৯
যেমন কুকুর-বেড়ালের গলায় দড়ি বেঁধে রাখে সেইরকমই বাচ্চা ছেলেটাকে কোমরে দড়ি বেঁধে দড়ির একপ্রান্ত আবার বাঁধা আছে জানালার শিকে! বাচ্চাটা রকের ওপর বসে খেলছে।
বেশ ভালো ব্যবস্থা। আমাদের গলির মোড়ের বড় বাড়িটার রকে আমি বাচ্চাটাকে মাঝে-মাঝে দেখতে পাই। একটা ঠিকে ঝি চার-পাঁচ বাড়িতে কাজ করে, সে বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে ফেরে। ব্যবস্থাটা সত্যিই ভালো বলতে হবে। ঐ ঝিয়ের পক্ষে হয়তো বাচ্চাটাকে বাড়িতে রেখে আসার অসুবিধে আছে—ঐটুকু বাচ্চাকে একা বাড়িতে ফেলে আসা যায়না। বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে কাজ করাও যায়না। বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময়ে একটা বাচ্চা সঙ্গে থাকলে চলবে কেন? তাতে বাড়ির মালিকর! বিরক্ত হবে—তাছাড়া ঝিয়ের বাচ্চা যদি বাড়িময় ঘোরে কিংবা ট্যা-ট্যা করে চ্যাচায়—সেটা বাড়ির মালিকদের পছন্দ না-হওয়া খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং বাচ্চাটাকে বাড়ির বাইরে বসিয়ে রেখে যায়। আর বাচ্চা যাতে রক থেকে গড়িয়ে না-পড়ে কিংবা গাড়ি ঘোড়ার রাস্তায় গিয়ে না-পড়ে, সেইজন্য বেঁধে রাখা। ক্যাঙারুর পেটের থলিতেই বাচ্চা রাখার ব্যবস্থা আছে, মানুষের তো তা নেই—সুতরাং কী আর করা যাবে। প্রত্যেকদিন সকালে ঝি কাজ করতে এসে বাচ্চাটাকে রকের ওপর বসায়, শক্ত নারকোল দড়ি দিয়ে ওর পেটের সঙ্গে বেঁধে জানালার শিকে আবার বেঁধে দেয়। তারপর বাচ্চাটাকে বলে চুপটি করে বসে থাকবি নড়বিনি বলচি! —বাচ্চাটার অভ্যেস হয়ে গেছে—সে জুলজুলে চোখে পথের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে—মুখ দিয়ে অবিশ্রান্ত লালা গড়ায়। কখনো তার মা খানিকটা মুড়ি ছড়িয়ে দিয়ে যায় বাচ্চাটা খুঁটে-খুঁটে খায়। খুবই যুক্তিসঙ্গত, নিরাপদ ব্যবস্থা বলা যায়।
কিন্তু মানুষের মন তো বড়ই উদ্ভট। সেই জন্যই মাঝে-মাঝে ঐ বাচ্চাটাকে দেখে আমার কষ্ট হয়। গরু-ছাগল-কুকুরের মতন মানুষকেও দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখা—আমি ঠিক সহ্য করতে পারিনা—অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, আহারে! পরক্ষণেই নিজের ওপর আমার রাগ হয়। মনে হয়, আমি দয়ামায়ার ফ্যাশান দেখাচ্ছি! আজকাল দয়ামায়া জিনিসগুলোও বুঝেসুঝে খরচ করা উচিত—তা নিয়ে বিলাসিতা করা মোটেই চলে না। জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের তুলনা করে হাহুতাশ করাও আমার পক্ষে ন্যাকামি। পৃথিবীতে কত জায়গায় কত মানুষ যে গরু-শুয়োরের খোঁয়াড়ের চেয়েও খারাপ ঘরে থাকে, খারাপ খায়—তা কী আমি জানিনা? কে না জানে? তবে হঠাৎ আমার দরদ উথলে ওঠার কারণটা কী? গোটা পৃথিবীটা সম্পর্কে চিন্তা করার ভার তো আমার ওপরে কেউ দেয়নি! এখন পৃথিবীতে মানুষ গিসগিস করছে-এর মধ্যে আমি কী করে কোনক্রমে একটু ভালো থাকব—সেটাই আমার চিন্তা করা উচিত। আর কোন ভাবালুতার কোন মানে হয়না।
ঠিক। সেকথাই আমি নিজেকে বোঝাই। অতীন আর সুমিত্রাকেও আমি সেই কথা বলি। অতীন আর সুমিত্রা এক অফিসেই চাকরি করে—খেয়ে-দেয়ে দুজনেই পান চিবুতে-চিবুতে এসে মোড় থেকে বাসে ওঠে। ওদের একটি দুবছরের বাচ্চা আছে—বাড়িতে আয়ার কাছে তাকে রেখে যায়। নিজের বাচ্চা আছে বলেই বোধহয় সুমিত্রা হঠাৎ খবু স্নেহপরায়ণ হয়ে যায়। রকটার দিকে তাকিয়ে বলে আহারে, বাচ্চাটাকে কীভাবে বেঁধে রেখেছে। ওর মার একটু দয়ামায়াও নেই!
আমি পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। ক’দিন আগে আমারও এরকম মনে হয়েছিল। আজ সুমিত্রার মুখে একথা শুনে আমি রেগে উঠি। হয়তো একটা মেয়ের চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তা মিলে গেছে—এটাও একটা রাগের কারণ। আমি ঝাঁঝালোভাবে বলি তাতে কী হয়েছে? বেঁধে না-রাখলে তো গড়িয়ে পড়ে যেত।
আমার কথার ঝাঁঝে সুমিত্রা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। তারপর মুচকি হেসে বলে, খুব স্মার্ট আপনি? না। সত্যি!
অতীন আমার দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়। তারপর দেশোদ্ধারকারীর মতন কৃত্রিম মুখ করে বলে, আসল ব্যাপারটা কী জানিস। এই যে ছেলেটাকে এখন বেঁধে রাখছে—এর ফলে ভবিষ্যতে কী হবে? ও যখন বড় হবে—তখনো ওর বন্ধন কাটবে না। স্বাধীনভাবে কোন কাজে ও হাত দিতে পারবেনা, কোন নতুন জায়গায় যেতে সাহস পাবেনা—সব সময় মনে করবে ওর গলায় দড়ি বাঁধা। অবশ্য এই একটা-আধটা কেসের কথা ভেবে লাভ নেই—একটা বিপ্লর না এলে—
আমি বললুম, ওসব ছেঁদো কথা রেখে দে। তোর কাছে বিপ্লব মানে তো অফিসে গিয়ে কাজ না-করে স্ট্রাইক বাধানো। এদিকে সকালবেলা টোস্টে মাখন কম হলে তো রোজ সুমিত্রাকে বকুনি দিয়ে
সুমিত্রা আবার মুচকি হেসে বলে, যা বলেছেন!
অতীন আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, কী ব্যাপার, আজ যে তুই সকাল থেকেই খাপচুরিয়াস?
আমি বললুম, বন্ধনের কথা বলছিস? ঐ ছেলেটার মধ্যে যদি সেরকম মালমশলা থাকে ও ঠিকই বন্ধন ছিঁড়তে পারবে। গোটা জাতটার কারুরই তো বন্ধন ছেঁড়ার আগ্রহ নেই দেখতে পাচ্ছি।
—দুশো বছরের পরাধীনতার জের চলছে। যাই বল এটুকু ছেলেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা আমি আগে কখনো দেখিনি।
—বরাবরই আমাদের দেশে এ জিনিশ চলছে। শ্রীকৃষ্ণকেও তো যশোদা গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত। কৃষ্ণ অবশ্য বন্ধন ছিঁড়েছিল। যমলার্জুনের কাহিনী পড়িসনি?
অতীন কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল। যার মানে হয়, যে-লোক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে সে-কেন রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ পড়ে সময় নষ্ট করতে যাবে! সুমিত্রা বলল, ঐ যে বাস এসেছে!
মনকে এসব বোঝানো সত্ত্বেও আমার ভুল হয়ে যায়। এর কয়েকদিন পর আবার দেখলাম রকের ওপর সেই বাচ্চা ছেলেটাকে—বমি করে তার ওপরেই ঘুমিয়ে আছে। দেখে আমি নড়তে পারলামনা। কী করুণ সেই ঘুমন্ত ভঙ্গি, বিদেশি ফটোগ্রাফাররা এ দৃশ্য পেলে লুফে নিত। ঝিটা সেইসময়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, নির্লিপ্তভাবে দড়ির গিট খুলতে লাগল। আমি তাকে না-বলে পারলামনা, তুমি কী গো! ছেলেটাকে এরকম একা-একা বেঁধে রেখে চলে যাও!
ঝিটা আমার দিকে একবার অবজ্ঞার চোখে তাকাল শুধু। কোন কথা বললনা। ছেলেটা ঘুম ভেঙে চোখ মেলল। অসুস্থ লাল চোখ দেখে আমি বললুম, ইস। ছেলেটা এবার আমাকে দেখল।
হঠাৎ তার সেই অসুস্থ লালচে চোখ আর তার মায়ের নির্লিপ্তভঙ্গি দেখে আমার অসম্ভব ভয় করল। আমি সেখান থেকে সরে গেলাম। কিন্তু ভয় তক্ষুনি কাটলনা। সেই ভয় থেকেই দুঃস্বপ্নের জন্ম।
সে রাত্রে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে আমি ঘামে ভিজে চিৎকার করে জেগে উঠলাম। স্বপ্ন দেখলাম, চারদিকে খুব গোলমাল হচ্ছে। হঠাৎ যেন অরাজকতা শুরু হয়ে গেছে। হু-হু করছে বাতাস, দূরে মাঝে-মাঝে আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে। আমি পথ খুঁজে পাচ্ছিনা—ছুটোছুটি করছি এইসময় একটা বিশাল চেহারার মানুষ একটা লম্বা ছুরি নিয়ে আমার সামনে লাফিয়ে পড়ল। লোকটা ছুরি উঁচিয়ে বলল এই যে, তোমাকেই খুঁজছিলাম! আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম, আমাকে?
—হ্যাঁ, তোমাকেই।
লোকটার সবল পেশীবহুল শরীর। কালো কুচকুচে দেহ। প্রায় উলঙ্গ, শুধু একটা কাপড়ের টুকরো কোমরে বাঁধা। পেটের চারপাশে একটা গোল ঘা। লোকটার মুখ আমার একটু যেন চেনা মনে হচ্ছিল। চিনতে পারলাম, এ সেই ঝিয়ের ছেলেটা—এতবড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু পেটের কাছে সেই নারকোল দড়ি বাঁধার ঘা-টা রয়ে গেছে।
আমি কাতরভাবে বললুম, আমাকে মারবে কেন? আমি কী দোষ করেছি? লোকটা কর্কশ হুংকারে বলল, তুমি আমাকে একদিন দয়া দেখাতে এসেছিলে! যে-যে আমাকে দয়া দেখিয়েছিল আমি তাদেরই আগে খুন করব।
একথা বলেই সে ছুরিটা আমার বুক লক্ষ করে তুলে ধরল।