৪.৪
বাইরে বেরোতেই দেখলাম আমার চোখ জ্বলছে। তখন সন্ধ্যা হয় হয়, পশ্চিমের আকাশে মেঘের কপট লাল রং, মনে হচ্ছে কোনো তৃতীয় শ্রেণির শিল্পী আকাশের গায়ে তুলি দিয়ে তার কোনো চাতুর্যপূর্ণ কূটকর্ম সেরেছে। উইলিস আমার কাঁধে হাত রেখে পাশে পাশে হাঁটছে, তার শরীরী ভঙ্গিমা থেকে মনে হচ্ছে আমরা যেন কতকালের বন্ধু। আমি ভাবছি, না, তারা এটা করতে পারে না, দুটো তারুণ্যদীপ্ত মেয়ের সৃজনশীলতার সব প্রকাশকে এভাবে রুদ্ধ করে দেওয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই, আর যদি তারা তা করে, তাহলে সেটা একটা পুরো পৃথিবী লন্ডভন্ড করে দেওয়ার চাইতে কম অন্যায়ের কিছু হবে না।
উইলিস একটু থামল, তার মার্লবোরোর প্যাকেট থেকে নিজে একটা সিগারেট নিল, আমাকে একটা দিল, আর বলল, ‘সিগারেটটা শেষ করে যাই,’ তারপর এক পা আমার কাছে সরে এসে আবার বলল, ‘প্রফেসর, আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন, শুনতে ভালো লাগে। একটা প্রশ্ন। আপনার কী মনে হয়, আমাদের জীবনের অর্থ কী?’
আমি তখন ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় জ্বলছি এবং সম্ভবত ওই ট্রুথ সেরাম সোডিয়াম থিওপেন্টাল আমার মাথা কিছুটা এলোমেলোও করে দিয়েছে। আমি খেপে উঠলাম তার প্রশ্ন শুনে এবং এই প্রথম নিজের ভেতরকার ভীতি কাটিয়ে (বাইরের মুক্ত আলো-বাতাসও কাজটাতে আমাকে সাহায্য করল নিশ্চয়), আমি প্রায় চিৎকার করে তাকে বলে উঠলাম, ‘হোয়াট ডু ইউ থিংক অব ইওরসেলভস, ইউ ডার্টি আমেরিকানস? আই টুলি হেইট ইউ—ইউ অ্যান্ড ইউর হার্ভার্ড-মিক্সড-উইদ-ল্যাংলি অ্যাকসেন্ট। তোমাদের কোনো অধিকার নেই আমাকে এভাবে আমার মিশন থেকে দূরে রাখবার, মেহেরনাজকে ভয় দেখিয়ে, তার বাবা-মাকে ভয় দেখিয়ে তাকে এ মিশন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। সরি, ইউ সিম্পলি ক্যান্ট ডু দ্যাট মিস্টার বার্নস্টেইন, নো ম্যাটার হোয়াট শিট-ফাক ইউ আর, হোয়াট চিফ অব হুইচ ইন্টারকন্টিনেন্টাল পুসি অ্যান্ড কান্ট ইউ আর।’
কিছুক্ষণের নীরবতা। বার্নস্টেইন মাথা নিচু করে আমাকে জানাল সে সামান্য চাকরি করে, এটা আমেরিকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপার, বাংলাদেশে ইদানীংকার কিছু ডেভেলপমেন্টে আমেরিকা অতিসজাগ, সারা পৃথিবীতে ওই আইএস একটা দুর্বার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে, এই শব্দের পেছনে আসলেই ভয়াবহ এক ষড়যন্ত্র আছে, কোরিয়ান চায়নিজ কিছু বিজ্ঞানী রিমোটলি কন্ট্রোলড সাউন্ড ওয়েভ ও ইমেজের সমন্বয় ঘটিয়ে এমন একটা কিছু আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেটা একবার তারা আবিষ্কার করে ফেলতে পারলে এই পৃথিবীর ইতিহাসই বদলে যাবে, সভ্যতাকে আবার নতুন করে শুরু হতে হবে, কিন্তু তারপরও ব্যক্তিগতভাবে সে দুঃখিত আমার মতো এক নিরীহ ও সৎ প্রফেসরের প্রতি তাকে এ রকম অসভ্য আচরণ করতে হলো বলে।
তার এই অন্তঃসারশূন্য উদারহৃদয় কথাবার্তায় আমার মন গলল না। আমি আমার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ব্যক্তিগত ফোন মেসেজ এসব হ্যাক হওয়ার (এবং অন্য কিছু লোকের দল বেঁধে সেগুলো পড়ার) অবমাননায় কুঁকড়ে উঠতে লাগলাম।
এদের নীচতা ও ন্যায়বিরুদ্ধ কাজকর্ম আমাকে এতখানিই ক্ষুব্ধ করে তুলল যে আমি তার দেওয়া (তখনো না ধরানো) সিগারেটটা তার সামনেই মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মাড়াতে লাগলাম এবং তাকে উত্তর দিলাম তার ‘জীবনের অর্থ কী’ প্রশ্নের : ‘সত্যিকারের প্রশ্ন আর বাজে ও নকল প্রশ্নের মধ্যেকার পার্থক্য কী, তা-ই তুমি জানো না মিস্টার বার্নস্টেইন, সে কারণেই তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ যে জীবনের অর্থ কী? কেন তা জিজ্ঞাসা করেছ, তা আমি জানি। তুমি সত্যি প্রশ্ন ও মিথ্যা প্রশ্নের উত্তরে আমার চোখের পিউপিল ও ভোকাল কর্ডের নড়াচড়ার কী তারতম্য হয়, তা দেখতে চেয়েছিলে, কিন্তু তুমি তাড়াহুড়ায় একটা স্টুপিডের মতো ভুলে গিয়েছিলে তখন আমাকে প্রশ্নটা করতে। হায়, তুমি জানো না যে তোমার ওই মিথ্যা প্রশ্নটা আসলেই একটা মিথ্যা প্রশ্ন। যেমন, ভিটগেনস্টাইন বলেছিলেন, “প্রিয় দেশবাসী, শত্রুকে হারানোর পরে বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে কী আছে, যা আমরা অর্জন করতে পারি না?” এটা একটা মিথ্যা প্রশ্ন, স্রেফ ফাঁকা বুলি আর এর প্রশ্নবোধক ভাবটা স্রেফ প্রশ্নের নাটকীয় গতি বাড়ানোর জন্যই করা। “সো হোয়াট?” “হোয়াট ডোন্ট ইউ গেট লস্ট?” “হোয়াট আর ইউ লুকিং অ্যাট?”—তিনি বলেছিলেন, এগুলোও তেমন, এদের প্রশ্নের মতো শোনায় বটে কিন্তু কোনো প্রশ্নই না এরা। ব্যাকরণ আমাদের এভাবেই ঠকায় পদে পদে, একইভাবে চিন্তা করার দিকে ঠেলে দিয়ে। “আমাদের জীবনের অর্থ কী?” সে রকমই একটা লোকঠকানো আমেরিকান প্রশ্ন মিস্টার বার্নস্টেইন, এবং “আমাদের জীবনের” বলে যে মহত্ত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বোধ এখানে তৈরি করা হচ্ছে, তার কারণে এটা আরও অর্থহীন, মনে হচ্ছে জেনারেল চেস্টার নিমিটস তার নিজের স্বার্থ মাথায় রেখে যেন এই প্রশ্নটা করছে। আমি তোমাকে এর বেশি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না শুয়োরের বাচ্চা উইলিস। আমেরিকার রাজনীতির কথাবার্তাগুলো যে কত ফাঁকা, “ওয়ার অ্যাগেইনস্ট টেরর” যে কত মিষ্টি কথা, তা তুমি ধরতে না পেরে ওদের কথায় নেচে নেচে সারা পৃথিবীর কত বড় ক্ষতি করে চলেছ প্রতিদিন, সে বিষয়ে তোমার কোনো ধারণা নেই। হোয়াট আ শেম!’
উইলিস বলতে লাগল, সে দুঃখিত, সে দুঃখিত। কিন্তু আমাকে কী এক কথা বলার নেশা পেয়ে বসেছে তখন। আমি সন্ধ্যার নাটুকে লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে সুরভি-মেহেরনাজ-ম্যারি অলিভারের মুখগুলো মনে করে হঠাৎই হিংস্র হয়ে উঠলাম, তা ছাড়া ওষুধের প্রভাবে আমার মাথাও তখন যথেষ্ট এলোমেলো, যথেষ্ট ভারী এবং জাহান্নামে যাওয়ার ইচ্ছায় পরিপূর্ণ। আমি এমবাসি বিল্ডিংয়ের এক করিডরের একটু নিরিবিলি এক কোনায় ঝট করে উইলিসকে টেনে আনলাম তার হাত ধরে। সে এল বিনা বাধায়। এবার আমি ফেটে পড়লাম আগেরবারের চাইতেও বেশি ক্রুরাচার ও রক্তপিপাসা নিয়ে, উত্তাল এক গলায়। বললাম :
“আমার কথা মন দিয়ে শোনো উইলিস। চাকরি করো তুমি, চাকরি করি আমিও। কিন্তু আমাদের জানতে হবে কী হচ্ছে পৃথিবীতে, কী হয় এখানে।’
এ পর্যায়ে আমি তাকে আমার কুকুরদাঁত দেখালাম নিজের মুখে আঙুল দিয়ে।
‘বাইরে অন্ধকার ও ভেতরে আলো জ্বলা মিটিং রুমগুলোতেই ঠিক হয় কী বলা হবে জনতাকে, কোন আইন পাস করা হবে, আর কীভাবে আইন ভাঙতে বাধ্য করে তাদের কাবু রাখা হবে চিরকাল। এটাই আবার ঠিক, আদারওয়াইজ রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা যাবে না, কারণ অ্যাবসলিউট শুভ, অ্যাবসলিউট ভালো ও অ্যাবসলিউট অবজেকটিভ বলে কিছু নেই, অ্যান্ড আই সাপোর্ট দ্যাট, এটাই মানবগোষ্ঠীকে সামনে এগোনোর ও প্র্যাকটিক্যাল বিহেভ করার ধারটা দেয়। ধার।’
এবার আমি বলতে বলতে একটা ছুরি, একটা চাকুর ধারের ইঙ্গিত করলাম আমার হাত দিয়ে।
‘দুটো বিপরীতমুখী শক্তি থাকতেই হবে, কিন্তু মডারেশন দরকার, কারণ ডান সত্যি ভালো না, ডানের শক্তিরা বিশ্বাস করে জোর করে মানুষ বদলানোয়। আমি মধ্য ডান, লিবারাল, আমার টলারেন্স বেশি। এগুলো ভেতরে ঢোকানোই থাকে। প্রকৃতি মানুষের সবচাইতে বড় হেল্প-গান, বই ও প্রকৃতি। মানুষের অসহায়ত্ব ভালো জিনিস, জেনারেলি সবচেয়ে ভালো এটাই যে অসহায়ত্বের বোধ থেকে মানুষ মিথ্যা কথা বলে, এটা তার সৃজনীক্ষমতা, অসহায়ের দর্প, এইটা দরকার উইলিস, এইটা দরকার, যার যার মত ও বিশ্বাস শক্ত করে এস্টাবলিশ করার জন্য এইটা দরকার, না হলে সব ওয়ান-সাইডেড হয়ে যাবে, ভার্টিকালি বোরিং হয়ে যাবে, এমন হয়ে যাবে যে ওপরে শুধু আল্লাহ, তারপর এলিট ও পাওয়ারফুলরা, তাদের মধ্যে আবার উঁচু-নিচু ভাগ, তারপর সাধারণ মানুষ, যারা ইনস্ট্রাকশনের গ্রহীতা, আর তাদের মধ্যেও ৩৩ ভাগ। খোদাও কি ফুল্লি অবজেকটিভ? তিনিও বেছে নেন কখন কোন জাতির কোন মুহূর্তে তিনি আসবেন তাঁর আয়াত ও তাঁর কালাম নিয়ে, কাকে তাঁর প্রফেট বানাবেন এবং কাকে ফ্রি উইল দিয়ে খুনি ও ডাকাত বানিয়ে রাখবেন।’
উইলিস শুনছে আমার চোখের গভীরে তাকিয়ে, আমি বলে যাচ্ছি বাচ্চাদের স্কুলে হঠাৎ ভিজিটে যাওয়া ইউনিভার্সিটি প্রফেসরদের মতো করে।
‘পৃথিবী লিরিক্যাল মিস্টার বার্নস্টেইন, যেমন তোমার এই বার্নস্টেইন নাম, এটাও লিরিক্যাল। পৃথিবীর সো-কলড সব সত্য লিরিক্যাল, তাই আমার এই পৃথিবীর কাছে চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এটা লিরিক্যাল বেদনা—মা, বাবা, বাচ্চা, জীবনসঙ্গী হারানোর বেদনা। এইটাই জীবনের যাতনা, দরিদ্র থাকার ভয়ের পাশাপাশি এটাই আরেকটা বড় যাতনা। শান্তি কেউ চায় না। ইমপসিবল।
এ পর্যায়ে আমি ‘ইমপসিবল’ বলতে বলতে আমার হাত দিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটের পাশটাতে বাড়ি মারলাম।
‘সবাই চেঞ্জ চায়। শান্তি কখনো চেঞ্জ চাইলে হবে না, চেঞ্জ কখনো শান্তি দিতে পারে না। চেঞ্জ মানেই উদ্বিগ্নতা এবং কারও না কারও প্রতি অন্যায়, কোনো বৃহত্তর ভালোর নামে কারও না কারও প্রতি অন্যায়। সো ইটস রং ফ্রম ইটস স্টার্টিং পয়েন্ট, কারণ এখানে কারও না কারও প্রতি অন্যায় হয়েই যায়, যার আবার জীবন ওই একটাই। ইটস ক্রুয়েল। ক্রুয়েলটি ইজ এসেনশিয়াল ফর দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ারস টু টেক শেইপ, সো দ্যাট কন্টিনিউয়াস চেঞ্জেস ক্যান হ্যাপেন। তার মানে যেহেতু অন্যায়ের শিকার একটা লোকও থাকছে পৃথিবীতে, সেহেতু ১০০ ভাগ ভালো বলে কিছু নেই, থাকা সম্ভব না। এমন এক পৃথিবী এটা, এমন এক পৃথিবী’—আমি হাত দিয়ে এই দালান, ওই মাঠ, ওই আকাশ, সব দেখালাম; আমার হাত যেদিকে যেদিকে যাচ্ছে, উইলিসের চোখও যাচ্ছে সেদিকে সেদিকে— যেখানে প্রত্যেকের এনটাইটেলমেন্ট আছে নিজের নিজের অপিনিয়ন রাখার, যেখানে সবকিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যায় ভাষা দিয়ে, শব্দ দিয়ে, প্রতিটা ভালো দিক খারাপ দিক একই রকম জোরের সঙ্গে তুলে ধরা যায়, হাহ্, তেমন এক পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য অ্যাবসলিউট ভালো বলে কিছু থাকা অসম্ভব’।
‘অসম্ভব’ কথাটা বলে আমি চাড়ালের মতো থুতু ফেললাম এমবাসির সীমানার ভেতরের এই পরিচ্ছন্ন মেঝেয়। উইলিস অবাক হলো, কিন্তু কিছু বলল না আমাকে।
‘বিল ক্লিনটনকে আমি কেন পছন্দ করি, জানো? কারণ, সে মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে ওই কাণ্ডটা ঘটাল। একজন শিক্ষিত মানুষ হঠাৎ আছাড় খেল কলার খোসায় পা রেখে। এখানে তার লোভ, সাহস ও বেপরোয়াভাবের ছাপ আছে এবং এই বেপরোয়াভাবটা ভালো সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ বা গোয়েরিং বা মেজর ফারুক, মেজর রশিদের বেপরোয়াভাবের চাইতে। সবই আপেক্ষিক, উইলিস। অ্যাবসলিউট ভালো বা খারাপ কেউ না, এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি ফারুক-রশিদ-নূর এরাও না, এরা, যাদের কথা আমি বছরের প্রতিটা দিন ভাবি, যারা আমার জীবনের একমাত্র অবসেশন, তারাও না। যে কবি চেশোয়াভ মিওশ লিথুয়ানিয়ার পাসপোর্ট দেখিয়ে নাৎসি না যেন রাশিয়ানদের থেকে জানে বেঁচেছে, সে-ও না। সব পোপ, সব ইমাম, ক্লাস নেওয়া সব প্রফেসর আর সব বৌদ্ধ সাধু এসব কথা বলে, মানে যা তারা বলে প্রতিদিন, বলে এই পৃথিবীকে নিয়ে, কারণ তারা যথেষ্ট এক্সপোজড হয়নি, তারা অধিকাংশই অর্ধশিক্ষিত, অর্ধজ্ঞানী। বঙ্গবন্ধু মুজিবের খুনিরাও একটা কিছুতে বিশ্বাস করেছিল, এই যে যে কারও ক্ষমতা মনে মনে একটা বিশ্বাস দাঁড় করানোর এবং তারপর নিজের লজিক দিয়ে সে জিনিস প্রাণপণে বিশ্বাস করে বসার, এ জন্যই পৃথিবীর মূল সত্য— অ্যানার্কি।’
অ্যানার্কি বা নৈরাজ্যের কথাটা বলে আমি দেখলাম আমার অসুস্থ লাগছে, আমি ঘামছি খুব, তবু থামলাম না, তবে আমার মনে হলো হঠাৎ এখনই আমার সব কাপড়চোপড় খুলে ফেলে এখানে কোনো কাকতাড়ুয়ার মতো শতভাগ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন হয়? কিন্তু না, আমি তা করলাম না এই এমবাসির লোকেরা তখন আমার পেনিসের শেপ ও সাইজ ‘জাজ’ করবে সেই ভয়ে।
বলতে লাগলাম, “উইলিস, জ্ঞানের কথা শোনো, জর্জ সানতায়ানা বলেছিলেন, প্রকৃতির সবকিছু মৌলিক চরিত্রে লিরিক্যাল, নিয়তিতে ট্র্যাজিক এবং অস্তিত্বে কমিক। এই একটামাত্র বাক্যের মধ্যেই আছে পৃথিবী কী ও পৃথিবীর পক্ষে কী হওয়া সম্ভব এবং সম্ভব নয়, তার পুরো সার। এ পৃথিবীতে মানুষ যা খুশি বিশ্বাস করতে পারে এবং তার জন্য লড়াই করতে পারে। বিশ্বাসটা লিরিক্যাল, লড়াইটা কমিক্যাল, আর লড়াইয়ের ফলটা—ট্র্যাজেডি। পুরোটাই সাবজেকটিভ ডিসিশন। হ্যাঁ, নৈরাজ্যের সংজ্ঞা এটাই। এ পৃথিবী নিয়ে আমার আশা বা নিরাশা, কোনোটাই তাই নেই। এটা একদিন একদম শেষ হবেই—এই নিষ্ঠুর সিস্টেম, এই এখানে জন্ম নিয়ে তারপর লড়াই করে বা না করে মৃত্যুর দিকে যাওয়া, এই যে মানুষের ক্ষমতা মিথ্যা বলার, সত্য বাঁকানোর, শব্দের ওপরে জোর খাটানোর, ব্যাখ্যা করার, বাড়িয়ে বলার, এই যে অধিকাংশ তত্ত্বকথা ইচ্ছাপূরণের, এই যে ডানের লোকগুলো তাদের ইচ্ছাপূরণের জন্য আগে উপসংহার টানে কোনো কিছুর, তারপর প্রথম থেকে সবটা সাজায় উপসংহারে পৌঁছানোর স্বার্থে; আর এই যে বামের লোকগুলোকে আমরা হয়ে উঠতে দেখলাম একটা স্তালিন, একটা মাও সে তুং, একেকটা ফ্যাসিস্ট। হাহ্, এখানে সিটবেল্ট একটা ইলিউশন। কোনো সিটবেল্ট আসলে নেই উইলিস, আর থাকলেও সেটা ইকুয়ালি মারণঘাতী। আমাদের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান মারা গিয়েছিলেন তাঁর সিটবেল্টের কারণেই।’
আমি থামলাম। বুঝলাম যা বলতে চেয়েছি তা বলা হয়নি, কিন্তু যা বলা হয়েছে, তার আঁকাবাঁকা আউটলাইনটাই যথেষ্ট উইলিসকে ঘৃণাভরে যা বোঝাতে চেয়েছি, তা বোঝানোর জন্য। উইলিস ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তার শরীরের গড়ন ও শরীরের ভাষা বৃদ্ধ মানুষের, চেহারা কিশোরের। আমি তার চোখের একেবারে ভেতরে তাকিয়ে সেখানে দেখতে পেলাম আশার ছলনার নানা জলবিন্দু। বললাম, ‘আসি।’
.
দুটো দিন পার হয়ে গেছে। আজ পঁচিশে আগস্ট, মঙ্গলবার। মেহেরনাজ আমার সঙ্গে সাময়িক যোগাযোগ রেখে চলেছে, চট্টগ্রাম থেকে। আমাদের কথাবার্তা এমন এক মাধ্যম দিয়ে হচ্ছে, যা ট্র্যাক করার ক্ষমতা কারোরই নেই। মেহেরনাজের বড় বোন তাসনিম হায়দার আমাদের এ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সে একদিন আমার বাসায় এসেছে পিংকি হিজড়ার সঙ্গে, বোরকা পরে। ঘরে ঢুকে বোরকা খুলেছে এবং আমাদের এই প্রথম পরিচয়ের প্রথম বাক্যই বলেছে, ‘থ্যাংক ইউ ফর সো সিস্টেমেটিক্যালি রুইনিং দ্য লাইফ অব মাই সিস্টার।
তার বোনের জীবন আমি কী করে ধ্বংস করলাম, জিজ্ঞাসা করতেই সে পিংকিকে বলল চলে যেতে, বলল সে নিজে পথ চিনে ফিরে যেতে পারবে, তারপর পিংকি দরজা বন্ধ করে চলে যেতেই সে বলল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার অবসেশনের গল্প সে তার বোনের কাছ থেকে শুনেছে, বলল, মেজর ডালিমের বউয়ের নামে তার নাম—তাসনিম, বলল, বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ মারা হলে ওই তাসনিম যখনই খুনিদের দেখত, যখনই তার দেখা হতো স্বামীর খুনি উপাধি পাওয়া বন্ধুদের সঙ্গে, তখনই তাসনিম থুতু মারত তাদের মুখে, বলল, ‘আমারও এখন আপনার মুখে থুতু মারতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমাদের বাবাও আমাদের দুই বোনের সঙ্গে এই কাজটা করেছেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের মানুষ করেছেন ব্রেইনওয়াশ করে করে। বাবা যেমন একটা অ্যাসহোল, আপনিও তেমন একটা অ্যাসহোল।’ আমি তার কথার কিছু বুঝলাম না, শুধু সাহায্যটা নিলাম, তার বোনের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপনবিষয়ক সাহায্যটা।
পাশাপাশি সুরভির সঙ্গে একদম নতুন পথে যোগাযোগ স্থাপন ও বজায় রাখতেও আমার সাহায্য এল পৃথিবীর একেবারে অন্য প্রান্ত থেকে। জন ব্রোকম্যান কথা বললেন আমাদের ডিজিএফআইয়ের জেনারেল জামালের সঙ্গে, বার্লিন থেকে। জেনারেল জামাল আমাকে ডাকলেন গুলশানে ফখরুদ্দিন বাবুর্চির বিরিয়ানির দোকানে এবং ফিসফিসে গলায় সব বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কীভাবে আমাকে সুরভির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এফবিআই, সিআইএর ছায়া এড়িয়ে।
সুরভিকে আমি বলে দিলাম, দিন এসে গেছে; যেহেতু মাঠে মেহেরনাজ নেই, তাই তাকে ওই দিনটার জন্য ঢাকা আসতেই হবে। সুরভি বলল সে অমুক তারিখে সকাল নাগাদ ঢাকা পৌঁছাবে অন্য পাসপোর্টে, অন্য নাম নিয়ে। তার নতুন নাম ‘অরুনিমা গুরুং’। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এই সুন্দর নামটা সে কোথায় পেল? সুরভি জানাল, এটা নেপালি দুই নামকরা অভিনেত্রীর নামের দুই অংশ—অরুনিমা লামসাল ও রিশমা গুরুং। আমি বললাম, ‘ভালো।’
ওই দিনই সুরভি আমাকে একটা ইউটিউবের গানের লিংক পাঠাল, বলল আমি যেন পরবর্তী দশ মিনিটের মধ্যেই গানটা শুনি, কারণ, এটাই পৃথিবীর সেরা গান, এর ওপরে কোনো গান হয় না। আমি শুনলাম গানটা। ব্যান্ডের নাম ‘The Shins’। গানের নাম ‘ Those to Come’। গানের সুর আসলেই ভয়ংকর সুন্দর এবং কথা অদ্ভূত :
They are cold
Still
Waiting in the ether to
Form
Feel
Kill
Propagate
Only to die
Dissolve
Magically, absurdly
They will end
Leave
Dissipate coldly
And strangely
Return.
উইলিস বার্নস্টেইনও যোগাযোগ রেখে চলেছে আমার সঙ্গে এবং যত সময় যাচ্ছে, তত সে আমার সত্যিকারের বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছে। সে এমিলি ডিকিনসনের কবিতার বিরাট ভক্ত, আমিও কিছুটা, আর তা আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে আমাদের যোগাযোগ ও কথাবার্তা রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে বেশ ব্যক্তিগত লেভেলেও চলে এসেছে। আমি তাকে বলেছি আমার ক্যাডেট কলেজে পড়ার দিনগুলোর গল্প, যে গল্প ছাড়া আমার জীবনে অন্য আর কোনো খাঁটি সোনা ধরনের গল্প নেই। সে এখন জানে আমার ক্যাডেট নাম্বার ২১৬। আমি তাকে সেই ১৯৮৩ সালের ছোটবেলার এক ছবিও দেখিয়েছি, যেখানে আমরা ৫৭ জন ক্যাডেট একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি খাকি পোশাক পরে, কোমরে বেল্ট ও কাঁধে অ্যাপুলেট লাগিয়ে এক দুপুর বা বিকেলে কলেজ বার্ষিকীর জন্য আমাদের ব্যাচের ছবি তুলতে। ছবিটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে দেখলাম, ময়লা ধরে গেছে তাতে, তবে সাইজে বিরাট বলে এখনো পড়া যাচ্ছে আমাদের সবার বাম বুকে লাগানো নেমপ্লেটগুলোর কয়েকটা। উইলিস ওই ছবির ক্লাস এইটের আমাকে একবার দেখে, আরেকবার তার সামনে বসা এই আমাকে দেখে ‘ইটস মেলানকোলিক, ইটস মেলানকোলিক’ বলতে বলতে তার চোখ ভিজিয়ে ফেলেছে। আমি তাকে বললাম এরপর যেন সে ‘ইটস লাইফ’, বা ‘দ্যাটস লাইফ’-মার্কা কোনো সস্তা, বহুল ব্যবহৃত উপসংহার না টানে।
আমি তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছি বলেই এবার তাকে বললাম আমার জীবনের আরেকটা গোপন কথা, আমার ২১৬ ক্যাডেট নাম্বারের মতোই আরেকটা গূঢ় জীবনসত্য। বললাম, গায়িকা পিজে হারভি ও আমার জন্মদিন একই সালে, একই দিনে – ১৯৬৯-এর ৯ অক্টোবর। এটার মধ্যে কী গোপনতা আছে, তা বুঝল না উইলিস। আমি তাকে ছোট একটা কাগজে লিখে দিলাম দুটো লাইন :
This Mess We Are In
by
PJ Harvey
এবং বললাম এই গানটা শুনতে, কারণ, ‘তাহলেই তুমি বুঝবে আমি কী বলতে চাইছি।’
উইলিস তার বুড়ো শরীর নিয়ে কিশোর চোখে আবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। বলল যে আমার চাপে সে বোর্হেস পড়া শুরু করেছে, এবং আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছে এলিজাবেথ বিশপ পড়ার। মার্কিন বড় কবি এলিজাবেথ বিশপের আমি নাম শুনেছি, কিন্তু কখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। আমি উইলিসকে বললাম, ‘পড়ব।’ উইলিস বলল, সে কাল রাতে বোর্হেসের একটা অণুগল্প পড়েছে, নাম ‘The Plot’। এবার উইলিস নিজে গেল আমার রান্নাঘরে, বলল, ‘সুন্দর গোছানো তো!’ জিজ্ঞেস করল-আমি তার মিনেসোটা অ্যাকসেন্টের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি রীতিমতো— ‘হ্যালো, তুমি বিয়ে করোনি কেন? হু কুকস ফর ইউ?’ দুটো প্রশ্নের একটারও জবাব দিলাম না আমি। উইলিস এবার আমাকে রান্নাঘর থেকে ডাকল চায়ের কাপ ও চিনি খুঁজে পাচ্ছে না বলে। আমি তা দেখিয়ে দিয়ে এলাম আর সোফায় বসে মেজর রাশেদ চৌধুরীর ব্যাপারে একটা রিপোর্ট পড়তে লাগলাম।
সেরনিয়াবাতের বাসায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো এই মেজর এখন আমেরিকায়। আমি রিপোর্টের ছবিতে রাশেদের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি, দেখতে পাচ্ছি ঘটনার পুরোটুকু—যা ছবিতে তার চোখের কর্নিয়াতে লেপ্টে রয়েছে বায়োস্কোপে দেখানো রিলের পর রিল হয়ে। আমি দেখলাম রাশেদের নেতৃত্বে দুই ট্রাক সৈন্য, তারা টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের, নামল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে পুবদিকে কিছুদূর গিয়ে এক ব্রিটিশ বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির সামনে–২৭ নম্বর মিন্টো রোড। আমি দেখতে পাচ্ছি, রাশেদ চিৎকার করে বলছে, ‘হারি আপ, হারি আপ’ এবং হাতের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে সৈন্যদের বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তাদের ওই বাড়িটার মধ্যে ঢুকতে হবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো সৈন্য কালো পোশাকও পরা, অর্থাৎ ল্যান্সারের, ট্যাংক বাহিনীর। শুনতে পাচ্ছি বাড়িটা লক্ষ্য করে গুলি চলছে, ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ছে জানালাগুলোর। তারা মূল দরজা ভেঙে ফেলল, বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল, তাদের চারজন তড়িঘড়ি দোতলায় উঠে গেল এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাত — বঙ্গবন্ধুর সেজ বোন আমেনা বেগমের স্বামী তিনি—ও মিসেস সেরনিয়াবাতকে নিচতলায় নিয়ে এল। তারা তাদের ঢোকার মুখের একটা ঘরের ভেতরে দাঁড় করাল। চারপাশে চিৎকার হচ্ছে ‘সারেন্ডার’, ‘সারেন্ডার’, অনেকগুলো বাচ্চা কাঁদছে, ১৫-২০ জনের একটা দল এখন ঘরের মধ্যে, তারা সিঁড়ি বেয়ে নামছে ও উঠছে, উঠছে ও নামছে এবং তাদের আরেক লিডার মেজর শাহরিয়ার বাড়ি কাঁপিয়ে বলেই যাচ্ছে, ভয় পাবেন না, সবাই নিচে নেমে আসুন, সবাই নিচে।’ আমি শুনলাম, বাচ্চা একটা মেয়ে, বেবি সেরনিয়াবাত, ক্লাস নাইনের ছাত্রী, বয়স বড়জোর ১৫, বলে উঠল, ‘আরে ভাই, ভয় পাব কেন? আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। মরতে একদিন সবাইকে হবে।’ আমি দেখতে পেলাম ঢোকার মুখের সেই ঘরটার ভেতরে কয়েকজন সৈন্য স্টেনগান হাতে তুলে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক একেবারে কিশোর বয়সী সৈন্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে জিজ্ঞেস করল, ‘নাম?’ সেরনিয়াবাত বললেন, ‘আবদুর রব সেরনিয়াবাত।’ সেরনিয়াবাতের স্ত্রী রাশেদ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কি আমাদের মারবেন?’ রাশেদ উত্তর দিল, ‘না, আপনাদের মারব কেন?’ এই কথা বলে রাশেদ তার স্টেনগান দিয়ে সেরনিয়াবাতের বুক ও মুখ বরাবর একবার ডান থেকে বামে, আরেকবার বাম থেকে ডানে ব্রাশফায়ার করল। আমি ছবিতে রাশেদ চৌধুরীর চোখের দিকে তাকালাম, অন্ধ চোখ, জ্যোতিহীন। বায়োস্কোপের রিল শেষ। আমি তার দুই চোখে আমার দুই আঙুল ছোঁয়ালাম, তারপর ধীরে ধীরে আঙুলটা ঢোকাতে লাগলাম তার চোখের ভেতরে, গভীরে, কাগজটা ফুঁড়ে একসময় আমার আঙুল দুটো অন্য পাশে বের হয়ে ঝুলতে লাগল কাগজ ও মেঝের মাঝখানের শূন্যে।
সে এক প্রচণ্ড ঘামের মুহূর্ত, প্রচণ্ড যাতনা ও উত্তেজনার মুহূর্ত, যখন কিনা হৃৎপিণ্ড উঠে আসে জিবের ডগায়, নাকের পেছনে। উইলিস কখন তার চায়ের কাপ নিয়ে পাশে এসে বসেছে জানি না, সে ইংরেজিতে লেখা ডেইলি স্টার-এর নিউজ রিপোর্টটার শিরোনাম পড়েই সব বুঝে গেছে। উইলিস এবার আমার দুই আঙুল অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে আনল ওই ফুটো হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের পাতাটা থেকে। বলল, “লিসেন, ডোন্ট অ্যাজিটেইট ইওরসেলফ সো মাচ। দিজ রাশেদ চৌধুরী ইন ইউএসএ ইজ সাফারিং মোর দ্যান অ্যানিবডি এলস। ডোন্ট ইউ থিংক সো? পুওর ম্যান। হি ইজ জাস্ট ওয়েটিং ফর হিজ লাইফ টু এন্ড। লুক অ্যাট হিজ আইজ, লুক অ্যাট হিজ আইজ।’
আমি বুঝলাম না ফুটো হয়ে যাওয়া দুই চোখের মধ্যে—যার মধ্যে আসলে এখন আমার আঙুলে করা গর্ত ছাড়া কিছুই নেই—কী দেখতে পাচ্ছে উইলিস। আজব।
উইলিস এবার অর্ধেক চা খেয়ে তার কাপটাই আমাকে এগিয়ে দিল। বলল, ‘খাও।’ আমি চা খাচ্ছি আর সে বলছে বোর্হেসের গল্প, ‘দ্য প্লট’, তার মতো করে, তার জবানে। ‘গল্পটা এই, সামান্য ১২-১৩ লাইন’, বলল উইলিস।
জুলিয়াস সিজারকে খুন করবার জন্য একটা বড় মূর্তির পায়ের কাছে সিজারকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে খুনিরা। তাদের ড্যাগারগুলো অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আর তখন, সিজারের মনের মধ্যে চলতে থাকা বিভীষিকার বোধকে পূর্ণতা দিতেই যেন, সিজার দেখলেন খুনিদের ওই ভিড়ের মধ্যে, ওই ড্যাগার, ওই ছোরার ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে তার পোষ্য, সম্ভবত তার নিজেরই সন্তান, মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। ব্রুটাসকে ওখানে দেখে সিজারের আত্মরক্ষার ইচ্ছাই তিরোহিত হয়ে গেল। তিনি বিস্ময়বোধক গলায় বলে উঠলেন : ‘তুমিও, ব্রুটাস?’ সিজারের সেই বেদনাবিধুর চিৎকার পরে অমর হয়ে থাকল শেক্সপিয়ার ও কুয়েভেদোর লেখায়।
এবার দ্যাখো নিয়তি কীভাবে পুনরাবৃত্তি, রূপভেদ ও সিমেট্রিকে পছন্দ করে। সিজারের সেই ঘটনার উনিশ শতক পরে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস প্রদেশের দক্ষিণে এক গাউচোকে—আর্জেন্টিনার কাউবয় বা রাখাল পেশার এরা-খুন করার জন্য ঘিরে ধরল এক দল গাউচো। ওই গাউচো যখন মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, সে দেখল খুনিদের দলে আছে তার নিজের পালিত পুত্রও এবং সে তখন হালকা ভর্ৎসনা ও ধীর বিস্ময় জানিয়ে-বোর্হেস বলছেন, তার বলা এই কথাটা কানে শুনতে হবে, পড়লে হবে না—তার পুত্রকে বলল, ‘Pero iché!’ ‘আররে, তুমি, এখানে?’ মারা গেল সে, কিন্তু সে জানে না যে তার এই মৃত্যুটা হলো কেবল ইতিহাসের একটা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জন্যই।
গল্প শেষ। আমরা দুজনে চুপ। উইলিস হাত রাখল টেবিলের ওপরে রাখা আমার হাতের আঙুলগুলোর আগার দিকে। আমি নুয়ে আছি। বোর্হেসের এই গল্প আমাকে মূক বানিয়ে দিয়েছে। উইলিস বলল, ‘ইন্টারনেটে পড়লাম, বোর্হেসের এই Pero iché বা Pero ché-র কোনো অনুবাদ অসম্ভব, এটা একান্তই আর্জেন্টিনিয়ান, এটা বুঝতে হলো বুয়েনস এইরেসের আবছায়া ক্যাফেগুলোতে একটা পুরো ছোটবেলা কাটাতে হবে। এর মানে হতে পারে, ‘কিন্তু! আরে!’, হতে পারে, ‘কিন্তু, মানে, ছাড়ো’, হতে পারে, ‘ছাড়ো তো, শেষ করো’, হতে পারে, ‘হেই! শেষ করো,’ হতে পারে, ‘কী? তুমি এখানে?’ হতে পারে, ‘ধেত্তেরি! কিন্তু!’
আমি তাকে থামতে বললে তখনই থামল উইলিস। মৃত্যুর ঠিক আগে নিজের সন্তানকে খুনির দলের মধ্যে দেখে একটা মানুষ কীভাবে কী বলতে পারে-ভয়ে নিশ্চয় নয়, বরং ঘৃণা, বিবমিষা, আক্ষেপ ও বিরক্তি মিলিয়ে—তার এই দীর্ঘ বর্ণনা আমাকে আরও বিবশ করতে তুলল। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হলো খুনিদের দলে নিজের বড় পুত্র শেখ কামালের বন্ধু নূরকে দেখে ঠিক কী বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, ঠিক কী ভাষায়, ঢাকার জবানে না গোপালগঞ্জের, স্পষ্ট বোধগম্য কোনো শব্দে নাকি আঞ্চলিক-প্রাদেশিক বর্ণনা-অযোগ্য কোনো সাংকেতিক অভিব্যক্তিতে?
আমি উইলিসকে বললাম, আমি সব সময়েই বিপদে পড়া মানুষদের দলে, মানে যারা মিসফিট, যারা সমাজচ্যুত, যারা নির্বাসনে আছে, যারা অসহায়। আমার কথার কী মানে বুঝল উইলিস, তা আমি জানি না। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে দেখলাম একটা ধূমকেতু তেরচাভাবে ডান থেকে বামে চলে যাচ্ছে, কাছে থেকে দূরে।
উইলিস বলল, ‘এই পৃথিবীতে সবচাইতে এক্সাইটিং আইডিয়া এটাই যে এই জাহাজে চড়ে বসা কেউ কোনো দিন শিখবে না কিছু, কোনো দিন কেউ বদলাবে না। ইতিহাস তাই পুনরাবৃত্তির সিকোয়েন্সে সাজানো, মালার পরে মালা গেঁথে। যারা বাঁচতে পারবে, তারা ভাগ্যবান, মানে যারা বেঁচে থাকছে।’
আমি বললাম, ‘তার মানে যেকোনো জায়গাকেই বেহেশত বলা যাবে যদি আমাদের বাইরে রাখা হয়।’ উইলিস বুঝল না আমার কথা।
আমি তাকে বললাম, ‘এই যদি হয় পৃথিবী তো তাহলে আমরা তো নরকে আছি। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে আমাদের মূল আশা তো বেহেশতে ঢুকতে পারার। তার মানে আমাদের রাখা হয়েছে বেহেশতের বাইরে। তার মানে, বলছি যে, যে জায়গাটার বাইরে আমরা দাঁড়ানো, ভেতরে না, বাইরে, সেটাই বেহেশত। আমরা এই পৃথিবীতে সেই বেহেশতের বাইরে নরকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ফকিরের মতো।’
উইলিস আমাকে বলল, ‘তুমি অনেক ঘুরিয়ে কথা বলো। বাট ইউ ডু টক বিউটিফুলি।’ এরপর উইলিস আমাকে দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম, “আমি বেশি কিছু জানি না। মোটামুটি। এই মোটামুটি। লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের দুই ভাই আত্মহত্যা করেন ১৯০২ ও ১৯০৪-এ, এবং ভিয়েনার শিল্পী গুস্তাভ ক্লিমট ১৯০৫ সালে ভিটগেনস্টাইনের বোন মার্গারেটের বিয়েতে একটা দুর্দান্ত বিয়ের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। দেখবে? আমার কাছে আছে ভিটগেনস্টাইনের একটা জীবনীর মধ্যে।’ উইলিস তা দেখতে চাইল না। সে বলল, আমার সঙ্গে তার আসলে সিরিয়াস কথা আছে।
আমি বললাম, ‘বলো।’
উইলিস, আমরা ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তখনো, তার নিজের ফোনের সুইচ অফ করল, আমারটাও আমাকে দিয়ে করাল, তারপর (গোপনে) স্বীকার করে বসল যে পুরো প্রজেক্টটার পেছনে সে আমেরিকান সরকারের তরফ থেকে আর না পাচ্ছে রিসোর্স, না পাচ্ছে কোনো তাড়া, ব্যাপারটা এমন যেন মাত্র দশ দিনে পরিস্থিতি ঘুরে গেছে পুরোপুরি, ব্যাপারটা এমন যেন ওয়াশিংটনের কাছে ওই বিকট শব্দের বিষয়টা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এই কদিনেই। তাই দিন দিন হতাশা তাকে গ্রাস করছে, সে বুঝতে পারছে না এখন তার কী করা উচিত, ভাবছে তার লোকজন নিয়ে দেশেই ফেরত চলে যাবে।
‘নিশ্চয়ই পেন্টাগনের হাতে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় চলে এসেছে। আমি শুনেছি তারা ইরাক, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়া নিয়ে পরপর ঘটে যাওয়া তিন ঘটনায় খুবই ব্যস্ত। বাংলাদেশে এক শব্দের পেছনে পড়ে থাকা এই আমার জন্য তাদের অত ধৈর্য ও সময় নেই, আর এখানকার অ্যাম্বাসেডরও ওয়াশিংটনকে যা-তা কী সব বোঝাচ্ছে মনে হয়, সে আমার পরিকল্পনাকে কোনো একটা কারণে আন্ডারকাট করছে,’ বিষণ্ণ গলায় বলল উইলিস। ‘কোনো একটা কারণ’ বলতে সে আজমত সাহেবের সর্বময় ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করল কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
এরপর সে আমার কানে কানে বলল, ‘তুমি এগিয়ে যাও। আমরা মনে হয় আর এগোচ্ছি না। আবার হতেও পারে তিন-চার দিনের মধ্যেই সব, আমার এজেন্সির জন্য সব, আগের মতোই হয়ে যাবে। তুমি জানো ওরা কত বড় একটা কাণ্ড ঘটাতে চাচ্ছে। তুমি সাবধানে নিজের মতোই এগিয়ে যাও, আর আমাকে জানিয়ো যে কী করতে পারলে।’ তার কথাবার্তা আমার কাছে বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া এক অসহায়, দরিদ্র বৃদ্ধের কথার মতো শোনাল। আমি তাকে বললাম আমি থেমে নেই, আমার ইন্টারোগেশনের পরের দিন থেকে আমি এগিয়েই চলেছি, একা (এটা আমি মিথ্যা বললাম, কারণ, এক স্বার্থপর আমেরিকানের কাছে মেহেরনাজ বিষয়ে আমার সবকিছু খুলে বলার কোনো কারণ নেই। কোনো কারণ নেই এটাও বলার যে সুরভি মূল অপারেশনের দিনে ঢাকা আসছে আমাকে সাহায্য করতে)। তাকে আমি আরও বললাম যে সবকিছু আমার কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আমি সব লিঙ্ক ধরতে পারছি এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর বেশ কাছাকাছিই চলে এসেছি। এ পর্যায়ে আমি আবার তাকে আমার চূড়ান্ত অভিযানের তারিখ হিসেবে একটা ভুল দিনের কথা জানালাম। আমার নিজের বাসায় যেহেতু কোনো লাই ডিটেক্টর মেশিনের সামনে আমি বসে নেই. তাই সত্য বলার কোনো বাধ্যবাধকতাও আমার ছিল না।
.