৪.২
আমি রাস্তায় হাঁটছি তন্ময় হয়ে। সব ভুলে আমার মাথায় ঘুরছে দুটো কথা : এক. ‘এখন পর্যন্ত তোমাদের ওখানে মৃত্যুর সংখ্যা পনেরো – বসুন্ধরা এলাকায় একটাও পাখি নেই—তিন শ বাচ্চা অসুস্থ; ২. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে বসুন্ধরায় আসবেন। টেনশন। টেনশন।
আমি অ্যাপোলো হাসপাতাল পার হয়ে বাঁয়ে মোড় নিলাম। অনেক কাদা, অনেক গর্ত, অনেক এবড়োখেবড়ো রাস্তা এবং অনেক বিচিত্র সাইনবোর্ড—’বউ-বাচ্চা ভাত ঘর’, ‘সোলেমানিয়া সাইকেল গ্যারেজ’, ‘আহ্লাদ কোচিং সেন্টার’, ‘অপিনিয়ন ফার্টিলাইজার’ ইত্যাদি—–পেছনে ফেলে একসময় উঠলাম বড় রাস্তায় এবং তারপর কিছু দূর বাঁয়ে হেঁটে ভাটারা থানা কমপ্লেক্সে। এখানে আমার বন্ধু চাকরি করে। পুলিশের ওসি, নাম রফিক। রফিককে পেলাম তার ঘরেই। সে এক লোকের অভিযোগ শুনছে, প্রায় নিম্নমধ্যবিত্ত, প্রায় নিম্নবিত্ত পোশাক-আশাক অবয়বের এক লোক, তিনি রফিককে বলছেন, “স্যার, যেমনে হোক তানিয়ারে বাইর করেন, এই যে হের ছবি, আমার সর্বনাশ হইয়া যাইবে স্যার, আইজ তিন দিন ধইরা আসতেছি আপনাদের কাছে, তানিয়ার রিকশার সিটের নিচে আমার সব, তিন দিন কোনো অগরগতি নাই।’ রফিক আমাকে দেখে তাকে রুম থেকে বের করে দিল এই বলে যে, ‘পরে আবার ডাকছি আপনাকে। তানিয়ার সাথে আমাদের কথা হয়েছে। রেকর্ড শোনাব আপনাকে। তানিয়ার সাফ কথা আপনাদের ওই ঘরে যে আবার জানালা আছে, তা তার ধারণায়ও নেই। আপনি আসেন। পরে আবার ডাকতেছি।’
কী অদ্ভুত অভিযোগ। কী অদ্ভুত প্রত্যুত্তর! আমি এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। রফিককে জিজ্ঞাসা করলাম বিষয়টা কী। রফিক বলল, ‘বুঝবি না, বাদ দে, তোর কথা বল।’ আমি কী বলব? রফিকের টেবিল থেকে ছোট এক কাচের গোল পৃথিবী হাতে তুলে বললাম, ‘প্রাইম মিনিস্টার আসবে আমাদের ওইখানে। সিকিউরিটি সব ঠিক আছে তো বন্ধু?’ রফিক অবাক হলো, বলল, ‘প্রাইম মিনিস্টারের সিকিউরিটি ভাটারা থানা দ্যাখে না, বন্ধু। কেন? কোনো স্পেসিফিক কিছু বলবি?’ আমি বললাম, ‘বসুন্ধরায় শব্দের কথা শুনিস নাই?’ রফিক বলল, ‘আমি তো আমি, শালা বারাক ওবামা পর্যন্ত ওইটার কথা শুনছে। তুই ওবামার বিবৃতি শুনছিস?’ আমি বললাম, ‘না তো। ওবামা এইটা নিয়ে কথা বলেছে?’ রফিক বলল, ‘জি মাই ফ্রেন্ড। ঢাকার বসুন্ধরা বিখ্যাত হয়ে গেল রে। আমেরিকানরা নর্থ কোরিয়ান প্লটের কথা বলতেছে এখন। প্রথমে বলছিল আইসিস, এখন বলতেছে নর্থ কোরিয়া। সাউথ প্যাসিফিকের দিকে রওনা দিছে আমেরিকান রণতরি। শুনোছ নাই?’ আমি অবাকের পরে অবাক হচ্ছি শুধু। রফিকের উচ্ছ্বাস থামলে বললাম, ‘দোস্ত, যা ঘটছে তা পনেরোই আগস্ট শুরু হওয়ার সাথে সাথে ঘটছে। আবার সেই এলাকায় আসতেছে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, তা-ও পনেরোই আগস্ট তারিখেই। আমি কী বলতেছি, তোরে বোঝাতে পারছি না।
রফিক উঠল। বলল, ‘ফালতু প্যাচাল পাড়িস না। আমার অনেক কাজ আছে। তুই যা। প্রতিবছরের মতো তোর পনেরোই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া লাগবে না। সবগুলা ফাঁসিতে ঝুলছে তা-ও পাঁচ বছর হয়ে গেছে। তুই যা।’
আমি বললাম, ‘সবগুলা ঝোলে নাই। রশিদ ঝোলে নাই। নূর ঝোলে নাই। দোস্ত, এটা কী বলিস?’
রফিক খেপে গেল। উত্তেজিত গলায় বলল, “তা তুই কী করবি? কানাডা গিয়া নূররে মারবি? যাস না কেন?”
আমিও খেপে গিয়ে বললাম, ‘আমি নূর-ফুর নিয়ে বেশি ওয়ার্কড আপ না সেনাবাহিনীরগুলা খুনি। ওইটুকুই। আসল হইল পলিটিক্যাল সাইডের শয়তানগুলা। সেগুলার কয়েকটা এখন ঢাকায়।’
রফিক আমাকে ওর ঘরে রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এটা বলতে বলতে যে আমি নাকি একদিন এই পনেরোই আগস্ট করতে করতে মারা পড়ব।
হতেও পারে। রফিক ঠিক কথাই বলছে হয়তো। কিন্তু আমি ওকে আসল কথাটাই বলতে পারলাম না যে, আমার জানা জরুরি এই বিশাল বসুন্ধরার কোন জায়গায়, ঠিক কোথায় আজ প্রধানমন্ত্রী যাবেন। তক্ষুনি মনে হলো, না, আমার রফিকের হেল্প দরকার নেই, সেটা আমি নিজেই খুঁজে বের করতে পারি বসুন্ধরার ব্লকে ব্লকে, রোডে রোডে একটু হেঁটে। নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীর এখানে আসা উপলক্ষে প্লেইন ক্লদসের ডিবি, এনএসআই, ডিজিএফআই এতক্ষণে হাজির হয়ে গেছে বসুন্ধরায়। আমি উঠলাম। আমাকে বাসায় নিয়ে পিস্তলটা কোমরে গুঁজতে হবে আগে। বেরোচ্ছি তখন শুনলাম পায়ে শিকল বাঁধা এক অপরাধী তার বড় ভাইকে বলছে, ‘ভাইয়া ভাইয়া, আপনি শুধু ওদেরে পাঁচ শটা টাকা দিয়া বলেন যে আমারে জানি হাঁটুর ওপরে ঘায়ের জায়গাটায় না মারে। ভাইয়া, বলেন।’
আমি বাসায় পৌঁছালাম। দ্রুত গোসল করে দুটো পাউরুটি খেয়ে নিলাম গপাগপ ডিমভাজি ও কলা দিয়ে, তারপর একটা বড় গ্লাস মহিষের দুধ, যাকে গরুর দুধ বলে বিক্রি করে দুধওয়ালা জাকির। মুখে দুধের স্বাদ তখনো এখনকার, কলবেল বাজল। আমি দরজা না খুলেই বুঝলাম—মেহেরনাজ।
মেহেরনাজ ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘টোটাল ডেথ অ্যাজ অব লাস্ট আপডেট–টোয়েন্টি ট্ট।’ আমি ওর সঙ্গে চলমান তিক্ততা – আমার এটা জেনে যাওয়া যে সে অন্য আরও কারও কারও সঙ্গে বিছানায় যায়, তারপর আমার বিয়ের প্রস্তাব ওর প্রত্যাখ্যান, তারপর ওর সেই ঘৃণাভরা এসএমএস, এসব এসব—এবং এখনকার ওর এই স্বাভাবিক কথাবার্তা, এ দুয়ের মধ্যকার অযুক্তিযুক্ততাকে একটু বুঝে নিতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু না, মেহেরনাজ আমাকে সে সুযোগ দিল না। সে সরাসরি চলে এল মূল কথায়, জুতো খুলতে খুলতে বলল, ‘স্যার, আপনাকে ভার্সিটি থেকে ছুটি নিতে হবে, আমাকেও ক্লাস মিস করার ছুটি দিয়ে রাখতে হবে।’ আমি বললাম, ‘কালকে ১৬ আগস্ট, রোববার। ভার্সিটি যদি কালকে খোলে তো ব্যবস্থা করে ফেলব। মনে হয় না খুলবে। কে যাবে এই অবস্থায় ক্লাস নিতে?’ মেহেরনাজ বলল, ‘তা-ও ঠিক।’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে আমার ইনস্ট্রাকশন মতো সব কাজ ঠিকভাবে করে এসেছে কি না। মেহেরনাজ আমাকে বলল, ‘সব ঠিকমতোই যাচ্ছে। আমাদের আরও লোক লাগবে। ফান্ডিংও লাগবে। তবে আমি কিছুটা গুছিয়ে নিয়েই এসেছি।’
ব্যাগ থেকে ইলেকট্রনিক নোটবুকটা বের করল মেহেরনাজ। দেখলাম, আসলে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে, বাইরের গরমে নাকি তার হাঁপ ধরে গেছে। আমি তার ভেজা বগল খেয়াল করলাম। সাধারণত আমি তাকে দেহাতি মেয়েদের মতো বিশ্রী করে বগল ঘামাতে দেখি না কখনো, কিন্তু আজ দেখলাম। তবে আজকের কথা আলাদা। আজকের সব কথা এ পৃথিবীতে আলাদা। তাকে আমি বরফশীতল পানি দিলাম এক গ্লাস। মেহেরনাজ উত্তরে বলল, ‘এত বয়স হয়েছে, তবু আপনি বিয়ে করেন নাই। করলে আপনার ওয়াইফ আমাকে এখন শুধু এক গ্লাস পানি খেতে দিত না।’ আমি তাকে বললাম যে বাসায় কিছু রান্না নেই, তবে পাউরুটি আছে। মেহেরনাজ হাসল, তার দাবাড়ু মেয়ের হাসি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবা প্রতিযোগিতায় সে পরপর গত দুই বছরের চ্যাম্পিয়ন, ছেলেমেয়ে মিলে। আমি কয়েকবার দেখেছি, যখন সে জিতেছে তখনো, যখন সে হেরেছে তখনো, যে ফাইনাল খেলার দিনে কীভাবে সে আত্মভোলা হয়ে তার কনিষ্ঠ আঙুল একেবারে শিশুদের মতো মুখের ভেতর পুরে চুষতে চুষতে তার চালগুলো দিতে থাকে, এবং তখন তার চেহারা কীভাবে ভিটগেনস্টাইনের সেই চিন্তাক্লিষ্ট উদ্ভ্রান্ত চেহারা ছেড়ে প্রতিবারই (চালটা ভালো বলে প্রমাণিত হলে) বদলে যায় কোনো হাসিমুখ দেবশিশুর চেহারাতে। আমাদের সবার মধ্যেই আছে দেবত্বের কিছুটা, আর এই পৃথিবী— পরার্থপরতা, হিংস্রতা ও শালীনতা এখানে পাশাপাশি চলে বলেই প্রমাণিত হয়-কোনো সর্বশক্তিমান ও ন্যায়পরায়ণ খোদার কাজ হতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে, তবে তার চেয়েও বড় কথা এটাই যে শক্তি ও ন্যায়ের সবটা নির্ভর করে আমাদের ওপরেই। গ্যেটের সর্পিলাকার সময় ও ইতিহাসের তত্ত্ব থেকে এটুকু অন্তত পরিষ্কার যে অগ্রগতির ধারণায় আমরা বিশ্বাস না করলেও করতে পারি, তবু এটা সত্য—আমরা আগাই, আবার পেছাই, আবার আগাই, কারণ পথটা প্যাচালো, সর্পিল, তবে শেষমেশ আমার বিশ্বাস আমরা আগাই-ই বেশি।
আমি মেহেরনাজকে বললাম সকাল থেকে দেখা ও শোনা তার ফাইন্ডিংসগুলো আমাকে জানাতে, কারণ আমাদের এগোতেই হবে, না হলে প্রলয় অনিবার্য।
এরপরে তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু ক্ষুরধার বিশ্লেষণগুলো আমার সেই সন্দেহকেই প্ৰমাণ করল যে, প্রলয় অবশ্যম্ভাবী যদি না কার্যকরী কিছু এখনই করা হয়। তার বিশ্লেষণগুলো দেখলাম পাকা কোনো দাবাড়ুর অভিজ্ঞতা ও কার্যপদ্ধতি মেনেই করা। আমি তাকে জানালাম তার এই গুণের কারণেই আমি এ কাজে তাকে বেছে নিয়েছি, যদিও ডিবিতে কাজ করা আমার আপন চাচাতো ভাই নয়নকে নিয়ে কাজে নামবার সুযোগ আমার ছিল।
মেহেরনাজের সারা সকাল ও দুপুর ধরে চালানো তদন্তানুসন্ধানের মূল উপসংহারগুলো ছিল এ রকম (সে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে-বসে তা বিবৃত করে গেল বিনয়াবনত, কিন্তু কিছুটা দ্বিধার এক ভঙ্গিতে) :
এক. শব্দের রহস্য উদ্ঘাটনের দিকে আমাদের এই যাত্রা খুবই বিপৎসংকুল হয়ে উঠতে পারে, কারণ এরই মধ্যে সে দেখেছে বসুন্ধরা গিজগিজ করছে নিরাপত্তা বাহিনীর নানা চরে—সরকারি সাত-আট সংস্থার কোনোটাই বাদ নেই, এমনকি আবহাওয়াবিদ, শব্দ-প্রকৌশলী, সিভিল অ্যাভিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরাও সেখানে হাজির হয়েছেন পরিবেশবাদী এনজিও-কর্মীদের পাশাপাশি। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা শুধু সাধারণ প্লেইন ক্লদস হয়েই নেই, সমস্যার কথা যে তাঁরা আছেন ছদ্মবেশেও, যেমন ভিখিরি সেজে, কান সাফ করার চিকিৎসক সেজে, হাসপাতালের নার্স ও বেলুন বিক্রেতা সেজেও।
দুই. তার গুনে গুনে জিজ্ঞাসা করা মোট ৫২ জন লোকের মধ্যে ৪১ জনই বলেছে, শব্দটা এসেছে বসুন্ধরার বড় মসজিদ পার হয়ে আরও সোজা অনেক দূর চলে গেলে যে বালু নদের পাড়, সেখানকার কোনো একটা জায়গা থেকে। অর্থাৎ এর উৎপত্তি বসুন্ধরার সীমানার ভেতরেই, যদিও বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পের সত্যিকারের সীমানা বলতে এখন আর কিছুই নেই—অনেকে বলে যে একদম টাঙ্গাইল পর্যন্ত চলে গেছে এর শেষ মাথা, কারণ নিয়মিত জমি দখল হচ্ছে, নিয়মিত সীমানা বেড়েই চলেছে।
তিন. মানুষজন যতটা না সন্দেহ করছে কোনো বাইরের শক্তিকে, যেমন আইএস বা লস্কর-ই-তাইয়েবা বা অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী, তার চেয়ে বেশি সন্দেহ করছে ইদানীংকালে বসুন্ধরা ভরে যাওয়া চায়নিজ-কোরিয়ান জাপানিজ ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী এবং অন্যদিকে কেনিয়ান-নাইজেরিয়ান-তানজানিয়ান লোকগুলোকে, যাদের পঁচানব্বই ভাগই ফুটবল প্লেয়ার এবং বাকি পাঁচ ভাগ তাদের দালাল বা ম্যানেজার। সবচেয়ে বড় সংখ্যায় এখানে আছে কোরিয়ানরা, তারপরেই কেনিয়ানরা। লোকজনের সন্দেহ সেই তাদের নিয়েই, যদিও বিদেশিদের প্রতি আমাদের সাধারণ অবিশ্বাস ও সাধারণ কৌতূহলও হতে পারে এই সন্দেহের পেছনের মূল কারণ।
চার. এই চার নম্বর কথাটা মেহেরনাজ বলল পুরো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটা এ-ফোর সাইজের ম্যাপ তার কাঁধব্যাগ থেকে বের করে। বলল, বসুন্ধরায় যেহেতু মহাশক্তিশালী আজমত সাহেবের আদেশ ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না, তাই সে লোকমুখে অনেক শুনেছে যে আজমত সাহেব ও তাঁর ছেলেদের ধরলেই এ শব্দের কূলকিনারা সহজে পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এ চিন্তার সবচেয়ে দুর্বল দিকটা হলো, আজমত সাহেব ও তাঁর পরিবার ধরাছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরের মানুষ।
পাঁচ. দ্বিতীয়বার একই রকম শব্দ হবার সম্ভাবনা খুব কম বলেই মানুষের বিশ্বাস; কারণ পৃথিবীর ইতিহাসের শুরু থেকে, অর্থাৎ ষাট লাখ বছর আগে যখন বর্তমান মানুষ ও শিম্পাঞ্জিদের পূর্বপুরুষেরা প্রথম আবির্ভূত হয়, তখন থেকে এতগুলো বছর ও দিন যদি লাগে প্রথমবারের মতো এমন মারাত্মক এক শব্দ উৎপন্ন হতে, তাহলে এই অনুমান যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য এক অনুমানই থাকে যে, দ্বিতীয়বার এ রকম ঘটনা আমাদের জীবনকালে অন্তত আমরা আর হতে দেখব না। সম্ভাব্যতার গণিতই এর সবচেয়ে সহজ প্ৰমাণ।
ছয়. সবাই শব্দটার প্রকৃতি, স্থায়িত্বকাল ও পরিণতি নিয়েই ভাবছে বেশি এবং বহু লোক ভেবে যাচ্ছে এই শব্দের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য কী হতে পারে, সে বিষয়েও। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি কথাটা মানুষের মাথায় এসেছে কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হোয়াইট হাউসে দেওয়া বিবৃতির পরই : এর কারণ। কারণটা উদ্ঘাটন করা গেলেই, ওবামা যেমন বলেছেন, এই শব্দনির্মাতাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে এবং তার লেজে লেজে এর বাকি ব্যাখ্যাও, বাকি দিকগুলোও চলে আসবে সহজেই। মোদ্দা কথা, কারণ আগে, ব্যাখ্যা পরে এবং কখনোই এর উল্টোটা নয়।
সাত. ‘অনেকেই, স্যার, আপনার মতো করে অনেকেই, বছরের এতগুলো দিন থাকতে একেবারে ২০১৫ সালের পনেরোই আগস্ট শুরু হওয়া মাত্র এ শব্দের সংঘটন ঘটল বলে এর সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অদ্ভুত যোগাযোগ দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু কী সেই যোগাযোগ, তা তারা ব্যাখ্যা করতে পারছে না।’ মেহেরনাজ বলল তাদের কথাবার্তা শুনে তার এমনটা মনে হয়েছে যে : এক. প্রকৃতি এত দিন পরে, এই চল্লিশ বছর পরে ওই রাতের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাল তার নিজের ভাষায়; দুই. হত্যাকাণ্ডের ঠিক একই দিনে এই শব্দ ঘটিয়ে পাকিস্তানপন্থী, তীব্র ডানপন্থী ও আওয়ামী লীগবিরোধীরা হত্যাকাণ্ডের শোক ও গাম্ভীর্যের মূলে একটা অ্যাবসার্ডিটির তকমা পরিয়ে দিল। তারা আসলে পনেরোই আগস্ট তারিখটার প্রতীকী দিকটাকে এই চল্লিশ বছর পরে পরিবর্তন করে দিতে চাইল; তিন. এই দিনে এই শব্দ থেকে বোঝা গেল যে অন্ধকারের এজেন্টরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে ১৯৭৫-এ শেষ করতে পারলেও তার দুই মেয়েকে শেষ না করার আক্ষেপ থেকে, যে আক্ষেপ এখন তাদের আরও বেশি, কারণ বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়েই এখন আবার সেই একই দেশের ক্ষমতায়—এভাবে জানিয়ে দিল, তোমাদের বাকি দুজনকেও আমরা শেষ করব, সেই সাথে তোমাদের সন্তানসন্ততি নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার যে শাখায় বেড়েছে, সেই শাখাগুলোও ছেঁটে ফেলব। এই শব্দ একই সাথে ওই ষড়যন্ত্রকারীদের আক্ষেপ ও মরণকামড়ের গোঙা আওয়াজ।
আট. সবশেষে (‘সবশেষে’ কথাটা বলতে গিয়ে ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল দেখলাম মেহেরনাজ), সবশেষ কথাগুলো মনে রাখতেই হবে : শব্দটা আসমান থেকে আসেনি, যদিও অধিকাংশ ধার্মিক মুসলমান আসমান ও খোদার গজবের কথাই বলতে চাইছেন, তবে আকাশ থেকে ওটা আসাই অনেক ভালো ছিল কোনো মানবগোষ্ঠীর হীন কার্যক্রম থেকে আসবার চাইতে, আর এটা মাথায় রাখাই ভালো যে আরেকটা এমন শব্দ শোনার জন্য আমাদের হাজার বছর অপেক্ষা করতে হলেও এই শব্দের পরে অন্য কোনো একই রকম শব্দ না থেকে যদি দেখা যায় যে একেবারে অন্য রকম কিছু রয়েছে (যা এর থেকেও বিধ্বংসী), তাহলে সেখানেই সবকিছুর ইতি ঘটে যাবে।
মেহেরনাজের এই শেষ কথাটার মধ্যে এমন এক অশুভের ইঙ্গিত আছে যে কোনো সুস্থ মানুষ তা ভেবে অসুস্থ না হয়ে পারে না। সোজা কথা, এই থিওরি অনুযায়ী, শব্দটা শেষ নয়, শুরু মাত্র -এটা কোনো প্রলয়ংকরী ঘটনাপরম্পরার সূচনা, যার পরের ধাপ থেকে পরের ধাপে রয়েছে এক ধারাবাহিক ভেঙে পড়া, গুঁড়িয়ে যাওয়া, এক কূলকিনারাহীনভাবে নিষ্পাদিত হয়ে যাওয়া।
মেহেরনাজের জায়গায় আমি হলে ওর এই আটটা ফাইন্ডিংসের (যার শেষটাতে আবার রয়েছে তিনটে সাব-ফাইন্ডিংস, সে হিসাবে মোট দশ) বিবরণ দিতে গিয়ে একটা পুরো বিকেলই নিয়ে নিতাম, যেহেতু আমার মধ্যে রয়েছে বেশি কথা বলার দোষ এবং পৃথিবীর অধিকাংশ বুদ্ধিমান মানুষের মতো কিছুটা অতিশয়োক্তি করার প্রবণতা। অতিশয়োক্তি করা মানুষ থেকে মানুষে কার্যকরী যোগাযোগ ঘটানোর এক প্রমাণিত শক্ত মাধ্যম, যাতে বিশেষ জোর দেওয়া হয় অনুমান ও অর্ধসত্যের ওপরে, যার ফলে বলা কথাটা সম্বন্ধে শ্রোতার বিশ্বাস ও আস্থা উৎপাদন সহজ হয়। কিন্তু আমি আজকের এই দানবীয় অব্যাখ্যেয় বিভীষিকার কথা মাথায় রেখে এটা ভেবে খুশি হলাম যে, মেহেরনাজ কোনো অতিশয়োক্তি করেনি, যা বলার তার চাইতে একটুও বেশি বলেনি, সে মাত্র পনেরো মিনিটে শেষ করেছে তার সব কথার পুরোটাই। আর এ বিষয়ে সে যা বলেছে, তার মধ্যে ফের কোনো অতিশয়োক্তি ঘটানোর মানে তো সোজা কেয়ামতেরই কথা বলা।
আমি তাকে ‘থ্যাংক ইউ, মেহেরনাজ’ বললাম আন্তরিকভাবে, এক সকাল ও এক দুপুরের মধ্যে এতগুলো অনুমান, এতগুলো আন্দাজ ও পূর্বধারণাকে তার একসঙ্গে জড়ো করতে পারার প্রশংসা করলাম দ্বিধাহীন চিত্তে। আহা, এই গরমের দিনটাতে কত কত লোকের সঙ্গেই না তাকে কথা বলতে হয়েছে, কত কত ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের গোয়েন্দাকে পটাতে হয়েছে মিষ্টি হাসি দিয়ে কিংবা ওড়না একটু ওপরে তুলে বা (যেটা সে সব সময়েই করে) ঘাড়ের চুল সরিয়ে তার ডান ঘাড়ের মারাত্মক এক জায়গায় ওই সুন্দর তিলটা তাদের একনজর দেখতে দিয়ে। এ ব্যাপারে কৌতুকচ্ছলে তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে তার মুক্তোদানার মতো দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চিপে ধরে ভাবপ্রবণ এক হাসি হেসে বলল, ‘স্যার, বিশ্বাস করবেন, আজ মোট দশজনের মতো অফিসারকে আমি তিলটা দেখিয়েছি, মোট জনা পনেরো পথচারীকে ওড়না সরায়ে বুকের সাইজ বুঝতে দিয়েছি, মোট দুই ডজন লোককে অকারণে গালে টোল ফেলানো হাসি উপহার দিয়ে খুশি করেছি, আর তিন সত্যিকারের বড় সাংবাদিককে, যার মধ্যে একজন বিদেশিও ছিল এবং আমার ধারণা, সে কোনো সাংবাদিকই নয়, সে ছিল কোনো পাওয়ারফুল এমবাসির লোক, এ রকম তিনজনকে আমার হাতও টিপতে দিয়েছি।’
‘কেন করলে এসব তুমি?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘আপনি বলেছেন স্যার (আমি খেয়াল করলাম সে মাত্রাতিরিক্ত রকমের স্যার স্যার করছে আমাকে, বুঝলাম এটা ইচ্ছাকৃত, বললাম না কিছু।) বারবার বলেছেন, যা যা করতে হয়, তার সব করবে, কারণ আজ বিকেলের মধ্যেই আপনার সব কটি মূল অনুমানের খোঁজ লাগবে। বলেননি, স্যার?’
আমার মনে পড়ল না আমি কখন তাকে যা যা করার তার সব করতে বলেছিলাম, যে কথার মধ্যে কোনো মেয়ের জন্য এর চেয়েও ভয়ংকর হাত ধরাধরির চাইতেও ভয়ংকর—কোনো কাজ করতে বলার ইঙ্গিত থাকে। কী নির্বোধ আমি, আর কত সহজে একটা মেয়েকে বেচে দিতে, এত বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পিছপা হইনি। যা হোক, আমি তার সঙ্গে কোনো তর্কে গেলাম না, স্রেফ নিজের ‘কল্যাণকামী’ স্বার্থপরতাকে ন্যায্যতা দিতেই তাকে বললাম, ‘তোমাকে ওভাবে জোর দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না, মেহেরনাজ। অ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে জ্বরে পুড়তে থাকা শত শত বাচ্চা ও স্মৃতি হারানো কিছু বয়স্ক লোককে দেখে আমি বুঝে গেছি, যা করার তা আকারে-ইঙ্গিতে করার আর সময় নেই। সবকিছু এখন অনাসক্তি, কিন্তু-কিন্তু ভাব ও বাসনাসংযমের বাইরে গিয়েই করতে হবে।’
মেহেরনাজ বলল যে আমার বাংলা শুনে তার মনে হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেন কথা বলছেন। আমি জানি না বঙ্কিম কীভাবে কথা বলতেন, কিন্তু ‘বাসনাসংযম’ শব্দের এ রকম অপরিকল্পিত প্রয়োগে আমি নিজেই চমকে উঠলাম। যা কিছু হবার নয়, তা-ই হয়ে যাচ্ছে আজকে।
মেহেরনাজ চুপ, আমিও চুপ। আমার মনে হলো সে আমার কথার কিছুটা বুঝতে পেরেছে এবং কিছুটা ধরতে না পেরেই চুপ হয়ে গেছে। আমি তার দুচোখে দেখলাম অনেক অজ্ঞাত অশ্রুবিসর্জন, অনেক স্নায়ুদৌর্বল্যের গোধূলি এবং অজানার সামনে দাঁড়ানোর নারীসুলভ জাড্য। হঠাৎ থিরথির করে ওঠা একধরনের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে আমি দ্রুত তার সোফার পাশে গিয়ে তার মাথা আমার দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বুকের নিচের দিকে ঠেকালাম। সে স্থির হয়ে থাকল, নড়ছে না একটুও। এবার আমি তার মাথাভরা চুলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসে গলায় আওড়ালাম ইউরিপিদিসের অমর বাক্য : ‘He is not a lover who does not love forever।’ মেহেরনাজ নিজেকে আমার থেকে নরমভাবে, জোরে নয়, মুক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘ইউরিপিদিস হোক আর যে-ই হোক, এই কথাটার মধ্যে বিরাট ফাঁকি আছে। এটার এ ব্যাখ্যাও হয় যে ইউরিপিদিস এখানে কোনো মানুষকে ভালোবাসার কথা বলেনইনি, বলেছেন “চিরন্তন”কে, “ফরএভার”কে ভালোবাসার কথা। হা-হা।’
“তাহলে মার্সেল প্রুস্তের “Love is space and time measured by the heart”, এই কথাটা?’
‘এটা শোনাচ্ছে ফিজিকসের মতো। নূর হোসেন স্যার এটা অ্যাপ্রিশিয়েট করবেন, আমি না। আর মার্সেল গ্রুস্তের আমি নামও শুনতে চাই না।’
এভাবেই, এভাবেই কেটে গেল কিছুটা সময়। আমরা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ম্যাপ টেবিলে পেতে মুখোমুখি বসলাম টেবিলের এপাশ আর ওপাশে এবং দান্তের ডিভাইন কমেডিতে বাগানে বসে প্রেমের এক বই পড়তে পড়তে হঠাৎ সুন্দরী ফ্রান্সেসকার ঠোঁটে—মুখের ভেতরে-যেভাবে চুমু দিয়ে বসে পাওলো, সেভাবে আমিও আমাদের মাঝখানের ছোট টেবিল অতিক্রম করে ঠোঁট বাড়িয়ে দিলাম মেহেরনাজের ঠোঁটের দিকে।
সে শুধু কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে গিয়ে তার কণ্ঠের মধ্যে কোনো গুহাবাসী মানুষের আলোর প্রতি অসহনীয়তাকে ধারণ করে বলল, ‘স্যার, আজ না। এমনিতেও আপনার সঙ্গে আর না। আর এমনিতেও আপনি-আমি কেউই জানি না কাল রাতের ওই শব্দ আমাদের ঘরসংসার, বেডরুমে, বাথরুমে কী কী ঘটায়ে থাকতে পারে। জাস্ট থিংক অ্যাবাউট ইট-এমনও তো হতে পারে যে বিশাল এক শব্দ করে এক ধাক্কায় সব জায়গায় বসায়ে দেওয়া হয়েছে গোপন ক্যামেরা, সব হাতে, সব ব্যাগে ভরে দেওয়া হয়েছে গুপ্তচরের ইনভিজিবল টেপরেকর্ডার?”
আমি সভয়ে—মর্মাহতের মতো—বুঝতে পারলাম ওই বিকট শব্দ ঢুকে পড়েছে আমাদের ভালোবাসাবাসি ও মান-অভিমানের জায়গাগুলোতেও।
মেহেরনাজকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, যে ‘এমনিতেও আপনার সঙ্গে আর না’ বলতে সে কী বুঝিয়েছে। মেহেরনাজ উত্তর দিল না। আমি তার সঙ্গে ঝগড়া বাধাতে চাইছি। এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, অন্য আরও পুরুষের সঙ্গে বিছানায় যেতে তার কেমন লাগে? জিজ্ঞাসা করলাম, প্রধানমন্ত্রী বিকেলে বসুন্ধরার ঠিক কোন জায়গাগুলোতে যাবেন, তা সে জানে কি না?
মেহেরনাজ প্রথমে বলল, ‘আই ডোন্ট আস্ক ইউ অ্যাবাউট সুরভি। আই নেভার আস্কড ইউ অ্যাবাউট ইওর ফ্যান্টাসিজ ফর ইওর ফ্রেন্ডস ওয়াইফ লুনা। হোয়াই ডু ইউ আস্ক মি অ্যাবাউট হোয়াট আই ড্র উইদ হুম ইন হুজ বেডরুম? হোয়াট আই ফিল অর ডোন্ট ফিল অ্যাবাউট ড্রয়িং দ্যাট থিং উইদ হিম অর দেম?’
আমি বুঝলাম, সারা দিনের গরম, ঘাম, ক্লান্তি, খিদে-সবকিছু মিলে মেহেরনাজ দ্রুত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। পরিবেশ, পরিবেশের প্রভাব। সব এড়ানো যায়, শুধু এ জিনিসটা ছাড়া। আমার ভালোই লাগছে ওর লাল হয়ে আসা গাল, ঘাম ফুটে উঠতে থাকা অদৃশ্য গোঁফের জায়গা এবং রাগে-ক্রোধে বুকের ওঠানামা দেখে যেতে।
কী যেন হলো মেহেরনাজের। সে হঠাৎ শুয়ে পড়ল সোফায়, হাতলে মাথা রাখল, চোখ বুজল এবং স্বগতোক্তির মতো করে বলল, ‘ধুয়ে ফেললে সব শেষ। এটাই প্রধান সত্য। মানুষ সেক্সুয়াল লয়্যালটি ও ফাইডেলিটির ধাঁচেই গড়া না। অসম্ভব। গোপন জীবন সবচাইতে বিশ্বস্ত, সবচাইতে ফেইথফুল হাজবেন্ডেরও আছে, ওয়াইফেরও আছে। থাকতেই হবে। ফেইথফুলনেস একটা কনসেপ্ট মাত্র। অন্যভাবে ভাবলেই এ ধারণার শেষ। এক পুরুষে বিশ্বস্ত থাকা—এগুলো পুরুষদের ঈর্ষা থেকে বানানো সিস্টেম। রিলিজিয়ন বলছে এটা একটা ব্যাধি, এটা না দূর করলে সমাজব্যবস্থা টিকবে না। এটা চরম পর্যায়েই চিরকাল ছিল, চিরকাল আছে, আবার একই সাথে সমাজ টিকেও আছে, থাকবে। কারণ, স্যার, সমাজব্যবস্থার গোড়ায় আছে নেসেসারি হিপোক্রেসিগুলো। চাকরের সাথে ভালো ব্যবহার করো, কিন্তু চাকর চাকরই থাকুক। আমার টাকা আমার সন্তানের জন্য ছাড়া অন্য কারও জন্য না, সন্তানের প্রয়োজনে লাগুক কি না লাগুক। সবকিছুর গোড়ার দিকে এই সংসার, এই ফ্যামিলি কনসেপ্ট। আর সংসার ব্যবস্থার গোড়ার দিকে হিপোক্রেসি। অ্যান্ড আই হ্যাভ নাথিং বাট গুড টু সে অ্যাবাউট দ্যাট।’
আমি চুপ করে আছি। নতুন একটা কথাও বলেনি মেহেরনাজ। আমি তার কাছ থেকে নতুন কিছু শোনার আশা করছিলাম। পাশ ফিরল সে, সোফার পিঠের দিকে। আমি দেখলাম সে ঢুকে যেতে চাইছে সোফার ওই পিঠ ও পাছার মাঝখানের গর্তের ভেতরে। অনেকটা ঢুকেও গেল সে, নিজের দুহাত রাখল তার দুই হাঁটুর মাঝখানে, শিশুদের মতো, তারপর আবার টান টান করল শরীর, আমি আবারও দেখছি তার পিঠ সরে যাচ্ছে ওই গর্তের দিকে। মেহেরনাজ বলল, ‘স্যার, জাস্ট দ্য বাউন্ডারিজ নিড টু বি ডিসকাসড ইন রিলেশনশিপস। হোয়েন উই সি লাইফ অ্যাজ আ স্টোরি, উই ওয়ান্ট দ্য ক্যারেকটারস নিয়ার অ্যান্ড ডিয়ার টু আস টু বি দ্য ওয়ানস উই ক্যান ট্রাস্ট। বাট দ্য থিং ইজ, লাইফ ইজ নট আ স্টোরি। সামথিং ক্যান নট বি আ স্টোরি হুইচ ইজ এডিটেড সো মাচ, সো অফেন। লাইফ ইজ ম্যাক্সিমাম আ নিউজ রিপোর্ট।’
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে। কী এক তীক্ষ্ণতা আবার একই সঙ্গে এক ঘুমে ক্লান্তিতে জড়ানো নিশুতি ছিল ওর কথার মধ্যে যে কথার কনটেন্টের চেয়ে বলার স্টাইলটা আমাকে আকৃষ্ট করল বেশি। হঠাৎ কী একটা স্পন্দন, কী একটা কিছু আমি লক্ষ করলাম ওর শরীরের ভঙ্গিমাতে এবং বুঝে গেলাম মেহেরনাজ ঘুমিয়ে পড়েছে। চেনা মানুষ কখন স্রেফ চোখ বন্ধ করে আছে আর কখন ঘুমিয়ে গেছে, তা বোঝার জন্য স্রেফ নিশ্বাসের শব্দটা ঠিকভাবে শুনলেই চলে। আমার মনে হলো যেন আলবারতিন ঘুমিয়ে রয়েছে আর মার্সেল দেখছে এবং ঈর্ষার আগুন ও ভালোবাসায় পুড়ছে। আলবারতিন ঘুমিয়ে থাকলেই কেবল মার্সেলের শান্তি, কারণ, আলবারতিন জাগলেই মার্সেল উদ্বিগ্ন, বিচলিত তার অবিশ্বস্ততার গল্পগুলোর সত্য-মিথ্যা নিয়ে, আবার ওই গল্পগুলো শোনা ছাড়া মার্সেলের উপায়ও নেই কোনো। আলবারতিনকে ভালোবেসে যাওয়ার তার একমাত্র পথই ওটা—নানাবিধ ঈর্ষার কাঁটায় বিদ্ধ হতে থাকা। মার্সেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায় বিছানায় ঘুমন্ত আলবারতিনের দিকে তাকিয়ে থেকে, সে বোঝে আলবারতিনের এই ঘুমের মুহূর্তগুলোতেই শুধু সে মুক্ত যন্ত্রণার হাত থেকে, শুধু কেবল তখনই সে আলবারতিনকে ভালোবাসতে পারে একটু লম্বা সময় ধরে।
আলবারতিনের সঙ্গে কাটিয়েছি আমি অনেক হাসিখুশির সন্ধ্যা–কথা বলে, খেলা করে; কিন্তু সে ঘুমিয়ে আছে সেটা দেখতে পারার মধ্যে যে শান্তি, তা আর কিছুতে নেই।…তার চোখ বন্ধ করে, ঘুমের মধ্যে তার চেতনকে হারিয়ে আলবারতিন একটার পর একটা খুলতে থাকে তার বিবিধ ব্যক্তিত্বের নানা চেহারা, যে চেহারাগুলো দিয়ে সে আমাকে প্রতারিত করে যাচ্ছে তার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে। ঘুমন্ত আলবারতিনের মধ্যে যেটুকু প্রাণ তা গাছেদের, উদ্ভিদদের অবচেতন জীবনের মতো, এমন এক জীবন, যা আমারটার থেকে অনেক আলাদা, অনেক অচেনা, কিন্তু যা আমার অনেক নিশ্চিত দখলে। …তার এই রূপটাকে আমার চোখের সামনে ভাসমান রেখে, আমার হাতে ধরে রেখে আমি অনুভব করলাম যে আমি তার দখল নিয়ে নিয়েছি পুরোপুরি, এমনভাবে যেটা কিনা আমি কখনো করতে পারিনি তার জাগ্রত অবস্থায়। তার জীবন এখন আমার অধীন, সেই জীবনের মৃদু নিশ্বাস এখন ভেসে আসছে আমার দিকে।… আমি তার পাশে শুয়ে পড়লাম, আমার একটা হাত রাখলাম তার কোমর বেড় দিয়ে, ঠোঁট ছোঁয়ালাম তার গালে, তার হৃদয়ে, তারপর আমার মুক্ত হাত রাখলাম ঘুরে ঘুরে তার শরীরের সবখানে। আমার হাতটাও উঠছে আর নামছে, মুক্তোদানার মতো করে, আলবারতিনের নিশ্বাসের ওঠা ও নামার সাথে : আমার সারা শরীর হালকা দুলছে তার শরীরের নিয়মিত স্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে। আলবারতিনের ঘুমের মধ্যে আমি পাল উড়িয়ে দিলাম।
মেহেরনাজ ঘুমাচ্ছে। আমি বেডরুমে গেলাম। বিছানায় মাথার পাশের ড্রয়ার থেকে হাতে নিলাম আমার স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন 39।4 -অ্যালয় ফ্রেম, ব্লু কার্বন-স্টিল স্লাইড, সাপের গায়ের রং, নাইন মিলিমিটার, ম্যাগাজিন আট রাউন্ড, ভরা আছে। প্রধানমন্ত্রী বসুন্ধরার যেখানে আসবেন, সেখানে আমার তাঁকে প্রতিরক্ষা দিতে হবে আগস্টের অন্ধকার শত্রুদের হাত থেকে। না, বিকেল নেমে যাচ্ছে, আমার দেরি করার আর সময় নেই। কে জানে প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে পৌঁছে গেছেন কি না। আমি হন্তদন্ত হয়ে, পিস্তল কোমরের কাছে গুঁজতে গুঁজতে, বের হলাম বেডরুম থেকে। দেখি মেহেরনাজ দাঁড়িয়ে আমার বেডরুমের দরজায়, সে বলল, ‘পিস্তল নিয়ে কোথায় যান, স্যার?’ আমি ঘাবড়ে গেলাম এক মুহূর্ত, তারপর মনে করলাম যে সে সবই জানে, জানে এটা আমি কাল ইবরাহিমের কাছ থেকে নিয়েছি। বললাম, ‘প্রাইম মিনিস্টার বসুন্ধরা আসছেন। আই মাস্ট প্রটেক্ট হার। আই মাস্ট অ্যাট লিস্ট ট্রাই টু। ইটস ফিফটিনথ অগাস্ট টুডে।’
মেহেরনাজ আমার পথ আগলে ধরল, বলল, ‘ডোন্ট বি সিলি। পিএম ইজ গোয়িং ট ডি ব্লক, হাউস নাম্বার সিক্সটি থ্রি। আওয়ামী লীগের এক নামকরা নেত্রীর বাসায় তাঁর স্বামী মারা গেছেন ওই শব্দ থেকে। তাঁর বয়স হয়েছিল পঁয়ষট্টি, এমনিতেও ভুগছিলেন জন্ডিসে, অ্যান্ড হি ডায়েড হোয়েন ইট এক্সপ্লোডেড। পিএম তাকে কনডোলেনস জানাতে আসছেন আপনার ওখানে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমি ছিলাম ওখানে। পুরো ডি-ব্লক চার-পাঁচ লেভেলের সিকিউরিটি ব্লাংকেটের মধ্যে মোড়া এখন। ইউ উইল জাস্ট গেট অ্যারেস্টেড অন দ্য স্পট ইফ ইউ গো দেয়ার উইথ ইওর ব্লাডি পিস্তল। আর ইউ আ ফুল?’
মেহেরনাজ ধমকের সুরে জোরে বলল আমাকে, প্রায় চেঁচিয়ে। আমি দেখলাম, যুক্তি আছে ওর কথার মধ্যে। সে নিজের চোখে দেখে এসেছে এই নিরাপত্তাব্যবস্থা, অতএব আমার ভরসা রাখার জায়গা আছে কিছুটা। আমি পিস্তলটা টি-শার্টের নিচ থেকে বের করে হাতে নিলাম, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন সে বলল ‘এক্সপ্লোডেড’ কথাটা, কী করে সে জানল ওই শব্দ কোনো বোমা বা কিছুর বিস্ফোরণ ছিল? মেহেরনাজ বলল যে সে জানে না ওটা এক্সপ্লোশন ছিল কি না কোনো, শুনতে এক্সপ্লোশনের মতো লেগেছিল বলেই সে বলেছে কথাটা, কোনো স্পেসিফিক কারণে নয়।
আমার হাত থেকে পিস্তল একরকম কেড়ে নিল সে তার হাতে, বলল, ‘ইট লুকস লাইক আ স্নেক, স্যার, বিউটিফুল’, তারপর সে হেঁটে গেল আমার লেখালেখির ঘরে, আমার ছোট লাইব্রেরি রুমে। আমি গেলাম তার পেছন পেছন। সেখানে টেবিলে ছড়ানো আমার কাফকা, সাদা কাগজে সেলো পয়েন্টেক 0.5 জেল পেনে তারা সাদা সাদা এ-ফোর সাইজের কাগজের ওপরে মাখামাখি।
মেহেরনাজ বলল, ‘দিস ইজ ইওর প্লেস, দিস পেন ইজ ইওর উইপন, আই মিন ইফ ইউ ওয়ান্ট টু কল আ পেন আ উইপন। নট দিস পিস্তল।’
আমি তাকে শান্ত-স্থির গলায় বললাম, ‘কাফকা বাদ। আর কোনো অনুবাদ না। আমি লিখব আমার নিজের লেখা—টুঙ্গিপাড়ার বিদ্রোহ নিয়ে, টাইমলাইন ১৬ আগস্ট ১৯৭৫।’
মেহেরনাজ বলল, অধিকাংশ ঘটনা ও বাক্যের শেষে আমি যেভাবে বলি, ‘ভালো।’
তারপর আবার, আমার হাতে পিস্তলটা ফেরত দিতে দিতে, আই অ্যাম হ্যাপি ফর ইউ।’
.
পনেরোই আগস্ট রাত নামল অন্য সব রাতের মতোই, শুধু পার্থক্য এটুকু যে সবকিছু বড় বেশি শান্ত, যেন আমরা বাস করছি কোনো শ্মশানে। আমি বাসায়। টিভিতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বসুন্ধরা এসেছিলেন, তিনি একটা বাসায় ঢুকে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীকে সমবেদনা জানালেন, তারপর চলে যাওয়ার সময় বাড়ির সামনে উপস্থিত জনতাকে বললেন, ‘আমরা এই বিকট শব্দের উৎস ও কারণের খোঁজে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এফবিআইয়ের সহায়তা চেয়েছি। তারা জানিয়েছে, তারা আমাদের সব রকম সহযোগিতা করবে। দেশ যখন সামনে এগোচ্ছে, তখন যারা এ দেশের ভালো চায় না, তারা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে এভাবে বারবার ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আজ জাতীয় শোক দিবসের দিনে তারা এভাবে পঁচিশজনের মতো নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে কী অর্জন করল, সে প্রশ্ন আমার জাতির কাছে। ১৯৭৫-এর এদিনে আমি সব হারিয়েছি। আজকের শোকগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বলব, আমি তাদের এই আকস্মিক বিপদে পাশে আছি, আমার সরকার তাদের শোকের সঙ্গী, আজকের এই দিনে আমার দিকে তাকিয়ে আপনারা বেঁচে থাকার সাহস সঞ্চয় করুন এবং মহান আল্লাহ তাআলার ওপরে ভরসা রাখুন। আমাদের তদন্ত চলছে, শিগগিরই আমরা আশা করি ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খুলে দিতে পারব। এতগুলো নিরীহ মানুষের মৃত্যু এবং এতগুলো নারী-পুরুষ-শিশুর আহত হওয়ার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে সরকার আগামীকাল ১৬ আগস্ট রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষণা করছে, আর আমি সবাইকে, বিশেষ করে আমাদের চিকিৎসক ভাইবোনদের আহ্বান জানাচ্ছি অসুস্থ মানুষের পাশে থাকবার জন্য। আপনাদের সবার দোয়ায় আমরা এই বিপদ কাটিয়ে উঠবই।’ ইত্যাদি।
একটু পর টিভির নিচের স্ক্রলে লেখা আসতে লাগল যে বিশেষ শোক দিবস উপলক্ষে আগামীকাল স্কুল-কলেজ সরকারি অফিস সব বন্ধ থাকবে, সারা দেশের মসজিদগুলোতে বিশেষ প্রার্থনা চলবে। একটা টিভি চ্যানেল লাইভ দেখাতে লাগল এর পরে প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপোলো হাসপাতালে যাওয়ার পথটুকু, যার শেষে তিনি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে আহত মানুষদের, দেখলাম অধিকাংশই শিশু, আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। আমি এই প্রথম দেখলাম তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর বোন শেখ রেহানাও। আমি ভাবলাম, ওই পরিবারের এ দুজন মাত্র মানুষই বেঁচে গেছেন ‘৭৫-এ, ভাবলাম আজকের দিনে এদের টিভি পর্দায় দেখে নিশ্চয়ই কতখানি বিচলিত হচ্ছে ওই লোকগুলো, যারা চল্লিশ বছর আগে ১৯৭৫-কাণ্ড ঘটিয়েছিল।
আমি টিভি বন্ধ করলাম, বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আকাশে বিরাট গোল চাঁদ। আমরা ওখানে থাকি না, ওই গোলকের মধ্যে। আমরা থাকি তার কাছেরই আরেকটা গোলকের ওপরে, যাকে চাঁদের থেকে দেখতে লাগে তলহীন কৃষ্ণকালো এক সাগরের মাঝখানে বায়ু ও রঙের খোল দিয়ে মোড়া কোনো মার্বেলের মতো, ভঙ্গুর সে, আশ্চর্য সে, কোনো সাবান ফেনার বড় বুদ্বুদ যেন। আমার মনে পড়ল ‘আর্থরাইজ’ নামের বিখ্যাত ফটোটার কথা। ১৯৬৮ সালের ক্রিসমাসের দিনে অ্যাপোলো-৮ থেকে ওই ফটো তুলেছিলেন নভোচারী মেজর উইলিয়াম অ্যান্ডার্স। অ্যাপোলো মিশনের চাঁদে নামবার জন্য যথাযোগ্য জায়গা খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি অত দূরে, আর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ‘পৃথিবীওঠা’র ওই বুক হা-হা করে ওঠা ছবি, ঠিক সূর্য ওঠার মতো, চাঁদ জাগার মতো। দূরে সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে সেই ফটোয় তাতে দেখা যাচ্ছিল চকচকে এক নীল পৃথিবী, নীল মার্বেল, জাগছে চাঁদের ছাইরং পাহাড়-পর্বতের ওপর দিয়ে কোনো কসমিক হাসিমুখের মতো করে। সঙ্গী কমান্ডার বোরম্যান অ্যান্ডার্সকে বলেছিলেন, ‘হেই, ছবি নিয়ো না, আমাদের কাজের তালিকার বাইরে যেয়ো না।’ অ্যান্ডার্স কথা শোনেননি, না শুনে তিনি সারা পৃথিবীকে ‘পৃথিবীওঠা’র বিহ্বল ও বিবশকারী ওই ছবি উপহার দিলেন। মেজর অ্যান্ডার্স ও কমান্ডার বোরম্যান কথা বলছেন, সরাসরি ব্রডকাস্টে তখন তাঁদের সে কথা শুনছে পৃথিবীর অসংখ্য, অগণন মানুষ। অ্যান্ডার্স বললেন, ‘আদিতে ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন আসমান ও পৃথিবী।’ কমান্ডার বোরম্যান বললেন, ‘আর ঈশ্বর নিশ্চিত করলেন যে এই সৃষ্টি ভালো হলো।’ অ্যাপোলো-৮-এর আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার, সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার এখন এই ছবি। প্রাণের অস্তিত্ব আছে, এমন একটামাত্র আবাসিক গ্রহের অধিবাসীরা তাদের ‘জায়গাটা চিনল ওই প্রথমবার’, যেমন বলেছিলেন টি এস এলিয়ট। ‘চাঁদ পরীক্ষা করতে গিয়ে’, মেজর অ্যান্ডার্স পরে বলেন, ‘মানুষ পৃথিবীকে আবিষ্কার করে এল।’
আমি ঘরে ঢুকে ল্যাপটপে, ইউটিউবে গেলাম, কারণ, আমার মন চাইল যে আমি ৪৭ বছর আগের ভিডিও-অডিও ফাইলের ঝিরিঝিরি শব্দের মধ্যে অ্যান্ডার্স ও বোরম্যানের ওই কথোপকথন শুনি। শুনলাম। কুঁজো পিঠ পৃথিবী, উজ্জ্বল আলো ছড়ানো নীল তার রং, ভাসছে শূন্য খাঁ খাঁ চাঁদের দিকচক্রবালের ওপরে আপাত-গতিহীন, আপাত-পাতালহীন মহাজাগতিক এক কালো শূন্যের মাঝখানে। আমরা কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তারই চাক্ষুষ এক প্রমাণ এই ছবি, একই সঙ্গে এই ছবি আমাদের সুন্দর, নড়বড়ে, অপ্রতিকল্পনীয় ঘরটার মৌন এক রূপ। পৃথিবী মরূদ্যান, পৃথিবী নরক, এবং তার চারপাশের অনন্ত নিঃসঙ্গতা— যার মধ্যে সে ভাসছে—আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাদের যার যার ক্ষণজীবিতাকে। পৃথিবী থেকে তাকিয়ে চাঁদ দেখার ইচ্ছা উধাও হলো আমার, কানে বাজছে নক্ষত্রলোক থেকে পাঠানো রেডিওর স্ট্যাটিকের আওয়াজ, মনে হলো ওদের যেটুকু শোনা যাচ্ছে না, তা নিশ্চয়ই অ্যান্ডার্সদের দূরবিলাপের হ্যালো হ্যালো দিয়ে ভরা। আমার মন খারাপ হলো। তখনই বেজে উঠল ফোন। সুরভি। কাঠমান্ডু থেকে।
সুরভি তাদের ওখানকার ভূমিকম্পে মানুষের কী সব দুর্বিষহ দিন গেছে, তা বলছে আমাকে। আমি ফোনের এ পাশে নিঃশব্দ থেকে তা শুনছি। সুরভি হঠাৎ হঠাৎ বলে উঠছে, ‘হ্যালো, হ্যালো।’ সে আবার বলছে, ‘এত কিছুর পরও তোমাদের ঢাকার বসুন্ধরার ওই মুখ-চিপে-ধরা প্রচণ্ড শব্দ, যা এখন কিনা টিভিতে বারবার শোনাচ্ছে সিএনএন, বিবিসি, এমএসএনবিসি, সেই শব্দের এক ধাক্কাতেই ভয়ে-আতঙ্কে শত শত শিশুর প্রচণ্ড জ্বর এসে গেছে, লাশের মিছিল যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে আর আমরা দেখছি সেটা, সত্যি এর অভিঘাত কোনো ভূমিকম্পের চাইতেও বেশি বিধ্বংসী।’
আমি বললাম, ‘হুঁ।’
সুরভি আবার, ‘…এর মূলে আছে এর রহস্যময়তা। সবাই এ খবর নিয়ে কেন মেতে আছে বুঝতে পারছ? এর কারণ এর ভেতরকার ধাঁধা, কোনো ভূমিকম্পের ভেতরে যা নেই।’
সে এবার আমাকে মনে করিয়ে দিল কালভিনোর বেরেনিসে শহরের কথা। ‘অন্যায্য শহর’ বেরেনিসে, যার ভেতরে আবার আছে একটা ‘ন্যায্য শহর’, তার ভেতরে আবার এক ‘অন্যায্য শহর’, তার ভেতরে…। ‘বেরেনিসে অনেক শহরের একটা সিকোয়েন্স’ বলল সে, ‘ন্যায্য ও অন্যায্য, আর সেখানে ভবিষ্যতের অন্য সব বেরেনিসে ইতিমধ্যেই উপস্থিত, একটাকে আরেকটার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না এমন ওতপ্রোতভাবে জড়ানো ওরা।’
‘তুমি কি কাঠমান্ডুর কথা বলছ?’ আমি সুরভির কাছে জানতে চাইলাম।
‘তুমিই বলো,’ উল্টো সুরভি জিজ্ঞেস করল আমাকে।
‘আসলে আমি কী বলছি তা বুঝতে পারছি না, সুরভি। ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নের রাত গেছে আমাদের। ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের দিন। এখানে সব ঘরে খাওয়াদাওয়া বন্ধ। ভয় হচ্ছে এটাই বোধ হয় সভ্যতার শেষ।’ ‘সভ্যতা’র ইংরেজি আমি ভুল করলাম, তাড়াহুড়ো করে ‘সিভিলাইজেশন’কে বলে বসলাম, ‘সিভিলেশন।’ সুরভি আমার ভুল ধরিয়ে দিল। আমি তার ঠাট্টা উপেক্ষা করে বলতে লাগলাম, ‘সবচেয়ে বড় কথা, জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার ওপরে সবার বিশ্বাসই উঠে গেছে, মাত্র এক রাতের ব্যবধানে, পনেরোই আগস্ট রাতে। বুঝতে পারছ আমি কী বলছি? স্রেফ আরেকবার যদি এ রকম শব্দ আরেকটা হয়, তাহলে এদিকে মানুষের সব জীবনযাপন চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, তার চেয়েও বড় কথা আতঙ্কের ধাক্কায় মানুষ তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলবে। অ্যাপোলো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে দেখলাম অনেক রোগী কাঁদছে, কারণ তারা ওই শব্দের আগের পরের কোনো কিছু আর মনে করতে পারছে না, সামান্য ছাড়া ছাড়া এটা-ওটা তাদের মনে আসছে, এই যা।’
‘সেটাই তো ব্যাপার, প্রফেসর,’ সুরভি বলল, ‘যাক, আমার এখন ফোন রাখতে হবে। সারা পৃথিবী পুরো ঘটনাটার মধ্যে শয়তানের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। প্রকাশ্য কোনো শয়তান হলে হতো, যেমন আইএস বা আল-কায়েদা বা আমেরিকা বা নর্থ কোরিয়া, মানে অনেক টিভি চ্যানেলে যাদের কথা বলা হচ্ছে বারবার। কিন্তু এ শয়তান প্রকাশ্য নয়, সে শুধু শব্দই করেছে একটা, তার চেহারা দেখায়নি। এ সেই ফেরেশতা শয়তান, যে ফেরেশতা হতে রাজি হয়নি, কারণ তার মধ্যে অনেক ঘাটতি ছিল। বুঝতে পারছ আমি কী বলছি? কালো আয়না। প্রতিটা মানুষের, প্রতিটা সমাজের সব ভালো জিনিসের উল্টো চেহারা ওই আয়নাতে। তেমন কিছুই ঘটে গেছে তোমাদের ওখানে। প্রাচীন শত্রু একটামাত্রই লোক, কিন্তু সব পাপীর সব পাপের যোগফল আছে তার মধ্যে।’
আমি ভয় পেয়ে গেলাম সুরভির কথায়, তার বলার ঢঙে, তার নিপুণ ইংরেজি শব্দচয়নে এবং নিশ্বাসের গভীর শাঁ-শাঁ আওয়াজে। অন্ধকারের রাজপুত্রকে নিয়ে তার এসব কথা আমার জানা, কিন্তু সুরভি তার মোহিনী গলায় সামান্য নেপালি অ্যাকসেন্টের ক্ষমাশূন্যতা নিয়ে সেগুলো কেমন নাটকীয় করে তুলল ফোনের অন্য পাশে। বাইরে না তাকিয়েই আমি এত রাতে শুনতে পেলাম অনেক অ্যাম্বুলেন্সের অনেক ভোঁ ভোঁ, মিডিয়ার অনেক উদ্ধতচারী গাড়ির অনেক হর্ন এবং মাঝেমধ্যে এর বা তার চিৎকার। এতক্ষণ এই এত আওয়াজ কোথায় ছিল? সুরভি কালো আয়নার কথা বলে কি ডেকে আনল ওদের? ওরা সবাই কালো আয়নার কথা শুনে সেলিব্রেট করতে এল পৃথিবীর শেষটাকে? সাধু অগাস্তিন বলেছিলেন, “শয়তানকে বোঝা যাবে সদগুণের বা ভালোর অভাব থেকেই।’ তার মানে ঘরের মধ্যে প্রথমে থাকতে হবে আলো, তারপর হঠাৎ নিভে যেতে হবে মোমবাতিটাকে, আর তখন যে অন্ধকার নেমে আসবে, তার নামই শয়তান, অর্থাৎ কিনা প্রথম থেকে ঘর অন্ধকার থাকলে শয়তান আছে বলা যাবে না—শয়তানকে হতে হবে আলো ও ভালোর অনুপস্থিতির প্রতীক। আমাদের এখানেও সবকিছু কত ভালো ছিল গত রাত ১২টা ৭ মিনিটের আগে পর্যন্ত, আর এখন কীভাবে সবকিছুই শয়তানের দখলে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
সুরভি ফোন রাখার আগে আমাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘চুমু দিলে না?’ আমি চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তাকে বললাম, ‘আজ রাতে শেলির “ট্রায়ামফ্ অব লাইফ” কবিতাটা পড়তে পারো, মৃত্যু-কবিতা। সুরভি জানাল, সে ফোন রেখে কিছুক্ষণের মধ্যে কবিতাটা খুঁজে পড়বে, পরে আমাকে বলবে তার কেমন লাগল। ‘নিশ্চয়ই ফোনের “পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন” অ্যাপে পাওয়া যাবে ওটা?’ আমাকে জিজ্ঞাসা করল সে। ‘মোস্ট প্রব্যাবলি’, বললাম আমি।
রাত ভোর হতেই ইউলিসিসের সফরে নামব বলে ততক্ষণে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি, অস্থির লাগছে অনেক, আজ রাত চুমু খাওয়ার বা পাওয়ার রাত নয় কোনো এবং যেহেতু আমি জানি যে ফোন রাখি-রাখি করতে করতে সুরভি আসলে আরও অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেবে এবং বারবার বলবে ওই চুমুর কথা, তাই ওকে বুঝতে না দিয়েই হঠাৎ ফোনের লাইন কেটে দিলাম ওর হাঁসফাঁস করা অনেক কথা, অনেক রকম অনেক আওয়াজের মধ্যেই।
.