয়ে গিয়েছিল। মহারাজা ইট্রুমেন্ট অব একসেশনে স্বাক্ষর করে ভারতে যুক্ত হয়েছেন। এই কাগজের বলে ভারতের ধারণা ছিল আন্তর্জাতিক বিচারে কাশ্মীরের অধিকার ভারত পাবে। কিন্তু, সেটি হয়নি। নানা কারণে, জাতিসংঘের রেজুলেশনগুলোর মোদ্দাকথা দাঁড়ায়, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (Final Dsposition) নির্ধারিত হবে গণতান্ত্রিক পন্থায় গৃহীত জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে (Will of the people expressed by the democratic method)। তখন থেকে পাকিস্তান সবসময়ই সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের
ভূমিকার পক্ষে ছিল। ভারত বলেছে, সমাধান হবে দ্বিপক্ষীয়ভাবে। তবে, দুই পক্ষই বিভিন্ন সময়ে নিজেদের অবস্থানে কিছুটা রদবদল করলেও আখেরে আবার নিজস্ব অবস্থানে ফিরে গেছে। দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার পথে তৃতীয় জটিলতা হলো, কাশ্মীরি জনগণ ও তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের অংশীদারিত্ব। পাকিস্তান বিভিন্ন সময় কাশ্মীরি নেতাদেরকে আলোচনার অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করেছে। ২০১৫ সালেও নওয়াজ শরীফ জাতিসংঘে তার বক্তব্যে বলেছেন, কাশ্মীরি নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পার্টি। কিন্তু, শিমলা চুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাশ্মীরি নেতৃত্বকে অংশীদার হিসেবে স্পষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আর ভারতের পক্ষ থেকে কখনোই কাশ্মীরিরা বিরোধের অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। এভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষকে সমাধান পক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া বা অস্বীকার করার মাধ্যমে সমাধান প্রস্তাবগুলোকে সর্বজনীনতাহীন করে দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ২০০৪ সালে (যখন ভারত-পাকিস্তান কম্পোজিট ডায়লগ প্রসেস চলছিল) ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের প্রধান জন ওয়ালস কুশনান বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি যে সেখানে তিনটি পক্ষ রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে গ্রহণযোগ্য স্বার্থ রয়েছে। এই তিনটি পক্ষ হলো, ভারতীয় সরকার, পাকিস্তানি সরকার এবং কাশ্মীরি জনগণ ও তাদের প্রতিনিধিরা। সুতরাং, এই সবপক্ষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। চতুর্থ সমস্যা হচ্ছে পাকিস্তানের সাবেক প্রসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের চার দফা প্রস্তাবের ব্যর্থতা। অনেকের মূল্যায়ন হলো, মোশাররফ চেষ্টা করেছিলেন কাশ্মীরকে বাঁচাতে, তার পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ উপায়ে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ আরেকটি (চার দফাবিশিষ্ট) সমঝোতার প্রস্তাব দেন। সেটিও অনেকটা মোশারফের প্রস্তাবের মতো। তিনি বলেছিলেন,
১. দুই দেশ লাইন-অব-কন্ট্রোলে গুলিবিনিময় সম্পূর্ণ বন্ধ (Cease fire) করবে। জাতিসংঘ সেটি মনিটর করবে।
২. দুই দেশ কোনো অবস্থাতেই পরস্পরকে ভীতি প্রদর্শন বা শক্তি প্রদর্শন করবে না।
এবং এটি জাতিংসঘের মৌলিক নীতি।
৩. কাশ্মীর থেকে মিলিটারি সরিয়ে নেওয়া (Dermilitarize) হবে।
৪. উভয়পক্ষ নিঃশর্তভাবে পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন গ্লেসিয়ার থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে।
অবশ্য তিনি সেখানেও কাশ্মীরি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনাকে অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তার প্রস্তাবে (১) কাশ্মীরি বিদ্রোহী নেতাদেরকে আমলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। (২) জাতিসংঘকে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত করার
কথা বলা হয়েছে। এবং প্রস্তাবটি তিনি তুলেছেনই জাতিসংঘে। এই দুইটি বিষয়কেই অস্বীকার করে আসছে ভারত সব সময়। সেদিক থেকে নওয়াজ শরীফের প্রস্তাব কমই গ্রহণযোগ্য বিপরীত পক্ষের কাছে। অপেক্ষাকৃতভাবে, মোশাররফের প্রস্তাব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সে সময় একমাত্র সৈয়দ আলী গিলানী ছাড়া সবাই পারভেজ মোশাররফের প্রস্তাবের পক্ষে একমত হয়েছিল। কিন্তু, এরই মধ্যে পারভেজ মোশাররফ নিজ দেশেই ক্ষমতাচ্যুত হন।
ফলে, সে প্রস্তাবের ভিত্তিতে আলোচনা আর অগ্রসর হয়নি। ২০১৫ সালের অগাস্টে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইসর লেভেল আলোচনা শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষে আজিজ এবং ভারতের পক্ষে অজিৎ দোভালের মধ্যে এ আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা অপুষ্ট গর্ভপাতের ভাগ্য বরণ করে। ২৩-২৪ অক্টোবর এই আলোচনার নির্ধারিত দিন ছিল। আজিজ এসেছিলেন। কিন্তু, আগমূহুর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ শর্ত দিয়ে দেন যে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিতে হবে, তারা সেপারেটিস্ট’ নেতাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করবে
পরদিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ তার মন্ত্রিসভায় বলেন, কাশ্মীরি নেতাদের মতামত ছাড়া কাশ্মীরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
কাশ্মীরের নেতারা কোনো তৃতীয় পক্ষ নয়। তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। হুরিয়াত নেতা শাবির শাহ দাবি করেন, হুরিয়াত কনফারেন্সই জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের সব এলাকার মানুষের মতামতের সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু, ভারতীয় সংবিধানের অধীনে কোনোভাবেই হুরিয়াতের সঙ্গে নয়াদিল্লির আলোচনা সম্ভব নয়। পঞ্চমত, দুই দেশের সেনাবাহিনীর অবস্থান কী? তারা কি সমাধান চায়? ১৯৬৫ সাল নাগাদ জাতিসংঘের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সকল উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। তার পর থেকেই উভয় দেশ সমস্যার একটা সামরিক সমাধানে আগ্রহী।
যারই ফল হলো ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। কিন্তু, তা কোনো সমাধান দিতে পারেনি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ও ব্যাপক জ্বালানি সরবরাহ করে কাশ্মীর সমস্যায়। ঢাকায় পরাজয়ের পর পাকিস্তানি নীতি নির্ধারকদের মধ্যে উপলব্ধি হয় বলপ্রয়োগ করে ভারতের হাত থেকে কাশ্মীর নেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া ১৯৭১ পরবর্তী শিমলা চুক্তি আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকাকে আরও সীমিত করে দেয়। ফলে কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকরাও নতুন পথ ভাবতে শুরু করে। কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে কি হবে না, সে প্রশ্ন অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে যায়। নতুন ভাবনা শুরু হয়, ভারতের মধ্যে জেঅ্যান্ডকে কী ধরনের স্ট্যাটাস পাবে। ভারতও অনেকটা আত্মবিশ্বাস পায়। শেখ আবদুল্লাহসহ অনেক রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়। জাতিসংঘের বাতলে দেওয়া গণভোটের প্রশ্নটিই শুধু পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।
এই প্রেক্ষিতে সমস্যার সস্তা ও ত্বরিত সমাধান দৃশ্যত অসম্ভব মনে হচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না যে সমস্যাটির পেছনে হাজার বছরের পুরনো কারণও যুক্ত রয়েছে। প্রথমত, দীর্ঘমেয়াদে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
১. জনগণের সমস্যাবলী উপলব্ধি ও তাদের শান্তিপ্রতিষ্ঠার পথে অংশীদার করা,
২. বিভিন্ন গ্রুপকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা,
৩.সিভিল সোসাইটির সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলা জরুরি। সেটা হতে পারে উভয় পাশে,
৪. কাশ্মীর সমস্যার বর্ণনা একেক পক্ষ একেকভাবেই প্রদান করছে। একাধিক পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদী চশমার মধ্যদিয়ে সমস্যাটিকে দেখা ও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এখন বৈশ্বিকভাবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য একটা ঐক্যবদ্ধ ন্যারেটিভ (বয়ান) তৈরির উদ্যোগ নেওয়া দরকার,
৫. কাশ্মীরের মুসলমানদের সঙ্গে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের একটা সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। সকল মুসলিম সন্ত্রাসী নয় এটি যেমন একটি সত্যকথা, তেমনি সকল হিন্দুকে সাম্প্রদায়িক বলার সংকীর্ণতা থেকেও মুসলিম সম্প্রদায়রের উত্তোরণ ঘটাতে হবে। একইভাবে ইসলামের বিভিন্ন তরিকার মধ্যেও আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে যেন একসঙ্গে সবাই চর্চা চালিয়ে যেতে পারে। আর এই সবকিছুর আগে সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে।
এজন্য আগে সংঘাত নিরসনের টেকসই পদ্ধতির ধারণা জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সৃষ্টির শুরু থেকেই নানা ধরনের সংঘাতের মধ্য দিয়েই বিশ্বব্যবস্থা এগিয়ে চলেছে। আবার সংঘাত নিরসন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও এসেছে একের পর এক। ইয়োহান গালটুং, উইলিয়াম উরিসহ বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের পুরোধাগণ তাই এখন বলছেন, সংঘাত যেমন সর্বকালীন, শান্তিরক্ষার প্রচেষ্টাও তেমন সর্বকালীন। তারা বলছেন, পৃথিবী যতদিন আছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় ভূমিকা ততদিন চালিয়ে যেতে হবে। যেকোনো সময় একটি সংঘাতের সমাধান হওয়ার পর সামান্য কারণে আবার সেখানে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
এজন্য পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের জনক ইয়োহান গালটুং তার সক্রিয় শান্তি’ (Active Peace) তত্ত্বে সংঘাত নিরসনের তিনটি পর্যায় ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমত, সংঘাত ব্যবস্থাপনা (Conflict Management): অর্থাৎ, যে কোনো উপায়ে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা। এই পর্বে অন্তত সহিংসতা ও প্রাণহানির অবসান ঘটানোর চেষ্টা হয়। এ অবস্থাকে অনেকে আর্মড পিস হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এই অবস্থায়ও বিরোধপূর্ণ পক্ষগুলো একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। চরম যুদ্ধাবস্থা থেকে এই প্রথম পর্যায়ে উন্নীত করার প্রচেষ্টাকে শান্তি রক্ষা (Peace
Keeping) বলা হয়। শান্তি রক্ষার এই পর্যায় থেকেও সামান্য কারণে আবার যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। যেমনটা হয় কাশ্মীরে। এই দেখা যায় সবকিছু স্বাভাবিক, কোনো প্রাণহাণি নেই। প্রতিবাদ নেই। পর্যটকরা যাচ্ছে। নির্বাচন হচ্ছে। ভারত সরকার বলছে সবকিছু ঠিকঠাক। নরমাল। কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে ভালভাবেই। আছে। ভূ-স্বর্গে স্বর্গীয় শান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু, হঠাৎ করেই কোনো এক জঙ্গলে বুরহানের মৃত্যু হলো। আর শান্তির পায়রা উড়ে গেল। একদিকে বিক্ষুব্ধ জনগণ মাসের পর মাস হরতাল পালন করছে। সরকার চালু রাখছে কারফিউ। অন্যদিকে, সশস্ত্র প্রতিরোধকারী ও সৈন্যদের মধ্যে গুলিবিনিময় হচ্ছে। এই সশস্ত্র শান্তি (Armed Peace) আসলে প্রকৃত শান্তি নয়। পৃথিবীর সব সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা শান্তি বলতে এই পর্যন্তই বোঝে।
তাদের বয়ানে শান্তি মানেই হলো যেখানে যুদ্ধ নেই। মিলিটারিজম বিশ্বাস করে যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এজন্য, পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯ শতককে বলা হয় শান্তির শতক। কারণ, ওই শতকে কোথাও বড় কোনো যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু, ওই শান্তি পরের শতকে এসে অশান্তি হয়ে গেল। বিশ্বযুদ্ধে জ্বলে উঠলো দুনিয়া। এরপর বাকি সময় ধরে চলল শীতল যুদ্ধ আর অসংখ্য স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রমাণ হয়ে গেল, সশস্ত্র শান্তি আসলে শান্তি নয়। সংঘাত সমাধানের দ্বিতীয় পর্যায়কে গালটুং বলছেন সংঘাত নিরসন (Conflict Resolution)। এই পর্বে বিবদমান সব পক্ষ একে অপরের কথা শুনতে আগ্রহী হবে। তারা প্রত্যেকেই অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।
সবাই মিলে একটা সমঝোতায় আসে বা আসতে চায়। এই কার্যটি বিবদমান পক্ষগুলো নিজেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে করতে পারে। আবার সেখানে তৃতীয় কোনো পক্ষ মধ্যস্থতা করতে পারে। তৃতীয় পক্ষ তাদের সমঝোতায় আসতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধ্যও করতে পারে, সালিশ ব্যবস্থার মতো। সক্রিয়তার এই দ্বিতীয় পর্বকে গালটুং বলেছেন শান্তি তৈরি (Peace Making)। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি মূলত এই পর্যায়েরই শুরু।
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে গত পৌনে এক শতাব্দীব্যাপী চলমান বিরোধের সমাধান কাজ এই পর্ব পর্যন্ত আসতেই পারেনি। শান্তি প্রচেষ্টার তৃতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা কাশ্মীর ইস্যুতে অপ্রয়োজনীয়। তা হলো, পৃথিবীর যেসব সংঘাত নিরসন (Resolution) হয়েছে সেটাও পূর্ণ শান্তির নিশ্চয়তা নয়। শান্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা হবে তখনই যখন সংঘাত পরিবর্তিত হবে সম্প্রীতিতে। একে গালটুং বলেছেন Conflict Transformation। এই পর্বে উন্নীত হলে বিবদমান পক্ষগুলো একে অপরকে আর শত্রু ভাববে না, ঘৃণা করবে
কাশ্মীরে সেই পর্যায়ের শান্তির আশা আমরা করতেই পারি। সেজন্য, অবিলম্বে সকল পক্ষের কাছে অন্তত প্রাণহানি বন্ধ করার মিনতি রইল। এই বাস্তবতায়ই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে বাংলাদেশিদের। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা চাওয়া বা না চাওয়া যে কারও মৌলিক অধিকার। অন্য কেউ তা আদায় করে দিতে পারে না। কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশিদের লড়ার সুযোগ নেই। কাশ্মীর বিরোধের শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য মীমাংসার প্রত্যাশা করতে পারি আমরা; শান্তি কামনা করতে পারি; মানুষে মানুষে সখ্য আর আস্থার আশা করতে পারি।
ভারত দাবি করে কাশ্মীর হচ্ছে ‘ক্রাউন অব ইন্ডিয়া’। ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত যদি সম্প্রীতিতে রূপ নেয় তাহলে কাশ্মীর হয়ে উঠতে পারে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মুকুট। ক্রাউন অব সাউথ এশিয়া। এটা হতে পারে আমাদের দৃঢ় আশাবাদ। আমাকে কাশ্মীরের বন্ধুরা প্রায়ই প্রশ্ন করত, তুমি কাশ্মীর সমস্যার কী সমাধান চাও। তুমি কি আমাদের আজাদির সমর্থন করো? আমি বলতাম, “তোমাদের কাশ্মীরকে নিয়ে দুই দেশ টানাহেঁচড়া করছে। তোমরা নিজেরাই এখানে একটা পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওনি। চতুর্থ পক্ষ হিসেবে তোমরা আমাকে যুক্ত করতে চাও?’ দৃশ্যত, কাশ্মীর প্রশ্নে বাংলাদেশিদের কোনো অবস্থান, জটিলতায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। তাই, শেষ প্রান্তে এসে আমি বরং দুটি বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকেই প্রশ্ন করি, বিধ্বস্ত, বিপন্ন কাশ্মীর আমাকে কী দিয়েছে?)
নোট/সূত্র
১. Mahboob Makdoomi; Greater Kashmir; August 8, 2015; P9.
২. Happymon Jacob; Is Pakistan Unable to Defeat terrorism?; Greater Kashmir, P10; September 20, 2015.
৩. J-k.com; Kashmir, World’s Most Beautiful Prison; http://www.jammukashmir.com/archives/archives 2004/kashmir20040721a.html (accessed: 14, Oct; 2015)
৪. Mahmood Ur Rashid; Signs of Change, at last!; Greater Kashmir; September 19, 2015; P11.
৫. Greater Kashmir; October 1, 2015; PI.
৬. Ahmed, Samir; Contextualizing Mosharraf’s Four Point Formula; Journal of Kashmir Studies, 2012; Pp: 87-105.
৭. Greater Kashmir; August, 26; 2015; P:1.
৮. Sajad Padder; India-Pakistan Composit Dialogue Process (2015); Pp: 20-30.
৯. Mehmood-ur-Rashid; Two Nations Practice; Greater Kashmir; September 26, 2015; P:11.
১০. Zakaria Polash; কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কী? (সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৬) http://www.ntvbd.com/author/zakaria-polash
১১. জাকারিয়া পলাশ; কাশ্মীর থেকে শেখা; সাম্প্রতিক দেশকাল; নভেম্বর ১০, ২০১৬ (ধারাবাহিকের শেষ পর্ব)।