আগস্ট আবছায়া – ১.৪

১.৪

বাসায় এসে অস্থির লাগা শুরু হলো। সব ছাপিয়ে মনে হলো এখন প্রেম-ভালোবাসাবাসির সময় নয় মোটেও। এই পৃথিবীতে সন্তান জন্মদান করা নিয়ে ফ্লবেয়ার তার বান্ধবীকে যা লিখেছেন (‘বেঁচে থাকার লজ্জা ও অবনমনের বোধ আমি কারও মধ্য দিয়ে যেতে চাই না’), তা মনে করে ভার্টিগোর বোধ হতে লাগল। তার ওপর ক্লাস শেষে আমার সোজা বাসায় চলে আসা হয়ে ওঠেনি, পথে আমাকে আটকেছিল ভারত থেকে র‍্যাগিংয়ের ভয়ে ফেরত আসা ওই দুই ছাত্র, একজন বড়মতো, আরেকজন ছোটখাটো। ওদের কাছ থেকে শুনলাম, ওরা মুসলমান বলে হিন্দু ছাত্ররা হোস্টেলে ওদের ওরিয়েন্টেশন নাইটে জাঙ্গিয়া পরে নাচতে বলেছিল, যখন কিনা ফার্স্ট ইয়ারের অন্য সবাইকে বেশি হলে কবিতা আবৃত্তি করতে বা গান গাইতে হয়েছে। পুরো প্যান্ট খুলে সারা দিনের ময়লা জাঙ্গিয়া পরে ওদের নাচতে হয়েছে অন্তত এক শ মানুষের সামনে, হোস্টেলের বারান্দায়, পেছনে ফুলের বাগান রেখে (সব পুরোনো হোস্টেলের দালানের মাঝখানে উঠোনমতো জায়গাটায় যে রকম এক নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ফুলের বাগান থেকে থাকে—পাতাবাহার, গোলাপ, ক্যামেলিয়া, রঙ্গন, জিনিয়া, কসমস ও তারাগেন্দার বাগান)। আমি ভাবলাম, ওরা যখন নাচছিল, তখন নিশ্চিত অনেকেই দেখছিল ওদের জাঙ্গিয়া কত ময়লা আর কেউ কেউ অবশ্যই তাকিয়েছিল জাঙ্গিয়ার ওপর থেকে কী রকম হালকা উঁচুমতো দেখা যাচ্ছে ওই জায়গাটা, সেদিকে। আমি লজ্জায় দুমড়ে-মুচড়ে গেলাম। ওদেরকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দর্শন’ বিষয় নিয়ে পড়ার ব্যাপারে সাধারণ প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিয়ে আমার পিয়ন মালেক থেকে শুনে ওই র‍্যাগিংয়ের কথা জিজ্ঞাসা করাটা ভুল হয়েছে, বুঝলাম। 

মেহেরনাজকে টেক্সট মেসেজ পাঠালাম আমার বাসায় এখন না আসবার জন্য, লিখলাম যে প্রেম-ভালোবাসার সময় নয় এটা। কিন্তু কেন আমাদের অন্তরঙ্গতার সময়টা এভাবে বদলে গেল আমার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে, তা নিয়ে তাকে বললাম না কিছু, রওনা হলাম বসুন্ধরা সোসাইটির চেয়ারম্যান সরফরাজ নওয়াজ সাহেবের ডেরার দিকে 

সরফরাজ সাহেব আমাকে সহ্য করতে পারেন না আমি জানি। তার সঙ্গে আমার কোনো আলোচনাই কোনো দিন সুখকর হয়নি। তবু আমি তাকে ‘জাজ’ করতে যাইনি কোনো দিন—তার বিশ্বাস তার, আমারটা আমার। আজ তার কাছে আমাকে যেতেই হচ্ছে, কারণ আমার কাজ আছে। তিনি এই বিশাল কমিউনিটির ভালো-মন্দ দেখভাল করার কমিটির চেয়ারম্যান। অন্য কোনো উপায় নেই আমার। সি-ব্লকের মসজিদে পাওয়া গেল তাকে, আমি ঠিক যেমন ভেবেছিলাম। তিনি এই মসজিদ কমিটিরও প্রধান, এর লাগোয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানারও। তার কপালে নামাজ পড়ার গভীর কালো দাগ, দাড়িতে মেহেদির রং। আমাকে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি, যদিও আমি চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছি আমার মুখটা দেখা তার একেবারে পছন্দ হয়নি। আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে এলাম, তাকে বললাম কাল রাতে দেখা গাছগুলোর হাল-অবস্থা, জিজ্ঞেস করলাম কিছু করা যায় কি না গাছের অসুখ নিয়ে, কমিটি কিছু করছে কি না বা আদৌ কমিটির চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়েছে কি না? 

তিনি বড় দল নিয়ে চলেন, তার দলের বাকিরা তাকে ঘিরেই বসা, তাদের অনেকেই আমাকে চেনেন, কিন্তু তাদের সবার কাছেই আমার কোনো নাম নেই ‘প্রফেসর’ উপাধিটা ছাড়া। জেনারেল সেক্রেটারি ভদ্রলোক, নাম আখলাকুর রহমান, পেশায় গাড়ি ব্যবসায়ী, আমার কথার উত্তর দিতে উদ্যত হলেন কিন্তু তাকে মুখ খুলবার আগেই থামিয়ে দিলেন সরফরাজ নওয়াজ এবং তার ভারী, কর্তৃত্বপরায়ণ গলায় আমাকে বলা শুরু করলেন এই কথা : 

‘প্রফেসর সাহেব, আপনি দর্শনের লোক, আমি ইকোনমিকসের। আপনার হায়ার স্টাডিজ ইংল্যান্ডে, আমার স্কটল্যান্ডে। আপনার চোখে বসুন্ধরার গাছগুলোর এই অবস্থা ধরা পড়েছে, তাতে আমি খুশি। আমি আগে থেকেই জানতাম গাছপালা-ফুল-পাখি-প্রাণী—এসব নিয়ে আপনার বিশেষ আগ্রহ আছে। জন রাসকিন নামে এক বিখ্যাত লোক ছিলেন প্রফেসর সাহেব, আমরা ইকোনমিকসে তার লেখা পড়তাম, আপনি নিশ্চয় জানেন তার নাম। তিনি বলেছিলেন, “কোনো মানুষ এই পৃথিবীতে যদি কোনো দিন সবচেয়ে বড় কোনো কাজ করে তো সেটার নাম কোনো কিছু দেখা, এবং কী দেখল তা পরিষ্কার করে বলা;” তিনি বলেছিলেন, “স্পষ্ট করে দেখার নামই কবিতা, ভবিষ্যৎবাণী, ধৰ্ম, সব একসাথে।” তো, আপনি যে গাছগুলোর এই অবস্থা দেখেছেন আর এখন যে তা আমাদের সুন্দর করে বললেন, তাতে খুশি হলাম আমি, রাসকিনের কথা মনে পড়ল। কিন্তু আপনি’–একটু থেমে, কথার মধ্যে জোর প্রয়োগ করে বললেন তিনি-’স্পষ্ট ও স্বচ্ছ করে দেখেননি প্রফেসর সাহেব। পৃথিবীর সবকিছু গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, চুরমার হয়ে যাচ্ছে—বিশ্বাস, সম্পর্ক, সহযোগিতা, কমিউনিটির ফিলিংস। আপনি আসবার আগে আমরা কোরআনের আয়াত ধরে ধরে সে কথাই আলোচনা করছিলাম। বলছিলাম যে আইয়ামে জাহেলিয়াত চলছে—গতকালই কাবুলের মসজিদে বোমা মারা হলো, মারা গেল ২৯ জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান আর গত সপ্তাহেই সিরিয়াতে কী হলো দেখেছেন নিশ্চয়ই, ওখানে আড়াই লাখ মুসলিম মারা গেছেন এ পর্যন্ত, সেটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু শার্লি হেবদোর অফিসে ১৭ জন মারা গেল তাই দেখলেন তো কীভাবে কেঁপে উঠল সব? ওদিকে কিউবার সঙ্গে আমেরিকা আবার বন্ধুরাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, যাক। আমাদের তাতে কোনো অসুবিধা নেই। গ্রিস ঋণের ভারে ভিক্ষুক রাষ্ট্র হয়ে গেলেও আমাদের কী? ইউরোপের বড় বড় দেশগুলো লোন দিয়ে পয়সা কামানোর জায়গা পেয়ে গেল, পাক। আমাদেরকে আমাদের মুসলিম বিশ্ব নিয়ে ভাবতে হবে। সৌদি আরব এই মার্চে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালাল, তার সঙ্গে আছে আরও সাত-আটটা আরব দেশ। এই যে মুসলমানরা মুসলমানকে মারছে, বড় শক্তিগুলোর চাপে পড়ে এই যে তারা বর্তমানকে সামলাতে গিয়ে ভবিষ্যৎ উম্মাহর বুকে ছুরি বসাচ্ছে, আমাদের তা নিয়ে ভাবতে হবে। গত মাসে আইএস, বলা হচ্ছে, ৩৩ জনকে মারল টার্কিতে, বলা হচ্ছে এই আমি, এই আপনি (তিনি উপস্থিত অন্যদের দেখালেন তার আঙুল শূন্যে ঘুরিয়ে) খুনি, আমরা আইএস, আমরা রিফিউজি হয়ে ভরে ফেলছি ইউরোপ, সামনেই আমরা বড় বড় আক্রমণ করতে যাচ্ছি ইউরোপের মাটিতে আর ওদিকে আমাদের বাচ্চাগুলো সারাক্ষণ আছে ইন্টারনেটে, পর্নোগ্রাফি দেখছে, সারা রাত ধরে অশ্লীল চ্যাট করে যাচ্ছে ছেলেমেয়ে মিলে, দল বেঁধে—তো এই যখন পৃথিবীর অবস্থা, এই যখন নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে ফেলা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে, সব ভরে যাচ্ছে মুসলমানের লাশ ও দুর্নীতিতে, তখন কিনা তখন কিনা এত কিছু থাকতে আপনার মনে হলো যে আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন বসুন্ধরার গাছের গায়ে পোকা ধরা নিয়ে?” 

আমি তার কথা শেষ হতে উঠে দাঁড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য। তিনি আমাকে স্নেহের সঙ্গে হাত ধরে ধর্মে যেভাবে বলা হয়েছে সে রকম শিষ্টাচার মেনে টেনে বসালেন। 

আমরা চুপ করে আছি। তিনি একটু আগে আমাকে বলেছেন যে তিনি কখনোই আমাকে ও আমার ইউনিভার্সিটির বেশ কিছু শিক্ষককে মসজিদে এমনকি জুমার নামাজের দিনেও আসতে দেখেন না, দেখলে তিনি খুশি হতেন। ‘আমাদের সব সমস্যার গোড়া হলো আমরা আমাদের ধর্মটাকে বুঝি না, বোঝার চেষ্টাও করি না’, বললেন তিনি। বাকিরা সবাই তার কথায় মাথা নাড়লেন। 

তিনি আবার আমাকে বললেন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার প্রিয় কবিদের একজন ছিলেন, ছাত্র বয়সে যখন তিনি স্কটল্যান্ডে পড়ছেন তখন। ‘সেই ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো করে প্রকৃতির জন্য মায়া ও দরদ পুষে রাখা ভালো, কিন্তু এখনকার কবি-লেখকদের সমস্যা হচ্ছে’–আমাকে তিনি লেখক হিসেবেও জানেন, আমার হোমার অনুবাদ নিয়ে এর আগে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল—’তারা প্যানথিয়িস্টিক, তারা মনে করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর মধ্যে খোদা আছেন, ব্ৰহ্মাণ্ড খোদারই প্রকাশিত রূপ। কুফরি ভাবনা এগুলো প্রফেসর সাহেব। প্রকৃতিকে ভালোবাসা ভালো কথা, কিন্তু বিশ্বাস রাখতে হবে খোদার ওপরে। বিশ্বব্যবস্থার, প্রকৃতিসহ, চাঁদ-তারা-গ্যালাক্সি-মিল্কিওয়ে সবসহ, বিশ্বব্যবস্থার পুরোটার নিয়ম চিরস্থায়ীভাবে আছে ওই খোদার হাতে আর আমরা মুসলমানরা সেই খোদাকে আল্লাহ বলে বিশ্বাস করি।’ অর্থাৎ তিনি আমাকে বলতে চাইলেন, প্রকৃতির প্রতি প্রেম যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধ না হয়, তো এর কোনো অর্থ নেই, কারণ এই প্রকৃতি, এই গাছ-সমুদ্র-পর্বত-বীজতলা-অরণ্য-নক্ষত্রপুঞ্জ-দিকচক্রবাল এবং এই মেঘ-তীরভূমি-পাখির ডাক-কালো জলের দিঘি—সবই আল্লাহর মহিমা, তারই গড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যবস্থার চিরস্থায়ী নিয়মের অংশ। 

আমি তার কথা ভাবছি, চুপ করে আছি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিনি এবার বললেন, ‘মানুষ এক আধ্যাত্মিক সত্তা, প্রফেসর সাহেব। মানুষ তার জন্য পূর্বনির্ধারিত জীবনী শক্তিটুকু ও আল্লাহর ঔদার্যটুকু পাচ্ছে তার ভেতরকার নৈতিক ডাককে মেনে। আর কোনটা নৈতিক ও কোনটা অনৈতিক, তার সবকিছু ঠিক করে দিয়েছে কোরআনের বিধান। আপনি বিবাহ ছাড়া কোনো মেয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক রাখতে পারেন কি না, এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কোরআন বলে দিয়েছে জিনা কী এবং জিনা করা কেন ও কীভাবে হারাম। নিজের মতো অন্য কোনো লিবারাল হিউম্যানিস্ট সংজ্ঞা দিয়ে এই অবৈধ সহবাসকে নৈতিক ও হালাল বলার কোনো অবকাশ আমাদের নেই, প্রফেসর সাহেব।’ 

আমি বুঝতে পারলাম তার কথায় কিসের ইঙ্গিত। তিনি মেহেরনাজের একা এক পুরুষ মানুষের বাসায় আসার দিকে আঙুল তুলছেন, সেটাকে বিরাট পারপল কালার গদ্যে, যেহেতু তিনি ইকোনমিকসের ভালো ছাত্র, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তুলছেন, তার বিশ্বাসকে শক্ত মেসেজে মোড়ার জন্য তিনি ধর্মকে ব্যবহার করছেন এবং আমাকে হেয় করছেন এতগুলো মানুষের সামনে, যদিও আমার ধারণা, এখানে এমন কিছু নির্বোধ লোকও আছে যারা তার এই গূঢ় ক্রিপ্টিক কথার তলটা ধরতে পারল না। 

আমাকে মুখ খুলতেই হলো। বিশেষ করে তিনি আমার প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষকে এভাবে রঙিন গদ্যে সাজালেন বলে, এবং সেই গদ্যের অন্তঃসার ও হিপোক্রেসি আমার চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ল বলে। আমি বিশ্বাস করি তিনি প্যানথিয়িজম অর্থে এটাও বুঝিয়েছেন যে, এখনকার এই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আমি বুঝি পুবের ধর্মগুলোর মতো, বৌদ্ধ ও হিন্দু তান্ত্রিকদের মতো বা পারসিয়ান সুফিদের মতো মেহেরনাজের রূপকেও ঈশ্বরের রূপের এক কণার প্রকাশ বলে মনে করছি, যার পেছনে কিনা আসলে লুকিয়ে আছে আমার অনৈতিক কাম ও বাসনা। 

আমি মুখ খুললাম। সব যখন সাময়িক নীরব, সেই মুহূর্তটাকে আমার কথা বলবার জন্য বেছে নিয়ে সরফরাজ নওয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি এই কমিউনিটির রাজা, আর আপনার গায়ে আসলেই কাপড় নেই, সরফরাজ সাহেব। কিন্তু আমার এটুকু দেখার মতো সিক্স-বাই-সিক্স দৃষ্টিশক্তি আছে যে আমি রাজার শরীরের নতুন কাপড়কে দেখতে পারছি না, আমি দেখতে পারছি আসল সত্য, সেটা হলো—আপনার গায়ে নতুন বা পুরোনো কোনো কাপড়ই নেই, সরফরাজ সাহেব।’ 

যারা বুঝল না, তারা বুঝল না আমার বলা এই হ্যানস ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের অতি পুরোনো কথাটা— ‘এমপেররস নিউ ক্লদস’। আর যারা বুঝতে পারল আমি কী বলছি তাদের নেতাকে, তারা প্রায় তেড়ে এল আমার দিকে, আমার গায়ে একরকম হাত তুলতে। 

সরফরাজ সাহেবই থামালেন তাদের, তিনি সবাইকে এক ধমকে শান্ত করে আমাকেও প্রায় ধমকের সুরে বললেন, ‘আপনি চলে যান, প্রফেসর। আপনাকে আমার আসলেই আর বলার কিছু নেই। আপনি নিজেই দেখিয়ে দিলেন যে, আপনার আত্মায় কহর (বা মোহর, আমি বুঝতে পারলাম না শব্দটা) পড়ে গেছে। আমরা ইকোনমিকসে পড়তাম, এই সমাজ পরিসংখ্যানের চার্টেই কেবল সম্পদশালী, ধনী, কিন্তু এখানে শ্রমিকদের হাতে বাস্তবে কোনো কাজ নেই, ওভার-প্রোডাকশনের কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে, পণ্যকে পুরোনো করে দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়ানো হচ্ছে ইকোনমিক গ্রোথের স্বার্থে, চোখধাঁধানো বিলাসিতার সঙ্গে এককাতারে রাখা হচ্ছে দারিদ্র্য ও ভাতের ক্ষুধার মতো আরেক চরম অবস্থাকে। বলা হচ্ছে ধর্ম বলেছে দারিদ্র্য প্রকৃতির নিয়ম’–এখানে থামলেন তিনি, সবার দিকে তাকালেন, আবার বললেন তার ক্ষণিকের বিরতির শেষে—’কিন্তু ইসলাম বলেছে জাকাতের কথা, বলেছে সম্পদের ভাগ দরিদ্রকে দিতে হবে, বলেছে মানুষ যেন তাদের দীনহীন অবস্থা মেনে না নেয়, তারা যেন প্রয়োজনে যুদ্ধে নামে, আর আপনারা’– আমার দিকে তাকালেন তিনি-’পশ্চিমের বড় দেশগুলোর দালালেরা, মানুষের স্বভাবের যান্ত্রিক অবস্থায়ই আপনাদের মন। আপনারা লিবার্টিতে বিশ্বাস করেন, মানুষের দেওয়া লিবার্টি, কিন্তু বোঝেন না যে যখন অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত, তখন ওই লিবার্টি অর্থহীন। আপনারা আরও বিশ্বাস করেন, আমার ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার হলেই বুঝি আমার সম্প্রদায়ের সচ্ছলতা ও শ্রীবৃদ্ধি আসবে। কিন্তু আমি কাকে কী বলছি এসব? আমার এত কথার পরও আপনি আমার মেন্দি দেওয়া দাড়ি ও কপালে নামাজের দাগ দেখে আমাকে ভাববেন, এই ব্যাটা একটা চরমপন্থী ইসলামিস্ট, উগ্রবাদী ফান্ডামেন্টালিস্ট, আইএসের দেওয়া বোমা বগলে নিয়ে ব্যাটা বসে আছে সব উড়িয়ে দিতে, এমনকি আপনার ভালোবাসার গাছ-লতা-পাতাসহ। ছি!’ 

তাহলে লেগেছে তার আমার খোঁচাটা। লেগেছে বলেই তিনি অর্থনীতিবিদের মতো সম্পদ ও সম্পদের বণ্টন প্রসঙ্গ টেনে আনলেন এর আগে তার বলা মুসলিম উম্মাহর চরম দুর্দশার উপসংহারে। আমি তার কথার আগের ও পরের মধ্যে কোনো সংগতি খুঁজে পেলাম না, বুঝলাম তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কথার সংগতি হারিয়ে ফেলেছেন তার ভাষণের মধ্যে। কিন্তু যেহেতু যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা ও সবাইকে বলতে দেওয়াই এ সভ্যতার নিয়ম, তাই আমি মনে মনে তার সংযম ও সদাচরণের প্রশংসা করে এবং আমার জীবনাচরণের তথাকথিত অসামাজিকতার দিকটুকু নিয়ে তার ক্ষুদ্রমনস্কতাভরা খোঁচার প্রতি আমার চোখের দৃষ্টিতে তার জন্য বিদায়বেলার ঘৃণা রেখে মসজিদ ত্যাগ করলাম। 

মসজিদ থেকে চুপচাপ মাথা নিচু করে হেঁটে ফিরে আসতে গিয়ে বুঝলাম এতগুলো ইতরভাষার-যার একটা বাক্যে তার প্রতি তিরস্কারের নামে আমার নিজের অশিষ্টতারও প্রকাশ ঘটেছে—কোনো কিছু থেকে আমি জয়ী বা পরাজিতের কোনো শান্তি বা অশান্তিই পাচ্ছি না, বরং আমার মন এক মৌন হতাশ্বাসে আগাগোড়া ভরে গেছে। 

বাসায় ফিরে এসে দেখলাম আমার নিজেকে লাগছে ফাঁকা। নিস্পন্দ পড়ে থাকলাম সোফায়—বাইরে তখন আবার নামছে সন্ধ্যা, মাগরিবের আজানের শব্দে থিরথির করছে হাওয়া আর বহু পাখি উত্তর দিকের বালু নদের ওদিক থেকে এসে বসছে বড় বড় দেবদারু, শিরীষ ও কাঁঠালের ডালে, রীতিমতো ঝগড়া করছে তারা। 

আমার ধর্মবিশ্বাস কতটা গাঢ় তা নিয়ে আমি, এই পৃথিবীর অন্য অনেক বিশ্বাসী মানুষের মতোই, সংশয়ে থাকি। মনে হলো, আহা, সামান্য এক মানুষ হিসেবে আমি যদি শুধু নিশ্চিত করে জানতাম অসামান্য ও বিশাল খোদা সব সময়েই আমাদের পাশে আছেন সবকিছুর ওপরে তাঁর। বদান্যতা ও সুবিচারের বিশাল হাতটা মেলে, তার ঊর্ধ্বারোহী গান ও উড্ডয়নশীল সুরের গূঢ় অর্থদ্যোতক প্রসাদগুণ আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে, সব মানুষ ও পশুপাখি, পতঙ্গ ও বৃক্ষের জন্য তার ন্যায়নিষ্ঠত্বের স্পষ্ট অঙ্গীকারের তরঙ্গ তুলে, আহা, তাহলে কীভাবে আমি অর্থ খুঁজে পেতাম এই অন্ধকার ঘরের আলোকশূন্যতার মাঝেও! কীভাবে উতরে যেতাম আমার মনের অসুখ ও শরীরের গতিশূন্যতার এই জেলহাজতটাকে। 

একটু আগে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেছি একটা কপারস্মিথ বারবেট পাখি এই ভরা প্রদোষের অন্ধকারে রংশূন্য হয়ে মিলিয়ে গেল গাছের মধ্যে খোঁড়া তার অন্ধকার গর্তের ভেতরে। আমি একাগ্র মনে ওই বারবেট পাখির রাতের আশ্রয়, ওর কৃষ্ণকালো গুহার দিকে তাকিয়ে থেকে হৃদয়ের সমস্তটুকু দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলাম, কাঁপা কাঁপা বুকে–কারণ আর পারছিলাম না আমি—আল্লাহ, খোদা, ইয়াওয়েহ, কৃষ্ণ, পরব্রহ্ম, জিউস, আহুরা মাজদার সঙ্গে। কিন্তু আকাশে-বাতাসে আমার সেই নিঃশব্দ অন্বেষা অন্বেষাই থেকে গেল আপাতত, সন্ধ্যা গড়িয়ে-ছড়িয়ে-লেপটে গিয়ে একাকার হয়ে একই রকম দৌড়ে যেতে লাগল ঘন রাত্রির পথে। আমি দুচোখ বন্ধ করে ক্ষুধা ও ঘুমহীনতার চাপে জ্ঞান হারাতে লাগলাম, তারপর অসংবৃতভাবে পড়ে গেলাম বারান্দার ধুলো জমা মেঝের ওপর। তখনো মৃদু শুনতে পাচ্ছি হাজার মাইল লম্বা কোনো সুড়ঙ্গের ওপার থেকে কপারস্মিথের ধাতব টুং-টুং-টুং। 

এরই আগে বা পরে, তাতে কিছুই ফারাক হয় না কোনো কিছুর, আমার কাফকা অনুবাদ করতে বসা, তারপর পড়ার রুমে গিয়ে প্রুস্ত হাতে নেওয়া। তারপর, তার আগে নাকি পরে তা আমার মনে নেই, আমার এই মহাপতন। এই রাতেই আমাকে যেতে হলো অ্যাপোলো হাসপাতালে, সঙ্গে আমার নিচতলার প্রতিবেশী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ সাহেব, মাহমুদ আনসারি। আমি আমার জ্ঞান ফেরার পরে অনেক কষ্টের বমি শেষে, বুকে খুব ব্যথা ও চোখে দৃষ্টিশূন্যতার ঘোলা নিয়ে তাকে ফোন দিয়েছিলাম একরকম ভয় পেয়ে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার ঝামেলা এড়াতে তিনি আমাকে রিকশায় তুলে অ্যাপোলোর ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। পথে আমি এই প্রাক্তন মিলিটারি ভদ্রলোককে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইলাম, সামরিক বাহিনীর অনেক প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন ইত্যাদির কথা বুঝতে চাইলাম—একটা পেশাদার বাহিনীতে চাইলেই কি বিদ্রোহ হতে পারে, নাকি পারে না? সিস্টেমটা কী? এসব। তিনি বুঝতে পারলেন না যে বুকে ব্যথা নিয়ে প্রতিবেশীর সাহায্য চাওয়া এক ভদ্রলোক হাসপাতাল ইমার্জেন্সির পথে যেতে যেতে এসব কী জানতে চাইছেন, তাই উত্তরে শুধু আমাকে বলেন, ‘ইউ মাস্ট কুল ডাউন, ইউ মাস্ট সুইচ অব দ্য থিংকিং বাটন।’ 

নিখাদ ভদ্রলোক ও ভিতু, সামরিক বাহিনী ছেড়ে দিয়েও এমন কোনো কিছু বলতে চান না, যা তাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। আবার হতে পারে, সামরিক বাহিনীর খোলনলচে নিয়ে বাইরের একজনের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারটা তিনি অপেশাদার কাজ বলে মনে করেছেন। এই যে তার পেশাদারির প্রতি সম্মান, তার পা মেপে চলা, তার শব্দ মেপে কথা বলা এবং প্রশ্নকে এড়িয়ে অন্য উত্তর দেওয়ার ভদ্রতাবোধ ও কৌশল, এসব—ইমার্জেন্সিতে ঢুকতে ঢুকতে—আমি ভাবি কোথায় গিয়েছিল সে রাতে, যেদিন তারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে পরিবার-পরিজনের সামনে, পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করল নীতিবহির্ভূত ও চরম অপেশাদারভাবে? 

টেকনিশিয়ান যখন আমার গায়ের জামা খুলে ওই দশটা ইলেকট্রোড চামড়ায় বসানোর আগে ঠান্ডা জেলটা মাখাচ্ছেন শরীরের জায়গায় জায়গায় আর আমি সামনে তাকিয়ে একবার দেখছি ইসিজি মেশিনটাকে—ভয়ংকর-দর্শন এক যন্ত্র, যার চাকা লাগানো পা আছে, তার ওপর আছে কি-বোর্ড, তার ওপর ডিসপ্লে প্যানেল, সব মিলে মনে হচ্ছে বিরাট এই জিনিসটাতে সামান্য টিপাটিপি করেই পারমাণবিক বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব—আমি একবার তাকিয়ে দেখছি ওটা, আরেকবার ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ আনসারির পুরুতঠাকুরসদৃশ নির্মল চোখ, তখন আমার এই প্রথমবারের মতো মনে হলো মিথ্যা কথা বলা হয়েছে আমাদের, নির্জলা মিথ্যা শোনানো হয়েছে আমাদের। 

বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল লোক এই কাজটা করেছে পনেরোই আগস্টের ভোররাতে, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর বাকিরা, অর্থাৎ কমান্ড চেইন এতে জড়িত ছিল না, অর্থাৎ দেশের সেনাবাহিনী করেনি এই জঘন্য-বর্বর কাজ, এটা যারা করেছে, তারা সংখ্যায় অতি ছোট একদল পথভ্রষ্ট অফিসার ও জওয়ান -সেটা মিথ্যা কথা। সত্য হচ্ছে, বাহিনীর যে সিস্টেম-যার বিষয়ে রিকশায় আমাকে কিছু বলতে রাজি হলেন না ব্রিগেডিয়ার সাহেব—ওই বাহিনীর মূল কথা, সেই সিস্টেম তার কলকবজা ও সিস্টেমটাকে ঠিক রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওপরের দিকের সব কটি চরিত্রকে একসঙ্গে নিয়ে সে রাতে ভেঙে পড়েছিল চীনের প্রাচীরের উত্তর-পশ্চিমাংশের বিখ্যাত ভাঙা জায়গাটার মতো করে, এক ধাক্কায়, যেনবা এক ফুঁয়ে, প্রতারণার এক হাতসাফাই জাদুতে। যারা বিপথগামী ছিল, তারা সে রাতে বিপথগামী হতে পেরেছিল, কারণ সিস্টেমের নেতৃত্বে থাকা মানুষগুলো ওদের আগেই নিজেরা বিপথে গিয়ে বসে ছিল তাই। সে জন্যই নিস্তব্ধ রাত্রির পর্দা ফেঁড়েফুঁড়ে দেওয়া এতগুলো ট্যাংকের ঘরবাড়ি-গাছপালা কাঁপানো আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি সে রাতে, কারণ তারা, সমস্ত কমিশন্ড অফিসার ও পুরো সিস্টেম, তাদের কান জমা দিয়ে রেখেছিল আরমারিতে, তোশাখানায়-ওখান থেকে বের হওয়া ডজন ডজন পিস্তল, সাবমেশিনগান, কামান, কার্তুজ, বুলেটের বিনিময়ে। 

বাস্তুঘুঘু—এই অপ্রচলিত বাংলা শব্দটা মাথায় এল আমার, যখন দাড়িওয়ালা তরুণ এক ডাক্তার ইমার্জেন্সির বিছানায় আমাকে শুইয়ে ফেঁড়ে ফেলবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বললেন, তিনি ব্যস্ত আমাকে নিয়েই, অন্য কিছু নিয়ে নয়। আমি তাকে নিশ্চিত করলাম যে আমি তার ব্যস্ততা নিয়ে কিছু বলিনি, আমি ‘ব্যস্ত’র মতো শোনায় এমন একটা বাংলা শব্দ মনে মনে আওড়েছি মাত্র। তিনি হাসলেন, আমার পেশা কী জিজ্ঞাসা করলেন, কখন থেকে বুকে ব্যথা, শেষ কখন খেয়েছি, এসব জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম আমার ঘুম না হওয়ার কথা, বসুন্ধরা সোসাইটির চেয়ারম্যানকে সীমার বাইরে গিয়ে অপমান করার কথা, এখানকার গাছগুলো মরে যাচ্ছে সে কথা, বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য নয়, বরং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদম উপর দিকের কিছু লোকই যে আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল এবং তা যে আমি অলৌকিক কোনো ওহির মতো করে আজ হঠাৎ বুঝে গেছি সে কথা, আমার এক বন্ধুর কোলন ক্যানসার ও আরেক বন্ধুর অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে খুন করতে চাওয়ার অক্ষম বাসনার কথা। আমি বলে যাচ্ছি, বলেই যাচ্ছি, আমাকে থামানো যাচ্ছে না, আমি থামতে পারছি না, বলতে চাচ্ছি—ডাক্তার আমাকে থামান, আমি এমন সব সত্য বলতে থাকব যে পৃথিবী আজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে; ডাক্তার, এ এক পৃথিবী যা আদতে শয়তানের বাসরঘর, আর আমি চাচ্ছি, অন্তত গত কদিন ধরে চেয়েছি যে এই বাসরঘরে আমি আগুন লাগিয়ে দেব, আমার এই ইচ্ছা প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা, ডাক্তার, যদি শুধু আমি জানতাম যে কী করে প্রতিশোধটা নিতে হবে, কী কর্মপদ্ধতি ও কৌশল মেনে, তাহলে আপনি আমাকে এখন এ মুহূর্তে এই হাসপাতালের বিছানায় দেখতেন না, আমি তাহলে আমার কাজেই নেমে যেতাম আত্মা-মন-শরীরে এক ভয়ংকর জ্বর নিয়ে, কিন্তু আপনি আমাকে এখানে দেখছেন, আমি আপনার রোগী হয়ে এখানে পড়ে আছি। কারণ, আমি তাদের একজন, যারা প্রতিশোধ নিতে চায়, ক্রোধে ফুঁসতেও থাকে, কিন্তু তারা জানে না যে, যে লোক প্রতিশোধ সত্যি করে নেয়, সে কখনো দৃশ্যমান ক্রোধে ফোঁসে না। আমার ক্রোধ আছে, কারণ আমার সত্যিকারের প্রতিশোধ নেওয়ার সাহস বা শক্তিটুকু নেই। তাই নিজের অক্ষমতা থেকে, ডাক্তার, আমি খুব বাজেভাবে ভুগে ভুগে মরছি, আমার আত্মা ও শরীর বিষে ভরে গেছে এবং বিষ আরও বাড়ছে এটা জানার পর থেকেই যে প্রতিশোধ বাস্তবে নিয়ে ফেলার চেয়ে বোধ হয় প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা থাকাটা দামি বেশি, আর আমি না পারছি এই সত্যের পেছনের যুক্তিকাঠামোকে উপড়ে ফেলতে, না পারছি আমার এই বোধকে মেনে নিতে। 

এতগুলো কথা বললাম। তরুণ ডাক্তার এবং আমার প্রতিবেশী ব্রিগেডিয়ার ও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স সব শুনলেন। তারা চুপ করে থাকলেন, বললেন না কিছু। আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হবে, কারণ যতগুলো কথা বললাম, তার বেশি হলে অর্ধেকটাই মাত্র মনে করতে পারছি এখন, তার মানে প্রচুর সময় ধরে কথা বলেছি আমি—ইনজেকশন রক্তে কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময়, এতটা যে দুচোখ ভরে ঘুম এসে গেল, আর তা যখন এল, তখন তা শরীর শিথিল করে দিয়ে বানের পানির মতোই এল, কোনো ছলনার বাঁকা পথ ধরে নয়, বরং সরাসরি স্থির নিশ্চিতির সঙ্গে এল। সেই ঘুমের অতলে হারিয়ে যেতে যেতে আমি শুনলাম, তরুণ ডাক্তার মুখে হাসি নিয়ে আমাকে বলছেন, ‘আপনি তো ভালোই পড়াশোনা জানা লোক, তাহলে আপনাকে কেন আমার এই কথা বলে দিতে হচ্ছে যে রক্তপাত-ব্লিডিং-ব্লাডলেটিং শরীরের বাইরে ঘটানোর বিষয়, সে জন্য মানুষের হাতে ধারালো অস্ত্র আছে আর মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপরে চামড়াও আছে, তো তাহলে কেন আপনি আপনার রক্তপাত শরীরের ভেতরে ঘটাচ্ছেন? এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ; ব্লাড মাস্ট নট বি শেড ইনসাইড, প্রফেসর।’ তিনি বলেছিলেন একটামাত্র লাইন, ডেরেক ওয়ালকটের কবিতার মতো হঠাৎ গাঢ় এক লাইন পঙক্তির আয়তনে পুরো ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের শোষণের ইতিহাস তুলে ধরে থাকে যে রকম লাইন, সে রকমই এক দীর্ঘ, বড় বাক্য। এবং আমি পরদিন তা মনে করে, হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে, মেহেরনাজকে ওই কাব্যিক মহিমাপূর্ণ লাইনটাই বলছিলাম ব্যাখ্যা করে করে, ‘ব্লাডলেটিং’ শব্দটার লিরিক্যাল ব্যঞ্জনা আমার অনেক ভালো লেগেছিল তাই। 

.

হাসপাতালের কেবিনে ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ ব্যাপার আছে। নিজে উঠতে হয় না এখানে, নার্সরাই উঠিয়ে দেয়। আমার বেলায়ও তা-ই হলো, আমাকে ঘুম থেকে তুলে ধুয়েমুছে তৈরি করা হলো আরেকটা দিনের সামনে কোনোমতে দাঁড়ানোর জন্য। আমি তা-ই করলাম, নতুন পরিস্থিতির সবকিছু শান্তভাবে মেনে নিলাম, যেমন এই তথ্য যে রাতেই আমাকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে, ইমার্জেন্সিতে থাকতেই আমাকে কড়া ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে এবং ডাক্তার আমাকে নাকি ব্যাখ্যাও করেছেন ইসিজি রিপোর্ট দেখে তিনি কেন মনে করেছেন আমার করোনারি এনজিওগ্রাম করতে হবে। তাহলে এই হচ্ছে বিষয়, এনজিওগ্রামের অভিজ্ঞতা নেওয়াটাই আমার জীবনে বাকি ছিল শুধু। ভালো। 

আমি কল্পনা করতে পারলাম আমার হাতের ধমনির ভেতর দিয়ে ডাক্তার একটা পাতলা সরু ফাঁপা টিউব ঢোকাচ্ছেন, একটা ক্যাথেটার, তারপর আয়োডিন মেশানো একটা সলিউশন পুশ করা হচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ডে রক্ত সাপ্লাই দেওয়ার বড় ধমনিতে, তারপর ফ্লুরোস্কোপ যন্ত্র ছবি তুলছে ওখানকার, বুঝতে চাইছে হার্টে রক্ত সঞ্চালনের কী অবস্থা। নার্স মেয়েটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, সে ভাবছে আমি তাকে এনজিওগ্রাম নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করব, আর আমি ভাবছি ফ্লুরোস্কোপ যন্ত্র যদি আমার হৃৎপিণ্ডের সত্যিকারের অবস্থার ছবি নিতে পারত, তাহলে দেখা যেত আমার হৃদয়ের পাশে শুয়ে আছে বড় একদলা গতিহারা অন্ধকার, এবং তার প্যাঁচানো মোড়ানো ভাঁজের মধ্যে, যেখানে রয়েছে আরও আরও গাঢ় অন্ধকার, সেখানে খুলে হাঁ হয়ে আছে একটা ক্ষত—আকারে আমার হাতের তালুর মতো, রং নানা শেডের গোলাপ-লাল, যেমন গভীর দিকটায় কালো আবার কিনারের দিকে হালকা, ভেতরে দেখা যাচ্ছে সূক্ষ্ম দানা দানামতো, রক্ত সেটার একেক জায়গা থেকে ভুজভুজ করে বের হয়ে আসতে চাইছে একেকভাবে, এবং ক্ষতের পুরোটা মুখ হাঁ হয়ে আছে দিনের আলোয় কোনো মাটিতে পোঁতা বোমার মতো করে। 

আমার নিজের চিন্তার মধ্যে অনায়াসে এভাবে ফ্রানৎস কাফকার গল্পের লাইন ঢুকে যাওয়াটা আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলল। কাফকা বলেছিলেন, ‘জীবনের অর্থ হচ্ছে এই যে, জীবন থেমে যায়।’ এটা অনেক বেশি হতাশ্বাসে ভরা কথা, আমি ভাবতে চাই না ওসব, এমনকি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও না। আমি বরং জানতে চাই, বুঝতে চাই জীবন যেমন, জীবন কেন তেমন, এবং পারলে মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই সেই শত্রুশক্তির যার কারণে জীবন এমন। কিন্তু আমি জানি না সেই শত্রুর, সেই অশুভ শক্তির নাম। আমি শুধু কিছু শব্দ দিয়ে তার পরিচয়কে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাই করতে পারি মাত্র। আমার মাথায় পরপর এল এই শব্দগুলো, সম্ভবত তাৎপর্যের কোনো ক্রম না মেনে : ক্ষমতার লোভ, নিজেকে জাহির করার প্রণোদনা, অন্যকে আহত করার আনন্দ (নিষ্ঠুরতা), নিজের বিশ্বাস নিয়ে অন্ধত্ব, শুধু মানুষকেই পৃথিবীর একমাত্র অধিবাসী ভাবা (প্রকৃতি ও অন্য প্রাণীদের সঙ্গে মিলে জীবনের যে বৃহত্তর সিম্ফনি তা উপেক্ষা করে চলা), ষড়যন্ত্রপরায়ণতা, অহং, অর্থ-সম্পদের মোহ (এ কারণে সৃজনশীলতা হারানো এবং সেভাবেই নিজের অনৈতিক আচরণে আর বিচলিত না হওয়া), জাত-পাত-ধর্ম থেকে আসা সংকীর্ণমনস্কতা এবং শেষে মৃত্যুবিষয়ক চেতনা (মৃত্যু নামের যে নিশ্চিতির কারণে একদিকে অন্য সব মূল্যবোধ তুচ্ছ হয়ে যায়, আবার অন্যদিকে যে নিশ্চিতি মানুষকে নিরাসক্ত করে)। 

এটুকু ভেবে মনে হলো কোথায় যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে, কোথায় যেন আমি হারিয়ে ফেলছি আমার চিন্তার স্বচ্ছতা। আবার তালিকাটা মনে মনে আওড়ে নিলাম। এবার মনে হলো, রাজনৈতিক বিশ্বাস বাদ পড়ে গেছে, যে বিশ্বাসের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ হয়ে কোটিতে কোটিতে মারা গেছে তুলনায় নির্বোধ ও ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ—গুপ্তহত্যা, জেল, নির্যাতন ও রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। আবার মনে হলো, পৃথিবীর এই আপাত-সুন্দর চেহারাটা কলুষিত করে যে শক্তিগুলো, তাদের নামের এত বড় তালিকা করা লাগে না; এরা সব মিলে, আবার এদের একে একে দেখলেও, আদতে এরা একটাই শক্তি, এত বড় তালিকার সব কটি ওই একই শক্তির নানান রূপ, কিন্তু আমার অক্ষমতা এই যে আমি সেটার জন্য প্রযোজ্য কোনো সঠিক শব্দ জানি না-না বাংলায়, না অন্য কোনো ভাষায়। 

পৃথিবীর উৎকট চেহারা নিয়ে এসব ভাবনার মধ্যেই আমাকে অবাক করে দিয়ে মেহেরনাজ এল। তাকে আমি আশা করিনি। আমার হিসেবে তার জানারই কথা নয় যে আমি হাসপাতালে আছি, যদি না সে আজ সকালে আমার বাসায় গিয়ে থাকে। কীভাবে মেহেরনাজ হাসপাতালের এই কেবিনের সন্ধান পেল, সেসব জিজ্ঞাসা না করে আমি তাকে নিষ্প্রাণ সুরে বসতে বললাম বিছানার পাশের চেয়ারে, কিন্তু সে বসে পড়ল আমার পায়ের কাছে, বিছানাতেই। আমি লক্ষ করলাম, আমার পায়ে হাত দিয়েছে সে এবং তার চোখ পানিতে চিকচিক করছে। নার্সকে আমি বললাম এই কেবিনের দৈনিক ভাড়া কত, তা আমাকে জানাতে। নার্স চলে যাচ্ছেন, তখন আবার ডেকে বললাম, এখন পর্যন্ত বিল কত হয়েছে, তা-ও জানাতে। নার্স নিশ্চিত ভেবেছেন, মেহেরনাজ আমার স্ত্রী হবে। কারণ, তিনি যেতে যেতে বললেন, ‘ভাবি, আপনার জন্য চা দেব?’ 

নার্স চলে যেতেই মেহেরনাজকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাবি, আপনি নাশতা করেছেন?’ মেহের কেবিন ফাঁকা পেয়ে চোখের নিমেষে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল-আমি বিছানায় শোয়া, হাসপাতালের অটোমেটিক বেড একটু উঁচু করা, আমার শরীরের ঊর্ধ্বভাগ শোয়া ও বসার মাঝামাঝি এক অবস্থানে। আমি অবশ হয়ে গেলাম তার কান্না দেখে। কিছুই বলল না সে, জিজ্ঞাসা করল না যে আমার কী হয়েছিল, কেন আসতে হয়েছিল ইমার্জেন্সিতে, কেন এখন আমি এই কেবিনে, কেন আমি ঠিকমতো খাচ্ছি না, ঘুমাচ্ছি না, এসব কিছু। কারণ, এর সব কটির উত্তর আমার ধারণায় সে জানে, ভালোভাবে জানে। প্রশ্নগুলোর উত্তর তার জানা। কারণ, সে অনেক বুদ্ধিমান এক মেয়ে, ডাক্তারের কাছে সব জিজ্ঞেস করেই সে এখানে এসেছে। এমনকি আমি অবাক হব না যদি জানি যে সে আমার প্রতিবেশী ব্রিগেডিয়ার আনসারি সাহেবের কাছ থেকে কাল রাতের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব নিজ কানে শুনে তারপর এসেছে এখানে। সোজা কথা, এসব প্রশ্নের উত্তর সে জানবে। কারণ, আমি তার ঘনিষ্ঠ, তাই তার জানা স্বাভাবিক যে আমার মনের মধ্যে কখন কী চলে, কেন হঠাৎ একটা সুস্বাদু বার্গারও আমার কাছে হঠাৎ বিস্বাদ ঠেকে। 

মানুষে মানুষে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বেলায় এই একজনের বিষয়ে সব সত্য অন্যজন জানা ও না-জানার ভেতরকার সত্যটা এবং তার ভেতরে যে দাবি ও অধিকার লুকিয়ে থাকে তা এবং সেই জানার ভেতরের ফাঁকিটুকু, যা কখনো মিটবার নয় তা, আমাকে অবাক করে। আমি মেহেরনাজকে বোধ হয় আরও অবাক করে দিয়ে বললাম, ‘বাসায় যাও, গিয়ে আমার জন্য পথের পাঁচালী ও আমার ল্যাপটপটা নিয়ে এসো।’ মেহেরনাজ তখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। চোখ মুছতে ও নিজেকে গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিল সে, তারপর আমার প্রায় মুখের ওপর মুখ রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘বিভূতিভূষণের?’ আমি বললাম, ‘না, বিভূতিভূষণ না। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের।’ শুনে অনেক হাসল মেহেরনাজ। তখনই দরজায় টোকা। 

মেহেরনাজ সোজা হয়ে বসে বলল, ‘আসুন।’ নার্স ভেতরে ঢুকে মেহেরনাজের কান্নাভেজা চোখের দিকে একবার তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে তার চোখ ফিরিয়ে আমাকে জানালেন কেবিনভাড়ার অঙ্ক এবং এখন পর্যন্ত কত বিল হয়েছে তা। আমি মোট অঙ্কটা শুনে ঘাবড়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম কত দিন এখানে থাকতে হবে? উত্তরে নার্স জানালেন, ‘আনুমানিক আরও দুই রাত বা তিন রাত।’ তখন আমি দৈনিক ভাড়াকে মোট তিন দিয়ে গুণ দিয়ে তার সঙ্গে আগের ফলাফলের বড় একটা অংশ যোগ করে, তার ওপর আরও চার ভাগের এক ভাগ চাপিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এতগুলো টাকা? হঠাৎ কোথায় পাব এখন? বুঝে গেলাম, সামান্য এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জন্য অ্যাপোলো হাসপাতাল নয়, এটা আমার চাইতে আয়-ইনকাম কমপক্ষে পাঁচ গুণ বেশি এমন মানুষদের জন্য। মেহেরনাজকে কিছুই বললাম না, শুধু ঠাট্টা করে রিলকের মালটে লাউরিড ব্রিগগের প্রথম লাইনটার প্যারোডি করলাম : ‘তো, এই হচ্ছে অ্যাপোলো হাসপাতাল, যেখান মানুষ আসে বাঁচতে, আমার তো মনে হয় এখানে তারা আসে শুধু মরতে।’ 

আমার প্রিয় গল্প-উপন্যাস-কবিতা ইত্যাদির প্রায় সব কটারই বিশেষ প্রিয় লাইনগুলো মেহেরনাজের জানা। তাই সে বুঝল আমি কী বলছি, কোন বই থেকে বলছি। কিন্তু কোনো কিছু না বুঝে তার কথার উত্তরে আমার এ কথাটা শুনে নার্স বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমাকে কী ভেবেছিলেন এই নার্স? আমি একজন বড়লোক? মেহেরনাজের দামি কাপড়চোপড়, ঘড়ি, দামি পারফিউম, জুতো, পার্স—এসব দেখে তার সে ভাবনাই কি আরও পোক্ত হয়েছিল? আর এখন তিনি এত বড়লোকদের মুখে শালীনতা ও পরিবেশের সুর নষ্ট করে দেওয়া এই টাকাপয়সা নিয়ে ছোটলোকি মন্তব্য শুনে কি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন? তার কি এটাও মনে হচ্ছে যে এই ভদ্রলোক আসলে তার এ রকম সুন্দর ও স্মার্ট স্ত্রীর সঙ্গে ভয়ংকর বখিলি করেন? এ ব্যাটা আসলে অনেক হীনচেতা এক লোক যে কিনা আমার সব সার্ভিস হাসিমুখে, প্রয়োজনে আমাকে তোষামোদ করে করে নেবে কিন্তু হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার দিন কোনো না কোনোভাবে এড়িয়ে যাবে আমাকে সামান্য দুই শ টাকা টিপস দেওয়ার ব্যাপারটা? 

টিপস নিয়ে ভাবতেই আমার মনে পড়ল আইয়ারের মুখ। আমি মেহেরনাজকে বললাম, ‘একদিন, মনে হয় এ বছরের শেষ দিকে, আমি আবার মুম্বাই যাব স্রেফ আইয়ারের সঙ্গে দেখা করতে।’ মেহেরনাজ জিজ্ঞেস করল, ‘আইয়ার কে?’ আমি বুঝলাম, না, তাকে আমার আইয়ারের কথা বলা হয়নি, যেমন বলা হয়নি কাল রাতে ইমার্জেন্সিতে ওই দাড়িওয়ালা তরুণ ডাক্তারের ওপরে ফেটে পড়ার কথাও। আমি তাকে কাল রাতের কথাগুলো—পনেরোই আগস্ট ১৯৭৫-এর বাস্তুঘুঘুদের কথাসহ, আমার প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা ও অক্ষমতার কথাসহ—সবই বললাম, এমনকি সরফরাজ নওয়াজ সাহেবের বলা সামান্য কিছু টেবল-টক ধরনের কথার উত্তরে আমি তাকে যে ভয়ংকর অপমানকর কথা বলে এখন অনুশোচনা বোধ করছি, তা-ও। আমার কথা শেষ হলে মেহেরনাজ জিজ্ঞাসা করল, “ভারতে কী হয়েছিল আইয়ারের সঙ্গে? কে আইয়ার?’ আমি উত্তর দিলাম, আইয়ারের গল্প পরে আরেক দিন তাকে শোনাব তবে এখন তার এটুকু শুনলেই চলবে যে, আইয়ার নামের লোকটা তার দেশের বাড়ি তামিলনাড়ু থেকে মুম্বাইতে এসেছে জীবিকার জন্য, কিন্তু তার কাজের টাইমটেবল এমন যে সে ঘুমানোর সময় পায় দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা, এবং এভাবেই তার চলছে বছরের পর বছর, তার কিছুই করার নেই স্রেফ এভাবে জীবন কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া। মেহেরনাজ আমাকে বলল, আমার বাসায় গিয়ে বই ও ল্যাপটপটা আনার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে যে আইয়ারের গল্প সে আর শুনতে চায় না, আইয়ারের কথা তার বোঝা হয়ে গেছে। 

মেহেরনাজ চলে যেতে এই প্রথম আইয়ারের মালিকের কথা ভাবলাম আমি। এক রেন্ট-এ-কার কোম্পানির মালিক সে, কোম্পানির নাম সিমরান ট্রাভেলস, বয়স তার নিশ্চয়ই হবে পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায়, আর এই কোম্পানি তৈরি হওয়ার পর থেকে তার জীবন কেটে গেছে অন্য গাড়ি কোম্পানির মালিকদের সঙ্গে এই প্রতিযোগিতায় নেমে যে আরও কত কঠোর ও সফল এক মালিক হওয়া যায়। এখন আর এই কয়টা গাড়িতে হচ্ছে না তার, নতুন গাড়ি কেনার জন্য আরও টাকা চাই, কোম্পানির অ্যাকাউন্টে মাসের শেষে, দিনের শেষে আরও লাভ চাই। অন্যের জীবন তছনছ করে দেওয়ার তার যে ইচ্ছা, বোকাসোকা ও জীবনের হাতে ধরা খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি তার যে বিদ্বেষ, তা আসলে তার কাছে আনন্দের, যেন সে প্রতিশোধ নিচ্ছে কিছুর ওপরে, যেন ওটা তাকে একধরনের উত্তেজনার খেলার মধ্যে ডুবিয়ে রাখছে। সে আইয়ারের ওপর তার ক্ষমতা দেখিয়ে মজা পাচ্ছে। কারণ, এতে আইয়ারকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার, দাবিয়ে রাখার আনন্দ বেড়েই চলেছে তার। আমার আনন্দ অন্যের জীবনকে নিরানন্দ করে দেওয়ার মধ্যেই। নিৎশে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রকৃতিতে মজা পাই গাছের ডাল ভেঙে, পাহাড়ের পাথর খুলে নিয়ে, বন্য পশুদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের খুঁচিয়ে মেরে, যেন আমরা বুঝতে পারি আমাদের শক্তি ও ক্ষমতার কথা।’ আমরা কোনো দায়িত্ব নিই না কাউকে কষ্ট দিয়ে এবং দায় না নেওয়াকে অনৈতিক কিছু বলেও মনে করি না। যে মুহূর্তে মালিক তার নিজের স্বার্থ থেকে শ্রমিকদের মজুরি কাল থেকে দশ টাকা করে কমিয়ে দিলেন বা যে মুহূর্তে গৃহকর্ত্রী হঠাৎ গরম খুন্তি দিয়ে বাড়ি মারলেন তার বাসার গরিব কাজের মেয়েটাকে, যে মুহূর্তে গাছের শেষটুকু কাটা হলো এবার ভ্যানগাড়িতে গুঁড়িসহ তুলবার জন্য, সে মুহূর্তেই আমাদের মাথার ভেতরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে লজিক যে কেন আমরা কাজটা করলাম। কেউ জিজ্ঞেস করল যে কেন করলেন এটা, তো সুন্দর যুক্তিপূর্ণ উত্তর তৈরি, আর কেউ জিজ্ঞেস না করল তো ওই একই উত্তর তৈরি নিজের জন্য। এই যুক্তির জ্ঞান আছে বলেই মানুষ তার নিম্নতরকে দেখে তার নিজের উচ্চতর অবস্থানে থাকার শান্তি পায়—এই শান্তিপ্রাপ্তির আনন্দ, এই এক জীবনে জিতে থাকার আনন্দ, জীবনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবন থেকে মৃত্যুর মধ্যকার পথটাকে দাবড়ে চলার আনন্দ। 

নিৎশের কথার সঙ্গে বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে আমার নিজের ভাবনা, কিন্তু তা আগাচ্ছে আমি দেখলাম নিৎশের পথ ধরেই। আমার খানিক আফসোস লাগা শুরু হলো যে গতকাল কেন আমি কোর্স কো-অর্ডিনেটরের ওপর জেদ করে ক্লাসে নিৎশে পড়ালাম না। হঠাৎ আমার দরদ বোধ হলো আমার কোর্স কো-অর্ডিনেটর বৃদ্ধ ইলিয়াস সাহেবের জন্য। মনে করতে পারলাম না তাকে ই-মেইলে ওই কড়া উত্তরটা, যার প্রতিটা বাক্য এখনো আমার মাথার মধ্যে ঘুরছে, আমি লিখেছিলাম কি না, নাকি সুরভির মেইলগুলো পেয়ে ওই কাজ আর করা হয়ে ওঠেনি। কেমন এক জবুথবু মানুষ এই বৃদ্ধ ইলিয়াস কারও এক তদবিরে ঢুকেছেন নর্থ-ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এর আগে পড়াতেন কোন দূর মফস্বলের কোনো এক কলেজে কিংবা সেখানকার একই দর্শন বিভাগে কাজ করতেন কোর্স কো-অর্ডিনেটরের। তারপর সেই দূর মফস্বল থেকে হঠাৎ ঢাকায়, একগাদা ঝকঝকে ইংল্যান্ড-আমেরিকা ফেরত পিএইচডিধারীদের মাঝখানে, চিন্তাক্লিষ্ট, নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করার চিরন্তন সংগ্রামে ক্লান্ত, প্রতিটা বাক্য বলার আগে শব্দচয়নের যথার্থতা ও ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং নিজের নির্বুদ্ধিতা থেকে অন্যের আরও আরও সহানুভূতি ও মায়ার কুয়োর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে সেই কুয়োতে ডুবে একসময় পুরো মরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। হাহ্। 

মানুষের জন্য দরদ খুব অদ্ভুত এক জিনিস। মানুষের ক্ষতি করার উদ্দেশ্য এই থাকে যে, ওই লোকটা আহত হোক, যন্ত্রণায় কাঁদুক, শেষ হয়ে যাক; কিন্তু মানুষকে দয়া ও দরদ দেখানোর উদ্দেশ্য প্রায়শই এটা থাকে না যে মানুষটা আনন্দ পাক, খুশি হোক, হাসুক, বরং যে দয়া-দরদ দেখায় সে মজা পায় নিজের ভেতরকার আবেগের স্ফুরণ দেখে, যেমন আমরা আবেগাপ্লুত হই (মজা পাই) ট্র্যাজিক লেখাগুলো পড়ে। আবার এ-ও সত্য যে, দয়া-দরদ দেখানো লোকটা এখানেও নিজের উচ্চতর অবস্থান বুঝতে পেরে পরিতৃপ্তিতেই ভোগে। তুমি বোঝো যে তোমাকে আমি দয়া-দরদ দেখালাম, তুমি বোঝো যে আমি মানুষটা ভালো, আরও বোঝো যে আজ থেকে আমি তোমার থেকে বড় হয়ে থাকলাম, তাই আগে আমি তোমাকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম কিন্তু এখন থেকে তোমাকে তুমি করে বলব, এবং আমি জানি তুমি তা হাসিমনেই মেনে নেবে। এ রকম। তা ছাড়া কষ্টে থাকা লোকটা যদি আমার কাছের কোনো লোক হয়, তাহলে তো এর তৃতীয় এক মাত্রাও 

আছে—কাছের মানুষকে দয়ামায়া দেখিয়ে আমার নিজের নানা কষ্টও কিছুটা লাঘব হলো। দয়া-মায়া মানুষের নীতিসম্মত মানসিক অবস্থাগুলোর মধ্যে যথেষ্ট নিচের দিকের। নিৎশের ‘উইল টু পাওয়ার’-এ, যা আমি পড়াইনি কাল, সুন্দর তিনটে লাইন আছে : 

ভালো কী? তা-ই, যা কিছু ক্ষমতা থাকার বোধকে বাড়ায়। 
মন্দ কী? তা-ই, যা কিছু দুর্বলতা থেকে আসে। 
সুখ কী? সুখ সেই বোধ যে ক্ষমতা বাড়তে থাকে, সেই জ্ঞান যে আরেকটা পথের বাধা দূর হলো। 

আমি আমার ইঞ্জিনিয়ার বড় ভাইকে ফোন করে কিছু টাকা ধার চাইলাম, হাসপাতালে আছি সে কথা না বলেই। বড় ভাইয়া জানালেন, কালকের মধ্যে টাকা তিনি খুলনা থেকে কুরিয়ার করে দেবেন। অন্তত হাসপাতাল থেকে বেরোনোর পথের বাধা আমার দূর হলো। 

বহু আগে এনজিওগ্রাম শেষ হয়েছে, মারাত্মক কোনো ব্লক পাওয়া যায়নি জানানো হয়েছে আমাকে, আবার এ-ও বলা হয়েছে যে আমার হাসপাতাল ছাড়া যাবে না, ডাক্তার আমাকে অবজারভেশনে রাখবেন— ‘আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি আর দুটো রাত থাকতে, কারণ আছে’, বলা হয়েছে। সরফরাজ নওয়াজ সাহেব সোসাইটির জিএস গাড়ি ব্যবসায়ী আখলাকুর রহমানসহ আমার সঙ্গে এরই মধ্যে দেখা করে গেছেন, একধরনের তন্দ্রায় থেকেই আমি শুনেছি তিনি বলেছেন আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দান করুন। মেহেরনাজ এসেছে আবার এবং চলে গেছে। তার জাফরান রঙে মেশানো এমারল্ড গ্রিন সালোয়ার-কামিজে তাকে লাগছিল কর্মতৎপর কোনো বাইজির মতো, যে আবার একই সঙ্গে বৃন্দাবনেশ্বরী-রাধা, আর আমি তা দেখেছি আমার তন্দ্রার ওপার থেকে, নিঃশব্দে, চোখ পুরো না খুলে। এরপর সময় বয়ে গেল আমাকে না জানিয়েই। আমি হারিয়ে ফেললাম এমন কিছু ঘণ্টা, এমন কটা দিন যার স্মৃতিও আমার নেই, শুধু ভয়ংকর আজগুবি কিছু স্বপ্ন ছাড়া, যা-ও কিনা কিছুই মনে থাকল না ঘুম থেকে সত্যিকার জেগে উঠে সময়ের নিরন্তর গোঁয়ারের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে চলা মহিষটার পিঠে আবার চড়ে বসার পরমুহূর্তে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *