আগস্ট আবছায়া – ৪.৫

৪.৫

২৬ আগস্ট। আজ বেলা এগারোটার ফ্লাইটে কাঠমান্ডু থেকে অরুনিমা গুরুং নামের এক মেয়ে ঢাকায় নামবে তার ব্যবসায়ের কাজে। আমি কল্পনা করতে পারলাম এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের লোকেরা কীভাবে তাকিয়ে থাকবে মেয়েটার ঘাড়, গলা ও বুকের দিকে, কীভাবে তাদের মন উচাটন হবে মেয়েটার বিদ্যুল্লতার মতো রূপ এয়ারপোর্টের বিশাল হলরুমের ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়তে দেখে। এমন সময় কলবেল বাজল। আমার পরনে হাফপ্যান্ট, খালি গা, দাঁত ব্রাশও করা হয়নি। আমি একটা জামা গায়ে চাপাতে চাপাতে দরজা খুললাম। পিংকি। পিংকি হিজড়া। সে কাঁদছে। ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা করলাম। সে ভেতরে ঢুকল, আমার হাতে তুলে দিল একটা কাগজ, পোস্টার সাইজের, তার পেছন দিকটায় তখনো লেগে আছে আঠা এবং দেয়ালের চুনকামের সাদা সাদা শক্ত টুকরোটাকরা। আমি পোস্টারটা পড়লাম আদ্যোপান্ত : 

বসুন্ধরায় বন্ধ হোক যাবতীয় অসামাজিক কার্যকলাপ 

বসুন্ধরা বি ব্লক নিবাসী, রোড ৬-এর ১২২/গ নং বাসার নয়তলায় প্রতিদিন প্রতি রাতে চলছে অসামাজিক কার্যকলাপ। এই ফ্ল্যাটে থাকেন নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক [আমার নাম]। এখানে তাঁর সঙ্গে থাকেন বসুন্ধরার কে ব্লকের রোড নং ১৩, বাড়ি নং ১৭/ক-এর মেহেরনাজ হায়দার, যিনি সম্পূর্ণ চরিত্রহীনা এক নারী এবং নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপকের ছাত্রী। শিক্ষক ও ছাত্রীর মধ্যে কী চলছে এসব সবার চোখের সামনে? মাঝে মাঝে হিজড়াদের দলও কেন যোগ দিচ্ছে সেই রঙ্গলীলায়? আমরা কি মা-ভাই-বোন নিয়ে এই এলাকায় থাকতে পারব না? বসুন্ধরা সোসাইটি কি কিছুই দ্যাখে না? এদের পাপের শাস্তি কি আমরা এভাবেই পেতে থাকব যেভাবে পেয়েছি গত ১৫ আগস্ট রাতে? 

বসুন্ধরার শ্লীলতা ও সভ্যতা বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হোন 
আমরা বসুন্ধরার ‘নৈতিক পুলিশ”। আমাদের সমর্থন করুন। 

আমি আমার বেডরুমের ড্রয়ার থেকে নিয়ে পিস্তল কোমরে গুঁজলাম। আজ বিকেলে এটা এমনিতেও আমার সঙ্গে নেওয়া লাগত। পিংকি তা দেখল। সে বলল, ‘সরফরাজ নওয়াজরা এই কাজ করে নাই। আমরা জানি।’ ‘মানে?’ চিৎকার করে বললাম আমি। ‘কারা করেছে তাহলে?’ 

পিংকি বলল, তার হিজড়ার ভঙ্গিতে দুলে দুলে বলল, ‘কোরিয়ানরা। এ-ব্লকে থাকে যে উন উন ফ্যামিলি, কোয়োংজু উন ফ্যামিলি, তাদের বড় ছেলে এইটা করছে। লি কোয়াংজু উন। সে কাজটা করছে আমাদের জসিমরে নিয়া। হিজড়া জসিম। জসিমরে আমরা বাইন্ধা ফেলছি। হ্যায় সব স্বীকার গেছে।’ 

আমি বললাম, ‘ভালো।’ বললাম, ‘পোস্টার কত লাগানো হয়েছে?’ 

.

পিংকি বলল, ‘এক শর মতো লাগাইতে পারছে। তখনই আমরা দেইখ্যা ফেলি। বাকিটা লইয়া পলাইছে। আমরা লড়ানি দিছি। আমরার হিজড়ারা এখন এ-ব্লকে কোয়াংজু উন উনদের বাড়ির সামনে কাপড় খুইল্যা নাচতেছে, পাছা দেখাইতেছে।’ 

আমি বললাম, ‘জলদি যাও। নাচানাচি বন্ধ করতে বলো, ওতে আমারই বদনাম হবে। যারা জানত না তারাও জেনে যাবে। আর ওই এক শ পোস্টার তুলে ফেলার কাজ শুরু করো। জলদি।’ 

পিংকি বলল, ‘যাইতাছি। পোস্টার তোলার কাজ প্রায় শেষ। আমার চাইতে বুদ্ধি আপনার বেশি না, স্যার। কিন্তুক মেহেরনাজ আপায় কই?’ 

‘জানি না।’ বললাম আমি। 

‘আপনি কি তারে মাইরা ফালাইছেন?’ 

‘কী বলছ এসব পিংকি?’ আমি বকা দিলাম তাকে। ‘মেহেরনাজ বিপদে আছে। আমেরিকানরা পেছনে লাগছে ওর। আমি কেন মেহেরনাজকে মেরে ফেলব? তুমি পাগল নাকি?’ 

পিংকি যেতে যেতে বলল, সে মেহেরনাজের বড় বোন তাসনিমকে বলতে শুনেছে আমারই এই ঘরে যে আমি মেহেরনাজকে শেষ করে দিয়েছি। 

‘আমার কী দোষ?’ বলে পিংকি নাচতে নাচতে নেমে যাচ্ছে নয়তলা সিঁড়ি বেয়ে। সে কখনো লিফট ব্যবহার করে না, তার জীবনে কোনো দিন করেনি। আমি শুনছি সে ঝিড়িং ঝিড়িং শব্দ করে নামছে আর বলছে, ‘আমার কী দোষ? আমার কী দোষ?” 

ষড়যন্ত্রকারী তাহলে রয়েছে ঘরের ভেতরেই। ভাবলাম আমি। এই জসিম হিজড়া, পুরুষ হিজড়া সে, আমার অনেক কাছের এক মানুষ। দুই বছর আগে সে পিংকির বয়ফ্রেন্ডও ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে পিংকি ও জসিমের পাশাপাশি দাঁড়ানো একটা ছবি, তারা দুজনে সম্ভবত ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠার ভয়ে সন্ত্রস্ত, ছবিটার পেছন দেয়ালে মাঝখানে লেখা ‘ঝরনা স্টুডিও’, এবং ওই লেখার নিচে মোটা দাগে আঁকা একটা বড় তালগাছ, সাদা সাদা বড় পাখি, এবং তালগাছটার পাশে কাঞ্চনবরন ধানের খেতে খেতে মিশিয়ে দেওয়া এক কচি কলাপাতা রং, আর লাল তুলিতে জসিমের পায়ের পাশে ছোট করে লেখা ‘আর্টিস্ট ইলিয়াছ’, তার পাশে ব্র্যাকেটের ভেতরে ‘এইট পাস’। সেই সঙ্গে ছবির কাগজের ওপরে, ছবির নিচ দিকটায় পিংকি হিজড়ার হাতে লেখা ‘জসিম, ভুলো না আমায়। ইতি, জসিম। 

আমার মনে আছে, আমি ওই দুই দুষ্টু, দুরন্ত ও ছটফটে তরুণ-তরুণীকে সেদিন সামনে বসিয়ে বলেছিলাম, ‘এর আবার মানে কী পিংকি? ইতি জসিম লেখা কেন?’ তারা দুজনে তখন খিলখিল করে হাসছিল তাদের নিষ্পাপ হেমন্ত-ভোরের হাসি, আর জসিম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলছিল, ‘স্যার, এইটা আপনে বুঝবেন না, পিংকি নিজের নাম জসিম লিইখ্যা, ইতি জসিম লিইখ্যা বুঝাইতে চাইছে যে, যে জসিম সে-ই পিংকি, যে পিংকি সে-ই জসিম, মানে আমরা এক, পুরাপুরি।’ আবার হাসি। অনেক অনাবিল হাসি। 

আর আজ সেই জসিম কিনা হাত মেলাল কোরিয়ানদের সঙ্গে? পয়সার লোভে? যৌনবিকৃতি থেকে? আমি সারা দিনের পরিকল্পনাগুলো সাজিয়ে নিলাম মনের মধ্যে, সাদা একটা কাগজে আঁকাআঁকি করলাম কিছুটা যুদ্ধের সময়ের আর্মি কমান্ডের মতো করে, তারপর মনে হলো ব্রেকফাস্ট করিনি, ব্রেকফাস্ট করতে হবে, শেভ করতে হবে, কাপড়-জামা ইস্তিরি করতে হবে, লুনার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হবে, লুনা আমাকে বলেছে সে আমার এই কাজে দুই লাখ টাকা কন্ট্রিবিউট করবে, টাকাটা কোথায় বসে নেব, সেটা ঠিক করতে হবে, হিজড়ার দলকে পেমেন্ট করতে হবে, অরুনিমা গুরুংয়ের সঙ্গে উত্তরার পিৎজা হাটের দোকানে দেখা করতে হবে, তারপর দুপুর যখন দুপুরের ঘুমে কাতর হবে, তখন শুরু করতে হবে যাত্রা। এতগুলো কাজ! মেহেরনাজ কোথায়? বিদেশ থেকে, তানজানিয়ার নাম্বার থেকে, কে ফোন করছে আমাকে? এখন পর্যন্ত কটা মানুষ পড়েছে ওই পোস্টার? বসুন্ধরার এফ ব্লকের সেই জমিদার বাড়িটাতে হোর্থন ফুলের ঝাড়গুলোর কী অবস্থা? 

হোর্থন ফুলের ঝাড়ের কথা মনে হতে আমি সব কাজ ফেলে রেখে, মনকে কিছুটা শান্ত করতেই, হাতে তুলে নিলাম গ্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম, খুঁজলাম সে বইয়ের অবিনাশী অংশগুলো, যেখানে যেখানে প্রুস্ত হোর্থন ঝাড়ের কথা লিখেছেন অসম্ভব মায়া দিয়ে। আমার হাতে এখন উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড-স্কট মনক্রিয়েফের অনুবাদে উয়িদিন আ বাডিং গ্রোভ, পৃষ্ঠা ৬৮৪; এবং পেঙ্গুইন থেকে বের হওয়া নতুন জেমস গ্রিভের অনুবাদে ইন দ্য শ্যাডো অব ইয়াং গার্লস ইন ফ্লাওয়ার, পৃষ্ঠা ৪৯৮। 

মার্সেলের এর আগে মাত্র প্রথম দেখা হয়েছে আলবারতিনের সঙ্গে, শিল্পী এলস্টিরের স্টুডিওতে, ফ্রান্সের নরমান্ডি উপকূলের বালবেক শহরে। মার্সেল দেখেছে আলবারতিনের গালে একটা ‘বিউটি স্পট’ আছে; মার্সেলের সাক্ষাৎ হয়েছে তরুণী আলবারতিনের বন্ধু অঁদ্রির সঙ্গেও; আলবারতিন মার্সেলের উদ্দেশে একটা চিরকুট পাঠিয়েছে, তাতে লেখা ‘আই লাইক ইউ’; মার্সেলের মনে হয়েছে সে আলবারতিনদের সি বিচে সাইকেল চালানো দলের সব কটা মেয়েরই প্রেমে পড়ে গেছে; মার্সেলের মনে হচ্ছে চোখ যা দেখে, মন যা ভাবে, সব গিয়ে জমা হয় স্মৃতির ঢালে-আমরা যাকে মনে করা বলি, তা অন্য অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়ারই এক অংশমাত্র। এরপরই একটা কাঁচামাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মার্সেল অঁদ্রিকে বলছে তার আলবারতিনকে ভালো লাগার কথা। অঁদ্রি উত্তরে জানাল, আলবারতিনকে তার নিজেরও পছন্দ। 

হঠাৎ, সরু ঢালু পথটার অর্ধেক অংশ যেতে আমি স্থির হয়ে দাঁড়ালাম, আমার শৈশবের এক স্মৃতি নাড়া দিল আমার মনকে। আমি এইমাত্র চিনতে পারলাম, পাতাগুলো অস্থির, চিকচিক চেহারা নিয়ে যেভাবে আমার দিকে নিজেদের মেলে ধরে আছে তাতে, যে এটা একটা হোর্থনের ঝাড়–পুষ্পহীন, হায়, যেহেতু বসন্ত এখন শেষ। আমার চারপাশে ভেসে ওঠা শুরু করল দূর অতীতের সেই দিনগুলো— মে মাসের প্রার্থনার দিন, সেই রোববারের বিকেলগুলো, বহু আগে ভুলে যাওয়া বিশ্বাস ও ভুলগুলো। আমি ওদের ধরতে চেষ্টা করলাম। একমুহূর্ত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আমি, অঁদ্রি কী সুন্দর বুঝে ফেলেছে আমার মনের মধ্যে কী চলছে, সে আমাকে সুযোগ করে দিল হোর্থনের পাতাগুলোর সঙ্গে কথা বলার। আমি পাতাগুলোকে জিজ্ঞাসা করলাম ফুলদের খবর কী, সেই যে আনন্দমুখর ছোট বাচ্চাদের মতো হোর্থন ফুলেরা, একরোখা, প্রেমবিলাসে ভরা, বিশ্বস্ত। ‘ওই কিশোরীদের দল বেশ অনেক দিন হয় চলে গেছে এখান থেকে’, হোর্থনের পাতাগুলো বলল আমাকে। 

থম মেরে আমি বাসায় বসে আছি। অপেক্ষা করছি অরুনিমা গুরুংয়ের ফোনের। দুপুর বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট পার হয়ে গেছে। আমি খোঁজ নিয়ে ফেলেছি কাঠমান্ডু ফ্লাইট আর্লি নেমেছে আজ, দশটা চল্লিশে নেমেছে। খোঁজ নিয়ে আরও জেনেছি, যাত্রীরা সবাই চলে গেছে যার যার বাক্স-পেটরা নিয়ে, আজ এয়ারপোর্টে ‘অ্যাবসলিউটলি ভিড় ছিল না কোনো’, সেখানে দাঁড়িয়ে নূর আমাকে ফোনে বলেছে। সে আরও বলেছে, ‘লাস্ট যাত্রী পর্যন্ত ওয়েট করলাম। অরুনিমা আসেনি।’ আমি পিৎজা হাটের সার্ভিস স্টাফ তাওসিফের নাম্বারে ফোন করলাম। সে ফোন ধরে বলল, ‘স্যার, টাকা ৫ হাজার তো পাইছি। কিন্তু আপনার অরুনিমা ম্যাডাম তো আসেন নাই।’ এই ফোন অর্থহীন। কারণ, সুরভিকে ওখানে নিয়ে যাবে নূরই, যে নূর এখন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে একা, চিন্তিত, হতাশ। 

হঠাৎ একটা ফোন। অচেনা নাম্বার। ভারী এক পুরুষকণ্ঠ আমাকে বলল, ‘নেন, কথা বলেন। সুরভির গলা শুনলাম, সে বলল, ‘শোনো। ফোনটা ঢাকা এয়ারপোর্টের এক পুলিশ কর্মকর্তার। আমাকে ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না। আর এক ঘণ্টা পরের ফ্লাইটে আমাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। তুমি চিন্তা কোরো না। আমার হাতে সময় নেই, মন দিয়ে শোনো। মেহেরনাজ ওখানে থাকবে, আর বেশি বললাম না। আর শোনো, আমি ঢাকা শহরের অনেক ছবি তুলেছি প্লেন নিচের দিকে নামবার সময়। এই পুলিশ ভাই আমার তোলা একটা ছবি দেখে বলেছে, “ওইটা বসুন্ধরা আবাসিক,” আমার মন তাতেই ভালো হয়ে গেছে। এখানে সবাই আমার সঙ্গে অতি ভালো ব্যবহার করছে। এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি চিফকে আমি এমনকি একটা গানের লিস্টও করে দিয়েছি।’ লাইন কেটে গেল। 

.

হায়! তাহলে সুরভির আর ঢোকা হলো না বাংলাদেশে, দেখা হলো না বসুন্ধরা, হাত বোলানো হলো না আমার পড়ার ঘরের আলস্যভরা তাকে রাখা বইগুলোর গায়ে। কী পাপ করেছি আমি? আজ সকালে এতখানি শ্রম দিয়ে যে আমি বাসা গোছালাম ঘেমে-নেয়ে, সব কি এই সংবাদটা পাওয়ার জন্যই? কী আমার পাপ? তুলনায় বয়সে বাচ্চা মেয়ে মেহেরনাজকে ঢাকা শহর থেকে বিতাড়িত করা? মুম্বাই-পুনে-মুম্বাই যাত্রাপথের ড্রাইভার আইয়ারকে তার প্রাপ্য বকশিশ থেকে বঞ্চিত করা? 

আইয়ারের কথা মনে পড়তেই আমি ফোন আবার হাতে নিলাম। কোনো কিছু না ভেবে কল করলাম +৯১ 86524 345×× নম্বরে। তিন চারটা রিং হতেই স্পষ্ট আইয়ারের গলা শুনলাম, সেই শুষ্ক কিন্তু সামান্য হিউমিড কণ্ঠস্বর। ‘হ্যালো। কোন্ বোল রাহে?’ 

আমি ইংরেজিতে তাকে বললাম, ‘আইয়ার, আমি।’ 

আইয়ার বললেন, ‘কৌন্? 

আমি এবার পিঠ সোজা করে একমুহূর্ত আত্মসচেতন হয়ে নিয়ে, অর্থাৎ পা দিয়ে মেঝেতে বাড়ি মেরে বললাম, ‘বাংলাদেশের প্রফেসর। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে উপন্যাস লিখছি। এই মাসের ৬-৭ তারিখে আমাকে পুনে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি। শাহরুখ খানের বাড়ির কাছের এক হোটেলে ছিলাম আমি। ফেরার পথে রাতে পাম বিচ ক্রিকের পাশে দেরাদুন-মসৌরির এক লোক … ‘ 

আমার কথা থামিয়ে দিলেন আইয়ার। বললেন, স্পষ্ট ইংরেজিতে বললেন, ‘আপনাকে চিনতে পারছি। ভালো আছেন? বই লেখার কাজ চলছে?’ 

আমি চুপ করে আছি। ফোনের অন্য প্রান্তে আইয়ারও চুপ। আমাদের দুজনের মাঝখানে নেপচুন কিংবা প্লুটো গ্রহ থেকে সঞ্চারিত হয়ে পৃথিবীর এদিকে আসা কোনো রুদ্ধবেগ হাওয়ার শোঁ-শোঁ। আমি বললাম, ‘আইয়ার, আমি সরি।’ আইয়ার তখনো চুপ। আমি আবার বললাম, ‘আইয়ার–আইয়ার, আমি সরি।’ কথাটা বলতে গিয়ে আমার গলা কেমন ডিসটেম্‌পার পেইন্ট করা সারফেসের মতো আঠা আঠা হয়ে এল। 

আইয়ার বললেন, “কুছ বাত নেহি,’ এ-কথাটা হিন্দিতে বললেন তিনি। তারপর, ‘ইটস্ ওকে। আমি আজও জানি না আপনি আমার সঙ্গে পুরো একটা সুন্দর দিনের শেষে ওরকম করেছিলেন কেন?’ 

আবার চুপ। আমি আইয়ারকে বললাম তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা আমাকে এসএমএস করে দিতে, যাবতীয় ব্যাংক ডিটেইলসহ। আইয়ার শুনলেন, কিছু বললেন না। আমি বললাম, ‘আইয়ার, টক টু মি।’ 

এবার আইয়ার বললেন যে তিনি এখন গাড়ি চালাচ্ছেন, গাড়িতে কোনো যাত্রী নেই, তবে যেহেতু এটা একটা হাইওয়ে তাই তার পক্ষে গাড়ি সাইডে পার্ক করাও সম্ভব না, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর পরে তিনি আমাকে এসএমএস করবেন, তবে তিনি জানতে চান টাকাটা আমি কার জন্য ও কেন পাঠাচ্ছি? 

আমি বললাম আমি কিছু টাকা, অল্প কিছু টাকা পাঠাতে চাই তার স্ত্রীর জন্য। 

আইয়ার বললেন, ‘আমার স্ত্রীর টাকার দরকার নেই। তিনি হাফ-প্যারালাইজড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। টাকা দিয়ে আমার স্ত্রী আর কী করবেন? যদি পারেন তো আপনি আমাকে সাহায্য করেন। আমি সিমরান ট্রাভেলস-এর ড্রাইভার হয়ে আর থাকতে চাই না। আমার দরকার নিজের একটা ট্যাক্সি নিজের।’ তিনি ‘নিজের’ কথাটা—অর্থাৎ ইংরেজিতে ‘মাই ওউন’—এমনভাবে বললেন যে আমি তার আমিত্বের এত স্পষ্ট প্রকাশে তছনছ হয়ে গেলাম। 

ট্যাক্সি কেনার টাকার কথা শুনে ঘাবড়ে গেলাম আমি। একঝলকের জন্য আমার আইয়ারকে মনে হলো লোভী, নিজেকে মনে হলো বোকা -তারপর আবার সব আগের মতোই। 

আমি সিমরান ট্রাভেলস্-এর হাতে তার দাসত্বকে মনে করলাম, তার দৈনিক দু-ঘণ্টা ঘুমের রুটিনকে মনে করলাম এবং সেভাবেই তার একটা নিজের ট্যাক্সি হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে মন থেকে সমর্থন দিলাম, যদিও পরিষ্কার জানি তাকে এত বড় টাকা দিয়ে সাহায্য করার আমার কোনো ক্ষমতা নেই, শব্দ-সংক্রান্ত আমাদের অনুসন্ধানের সামান্য কয়েক লাখ টাকার খরচও আমাকে কিনা চালাতে হচ্ছে লুনা ও মেহেরনাজ থেকে ধার নিয়ে নিয়ে। হায়! 

আমি আইয়ারকে বললাম, ‘দেখি। চেষ্টা করে দেখি কী করা যায়, কতটা করা যায়, আইয়ার।’ 

আইয়ার বললেন, ‘থ্যাংক ইউ। সিরিয়াসলি দেখেন। আপনার নিজের টাকা না থাকলে ঢাকার অন্য বড়লোকদের কাছে আমার কথা বলে দেখেন। মুম্বাইতে কারও কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। এখানে, এখানে, এই মুম্বাইতে সবাই শুধু টাকা কেড়ে নিতে জানে। রবার। ডাকাত। লায়ার। মিথ্যাবাদী। মিথ্যা আশা দেয় শুধু এরা। ফলস্ হোপ।’ 

ফলস্ হোপ। আবার স্তব্ধতা আমাদের দুজনের ফোনের মাঝখানের অদৃশ্য হাইওয়ে জুড়ে। আমি আইয়ারের গাড়ি চলার হাইওয়ের কলপ দেওয়া রাস্তায় চাকার ঠা-সাক ঠা-সাক শব্দ শুনতে পাচ্ছি মনে হলো, আর আমাদের দুজনের মাঝখানকার বায়ুথরথর হাইওয়েতে তখন অনেক মাথা চাপড়ানো হাভাতে এলিয়েনের অনেক আক্ষেপজনক মায়াকান্না, এমনকি হতে পারে থামা থামা হাস্যপরিহাস। 

.

আসল সময় সমাগত। ইউলিসিস ইথাকায় জাহাজ ভেড়ানোর একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। ডিজিএফআইয়ে আমাদের মিত্র ব্রিগেডিয়ার জামাল আমাকে জানালেন যে সবকিছুই অ্যারেঞ্জ করে রাখা হয়েছে, আমি বেশ কজন বন্ধু পাব সেখানে, কোরিয়ান পল্লিতে। আমি মেহেরনাজের কথা ভাবছি। হায়, বসুন্ধরা এলাকার মানুষদের ভালোর জন্য এই বাচ্চা মেয়ে মেহেরনাজকে এখন, সবার চোখের আড়ালে, হয়তো ওই কোরিয়ান পল্লিতে তার সুন্দর শরীরকে নানাভাবে ব্যবহার করতে দিয়ে কত কত অবমাননা ও লজ্জার ভেতর দিয়েই না যেতে হচ্ছে! হায়, কে জানে সে নিশ্চয়ই এখন গোপনে শুয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের এই মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় লোকজনের সঙ্গে, আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কোরিয়ানদের সঙ্গেও। কোথায় মেহেরনাজ? 

সমস্ত বসুন্ধরা তখন দুপুরের ঘুমে কাতর, আমি মন্থর গতিতে এগোতে লাগলাম কোনো এক অনন্তকালের দিকে, কারণ, ভয়ে ও উত্তেজনায় আমি লক্ষ করলাম যে সময় সামনের দিকে চলছে না, অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের ক্রমিক নিয়ম মেনেও চলছে না-সে স্রেফ এক বিরামবিহীন নৈমিত্তিক সরলরেখা হয়ে গেছে। 

বালু নদের অনতিদূরে কোরিয়ান পল্লির সামনে দেখলাম একজন মানুষও নেই। দূরে, পল্লির সীমানাদেয়াল পার হয়ে ভেতরদিকে অনেক দূরে, ছায়া ছায়া চোখে পড়ল ওদের বিশাল বিশাল চার-পাঁচটা প্রাসাদ। এত দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে প্রাসাদগুলোর একই সাথে অনুভূমিক ও উল্লম্ব কাঠামো, ওদের লাল লাল থাম, সামনের দিকে ত্রিকোণাকার ছড়ানো বিরাট ইংরেজি অক্ষর এ-শেপের লাল ব্র্যাকেট যার ওপরের দিকগুলো আকাশের দিকে উঠে গেছে সুচালো হয়ে এবং যার দুপাশে একই রকম এ-শেপের ডান ও বাম বাহু হয়ে—ঢেউ খেলে শেপটা নেমে গেছে, এবং শেষে, প্রান্তদেশে, আবার ওপরের দিকে উঠে গেছে ছাইরং বিশাল টালির ছাদ। 

প্রকাণ্ড কাঠের তোরণটা চোখে পড়ল, যার দুই ধারে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে পাথরের পুরুষ্ট দেয়াল, যে দেয়ালের সারা গায়ে পঞ্চভুজাকার নকশা করা, দেখতে লাগছে দিগন্তবিস্তৃত রাশি রাশি মৌচাক যেন। আর তোরণের মাথায়, টাওয়ারসদৃশ সে মাথা, এক কাঠের কাঠামো; তার আবার ওপর-নিচ তিন ধাপ, সেটা কেমন হাঙরের চোয়ালের ওপর দিক হয়ে তাকিয়ে আছে পল্লিতে ঢুকতে ইচ্ছুক আগমনকারীদের দিকে। সেই কাঠামোটার মাথায় বানানো আরেকটা কাঠামো, যার ভেতর থেকে আকাশের দিকে বেরিয়ে আছে—এক অসম্ভব মাথাঘোরানো জ্যামিতিক নকশায় পনেরোকুড়িটা তির, কিংবা ওরকম কিছু। আমি পৌঁছে গেলাম তোরণের প্রায় কাছাকাছি, মুখ হাঁ করে তাকিয়ে দেখছি ওই প্রাসাদগুলোর টালির ছাদের রং কী করে বদলে যাচ্ছে শেষ বিকেলের আকাশের নানা আলোর অগণন বর্ণালি শুষে নিতে নিতে, কী রকম ওদেরকে মনে হচ্ছে কোনো ময়ূর যেন ঘুরে ঘুরে চলেছে অধবৃত্তাকারে। রং এত বিভ্রম জাগাতে পারে? ভাবলাম আমি। এতটা? 

মূল তোরণ থেকে তখন আমার দূরত্ব কোয়ার্টার মাইল–কিছু কম, কিছু বেশি—আমি দেখলাম তোরণের মাথার কাঠামোর মাথার তির নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ওই আজব কাঠামোটা পেছন দিকে হেলে গেল, সম্ভবত আমাকে দেখতে পেয়ে, সম্ভবত অনেকগুলো চোখ আছে ওর—এবং ওপরের চোয়ালের সেই পেছনে হেলান দেওয়ার মধ্য দিয়েই দৃশ্যমান হলো কোরিয়ান ভাষায় লেখা সাতটা লাইন, একদম বাঁয়ে; তার পাশে, মাঝখানে ইংরেজি হরফে লেখা সেই লাইনগুলোর উচ্চারণ (নিশ্চয়ই এই উদ্দেশ্য থেকে যে আমরা যেন পড়তে পারি); এবং একদম ডানে আবার ইংরেজিতেই লেখা ওই লাইনগুলোর অর্থ। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রথমে পড়লাম ইংরেজি হরফের ট্রান্সক্রিপশনটুকু : 

সোন্‌নান হিম 
নোদোদো নায়েমিরো 
ইনমিনুয়ি ত্‌তুসুরো সান 
নারা 
হানোসি পুগাঙহানুন ই 
চোসোন 
কিরি পিন্‌নায়েসে 

এবার পড়লাম ডান দিকের ইংরেজি অর্থটা : 

The nation, created by the will of the People,
Facing the furious waves with thunderous force. 
Let’s glorify this Korea forever, 
Infinitely rich and strong. 

আমার ফোনে টুং শব্দ করে ম্যাসেজ এল একটা। আসবারই কথা ছিল। আমি তো বলব বরং কিছুটা দেরি করেই এসেছে এই ম্যাসেজ। দশ-এগারোটা জিরো জিরো জিরো জিরো জিরো নাম্বার থেকে আসা সেই ম্যাসেজে লেখা : ‘তোমার বাঁ দিকে যে বাচ্চাদের সি-স খেলার মেশিনগুলো বসানো, সেখানে যাও। মেহেরনাজ ওয়েটিং। -ডি.এস.।’ 

ডোনাল্ড সমারভিল, সিনেটর ডোনাল্ড সমারভিল, তাঁর কথা রেখেছেন। আমি এত দিন পরে মেহেরনাজকে দেখব বলে চূড়ান্ত উত্তেজনায় দৌড়ে গেলাম কোয়ার্টার মাইলমতো বাঁয়ে। দেখি বালু নদীর প্রায় পাড়ে পৌঁছে গেছি, দেখি সেখানে দানবাকৃতির সি-সগুলো দাঁড়ানো, একটার পরে একটা মোট আঠারোটা সি-স, সবগুলোর লাল রং, যেমনটা হয়ে থাকে বাচ্চাদের খেলার পার্কে। খেয়াল করলাম এক অপার্থিব জ্যামিতি মেনে বসানো ওই সি-সগুলোর প্রতিটারই এদিককার মাথা মাটিতে ফেলা, অতএব ওদের উল্টোদিক উঁচু হয়ে আছে কোরিয়ান পল্লির সীমানাদেয়ালকে যেন ইঙ্গিত করে। কতবার, জীবনে কতবার বরিশালের শিশুপার্কে আমি বসেছি এসব সি-সর এক পাশে ( স্রেফ আকারেই যা ছোট ছিল শৈশবের ওসব সি-স), অন্য পাশে আমার বন্ধুরা—কখনো কাইল্যা কবির, কখনো তমাল, কখনো রিজভি, রিয়াজ, মিরাজ এরা। কতবার জীবনে ওভাবে নিচে পড়েছে সি-সর আমার দিকটা, আর ওপরে উঠে গেছে কাইল্যা কবিরের পাশ; কতবার ওভাবে ওপরে উঠে গেছে সি-সর আমার পাশ, আর নিচে পড়ে গেছে তমালের দিক। এবং, দ্যাখো, ওরই, ওরই দশ নম্বর সি-সয় প্রায় মাটিতে নিতম্ব ঠেকিয়ে বসে আছে মেহেরনাজ, আমার মেহেরনাজ। 

আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পড়ে থাকা সি-সর প্রান্তে পড়ে থাকা মেহেরনাজ আমার দিকে তার হাত উঁচু করে বাড়িয়ে দিল, আমি টেনে তুললাম তাকে। সে উঠে দাঁড়াতেই চাইলাম তাকে জড়িয়ে ধরব প্রচণ্ড এক আলিঙ্গনে। সুন্দর হালকা নীল সালোয়ারের সাথে ম্যাচিং করে গাঢ় নীল-তাতে ময়ুরের পাখার এক অবর্ণনীয় ডিজাইন—কামিজ পরা অপরূপা মেহেরনাজ শক্ত হাতে থামিয়ে দিল আমার আলিঙ্গন, বলল, ‘প্রেম-ভালোবাসার সময় না এখন। বিপদ চারিদিকে। জলদি করেন, স্যার।’ 

কী জলদি করব আমি? তাকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে ফিরে যাব মূল তোরণের কাছে? তাকে সঙ্গে করে উড়ে যাব তার ময়ূরের পাখাগুলোয় নিজেকে ভাসিয়ে? তার সঙ্গে সি-স খেলব ছোটবেলার মতো করে? সে বসবে সি-সর ওই পাশে, এবং আমি বসব এপাশটায়? তারপর তাকে বলব, শুরু করো খেলা? না, মেহেরনাজ আমাকে বলল ওসবের কিছুই করতে হবে না আমাদের, এই যে তার হাতের মুঠোর কাগজে লেখা ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার জামাল সাহেবের ইনস্ট্রাকশন, এই যে ওতে লেখা : ‘দুজনে একসাথে বসে পড়ুন তেরো নম্বর সি-সয়, তারপর দুজনের মোট চারটা পা দিয়ে জোরে বাড়ি মারুন মাটিতে।’ 

আমরা দুজন একসঙ্গে গিয়ে দাঁড়ালাম তেরো নম্বর সি-সটার সামনে। যাচ্ছি এবং আমি মেহেরনাজকে বলছি, ‘আই লাভ ইউ মেহেরনাজ।’ বলছি, ‘তুমি এত শুকিয়ে গেছ কেন মেহেরনাজ?’ আবার বলছি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, মেহেরনাজ।’ 

মেহেরনাজ এ-তিনটে বাক্যের উত্তরে এটুকুই বলল শুধু : ‘মিথ্যা কথা।’ 

এই তাহলে আমাদের ভালোবাসাবাসির শেষ পরিণতি? এই তাহলে এসে পৌছুলাম আমরা তীব্র এক প্রেমের সম্পর্কের এ রকম দম-বন্ধ-করা পেছন দরজায়? এই তবে চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যকার দীর্ঘায়তন গুটিপোকা যার পেছন ভাগ দিয়ে এইভাবে এইভাবে বিক্ষিপ্ত বেরিয়ে ছড়িয়ে যায় সব সম্পর্কের খসখসে শণ? আমি আবার চেষ্টা করলাম তাকে বোঝাতে যে সে ভুল বুঝেছে আমাকে, সে ভুল ধারণা করছে যে আমি তাকে বেচে দিয়ে হাত মিলিয়েছি আমেরিকানদের সঙ্গে, সে বুঝতেই পারছে না উইলিস বার্নস্টেইন এখন স্রেফ আমার কবিবন্ধু, এবং আর কিছুই নয়, আর সে চাইলেই আমার এই কথাগুলোর সত্যতার সাক্ষ্য দিতে পারে আমাদের কমন বন্ধু পিংকি হিজড়া। কিন্তু মেহেরনাজের দেখলাম কোনো মন নেই আমার ওসবে। সে আমাকে এক দীর্ঘ পুনরুক্তিতে ভরা বাক্যে জবাব দিল আমার কথাগুলোর, যার আবার সারমর্ম এটাই দাঁড়ায় যে, ‘আপনি সারাটা জীবন অদ্ভুত সব সময় বেছে নেন অদ্ভুত সব কথা বলবার জন্য। নাউ ইটস্ টাইম ফর বিজনেস। নাউ ইটস্ টাইম টু সেইভ দি ওয়ার্ল্ড।’ 

এবং, তার সব কথার শেষে, ‘কে উইলিস বার্নস্টেইন?’ 

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েই আছি। মেহেরনাজ বসে গেছে তেরো নম্বর সি-সয়, তার পাছা প্রায় মাটিতে ঠেকিয়ে। সে আমাকে বলছে, ‘আসেন স্যার।’ আবার বলছে, ‘আসেন স্যার’। আবার বলছে, ‘আপনি আমার সামনে বসেন।’ 

আমি দুপা দু দিকে দিয়ে উঁচু হয়ে থাকা সি-সর পিছল ইস্পাতের ওপরে মেহেরনাজের সামনে গিয়ে এমনভাবে বসলাম যে এমনভাবে পেছনে তার দিকে আমার শরীরের পেছন ভাগ সর-সর করে সরে যেতে লাগল যে আমার পুরো পিঠ ঠেকল তার উদ্ধত বুকে, তার বুক দুটো পিষ্ট হয়ে গেল আমার পিঠের আয়তনে, সে মুখ দিয়ে সামান্য গোঙানির মতো শব্দ করল একটা—’উহ্’, আর নিজেকে সামলে নিতেই দু হাতে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমার পেটের দিকটা, ঠিক যেভাবে পেছনের মোটরসাইকেল আরোহী জড়িয়ে ধরে সামনের জনের শরীরের নিম্নভাগ। মেহেরনাজ এবার চিৎকার করে বলল, ‘স্যার, পা দিয়ে ধাক্কা দেন।’ বালু নদীর তীর ধরে লাগানো নিমগাছগুলোর মাথা থেকে তখন আকাশে উড়াল দিল শত শত কানিবক, শত শত মৌটুসি এবং কমপক্ষে কুড়িটা বিরাট পুটিয়াল ধনেশ। আমরা দুজনে যার যার পা দিয়ে মাটিতে জোর ধাক্কা দিয়ে ফেলেছি ততক্ষণে। 

কী এক শক্তি আমাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে বসাল চৌদ্দ নম্বর সি-সটায়, সেখানে দড়াম করে আমাদের প্রান্ত নিচে মাটিতে ঠেকল, আবার তখন পা দিয়ে মাটিতে জোর ধাক্কা দিতেই কী এক শক্তি এবার আমাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে বসাল পনেরো নম্বর সি-সটায়, আবারও একই জিনিস -এবার ষোলো নম্বর সি-স, তারপর সতেরো, তারপর আঠারো, আর আঠারো শেষ হতেই একটা দেয়াল, তার শরীরজুড়ে আঁকা পঞ্চভুজাকার অসংখ্য মৌচাক। হঠাৎ যেন রাস্তার ওপরে চলার পথে খাড়া করা হয়েছে দেয়ালটাকে, এবং দেয়ালের গায়ে, ঠিক যেখানে আমরা এসে থেমে গেছি সেখানে একটা তির চিহ্ন, তিরের নিচে কোরিয়ান ভাষায় লেখা, নিশ্চয়ই লেখা যে ‘উপর দিকে লাফ দিন’, কারণ তীরের মাথা ডানেও নয় বামেও নয়, সোজা ওপরের দিকে তাক করা। 

আমরা লাফ দিলাম, মেহেরনাজ ও আমি, দুই চিরশিশু, পৃথিবীকে ভয়াবহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দুই তীক্ষ্ণবুদ্ধির যোদ্ধা বালক-বালিকা। না, কিন্তু কিছুই হলো না, আবারও লাফ দিলাম আমরা। তারপর হঠাৎ মেহেরনাজ চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, ব্রিগেডিয়ার জামাল স্যার বলছেন যে দেয়াল হাতড়ে পার হতে হবে’। 

আমরা হাতড়ে হাতড়ে ওই পাথুরে দেয়াল পার হওয়ার চেষ্টা করলাম এবার। হাঁচড়েপাঁচড়ে দেয়াল বেয়ে উঠছি আমরা। কোনো মৌচাকের এক বাহুতে মেহেরনাজ তো অন্য বাহুতে আমি, দুজনের দু হাত এবার ওই মৌচাকের এক বাহুতে এসে মিলেছে তো, পরক্ষণে অন্য দু বাহুতে যেই আমাদের যার যার পা, তখনই আমাদের দুজনের দু হাত সরে যাচ্ছে পরস্পর থেকে দূরে। হায়, কীভাবে একসাথেই ছিলাম আমরা শুরুতে, আর দেয়াল বেয়ে উঠতে উঠতে কীভাবে না দূর থেকে দূরে সরে গেলাম আমরা—এত দূরেই যে, যতই উঠছি ততই দূর থেকে আরও দূরে এত সরে যাচ্ছি যে শেষমেশ যখন আমরা দুজনে দেয়ালের মাথায় ততক্ষণে আমরা দুজনে দুজন থেকে দশ বটগাছ সমান দূরে। 

মেহেরনাজকে ওভাবে, আমার অনিচ্ছায় এবং সম্ভবত তার ইচ্ছায়, অতটা দূরে সরে যেতে দেখে তখন বিস্মিত আমি নিজেকে নিয়ে নয়, ভয় পেলাম ওকে নিয়ে, ওই চঞ্চল-করিতকর্মা-নো ননসেন্স সুন্দরী মেয়েটাকে নিয়ে। সেই ভয় থেকেই আমার কোমরে গুঁজে রাখা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটার বাঁটে হাত রাখলাম এবার। হাতটা ওখানে রাখামাত্র ভারী-কান ঝিঁঝিঁ করা-পুরু-মোটা অতিকায় ও স্ফারিত শব্দ হলো একটা-ঢং। কোরিয়ান ঘণ্টা বাজল। হান্‌গুল। হাজা। উজেয়ং-উই জং। উজংউই চোং। আমি দূরে ডানে তাকিয়ে ডেকে উঠলাম, ‘মে-হে-র-না-জ’। মেহেরনাজ উত্তরে বলল, ‘নিচে তাকান, স্যার।’ 

হাগুলের ঢং শব্দে তখনো বাতাস ঘনবদ্ধ, তখনো সে বাতাসে নিশ্বাস প্রায় নেওয়ার অযোগ্য, এবং তিরবেগে ছোটা সেই কুড়িটা ধনেশ তখন আকাশে স্থির, যেভাবে এয়ারপোর্টের ওপরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় দৈত্যাকার বোয়িং ট্রিপল সেভেনগুলো, আর তখন আমরা দুজনে—আমার অনুমানে একদম ঘড়ির কাঁটা মেনে আমরা দুজনে একই সময়ে আমাদের সামনে নিচে ঢাকার মাটিতে অবস্থিত এক সার্বভৌম কোরিয়ান প্রান্তরের দিকে দৃষ্টি রাখলাম। 

.

হে ভয়ংকর শয়তান, তুমি এটা কী বানিয়েছ? আর কত ঠুনকো জিনিস দিয়ে এত বিশাল এক সাধারণ জিনিস বানিয়েছ তুমি? এটা কি কোনো ছবি, কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি, কোনো আসবাব, কোনো রান্না করার জিনিস, নাকি আনুপূর্বিক এক প্রেইরির প্রান্তর, মৃত্যুঞ্জয়ী সরীসৃপ, চৈতন্যহীন অরণ্যনিবাস? আমি জানতাম আমি একজন সাহসী মানুষ এবং আকাশের অনুজ্জ্বলতা আমাকে কখনো বিভ্রান্ত করতে পারে না। আমি জানতাম আমার বেপরোয়াভাব এতখানিই খোদার অভয়বাণী দিয়ে ঘেরা যে জ্যোতিঃমণ্ডলের আপাত-বৈজ্ঞানিক, আপাত-স্বেচ্ছাচারী ভ্রুকুটি আমাকে বিচলিত করে না। কিন্তু হে শয়তান, তোমার এই খামখেয়ালের সামনে আমি কাপুরুষ হয়ে গেলাম, এতটাই যে চোখের সামনে আমি কী দেখছি, তার বর্ণনা করার ধৃষ্টতা আমাকে দেখাতে হচ্ছে ভাষার চূড়ান্ত সীমাবদ্ধতা মেনেও মানুষেরই ভাষায়, পাছে আমি নৈঃশব্দ্যের আতঙ্ক থেকে নিজেই না নিজেকে পাথর বানিয়ে ফেলি।  

একটা এক শ গজ বাই এক শ গজ চওড়া আর দেড় শ গজ বাই দেড় শ গজ লম্বা মাঠ, মানে ফুটবল খেলার মাঠের চাইতে অনেক বড় আকার তার। এর পুরোটা একদিন নিশ্চয় সবুজ ঘাসে ঢাকা ছিল, আর এখন তা একদম প্রান্ত থেকে প্রান্ত পর্যন্ত এক মহিষের সাদা ভুঁড়ি দিয়ে মোড়া, গরু-মহিষের পেট কাটলে যে বড় সাদা পেটটা ধপ করে বেরিয়ে আসে, সেই সাদা, সেই পেট, সেই ভুঁড়ি। মাঠের এক কোনায় ওই জবাই হওয়া মহিষটার কাটা মাথা খাড়া করে রাখা, তার নিচ দিকটায় রক্ত ভুঁড়ির ওপরে কিছুটা জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে গেছে, এবং এই মাথাটার উচ্চতা ছুঁয়েছে মাঠের ওপাশের সুউচ্চ ছাইরং টালির ছাদের সর্বোচ্চ বিন্দুকে। পুরোটা মাঠজুড়ে হীরার টুকরোর মতো পাউডার ছড়ানো। সেগুলো চিকচিক করছে। বুঝলাম ওই ছড়ানো ভুঁড়ি ও বাসি রক্ত থেকে কোনো গন্ধ বেরোচ্ছে না সে কারণেই। 

তাহলে ওই রাতে জবাই দেওয়া হয়েছিল এই অতিপ্রাকৃত, এই জেনেটিক্যালি ডিফর্মড মহিষটাকেই, আর তাই আমরা শুনেছিলাম জবাইয়ের সময়ে মহিষটার মুখ চেপে ধরা হঠাৎ এক ভরাত আওয়াজ? কসাইদের দলের হাত পিছলে হঠাৎ ঘটে গিয়েছিল ওই ঘটনা? আর তারা ব্যাপারটা সামলে নিতেই কি লেগেছিল ওই তিন-চার সেকেন্ড? 

এত বড় মহিষ জবাইয়ের সময়ে তার কণ্ঠনালি দিয়ে বেরোনো শব্দ আরও জোরের কেন হয়নি, তা নিয়েই বরং আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম, আবার তাকালাম মহিষটার কাটা মাথার দিকে। কোনো কিছু এত বীভৎস, এত বিকট কী করে হতে পারে, তা-ও এই মানুষের পৃথিবীতে যেখানে প্রতিদিন ভোর হয় শান্ত হাওয়ার ডানায় চেপে আর বিকেল নামে পাখিদের অনুগ্রহ দৃষ্টির পেছনে পেছনে? ঠিক এ সময়েই আমার চোখে পড়ল, যে দেয়ালের ওপরে আমরা পা ছড়িয়ে বসে আছি, তার এ পাশটার পুরোটাজুড়ে এক দ্বীপের মানচিত্র, যা আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে ঝুঁকে এবং ডানে বামে তাকিয়ে তাকিয়ে-ছোট, অনুল্লেখযোগ্য রকমের বৈচিত্র্যহীন একটা দ্বীপ, আসলে স্রেফ একটা ডট, যার পাশে পানির ছবি আছে বলেই বোঝা যাচ্ছে ওটা কোনো দ্বীপই হবে। 

আমরা ঘাড় অনেক নিচু করে তাকালাম দেয়ালের এমাথা থেকে ওমাথা অবধি। দেখাও যায় না এতটা দূরত্ব আমাদের থেকে ওই দেয়ালের শেষ প্রান্তের, তবু দেখলাম দেয়ালের পুরোটাই ব্লো করা বিশাল এক ডিজিটাল ছবি, দেয়ালটার গায়ে টানানো। ঠিক তখন আমাকে দূরের ওই লাল প্রাসাদের কোনো একটা জানালা থেকে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলা হলো : ‘গেট ডাউন, মিস্টার প্রফেসর। গেট ডাউন, আওয়ার এমপ্রেস।’ 

তারা সবাই বসেছে প্রাসাদের সামনের চত্বরের চারপাশজুড়ে, যার যার আসনে, আর আমাকেও বসানো হয়েছে একটা বেতের চেয়ারে। বয়সে বৃদ্ধ কিন্তু সুঠামদেহের এক কোরিয়ান, যাকে দূর থেকে ছায়া ছায়া দেখতে মনে হচ্ছে সে চার্লস ডারউইনেরই চীনা-কোরিয়ান এক ভার্সন, কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি চলে এলেন তাঁর মূল বিষয়ে। আমি তাঁর কণ্ঠস্বরের প্রক্ষেপ থেকে বুঝলাম তিনিও আমার মতো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন সম্ভবত। তিনি তাঁর কথাগুলো একটানা বলে গেলেন কোরিয়ান অ্যাকসেন্টের স্পষ্ট কিন্তু সংসক্ত ইংরেজিতে : 

‘শয়তানের কাছে আপনি আসেননি প্রফেসর, যদিও এত বড় মাঠজুড়ে এত বড় এক মহিষের, নয় শ মহিষের সমান এক মহিষের সাদা ভুঁড়ি কোনো শয়তানি কর্মকাণ্ডেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা আমি বুঝি। আপনাকে দেখার চোখটা শুধু উল্টে নিতে হবে, এই যা। যা কিছু দেখতে শয়তানের মতো, তা এই পৃথিবীতে এখন দেবতুল্য, কারণ যা কিছু দেখতে ঐশ্বরিক এবং যা কিছু মোড়ানো মহান দেবসুলভ বাণী দিয়ে, তা-ই পৈশাচিক। আমেরিকা পৃথিবীকে এক দৃষ্টিশূন্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সবার অজ্ঞাতসারে পৃথিবীকে দিন দিন, প্রতিটা দিন থেকে দিনে, একেবারে গোড়া থেকে উদ্ভ্রান্ত করে ফেলা হচ্ছে। এই আমেরিকা এখন চালাচ্ছে আপনার প্রিয় কবি মিখাইল লেরমন্তভের ভাষায়: কুখ্যাত গুন্ডাদের উদ্ধত বংশধরগণ। আমরা তা চিরকাল বিনা চ্যালেঞ্জে হতে দিতে পারি না, অন্তত টেকনোলজিতে এতটা এগোনোর পরে তো অবশ্যই না। 

‘প্রফেসর, আমরা সাউন্ড ওয়েভ দিয়ে স্থানের ইমেজকে ধ্বংস করার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হ্যাঁ, ওই দেয়ালে টাঙানো দ্বীপের ছবিটা সাউথ প্যাসিফিকে পলিনেশিয়ান অঞ্চলের এক দ্বীপ, মরিসন দ্বীপ ওর নাম। সেখানে কোনো মানুষ থাকে না, আর দ্বীপটা এতই ছোট যে তাকে গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দিলেও কেউই জানবে না, কারণ পৃথিবীর কোনো মানচিত্রেই ওই দ্বীপের নাম-নিশানা নেই। 

‘আমরা এখানকার শব্দতরঙ্গ দিয়ে ওই দ্বীপের মূল ছবিটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছি সেই বিকট শব্দের রাতে, আর যে মুহূর্তে স্টিল ইমেজটা ধ্বংস হয়ে গেছে, তার কয়েক সেকেন্ড পরেই মোটামুটি বিলীন হয়ে গেছে মূল দ্বীপটাও—সে বলতে গেলে কখনো ছিলও না, আর এখন বাস্তবিক অর্থেই আর নেই। এতখানিই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে ওই মূল দ্বীপ যে আমরা তার এখানকার টুকরো হয়ে যাওয়া ইমেজ বারবার চোখে দেখাটা আর সহ্য করতে পারিনি, তাই পরে ওটারই অতীতের আরেকটা ভালো ছবি এখন দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি 

‘যা হোক, আপনি তাহলে বুঝতে পারছেন আমাদের এই সাউন্ড ওয়েভ টেকনোলজি রিমোটলি কী কাণ্ড ঘটাতে পারে? কী কী করা সম্ভব তাহলে, বুঝতে পারছেন মিস্টার ইউলিসিস? এখানে আইফেল টাওয়ারের ছবি টাঙালেন, আর এখানে বিকট শব্দে স্রেফ জবাইয়ের সময়ে মহিষের মুখটা হঠাৎ একটু ছেড়ে দিলেন, তাতে আপনার টাঙানো আইফেল টাওয়ারের ছবি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। হাহ্! আর যে মুহূর্তে তা হলো, তখনই টুকরো হওয়া ইমেজ ধাওয়া করল মূল বস্তুকে, ওই বিকট শব্দের সাউন্ড ওয়েভ মহাদেশ-মহাসাগর পেরিয়ে এবার মূল আইফেল টাওয়ারকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। হ্যাঁ, কোনো প্লেন হাইজ্যাক করার তাহলে ব্যাপার নেই, কোনো প্লেন ছুটিয়ে টাওয়ারের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া নেই, কোনো রাষ্ট্রপতিকে আর ভোররাতে তাঁর বাসায় ঢুকে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করার প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছেন আপনি যে আমরা কোন দিকে যেতে চাচ্ছি?’ 

এটুকু বলে থামলেন তিনি। তার থামার সাথে সাথে গুনগুন শুরু হলো, অনেক মানবকণ্ঠের এক অগ্নিগর্ভ গুনগুন। মানুষগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না আমি দেয়ালের গা ঘেঁষে বসা আমার জায়গাটা থেকে। সূর্য এত দ্রুত নেমে যাচ্ছে কি? না, তারা রয়েছেন আমার থেকে বেশি দূরে। শুধু বোঝা যাচ্ছে তাদের একেকজনের গায়ের একেক রং তাদের একেকজনের দেহের একেক রকম উচ্চতা। আহ্, আমি যদি শুধু ওই কোরিয়ান ভদ্রলোককে একটু ভালো করে দেখতে পারতাম। কী ভারী তাঁর কণ্ঠস্বর, কী আত্মবিশ্বাসের অহংকারে ভরা তাঁর প্রতিটা শব্দোচ্চারণ। আর কী ভয়ংকর এক কথা বলতে চাইছেন তিনি। ঢাকার এই মাঠজুড়ে টাঙানো হবে আমেরিকার হোয়াইট হাউসের ছবি, তারপর জবাই দেওয়া হবে নয় শ মহিষের সমান জেনেটিক্যালি ডিফর্মড একটা মহিষ, ওটার জবাইয়ের সময়ের ভয়াল ও প্রচণ্ড শব্দের তরঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে দেবে হোয়াইট হাউসের ওই বিশেষভাবে বানানো ডিজিটাল ছবিটাকে, তারপর যে মুহূর্তে ধ্বংস হবে এখানকার ওই ছবিটা তখনই টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ওই ছবির ইমেজ আকাশপথে সাতসমুদ্র পেরিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আঘাত হানবে মূল হোয়াইট হাউসে গিয়ে, অর্থাৎ আছড়ে পড়বে ছবির মূল স্থাপনার গায়ে এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে মূল স্থাপনাটাকে? ঠিক বুঝেছি আমি? এটাই তো বললেন কোরিয়ান লোকটা, নাকি? ওহ্ খোদা, ওহ্ খোদা, এটাই তো বললেন তিনি যে ঠিক এদিকেই যেতে চাইছেন তারা, এবং তাঁর কথাকে অঙ্গীকার মেনে গুনগুন করে উঠল তাঁর ওই হাজার সমর্থক? 

আবার বলা শুরু করলেন তিনি। বললেন, ‘স্রেফ ইমেজ-টু-রিয়াল-ডেসটিনেশন-অবজেক্ট ট্রাভেলে এখন আমাদের পথের মাঝখানের বৃষ্টি ও আর্দ্র আবহাওয়ার শেষ বাধাটাই যা পেরোনো বাকি, ঠিক যে কারণে মরিসন দ্বীপটার কিছু ঘাস এখনো এর মাটির কিছু স্মৃতিকে ধরে রেখেছে।’ 

আবার থামলেন তিনি। গুনগুন থেমে গেছে। এবার বললেন : 

‘এখানে আমাদের সঙ্গে আছেন সবাই, অন্তত অনেকেই–পেরু, বলিভিয়া, ম্যাকাও, ইন্ডিয়া, চায়না, নাইজার, জিবুতি, মেক্সিকো, সিরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, এস্তোনিয়াকে নেই? পুরো ঘরটার দিকে একবার তাকান প্রফেসর, তাহলেই বুঝবেন পৃথিবীর কত বড় একটা অংশের মানুষ আমরা একসঙ্গে হয়েছি। আর আপনাদের দেশকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কোনো মানুষের সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র ক্ষমতা বলে কিছু আছে এই পৃথিবীর শুধু দুটো জায়গাতেই—পিয়ংইয়ং ও আপনাদের ঢাকার এই বসুন্ধরা। এ রকম অবিতর্কিতভাবে কারও শতভাগ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত জায়গা ছাড়া আমরা এত বড় এক্সপেরিমেন্টটা করতাম কোথায়? পিয়ংইয়ংকে, উত্তর কোরিয়ার মার্শাল অব দ্য রিপাবলিক কিম জং-উনকে, আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি আর শয়তানের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য আরেক শয়তানের কাছে হাত পাতাটাও আমাদের ভালো লাগেনি। আমরা মূলত নর্থ কোরিয়ান হলেও আমরা কিম জং-উনের মানবতাবিরোধী কাজকর্মকে সমর্থন করি না। হ্যাঁ, তখনই আপনাদের বসুন্ধরার আজমত সাহেব আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন-শতভাগ গোপনীয়তার, শতভাগ নিরাপত্তার, শতভাগ নিশ্চয়তার দুই হাত। আপনার বন্ধু উইলিস বার্নস্টেইন আমাদের পেছনে লেগেছিল, তাকেও আমরা কালার-ব্লাইন্ড বানিয়ে দিয়েছি, সে এখন খোঁড়া; ঘটনা ঘটার দেশটা এই মডারেট মুসলিম বাংলাদেশ না হলে আমরা এত সহজে তাকে খোঁড়া করতে পারতাম না। আর আপনার ব্যাপারে বলতে হয়, আমরা জানি আপনি শুভের পক্ষে, আমরা জানি আপনি ওই বিকট শব্দের পরিণামে কয়েক শ শিশুর চিরতরে বধির হওয়ার ঘটনায় মর্মাহত, কিছু মানুষের মৃত্যুতে বিচলিত। কিন্তু মিস্টার প্রফেসর, মিস্টার ইউলিসিস, পৃথিবীতে আলটিমেট শুভ ঘটাতে গেলে কবে কোন দিন শুরুতে কিছুটা অশুভকে এড়ানো গেছে, বলুন? না, তা যায়নি, বড় কিছুর জন্য ওটা অবশ্যম্ভাবী, চিরদিনই। পৃথিবীর সৃষ্টির পেছনেও একই কথা, একটা বিগ-ব্যাং, অসংখ্য নক্ষত্রমণ্ডলীর, বস্তুপিণ্ডের, সৌরবস্তুর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া, তারপরই এই সবুজ পৃথিবীর ছিটকে জন্ম নেওয়া, প্রাণের বিকাশ, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝতেই পারছেন, আমি পৃথিবীর সম্পূর্ণ ইতিহাস একদম, একদম, একদম নতুন করে লেখার কথা বলছি, আর তা ছাড়া আপনি যেহেতু আজও শেলির কবিতা, শেলির কবিতা, শেলির কবিতা পড়েন, তাই প্রলয় ও নবসৃষ্টি বিষয়ে আপনাকে এর থেকে আর বেশি বুঝিয়ে বলতে হবে না, হবে না, হবে না আশা করি। যে আমাদের শয়তান বলছে, সে-ই শয়তান, শয়তান, শয়তান, শয়তান। আপনি শুধু ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে দাগটা পার হয়ে আসুন। সেটা আপনার ইচ্ছা।’ 

আমি আন্দাজ করে নিলাম তিনি বসে পড়েছেন তার চেয়ারে, তার সিংহাসনে। তো, এটুকুই তার কথা? মাত্র এটুকুই? পৃথিবীর যেকোনো কিছুকে, যেকোনো দালানকে, যেকোনো স্থাপনাকে, যেকোনো পুকুর-সমুদ্র-খেলার মাঠ ও হাটবাজারকে যেকোনো সময় নয় শ মহিষের সমান কোনো মহিষ হত্যা করে গুঁড়িয়ে তুলো তুলো করে দিতে সক্ষম টেকনোলজির আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানীর, রাজনৈতিক দার্শনিকের, ভিন্নমতাবলম্বী এই পাগল খলিফার এটুকুই মাত্র কথা? যারা সত্যিকারের প্রতিশোধ নেয় এবং সত্যিকারের প্রতিহিংসা চরিতার্থে সক্ষম তারা এত কম কথা বলে এত বড় বড় কাজ সারে তাহলে? না। আমি তার কাপড়ের খসখস আবার শুনতে পেলাম, দূরে ছায়া ছায়া দেখতে পেলাম তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং এবার তাকিয়েছেন আমার দিকে না, আমার থেকে দশ বটগাছ সমান দূরে দাঁড়ানো মেহেরনাজের দিকে। তিনি তার জলদগম্ভীর কণ্ঠে এবার আর আমাকে না, মেহেরনাজকে বললেন এই কথা : 

‘মাই এমপ্রেস, আমার সম্রাজ্ঞী। তো, আপনি দলত্যাগ করুন। আমরা আপনার বীরত্বে মুগ্ধ, আপনার অবিশ্বাস্য নিশ্চয়তা ভরা পদক্ষেপ ও পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে মুগ্ধ। হলে আপনাকে দিয়েই হবে, মেহেরনাশ্।’ 

তিনি মেহেরনাজের জ-র উচ্চারণ করলেন স্পষ্ট সাপের শ-এর মতো, বিনাশের ঘন শ-এর মতো। বলতে লাগলেন : 

‘উন্মাদনার ইতিহাস ক্ষমতার ইতিহাস, মেহেরনাশ্। উন্মত্ততা যেহেতু ক্ষমতাকে কল্পনায় দেখে, তাই তা একই সঙ্গে যেমন অক্ষমতা-নপুংসকতা, তেমনই সর্বময় ক্ষমতা। উন্মত্ততার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দরকার ক্ষমতাকে। কর্তৃত্বের ও শাসনক্ষমতার সাধারণ স্বাভাবিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তথাকথিত উন্মাদনা, তথাকথিত এই মতিচ্ছন্নতা বিরামহীন, বিরতিহীন বলতে থাকে—যা শুনলে কখনো কখনো মনে হবে আপনি কোনো মনোবিকারগ্রস্তর স্বগতোক্তি শুনছেন যেন—বলতে থাকে ক্ষমতার কথাই। সেই ক্ষমতা ধ্বংসকামী উন্মাদেরা কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। তারপর আমরা সহ্য করেছি এবং সংহত করে নিয়েছি নিজেদেরকে, বুঝে নিয়েছি ম্যাডনেসের সামাজিক ইতিহাস, এবং নিজেরাই এবার আমরা, সৃষ্টিকামী উন্মাদেরা, দখল ও আত্মস্থ করেছি ক্ষমতাকে। আপনার ক্ষমতা মেহেরনাশ্ আমাদের দরকার। আমাদের সম্মিলিত ক্ষমতা মেহেরনাশ্, আপনার দরকার। অতএব আপনি দাগটা পার হয়ে আসুন। আপনি দলত্যাগ করুন। আ-সু-ন।’

কী ভয়ংকর এক স্বরে তিনি শেষে বললেন, ‘আসুন’ শব্দটাকে, যা শুনে বুঝে উঠতে পারলে মাথার ওপরের ওই বিশাল আকাশও এখন এই মুহূর্তে নিজেকে রুটির মতো ভাঁজ করে নিয়ে এসে বসে পড়ত ওই মানুষটার পায়ের কাছে, বসত রুটির মাথাটা নুইয়ে কোনো গেরস্ত বিড়ালের মতো করে। 

মেহেরনাজ একবার আমার দিকে তাকাল, আমার দুচোখ দ্রুত ভিজে উঠল, কিন্তু সে দেখল না আমার চোখের পানির চিকচিক। কারণ আমাদের মধ্যখানে দূরত্ব অনেক তারপর সে মুখ ফিরিয়ে নিল আমার থেকে। আমি মাত্র সামান্য ক্ষণিকের জন্য যেন তার মুখে, আমার অতি পরিচিত ওই প্রেমিকা-বন্ধু-বোনের মুখে দেখলাম আমার প্রতি, 

পৃথিবীর ক্ষমতাহীন ও অসহায়দের প্রতি কারুণ্য। 

এরপরই আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম, আমার দৃষ্টি তখন চোখের নুনপানিতে ঘোলা ঘোলা, আর আকাশে বোয়িং ট্রিপল সেভেনের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পুটিয়াল ধনেশগুলো তখন তাদের ওই আকস্মিক জড়তা ভেঙে ডানা ঝাপটে মাত্র উড়ে যেতে শুরু করেছে, তারা মেহেরনাজকে তাদের চল্লিশটা ডানার শব্দ তুলে তার বেছে নেওয়া, তার প্রাপ্য সম্রাজ্ঞীর স্যালুট জানাচ্ছে, হ্যাঁ, তখন আমি দেখলাম কোরিয়ান-বলিভিয়ান -রাশিয়ান-জানজিবারিয়ান বিরাট বিশাল ভিড়টার দিকে দৌড়ে চলেছে মেহেরনাজ, দৌড়ের ছন্দে দুর্দান্ত দুলছে তার বুক, এবং অপবিত্রতার ছায়া মেখে দুলছে তার ভারী—তবে ইদানীং কিছুটা শুকিয়ে যাওয়া—দুই নিতম্ব। বিদায়, মেহেরনাজ, বিদায়। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *