1 of 2

আগল

আগল

প্লেনটা টেক-অফফ করেছে। মাত্র মিনিট দশেক ডিলেড ছিল ফ্লাইট। ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইন্স-এর পক্ষে এ বড়ো কম কৃতিত্ব নয়। এখন সিট-বেল্ট বেঁধে রাখার আলোও নিভে গেছে!

জুতোটা খুলে, পা দুটো ছড়িয়ে দিলেন সেনসাহেব।

জুতোটা অবশ্য প্লেনে ওঠামাত্রই খুলতে পারতেন। কিন্তু কোনো দিনই খোলেন না। ভাবেন, অ্যাক্সিডেন্টের অধিকাংশই তো হয় টেক-অফফ করার বা ল্যাণ্ডিং-এর কিছুক্ষণ পরে অথবা আগে। তাই, যদি কিছু হয়ই এবং দৈবক্রমে প্রাণে বেঁচে যান, জুতোটা পরা থাকলে প্রাণ বাঁচিয়ে হেঁটে বা দৌড়ে যেতে সুবিধে হবে।

নিজেও কখনো-কখনো যে হাসেন না, এই কথা মনে করে, মনে মনে; এমনও নয়। প্লেন যদি পড়েই নীচে তবে বাঁচলেও পেছনের দিকে ইকনমি ক্লাসের যাত্রীদের মধ্যেই কেউ কেউ বেঁচে যেতে পারেন দৈবক্রমে। কিন্তু একেবারে সামনের এগজিকিউটিভ ক্লাসের যাত্রীদের মৃত্যু অনিবার্য। যদি না অবশ্য মিরাকল কিছু ঘটে। সেনসাহেবের গভীর বিশ্বাস আছে যে, এয়ারবাস (তিন-শো) ভেঙে পড়লেও নিজে তিনি অক্ষত থাকবেনই। কারণ, এখনও তাঁর অনেক লড়াই জেতা বাকি। অনেক ঔদ্ধত্য, অন্যায় এবং ইতরামির জবাব দেওয়া হয়ে ওঠেনি এখনও। সেইসবের জন্যই তাঁকে আরও কিছুদিন বাঁচতে হবেই।

বেঁচে থাকার বড়োই ইচ্ছে সেনসাহেবের। এই ইচ্ছেটা অন্য দশজন মানুষের তুলনায় কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। ভালো-খাওয়া, ভালো-পরা, অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি এইসবের কামনা বা প্রার্থনাতে তাঁর বাঁচতে চাওয়া নয়, বাঁচতে চাওয়া আরও অনেক বড়ো কিছুর জন্য। তিনি যে তিনিই— তা প্রমাণ করার জন্যে। এই প্রমাণটি অন্য কারোকেই দেওয়ার জন্য যতখানি নয়, তার চেয়ে অনেকই বেশি নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণিত করার জন্যে।

তাঁর এই মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছিলেন পচাদা এবং পাঁচুও।

একটু একলা হলেই ভাবেন সেনসাহেব। ভাবনার ক্ষমতা তো মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীবকেই দেননি বিধাতা। ‘টাইম-কিল’ করার জন্যে পেপার-ব্যাক পড়েন না। হাতে ক্যালকুলেটর বা কম্পিউটার নিয়ে নিজের বিত্ত অথবা পান্ডিত্যচর্চা বা প্রসারের প্রচেষ্টাও চালান না। উনি মানুষটা একটু অদ্ভুত ধরনের। এবং সেইজন্যেই কারো সঙ্গেই তাঁর বিশেষ মিল এবং ঘনিষ্ঠতা নেই। কোনো দলেই ভিড়তে পারেননি জীবনে। দলবদ্ধ জানোয়ার হয়ে কোনো যূথপতির তাঁবেদারি করাই তাঁর চরিত্রানুগ নয়। একাই থাকেন এবং একা থাকতেই ভালোবাসেন। সাধারণত্বর সাধনা তাঁর কোনো দিনই ছিল না।

প্লেনে বসে এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতেই মনে ফিরে এল আবারও কথাটা। পাঁচুর কথাটাই। ভবানীপুরের, তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু পাঁচু। অখ্যাত, আধুনিক কবি পাঁচু। যদিও কুড়িখানি কাব্যগ্রন্থ তাঁর। তবে কবি পাঁচুর চেয়ে ‘বন্ধু পাঁচু’ সেনসাহেবের কাছে অনেক বেশি প্রিয় ছিলেন।

কবিতা লিখলে বা কবিতার বই থাকলেই শুধুমাত্র সে কারণেই কেউ কবি হয়ে ওঠে না। সেনসাহেবের বন্ধু প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। সময় না দিলে, নষ্ট করার মতো সময় না থাকলে, বন্ধুবান্ধব বেশি থাকে না মানুষের। বন্ধুবান্ধব, আড্ডাবাজি এসব সাধারণের জন্যে। তাই, বন্ধু বলতে তাঁর শুধুমাত্র একজনই ছিল।

একমাসও হয়নি পাঁচু গেছে। ভাবছিলেন সেনসাহেব। সেই শেষদেখার দুঃখময় স্মৃতিটি মনে এলেই মনের মধ্যে ধুলোর ঝড় ওঠে। চোখ জ্বালা করে।

এবারে টাইয়ের নটটা আলগা করলেন উনি। মোজা-পরা পা দুটো আরও ছড়িয়ে দিলেন সামনের সিটের নীচে।

একটু পরই রোগশয্যায় শায়ীন পাঁচুর যন্ত্রণাকাতর মুখখানির স্মৃতিকে ছুঁয়ে এসেই আবার অন্য ভাবনাতে ফিরে গেলেন। উনি, মানুষটা ওইরকমই। ওঁর মনটা একটি একক অর্কেস্ট্রা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ‘দক্ষিণী’-র রবীন্দ্রজন্মোৎবের অনুষ্ঠানের মহড়াতে সুনীলদা, সুনীল রায়; রবীন্দ্রনাথের একটি গান শিখিয়েছিলেন। সেই গানটির কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল। এমনই মনে পড়ে সব ভুলে-যাওয়া, ফেলে-আসা গান হঠাৎ হঠাৎ, সেনসাহেবকে চমকে দিয়ে।

তুই কেবল থাকিস সরে সরে
তাই পাসনে কিছুই হৃদয় ভরে
আনন্দ ভান্ডারের থেকে দূত যে তোরে গেল ডেকে
তুই কোণে বসে সব খোয়ালি এমনি করে…
তুই কেবল থাকিস সরে সরে…

বড়ো সুরেলা গলা ছিল সুনীলদার। কিন্তু, আজ সুনীলদার কথা যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মনে পড়ছিল গানটির বাণীর কথা।

সেই সময়ের গানের স্কুলের ছেলে-মেয়েরা আজ কে কোথায় চলে গেছে ছিটকে-ছাটকে। অনেকদিন আগের কথা। তাদের সকলেরই আজ বয়েস হয়েছে নিশ্চয়ই। তবু মনের আয়নাতে এখনও একরাশ চঞ্চল, উজ্জ্বল, যুবক-যুবতীর ছবিই রয়ে গেছে; রোদ-ঝলমল আকাশে একঝাঁক বহুবর্ণ পায়রার উড়াল ছবিরই মতো। বুকের মধ্যে যৌবনের ছবি রাখাই পছন্দ করেন সেনসাহেব।

নিজের এবং অন্য সকলেরও।

শিক্ষকদের মধ্যেও বোধ হয় সুবিনয়দা ছাড়া আর কেউ আজ নেই। প্রসাদদা আছেন, প্রসাদ সেন। হয়তো শ্যামলদাও আছেন, কে জানে! শ্যামল মুখোপাধ্যায়। শ্রীরামপুরে থাকতেন। সেখান থেকে আসতেন। রবীন্দ্রসংগীত তো গাইতেনই ‘ভূশন্ডীর মাঠ’-ও জব্বর গাইতেন। সম্ভবত ‘আশ্রমিক সংঘ’র হয়ে গাইতেন।

শ্যামলদার তেমন নাম-টাম হল না। ছেলে-মেয়েদের কাছে কিন্তু খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। গুণপনার সঙ্গে নাম-টামের, স্বীকৃতির সাযুজ্য তখন যদি-বা কিছু ছিল, জীবনের কোনো নিভৃত শিল্পক্ষেত্রেই আজ আর তা একেবারেই নেই। এখন নিজেই নিজের ঢাক ‘হুম-হুম’ করে পিটিয়ে না বেড়ালে হুলোবেড়াল হয়ে ওঠা আদৌ যায় না। সর্বক্ষেত্রেই হুলোদেরই রাজত্ব চলছে এখন। সবাই বেড়াল। বাঘেরা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। গেছে। কালো, ধলো, রোগা-মোটা। চুরি-করে খাওয়া দুধের দাগ তাদের অধিকাংশরই গোঁফে।

আজ অবধি সুবিনয়দাকে সংগীত-নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কারও দেওয়া হল না। সব পুরস্কারই এখন প্রহসন হয়ে গেছে। তবে উনি শ্রোতার সম্মান অবশ্যই পেয়েছেন। এর চেয়ে বড়ো সম্মান আর কী-ই বা আছে! অন্যসব প্রাতিষ্ঠানিক, ধর-পাকড়ের, তেল-দেওয়ার, বিনিময়ের সম্মানের দাম তাৎক্ষণিক।

সেইসব সম্মান থাকেও না।

এসব দেখেশুনে আজকাল আর রাগতও হন না সেনসাহেব. দুঃখিত তো হনই না। তবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংবলিত এই জীবদের প্রতি, যারা মানুষ বলেই চলে যাচ্ছে শুধু নয়, ইদানীং রীতিমতো দাপিয়েও বেড়াচ্ছে মেদিনী, তাদের প্রতি অসূয়া নয়, এক ধরনের অনুকম্পা বোধ করেন উনি। সম্ভবত পি জি উডহাউসেরই কোনো লেখায় পড়েছিলেন, When there was enough material to make a perfect ass. I don’t know why did God make an imperfect human being of him—! এই উক্তিটি মনে পড়ে যায় সেনসাহেবের। এদের অনেককে দেখেই। হয়তো হুবহু মনে নেই। তবে বাকিটা অনেকটা এইরকমই ছিল এবং লেখাটা অবশ্যই পি জি উডহাউসেরই।

যাকগে যাক। যা ভাবছিলেন। বাঁচা অথবা মরার প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল ওঁর। এই ‘বাঁচার ব্যাপারটা’ ভারি অন্যরকম করে বলতেন পচাদা। জীবন সম্বন্ধে একটি ওরিজিনাল পয়েন্ট অব ভিউ ছিল পচাদার।

সেনসাহেবের ডাক নাম ফুচু। ওঁদের পুরোনো পাড়ার ক্লাবের নাটকের পরিচালক পচাদা প্রায়ই অভিনয়ের মহড়ার মধ্যে মধ্যে ওঁকে, পাঁচুকে এবং আর এক বাল্যবন্ধু গবাকে বলতেন, হ্যাঁরে, তোরা ‘বাঁচা’ শব্দটার মানে জানিস কি কেউই?

গবা একদিন পচাদার এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, তুমি রোজ রোজ এমন হেঁয়ালি কেন করো বলো তো, পচাদা? ‘বাঁচার’ মানে কে আর না জানে! নাক দিয়ে নি:শ্বাস যার পড়ে, সে-ই বাঁচে। তাকেই বাঁচা বলে, মানে, সে-ই জীবিত।

পচাদা কাঁচি সিগারেটটা বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে গাঁজার কলকের মতো ধরে জোরে একটান মেরে সেদিন অত্যন্ত বিদ্রূপভরা গলাতে বলেছিলেন, তুই একটা লম্বকর্ণ। মানুষ নি:শ্বাস নেয় না, নি:শ্বাস ফেলে। প্রশ্বাস নেয়। শিখে রাখ কথাটা। কিন্তু ‘বাঁচা’ কথাটা তা নয়। ‘বাঁচা’ কথাটা অত সোজা নয়। এবাঁচা, অন্য বাঁচা। প্রশ্বাস নেওয়া, নি:শ্বাস ফেলা আর বাঁচা—কোনো দিনই সমার্থক ছিল না।

বাঁচা; বাঁচা। মরার উলটোটাই বাঁচা। তার আবার অন্য, পর কী?

গবা নয়, পাঁচু একদিন বলেছিল, পচাদার মুখের ওপরই।

পচাদা আস্তে আস্তে একদিন বলেছিলেন, আছে রে আছে। প্রশ্বাস নেয় ও নি:শ্বাস ফেলে তো সকলেই কিন্তু অধিকাংশই বাঁচে আগল তুলে, আর অতিস্বল্পজনে বাঁচে আগল খুলে। আগল তুলে অন্ধকার জীবের মতো বাঁচাকে ‘বাঁচা’ বলে না। আগল-খুলে বাঁচিস তোরা, আগল-খুলে বাঁচিস রে। পার্ট যখন বলবি, তখনও আগল খুলেই বলবি। এ, তোদের দোরের আগল নয়; মনের আগল। বুঝলি কিছু? পাঁচু, ফুচু, গবা? তোদের শিখিয়ে গেলাম বাঁচার গুপ্তমন্ত্রটা। আরে, সকলেই ভাবে যে, তারা বেঁচে আছে কিন্তু বাঁচা কি অত সোজা রে? সে যে ভারি কঠিন ব্যাপার।

সিগারেটটা শেষ করে পাঁচুদা বলেছিলেন, আমি আর ক-দিন আছি? আমি পারিনি। তোরা চেষ্টা করিস। তোরা তো আমার তুলনাতে বয়েসে চুনোপুঁটি। তোদের এখনও অনেকই সময় আছে হাতে। বাঁচার কায়দা জানা সত্ত্বেও একেবারেই বেকায়দায় কাটিয়ে গেলাম আমি নিজে, নিজের জীবনটা। তোরা সব…

পাঁচু তো গতমাসে চলেই গেল। সবরকম বাঁচার অন্য পারে। ওর সামান্য করণিকের চাকরি, সেই চাকরিটাও কর্তব্যজ্ঞানহীনতা, অনিয়মানুবর্তিতা ও আত্মসম্মানজ্ঞানহীনতা দিয়ে সামান্যতর করে তুলেছিল ও নিজেই। এবং সে-সম্বন্ধে ও পুরোপুরি অবহিত ছিল বলেই হয়তো লজ্জিতও হত। লজ্জাবোধটাও যে খেয়ে বসেনি এই ঢের!

কবি হিসেবেও সে যে তেমন স্বীকৃতি পেয়ে যেতে পারল না পাঠক-পাঠিকার কাছে, সেই দুঃখটা পাঁচুকে বড়োই বিঁধত। সেনসাহেব জানেন না যে, পাঁচু সত্যটা বুঝত কি না যে, ‘চেষ্টা’ করলে ভালো করণিক, ভালো উকিল, বা ভালো ডাক্তার, ভালো রাজনীতিকও হয়তো হওয়া যায়, কিন্তু ভালো ‘কবি’ হওয়াটা শুধুমাত্রই চেষ্টা-সাপেক্ষ নয়। রাজারাজড়া বা তাদের চেয়ে ক্ষমতাশালী কোনো মিডিয়াও যে নিজ-গুণেকবি নয়, তাকে কবি বানিয়ে দিতে পারে না। একই কারণে পাঁচুর পার্টিও পাঁচুকে কবি বানাতে পারেনি।

তবে বাল্যবন্ধুর কোনো অপারগতার জন্যেই ব্যক্তিগতভাবে ফুচু সেন পাঁচুকে কোনোদিনও দায়ী করেননি।

পাঁচু হাসপাতালের বিছানাতে শুয়ে শুয়ে ব্যথাতুর মুখটা বালিশের ওপরে দু-পাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেছিল, পচাদার কথা তোর মনে আছে রে ফুচু? শেষজীবনে পাগল হয়ে গেছিল পচাদা। বেঁচে গেছিল। মানসিকভাবে সুস্থ মানুষদের আজকাল বড়োই কষ্ট। তুই তো আর পুরোনো পাড়াতে থাকিস না, তাই হয়তো খোঁজ রাখতিস না। কিন্তু, পচাদার সেই ‘আগল খুলে বাঁচা’র কথাটা আমার প্রাই মনে পড়ত। এখনও পড়ে। পচাদার মতো আমিও পারলাম না রে ফুচু। আমারও চলা শেষ। মন্ত্রটা পেয়েও কাজে লাগাতে পারলাম না রে ফুচু! পারলে, তুই অমন বাঁচা বাঁচিস। যদি পারিস! চেষ্টা করিস অন্তত।

শেষনি:শ্বাস ফেলার সময়েও পাঁচু বাল্যবন্ধু ফুচু সেনের হাতে হাতটি রেখে বলেছিল, বাঁচার মতো বাঁচা হল না রে ফুচু। কিছুই করা হল না। সবই বৃথা হল। মিথ্যা আদর্শ, ভুল পথ, বৃথা জীবন। চললাম রে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেনসাহেব।

কোথায় চলে গেল পাঁচুটা।

পাঁচুর ইদানীং খুব ‘পাহাড়-পাহাড়’ বাতিক হয়েছিল। পার্টি থেকে মন সরে গিয়েছিল। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াত। গাড়োয়াল হিমালয়, কুমায়ুন হিমালয়, মহাকাল রেঞ্জ, বিন্ধ্য রেঞ্জ এসবের কথাও বলত সাম্প্রতিক অতীতে সবসময়ই। বলত, একবার চল আমার সঙ্গে ফুচু। আমাদের ট্রেকিং টিম-এর সঙ্গে। একবার গেলে আর এই ফেরেববাজদের শহরে ফিরতেই ইচ্ছে করবে না তোর। আঃ। ভগবানের জায়গা রে। দেবভূমি।

ভগবান-টগবান কী বলছিস তুই, চুপ কর। চুপ কর। তোর পার্টির দাদারা, কলকাতার আঁতেলরা শুনতে পেলে কী হবে?

সেনসাহেব বলেছিলেন।

যাওয়ার আগে শেষমুহূর্তের, শেষকথা বলেছিল অবিবাহিত পাঁচু, ‘আগল খুলে বাঁচিস রে ফুচু।

ডিনার সার্ভ করে দিয়েছে। কফিও। তার পর বাসনপত্র সব নিয়ে-টিয়েও গেছে এয়ার হস্টেস এসে। সকলেরই একটু ঘুম ঘুম ভাব। দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিট বা আড়াই ঘণ্টার ফ্লাইট। তারমধ্যে আধাআধি পেরোনো গেছে। নাগপুরও পেছনে ফেলে এসেছে প্লেন।

কিছুক্ষণ পরেই প্লেনটা হঠাৎ অসম্ভব ঝাঁকাতে আরম্ভ করল সকলের চোখের ঘুম ঘুম ভাব চটকে দিয়ে। মনে হল, ইঞ্জিনের মধ্যে যেন কোনো পাথরের চাঙড় বা লোহার পিন্ডই ঢুকে গেছে। কী যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ইঞ্জিনের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনটাও। সিট-বেল্ট বাঁধার সাইনটা জ্বলে উঠেছে আগেই।

আশ্চর্য একটা শব্দ করতে লাগল প্লেনটা। সপ্তাহে গড়ে চার বার প্লেনে-চড়া সেনসাহেবেরও এমন অভিজ্ঞতা কখনোই হয়নি। প্রথমে মনে হচ্ছিল, এয়ারবাসের ইঞ্জিন নয়, দার্জিলিং-হিমালয়ান-লাইট রেলওয়ের ইঞ্জিনই কথা বলছে। পাহাড়ে চড়ছে ছোটো ট্রেন। একটা সমান ব্যবধানের, সমান ডেসিবেল-এর ‘ধস ধস’ শব্দ।

ক্রমশই সেই শব্দটা জোর হতে লাগল। এমনভাবে থরথর করে, সড়সড় শব্দ করে কাঁপতে লাগল প্লেনটা যে, মনে হতে লাগল, ওভারহেড লকারগুলো সব ভেঙে মাথার ওপরেই পড়বে। তার পরই একটা মুহূর্ত এল যখন স্টারবোর্ড ইঞ্জিনের মধ্যে থেকে তীব্র একঝলক আগুন লাফিয়ে উঠল এবং তার পরেই মনে হল যে, প্লেনটা ভেঙেই পড়বে এক্ষুনি নীচে। সব শেষ। এবং সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের আলোগুলোও হঠাৎ নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল পুরো প্লেনটা এবং যে এয়ার-ডাক্ট দিয়ে বাইরের টাটকা বাতাস ঢোকে তা দিয়ে কালো ধোঁয়া আসতে লাগল। সঙ্গে পেট্রোলের গন্ধ। বিভিন্নগ্রামে কান্নাকাটির ও হা-হুতাশের আওয়াজে ভরে গেল প্লেনের মাথা থেকে ল্যাজ পর্যন্ত।

এয়ার হোস্টেস বা স্টুয়ার্টদেরও দেখা গেল না। তাঁরাও কি কাঁদছেন? এমনিই অন্ধকারে অন্ধকারতর সন্দেহে ও আতঙ্কে কাটল সকলেরই আরও মিনিট পাঁচেক। কিন্তু সেই পাথর আর লোহা গুঁড়োনো শব্দটা যেন, হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল স্টারবোর্ড সাইডের ইঞ্জিন থেকে। আগুনও আর দেখা গেল না।

প্রতিটি যাত্রীর মনেই তখন বাঁচার ইচ্ছেটা তীব্রভাবে ফিরে এল হঠাৎই আবার। এতক্ষণ, মরতে যে হবেই, এটাই সকলে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাতে মেনে নিয়েছিলেন।

‘জে’ক্লাসের ফার্স্ট রো-র ‘এ’ সিটে একজন মন্ত্রী যাচ্ছিলেন আর ওয়ান ‘এইচ’-এ একজন বামপন্থী সাংসদ। প্লেনে উঠে চোখাচোখি হতেই নমস্কার বিনিময়ও হয়েছিল দুজনের মধ্যে। লক্ষ করেছিলেন সেনসাহেব। তবে একজন ডানপন্থী অন্যজন বামপন্থী। একটু আগেই দুজনেই মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন।

এমন সময়ে ইন্টারকম-এ ক্যাপ্টেনের গলা ভেসে এল। উনি বললেন, প্লিজ, আপনারা কান্নাকাটি করবেন না। উত্তেজিত হবেন না। প্লেনের ডান দিকের ইঞ্জিনে আগুন যে ধরে গেছিল তা ঠিকই। কিন্তু ইঞ্জিনের মধ্যেই বিল্ট-ইন-ডিভাইস থাকে। তা দিয়ে আগুন আমরা নিভিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এখন প্লেন উড়ছে একটা ইঞ্জিনেই মাত্র। পোর্ট-সাইড অর্থাৎ বাঁ-দিকের সে ইঞ্জিনটিও যে খারাপ হবে এমন আশঙ্কা করার কোনো কারণ নেই। তবে ল্যাণ্ডিং-এর সময়ে আমাদের কিছু অসুবিধে হতে পারে। বম্বের আকাশের ওপরে ঘুরে ঘুরে সব ফয়েল পুড়িয়ে ফেলে, হোপফুলি, হয়তো ভোর দেড়টা-দুটো নাগাদ আমরা ল্যাণ্ড করব সান্টাক্রুজ-এ। একইঞ্জিনেই। পাওয়ার বাঁচাবার জন্যই আলো সব নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনারা রিল্যাক্স করুন। হ্যাপি ল্যাণ্ডিং।

সঙ্গে সঙ্গে একটা জোর গুঞ্জন উঠল প্লেনময়। মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরে এলেন আপাতত প্রত্যেকটি যাত্রী। গরিব থেকে বড়োলোক, পুরুষ থেকে নারী, ‘ইকনমি’ ক্লাস ও ‘জে’ ক্লাসের প্রত্যেক প্যাসেঞ্জার। সিট-বেল্ট সাইন তখনও অফফ হয়নি, হয়তো হবেও না। কারণ, বাঁচাটা এখনও সুনিশ্চিত হয়নি। যদি মরতে হয়, তবে মরার ক্ষণকেও বিলম্বিত করা গেল কিছুটা। এতেই যেন সকলে খুশি। ল্যাণ্ডিং-এর সময়ে কী হবে না হবে তখনই দেখা যাবে।

ফর্সা, বেঁটে মন্ত্রী নিজের সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে কালো, লম্বা সাংসদকে ডান হাত বাড়িয়ে বললেন, কনগ্র্যাচুলেশনস!

সাংসদও বাঁ-হাত বাড়ালেন। হেসে বললেন, কিস লিয়ে জি?

মওত কো হটানে কে লিয়ে জি, দুবারা জিনে কি লিয়ে। যুগ যুগ জি জিন্দাগি।

অন্যজনও বললেন, জিন্দাগি মুবারক হো। মুবারক।

হা:। হা:। হা: করে দু-তরফেরই হাসি শোনা গেল। এবং সেই যুগ্ম দেশসেবকদের হাসিতে যোগ দিলেন ‘জে’ ক্লাসের প্রায় সব যাত্রীই। জীবনের হাসির হররাতে ক্রমশ ভরে যেতে লাগল অত বড়ো প্লেনের আনাচ-কানাচ। দীর্ঘরাতের শেষে ভোরের শব্দের মতন। ধীরে ধীরে।

বেঁচে থাকাটা যে কত্ত সুখের!…আঃ।

ফুচু সেন বাইরে চেয়ে দেখলেন, তারা-ভরা কৃষ্ণপক্ষের ব্রহ্মান্ড। প্লেনটা একত্রিশ হাজার ফিট ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এভারেস্টের উচ্চতা যেন কত? উনত্রিশ হাজার দু-ফিট?

সবচেয়ে কাছে যে-তারাটা সেটা কত দূরে? কে জানে! আলোর গতি যেন কত? এক সেকেণ্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল? তবে ওই জ্বলজ্বল-করা তারাটা? কত দূরে? কে জানে!

এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সেনসাহেবের জীবনের জমে-থাকা সব ভাবনাই। জীবনের ঘর থেকে মৃত্যুর ঘরে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে এলে বোধ হয় এমনিই ঘটে। আগে তো কখনো হয়নি এমন অভিজ্ঞতা!

সেনসাহেব মনে মনে বললেন, তুমি শুধু শুধু বাজে কথা বলতে পচাদা। বাগাড়ম্বর। কথারই কথা। যাঁরা মৃত্যুর কাছাকাছিও একবার গিয়ে পৌঁছেছেন তাঁরাই জানেন, বেঁচে থাকাটা কত্ত সুখের। শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই, প্রশ্বাস নেওয়া আর নি:শ্বাস ফেলাটাই—গবা তোমাকে যেমন বলেছিল।

মানুষ মরে কোথায় যায়, কে জানে? আদৌ কি যায় কোথাওই? একদল জোরের সঙ্গে বলেন, মৃত্যুই শেষকথা। সবই থেমে যায় সেখানে পৌঁছে। অন্যদল বলেন, ভুল, ভুল।

হিন্দুদের স্বর্গ-নরক আছে। শুধু একরকমেরই নয়। বহুরকমের। মুসলমানদেরও তাই। ‘পরলোক’ সম্বন্ধে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী দু-দলের মধ্যে কোন দল ঠিক, তা কে জানে! তবে ফুচু সেনের মতো এইমুহূর্তে আর কেউই জানেন না যে, দল-মত-জাত-ধর্মনির্বিশেষে এই প্লেনের প্রত্যেকটি মানুষ এইমুহূর্তে নি:শর্তে মানেন যে, জীবনের চেয়ে, বেঁচে থাকার চেয়ে, বড়ো প্রার্থনার আর কিছুই নেই।

সত্যি।

ভাবা যায় না, এই মরতে মরতে বেঁচে যাওয়ার ব্যাপারটা।

কিন্তু ল্যাণ্ডিং-এর সময়ে কী হবে?

অন্ধকার থেকে ওঁর মৃত বন্ধু পাঁচু যেন হাতছানি দিল সেনসাহেবকে, বাইরের অন্ধকার কিন্তু তারা-ঝলমল ব্রহ্মান্ড থেকে। বলল, দুস। দুস ফুচ। একে বাঁচা বলে রে? তোরা যেমন বাঁচছিস, আমি যেমন বেঁচে ছিলাম? ছ্যা: ছ্যা:! আগল খুলে বাঁচ রে, আগল খুলে বাঁচতে শেখ। এখনও শেখ। আগল তুলে বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়াতে কোনো তফাত নেই। আমি বলছি। জীবন আর মৃত্যু দুই-ই আমার দেখা আছে বলেই বলছি। বাঁচ রে ফুচু। বাঁচার মতো বাঁচ। জীবিকার জন্য বাঁচিস না, জীবনের জন্যে বাঁচ।

বিপদের সময়ে কখন যে রিফ্লেক্স-অ্যাকশনে জুতোটা পরে ফেলেছিলেন ফুচু সেন তা নিজেও খেয়াল করেননি। লজ্জিত হলেন। সত্যিই সত্যিই বাঁচার বড়োই ইচ্ছে ফুচু সেনের। শুধু ওঁর একারই বা কেন? হয়তো সব মানুষেরই। চোখের সামনেই তো দেখলেন প্রত্যেককে। বাঁচার ইচ্ছে কার নেই? এমনকী যেমন-তেমন করে বাঁচার ইচ্ছেও। এখন আবার জুতোটা খুলে ফেলে, মোজা-পরা ‘টেনসড-হয়ে থাকা’ পা দু-খানিকে পুরোপুরি ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজে ফেললেন। আঃ। নিশ্চিন্ত। আপাতত। ল্যাণ্ডিং-এর আগে পর্যন্ত।

ওঁর কানের কাছে কারা যেন সমানে বলে যেতে লাগল, এবার যেন শুধু পাঁচুরই নয়, পচাদার গলাও পেলেন; একে বাঁচা বলে না রে ইডিয়ট। বাঁচ! বাঁচ। আগল-খুলে বাঁচ। অমন বাঁচা গোরু-ছাগলেরা আর ফেরেববাজেরাই বাঁচে। বাঁচ রে ফুচু। বাঁচ।

কল-বাটন টিপলেন সেনসাহেব। হোস্টেসের কাছে তুলো চাইবেন ভাবলেন কানে গোঁজার জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন এই স্বরক্ষরণটা হচ্ছে তাঁর নিজের মস্তিষ্কেরই মধ্য থেকে, শব্দহীন রক্তক্ষরণেরই মতন।

তুলোর সাধ্য কী তা…

পাঁচু ও পচাদারা একটা ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছেন ফুচু সেনকে, সারাজীবনেরই মতো। মানে, যতটুকু আর বাকি আছে। তাঁর জীবনটাও প্রায় চলে যেতে যেতে বুমেরাং হয়েই ফিরে এল তাঁর আপাতসুখী, সংসারী, তথাকথিত কৃতী কিন্তু অন্তঃসার শূন্য জীবনের মধ্যে, অন্য একটা জীবন হয়ে। ফুলের মধ্যে ফুলের মতন, পাতার মধ্যে পাতা। নতুন জীবনের বাণী বয়ে। এতাবৎ সম্পূর্ণই অচেনা একটা চেহারা নিয়ে। হঠাৎ।

অর্ণবী সেদিন একটা ফোটো পাঠিয়েছিল তার চিঠির সঙ্গে। বীরভূমে তাদের দেশের গ্রামের। আহা! কী সুন্দর লালমাটির পথ! গোরুর গাড়ি চলছে। চাপ চাপ সবুজ ঘাস। সবুজ, সবুজ; চারিদিকেই সবুজ। একটা সাদা গোরু আর একটা কালো গোরু চরছে পথের দু-পাশে। দু-দিকেই ঝাঁকড়া, বড়ো বড়ো গাছ। কচি কলাপাতা-সবুজ। সুরুলের খুব কাছেই নাকি জায়গাটা। ঠিক যে কোথায়, তা কে জানে? সব তো জানায়নি।

ফুচু সেনের স্ত্রী নলিনী যাই বলুন, তিনি থাকুন তাঁর চাকরবাকর, সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি, গাড়ি-ড্রাইভার এবং তাঁর ‘সাহেব’ ছেলেকে নিয়ে কলকাতাতে এইসব ‘ভদ্র’, ‘সভ্য’, ‘শিক্ষিত’, শহুরে মানুষদের সঙ্গে।

ফুচু সেন অবশ্যই চলে যাবেন। সেই গ্রামে। নামটা মনে পড়ছে না, এ-মুহূর্তে। জানিয়েছিল কি? অর্ণবী ওঁকে সিরিয়াসলি নেয়নি। নিলে, ওঁর চিঠির আর্তিটা বুঝতে পেত। মনে হয়, কেউই ওঁকে সিরিয়াসলি নেয় না। নামও জানেন না জায়গাটার, অর্ণবীদের দেশের, গাঁয়ের—।

ফোটোটা পাওয়ার পর থেকেই অর্ণবীদের গ্রাম নিয়ে অনেকই স্বপ্ন দেখেছেন ফুচু সেন। যদি জমি পেতেন একটু অথবা একটি ভাড়া বাড়িও! মাটির বাড়ি হলেও চলে যেত। বই-পত্তর, রেকর্ড-টেকর্ড, রং-তুলি সব নিয়ে বাকিজীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দিতেন তাহলে।

সত্যিই সত্যিই মনটা আজ বড়োই উচাটন হয়েছে বাঁচার জন্যে। আগল খুলে বাঁচার জন্যে। বিশেষ করে পাঁচুটা অকালে চলে যাওয়ার পর থেকে। এবং আজকের ওই দুর্ঘটনা অথবা ঘটনা…

এই পুরোনো রাতের শেষে অথবা অনাগত নতুন দিনের শুরুতে যদি প্লেনটা তেল-টেল ফুরিয়ে নিয়ে একইঞ্জিনে অবশেষে সত্যিই নামতে পারে নিরাপদে তবে আর কারো গোলামিই তিনি আর একদিনও করবেন না। সত্যি সত্যিই সমস্ত ভার-মুক্ত, এক নতুন মানুষ হয়ে যাবেন এই জীবনের মতন। আগলটা দু-হাতে খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেবেন। ভোরের পাখি হয়ে যাবেন। আনন্দে গান গাইবেন। যদি অর্ণবীদের দেশে না-যাওয়াও হয়, যদি ওরা নাও চায় ওঁকে, তবে উনি চলে যাবেন পাঁচুর শেষজীবনের গল্পে গল্পে নেশা ধরে-যাওয়া গাড়োয়াল হিমালয়ে—অলকানন্দার ধারে—বা মন্দাকিনীর পারে কোনো ছবির চেয়েও সুন্দর গ্রামে। গিয়ে, এই অপ্রয়োজনের প্রয়োজনের ভারে ন্যুব্জ, এই ইট-চাপা ঘাসের ফ্যাকাশে বিস্বাদ জীবনকে পুনরুজ্জীবিত করবেন তিনি। ‘চুকোর’ আর ময়ূরের ডাকে ভোর করবেন প্রতিটি দুঃস্বপ্নের রাত, উত্তর-বাহিনী হাওয়ার মধ্যে।

ফুচু সেন বুঝতে পারছেন যে, পাঁচুর চলে-যাওয়াটা আর একটু আগের প্রায় হঠাৎ-মৃত্যুর ছোঁয়াটা তাঁকে জীবনের এক নতুন মানে খোঁজাতে আপ্রাণ উদবুদ্ধ করেছে।

বড়োই ঝামেলাতে ফেলে গেছে পাঁচু তাঁকে যাওয়ার সময়ে। এবং বহুদিন আগে চলে যাওয়া পচাদাও।

প্লেনটা নানা-রঙা আলো ঝলমল দিগন্ত-বিস্তৃত বম্বে শহরের ওপরে এসে ক্রমাগত ঘুরতেই লাগল। একটা এয়ারবাস তিন-শোতে ঠিক কতখানি অ্যাভিয়েশন ফুয়েল থাকে, কে জানে? কলকাতা থেকে বম্বে পাড়ি দেওয়ার পরও কতখানি তেল থাকে?

এবার ক্রমশ উচ্চতা হারাচ্ছে প্লেনটা তবে বাঁ-দিকের ইঞ্জিন ঠিকই কাজ করছে। নামছে, নামছে, নামছে।

পৃথিবী ডাকছে, আয়! আয়! আয়! নাকি পাঁচু ডাকছে? পচাদা?

সকাল প্রায় পৌনে দুটোর সময়ে অবশেষে টালমাটাল পায়ে আত্মভোলা শিশুর মতন একইঞ্জিনে কোনোক্রমে নেমে পড়ল এত বড়ো এয়ারবাসটা মস্ত একটা হার্টফেল করানো ঝাঁকি দিয়ে। ‘টারম্যাক’-এর শেষপ্রান্তে, মানে যেখানে প্লেন ল্যাণ্ড করে, তারই দু-পাশে পরম উদবেগের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়ার-ব্রিগেড আর অ্যাম্বুলেন্স-এর গাড়িগুলো যেন প্লেনটাকে ধাওয়া করে ছুটে আসতে লাগল পেছন পেছন হেডলাইট জ্বেলে। কিন্তু কোনো অঘটনই ঘটল না। এবারের মতো বেঁচে গেলেন ফুচু সেন, ফর্সা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কালো সাংসদ এবং প্লেন-ভরতি অগণ্য নারী-পুরুষের দল, যাঁদের অধিকাংশেরই জীবনে বেঁচে থাকার কোনো বিশেষ সার্থকতা নেই। যাঁরা ‘আগল-খুলে বাঁচা’ কাকে বলে, তা জানেন না পর্যন্ত। ধোপার গাধা বা চাষের বলদের চেয়ে অন্য বা ভিন্ন কোনো পরিচয়ই নেই যাদের ফুচু সেনেরই মতন।

তবুও, তাঁরাও সকলেই আবারও জীবন পেলেন।

সঙ্গে সঙ্গেই গত একঘণ্টা ধরে নতুন নতুন উৎকন্ঠায় শুকিয়ে-যাওয়া গলা নিয়ে বসে থাকা যাত্রীরা দ্বিতীয় বার বেঁচে ওঠার আনন্দে যেন মেঘলা ভোরের ময়ূরের মতো নৃত্য করে উঠলেন। এক সুন্দরী বিবাহিতা বাঙালি বললেন, তাঁর স্বামীকে; ‘ক্যাপ্টেনকে চুমু খাব আমি।’ স্বামী আনন্দে গদগদ হয়ে বললেন, ‘ককওনা, কাও’। সঙ্গে সঙ্গেই একজন সাড়ে ছ-ফিট শালপ্রাংশু সর্দারজি বললেন, ‘আমিও খাব, কো-পাইলটকে’।

বেচারা কো-পাইলট!

এই জীবন ফেরত পেয়ে ট্যাঁকস্থ করার হইচই-এর মধ্যেই ফুচু সেন টাইয়ের নটটা ঠিক করে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, আজকের ভোরের আলো আসবে আমার মুক্তি নিয়ে, পচাদা, পাঁচু, আপনারা, তোরা, দেখবেন; দেখিস। জীবনের যে ক-টা দিন আর বাকি আছে, আর একজনেরও গোলামি করব না। না কোনো অশিক্ষিত, উদ্ধত মালিকের; না বউ এর, না ছেলের, না অন্য কারোরই। আগল খুলে বাঁচা কাকে বলে, তা দেখিয়ে দেব।

চেরিয়ান জর্জ, মক্কেলের কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার, নিতে এসেছিলেন সেনসাহেবকে। প্লেন ল্যাণ্ড করার কথা ছিল রাত সাড়ে দশটাতে কিন্তু নামল সকাল দুটোতে। অপেক্ষার কষ্টের চেয়েও উৎকন্ঠার কষ্টটা অনেকই বেশি ছিল জর্জসাহেবের। সেনসাহেবকে জড়িয়ে ধরে তিনি চুমু খেলেন। সিগারেটের গন্ধে আর থুতুতে মুখময় মাখামাখি হয়ে গেল সেনসাহেবের। তবু ভারি খুশি হলেন। জর্জসাহেব বললেন, কনগ্র্যাটস স্যার। ফর দ্য সেকেণ্ড লাইফ।

তাজমহল হোটেলে যখন পৌঁছোলেন ওঁরা, তখন পৌনে তিনটে সকাল। জর্জকে তখনই যেতে দিলেন না ফুচু সেন। সোজা তাঁর হাত ধরে ‘শামিয়ানা’-তে ঢুকে বললেন, হোয়াটস দ্য বেস্ট স্কচ ইউ হ্যাভ?

জনি ওয়াকার ব্লু লেবেল স্যার।

স্টুয়ার্ট বললেন।

ব্রিং আস ফোর লার্জ প্লিজ।

উইথ সোডা অর ওয়াটার স্যার?

উইথ সোডা। অ্যাণ্ড প্লেন্টি অব আইস প্লিজ।

হুইস্কি আসার পর ফুচু সেনের হাতে হাত ঠেকিয়ে, গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে জর্জসাহেব বললেন, ট্যু ইউ স্যার। অ্যাণ্ড টু লাইফ।

ট্যু আগল-খোলা লাইফ।

মনে মনে বললেন, সেনসাহেব।

চলে যাওয়ার সময়ে জর্জসাহেব বললেন, আওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইজ অ্যাট ইলেভেন থার্টি স্যার। ইলেভেন থার্টি শার্প।

হোয়াট?

স্বপ্নোত্থিতের মতন বললেন সেনসাহেব।

বললেন, উইথ হুম?

উইথ দ্য চিফ কমিশনার স্যার। মি. এস ইনামদার।

ওঃ ইয়েস। ইয়েস, ইয়েস! আই সি। কীজন্যে মুম্বই আসা সেটাই ভুলে গেছিলেন।ডানা-কাটা অ্যালবাট্রস পাখির মতন বললেন তিনি।

আর কিছু বলার আগেই জর্জ বলল, আই উইল কাম টু পিক ইউ আপ অ্যাট ইলেভেন শার্প। হ্যাভ সাম স্লিপ। ভেরি গুড মর্নিং স্যার।

গুড মর্নিং।

যন্ত্রচালিতের মতো বললেন সেনসাহেব। জর্জসাহেবের স্টিল-গ্রে মারুতি ওয়ান থাউজ্যাণ্ড চলে গেল।

সেনসাহেব তখনও তাজমহল হোটেলের লবির বাইরের সিঁড়িতেই দাঁড়িয়েছিলেন জর্জসাহেবকে সি অফ করে।

সর্দারজি গেটম্যান বলল, শ্যাল আই কল ইয়োর কার স্যার?

বেল-ক্যাপ্টেনের ডেস্ক-এর সামনে বেল-বয় তাঁর ব্যাগটি ট্রলিতে বসিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সেনসাহেব ঘোর ভেঙে বললেন, ‘নো। থ্যাঙ্ক ইউ।’

বলেই, কাচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে গিয়ে, সই করে দিয়েই, (এ হোটেলের ওঁকে সকলেই চেনে); ধীরে ধীরে বাঁ-দিকে ঘুরে ওল্ড উইং-এ যাওয়ার লিফট-এর দিকে হেঁটে চললেন। পাশে পাশে চাবি আর ছাপানো লেটারহেড নিয়ে গেস্টস-রিলেশন-এর সুন্দরী মেয়েটি কী যেন বলতে বলতে যেতে লাগল। শুনতে পেলেন না সেনসাহেব। যেন, খোঁড়া-গোরু।

বেল-বয় সার্ভিস লিফট দিয়ে ওঁর ব্যাগ নিয়ে আসবে।

ফুচু সেন জানেন, কাল সকাল পৌনে এগারোটাতে যে-মুখটি তিনি দেখতে চান না, যে-মুখটিকে তিনি ভালোবাসেন না, সেই মুখটি, সেই ফুচু সেনের ক্লান্ত বিরক্ত মুখটিই তিনি দেখতে পাবেন আয়নাতে। দেখতে পাবেন, মনোযোগ দিয়ে টাই বাঁধছেন তিনি। আবারও আর একটি গোলামির দিন শুরু করতে হবে। ঘরের দরজা থাকবে ডাবল-লক করা। বাইরে লাল আলো জ্বলবে। ‘প্লিজ ডু নট ডিস্টার্ব।’ কিন্তু যে তাঁকে ডিস্টার্ব করে অনুক্ষণ সে তো আছে ঘরের ভেতরেই, আয়নায় যার মুখ আঁকা।

মুক্তি নেই; মুক্তি নেই। অর্ণবী তুমি একজন হতভাগা মানুষের সবুজের স্বপ্ন সিরিয়াসলি নিলে না। মুক্তির ইচ্ছের তীব্রতাটা বুঝলে না একটুও।

যে আগলের কথা পচাদা বলেছিলেন, পাঁচু প্রায়ই বলত, সেই আগল তো চোখে দেখার নয়, হাতেও ছোঁওয়ার নয়।

টাইটা বাঁধা হয়ে গেলে, ওয়াড্রোব থেকে জ্যাকেটটা বের করে পরলেন। তার পর প্লাস্টিক জ্যাকেটের মধ্যে ভরা ব্রিফটা তুলে নিয়ে ঘরের দরজাটা খুলতেই হঠাৎ কোনো নিরুদ্দেশ থেকে আবার রবি ঠাকুরেরই একটি গানের কলি, যাঁর গানের সঙ্গে অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির বাঁচা-মরা সব জড়িয়ে-মড়িয়ে গেছে অদৃশ্য ভাইরাসেরই মতন, ফিরে এল:

আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি
অলস যেন না রয় ডানা দুটি
ওরে পাখি ঘন বনের তলে
বাসা তোরে ভুলিয়ে রাখে ছলে
রাত্রি তোরে মিথ্যে করে বলে
শিথিল কভু হবে না তার মুঠি
….আকাশে তোর তেমনি আছে ছুটি।

‘তাজমহল’ হোটেলের তিনতলায় ঝকঝকে বারান্দা দিয়ে লিফটের দিকে খুব আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে যেতে সেনসাহেব অস্ফুটে বললেন, পাঁচু, পারিনি রে। পারলাম না। সেনসাহেবের জল-ভরা চোখ দুকটি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ হোটেলের সর্বত্র হন্তদন্ত হয়ে টাকা, ক্ষমতা, প্রতিযোগিতা আর প্রতিপত্তির ফেরে দিন-রাত ছুটে বেড়ানো মানুষদের একজনেরও চোখে পড়ল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *