২.৩
আলেকসান্দার পুশকিন, প্রধানতম রাশিয়ান কবি, আধুনিক রাশিয়ান গদ্যের জনক, তাঁর লেখক-কবি খ্যাতির পাশাপাশি এ জন্যও অমর হয়ে আছেন যে সাহিত্যের ইতিহাসে তিনিই প্রথম বড় কেউ, যিনি নিজের নাম লিখে গেছেন রক্ত ও বারুদ দিয়ে। বিধ্বংসী মেজাজের এই যুবক মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তাঁর নিজের ভায়রা ভাই জজ দাঁতেসের—যাঁর অন্য নাম দান্তেস-গেক্কার, রাশিয়া নিবাসী সুদর্শন ফরাসি অ্যাডভেঞ্চারার সঙ্গে পিস্তলের ডুয়েল লড়ে প্রাণ হারালেন প্রায় তুচ্ছ, প্রায় উপেক্ষার যোগ্য এক মামুলি কারণে, যেমনভাবে তাঁর কাব্য-উপন্যাস ইভগেনি আনেগিন-এ আরেক পিস্তলের ডুয়েল লড়াইয়ে নায়ক আনেগিনের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র, নায়কেরই প্রিয়তম বন্ধু তরুণ কবি ভ্লাদিমির লেনস্কি, আর সেটাও এক প্রায় তুচ্ছ, প্রায় উপেক্ষার যোগ্য ছোট কারণ থেকে।
১৮৩৩ সালে প্রকাশ হয় ইভগেনি আনেগিন, এর ৫ হাজার ৪৪৬ পঙ্ক্তির ভেতরে এর কাহিনির বহু জায়গায় লেখক পুশকিনের নিজের জীবনের অসংখ্য ছায়া নিয়ে; বলা যায় প্রায় আত্মজীবনীমূলক এক লেখা; এবং তারই চার বছর পরে, ১৮৩৭ সালের ২৯ জানুয়ারি পুশকিন নিজে মারা গেলেন একইভাবে, সেন্ট পিটার্সবার্গের চেরনায়া বা কালো নদীর তীরে, ডুয়েল লড়তে গিয়ে। পুশকিনের আকস্মিক ও অকালমৃত্যুতে রাশিয়ান সমাজ তখন কাঁদছে ও কাঁপছে ক্ষোভে-শোকে; সে সময় আরেকজন বড় কবি, মিখাইল লেরমন্তভ, এখন যাঁর স্বীকৃতিও পুশকিনের পরেই রাশিয়ার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে এবং তখনকার দিনে যাকে ডাকা হতো ‘ছোট পুশকিন’ নামে, সেই লেরমন্তভ তাঁর প্রিয় কবির মৃত্যুশোক সামলাতে না পেরে ‘ডেথ অব দ্য পোয়েট’ নামের এক কবিতা লিখে কাঁপিয়ে দিলেন জারের শাসনে থাকা রাশিয়ান সামন্ত সমাজের ভিত, এক কবিতার অভিঘাতে পুরো সাম্রাজ্যকে নাড়িয়ে দিয়ে নিজে হয়ে উঠলেন পুশকিনের যোগ্য উত্তরসূরি, সেই কবি লেরমেন্তভও মাত্র ২৬ বছর বয়সে নিজের বাল্যবন্ধু নিকোলাই মারটিনভের ছুড়ে দেওয়া ডুয়েল লড়ার চ্যালেঞ্জ মেনে পিস্তলের গুলিতে মারা গেলেন ককেশাস পর্বতমালার পাদদেশের ছোট শহর পাইয়াতিগরস্কের মাশুক পাহাড়ের নিচে, প্রায় তুচ্ছ, প্রায় উপেক্ষণীয় এক কারণ থেকে, ১৮৪১ সালের ২৫ জুলাই তারিখে।
তিনটে মৃত্যু পরপর, তিনটেই বন্দুকযুদ্ধে–১৮৩৩, ১৮৩৬ ও ১৮৪১। প্রথমটা ঘটল এক উপন্যাসে এবং পরের দুটো বাস্তবে-রাশিয়ান দুই মহান কবির জীবনের ইতি টেনে। দ্বিতীয় মৃত্যুটা প্রথমটার কাল্পনিক ডুয়েলকে লেখকের বাস্তবে রূপ দেবার ইচ্ছা থেকেই যেন, আর তৃতীয় মৃত্যুটা যেন দ্বিতীয় ডুয়েলের অপ্রয়োজন ও অন্তঃসারশূন্যতার বোধ থেকে জাগা ক্ষোভের আরেক অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি ঘটাতে।
পুশকিন নামটা আমাদের স্মৃতিতে এভাবেই যুক্ত হয়ে আছে পিস্তলের সঙ্গে। ‘পুশকিন’ শব্দটা ভাবলে কারও মাথায় যেমন আসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সাহিত্যিকের কথা, যেমন সার্ভেন্তেস ভাবলে স্পেন, শেক্সপিয়ার ভাবলে ইংল্যান্ড আর দান্তে ভাবলে ইতালি, তেমনই মাথায় আসে এই ছোট শব্দ—পিস্তল। বড় এক পিস্তল হাতে ছোট পুশকিন, নিজের অহং ও জেদের শিকলে বন্দী; সিভিলিয়ান, কিন্তু যুদ্ধের সামরিক মাঠে অন্য যে কারও চাইতে জীবনকে তুচ্ছ করে ভাবতে উন্মুখ এক বেপরোয়া প্রাণ, যেন তিনি কোনো মিলিটারি জেনারেল, যিনি বুঝে গেছেন যে জীবনের মূল মানে ফুঁ করে এক শেষতম শ্বাস ফেলা, তারপর হারিয়ে যাওয়া অনন্তের হাতে হাত রেখে। পুশকিন—চণ্ডাল, কিন্তু খ্যাপাটে নীতিমান। আর লেরমন্তভ, তাঁর শিষ্য, তাঁরই অনুগামী—যদিও তাঁর অগ্রজ পুশকিনের সঙ্গে তাঁর কোনো দিন দেখা হয়েছিল বলে নিশ্চিত প্রমাণ নেই—কিন্তু পুশকিনের চেয়েও পাগলাটে, জীবনকে নিয়ে যা ইচ্ছা তা-ই করার প্রায় স্নায়ুবিকারে ভোগা, চেচনিয়া-দাগেস্তানে যুদ্ধে যোগ দিয়ে ‘লেরমন্তভ বাহিনী’ নামের এক দুর্বৃত্ত, ডাকাত-সৈনিক দলের বেয়াদব নেতার উপাধি পাওয়া শঙ্কাহীন তরুণ, যিনি বুঝে গিয়েছিলেন, মাত্র ২৬ বছর বয়সেই, যে জোর করে এক মুহূর্তের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না, তার চেয়ে ভালো হয় কোমরের বেল্ট থেকে পিস্তল হাতে তুলে নিয়ে প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে যা হয় হবে বলে ট্রিগারে চাপ দিয়ে দেখা যে কী হয়! শেষে বেশি হলে তো মৃত্যুই হতে পারে শুধু!
সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে রাত নেমেছে, ধীরে ঘন হচ্ছে অন্ধকার। শুক্রবারের সন্ধ্যা যেমন হয়, তেমন হালকা ভিড়, হালকা চিৎকার চারপাশে, আর শিশুদের কলকাকলি, শিশুরা যারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে সংসদ ভবন, শিশুপার্ক, শহীদ মিনার, টিএসসির মোড়—এসব দেখবে বলে। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি পুশকিন-ইভগেনি আনেগিন লেনস্কি -লেরমন্তভ—এই মানুষগুলোর কথা, ভাবছি যে কীভাবে পুরুষের মৃত্যুর পেছনে নারীর হাত থাকে, কীভাবে এ সবকিছুর যোগ খুঁজে পাওয়া যায় হোমারে। হেলেন নামের রূপবতী গ্রিক রানি তাঁর স্বামী মেনেলসকে রেখে ভেগে গিয়েছিল ভিনদেশি ট্রয় রাজ্যের যুবরাজ প্যারিসের হাত ধরে। পরিণামে, হেলেনকে ফিরিয়ে আনার জন্যই, পাল তুলেছিল সহস্র গ্রিক জাহাজ—৪৪ জন সেনা অধিনায়কের নেতৃত্বে ২৯টি সৈন্যদল গ্রিসের ১৭৫টি রাজ্য থেকে মোট ১ হাজার ১৮৬টি জাহাজ নিয়ে গ্রিস থেকে রওনা দিয়েছিল ট্রয় অভিমুখে, হেলেনের ভাশুর আগামেমননের পেছন পেছন। (আমার মনে পড়ল মেজর ডালিম তার ‘অপূর্ব সুন্দরী’ স্ত্রী তাসনিমকে ভাবত সে বুঝি বাংলার হেলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ডালিম সবাইকে এটা বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল যে তাসনিমের মুখের দিকে চেয়েই পনেরোই আগস্ট ভোরের হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া ট্যাংকগুলো চলতে শুরু করেছিল, যেমন হেলেনের জন্য করেছিল ওই সহস্ৰ জাহাজ। হাহ্। আমি হাসলাম। তাসনিমের চেহারা এমন ছিল না, যা দেখে সহস্র জাহাজ বা ৩০টা ট্যাংক তো দূরের কথা, একটা ঠেলাগাড়িও যাত্রা শুরু করবে।) যাহোক, হোমারেই ফিরে গেল আমার মন, যেখানে ওই এক হেলেনের কারণেই যুদ্ধে ও অন্তর্ঘাতে মারা গেল প্যাট্রোক্লাস, হেক্টর, অ্যাকিলিস, প্যারিস, আগামেমনন— এসব বীর।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে আমি ততক্ষণে এসে পড়েছি নীলক্ষেত মোড়ে। আবারও, না বুঝে ঢুকে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর, নীলক্ষেতের গেটের তলা দিয়ে। এই অন্ধকারের মধ্যেই চোখে পড়ল বিশালদেহী মেঘশিরীষ বা রেইনট্রিগাছগুলো, ওদের বয়স হবে নিশ্চিত ১০০-এর বেশি, আর মেঘশিরীষের থেকেও উঁচু কয়েকটা গগনশিরীষ গাছ, ঝরঝরে, স্লিম, মেদহীন, কী সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে ১৪ আগস্ট রাতের সব বাস্তবতাকে থোড়াই কেয়ার করে। আমি শুনেছি গগনশিরীষেরা, কেউ বলে রাজকড়ই, এসেছে মাদাগাস্কার থেকে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপের সমস্ত ইহুদিকে জাহাজে ভরে চালান করে দিতে চাইছিলেন হিমলার ও হেইড্রিখ।
গগনশিরীষ ও মেঘশিরীষগুলোতে হাওয়া উঠল খানিক, তবে পাতার সরসর শব্দ যতখানি, হাওয়া তত নয়, আগস্টের গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য কোনোভাবে যথেষ্ট তো নয়ই। আমি জহুরুল হক হলের উল্টো দিকের গামারিগাছগুলো খুঁজতে লাগলাম। কোথায় লুকিয়েছে ওরা এই অন্ধকারে, ওদের পানপাতার মতো বড় বড় পাতা নিয়ে? ফাল্গুন এলে বাদামি হলুদ বর্ণের পুষ্পপ্লাবনে ভেসে যায় ওরা, তখন এমনও দিন গেছে যে শুধু ওদের দেখতেই আমি ও মেহেরনাজ রিকশায় করে এসেছি এই একই জায়গায়, যেখানে দশ-বারোটা গামারি তাদের হাজার ফুল নিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে আমাদের, অকাতরে, আর মেহেরনাজ আমার উচ্ছ্বাস দেখে বলেছে, আমি একটা বাচ্চা ছেলে, খুব বেশি হলে কিশোর বলা যেতে পারে।
কিছুটা পেছন দিকে হাঁটতে হলো ফেলে আসা বিশাল উঁচু গামারিগাছগুলো খুঁজতে। পেয়ে গেলাম। সঙ্গে বোনাস হিসেবে মিলল হলের গেটের ছায়াঘন চালতে বৃক্ষটা এবং মাঠের ধারে কয়েকটা তেলসুর। তেলসুরগুলোর বাদামি সাদা ফুল নিচুমুখো হয়ে ঝুলে আছে ঝুমকার মতো, গাড়ির হেডলাইটের আলো তাদের গায়ে পড়তেই আমার মনে হলো চিরসবুজ এই ওদের এখন আর সবুজ লাগছে না কোনোমতে।
মানুষ ক্ষণস্থায়ী, প্রকৃতি চিরস্থায়ী—এমন এক বিশ্বাস প্রকৃতির ওপরে থাকে বলেই মানুষ তাদের নিয়তি নিয়ে পিচ্ছিল কিছু আশাও বুকে ধরে থাকতে পারে। তেলসুরগুলোর পাতার রং অন্ধকারে বদলে গেছে দেখে আমার বুকের ভেতরে প্রকৃতির চিরস্থায়িত্ব নিয়ে এক অযৌক্তিক কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য ব্যথা খচ করে উঠল। ট্রয় এক শহর, যা পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তার গাছগাছালি, পাখি—সবসহ। হোমার এক অতিমানবিক স্থিরতা ও প্রশান্তির সঙ্গে সে কথা বলেছিলেন তাঁর মহাকাব্যে। ট্রয় নগরীর সার্বিক পতনের সেই তীক্ষ্ণ বিলাপগান বেজে উঠল আমার কানে, স্মৃতিতে। আমি একটা বড় তেলসুরগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম আমার কোমরে গোঁজা পিস্তল ও পুশকিনকেও।
মনে পড়ল গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছিল লাইকাওন নামের এক ট্রোজান সৈন্য, উত্তরে অ্যাকিলিস তাকে বোঝাল যে প্রাণভিক্ষা চেয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ, প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কোনো অর্থই হয় না এই পৃথিবীতে, কারণ : ““বন্ধু আমার, তোমাকেও মরতেই হবে। কেন তা নিয়ে এ রকম হা-হুতাশ করো, বলো? এমনকি প্যাট্রোক্লাসও মারা গেছে, যে ছিল তোমার চেয়ে ঢের বড় মাপের মানুষ একজন। তুমি কি দ্যাখো না এই আমি কোন ধরনের লোক—দেখতে কী রাজসিক এবং কত প্রকাণ্ড বলশালী? তবু তারপরও, আমার ওপরেও মৃত্যুর নিঠুর নিয়তি ঝুলে আছে। একদিন আসবে এক ভোর, এক দুপুর বা ধরো একটা বিকেল, যখন কেউ একজন এসে আমারও জীবন নিয়ে নেবে।” তারপর ধারালো তরবারি হাতে তুলে অ্যাকিলিস মারল লাইকাওনের ঘাড়ে, কাঁধ ও বুকের সংযোগ অস্থির পাশে। দুধারী তরবারি সোজা লাইকাওনের ভেতরে ডুবে গেল, লাইকাওন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সামনের দিকে।’
প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের মাঝে দাঁড়িয়েও কসাইয়ের এই নির্মমতা দেখানোর ক্ষমতা, সবকিছু বুঝে চিন্তা করে নিয়েও তা দেখানোর ক্ষমতা অধিকাংশ মানুষেরই আছে এবং তাদেরই কয়েকজন একইভাবে, ধরন-আকার ও প্রকারে একই রকম চিন্তাস্নিগ্ধ হেঁয়ালি ছড়িয়েই, গুলি করেছিল বঙ্গবন্ধুকে— ব্রাশফায়ার—আর তিনি বাইরে ভোরের আলোকে একবার দেখে নিতেও ব্যর্থ হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে, একদিন ভোর পাঁচটা পঞ্চান্ন মিনিটে।
.
খুনি ইভগেনি আনেগিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম ভিসির বাসার দিকে। ইভগেনি আনেগিন বড় হয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গের অভিজাত পরিবেশে। উপন্যাসের যখন শুরু, ১৮২০ সালে, তখন আনেগিনের বয়স ২৪, কিন্তু এরই মধ্যে জীবনে প্রায় সব সফলতা পাওয়া হয়ে গেছে তার। এত কম বয়সে এত বেশি পেয়েই সে এখন জীবন নিয়ে উদাসীন, একঘেয়েমি থেকে বিরক্ত। ইভগেনির কাছে একদিন খবর এল তার চাচা মৃত্যুশয্যায়। এই চাচার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তরুণ ইভগেনি নিজে। চাচার গ্রামের জমিদারবাড়ির পথে রওনা হলো সে। সে ওখানে না পৌঁছেই ভাবছে :
ইয়া খোদা, কী বিরক্তির এই কাজ
দিনরাত বসে থাকা রোগী মানুষের পাশে…
আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে সারাক্ষণ ভাবা :
‘বুড়ো, শয়তান তোমাকে কবে যে তুলে নেবে?’
চাচা মারা গেলেন ইভগেনি পৌঁছানোর আগেই। এই সময় উপন্যাসে প্রবেশ ১৭ বছরের তরুণ, উদীয়মান খ্যাপাটে কবি ভ্লাদিমির লেনস্কির। জার্মানির গোটিংগেন থেকে ফিরেছে সে নিজের গ্রামে, গ্যেটে-শিলার-ইমানুয়েল কান্ট ছাড়া কিছু বোঝে না। লেনস্কির ভেতরে আছে যে আদর্শবাদ ও জীবন নিয়ে আশা, ইভগেনির তা নেই। ইভগেনি ও লেনস্কির বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা শুরু হলো এবং তা বাড়তে লাগল দিন দিন।
প্রতিবেশী লারিনের ছোট মেয়ে ওলগাকে শৈশব থেকেই ভালোবাসে এই লেনস্কি। অন্য সব কমবয়সী মেয়ের মতোই ওলগা চঞ্চল, মেয়েলি। পুশকিন ওলগাকে রেখে আমাদের এবার পরিচয় করান ওলগার বড় বোন তাতিয়ানার সঙ্গে—অন্তর্মুখী ও ভাবুক স্বভাবের তাতিয়ানা, খেলাধুলা-বন্ধু-পুতুল এসব বাদ দিয়ে তার মনোযোগ প্রকৃতির রূপ ও ফরাসি উপন্যাসে। ওলগার মতো সুন্দর না সে দেখতে, তবে যার চোখ আছে, সে ঠিকই টের পাবে তাতিয়ানার রূপ। এই ওলগার সঙ্গেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে লেনস্কির, আর লারিন পরিবার এখন বর খুঁজছে তাদের বড় মেয়ে তাতিয়ানার জন্য।
এরই মধ্যে মারা গেলেন এ দুই মেয়ের বাবা লারিন। লেনস্কি তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর স্মৃতিতে কবিতা গাঁথল এবং মনে করল তাঁর নিজের মৃত পিতামাতাকেও। এরপরে একদিন ওলগাদের বাড়িতে ইভগেনিকে নিয়ে গেল লেনস্কি। ইভগেনি তাতিয়ানাকে বলতে গেলে পাত্তাই দিল না। এরা চলে যাবার পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল তাতিয়ানা। সে প্রেমে পড়ল ইভগেনির, কিন্তু সে জানে না কীভাবে মস্কো নিবাসী এই শহুরে তরুণকে তার মতো গ্রাম্য এক মেয়ে আকৃষ্ট করবে। ইভগেনিকে রাতভর জেগে এক তীব্র প্রেমপত্র লিখল সে, তারপর সকালে তার আয়ার মাধ্যমে সেই পত্র পাঠাল ইভগেনির কাছে। ইভগেনি প্রত্যাখ্যান করল তাতিয়ানাকে, সরাসরি। ওদের বাড়ির বাগানের নির্জনে দাঁড়িয়ে সে তাতিয়ানাকে বলল জীবনের নিষ্ঠুর সত্যের কথা— স্বামী হিসেবে সে কখনোই ভালো হবে না, কারণ মেয়েদের বিষয়ে মস্কোতে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে, আর বিয়ে-সংসার ভালো কিছু নয়, বরং নিরানন্দ, একঘেয়ে।
তাতিয়ানা এভাবে ‘না’ শুনে জীবন কাটাতে লাগল বিষণ্ণতায়, শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে। এদিকে লেনস্কি ওলগার জন্য প্রেমে ফুটছে টগবগ করে, কবিতার পর কবিতা লিখে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা দেখি ওলগা তার কবিতাগুলো পড়েও না। আর ইভগেনি আনেগিনের দিন কাটে জমিদারবাড়িতে, অলসতা করে। এত উত্তরের এই জায়গা যে সেখানে বরফ পড়ে গ্রীষ্মকালেও, সাদা তুষারে ঢাকা প্রকৃতি ইভগেনিকে আরও ক্লান্ত করে তোলে। কিছুদিন পর তাতিয়ানাদের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে ইভগেনি যায় সেখানে। দাওয়াতটা এসেছিল লেনস্কির মাধ্যমে। তাতিয়ানা নিজে সেখানে, ইভগেনির প্রতি তার ভালোবাসার বোধে তখনো বিভ্রান্ত সে, মনমরা। ইভগেনি দেখল মস্কোর যেসব শহুরে দাওয়াতে যেতে যেতে তার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল, সেগুলোরই গ্রাম্য এক প্যারোডি এই দাওয়াত, আর লেনস্কি যে তাকে বলেছিল এটা ছোট একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান হবে মাত্র, এটা মোটেই তা নয়, অনেক লোক এখানে আর তার ওপর খাবারদাবার অনেক ভারী ভারী এবং সবকিছু ছাপিয়ে তাতিয়ানার বিশ্রী অবস্থা।
তাকে এখানে, এই নরকে, টেনে আনার জন্য লেনস্কির ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠল ইভগেনি। নাচ শুরু হলে সে তার শহুরে মেয়ে পটানোর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ওলগাকে নিয়ে নিল লেনস্কির কাছ থেকে, তার সঙ্গে নাচল অনেক, লেনস্কিকে বঞ্চিত করল ওলগার সান্নিধ্য থেকে। লেনস্কি পার্টি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল একসময়, তার মাথায় তখন ঘুরছে নিজের সম্মান ফিরে পেতে ইভগেনিকে পিস্তলের ডুয়েল লড়ার চ্যালেঞ্জ জানাবার কথা।
সকালে ইভগেনির বাসায় ডুয়েলের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো জারেস্কি নামের এক অভিজাত বংশের লোক, ডুয়েল লড়াই নিয়ে তার অনেক প্যাশন। ইভগেনি ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল, কিন্তু একই সঙ্গে তার অপরাধবোধ হতে লাগল নিজের নিষ্পাপ বাল্যবন্ধু লেনস্কিকে গত রাতে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য। লেনস্কি যখন শুনল ইভগেনি ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ মেনে নিয়েছে, সে খুশি হলো অনেক, কারণ সে ভাবছিল ইভগেনি তার চ্যালেঞ্জকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না।
ডুয়েলের সকাল। লেনস্কি পূর্বনির্ধারিত লড়াইয়ের মাঠে হাজির, সঙ্গে তার ডুয়েলের প্রথামাফিক সহকারী জারেস্কি, আর অন্যদিকে আনেগিনের ঘুম ভাঙল দেরিতে, নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে নিজের ভৃত্যকে সহকর্মী বানিয়ে সে হাজির হলো ডুয়েলের মাঠে। তার এই এত দেরি করে আসা এবং যথাযোগ্য অভিজাত বংশের কাউকে সহকর্মী না বানানো, এ দুই কারণই যথেষ্ট ছিল জারেস্কির তরফ থেকে ডুয়েল বাতিল ঘোষণা করার জন্য। কিন্তু জারেস্কি উল্টো দুজনকে ডাকল মাটিতে আঁকা নির্দিষ্ট দাগের কাছে :
নিখুঁত মাপ মেনে জারেস্কি হেঁটে নিল বত্রিশ কদম,
এরই দুধারে বলল তার দুবন্ধুকে খাড়া হয়ে যেতে।
এবার এরা দুজন হাতে তুলে নিল যার যার পিস্তলখানা।
“এবার সামনে আগাও!”
তখনো নিশানা নেয়নি তারা কেউ, মাথা ঠান্ডা দুই যোদ্ধারই,
তারা ধীরস্থির ঢঙে, সমান পা ফেলে এগোল চার কদম করে,
মৃত্যুর অভিমুখে চারটে কদম।
এবার আগেনিন প্রথমে, না থেমে, ধীরে উঁচু করল পিস্তল তার।
আরও পাঁচ কদম করে সামনের দিকে আসবার পরে,
লেনস্কিও বাম চোখ পিটপিট করে নিশানা করে নিল।
কিন্তু তক্ষুনি আনেগিন ট্রিগার টিপে দিল…
নিয়তিনির্দিষ্ট মুহূর্ত হাজির হলো অবশেষে কবি থামল,
নীরবে হাত থেকে পড়ে গেল তার অস্ত্রখানি,
সে হাত রাখল নিজ বুকের ‘পরে, তারপর মাটিতে গড়াল।’
জারেৎস্কি রওনা হলো ঘোড়ার গাড়িতে লেনস্কির মৃতদেহ তুলে।
ভিসির বাসা পার হয়ে আমি এখন চলেছি অনেক কটা শতবর্ষ পুরোনো দেবদারুগাছ পাশে রেখে, গুরুদুয়ারা নানকশাহির দিকে। সেখানে কয়েকটা স্বর্ণচাপা বৃক্ষ, তাতে ম্লান হলুদ সব ফুল ফুটে আছে, রাতের অন্ধকারে যদিও দেখাচ্ছে রং ঘন সবুজমতো। আর রোকেয়া হলের সামনে, টিএসসির ভিড়ের আলোয় দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু জারুল, নিস্তব্ধ হাওয়াহীন তারা দাঁড়িয়ে আছে এই আঁধার বেলায়। পুশকিনের মাস্টারপিস ইভগেনি আনেগিন আমি পড়েছি মোট দুবার, দুই ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদে, যদিও সংগ্রহে আছে পাঁচটা, নবোকভেরটাসহ। এরপরই ক্লান্তি—পুশকিনের ট্র্যাজিক জীবনবীক্ষণকে নানা শব্দে, নানা প্রকাশে বারবার পড়ার ক্লান্তি, যা আজ আবার ১৪ আগস্টের রাতে আমাকে গ্রাস করেছে ইবরাহিমের মুখ থেকে ডুয়েল লড়ার কথা শুনে।
দুটো পাইনগাছের নিচে ছোট এক কবরে শুয়ে থাকা লেনস্কিকে বিদায় জানিয়ে এর পরের কাহিনি খুব সাধারণ। কিন্তু তা আজ মনে করার আমার ইচ্ছা নেই কোনো। লেনস্কি মারা যায়, ওলগা বিয়ে করে কোথায় চলে যায়, তাতিয়ানারও বিয়ে হয় মস্কোর এক প্রিন্সের সঙ্গে, আর খুনি ইভগেনি আনেগিন…আমার ভাবতে ইচ্ছা করল না ওসব। টিএসসি হয়ে আমি এবার হাঁটছি শাহবাগ চত্বরের দিকে। আর্ট কলেজ কাছে আসতেই দেখলাম কলেজের দেয়াল ঘেঁষে বসানো রয়েছে রংচঙে এক দীর্ঘ কাগজের ড্রাগন, তার একটা দাঁত নুয়ে পড়ে আছে, সম্ভবত উঠে গেছে আঠা, তাই তাকে দেখতে লাগছে আরও বীভৎস। পাবলিক লাইব্রেরির গেটে আমার পরিচিত বাদাম বিক্রেতা মোজাম্মেলকে দেখলাম, সে-ও দেখল আমাকে। আমি মোজাম্মেলের পাশে থাকা তার মেয়ে নাজমাকে দেখলাম না কোথায়ও।
মোজাম্মেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। হ্যাজাক বাতির আলোতে মোজাম্মেলের চোখ জ্বলছে বাঘের চোখের মতো। ‘মোজাম্মেল, নাজমা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলাম। মোজাম্মেল জানাল নাজমা দুই মাস হয় টাইফয়েডে মারা গেছে, আরও বলল, আমার থেকে ধার নেওয়া দুই হাজার টাকা সে অবশ্যই সামনের শীতে আমাকে ফেরত দেবে।
আমি ভাবছি, আনেগিন তাতিয়ানাকে হারিয়েছে, নিজের একমাত্র বন্ধুকে হত্যা করেছে এবং জীবনে কোনো শান্তি খুঁজে পায়নি। সে তার নিজের গর্ব, অহংকার ও স্বার্থপরতার নিষ্ঠুর শিকার; তার ট্র্যাজেডি এটাই যে একা থাকাটাই তার নিয়তি। যাঁরা পুশকিন পড়েছেন, তাঁরা জানেন, উপন্যাসের এই ইভগেনি আনেগিনই আসলে কবি-লেখক-নাট্যকার আলেকসান্দার পুশকিন, রাশিয়ার সাহিত্য-আকাশের বৃহত্তম সূর্য। পুশকিন নিজে জীবনে ডুয়েল লড়েছেন নব্বইয়ের মতো, এর মধ্যে পনেরোটা ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ তাঁর নিজেরই ছোড়া। ইভগেনি আনেগিন উপন্যাসে নিজের প্রেমিকার সঙ্গে ইভগেনিকে জনসমক্ষে সীমা অতিক্রম করতে দেখে অপমানিত হয়ে তাকে ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ জানায় লেনস্কি, আর মরে তাতে। বাস্তব জীবনে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ফরাসি যুবক জজ দাঁতেসের সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়ে দাঁতেসকে—স্ত্রীর ও নিজের সামাজিক সম্মান ফিরে পেতে—ডুয়েল লড়ার চ্যালেঞ্জ জানালেন পুশকিন, আর মরলেন তাতে।
পুশকিনের স্ত্রী নাতালিয়া পুশকিনা ছিল সে সময়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ ও মস্কোর এলিট সার্কেলে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের একজন। তার পেছনে পড়ল ফরাসি মিলিটারি অফিসার, সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ান সম্রাটের দরবারে ডাচ হল্যান্ডের দূত ব্যারন হেককারনের দত্তক নেওয়া পুত্র, অসম্ভব সুদর্শন সুপুরুষ জজ দাঁতেস। সমাজে গুঞ্জন উঠল, নাতালিয়ার সঙ্গে প্রেম চলছে এই ফরাসির। কারা যেন পুশকিনকে বেনামি বিদ্রূপাত্মক চিঠি পাঠাল তাকে “খানকি স্ত্রীগণের স্বামীদের ডেপুটি গ্র্যান্ড মাস্টার ও ইতিহাসবিদ’ খেতাব ও ডিপ্লোমা দিয়ে। পুশকিন সন্দেহ করলেন ডাচ দূত হেককারনকে। গবেষকেরা এখন বলছেন, এই চিঠি, এই ডিপ্লোমার পেছনে হাত ছিল স্বয়ং রাশিয়ার সম্রাট জার নিকোলাইয়ের, কারণ জারের দরবারে যাতায়াত ছিল নাতালিয়ার এবং জার নিজে ছিলেন নাতালিয়ার প্রেমাকাঙ্ক্ষী।
১৮৩৬ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে পুশকিন ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ দিলেন জজ দাঁতেসকে। ডাচ দূত হেককারন, দাঁতেসের দত্তক পিতা, অনুরোধ জানালেন ডুয়েল দুই সপ্তাহ পেছানোর। নভেম্বরেই, জটিল সমীকরণের শেষে, অনুমান যে ডুয়েল ঠেকাতেই, জজ দাঁতেস বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন পুশকিনের শালী, নাতালিয়ার বোন, ইয়েকেতেরিনাকে। ১৮৩৭-এর ১০ জানুয়ারি বিয়ে হলো তাঁদের। এখন পুশকিন ও জজ দাঁতেস ভায়রা ভাই। পুশকিনের কানে এল যে জজ দাঁতেস ইয়েকেতেরিনাকে বিয়ে করেছেন স্রেফ এ জন্য যে সমাজ যেন আর মনে না করে তাঁর সঙ্গে নাতালিয়ার সম্পর্ক চলছে, কিন্তু আসলে তাঁর সঙ্গে নাতালিয়ারই সম্পর্ক চলছে। আর দাঁতেসও জনসমক্ষে নাতালিয়ার সঙ্গে উসকানিমূলক মেলামেশা থামালেন না এই বিয়ের পরেও। পুশকিন সব গুজবের ও অপমানের ইতি টানার দৃঢ়সংকল্প করলেন এবার। ২৬ জানুয়ারি তারিখে তিনি দাঁতেসের দত্তক পিতা হেককারনকে এক চরম অপমানজনক চিঠি লিখে পাঠালেন, এমনই সে চিঠি যে পুশকিন জানতেন, তার উত্তরে হেককারন পোষ্যপুত্রের পক্ষে পুশকিনকে ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ না জানিয়ে পারবেন না। শালী ইয়েকেতেরিনা মারফত দাঁতেসের ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ পৌঁছাল পুশকিনের কাছে, একই দিনে।
পরদিন, ১৮৩৭-এর ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চেরনায়া নদীর তীরে মাত্র বিশ কদম দূরত্বে দুজন—জজ দাঁতেস ও পুশকিন, দুই বোনের দুই স্বামী—ভয়ংকর বরফজমা পথের ওপর দাঁড়ালেন মৃত্যুর খেলা খেলতে। বলা হয়ে থাকে, প্রথম গুলিটা চালালেন পুশকিন, মিস করলেন। এবারে গুলি করলেন দাঁতেস, গুলি লাগল পুশকিনের কটিদেশে, পাকস্থলীতে। তখনকার দিনের চিকিৎসাব্যবস্থার বিচারে যথেষ্ট ছিল সেটা মানুষ মারার জন্য। বরফের মাঠে পড়তে পড়তে আবার গুলি করলেন পুশকিন, দেখলেন তাঁর প্রতিপক্ষও পড়ছে মাটিতে এবং তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন : ‘ব্রাভো।’ গুলি দাঁতেসের ডান বাহুতে হালকা আঘাত হানল মাত্র। অন্যদিকে পাকস্থলী ভেদ করা বুলেট শরীরে নিয়ে পুশকিন মারা গেলেন এর দুদিন পর, মরার আগে মৃত্যুশয্যা থেকে দাঁতেসকে এই বার্তা পাঠিয়ে যে তিনি তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, যদিও পুশকিনের মৃত্যুতে রাশিয়ার সমাজ না ক্ষমা করেছিল তার স্ত্রী নাতালিয়াকে, না দাঁতেসকে, না জারের দরবারকে। বলাবলি হতে লাগল যে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে জার নিকোলাই ও রাজন্যবর্গ কবিকে খেপিয়ে তুলে, সরলমনা স্থূলবুদ্ধির নাতালিয়াকে ব্যবহার করে তাদের প্রিয়তম সাহিত্যিকের জীবন কেড়ে নিয়েছে।
সাকুরা রেস্তোরাঁর সামনে দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি বাংলামোটরের দিকে। বিশাল শেরাটন হোটেলে কোনো একটা মেলা বা প্রদর্শনী চলছে, প্রচুর মানুষ সেখানে ঢুকছে ও বেরোচ্ছে দেখলাম। মোজাম্মেল আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছে কিছুক্ষণ। তার চোখের পানিতে আমার জামা ভিজে গেছে। কান্নার শেষে মোজাম্মেল কীভাবে যেন, বাচ্চাদের মতো, পা দিয়ে বারবার রাস্তায় বাড়ি মেরেছে নির্বোধ পাগলের ভঙ্গিমায়, বারবার। প্রতিটা বাড়িতে তার কষ্ট তাৎক্ষণিক কিছু কমছিল বলেই আমার ধারণা, না হলে ওরকম করবে কেন সে, বিশেষ করে যখন তার বাদামের কাস্টমার ছিল চারপাশে আরও সাত-আটজন? নাজমার যে টাইফয়েড হয়েছে, তা ধরা পড়তে পড়তেই দিন চলে গিয়েছিল, বলল মোজাম্মেল। আরও বলল যে গত দুই মাসে আমি যদি তার এখানে এসে থাকি তো নিশ্চয়ই তাকে দেখিনি, কারণ, সে বাদাম বেচেনি প্রায় দুই মাস। মোজাম্মেল আমার কাছে জানতে চাইল, ‘মেহের আপা কই?’ আমি তার সে কথার উত্তর দিলাম না কোনো।
বাংলামোটরের কাছাকাছি এসে গেছি। রাস্তায় অনেক ভিড়, হইচই, চিৎকার, বাস কন্ডাক্টরদের ডাকাডাকি। কিন্তু আমার মন সব ছাপিয়ে ভাবছে—কোমরে গোঁজা পিস্তলে হাত রেখে, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার তোয়াক্কা না করে—ডুয়েল লড়াই পৃথিবীতে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর মানুষের হারানো সম্মান ফিরে পাওয়ার আর কী পথ খোলা আছে?
ডুয়েলের দিন যদি থাকত, আজও তাহলে কত সহজ হয়ে যেত সবকিছু—আমি কতগুলো মানুষকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে কিংবা আশুলিয়ার পানির পাশে ডাকতাম আমার সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নিতে। কাদের ডাকতাম আমি? কাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়তাম? অনেকগুলো হিজিবিজি নাম মাথায় ভিড় করে এল, এখনো জীবিত এরা, এই দেশে, বিদেশে, আর কেউ কেউ মৃত যেমন ইভগেনি আনেগিন, জজ দাঁতেস, নিকোলাই মারটিনভ।
পুশকিনের অহেতুক ও অন্যায় মৃত্যুতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খেপলেন তখনকার রাশিয়ার দ্বিতীয় বড় কবি মিখাইল লেরমন্তভ। সেন্ট পিটার্সবার্গের হাই সোসাইটির মহিলারা, তিনি দেখলেন, সব জজ দাঁতেসের পক্ষে কথা বলছে। লেরমন্তভ বিশ্বাস করলেন যে পুশকিন এক ষড়যন্ত্রের ভয়াল শিকার। তিনি দাঁতেসকে ডুয়েল লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ পাঠানোরও চিন্তা করলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩। তিনি পুশকিনের ডাক্তারের কাছ থেকে শুনলেন প্রিয় কবির মৃত্যুর শেষ মুহূর্তগুলোর কথা, তারপর নার্ভাস ব্রেকডাউনের কাছাকাছি পৌঁছে তিনি লিখলেন ক্ষিপ্ত এক কবিতা—’ডেথ অব দ্য পোয়েট,’ যার একটা লাইন : ‘আর তোমরা, কুখ্যাত গুন্ডাদের উদ্ধত বংশধরগণ …।’ কবিতায় তিনি ‘রাজদরবারের অভিজাতদের’ এবং ‘লোভী লোকগুলোর’ ওপর খোদার গজব পড়ার কথা বললেন, তাদের গালি দিলেন মানুষের স্বাধীনতা হত্যাকারী জল্লাদ বলে এবং তাদের সরাসরি অভিযুক্ত করলেন পুশকিন ট্র্যাজেডির পেছনের মূল হোতা হিসেবে।
এই কবিতা লেখার পরপর রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেপ্তার হলেন লেরমন্তভ এবং পুশকিনের মৃত্যুর ২৭ দিনের মাথায় সম্রাট জার নিকোলাই কবিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন ককেশাস অঞ্চলের এক সেনা রেজিমেন্টে। ওখানেই, চেচনিয়া-দাগেস্তানে অনেক যুদ্ধে অনেক নাম-বদনাম কামানো শেষে, চার বছর পরে, ১৮৪১ সালের জুলাই মাসে ডুয়েল হলো লেরমন্তভ বনাম মার্টিনভের মধ্যে।
দুই বন্ধু তাঁরা—ঠিক ইভগেনি আনেগিন ও ভ্লাদিমির লেনস্কির মতো—আর দুজনেই প্রেমপ্রার্থী এক আর্মি জেনারেলের মেয়ে এমিলিয়ার। একদিন জেনারেলের বাসায় দুজনে গল্প করছেন এমিলিয়ার সঙ্গে, হঠাৎ চির-উদ্ধত লেরমন্তভ, চির বেয়াদব, ঠাট্টা ও ব্যঙ্গ শুরু করলেন মেজর মার্টিনভের জামাকাপড় নিয়ে। দুজনের তুমুল ঝগড়ার শেষে, একদিন পরই, তাঁরা দুই অফিসার একে অন্যের দিকে পিস্তল তুলে দাঁড়িয়ে গেলেন মাশুক পাহাড়ের ডান পাশের এক খোলা জায়গায়, চারপাশে অনেক ফুলে ভরা জঙ্গলের মাঝখানে।
প্রথম কাউন্টডাউন শেষ হলো, গুলি করলেন না দুজনের কেউই। তখন ডুয়েল-প্রশাসকদের একজন চিৎকার করে উঠলেন : ‘হয় গুলি করো, না হয় ডুয়েল বাতিল!” লেরমন্তভ উত্তর দিলেন : ‘আমি এই নির্বোধকে গুলি করব না।’ লেরমন্তভ আগে থেকে সবাইকে জানিয়ে রেখেছিলেন যে তিনি আসলে শূন্যে গুলি করবেন, অর্থাৎ মার্টিনভকে মারার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। পরবর্তীকালে মার্টিনভ তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘আমি ওর এই কথা শুনে রেগে গিয়েছিলাম। তারপর ট্রিগার টিপলাম।’ একটাই গুলি, মার্টিনভ নিশানা করেছিলেন-জানা সত্ত্বেও যে তাঁর বন্ধুর নিশানা আকাশের দিকে—লেরমন্তভের বুক বরাবর। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন কবি, বয়স স্রেফ ২৬, মারা গেলেন ঘটনাস্থলেই।
আজও ওখানে, ককেশাস অঞ্চলের পাইয়াতিগরস্ক শহরে, শত শত মানুষ যায় কবির নিহত হওয়ার জায়গাটায় ফুল দিতে। তারা শহরের আপার মার্কেট থেকে ১৬ নম্বর বাসে চড়ে গিয়ে নামে ‘মেস্তো ডুয়েলি’ বা ‘ডুয়েল সাইট’ স্টেশনে, তারপর ওখান থেকে ৫০০ মিটারের হাঁটা পথ, রাস্তা এক জায়গায় এসে দুদিকে ভাগ হওয়া পর্যন্ত, তারপর বাঁয়ের পথে ঢুকে প্রায় আরও ৫০০ মিটার।
তারা, অধিকাংশ রাশিয়ানই, বিশ্বাস করে এই কবির মৃত্যুও কর্তৃপক্ষের সাজানো খেলা ছিল, পুশকিনেরটার মতোই, আর এতেও হাত ছিল স্বয়ং সম্রাটের। আমি জানি না কতটা সত্য সেটা, জানি না জার নিকোলাসের কী লাভ হয়েছিল তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের দুই প্রধান কবিকে পরপর, চার বছরের ব্যবধানে, পৃথিবী থেকে ওঁদের ওই কাঁচা বয়সে তাড়িয়ে ভাগিয়ে দিয়ে? আমার শুধু মনে হয়, ততক্ষণে আমি কারওয়ান বাজারের মোড়ে, হাঁটছি দ্রুত পায়ে, আমার রক্তে টান লেগেছে জোয়ারের, আমি ঘামছি, মুখ মুছছি জামার হাতায়, বারবার, আর আমার মনে হচ্ছে এই লেনস্কি, এই পুশকিন, এই লেরমন্তভ—এঁরা তিনজন একটাই লোক, আর ওই তিন ঘাতক বুলেট, স্থান-কাল-পাত্রের বিজ্ঞানকে তাচ্ছিল্য জানিয়ে আসলে একটাই বুলেট, যা পরপর চলে গেছে, এমনকি উপন্যাসের পাতা থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের অদূরের এক গ্রামাঞ্চলে, তারপর সেখান থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের চেরনায়া নদীর তীর, শেষে ককেশাস অঞ্চলের মাশুক পাহাড়ের নিচে, ওখানে গিয়েই কেবল সে থেমেছিল বাতাসের মধ্যে দিয়ে শাঁ শাঁ আওয়াজ তুলে তার ওই দীর্ঘ দৌড়ের শেষে।
বোরহেসিয়ান এই মেটাফিজিক্যাল ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ল লেরমন্তভের বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা ‘মজিরি’র (জর্জিয়ান ভাষায় যার অর্থ ‘সেবা না দেওয়া ভিক্ষু’) শেষ অংশটা, যেটা তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা, ১৮৪০ সালে :
যখন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখবে আমাকে,
ওটা ঘটবে দ্রুত… আজই…
তখন ওদের বোলো তারা যেন আমাকে সরিয়ে নেয় এই ঘর থেকে
রাখে বাগানের মাঝে, যেখানে ফুটে আছে
দুটো সাদা আকাসিয়া, বেড়ার পাশটাতে…
ওই দুইয়ের মাঝে ঘাস কী রকম ঘন,
আর হাওয়া যে শিশিরের চাইতেও কত মিষ্টি হাওয়া,
আর প্রতিটা পাতা কাঁদছে সোনার রং মেখে
পরিপূর্ণ রোদে ভরা সোনা! আর কী সে দৃশ্য…
ওদের বোলো আমাকে ওখানেই রেখে দিতে।
আকাশ নীলে ভরা সেই দিনের রূপ দেখে
শেষবার তৃপ্তি পেতে চাই আমি মন ভরে।
দেখতে চাই দুচোখে ককেশাস পাহাড়ের মহীয়ান ছবি!
ওই উচ্চতা থেকে, ওরা আমাকে পাঠাবে দেখো
তাদের শেষ বিদায়বাণী, সত্যিই হতে পারে এটা।
ওরা পাঠাবে মৃদুমন্দ হাওয়া, আর আলোর নতুন এক ছটা…
আর আমি, এইখানে শুয়ে, শুনব বাসনার সুর,
আমার পাশজুড়ে, আমি শেষবার শেষ হওয়ার অব্যবহিত আগে।
আমি ভাবব এ আওয়াজ আমার বন্ধুর,
কিংবা কোনো ভাইয়ের হবে, যে কিনা মাথা নুয়ে আছে,
আর সে গুনগুন গাইছে আমার জন্মস্থান নিয়ে,
আমার দেশ, সে দেশের বিশ্বস্ত সন্তান…এসব বিষয়ে,
আমার এই ভাবনার সাথে ইতি হবে সব দৌড়ঝাঁপ
আমি ঘুমাব অবশেষে, কাউকেই দেব না অভিশাপ!
এতক্ষণে শোয়ানো হয়েছে মাসুম হায়াতকে চিরদিনের বিছানায়, নিশ্চিত। আমি অবাক হলাম আমার কাছে কারও একটাও ফোন এল না দেখে। সবাই তাহলে মাসুমের জানাজা ও দাফন নিয়ে ব্যস্ত। আর এ সবাইটাই-বা কে আমার জন্য? নূর, লুনা, মেহেরনাজ, মাসুম, পিংকি হিজড়া, এবং কাঠমান্ডুর সুরভি, এর বাদে ডিপার্টমেন্টের কজন শিক্ষক ও দু-চারটে প্রিয় ছাত্রছাত্রী ছাড়া আমার ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে নামই-বা আছে কটা?
দুটো অ্যাম্বুলেন্স পাশাপাশি ছুটে যেতেই মনে হলো অন্তত নূরকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করি মাসুমকে কবরে শোয়ানো শেষ হয়েছে কি না এবং ভার্সিটির ভিসি ভদ্রলোক মাসুমের স্ত্রী ফারজানাকে বিশ লাখ টাকার চেকটা দিয়েছেন কি না। কিন্তু ভাবনায় বাধা দিল ফার্মগেটের কাছাকাছি গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া এক বালিকা, সঙ্গে তার বয়োবৃদ্ধ মা কিংবা মা-সমান আত্মীয় কেউ। প্রচণ্ড জোরে হর্ন দিল বড় একটা পাজেরো বা প্রাডোমতো গাড়ি, ব্রেক কষল, রাস্তার সবাই থেমে গিয়ে তাকাল ওদিকে। মা-মেয়ে কূলে এসে কাঁপতে কাঁপতে ভিড়ল আমার পায়ের কাছে, আমি চমকে উঠলাম। ওদের পোশাক-আশাক, গায়ের রং, দৌড়ানোর ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি, সবকিছুতেই স্পষ্ট যে ওরা অনেক গরিব, ভিখিরি স্তরের থেকে খুব বেশি হলে এক-দু ধাপ ওপরের হবে। মেয়েটা নাজমার বয়সী, আর নাজমা ছিল দুর্গার বয়সী এবং এ মহিলা সর্বজয়া। পথের পাঁচালীতে চরম দারিদ্র্যপীড়িত হরিহর-সর্বজয়া পরিবারে প্রায় বিনা চিকিৎসায়, ম্যালেরিয়ায়, দুর্গার মৃত্যু এবং আরেক জায়গায় গোকুলের বউয়ের হারিয়ে যাওয়া গাঁজাখোর ভাইয়ের কথা মনে পড়া—আমার প্রায়ই মনে হয় পুরো বিশ্বসাহিত্যের করুণতম দৃশ্যগুলোর দুটো এরা।
সকাল দশটার সময় নীলমণি মুখুয্যে অনেকদিন পরে নদীতে স্নান করিতে যাইবেন বলিয়া তেল মাখিতে বসিয়াছেন, তাঁহার স্ত্রীর উত্তেজিত সুর তাঁর কানে গেল—ওগো, এসো তো একবার এদিকে শিগগির—অপুদের বাড়ির দিক থেকে যেন একটা কান্নার গলা পাওয়া যাচ্চে-
ব্যাপার কি দেখিতে সকলে ছুটিয়া গেলেন।
সর্বজয়া মেয়ের মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিতেছে-ও দুগ্গা চা দিকি—ওমা, ভালো করে চা দিকি—ও দুগ্গা-
সর্বজয়া…চিৎকার করিয়া উঠিল—ওগো, কি হোল, মেয়ে অমন করচে কেন?
দুর্গা আর চাহিল না।
.