আগস্ট আবছায়া – ৪.৩

৪.৩

এর পরের দিন, ১৬ আগস্ট, এক দিনের সরকারি শোক দিবস চলছে, স্কুল-কলেজ-অফিস-বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ, আমরা দুজনে— আমি ও মেহেরনাজ—প্রচুর হাঁটাহাঁটি করলাম বালু নদের শুকিয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ তীর ধরে কে ব্লক, এফ ব্লক, জে ব্লকের গোলকধাঁধায়, সুরকি বিছানো নানা রাস্তায়, কাদামাটির নানা পথে, অনেক জংলি বাদামের গাছ, অনেক চালতা, নিম, পান্থপাদপ, বাতাবিলেবু, ঝুমকোলতা, তুলসী, করবী, গোল্ডেন শাওয়ার ও থানকুনিদের গন্ধ ও পাতার ছায়ায়। এই প্রথম বাংলাদেশে কোথাও দেখলাম আফ্রিকান টিউলিপ, বাংলা নাম রুদ্রপলাশ; এই প্রথম ঢাকার কোথাও লক্ষ করলাম এত বিশাল গাবগাছ, যার নিচু ডালে বসে কথা বলছে এক ধলাগলা বুলবুল ও এক হলদে-ভুরু ফুটকি। বুলবুলটার বিষণ্ণ দৃষ্টি দেখে আমি বুঝলাম ভালোবাসা জরুরি এক বিষয়, আমি হাত ধরলাম মেহেরনাজের; আর একই পাখির শশব্যস্ত ডালে ডালে লাফানো এবং ফুটকিকে কোনো রকম বিদায় না বলে তার চলে যাওয়া দেখে বুঝলাম তাত্ত্বিক অর্থে যদিও ওই বিকট শব্দের কারণটাই মূল, তবু তার উৎস খুঁজে পাওয়াটাই এখানে আসল কথা। 

একটা জিনিস খেয়াল করলাম আমরা। আমরা যেখানে যাচ্ছি, দেখছি যে তার আগে বা পরে চার-পাঁচজন লোকের একটা দলও সেখানে যাচ্ছে কিংবা সেখান থেকে স্থান ত্যাগ করছে। আমি মেহেরনাজকে বললাম, ‘পিস্তল কাছে রাখা দরকার ছিল।’ মেহেরনাজ খুব স্বাভাবিক গলায় আমাকে বলল যে তার কাছে একটা ‘বেরেট্টা নাইন এমএম সেমি অটোমেটিক আছে, ট্রিগার অ্যাকশন ডাবল, হাইলি রিলায়েবল, ওপেন-স্লাইড, ফাস্টার সাইকেল টাইম, এক্সেপশনাল অ্যাকুরেসি, ওয়ার্ল্ডের মোস্ট ট্রাস্টেড মিলিটারি ও পুলিশ পিস্তল এইটা, সো ডোন্ট ওরি।’ মেহেরনাজ ভয়ংকর, মেহেরনাজ সাংঘাতিক, মেহেরনাজ সমুদ্রগর্ভের আস্ফালন, মেহেরনাজ মেঘবহ্নি। 

এই দলগুলোর যিনি প্রধান, সেই সরফরাজ নওয়াজ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সন্ধ্যা নামার একটু আগে মেহেদি মার্টের পাশে। তিনি খানিক সময় নিয়ে মেহেরনাজকে লক্ষ করলেন। মেহেরনাজ তাঁর সালামের জবাবও দিল না, পা বালুতে ঘষে ঘষে একটা ডিজাইন বানানোয় ব্যস্ত থাকল। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার শরীর কেমন? আমি বললাম, ‘ভালো।’ তিনি বললেন, আমি যখন হাসপাতালে ঘুমিয়ে আছি, তখন এক ডাক্তার তাঁকে বলেছিলেন, এই রোগীর মূল সমস্যা টেনশন করা। ‘টেনশন করবেন না, মাইন্ড কন্ট্রোল করাটা যে কী জরুরি!’ বললেন তিনি আমাকে। আমি জানতে চাইলাম তাঁর লোকগুলো কী খুঁজছে, আমি যেখানে যাচ্ছি, তাদের দেখতে পাচ্ছি—এই সব। তিনি একবার মেহেরনাজের দিকে, একবার আমার দিকে, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘আপনারা দুজনে যা খুঁজছেন, আমরা কজন মিলেও তা-ই খুঁজছি। পার্থক্য হলো, আপনারা খুঁজছেন শয়তানকে, আমরা খুঁজছি খোদাকে।’ 

তাহলে মেহেরনাজের সেই প্রাথমিক অনুমানই সত্য ছিল। তার মানে এখানে এমন মানুষ আছেন, যাঁরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে ওই শব্দ কোনো দয়াল খোদার তরফে আসমান থেকে এসেছিল, যদিও হতে পারে তা মাটিতে উৎপন্ন। নিৎশে ১৮৮৭ সালে বলেছিলেন, খোদার মৃত্যু একটা সাম্প্রতিক ঘটনা, এবং ইতিহাস বলে (সিসেরোর ভাষ্যমতে) ডায়াগোরাস একদিন দেবতা হেরাক্লিসের কাঠের মূর্তি কেটেকুটে নিয়ে গিয়েছিল তার শালগম সেদ্ধ করার কাজে এবং সোজাসুজি ঘোষণা রেখেছিল যে ঈশ্বর, দেবতা, সৃষ্টিকর্তা—এসব কোনো কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি একজন বিশ্বাসী মানুষ, কিন্তু এতগুলো শিশুকে চিরদিনের জন্য বধির করে দেওয়া ওই বিকট শব্দের ওপর খোদাত্ব আরোপ করার এই হীন চেষ্টার আমি প্রতিবাদ না করে পারলাম না। বললাম, ‘পঁচিশজন মানুষের মৃত্যু ঘটানো ওই শব্দ আর হাজারখানেক বাচ্চাকে কালা বানিয়ে ছাড়া ওই শব্দ যদি খোদার কাজ হয়ে থাকে তো সেটা আপনার ভাবনার দোষ, খোদার দোষ না, কারণ খোদা অমন কাজ করতে পারেন না। এতগুলো মানুষের কানে ঝিঁঝিঁ, এতগুলো মানুষের দুই কানের ব্যালান্স হারায়ে ভারটিগো, এটা খোদার কাজ?’ 

তিনি আমার দিকে প্রায় তেড়ে এলেন, তার সঙ্গী চার-পাঁচজন হুজুর গোছের মানুষ তৈরি হলেন তাঁদের বসকে সাহায্য করবার জন্য। আমি দেখলাম মেহেরনাজের হাত চলে যাচ্ছে তার কাঁধের বড় ব্যাগটার ভেতরে, আমি তাকে চোখ ইশারায় বললাম, ‘খবরদার’, আর সরফরাজ নওয়াজ আমার মুখের একেবারে ওপরে গড়িয়ে গড়িয়ে উঠতে চেয়ে থেমে গেলেন, বললেন, ‘খোদা কী কাজ কেন করেন, তা যদি আপনি জানতেন, আমরা কেউ জানতাম, তাইলে তো কথাই থাকত না। যা জানার না, তা জানার চেষ্টা করবেন না। মানুষের জ্ঞানের দৌড় তার মাথার ওই সামান্য কয় আউন্স মগজের মাপে, এটা মনে রাখবেন। শব্দটার পেছনে শয়তান খুঁজছেন, খুঁজুন, বাধা দিচ্ছি না, কিন্তু মেয়ের বয়সী ছাত্রীকে সঙ্গে করে যে দিন নেই, রাত নেই ঢ্যাং ঢ্যাং’–এটা বলার সময় হালকা নেচে উঠল তাঁর এক পা— ‘ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেটা ভালো হচ্ছে না।’ 

তাহলে সামাজিক অপরাধ করে ফেলছি আমি ও মেহেরনাজ —শিক্ষক ও ছাত্রী, বয়স বেশি ও বয়স কম এবং অবিবাহিত। এখন আমি আর অবাক হব না যদি দু-এক দিনের মধ্যে দেখি বসুন্ধরার সব দেয়ালজুড়ে আমার ও মেহেরনাজের ‘প্রেমলীলা’ নিয়ে পোস্টার পড়ে গেছে, ঠিক যেভাবে আজ সকালে দেখলাম এই এলাকার সব দেয়াল ভরে গেছে পিংকি হিজড়ার তরতাজা বাণী দিয়ে : 

প্রিয় এলাকাবাসী, আসসালামু আলাইকুম। আমরা হিজড়া সম্প্রদায়ের লোক, আমরা এই থানাতে ২৮৫ জন হিজড়া বসবাসকারি [বানান ভুল]। আপনাদের দয়ার ওপর নির্ভর করে আমরা জিবিকা [বানান ভুল] নির্বাহ করি। এত বড় একটা ঈদ গেল, আর আমরা প্রায় না খেয়ে থাকলাম। এখন আসলো এই বিভৎস বিরট [ভুল বানান] আওয়াজ। আপনারা অনেক দান খয়রাত করছেন, সদগাহ দিচ্ছেন, মানত রাখছেন, কত টাকাপয়সা কত দিকে খরচ করছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির জন্য। আপনাদের ওই সকল দান-জাকাতের অংশ থেকে আমাদের মতো লাঞ্চিত-বস্থিত [ভুল বানান) মানুষদের জন্যও একটু অর্থ বরাদ্দ রাখবেন। আমরা ওই আওয়াজের খোঁজ আপনাদেরকে দিবই, দোয়াও দিব। হিজড়ারা যা পারে সাধারণ মানুষ তা পারে না, মনে রাখবেন। যোগাযোগ : পিংকি # 01712755…। [ফোন নাম্বার আমি ঢাকলাম।] 

সরফরাজ নওয়াজের সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না। খোদা কি মানুষের প্রার্থনার উত্তর দেন? যদি দেন তো কীভাবে দেন? খোদাকে সত্যিকারের খোদা হতে হলে এমনই এক খোদা হতে হবে, যার কাছ থেকে এসেছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং যিনি চালু রেখেছেন এই মহাযজ্ঞকে—কেবল তাহলেই আমাদের এত হাজার বছরের এত প্রার্থনা, এত পূজা-অৰ্চনা, এত বলি ও উৎসর্গের যোগ্য বলা যাবে তাঁকে। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে আমাদের খোদা সত্যিকারেরই খোদা—এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা। কিন্তু শতসহস্র বছরের এত প্রার্থনার উত্তরে এই শব্দ, এই বিকট আওয়াজ কী করে খোদার কাজ হতে পারে? আর অন্যদিকে খোদার গজবের মধ্যে যদি আমরা এর উত্তর খুঁজি, তাহলে হিটলার বা স্তালিন তো বলবে ওরকম লাখ লাখ লোক আমরা মেরেছিলাম মানবজাতির জন্য অন্য রকমের এক ভালোবাসা থেকেই। বিশ্বাসীরা বলে, খোদা তাঁর নিজের চেহারার কিছুটা দিয়ে দিয়েছেন প্রতিটা মানুষের চেহারার মধ্যে; মানুষ সশ্রদ্ধচিত্তে তার প্রতিদানে খোদাকেও তো কম দেয়নি এত হাজার বছর ধরে, প্রতিদিন? সেই বিচারে, শেষমেশ, আমাদের ওপরে খুশি এক খোদাকেই তো ধারণা করা যায়। অতএব যুক্তি বলে—সরফরাজ সাহেবরা যতই মাথা ঝাঁকিয়ে না বলুন না কেন—ওই বিকট শব্দ কিছু বিকৃত শক্তির কাজ, যার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত হিজড়া পিংকি পর্যন্ত রেখেছে তার পোস্টারে, তার বাণীর আড়ালে। 

মেহেদি মার্ট হয়ে আরও এক কিলোমিটার উত্তরে, বালু নদের একেবারে বালুর পাড়ে এক সারি ছন্নছাড়া নিমগাছের একটার তলায় বসলাম আমরা দুজন, নীরব। আমার মনে পড়ল বিভূতিভূষণের কথা : ‘স্তব্ধ দুপুরে ফাল্গুন-চৈত মাঝে এখানে বসিয়া পাখির কূজন শুনিতে শুনিতে মন কত দূরে কোথায় চলিয়া যাইত, বন্য নিমগাছের সুগন্ধি নিমফুলের সুবাস ছড়াইত বাতাসে।’ নিমফুলের মধুর মতো গন্ধ আমি ঠিকই নাকে পাচ্ছি, সন্ধ্যা নামি নামি করছে, ওপারে দূরে পৃথিবী না অন্য কোনো গ্রহের দিগন্তরেখা তা বোঝা যাচ্ছে না, আকাশের রং এতটাই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আমি মেহেরনাজকে বললাম, ‘টাকা হলে একবার রাশিয়া যাবই যাব।’ মেহেরনাজ বলল, ‘চলেন যাই। অত টাকা লাগে না রাশিয়া যাওয়ার জন্য। আমি দেব।’ আমরা চুপচাপ। মেহেরনাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন রাশিয়া?’ 

আমি মেহেরনাজকে সুগভীর কণ্ঠে ব্যাখ্যা করলাম কেন রাশিয়া। তাকে বললাম বা নিজেকেই বললাম এই কথাগুলো : আমি তুলায় যেতে চাই, তুলা শহর থেকে একটু দূরে, বাইরে, রাশিয়ান স্তেপের কাছে, দেখতে চাই তুর্গেনেভের দেখা গভীর ও উদারহৃদয় সন্ধ্যাগুলো কীভাবে নামে উঁচু কোনো বালিয়াড়ি থেকে অনেক বালু নিচে ঢাল বেয়ে নামবার মতো করে। তারপর যাব পাইয়াতিগরস্ক, তুলা থেকে খুব বেশি দূরে হবে না সেটা, সেখানে ১৬ নম্বর বাসে চড়ে গিয়ে নামব মেস্তো ডুয়েলি স্টেশনে, মাশুক পাহাড়ের ঢালে, সেখানে বাঁ দিকে মাথা তুলব, চোখে পড়বে ককেশাস পর্বতমালা। পুশকিন বলেছিলেন, এই সেই জায়গা, যেখানে পাহাড়ে-পর্বতে চলে সশস্ত্র ডাকাতি আর এর বোবা নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে লেখক-কবিদের প্রেরণার বন্য সৃজনীশক্তি। লেরমন্তভ এই অঞ্চলের ব্যাপারে নিজে লিখে গেছেন—কী এক মহিমাময় স্থান। যেখানেই যান দুপাশে পাবেন অনতিক্রম্য পর্বত, লাল রঙের উচ্চভূমি, সেগুলো ঝুলে আছে সবুজ আইভির ঝাড়ে আর তাদের মাথার মুকুট হয়ে আছে প্লেন গাছেদের দল; আছে হলুদ সব খাড়া প্রপাত, তারা ঢেকে আছে জল নিষ্কাশন করা গিরিখাত দিয়ে, আর আরও ওপরে দ্যাখো, মেহের দ্যাখো, আরও ওপরে বরফের সোনালি আঁচল। 

মেহেরনাজ চুপ। সে তার ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়ে ভেতর থেকে পানির বোতল বের করল একটা, পানি দিয়ে মুখ ধুলো, মুখ মুছল না। আমি তার ঘাম ও পানিতে স্নাত শিশুমুখ দেখছি, সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে দুদ্দাড় করে, কোথায়ও একটা কোনো পাখি নেই, মানে যারা দল বেঁধে থাকে সন্ধ্যার আকাশে। বুঝলাম পাখিদের দল তাদের নিজেদের সংকেতে সংকেতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা আপাতত এড়িয়ে চলবার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। মেহেরনাজ বলল, ‘আমি আপনাকে একদিন রাশিয়া বেড়াতে নিয়ে যাব, শিওর। কবি লেরমন্তভের মৃত্যুর গল্প আপনার কাছ থেকে আগে শুনেছি। মর্মান্তিক।’ আমি তাকে বললাম, ‘তোমাকে বলিনি যে লেরমন্তভ মারা গেলে কী বলেছিলেন রাশিয়ার জার।’ মেহেরনাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী?’ 

আমি তাকে বললাম পুশকিনের মৃত্যুতেও কীভাবে জারের হাত ছিল, বললাম, ‘পুশকিনের আনেগিন, লেরমন্তভের পেচোরিন। আমার কাছ থেকে নিও লেরমন্তভের উপন্যাস আ হিরো অব আওয়ার টাইম, পেচোরিনের গল্প। লেরমন্তভ মার্টিনভের সঙ্গে ডুয়েলে মারা গেলে এই ২৬ বছর বয়সী কবির ব্যাপারে জার নিকোলাস দ্য ফার্স্ট বলেছিলেন, “আ ডগ ডায়েড আ ডগস ডেথ।” একটা কুকুরের হয়েছে কুকুরের মৃত্যু। একটা কুকুর মরেছে কুকুরের মৃত্যু। মৃত্যুর দিনে শেখ কামালেরও বয়স ছিল ২৬ বছর। ২৬ বছর ১০ দিন। আর শেখ কামাল তাঁর পায়ে প্রথম গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরে মেজর হুদা চিৎকার করে বলেছিল, “এই কুকুরের বাচ্চা, সোজা হয়ে দাঁড়া,” যেন সে ব্রাশফায়ার করতে পারে কামালের বুকে। 

.

শব্দটা ঘটবার ঠিক ছয় দিনের মাথায় আমাকে এক ধাক্কায় এই শব্দসম্পর্কিত ধর্মতাত্ত্বিক বাদ-প্রতিবাদের বাইরে নিয়ে গেল ইউএস এমবাসি থেকে আমার মোবাইল ফোনে আসা একটা কল। স্পষ্ট আমেরিকান উচ্চারণে, বাক্যের দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনে থামা থামা এক ভারী পুরুষকণ্ঠে আমাকে বলা হলো, ‘প্রফেসর সাহেব, আমরা খুব খুশি হব যদি আজ বিকেলে আপনি একটু অনুগ্রহ করে ইউএস এমবাসির মূল গেটে এসে নিজের পরিচয় দেন। আমাদের প্রতিনিধি উইলিস বার্নস্টেইন আপনাকে গেট থেকে ভেতরে নিয়ে আসবে। আমরা আপনার গত ছয় দিনের কর্মকাণ্ডে অনেক খুশি, অনেক বিস্মিত এবং তা ভালো অর্থেই। আর আপনাকে আমরা এই দাওয়াতটা দিচ্ছি স্রেফ কফি খেতে খেতে সামান্য গল্প করার জন্য। তাই আমরা যথেষ্ট প্রীত হব যদি আপনি এখানকার কোনো এজেন্সির কাছে এ বিষয়ে কিছু না বলেন। এখন ঘড়িতে বাজে বেলা আড়াইটা, আর গেটে মিস্টার বার্নস্টেইনের সঙ্গে আপনার দেখা হবে ঠিক চারটায়, যদি আপনি চান তো। তবে আপনার সহকর্মী মিস মেহেরনাজ হায়দার এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে বসে আছেন। ধন্যবাদ, প্রফেসর।’ 

আমি ফোন রেখে একটা সাদা জামা (ফুলহাতা) ইস্তিরি করতে লেগে গেলাম। এই ফোনের হুমকি আমার কাছে পরিষ্কার। মেহেরনাজকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে এবং সে কারণে আজ বেলা এগারোটা থেকে মেহেরনাজ আমাকে না বলে-কয়ে হাওয়া। আজ আমাদের কথা ছিল আমরা বসুন্ধরার কোরিয়ান পল্লির বাইরের দিকটাতে যাব, পল্লিতে ঢোকার মুখে যে লোহার অদ্ভূত সব সি-স তারা তৈরি করেছে, সেগুলোর সামনে মেহেরনাজ আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। এমনকি মেহেরনাজ আমাকে সকাল নয়টায় ও ফোনে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘স্যার, ভাবছিলাম কোরিয়ানদের জন্য একটা নেড়ি কুত্তা ধরে নিয়ে যাব গিফট হিসেবে। কিন্তু সত্যি করে বলছি, এই কোরিয়ানরা পল্লি বানানোর পর থেকে আজ প্রায় নয়-দশ মাস হয় বসুন্ধরায় একটাও, একটাও, কুকুর নেই। হা-হা।’ 

ইউএস এমবাসি, তার মানে আমাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল, তার মানে বাংলাদেশের ডিজিএফআই-এনএসআই-ডিবি-এসবির বাইরে এফবিআই-সিআইএও মাঠে সক্রিয়। কিন্তু আমি বা মেহেরনাজ কেউই তো কাউকে বিন্দুমাত্র বুঝতে দিইনি আমাদের অনুসন্ধানের অগ্রগতি, যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়ার উত্তেজনা থেকেও না। উল্টো আমরা বসুন্ধরা চষে বেড়িয়েছি দুই আলাভোলা, উদ্‌ভ্রান্ত, লক্ষ্যহীন ও লক্ষ্যের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনাহীন ভবঘুরের মতো। আমাদের কুশলী সেই সব পদক্ষেপ তাহলে ব্যর্থ? এখন ইউএস এমবাসি দৃশ্যপটে ঢুকে আমাদের নিখুঁত শেষ কটা ধাপ কি তবে নষ্ট করে দেবে? সবকিছু ভজকট পাকিয়ে দেবে? জিওপলিটিকসের কোন অজ্ঞাত প্যাঁচ ও প্রয়োজনীয়তার কাছে এখন মার খেতে যাচ্ছি আমরা? এসব ভাবতে ভাবতে এবং দরদর করে ঘামতে ঘামতে আমি গরম ইস্তিরিতে আমার জামার হাতার নিচ দিকটা পুড়িয়ে ফেললাম। তবে হাতার ওই অংশটা বারাক ওবামার মতো স্টাইলিশ ভঙ্গিতে গুটিয়ে পরে ফেলা যাবে বলে, জামা পুড়ে যাওয়া নিয়ে আর বেশি বিচলিত হলাম না। 

বিকেল চারটার দুই মিনিট আগে পৌঁছে গেলাম এমবাসির মূল গেটে। যথেষ্ট মোটা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে প্রবীণ কিন্তু চেহারায় তরুণ এক আমেরিকান হেঁটে এল আমার দিকে এবং এক ঝটকায় আমাকে, গেটে কোনো রকম কোনো এন্ট্রি ছাড়াই, ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল। ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে সে আমাকে বলল, তার নামই উইলিস বার্নস্টেইন এবং ‘অবশেষে’ আমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় সে প্রীত আর ‘হঠাৎ’ এভাবে আমাকে ডেকে আনতে হলো বলে সে দুঃখিতও বটে। আমরা এমবাসি বিল্ডিংয়ে ঢোকার আগে সে আমাকে থামতে বলল একটু, নিজে মার্লবোরোর প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট নিল, আমাকে অফার করল না কিংবা আমার সঙ্গে কোনো কথাও বলল না। এক অনিশ্চয়তায় আমার বুক কাঁপছিল পুরোটা সময়। আমি আমার ভাঁজ করা জামার হাতার ভেতরে লুকানো পোড়া অংশটার কথা ভাবতে লাগলাম, এবং দূরে এক বিকট শব্দের আক্রমণের সামনে ভূতলশায়ী হয়ে যাওয়া বসুন্ধরার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, বুঝলাম আমার ভুল হয়ে গেছে; কাউকে-কোনো পত্রিকা অফিস, ভার্সিটিতে আমার ডিপার্টমেন্ট বা স্থানীয় ভাটারা থানায় আমার পরিচিত ওসি কিংবা ডিবিতে কাজ করা আমার চাচাতো ভাই নয়ন—ওদের কাউকেই না জানিয়ে এখানে এভাবে হুট করে চলে আসাটা আমার ঠিক হয়নি। এখন যে কাউকে ফোনে সেটা বলব তার উপায়ও আর নেই। ওই গাল ভরে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে থাকা, চিন্তিত চেহারার মিস্টার বার্নস্টেইন গেট পেরিয়ে ভেতরে হেঁটে আসবার সময় আমার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই আমার মোবাইল ফোনটা নিয়ে নিয়েছে। 

ভেতরে করিডরের পর করিডর, রুমের পরে রুম পেরিয়ে শেষে আমাকে বসানো হলো ছোট্ট এক বর্গাকার ঘরে। সেখানে আমি দেখলাম এক পাশে রাখা একটা চেয়ার, সামনে একটা টেবিল, টেবিলে অনেক ফাইলপত্তর এবং উল্টো দিকে দুটো চেয়ার, ওগুলোর পাশেই আরেকটা ছোট টেবিল, তাতে একটা ঝকঝকে অ্যাপল ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং আরও কিছু অ্যাপল লোগো লাগানো এটা-সেটা। পুরো ঘরটা, মূলত এর চতুর্ভুজের সব বাহুর দৈর্ঘ্যের এতখানি সমতার কারণে, দেখলেই বোঝা যায় যে এটা কোনো ইন্টারোগেশন রুম। তারা যে আমাকে বলেছে আমার সঙ্গে একটু গল্প করবে, কথা বলবে, তা মিথ্যা ছিল তাহলে। গল্প করা বা আলাপ করার রুমে সোফা থাকে, দৃশ্যমান এসির হাওয়ার চলাচল থাকে, সামনের সেন্টার টেবিলে ম্যাগাজিন থাকে, দেয়ালে ছবি ঝোলানো থাকে আর থাকে গরম চা-কফির উষ্ণতা। না, কফি এখানেও এল একটু পরেই, যখন কিনা আমি মাত্র বসেছি টেবিলের সে পাশটায়, যেখানে একটামাত্র চেয়ার রাখা। 

আমার উল্টো দিকে মুখোমুখি বসল উইলিস বার্নস্টেইন। জানালা থেকে তেরচা হয়ে তার মুখের ওপর পড়া আলোর কারণে এতক্ষণে আমি প্রথম দেখলাম যে তার বাম গালে গভীর এক পোড়া দাগ, ছোট আকারের এবং তার চেহারাটা কোনো তরুণের নয়, স্রেফ কিশোরের। শরীরের গড়ন ও চেহারার মধ্যে এতখানি অসামঞ্জস্য আমার এই প্রথম দেখা। এর আগে কাজ ও চেহারার মধ্যে বেমিল আমি দেখেছি, যেমন গোয়েবলস ও সিমন বলিভার; কিন্তু বাকি শরীরের গড়ন ও চেহারার মধ্যে সেটা কোনো দিন এভাবে দেখিনি। 

বসতে না বসতে আমার জন্য কফি নিয়ে ঘরে ঢুকল ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সী এক আমেরিকান, তার হাতে টেনে আনা ট্রলি থেকে দুই কাপ কফি আমাদের যার যার সামনে রেখে উইলিসের পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে সে বসল অ্যাপল কম্পিউটার ও বিভিন্ন অ্যাপল সামগ্রীর ছোট টেবিলটায়। সে যেহেতু আমাকে তার পরিচয় দিল না, তাই আমিও তাকে বললাম না কিছু, শুধু সে একঝলক আমার দিকে তাকাতে সামান্য একটু হাসি দিলাম তার উদ্দেশে, সেটা সাধারণ ভদ্রতার হাসি। অবশ্য সে কোনো হাসি ফিরিয়ে দিল না আমাকে। তবে তার এই কফি নিয়ে ঘরে ঢোকা, টেবিলে কাপ দুটো রাখা এবং চুপচাপ ছোট টেবিলে বসে যাওয়া থেকেই আমি বুঝলাম, সে সামান্য কেরানি বা টাইপিস্ট গোছের কেউ হবে, কিংবা ইন্টারোগেশনের প্রযুক্তিসংক্রান্ত টেকনিশিয়ান। 

উইলিস এবার আমাকে জানাল, সে উইলিস বার্নস্টেইন এবং তার নামটা অদ্ভুত, আরও অদ্ভুত এ কারণে যে তার নিজের মুখে রয়েছে একটা পোড়া দাগ। সে আরও জানাল, সে আমেরিকার আইসিএস-টু-এ ডিআরইউর প্রধান। আমি প্রশ্নবোধক মুখভঙ্গি করতে সে বলল, এই অ্যাক্রোনিমের মানে ‘ইন্টার-কন্টিনেন্টাল সারফেস টু এয়ার ডিজাস্টার রিকভারি ইউনিট’, তার এই সংস্থা আমেরিকান মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স বা পেন্টাগনের চিফকে রিপোর্ট করে, কিন্তু খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে ভার্জিনিয়ার ল্যাংলির সিআইএ সদর দপ্তরের সঙ্গে এবং আজ ছয় দিন ধরে সে ঢাকায়। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ওই বিকট শব্দের উৎস ও কারণ খোঁজার মিশন নিয়ে সে ও তার চার সহকর্মী এখানে এসেছে এবং তারা ঢাকার ইউএস এমবাসির নয়, এমবাসিতে পোস্টেড ইউএস মেরিনের অতিথি হিসেবেই কাজ করছে। 

আমাকে যেহেতু কোনো প্রশ্ন করা হয়নি, তাই আমি কোনো উত্তর দিলাম না, কোনো প্রশ্নও করলাম না, শুধু আমাকে দেওয়া অসম্ভব তেতো কিন্তু সুস্বাদু কফি শেষ করে কাপটা নীরবে টেবিলে রাখলাম। 

‘প্রফেসর’, আমাকে বলল উইলিস, ‘আপনাকে কফির সঙ্গে ট্রথ ড্রাগ খাওয়ানো হয়েছে। সোডিয়াম থিওপেন্টাল। আর আমার সহকর্মী এখানে আছে, “আই টাংকি টেকনোলজি” ও “ভয়েস রিস্ক অ্যানালাইসিস টেকনোলজি”র টেকনিশিয়ান হিসেবে-সে ওই দুই বিষয়ের ওপরেই প্রফেশনাল ডিগ্রিধারী। আমাদের এজেন্সি পলিগ্রাফ টেস্টিংয়ে আর বিশ্বাস করে না। আমরা মিথ্যা বলার সময়ে মানুষের চোখের পিউপিলের ডাইলেশন ও ভোকাল কর্ডের সাউন্ড ওয়েভের ডিসটরশন ট্র্যাক করে পলিগ্রাফের চাইতে অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারি যে, কোন কথাটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। আশা করি আপনি মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না, আমাদের ফ্রেন্ডলি এই এনভায়রনমেন্ট আনফ্রেন্ডলি করবেন না।’ 

‘আমার মিথ্যা বলার কোনো কারণ নেই,’ বললাম আমি। 

‘কিন্তু মিথ্যা আপনি বলেন। এখানে ফাইলে আপনার সমস্ত ফোন কলের কনভারসেশন ট্রান্সক্রিপ্ট, ইদানীংকালের সব ই-মেইল, সব এসএমএস রয়েছে। দেখা যাচ্ছে নেপালের সুরভি ছেত্রির সঙ্গে আপনি ই-মেইলে প্রচুর অশ্লীল আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাকে বলছেন যে মেহেরনাজ একটা “পেইন ইন দ্য অ্যাস”, আবার মেহেরনাজকে ফোনে বলছেন যে সুরভি একটা “ম্যাড উইম্যান”, বলছেন যে সে বসুন্ধরার এই বিকট শব্দ এবং নেপালের রিসেন্ট ভূমিকম্পের উৎস একই বলে দাবি করছে, তাই আপনি সুরভির সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছেন, যখন কিনা,’ এ পর্যায়ে চিৎকার করে উঠল উইলিস, ‘মেহেরনাজের ফোন রেখেই আপনি আবার সুরভিকে চূড়ান্ত অশ্লীল ইন্টারকোর্স পজিশন নিয়ে মেইল পাঠাচ্ছেন। অবশ্য সুরভি আপনার চেয়েও বেশি অশ্লীল, এ কথাটুকু না বললে আমার কথার অবজেকটিভিটি থাকে না।’ 

‘এর সবই তো আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আপনারা কেন আমার পার্সোনাল মেইল, এসএমএস ট্র্যাক করছেন? আমি কি কোনো ক্রিমিনাল?’ 

‘প্রফেসর’, আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বলল উইলিস, ‘নাথিং ইজ পার্সোনাল। সবই পলিটিক্যাল এবং সবই ইন্টারকানেকটেড। হাউ মেনি টাইমস ইউ হ্যাভ ফাকড মেহেরনাজ অর ফর দ্যাট ম্যাটার সুরভি, দ্যাট ইজ নান অব মাই অর মাই এজেন্সিজ বিজনেস। কিন্তু শব্দের তদন্ত নিয়ে আপনি ও মেহেরনাজ কোন দিকে যাচ্ছেন, সুরভি নেপালে ভূমিকম্পের পেছনে ইউএস ইন্টারেস্ট নিয়ে পত্রপত্রিকায় কোন সব শিট লিখছে এবং তার সঙ্গে ঢাকার বসুন্ধরার ওই আওয়াজ মিলিয়ে কী থিওরি দাঁড় করাতে চাচ্ছে, তা অবশ্যই আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটির বিজনেস।’ 

আমার হালকা মাথা ঘুরতে লাগল, হতে পারে কফিতে মেশানো ওই ট্রুথ সেরামের কারণে। আমি আমার দিকে আসা প্রশ্নের তিরবৃষ্টির সত্য উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। 

প্রথম প্রশ্ন করল উইলিস, ‘ব্যাকগ্রাউন্ড? আই মিন আপনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘লোয়ার মিডল ক্লাস। কিন্তু বড় হয়ে বুঝলাম গরিব না থাকার অধিকার আমার আছে। তখন পড়াশোনায় মন দিলাম খুব। বৃত্তিটূত্তি নিয়ে বাইরে পড়ে আসলাম। পুরোটা একটা খেলা, আপনাকে শুধু খেলার নিয়মকানুনগুলো ভালোভাবে শিখে নিতে হবে।’ 

দ্বিতীয় প্রশ্ন: ‘কাজ? আপনার কাজ?’ 

বললাম, ‘পৃথিবী যেমন, তেমনভাবে একে তুলে ধরার চেষ্টা করা।’ উত্তর দিতে দিতে দেখলাম আমি সামনের দেয়ালটাকে সামান্য পেছনে সরে যেতে দেখছি। দেয়ালটা সেকেন্ড পরেই আবার ফিরে এল তার আগের জায়গায়। ভালো। 

উইলিস জিজ্ঞাসা করল, ‘পৃথিবী যেমন, সেটাকে তেমনভাবে তুলে ধরতে পারছেন কি?’ 

বললাম, “না। কারণ, সেটা করতে গেলেই আমাকে প্রকৃতির সাহায্য নিতে হচ্ছে, গাছপালা, ফুল, পাখি, ভোর ও সন্ধ্যার সাহায্য। তখনই এর মধ্যে টু মাচ লিরিক ঢুকে যাচ্ছে।’ 

তৃতীয় প্রশ্ন : ‘কেউ কি পেরেছে পৃথিবী যেমন, তেমনভাবে তাকে তুলে ধরতে?” 

বললাম, ‘হ্যাঁ। মাত্র পাঁচজন। কাফকা, ভিটগেনস্টাইন, বোরহেস, কনরাড ও সেবাল্ড। শুধু এ পাঁচজনই পরিষ্কার বুঝেছেন কী এই পৃথিবী, কী আমাদের কাজ এখানে, শুধু এরাই এগুলো বুঝেছেন অ্যাজ ইট ইজ বেসিসে এবং তা বলতে পেরেছেন লিরিক্যাল না হয়ে, লিরিকের কোনো সাহায্য ছাড়া, বলতে পেরেছেন যে এই “অ্যাজ ইট ইজ”টা কী। আর কেউ না, অন্য কেউ না।’ 

আমাকে এবার বলা হলো, ‘প্রফেসর আপনি কি ঘুমিয়ে পড়ছেন?’ 

আমি বললাম, ‘না। প্রচণ্ড গরম।’ 

উইলিস বলল, ‘প্রফেসর, জামা খুলে ফেলতে পারেন। অসুবিধা নেই। ইউ আর নট আ উওম্যান। আমি দুঃখিত, আমার এসি অন করা নিষেধ। পরিবেশের ইফেক্ট সব বদলে দিতে পারে।’ 

আমি চুপ। আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করা হচ্ছে না কেন? আমি জামা খুলে ফেললাম। জামা মেঝেয় ফেলে দিলাম। তোলার কেউ নেই। আমি বললাম, ‘ভালো লাগছে। প্রশ্ন করুন। আমি সব প্রশ্নের সৎ ও সাহসী উত্তর দেব।’ 

চতুর্থ প্রশ্ন: ‘আপনারা দুজন—আপনি ও মেহেরনাজ—ঠিক কী কারণে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি কমিউনিটিকে মাঝপথে ফেলে হঠাৎ তীব্রভাবে কোরিয়ান ও চায়নিজদের দিকে সমস্ত শ্রম দেওয়া শুরু করলেন?’ 

আমি বললাম, ‘ভারত ও পাকিস্তানি কমিউনিটি ব্যস্ত টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের চাকরি, আরনস্ট অ্যান্ড ইয়াং, পিডব্লিউসি ইত্যাদি কনসালট্যান্সি, রেস্তোরাঁ চালানো, সফটওয়্যার ও হেভি ইন্ডাস্ট্রির মেশিন বিক্রি ইত্যাদি নিয়ে। অন্যদিকে এখানে কোরিয়ানরা ব্যস্ত অকারণে। তাদের হাতে প্রচুর সময়, তাদের মাথায় প্রচুর বুদ্ধি, আর শব্দটা হওয়ার দিন, মানে শব্দটা হওয়ার আগের দিনের বেলা লোকজন কোরিয়ান পল্লিতে মানুষজনের বড় মুভমেন্ট দেখেছে।’ 

পঞ্চম প্রশ্ন : ‘সরফরাজ নওয়াজের সঙ্গে আইসিসের কানেকশন আছে এবং আইসিসের সঙ্গে আছে ঢাকায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কজন ব্লগার হত্যার। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য?’ 

‘সরফরাজ নওয়াজ একজন ভদ্রলোক,’ আমি বললাম ওই কেরানি লোকটার দিকে তাকিয়ে। ‘আমি জানি না তাঁর সঙ্গে কাদের কানেকশন আছে। শুধু জানি তাঁরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই শব্দের উৎস সন্ধান করছেন।’ 

আমার প্রতিটা উত্তরের সঙ্গে যে ওদিকে মুখ করা অ্যাপল কম্পিউটার আমার চোখ ও কণ্ঠস্বরের নানা গ্রাফ, নানা গোলাকার, বর্গাকার, ত্রিভুজাকার, লালরং, হলুদরং, নীলরং, বেগুনিরং, লালরঙের মানে এই, হলুদরঙের মানে এই, নীল ও বেগুনির মানে এই, এসব তথ্য-উপাত্ত-ডেটার টু দ্য স্মলেস্ট ডিটেইল গ্রাফিক্যাল বিশ্লেষণ করে চলছে, তা আমি আন্দাজ করতে পারছি ওই কেরানি টেকনিশিয়ানের হঠাৎ মাথা নাড়া, হঠাৎ চোখ গোল করা, হঠাৎ মাথার পেছন দিকে দুহাত রেখে তার চেয়ারে হেলান দেওয়া, এসব দেখে। 

ষষ্ঠ প্রশ্ন (আমি মনে মনে গুনে চলেছি প্রশ্নসংখ্যা) : ‘সুরভি আপনাকে গত চার-পাঁচ দিন কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে ই-মেইলে? কোরিয়ানদের মধ্যে নর্থ কোরিয়ানরাও আছে, সেটা? “ইসরায়েল-HAARP মৈত্রী নিয়ে সেদিন অন্য নাম্বার থেকে তোমাকে যা যা বললাম, তা মাথায় রাখবা যখন কথা বলবে ড. জনসনের সঙ্গে,” সুরভি এই কথা লিখেছে আপনাকে তার ২০ আগস্টের ই-মেইলে। কে এই ডক্টর জনসন?’ 

আমি নড়েচড়ে বসলাম। প্রশ্ন শুনে আমার ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গেল। কীভাবে আমাদের অন্য নাম্বারে কথা বলার কথা জানল এরা? মানুষ কী করে এত আহাম্মক হয়? কী করে সুরভি পারল সেই অন্য নাম্বারের কথা আবার ই-মেইলে লিখতে। আমি আমার বাসার বইয়ের এক র‍্যাকের পেছনে পড়ে থাকা সস্তা একটা নকিয়া ফোন এবং তাতে একদম কদিন আগে ভরা প্রিপেইড সিমটার কথা মনে করলাম। কত নিঃসঙ্গ পড়ে আছে ওই ফোনটা অতগুলো বইয়ের মাঝখানে বন্ধুবান্ধবহীন এক পরিবেশে আর কীভাবে আজ তা ঝামেলায় ফেলেছে আমাদের দুজনকে। উইলিস জোরে বলে উঠল, ‘আনসার মি।’ কেরানি পা নাচাচ্ছেন দেখলাম, তার ভাবটা এমন যেন তিনি আমাকে বলতে চাচ্ছেন, ‘এইবার?’ 

আমি বললাম, ‘কোরিয়ানদের মধ্যে নর্থ কোরিয়ান আছে কি না, তা আমি জানি না। সাউথ ও নর্থ তো বাদই দিই, আমি এখনো কোনো চায়নিজ ও কোরিয়ানের চেহারার পার্থক্যই ধরতে শিখিনি, শুধু জাপানিজ ও ফিলিপিনোদের মধ্যে যা একটু ফারাক করতে পারি। অ্যান্ড অ্যাবাউট “ইসরায়েল-HAARP মৈত্রী” সুরভি আমাকে নতুন কিছুই বলেনি। সে শুধু বলেছে HAARP-এ চাকরি করা এক আমেরিকান মেয়ে নেপালের এক পলিটিশিয়ানের সঙ্গে দেখা করেছে সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়াতে, গত সপ্তাহে। মেয়েটা তাকে একটা পেন ড্রাইভ দিয়েছে, তাই আমরা এই প্রথম কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পেতে যাচ্ছি তেলআবিবে নেপালের ভূমিকম্প নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসের এক বৈঠক বিষয়ে। তেলআবিবে মোট তিনটা বড় মিটিংয়ের প্রথমটা ছিল এটা।’ 

আমি থামলে উইলিস বলল, ‘ইনকমপ্লিট আনসার। কন্টিনিউ।’ 

আমি চুপ করে আছি। উইলিস আবারও বলল, ‘কন্টিনিউ।’ কিন্তু আমি চুপ। আমার পক্ষে মুখ খোলার কোনো উপায় নেই। আমি দেখছি দেয়াল আবার পেছন দিকে চলে যাচ্ছে, এবার তার যাওয়া আর থামছে না, মনে হচ্ছে এটা বিশাল বড় এক রুম, মনে হচ্ছে এর সাইজ কোনো ফুটবল মাঠের সমান, এবং ওই দেয়ালে লাগানো গোলপোস্ট যেন সরে যাচ্ছে দূরে, আবার। কেরানি তার চেয়ার থেকে উঠল। সে চোখের নিমেষে আমার ঘাড়ের পেছনে স্ট্যাপলার মেশিনের মতো দেখতে এক জিনিস দিয়ে চাপ দিল, আমার মাংসে সুই ফুটল আধুনিক রক্ত নেওয়ার মেশিন পিঁপড়ার কামড়ের যে রকম অনুভূতি দেয়, ততটুকু ব্যথার অনুভূতি তুলে। 

উইলিস আমার কানের সামনে এসে চিৎকারে ফেটে পড়ল। ‘কন্টিনিউ।’ 

‘তোমাদের মার্কিন সিনেটর ডোনাল্ড সমারভিল সব জানে। সে নেপালের কাঠ ব্যবসায়ী মদন কৃষ্ণা শ্রেষ্ঠার সঙ্গে বসেছিল এই সোমবারে, নিউইয়র্কের ‘ফাইভ গাইস বার্গার’-এ। ওয়েস্ট ফরটি থার্ড, ফিফটি ফিফথ স্ট্রিট। মদন কৃষ্ণা শ্রেষ্ঠার হাতে এখন জাইরো ফ্রিকোয়েন্সি হিটিং রিসার্চের গত ছয় মাসের সব ডেটা। পৃথিবী এবার জানতে পারবে আয়নোস্ফিয়ারকে কাজে লাগিয়ে কী কী জঘন্য কাজ তোমার করছ এজেড/ই-এল টেলিস্কোপ ডোমে, কীভাবে সর্বনাশ করেছ হাইতির, গ্রিসের, ফিলিপিনসের, ইরান ও পাকিস্তানের। এই ডোনাল্ড সমারভিলই শ্রেষ্ঠাকে বলেছে, যে শ্রেষ্ঠা আবার তার বন্ধুর মেয়ে সুরভিকে বলেছে, বাংলাদেশের শব্দেরও সমাধান পাওয়া গেছে। যারা শেখ মুজিবকে মেরেছিল, তারাই এ শব্দ ঘটিয়েছে লো-ফ্রিকোয়িন্সে ব্যাকগ্রাউন্ডের গুনগুনকে এক নির্দিষ্ট লেয়ারে ঘনত্বের বদল সৃষ্টি করে। HAARP-এ চাকরি করা ওই মেয়ে আজকে ফ্লাইটে, সে “বাংলাদেশ সাউন্ড” নামের আরেকটা পেন ড্রাইভ নিয়ে আজ যাচ্ছে আমেরিকার ফারগোয়। ঢাকা থেকে জন ব্রোকম্যান নামের এক ভদ্রলোক ওই মেয়ের সঙ্গে ফারগোতে মিটিংয়ের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে গেছে এক বাংলাদেশিকে, সেই বাংলাদেশি এখন ফারগোয়, অপেক্ষা করছে HAARP-এর মেয়েটার আলাস্কা থেকে ফারগো পৌঁছানোর জন্য। ড. জনসন বলে কেউ নেই। তোমাদের ভুল হচ্ছে। হবে জন ব্রোকম্যান।’ 

এরপর কী একটা হলো বুঝতে পারলাম না। শুধু বুঝলাম আমার পুরো শরীর আমার নিজেরই পেটের ভেতরে ঢুকে গেল, শুধু পা দুটো ছাড়া এবং আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল আমার পুরুষাঙ্গ। তারপর হঠাৎ আমার কাঁধে জোরে জোরে ধাক্কা। আমি নড়েচড়ে বসলাম। ‘প্রফেসর আপনি পনেরো মিনিট ঘুমিয়েছেন। ভালো লাগছে এখন?’ উইলিসের মুখ একদম আমার মুখের ওপরে। আমার নাকে এল তার মার্লবোরো সিগারেটের কড়া গন্ধ। 

‘আমি কি যেতে পারি?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি। 

‘নো’, আমাকে বলা হলো। ‘এখনো কিছু কথাবার্তা বাকি। যাবেন। আপনাকে মেরে তো আর ফেলা হচ্ছে না। প্লাস ইউ লাইয়েড ইন ইওর লাস্ট আনসার। ই-মেইলে স্পষ্ট লেখা ডক্টর জনসনের কথা, তা-ও দুবার। এই দেখুন।’ 

আমাকে সুরভির একটা ই-মেইল দেখানো হলো তাজা তাজা তক্ষুনি প্রিন্ট করে। সুরভি লিখেছে, ‘হোয়াটএভার আই টোল্ড ইউ দ্যাট ডে ফ্রম মাই আদার নাম্বার অন দ্য “ইসরায়েল-HAARP অ্যালায়েন্স”, রিমেমবার এভরি ওয়ার্ড অব দ্যাট হোয়েন ইউ টক টু ড. জনসন। ড. জনসন উইল আইডেনটিফাই হিমসেলফ টু ইউ অ্যাট ইওর গুলশান কেএফসি।’ 

আমি বললাম যে আমি গুলশান কেএফসিতে গত এক বছর হয় যাইনি। আমি কোনো ড. জনসনকে চিনি না। আমি জন ব্রোকম্যানকে চিনি। 

উইলিস হাসল। সাংঘাতিক এক হাসি। সে তার সহকর্মীকে বলল, ‘হি থিংকস উই আর ফুলস।’ তারপর সে একটা ছবি তুলে দিল আমার হাতে, সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঠিক আমার মতো দেখতে একটা লোক, প্রায় পঁচানব্বই ভাগ আমার মতো, গুলশান কেএফসির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে এক বিদেশির সঙ্গে। আমি বললাম, ‘দ্যাটস জন ব্রোকম্যান। আর পাশের লোকটা কি আমি?’ 

উইলিস বলল, “কী মনে হয়?’ 

আমি বললাম, ‘একবার মনে হয় আমি আরেকবার মনে হয় আমি না। বাট আমি গুলশান কেএফসিতে গত এক-দেড় বছরে যাইনি।’ এরপর কয়েক মুহূর্ত ছবিটাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে আমি সন্দেহাতীতভাবে বুঝে গেলাম যে ছবির ওই লোকটা আমিই। বললাম, ‘ছবিতে ওটা আমিই। কিন্তু আমি কেএফসি যাইনি।’ 

উইলিস প্রসঙ্গ পাল্টে (যেহেতু সে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছে, যেহেতু জন ব্রোকম্যানকে ভালোভাবে আইডেনটিফাই করা তার দরকার ছিল এবং তা হয়ে গেছে) সপ্তম প্রশ্ন করল, ‘যারা শেখ মুজিবকে মেরেছিল, তারাই এ শব্দ ঘটিয়েছে। এক্সপ্লেইন।’ 

আমি বললাম, ‘রিসেন্টলি এ কথাটা আমি বলিনি। কথাটা বলেছে তোমাদের সিনেটর সমারভিল। সে মুজিব হত্যায় আমার বিশাল ইন্টারেস্ট দেখে একদিন আমার হাতে একটা চিরকুট দিয়েছিল গুলশান পারসোনা বিউটি পারলারের সিঁড়িতে। এই যে দেখো কী লেখা ওতে?’ আমি মোবাইল ফোনে তুলে রাখা সমারভিলের ওই চিরকুটের ছবি দেখাতে চাইলাম উইলিসকে। পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম মোবাইল আমার কাছে নেই, সেটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সে-ই। উইলিস বুঝল, সে আমার মোবাইল অন করল, আমার হাতে দিল ফোনটা, বলল, ‘দেখাও।’ আমি ছবির গ্যালারিতে ঢুকে বের করলাম সমারভিলের চিরকুট, তাতে ইংরেজি আঁকাবাঁকা হরফে হাতে লেখা : ‘দিজ আর দ্য পিপল হু কিলড ইওর ম্যান ইন।975 উইদ দ্য হেল্প অব ইউএসএ। ফিউ লেফটিস্টস অ্যান্ড ফিউ রাইটিস্টস ডিড ইট টুগেদার। ইট ওয়াজ আ পারফেক্ট ম্যারেজ অব কনভিনিয়েন্স বিটুইন লেফট অ্যান্ড রাইট, ইন আ ওয়ে দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাড নেভার সিন বিফোর। দিজ আর দ্য নেমস : তাহের, ইনু, সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ, রব, জিয়াউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, অ্যান্ড শাহজাহান ওমর; অ্যান্ড নাউ মোশতাক, তাহের ঠাকুর, এনায়েতুল্লাহ খান, মাহবুবুল আলম চাষী, শাহ মোয়াজ্জেম, ইউসুফ আলী অ্যান্ড ওসমানী অ্যান্ড সো অন 

চিরকুট দেখানো শেষে আমি বলতে লাগলাম, ‘সমারভিল আমাকে এই চিরকুট দিয়েছিল একদিন, আর আমরা এ বিষয়ে গল্প করেছিলাম অন্য একদিন। সমারভিল সেদিন আমাকে স্পষ্ট বলেছিল শেখ মুজিবকে মারে আমেরিকার এজেন্টরা, সঙ্গে ছিল পাকিস্তান এবং চীনপন্থী বামের জোট জাসদ ও গণবাহিনী। সে বলেছিল সে আমার আগ্রহ দেখে এ বিষয়ে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, কিছুটা স্টেট ডিপার্টমেন্টের বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়েছে, এবং বুঝেছে যে আর্মির খুনিরা কেবল গুলিই চালিয়েছিল সে রাতে, তারা ছিল ‘গুলির-পার্টের’ লোক, আর আসল কাজটা করেছিল ‘রাজনৈতিক পার্টের’ এরা। এদের পেছনে পুরো খেলাটা চালাচ্ছিল পাকিস্তান, পাকিস্তানকে ফুল সাপোর্ট দিচ্ছিল আমেরিকা, যে কখনো চায়নিই যে বাংলাদেশের জন্ম হোক। ডানপন্থীরা যোগ দিয়েছিল বামপন্থী চীনাদের সঙ্গে। ইন্টারেস্টিং। এখন বুঝতে পারছ কী বলা হচ্ছে এ কথা বলে যে যারা শেখ মুজিবকে মেরেছিল, তারাই এ শব্দ ঘটিয়েছে? সমারভিল বোঝাতে চেয়েছেন, ১৯৭৫-এ সবকিছুর মূলে, গোড়ায় ছিল আমেরিকা, তার হাতেই ছিল পলিটিশিয়ান-সিভিলিয়ান আর্মি সব ঘুঁটি। সমারভিল বলতে যাচ্ছেন যে ওই আমেরিকাই চল্লিশ বছর পর একই দিনে এই শব্দকাণ্ডটা ঘটিয়েছে।’ 

উইলিস মাথা নাড়ছে। সংকেতে কী যেন বোঝাচ্ছে তার সহকর্মীকে। আমার ধারণা, এই সপ্তম প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তরটা তাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা ভাবছে কীভাবে এটাকে রি-বিল্ড কিংবা ডিলিট করা যায়। কীভাবে সম্ভব তা? কোনো কিছু একবার দাঁড়িয়ে গেলে তাকে বাতিল করা, খারিজ করা, মাটি করা? সেটা যদি হতো তাহলে পৃথিবীর চেহারা অন্য রকম হতো নিশ্চয়, তাহলে এতগুলো অর্ধসত্য এত শত বছর গেড়ে বসতে পারত না পৃথিবীতে। 

উইলিস তার অষ্টম প্রশ্ন করল : ‘বসুন্ধরা এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি আজমত সাহেবের বাসায় গত পরশু সন্ধ্যায় একদল ভেনেজুয়েলান, পেরুভিয়ান ও মেক্সিকান লোক দেখা গেছে, যাদের কথা সুরভি’তার ই-মেইলে আপনাকে জানিয়েছিল তার আগের সন্ধ্যায় এই বলে যে “The Latinos have just left Kathmandu for Dhaka”। তারপর আপনি মেহেরনাজকে লক্ষ রাখতে বললেন আজমত সাহেবের বাসার গেটের দিকে। খুলে বলুন।’ 

আমি সোজাসাপটা বললাম, ‘সুরভির কথায় পড়ে আজমত সাহেবের ওখানে লাতিন আমেরিকানদের পেছনে সময় ব্যয় করা আমার ভুল হয়েছে। এর কোনো দরকার ছিল না, কারণ তারা আজমত সাহেবের কাছে গিয়েছিল একটা ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে। আজমত সাহেব শিগগিরই বাজারে একটা নতুন মিনারেল ওয়াটার লঞ্চ করতে চাচ্ছেন, নাম “আদার লাইফ”। 

আমি ‘আদার লাইফ’ কথাটা বলতে বলতে চেয়ার থেকে পড়ে গেলাম, পড়তে পড়তে এই অনুভূতি হলো যে আমার পুরো শরীর, পা, হাত, পেট, পিঠ, বুক—সবসহ ঢুকে যাচ্ছে আমারই মাথার ভেতরে এবং এই দফা আমার পুরুষাঙ্গ ঝুলছে ঠিক আমার কপালের মাঝখানে, যেখানে মেয়েরা টিপ দেয় আর পিতামাতারা তাদের স্কুলগামী সন্তানদের চুমু দেন প্রতি ভোরে ঘুমন্ত চেহারা নিয়ে। আমি বুঝলাম আমার কাঁধে ঢোকানো ওই ইনজেকশন অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে ষড়রিপুকে উসকে দিয়ে, এখন সবকিছু ব্যাখ্যা ও অন্তর্দর্শনের সমরেখায়। আমাকে ধরে তোলা হলো, চেয়ারে বসানো হলো, কাজটা তারা করল এলেবেলেভাবে, এমন যে আমি একমুহূর্ত পরিষ্কার দেখতে পেলাম উইলিসের সহকর্মীর অ্যাপল ল্যাপটপের স্ক্রিনের পুরোটা। 

তার স্ক্রিন দেখলাম মাঝামাঝি ভাগ করে আছে দুটো জ্বলজ্বলে ছবি বাঁয়েরটা ডলচে অ্যান্ড গাবানার একটা টি-শার্ট পরে বুক অশ্লীলভাবে উঁচু করে মরক্কোর নায়িকাদের মতো দাঁড়ানো সুরভির। ডানেরটা HAARP প্রজেক্ট কাজ করা আমাদের ইদানীংকালের আমেরিকান বন্ধু ম্যারি অলিভারের, যে আমাদের সাহায্য করছে স্রেফ টাকার লোভে, অন্য কোনো কমিটমেন্ট থেকে নয়। 

আমি বুঝে গেলাম এ মুহূর্তে আমেরিকার মাটিতে অসংখ্য এজেন্ট ম্যারিকে গ্রেপ্তার করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ফারগোর এয়ারপোর্টে, কোনো আন্টি অ্যান’ প্রেটজেল দোকানের সামনে কিংবা কোনো ‘সাবওয়ে’ স্যান্ডউইচ শপের কোনায়। হায় ম্যারি অলিভার। আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলাম। আমি ম্যারি অলিভারের সাতাশ-আটাশ বছরের উজ্জ্বল মুখ, সোনালি চুল ও তার চিবুকের নিচে নেমে যাওয়া পিচ্ছিল গলা—এসবের কথা ভেবে বুকের মধ্যে কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠতে দেখলাম। গতকাল, মাত্রই গতকাল, পিংকি হিজড়া কথা বলেছিল ম্যারির সঙ্গে আমার বাসায় আমার গোপন ওই নকিয়া ফোন থেকে, বলেছিল (আমার বাংলা হরফে লেখা ইংরেজি বাক্য অদ্ভূত বাংলা উচ্চারণে ইংরেজিতে পড়তে পড়তে) : ‘হোয়াটএভার ইউ ছে, আই ডোল্ট বিলিব ইউ, বিকজ আপা’-এই আপা শব্দ পিংকি নিজে যোগ করেছিল কথা বলতে বলতেই—’আই নো কোরিয়ানস হ্যাব ডান ইট, নো আমেরিকানস।’ আমি কোনো ফেডারেল প্রিজনে বন্দী হলুদ রঙের কাপড় পরা ম্যারিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম বাইরের এক টুকরো আকাশের দিকে, আগামীকাল থেকে যদ্দিন না তার বয়স পঞ্চান্ন হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁস করার অপরাধে বন্দী সে—আমি সামনের এতগুলো দিন, মাস ও বছরের প্রতিদিনের ম্যারিকে এভাবেই দেখে ফেললাম একঝলকে, এক দ্রুত ও অপরিবর্তনশীল সিকোয়েন্সে। 

নবম প্রশ্ন করা হলো আমাকে। আমি দেখলাম আমার এবার শীত শীত লাগছে। আমি জামা চাইলাম। উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মেহেরনাজ যে ওই লাতিনো সন্ধ্যায় আজমত সাহেবের সিকিউরিটির হাতে নিষ্ঠুরভাবে রেপ হওয়া থেকে বেঁচে গেছে, তা কি আপনি জানেন? আপনাকে সে কথা বলেছে মেহেরনাজ?’ 

আমি বেশ অবাক হলাম এ প্রশ্নে। বললাম, ‘মেহেরনাজ আমাকে বলেনি যে আজমত সাহেবের সিকিউরিটির লোকেরা তাকে রেপ করতে গিয়েছিল। সে আমাকে শুধু বলেছে সে নানাভাবে তার শরীর দেখিয়ে, তার শরীরে হাত দিতে দিয়ে সিকিউরিটির লোকদের ম্যানেজ করে “আদার লাইফ” নামের ওই মিনারেল ওয়াটার-বিষয়ক তথ্য পেয়েছিল।’ 

দশম প্রশ্ন: ‘আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিকসের প্রফেসর নূর হোসেন গত বুধবার অনেক ভোরে আপনার বাসা থেকে বেরিয়েছিল। সে যে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের পেইড এজেন্ট, তা আপনি জানেন? অত ভোরে সে কী করছিল আপনার বাসায়? আর বসুন্ধরা সোসাইটির নেতা গাড়ি ব্যবসায়ী আখলাকুর রহমান কেন তার মিনিট পনেরো পরে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল আপনার বাসা থেকে?” 

আমি বললাম, ‘নূর আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে আমার কাছে রাত বারোটায় মিনতি জানাতে এসেছিল যে আমি যেন ছুটি ক্যানসেল করে ডিপার্টমেন্টে ইমিডিয়েটলি জয়েন করি, কারণ ভার্সিটিতে নাকি আমার চাকরিচ্যুতির নানা কানাঘুষা চলছে। তারপর আমাদের মধ্যে “ডিপ টাইম” থিওরি নিয়ে গল্প শুরু হয়। ওভাবে রাত সাড়ে তিনটা বাজলে আমি তাকে বলি গেস্টরুমে ঘুমিয়ে পড়তে, এত রাতে বাইরে, বাসায়, না যেতে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় নূরের ঘুম ভাঙে, সে দৌড়ে তার বাসার দিকে রওনা হয়। কারণ, তার মেয়ে এখন তার কাছে থাকে, মেয়েকে স্কুলে পাঠানো তার দায়িত্ব। নূর পাকিস্তানের আইএসআইয়ের এজেন্ট না। পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি তা বিশ্বাস করব না। আখলাক মিয়া আমার বাসায় আসেন সকাল ছয়টায়, আমাকে এই খবর দিতে যে সকাল সাতটায় আমার বাসায় এসে নাশতা খাবেন তার বস সরফরাজ নওয়াজ। কারণ, তিনি আর আমার সঙ্গে ঝামেলা চাইছেন না, ডিজিএফআইয়ের জেনারেল জামাল তাঁকে আমার সঙ্গে মৈত্রী করতে বলেছেন। আখলাক সাহেব আমাকে এই কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন হঠাৎ তিনি আমার সোফার পাশের টেবিলে আমার ব্যক্তিগত পিস্তলটা — সাপের গায়ের রঙে তার রং-দেখে দৌড় দেন, কিছু না বলে সোজা দৌড় দেন। 

উইলিস বার্নস্টেইন এ পর্যায়ে আমার কাছে জিজ্ঞেস করল, “হোয়াট ইজ “ডিপ টাইম”? হাউ কাম আই হ্যাভনট হার্ড অ্যাবাউট ইট।’ 

আমি বললাম যে আমি নিজেই বিষয়টা ভালো করে জানি না। তবে মোটের ওপর ব্যাপারটা এমন। ‘গভীর সময়’ মানে এই আইডিয়া যে আমাদের পৃথিবী অনেক অনেক পুরোনো এক পৃথিবী এবং আমাদের এই মানবপ্রজাতির সেখানে অস্তিত্ব অত পুরোনো নয়, সব মিলে পৃথিবীতে মানুষের বয়স পৃথিবীর বয়সের সঙ্গে তুলনায় সামান্য ওই সেদিনের। মানুষ যেদিন জানল পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে, এর উল্টোটা নয়, তখন যেমন নাড়া খেল আমাদের সমস্ত বিশ্বাস, তেমনই ‘ডিপ টাইম’ থিওরি এসে নাড়িয়ে দিয়েছিল মানুষকে, ভীষণভাবে, কারণ এই থিওরি বলছিল এত দিনের বিশ্বাসের পুরো উল্টো কিছু। 

এটুকু কথা বলে থামলাম আমি। পানি চাইলাম। টেকনিশিয়ান আমাকে এক গ্লাস পানি দিল। উইলিস অধৈর্য হয়ে উঠেছে বাকিটা শুনতে। আবার বলা শুরু করলাম। 

বাইবেল ধরে আগে ক্যালকুলেট করে বলা হতো পৃথিবীর বয়স ছয় হাজার বছর, এবং বিরাট এক বন্যায় নাকি মানুষেরা ছিটকে ছিটকে পড়েছিল সারা পৃথিবীজুড়ে। তখনকার দিনের কেমিস্ট্রি এই বন্যার সপক্ষে প্রমাণও দিয়েছিল। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার জন প্লেফেয়ার ও জেমস হাউন ১৭৮৮ সালে বললেন, পৃথিবী ধুম করে সৃষ্টি হয়নি, হয়েছে ধীরে, অতি ধীরে, এর বয়স ৩ হাজার বছর না, ৪.৬ বিলিয়ন বছর। হাউন বললেন যে, স্থানের বিশালতা বোঝা সোজা। আমরা যখন তারাদের দিকে তাকাই, আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিশালত্ব, ব্যাপকত্ব সব সহজেই ধরতে পারি। কিন্তু সময়ের ব্যাপকত্ব ও গভীরতা আন্দাজ করা মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরের জিনিস। মানুষ হিসেবে প্রকৃতিকে দেখলে মনে হয় এটা কতগুলো ঋতুর বদল, আর মাঝেমধ্যে ঝড়-বন্যা ইত্যাদি। এ কারণে পৃথিবী দ্রুত তৈরি হয়েছে, ঋতুবদলের মতো দ্রুত, এমন ধারণা করা মানুষের জন্য স্বাভাবিক। সেই একই মানুষ ভাববে কী করে যে পৃথিবী তৈরি এবং প্রাণের আবির্ভাব ও বিকাশ অনেক ধীর ও ধাপে ধাপের এক ব্যাপার? সব বদলে দিলেন হাটন। বিশাল কল্পনাতীত ব্যাপক সময় যখন হাতে আছে, প্রাকৃতিক পৃথিবীর নির্মাণ তখন ভাবনারও অতীত ধীরগতিতে সম্ভব হলো। 

এ পর্যায়ে উইলিস মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগল, ‘মেকস্ সেনস, ইট মেকস্ সেনস।’ আমি আবার বলতে থাকলাম, হাউনের পরেই আসে আধুনিক জিয়োলজি, পরে আসে বিবর্তনবাদ, যা দেখাল কত ধীরে রূপের বদল হয়েছে প্রাণিকুলের, আর শেষে এল মহাদেশগুলোর পর্যায়ক্রমিক নড়ে-সরে যাওয়ার তত্ত্ব। এর সবই শুরু ওই ‘ডিপ টাইম’ তত্ত্ব থেকে। হাউন বিরাট ধাক্কা দিলেন তাঁর আগের প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসকে। তিনি তাঁর বইয়ের নাম Theory of the Earth — শেষে বললেন, ‘কোনো শুরুর সামান্য কোনো চিহ্নও পাচ্ছি না কোথাও, অতএব কোনো শেষের সম্ভাবনাও দেখছি না।’ এই কথা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিল বাইবেলে পৃথিবী সৃষ্টির দিন ও হাশরের ময়দানে বিচারের দিনের বিশ্বাসকে। 

এটুকু বলে আমি থেমে উইলিসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বোঝাতে পেরেছি?’ 

উইলিসের চোখে হঠাৎ লক্ষ করলাম কোনো নিষ্ঠুর ইন্টারোগেটরের দৃষ্টির শীতলতা অপসৃত হয়েছে, সেখানে বরং ঝুলে আছে কবির কবিত্বের লালিমা। উইলিস আমাকে বলল, ‘ইটস আ বিউটিফুল আইডিয়া। আই ডিডনট নো অ্যাবাউট দিস। সময়ের পাতালের দিকে তাকালে মাথা না ঘুরতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর ধরলে এবং মানুষের জীবন ৭০ বছরের ধরলে আমার দুটো জিনিস হয়। মনে হয় কত তাৎপর্যহীন আমরা; আবার এই বিশাল সময় স্রোতের মধ্যে, যার মধ্যে আমরা বাস করছি, মনে হয় একই কারণে কত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের এই ধুলোর সমান জীবনকালটুকু।’ 

উইলিস এ রকম কাব্যিকতা করে কথা বলতে পারে, ফিজিকসের ‘ডিপ টাইম’ থিওরির সামান্য দুটো কথা শুনে সে এ রকম সম্মোহনী উপসংহারে আসতে পারে, যা কিনা সেদিন রাতে আমিও পারিনি, যে আমি সারা দিন থাকি এসব নিয়েই, এই সত্যটা আমাকে নাড়িয়ে দিল। আমি বুঝলাম, সাংঘাতিক বিপদ বলতে যে মৃত্যুর কথা বলা হয়, সেই বিপদের মধ্যে আমি নেই। 

উইলিস আমাকে বলল, ‘আমরা প্রায় শেষের দিকে প্রফেসর। আর একটা মাত্ৰ প্ৰশ্ন।’

আমাকে একাদশ প্রশ্নটা করা হলো : ‘আপনারা কবে যাচ্ছেন কোরিয়ান পল্লিতে মূল আক্রমণ চালাতে? চোর ধরার শেষ খেলাটা খেলতে?’ 

আমি বললাম, ‘আমাদের কোরিয়ান পল্লিতে আবার যাওয়ার কথা ছিল আজ এবং নিষ্পত্তিমূলক শেষ যাওয়ার কথা এখন থেকে দু-তিন দিন পরে।’ 

আমার উত্তরে টেকনিশিয়ান লোকটা হেসে উঠল, সে ঠা-ঠা স্বরের এক শুষ্ক ইংরেজিতে বলল যে আমি ডাহা মিথ্যা কথা বলছি। তার এ কথা শুনে উইলিস মন্তব্য করল না কোনো। টেকনিশিয়ান লোকটা আগেরবারের মতো তার চেয়ার ছেড়ে উঠল, আমি দেখলাম সে আমার কাঁধের দিকে যাচ্ছে, উইলিস ছুটে এসে মাঝখানে দাঁড়াল, লোকটাকে বলল, ‘না।’ তারপর কী একটা হলো তাদের দুজনের মধ্যে, আমি চেয়ার থেকে পড়ে গেলাম মেঝেতে, পড়েই বমি করা শুরু করলাম, পড়ে থাকলাম বমির মধ্যেই। 

আমি শুনছি উইলিস বার্নস্টেইন অদ্ভুত এক ভাষায় (সম্ভবত হিব্রু) দু-তিন মিনিটের মতো আলাপ করল কেরানি টেকনিশিয়ানের সঙ্গে। বুঝতে পারলাম উইলিস এখন ওই টেকনিশিয়ানের কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে দাঁড়ানো। অনুমান করলাম, তারা এখন আমার এগারোটা উত্তরের রেজাল্ট বিশ্লেষণ করছে। আমি কি পাস করেছি সত্যের পরীক্ষায়? আমি কি ভালো করেছি মিথ্যের পরীক্ষায়? 

উইলিস হাত ধরে আমাকে তুলল। বমির গন্ধ নিশ্চয়ই তার নাকে যাচ্ছে, কিন্তু তাতে তার কোনো বিকার নেই। টেকনিশিয়ান কেরানি আমাকে একটা বড় ফাইল রাখার তাকের পেছনে নিয়ে গেল। আমি সেখানে দেখলাম একটা বেসিন, পুরোনো দিনের ফুলের ডিজাইনের তামার ট্যাপ তাতে। আমি মুখ ধুলাম, পেট-বুক ধুলাম, আমাকে টিস্যু পেপার দেওয়া হলো, আমার জামা এনে দেওয়া হলো আমার হাতে। 

উইলিস আমাকে বলল, ‘প্রফেসর, ইউ আর আ ফেয়ারলি অনেস্ট ম্যান। আই লাইক ইউ। বাট ইউ আর অলসো আ ভেরি ডেঞ্জারাস ম্যান, মোর ডেঞ্জারাস দ্যান অ্যানিবডি এলস আই হ্যাভ মেট বিফোর। ইউ আর এক্সেপশনালি ডেঞ্জারাস। যাক, আমরা আপনাকে একটু পরেই ছেড়ে দিচ্ছি। ইউ আর ফ্রি। কিন্তু মেহেরনাজ এ মুহূর্তে ঢাকার ডমেস্টিক এয়ারপোর্টে, তাকে তার দেশের বাড়ি চট্টগ্রামে নিয়ে যাচ্ছে তার বাবা ও বড় ভাই। অতএব, কোরিয়ান পল্লিতে ইনভেশনে আপনি এমনিতেও তাকে আর সঙ্গে পাচ্ছেন না। মেয়েটা আপনাকে সত্যি অনেক ভালোবাসে, আমাদের টুথ আইডেনটিফিকেশন টেকনোলজি এই সাক্ষ্য দিয়েছে। আমার আসল কথা এটাই যে আপনি এখন ভুলেও ওই কোরিয়ান পল্লিতে একা যেতে চেষ্টা করবেন না, যা সামলানোর, তা ইউএস ফোর্সই সামলাবে। আপনার ইন্টারভেনশন আমাদের বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্লিয়ার?” 

আমি উইলিসের প্রচণ্ড জোর দিয়ে বলা ‘ক্লিয়ার?’ প্রশ্নের উত্তরে তত জোরেই বললাম ‘ক্লিয়ার’, এতই জোরে যে তারা দুজন হা-হা করে হেসে উঠল এবং তখন আমার নিজেকে খুব বোকা বলে মনে হতে লাগল। হাসির শেষে উইলিস আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ‘আপনি মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সত্যের যতটা কাছে এগিয়েছেন, তা-ও অ্যাকটিভ ইন্ডিয়ান র’ এবং পাকিস্তানি আইএসআই-এর প্রবল উপস্থিতি সত্ত্বেও, তাতে করে আপনার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু আপনাদের সামান্য ধারণাও নেই যে কেন তারা ওই শব্দ পৃথিবীর এত দেশ থাকতে বাংলাদেশেই ঘটাল, এত শহর থাকতে ঢাকাতেই ঘটাল, এবং ঢাকার এত এত এলাকা থাকতে কেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাতেই ঘটাল? সুরভি আপনার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। মেহেরনাজ কাজে ক্ষিপ্রগতির, কিন্তু বুদ্ধি কম। সেই সুরভিও জানে না, আপনাদের ইউএস-নেপাল নেটওয়ার্কের লোকেরাও জানে না এসব কেনর উত্তর। ম্যারি অলিভার ইজ শিট। আওয়ার সিনেটর ইজ শিট। মদন কৃষ্ণা শ্রেষ্ঠা ইজ ডেড অ্যাজ অব দিস মর্নিং। হি হ্যাজ বিন কিলড। হিজ মেইন মোটিভ ইন দিস ওয়াজ টু স্লিপ উইদ হিজ ফ্রেন্ডস ডটার সুরভি, ইওর সুরভি। অ্যান্ড জন ব্রোকম্যান, আই মিন ড. জনসন, হি নোজ এভরিথিং অ্যান্ড হি ইজ প্লেয়িং আ ডেঞ্জারাস ডাবল গেম ফর চিপ নেপালি মানি, চিপ বাংলাদেশি মানি। ইওর ডিজিএফআই পিপল আর রিচ, ইওর গভর্নমেন্ট হ্যাজ মেড দেম অ্যান্ড কেপ্ট দেম রিচ, অ্যান্ড দ্যাটস গুড ফর দিস ব্লাডি বিজনেস। মাই সিমপ্যাথি ফর দ্য কিলিং অব ইওর ফাদার অব দ্য নেশন। ইফ ইওর পিস্টল ইজ মেন্ট টু কিল সামওয়ান হু কন্ট্রিবিউটেড ইন কিলিং হিম, দেন গো অ্যাহেড, ডু ইট–মিস্টার হেনরি কিসিঞ্জার ইজ স্টিল অ্যালাইভ অ্যান্ড হি শিওরলি ডিজারভস আ বুলেট।’ 

আমি তার কথাগুলো শুনে পাথর হয়ে গেছি তা যেমন সত্য, তেমনই এতগুলো সুন্দর কথার আড়ালে সারবত্তা যে কিছু নেই, সেটাও ধরে ফেলতে পেরেছি। উইলিস হ্যান্ডশেক করল টেকনিশিয়ানের সঙ্গে, আমাকে ‘গুড বাই’ বলল এই আস্ত কেরানি লোকটা এবং দরজার বাইরে আমি পা রাখতে যাব, তখন উইলিস বলে উঠল, ‘লিসেন টু দিস, প্রফেসর। মেহেরনাজের সঙ্গে আপনার আর কোনো দিন দেখা বা যোগাযোগ হচ্ছে না। যোগাযোগ হলেও দেখা হচ্ছে না। আর সুরভিকে আমরা কাঠমান্ডু থেকে সরিয়ে শিগগির সিকিউরিটি ব্র্যাকেটে নিয়ে নিচ্ছি, শি ইজ এক্সট্রিমলি ডেঞ্জারাস ফর হারসেলফ অ্যান্ড ফর দ্য ইউএস ইন্টারেস্ট ইন দিস রিজিয়ন। অতএব তাকেও আপনি হারাচ্ছেন। তবে এক্ষুনি না। তো, এই যে আপনার এত বড় ত্যাগ স্বীকার, বিশ্বমানবসংঘের জন্য, শিশুদের জন্য, পৃথিবীর ভাষা ও ইতিহাসের জন্য এত বড় স্যাক্রিফাইস, তার আমি সত্যি প্রশংসা করি। প্রফেসর, আপনার মতো মানুষদের কারণেই পৃথিবী বারবার বেঁচে যাবে ধ্বংস হওয়া থেকে। চলুন এখন, আপনাকে মূল গেটে দিয়ে আসি, আর এই নিন আপনার মোবাইল। অ্যান্ড থ্যাংক ইউ ফর দ্য “ডিপ টাইম” থিওরি।’ 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *