আগস্ট আবছায়া – ২.১

২.১

সকাল দশটার দিকে ঘুম ভাঙল এক চেনা স্বপ্ন দেখে। দেখলাম বড় এক জঙ্গলের মধ্যে, হতে পারে জঙ্গল, হতে পারে বাগান, আমি এক টিনের অ্যারোপ্লেনে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, প্রতিটা গাছের কাছে গিয়ে থামছি কিছুক্ষণ করে, পরে আবার উড়ে যাচ্ছি পাশের গাছের দিকে। দেখলাম উঁচু সুপারির পাশে আরেকটা সুপারি, ওদের গায়ে জড়ানো মানিপ্ল্যান্ট, ডান দিকে একটা বড় আমগাছ, বাঁয়ে বকুল, আরও বাঁয়ে একটা দেবদারু এবং নিচে বামে—আমি টিনের প্লেন নিয়ে বিপজ্জনক নিচে নেমে এসেছি—মধুমালতী, হাসনাহেনা। তারপর ঝাঁ করে প্লেন নিয়ে আমি উড়ে গেলাম ওপরে, অন্যদিকে, দেখলাম একটা ইউক্যালিপটাস জড়িয়ে আছে গুলঞ্চ লতা, এরপর আরেকটা দেবদারু, একটু বাঁয়ে বেঁকেঝুঁকে আছে একটা অর্জুনগাছ, ঠিক যার সামনে গিয়ে প্লেন থামালাম, খেলনা প্লেন, সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল শূন্যে আর তখনই শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, বৃষ্টির ছাটের ওই ভেজা ভাব আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলল ঘুম থেকে আর জাগতে জাগতে আমার মনে হলো বৃষ্টি নয়, আমার গা ভরে গেছে পাখির গুয়ে। 

গার্সিয়া মার্কেসের ক্রনিকল অব আ ডেথ ফোরটোল্ড-এর প্রথম পৃষ্ঠায় হতভাগ্য নায়ক সান্তিয়াগো নাসারের স্বপ্ন এটা, যা আমার স্বপ্নেও ঢুকে গেছে তবে মূলটা রয়েছে একই, স্রেফ কলম্বিয়ার বাদাম অরণ্যের জায়গায় বসুন্ধরা আবাসিকের গাছপালা ভিড় করেছে এই যা। 

এ স্বপ্নের কী মানে হতে পারে, তা নিয়ে কিছু ভাবতে মন চাইল না, কারণ, খারাপ বাদে এ স্বপ্নের ভালো মানে হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। টিনের খেলনা প্লেনে আমি উড়ে যাচ্ছি গাছপালার মধ্য দিয়ে আর যাকে বৃষ্টি বলে ভেবেছি, তা আসলে পাখির গু—আমি চোখ খুলতেই অশুভ চিহ্ন ও অমঙ্গলের কালো বিড়ালকে দেখতে পেলাম যেন বসে রয়েছে আজকের দিনটার কাঁধে। 

আজ ১৪ আগস্ট। না, আজ ১৪ আগস্ট না, আজকের তারিখের সঠিক নাম ‘পনেরোই আগস্ট অ্যাপ্রোচিং’, ‘পনেরোই আগস্ট আসছে’। যা ঘটার তা আজকেই ঘটেছিল। ১৪ আগস্টের সন্ধ্যা থেকে যে আয়োজনের শুরু, তার মধ্যেই পরিষ্কার লেখা ছিল কী হবে এবং যা হবে তা থামাবার কেউ নেই, কারণ যারা যা হওয়াচ্ছে এবং যারা যা থামাবে বলে অনুমান করা যায়, তারা সব ছিল একই লোক। ১৪ আগস্টের সন্ধ্যা থেকে চতুর্দিকে বিছিয়ে, গড়িয়ে, ছড়িয়ে দেওয়া যত আয়োজন, তার যবনিকাটুকু ঘটেছিল স্রেফ রাত বারোটার কাটার ওপারে গিয়ে। 

আমি পনেরোই আগস্টের পিঠে উঠলাম আরও একবার — খাটাশের পিঠের মতো অমসৃণ, ঠাসবুননের ঘন লোমে সিঁথি টানা টানা পিঠ, শুখা, খটখটে ও—বিশেষ করে—লজ্জাশূন্য। মানুষের ইতিহাসজুড়ে এত এত রক্তপাত ও ধ্বংসের গা ছমছম চেহারার সাক্ষী যে তারিখ তা কতটা স্পৃহাশূন্য ও নিরাসক্ত হতে পারে, সেটা বোঝা যায় এর এই খরখর পিঠে উঠে বসলেই, কারণ খাটাশটা দৌড়ে চলে না আমাকে পিঠে নিয়ে, বরং যেতে থাকে হাঁসের হাঁটার মতো ধীরে, দুপাশে ঝুঁকে ঝুঁকে। তার চলার এই উগ্রতাহীনতাই আমাকে আসলে বলে দেয় সে কত সুনিপুণ এক ঘোড়েল, কীভাবে সময়কে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে নিজের মিথ্যা এক মূঢ় চেহারা দেখিয়ে। 

১৪ আগস্ট, ১০৪০ সালে রাজা ডানকানকে হত্যা করে স্কটল্যান্ডের রাজমুকুট মাথায় পরেন ম্যাকবেথ, যিনি ছিলেন রাজা ডানকানেরই অনেক বিশ্বস্ত এক সামরিক কমান্ডার, তাঁরই অনুগত প্রাদেশিক গভর্নর। পরে পনেরোই আগস্ট ১০৫৭ সালে ডানকানের পুত্র ম্যালকম লুম্ফানানের যুদ্ধে— ইংলিশদের সহায়তা নিয়ে—ম্যাকবেথকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। 

আর ১৯১৪ সালের পনেরোই আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধের খুনখারাবির মধ্যে জাপান সরকার জার্মানিকে আলটিমেটাম দেয় যে ২৩ আগস্ট তারিখের মধ্যে সমস্ত জার্মান জাহাজকে চীন ও জাপানের জলসীমানা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, দেশের বাইরে জার্মানির সবচেয়ে বড় নেভাল ঘাঁটি শিংতাও ছেড়ে বিদায় নিতে হবে। 

আবার ১৯৪৫ সালের পনেরোই আগস্ট—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ পর্ব তখন শেষ, হিটলার আত্মহত্যা করেছেন তিন মাস হয়ে গেছে এবং হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা পড়েছে সপ্তাহখানেক হবে, মাত্র দুটো বুম শব্দে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে দেড় লাখ মানুষ—জাপানের সম্রাট হিরোহিতো প্রথমবারের মতো কথা বললেন রেডিওতে, জনগণকে জানালেন জাপান আত্মসমর্পণ করছে। কারণ, এই যুদ্ধ চলতে থাকলে শত্রুর হাতে জাপানিজ জাতিগোষ্ঠীই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। 

এরও আগে ১৯৩৪ সালের পনেরোই আগস্ট জার্মান রাইখের প্রেসিডেন্ট হিনডেনবার্গ—যিনি এর বছর দেড়েক আগে মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু নাৎসিদের নেতা হিটলারকে দেশের চ্যান্সেলর বানিয়েছিলেন—তাঁর মৃত্যুর পূর্ববর্তী শেষ উইলে হিটলারের ‘পিতৃভূমির জাগরণ’ প্রচেষ্টাকে সালাম জানিয়ে গেলেন। বললেন, ‘জীবনসায়াহ্নে জার্মান জাতির এই পুনর্জাগরণ দেখে যেতে পেরে আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি’, এবং নাৎসিরা তাঁর এই সত্যায়নপত্র পেয়ে মহা উৎসাহে জাল বিছাতে শুরু করল মৃত্যুলীলার। 

আর পনেরোই আগস্ট ১৯৪৭ সালে, ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত ছুঁতেই, কার্যকর হয়ে গেল ভারতের স্বাধীনতা বিল, ২০০ বছর শাসনের পর বিদায় নিল ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন কিন্তু রেখে গেল হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষের নুনগোলা এক অবস্থা, যা থেকে—ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্র কদিনের মধ্যে পাঞ্জাব ও অন্যান্য অঞ্চলের পথে পথে লাশ পড়ল হাজারে হাজার। 

আর পনেরোই আগস্ট ১৯৬০ সালে ফরাসি উপনিবেশের শাসন থেকে মুক্ত হলো রিপাবলিক অব কঙ্গো, যাকে আমরা কঙ্গো-ব্রাজাভিল নামে বেশি জানি, এবং যার প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো বেলজিয়াম রাজা লিওপোল্ডের সীমাহীন লোভের শিকার হয়ে—সভ্য দুনিয়া থেকে আসা হাতির দাঁতশিকারি ও রাবার ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে—নিজের মাটির এক কোটি কালো মানুষ হারাল উপনিবেশের আমলে, যার কথা কথা জোসেফ কনরাড লিখে গেছেন হার্ট অব ডার্কনেস উপন্যাসে। উপন্যাসে কঙ্গোর দূর জঙ্গলে পোস্টিং হওয়া মেধাবী স্টেশন এজেন্ট কুর্টজের শিক্ষিত, আলোকিত, মানুষ তিনি—শেষ ছবিটা অসংখ্য কালো মানুষের কাটা মুণ্ডু দিয়ে সাজানো এক শাপগ্রস্ত, থিকথিকে নরকের, যার মাঝখানে আলোকোজ্জ্বল ঈশ্বর বা সম্রাট হয়ে বসে আছেন কুর্টজ-সাম্রাজ্যবাদী হরর শোর মূর্ত প্রতীক, অন্য জাতিগোষ্ঠীকে সভ্য বানানোর যে দর্শন তাঁর ভেতরকার নির্মম ঠাট্টাটুকু যেন তিনি নিজেই। 

পরে ১৯৭৯-এর পনেরোই আগস্ট তারিখেই মুক্তি পেল ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার বিখ্যাত সিনেমা অ্যাপোক্যালিপস নাউ, যার মূল গল্প আবার কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস থেকেই নেওয়া, শুধু প্রেক্ষাপট বেলজিয়াম-শাসিত কঙ্গোর জঙ্গলের বদলে এবার ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকার দিনগুলোতে কম্বোডিয়ার এক জঙ্গল, যেখানে আমেরিকান কর্নেল কুর্টজ একই রকম এক নরকের অধিপতি, একই রকম অসংখ্য মানুষের কাটা মাথা দিয়ে সাজানো তাঁর সাম্রাজ্যের চৌহদ্দি, স্বাগত-তোরণ এবং পুরো চৌহদ্দির চারপাশ একই রকম থিকথিক করছে রক্ত ও কাদায়। কর্নেল কুর্টজের মৃত্যুর রাতে, ছবির শেষ রাত সেটা, বিরাট আয়োজন করে ঘাড়ের ওপর কুপিয়ে কুপিয়ে জবাই দেওয়া হলো এক ওয়াটার বাফেলো, এক বিরাটাকার মহিষ এবং সেই মহিষের বীভৎস হত্যাযজ্ঞের সমান্তরালে চলতে থাকল কর্নেল কুর্টজের নিজের মৃত্যুদৃশ্য-শট বাই শট, সিন বাই সিন, ধাপে ধাপে। মৃত্যুর আগে কুর্টজ শুধু ফিসফিস করে বলে যেতে পারলেন একটা কথাই ‘হরর, হরর’। সে কথা কোপের পরে কোপ খেয়ে নিজের নৃশংস মৃত্যুবরণকে প্রত্যক্ষ করে বললেন তিনি, নাকি ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে গেড়ে বসা নিষ্করুণ ধ্বংসাত্মক শক্তিকে পুরো বুঝে ফেলে তাঁর এই শেষ উচ্চারণ (যেন বা মানবপৃথিবীর একমাত্র সত্য এটাই—হরর, হরর), তা জরুরি এক প্ৰশ্ন হয়ে ঝুলে থাকল দর্শকের মনে। 

এতগুলো পনেরোই আগস্টের পিঠ থেকে নামলাম আমি, তখনো আমার বিছানাতেই উপুড় হয়ে বসে, মুখ চাদর-তোশকের মধ্যে গুঁজে পিঠ বিছানার মোটামুটি সমান্তরালে রেখে দুই হাত ও দুই পা ওখানে কুকুরের মতো ছড়িয়ে-বাইরের হরর শো, যা মিনিট বাই মিনিট এগিয়ে যাচ্ছে ১৪ আগস্টের এক অপরিবর্তনীয় ও অনুদার সন্ধ্যার দিকে, তার আঁচ থেকে নিজেকে ঢেকে রাখবার জন্যই যেন। 

দেখলাম জোসেফ কনরাডকে মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। বড় এক ওজন হয়ে কনরাড আমার মাথার সেরেব্রাম করটেক্স অংশ রেখে লিমবিক সেন্টারকে দখল করেছেন, আর তাই আমি রাগ-ক্ষোভে ফুঁসে উঠছি ভেতরে-ভেতরে। কেন তিনি ব্রিটিশ ভারত নিয়ে লেখেননি কিছু? কোনো ব্রিটিশ উপনিবেশেরই শোষণ-নিপীড়ন তাঁর কোনো লেখার কাহিনি হয়ে ওঠেনি কেন? তিনি কি মনে করতেন ব্রিটিশরা ভালো ঔপনিবেশিক শাসক এবং ডাচ, ফরাসি, স্প্যানিশ ও ফ্রেঞ্চরা খারাপ? আর এত সাধারণভাবেই-বা কি তিনি দেখতেন সাম্রাজ্যবাদের বিষয়গুলো? 

‘কঙ্গোর রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন’-এ যোগ দিয়ে কঙ্গোকে সাদা মানুষদের দয়ামায়াহীন, সিস্টেমেটিক বর্বরতা থেকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলনে নামতে রাজি হলেন না কনরাড। তিনি বরং রজার কেসমেন্টকে (রেলরোড সারভেয়ার, কনরাডের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় কঙ্গোয় ১৮৯০ সালে, পরে এই কেসমেন্ট কঙ্গোয় ইউরোপিয়ানদের বর্বরতা নিয়ে এতখানি সোচ্চার হন যে বহু নাটকের অবশেষে ব্রিটেনে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাঁকে) লিখেছিলেন এ রকম কিছু : ‘আন্দোলন করা আমার ধাতে নেই। আমি স্রেফ এক হতভাগ্য লেখক, সৃষ্টি করে যাচ্ছি কিছু হতভাগা গল্প। ওই দুর্বিষহ খেলায় যোগ দেওয়ার মতো যোগ্যতা বা মানসিকতা আমার নেই।’ 

কোন দুর্বিষহ খেলায়? কনরাড জানতেন, ইতিহাসে ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই এবং ইতিহাসের হররগুলো থেকে পালানোর কোনো পথ খোলা ছিল না কোনোকালে এবং মানুষের স্বভাবই এমন যে সেই পথ রুদ্ধই থাকবে চিরকাল। তিনি জানতেন, বারবার ইতিহাস লেখা হবে নতুন নতুন হরর দিয়ে, কোনো আন্দোলনই ঠেকাতে পারবে না কিছুকে। ক্ষমতা প্রত্যেক মানুষকে নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে, নৈতিকতা এক তরল পদার্থ, যা মানুষের যার যার নিজের সংজ্ঞায় সময়মতো বদলে যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার থাকবেই। কারণ, ইতিহাসের ভয়ংকরতা মানুষ তার জিনের ভেতরে বহন করে চলেছে—কনরাড জানতেন, এ তিনটেই জরুরি সত্য। 

ব্যাবিলোনিয়ান সম্রাট হাম্মুরাবির আইনি সংবিধান ২৮২টা আইনের ধারা লিপিবদ্ধ করলেও এর মূল কথা— সমস্ত আগাছা সরিয়ে মূলটুকু দেখলে যা দেখা যায় অর্থে-একটাই : মানবসমাজ তিন স্তরের-উচ্চশ্রেণি, সাধারণ মানুষ ও ক্রীতদাস। তো, এই হচ্ছে আইন—উচ্চশ্রেণির লোকেরা জীবনের সব ভালো কিছু পাবে ও ভোগ করবে; সাধারণ মানুষ পাবে তাদের, উচ্চদের, ভোগের পরে ফেলে রাখা উচ্ছিষ্টটুকু; এবং ক্রীতদাসরা পাবে প্রহার, কারণ, তারা বাধ্য হয়ে নালিশ জানাবে আগের দুই শ্রেণির পাওয়া-টাওয়ার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে। 

অ্যারিস্টটলের মতো আলোকিত মানুষ বলেছেন ক্রীতদাসদের আছে ‘দাসের স্বভাব’, এবং মুক্ত মানুষের আছে ‘মুক্ত স্বভাব’। তার মানে সমাজে তাদের যার যার অবস্থান স্রেফ তাদের যার যার ভেতরকার ‘স্বভাবের’ প্রতিফলন? কিছু মানুষ যে অন্য কিছু মানুষের চাইতে ওপরে রয়েছে আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থে, তাতে যে রক্তের, মগজের, মননের ও বীর্যের কোনো ভূমিকা আসলে নেই, এত বড় সত্যটা দেখতে পাননি অ্যারিস্টটল? 

ইতিহাসের ঘাড়ে চেপে বসা গোঁয়ার মহিষ, ধূসর কালো তার রং, জন্ম-জন্মান্তর ধরে ঘুরিয়ে চলেছে মানুষের মহাযাত্রার সোনালি চাকা, যার চারপাশটা ভরা গেঁজা-ফেনা ও বুদে এবং ফেনার পর্দাটা একটু সরানো গেল তো দেখা যাবে চাকার রং আসলে রক্তলাল। একমুহূর্তের জন্য, হঠাৎই, আমার মনে হলো কনরাড কাফকার মতোই সব সত্য জেনে গিয়েছিলেন এবং তাই তাঁর হার্ট অব ডার্কনেস জুড়ে বলতে গেলে কোনো কিছুকেই তিনি সে জিনিসের আসল নামে, বিশেষ্য ধরে, ডাকেননি, না ওই নদীকে, না কঙ্গোর ওই প্রদেশকে, না আফ্রিকাকে। উপন্যাসের মূল অর্থকে তাই তিনি মুড়ে দিয়েছেন ঘোলাটে সব বিশেষণ দিয়ে : inscrutable (দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময়); inconceivable (অচিন্তনীয়); impenetrable (অভেদ্য ); impalpable ( অস্পর্শনীয়, দুরধিগম্য)। 

আমি উঠলাম বিছানা থেকে। আমার রাগ পড়ে গেছে। আমি শান্ত ও সুস্থির। ১৪ আগস্টের সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে। কী কী অপশন হাতে আছে আমার এখন? সন্ধ্যা পর্যন্ত কী করব আমি এই পাখির গুয়ে গা ভরা দিনে? কোনো মহিষ কিনে এনে কি জবাই দেব ভরা রাস্তায় আর মানবজাতিকে প্রতীকী অর্থে মুক্ত করব তার পাপ থেকে, যেভাবে ইহুদি যিশু করতে চেয়েছিলেন নিজের সামান্য মৃত্যুকে অসামান্য কিছু ভেবে? 

আজ ১৪ আগস্ট। না, আজকের তারিখটার নাম : পনেরোই আগস্ট আসছে। পুরোটা মিলে একটাই নাম। হায়, বেঁচে থাকার কত কষ্ট, কত বাহানা, কত রহস্যময়তা। কীভাবে মিথ্যা বলেছি আমি মাসুম হায়াতকে, নূর হোসেনকে, মেহেরনাজকে, কীভাবে ওদের বানিয়ে বানিয়ে বলেছি আইয়ারকে বিরাট বকশিশ দেওয়ার কথা এবং কীভাবে একটা মিথ্যা, একটা সাজানো গদ্য, একটা পরিপাটি পরিবেশনা সব কষ্টের সমাধান করে দিয়েছে ঠিক সেভাবে, যেভাবে ধোঁকা সবকিছুর সমাধান করে দিচ্ছে সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ অবধি। হরর অব লিভিং! 

আমি নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে গোসলে গেলাম, তার আগে দাঁত ব্রাশ করা, শেভ করা, টয়লেটে বসা, দুর্গন্ধ ছড়ানো, দুর্গন্ধের ভেতরে বসে থাকা, আর বাথরুম স্টলে দাঁড়িয়ে নিজের ঝুলে থাকা অণ্ডকোষে সাবান ঘষা, নিজেকে নিয়ে সহানুভূতি দেখানো, নিজেকে পশু নয়, বরং এক অমর-অজেয় আত্মায় সমৃদ্ধিশালী আলোকিত সত্তা হিসেবে অনুভব করে গায়ে ঝাঁকি দিয়ে উঠে জীবনের কোনো একটা গভীর অভীষ্ট লক্ষ্য যে আছে, সেই বোধে একটুখানি ডুবে থাকা, তারপর শাওয়ারের পানি থামতেই আবার বাইরের পৃথিবীর আওয়াজ, আবার শুকনো খটখটে শরীর যাতে তেল-ক্রিম কিছু মাখতেই হবে, নয়তো দেখাবে যেন মহিষের চামড়া, আবার সুরভি ও মেহেরনাজ, আবার তাদের বিছানায় অশালীন ভঙ্গিমা ও আবার নাকে আসা সেক্সের ভ্যাপসা গন্ধ, আর আবার মুখ বুজে সহ্য করা মাসুম হায়াতের সেই কথা যে, “বন্ধু, তুমি এমনভাবে এই আইয়ারের কথা, তার দারিদ্র্যের কথা বলছ যে মনে হচ্ছে তুমি ইউরোপিয়ান শাসক, দারিদ্র্য দেখতে আফ্রিকার জঙ্গলে গেছ। বাংলাদেশের লোকের তো দারিদ্র্য দেখতে ইন্ডিয়া যাওয়ার দরকার নেই। কী বলছ এসব? থামো তো। এই ঢাকাতেই তো আইয়ার আছে হাজার হাজার। তোমার মাথায় কী ভূত চেপেছিল যে আইয়ার এত বড় একটা বিষয় হয়ে গেল?’ 

আমি বাথরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব বাজে একটা গালি দিলাম। পরক্ষণেই মনে হলো নিজেকে আমার এ গালি দেওয়ার কারণ নেই কোনো। আমি এই পাখির গুয়ে মাখা দিনটাকে গালি দিয়েছি। 

ঠিক আছে। নিজেকে বললাম আমি জোরে। ঠিক আছে। তো তাহলে দিনটার মোকাবিলা করা যাক শক্ত হাতে। জীবনকে অভিশাপ দিয়ে কোনো লাভ নেই। জীবন ঘটে গেছে এবং এই ঘটে যাওয়া এখন অমোচনীয়। আর আমার কাছে এখন এর একটাই মানে—রাগ মেটানো। তো তাহলে পরা যাক কাপড়চোপড়, জুতা, মোজা, বেল্টসহ। 

শরীরটা টানটান করলাম আমি। নাশতা খেলাম নিজ হাতে পাউরুটিতে মাখন চড়িয়ে, পাউরুটির টুকরো হাতে মুড়িয়ে। ল্যাপটপ বন্ধ করতেই হবে। সুরভির আর কোনো মেইল পড়তে চাই না আমি। যথেষ্ট পড়া হয়েছে, যথেষ্ট শোনা হয়েছে তার বাছাই করা গান, যথেষ্ট খোঁজা হয়েছে রেড হট চিলি পেপারসের ‘ব্লাড লস ইন আ বাথরুম স্টল’ কথাটার মানে, বোঝা হয়েছে সেই মানে, বোঝা হয়েছে স্বভাবে রোমান্টিক সুরভির এলিটিস্ট ঘরানার জীবনকে গানের কলিতে কলিতে উপভোগ করতে চাওয়ার অনন্ত বাসনাকে। 

আমি বুঝলাম, তার মেইলগুলো থেকে আমি সত্যি যদি নতুন কিছু পেয়ে থাকি তো তা শুধু এই ভূমিকম্প নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গটুকু, আর কিছু নয়। কারণ, ওসব লেখার অন্য সবকিছু ভালোবাসার কথামাত্র, মুহূর্তের বোধ যার পরমুহূর্তের বোধ এটাই যে আলবারতিনকে কোনো দিনই পাওয়া হবে না মার্সেলের, কেউ কাউকেই পেতে পারে না কোনো দিন সম্পূর্ণ করে, ওই পেতে চাওয়াটাই inscrutable, inconceivable, impenetrable ও impalpable এক চাওয়া। ভাষার সাহায্য নিতেই হলো আমাকে সুরভি প্রসঙ্গকে কবর দেওয়ার জন্য। আপাতত। হ্যাঁ, আপাতত। সামনে ১৪ আগস্টের পুরোটা দিন, অনেক কাজ আছে আমার, প্রথম কাজ মাসুম হায়াতের খোঁজ নেওয়া। বন্ধ ফোনের সুইচ অন করলাম সেই খোঁজ নিতে। 

আটটা না-ধরা কল মেসেজ আকারে পেয়ে গেলাম ফোন অন করতেই। সব কটি নূর হোসেনের। যা বোঝার বুঝে গেলাম। নূর হোসেনকে কলব্যাক করতে সে মহা ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে উঠল আমার ওপরে। কীভাবে কোনো মানুষ পারে এভাবে ফোন বন্ধ করে ঘুমাতে, যখন কিনা বন্ধু হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়? এই তার ক্ষিপ্ততার কারণ। জানলাম, মাসুম মারা গেছে সকাল নয়টা সাঁইত্রিশ মিনিটে, অর্থাৎ যখন কিনা আমি সম্ভবত টিনের অ্যারোপ্লেনে চড়ে ঘুরছি উঁচু সুপারি, মানিপ্ল্যান্ট, দেবদারু, বকুল ও অর্জুনের জঙ্গলে। আর মজনু? গলা থেকে নামানো হয়েছে তার পিন? সুস্থ আছে সে? বাড়ি চলে গেছে তার বাবার হাত ধরে নাকি শুয়ে আছে হাসপাতালের নোংরা বিছানায়, গলা থেকে পিন তোলার পদ্ধতিতে ডাক্তারের সামান্য হিসাবের গোলমালের খেসারত দিতে? 

তো, মাসুম এখন মৃত? আমাকে জলদি ওদের বাসায় চলে যেতে আদেশ করেছে নূর হোসেন। বলেছে, অন্যান্য শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী বন্ধুরা সব এসে গেছে। আর সবাই, অনেকেই, জিজ্ঞাসা করছে আমার কথা। ‘বলতে যে আমি ফোন বন্ধ করে ঘুমাচ্ছি!’ নূরকে বললাম আমি। ওই শেষ কথা। মুখের ওপর ফোন রেখে দিল নূর হোসেন। আমি কাজে নামলাম। 

প্রথমেই চলে গেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসায়। ওনাকে পাওয়া গেল। ছুটির দিন, বিশ্রাম নিচ্ছেন, ভাবছিলেন যে অঙ্কের প্রফেসর মাসুমের বাসায় যাবেন পরিবারকে সমবেদনা জানাতে। আমি আমার প্রস্তাবটা দিলাম তাঁকে। মাসুম হায়াতের দুস্থ পরিবারকে সাহায্য করতে হবে। ওর স্ত্রী ফারজানা হায়াত এখন বিধবা। কীভাবে দিন চলবে তার দুই যমজ ছেলে, বাচ্চা ছেলে, শাহরিয়ার ও শাহনামাকে নিয়ে? ভিসি বললেন, তিনি ভেবে দেখবেন কী করা যায়। আমি উত্তর দিলাম, কড়া স্বরেই যে এত ভাবার কিছু নেই, ফারজানা ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে এমএ পাস, তাকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিন বিভাগে একটা চাকরি দিয়ে দিলেই হয় এবং সেই সঙ্গে লাখ বিশেক টাকা, যেন মেয়েটা সবকিছু একটু সামলে নিতে পারে, কারণ, ‘স্যার, আমি জানি, মাসুম কোনো সঞ্চয় রেখে যায়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় তার বিদেশে চিকিৎসা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেমো দিতে দিতে আর ডাক্তারের পেছনে ছুটতে ছুটতে ওর সব সেভিংস শূন্য হয়ে গেছে, আমি জানি।’ আমার সাফ সাফ প্রস্তাবে যেন বিপদ থেকে বাঁচলেন ভিসি সাহেব কিংবা এমনও হতে পারে তিনি আরও বড় বিপদের মুখে পড়লেন। 

চুপ করে বসে থাকলেন তিনি অনেকক্ষণ। চা এল। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। আবার বললাম, মাসুমের বিধবা স্ত্রীর জন্য একটা চাকরি এবং বর্তমান অবস্থা সামলে নেওয়ার জন্য বিশ লাখ টাকা সাহায্য—এটুকুই। আরও বললাম, ধনী বিশ্ববিদ্যালয় এটা, বড় বড় ধনী লোকজন এটা চালাচ্ছে, ব্যাংকে ব্যাংকে আমাদের ভার্সিটির নামে ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে কোটি কোটি টাকার, প্রতিবছর ছাত্র ঢুকছে স্রোতের মতো আর আয় বাড়ছেই, বিশ লাখ টাকা সে হিসেবে অতি সামান্য, আপনাকে নিতেই হবে এই ডিসিশন দুটো। 

তিনি হঠাৎ রূঢ় স্বরে বলে উঠলেন, ‘তুমি থামবে?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘আপনি হ্যাঁ না বলা পর্যন্ত আমি থামতে পারছি না।’ তিনি আমার চোখের দিকে তাকালেন, গভীর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। আমিও তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, গভীর ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। এটা একটা খেলা। চোখাচোখি খেলা। তিনি খেলায় হারলেন, চোখ নামালেন। কারণ, আমার চোখের মধ্যে তিনি হুমকি দেখেছেন। কারণ, তিনি জানেন, আমার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ বলেই জানেন যে আমি জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পারচেজ কমিটির মেম্বার হিসেবে পারচেজ কমিটিতে তাঁর কাছের দু-তিনজন লোকের মধ্যে একজন হিসেবে জানি যে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত এক ভিসি তিনি, কীভাবে স্রেফ আমাদের ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরির বই কেনার কাজে একটা বাইরের বড় অঙ্কের অর্ডারকে তিনি তছনছ করেছেন নিজের পকেটে সামান্য লাখ দেড়েক টাকা ভরতে। তাঁর চোখ নামানোর ভঙ্গি থেকে আমি আরও বুঝলাম, তিনি জানেন যে আমি আরও জানি কেন এত লোক থাকতে তিনি আমাকেই ২০১২-তে ওয়াসফিয়া নাজরীনের এভারেস্ট অভিযানের ‘ফ্ল্যাগ অফ সিরিমনি’তে যোগ দিতে কাঠমান্ডু পাঠিয়েছিলেন কোন কাজে আমার চুপ থাকার পুরস্কার হিসেবে। তিনি জানেন না যে আমি আরও জানি অন্য খরচের খাতগুলোও কীভাবে তাঁর ব্যক্তিগত লোভের শিকার হয়েছে, কীভাবে দেখা যাবে এর সত্তর ভাগই গুজব, মিথ্যা, কিন্তু ত্রিশ ভাগ গুজবই আবার সত্য। আপনি মাসুম হায়াতের স্ত্রীকে সাহায্য করবেন না, যেভাবে যেভাবে বললাম, সেভাবে করবেন না তো আমি একা উসকে দেব এই গুজবের সত্য ও মিথ্যা অনুপাতের ত্রিশ ইজ টু সত্তর আগুন। থ্রেটটা দিলাম না তাঁকে, তবে যেভাবে চায়ের কাপ ঝন করে টেবিলে রাখলাম, তাতে থ্রেট দেওয়ার বাকিও থাকল না কিছু। 

আমি আবার বললাম, ‘স্যার, হ্যাঁ বলেন, আমি এখনই মাসুমদের বাসায় এই গুড নিউজটা নিয়ে যাব আপনার তরফ থেকে, ভাইস চ্যান্সেলরের তরফ থেকে।’ তিনি উত্তর দিলেন, “ইন প্রিন্সিপল আমি রাজি হচ্ছি তোমার কথায় কিন্তু আমার তো বোর্ড আছে। বিশ লাখ টাকা দেওয়ার ফাইন্যান্সিয়াল অথরিটি তো আমার নেই। মাসুমের ওয়াইফকে চাকরি দিতে পারি আমি। কিন্তু টাকা?’ আমি বললাম, ‘কোনো গ্যারান্টি নেই যে মাসুমের ওয়াইফ আপনার দেওয়া চাকরি নেবে, ম্যানেজার র‍্যাঙ্কের নিচে দিলে সে নেবে না। কেরানি হিসেবে আপনি তাকে নিতে চাইলে সে আপনার অফার নেবে না।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট তো অনেক বড়। ভালো চাকরিই হবে তার, চিন্তা কোরো না।’ আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাঁর দিকে তাকালাম, বললাম, ‘আপনি বোর্ডকে এখনই ফোন করেন। আজ মারা গেছে সে। ফিক্স ইট হোয়েন দ্য আয়রন ইজ হট। আর বোর্ড বলতে তো গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। কোটি কোটি টাকার ব্যবসায়ী মানুষ। আপনি এখনই স্যার ফোন করেন, উনি রাজি হয়ে যাবেন।’ ‘কী যে করো, কী যে করো’ বলতে বলতে ফোন তুললেন এই লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের পিএইচডি ডিগ্রিধারী আমাদের জ্ঞানী ও স্মার্ট ভিসি। 

আমি ওই বাসা থেকে, সুন্দর ও সফল এক ব্ল্যাকমেলিংয়ের শেষে, বের হলাম বুকের ছাতি কিছুটা বড় করে, নিজের চাওয়া সম্পূর্ণ আদায় করার দুষ্ট প্রক্রিয়ার কারণে নিজের ওপর সামান্য হলেও খুশি হয়ে। আমি ভিসি সাহেবকে আজ আঘাত দেওয়ার জন্য আক্রমণ করিনি, তাঁকে জয় করবার জন্যও না, স্রেফ আমার নিজের শক্তি বুঝতেই কাজটা করেছি, স্রেফ সে কারণেই যেভাবে করেছি, সেভাবে করেছি কাজটা। ভালো। 

ভিসির বাসা থেকে বের হয়ে নূর হোসেনকে ফোন করলাম, বললাম সে যেন ফারজানাকে জানায় যে ভিসি ম্যানেজার র‍্যাঙ্কে ফারজানার চাকরি কনফার্ম করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিন সেকশনে, আর তার হাতে বিশ লাখ টাকার চেক তুলে দিতে আজ বিকেলেই ওদের বাসায় যাচ্ছেন উনি। নূর হোসেন হতভম্ব হয়ে গেল শুনে। জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কোথায়?’ আমি জানালাম, ‘জাহান্নামে।’ সে এবার বলল, ‘মাসুমের জানাজা আজ আসর বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে’ এবং আমি মাসুমদের বাসায় গেলে সে আমার সঙ্গে একসঙ্গে জানাজায় যাবে। আমি উত্তরে বললাম যে আমি না যাব মাসুমদের বাসায়, না যাব তার জানাজায়, সরি। 

মৃত মানুষের মুখ দেখার আমার কোনো ইচ্ছা নেই, তা সে মৃত বন্ধুর মুখ হোক বা শত্রুর, কোনো ফারাক হয় না তাতে। মানুষ পরিচিতজনের মুখটা শেষবারের মতো একবার দেখে নিতে কত আগ্রহী! কী মায়া ও ভালোবাসা নিয়ে তারা দেখে সেটা, কীভাবে কাঁদে সেই মুখ আর কোনো দিন দেখবে না বলে এবং কীভাবে তারা কদিন বাদেই ভুলতে থাকে সেই শেষ দেখা মুখের আউটলাইনগুলো, বৈশিষ্ট্য ও ভাবগুলো। তা তারা দেখুক, তাতে আমার আপত্তি নেই কোনো, বরং আমি মোটামুটি বাসযোগ্য এক সামাজিক ব্যবস্থার স্বার্থে সেই দেখার আগ্রহের প্রশংসাই করি মনে মনে। 

মৃতের একাকী পড়ে থাকা, লাশের বন্ধুহীন শুয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক অর্থে কোনো ব্যাপার না হলেও মানুষের উচ্চতর এক প্রাণী হওয়ার দাবির অর্থে সেটা করুণ ও ঘৃণার্হ এক অবস্থা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি মৃত মানুষের মুখ দেখতে চাই না অন্য কারণে—কিছুক্ষণ ওই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে আমি তাতে পরিষ্কার অদূর ভবিষ্যতে আমার নিজের মুখের ছায়া দেখতে পাই, আমার মনে পড়ে যায় এই সত্য যে কদিন বাদে আমিও শুয়ে থাকব ওভাবেই এবং আমার লাশের পাশে বসে কেউ একজন আরেকজনের ফোন ধরে বলবে, ‘ডেলিভারি চালানটা ছেড়ে দাও, আমি পরে এসে সই করে দিচ্ছি’, এসব কথা। 

এসব চিন্তা করতে করতে আমি রিকশা থেকে নামলাম লুনাদের বাসার সামনে। রিকশাওয়ালার সঙ্গে দশ টাকা ভাড়ার কমবেশি নিয়ে অকারণ তর্কও করলাম কিছুক্ষণ, যদিও ভেতরে ভেতরে আমি জানতাম তাকে আমি, আমার হিসেবে, দশ না, বিশ টাকা ভাড়াই বেশি দেব। কারণ, সে ১৪ আগস্টের গুমোট গরমের মধ্যে রিকশা চালিয়ে আমাকে এনেছে এইখানে। 

কতবার এসেছি আমি এই বাসায়, কত দাওয়াতে, নূরের সঙ্গে কিংবা আমি, মাসুম ও অন্য কয়েকজন নূরকে আড্ডায় জরুরি বলে এখান থেকে তুলতে। সেসব দিন ভাবলে কেমন অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য লাগে। বন্ধুত্বগুলো নিখাদ বন্ধুত্বই ছিল তখন, জীবনের ব্যস্ততাও এত ছিল না। কিংবা হয়তো নিখাদ কোনো বন্ধুত্বই হয় না; হয়তো জীবনের ব্যস্ততা একই ছিল তখনো, শুধু জীবন কাটানোর প্রায়োরিটির তালিকা অন্য রকম ছিল, এই যা। 

বাসার নিচের গার্ড আমাকে চিনল, জিজ্ঞাসা করল কেমন আছি। সে নিশ্চয়ই জানে যে লুনার ডিভোর্স হয়ে গেছে নূরের সঙ্গে এবং আমি নূরের বন্ধু হিসেবে এখন এ বাসায় আসবার আর কেউ নই। কীভাবে কেউ থেকে কেউ-না হয়ে যায় মানুষ এক জীবনেই, কত কত পরিচিতজনের সঙ্গে, আর গার্ডরা-ড্রাইভাররা-পিয়নেরা দেখে যে সাহেবরা কীভাবে দ্রুত খাতা খোলে ও খাতা বন্ধ করে, তারা নিশ্চয়ই ভাবে যে শিক্ষিত ও বড়লোক মানুষদের (তাদের হিসেবে আমি নিশ্চয়ই বড়লোক) কাজকামের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কিংবা আমি যা ভাবছি, তার সবই ভুল, তারা এতে অবাক হয় না একটুও। কারণ, তাদের পরিমণ্ডলেও এই একই ঘটনা ঘটে একইভাবে। দারিদ্র্যের মধ্যে সরলতা আছে এবং প্রাচুর্যের মধ্যে জটিলতা—এ রকম একটা সাধারণ বিশ্বাস আছে মানুষের মনে কিন্তু অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে নিশ্চয়ই প্রমাণ করা যায় যে এই বিশ্বাস ভুল। 

যেকোনো যুক্তি দিয়েই যেকোনো কিছুকে প্রমাণ করা যায়, এমনই এই পৃথিবী। আর এটাই মানবসমাজের সবচেয়ে বড় ব্যাধিগুলোর একটা। ফরাসি রেনেসাঁর দার্শনিক মিশেল দ্য মনতেইন প্রায় সোয়া চার শ বছর আগে মানুষের সিদ্ধান্ত বা বিচারবুদ্ধিগুলোর অনিশ্চয়তা বিষয়ে বলতে শুরু করেছিলেন এই কথা বলে যে, ‘যেকোনো কিছুর পক্ষে বলার এবং বিপক্ষে বলার সমূহ সম্ভাবনা রাখে মানুষ।’ 

যেকোনো কিছুর পক্ষে ও বিপক্ষে একই রকম ধারালো যুক্তি দিয়ে একেবারে দুই রকম কথা বলতে পারার গুণ মানুষকে কতটা যুক্তিবাদী প্রাণী করেছে কিংবা পৃথিবীতে আইন, প্রথা ও বিশ্বাসের প্রয়োগকে কতটা সুবিধাবাদী প্রকল্প বানিয়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে এবং সে অর্থে সমাজব্যবস্থাকে কীভাবে পিচ্ছিল করে তুলেছে, তা নিয়ে আবার ভালো বিতর্ক হতে পারে। কোথায়ও দাঁড়াতে পারছি না আমরা সুস্থির হয়ে এবং স্থিরতা বলে কিছু নেই, আছে শুধু বিশ্বাস ও যুক্তির কুয়াশাচ্ছন্ন ভাষার খেলা। আর তাই একজনের কাছে যা যৌক্তিক, আরেকজনের কাছে তা হয় চাপিয়ে দেওয়া যুক্তি, নয়তো স্রেফ অন্যায়—এই দুষ্টচক্রের মধ্যেই ঘুরছি আমরা শুধু আমাদের জ্ঞানের গর্বটুকু নিয়ে, ভাবলাম আমি। মনতেইনই বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কথা : ‘মানুষের ওপরে একটা প্লেগই ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেটা তার এই মত যে, সে কিছু জানে।’ মতামতকে মানুষ জ্ঞান বলে ভাবে এবং জ্ঞানকে ভাবে (যা আসলে স্রেফ একটা মতামত মাত্র) কাউকে দমিয়ে রাখার মোক্ষমতম অস্ত্র। 

আমাকে নিয়ে এ মুহূর্তে কী ভাবছে ওই পূর্বপরিচিত বৃদ্ধ গার্ড, বারিধারার মতো বিলাসী আবাসিক এলাকায় চার দেয়াল দেওয়া এক বড় বাড়ির জীবনে অনেক কিছু দেখা ও শোনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গার্ড মানুষটা? সে কি তার সামান্য মতামতের জায়গা থেকে দেখছে আমাকে আর ভাবছে যে, এই লোক আবার এখানে এসেছে কি কোনো ঝামেলা পাকাতে? নাকি সে আমাকে দেখে তার জ্ঞানের জায়গা থেকে ভাবছে যে এই লোকও তাহলে লুনা ম্যাডামের প্রেমিকদের একজন? এসব ভাবনার কোনটা মতামত এবং কোনটা জ্ঞান? এ কথা ভাবতে ভাবতে প্রায় বিভ্রান্ত হয়ে আমি দোতলায়, যেখানে শুধু লুনা থাকে বলে জানতাম, না থেমে ভুলে আরও একতলা ওপরে উঠে তিনতলার দরজার কলবেল টিপে ফেললাম। 

দরজা খুলল একজন ভৃত্য, শক্তপোক্ত চেহারার, সুন্দর পোশাক-আশাক পরা। আমি ভেতরে পা রাখতেই দেখতে পেলাম প্রায় আশি-নব্বই বছরের এক সাদা ফকফকে মহিলাকে, হুইলচেয়ারে বসা, হাতে তাঁর রুপোয় বানানো পানের বাটি। তাহলে এই তিনি লুনার দাদি, বগুড়ার এক বিখ্যাত প্রাক্তন জমিদারবাড়ির মূল অধিকর্ত্রী? জমিদার সাহেবের এক বয়সের জাঁদরেল স্ত্রী তিনি? বৃদ্ধার চেহারার মধ্যে এই বয়সেও যে কর্তৃত্ব ও আস্থার ছাপ, তা আমাকে পরিষ্কার বলে দিল, জীবন থেকে অনেক কিছু পাওয়াদের দলের তিনি একজন, পৃথিবীতে মাত্র ১-২ পারসেন্ট সব পাওয়া ব্যক্তির যে গোত্র, তাঁদেরই একজন তিনি—ক্ষমতাশালী, যাঁর অঙ্গুলিহেলনে নিশ্চয়ই একদিন সপাং সপাং বেতের বাড়ি পড়ত খাজনা দিতে দেরি হওয়া গরিব কৃষক ও প্রজাদের পিঠে। নায়েব কোথায় তাঁর এখন? নিশ্চয়ই মরে গেছে। হতভাগ্য সেই সব প্রজা কোথায়? নিশ্চয় তারাও মৃত। পাইক-পেয়াদা এবং চাবুক ও বন্দুকবাহিনী কোথায় আজ? নিশ্চয়ই তারাও লুটিয়েছে ধুলোয়। তাহলে এত দিন বেঁচে থেকে কী করছেন তিনি? একাকিত্বের বোঝা সামলাচ্ছেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত মোচনের মোড়কে তাঁর অফুরন্ত সময়কে মুড়িয়ে? 

আমি তাঁর পানের বাটির পাশে দেখলাম খুব দামি দেখতে মতো এক তসবিহ। ভালোই, তাহলে তসবিহ টিপেই দিন যাচ্ছে এই বৃদ্ধার, ওটুকু ভুলতে যে আজ জমিদারিও নেই, সেই শাসন-ত্রাসনের মধ্যে ডুবে নিজের জীবনকে ক্ষমতায় ভরপুর থাকার প্রাপ্তিবোধের খুশিও আজ নেই, আছে শুধু আর মাত্র কয় মাস বা বছরের মধ্যে হুইলচেয়ারটার মাপের ভেতরে নেতিয়ে পড়ে চিরতরে ডুবে যাওয়া? অতএব, কিছুই যখন নেই কবরে যাওয়ার নিশ্চয়তাটুকু ছাড়া, তখন সারা জীবনের এত অন্যায়-অনাচার-পাপ ঘটানোর পর আল্লাহকে বন্ধু করে নিলেই জীবনভর টেনে আনা ভারটার বোঝা কমবে? আমি আর সহ্য করতে পারলাম না ওই সাদা-বৃদ্ধ-চুলপড়া ডাইনিকে। 

লুনার কাছ থেকেই শুনেছি খরার দিনে তার দাদা-দাদিরা কীভাবে কৃষকদের পেটাতেন ফসল কম হয়েছে বলে, সেসব গল্প। লুনা গর্ব করে বলত ওসব কথা, নিজের জাত বোঝাতে। আমি নিজে ক্ষমতাশালী কিংবা আমি কোনো ক্ষমতাশালী পরিবারের একজন সদস্য কিংবা আগে ক্ষমতাশালী ছিল, এমন এক পরিবারের একজন আমি—এই তিন জাতের চেয়ে আত্মম্ভরি ও হিংসুক জাত পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই। কিন্তু তাদের জাতের প্রকাশটুকু তারা করে কত বিনয়ের সঙ্গে, যেন প্রকাশের মধ্যে বিনয়টুকু আনলে জাতটা আবার বনেদিও হয়ে যায়। উঁচুজাতের লোকদের সোজা সব হিসাব এগুলো। সুরভিও একইভাবে হিসাব করে তার জীবনের ব্যালান্সশিটের জাত বনাম অজাত, নতুন পয়সাওয়ালা ধনী বনাম বনেদি, তা এখন আর পয়সা থাকুক বা না থাকুক। ক্লাস বিভাজন গরিবের স্তরে সরল : খেতে পারলাম, শুতে পারলাম, চাইলে কাউকে মারতে পারলাম—এ রকম, আর ধনীর স্তরে তা কত ভাগ ভাগ। কিন্তু হতে পারে এই সরলীকরণ করে দেখা আবার একটা ভুল। গরিবের স্তরের মধ্যেও নিশ্চয়ই আবার আছে অনেক স্তর, যাতে ওখানেও কেউ কেউ নিজেকে ভাবে আমি পুরোনো গরিব, আবার অন্য কেউ ভাবে আমি নতুন গরিব। তবে এই দুই গরিবের মধ্যে কে ওপরে ওঠে, তা আমি জানি না, নিশ্চয়ই সমাজবিজ্ঞানীরা জানেন। আবার হতে পারে বিভাজনের দাগটাই গরিবের বেলায় নতুন ও পুরোনোর ফারাক দিয়ে দেখার নয়, সেটার অন্য কোনো মাপকাঠি আছে নিশ্চয়। 

‘লুনার ফ্লোরে যাব’ কথাটা বলে সেই বৃদ্ধার দিকে পিঠ ফেরালাম আমি। তিনি কানে শোনেন না বোঝা গেল। চিৎকার করে ভৃত্য লোকটাকে তিনি বললেন : ‘ফরিদ, কী, কী বলছে, কে এ, ফরিদ, ফরিদ?’ আমি ফরিদকে তাঁকে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগটুকু দিয়ে একতলা নিচে নামলাম। দরজায় কলবেল দিতেই দরজা খুলল স্বয়ং লুনা, তাকে একনজর দেখে নিয়ে আমার মনে হলো এত সুন্দর কোনো মেয়ে আমি দীর্ঘ দীর্ঘদিন দেখিনি। তার গলায় প্যাচানো একটা গুচির স্কার্ফ, গুচির লোগো স্কার্যজুড়ে নকশাকাটা—এই লোগো তাকে পৃথিবীর মাটি থেকে সামান্য কয়েক ইঞ্চি ওপরে ভাসিয়ে রেখেছে রীতিমতো এবং তার সাজগোজের পারিপাট্যবোধ দেখে মনে হচ্ছে সে এ মুহূর্তে এ বাসায় নেই, আছে অস্কার অনুষ্ঠানের রেড কার্পেটে ক্যাথেরিন জিটা জোনসের পাশে। স্কার্ফের ঠিক নিচে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার দুই বুকের মাঝখান ফুটফুটে এক কাটা, সেখানে বর্ষার ফুল যেন ধুম করে ফুটে উঠবে যেকোনো মুহূর্তে। আমার মনে পড়ল টগরের কথা, শান্ত পানিতে বৃষ্টির মধ্যে ভেজা টগর ও তার রঙের বিভা, যেহেতু আকাশ এই বৃষ্টির মধ্যেও কোথায় যেন রোদটুকু—সামান্য হলেও—ধরে রেখেছে। আমি শুধু ভাবলাম তার পাশে, এই ক্যাথেরিন জিটা জোনসের বান্ধবীর পাশে এ মুহূর্তে একমাত্র যাবে কোনো চিত্রল হরিণ, তবে বিদেশেরটা নয়, আমাদের সুন্দরবনের স্বাস্থ্যবান কিন্তু একহারা কোনোটা। আমি ভেতরে ঢুকলাম। না, লুনা আমাকে হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিল। 

সুন্দর এক অভিজাত ড্রয়িংরুমে বসলাম। লুনা এসি অন করল, তারপর এসে বসল আমার দিকে কোনাকুনি মুখ করে আরেক সোফায়। এই ঘরে আগেও এসেছি আমি, শেষ কবে, তা মনে নেই, তবে বছর দুয়েক হবে। আমাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেশি নয়। আমার মনে হলো, আমি তাকে যে কথাটা শোনাতে এসেছি, তার সাপেক্ষে দূরত্ব আরেকটু বেশি হলেই বোধ হয় কথাটা বলতে সুবিধা হতো আমার। 

লুনাই শুরু করল কথা, ‘বাইরে যাচ্ছিলাম, মাসুম ভাইদের বাসায়,’ বলল সে। আমি বললাম, “তোমার বান্ধবীকে হাসপাতালে দেখলাম কাল রাতে, নূরও ছিল ওখানে।’ লুনা বলল, ‘জানি।’ তারপর নীরবতা। 

আমিই ভাঙলাম সেই নৈঃশব্দ্য, বললাম, ‘এত সেজেগুজে মরা বাড়িতে যাচ্ছ?’ লুনা বলল, ‘এক ফোঁটাও সাজিনি তো, কী যে বলেন। লিপস্টিকও তো লাগাইনি।’ আমি অবাক হলাম ওর কথা শুনে। ভালো করে দেখলাম ওকে। আসলেই সাজগোজ বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই করেনি সে, স্রেফ একটা সালোয়ার-কামিজ পরে গলায় স্কার্ফ বেঁধেছে। কিন্তু বুঝলাম, তার সালোয়ার-কামিজটাই এত দামি, জুতো জোড়াও, আর সবচেয়ে বড় কথা তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য, চোখের কাজল কালো তীক্ষ্ণতা, ভুরুর টান, পাপড়ির ফুটে ওঠা ও পাতলা ঠোঁটের লাল স্বাভাবিক রংটাই এমন যে মনে হচ্ছে লুনার জন্য যা কোনো সাজগোজ নয়, তা অন্য যেকোনো মেয়ের জন্য বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার সমান। লুনা আমাকে জিজ্ঞাসা করল কেমন আছি আমি। 

একটু ধাতস্থ হয়ে, ততক্ষণে ঘর প্রায় শীতল হয়ে উঠেছে, আমি তাকে জানালাম যে আমি ব্যস্ত আছি ১৪ ও ১৫ আগস্ট নিয়ে। 

লুনা বলল, ‘সত্যি বুঝি না যে কী হয় আপনার এই দিনটাতে? প্রতিবছর। আমাকে নূর বলত, বাংলাদেশে আপনি ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই, যাকে পনেরোই আগস্ট এভাবে তাড়া করে। আমি ওকে বলতাম, এটা তো একটা রাজনৈতিক ঘটনা, এটাকে উনি অত পার্সোনালি নেন কেন?’ 

আবার সব চুপচাপ। লুনাই ভাঙল এবারের নীরবতা, বলল, ‘কী নিয়ে ব্যস্ত আপনি, মানে পনেরোই আগস্টের কী নিয়ে ব্যস্ত? 

আমি তাকে গড়গড় করে বলে গেলাম পনেরোই আগস্ট নামের ইতিহাসের অভিশপ্ত এক তারিখের আগাপাছতলা। রাজা ম্যাকবেথের মৃত্যু, ম্যালকম ডানকানের হাতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে জাপানের আলটিমেটাম দেওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই দিনে জাপানের সম্রাটের রেডিওতে জাতির উদ্দেশে আত্মসমর্পণের ঘোষণা। এর আগে ১৯৩৪ সালে এদিন প্রেসিডেন্ট হিডেনবার্গের নাৎসি বাহিনীকে এগিয়ে চলার প্রত্যয়নপত্র দিয়ে দেওয়া। কঙ্গো-ব্রাজাভিলের ফরাসি উপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভ। কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস-এর গল্প নিয়ে বানানো ছবি অ্যাপোক্যালিপস নাউ-এর মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনসহ খুন হওয়া। এটুকু বলে চুপ করে গেলাম আমি। 

লুনা বলল, ‘পৃথিবীতে যেকোনো নির্দিষ্ট দিনের ইতিহাস ঘাঁটলেই তো এ রকম লিস্ট বের করা যাবে।’ আমি প্রতিবাদ করলাম সে কথার, ‘এতগুলো মৃত্যুর লিস্ট। আমার লিস্টের প্রতিটা মৃত্যুই খুন। এই একই দিনে ঘটা মৃত্যু আর এই দিনের উৎস থেকে ঘটা মৃত্যু, আমি যে কটা বললাম, তার সব কটা যোগ দাও, আমার হিসাবে ৯ কোটি ২৫ লাখ লোকের মৃত্যুর পেছনে আছে পনেরোই আগস্ট তারিখ।’ 

এটুকু বলে থামলাম। কারণ, আমার আক্ষেপ হতে লাগল যে আলোচনা যেদিকে যাচ্ছে, তা আমার জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। তাকে আমি একটামাত্র কথা শোনাতে এসেছি, তার সঙ্গে ইতিহাসের মৃত্যুময়তার হিসাব-নিকাশ করতে নয়। এভাবে চলতে থাকলে আমার মূল কথাটার কোনো ইমপ্যাক্টই আর থাকবে না বলে আশঙ্কা হতে লাগল আমার। 

‘নয় কোটি পঁচিশ লাখ লোক মারা গেছে পনেরোই আগস্ট ঘিরে?’ আন্তরিক কৌতূহল থেকেই প্রশ্নটা করল লুনা। ‘আর বঙ্গবন্ধুর বাসায়?’ 

‘তিন বাসা মিলে ২৬-২৭ জন। ওই বাসায় ১২-১৫ জন। এক রাতেই। আধা ঘণ্টার মধ্যে। সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। জানি না। আমাদের জাতি হিসেবে ঠিক রেকর্ড রাখার চর্চাই শুরু হয়নি তখন।’ কথাটা বলতেই হলো আমাকে, তারপর নীরবতা ডেকে আনলাম আমিই, চুপ করে বসে থাকলাম। 

চা এল। লুনা বলল, ‘আপনাকে কফি খাওয়াতে পারলাম না, আপনি এসব ইনস্ট্যান্ট কফি তো খাবেনও না। তা এখন বলেন, কী মনে করে এখানে? আর স্যান্ডউইচটা আমার নিজের বানানো, টুনা স্যান্ডউইচ, আপনার অন্য রকম লাগবে শিওর। কারণ, কমপক্ষে পাঁচটা আনইউজুয়াল আইটেম আছে এটার ভেতরে। খেয়ে বলবেন যে কেমন লাগল।’ 

আমার মনে পড়ল লুনা রান্নার পাগল, রেসিপি এক্সপেরিমেন্ট করে করে দেখা তার বড় শখগুলোর একটা। 

চায়ে চুমুক দিয়েছি। ওই স্যান্ডউইচটা খেতে হবে ভাবতে আমার অস্বস্তি লাগছে। একটা সবুজ হয়ে আসা রঙের সাদা শসার টুকরো একটুখানি বের হয়ে আছে স্যান্ডউইচের গা ঘেঁষে। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চোখে পড়ল সাদা মেয়োনিজ হালকা চুইয়ে পড়ছে ওটার আরেক কিনার বেয়ে। অশ্লীল এক দৃশ্য। লুনাকে দেখতে সব সময়েই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লাগে আমার, এমনকি এখন যে সে মুখে স্মিত হাসি ছড়িয়ে আমার চা খাওয়া দেখছে এবং তার ঠোঁটের দুই কিনারে স্বচ্ছ পানি পানি কী একটা জমে উঠেছে সামান্য আর ওই ক্ষুদ্র ফোঁটা দুটো চিকচিক করছে বাল্বের আলোয়, সেটাও আমার কাছে খারাপ লাগছে না মোটে, মনে হচ্ছে এক দীর্ঘ চুমুতেই ওই দুটো ফোঁটা হাওয়া করে দেওয়া সম্ভব। 

লুনা আন্তরিকতা ভরা গলায়ই জিজ্ঞেস করল আমাকে, ‘স্যান্ডউইচ খাবেন না? পনেরোই আগস্ট নিয়ে পরে ভাববেন, এখন খান তো।’ 

তার কণ্ঠস্বরে প্রাক্তন স্বামীর প্রিয় বন্ধুর কাছে করা আবদার স্পষ্ট। কিন্তু ওটার মধ্যে পনেরোই আগস্টকে টেনে এনে সে যেন আমার মাথাটা কেমন ঝমঝমে, চুড়ির আওয়াজের মতো করে দিল। মুখের মধ্যে অ্যাসিডের একটা বোধ হলো আমার, যা হয় রিসর্ট্রেটো কফি খেলে। লুনা কিছু আগে বলেছে যে পনেরোই আগস্ট একটা রাজনৈতিক ব্যাপার আর তা আমি কিনা পার্সোনালি নিচ্ছি। এই বটতলা লেভেলের বাজে কথাটা মনে পড়তেই দুটো জিনিস হলো আমার মাথায় ভেতরে : এক. লুনাকে খানকি বলে গালি দিতে ইচ্ছা করল; দুই. মনে হলো অতিথিপরায়ণতা ভরা ‘সামাজিক’ স্যান্ডউইচটার মধ্যে দুফোঁটা তাজা বিষ ভরে দিয়ে লুনা ওটাকে নূরের কাছের অন্যদের অসুস্থ করে তুলবার এক পার্সোনাল অস্ত্র বানিয়ে ছেড়েছে। 

আমার মনে হলো আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, কীভাবে সে নিশ্চিত হচ্ছে যে তথাকথিত রাজনৈতিক বিষয়গুলো আদতে কারও কোনো পার্সোনাল বিষয় নয়? দাগটা কোথায়? পনেরোই আগস্টের হত্যাযজ্ঞ কি বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের জন্য রাজনৈতিক, নাকি পার্সোনাল ব্যাপার? হিমলারের এসএস বাহিনী যে লাখ লাখ লোককে ধরে নিয়ে গেছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত, তা কি ওই নিরীহ লোকগুলোর জন্য রাজনৈতিক আঘাত, নাকি পার্সোনাল আক্রমণ? তখনকার জার্মান জাতি, যারা বুঝে না-বুঝে হিমলার ও হেইড্রিখকে সাহায্য করে গেছে নির্বিচারে ইহুদি বা পোলিশদের ধরার কাজে, তারা কি তা করেছে সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে, নাকি পার্সোনাল কারণ থেকে? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে আমি যদি পার্সোনালি নিয়ে নিই, তাহলে কি ইতিহাস আমাকে ভুল পথে চলা মতিভ্রষ্ট মানুষ বলে রায় দেবে? সম্ভবত দেবে, কারণ ইতিহাসের স্বভাবই ওটা, কারণ ইতিহাস কোনো ঘটনা পার্সোনালি নিয়ে নেওয়াকে খারাপ চোখে দেখতে শিখিয়েছে যেনবা সেভাবে নিয়ে নিলে ঘটনার বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে যায়। বস্তুনিষ্ঠতা জিনিসটাই বা কী? মানুষের খাড়া করা এসব প্রথার গোড়া ধরে প্রশ্ন করাও এখনকার দিনে গণ্য হচ্ছে হয় অপরাধ না হয়-অন্তত-শিশুতোষ কাজ হিসেবে। নিকুচি করি আমি ওসবের। 

পার্সোনাল অনুভূতির জায়গা থেকে পনেরোই আগস্টের ঘটনাকে বিচার করার এবং তাতে ক্রোধান্বিত হয়ে অনেক কিছুর ওপর পেট্রল-অকটেন ঢেলে দেবার মতো নৈরাজ্যজনক কোনো কাজ করে ফেলার সমস্ত পার্সোনাল অধিকার আছে আমার। সে জন্য আমাকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ হতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতার কথা কোথায়ও লেখা নেই এবং থাকলেও ওগুলো সুবিধাবাদীদের কিংবা সিস্টেমকে সম্মান জানিয়ে চলা সুশীল মানুষদের তৈরি মাত্র। ‘ফাক দেম অল’, আমি জোরে বলে ফেললাম গা ঝাঁকিয়ে এবং চায়ের কাপ সশব্দে পিরিচে রেখে উঠে দাঁড়ালাম লুনাকে অপমান করব বলে। 

ঘাবড়ে গেল লুনা, সন্ত্রস্ত হয়ে একমুহূর্তের জন্য সে কুঁকড়ে গেল তার সোফার ভেতর দিকে শরীর ঢুকিয়ে দিয়ে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে, বুকের স্কার্ফ সরিয়ে ওটা দিয়ে তার মুখের দুই কিনারার জলবিন্দু মুছে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কী বললেন? কাকে গালি দিলেন?’ 

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, ‘তোমাকে।’ 

লুনা বলল, ‘কেন?’ 

আমি লুনার একদম কাছে চলে এসেছি। আমি দাঁড়িয়ে, সে বসে আছে। সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হাউ ডেয়ার ইউ কল মি যখন তখন? জাস্ট টু টেল মি যে তোমার এক্স হাজবেন্ডকে তুমি কীভাবে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসাবে? আমাকে সেই হুমকি শুনিয়ে তারপর বলো যে তোমাদের মগবাজারের ফ্ল্যাটটা নূরকে তোমার নামে লিখে দিতে হবে, আর আমি তোমার থ্রেটগুলো সিরিয়াসলি নিচ্ছি না, আর’–এ পর্যায়ে হাঁপাতে লাগলাম আমি, আমার বুক কাঁপছে দেখলাম ধড়ফড় করে—’আর আর’–আমি এবার দুহাতে ওপর-নিচে ঝাঁকিয়ে কথা বলতে লাগলাম গোয়েবলসের বিখ্যাত ভঙ্গিতে—’আর এটা কী কথা যে তুমি প্রতিবার আমাকে শেষে বলো, বিনিময়ে আপনি যা চান, যা চান, যা চান, তা আমি আপনাকে দেব? মানে কী এটার?’ 

লুনার মাথা নিচু থেকে আরও নিচু হয়ে গেল একমুহূর্তে। একবার সে তাকাল আমার দিকে, একবার দাঁতে নখ কাটল, একবার নাকের নিচটা মুছল হাত দিয়ে, শেষে আবার তাকাল আমার দিকে এমনভাবে যেন সে কোনো সম্রাটের দরবারে বসে তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে নয়, দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সম্রাটের ছায়ার দিকে। তার দুচোখ ভরা পানি চিকচিক করছে নানা দিকের নানা বাল্বের স্পষ্ট আলোয়। মেয়েদের এসব কান্নায় মন গলবার কোনো ব্যাপার আমার মধ্যে নেই বলে আমার ধারণা। উল্টো তার চোখের পানি আমাকে আরও ক্রোধোন্মাদ করে তুলল। আমি তাকে একই রকম উদ্ধত ভঙ্গিতে, আরও ধীর কিন্তু তির্যক স্বরে বললাম, ‘আই ডোন্ট টেক ইওর অফার অব সেক্স। ফার্স্ট অব অল, ইট ডাজনট ইন্টারেস্ট মি। আর সেকেন্ড অব অল, তোমার যখন এতগুলো ফ্ল্যাট-জমি-বাড়ি আছে, তখন ওই মগবাজারের সামান্য এক ফ্ল্যাটের জন্য তোমার এত মরিয়া হয়ে ওঠা জঘন্য এক ব্যাপার।’ 

আবার চুপ সবকিছু। লুনার সশব্দ কান্না শোনা যাচ্ছে। এটা ঠিক কান্নার আওয়াজ না, কেমন যেন বুকের ভেতর থেকে আসা এক শব্দ—উহ্ উহ্‌হ্ ধরনের। ওদিকে আমি থামতেই পারছি না। কোনো একটা ভয়ানক আক্রোশ আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি ভাবছি, মেয়েদের সুযোগমতো পেয়ে অপমান করবার পুরুষের শাশ্বত আক্রোশই কি না এটা। আমি বলতে লাগলাম, ‘হোয়াট ডু ইউ থিংক অব ইওরসেল্ফ, লুনা? ইউ আর ক্যাথারিন জিটা জোনস? ইউ আর আনা কারেনিনা? ফাক ইউ।’ 

আমার কথা বলার মধ্যে বাধা পড়ল ইন্টারকমের তীক্ষ্ণ বিবিবিবিবিপ বিবিবিবিপ আওয়াজে। পাঁচ-ছয়বার বেজে থামল তা। আমি এই আকস্মিক বাধা পেয়ে কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি যেন, লুনার সামনে বৃত্তাকারে পাক খাচ্ছি মাতালের মতো, পানির গ্লাসটা হাতে তুলেছি, তখন আবার বিবিবিবিবিপ বিবিবিবিপ। এবার থামছেই না রিং। লুনা উঠল, ঘরের ভেতর দিকে চলে গেল ফোন তুলতে। 

আমি কেন জানি না চুপচাপ গেলাম ওর পেছন পেছন ওর উঠে যাওয়ার পনেরো-বিশ সেকেন্ডের মাথায়। এই ড্রয়িংরুম আর ভেতরঘরের মাঝখানে আশ্চর্য অভিজাত এক কাচের দরজা। তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, শুনলাম লুনা চাপা গলায়, সেই কণ্ঠস্বরে কান্নার সামান্য ছাপ নেই, বলছে : ‘খানকি বেটি, তুই চুপ কর, খানকি বুড়ি মাগি, আমার বাসায় কে এসেছে, তা তোরে বলতে হবে আমার? আমি তোর খাই না পরি? চুপ কর তুই।’ 

নীরবতা। আবার : ‘আর একটা কথা বলবি তো তোরে আমি বঁটি দিয়ে কোপায়ে ফালা ফালা করব, তুই চিনিস না আমারে? খানকি বেটি, তুই আমারে জিজ্ঞেস করিস আমার বাপের বাসায় কে এসেছে, এত বড় সাহস তোর বেটি?’ 

আবার একটু বিরতিতে, “দাঁড়া, সেদিন তোরে পিটাইছি খুন্তি দিয়ে, আজ পিটাব ঝাঁটা দিয়ে…চুপ কর বুড়ি…চুপ কর।’ নীরবতা। ওপাশ থেকে কী বলছেন ওর দাদি, তা শোনার কোনো উপায় নেই আমার। 

তারপর আবার এবার লুনা বিরাট ক্ষিপ্ত, রীতিমতো চিৎকার করছে সে গলার স্বর কঠিনভাবে চেপে রেখে, যেহেতু আমি আছি পাশের রুমে। 

‘ওই কুত্তারবাচ্চি বুড়ি, আমার বাচ্চা নিয়ে কোনো কথা বলবি না। আমার বাচ্চার বাপের সাথে আমার কী, তাতে তোর কী মাগি? তোর জোয়ান বয়সে তুই যে বগুড়ার রিকশাওয়ালাদেরও লাগাইতে বাকি রাখিস নাই, সেইটা?’ ধুম করে দেয়ালের গায়ে রিসিভার বাড়ি মেরে রেখে দিল লুনা। 

আমি ছুটে ফিরে গেলাম ড্রয়িংরুমে। কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে থাকলাম জানালার পাশে, বাইরে শূন্য দৃষ্টি মেলে। লুনার ভাষা, গালি, তার এই অনেক ডেসিবলের চাপা চিৎকার আমার শুনে ফেলার ভয়, ওটাকে গলার ভেতরেই হাজার কম্বল দিয়ে চাপা দেওয়ার প্রয়াস—সব মিলে আমি নির্বের্গ হয়ে গেছি। একটু আগের ওকে কথা শোনাতে থাকা আমার নিজেকে মনে হচ্ছে হঠাৎ থেমে যাওয়া কোনো পেন্ডুলাম, যা এখন দুলতে ভুলে গেছে। 

লুনা ফিরে এসে বসেছে তার আগের আসনেই। তার দাদিকে বলা শেষ কথাটা আমার কানের মধ্যে ঘুরছে ঝুনঝুনির ভেতরের টিনের জিনিসটার মতো—”রাখ তুই বেশ্যা বেটি।’ তার দিকে ঘুরে তাকালাম। কান্নার শব্দ বেড়ে গেছে হঠাৎ। প্রায় অঝোরে কাঁদছে সে। 

ওকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমার স্পষ্ট মনে পড়ে গেল আজ থেকে নয়-দশ বছর আগে, লুনা ও নূরের বিয়ের পরপর, আমাদের বন্ধুদের চার কাপল ও ব্যাচেলর আমি, মোট এই নয়জনের বাই-রোডে বাংলাবান্ধা বর্ডার হয়ে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়ার কথা। 

সকাল নয়টার দিকে টয় ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে। বাংলাবান্ধা বর্ডারে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল, আমাদের বড় মাইক্রোবাসের ইন্ডিয়ান ড্রাইভার বারবার বলছিল যে আমরা বোধ হয় এই ট্রেন মিস করব আর তা করলে আজকের রাত শিলিগুড়িতেই কাটাতে হবে। লুনা দাঁত কামড়ে পড়ে থেকে গাড়ির সিটে আঁচড় কেটে যাচ্ছিল অনবরত, পাগলের প্রলাপের মতো বলছিল, ‘দার্জিলিং আজকের মধ্যে যেতেই হবে, আজকের মধ্যেই যেতে হবে, এই ট্রেন মিস করা চলবে না, এই ট্রেন মিস করা চলবে না।’ তার নতুন স্বামী, আমাদের বহুদিনের বন্ধু নূর, তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিল বারবার, বলছিল, “উফ্, এমন বাচ্চাদের মতো করছ কেন? নয়টা সস্তা ট্রেন টিকিট নষ্ট হবে তো হবে। যদি মিস করি তো আজ শিলিগুড়িতে রাত থেকে কাল দার্জিলিং যাব।’ 

ড্রাইভার গাড়ি ছোটাচ্ছে বেপরোয়া গতিতে। লুনার অস্থিরতা ড্রাইভার বেচারাকে অস্থিরমতি করে তুলেছে নিশ্চয়। আমরা সবাই চুপ। আমার মনে আছে, গাড়িতে তখন হিন্দি গান বাজছিল একটা, কিশোরকুমারের ‘মেরে মেহবুব কেয়ামত হোগি’। লুনা হঠাৎ সিট থেকে উঠে রীতিমতো দাঁড়িয়ে পড়ল, ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে জানতে চাইল, ‘ড্রাইভার সাব, অওর কিতনা টাইম লাগে গা?’ আমরা সবাই শুনলাম এবং দেখলাম যে লুনা প্রশ্নটা করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, যেমন কাঁদছে সে এখন। নূর আবার তাকে বলতে গেল ধৈর্য ধরার যুক্তির কথা। লুনা দড়াম করে নূরকে বলে বসল, একরকম কাঁদতে কাঁদতে, ‘আর একবার যদি আমাকে বোঝাতে আসো তো আমি থাপ্পড় মেরে তোমার দাঁত ফেলে দেব।’

আমরা সেদিন দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের টয় ট্রেন মিস করিনি, উল্টো স্টেশনে পৌঁছে দেখি নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেন শিলিগুড়ি পৌঁছাতে আধা ঘণ্টা বা বেশি লেট আছে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে লুনা বিজয়ীর আনন্দে হাসছে, তার হাসি থেকে মুক্তা ঝরছে চারপাশে। রেলস্টেশন ঘিরে অসংখ্য চায়নিজ চেরিগাছ, মাটি ভরে আছে তাদের মরা পাপড়ি ও মসৃণ বেরির মতো অসংখ্য লাল ফলে। আমাদের বন্ধু ইকবাল—এখন সে থাকে ফ্রান্সের প্যারিসে, জীবিকার প্রয়োজনে নাম ও ধর্ম বদল করেছে, তার বর্তমান নাম রুডলফ আলেকজান্ডার—তার শ্যামলা বরণ, গালে টোল পড়া চটুল চেহারার স্ত্রী শ্যামলী, তারাও তখন প্রায় নববিবাহিত, দেখলাম বউকে শোনাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা : 

হানিয়া মধুর হাস্য, শাখায় শাখায় উচ্ছ্বসিত 
ক্লান্তিহীন সৌন্দর্যের আত্মহারা অজস্র অমৃত
করেছে নিঃশব্দ নিবেদন। 

কিন্তু আমি স্পষ্ট খেয়াল করলাম, ইকবাল আসলে চোরাচোখে বারবার তাকাচ্ছে লুনার দিকে। আমার মনে হলো, পুরো স্টেশনই দেখছে লুনাকে—তার চলার ভঙ্গি, তার রাজসিক হাসি, পাহাড় ঘিরে ছড়িয়ে পড়া রোদের আলোয় তার চিকচিক করে ওঠা তন্বী শরীর, ওড়না গলায় পেঁচিয়ে রাখার ফলে স্পষ্ট, উদ্ধত তার বুক। 

মাসুম হায়াতের স্ত্রী ফারজানা, তখন সে আজকের হিজাব মেনে চলার ধারেকাছে নেই, তার পরনে তখন জিনসের প্যান্ট, সেটার রং অ্যাশ না ডেনিম তা এখন আর মনে নেই আমার, বন্ধুদের বউদের মধ্যে তখন একমাত্র ফারজানাই আমাকে তুমি করে বলে। সে আমাকে বলল, ‘লুনার ওভাবে সবার সামনে হাজবেন্ডকে বলা এক্কেবারে ঠিক হয়নি। নূর ভাইয়ের চেহারা দেখেছ?’ 

আমি নূরকে দেখার বদলে তাকিয়ে দেখছি সামনে দূরে দুই পাহাড়ের মাঝখানে এক ছোট উপত্যকা মতো, যার দুই পাশকে জুড়ে দিয়েছে একটা রেলসেতু-মাটিতে দাঁড়ানো আট-দশটা স্প্যানের ব্রিজ, কমপক্ষে ত্রিশ ফুট উচ্চতা হবে স্প্যানগুলোর, দেখতে খিলান বা গম্বুজ আকারের অর্ধচন্দ্রাকার আর সবটাই কেমন খয়েরি লাল ইটে বানানো, ওদের দূর থেকে দেখাচ্ছে স্কটল্যান্ডের জমিনে, পানিতে নয়, দাঁড়ানো প্রাচীন রেলসেতুগুলোর প্রতিরূপ যেন। আমার মনে আছে আমি মাটির কাপ হাতে নিয়ে গরম দুধ মেশানো চা খেতে খেতে রেলসেতুটার দিকে তাকিয়ে গুনছি চক্রাকারে যে পাখিগুলো ওটার ওপরে কারণে-অকারণে ওড়াউড়ি করছে, তাদের মোট সংখ্যা। 

আমাদের একমনে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার বন্ধুরা সবাই জড়ো হলো কৌতূহলবশত, লুনাও। কমবেশি সবাই জানতে চাইল, কী দেখছি আমি? বললাম, ‘রেলসেতু। সুন্দর, নিশ্চয়ই বহু আগে ব্রিটিশদের বানানো।’ সবার মধ্যে একমাত্র কথা বলে উঠল লুনাই : ‘রেলসেতু অন্য জিনিস। যদিও রেলসেতু বললে ক্ষতি নেই, কিন্তু এগুলোর আসল নাম ভায়াডাক্ট।’ 

মনে আছে, জীবনের সে সময়টায় আমি প্রথমবারের মতো মার্সেল প্রুস্তে চন্দ্রগ্রস্ত, প্রুস্তের সঙ্গে আমার প্রথম প্রেম চলছে তখন, সারা দিন সারা রাতই কাটছে প্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম নিয়ে। বন্ধুরাও তা জানত। ‘ভায়াডাক্ট’ শব্দটা আমাকে এক মুহূর্তের জন্য স্তে নিয়ে গেল। আমি বললাম কীভাবে প্রুস্ত-পাঠকদের ওই উপন্যাসের প্রিয়তম প্যারাগ্রাফ বা ঘটনা একেকজনের জন্য একেকটা। কারও জন্য সেটা মার্সেলের মায়ের গুডনাইট কিস-এর দৃশ্য, কারও জন্য লেবু-চায়ে মদলেইন কেক ভিজিয়ে খাওয়ার অংশটা, কিংবা সেই দৃশ্য, যেখানে তিনটে চার্চের চূড়া মার্সেলকে যেন ডাকছিল, তাকে বলছিল ওদের কথা কাগজে লিখে ফেলতে। কারণ, ওদের সৌন্দর্য যে শুধু মার্সেলের চোখেই ধরা পড়েছে। কিন্তু আমার কাছে ওই উপন্যাসের-তখনকার হিসেবে, এমনকি দশ বছর পর আজও—সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সম্ভবত সেটা, যেখানে এক শনিবারের সন্ধ্যায়, চাঁদের আলোর নিচে, কুমরে নামের ওই ছোট মফস্বল শহরে হাঁটতে বেরোয় মার্সেলদের পরিবার। 

পরের দিনটা রোববার বলে চার্চে প্রার্থনা শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত অন্তত ঘুম থেকে ওঠার কোনো বালাই থাকত না। আর যদি সময়টা হতো চাঁদনি রাত, উষ্ণ হাওয়ায় ভরা, তাহলে আমাদের তক্ষুনি বাড়িতে ফিরিয়ে না এনে বাবা, তার ব্যক্তিগত মহিমা অর্জনের তৃষ্ণা থেকে, লম্বা হাঁটা পথে নিয়ে যেতেন অশ্বারোহী সেনাদলের জায়গা বেড় দিয়ে হেঁটে আসার জন্য। কখনো কখনো আমরা চলে যেতাম একদম ভায়াডাক্ট পর্যন্ত, যার দৈত্যাকার পাথরের খিলানগুলোর শুরু একদম রেলস্টেশন থেকেই। ভায়াডাক্টটা আমার কাছে ছিল মানবসভ্যতার সীমানারেখার বাইরে নির্বাসিত হওয়ার দুর্দশার প্রতীক, কারণ প্রতিবছর আমরা যখন প্যারিস থেকে কুমব্রে আসতাম আমাদের সাবধান করে দেওয়া হতো যে কুমৱে পৌঁছে আমরা যেন স্টেশন ফেলে সামনে চলে না যাই, যেন ট্রেন থামবার আগেই পুরো তৈরি হয়ে বসে থাকি নামার জন্য, যেহেতু ট্রেন ওখানে মাত্র দুই মিনিট থামবে এবং তারপর চলে যাবে ভায়াডাক্ট পার হয়ে খ্রিষ্টান দেশগুলোর বাইরে কোথায়ও, যে দেশগুলোর আমার কাছে কুমব্রেই ছিল শেষ সীমানাবিন্দু। 

জ্যোৎস্নায় ভেসে যেত দেখতাম টেলিগ্রাফ অফিসটা। সে অফিসের স্রেফ একটা স্তম্ভই টিকে ছিল তখন পর্যন্ত, তা-ও আবার অর্ধেক গুঁড়িয়ে যাওয়া, কিন্তু সেটুকুর ভেতরেই দেখতাম ধরা আছে ধ্বংসস্তূপের শাশ্বত, অবিনাশী সৌন্দর্য। … অনেক দূরে বাড়ির গেটে দাঁড়ানো পাহারা-কুকুরগুলো নীরবতার মধ্যে আমাদের পায়ের শব্দে জেগে প্রার্থনাসংগীতের মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠত একটার পর একটা। সেই ডাক আমি আজও মাঝেমধ্যে শুনি সন্ধ্যার দিকে, সেই ডাকগুলোর ভেতরে নিশ্চয়ই আজ শেষ আশ্রয় নিয়েছে স্টেশন বুলেভার্ড (মানে যখন কিনা বুলেভার্ড হটিয়ে ওখানে বানানো হয়েছে আজকের কুমব্রের পাবলিক গার্ডেন)। আজ আমি যেখানেই থাকি না কেন, সন্ধ্যায় সেই ডাকগুলো কানে আসে আমার, এই যে ওদের কেউ শুরু করে ঘেউ বলে চ্যালেঞ্জ জানানো, তারপর প্রত্যুত্তরে আরেকটা ঘেউ—তখন আমি আবার দেখতে পাই লাইমগাছে ভরা কুমব্রেকে, যার পেভমেন্টগুলো চিকচিক করছে জ্যোৎস্নায়। 

মনে আছে আমাদের টয় ট্রেন পার হচ্ছে শিলিগুড়ি স্টেশনের অনতিদূরের ভায়াডাক্ট, আমরা নয়জন কামরায় বসেছি একসঙ্গে, আমার সিট জানালার পাশে, আমি মাত্ৰ শেষ করেছি সুয়ানস ওয়ের এক অধ্যায় ‘কুমব্রে’ থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশটা পড়ে শোনানো, এবার বাইরে এক ঠায় তাকিয়ে আছি রডোডেনড্রন গাছগুলোর দিকে, ওদের ফুল নানা রঙের—স্কারলেট, মভ, সাদা, কিন্তু সবটাতেই গোলাপির আভা মেশানো; মনে আছে বাড়িগুলোর সামনে অর্কিডের ঝাড়–সোনালি, রুপালি, গোলাপি, সাদা ও পারপল; সেই সঙ্গে সাদা ফুল ধরা দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত পিচ ফলের বাগান এবং ট্রেনের জানালা ধরে দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকা কমলা রং, মেরুন ও সোনালি হলুদ মেরিগোল্ড, আর কখনো কাছে, কখনো দূরে পাহাড়জুড়ে চিরসবুজ পাইন, লার্চ, ওক, মেপল ও চেস্টনাট এবং মাঝেমধ্যে, মানে কার্সিয়াং যত কাছে আসছে, তত বেশি মালিং বাঁশের ঝাড়। 

কামরার মধ্যে আমি খেয়াল করলাম সবকিছু চলছিল লুনাকে কেন্দ্র করে—লুনা হেসে উঠলে বাকি সবাই হাসে, লুনা চুপ করলে সব চুপ হয়ে যায়, যেন ইকবালের স্ত্রী শ্যামলী, মাসুমের স্ত্রী ফারজানা, আরেক বন্ধু আলমগীরের স্ত্রী রুবি (আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই আলমগীর বছর পাঁচেক আগে উত্তরবঙ্গের কোনো একটা বড় সেতু থেকে দিকচিহ্নহীন কোনো বিশাল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে; তার স্ত্রী রুবি কোথায় আছে, কী করে, তা আমাদের কারোরই জানা নেই), মনে হচ্ছে যে এরা কোনো ব্যাপারই না, এরা কোনো মেয়েই না—পুরুষগুলো তেমনভাবে হইচই করছিল লুনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, তাকে খুশি করার জন্য, তার মনোযোগ পেতে। নূর বসে ছিল আমার পাশেই, আমার হাঁটুতে এক হাত রেখে সে অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছিল আড্ডা জমিয়ে তুলতে, যাতে করে সবাই দ্রুত ভুলে যায় ওর অপমানের কথা। আর আমি মাঝেমধ্যে জানালা থেকে চোখ ভেতরে ফিরিয়ে দেখছিলাম কীভাবে দৃষ্টি বিনিময় চলছে ইকবাল ও লুনার মধ্যে। মনে আছে দীর্ঘ যাত্রার শেষে ট্রেন তখন দার্জিলিং পৌঁছাবে পৌঁছাবে করছে, সবাই অনেক হাসাহাসি-আড্ডার পর ঝিমোচ্ছে অপরাহ্ণকালীন তন্দ্রার ভেতরে, মাসুম হায়াত মাত্র জিজ্ঞেস করেছে আমাকে ‘একই দৃশ্য কতক্ষণ আর দেখতে ভালো লাগে তোমার?’ আর মাসুমও তন্দ্রার ভেতরে চলে যাওয়ার পর আমি তেরচা চোখে দেখছি প্রতিটা শ্বাসের সঙ্গে ঘুমন্ত মুখ সামান্য হাঁ করা দেবীর মতো চেহারার লুনার সুদৃঢ় বুকের বিরাট ওঠানামা – মনে আছে এ রকম এক সময়ে একটু সামনে বাঁয়ের দিকে আরেকটা ভায়াডাক্ট চোখে পড়ার কথা, যেদিকে তাকিয়ে আমার সম্ভবত জীবনে প্রথমবার মনে হয়েছিল ‘অনন্ত’ বলে তাহলে কিছু আছে। 

একটু পর দার্জিলিং পৌঁছে যাচ্ছি বলে তখন হইহল্লা শুরু করেছে ট্রেনের বয়-বেয়ারা ও যাত্রীরা, তন্দ্রা থেকে উঠে গেছে আমাদের দল, আড়মোড়া ভাঙছে সবাই কোনো সার্কাসের নাচিয়ে বাহিনীর মতো একের সঙ্গে অন্যে নিজেকে সিংক্রোনাইজ করে নিয়ে, ওরকমভাবে নামার জন্য তৈরি হয়ে নিতে নিতেই একদম অশ্লীল একটা জোক বলল লুনা, ওর জোকের প্রথম লাইনটা ছিল ‘এক লোক গেছে বোদায়…’। সবাই তখন হাসছে জোকটা শুনে নয়, বরং হতভম্ব হয়ে গিয়ে যেকোনো মেয়ে এ ধরনের জোক বলতে পারে পুরুষদের সামনে, আর আমি—আজও স্পষ্ট মনে পড়ে—জানালা থেকে হাত কিছুটা বাইরে দিয়ে হাওয়ার আর্দ্রতা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হাসছি জোক শুনে, বিস্ময়ের সে হাসি, আর আরেক হাতে নূরের হাঁটুতে সামান্য বাড়ি মেরে ওকে আশ্বস্ত করে যাচ্ছি যে লুনাকে নিয়ে ওর অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে এবং এক সারি পাইনগাছের জঙ্গল দেখতে দেখতে ভাবছি ওই যে প্রলোভন-জাগানোমতো হালকা খুলে রাখা কুমব্রের সুন্দর ভিলাগুলোর লোহার গেট, ওগুলো পার হয়ে নিশ্চয়ই প্রতিবার ভেতরে উঁকি দিতে চাইত মার্সেলের মন, দেখতে চাইত যে কী পৃথিবী, কী ধরনের মানুষজন, কী ধরনের ভালোবাসা-মায়া-ঘৃণা আর কী সব অচেনা-অজানা পথ থাকে এই সব দামি দামি ভিলার ভেতর অলিন্দে, আরও ভেতরের দিকে 

ট্রেনের গতি তখন অনেক ধীর হয়ে আসছে, আরেকটা বাঁক নিলেই যে আমরা স্টেশনে পৌছে যাব, তা আমার মনের হিসাবে পরিষ্কার, ওদিকে লুনা সবাইকে শাসাচ্ছে যে হোটেলে পৌঁছে বাইরে নামার জন্য কারও এক মিনিটও দেরি করা চলবে না; ফারজানা বলছে, ‘যতই বলো, দেখবা রুম থেকে বেরোতে বেরোতে আধা ঘণ্টা লাগবেই’, আর লুনা বলছে, ‘মাত্র পাঁচ মিনিট দেওয়া যাবে, না মাত্র তিন মিনিট—কিসের আবার গোছানো? রাতে খেয়েদেয়ে রুমে ফিরে গোছানো যাবে,’ আর তখন আশপাশের অর্কিডে ঘিরে থাকা বাড়িগুলো থেকে ট্রেনটা দেখে ডাকতে শুরু করেছে দার্জিলিং শহরের লোমে ভরা নোংরা কুকুরগুলো। ছোটবেলার কুমব্রেতে কুকুরদের ঘেউ ঘেউ শোনার কথা কোনো দিন ভোলেনি মার্সেল। যতবার অন্য জায়গায় ওরকম সন্ধ্যাবেলায় কুকুরেরা ডেকেছে, তার মনে পড়ে গেছে বাবা-মায়ের হাত ধরে জ্যোৎস্নারাতে কুমরের স্টেশন বুলেভার্ড ধরে ওই হেঁটে বেড়ানোর কথা। মার্সেল পরে বলছে, কুকুরেরা যে বুলেভার্ডটাতে দাঁড়িয়ে ডাকত, সেটাই এখন আর নেই, অনেক প্রাচীন কোনো ধ্বংসাবশেষের মতো সময়ের হাওয়া তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বুলেভার্ডটাকে এবং তার জায়গায় এখন জায়গা করে নিয়েছে নতুন বানানো মিউনিসিপ্যালিটির পাবলিক গার্ডেন। 

ট্রেন যখন থামছে, তখন আমি আর এ পৃথিবীতে যেন নেই, যদিও আমার মাথার চুলে জোরে হাত ঢুকিয়ে লুনা বলে বসল : ‘ওয়েক আপ, মার্সেল প্রস্ত।’ আমার মনে হলো, কোথায় এখন সেই উপন্যাসের মার্সেল, কোথায় ওই কুকুরগুলো, কোথায় মার্সেলের সেই বাবা-মা, আর কোথায় সেই টেলিগ্রাফ অফিসের দাঁড়িয়ে থাকা একটা মাত্র স্তম্ভ? 

পুরো দার্জিলিং ট্রিপে সে বিষণ্ণতা আর কাটল না আমার। আমি শুধু চেষ্টা করে গেলাম সবার সঙ্গে কোনোভাবে তাল মিলিয়ে চলতে, যন্ত্রের মতো, কারণ পাহাড়, কাঞ্চনজঙ্ঘার রোদে জ্বলা সোনালি চূড়া, রডোডেনড্রন গাছ ও তাতে হইচই করতে থাকা কাকের দল বারবারই আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, অনবরত, যে সময় জোর এক হাওয়ার মতো, এই এখন ধরা গেল, আর এই এখন সে বিগত, পার হয়ে যাওয়া, অতএব আমাদের সবারই দুশ্চিন্তার বিশেষ কারণ আছে এই পৃথিবীর বিস্ময়গুলো দেখে আমাদের রাতজাগা জীবনটাকে নিয়ে। 

পুরো ট্রিপের বাকি তেমন আর কিছু আমার মনে পড়ে না এখন, এমনকি সুন্দর সেই ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের হোটেলের নামটাও, এমনকি স্টেশনের নামগুলোও গুলিয়ে গেছে মাথার মধ্যে, একটু আগে যে যে নাম ভেবেছি, তার সবই একরকম আন্দাজের ভাবা। শুধু মনে আছে একদিন ব্রেকফাস্ট বুফেতে দেরি করে যাওয়ার পথে আমি হোটেলের কোনো এক সিঁড়িঘরের একাকীতে, কোনো একটা কোনায়-কিনারে, কিংবা হতে পারে কোনো এক করিডরের বাঁকানো গলিপথের কোথায়ও লুনা ও ইকবালকে দেখেছিলাম ট্র্যাপিজ আর্টিস্টদের মতো দ্রুতগতির ভঙ্গিমায় বাহুতে বাহু জড়িয়ে তীব্র চুমু খেতে—গুস্তাভ ক্লিমটের কিস ছবির মতো করে। আমি আজও জানি না ওরা আমাকে দেখেছিল কি না, আর দেখলেও ক্ষতি ছিল না কোনো। কারণ, ওরা দুজনেই জানত যে এত ভয়ংকর কথাটা আমার মতো সমাজ মেনে চলা বিবেকবান কোনো মানুষ বন্ধুত্বের স্বার্থেই কোনো দিন বলব না, কাউকে। 

আমি লুনাকে বললাম, ‘যাই।’ লুনা কান্না থামিয়ে উত্তর দিল, ‘না, আরেকটু থাকেন।’ আমি বসলাম আমার সোফায়। লুনা উঠে দাঁড়াল, অবলীলায় এসে বসল আমার সোফার হাতলের ওপরে, তার শরীরের পেছন দিকের এক বড় অংশ আমার গায়ের সঙ্গে ঠেস লাগিয়ে। অনেক আড়ষ্ট হয়ে আমি তখন পাথরের মতো চুপচাপ বসে আছি, বুঝতে পারছি না কী করা উচিত আমার—ওকে ধাক্কা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াব, নাকি আমার হাত সামান্য ডানে বেড় দিয়ে ঘুরিয়ে ওর কোমরের কাছটায় জড়িয়ে ধরব? লুনা ভরাট গলায় বলল, ‘আমি আপনাকে যা চান, যা চান, যা চান, তা-ই দেব বলেছি, তাতে আপনার এত আপত্তি? সবাই তো আমাকেই চায়। নূর বলে, ঢাকা শহরে আমার আট-দশজন লাভার আছে। হুহ্।’ 

কোনো কথা নেই দুজনের মধ্যে। কী উত্তর দেব আমি এ কথার জানি না, তাই চুপ করে থাকলাম। লুনাই আবার বলল, ‘যে যা চায়, সবই দেব আমি, স্রেফ নূরকে আমার বাচ্চা দেব না আর মগবাজারের ওই ফ্ল্যাট ওকে দেব না, দেব না, দেব না।’ আবার চাপা কান্নার শব্দ। 

আমি জানতে চাইলাম ওদের ডিভোর্স প্রসিডিংসের কী অবস্থা? উত্তর পেলাম না কোনো। লুনা তার বাঁ হাত সোফার পেছন দিকে নিয়ে এবার আমার ঘাড় বেড় দিয়ে ধরল, এমনকি হাতের আঙুলগুলো আমার ঘাড়ের পেছনের চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে নাড়াতে লাগল এমনভাবে যেন সে সুর তুলছে কোনো বাদ্যযন্ত্রে। অস্বস্তিকর অবস্থা। 

লুনা বলল, ‘আমি জানি, আপনার ভেতরে এখন কী হচ্ছে, আপনার শরীরের কোন জায়গায় এখন কী হচ্ছে। নূরের সেটুকুও হয় না, আর হলেও আপনি কি জানেন যে আপনার বন্ধু নূর সবচেয়ে ইন্টিমেট সময়েও হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে? আমি সেক্স করতে করতে ওকে নাক ডাকতেও শুনেছি। ক্যান ইউ বিলিভ দ্যাট?’ 

আমি বললাম, ‘ওটাই কি বিয়ের সবকিছু?’ 

লুনা বলল, ‘ধরলাম কিছুই না, গুরুত্বপূর্ণ কিছুই না, কিন্তু ওর ওই আচরণটা অনেক কিছু। হি ইজ আ লেম ডাক, অ্যান্ড আই ক্যান নট লিভ উইথ আ লেম ডাক। আমার বাবা শয়তানের সঙ্গে ঘর করেছে, আমার দাদা আরেক শয়তানের সঙ্গে ঘর করেছে, আমিও শয়তানের সঙ্গে ঘর করতে রাজি আছি, কিন্তু কোনো ভেজিটেবল, কিক-অ্যারাউন্ডের সঙ্গে না। অসম্ভব।’ 

‘অসম্ভব’ শব্দটা লুনা এত জোরে বলল যে আমার মনে হলো সে প্রায় চিৎকার করল যেন। আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি না, বরং ওর চুল আমার মুখে এসে পড়ছে আর ওর হাতের আঙুলগুলো থামছেই না, তারা অনবরত ঘষছে আমার ঘাড়ের চামড়া, চুলের গোড়া। ‘ইউ আর নট আ লেম ডাক। ইউ আর ডেঞ্জারাস, ইউ আর অ্যাজ ম্যাড অ্যান্ড ডেঞ্জারাস অ্যাজ মাই ফাদার ওয়াজ, অ্যান্ড আই লাভ ইউ ফর দ্যাট’ আমাকে বলল লুনা।

আমি সামনের দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকা বড় এক টিকটিকির শরীরের মসৃণতা দেখতে দেখতে বললাম, ‘আমি তোমার বাবার কথা কিছুই জানি না। কোনো দিন বলোনি।’ 

লুনা চুপ করে থাকল, তারপর অনেকটা সময় পার হতে এই প্রথম মাথা ঘুরিয়ে তার থেকে নিচে বসা আমার মুখের দিকে তাকাল, উল্টো জিজ্ঞেস করল, “মানে? নূরও বলেনি কোনো দিন? ইউ ডোন্ট নো অ্যানিথিং?’ 

আমি মাথা নেড়ে ‘উহুঁ’ বলতে ধুম করে উঠে দাঁড়াল লুনা, তার সোফাতে গিয়ে সেটার হাতলের ওপরে বসে প্রায় আমার দুই হাঁটুর মধ্যে ওর পা দুটো ঢুকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বলে গেল কীভাবে তার জমিদার বাবাকে ওদের সিলেটের এক চা-বাগানে শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই ঈদে মিলাদুন্নবীর দাওয়াত দিয়ে বগুড়া থেকে নিয়ে গিয়ে মিলাদের মিষ্টি ও তবারক বিতরণের পরপর, মাগরেবের নামাজের শেষে, সন্ধ্যা নামার সামান্য খানিক পরে দিন ও রাতের মাঝখানের ঘোলাটে সময়টায়, হালকা বৃষ্টির মধ্যে জনা তিরিশেক লোক আরও প্রায় সত্তর-আশিজন লোকের সামনে কীভাবে রামদা-বঁটি ইত্যাদি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল আজ থেকে বিশ বছর আগে, ‘১৯৯৫ সালের কী জানি আমার মনে পড়ছে না, কী যেন মাসের কী যেন তারিখে। আমার তখন আর বয়স কত? 

‘মনে আছে, বাবা আমাকে আদর করত খুব, আমাকে ডাকত “লুনিস্ট” বলে, আদরের ডাক। লুনিস্ট, স্কুল কেমন চলছে? লুনিস্ট, রাতের বেলা কি জিনগুলো এসেছিল? আমি তো লুনিস্ট আজ একটা জিন দেখলাম বাথরুমের শাওয়ারের ফাঁকে বসে আছে, আর আমি শাওয়ার ছাড়তেই জিনটা ঢুকে গেল সাবানের মধ্যে। বাবা মানতেই চাইত না আমার বয়স তখন আর ছয়-সাত বছর নেই, আমি তখন বড় এক মেয়ে, আমি জানি যে বাবার ওই জিনগুলো সব গল্পের জিন। সকালে শ্রীমঙ্গল রওনা দেওয়ার আগে, সেদিন ছিল স্কুল ছুটির দিন, ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটি, বাবা আমাকে কাছে ডেকে আদর করল অনেক, চুলে হাত বোলাল, জিজ্ঞেস করল, লুনিস্ট বলো তো ঈদে মিলাদুন্নবীতে কী হয়, আর জিজ্ঞাসা করল যে শ্রীমঙ্গলের আমাদের চা-বাগান থেকে আমার জন্য কী আনবে বাবা, কালকেই, আমি জানতে চাইলাম, ও, তার মানে তুমি রাতে ফিরবা না, তুমি কি তাহলে ওই বড় বাংলোটায় একা একা থাকবা রাতে, বাবা বলল, না আজ রাতটা থাকব, বাংলোর জিনগুলো আমাকে খুব রিকোয়েস্ট করেছে, বলেছে জমিদার সাহেবের পুত, আমাদের সঙ্গে একটা রাত তো থাকো, আর বাবা চলে যাব যাব করছে, বাড়ির পোর্চে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, আমাকে বলল, লুনিস্ট, তোর মাকে ডাক, আমি চলে যাচ্ছি, কথাটা শুনে আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের মহিলা যাকে আমরা হীরা খালা বলে ডাকতাম, সে ঝটপট ভেতরে গেল আবার ঝটপট ফিরে এসে বলল, ভাইজান, আপা শুয়ে আছে, আপা বলেছে মাথা ধরেছে, আপনাকে বলতে বলেছে যে, খোদা হাফেজ, দেখলাম বাবা দুঃখ পেল একটু, শুধু বলল, লুনিস্ট, তোর মাকে বলিস আমি গেলাম। সেই আমার বাবাকে শেষ দেখা। “আমি গেলাম লুনিস্ট”, সেই আমাকে বাবার আক্ষরিক অর্থেই বলে চলে যাওয়া, চিরদিনের জন্য। “আমি গেলাম”। হাহ্হ্। সব পত্রপত্রিকায় খবরটা এসেছিল ছোট করে। মোট কোপ ছিল দেড় শর মতো—শুনলে বিশ্বাস হবে না, কিন্তু সত্যি দেড় শ।’ 

দে-ড়-শ শব্দটা এভাবে বলল লুনা। 

আমি ভাবতে লাগলাম, একটা মানুষের ছোট শরীরে দেড় শ কোপ দেওয়ার জায়গা কোথায়? 

‘আপনি এখন ভাবছেন দেড় শ কোপ দেওয়ার জায়গাটা কোথায়, তাই তো?’ বলল লুনা। ‘আমি নিজেও জানি না, ডেডবডি আমরা দেখিনি কেউ, মা-ও দেখেনি, আর আমার ভাইবোনও কেউ নেই, শুধু মনে আছে বগুড়া ও ঢাকার হাই সোসাইটি কাঁপিয়ে বেড়ানো আমার মা এরপর আর সামলাতে পারল না কিছুই, তার বিরাট বিরাট পাওয়ারফুল সব লাভার ভয়ে তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল দল বেঁধে আর মা একের পর এক হারাতে লাগল আমাদের সব সম্পত্তি, দালানকোঠা, জমি, চা-বাগান, রাবারবাগান— সব। তারপর একদিন বগুড়ার আমাদের পুরোনো জমিদারবাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেল হেড ইনজুরিতে।’ 

লুনা আরও বলল, ভালোই হয়েছে তার মা মারা গিয়ে, কারণ, এসটিডিতে ভরে গিয়েছিল ওই মহিলার শরীরের নিচের ‘প্রাইভেট পার্টস’, সম্ভবত শ খানেক কুৎসিত জেনিটাল ওয়ার্টস হয়েছিল তার ওখানে, সামনে-পেছনে সব দিকে আর মা লজ্জায় কোনো ডাক্তার দেখাতেও যেতে পারেনি কোনো দিন, কিন্তু সেই কথা বলার এখন কোনো মানে নেই, তবে ভাগ্য ভালো, ঢাকার এই বাড়িটা টিকে গিয়েছিল, এটাই এখন একমাত্র বড় সম্পত্তি লুনাদের, অতএব সবাই যে ভাবে লুনারা অনেক ধনী, অনেক সম্পত্তি ওদের, হ্যাঁ কিছু হয়তো এখনো আছে, তবে সবকিছু বারো ভূতে খাচ্ছে, আর ক্যাশ বলতে প্রায় কিছু নেই, তো এই অবস্থায় তার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার ও নূরের করা মগবাজারের ফ্ল্যাট নিয়ে সে লড়াই করবে না তো ‘সেটা আপনি করবেন’? 

আমি চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি। লুনা নিঃসংকোচে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি বুঝতে পারছি তার এই জড়িয়ে ধরার মধ্যে অসহায়ত্বের প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নেই, কিংবা সেটা আমার সাময়িক ধারণা ছিল মাত্র, পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খায়, এমন এক ধারণা, যেমন সব ধারণা আমরা মানুষেরা গল্প বা আলোচনার চিরচেনা প্যাটার্ন মেনে প্রায়শ করে থাকি। বাসার মূল দরজা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল লুনা, দরজার ওপরেই, তার মানে আমার যাওয়ার পথ বন্ধ। 

‘আসল কথাটা জানেন? সেদিন বাবাকে শ্রীমঙ্গলের পথে বিদায় দিতে মা কেন নিচে নামেননি, এমনকি হীরা খালা গিয়ে মাকে বাবার অনুরোধে ডাকবার পরেও? আমি সব জানি এখন। আল্লাহ আমাকে সব জানতে শিখিয়েছেন। নেপোলিয়ান সেন্ট হেলেনা দ্বীপে কেন মারা গেলেন তা, আবার আমার মা বাবাকে বিদায় না দেওয়ার ছুতোয় কেন হীরা খালাকে বলে পাঠাল যে তার মাথা ধরেছে, তা-ও। মা-ই বাবাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে শ্রীমঙ্গলে পাঠিয়েছিল মৃত্যুর মুখে। তখন আমার মায়ের বিশাল প্রেম চলছে শ্রীমঙ্গলে ঠিক আমাদের পাশের চা-বাগানের মালিক ইয়াজদানি চাচার সঙ্গে। অবাঙালি-পাকিস্তানি ইয়াজদানি চাচা, দেখতে ছিলেন সেই আগের নায়ক নাদিমের মতো, ছিপছিপে, পার্শিয়ান চেহারা। ইয়াজদানি চাচা ও মা মিলে ঠিক করেছিল আমার বাবাকে মরতেই হবে তাদের প্রেমের স্বার্থে। তাই কীভাবে কীভাবে আমাদের চা-বাগানে শ্রমিক-কর্মচারী বিদ্রোহ ঘটিয়ে দিল চাচা, যেমন হলো পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহতে। কিন্তু মা বাবার দেড় শ কোপে অমন ক্রুয়েল মৃত্যুর কথা শুনে ইয়াজদানি চাচাকে আর মেনে নিতে পারল না, আবার চাচাও বাবা মারা যাওয়ার পরে তার বউয়ের কাছে বলতে পারল না যে বগুড়ার জমিদারের মেয়ে নারগিসকে-আমার মায়ের ডাক নাম নারগিস–সে বিয়ে করতে চায়। পরে তাদের প্রেমের শেষ হয় এভাবেই, আর এখন আমাদের চা-বাগানটারও কীভাবে কীভাবে পঁচাত্তর ভাগ মালিক ওই ইয়াজদানি আর বাকি পঁচিশ ভাগ আমাদের বাগানের জেনারেল ম্যানেজার, আমার বাবার আপন চাচাতো ভাই, আমার জুলফিকার চাচা।’ 

আমরা দাঁড়িয়ে আছি দরজার ওপরেই। লুনা চোখ মুছে ফেলেছে শক্ত করে। এখন আর সেখানে কোনো অশ্রুবিন্দুর চিহ্ন নেই। আমি পরিষ্কার দেখছি যে তার শোকোচ্ছ্বাস জাদুর মতো রূপ নিয়েছে নিজের প্রতি সমবেদনায়, যার মধ্যে আবার লুকিয়ে আছে নিরুত্তেজ এক নিয়তিনির্ভরতা, শুধু লুনার ছবির মতো আঁকা চোখের দুই কিনারে আমি একঝলকের মতো দেখলাম শঙ্কাশূন্য দুটো ছিনেজোঁক লেপটে আছে লোকঠকানো মানুষদের জন্য ত্রাস সঞ্চার করে। লুনাই আবার কথা বলল, একদম অন্য প্রসঙ্গ এবার, যেনবা তার বাবা-মা-ইয়াজদানি আঙ্কেল, জুলফিকার চাচা, হীরা খালা—এদের নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়নি কিছুই, সে আমাকে বলেনি কিছুই। লুনা বলল, পনেরোই আগস্ট সারা পৃথিবীতে কী কী হয়েছে, সব আমি ঠিকঠাক বললেও সে ভাবতে পারছে না যে আমি কী করে ভুলে গেছি পনেরোই আগস্ট নেপোলিয়নেরও জন্মদিন ছিল? লুনা বলল, ব্যাটল অব ওয়াটার লুর কথা সে প্রথম পড়ে ভিক্টর হুগোর লা মিজরেবল-এ, তারপর ওদের অনার্সের পাঠ্যসূচিতে আবার যখন জেন অস্টেনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস পড়ানো হচ্ছে, তখন নেপোলিয়নিক ওয়ারগুলোর কথা আবার পড়তে হয়েছিল। হায়, আমি কীভাবে জানি না যে জেন অস্টেনের আপন দুই ভাই সে সময় চাকরি করত ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে? ‘আর আলেকজান্ডার দুমার কাউন্ট অব মন্টে ক্রিস্টোতে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের কত কত কিছু আছে, ধুর, সব মনেও নেই এখন আমার, কিন্তু মনে আছে যে একটা কবিতা ছিল সম্ভবত দুমার বইতেই যে, “হে নেপোলিয়ন, রাজাধিরাজ, তোমার তেরো বছরের যুদ্ধ গুঁড়িয়ে দিল মোট বত্রিশ লাখ প্রাণ, বলো এর অর্থ হয় কোনো?”“ 

আমি লুনাকে ধন্যবাদ জানালাম এই তথ্যের জন্য — পনেরোই আগস্টের সঙ্গে মানুষের দুঃখ-যাতনা-প্রতারণা ও বিনাশের এই আরেক বড় সংযোগসূত্র আমাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। আমার ধন্যবাদ পেয়ে হালকা খুশি ফুটল তার চেহারায়। সে তার দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে নিজেকে সামান্য খাড়া করে আমার কপালে একটা চুমু দিল, বলল যে তার কোনো প্রয়োজনে তাকে আমার সাহায্য না করলেও চলবে, তবে আমার কোনো প্রয়োজনে তাকে যদি আমার কখনো লাগে তো আমি যেন তা তাকে জানাতে দ্বিধা না করি। স্কুলযাত্রী ছোট শিশু লুনিস্টের মতো করে এক বাবার কাছ থেকে কপালে চুমু নিয়ে আমি লুনাকে পাশ কাটিয়ে দরজাপথের দিকে যেতে উদ্যত হতে, এই দফা লুনা সরে গেল আমার পথ থেকে। 

আমি আর একবারও পেছনে না তাকিয়ে-যেহেতু আমি দেখেছি তার একটু আগের অশ্রু মুছে ফেলা অপরূপ সুন্দর দুই চোখ আবার কান্নায় ভরে আসি আসি করছে—জোর পদক্ষেপে, প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগলাম ওদের বাড়ির প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে, আর যখন নিচে বাড়ির মূল গেটের কাছে পৌঁছেছি, ওদের গার্ড লোকটা দৌড়ে এল আমাকে গেট খুলে দিতে। আমার মনে হলো সে নিশ্চিত ভাবছে যে এতক্ষণ ওপরের কোনো বেডরুমে কী ঝড়টাই না উঠেছে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তাদের লুনা ম্যাডামের, যেন সে আমাকে বলতে চাইল, ‘ফরজ গোসল-টোসল করে বের হয়েছেন তো, স্যার? নইলে কিন্তু বালা-মুসিবত হবে।’ 

হয়তো এসবের কিছু না, হয়তো বৃদ্ধ স্রেফ দু-এক শ টাকা বকশিশের আশা করেছে মাত্র, আর উল্টো হয়তো তার খারাপই লাগছে যে লুনা ম্যাডামের সংসার ভেঙে যাওয়ার পর এই জিন-ভূত ও বৃদ্ধা এক পাগলির বাড়িতে এখন আর কেউ আসে না, আর এভাবেই কীভাবে মুছে যাচ্ছে অনেক লোকের অনেক বন্ধুত্বের একটা পুরো এক দশকের ইতিহাস। গার্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হলো আমার, তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো সে লুনার বাবার ওই নৃশংস খুন হওয়ার গল্প জানে কি না, নাকি সে গল্প তার থেকে চেপে রাখা হয়েছে যেন সে আবার কোনো দিন গভীর রাতে পাড়ার অন্য গার্ডদের সঙ্গে মিলে এই বাড়ি লুটতরাজ ও লুনাকে ধর্ষণ করার লোভ থেকে লুনা ও লুনার দাদিকে মোট দেড় শ দেড় শ তিন শ কোপে হত্যা না করে বসে? 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *