আগস্ট আবছায়া – ৪.৬

৪.৬

এই। এটুকুই। আমাকে জিম্বাবুয়ের এক লোক, রেনে ভার্জিনিয়া মার্টিন, ওই বাসি কিন্তু মোটামুটি তাজা ও সম্পূর্ণ গন্ধহীন অনন্ত-বিস্তৃত ভুঁড়ি মাড়িয়ে দেয়াল পার করে সি-সগুলোর সামনে এনে ছেড়ে দিল। রেনে মার্টিন (তার মাঝখানের নামটা মেয়েদের নাম ভার্জিনিয়া কেন?) আমাকে আরও একটা কথা বলল অনেকটা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ভরাট গলায় যে তাদের এই প্রাসাদ সীমানায় কোনো অস্ত্র, কোনো পিস্তল, কোনো স্টেনগান কাজ করবে না, যেমন কাজ করবে না আমার কোমরে লুকানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন 3941-টাও। 

।প্রাসাদের সীমানার ভেতরে, ওই মাঠের থেকে দেখা যায় না মতো এক জায়গায় রেনে মার্টিন কিংবা পুরুষের বেশ ধরা নারী ভার্জিনিয়া আমাকে বলল, ‘বিশ্বাস হয় না? দেখি ফায়ার করো। করো না।’ আমি পিস্তলটা সাঁৎ করে ডান হাতে নিয়ে অ্যাকশন মুভির নায়কের ধরনে এক পা সামনে এগিয়ে, এবং পেছনের পায়ে পেশির জোর খাটিয়ে আমার ডান হাতে তির্যকভাবে ঝট করে পিস্তল ওপরে তুলে রেনের কপাল বরাবর ট্রিগার টিপলাম। দেখলাম আমার পিস্তল থেকে গুলি বেরোল না কোনো, স্রেফ ফুৎ ফুৎ করে শব্দ হলো দুটো। দুই ক্ষীণ শব্দ—এক ক্ষীণ ফুৎ এবং এক গগনবিদারী কিন্তু তবু ক্ষীণ ফুৎ। 

টলোমলো পায়ে বাড়ি ফিরবার পথে আমি তখন ভাবছি যে মেহেরনাজ হায়দার এতক্ষণে ওই লাল প্রাসাদের কোনো একটা ঘরেই আছে সম্ভবত এবং কোরিয়ান ওই বৃদ্ধ বিজ্ঞানী তাকে তাড়া দিয়ে (সংগম চলাকালীন) নিশ্চয়ই এখন জানতে চাইছে যে তার কী মনে হয়, আমি, যে আমি তার প্রেমিক, সেই আমি তাহলে শয়তান ও দেবতাকে ঠিক ঠিক আলাদা করে চিনতে পেরেছি কি? 

যতক্ষণে আমি আমার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেছি—অনেকক্ষণই লাগল আমার, কারণ আমি শক্তভাবে হাঁটতে পারছিলাম না – তখন আসরের নামাজের সময় হয়ে এসেছে, অসংখ্য বাড়ি থেকে মুসল্লিরা বেরিয়েছে মসজিদের উদ্দেশে; কিংবা আসরের নামাজ শেষ, এখন তারা যাচ্ছে বাড়ির পথে। তাদের কেউ হাত নেড়ে, কেউবা কাছে এসে আমাকে সালাম দিচ্ছে ‘প্রফেসর সাহেব, সালামুআলায়কুম’ বলে। তাদের মুখ থেকে উদ্যমহীনতার স্বাভাবিক অপ্রস্তুত গন্ধও বেরোচ্ছে আমি টের পেলাম, আর পিংকি হিজড়া আমাকে জানাল যে সে সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসতে চায়, আমার সঙ্গে তার জরুরি কথা আছে। 

আমি আমার বাড়ির দিকে যাচ্ছি পাথরের মতো হয়ে যাওয়া ভারী পায়ে এবং ভাবছি নানা কথা। কেন এভাবে দলত্যাগ করল মেহেরনাজ? ক্ষমতার লোভে? নিশ্চয়ই। ক্ষমতা এতটা আকর্ষণীয়? হবে হয়তো। কেন কোরিয়ানদের নিয়ন্ত্রিত বিশেষ ওই বিশ্বমানবসংঘে যোগ দিতে হলো তাকে? তার ‘অ্যাস্হোল’ পিতার প্রতি ঘৃণা থেকে? আমাকে ভুল বুঝে? আমি, আমার মতো সামান্য এক লোক, তার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? আর কীভাবে পাখিগুলো দাঁড়িয়ে গেল আকাশে? স্থির। তার মানে প্রকৃতি এবং তার পাখি বায়ুপ্রবাহ-জলের মাছ সব তাদের নিয়ন্ত্রণে? আর আমাকে ছেড়ে দিল কেন ওরা? কী এর মানে? ওরা কি জেনে গেছে যে আমি হাত মিলিয়েছি আমেরিকানদের সঙ্গে, এমনকি অর্থসাহায্য নিচ্ছি আমেরিকান সিআইএর কাছ থেকে, এমনকি আমেরিকান সিনেটর এখন আমার দলের লোক? তাই কি ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে স্পষ্ট ধোঁকা ও বিভ্রমে ফেলল তাদের দুশমন ওই মার্কিনদের এবং ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে? নাকি আমাকে ওদের লেগেছে দু-পয়সার এক খ্যাপাটে কিন্তু দন্তহীন, কবিতাপ্রেমী এক নভিস্ অ্যামেচার স্টুপিড? আর মূল কথা, কোনো বিরাট-বিশাল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে কি বর্তমানের পুরো ওয়ার্ল্ড অর্ডারটাই বদলে দেবার জন্য? এমনকি হতে পারে যে নর্থ কোরিয়ার পেছনে আছে চীন, এবং আমার দেখা ওই লাল কোরিয়ান প্রাসাদগুলো আসলে চীনের প্রাসাদ? যে মৌচাকে মৌচাকে ভরা দেয়াল আমি দু দফা পার হলাম, তা আসলে চীনের প্রাচীর? এবং এই চীনা-কোরিয়ান সবকিছুর পেছনে আসলে আছে আমেরিকারই হাত? বর্তমানের লিবারালমনা আমেরিকানদের ঝেড়ে ফেলে এটা নতুন এক নাক বোঁচা-আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করারই একটা আপাত প্রচণ্ড জটিল কিন্তু আদতে বিশাল সরল স্রেফ প্রথম ধাপ? 

ঘরে ঢুকে বসতেই উইলিস বার্নস্টেইনের ফোন এল। ‘অ্যানি আপডেট, মাই ফ্রেন্ড?’ সে জিজ্ঞাসা করল। আমি কিছুটা নিখোঁজ সুরভি ছেত্রির কথা মনে করে, তার অরুনিমা গুরুং নামের ভেতরকার শ্বাসরুদ্ধ বিষাদের কথা মনে করে এবং কিছুটা উইলিসের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তাকে মিথ্যা বললাম যে আমার মিশন ব্যর্থ হয়েছে, তাদের ফাইলের ওই সি-স পেরোনো এক্স চিহ্নিত প্রাসাদটাতে কেউ নেই, কিছু নেই, অতএব তার আমেরিকা ফেরত যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তবে তার আগে সে মার্কিন স্যাটেলাইট থেকে ওই একই প্রাসাদগুলোর ছবি তুলে দেখতে পারে যে আমার কথা সত্য কি না, এবং সে যেহেতু সম্ভবত এখান থেকে চিরদিনের মতোই চলে যাচ্ছে, তাই তাকে আমি আজ, বিশেষ করে, এমিলি ডিকিনসনের ‘Poem।260’ শোনানোর মনস্থ করেছি। 

উইলিস ফোনের ওই প্রান্তে কবিতা শোনার আশায় নীরব হয়ে রইল, আর আমি আমার কবিতাপাঠের চিরকালীন কৃত্রিম কণ্ঠে তার উদ্দেশে ‘ব্রাইড অব দ্য হোলি ঘোস্ট’ ডিকিনসনকে আওড়ালাম : 

Because that you are going
And never coming back
And I, however absolute
May overlook your track-
Because that Death is final
However first it be, 
This instant be suspended
Above mortality-

.

পরিশিষ্ট – উপন্যাসের কিছু প্রধান চরিত্র এখন কে কোথায়? 

এ বইয়ের কারা এখন কোথায়, সে তালিকায় যাওয়ার আগে একটা কথা বলা প্রয়োজন। ২৫ আগস্ট ২০১৫-র ওই ঘটনার ঠিক ১০ মাস ৬ দিন পরে, ১ জুলাই ২০১৬ তারিখে রাত ৯টা ২০ মিনিটে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে পবিত্র রমজান মাসের ইফতারির কিছু পরে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। পৃথিবীর মানুষের আচার-ব্যবহার, চালচলন ও ভ্রান্ত বিশ্বাস বদলের স্বপ্ন নিয়ে সেখানে একদল জঙ্গি ক্রুড বোমা, রামদা, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে হামলা চালায় রেস্টুরেন্টে খেতে বসা নিরস্ত্র মানুষের ওপরে। সব মিলে মারা যান ২৯ জন, যাঁদের মধ্যে আছেন ১৮ জন বিদেশি ও দুজন বাংলাদেশি জিম্মি, দুজন পুলিশ অফিসার, পাঁচ বন্দুকধারী জঙ্গি এবং দুই রেস্টুরেন্ট স্টাফ। আহত হন প্রায় ৫০ জন। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ত (আইএসআইএল), সোজা কথায় আইসিস, এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে দাবি করে, কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশ জানায়, এটা জামাআতুল মুজাহিদীনের কাজ। হত্যাকারী জঙ্গিদের একজনের নাম ছিল নিবরাস ইসলাম, যে তার নায়কসুলভ কিশোর মুখ, সুন্দর চোখ ও সুউন্নত নাকের জন্য এবং তার ‘নিবরাস’ নামের ভেতরকার বিদ্যুৎ-প্রভার কারণে অনেক খ্যাতি অর্জন করে। এই নিবরাস ছিল এ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বসুন্ধরার সরফরাজ নওয়াজ সাহেবের মেজ ছেলে। তার আসল নাম ছিল ইশতিয়াক নওয়াজ, সে মালয়েশিয়ায় পড়তে গিয়ে বুঝতে পারে তার ইশতিয়াক নামের আরবি অর্থ বাসনা বা ব্যগ্রকামনা, যার কোনো অর্থই হয় না। কারণ, তার দায়িত্ব পৃথিবীকে আলো দেওয়া, পৃথিবীর জন্য বাসনাকাতর হওয়া নয়। তাই সে তার নাম পাল্টে রাখে নিবরাস, অর্থ আলো, বাতি, দীপিকা। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসমেট, আমার বন্ধু পুলিশ অফিসার (বর্তমানে অ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনার) মনিরুল ইসলাম প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতা, স্থৈর্য ও দানবীয় সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের সব ধরনের সব জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপরে এবং বাংলাদেশকে আপাতত, এক দৃশ্যমান ভবিষ্যৎ পর্যন্ত, জঙ্গি হামলার হুমকিমুক্ত অঞ্চল বানিয়ে ছাড়েন। 

এখন দেখা যাক, ২০১৫-র এই ঘটনার আড়াই বছর পর এর মূল কিছু চরিত্র এখন কে, কোথায়, কী করছে? শুরু করা যাক মেহেরনাজকে দিয়ে। 

মেহেরনাজ হায়দার : কোরিয়া চলে গেছে মেহেরনাজ। আমার জানামতে, সে শুধু ওপরেই উঠছে। আমি শুনেছি সে বিয়েও করেছে। তবে আমি জানি না কাকে। ওই বৃদ্ধকে কি? তার বিয়ে প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেই দেখেছি সে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। আমার সঙ্গে তার সেদিন চিরবিদায় হয়ে গেলেও কে জানে কী এক কারণে এখনো, ক্ষীণভাবে, লটকে আছি আমরা একে অপরের সাথে, ই-মেইলে ভর করে। প্রথম এক বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না, আর আজ আবার প্রায় এক বছর হয় তার সঙ্গে কোনো রকম কোনো যোগাযোগ নেই আমার। আমি তার শেষ ই-মেইল পাই ৯ ডিসেম্বর ২০১৬-তে। সেখানে সে অদ্ভুত এক ভাষায়—যে-ভাষা আমরা দুজনে মিলে নির্মাণ করেছিলাম বসুন্ধরা শব্দকাণ্ডের পরে আমাদের আত্মগোপনে থাকা দিনগুলোতে বাংলা অক্ষর বিন্যাসের ধড়ফড় করা এক নির্বিচার ওলটপালট ঘটিয়ে (যেমন অতিসাধারণ একটা বাংলা শব্দ ‘দেখা হবে’ সে ভাষায় ‘গশাপঠা’, কিংবা ‘বিদ্রোহ’ হচ্ছে ‘ধোগুংট’, এমন)—সে ভাষায় আমাকে ইংরেজি হরফে লিখে জানায় (যে লেখা আমি ছাড়া এই পৃথিবীর কেউ, কিংবা কোনো মাংসাশী গোয়েন্দা সংস্থাও কোনো দিন বুঝে উঠতে পারবে না) : ‘এমন হতে পারে আমি শিগগিরই কিম জং-উনকে সরিয়ে দিচ্ছি।’ তার এই কথা পড়ে আমি আজও ভাবি, তবে আমার ওই মেহেরনাজ কি এখন নর্থ কোরিয়া সাউথ কোরিয়া মিলে পুরো কোরিয়ান পেনিনসুলারই সম্রাজ্ঞী? সেই একই ই-মেইলে সে আমাকে আরও লিখেছিল যে পিয়ংইয়ংয়ে অনেক ঠান্ডা…’রাত্রির নাম রাত্রিই, কখনোই ভোর হওয়া নয়’। ই-মেইলটা খুললাম আমি এই মুহূর্তে। ইংরেজি হরফের সুন্দর বাংলায় তার শেষ প্যারায় লেখা (যা আমি তিন ডট দিয়ে দিয়ে গোপন করছি যেখানে যেখানে দরকার) : ‘এখানকার দালানের পর দালানে অনেক খিলান, অনেক স্তম্ভ, আর এখানে অনেক প্যাগোডা, তাদের ছাদগুলো লাল। সূর্যের আলো ওই লালে পড়লেই মনে হয়, এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে একভাবেই—জিতে। …আসলে আমার অ্যাস্হোল বাবার থেকে মুক্তি দরকার ছিল আমার, তবে কোনো জাস্টিফিকেশন দেব না, ওটা দুর্বলতার লক্ষণ। … আপনাকে মাঝে মধ্যে অনেক মিস করি, দেশকেও মিস্ করি। …আপনি নোংরা ও হৃদয়হীন… আপনার কাছে কারোই কোনো মূল্য নেই… তা-ও যদি আপনি কাফকা দ্বিতীয় খণ্ডটা শেষ করতেন, তাহলে কিছুটা হলেও আমি ভাবতাম আপনার কাছে আমার মূল্য অন্তত সামান্য হেমন্ত-বিকেলের অতি সামান্য উইলো-টিট পাখিগুলোর সমান। …শিগগিরই সারা পৃথিবী জানবে আমার নাম। ক্ষমতা, এতখানি ক্ষমতা থাকাটা অনেক আনন্দের। আর পড়াশোনা করা একজন মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে পৃথিবীর ক্ষমতাশালী মেয়েদের সত্যিকারের ইতিহাস আসলে রাজাদের বিছানার দখল নিতে পারার ইতিহাস।’ 

সুরভি ছেত্রি : সুরভি এখন পারমানেন্টলি আমস্টারডামের বাসিন্দা। মাঝখানে দেড় বছর তাকে আমেরিকা কোথায় আটকে রেখেছিল তা কেউ জানে না। সুরভির নেপালের বন্ধুদের ধারণা সে বন্দী ছিল লিথুয়ানিয়ার ভিলনাউসে সিআইএর এক কারেকশনাল ফ্যাসিলিটিতে। মাঝখানে আমি সুরভির খোঁজে দুদিনের জন্য কাঠমান্ডু গিয়েছিলাম, তখন আমার দেখা হয়েছিল সুরভির মা মালবিকা ছেত্রির সঙ্গে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি যদি পারতেন—ক্ষমতা অর্থে নয়, বিবেকের ডাক অর্থে—তাহলে আমাকে আজকেই অ্যারেস্ট করিয়ে নেপালের কোনো জেলে ঢুকিয়ে নিশ্চিত করতেন আমি যেন সারা জীবন ওখানে পচে মরি। আমি তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম বারবার, কিন্তু তিনি শেষে আমাকে ‘গেট আউট’ বলে তাঁদের পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। 

সুরভির সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় মাত্র দু সপ্তাহ আগে। সে ফোনে আমাকে জানায় (তার গলার স্বর বদলে গেছে পুরোপুরি, কারণ ‘এক বদ্ধ হিমধরা ঘরে আমাকে রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে ঠান্ডা মেঝের ওপরে শুয়ে, গায়ে একরকম কোনো কাপড় ছাড়াই…তারপর কীভাবে যেন আমার গলা নষ্ট হয়ে গেছে চিরকালের মতো’) আমস্টারডামে অ্যানা ফ্রাংকদের বিখ্যাত বাড়ির একদম কাছে সে একটা দোকান ভাড়া নিয়েছে ট্যাটু শপ খুলবে বলে। ট্যাটু করার মেশিনপত্র কিনতে তার খরচ হয়েছে অনেক, কিন্তু তার নিপীড়নকারীদেরই একজন তাকে বিরাট অর্থ সাহায্য করেছে… ‘একই লোক যে আমাকে একদিন মারতে মারতে মাটিতে ফেলা কফ চেটে খেতে বাধ্য করেছিল, একই লোক যে নির্যাতনের এক নিঃসঙ্গ ও সান্ত্বনাহীন রাতে আমার বাঁ হাতের দুটো আঙুল কেটে নিয়েছিল, তার কাছ থেকেই আমি টাকা নিয়েছি ট্যাটু শপটা খোলার জন্য।’ ফোনের শেষে সে আমাকে তার এই অদ্ভুত নতুন গলায় আরও বলেছিল, ‘ডু ইউ নো সামথিং? ইউ আর এ খানকি (এই বাংলা গালি তাকে আমিই শিখিয়েছিলাম)। নেভারদিলেস, আই স্টিল লাভ ইউ। মিট মি ইফ ইউ এভার কাম টু আমস্টারডাম। দেয়ার ইন দ্য অ্যানা ফ্রাংক নেইবরহুড সার্চ ফর অ্যান ইন্ডিয়ান লেডি নেমড্ নূরজাহান খান্না, দ্যাটস্ মাই নিউ নেইম মাই ক্যাপটরস্ হ্যাভ গিভেন মি।… অ্যান্ড ডোন্ট ফরগেট টু লিসেন টু দি সং “Amsterdam “ বাই “Gregory Alan Isakov”। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর আর কোনো গান হয় না।’ 

আমি ফোন রেখে ইউটিউবে শুনেছি গানটা এবং দীর্ঘ বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ বছরে প্রথমবারের মতো আমার অনেক কান্না পেয়েছে আর শেষে আমি নিজেকে অবিমিশ্র ও নিপাট অবাক করে দিয়ে কেঁদেছি। সুরভি আমাকে আরও বলেছে, কাঠমান্ডুতে তাদের বাসা তছনছ হওয়ার সময় নানা এজেন্সির নানা লোকেরা তার ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টেবিলের কাগজপত্র সব চিরদিনের জন্য নিয়ে চলে গেছে, অতএব ‘আমার কালভিনো পাণ্ডুলিপি চিরকালের মতো হাওয়া। তবে ট্যাটু শপটা গুছিয়ে নিয়ে, এদের হালকা পলকা সারভেইল্যানস্ এড়িয়ে আমি মার্গারেট ইউরসেনারের “মেমোয়ারস্ অব হাদ্রিয়ান”-এর নেপালি অনুবাদে হাত দিতে যাচ্ছি, যেটা হবে আমার ইচ্ছাখুশির এক অনুবাদ, কারণ ৭৬ সালে জন্ম হয়ে ১৩৮ সালে মারা যাওয়া সম্রাট হাদ্রিয়ান কী বলেছেন আর কী বলেননি তা আসলে মূল লেখকও জানেন না, কোনো ইতিহাসবিদও জানেন না। অতএব আমি হাদ্রিয়ানকে দিয়ে যা বলাব তা-ই হাদ্রিয়ান, আমি হাদ্রিয়ানকে দিয়ে যা ভাবাব তা-ই হাদ্রিয়ান।’ 

নূর হোসেন : এখনো একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে, এখনো সে আমার ভালো বন্ধু। আজ পাঁচ মাসের মতো হয় তার একই স্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিয়ে হলো। লুনা প্রতিজ্ঞা করেছে—আমার সামনে—যে সে আর কোনো দিন স্বামীর সঙ্গে অবিশ্বস্ততা করবে না, এবং নূর প্রতিজ্ঞা করেছে—একই দিনে, একই জায়গায়, একই সময়ে—যে সে লুনাকে অবজ্ঞা করে তার ইচ্ছেখুশির ও পড়াশোনার বিরক্তিকর, সেমি-বোহিমিয়ান জীবন কাটানো বন্ধ করবে। তারা দুজনেই আবার বারবার—আমাকে ও উপস্থিত অন্য বন্ধুদের বলেছে, পুরো কাজটা তারা করছে তাদের মেয়েটার স্বার্থে, অন্য কোনো কারণে নয়। সবাই তাদের কথা শুনে হেসেছে। আমি জানি যখন আমি এ লেখা লিখছি, ঠিক এখন নূর তার বাসায় বিছানায় শুয়ে, সুন্দরী স্ত্রীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে দ্বিতীয়বার পড়ছে ইভান তুর্গেনেভের স্কেচেস ফ্রম আ হান্টারস অ্যালবাম-এর গল্পগুলো। এ বই আমি তাকে তার পুনর্বিবাহে গিফট করেছি—এভরিম্যানস লাইব্রেরি থেকে বেরোনো দুর্দান্ত এডিশন সেটা, তবে আমি তাকে দিয়েছি অন্য ইংরেজি অনুবাদ, একই বই স্রেফ অন্য নামে : আ স্পোর্টসম্যান নোটবুক, অনুবাদক চার্লস ও নাতাশা হেপবার্ন। 

উইলিস বার্নস্টেইন : পেন্টাগনের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে উইলিস আজ বছরখানেক হয়। সে এখন ব্যস্ত আমেরিকান কবি এলিজাবেথ বিশপের ওপর এক কবিতা পর্যালোচনা ধরনের বই লেখা নিয়ে। আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় প্রতি দু-তিন দিনে একবার করে, ই-মেইলে, আবার জরুরি কোনো প্রয়োজনে ফোনে। যেমন গত রাতে উইলিস ফোন করেছিল আমাকে এটা জানাতে যে আমি যেন মনে রাখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটে যাওয়া ইহুদি গণহত্যা বা হলোকাস্টের গা-ছমছমে কাহিনিগুলো পৃথিবীর অসংখ্য তরুণ লেখককে প্রথমবারের মতো সুযোগ করে দিয়েছিল সহজে ইতিহাসের ভেতরে ঢোকার। ঠিক তেমন আমি যেন ভুলে না যাই ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের বসুন্ধরা শব্দকাণ্ডকে, আমি যেন প্রথমে ওটায় ভর করে ইতিহাসের ভেতরে ঢুকি এবং পরে যেন ওই বিকট শব্দের ওপরে দাঁড়িয়েই আমার দেশের ইতিহাসটা লিখি। উইলিস আমাকে আরও জানিয়েছে, মার্সেল প্রস্ত তার কাছে কঠিন লাগছে, কিন্তু আবার অনেক ভালোও লাগছে। তবে তার একটাই ভয় যে এই চার হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাস পড়তে গিয়ে তার আবার জীবনটাই না শেষ হয়ে যায়। উইলিস আমাকে আরও বলেছে, আমি কখনো আমেরিকা আসতে চাইলে যেন ভিসা পাওয়া ও প্লেন টিকিটের খরচ, এসব নিয়ে চিন্তা না করি। সে বর্তমানে থাকে ফিলাডেলফিয়ায়, কিন্তু সে বলেছে আমি যদি কখনো আমেরিকা আসি তো সে লস অ্যাঞ্জেলেসে বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর রাশেদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। রাতে ফোনে কথা হওয়ার পরে আজ ঘুম থেকে উঠে দেখি উইলিস আমাকে এলিজাবেথ বিশপের ছোট একটা দশ লাইনের কবিতা পাঠিয়েছে, নাম ‘A Short, Slow Life’। কবিতাটা এই : 

We lived in a pocket of Time. 
It was close, it was warm. 
Along the dark seam of the river 
the houses, the barns, the two churches, 
hid like white crumbs 
in a fluff of gray willows & elms, 
till Time made one of his gestures; 
his nails scratched the shingled roof.
Roughly his hand reached in, 
and tumbled us out. 

কবিতাটা পড়ে ভালো লাগা থেকে আমি দ্রুত এর বাংলা অনুবাদ করে ফেলেছি, তৎক্ষণাৎ। ইচ্ছা যে অনুবাদটা আমার কবিবন্ধু ব্রাত্য রাইসুকে পাঠাব, ওর কাছ থেকে এটা শুনতে যে কেমন হয়েছে আমার এই একবারও রিভিশন না করা চটজলদির অনুবাদ, যা এই : 

আমরা বাস করি সময়ের এক পকেটের মাঝে
বন্ধ পকেট, তবে উষ্ণও বটে। 
নদীর অন্ধকার কাটা দাগ ঘিরে
বাড়িগুলো, গোলাঘর, গির্জা দুখানা
লুকিয়ে আছে সাদারং খাদ্যদানার মতো
ধূসর উইলো ও এলমদের নরম ছায়াতে,
তদ্দিন—যদ্দিন না সময় তার শরীর ঝাঁকাল;
তার নখগুলো আঁচড়ে দিল ঘরের টালি ছাদ।
মোটামুটি তার হাত ঢুকে গেল গৃহ অভ্যন্তরে,
এবং আমাদের উপড়ে ফেলে দিল। 

দুই ঘণ্টা পর ই-মেইলে রাইসু জানাল, আমি আবার যা জানালাম উইলিসকে লিখে যে ‘কবিতাটা ভয়ংকর।’ 

ইবরাহিম : মৃত। কেরানীগঞ্জে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে ইবরাহিম নিহত হয়েছে ১১ নভেম্বর ২০১৭-তে। তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৮ বছর। আমি প্যারিসপ্রবাসী আমাদের অতীত দিনের বন্ধু ইকবালের (যার নাম রুডলফ আলেকজান্ডার) কাছ থেকে শুনেছি ইবরাহিমকে র‍্যাব হাত-পা বেঁধে মেরে তারপর তার পেট ফেঁড়ে, পেটের মধ্যে বড় বড় পাথর ঢুকিয়ে কেরানীগঞ্জের ‘সামাদের বিলে ফেলে দেয়। ইবরাহিমের পিস্তলটা আজও আমার কাছে আছে। সেটার রং সময়ের সাথে সাথে একদম সাপের গায়ের রং হয়ে যাচ্ছে। 

আইয়ার : ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে, আজ থেকে মাস তিনেক আগে, আমি আবার মুম্বাই গিয়েছিলাম আমার কাফকা ও হোমারের প্রকাশককে নিয়ে, তার খরচে আমাজন ইন্ডিয়ার সঙ্গে অর্থহীন এক আলোচনার জন্য। তখন আমি মুম্বাইয়ের ঘাটপোকারে সিমরান ট্রাভেলসের অফিসে আইয়ারকে খুঁজেছি। তবে সে অফিসে একটা মানুষও পাইনি যে ২০১৫-র ড্রাইভারদের চেনে, কারণ সিমরান ট্রাভেলস তার নাম বদলায়নি ঠিকই, কিন্তু কোম্পানির মালিকানা বদল হয়েছে। তারা এই অফিসের সবাই এখন নতুন। আইয়ারের নাম্বারে যতবার ফোন করেছি, ততবারই ফোন ধরেছে এক অসভ্য ভদ্রলোক। চারবারের মাথায় সে আমাকে বলেছে, ‘আরে ইয়ার, তুম তো বহুত চুতিয়া হো।’ আইয়ারকে কোনো দিনও কোনো বকশিশ বা অর্থসাহায্য দেওয়া হয়ে ওঠেনি আমার। 

ফারজানা হায়াত : মাসুমের বিধবা স্ত্রী। সে এখন ঢাকায় থাকে, গাবতলীর কাছে। তার দুই ছেলে শাহনামা ও শাহরিয়ার কাছাকাছি একটা সস্তা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ফারজানা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা নেয়নি। সে কিছুই করে না, হিজাবও ছেড়েছে। শেষবার আমি ও নূর তাদের বাসায় যাই তার হাতে ২০ হাজার টাকা দিয়ে আসতে। সে আমাদের বলে, ‘দিন চলে যাচ্ছে।’ সেদিনই আমরা প্রথম জানি যে সে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের শ্রমিকদের জন্য দুপুরের খাবারের ‘টিফিন ক্যারিয়ার’ বিজনেস করে। সে আমাদের আরও জানায়, তার ব্যবসা ভালো হচ্ছে, ব্যবসা বাড়ছে, কিন্তু তারপরও ভীষণ অভাব। সে আরও জানিয়েছিল (সেটা অনেক আগে, দুই বছর আগে) যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ২০ লাখ টাকার প্রায় সবটা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে মাসুমের মা ও বোনেরা, নানা ফন্দিফিকির করে, নানাভাবে। ফারজানা এই সেদিন আমাকে ও নূরকে বলেছিল, ভয়ংকর সব পরিবহনশ্রমিকের সঙ্গে তার পরিচয় হচ্ছে। তার ইচ্ছা আছে যে তার এই নতুন লড়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে মাসুম হায়াতের বড় বোনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে এবং তার ও তার দুই বাচ্চার প্রতি করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবে। 

সরফরাজ নওয়াজ : হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে কীভাবে কীভাবে জড়িয়ে আমার বন্ধ পুলিশের মনিরুল ইসলামের জঙ্গি দমন ও উৎপাটন অভিযানগুলোর একটাতে বন্দী হয়ে তিনি এখন জেলে। হোলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডে তার ছেলে নিবরাস ইসলামের দেশকাঁপানো সম্পৃক্ততা তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়েছিল। বসুন্ধরা সোসাইটির নতুন চেয়ারম্যান এখন বকুল শাহনেওয়াজ, পেশায় আর্মির কন্ট্রাক্টর, রাজনৈতিক বিশ্বাসে চরম বাম, জাসদের সাবেক নেতা আ স ম আবদুর রবের বিশ্ববিদ্যালয়-দিনের বন্ধু ও রুমমেট। ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। 

মেজর এসএইচএমবি (হি শট মিস্টার বঙ্গবন্ধু!) নূর : বঙ্গবন্ধুর বুকে ব্রাশফায়ার করা এই খুনি ভদ্রলোক এখন কানাডায়। আওয়ামী লীগ সরকার অনেক চেষ্টা করছে তাকে বাংলাদেশে এনে ফাঁসিতে ঝোলানোর। কানাডা বলছে যে, তারা তাকে বাংলাদেশে পাঠাতে রাজি যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অঙ্গীকার করে যে তারা নূরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে না। কানাডার হিউম্যান রাইটসের এই উত্তুঙ্গ জয়জয়কার অবস্থান দেখে পৃথিবীর অনেকেই প্রীত হচ্ছে, তারা বলছে, ‘কল অব কনশানস্ (অর্থাৎ বিবেকের ডাক) কাকে বলে দ্যাখো।’ আমি বিভিন্নভাবে নূরের ব্যাপারে কিছু খবর জোগাড় করেছি। তার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিংটা এই যে নূর প্রতি সকালে টরন্টো থেকে কিছু দূরের লন্ডন, ওন্টারিও নামের এক শহরের উপকণ্ঠে তার দুই রুমের গোপন বাসায় ঘুম থেকে ওঠে, বাইরে এক নিঃসঙ্গ লেক ও জঙ্গলের দিকে তাকায় (সেখানে মাঝেমধ্যে কুঁজওয়ালা কাঁধের, লম্বা লম্বা চার পায়ের, মাথায় ভিক্ষাপাত্রের মতো ছড়ানো মেলে ধরা শিঙের মুস নামের হরিণ গোত্রের প্রাণী দেখা যায়), এবং প্রতিদিনই আক্ষেপ ও আফসোস করে তার বন্ধু কামালের বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের বুকে নিজ হাতে স্টেনগানের ব্রাশফায়ার চালানোর জন্য। তারপর সারাটা দিন যায় তার থমথমে, ভীরু এক হতাশা ও বৃথারাগে, কিন্তু আবার যেই না সন্ধ্যা হয়, সে গ্লাসের পরে গ্লাস অ্যালকোহল (সস্তা হুইস্কি) পেটে ঢেলে ফের জীবন ফিরে পায়, ফের ভাবে সে এবং তারা মিলে যা করেছিল, তা দেশের ভালোর জন্যই করেছিল, যেহেতু দেশ বলে কথা, তাই ওখানে আবেগের কোনো জায়গা ছিল না। আমি উইলিসকে সম্প্রতি জানিয়েছি মেজর রাশেদ চৌধুরীর ব্যাপারে আমার আগ্রহ অনেক, তবে নূরের তুলনায় কম তো বটেই, জিজ্ঞাসা করেছি সে আমাকে কানাডায় নূরের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে কি না। সেদিনই আমাকে উইলিস বলেছে যে নিৎশে বলেছেন ‘If you have a why to live, you can bear almost any how’—অর্থাৎ আপনি যদি জানেন যে ‘কেন’ আপনাকে বাঁচতে হবে, তাহলে বেঁচে থাকার ‘কীভাবে’ প্রশ্নটা কোনো ব্যাপারই না। আমি উইলিসকে বলেছি, আমার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একটু অন্য রকম। আমি আমার ‘কেন’ প্রশ্নটার উত্তর জানি, আমার সমস্যা ‘কীভাবে’টা নিয়ে। কীভাবে আমি একটামাত্র লোক, পেশায় আবার লেখক-অধ্যাপক এবং আর্থিক অবস্থার বিচারে যেনতেন, সেই আমি কীভাবে ঢাকা, কানাডার লন্ডন অন্টারিও, লস অ্যাঞ্জেলেস, করাচি, ত্রিপোলি, সেনেগালের ডাকার—এসব একা সামলাব? 

আমি : গত ছয় মাস যাবৎ মার্সেল প্রস্তের প্রতি অপার ভালোবাসা থেকে আমি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অনেক খোলা জায়গায়, অনেক গলিতে, অনেক বাগানে এ এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি আজমত সাহেবের ছেলের বিশেষ অনুমতি নিয়ে অসংখ্য হোর্থনগাছের চারা লাগিয়েছি। আমাকে ফ্রান্স থেকে হোর্থন চারা আনবার ব্যাপারে সাহায্য করেছে লুনা, নূরের স্ত্রী। লুনাদের বারিধারার বাড়িটা উঁচু দামে বিক্রি হয়েছে এবং সে চলে গেছে নূরের সঙ্গে তাদের সেই বিখ্যাত মগবাজারের ফ্ল্যাটে। নূরকে না জানিয়েই সে আমাকে ধাপে ধাপে কিছু টাকা দিয়েছে, যা দিয়ে আমি প্যারিস থেকে, প্যারিসপ্রবাসী বন্ধু ইকবালের (অর্থাৎ রুডলফ আলেকজান্ডারের) সহায়তায় প্লেনে করে এনেছি এই হোর্থনের চারাগুলো। গাছগুলো বড় হচ্ছে ধীরে। আমি দেখছি। 

জীবিকার ব্যাপারে বলব যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আমি ছেড়ে দিয়েছি। তারপরে কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা ঢাকার বনানীতে একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছিলাম ২০১৬ সালের মে মাসে। তেমন চলেনি। এ রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের মাত্র দুই মাসের মাথায় হোলি আর্টিজান বেকারির হত্যাকাণ্ড ঢাকার গুলশান-বনানী এলাকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ের মূল দরজা দিয়ে স্ক্রু-ড্রাইভারের মতো ঢুকে পেছন দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছে এ ব্যবসাকে চাকা চাকা পাউডার বানিয়ে ছেড়ে। 

এভাবেই যাচ্ছে আমার প্রতিদিন। একবার মার্সেল প্রস্তে হাত দেওয়া, পড়া জিনিস আবার আবার পড়া, আরেকবার লেখার টেবিলে বসা আর অপেক্ষা করা যে কবে আমি নর্থ কোরিয়াতে সামরিক অভ্যুত্থানে সরকার পতনের কথা শুনব, এবং কবে আমি আমার নেপালি বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে জানব যে নূরজাহান খান্না নামের এক সম্পূর্ণ অচেনা লেখিকার বই বেরিয়েছে নেপালি ভাষায়, নাম ‘মেমোয়ারস্ অব হাদ্রিয়ান’। যা-ই হোক, কাল রাত তিনটার অন্ধকার আকাশে ওরিয়ন, ক্যানিস মাইনর ও পোলাক্স নামের তিন উজ্জ্বল কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে এই সংকল্প করেছি যে আমার এ উপন্যাস লেখা শেষ হলে আমি—যেমনটা আমার বন্ধুরা বিশ্বাস করে, তা খারিজ করে দিয়ে-ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্রর দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ নিয়ে বসব না, বরং ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ দাফনের দিনে তাঁর গ্রামের বাড়ির দীর্ঘদিনের কাজের লোক বৈকুণ্ঠের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে লোমহর্ষক ও অসংখ্য কূটপ্রশ্নে ভরা সাধারণ জনতার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল—মানুষের মনের ইতিহাসে যার নাম ‘টুঙ্গিপাড়া বিদ্রোহ’সেই বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস লেখা শুরু করব, আর স্বভাবতই, বিষয়বস্তুর কারণে, সেটা আমার সেলো পয়েন্টেক 0.5 জেলপেনের কালিতে লেখা যাবে না—আমাকে তা লিখতে হবে অকটেন বা হাইড্রোজেন ফুয়েল দিয়ে। 

.

কৃতজ্ঞতা স্বীকার 

চার বছর দীর্ঘ এই উদযোগে কমবেশি সব সময় আমার পাশে ছিলেন ঢাকার সাহিত্যজগতে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু কবি ব্রাত্য রাইসু। এ বইয়ের পাণ্ডুলিপির ওপর এই প্রবল মেধাবী মানুষটির নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ আমাকে এমনকি গত এক সপ্তাহ আগেও (জানুয়ারির শেষ ভাগ, ২০১৯) বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে একদম নতুন ৬-৭টি পৃষ্ঠা লিখিয়ে ছেড়েছে। আরও বলতে হয় কবি মারুফ রায়হানের কথা, যিনি আমার পরিবারের সদস্যতুল্য একজন। তাঁর হাত ধরেই ১৯৯২-৯৩ সালে আমার ঢাকার সাহিত্যজগতে প্রবেশ। তাঁর বেশ কিছু পরামর্শ উপন্যাসটি এখন যা, এটাকে তা হয়ে উঠতে বিরাট সহায়তা করেছে। প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি বিষয়ে গুণীজনদের মতামত নিতে পারলে যে ভালো হয়, এ রকম স্পর্শকাতর একটি ঘটনা নিয়ে লেখার বেলায় তৃতীয় চোখ দিয়ে দেখে নেওয়া যে ভালো, সেই সৎ পরামর্শও মারুফ রায়হানের। লেখাটির এ প্রথম দুই পাঠকের কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী 

ধন্যবাদ দিতে হয় প্রকাশক ও বন্ধু মাজহারুল ইসলামকে, যার অন্যদিন পত্রিকার ২০১৫ সালের ঈদসংখ্যায় এ উপন্যাসের শেষটুকু বেরিয়েছিল ‘বিকট’ নামের এক বড় গল্প হিসেবে। 

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যিনি আমার অনেক কাছের একজন, খুব দামি কিছু মন্ত্রণা দিয়েছিলেন এ উপন্যাসের সেনসিটিভ কিছু বিষয় নিয়ে। তাঁর কাছে যথেষ্ট ঋণী আমি। ঋণী প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক অরুণ বসুর প্রতিও, যিনি আমার এই উপন্যাসের তৃতীয় পাঠক। অরুণ বসুর পরামর্শে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে উপন্যাসের বেশ কিছু জায়গায়। তিনি যা বলেন, সাফ সাফ বলেন; এবং সেটাই ভালো। 

আমার প্রচণ্ড ঋণ শিল্পী সেলিম আহমেদের প্রতিও। তিনি আমার আগের বইগুলোর প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন এবং আমি একবার অনুরোধ করতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন এ বইয়ের প্রচ্ছদের কাজটা করতে। কী বিশাল পরিমাণেই না তাঁকে জ্বালিয়েছি আমি, কিন্তু বিরাট এই ভালো মানুষটি একবারও বিরক্ত হননি। 

এখন বলব প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক লেখক-কবি জাফর আহমদ রাশেদের কথা। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া আমার এবারই প্রথম। বন্ধু রাশেদ নিশ্চিত করেছেন আমাদের সম্পর্কের এই সূচনাকে। ডিসেম্বর ২০১৮-এর শেষে, একদিন ফোনে, আমাকে প্রচণ্ড ঝাঁকিটা যদি রাশেদ না দিতেন তো নিশ্চিত এ বই বের হতে আরও এক-দুই বছর লেগে যেত। রাশেদই (এবং সেই সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান) আগস্ট আবছায়ার আলোতে আসার পেছনে মূল শক্তি। প্রিয় মতিউর রহমানকে আমি এবার চিনলাম নতুন করে। তিনি আমাকে ২০১৭ থেকে এ বই নিয়ে তাড়ার মধ্যে রেখেছেন। সেই তাড়ার শেষে এসে দেখলাম কী অদম্য এনার্জি তাঁর. কী তাঁর প্রজ্ঞা এবং চিন্তার ম্যাচুরিটি। 

অপার কৃতজ্ঞতা আমার স্ত্রী ফারহানা মাসরুরের প্রতি। বেডরুম থেকে আমার লেখাপড়ার রুমের দূরত্ব সামান্য, কিন্তু সেই দূরত্বকে কত বিশাল করে তুলেছে আমার দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। কতবার দেখেছি এ-মানুষটি কীভাবে পুরো এক বেলা, পুরো একটা দিন নিঃসঙ্গ বসে আছে বাড়ির কোথাও। এই ত্যাগ অবর্ণনীয়। 

অবশেষে ধন্যবাদ তিন গুণীজনকে —আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক ও (প্রচণ্ড অসুস্থ) শেখ আবদুল হাকিম। তাঁরা তিনজন এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। তাঁদের প্রশংসা আমার শক্তি। তাঁদের কথা থেকেই বুঝলাম আমার জন্ম হয়েছে আসলে লেখার জন্যই। এ তিনজনের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *