আগস্ট আবছায়া – ১.৩

১.৩

এয়ারপোর্টের বাইরে, বড় রাস্তায়, বাড়ির পথে যেতে যেতে বিশাল ধাক্কা খেলাম পনেরোই আগস্টের পোস্টারগুলো দেখে। আমার মুম্বাই যাওয়ার সময়ও নিশ্চয়ই ছিল ওরা, কিন্তু তখন জুলাইয়ের শেষ বলে হয়তো সংখ্যায় ছিল কম, এবং এবারের মুম্বাই সফরের স্মৃতির পীড়ন তখন আমার মাথায় ছিল না বলে হয়তো যে দু-একটা চোখে পড়েছিল, তাদের অভিঘাত এত তীব্র লাগেনি আমার কাছে। 

ট্রাফিক পুলিশ এত রোদের ভেতরে দাঁড়িয়ে ডিউটি করে যাচ্ছেন কী করে? দুজন মাত্র তারা, কিন্তু শত শত গাড়ি সামলে চলেছেন নির্বিকারে। দুজনের মধ্যে যিনি পদবিতে বড়, তার মুখে এমনকি ঝুলে আছে একচিলতে হাসি; দুজনের জামারই বগলের দিকটা ঘেমে একাকার, সারা মুখে ঘাম, কপাল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। পরিবেশের প্রভাব বলে যে কথাটায় বিশ্বাস করি আমি (এমন যে যা কিছু আমাদের মনের গহিনে ঘটে তা পরিবেশগত ইফেক্টের কারণে ঘটে; যেমন আগেই বলেছি, দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে বলে স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্স হয়ে যেতে পারে কিংবা গোরস্থানের পাশ দিয়ে কেউ হাঁটছে বলে ভিক্ষুকের থালায় লাথি পড়তে পারে বা সমুদ্রের পাশে বসে আছে বলে লজ্জাহীনের মতো কেউ অনেক মানুষের সামনেও খালি গা হয়ে যেতে পারে), সেটা ভুল প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে এ দুই ট্রাফিক পুলিশের নিরভিমান আচরণের মধ্য দিয়ে। কারণ, যে গরম পিচের ওপর দাঁড়িয়ে নিষ্করুণ সূর্যের নিচে তারা হাজার গাড়িকে নিয়মের মধ্যে রাখার ডিউটি করে যাচ্ছেন, এবং সেই সঙ্গে যে প্রচণ্ড আপসহীন হর্ন ও চিৎকারের মধ্যে তারা করে যাচ্ছেন কাজটা, তাতে আমার হিসেবে একমাত্র স্বাভাবিক দেখায় হঠাৎ তারা, চিত্তবৈকল্য থেকে, ভিড়ের ওপর রোষাগ্নি নিয়ে ফেটে পড়লেই, রক্তপিপাসা নিয়ে ধুমধাম দু-চারটে মানুষ আছড়ে মেরে ফেললেই। 

কোন দেববাণী তাদের আস্থা দিয়ে রেখেছে পৃথিবীর কোমল-পেলব মৃদুতার ওপর ভরসা রাখার, যেভাবে শ্রোতার আস্থা থাকে গানের তাল ও মাত্রার স্বাভাবিক প্রবহমানতায়? এদের এই মাথাঠান্ডা সুস্থ আচরণ জ্যামের মধ্যে দাঁড়িয়ে যত দেখছি, ততই বেড়ে যাচ্ছে আমার চিত্তের অসহিষ্ণুতা, বিষাদের কালো ছায়া মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমাকে ঢেকে ফেলে করে তুলছে ভীতিবিহ্বল। তোলপাড় করা মন নিয়ে, এক মুহূর্তের জন্যও দেরাদুন-মসৌরি থেকে আসা মন্ত্রগম্ভীর চেহারার পাহাড়ি তরুণকে স্মৃতি থেকে সরাতে না পেরে, তার স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলবারটার সামনে ভয়ে কাঁপতে থেকে, গত রাতের সেই একই হ্যালুসিনেশনের কেন্দ্রে মাথা ঢুকিয়ে, ঝট করে মাথা ওপরে তুলে আমি তাকালাম পনেরোই আগস্টের বিরাট এক পোস্টারের দিকে। 

সেই ছবি, সিঁড়িতে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর বুক ভিজে যাচ্ছে রক্তে, পুরো চব্বিশ ঘণ্টা একই ভঙ্গিমায় বসে আছেন তিনি, একজনও নেই যে তাকে ধরে প্রয়োজনে সিঁড়ির ওপরেই একটু শুইয়ে দিল, তারই পায়ের কাছে পড়ে থাকা বড় চাদরের মতো কাপড় দিয়ে তাকে একটু ঢেকে দিল। কিসের কাপড় ওটা? আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেনি কী ছিল ছবিতে দেখা এই কাপড় এবং ছবির ডান পাশে সম্ভবত কালো একদলা রক্ত, ছবির ডান দিকের হাত তার বাম হাত, কনুইয়ের কাছে প্রায় উড়েই গেছে, কাঁধের পেছনে যে সিঁড়ি, তা ভরে আছে নিশ্চিত রক্তেই, কাঁধের ওপর দিকে তাকালে তা-ই তো লাগছে, আর ছবির বাঁয়ে, তার শরীরের ডানে বুকের নিচে ঘটে গেছে সাংঘাতিক ঘটনাটা, স্টেনগানের অজস্র বুলেট মনে হচ্ছে শরীরের ওই জায়গায় একেবারে বড় একটা গর্ত না করে দিয়ে থামেনি; সেই গর্তের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ছবিটা দেখলে, শুধু সাদা পাঞ্জাবির ওপরে বড় কালো প্রায় চারকোনা, প্রায় বর্গাকার একটা ছোপ; বর্গের ওপর ও ডান দিকের রেখা দুটো যেখানে মিলেছে, সেখানে একটা মহা লেপটে যাওয়া, ধ্যাবড়া-জ্যাবড়া অবস্থা। 

এভাবেই পোস্টারের মাঝখানে পড়ে আছেন তিনি, যেমন আমি জানি প্রথম পুরো চার ঘণ্টা তিনি সিঁড়িতে পড়ে ছিলেন, সিঁড়িঘরের নিচ দিকে—মুখ থুবড়ে, উল্টো হয়ে, উপুড় হয়ে; তারপর চার ঘণ্টা পরে সরকারের তথ্য দপ্তরের ক্যামেরাম্যান হাজির হলে তাঁকে সোজা করে, ছবিতে যেমন দেখছি, সেভাবে বসানো হয় সিঁড়িরই ওপর। কিন্তু তার আগে খুনিদের একজন, রাষ্ট্রপতিকে কাছ থেকে আগে কখনো দেখেনি বলে দেখার ইচ্ছা থেকে, তার পায়ের বুটজুতো বঙ্গবন্ধুর শরীরের নিচে ঠেলে দিয়ে, অনেক শক্তিক্ষয় করে তাঁর শরীরকে উপুড় অবস্থা থেকে সোজা করে। আমি ভাবি, আসলেই অনেক শক্তি ছিল ওই লোকের গায়ে, কারণ সিঁড়ির ঢালে কোনো একটা জিনিস ওভাবে উঁচু করে তোলা, তা-ও স্রেফ পা দিয়ে, একেবারে সোজা কথা নয়। 

কোত্থেকে এসেছিল তার এই শক্তি? বিদ্বেষ ও আক্রোশপরায়ণতার শক্তি এত বেশি? এতই বেশি যে তা বাড়িটার একতলা, দোতলা, গেটের কাছের প্রহরীঘর সব এক রক্তের মহাপ্লাবনে ভাসিয়ে দিল মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে, এতটাই যে কার রক্ত কারটার সঙ্গে মিশছে, তা কোনো ব্যাপার নয়, ঠিক কে কে মারা গেল, তা-ও নয়; একটাই ব্যাপার যে এ বাড়ির একজন মানুষও জীবিত থাকবে না—প্রত্যেককে, সবাইকে, একে একে মরতে হবে; তারপর পড়ে থাকুক লাশ, আগস্টের গরমের মাছি এসে বসুক যেখানে পারে, যার ওপরে গিয়ে পারে, পড়ে থাকুক যে যেভাবে আছে সেভাবেই, কাপড়-টাপড় শরীর থেকে সরে গেলেই-বা কী, না গেলেই-বা কী, মহিলা হলেই কী বা পুরুষ কিংবা শিশু হলেই-বা কী। 

এত বড় দ্বিধাহীনতা যদি এত বড় এক দল মানুষের মধ্যে কাজ করতে পারে, অকুণ্ঠিতচিত্তে যদি এভাবে এতগুলো লোক শিশু-মা-বড় বউ-পুত্র-পিতা-মেজ বউ-ভাই-বোন-ভাগনে-ভাগনি-খালা-ফুপা-ফুপু-চাচা সব স্টেনগানের বুলেটবৃষ্টিতে ঠিক এভাবে, জায়গায় জায়গায় টেনে এনে দাঁড় করিয়ে, বসিয়ে, জড়ো করে, আলাদা করে ধুয়েমুছে দিতে পারে, গুঁড়িয়ে-ভেঙে চুরমার করে বিলয় ঘটিয়ে দিতে পারে তো আমার মনে হলো—জ্যাম ছুটে গেছে দেখে পোস্টারটার দিকে ঘাড় কাত করে ও ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে দেখতে মনে হলো—এ পার্থিব পৃথিবীর কেন্দ্রে ভয়াবহ এক অপার্থিবতা রয়েছে, যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা হয় না, এমন এক অপদেবতা খোদার দৃষ্টির নিচেই পৃথিবীকে বিস্ময়কর রকমের ধ্বনিহীন স্বরহীন বীভৎসতার শক্তি, বল ও প্রণোদনা দিয়ে চালাচ্ছে, আর যা কিছু নিত্যদিন আমরা দেখছি, তা স্রেফ পৃথিবীর মেকআপ; পেছনেই গ্রিনরুমে বসে আছে ওই অপদেবতা, পৃথিবীর যুবরাজ এবং সে তার চুলের পনিটেইল হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে ভাবছে যে কোনো মোটিভ ছাড়াই, প্রতিবারই আরও বড় থেকে বড় কুরুচির প্রকাশ ঘটিয়ে যেতে হবে, ধারাবাহিক ও বিরতিহীনভাবে, যেন একসময় মানুষ সত্যি বিশ্বাস করা শুরু করে যে ধ্বংসাত্মক শক্তির উৎস মানুষকে ছাড়িয়ে আছে অন্য কোথাও। —’পবিত্রতার আবরণ পরে ধোঁকা দিতে থাকো ওদের’, মনে করতে পারলাম না কার কথা ছিল ওটা, নিৎশের নাকি দস্তয়েভস্কির? 

দূর থেকে দেখতে পেলাম বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার লাল ও বেগুনি কৃষ্ণচূড়াগাছগুলো এবং যে মুহূর্তে এক সারিতে এক গাদা উঁচু বহেড়াগাছের পাশে দেখলাম ঠিক একটা সোনালু, তাতে শত শত হলুদ-সোনা রং ফুল এবং ঠিক একটা কাঠচাঁপা, বহেড়ার দলটা শুরু হওয়ার সামান্য আগে, পাঁচ ফুট ভেতরের দিকে—আমি বুঝে গেলাম আমি বসুন্ধরায় পৌঁছে গেছি। নিজের চেনা হাজার গাছের লাখো সবুজ পাতার রোদ-চিকচিক মুখের দিকে তাকিয়ে আমার হতোদ্যম অবস্থার উল্টো দিকে পৃথিবীর জন্য ভালোবাসা নিয়ে কিছু একটা ভাবতে যাব, যেমন মার্কাস অরেলিয়াসের কোনো কথা বা পাসকাল থেকে কিছু, কিংবা রবীন্দ্রনাথের প্রভাতের গানের কোনো কলি, ঠিক তখনই ফোন এল আমার প্রকাশকের। 

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি ভালোভাবে ফিরেছি কি না, মুম্বাইয়ের পেঙ্গুইন পাবলিশার্সের অফিসে যাওয়ার সময়টুকু ম্যানেজ করতে পেরেছিলাম কি না এবং এখন কেমন আছি, সব ভালো তো? আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া ঠিক আবার কবে শুরু করতে যাচ্ছি? তার এতগুলো প্রশ্ন শুনে আমি বুঝে গেলাম যা বোঝার। তিনি জানতে চাইছেন, ইনিয়ে-বিনিয়ে, যে আমি ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্রর দ্বিতীয় খণ্ডের কাজে কবে হাত দেব? যেহেতু দু-তিন বছর হয়ে গেছে, দু-তিনটে বইমেলা পার হয়ে গেছে কিন্তু প্রথম খণ্ডটার পর দ্বিতীয় খণ্ড আর বেরোয়নি, ওদিকে আমি ভালোই মোটা অঙ্কের একটা অ্যাডভান্স রয়ালটি তার কাছ থেকে নিয়েছি দু-বছরেরও আগে, সেহেতু তিনি তার অভিজ্ঞতা ও অনুমানের ভিত্তিতে চিন্তিত যে আমি না এবারের, আর মাত্র ছয় মাস পরের, বইমেলাটাও মিস করে বসি। তাকে আশ্বস্ত করার ও সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ পেলাম না। শুধু বললাম যে আজ বিকেলেই এ ব্যাপারে মেহেরনাজের সঙ্গে আমি বসব (মেহেরনাজ নামটা বলতেই আমার এই প্রকাশক বন্ধু স্রেফ এক লহমার জন্য একটা স্মিত হাসি দিলেন ফোনের ও পাশে, আমার তা খেয়াল এড়াল না) এবং আজ রাতেই কাফকার দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ শুরু করব, আর মন-মেজাজ ভালো না বলে যদি আজ না-ও বসি তো অন্তত আজ প্রস্তুতিটা নিয়ে রাখব যেন কাল থেকে অবশ্যই কাজ শুরু করতে পারি, ‘আপনি বেশি চিন্তা করবেন না এ নিয়ে, একবার শুরু হলে জানেনই তো আমার কাজ কেমন ঝড়ের মতো আগায়। 

ফোন রাখতেই মনের ওপর চাপ আরও এক মাত্রা বেড়ে গেল। এই প্ৰকাশক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি স্বেচ্ছাচারিতার যে আচরণ দেখিয়েই চলেছি, বছরের পর বছর, তার কোনো মানে হয় না; তার কাছ থেকে লুকিয়ে চলতে হচ্ছে আমাকে, এরও কোনো মানে হয় না। বাসায় পা রাখতে যাব, মনে পড়ে গেল পাসকালের কথাটা, সম্ভবত যেটা মনে করতে চাইছিলাম একটু আগে যে, “নিঃসন্দেহে তুমি সেই খোদা যে আপনাকে লুকিয়ে রেখেছ।’ আর পাসকাল মনে পড়ামাত্র খুলে গেল জট। ‘পবিত্রতার আবরণ পরে তুমি ধোঁকা দাও ওদের’, কথাটা নিৎশেরও না, দস্তয়েভস্কিরও না, বাইবেলের। ‘মিথ্যা নবীদের ব্যাপারে সাবধান। ওরা আসে ভেড়ার পোশাক পরে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওরা রাক্ষুসে নেকড়ে’, এ কথার ঠিক আগে বা পরেই ছিল কথাটা, এমন যে, ‘তারা তাদের বাহ্যিক আবরণের মধ্যে একটা ঈশ্বরতুল্য ভাব ধরে রাখে, যদিও সেই ভাবের আসল শক্তিকেই তারা অস্বীকার করে; তাদের এড়িয়ে চলো।’ 

কী সংযোগ আছে এ কথার সঙ্গে আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনার বা আইয়ারের সঙ্গে আমার আচরণের? আদৌ কি সংযোগ আছে কোনো? মানুষের চিন্তা কীভাবে কাজ করে? চিন্তাকে কি ডেকে আনা হয়, না চিন্তা নিজেই আসে সেই অপ্রবেশ্য কুঠুরির ভেতর থেকে, যার নাম আমরা দিয়েছি অবচেতন, যেখানে বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকে স্মৃতি এবং হঠাৎ হঠাৎ দু-চারটেকে ঠেলে দেয়, চিন্তার রূপে, ওপরের দিকে? কিন্তু চিন্তা শুধু স্মৃতি থেকেই আসবে কেন? সক্রিয়ভাবেও তো আমরা চিন্তা করি। বলি যে, ‘গভীর চিন্তায়’ আছি; বলি যে, ‘এত ক্লান্ত যে এখন চিন্তা করতে পারছি না’; কাউকে বলি সে দ্রুত চিন্তা করতে পারে;’ কাউকে বলি ‘খুব ধীরে চিন্তা করেন উনি।’ যেটাই হোক, চিন্তা আমরা করি; চিন্তা করা, ভাবা, মানুষের সহজাত, ঠিক যেমন ওড়া, পাখির; আর সাঁতার কাটা, মাছের। কিন্তু পাখি যেমন ওড়ার সময় জানে না এরোডাইনামিকসের নিয়মকানুন এবং মাছ যেমন সাঁতারের সময় জানে না ভেসে থাকার পদার্থবিজ্ঞান, তেমন, ঠিক তেমন আমারও মনে হলো আমার চিন্তাগুলো কীভাবে আসে, এমন হিজিবিজি চেহারায়ই বা আসে কেন, আর ওগুলো এমন অপরিচ্ছন্ন, অস্বচ্ছ চিন্তাই-বা কেন, তা আমার জানা নেই। 

আমার চিন্তা করার ফ্যাকাল্টি নিয়ে এবং সেই চিন্তাগুলোকে ভাষায় সাজানোর ও ব্যক্ত করার অক্ষমতা নিয়ে নিজের প্রতি হীনতার বোধে ভুগলাম কিছুক্ষণ। মাথা বিছানার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে, জোরে বিছানার সঙ্গে নিজের শরীর চেপে ধরে থাকলাম। চোখ বোজা ঘোর অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেলাম ট্রাফিক পুলিশদের মুখ, চার চায়নিজ স্মাগলারের মুখ, প্লেনে আমার সাহায্যে দৌড়ে আসা এয়ারহোস্টেসের মুখ, আইয়ারের মুখ, হ্যালুসিনেশনে হাজির হওয়া দেরাদুনের পাহাড়ি তরুণের মুখ, ল্যাপটপের স্ক্রিনে উদ্ভাসিত বিউটিশিয়ান নিহত মারিয়াম শেখের মুখ, সিঁড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা বসে থাকা আমাদের রাষ্ট্রপতির মুখ—যার নামের মধ্যেও আছে ‘শেখ’ শব্দটা—এবং আলবারতিন ও মেহেরনাজের মুখ। 

বিরাট শক্তিতে নিজের শরীর বিছানা থেকে ওপর দিকে ঠেলে দিয়ে, ওই উপুড় হয়ে চোখ বুজে দেখতে থাকা ইমেজের পরে ইমেজের, মূলত অনেক ইমেজ মিলে আমার মাথার মধ্যে জটপাকানো এক সিনেমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম আমি মেহেরনাজকে ফোন দিলাম, তাকে বললাম সে যেন শেষ বিকেলের দিকে চেষ্টা করে একটু আসতে, কাজ আছে। মেহেরনাজ আমাকে জানাল, আমি চাইলে সে এখনই আসতে পারে, কারণ পাশেই ভার্সিটির ক্যাম্পাসে আছে সে। আমি বললাম, ‘আমি ঘুমাব, পারলে সন্ধ্যার দিকে আসো।’ 

মেহেরনাজকে আমার ভালো লাগে সম্ভবত শুধু তার নামের কারণে। কী এক পৃথিবীর ঊষাকালের নাম এটা—করিতকর্মা, আবার একই সঙ্গে নির্লিপ্ত; সাংগীতিক আবার একই সঙ্গে নর্তনশীল; কল্যাণকামী আবার একই সঙ্গে দুঃখী; আমার হিসেবে যে নামের ব্যাপ্তি বড় কোনো কাশবনের ব্যাপ্তি, গভীরতা নিবিড় আঁধার কোনো জলকুয়ার গভীরতা, আর চরিত্র বাহ্যিকভাবে শক্তির, কিন্তু ভেতরে অনেক কাঁপুনির। সুস্থ একটা নাম এটা, ধ্বনিঝংকারে ভরপুর; এবং শায়িত কোনো নাম নয়, দণ্ডায়মান এক নাম মেহেরনাজ। নামের যদি ঋতু থাকত, তাহলে আমি বলতাম, মেহেরনাজ হেমন্ত ঋতুর; যদি সময় থাকত, তাহলে বলতাম, মেহেরনাজ সন্ধ্যাবেলার এবং ফের রাত্রি দ্বিপ্রহরের; আর যদি রং থাকত, তাহলে বলতাম মেহেরনাজ মূর্তিমান অর্ধচন্দ্রাকার এক নেভিরু। 

মার্সেল গ্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইম, যা আগাগোড়া একবার পড়েছি একটানা, আর সাত খণ্ড খাপছাড়া খাপছাড়া, এখান ওখানে এক প্যারা, দুই প্যারা করে পড়ছি বহু বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন, সেখানে নাম নিয়ে বলা হচ্ছে যে এই সব নাম, এই নামগুলোর ছাঁচের মধ্যে আমরা যে জানা-অসম্ভব ছবিগুলো ধরে রাখি, আবার একই সঙ্গে নামগুলোর বাইরে বাস্তবের একটুখানি জায়গাও আলাদা করে রাখি নিজেদের জন্য, সেই নামগুলো আমাদের বাধ্য করে এই জানা-অসম্ভব এবং এই বাস্তবের মধ্যে যোগ ঘটাতে, এতখানিই যে ‘আমরা কোনো শহরের নামের মধ্যে খুঁজতে যাই শহরের আত্মাকে, যে আত্মার সেখানে থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদেরও আর ক্ষমতা নেই ওই আত্মাকে শহরটার নাম থেকে তাড়ানোর।’ 

এখানেই থামেননি প্রুস্ত, তিনি নাম নিয়ে এগিয়ে গেছেন আরও অনেক দূর—ওরিয়ান গিয়েরমঁত নাম নিয়ে তার ফ্যান্টাসি, এই ডাচেস গিয়েরমঁতকে নিয়ে তার অবসেশন গ্রুস্তের হারানো সময় খুঁজে ফেরা সাত খণ্ড উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের পুরোটাজুড়ে ভালোবাসার এক ব্যাকুল আভা ও তিক্ত ক্ষার ছড়িয়েছে। 

আর গিয়েরমঁত নামটা, আমার সেই শৈশবের অংশ ছিল ওটা, যেন ঠিক সেই ছোট ছোট বেলুনগুলোর মতো, যেগুলো ভরা থাকত অক্সিজেন বা অন্য কোনো গ্যাসে : ওই বেলুন এখনো যখন ফোটাই এবং ওর ভেতরের গ্যাস মুক্ত করে দিই, তখন শ্বাসে নিতে পারি সেই বছরের, সেই দিনের কুম্বরে শহরের বাতাস, যাতে আজও মিশে আছে স্কোয়ারের কোনা থেকে আসা হোথর্ন ফুলের সুবাসের দমকা, আর তা জানান দিচ্ছে বৃষ্টি আসার …। 

মেহেরনাজের সঙ্গে আমার কোনো প্রেম নেই। মেহেরনাজ আমার হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজনা, হঠাৎ হঠাৎ উদ্বেগ, আমার আলবারতিন। মার্সেল জানে আলবারতিনকে কোনো দিন পুরোপুরি পাওয়া হবে না তার, তা অসম্ভব, কারণ আলবারতিনের জন্য তার মনস্কামনা, আলবারতিনের পুরোটা জীবনকে নিজের দখলে পাওয়ার তার সেই কামনা ভরে আছে ব্যথায়, কারণ মার্সেল বোঝে যে ওটা অর্জন অসম্ভব এক চাওয়া। কী করে কাউকে পাওয়া সম্ভব তার পুরো জীবনসহ? আলবারতিনকে নিয়ে কী ভয়ংকর এই চাওয়া ছিল মার্সেলের। ঘুমিয়ে পড়লাম আমি, কিছু না খেয়েই। 

.

ঘুম থেকে যখন উঠেছি, তখন বিকেলের শেষ ভাগ, আকাশের রং কোথাও ম্যাজেন্টা, কোথাও জাফরান, আর বড় অংশেই স্প্রে-পেইন্ট করা হালকা ক্রিমসন। বুকের ওপরে আমি অনেক বড় ভার অনুভব করলাম আমার শোবার ঘরের জানালা থেকে দিগন্তের এই বহুবর্ণ আশীর্বাদের দিকে তাকিয়ে। মেঘের মতো আমার দৃষ্টি তখন ঘোলা, বুকের ভেতরেও সব ঘোলা, কোনো কিছু স্বচ্ছ নয়, স্পষ্ট নয়। একই মিনিটের মধ্যে দেখলাম, জোরে শ্বাস নিয়ে নিয়ে যে আমার ভালোও লাগছে, আবার দুই সেকেন্ড পর খারাপও লাগছে, আবার ভালো, আবার খারাপ, থেমে থেমে, কিন্তু শেষমেশ বুক ভার বোধটাই বেশি। গোসল সারলাম ঝটপট, যেকোনো সময় মেহেরনাজ এসে পড়বে। রান্নাঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুলে দুধ বের করে গরম করলাম, কর্নফ্লেক্স খেয়ে ফেললাম পুরো বড় এক বাটি, তাতে দিয়ে দিলাম বাদাম, কিশমিশ, কলা ইত্যাদি ইত্যাদি। মন শুধু চলে যাচ্ছে, খেয়াল করলাম, প্রুস্তের দিকে, আর আমার কিনা মনকে নিতে হবে ফ্রানৎস কাফকায়, কারণ যেকোনো বড় লেখকে ঢোকার জন্য, কাফকায় তো অবশ্যই, সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি মনের প্রস্তুতি, যার কোনো বিকল্প নেই। ‘স্মৃতির পীড়ন-জ্বালাতন সবকিছুর যোগ হৃদয়ের থামা থামা বিরতির সঙ্গে’, আবার প্রস্ত। আমি আমার পড়ার ঘরের দিকে প্রায় ধেয়েই চললাম কর্নফ্লেক্সের বাটি রান্নাঘরের সিঙ্কের ওপরে জোরে আছড়ে ফেলে, মুখ মুছতে মুছতে। কাফকায় ঢোকার ইচ্ছা প্রায় তিরোহিত, মনে একটাই তীব্র ইচ্ছা যে গ্রুস্তের শেষ খণ্ডটা— টাইম রিগেইনড নিয়ে বসব, যখন কিনা সন্ধ্যা নামছে বাইরে। ভালো। নামুক। সবই বাঁধা নিয়ম, সন্ধ্যাকে নামতেই হবে ব্যতিক্রমহীনভাবে, কড়াক্রান্তি মেনে। 

পড়ার ঘরে ঢুকে চমকে উঠলাম। নতুন কোনো ঘটনা দেখলাম বলে নয়, একদম আশা করিনি বলে। আমার বইয়ের তাক, তার পাশে লেখার টেবিল, তার বাম পাশে পেছনের দিকে আড়াআড়ি রাখা একটা বড় সোফা, যাতে কেউ শুতে পারে অনায়াসে, একটা বালিশও রাখা থাকে সেখানে, কারণ মাঝেমধ্যেই ওটাতে টান টান শুয়ে, বালিশ ভাঁজ করে উঁচু করে নিয়ে সোফার হাতলে রেখে আমি পড়ি বা ঘুমিয়ে পড়ি—দেখি সেখানেই ঘুমিয়ে আছে মেহেরনাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে আমার ছাত্রী, অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী, আজ দুবছর ধরে সে আছে একই বছরে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামভিত্তিক পড়াশোনার ওপর সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, যদিও তার ভাষ্যমতে আমি তাকে পড়াশোনার এত বহুধাবিভক্ত দিকের সন্ধান দেখিয়েছি যে, ‘স্যার, আমি আমার কম্পাস হারিয়ে ফেলেছি।’ 

এ বাসার দুটো চাবির একটা তার কাছে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে, সে প্রায় বিড়ালের মতো নিঃশব্দে তালা খুলে ঘরে ঢুকেছে, অতি সাবধানে আমার বেডরুমে উঁকি দিয়ে দেখেছে যে আমি ভোরের প্লেনে এসে (তাকে এটা বলতে হয়নি যে, সারা রাত জেগে ভোরের প্লেনে এসে) ঘুমিয়ে আছি ভূতের মতো করে, তারপর আবার নীরবে সে আমার পড়ার ঘরে ঢুকে, হাতে পেঙ্গুইন মডার্ন ক্লাসিকস-এর ম্যালকম প্যাসলির অনুবাদে কাফকার দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না অ্যান্ড আদার শর্ট ওয়ার্কস্টা নিয়ে পড়তে পড়তে—আমার মতোই মানসিকভাবে তৈরি হওয়ার ইচ্ছা থেকে নিশ্চয়—নিজেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে। ‘জ্য মেতাই এমবারখে সুর লে সুম্মে দ্য আলবারতিন’, ‘আই হ্যাড এমবারকড আপন দ্য টাইড অব আলবারতিন’স স্লিপ,’ ‘আই হ্যাড সেট সেইল অন আলবারতিন’স স্লিপ’, ‘আমি পাল উড়িয়ে দিলাম আলবারতিনের ঘুমের মধ্যে’, ‘আমি জাহাজ ছাড়লাম আলবারতিনের ঘুমের ঢেউয়ের ওপরে।’—একটা পুরো পৃথিবীর পরমায়ুর মধ্যে যতটা মায়া ধরে, আত্মা আবিষ্কারের পর থেকে এই হ্রস্বজীবনের চিরজীবিতার মধ্যে যতটা স্নেহচ্ছায়া ভরে রাখা সম্ভব, ততটার পুরোটা নিয়ে আমি পড়ার চেয়ারে কোনো শব্দ না তুলে বসে, চেয়ারের গোলটা ঘুরিয়ে, পাল ওড়ালাম মেহেরনাজের ঘুমের ঢেউগুলোর ওপরে। তার চুল টান টান করে পেছনের দিকে বাঁধা, চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে প্রায় নিঃশব্দে, শুধু অতি ক্ষীণ এক শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ, মনে হচ্ছে ওই শব্দ তাকে তাল মিলিয়ে নিতে দিচ্ছে ঢেউয়ের আসা ও যাওয়ার নির্দিষ্ট বিরতির যে ফেনা ওঠানো কিন্তু সুবিন্যস্ত মোজাইক, তার সঙ্গে। পুরো দশ-বারো মিনিট সময়ের অপশাসনকে ভুলে থাকলাম আমি ‘নিগূঢ়’ ‘প্রগাঢ়’ মেহেরনাজের ছলশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে। 

‘গভীর আলবারতিন, তাকে আমি দেখলাম ঘুমাচ্ছে, মৃত’। ইংরেজি অনুবাদে বলা হয়েছে ‘প্রোফাউন্ড আলবারতিন’, এবং অন্য এক অনুবাদে ‘দ্য ডেপথস অব আলবারতিন’। ‘প্রোফাউন্ড’ আলবারতিনের কোনো অর্থ হয় না, এভাবে কেউ বলে না ওই ভাষায়। কিন্তু প্রুস্ত ফরাসিতে সেটা বলেছেন, যেমন আমি ওপরে বললাম— ‘প্রগাঢ়’ মেহেরনাজ। প্রগাঢ় রং হয়, মানুষ কি হয়? আলবারতিন বেঁচে থাকতে তার জন্য মার্সেলের ভালোবাসা মার্সেলকে যন্ত্রণা, ঈর্ষার কাঁটার ক্ষত ও নৈরাশ্যই দিয়েছে শুধু, কারণ মার্সেল তাকে সন্দেহ করে গেছে সব সময়, তাকে ভালোবাসতে চেয়েছে তার গলা টিপে ধরে রেখে, ভয়ংকর অবসেসিভ-পজেসিভ সে ভালোবাসা, উদারতার চেয়ে নিঠুরতাতেই তা ভরা বেশি। আর এখন মার্সেল দেখছে প্রেমের ভয় ও অনিশ্চয়তার ব্যথা সব দূর হয়েছে আলবারতিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, কিংবা তার মৃত্যুর আগে থেকেই তাকে হয়তো ভালোবাসা থামিয়ে দিয়েছে মার্সেল, কিন্তু ওই যে তার ব্যথার মৃত্যু ঘটেছে, তাতেই বিরাট কষ্ট পাচ্ছে সে, আলবারতিনের মৃত্যুতে নয়। ‘মানুষের দেহের মধ্যে থাকে,’ বলছে মার্সেল, ‘অতীতের প্রতিটা ঘণ্টা’, এবং এখন তার বর্তমান জীবনের পাতলা বরফের ওপর দাঁড়িয়ে ‘আলবারতিনের গভীরতাকে’ খুঁজে ফিরতে পারবে সে, কারণ আলবারতিন চলে গেছে (‘Mlle Albertine est partie’) অনেকগুলো অর্থেই—মারা গেছে সে; তার প্রতি আমার বাসনার মৃত্যু ঘটে গেছে; আমার স্মৃতি থেকে সে এখন তিরোহিত হবে; শীঘ্রই সে এমনকি স্মৃতির স্মৃতিও থাকবে না আমার কাছে। 

মৃত্যু, সবকিছু সে কীভাবে ধুয়েমুছে দেয়; মানুষ আসে, মানুষ চলে যায়, কিন্তু যখন যায়, তখন নিশ্চিতি দিয়েই যায় যে সে আর কখনোই ফিরবে না, অতএব যারা থেকে যায়, তাদের আর কোনো জবাবদিহির ভয় থাকে না মৃতের প্রতি। যে যায়, সবাইকে মুক্ত করে দিয়েই সে যায়, আর যে মুক্ত হয়, সে-ও একইভাবে অন্য কাউকে মুক্ত করার জন্যই আপাতত মুক্ত হয়। 

কে বানিয়েছে এই পাষাণ পৃথিবী? আর যদি বানিয়েছেই তো এমন অর্থহীনতা ও মর্মস্পর্শী রকমের চক্রাকার পুনরাবৃত্তির এ পৈশাচিক ছাঁচেই বানিয়েছে কেন? অমার্জনীয় এই অপরাধের দায় আমি কাকে দেব, তা ভাবতে ভাবতে, মাথার চুল হাতের মধ্যে নিয়ে দুহাতের কনুই দিয়ে নিজের হাঁটুর ওপরে ‘উহ্’ শব্দ করে গুঁতো মারতে মারতে হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে উঠে মেহেরনাজকে ঝাঁকি মেরে উঠিয়ে দিলাম ঘুম থেকে। 

চোখ খুলেই মেহেরনাজ দেখল তার মুখের ওপর আমার মুখ। সে ভাবল—জানি না কী ভাবল? বোকা সে, তার ধারণায়ও নেই যে আমি মার্সেল ও আলবারতিনের প্রেম নিয়ে কী কথা ভাবছি এবং এই মুম্বাই সফরে দিনে দুই ঘণ্টা ঘুমানো মানুষ দেখে আর এক মৃতদেহে ভরা ভৌতিক খাঁড়ি দেখে আমার মধ্যে কী ঘটে গেছে। হ্যাঁ, বোকা সে, কারণ সে তার মুখ ঢাকল হাত দিয়ে, সে ভেবেছিল আমি তাকে চুমু খেতে আমার মুখ তার মুখের ওপরে নিয়েছি, তাই তার ঘুমের পরের মুখের গন্ধ নিয়ে ভয় পাচ্ছিল সে। হাহ্, প্রোফাউন্ড মেহেরনাজ, নিগূঢ় মেহেরনাজ, এত ফিনফিনে চিন্তা তুমি করলে কী করে, তাও এই ভরা সন্ধ্যাবেলায় যখন পরিবেশের কারণে, আকাশের কাঞ্চনবর্ণের সঙ্গে বার্নুসিনা ও হিঙ্গুলবরণ মেশার কারণে এবং আকাশের নিচের অংশজুড়ে শালিক-শ্যামা ও ওপরভাগে দল বেঁধে রাঙামুড়ি পাখিগুলো ঘরের দিকে উড়ে যাওয়ার কারণে এ পৃথিবীর কোনো কিছুকেই লাগে না অনন্তকাল জীবিত, শাশ্বত-কোনো অর্থ, কোনো সৌন্দর্য, কোনো কামনা-বাসনা, কিছুই নয়, বরং যখন সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার মধ্য দিয়ে এক ঝলকের জন্য সব দেখে ফেলা যায় দিনের শেষ আলোয়, চকিতে: মানুষের সব দুর্দশা ও মূঢ়তা, সব প্রশংসালিপ্সা ও বিশ্বাসঘাতকতা? ‘এই সন্ধ্যায়, সময় হারিয়ে যাচ্ছে পাখির ডানায় করে’, মেহেরনাজকে বললাম আমি কবিতার ঢঙে। আমার কণ্ঠে কী ছিল জানি না, মেহেরনাজ সিরিয়াসলি নিল আমাকে, সে সোফায় বসতে বসতে ব্যাখ্যা করল কীভাবে কিছু জিনিস কখনোই হারিয়ে যায় না, তারা শাশ্বত ও চিরকালীন, যেমন আকাশ, যেমন সন্ধ্যার মেঘের রং কিংবা মায়ের আদর। আমি চাইলাম না তার সঙ্গে তর্ক করতে কিংবা তার চিন্তার কুঠরিতে দলা দলা অন্ধকার ছুড়ে দিতে, যদিও আমার বলতে ইচ্ছা করল যে, যেহেতু আমি থাকব না, তাই কিছুই আমার কাছে শাশ্বত নয়, সবই আমার কাছে স্রেফ সত্তর বছরের মাপে ও ছাঁচে ফেলার যোগ্য জিনিসমাত্র। 

মেহেরনাজ বাথরুমে গেল, আমার ধারণায়, তার দাঁত ব্রাশ করতে। এ বাসায় তার এক-দুই সেট টুথব্রাশ ও পেস্ট বাথরুমে রাখাই আছে। ফিরে এসে আমাকে তাড়া দিল সে, বইয়ের তাকে রাখা পাঁচ-ছয়টা ফ্রানৎস কাফকা একসঙ্গে টেবিলে রাখল, ওগুলোর সঙ্গেই রাখা ছিল তার নোটবই, সেটা সে খুলল এবং আমাকে দেখাল যে কীভাবে আজ থেকে সাত-আট মাস আগে বেশ কয়েক দিন খেটে সে এই একই জিনিসের কাফকার মৃত্যুর পর প্রকাশ হওয়া লেখাগুলো নিয়ে গল্পসমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডের—ফুল প্ল্যানিং করে রেখেছে। 

আমি দেখলাম তার হাতে একটা কাফকা, বইয়ের নাম : প্যারাবলস অ্যান্ড প্যারাডক্স। মেহেরনাজ বলল, ‘স্যার, এটার মধ্যে আমি কিছু ছোটগল্প পেয়েছি, যা ম্যালকম প্যাসলি, জয়েস ক্রিক বা এভরিম্যানস এডিশনে নেই, যেমন “দ্য টাইগার”। তো, এগুলো কি যাবে এই খণ্ডে?’ এটুকু বলে থামল মেহেরনাজ। আমি বললাম, ‘গুড। শেষ?’ মেহেরাজ মাথা নাড়ল। আমি বললাম “টাইগার” আমি পড়িনি, খুঁজে বের করে পড়ো তো।’ 

মেহেরনাজ সময় নিল না একটুও, যেন টাইগার তার হাতের মুঠোতেই ছিল, সেভাবে সে খাঁচাছাড়া করল কাফকার টাইগারকে, বলতে লাগল : ‘একবার পশু পোষ মানানোয় বিখ্যাত জনাব বারসনের কাছে আনা হলো একটা বাঘ, আনার উদ্দেশ্য এটুকু জানা যে এই বাঘ পোষ মানানো সম্ভব কি না। বাঘের ছোট খাঁচা, যার মধ্যে বাঘটা আছে, ঠেলে দেওয়া হলো প্রশিক্ষণ খাঁচার ভেতরে, যার মাপ একটা পাবলিক হলঘরের সমান; প্রশিক্ষণ খাঁচাটা রাখা শহর থেকে অনেক দূরের এক বড় ছাউনি-বাড়ির ভেতরে। বারসনের কর্মচারীরা সব সরে গেল ওখান থেকে। বারসন সব সময় চান যে যখন কোনো পশুর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হবে, তখন যেন ওখানে আর কেউ না থাকে। বাঘটা চুপচাপ শুয়ে আছে, যেহেতু তাকে একটু আগে পেট পুরে খাওয়ানো হয়েছে। হাই তুলল বাঘটা একটুখানি, তার চারপাশের নতুন পরিবেশের দিকে তাকাল ক্লান্ত চোখে এবং তারপর, কোনো দেরি না করে, ঘুমিয়ে পড়ল।’ 

আমি মেহেরনাজকে বললাম, ‘চমৎকার। বাঘ এমনিতেই পোষ মেনে গেছে বন থেকে বের হওয়ার পরে, কিংবা ওই ছোট খাঁচায় ঢোকামাত্র। ভালো।’ মেহেরনাজ জানতে চাইল, ‘কাফকা কী বোঝাচ্ছেন এখানে?’ আমি বললাম, ‘এটা টিপিক্যাল কাফকা। মানুষ এই পৃথিবীতে এসে বুঝে যায় যে তার সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে। পৃথিবী বন্ধুহীন, ভয়জাগানো এক জায়গা কিন্তু মানুষ তা মেনে নেয়, কোনো বিবাদ, প্রতিবাদ করে না, পোষ মেনে যায় সে প্রথম দিন থেকেই—এ রকম একটা কিছু হয়তো বলছেন কাফকা, ঠিক শিওর না আমি।’ 

আমরা দুজনে চুপচাপ বসে আছি। মেহেরনাজ সোফা থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরল, জিজ্ঞাসা করল যে আমার মন খারাপ কি না। আমি তাকে উত্তরে বললাম, “আমার এখন কাফকা ভালো লাগছে না, আমি মানসিকভাবে আছি মার্সেল গ্রুস্তের মধ্যে। মেহেরনাজ খেপে উঠল এই বলে, ‘স্যার, আপনার বোঝা উচিত ওই প্রকাশক বেচারার অবস্থাটা, বইমেলার আর মাত্র ছয় মাস বাকি। এখন মার্সেল প্রুস্তের সময় নেই, প্লিজ। আর আপনার এই প্রস্ত-প্রুস্ত-প্রুস্ত অনেক হয়েছে, স্টপ ইট, লেটস ফোকাস।’ 

মেহেরনাজের এই ধারালো বাক্যের পর আর কোনো কথা হয় না। আমার জন্য মায়া আছে বলেই সে এতটা খেটে সব গুছিয়ে রেখেছে। সে সত্যিই চায় আগামী বইমেলায় আমি কাফকা গল্পসমগ্রের এত দিনের ঝুলে থাকা বিষয়টার নিষ্পত্তি করি। ‘প্রথম খণ্ডে আপনার ভালোই নাম হয়েছে, বই চলেছেও ভালো, আবার সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন, ভালো রয়ালটির টাকাও পেয়েছেন, তাহলে সমস্যা কোথায়?’ এগুলো পুরোনো কথা। আমি তাকে বলতে পারিনি যে সমস্যা কী। সমস্যা অর্থহীনতার-একটা জিনিস নিয়ে বহুদিন মেতে থাকার পর বুঝে যাওয়ার সমস্যা যে সময় বেশিই ব্যয় করা হয়ে গেছে, এত সময় আসলে কারও জীবনেই নেই, তাই কাফকার পুরোটাই এখন আমার জন্য হারানো সময়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শোক করার সময়। এরই মধ্যে আবার নতুন করে আমি কাফকায় হাত দিই কী করে? 

আমার নীরবতা লক্ষ করে মেহেরনাজ কী বুঝল জানি না, সে উঠে দাঁড়াল এবং বলল যে আজ আমি রেস্ট নিতে পারি, মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দু-একটা গল্পে চোখ বোলাতে পারি, কিন্তু কথা হচ্ছে কাল থেকে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ দিয়ে এই কাজ শুরু হতেই হবে, ‘নতুবা আমি আর এ বাসায় আসব না। আমার ভালো লাগে না এসব। প্রকাশকের কাছ থেকে অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে তারপর কাজ শুরুও না করা, এটা ঠিক না।’ আমি তাকে বললাম, “ঠিক আছে, এবং এরপর গ্রুস্তের ছয়টা বইয়ের একটা হাতে নিয়ে আগে থেকেই ভাঁজ করে রাখা পাতা খুলে তাকে বললাম, হোর্থন ফুল নিয়ে মার্সেলের চিন্তাটা শুনে তারপর যেন সে যায়। আমার পড়ার রুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে মেহেরনাজ, তার মেরুদণ্ড বেশি রকমের খাড়া, তার শরীরের ভঙ্গিতে খুব কর্মঠ এক মানুষের ছায়া স্পষ্ট এবং তার ঠোঁটের মধ্যে এক ক্ষীণ তেল-চকচকে ভাব। 

তারপর আমি ফিরলাম হোর্থন ফুলগুলোর কাছে, ওগুলোর সামনে দাঁড়ালাম যেভাবে কেউ দাঁড়ায় পেইন্টিংয়ের কোনো মাস্টারপিসের সামনে; তখন অন্য কোনো কিছুর দিকে এক মুহূর্ত তাকানোর পরই মনে হয় যে বরং এই মাস্টারপিসটাই দেখি। সে জন্য হাত দিয়ে যে ছবি আঁকার পর্দা আঁকলাম, তাতে অবশ্য কাজ হলো না কোনো। এর চেয়ে ফুলগুলোতে মনোযোগ দেওয়াই ভালো; ফুলগুলো আমার মনে যে অনুভূতি জাগাল, তা আবছায়া ও অস্পষ্ট। আমি চেষ্টা করলাম নিজেকে মুক্ত করে আনতে। ব্যর্থ হলাম চাচ্ছিলাম ভেসে যাব, হোর্থনগুলোর সঙ্গে মিশে এক হয়ে যাব। 

মেহেরনাজ বলল, ‘আমার প্রুস্ত ভালো লাগে না, আপনি এত বলার পরও না। 

আমি তাকে বললাম, ‘প্রুস্ত ছাড়া কোনো প্রেম হয় না।’ এই প্রথম, দীর্ঘদিনের মধ্যে এই প্রথম, এ রকম কোনো চটুল কথা বেরোল আমার মুখ থেকে। 

মেহেরনাজ বলল, ‘সরি। আপনার সঙ্গে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। আমার ভালো লাগে, তাই আমি আপনার সঙ্গে মিশি। প্রেম থাকলে বিয়ে করতে বলতাম, অন্তত একবার হলেও।’ এটুকু বলে সে থামল, ফের জিজ্ঞাসা করল, আগামীকাল আমি ক্লাস নিতে যাব কি না, নাকি কাল আমার ছুটি? আমি জানালাম, ‘কাল অবশ্যই ক্লাস নিতে যাব, ‘ এবং এখন সে চলে গেলে, ‘ক্লাসের জন্য কিছু প্রিপারেশন নেব।’ 

মেহেরনাজ চলে যাওয়ার পর আমি এথিকস ও মরালিটির মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে বসলাম। কাল ক্লাসে এটাই পড়াব। বিশাল টপিক, এতই বিশাল ও তলহীন যে আমার মাথা একটু পরই ঝিমঝিম করতে লাগল। শুধু গ্রিক শব্দ ‘এথোস’ ও লাতিন শব্দ ‘মরালিস’, এ দুয়ের মিলই যথেষ্ট ভারটিগো সৃষ্টি করার জন্য। খুনির লইয়ারের উদাহরণটা ভালো লাগল : লইয়ার সাহেবের মরালিটি বলছে যে খুন করা অপরাধ, যে খুন করে তার সাজা হওয়া উচিত; আর পেশাদার লইয়ার হিসেবে তার এথিকস বলছে, ওই খুনি যেহেতু তার ক্লায়েন্ট, তাই তাকে আদালতে মনেপ্রাণে খুনির পক্ষেই লড়তে হবে, যদিও সে জানে যে তার ক্লায়েন্টই খুনটা করেছে। কিন্তু এই সুন্দর উদাহরণের ফাঁকিটা ধরতে আমার বেশি সময় লাগল না। কারণ, আমি এথিক্যালি শতভাগ সঠিক এমন মানুষ দেখেছি যাদের নৈতিকতা বলে আসলে কিছু নেই। আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়েই ভাবা যাক। এখানে খুনি নিজে নিজেকে ভাবতে পারে এথিক্যালি সঠিক ‘খুন’ করেছে সে, এবং যেহেতু তা সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী গ্রুপের বিদ্রোহের অংশ ছিল, সেহেতু প্রথমত ওই-জাতীয় নিধন কোনো ‘খুন’ই ছিল না; আর যেহেতু এথিকস সামাজিক ব্যবস্থার অংশ, বাহ্যিক, মরালিটির মতো ব্যক্তির নিজের ভেতরের বিষয় নয়, এবং সামরিক বাহিনী যেহেতু একটা সমাজ, তাই এটা যদি ‘খুন’ হয়েও থাকে, তবু কাজটা তার জন্য করা সঠিক ছিল। এথিকসের প্রশ্নে এখানে একজন খুনি আবার ভাবতে পারে যে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন বলে আমি এ ক্ষেত্রে কাজটাকে আমাদের বাহিনীর প্রফেশনাল গাইডলাইনের অংশ বলেই ভেবেছিলাম। 

আবার এলেবেলে চিন্তা। মরাল ফিলসফি আর পড়তে ইচ্ছা করল না। মনে হলো ক্লাসে যা হয় হবে। দেখা যাবে আগের প্রস্তুতিকে চোরকুঠুরির ভেতর থেকে মস্তিষ্কের সামনে ঠেলে দিচ্ছে স্মৃতি, এবং আমি তরতর করে ব্যাখ্যা করে চলেছি মরালিটি ও এথিকসের উৎস, গ্রহণযোগ্যতা, নমনীয়তার মাত্রা ইত্যাদি সবকিছু। আগস্টের খুনের কথা ভাবতেই মনে হলো—যদিও ছাত্রদের কাছে এটা বলা যাবে না-এই ফিলসফির তত্ত্বগুলো শুধু অদরকারিই না, নৈতিকতার জন্য বিপজ্জনকও। কারণ, এর যুক্তি মানুষকে স্বার্থপর ও বিচ্ছিন্ন করে দেয়; রুশো যেমন বলেছেন, ‘মানুষ তত্ত্বের আড়ালে লুকিয়ে অন্যের বিপদ ও দুঃখ দেখতে দেখতে তখন গোপনে বলে, “মর তুই, তাতে আমার কী? আমি তো ভালো আছি।”’

কিছুটা সময় যেতে দেখলাম মন আমার বিক্ষিপ্ত, সে কোনো একটা ভারের নিচে হতোদ্যম হয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। আমি নিচে নেমে এলাম রাস্তায়, হাঁটতে লাগলাম রাতের বসুন্ধরা ধরে, একবার অ্যাপোলো হাসপাতাল পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে সেখান থেকে বসুন্ধরা কমিউনিটি সেন্টার, আবার উল্টো দিকে একই পথে। প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার হবে আমার বাসা থেকে এই পুরো পথ, সেটাই শেষ করলাম ঘামতে ঘামতে। এই অন্ধকারেও একটা জিনিসই শুধু চোখে পড়ল যে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গাছ লাগানোর বেলায় কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম মানা হয়নি, এবং আজ রাতে, একধরনের বিশেষ মানসিক অবস্থায়, অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমার প্রথমবারের মতো মনে হলো যুক্তি দিয়ে নয়, বরং আবেগ দিয়ে যারা এভাবে গাছ লাগিয়েছে, গাছ লাগানোর নিয়ম ভেঙেছে, তারা ঠিক কাজটাই করেছে। এই বিচিত্রতা প্রাকৃতিক জঙ্গলের বিচিত্রতা, শহরের সাজানো বাগানের জ্যামিতির নকশা নয়। এটাই ভালো। কর্পূরগাছ দেখলাম তিনটা, তার পাশেই একগাদা ফার্ন–অ্যাডিয়েন্টাম, বার্ড নেস্ট ইত্যাদি, আবার তার পাশে দুটো কাঁঠালগাছ, তারপর তেঁতুল তেঁতুল তেঁতুল, তারপর শিউলি, রাধাচূড়া, রাধাচূড়া, হিজল হিজল হিজল হিজল, মহুয়া, আবার বড় ঝোপঝাড়, তাতে আকন্দ, জুঁই, বাঁশ, বাহারি কচু, এরপরই কিনা তিন-চার প্রজাতির অর্কচূড়, যার মধ্যে একটা ক্রিসমাস ট্রি, না, দুটো ক্রিসমাস ট্রি, তারপর একটানা পাঁচ-ছয়টা ছাতিম-হিজল, ছাতিম-হিজল, জোড়া বেঁধে বেঁধে। এতগুলো গাছ ঘুমিয়ে আছে দেখে মন যেখানে প্রশান্তিতে ভরে যাওয়ার কথা, সেখানে শেষমেশ আমার বিষাদই বাড়ল শুধু। 

সব গাছের সব পাতা ভরে আছে ধুলোয়, মলিন অবস্থা ওগুলোর, প্রায় বিবর্ণ হয়ে গেছে বলা যায়। যেমন একটা বন গন্ধরাজ, তার ডালে অসুখ ধরেছে, একটা কৃষ্ণচূড়ার গায়ে এতগুলো ছোট ছোট সাইনবোর্ড পুঁতে রাখা হয়েছে-মুসলমানি করার বিজ্ঞাপন, ইংরেজি শেখানোর বিজ্ঞাপন, আরবিতে কথা বলতে পারার গ্যারান্টি দেওয়া বিজ্ঞাপন, এবং সম্ভবত সে কারণেই ব্যথার একটু পরপর ধাক্কা থেকে কৃষ্ণচূড়াটা মারা যাচ্ছে, শুকিয়ে আসছে তার কাণ্ড। একটা কাঁঠালের—পার হয়ে এসে আবার ফিরে গিয়ে দেখতে হলো আমাকে সারা শরীরে দেখলাম ছোপ ছোপ দাগ, মনে হচ্ছে ওর শরীরজুড়ে ভয়াবহ চর্মরোগ হয়েছে, যে চর্মরোগ থেকে ওর আর নিস্তার নেই। ওর পাতাগুলো, প্রতিটা পাতাই বড় অংশ খাওয়া খাওয়া, নিশ্চিত পোকা ধরেছে, নিশ্চিত এমন কোনো ক্ষয়রোগ, যার হাত থেকে গাছটা বাঁচবে না বেশি দিন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী নই বলে একটা অসুখেরও নাম বা প্রকৃতি ধরতে পারলাম না আমি। তবে বুঝলাম যতগুলো গাছ দেখেছি আজ, তার চল্লিশ-পঞ্চাশ শতাংশই রোগাক্রান্ত, ভুগছে কোনো না কোনো মৃত্যুঘোষণার সামনে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণতা ও শারীরিক সমস্যায়। আমার বাসার কাছেই এক জায়গার মধ্যে অনেকগুলো ঝুমকোলতা, তার পাশে জুঁই ফুলের অনেক গাছ, পুষ্পিতা ও মাধবীলতার ঝাড়। ওগুলোর সামনে দাঁড়ালাম। একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে গাড়ির আলো পড়ছে এই বড় বাগানমতো জায়গাটায় এবং আমি দেখতে পাচ্ছি কীভাবে পোকায় ভরে আছে প্রতিটা গাছ, এমনকি পাশের প্লটের লতা বাঁশগুলোও কীভাবে পোকায় খাওয়া। 

আমার মনে হলো গাছের অসুখের ওপর একটা বই কেনা খুব জরুরি। কিনতে হবে, পড়ে বুঝতে হবে যে কেন, কী কারণে হচ্ছে এসব, এবং তারপর বসুন্ধরা সোসাইটির চেয়ারম্যান সরফরাজ সাহেবের সঙ্গে বসতে হবে তাকে একটা কিছু করার জন্য চাপ দিতে আমার পক্ষে যে কোনো একটা লক্ষ্য স্থির করে পরে লক্ষ্য অর্জনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া এখনো সম্ভব, অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো বৃহত্তর কাজে আসবার জন্য পারঙ্গমতা দেখানোর আগ্রহটুকু—উদ্যম নয়—আমি যে এখনো ধরে রাখতে পারছি, এই ভরা আগস্টের মাঝামাঝি অংশে ঘটে যাওয়া অমানবোচিত ক্রুরতার দিকে দিনগুলো দ্রুত ধেয়ে যাচ্ছে দেখেও (আর মাত্র সামান্য ক দিনই বাকি আছে), তাতে অবাকই হলাম আমি, এতটা যে আমার নিজেকে নিয়েই গুঞ্জন উঠল নিজের মাথা ও কানের ভেতরে। না, গাছগুলোর জন্য কিছু করতে হবে। গাছের জন্য ভালোবাসা আমার বহু বছরের, কিন্তু বুঝলাম তামিলনাড়ুর আইয়ারের সঙ্গে একটা দিন কাটানোতে হঠাৎ পুরোনো নেশা আবার ফিরে আসছে। 

এভাবেই কেটে গেল রাত। গোসল করে, ভাত রান্না করে খেয়ে, প্রুস্তের এখনকার ইন সার্চ অব লস্ট টাইম এবং সেই দূর অতীতের স্কট মনক্রিয়েফ অনুবাদে রিমেমব্রানস অব থিংস পাস্ট ওলটাতে ওলটাতে। ১৯২২ থেকে ১৯৯২, সত্তর বছর পৃথিবী গ্রুস্তের ইন সার্চ অব লস্ট টাইমকে জেনেছে রিমেমব্রানস অব থিংস পাস্ট নামে। প্রুস্তের সাত খণ্ডজুড়ে হারানো বা অপচয় হয়ে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়ের ‘সন্ধান’ মনক্রিয়েফের ইংরেজিতে হয়ে গেছে স্রেফ অতীত দিনের ‘স্মৃতিচারণা’। এ দুয়ের মধ্যে সামান্য মিলও নেই—প্রস্তের উপন্যাসের সবচেয়ে বড় কথা ‘সময়’, আর সেটাই মনক্রিয়েফের দেওয়া নামের মধ্যে হাওয়া। সময় বয়ে গেছে বলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সব তাৎপর্যময়তা, রূপ ও তদন্তানুসন্ধানগুলোর অপচয় হয়ে গেছে বলে মার্সেল বা কথক যে শেষ জীবনে এসে তার হারানো সময়কে ফিরে পেতে চাইছে, নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলতে চাইছে যে, তার পেছনে ফেলে আসা জীবনের সব রূপমাধুর্যের অভিজ্ঞতা ব্যর্থ হয়ে যায়নি, বলতে চাইছে যে, ওরা আসলে অবিনশ্বর, তার মানে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে হারানো সময়কে ফিরে পাওয়া সম্ভব, এবং হারানো সময়কে ফিরে পাওয়ার জন্য কোনো কিছু নতুন করে করতে হয় না, কোনো কিছু আবিষ্কারও করা লাগে না, শুধু অতীতের সবকিছুকে মনে করে একসঙ্গে জড়ো করে, বেছে নিয়ে, একটার সঙ্গে একটা স্মৃতির জোড়া দিয়ে, জোড়া খুলে, ঘটনাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগসূত্র বদলে দিয়ে, এক জীবন ভর সব দেখার অভিজ্ঞতা থেকে নতুন সংযোগসূত্র তৈরি করে স্মৃতির ধারাবাহিকতাহীন, কালানুক্রমিকতাহীন উন্মোচন করে গেলেই সম্ভবত, তাহলেই সম্ভবত আলুলায়িত ও লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া এক জীবনের পুনর্নির্মাণ সম্ভব হয় যেখানে প্রুস্তের আশা যে দেখা যাবে সবকিছুর মধ্যে, জীবনের প্রতিটা ঘটনা-নাম-স্থান-কালের মধ্যে চোরাস্রোতের বহমান এক ঐক্য রয়েছে, সুষম এক বিন্যাস রয়েছে, যেমন বিন্যাস আছে আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলীতে, সমুদ্রের ঢেউয়ের ডিজাইনে এবং তখন কে জানে হয়তো আরও দেখা যাবে এই তুচ্ছ-অর্থহীন-পাষাণভার মানবজীবনের-ধর্মের সুশীল হাতের ছোঁয়া ছাড়াই এক বিশ্বজনীন তাৎপর্যও রয়েছে কোনো। 

গ্রুস্তের এ চাওয়ার সবই আছে উপন্যাসটাকে তাঁর দেওয়া ফরাসি নামের ভেতরে : আ লা রোশেখসে দু তপম পারদ্যু— ইন সার্চ অব লস্ট টাইম বা ইন সার্চ অব টাইম ওয়েস্টেড, কিন্তু এর কিছুই নেই মনক্রিয়েফের রিমেমব্রানস অব থিংস পাস্ট-এ। তার চেয়েও সাংঘাতিক বিষয়, মনক্রিয়েফ যেখান থেকে নিয়েছেন এই নাম, শেক্সপিয়ারের সনেট নং ৩০, সেখানে শেক্সপিয়ার বলেছেন গ্রুস্তের ঠিক উল্টো কথা : ‘When to the sessions of sweet silent thought/ I summon up remembrance of things past’ ‘I summon up’-গ্রুস্তের উপন্যাসে স্মৃতি যেভাবে অবচেতনের গুহা থেকে নিজের স্বাধীন ইচ্ছার দমকে দমকে আসে, তার পুরো বিপরীত শেক্সপিয়ারের এই স্মৃতিকে ডেকে আনা’। 

ঘড়িতে দেখলাম রাত একটা। নিরিবিলি বসুন্ধরার বি ব্লকের এই বাসা যানবাহনের শব্দমুক্ত, শুধু মাঝেমধ্যে অ্যাপোলো হাসপাতালের দিকে অ্যাম্বুলেন্সের ছুটে যাওয়ার আর্তনাদ ও ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে টেক-অফ করে বসুন্ধরার ওপর দিয়ে প্লেনগুলোর বিশাল আওয়াজ তুলে ঊর্ধ্বমুখী উঠতে থাকার শব্দেই যা চিন্তার ব্যাঘাত হয়। ও দুটো জিনিস বাদে সবই সুনসান, শ্রীমণ্ডিত। সকালে ক্লাস আছে, তাই ঘুমানোর জন্য নিজের ভেতর থেকেই তাড়া উপলব্ধি করলাম। জোলিয়াম ০.৫ ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম একটা। এখন থেকে আর এক ঘণ্টার মধ্যে ঘুম আসবে, অর্থাৎ তখন দুটো বাজবে, কিন্তু আমি ফোনের ডিজিটাল ক্লকের দিকে তাকিয়ে আরও অপেক্ষা করব ষোলো মিনিট। কারণ, তখন ফোনের হোম স্ক্রিনে বড় করে দেখাবে ২:১৬, মানে ২১৬, আমার বরিশাল ক্যাডেট কলেজ দিনগুলোর ক্যাডেট নম্বর। 

১৯৮২ থেকে ১৯৮৮, আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগের কথা সেসব। সাধারণত প্রতি রাতে এভাবে আমি আমার তেত্রিশ বছর আগের আমিকে দেখি আর মনে পড়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত কাশবন, মাঠের পরে মাঠজুড়ে কসমস, আকাশে ভেসে থাকা ভুবনচিল ও কলেজের শিশুগাছদের ডালে বসা বহু জাতের শালিক (বেশির ভাগই থাকত ভাতশালিক) ও বহু জাতের মুনিয়া পাখিগুলোর কথা। অনেক স্মৃতির মধ্যে—একেক রাতে হয়তো মনে আসে একেক জিনিস-বেশি মনে পড়ে একটা তিলা ঘুঘুকে, বিশেষ এক তিলা ঘুঘু, অন্য কোনো ঘুঘু নয়, যে ঘুঘুটা আমার ধারণা আমাকে চিনত। দুপুরবেলা খাওয়ার পর আমরা যখন রুমে ফিরতাম ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম নিতে, তখন প্রায়ই, প্রায় প্রতিদিন আমি ওই তিলা ঘুঘুটাকে দেখতাম আমাদের কলেজের ধানখেতে—প্রতিবছরের হেমন্তে ধান কেটে নেওয়ার পরে—সে চরে বেড়াচ্ছে পড়ে থাকা ধান খুঁটে খাবে বলে, হেঁটে বেড়াচ্ছে কবুতরের মতো মাথা এ পাশে আর ও পাশে দুলিয়ে। প্রতি হেমন্তেই বেশ অনেকক্ষণ আমি ঘুঘুটার পেছনে হাঁটতাম, জানতাম যে তিলা ঘুঘু তাকে কেউ দেখছে জানলেই উড়ে যায়, তাই আমি হাঁটতাম ঘুঘুটা থেকে দূরে, স্পষ্ট টের পেতাম সে আমাকে দেখেছে; তবু সে উড়ে যেত না। পরে একসময় কখনো আমার উপস্থিতিতে, কখনো আমি সরে গেলে—ডানায় জোর শব্দ তুলে উড়াল দিত ঘুঘুটা। আমাদের কলেজের মালি-চাষি-দারোয়ানেরা তখন বলত, ‘ক্যাডেট ২১৬-র ঘুঘু উইড়া গেছে।’ এই কথা বলে হাসত তারা খুব; এবং আমার বন্ধুরা বিশ্বাস করত না প্রতিদিন ওই একই ঘুঘু আসে, প্রতিবছরের তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আমি জানতাম ওটা সব সময়ে একই ঘুঘু ছিল, কোনো দিনই দ্বিতীয় কোনো ঘুঘু না—তার দারুণ বাদামি পিঠের দিক, যার ওপর খাড়া গাঢ় রেখা, রেখায় কোনো ফোঁটা নেই, মনে হয় একই রঙের ওপর সেই রঙের আরেক গাঢ় মোজাইক, লম্বা লেজের বাইরে তার পালকের সাদা ডগা এবং কালো ঘাড়ে সাদা অনেক বেশি চিতি, অন্য সব তিলা ঘুঘুদের চেয়ে বেশি। আমার ভুল হতেই পারে না। 

হঠাৎ তেত্রিশ বছর পর ঘুঘুটার জন্য আমার বুকের মধ্যে গুমরে উঠল। আজও কি বেঁচে আছে সে? এর উত্তরে সংক্ষুব্ধ হয়ে আমি এক হাতে শেক্‌সপিয়ারের সনেটের বই ও অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে ভাবলাম, যে পৃথিবীতে মার্সেল প্রস্তের এত বড় মাপের উপন্যাস সম্পূর্ণ ভুল নামে বাজারে সত্তর বছর টিকে থাকতে পারে, যে পৃথিবীতে মানুষ ভ্রুক্ষেপহীন গাছ কেটে সেই গাছের ডাল ভ্যানগাড়িতে করে বসুন্ধরার বড় রাস্তা ধরে ঘরে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে রাষ্ট্রপতির সিঁড়িতে বসা মৃতদেহের ছবির চারপাশজুড়ে তাঁর রেখে যাওয়া দলের ছেলে-ছোকরারা তাদের নিজেদের স্যুট-টাই পরা, ব্যাক ব্রাশ করা চুলের নব্য রাজনীতিবিদের গুপ্তহাসি ছবি মালার মতো করে বসিয়ে রাখতে পারে, আর যে পৃথিবীতে তিলা ঘুঘুরা এ রকম মায়ার জালে মানুষকে জড়িয়ে রাখে এবং তারপর মানুষ নিজেই ঘুঘুটাকে পরম এক সম্মোহিত অবস্থায় নিজের স্মৃতির আয়তনে চিরদিনের জন্য জায়গা করে দেয় কিন্তু পরে খুঁজেও পায় না যে ঘুঘুটা কোথায় চলে গেছে, আরও বড় কথা, খুঁজে পাওয়ার কোনো উপায়ও দেখে না, আমি ভাবলাম, সে পৃথিবী অনেক দুঃখের এক পৃথিবী, যাতে মীমাংসা বলে কিছু নেই, যাতে সব ব্যবস্থাই, সব বিধান-বিলিবন্দোবস্তই প্রকৃতির অচিন্তনীয় এক একনায়কত্বের হাতে বন্দী। এই প্রকৃতি, এই সিস্টেম, প্রকৃতির সিস্টেম বা খোদার সিস্টেম যা-ই বলি, খুব মতিভ্রষ্ট এবং অস্বাভাবিক যাতে সামান্যতম ভারসাম্য নেই। 

আমি ছিটগ্রস্ত মানুষের মতো ছোটবেলার ঘুঘুটাকে মনে করে এবং এই পুরো ন্যায়বিরুদ্ধ ঘটনাটায় শেক্‌সপিয়ারের যে নিজের কোনো দোষ নেই, সে কথার সত্যতা দিতেই, তার সনেট নং ৩০ অনুবাদ করতে বসলাম : 

…তখন আবার শোক ফিরে আসে অতীতের ভুলে যাওয়া দুঃখ-দুর্দশার কথা ভেবে, 
অতীতে কেঁদে ফেরা প্রতিটা কষ্টকে ফের বেদনার সাথে মনে করে 
আরও একবার অনুভব করি আগের সব ব্যথা ও বেদনাকে
যেনবা ওগুলো নিয়ে সন্তাপ করিনি আমি কোনো দিন আগে। 
কিন্তু এমন সময়ে, বন্ধু আমার, তোমার কথা যদি মনে পড়ে 
যা কিছু হারিয়েছি সময়ের হাতে, সব ফিরে পাওয়া হয়, সব দুঃখের অবসান ঘটে।’ 

পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছুতেই আমার বিভাগের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান স্যার আমাকে তার রুমে ডাকলেন। সেখানে যেতেই তিনি আমাকে কোনো কুশলবিনিময় ছাড়াই তার রুমে ডাকলেন। সেখানে যেতেই তিনি আমাকে কোনো কুশলবিনিময় ছাড়াই একদম কর্তব্যপরায়ণ, পেশাদার বিভাগীয় চেয়ারম্যানের মতো জিজ্ঞাসা করলেন পুনের সিমবায়োসিস বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকের দল আগামী মাসে ঢাকায় আসবে তার ইতিবৃত্ত। তারপর আমার হোটেল কেমন ছিল জিজ্ঞেস করতেই আমি যখন বললাম ওই হোটেলের প্রহরীরা হেকলার অ্যান্ড কোচ এমপিফাইভের মতো এলিট ফোর্সের মারণাস্ত্র নিয়ে হোটেলের গেট পাহারা দেয়, তখন তিনি শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন যে তিনি ভালো করেছেন আমার সঙ্গে মুম্বাই না গিয়ে। তিনি মুম্বাই না গেলেই যে মুম্বাইয়ের ওই সত্য মুছে যায় না, তা কি তিনি বোঝেন না? কে তাকে বলবে যে তার মতো অনেককেই, যাদের মধ্যে বোবা কেউ থাকতে পারে যে কিনা তার ভয়ের কথা ব্যক্তও করতে পারছে না, প্রতিদিন ওই চকচকে কালো দীর্ঘ ৮.৯ ইঞ্চি ব্যারেলগুলোর সামনে দিয়ে হোটেলটাতে ঢুকতে ও বেরোতে হয়, সেখানে তিনি যোগ হলেই-বা কি, আর বিয়োগ হলেই-বা কি? মানুষকে এ-জাতীয় কথা বোঝানোর মতো দিন এখন আর নেই। এখন একটাই কথা, যেমন রুশো বলেছেন : “মর তুই, তাতে আমার কী? আমি তো নিরাপদে আছি।’ 

তার রুম থেকে বের হব বলে উঠবার নানা ভঙ্গি করে যাচ্ছি, প্রায় এক মিনিট ধরে, কিন্তু তার ইঙ্গিত পরিষ্কার যে আমার ওঠার সময় হয়নি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি চা বা আমার প্রিয় এসপ্রেসো কফি খাব কি না। তিনি জানেন আমি ‘না’ বলব, এবং তারপর তিনি আমাকে বলবেন বিয়ে করার জন্য, আর আরও বলবেন যে—এটা বলার সময় তিনি তার পায়ের ওপরে পা অনেক উঁচুতে তুলে দেবেন, যাতে করে টেবিলের বেশ খানিক ওপরে উঠে আসে তার এক হাঁটু—মেহেরনাজকেই আমি বিয়ে করি না কেন, ‘শিক্ষক-ছাত্রীর বিয়ে মহা বিচিত্র কিছু নয় পৃথিবীতে, আর এই ভার্সিটির মতো লিবারেল এনভায়রনমেন্ট ও কালচারে, না না, যেহেতু মেহেরনাজ আপনাকে নিয়ে সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলে, তাই আমরা জানি এটা কোনো হ্যারাসমেন্ট না, কোনো ডিসিপ্লিনারি বিষয় না, কিন্তু যেহেতু লিডারস মাস্ট লিড বাই এক্সামপল, তাই ভালো হয় না যদি আপনি মেহেরনাজকে বিয়ে করেন?’ এ সময় তিনি তার ল্যাপটপের দিকে তাকাবেন, আর কি-বোর্ডে আঙুল নাড়াচাড়া করবেন, শরীর ঝাঁকি দিয়ে সোজা করবেন, আবার কুঁকড়ে নিয়ে বাঁকা করবেন, এবং অতি অবশ্য কথা শেষ করেই পেছনের জানালার দিকে তাকাবেন, যার ওপাশে দুটো বড় কাঠবাদামগাছ, প্রায়শই যার ডাল ও কাণ্ডে দেখা যায় কাঠবিড়ালিরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে এই বিশাল দালানের জানালাগুলোর দিকে। 

এরপর তিনি বলবেন, ‘আপনাকে কথাটা বলছি, কারণ, তাহলে আপনাদের দুজনকে নিয়ে সব কথা বন্ধ হয়ে যাবে, যদিও আপনি জানেন আমি ফ্রান্সের সরবনের মতো একটা মুক্ত পরিবেশ থেকে পিএইচডি করে এসেছি, কার্লোস আলভারাদো-লাররোকাউয়ের মতো বিখ্যাত কবি-লেখক আমাদের ব্যাচেই ছিল, শুধু যা অন্য ডিপার্টমেন্টে, তবে একই বিল্ডিংয়ে, আপনি জানেন সেটা, তাই সত্যি আপনাকে অনুরোধ করব আমাকে ভুল না বুঝতে, এই সব গসিপের মধ্যে আমার নাম না জড়াতে, প্লিজ।’ তারপর আমি মুখে হাসি নিয়েই উঠে দাঁড়াব, বলব—একই কথা আবার, অর্থাৎ আগেও যা বলেছি তাকে : ‘মেহেরনাজ আমার বন্ধু (এটা মিথ্যা কথা; মেহেরনাজ আমার বন্ধুর চাইতে বেশি, কিন্তু সেটা কী, সে শব্দ এখনো বাংলা বা ইংরেজি ভাষায় আসেনি) এবং এখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা ছাড়া অন্য কিছু থাকার প্রশ্নই আসে না, এই বন্ধুত্ব মিউচুয়াল, আর যদি এটা কোনো দিন স্যার বিয়ে বা অন্য কিছুতে গড়ায়, সেটা আপনি জানবেন।’ 

এই ভাষণের শেষে আমি নিজের মনে নিজেকে এ কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে আসব যে, ওই একই সরবন থেকে পাস করে বেরিয়েছেন আহমেদ আল-তাইয়্যেব, আল-আজহার মসজিদের গ্র্যান্ড ইমাম, যার কোনোই খ্যাতি নেই কোনো লিবারেল মানুষ হিসেবে, কিংবা আরও বেরিয়েছেন ইসসেই সাগাওয়ার মতো খুনি ও ক্যানিবাল। এর সব আমার ইন্টারনেট থেকে চেক করে দেখা হয়ে গেছে, তবে এদের ‘জাজ’ করার না আছে আমার কোনো পর্যাপ্ত জ্ঞান, না আছে ইচ্ছা, কিন্তু ওদের নাম আপনি যেভাবে নিচ্ছেন সেভাবে নিলে অন্তত এটুকু সত্য হয়ে দাঁড়ায় যে, কোনো একটা বিখ্যাত বিদ্যায়তনের নাম, যেমন সরবন, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ইত্যাদি এই চাঞ্চল্যকর রকমের অজ্ঞান তিমিরে থাকা বৃহত্তর পৃথিবীতে আসলে কোনোই তাৎপর্য রাখে না, স্রেফ কতগুলো মানুষকে আত্মম্ভরি ও অস্থিরমতি বানানো ছাড়া। 

বিভাগীয় চেয়ারম্যানের রুম থেকে বেরিয়ে আমি আমার বিভাগের কমনরুমে গেলাম না, ক্লাসের দিকেও না। দেখলাম আমার ক্লাস ফ্রিডরিখ নিৎশের ওপরে, বিষয় তাঁর ‘উইল টু পাওয়ার’। আমার সঙ্গে কথা না বলে আমার পড়ানোর বিষয় কে ঠিক করল, কীভাবে ঠিক করল? কারিকুলামে তো ছিল ‘এথিকস অ্যান্ড মরালিটি’; সেখানে ‘উইল টু পাওয়ার কেন ও কীভাবে এল? প্রথম কথা, এভাবে লেকচার ঠিক হয় না, বিভাগের কো-অর্ডিনেটর এভাবে এটা একা ঠিক করতে পারেন না। দ্বিতীয় কথা, আমার এ বিষয়ে ক্লাস নেওয়ার মতো কোনো প্রস্তুতি নেই। আর তৃতীয়, আমার ভাসা-ভাসা জ্ঞান থেকেই জানি, ‘উইল টু পাওয়ার’ নিৎশের দার্শনিক তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অপরিপক্ব ও অসম্পূর্ণ যার কোনো পাণ্ডুলিপিও নিৎশে রেখে যাননি, নোটবুকে কিছু টোকাটুকি ছাড়া। 

আমি কোর্স কো-অর্ডিনেটরের সন্ধানে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলাম। ক্লাস শুরু হতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। কোথাও তাকে না পেয়ে আমার রুমের দিকে এগোলাম শেষমেশ। দুজন ছাত্রও আমার পেছন পেছন আসতে লাগল, কিন্তু এদের একজনকেও আমি আগে দেখেছি বলে মনে হলো না। এদের মধ্যে যে আকার-আয়তনে বড়, সে আমাকে বলল, আমি তখন রুমের দরজার তালা খুলছি, আমার পিয়ন মালেক আমাকে দেখে আমার দিকে ছুটে আসছে, তখন এই ছেলেটা আমাকে বলল : ‘গুড মর্নিং স্যার, নাইস টু হ্যাভ ইউ ব্যাক।’ আমি উত্তরে বললাম, ‘গুড মর্নিং’ এবং ঝটপট রুমে ঢুকে গেলাম। 

মালেক ভেতরে ঢুকতেই তাকে জিজ্ঞাসা করতে যাব যে এরা কারা, এরা কি আমাদের ডিপার্টমেন্টের কেউ? কোন ইয়ারের ছাত্র? কিন্তু মনে হলো নিশ্চয়ই আমার আবার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে, মালেককে অযথা এর মধ্যে টেনে এনে লাভ নেই, কারণ, আমি জানি সে বলবে, “কী বলছেন স্যার, কেউ তো ছিল না দরজায়’, এবং আমি মালেকের ওই উত্তর হজম করতে পারব না। চুপ করে গেলাম, বুঝলাম কোনো একটা নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার হচ্ছে আমার। ‘ডাক্তার দেখাতেই হবে’, নিজেকে বললাম। মালেক টেবিল থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা তুলে আমার হাতে দিল। 

কোর্স কো-অর্ডিনেটর মহোদয় ওই চিঠিতে সুন্দর ইংরেজিতে আমাকে লিখেছেন : ‘ই-মেইলে মেইলের জবাব না পেয়ে আমি এই চিঠি লিখছি আপনাকে। মূল বিষয়, ছাত্রছাত্রীরা গত নিৎশে ক্লাসে আপনার কাছ থেকে নিৎশের ‘উইল টু পাওয়ার’-সংক্রান্ত দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে এ বিষয়ে আরও জানার বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটা বিভাগের জন্য যেমন আনন্দের, আপনার জন্যও শিক্ষক হিসেবে ততটা সম্মানের, কারণ বুঝতে হবে যে আজকের এই যুগে ছাত্রছাত্রীরা কোনো কিছু নিজেদের থেকে জানতে চাইছে, তা একটু বিরল ঘটনা। তো, আমি আপনার তরফ থেকে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি, তিনি উত্তরে বলেছেন নিৎশের ‘উইল টু পাওয়ার’ যে আপনার একটি প্রিয় বিষয়, সে ব্যাপারে তিনি অবগত আছেন এবং তিনি মনে করেন ছাত্রছাত্রীদের এই ইচ্ছা প্রকাশের পর এ বিষয়ে আপনার অন্তত দুটো ক্লাস নেওয়া সংগত। তারই প্রথমটা হবে ৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে, ক্লাসরুম বি-সিক্সে। আপনাকে খুব কম সময়ের এই নোটিশ দিতে হলো বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি জানি যে আপনার এই ক্লাস ছাত্রছাত্রীরা দারুণ 

উপভোগ করবে এবং আমি আপনার সঙ্গে এই কোর্স ও পরীক্ষাসংক্রান্ত অ্যাডজাসমেন্ট বিষয়ে আপনি ভারত থেকে ফিরে এলেই বসব। বিনীত, ইলিয়াস আহমেদ, কোর্স কো-অর্ডিনেটর, দর্শন বিভাগ। 

আমার চিঠি পড়া শেষ হলে আমি মালেককে বললাম রং-চা দিতে, আর ‘এক বোতল পানি রুম টেম্পারেচার’, কারণ আমার গলায় ব্যথা। আরও বললাম, ‘দরজা বন্ধ করে দাও।’ মালেক যেতে যেতে বলল, ‘স্যার, ওই যে দুই ছাত্র দরজার বাইরে ছিল, ওরা অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের। ভারতের কোথায় যেন কয়েক মাস পড়ছে, ভাইস চ্যান্সেলর স্যারের বিশেষ অনুমতি নিয়া পরে এখানে ট্রান্সফার নিছে, কারণ এদের ভারতের হোস্টেলে র‍্যাগিং হচ্ছিল। এরা আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য আজ চার-পাঁচ দিন ধরে ঘুরতেছে।’ 

মালেকের চিরাচরিত ছাড়া ছাড়া স্টাইলের কথা শেষ হতে আমি টেবিলে দুহাতের কনুই রেখে আমার মাথা ধরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। তার মানে, ওরা রিয়াল ছিল, হ্যালুসিনেশন না; এবং আমি রিয়াল দুই জলজ্যান্ত মানুষকে হ্যালুসিনেশন বলে ভেবেছি? 

যাহোক, যে কারণে মালেককে আমি রুম থেকে চলে যেতে বলেছি, সেটা সেরে ফেলার ইচ্ছা হলো। কোর্স কো-অর্ডিনেটরের ই-মেইলটা পড়তে হবে, এবং তাকে ই-মেইলে, চেয়ারম্যানকে কপিতে রেখে, তার ই-মেইল ও এই আজব চিঠির কঠিন একটা উত্তর দিতে হবে, কারণ তিনি বা চেয়ারম্যান কেউই আমার সঙ্গে বিস্তারিত কথা না বলে এত বড় একটা জিনিস একতরফা ঠিক করতে পারেন না, আর ‘যেহেতু এটা আপনি, প্ৰিয় কোর্স কো-অর্ডিনেটর মহোদয়, আমাকে সে অর্থে না জানিয়ে নিজের একক সিদ্ধান্তে ঠিক করেছেন, সেহেতু বিষয়টা বাস্তবে রূপদানের দায় আমি নিচ্ছি না, এবং আমি নিশ্চিত যে আমার বিভাগীয় চেয়ারম্যানের মতো প্রাজ্ঞ ও রিজনেবল একজন মানুষ আমার এই পজিশনের লজিকের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন এবং আর একটু পরে আমি যে আমার আগের রুটিন মোতাবেক “এথিকস ও মরালিটি” পড়াতে যাচ্ছি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ রাখবেন না দয়া করে। আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এটা নিয়ে মাননীয় বিভাগীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে আমাকে কোনোই, কোনোই, সমালোচনা শুনতে হবে না। বিনীত, ব্লা ব্লা ব্লা।’ চিঠির ড্রাফট মনে মনে ঠিক করে ফেললাম। 

এ মেইলটা লেখার জন্যই আমি এত দিন পর ল্যাপটপে আমার মেইলবক্স খুললাম। মেইলটা লিখতে হবে ঠান্ডা মাথায়, মাথার ভেতরের সব রাগ ও গাত্রদাহ দূরে ঠেলে, নিৎশের ‘উইল টু পাওয়ার’-এর মতোই সব ভালোমানুষি, সব কাহিল ভাব থেকে বেরিয়ে এসে স্রেফ লক্ষ্য অর্জনের একরোখা জেদকে একমাত্র অভীপ্সা মেনে, শক্তি দিয়ে নিৎশের কথার মতো—’নিজের অ্যাকশনের পথের সব বাধা তুচ্ছ করে, প্রয়োজনে গায়ের শক্তিতে, গতরের জোরে, ‘by the power relations between bodies and forces’। ভালো। 

মেইলবক্স খুলে থমকে ও চমকে গেলাম। কোর্স কো-অর্ডিনেটরের মেইলের—তারিখ ২৮ জুলাই–আগে ও পরে নেপালের সুরভির মোট এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, হ্যাঁ চৌদ্দটা ই-মেইল। কিছুই বুঝলাম না। এখন এতগুলো ই-মেইল খোলার সময় নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা সুরভির ই-মেইলগুলো সাইজেও বড় হয়। আপাতত শুধু কয়েকটা মেইলের সাবজেক্ট লাইনে চোখ বোলালাম ঝটপট : ‘ফ্রম ইওর সুরভি ছেত্রি হুম ইউ হ্যাভ ফরগটেন’–’ফ্রম ইওর সুরভি ছেত্রি হুম ইউ হ্যাভ ফরগটেন 2’’হোয়াই ডোন্ট ইউ পিক আপ দ্য ড্যাম ফোন?’—’নেপাল আর্থকোয়েক আপডেট, সিরিয়াস-‘হোয়াট দ্য ফাক ইজ ইওর প্রবলেম?’’টক টু মি’—’ফিউ সংস ইউ মাস্ট হিয়ার’—’ইউ আর লস্ট অ্যাগেইন!!!’— ‘নেপাল আর্থকোয়েক আপডেট 3’–’নিড টু টক নিড টু টক নিড টু টক।’ 

আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে নিচতলায় গণিত বিভাগের দিকে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম, জোরে শ্বাস নিয়ে শরীর টান টান করে পরে ধনুকের মতো একবার তির্যকভাবে সামনে ও একবার পেছনে বাঁকিয়ে, আজন্মকালের প্রেম-ভালোবাসাবিষয়ক সংশয় ও সন্দেহকে শরীরের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া রেখার (বা ছায়ার) সঙ্গে বিশেষ সাধনপ্রক্রিয়ায় সাময়িকভাবে শূন্য করে দিয়ে, মুখ থেকে অস্ফুট উচ্চারণে ‘সুরভি, সুরভি, ওহ্ সুরভি’ বলে তিরবেগে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে নামতে ভাবলাম, এই নিৎশের কোর্স, এই মিথ্যা হ্যালুসিনেশন, এই চেয়ারম্যানের মেহেরনাজ-বিষয়ক বক্তব্য, এই শেকসপিয়ারের সনেট নং ৩০, কাল রাতের এই পোকাধরা গাছগাছালি, এই মার্সেল গ্রুস্তের সঙ্গে স্কট মনক্রিয়েফের অধর্মাচরণ, এই সুরভির চৌদ্দটা ই-মেইল—এত কিছু, এত কিছু আমার এই মানসিক অবস্থায়, এই আগস্ট মাসের মাঝামাঝি এসে আমি আর মাথায় নিতে পারছি না। 

গণিত বিভাগে এসে প্রফেসর মাসুম হায়াতের রুমে ঢুকে পৃথিবীর সব ডামাডোল ডিঙিয়ে কোনো শান্ত সমুদ্রতীরে ভিড়লাম যেন। আরও ভালো লাগল ফিজিকসের নূর হোসেনকেও একই রুমে পেয়ে। এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্রেফ এ দুজনই আমার সত্যিকারের বন্ধু আর আমি কিনা দুজনকেই পেয়ে গেলাম একসঙ্গে। কিন্তু মাসুমের দিকে ভালো করে তাকাতেই হাঁ হয়ে গেলাম। মাত্র দশ দিনে এত বড় পরিবর্তন? কোলন ক্যানসার হয়েছিল তার, পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে উদারভাবে দেওয়া টাকায় ব্যাংককে চিকিৎসাও করা হয়। আমার হিসেবে কেমোথেরাপি কাজ করছিল ভালোই, কিন্তু আজ দশ দিনের ব্যবধানে তাকে দেখে মনে হলো তার মৃত্যুর আর বেশি দিন বাকি নেই। আমি স্তম্ভিত হয়ে মাসুমের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নূর উঠে দাঁড়িয়েছে। সে আমার হাত ধরল। মাসুম আমাদের উল্টো দিকে তার চেয়ারে বসে। 

মাসুমের অসুস্থতার একেবারে প্রথম থেকে পুরো ঘটনাটার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। প্রথমে শুরু হলো তার ওজন হারানো, তারপর তলপেটে ব্যথা, তারপর সে বলল কালো রক্ত যাচ্ছে টয়লেটে, ব্ল্যাক স্কুল। আমরা ওর আলট্রাসনোগ্রাম করালাম, লিভারে টিউমার পাওয়া গেল, এরপর FNAC প্রসিডিউর করে রস পরীক্ষা, ধরা পড়ল মেটাস্টেটিক অ্যাডেনোকারসিনোমা। ডাক্তার বললেন, ‘এর অর্থ লিভারে আসলে টিউমার নেই, অরিজিন ইজ এলসহোয়ার ইন দ্য বডি, আপনারা বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি?’ আমি ও নূর সে অবস্থায় ভিসির সঙ্গে তর্ক করে দিন-দুনিয়া কাঁপিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষে রাজি হলো মাসুমের ও তার স্ত্রী ফারজানার ব্যাংকক যাওয়া ও চিকিৎসার খরচ বহন করতে। ব্যাংককে অনেক পরীক্ষা—কোলনস্কপি, এনডোসকপি, PET-CT Scan ইত্যাদি করে শেষে জানা গেল তার বাম কোলনে গ্রোথ। শুরু হলো ২১ দিন পর পর কেমোথেরাপি। আমি ওর দুটো কেমো নেওয়া দেখে ভারতে গেলাম, আর আজকে দেখি গায়ের রং কালো, নখ কালো, ফ্যাকাশে, চুলপড়া, কৃশকায়, বিষণ্ন মুখের এক জ্যান্ত লাশ। মাসুম আমাকে বলল, ‘এত চিন্তার কিছু নেই’, বলল যে, তার জীবনের শেষ ইনিংস চলছে, ইটস ওকে। জীবনের আসলে একটা হায়ার পারপাস আছে, কিন্তু আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না কী সেটা? কবে আর বুঝব? হা হা।’ 

এই হলো মাসুম হায়াতের অবস্থা। আর আমার অন্য বন্ধু নূর হোসেন এ মুহূর্তে যাচ্ছে তার ডিভোর্স প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তার স্ত্রী লুনা অবিশ্বস্ত। ‘এমা বোভারিকে বাংলাদেশে যদি কেউ স্বচক্ষে দেখতে চাও তো আমার বউকে দ্যাখো’, এ কথা আমাদের দুজনকে বহুবার বলেছে নূর হোসেন। নূর আমাকে বলেছে যেদিন আমি মাদাম বোভারি উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ প্রজেক্ট হাতে নেব, সেদিন সে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স পেমেন্ট দেবে কাজটা শেষ করার প্রণোদনা হিসেবে, ‘বিশ্বসাহিত্যে প্রথম কোনো পাঠক অ্যাডভান্স টাকা উপহার দেবে লেখককে, আর’, বলে নূর হোসেন, যেদিন আমি কাজটা শেষ করব, সেদিন সে আমাকে ঢাকা-প্যারিস-ঢাকার প্লেন টিকিট ফ্রি দেবে যেন আমি এর লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের জন্মস্থান ও সমাধি দেখতে নরমান্ডির রৌয়ায় যেতে পারি। ‘আমি চার্লস বোভারি, লুনা এমা বোভারি, শুধু তফাত এটা যে এমার অ্যাফেয়ার ছিল দুটো, রোডোলফ ও লিঁওর সঙ্গে, আর আমার বউয়ের অ্যাফেয়ার ঢাকার কমপক্ষে সাত-আটজনের সঙ্গে, একই সময়ে। আরেকটা পার্থক্য, এমা আত্মহত্যা করেছিল কিন্তু লুনা তা করবে না কোনো দিন, কারণ আত্মহত্যা করার জন্য কারও চোখের সামনে সারা পৃথিবীকে যেভাবে আঁধার-কালো হয়ে উঠতে হয় চারদিক থেকে, লুনার তা হবে না কোনো দিন, কারণ লুনা,’ বলে নূর হোসেন, জাহাজডুবি হয়ে যাচ্ছে দেখলে জানে যে কীভাবে সঙ্গে সঙ্গে ডাইভ দিতে হয়। একদিক থেকে সেটা ভালোও, মানে লুনার এই অদম্যতা,’ বলে নূর, ‘কারণ আমাদের মেয়েটার বয়স মাত্র ছয়। আমরা কেউ চাই না সে এমা ও চার্লসের মেয়ের মতো এতিম হয়ে যাক।’ 

এখন তাদের লড়াই চলছে আদালতে, মেয়ের জিম্মা নিয়ে। বউয়ের অবিশ্বস্ততার অনেকগুলো প্রমাণ উকিলের কাছে জমা দিয়েছে নূর। প্রমাণগুলো হাতে নিয়ে বিখ্যাত সেই উকিল নাকি তার দিকে কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়েছিলেন যে নূর হোসেনের মনে হচ্ছিল লোকটা তাকে সুন্দরী বউয়ের নপুংসক কিংবা আরও সোজা বাংলায় মেদা, সাবু-খাওয়া এক স্বামী হিসেবে বিবেচনা করছিল। ‘একদিক থেকে উকিল কিন্তু ভুল কিছু ভাবেনি’, বলেছিল নূর, ‘মানে যদি সে ব্যাটা ওরকম কিছু আমাকে নিয়ে ভেবে থাকে, কারণ আমি লুনার সঙ্গে তুলনায় আসলেই অতি সাধারণ, নীরস, ভোঁতা এক মানুষ। আমার এই রসকষহীন, “ডাল “ ব্যাপারটাই তাকে নাকি অ্যাফেয়ারগুলোর দিকে ঠেলে দিয়েছে, হা হা।’ 

আজ বেশ কিছুদিন হয়, মোটামুটি মাসুম হায়াতের ক্যানসার ধরা পড়ার পর থেকে যে আমি নূর ও লুনার ডিভোর্স প্রসিডিংসের আপডেট জানি না। প্রায়ই ভাবি তাকে জিজ্ঞেস করব, কিন্তু যেহেতু সে নিজে থেকে কিছু বলে না, এমনকি যখন আমরা দুজন একদম একা তখনো না, তাই আমার আর তাকে জিজ্ঞেস করা হয় না কিছু। আমি শুধু বুঝতে পারি, আমার তাকে এত বছরের চেনাজানা থেকেই যে, কী বিশ্রী এক কর্দমাক্ত মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে নূর, যার একাডেমিক দক্ষতা হিস্টোরি অব সায়েন্সে এবং যে তার পিএইচডি করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়া থেকে, তারপর দেশে ফিরে এসে তার নিজের নায়কোচিত চেহারার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই বিয়ে করেছে বগুড়ার এক প্রাক্তন জমিদারবাড়ির মেয়ে সুন্দরী লুনাকে, একবারও এ কথা না ভেবে যে মানবশরীরের বাইরের দিকের জেল্লার কাজ বাইরের রূপটাকে ফ্রেমের মধ্যে এমনভাবে গিল্টি করে দেওয়া যেন ছবি নয়, ছবির ফ্রেম দেখেই মুগ্ধ হয়ে থাকে দর্শক। কাফকা চিনেছিলেন এই ধোঁকা সবচেয়ে ভালো করে, কাফকা ও ফ্লবেয়ার—দুজনেই। 

ফ্লবেয়ার বাইরের রূপের বাহবার ভেতরের সত্য এমনভাবে চিনেছিলেন যে তিনি ওটার নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে এমনকি সামান্য শেভ করে সুন্দর পরিপাটি হওয়ার কাজটা করতে গিয়েও প্রতিদিন হেসে ফেলতেন। তিনি জানতেন মানুষ কীভাবে অসার ও অগভীর সব শোভনতা ও সৌন্দর্যের স্রেফ প্রলেপের পেছনে ছোটে এবং একদিন মর্মান্তিক এক সমাপ্তির মুখোমুখি হয়। কাফকা দেখিয়েছেন জীবনের ভয়জাগানো অযৌক্তিকতা আর ফ্লবেয়ার অন্তঃসারশূন্য জীবন কাটানোর হরর, নাটকীয় হরর। প্রথমজনের কাছে সুন্দর বলে কিছু নেই, যেহেতু পুরোটাই ধোঁকা, এমনকি ঈশ্বরও আমাদের ঠকিয়েছেন ভোরের বাতাস ও রাতের নক্ষত্রমণ্ডলীর দৃশ্যত সুন্দরের নিচে এক বিভ্রান্তিভরা জটিল পৃথিবী উপহার দিয়ে; আর পরের জনের হিসাবে জীবন নিষ্প্রাণ ও ফাঁপা বলে আমরা জেনেবুঝেই ধোঁকা খাই, মলিন ও জীর্ণ চারপাশকে ছুড়ে ফেলতে গিয়ে জীবনকে শেষমেশ নোংরা ও শোচনীয় করে তুলি। 

মাসুমের শারীরিক অবস্থা দেখে আমি এমন ধাক্কা খেয়েছি যে আমাদের তিনজনের মধ্যে তখন কোনো কথা নেই। তাই আমি মাসুমের সামনের একটা খালি চেয়ারে বসলাম, জানতে চাইলাম ওরা কী নিয়ে কথা বলছিল এই বন্ধ ঘরে, চুপচাপ, যখন কিনা বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা ফ্লোর গমগম করছে সকালবেলার রাশ আওয়ারে ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলি ও রীতিমতো চেঁচামেচিতে। নূর জানাল যে তারা কথা বলছিল দল বেঁধে চলা পাখিদের বিহেভিয়ারাল মডেল নিয়ে। ‘কী কথা?’ শুনতে চাইলাম আমি। 

ফিজিকসের গতি ও স্থিতির ভূমিকা দিয়ে শুরু করতে গিয়েও নূর তা বলা বন্ধ করে চলে এল মূল কথায়। বলল, ‘কীভাবে আসলে সবচেয়ে জটিল বিষয়টাও অবিশ্বাস্য রকমের সরলতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, তা বোঝা যায় আকাশে দল বেঁধে চলা পাখিদের ওড়ার ব্যাখ্যা থেকে, যে ব্যাখ্যাটা আমার না, ক্রেইগ রেনল্ডস নামের একজনের। ক্রেইগ বলছেন, এতগুলো পাখি যে আকাশে একভাবে, একই নিয়মে, অসাধারণ সিমেট্রিতে, বাতাস যেমন হোক আর আলোই যেমন হোক, তারপরও সুন্দর ছন্দ মেনে উড়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল, দেশের পর দেশ, তা আসলে তারা করছে মাত্র তিনটে সাধারণ নিয়ম মেনে : আলাদা থাকা, অর্থাৎ পাশের বা সামনের বা পেছনের পাখির সঙ্গে ভিড় করে এসো না; সরলরেখায় সারিবদ্ধ থাকা, অর্থাৎ তোমার প্রতিবেশী পাখিদের ওড়ার গড় উচ্চতাকে নিজের ওড়ার মধ্যে ধরে রাখো; এবং একসঙ্গে এঁটে থাকা, অর্থাৎ তোমার প্রতিবেশী পাখিদের পারস্পরিক গড় অবস্থানের দিকে বিরতিহীন ধেয়ে যেতে থাকো।’ থামল নূর। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটুকুই?’ রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাগছিল আমার নিজেকে। ‘এত সরল, এত সোজা? ওহ্ খোদা!’ আমি ভাবছি, নূর নিশ্চয়ই আরও কিছু বলবে এ বিষয়ে। কিন্তু না, সে বলল, আমার দুবার জিজ্ঞাসার উত্তরে, ‘হ্যাঁ, এটুকুই। ‘সুন্দর’, বললাম আমি, ‘অসম্ভব সুন্দর।’ 

আরও বললাম, ‘পাখিদের দল বেঁধে ওড়া সব সময় দেখেছি কিন্তু এমনভাবে কোনো দিন ভাবিনি এর ভেতরকার নিয়মকানুনগুলোর কথা, খুব বেশি হলে ভেবেছি পুরো বিষয়টাই পাখিদের সহজাত, প্রাকৃতিক।’ 

নূর আমাকে থামিয়ে বলল, ‘ফিজিকসের সবকিছু গোড়ায় চলে গেলে প্রাকৃতিক ও সহজাতই।’ 

আমরা হাসলাম। বেশ দীর্ঘ এক বিরতির পরই আজ হাসলাম আমি। কিন্তু মাসুম হায়াত আমাদের দুজনকেই অভিযুক্ত করল দল বেঁধে ওড়া এই পাখিদের বিহেভিয়রিয়াল মডেলের ভেতরকার গণিত ও ফিজিকসকে বিশ্বাস করে এর অলৌকিকত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার জন্য। ‘কী বলছে সে’, ভাবলাম আমি। জানি নূরও একই কথা ভাবছে। জানি আমরা দুজন একই জিনিস ভাবছি এখন : মাসুম কি দল বেঁধে ওড়া পাখিদের শূন্যে ভেসে চলতে থাকাকে অপার ও অপার্থিব সুন্দর কিছু অর্থে অলৌকিক বলছে, নাকি সে বলছে যে এটা, এই তিনটে নিয়ম মেনে পাখিদের চলাটা, খোদার অলৌকিকতারই নিদর্শন? এই কি তাহলে তার ক্যানসার ধরা পড়ার পর জীবনের ‘হায়ার পারপাস’ নিয়ে উপলব্ধি? কিন্তু মৃত্যুকে আসন্ন বা যেকোনো সময়ে ঘটে যেতে পারে এমন কিছু ভেবে সেই ভাবনার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকা আবার কোনো ‘পারপাস’ হয় কী করে? 

তিনজনের কেউ আমরা কথা বলছি না কোনো, পার হয়ে যাচ্ছে এক মিনিট, দুই মিনিট। এরকম নিঃশব্দতার মধ্যে আমি হাত দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো করছি একটা টোস্ট বিস্কিট, পানিতে চকচক করছে মাসুম হায়াতের চোখ, পরিষ্কার তা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না জীবন শেষ হয়ে আসছে ভাবলে কি জীবনের অনেক সাধারণ সুন্দর জিনিসকে ‘অলৌকিক’ সুন্দর বলে মনে হতে থাকে? আর যদি হয়ও তো তা কেন হয়, যেখানে জীবন যে শেষ হয়ে আসছে, এই ভাবনা তো শুধু কোনো ক্যানসার রোগীর ভাবনাই হতে পারে না, এটা তো যে কারও যেকোনো সময়েরই ভাবনা, যে কারও যেকোনো সময়েই তো জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে যেকোনো ভাবে, যেমন আপনি বাসে চড়ে ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছেন, বাস উল্টে গেল রাস্তার পাশ ধরে আর পড়ল এক খাদের মধ্যে, আপনি মারা গেলেন ছোট একটা বন্ধ জায়গার দিকে পানি ধেয়ে আসছে দেখতে দেখতে, কিন্তু আপনার করার কিছুই নেই; যেমন লঞ্চে চেপে যাচ্ছেন বরিশাল, লঞ্চ ঝড়ে পড়ল বা যাত্রী বেশি বলে উল্টে গেল, ডুবতে থাকল, আগের উদাহরণটার মতোই এখানেও বদ্ধ এক কেবিনের মধ্যে আটকে গিয়ে আপনি দেখতে লাগলেন পানি ঢুকছে কেবিনে ভুজভুজ করে নয়, বন্যার তোড়ের মতো, দূরে আপনি অনেক চিৎকার শুনতে পাচ্ছেন, আপনি শুধু ভাবছেন মৃত্যুর কষ্টটা কতক্ষণ হবে, অনেকক্ষণ? নাকি মাত্র দু-তিন মিনিট? যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন, প্রতিদিনকার মতো ঝরঝরে এক সকাল, বাথরুমে গেছেন প্রস্রাব করতে, দেখলেন ঠিক কোকের মতো, একজাক্টলি কোক বা পেপসির মতো কালো-লালের তুমুল ঘন রং প্রস্রাব হলো আপনার, এবং এর পরের দুই দিনের মধ্যেই আপনি জেনে গেলেন আপনার একটা কিডনি এই মুহূর্তে ফেলে দিতে হবে, ক্যানসার ছড়িয়ে গেছে ওখানে, আপনাকে বুঝতেও দেয়নি; যেমন আপনি যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে, গাড়ির মধ্যে বসা, গাড়ি জ্যামে পড়ে আটকে আছে একটা নিৰ্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচে, আর হঠাৎ শব্দ তুলে ভেঙে পড়ছে ফ্লাইওভারের বিশাল একটা স্প্যান, মাত্র দু-তিন সেকেন্ড সময় পেলেন আপনি তা দেখার, স্প্যানটা নিচের দিকে পড়তে যাচ্ছে আপনার গাড়ির ছাদ বরাবর, সোজা, পড়ছে, পড়ে গেল, নিজের মাথা একটা পানির গ্লাসের মতো চুরমার হয়ে যাওয়ার বোধটুকু ধরা গেল শুধু, দূরে অনেক চিৎকারের একটা আওয়াজ ক্ষীণভাবে শোনা গেল, শেষ। 

আমার হিসেবে মৃত্যুমুহূর্ত মোট তিন ধরনের। তিনটের শেষে গিয়ে ওই একই মৃত্যু; কিন্তু আমরা, মানুষেরা, ঘটনার চাইতে ঘটনা ঘটার সময়ের পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে বেশি আলোড়িত হই বলে এ তিনটেকে আলাদা আলাদা করে ভাবতে ভালোবাসি; এদের মধ্যে ভালো, কম ভালো, অনেক ভালো, খারাপ, অনেক খারাপ ইত্যাদি গ্রেডিংও করি। 

প্রথম ধরন : যন্ত্রণাদায়ক কিন্তু হয় দ্রুত না হয় ধীরে ঘটা মৃত্যু। পুরো বাসা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, আপনি বাথরুমে গিয়ে বোকার মতো শাওয়ার ছেড়ে অপেক্ষা করছেন, আগুন এবার ঢুকল ধুম করে বাথরুমেও, আপনি দেখছেন…(যন্ত্রণাদায়ক ও ধীর)। আবার, আপনার গাড়ি আটকে গেছে রেলক্রসিংয়ে, কারও না কারও ভুলে ট্রেন দ্রুত ধেয়ে আসছে, আপনি দেখছেন সামনে-পেছনে সবদিকে গাড়ি, গাড়ির দরজা খোলারও আপনার সময় নেই, ট্রেন ধাক্কা খেলো আপনার গাড়িতে, আপনার শরীরে, এবং আপনার সামান্য শরীর যাকে আপনি এত দিন পিঁপড়া ও পাখির সাপেক্ষে বেশ বড় বলেই ভেবে এসেছেন, সেটা একটা মণ্ড হয়ে যেতে সময় লাগল না একটুও, বেশি হলে মাত্র দশ সেকেন্ড (যন্ত্রণাদায়ক ও দ্রুত)। 

দ্বিতীয় ধরন : অসুস্থতা থেকে মৃত্যু। এ ধরনের মৃত্যু সাধারণত ধীরে ঘটে, আর যদি কখনো দ্রুত ঘটে যায় তো সেটাকে আমরা কিছুটা অস্বাভাবিক বলে অন্য কিছুর সন্দেহ করতে থাকি। যেকোনো অসুখে মৃত্যু, যেমন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর যে মৃত্যু আসে, আবার যেমন বৃদ্ধ বয়সে রোগে ভুগে একদিন চেয়ারে বসেই শেষনিশ্বাস ফেলা কিংবা ডায়রিয়া থেকে পানিশূন্যতা হয়ে তুলনামূলক দ্রুত মরে যাওয়া—সবই এই ধরনের মধ্যে পড়ে। তবে সব অসুখের যন্ত্রণা বা কষ্ট এক নয়। গলার ভেতরে ঘা হয়ে মৃত্যু আর সারা শরীরে মারাত্মক চর্মরোগ হয়ে যে মৃত্যু কিংবা না খেতে পেরে ধীরে অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে যে মৃত্যু, তার সঙ্গে তুলনা চলে না হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে মৃত্যুর। 

আর তৃতীয় ধরন : ধোঁকার মধ্যে থেকে মৃত্যু। আপনার জন্ম হলো, আপনি একটু বড় হয়ে বুঝতে শেখার পর থেকে দেখতে লাগলেন যে পৃথিবী কত সুন্দর, দেখতে লাগলেন যে রংধনু, প্রজাপতি, সমুদ্রের ঢেউ, বাবা-মায়ের স্নেহ ও পাখির ডাক—সবই সুন্দর, কিন্তু ওরকম সময় থেকে এটাও আপনার বোঝা শুরু হয়ে গেল যে জীবন সামান্য এক ক্ষণকালের, সামনেই মৃত্যু আছে, এই আমার চারপাশের একটা মানুষও আজ থেকে সত্তর-আশি বছর পর আর এ পৃথিবীতে থাকবে না, আমার সন্তান, যাকে আমি রেখে যাব, সে-ও যাবে আমার পরপরই, আর আমার আগেই যাবে আমার বাবা-মা, বড় ভাইবোন, তারপর একসময় দেখলেন যে শুরু হয়ে গেল, মিছিল করে শুরু হয়ে গেল অন্যদের চলে যাওয়া—আত্মীয়-পরিজন, শিক্ষক ও অন্য বড়রা, আর হতবিহ্বল হয়ে নিজের কাছে আপনি প্রশ্ন রাখলেন, কে আমাকে এখানে আনল? কেনই-বা আনল? সব রেখে যদি আমি চলেই যাব, তাহলে কিসের কী অর্থ থাকে আর? আবার আমি চলে যাওয়ার পর সব যদি একই থাকবে তো আমার এখানে কাজটা কী?—এসব। এভাবে একদিন আপনি বুঝলেন যে, পৃথিবীতে বাঁচার আনন্দ, দেখা-শোনা-পড়া ও পৃথিবীকে আবিষ্কার করতে থাকার আনন্দ, সেই সঙ্গে প্রেম আত্মতুষ্টি-সাফল্য অর্জনের আনন্দ এবং মহাকালের বিন্যাস ও দিগন্তজোড়া ধানখেতের ওপরে খেলে যাওয়া বাতাসের ধুন—এসবই ধোঁকা, কারণ সত্য একটাই যে, দ্রুত, অতি দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছি আমি। এ ধরনের মৃত্যুর নামই স্বাভাবিক মৃত্যু; অর্থাৎ জীবনের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধকে আলিঙ্গন করে জীবনের কোনো একটা অর্থকে খুঁজে পাওয়া গেল বলে মনে করা এবং একদিন কোনো অসুখে ভুগে নয়, কোনো দুর্ঘটনায় নয়, বরং খুব স্বাভাবিকভাবেই—কারণ ওভাবে এখান থেকে চলে যাওয়াটাই নিয়ম, ওটাই স্বাভাবিক—চিরদিনের মতো চোখ বন্ধ করা এবং এর কিছু পরই সবার জন্য দুর্গন্ধ হয়ে যাব, এমন এক অবস্থায় চলে যাওয়া। 

আমার শরীর অবসন্ন হয়ে এল, আমি আমার চারপাশের সব মানুষের জন্য করুণা, মায়া ও বেদনা বোধ করতে লাগলাম। বুঝলাম যে মাসুম হায়াতের কোলন ক্যানসার হয়েছে বলে আমার অবস্থা তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। চুপ করে কী চিন্তা করছি, তা আমাকে জিজ্ঞাসা করল মাসুম। আমি বললাম, যা এতক্ষণ ভাবলাম তার সার, দু-চার লাইনে। মাসুম বলল, কতগুলো মৃত্যু আমার হিসাব থেকে বাদ গেছে, যেমন পশুর থাবায় ও দাঁতের নিচে মৃত্যু, আত্মহত্যা, খুন, অন্তর্ঘাতে মৃত্যু। 

‘অন্তর্ঘাতে মৃত্যু’ কথাটা আমাকে আগস্টের হীনপ্রাণ, লোহিতবর্ণ বেদিতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। নূর জানতে চাইল আমি ক্লাসে যাচ্ছি কি না, ক্লাস শুরু হতে মাত্র সাত মিনিট বাকি, ছাত্রছাত্রীরা অপেক্ষা করবে। আমি বললাম, ‘যাচ্ছি, কিন্তু নিৎশে পড়াতে নয়, মরালিটি ও এথিকস পড়াতে।’ ওরা আমার এ কথার কিছু বুঝল না। থাক। আমি অবাক হচ্ছিলাম, আমার এ দুই বন্ধুর কেউই আমাকে এতগুলো দিন মুম্বাই ও পুনেতে কাটানো নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছে না কেন, তা ভেবে। এরপর নিজে থেকে, তিনজনই চুপচাপ এমন সময়ে, আমি আইয়ারের কথা বললাম, সেই গল্পের বক্রতা ও বিষাদ দুটোই তুলে ধরলাম। আর বললাম মুম্বাই-পুনে এক্সপ্রেসওয়েতে হুপু পাখি দেখার কথা ও পাম বিচ রোড নামের এক অন্ধকার রাস্তার গল্প, যার এক পাশে ঘন অন্ধকারের ভেতরে রয়েছে এক দেখা যায় -না-মতো এমন দাগ, যে দাগের ওপাশে মৃত্যুপুরী। শুধু সচেতনভাবে আমি এড়িয়ে গেলাম আইয়ারকে টিপস না দেওয়ার অংশটুকু, যা কিনা আমার এবারের মুম্বাই সফরে ছিল অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা কারণ ওটা—ওটা থেকে উদ্ভূত আমার অপরাধবোধ—আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু, আমাকে নিয়ে গেছে জোসেফ কনরাডের কাছে, নিয়ানডারথালদের কাছে, এয়ারপোর্টে এক বড় বসের সঙ্গে তার অধস্তনের হাসির বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার গভীর ভেতরকাঠামোর ভেতরে এবং শেষে ইভান তুর্গেনেভে। কম নয়, আর যদি এর সঙ্গে ঝকঝকে মারণাস্ত্রগুলো এবং আমার হ্যালুসিনেশন ও মুম্বাইতে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পরের মর্নিংগ্লোরি ফুলদের জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের কথা যোগ করি, তো তাহলে মোটামুটি এক জীবনের পুরো গল্পই হয়ে যায়। 

নূর আমাকে তাড়া দিল ক্লাসে যাওয়ার, বলল, ‘সামনের শুক্রবারে একসঙ্গে লম্বা আড্ডা দেওয়া যায়, যদি আমি তত দিনে আমার ফ্রানৎস কাফকা প্রজেক্ট শুরু না করি, তবে’—কৌতুকের স্বরে এবার বলল সে–বাংলাদেশের এমা বোভারির স্বামীর সঙ্গে এ রকম ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকা সত্ত্বেও আমি যে ‘মাদাম বোভারি’ প্রজেক্টটা হাতে নিচ্ছি না, এটা তাকে অবাক করছে। তখন কীভাবে যেন আমি হঠাৎ বুঝে গেলাম কেন নূর হোসেন মাদাম বোভারি বইটা নিয়ে এ রকম কৌতুক করে। এর বাংলা অনুবাদ হওয়াটা কোনো বিষয় নয়, কলকাতায় ইতিমধ্যে হয়েছেও নিশ্চয় এবং যদি হয়ে থাকে তা সম্ভবত নূরের অজানাও নয়; কিন্তু আমার মনে হলো, নূর এমা বোভারির কথা এভাবে বলে তার কারণ সে চায় লুনার এমার মতোই মৃত্যু হোক-হয় একই রকম আত্মহত্যা করে, না হয় তার হাতে খুন হয়ে। 

নূর লুনাকে খুন করতে চায় এই চিন্তা করাটা সহজ নয় মোটে, বিশেষ করে নূরের মুখ থেকে আজ আকাশে পাখিদের দল বেঁধে ওড়ার পেছনের ফিজিকসটা জানার পর তো আরও নয়। পাখিদের ওড়ার সৌন্দর্যের পেছনের বিজ্ঞান যাকে এভাবে আলোড়িত করতে পারে, সে মানুষ খুন করবে কীভাবে? চিন্তাটা দূরে সরিয়ে রেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম। ক্লাসে যাব। যেতে যেতে তাকে বললাম, ‘বন্ধু’–তাকে বা দুজনের কাউকে এভাবে বন্ধু বলে ডাকি না আমি—’ফ্লবেয়ারের ওই বিমর্ষ গল্প থেকে দূরে গিয়ে যদি মনটা একটু হালকা করতে চাও তো তুর্গেনেভ পড়ো’; আরও বললাম যে, মজার বিষয় হচ্ছে, সে কি জানে যে ইভান তুর্গেনেভের সঙ্গে গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের দারুণ বন্ধুত্ব ছিল, এতটাই যে দুজনের চিঠি নিয়ে প্রায় দুই শ পৃষ্ঠার এক বইও আছে? বললাম যদি সে চায় তো বইটা তাকে আমি দিতেও পারি। 

মাসুম হায়াতের রুম থেকে বেরিয়ে আমি সিঁড়ি ধরে ওপরের দিকে যাচ্ছি, দেখা হয়ে গেল আমারই পরিচিত অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে, তারা আমাকে দেখে আবার ফেরা শুরু করেছে ক্লাসরুম বি-সিক্সের দিকে। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, তুর্গেনেভকে কত চিঠিতে যে ফ্লবেয়ার কতবার লিখেছেন, ‘মস্কোবাসী বন্ধু, এখানে আসো, আমাকে দেখে যাও, আমাকে কেন চিঠি লেখো না?’ তার হিসাব নেই; অনেকটা উপেক্ষিত প্রেমিকের মতো করে লেখা সেসব চিঠি। ‘তোমার সঙ্গে এবারের শীতে দেখা হবে ভাবলেই মনটা এমন খুশি হয়ে যায় যে মনে হয় কোনো মরূদ্যান বুঝি দেখা হবে এই সমাজবিচ্ছিন্ন জীবনের রুক্ষ-শুষ্ক প্রান্তরে। শুধু যদি জানতে যে কত একা ও বিচ্ছিন্ন আমি।’ 

এসব বিক্ষিপ্ত স্মৃতির মধ্যে আমার সবচেয়ে স্পষ্ট মনে পড়ল—আমি তখন এক ক্লাসরুমভর্তি ছাত্রছাত্রীর সামনে, এথিকস নিয়ে শুরু করব করব ভাবছি, তখন আমার সবচেয়ে স্পষ্ট মনে পড়ল তুর্গেনেভ ফ্লবেয়ারকে ১৮৬৮ সালে লিখেছিলেন—মনে আছে তখন তুর্গেনেভের বয়স ৫০ এবং ফ্লবেয়ারের দু-তিন বছর কম যে, ‘এখন আমাদের ছুঁচোদের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকার দিন।’ পরে তিনি ফ্লবেয়ারকে কলমপেষার হাড়ভাঙা কষ্ট করতে দেখে তাকে তুলনা করেছিলেন পিঁপড়ার সঙ্গে। আর ফ্লবেয়ার তখন নিজের সম্বন্ধে বললেন, “বন্ধু, আমি একটা বুড়ো ব্যাঙ, আটকে আছি পুরোনো স্যাঁতসেঁতে এক গর্তে; আমি একটা চিঠি বিলির কাজে বেরোনো বৃদ্ধ ঘোড়া, ক্লান্ত কিন্তু সাহসী এখনো; আমি লেখালেখির কাজ করি ষাঁড়ের মতো করে আর জীবন কাটাই অয়েস্টারের মতো।’ তুর্গেনেভ ফ্লবেয়ারের নিজেকে এই ‘অয়েস্টার’ বলে উপাধি দেওয়া মাথায় রেখে লিখেছিলেন, ‘আমার বন্ধু ফ্লবেয়ার একটা বুড়ো অয়েস্টার, যা কিনা রোদেও খোলে না।’ এ রকম কিছু লিখেছিলেন এই রাশিয়ান, এবং ফ্লবেয়ার উত্তরে বলেছিলেন, ‘আহা, আমরা দুজনেই যদি সাপ হতে পারতাম, গায়ের পুরোনো চামড়া পুরোটা ছাড়িয়ে নিয়ে যদি পারতাম ফের সব নতুন করে শুরু করতে।’ 

এই সব মনমরা প্রাণীর সঙ্গে ভগ্নমনা তুলনার অবশেষে ইতি টেনে দিয়েছিলেন তুর্গেনেভ তাদের মধ্যকার একদম শেষ চিঠিতে এসে—যেটা বারবার পড়েছিলাম আমি, মনে আছে, ঢাকা-রাজশাহীর এক ট্রেনে চেপে যেবার যাচ্ছিলাম লেখক হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা করতে, তা-ও বহু বছর আগে—যখন তিনি আকস্মিক, এবং তার স্বভাব ভেঙে লিখে বসলেন, ‘আমি ভালো আছি গুস্তাভ, আমি খাঁচার মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছি প্রাণবন্ত এক কাঠবিড়ালির মতো।’ কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এত এত নিরালোক ও নিরানন্দ প্রাণীর, যেমন ছুঁচো, ব্যাঙ, সাপ, পিঁপড়া, অয়েস্টার ইত্যাদির শেষে এসে এই আলো-ঝলমলে সুন্দর কাঠবিড়ালির কথা আর ফ্লবেয়ারের পড়া হলো না তার রাশিয়ান বন্ধুর চিঠি খুলে। যত দিনে এই চিঠি এসে পৌঁছাল ফ্রান্সের নরমান্ডিতে, তদ্দিনে ফ্লবেয়ার কাঠের এক কফিনের ভেতর মৃত এক ভাল্লুক হয়ে পড়ে আছেন। এর তিন বছরের মাথায় মারা গেলেন তুর্গেনেভও। সালটা মনে আছে আমার, ১৮৮৩, কারণ ঠিক সে বছর পৃথিবীতে এসেছিলেন ফ্রানৎস কাফকা, যিনি আবার একসময় লিখলেন একটা বড় গল্প, নাম ‘প্ৰকাণ্ড ছুঁচো’, যা বাংলা অনুবাদে থাকবে আমার ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্রর দ্বিতীয় খণ্ডে যদি কিনা আমি আজ রাত থেকে মেহেরনাজের আদেশমতো আদৌ শুরু করতে পারি এ বইয়ের কাজ। 

ক্লাসে আমি সরাসরি, কোনো ভূমিকা ছাড়াই, এথিকস প্রসঙ্গে চলে গেলাম প্লেটো ও অ্যারিস্টটলকে রেখে কান্ট ও জেরেমি বেন্থামে। বিষাদে প্রুশিয়ান ব্লু হয়ে আসা মন নিয়ে—বিশেষ করে ফ্লবেয়ার ও তুর্গেনেভের মেলানকোলিয়া এবং শেষে কাফকার সঙ্গে এদের এক সামান্য প্রাণীর বদৌলতে সংযোগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার খামখেয়ালিপনা লক্ষ করে—কোনোমতে ক্লাস শেষ করলাম আমি, স্রেফ কোনোমতে, ব্যাঙের মতো কথার এখান থেকে ওখানে লাফ দিয়ে, আমার কথাগুলোর মধ্যে কোনো সংহতি স্থাপনে ব্যর্থ হয়ে। দেখলাম জনা পনেরো ছাত্রছাত্রী ক্লাস ছেড়ে গেল শেষ দিকে এসে, কিন্তু তাদের কিছুই বললাম না আমি, উল্টো রুশোর সঙ্গে টমাস হবস গুলিয়ে একাকার করে এই যন্ত্রণাদায়ক ক্লাস শেষে অপরাধবোধ থেকেই হয়তো নিজের শারীরিক উচ্চতা হারিয়ে ফেললাম অন্তত এক ইঞ্চি। মেহেরনাজ যে ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তা আমার অজানা ছিল। মেহেরকে দেখে বললাম, ঠিক যেন আমরা পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করছি সেভাবে, সবাই যেন দূর থেকে সেটাই ভাবে সেভাবে, যে আমি সোজা বাসায় চলে যাচ্ছি, তাকে কিছুক্ষণের মধ্যে প্লিজ প্লিজ আসতেই হবে। আমার প্রয়োজনটা কী – সান্ত্বনা ও করুণার এক প্রয়োজন ছিল সেটা—তা বুঝল মেহেরনাজ, বোঝারই কথা, কারণ আমার চোখের দৃষ্টি পড়তে পারে সে, এবং আরও বুঝল আমার ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর, আমাকে ওর হাঁটুর ওপর শুয়ে থাকতে দেওয়ার অব্যবহিত পর এই প্রয়োজন আমাদের কোন স্পন্দনীয়তার দিকে নিয়ে যাবে, সে কথাও। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *