আকাশ যখন ছবির মতো নীল
রামকুমারবাবুর গলায় একটি গান শুনেছিলুম এমনি একসময়ে, যখন আকাশ ছবির মতো নীল। ভোরের দিকে একটু শীত-শীত ভাব, পাখির পালক ভিজে-ভিজে, গাছের পাতায় বর্ষার অঙ্গরাগের চিহ্ন, প্রথম সূর্যের আলো কাঁচা হলুদের মতো। মনে হয়েছিল কে সেই ভক্তকবি, যিনি প্রকৃতিকে এমন চোখে দেখতে পেরেছেন। তিনি নিশিকান্ত চক্রবর্তী। গানটি হল,
‘তব চরণ ধোয়াবে শারদ-শিশির, শেফালি অর্ঘ্য দেবে।
ধরণি শ্যামল আসন বিছাবে, তুমি মা আসিবে যবে।।
রক্ত উষাতে সিন্দুরের টিপ পরাবে মা তোর ভালে।
চাঁদিমা আরতি দিয়ে যাবে মাগো সুনীল গগন-তলে।।
কত শতশত কমলকুমারী তোমারে পূজিতে চাহে।
দিকে দিকে তব আগমন-গীতি দোয়েল শ্যামা গাহে।।’
যখনই শুনি, আমার গ্রামের কথা আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। অনুভব করতে পারি, জীবন থেকে কতটা দূরে চলে এসেছি, স্বাভাবিক থেকে কতটা কৃত্রিম হয়ে গেছি! মরার আগেই কেমন মরে গেছি। তিন পুকুরের মাঝখানে ছিল মাঠ। একটা ইটফেলা রাস্তা। রাস্তার বিপরীতে বিশাল এক বাগান। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারত মর্মর-ধবল জমিদার বাড়ি। বিশাল দেউড়িতে লাঠিধারী দারোয়ান। মাথায় তার বিশাল পাগড়ি। দেউড়ি থেকে লাল সুরকিদানা পথ সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে গাড়িবারান্দায়। ডান দিকে আস্তাবল, সেখানে তাগড়াই দুটো ঘোড়া। সামনের খোলা জায়গায় একটা ব্রুআম গাড়ি।
ভরা বর্ষায় ওই তিন পুকুর ভেসে গিয়ে মাঠ-ময়দান-পথ সব একাকার হয়ে যেত। শৈশবের সে আর এক উত্তেজনা। এত অকৃপণ জল, এমন প্রাচুর্যে প্রাণ আনচান। ঘরেই থাকা দায়। যত বালক আর বালিকার দল সেই হাঁটু জলে মাছের সঙ্গে খলবল। গাছ, বেড়া, সব ডুবে গেছে। জলের তরঙ্গে পাতা নাচছে। গামছা-জালে মাছ ধরার চেষ্টা। ধরার আনন্দে ধরা, খাওয়ার আনন্দে নয়। মাছ আর পাখি ধরার আনন্দ দেবে বলেই পালিয়ে বেড়ায়। ওরে সাপ আছে রে! বড়দের সাবধান-বাণী। কে কান দিচ্ছে। মাথার ওপর আকাশ থেকে থেকে ভারী হয়ে আসছে। আলো কমছে। সকালেই সন্ধের ছায়া। দমকা বাতাস। ঝাঁঝরির মতো বৃষ্টি। আমরা চিৎকার করছি, মিহিদানা, মিহিদানা। চতুর্দিকে কলরব, ওরে বাড়ি আয়, বাড়ি আয়, জ্বরজারি হবে। পুজোর মুখে বিছানায়। ভিজে মাটির দাওয়ায় উঠতে উঠতে দেখতে পেতুম, কয়লার উননের ধোঁয়া কত নীচে দিয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টির পরদা ঠেলে উঠতে পারছে না। কুমু পিসি একপাশে জড়সড় হয়ে বসে দুহাতে-ধরা চায়ের গেলাসে চুমুক দিচ্ছে। আলুর পুতুলের মতো চিড় খাওয়া মুখ ছুঁয়ে নরম ধোঁয়া মৃদু সুখের মতো বইছে। আমাদের হাঁটু পর্যন্ত ভিজে, পায়ে ঘাসের কুঁচি, সবুজ ঝাঁঝি একটুকরো, দু-টুকরো। পেছনের জানলা অল্প ফাঁক করে আমরা দেখতুম, তিনপুকুর, মাঠ , পথ বিশাল এক সমুদ্র। অবিরাম বৃষ্টিধারায় সেতারের ঝালা। কদমের ডালে জড়োসড়ো ভিজে কাক। মাছরাঙার শীর্ণ চিৎকার।
একদিন, যেদিন শেষরাতে মা একটা সাদা চাদর গায়ে টেনে দিতে বলতেন, ঠিক করে শো। আধো ঘুম, আধো জাগরণ, মাথার দিকের জানলায় দুরপাহাড় রঙের আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে মনে হত, এসে গেছে। শরতের ‘শিশির আঁচল’ উড়িয়ে মা আসছেন, শেফালির পথ ধরে। তিনপুকুর তার সমস্ত বাড়তি জল টেনে নিয়ে টলটলে। আকাশ নেমেছে স্নানে। কাচের মতো নীল আকাশ। শালুক খুশিতে দুলছে। পাতার ওপর নাচচে জল-মাকড়শা। যত হাঁস ছিল সব বেরিয়ে এসেছে। প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন বাজাচ্ছে। মাছরাঙা অবাক হয়ে দেখছে। মাঠটা ভরে উঠেছে নতুন সবুজ ঘাসে। ঘোষেদের গরু ইতস্তত করছে। ভাবছে, এ ঘাস খাওয়ার নয়, দেখার।
আমি আর আমার বোন, আমরা দুজনে সেই নরম ভোরে ছুটতে ছুটতে সেই মাঠটায় চলে যেতুম। ঘাস কি ভিজে! পায়ের তলা ভিজে উঠত শিশিরের জলে। সারারাত আকাশ যেন নক্ষত্রের চোখে মা-মা করে কেঁদেছে। সবুজ ঘাসের ওপর আমার বোনের ফরসা-ফরসা দুটো পা। কেবলই মনে হত, মা সরস্বতী হাঁটছেন। জমিদার বাড়ির বাগানে শিউলিগাছ ভরে আছে। সরবতের মতো বাতাসে শিউলির গন্ধ। মানকচু পাতায় শিশিরের নোলক টলটল করছে। অবিশ্রান্ত শান্তির ছবি। শরতে দোয়েল খুব মেতে ওঠে। এটা যেন তাদেরই কাল।
রোদের রং পাকতে না পাকতেই ঘাস শুকিয়ে যেত। এখানে ওখানে নাকছাবি ফুল। সকালের সঙ্গেই প্রজাপতি জন্মায়। বেওয়ারিশ উড়ে বেড়ানোই তাদের কাজ। পুকুরের ধারেই পটুয়াপাড়া। এক সার চালাবাড়ি। চারপাশ খোলা একটা আটচালা। সেই আটচালাতেই মা আসছেন একটু একটু করে। আমরা অবাক হয়ে দেখতুম কুমুদদার কেরামতি। স্যাঁতসেঁতে মাটির দাওয়া। মাথার ওপর গোলপাতার ছাউনি। পাশে পাশে ঘাস আর আগাছা। একটা দিক নয়নতারা-ফুলে ভরে আছে। প্রথমে তৈরি হল বাখারির কাঠামো। যেন কিছুই নয়। আমাদের মাথাতেই আসত না, এই সামান্য জিনিসটা কেমন করে মা দুর্গা হয়ে উঠবেন। কোমরে গামছা জড়িয়ে কুমুদদা বিড়ি টানছেন। একপাশে ডাঁই হয়ে আছে এঁটেল মাটি আর খড়। কুমুদদার ছেলে আর মেয়েরা বেতের ধামি থেকে খুঁটে খুঁটে মুড়িমুড়কি খাচ্ছে। কুমুদদার বউ তোলা উনুনে পাখার বাতাস করছে। ছোট্ট ছাউনির তলায় ছ’টা লক্ষ্মীহাঁস পালক নিয়ে ব্যস্ত। বেড়ার পাশে ব্যাঙের বাচ্চা অকারণে হাইজ্যাম্প প্র্যাকটিশ করছে।
দিন যায়। আকাশ আরও নীল হয়। পুকুরের জল ছুঁয়ে উত্তুরে হাওয়ার ঝলক ভেসে আসে। আমরা বুঝতে পারি, হিমালয়ের দরজা খুলে গেছে। মায়ের পেছন-পেছন শীত আসবে পশমের ওড়নাগায়ে। কাল যা ছিল বাখারির কাঠামো আজ তার ওপর খড় চেপে গেছে। বিশ্বাসই হয় না, এই হাস্যকর আকৃতিতে মা আসবেন! আমরা জানতুম, আসতে তাকে হবেই। আকাশ এত নীল, জল এমন শান্ত, রোদ এমন কাঁচা হলুদ, ছায়া এমন শীতল, মায়ের না এসে উপায় কি! নাওয়া খাওয়া ভুলে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতুম। একমেটে, দোমেটে, দশটা হাত। দেখতে দেখতে সবই হয়ে গেল। সিংহ এসে দাঁড়িয়ে গেল পায়ের তলায়। মহিষাসুর বুক চিতিয়ে। এইবার একদিন কুমুদদা চোখ আঁকবেন। শরতের নীল আকাশের মতো বিশাল চোখ। শিউলির মতো গায়ের রং।
জমিদার বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসতেন স্বপ্নের মতো। সবাই বলতে মেজোবাবু। শৌখিন ফিনফিনে মানুষ। চোখে সোনার চশমা, ঠোঁটে সিগারেট। খুব হাসিখুশি অমায়িক ছিলেন তিনি। কুমুদদার আটচালায় এসে মূর্তি গড়া দেখতেন। দেশ-বিদেশের গল্প বলতেন। কুমুদদা মূর্তিতে রং চাপাতে চাপাতে বলতেন, এবার পুজোয় যাচ্ছেন কোথায়, মেজোবাবু। মেজোবাবু অমনি উত্তর ভারতের গল্প শুরু করতেন। কুমায়ুনের জঙ্গল, দেরাদুনের সহস্রধারা, মাউন্ট এভারেস্ট। আমরা কাছে কাছে সরে আসতুম। সেকালে রাজারা এইসময় মৃগয়ায় যেতেন। সুরথ রাজার কথা মনে হত। নামটা আমাদের খুব পছন্দের ছিল। মাঠটার উত্তরদিকে একটা জংলা মতো জায়গা ছিল। আমাদের মনে হত, হঠাৎ দুপুরে ওইখান থেকে শ্রীরামচন্দ্র বেরিয়ে আসবেন। এসে উঠবেন কুমুদদার দাওয়ায়। এটা তো বিশ্বামিত্রের আশ্রম।
দুপুরে বেলা বারোটার পরই রাস্তায় ছায়া নেমে আসত। শরতের দিন ছোট হয়ে আসে। সেই আধো-ছায়া পথে যত ফেরিওয়ালা, পুজোর আকর্ষণ নিয়ে। কেউ হাঁকছে বোম্বাই চাদর, কেউ শায়া, সেমিজ, ব্লাউজ। ঠ্যাংঠ্যাং বাজনা বাজাতে বাজাতে চলেছে কাঁসার বাসনওয়ালা। লম্বা লাঠিতে চুলবাঁধার ফিতে আর রিবন দুলিয়ে চলেছে একজন, পাতাপাতা সেফটিপিন, চুলের কাঁটা। হাতে গজকাঠি নিয়ে ছিট কাপড়ওয়ালা। এই তো সেই রাজার দল। মৃগয়ায় চলেছেন।
সে এক অভিজ্ঞতা। কিশোর এসে বললে, একটা জায়গায় যাবি? দেখবি সে এক ব্যাপার। কোথায় সেই জায়গা? রেললাইনের ধারে। ভয়ঙ্কর উৎকন্ঠা! কী এমন জিনিস! কিশোর পাক্কা দু-মাইল হাঁটল। আশ্বিনের রোদ যেন অসুর। বল্লমের খোঁচা মারছে।
উঁচু বাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেছে জোড়া জোড়া রেললাইন। টেলিগ্রাফের তারে ঝিনঝিন শব্দ। খসখসে সিগন্যাল। সেই বাঁধের ধারে বিশাল এক জলসা। মানুষের নয়। ফুলের। কাশফুল। যে ফুলের ছবিই শুধু দেখেছি, সত্যকারের সেই ফুল। সাদা পোশাক পরে একদল সুন্দরী যেন নাচছে। বাতাসে তাদের মাথাদোলানোর ফিসফিস শব্দ। আমাদের চোখে সম্ভ্রম বিস্ময়। আমরা সেই জলসায় হারিয়ে গেলুম। এক-একটা ফুল আমাদের চেয়েও বড়। আমাদের মাথা ছাড়িয়ে আরও ওপরে উঠে গেছে। বড় মানুষের মতো বড় ফুল। সেই কাশের জলসায় বসে আমরা অনেকক্ষণ গান শুনলুম, নাচ দেখলুম। দূরে কোথাও ঢাক বাজছে। উত্তরের বাতাসে সেই শব্দ ভেসে এল। জোড়ালাইনের ওপর দিয়ে চলে গেল দুরপাল্লার ট্রেন। পেট ঠ্যাসা পুজোর ছুটির মানুষ। কেউ যাচ্ছে দেশে, কেউ যাচ্ছে পাহাড়ে বেড়াতে। সেই সময় আমাদের মনে হয়েছিল, কাশ হল মায়ের ছেলে, লড়ুয়ে কার্তিক।
দিন তো এমনি করেই চলে গেল। সময় এক একমুখী রেলগাড়ি। লাইনের শেষে কোন স্টেশন, কে স্টেশন মাস্টার, কী পান্থশালা, কেউ জানে না। এতদিন পরে এইটুকু বুঝেছি, আগমনীর অর্থ হিমগিরি থেকে শুধু দেবীদুর্গার আগমন নয়, আমাদের বালক বয়সের আগমন। যা নেই তার স্মৃতি যখন শিশিরে, শেফালিতে ঝরে, দূরাগত ঢাকের বাদ্যের সমারোহে তখনই মনে তৈরি হয় শামিয়ানা, ‘ওগো এত ফুল আছে বনে, এত গান আছে মনে/ এত সৌরভ আছে গো বন-কুসুমের বাসে/জননী আমার আসে।।’